৩.৩ স্কাউটশিপের নিচের ঘরটিতে ইরন

স্কাউটশিপের নিচের ঘরটিতে ইরন, ত্রাস এবং শুমান্তি মহাকাশযান থেকে নিয়ে আসা দ্বিতীয় মাত্রার স্পেসস্যুটগুলো পরে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইরের ভয়ঙ্কর বিষাক্ত হাওয়ায় এই স্পেসস্যুট দিয়ে যথার্থ নিরাপত্তা পেতে হলে তার বিভিন্ন স্তরকে সক্রিয় করতে হবে, কাজটি জটিল এবং শ্রমসাপেক্ষ। মহাকাশযানে এই ধরনের কাজে সাহায্য করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে, স্কাউটশিপে পুরোটুকুই নিজেদের করতে হয়।

অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সঠিক মিশ্রণ পরীক্ষা করে ক্ষুদ্র প্যালেটগুলো সিলিন্ডারে রেখে বাইরে নিশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থাটুকু নিশ্চিত করতে করতে ত্রানুস ইরনের কাছে এগিয়ে যায়।

ইরন।

বল।

আমি তোমার চতুর্মাত্রিক প্রাণীর ব্যাপারটি বুঝতে পারি নি। আমরা যেখানে বড় হয়েছি সেখানে বিজ্ঞান শেখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

এর মাঝে বিজ্ঞান খুব বেশি নেই। সত্যি কথা বলতে কী বিজ্ঞান বেশি শিখে নিলে মস্তিষ্ক খানিকটা রুটিনের মাঝে চলে আসে, তখন প্রচলিত নিয়মের বাইরে কিছু দেখলে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

ত্রালুস মাথা নেড়ে বলল, শুমান্তিকে যার ক্রোমোজম৩ দিয়ে ক্লোন করা হয়েছে সে নিশ্চয়ই বড় বিজ্ঞানী ছিল, বিজ্ঞানের ব্যাপারগুলো তাই সহজে বুঝে ফেলে। আমি পারি না।

শুমান্তি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ইরন বাধা দিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ। আমিও লক্ষ করেছি।

ব্যাপারটা আমাকে বোঝাতে পারবে?

চেষ্টা করতে পারি। ইরন খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে কিছু একটা চিন্তা করে বলল, প্রাচীনকালে তথ্য আদান–প্রদান করার জন্য এক ধরনের জিনিস ব্যবহার করা হত, তার নাম ছিল বই। কাগজ নামের পাতলা এক ধরনের পরদার মতো জিনিসে লিখে অনেকগুলো একসাথে বেঁধে রাখা হত। তুমি কি সেগুলো কখনো দেখেছ?

না। সামনাসামনি দেখি নি। হলোগ্রাফিক ছবি দেখেছি।

চমৎকার। মনে করা যাক এই বইয়ের একেকটি পৃষ্ঠা হচ্ছে একেকটি ত্রিমাত্রিক জগৎ। মনে করা যাক আমাদের ত্রিমাত্রিক জগৎ হচ্ছে এক শ এগার নম্বর পৃষ্ঠা। আমরা, মানুষেরা শুধুমাত্র এই পৃষ্ঠায় বিচরণ করতে পারি, এর বাইরে যেতে পারি না। মনে কর আমরা ছোট পিপড়ার মতো এই বইয়ের পৃষ্ঠায় ঘুরে বেড়াই। এক শ এগার নম্বর পৃষ্ঠা থেকে এক শ বারো নম্বর পৃষ্ঠায় যেতে হলে পুরো পৃষ্ঠা পার হয়ে বইয়ের শেষ মাথায় এসে ঘুরে এই নতুন পৃষ্ঠায় যেতে হবে–বলতে পার বিশাল দূরত্ব পার হতে হবে।

