মিথিলার পরিবর্তনটা পরদিন সবাই লক্ষ করল। সে সকালবেলা সবার আগে কাপড় জামা পরে প্রস্তুত হয়ে গেছে। মাথায় কাপড়ের একটা টুপি, চোখে কালো চশমা। পিঠে একটা ব্যাগ এবং গলায় বাইনোকুলার। নৌকা তীরে এসে নেমে কাদার ভেতর দিয়ে ছপছপ করে হেঁটে সে ডাঙ্গায় উঠে এল। পুরো দলটির পেছনে পেছনে সে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াল, গুনগুন করে একটা ইংরেজি গানের সুর গাইত গাইতে বাইনোকুলার লাগিয়ে সে সব গাছের ওপর দিয়ে নিজের অজান্তেই কিছু একটা খুঁজে বেড়াতে লাগল।
ডক্টর আশরাফ একটু অবাক হয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, তুই কী দেখিস গাছের ওপর?
কিছু না আব্বু। এমনি দেখি। চোখ খোলা রাখলে দেখিস কত কী দেখা যায়।
মিথিলা হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, আমরা যদি উড়তে পারতাম তাহলে কী মজা হতো তাই না আব্বু!
তোকে কে বলেছে আমরা উড়তে পারি না! প্লেনে হেলিকপ্টারে আমরা উড়ি না!
মিথিলা মাথা নেড়ে বলল, না, না, না! আমি ঐ রকম উড়ার মতো বলছি না। সত্যিকার উড়ার কথা বলছি। পাখির মতো উড়ার কথা বলছি!
পাখি রয়েছে বিবর্তনের শেষ মাথায়, আমরাও রয়েছি শেষ মাথায়। আমাদের উড়ার কথা থাকলে এতদিনে আমরা পাখি হয়ে যেতাম!
মিথিলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের যদি পাখা থাকত তাহলে কী মজা হতো তাই না?
ডক্টর আশরাফ হাসল, বলল, আমাদের যত ওজন আমাদের উড়তে হলে যে পাখা লাগবে, শরীরে সেই পাখা লাগানোর জায়গাই থাকবে না! শুধু পাখাই থাকতে হবে-শরীর আর থাকবে না!
মিথিল ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে। ডক্টর আশরাফ জিজ্ঞেস করল, কী ভাবিস?
তাহলে আমাদের শরীরটা হালকা হতে হবে?
হ্যাঁ। পাখির যে রকম। হাড়গুলো হালকা, বিশাল ফুসফুস। মেদহীন ছিপছিপে শরীর!
মিথিলা কোনো কথা বলল না, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাইনোকুলারটা চোখে লাগিয়ে আবার সে গাছগুলোর ওপর দিয়ে দেখতে লাগল। দূরে কোথাও এক জায়গায় হঠাৎ করে অসংখ্য পাখি কিচিরমিচির করে ডাকতে ডাকতে তাদের মাথায় ওপর দিয়ে উড়ে গেল। ডক্টর আশরাফদের দলের লোকজন বিস্মিত হয়ে সেই পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কোথা থেকে হঠাৎ করে এতগুলো পাখি এসেছে? কোথায় যাচ্ছে?
রাত্রি বেলা অনেক দিন পর মিথিলা সবার সাথে বসে খেলো, গল্পগুজব করল এবং একজন যখন তাকে একটা গান গাইতে বলল সে একটুও সংকোচ না করে একটা ইংরেজি গান গেয়ে শোনাল। ডক্টর আশরাফ এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে তার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। এক রাতের মাঝে মেয়েটির মাঝে এ রকম একটা পরিবর্তন হবে কে জানত!
রাত্রি বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে গেছে তখন মিথিলা খুব সাবধানে তার কেবিন খুলে বের হয়ে এল। কেউ যেন বুঝতে না পারে সেভাবে নিঃশব্দে সে লঞ্চের ছাদে এসে দাঁড়াল। জোছনার আলোতে পুরো বনভূমিটিকে একটি অতিপ্রাকৃত ভূখণ্ডের মতো মনে হয়। অনেক দূর থেকে কোনো একটা বুনো পশু ডাকতে থাকে, এক ধরনের বিষণ্ণ করুণ কণ্ঠস্বর মনে হয়, শুনে মিথিলার বুকের মাঝে এক ধরনের কষ্ট হতে থাকে।
মিথিলা লঞ্চের ছাদে হাঁটতে থাকে, তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। কালকের সেই রহস্যময় ডানাওয়ালা কিশোরিটি কি আসবে আবার? যখন। হেঁটে হেঁটে একসময় সে ক্লান্ত হয়ে গেল, মনে হলো আর বুঝি সে আসবে তখন সে দেখতে পায় আকাশে বৃত্তাকারে কিছু একটা উড়ছে। বিশাল ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়তে উড়তে সেই রহস্যময় ছায়ামূর্তিটি কাছে আসতে থাকে।
মিথিলা দুই হাত উপরে তুলে নাড়তে থাকে, তখন খুব ধীরে ধীরে বুলবুল ডানা মেলে প্রায় নিঃশব্দে নিচে নেমে আসে। মিথিলা কাছে গিয়ে বুলবুলকে স্পর্শ করে বলল, আমি বুঝেছিলাম তুমি নিশ্চয়ই আসবে!
