৩.১ বুলবুলের ঘুম ভাঙে পাখির ডাক শুনে

তৃতীয় পর্ব

প্রতিদিন সকালে বুলবুলের ঘুম ভাঙে পাখির ডাক শুনে। সেই সূর্য ওঠার আগে পাখিগুলো তার ঘরের চারপাশে ভিড় জমিয়ে কিচিরমিচির করে ডাকতে থাকে। শুধু কিচিরমিচির করে ডেকেই তারা ক্ষান্ত হয় না, ঘরের ভেতর ঢুকে তার শরীরের ওপর চেপে বসে, তিড়িংবিড়িং করে লাফায়, ঠোঁট দিয়ে ঠোকর দেয়। তাকে জাগানোর চেষ্টা করে।

আজকেও যখন ছোট ছোট পাখি তাকে জাগানোর চেষ্টা করল বুলবুল চোখ খুলে তাকালো এবং সাথে সাথে পাখিগুলোর উত্তেজনা বেড়ে যায়, তারা দুই পায়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় লাফাতে থাকে, কিচিরমিচির করে ডাকতে থাকে। বুলবুল বিড়বিড় করে বলল, তোমাদের সমস্যাটা কী? এত কিচিরমিচির করছ কেন?

বুলবুলকে কথা বলতে দেখে পাখিগুলো আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং তারা আরো দ্রুত ছোটাছুটি করতে থাকে। তখন বুলবুল উঠে বসল এবং পাখিগুলোর মাঝে বিশাল একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। তাদের কিচিরমিচির ডাকে তখন সেখানে কান পাতা দায় হয়ে গেল। বুলবুল একবার চোখ কচলায়, হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙে এবং তারপর বিড়বিড় করে বলে, যেখানে আমি নাই সেখানে পাখিরা কী করে বলবে আমাকে?

পাখিগুলো তার কথার গূঢ় অর্থ বুঝতে পারে না কিন্তু হালকা সুরটুকু বুঝতে পারে। তারা উড়ে উড়ে তার ঘাড়ে মাথায় হাতে বসে একটানা কিচিরমিচির করতে থাকে। বুলবুল তখন তার ঘর থেকে বের হয়ে গাছের বড় ডালে এসে দাঁড়িয়ে তার পাখা দুটো বিস্তৃত করে দিয়ে একবার ডানা ঝাঁপটিয়ে বলল, চল তাহলে, দিনটা শুরু করি।

বুলবুলের কুচকুচে কালো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, দীর্ঘ সুগঠিত দেহ। সে তার দুটো পাখা ছড়িয়ে দিয়ে গাছের উঁচু ডাল থেকে শূন্যে ঝাঁপ দেয়, নিচে নামতে নামতে হঠাৎ করে সে ডানা ঝাঁপটিয়ে উপরে উঠতে থাকে, তার সাথে সাথে শত শত নানা আকারের পাখি কিচিরমিচির শব্দ করে উড়তে থাকে। বুলবুল সোজা উড়ে গিয়ে ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করে নিচে নেমে আসতে থাকে, নদীর পানিতে নেমে আসার আগে সে সতর্ক চোখে চারপাশে একবার দেখা নেয়, বনের পশুরী এখানে রাতে পানি খেতে আসে।

পানিতে মুখ ধুয়ে সে সামনে এগিয়ে যায়, তীরের কাদামাটিতে বুনো পশুর পায়ের ছাপ। বেশির ভাগই হরিণ—তার মাঝে আলাদা করে একটা বাঘের পায়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। একটা বাঘিনী, নতুন বাচ্চা হয়েছে—এই এলাকার আশপাশেই থাকে। নদীর পানিতে ছলাৎ ছলাৎ করে হেঁটে বুলবুল মাছ ধরার খাঁচাটা টেনে পানি থেকে তুলল। মাঝারি আকারের একটা মাছ ছটফট করছে, উপরে তুলতেই ভোরবেলার সূর্যের নরম আলোতে তার শরীরটা চিকচিক করতে থাকে। বুলবুল মাছটা আঁচা থেকে বের করে তীরে উঠে আসে, নদীর মাঝামাঝি একটা কুমির পুরানো গাছের গুড়ির মতো ভেসে ছিল, সেটা এবার ধীরে ধীরে তীরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

পাখিগুলো নদীর পানিতে ঝাপটাঝাপটি করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মাটি খুঁটে খুঁটে কিছু খেতে চেষ্টা করে। বুলবুল ডানা ঝাঁপটিয়ে উপরে ওঠার সাথে সাথে পাখিগুলোও তার সাথে আবার উড়তে শুরু করে।