আমরা এই মহাকাশযানে করে এ রকম একটা বিশাল দূরত্বে চলে এসেছি তবে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে আসি নি, ওয়ার্মহোল তৈরি করে এসেছি। ওয়ার্মহোল হচ্ছে পৃষ্ঠা ফুটো করে চলে আসার মতো–বইয়ের পৃষ্ঠায় একটা ছোট ফুটো করলেই এক পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায় চলে যাওয়া যায়, এটাও সেরকম।

এখন মনে করা যাক এই বইয়ের মাঝে অন্য এক ধরনের কীট এসেছে। সে বইয়ের পৃষ্ঠা কেটে কেটে যেতে পারে। আমাদের কাছে এই পোকাকে মনে হবে চতুর্মাত্রিক প্রাণী। কারণ এরা সহজেই বইয়ের ভিতর দিয়ে একটার পর অন্য একটা জগতের মাঝে চলে যেতে পারে। এরা যখন আমাদের জগতের ভিতর দিয়ে অর্থাৎ আমাদের পৃষ্ঠার ভিতর দিয়ে যাবে আমরা তখন তাদের দেখব কিন্তু শুধু আমাদের পৃষ্ঠার অংশটুকুই। তার প্রকৃত রূপ আমরা কখনো দেখব না, কখনো জানব না।

ইরন একটু থেমে বলল, বুঝতে পেরেছ?

হ্যাঁ, খানিকটা বুঝতে পেরেছি। পুরোটুকু না বুঝলেও ধারণাটুকু পেয়েছি।

শুমান্তি স্পেসসটটার ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলল, চতুর্মাত্রিক প্রাণী যেহেতু আছে, তার অর্থ চতুর্মাত্রিক জগৎও নিশ্চয়ই আছে। আমরা মানুষেরা সেখানে যেতে পারি না।

না, পারি না। এর অস্তিত্বের কথা জানার পরই নিশ্চয়ই প্রজেক্ট আপসিলন দাঁড়া করানো হয়েছে। পৃথিবীর একজন মানুষকে পাঠানো হয়েছে চতুর্মাত্রিক প্রাণীর কাছে। উপহার হিসেবে। বিনিময়ে এই প্রাণী আমাদের কাছে চতুর্মাত্রিক জগতে যাওয়ার প্রযুক্তি দেবে।

 তোমার তাই ধারণা?

ইরন একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, হ্যাঁ। আমার তাই ধারণা।

দ্বিতীয় মাত্রার স্পেসস্যুট পরা যতটুকু কঠিন মনে হয়েছিল দেখা গেল সেটি তার থেকে অনেক বেশি কঠিন। ইরন, শুমান্তি এবং ত্ৰালুস একজন আরেকজনকে সাহায্য করার পরও স্পেসস্যুটগুলো পরতে তাদের দীর্ঘ সময় লেগে গেল। জীবনরক্ষাকারী মডিউলটি পরীক্ষা করে লুস বলল, এটি ছয় ঘণ্টার মডিউল।

যার অর্থ ছয় ঘণ্টার মাঝে আমাদের এই স্কাউটশিপে ফিরে আসতে হবে?

জীবন্ত অবস্থায় স্কাউটশিপে ফিরে আসার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই, কিন্তু ইরন সেটি কাউকে মনে করিয়ে দিল না, বলল, হ্যাঁ ছয় ঘণ্টার মাঝে আমাদের ফিরে আসতে হবে।

ত্ৰালুস ভন্ট খুলে ভয়ঙ্কর ধরনের কয়েকটি অস্ত্র বের করে ইরন এবং শুমান্তির দিকে এগিয়ে দেয়। শুমান্তি মাথা নেড়ে বলল, আমি অস্ত্র চালাতে জানি না।

এর মাঝে জানার কোনো ব্যাপার নেই। যে জিনিসটাকে আঘাত করতে চাও সেটার দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরবে।

শুমান্তি তবুও অস্ত্রটি নিতে চাইল না, বলল, না, আমি এটা স্পর্শ করতে চাই না।

ইরন একটু হেসে বলল, না চাইলেও তোমাকে নিতে হবে। আমরা ঠিক জানি না আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। হয়তো অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে না। কিন্তু হয়তো অস্ত্র দেখাতে হবে।