বুলবুল বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, কী সুন্দর জোছনা উঠেছে, আমি তাই উড়তে বের হয়েছি। ভাবলাম তোমাদের লঞ্চটা দেখে যাই। তখন দেখি তুমি ছাদে দাঁড়িয়ে আছ, তাই এসেছি।
আমি না হয়ে যদি অন্য কেউ হতো?
আমি বুঝতে পেরেছি অন্য কেউ না। তোমরা যখন আজ জঙ্গলে গিয়েছিলে আমি তোমাদের সবাইকে দেখেছি।
দেখেছ?
হ্যাঁ। মিথিলা হেসে ফেলল, বলল, আমি বাইনোকুলার দিয়ে তোমাকে সবগুলো গাছের উপর খুঁজেছিলাম।
বুলবুল মাথা নেড়ে বলল, তোমরা কখনো খুঁজে আমাকে পাবে না। আমি গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারি। তোমরা আমাকে দেখবে না, কিন্তু আমি তোমাদের দেখি।
কী মজা!
শুধু পাখিগুলো মাঝে মাঝে ঝামেলা করে।
কী ঝামেলা করে?
হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে যায়। ডাকাডাকি করে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়।
মিথিলা চোখ বড় বড় করে বলল, ও আচ্ছা! বনের মাঝে হঠাৎ করে অনেকগুলো পাখি উড়ে উড়ে এল—
হ্যাঁ। ওগুলো আমার সাথে ছিল। ওরা আমার ঘরে ঘুমায়।
তোমার ঘর? তোমার ঘর কোথায়?
জঙ্গলে অনেক উঁচু একটা গাছের ওপর আমি ঘর তৈরি করছি।
ইশ! কী মজা।
বুলবুল কোনো কথা বলল না, নির্জন বনভূমিতে উঁচু একটা গাছের উপরে ছোট একটা কাঠের ঘরে দিনের পর দিন রাতের পর রাত একেবারে একা একা থাকা সত্যিই খুব মজার কি না বুলবুল কখনোই সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি। কিন্তু সে কোনো কথা বলল না।
মিথিলা জোছনার আলোতে কিছুক্ষণ বুলবুলের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ইশ! তোমার কী মজা তুমি উড়তে পার।
তুমি উড়তে চাও?
চাই না আবার? এক শ বার উড়তে চাই।
তুমি আমার সাথে উড়বে?
মিথিলা অবাক হয়ে বলল, উড়ব? তোমার সাথে?
হ্যাঁ!
কেমন করে?
তুমি আমার পিঠে বসবে, আমি তোমাকে নিয়ে উড়ে যাব।
সত্যি? তুমি পারবে?
কেন পারব না?
মিথিলার চোখ চকচক করে ওঠে, ইতস্তত করে বলল, কিন্তু–কিন্তু–
কিন্তু কী?
যদি পড়ে যাই?
বুলবুল হেসে ফেলল, বলল, পড়বে না। তুমি যখন পড়তে চেয়েছিলে তখনো আমি তোমাকে পড়তে দেই নাই। মনে আছে?
মিথিলা একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, মনে আছে।
আমি তোমাকে পড়তে দিব না, আর তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে রাখবে।
ঠিক আছে। মিথিলা এক কথায় রাজি হয়ে গেল।
বুলবুল তার দুই ডানা বিস্তৃত করে একটু সামনে ঝুঁকে দাঁড়াল। মিথিলা পেছন থেকে তার গলা ধরে তার পিঠে ঝুলে পড়ল। বুলবুল জিজ্ঞেস করল, তুমি ঠিক করে ধরেছ?