বনের মাঝামাঝি ফাঁকা একটা জায়গায় বুলবুল তার আগুনটা জ্বালিয়ে রাখে, উপরের ছাই সরিয়ে সে গনগনে জ্বলন্ত কয়লা বের করে তার ওপর মাছটা বসিয়ে দেয়। মাছটা আধপোড়া না হওয়া পর্যন্ত সে পা ছড়িয়ে বসে থাকে। পাখিগুলো আশপাশে গাছের ডালে ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের কিচিরমিচির শুনতে শুনতে সে খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ করে সব পাখি কিচিরমিচিড় শব্দ করে একসাথে উড়তে শুরু করে, বুলবুল সাথে সাথে সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে যায়–কিছু একটা আসছে।

কী আসছে সেটা প্রায় সাথে সাথেই দেখা গেল। জঙ্গলের এই এলাকার বাঘিনীটা খুব ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে, তার পেছনে পেছনে তিনটা ছোট ছোট বাঘের বাচ্চা। বাঘিনীটা কাছাকাছি এসে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় ঘরঘর এক ধরনের শব্দ করল, সেই শব্দে কোনো আক্রোশ বা সতর্কবাণী নেই, নেহায়েতই পরিচিত কোনো প্রাণীর প্রতি এক ধরনের সম্ভাষণ। বাঘিনীটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত বুলবুল সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, প্রয়োজন হলে মুহূর্তের মাঝে ডানা ঝাঁপটিয়ে সে উপরে উঠে যেতে পারবে, কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না।

বাঘিনীটা চলে যাওয়ার পর বুলবুল জ্বলন্ত কয়লা থেকে মাছটা বের করে ওপর থেকে পোড়া আঁশ সরিয়ে ভেতরের সেদ্ধ হয়ে থাকা নরম মাছটা ছিঁড়ে ছিড়ে খেতে থাকে। সে একা থাকে, দীর্ঘ সাত বছর কেউ তাকে দেখেনি সে জন্যেই কি না কে জানে তার আচার-আচরণে এক ধরনের বন্য ভাব চলে এসেছে।

 

জহুর যে কয়দিন বেঁচে ছিল সব সময় তাকে বলেছে, বুলবুল বাবা, তুই। এই জঙ্গলে একা একা থাকবি, তোর আশপাশে কোনো মানুষ থাকবে না। থাকবে বুনো পশু, কিন্তু মনে রাখিস, তোর শরীরে কিন্তু মানুষের রক্ত আছে। তোকে কিন্তু বুনো হওয়া চলবে না। বুলবুল সে জন্যে সব সময় তার কোমরে এক টুকরো কাপড় জড়িয়ে রাখে। সাত বছর আগের কাপড়, শতচ্ছিন্ন কিন্তু তবুও কাপড়!

খাওয়া শেষ করে বুলবুল তার আগুনটার মাঝে কিছু শুকনো কাঠ খুঁজে দিল, তারপর সেটা ঢেকে দিয়ে বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে। গহিন অরণ্য কিন্তু সে পুরো এলাকাটাকে একেবারে হাতের তালুর মতো চেনে। প্রত্যেকটা গাছ, প্রত্যেকটা ঝোপঝাড়, লতাগুল্মকে সে একটু একটু করে বড় হতে দেখেছে। বনের পশুগুলোও তার চেনা, সাপ গোসাপ কীটপতঙ্গগুলোও মনে হয় বুঝি পরিচিত।

হাঁটতে হাঁটতে সে উপরে তাকালো, এখানে গাছের ডালে বিশাল একটা মৌচাক। সেখানে মৌমাছির মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কোনো একদিন রাতে এসে সে মৌচাকের খানিকটা ভেঙে নিয়ে যাবে। মধু খেতে তার ভারী ভালো লাগে।

পায়ে হেঁটে বনের মাঝে ঘুরে বেড়াতে তার আর জহুরের কথা মনে হলো, জহুর তাকে বলেছিল, মানুষের শরীর খুব আজব ব্যাপার। এর যেটাকে যত ব্যবহার করা যায় সেটা তত শক্তিশালী হয়। সেই জন্যে তাকে বারবার বলত, তুই কিন্তু শুধু উড়ে বেড়াবি না, তুই হাঁটবি, দৌড়াবি। তাহলে পা শক্ত থাকবে! জহুর বলত, সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করবি মাথা, তাহলে বুদ্ধি বাড়বে। পশু-পাখি বেঁচে থাকে অভ্যাসের কারণে, মানুষকে বেঁচে থাকতে হয় বুদ্ধি দিয়ে।

বুলবুলের মনে আছে সে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা, আমি কি মানুষ?