শুমান্তি নেহায়েত অনিচ্ছার সাথে ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্রটি হাতে তুলে নেয়। সেফটি সুইচটি টেনে নিয়ে সে অস্ত্রটি পিঠে ঝুলিয়ে নিল। ত্ৰালুস ভল্ট থেকে চতুষ্কোণ একটা ভারী বাক্স টেনে বের করে এনে বলল, ইরন, তুমি যেহেতু বলছ অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখানোর প্রয়োজন হতে পারে তা হলে কি এই এন্টি ম্যাটারের বাক্সটা সাথে নিয়ে নেব?

এন্টি ম্যাটার? সেটা দিয়ে কী করবে?

এটা চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে আটকে রাখা আছে। গুলি করে বাক্সটা ভেঙে দিলে গ্রহের অর্ধেকটা উড়ে যাবে।

ইরন কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, হ্যাঁ, তা হলে নিয়ে যাওয়া যাক। কিন্তু এত ভারী এটা টেনে নিতে পারবে?

টেনে নিতে হবে না, ছোট একটা জেট প্যাক আছে।

.

বালুস জেট প্যাকের উপর এন্টি ম্যাটারের বাক্সটা রেখে জেট প্যাকের ইঞ্জিনটা চাল করে দিতেই সেটা মিটারখানেক উপরে উঠে আসতে শুরু করে। ত্ৰালুস স্কাউটশিপ থেকে আরো কিছু যন্ত্রপাতি তুলে নিয়ে বলল, আমি প্রস্তুত।

চমৎকার। ইরন এগিয়ে গিয়ে স্কাউটশিপের দরজার সামনে দাঁড়াল। লাল রঙের একটা লিভার টেনে দিতেই ঘড়ঘড় শব্দ করে চারপাশের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে তাদেরকে পুরো স্কাউটশিপ থেকে আলাদা করে ফেলল। দরজার কাছে একটা কমলা রঙের উজ্জ্বল আলো জ্বলছে এবং নিভছে, তার নিচে একটা বড় চতুষ্কোণ সুইচ। সেটা চাপ দিয়ে দরজাটি খোলার আগে ইরন ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে ঘুরে তাকাল, একমুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা আমাদের কী হবে জানি না। যদি আমরা বেঁচে ফিরে না আসি, তা হলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদের জীবনকে উপভোগ করার সুযোগ করে দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত।

শুমান্তি নরম গলায় বলল, তোমার ক্ষমা চাওয়ার বা দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেখে নিশি মেয়েটি কত খুশি হবে চিন্তা করে দেখ। সেই আনন্দটুকুর জন্য। জীবন দেওয়াটা এমন কিছু খারাপ নয়।

ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি কথা বলতে কী, তোমাদের ওপর আমার একটু হিংসাই হচ্ছে। জীবনকে এভাবে দেখতে পারাটা মনে হয় খারাপ নয়।

ত্রালুস হেসে বলল, তুলনা করার জন্য আমরা অন্য কোনো জীবন পাই নি তাই বলতে পারছি না কোনটা ভালো কোনটা খারাপ।