ধরেছি।
ঠিক আছে তাহলে আমরা উড়ছি।
বুলবুল তার শক্তিশালী ডানা দুটি ঝাঁপটে সামনে কয়েক পা এগিয়ে পা দিয়ে নিচে ধাক্কা দিয়ে উপরে উঠে পড়ে। মিথিলা শক্ত করে বুলবুলের গলা চেপে ধরে ভয়ের একটা শব্দ করল, প্রথমে বুলবুল খানিকটা নিচে নেমে আসে তারপর খুব ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। ডানা ঝাঁপটে বুলবুল মিথিলাকে নিয়ে বনভূমির দিকে উড়ে যায়, গাছের উপর দিয়ে সে আকাশের দিকে এগুতে থাকে, দেখে মনে হয় সে বুঝি সোজা চাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বুলবুল জিজ্ঞেস করল, তুমি ঠিক আছ?
মিথিলা বলল, হ্যাঁ। ঠিক আছি। তুমি?
আমিও ঠিক আছি।
তুমি কোথায় যাবে বল?
তোমার যেখানে ইচ্ছ।
বুলবুল ডানা ঝাঁপটে মিথিলাকে আরো উপরে নিয়ে যায়। মিথিলা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকে। জোছনার আলোতে নিচের বনভূমিকে রহস্যময় মনে হয়। ছোট ছোট খাল, নদী বনভূমিকে জড়িয়ে রেখেছে, জোছনার আলোতে সেগুলো চিকচিক করছে। চারপাশে নিস্তব্ধ, এতটুকু শব্দ নেই, তার মাঝে পাশ দিয়ে হঠাৎ একটা রাতজাগা পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। মিথিলা চমকে উঠল, ওটা কী?
আমার বন্ধু।
তোমার বন্ধু?
হ্যাঁ। মাঝে মাঝে অনেক রাতে আমি যখন আকাশে উড়ি তখন সে আমার সাথে সাথে ওড়ে!
কী মজা! সব পাখি তোমার বন্ধু?
হ্যাঁ সব পাখি আমার বন্ধু আমি ওদের দেখে-শুনে রাখি। ওরা খুব ভালো। ওরাও আমাকে দেখে-শুনে রাখে।
মিথিলা বুলবুলের গলা জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে নিচে তাকায়। তার ভেতরে অত্যন্ত বিচিত্র এক ধরনের অনুভূতির জন্ম হয়, যে অনুভূতির সাথে তার পরিচয় নেই। সে ফিসফিস করে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জান?
কী?
আমার মনে হচ্ছে আমি সারা জীবন এখানে থেকে যাই। আমার কী যে ভালো লাগছে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
আমি জানি তুমি এখানে থাকবে না। কেমন করে থাকবে? থাকার কোনো উপায় নাই। আমার থাকতে হয় তাই থাকি। তা না হলে কি আমি থাকতাম? কিন্তু তুমি যে বলেছ তোমার এখানে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে করছে, সে জন্যেই আমি খুশি! আমার যখন মন খারাপ হবে তখন আমি তোমার এই কথাটা মনে করব!
তখন মিথিলা তার মন খারাপের কথা বলল। তার মায়ের কথা বলল, তার মা কেমন করে মারা গেল সেই কথা বলল। তার স্কুলের কথা বলল, তার বন্ধুদের কথা বলল। বুলবুল তার জন্মের কথা বলল, জহুরের কথা বলল, আনোয়ারার কথা বলল। ডক্টর সেলিমের কথা বলল, লিপির কথা বলল। মিথিলা তার খেলার সাথীদের কথা বলল, তারপর গুনগুন করে একটা গান গেয়ে শোনাল।
ধীরে ধীরে যখন পুবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে তখন বুলবুল মিথিলাকে নিয়ে ফিরে আসে। তাকে লঞ্চের ছাদে নামিয়ে দিয়ে সে উড়ে যায়। তার সমস্ত শরীর ক্লান্ত কিন্তু বুকের ভেতর বিচিত্র এক ধরনের অনুভূতি—যার সাথে সে পরিচিত না। যেটা সে কোনোভাবে বুঝতে পারছিল না।
পরদিন ভোরে ডক্টর আশরাফ নাশতার টেবিলে তার মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে মেয়ের কেবিনে গিয়ে দেখতে পেল সে ঘুমে কাদা হয়ে আছে। ডক্টর আশরাফ ডেকে বলল, মিথিলা, মা উঠবি না? নাশতা করবি না?
মিথিলা ঘুমের মাঝে বিড়বিড় করে বলল, খুব ঘুম পাচ্ছে আব্বু! আমি এখন উঠব না!