চল তা হলে, রওনা দেওয়া যাক।

ইরন চতুষ্কোণ সুইচটা চেপে ধরতেই প্রথমে স্কাউটশিপের বাতাস বের হয়ে বাইরের সাথে বাতাসের চাপ সমান হয়ে গেল। তারপর গোলাকার একটা দরজা ধীরে ধীরে উপরে। উঠে গেল। বাইরে সবুজাভ এক ধরনের আবছা আলো, কখনো বাড়ছে কখনো কমছে। এক ধরনের ঝড়ো বাতাস বইছে এবং বাতাসের বেগ বাড়ার সাথে সাথে শিশুর কান্নার মতো তীক্ষ্ণ এক ধরনের ধ্বনি শোনা যেতে থাকে। স্কাউটশিপটি যেখানে নেমেছে সেই জায়গাটি মোটামুটি সমতল, কিন্তু সামনে যতদূর দেখা যায় উঁচুনিচু বিচিত্র আকারের পাথর। দেখে মনে হয় কেউ অনেক কষ্ট করে পাথরগুলো খোদাই করে এ রকম বিচিত্র রূপ দিয়েছে। বাইরের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের অনেক অংশ তরল পদার্থে ঢাকা, বেগুনি রঙের তরল কোথাও টগবগ করে ফুটছে, কোথাও বিষাক্ত বাষ্প বের হয়ে ধোঁয়ার মতো উপরে উঠে যাচ্ছে। বড় পাথরগুলো এবং সমতল স্থানগুলোর স্থানে স্থানে বড় বড় ফাটল এবং সেই ফাটল দিয়ে সবুজাভ এক ধরনের আলো বের হয়ে পুরো এলাকাটি এক ধরনের অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে।

ইরন খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, সর্বনাশ! কী মন–খারাপ–করা একটা জায়গা। দেখে মনে হয় এখানে অভ কিছু একটা আছে।

ত্রালুস সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নিচে নামতে নামতে বলল, ঠিকই বলেছ।

এ রকম জায়গায় যে প্রাণীরা থাকে তারা বুদ্ধি কি না জানি না, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই খুব বিষণ্ণ প্রকৃতির। শুমান্তি তরল গলায় বললু এখানে আনন্দ পাবার কিছু নেই।

সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে ত্ৰালুস সাবধানে মাটিতে পা রেখে বলল, মাটি শক্ত নয়, অনেকটা ভেজা বালির মতো।

ইরন বলল, সাবধানে যাও ত্রালুস।

হা, ত্ৰালুস খুব সাবধান।

ভাসমান জেট প্যাকের উপর এন্টি ম্যাটারের ভারী বাক্স এবং যন্ত্রপাতি রেখে এক হাত দিয়ে সেটাকে টেনে ত্রাপুস সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে, অন্য হাতে ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্রটি ধরে রাখে। ত্ৰালুসের পর শুমান্তি এবং সবার শেষে ইরন, দুজনেই অনভ্যস্ত হাতে একটি করে অস্ত্র ধরে রেখেছে।

সবুজাভ আবছা আলোতে তিন জন নিজেদের মাঝে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে থাকে। ঝড়ো হাওয়া কখনো সামনে থেকে কখনো পিছন থেকে আসছে। বাতাসে এক ধরনের সূক্ষ্ম বেগুনি রঙের ধুলো উড়ছে। স্পেসসটের চোখের সামনে ভিজরটি বারবার মুছেও পরিষ্কার রাখা যাচ্ছে না।

তিন জন বাতাসের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে শুনতে সামনে এগুতে থাকে। বড় বড় বিচিত্র পাথরের মাঝে জায়গা করে হাঁটতে হাঁটতে শুমান্তি জিজ্ঞেস করল, আমরা কোন দিকে। যাচ্ছি?

ত্রালুস ভাসমান জেট প্যাকে একটা মনিটর দেখে বলল, কীশার স্কাউটশিপ থেকে একটা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আসছে। সেটা লক্ষ্য করে যাচ্ছি।

কতদূর যেতে হবে?

খুব বেশি দূরে নয়। বড়জোর এক কিলোমিটার।

যদি সোজাসুজি যেতে পারি তা হলে এক কিলোমিটার। কিন্তু যেরকম পথ দিয়ে যাচ্ছি কোনো কি নিশ্চয়তা আছে?

নেই। সত্যি কথা বলতে কী, হঠাৎ যদি বেগুনি রঙের একটা বিষাক্ত হ্রদের সামনে এসে পড়ি তা হলে বিপদ হয়ে যাবে।

ইরন বলল, তখন এক জন এক জন করে এই জেটপ্যাকে করে হ্রদ পার হতে হবে।

হ্যাঁ ঠিকই বলেছ।

সৌভাগ্যক্রমে পথে হঠাৎ করে টগবগে বেগুনি রঙের তরলের কোনো হ্রদ ছিল না, নানা আকারের পাথরের মাঝে পথ করে ভেজা বালুর মতো মাটির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে তারা শেষ পর্যন্ত কীশার স্কাউটশিপের কাছাকাছি এসে পৌঁছল। কয়েক শত মিটার উঁচু কয়েকটা পাথরের পিছনে, ধূসর আকাশের খোলা আলোতে স্কাউটশিপটিকে একটি অতিকায় পশুর মতো দেখায়। ত্ৰালুস দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল চোখে লাগিয়ে কীশা এবং নিশিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। কিছুক্ষণ খুঁজেই তাদের পাওয়া গেল। স্কাউটশিপ থেকে দু শ মিটার দূরে কয়েকটা গোলাকার মসৃণ পাথরের সামনে অপেক্ষা করছে। নিশি হাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে। তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে কীশা। নির্জন একটি গ্রহে ঝড়ো বাতাসের কুদ্ধ গর্জনের মাঝে দুজনকে এভাবে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটিকে হঠাৎ করে একটি অপার্থিব অশরীরী দৃশ্য বলে মনে হয়।

ত্রালুস তার অস্ত্রটিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, এখন আমরা কী করব?

ইরন বহুদূরের কীশা এবং নিশির অবস্থানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমরা কথা বলার জন্য গোপন চ্যানেল ব্যবহার করছি, তাই কীশা সম্ভবত আমাদের কথা শুনতে পায় নি, এখনো জানে না আমরা তার এত কাছে চলে এসেছি।

ত্রালুস বলল, কিন্তু অনুমান করতে পারছে।

হ্যাঁ, সম্ভবত পারছে। আমার মনে হয় আমরা এখন তিনটি ভিন্ন জায়গা থেকে কীশার দিকে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে যাই।

ত্রালুস মাথা নাড়ল, বলল, সরাসরি তাকে বলতে হবে, এই মুহূর্তে নিশিকে চলে আসতে দিতে হবে। যদি না দেয় আমরা তাকে শেষ করে দেব। রোবটকে শেষ করায় কোনো অপরাধ নেই।

ইরন ত্রালুসের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, দেখ, আমি কীশাকে এখনো একটা রোবট বলে ভাবতে পারছি না।

কিন্তু

শুমান্তি ত্রালুসকে বাধা দিয়ে বলল, হ্যাঁ, ব্রালুস। আমিও পারছি না। আমরা অস্ত্র ব্যবহার করব না, শুধু ব্যবহার করার ভয় দেখাব।

সেটা করতে হলে তোমাকে সত্যিই বিশ্বাস করতে হবে যে তুমি অস্ত্র ব্যবহার করবে।

না–তার প্রয়োজন নেই

শুমান্তি এবং ত্রালুসের মাঝে একটা ছোট বিতর্ক শুরু হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ইরন হাত তুলে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন কী ঘটবে আমরা জানি না, কাজেই কী করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে আমরা সেটাও জানি না। তাই ঘুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। তিন দিক থেকে কীশাকে ঘিরে ফেলা যাক। ট্রিগারে হাত দেবার আগে খুব সাবধান, কীশা আর নিশি কিন্তু খুব কাছাকাছি।

ঠিক আছে।

ইরন আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বলে কয়েকটা জরুরি বিষয় ঠিক করে নেয়। তারপর একজন আরেকজনের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তিন জন তিন দিকে যেতে শুরু করে। জেট প্যাকটা এবারে ইরনের কাছে, সে সাবধানে সেটাকে টেনে নিতে থাকে।

আবছা অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে কীশার যেটুকু কাছে যাবার ইচ্ছে ছিল ইরন ততটুকু কাছে যেতে পারল না। তার আগেই হঠাৎ করে কীশা সচকিত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কে? কে ওখানে?