ডক্টর আশরাফ মেয়েকে আর বিরক্ত করল না, সারারাত ঘুমানোর পরেও কেমন করে একজনের ঘুম পায় সেটা সে বুঝতে পারল না। এই বয়সী মেয়েদের তাদের বাবারা নিশ্চয়ই কখনো বুঝতে পারে না।
রাত্রিবেলা খাবার টেবিলে ডক্টর আশরাফ ঘোষণা করল তাদের এবারকার অভিযান শেষ, পরদিন ভোরে তারা ফিরে যাচ্ছে।
মিথিলা চমকে উঠে বলল, ফিরে যাচ্ছি?
হ্যাঁ।
কেন আব্বু? এত তাড়াতাড়ি কেন?
ডক্টর আশরাফ হেসে ফেলল, বলল, তাড়াতাড়ি? এই কয়দিন আগেই তুই একেবারে অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলি কখন ফিরে যাব! এখন বলছিস তাড়াতাড়ি?
হ্যাঁ আব্বু। মিথিলা ইতস্তত করে বলল, আগে আমার ভালো লাগছিল না। এখন ভালো লাগছে।
ভালো লাগলে ভালো। আমরা আবার আসব।
কিন্তু—
কিন্তু কী?
আরো কয়েক দিন থাকো না আব্বু। অন্য কিছু স্টাডি করো।
অন্য কী স্টাডি করব?
বনে কত কী আছে। গাছপালা সাপ ব্যাঙ গোসাপ—
ডক্টর আশরাফ হেসে বলল, আমি তো গাছপালা সাপ ব্যাঙের এক্সপার্ট না। আমি পাখির এক্সপার্ট–
তাহলে পাখিই স্টাডি করো?
এ রকম সময় খাবার টেবিলের একপাশে বাস থাকা চশমা পরা। একজন বলল, স্যার, মিথিলার কথায় একটা যুক্তি আছে।
কী যুক্তি?
আজকে আমাদের লঞ্চের ছাদে এটা পেয়েছি। বলে চশমা পরা ছেলেটি ডক্টর আশরাফের দিকে একটা পালক এগিয়ে দেয়। পালকটি কমপক্ষে এক ফুট লম্বা এবং সেটি দেখে এক সাথে সবাই বিস্ময়ের একটা শব্দ করল। ডক্টর আশরাফ পালকটি হাতে নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে, এর অর্থ তোমরা কি জান?
কী স্যার?
এর অর্থ এই পাখিটির ডানার বিস্তৃতি ছয় থেকে আট মিটার।
এটা কী পাখি স্যার?
আমি জানি না।
একজন অবাক হয়ে বলল, আপনি জানেন না?
না। আমার জানামতে এত বড় পাখি পৃথিবীতে নেই।
তাহলে এটা কোথা থেকে এল স্যার?
ডক্টর আশরাফ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি জানি না।
আমরা কি এটা নিয়ে একটু স্টাডি করব? এটা খুঁজব?
আমরা গত কয়েক দিন যেভাবে স্টাডি করেছি তাতে এই পাখিটার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া উচিত ছিল। যেহেতু পাইনি—
ডক্টর আশরাফ আবার চুপ করে যায়, চশমা পরা ছেলেটি বলল, যেহেতু পাইনি?
যেহেতু পাইনি তার অর্থ, পাখিটা অনেক বুদ্ধিমান। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে।
মিথিলা আস্তে আস্তে বলল, হয়তো এটা পাখি না।
এটা পাখি না? এটা তাহলে কী?
হয়তো এটা পরী।
সবার জোরে হেসে ওঠার কথা ছিল, কিন্তু কেউ হেসে উঠল না।
গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেছে তখন মিথিলা নিঃশব্দে লঞ্চের ছাদে উঠে এল। চাঁদের আলো খুব বিচ্ছিন্ন, জোছনা রাতে সেটি ঝলমল করতে থাকে কিন্তু একদিন পরেই মনে হয় তার ঔজ্জ্বল্য কমে এসেছে। মিথিলা চাদটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তুই পাশে গহিন অরণ্য, সেখানে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তার মাঝে কত বিচিত্র প্রাণী তাদের জীবনকে তাদের নিজেদের মতো করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
মিথিলা নিঃশব্দে লঞ্চের ছাদে পায়চারী করতে থাকে। চাদটা যখন একটু ঢলে পড়ল তখন সে দেখতে পেল বিশাল একটা পাখির মতো ডানা মেলে বুলবুল লঞ্চটাকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘুরছে। ধীরে ধীরে বৃত্তটিকে ছোট করে নিঃশব্দে বুলবুল লঞ্চের ছাদে নেমে এল।
মিথিলা এগিয়ে গিয়ে বুলবুলের হাত ধরে বলল, তুমি এত দেরি করে এসেছ?
বুলবুল ফিসফিস করে বলল, আমি আরো আগে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লঞ্চে মানুষজন জেগে আছে, চলাফেরা করছে; তাই দেরি হলো। কেউ আমাকে দেখে ফেললে কী বিপদ হবে জান?
মিথিলা মাথা নেড়ে বলল, জানি। বিপদ মনে হয় একটু হয়েছে।
কী বিপদ?
তোমার একটা পালক এইখানে খুঁজে পেয়েছে। সেইটা দেখে সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সবাই বলছে, এত বড় পালক কোনো পাখির হতে পারে না।
সর্বনাশ!
হ্যাঁ। তোমাকে খুব সাবধান থাকতে হবে।
ঠিকই বলেছ।
তোমাকে যদি কেউ দেখে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
বুলবুল মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। সর্বনাশ হয়ে যাবে।
মিথিলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা কাল সকালে চলে যাব।
চলে যাবে?
হ্যাঁ। আমার খুব মন খারাপ হবে।
বুলবুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমারও।
মিথিলা বলল, আমার মনে হচ্ছে কেন তোমার সাথে দেখা হলো? দেখা না হলেই তো মন খারাপ হতো না।
বুলবুল মাথা নাড়ল, বলল, না। আমার সেটা মনে হচ্ছে না। আমার কী মনে হচ্ছে জান?
কী?
আমার মনে হচ্ছে আমার কী সৌভাগ্য যে তোমার সাথে দেখা হলো, এখন আমি সারাজীবন তোমার কথা মনে রাখতে পারব। বুলবুল আস্তে আস্তে বলল, আমি যখন আকাশে উড়ব তখন ভাবব একদিন তোমাকে নিয়ে আমি আকাশে উড়েছিলাম।
মিথিলা ফিসফিস করে বলল, আমার অসিলে চলে যেতে ইচ্ছে করছে না।
বুলবুল কথাটির কোনো উত্তর দিল না, একটু পরে বলল, তুমি কি আজকে আবার উড়তে চাও?
তোমার কোনো কষ্ট হবে না তো?
না। কোনো কষ্ট হবে না।
তাহলে চল যাই।
কিছুক্ষণের ভেতর বুলবুল মিথিলাকে নিয়ে আকাশে উড়ে গেল। ঠিক তখন একজন ডক্টর আশরাফের কেবিনে জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছিল। ডক্টর আশরাফ ঘুম থেকে উঠে ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে?
আপনি বিশ্বাস করবেন না স্যার। নিজের চোখে দেখলেও বিশ্বাস করবেন না।
কী হয়েছে?
বিশাল বড় একটা পাখির পালক কোথা থেকে এসেছে আমি জানি।
কোথা থেকে।
একজন মানুষ, তার পাখির মতোন পাখা।
ডক্টর আশরাফ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। বলল, কী বলছ?
বলছি, একজন মানুষ তার পাখির মতো পাখা।
সে কোথায়?
মিথিলাকে নিয়ে আকাশে উড়তে গেছে। একটু পরে আসবে।
মি-মিথিলাকে নিয়ে? মিথিলাকে?
হ্যাঁ স্যার। মানুষটা মিথিলাকে চিনে, দুজন খুব বন্ধু। আমি স্যার তাদের কথা শুনেছি।
ডক্টর আশরাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সবাইকে ডেকে তোলে। এই ক্রিয়েচারটাকে ধরতে হবে। মনে হয় এটা হবে। বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।
ঘণ্টা দুয়েক পর যখন মিথিলাকে পিঠে নিয়ে বুলবুল লঞ্চের ছাদে নেমে এল তারা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি প্রায় দুই ডজন মানুষ তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। মিথিলা তার পিঠ থেকে নেমে যখন বুলবুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তখন এক সাথে সবাই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মুহূর্তের মাঝেই বুলবুল বুঝে যায় কী হচ্ছে, সে তার শক্তিশালী পাখা। দিয়ে আঘাত করে কয়েকজনকে নিচে ফেলে দেয়। পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, কেউ একজন একটা লোহার রড দিয়ে তার মাথায় আঘাত করেছে, জ্ঞান হারিয়ে অচেতন হওয়ার আগে সে। শুনতে পেল মিথিলা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলছে, না! না! না!
মিথিলাকে ডক্টর আশরাফ ধরে রাখতে পারছে না, আরো দুজন মিলে মিথিলাকে আটকে রেখেছে। সে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো চিৎকার করে কাঁদছে, তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।