ইরন জেট প্যাকের পিছনে নিজেকে আড়াল করে বলল, আমি। আমি ইরন।

কীশাকে হঠাৎ করে কেমন যেন নিশ্চিন্ত মনে হল, মনে হল কিছু একটা নিয়ে সে ভারি দুশ্চিন্তায় ছিল, হঠাৎ করে সেই দুশ্চিন্তার বিষয়টি অপসারিত হয়ে গেছে। সে খানিকটা খুশি খুশি গলায় বলল, ও, তোমরা এসেছ?

হ্যাঁ।

কেন এসেছ?

নিশিকে নিতে।

নিশিকে নিতে? কিন্তু তোমরা তো নিশিকে নিতে পারবে না।

কেন পারব না?

কারণ আমি নিশিকে ওদের দিয়ে দিয়েছি। ওরা এক্ষুনি ওকে নিতে আসবে।

তুমি জান ওরা কারা? তুমি কি ওদের দেখেছ?

না। আমি দেখি নি।

ইরন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমরা দেখেছি, তুমি নিশিকে ওদের দিতে পারবে না।

কীশা কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ইরন গলার স্বর উঁচু করে নিশিকে ডাকল। বলল, নিশি তুমি আমার কাছে চলে এস। তিন দিক থেকে তিন জন কীশার দিকে অস্ত্র তাক করে আছে। সে তোমাকে কিছু করার চেষ্টা করলেই তাকে শেষ করে দেবে।

নিশি সোজা হয়ে বসল, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমি কেমন করে আসব? এই দেখ আমাকে বেঁধে রেখেছে।

নিশি দেখাল তার স্পেসস্ট থেকে শক্ত ধাতব শেকল বের হয়ে এসেছে। শেকল দিয়ে সে চতুষ্কোণ একটা বাক্সের সাথে বাধা।

ইরন সাবধানে আরো কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল, ওটা কিসের বাক্স? ওর ভিতরে কী আছে?

নিশি মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না।

ইরন আরো কয়েক পা এগিয়ে যায়। কীশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কীশা।

বল।

এই বাক্সটি কী?

আমি ঠিক জানি না।

এই বাক্সটির সাথে নিশিকে বেঁধে রেখেছ কেন?

আমার মনে হয় এখান থেকে কোনো ধরনের সঙ্কেত বের হচ্ছে। ওরা এই সঙ্কেত থেকে বুঝতে পারবে নিশি কোথায়।

ও। ইরন মাথা নেড়ে বলল, নিশি তুমি বাক্সটি থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে সরে দাঁড়াও।

নিশি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেন?

আমি গুলি করে এই বাক্সটি ধ্বংস করে দেব।

কীশা হাসির মতো শব্দ করে বলল, না ইরন, তুমি সেটা করবে না।

কেন?

কারণ আমি তোমাকে করতে দেব না। কীশা তার কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে নিশিকে জাপটে ধরে চতুষ্কোণ বাক্সটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিশিকে বাক্সটার উপর চেপে রেখে বলল, আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও। আমাকে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে আমি তার বাইরে কিছু করতে পারব না।

কীশা ইরন চিৎকার করে বলল, কীশা—

আমি দুঃখিত ইরন। ঐ দেখ ওরা আসছে।

ইরন আকাশের দিকে তাকাল, আকাশের নানা জায়গায় বিদ্যুতের ঝলকানির মতো আলো জ্বলছে। চারদিক থেকে কুৎসিত মাংসপিণ্ডের মতো কিছু একটা কিলবিল করে আবার অদৃশ্য হয়ে যেতে শুরু করে।

নিশি চিৎকার করে ওঠে আতঙ্কে, কীশা তাকে শক্ত করে ধরে রেখে শান্ত গলায় বলে, আর কয়েক সেকেন্ড নিশি। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

ইরন শুনতে পেল ত্ৰালুস এবং শুমান্তি ছুটে আসছে। এলুস অস্ত্র উদ্যত করে বলল, সরে যাও কীশা, সরে যাও। ছেড়ে দাও নিশিকে। ছেড়ে দাও।

কীশা ত্রালুসের কথা শুনতে পেল বলে মনে হল না। নিশিকে চেপে ধরে রেখে নিচু গলায় বলল, নিশি লক্ষ্মী মেয়ে। তুমি ছটফট কোরো না, চুপ করে শুয়ে থাক। তারা আমাদের খুঁজে পেয়েছে। ঐ দেখ তারা আসছে।

নিশি আতঙ্কে একটা আর্তচিৎকার করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে, একটি ঝটকা দিয়ে উঠে বসে, ত্রালুস এবং শুমান্তি কীশার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টেনে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, ঠিক তখন খুব কাছে হঠাৎ করে একটা তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা গেল, কালো ধোঁয়ায় চারদিক ঢেকে যায় এবং হঠাৎ করে কীশা একটা আর্তনাদ করে ওঠে।

ত্রালুস এবং শুমান্তি চিৎকার করে পিছনে সরে এল, কীশার স্পেসস্যুট ভেঙে তার ভিতর থেকে কুৎসিত থলথলে মাংসপিণ্ডের মতো কিছু একটা বের হয়ে আসছে। ইরন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল–নিশিকে নেবার জন্য চতুর্মাত্রিক প্রাণীটি যেখানে হাজির হয়েছে ঠিক সেখানে কীশা ছিল, প্রাণীটি নিশিকে নিতে পারে নি কিন্তু চেষ্টা করতে গিয়ে কীশার শরীরের ভিতর দিয়েই বের হয়ে এসেছে। ইরন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, অবাক হয়ে দেখল, তার দেহ ছিন্নভিন্ন করে ভিতর থেকে থলথলে মাংসপিণ্ডের মতো কিছু একটা বের হয়ে আসছে। কীশা থরথর করে কাঁপতে থাকে, তার মুখ যন্ত্রণায় বিবর্ণ হয়ে উঠছে–দাতে দাঁত চেপে সে ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে ওঠে।

ত্রালুস আর সহ্য করতে পারল না, অস্ত্রটি উপরে তুলে থলথলে মাংসপিণ্ডের মতো জিনিসটা লক্ষ্য করে গুলি করে বসে। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল, কালো ধোঁয়ায় চারদিক ঢেকে যায়। এক ধরনের জান্তব শব্দ শুনতে পেল সবাই, থলথলে জিনিসটি জান্তব। এক ধরনের শব্দ করতে থাকে, ভিতর থেকে সাদা কষের মতো আঠালো এক ধরনের তরল ফিনকি দিয়ে বের হতে শুরু করে। মাংসপিণ্ডটি হঠাৎ বিশাল বড় হয়ে যায়, সেখান থেকে। অসংখ্য শুড়ের মতো জিনিস বের হয়ে আসে। সেগুলো কিলবিল করতে করতে হঠাৎ করে পুরো জিনিসটি অদৃশ্য হয়ে গেল।

পুরো ব্যাপারটি বুঝতেই তাদের কয়েক মুহূর্ত সময় লেগে যায়। যখন বুঝতে পারল তখন তারা দৌড়ে কীশার কাছে গেল, তার শরীর এবং স্পেসস্যুটটা দেখে মনে হয় তার শরীরের ভিতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে। ইরন কীশার হাত ধরে দেখল সেটি নিশ্চল, দেহে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই। শুমান্তি ফ্যাকাসে মুখে বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে। কীশার?

আমার ধারণা একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিশিকে নেওয়ার জন্য প্রাণীটা আসছিল, ঠিক যেখানে বের হয়েছে সেখানে কীশা ছিল। হুটোপুটি হওয়ার কারণে প্রাণীটা ওর শরীরের ভিতর দিয়ে বের হয়ে এসেছে।

ত্রালুস একটু এগিয়ে এসে বলল, কীশা কি মারা গেছে? রোবট কি মারা যায়?

ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কীশা আসলে পুরোপুরি রোবট ছিল না। একটা সত্যিকার মানুষের মাথায় তার মস্তিষ্কের একটা অংশে কপোট্রন লাগিয়ে ওকে তৈরি করা হয়েছে। কপোট্রনটা শরীরের উপর নির্ভর করে ছিল। শরীর ধ্বংস হয়ে গেলে কপোট্রনটা আর থাকতে পারে না। আমার ধারণা ওর কপোট্রনটাও আর কাজ করছে না।

ইরন কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে শুনতে পেল খুব চাপা গলায় প্রায় ফিসফিস করে কেউ তাকে ডাকছে। ইরন চমকে উঠল, কে?

আমি। আমি কীশা।

ইরন কীশার উপর ঝুঁকে পড়ল, কীশা তুমি বেঁচে আছ?

আমি জানি না। এটা বেঁচে থাকা কি না। যদি এটা বেঁচে থাকাও হয় তা হলেও আমি আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকব না। রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে বলে খুব দ্রুত আমার সবকিছু একটি একটি করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন আর কিছু দেখতে পারছি না।

কীশা, আমরা খুব দুঃখিত। আমরা

আমি জানি। আমাকে তারা রোবট হিসেবে তৈরি করেছিল কিন্তু আমার ভিতরে যেটুকু স্মৃতি, যেসব অনুভূতি সব আমার নিজের। আমার মস্তিষ্কের অংশবিশেষ নিশ্চয়ই এখনো কোথাও রয়ে গেছে। মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসা কী আমি জানি ইরন।

আমরা কি তোমার জন্য কিছু করতে পারি, কীশা?

না। কিছু করতে পারবে না। কীশার গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে আসে, কষ্ট করে বলে, আমি ভোকাল কর্ডকে আর ব্যবহার করতে পারছি না, আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ইরন

বল কীশা।

আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদের ভয়াবহ বিপদে এনে ফেলেছি, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি নিজের ইচ্ছায় করি নি। আমার কোনো উপায় ছিল না।

আমরা জানি।

তোমাদের কথাও এখন অস্পষ্ট হয়ে আসছে। ভালো করে আর শুনতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে আমি ভেসে ভেসে বহুদূরে চলে যাচ্ছি। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না, কিছু শুনতে পাচ্ছি না, কিছু বুঝতে পারছি না।

কীশা। কীশা। ইরন চিৎকার করে ডাকল, কীশা।

বল ইরন।

ইরন চিৎকার করে উঠল, আমরা তোমাকে ভুলব না। আমরা সবসময় তোমাকে মনে রাখব। তোমার জন্য সবসময় আমাদের বুকে ভালবাসা থাকবে কীশা।

ভালবাসা। কীশার গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে আসে, ফিসফিস করে বলে, মানুষের ভালবাসা। আহা! কেন ওরা আমাকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে দিল না? কেন?

ইরন কীশার উপর ঝুঁকে পড়ে চিৎকার করে বলল, কীশা শরীরের গঠন দিয়ে মানুষ হয় না, নিউরন৩৪ আর সিনাপ্সের সংযোগ দিয়ে মানুষ হয় না, কপোট্রনের নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়েও মানুষ হয় না। মানুষ হচ্ছে তার বুকের ভিতরের অনুভূতি। তুমি মানুষ কীশা, তুমি মানুষ, তুমি পুরোপুরি একজন মানুষ।

আমি শুনতে পাচ্ছি না ইরন। মনে হচ্ছে আমি বহুদূরে চলে যাচ্ছি, বহুদূরে। বহুদূরে–

ইরন চিৎকার করে বলল, তুমি মানুষ কীশা। তুমি আমাদের মতো মানুষ। তোমার জন্য আমাদের ভালবাসা। ভালবাসা।

কীশা ফিসফিস করে বলল, ভালবাসা? আমার জন্য ভালবাসা? তার গলার স্বর একেবারে অস্পষ্ট হয়ে আসে, অনেক চেষ্টা করেও আর তার কথা শোনা গেল না।

ইরন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল, বলল, কীশার কপোট্রন থেমে গেছে।