জহুর এক মুহূর্তের জন্যে থতমত খেয়ে বলেছিল, যার শরীরে এক ফোঁটাও মানুষের রক্ত থাকে সেই মানুষ।

বুলবুল ভেবেছিল সে তখন জিজ্ঞেস করবে, তাহলে আমি কেন মানুষের সাথে থাকতে পারি না? কিন্তু সে সেটা জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস করলে জহুর কষ্ট পাবে, সে জন্যে জিজ্ঞেস করেনি। সে কখনোই জহুরকে কষ্ট দিতে চায়নি।

বুলবুল হেঁটে হেঁটে খালের কিনারায় এল। জোয়ারের সময় খালটা পানিতে কানায় কানায় ভরে যায়। এখন ভাটির টান এসেছে, খালটার পানি বলতে গেলে নেই। বুলবুল খালের কিনারায় খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে কিছু ফুলগাছ লাগিয়েছে—হরিণেরা এসে মাঝে মাঝেই ফুলসহ তার গাছ খেয়ে যায়—বুলবুল অবশ্যি কিছু মনে করে না। এই জঙ্গলে কোনো কিছুই কারো জন্যে নির্দিষ্ট নয়। সবকিছুই সবার জন্যে। বুলবুল তার ফুলগাছগুলো দেখে আরেকটু সামনে তার বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ দেখতে পেল। জহুর তাকে এটা শিখিয়েছিল। জহুর নাকি শিখেছিল একজন ডাকাতের কাছে। সেই ডাকাত জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল বারো বছর, জঙ্গলে কেমন করে বেঁচে থাকতে হয় সে তার সব কায়দাকানুন জানত।

বুলবুলের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের নিয়মটা খুব সোজা। মাটির মাঝে গর্ত করে তার উপরে একটা প্লাস্টিক বিছিয়ে রাখা! মাটি থেকে যে জলীয় বাষ্প বের হয় সেটা প্লাস্টিকের ওপর একত্র হয়ে ফোটা ফোটা করে ছোট একটা পাত্রে জমা হয়। জঙ্গলের বুনো একটা গাছের শক্ত খোেল দিয়ে সে বাটি বানিয়েছে। সেই বাটিতে এই পানি জমা হয়। বুলবুল বাটি বের করে ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে আবার ঠিক জায়গায় রেখে দেয়। এই বিশুদ্ধ পানি না হলেও তার আজকাল অসুবিধা হয় না, সে নদীর নোনাপানিও খেতে পারে। শুধু নোনাপানি নয়, সে যা কিছু খেতে পারে তার কখনো শরীর খারাপ হয় না। জীবনে তার জ্বর হয়নি, সর্দি কাশি কিছু হয়নি। তার শরীর কেটে গেলেও কখনো ইনফেকশন হয় না। জহুর দেখে দেখে অবাক হয়ে বলত, আমার কী মনে হয় জানিস?

কী বাবা?

তোর শরীরটা নিশ্চয়ই অন্য রকম কিছু দিয়ে তৈরি। তাই রোগজীবাণু তোকে ধরে না। তোর অসুখ হয় না।

বুলবুল বলত, অসুখ হলে কেমন লাগে বাবা?

জহুর হাসার চেষ্টা করে বলত, সেটা জানিস না খুব ভালো কথা। জানার জন্যে এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?

জহুরের শেষের দিকে খুব অসুখ হতো। এই জঙ্গলে তার শরীরটা টিকত না, খুব অসুস্থ হয়ে সে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকত। গভীর রাতে বুলবুলের যখন ঘুম ভাঙত সে দেখত ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে জহুর তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুলবুল ঘুম ঘুম গলায় জিজ্ঞেস করত, কী দেখো বাবা?

জহুর নিঃশ্বাস ফেলে বলত, তোকে দেখি।

আমাকে কী দেখো?

কাজটা ঠিক করলাম কি না সেটা দেখি।

কোন কাজটা বাবা?

এই যে তোকে ছোটবেলা বাঁচিয়ে তুলেছি। বাঁচিয়ে তুলে কি ভুল করলাম? তোর মায়ের সাথে তোকেও কি চলে যেতে দেয়া উচিত ছিল?

বুলবুল তখন বলে, না বাবা। ভুল করোনি।

ঠিক বলছিস? তোকে বাঁচিয়ে রেখে শুধু কি কষ্ট দিচ্ছি?

না বাবা। মোটেও কষ্ট দাওনি। তুমি খুব ভালো কাজ করেছ।

আর এখন? এই জঙ্গলে? একা একা?

এটা সবচেয়ে ভালো হয়েছে বাবা। আমি একেবারে স্বাধীনভাবে উড়তে পারি, ঘুরতে পারি!

জহুর ইতস্তত করে বলত, তুই যে একা!

কে বলেছে একা? এই তো তুমি আছ?

জহুর নিঃশ্বাস ফেলে বলত, আমি আর কদিন। আমি টের পাচ্ছি আমার ডাক এসেছে।

বুলবুল বুঝতে পারেনি সত্যি সত্যি তার ডাক এসেছে। একদিন ভোরবেলা জহুঁ বলল, বাবা বুলবুল।

বুলবুল বলল, কী বাবা।

জহুর বলল, আজকে খুব একটা বিশেষ দিন।

কেন বাবা? আজকে আমি যাব।

কোথায় যাবে বাবা?

জহুর হাসার চেষ্টা করে বলল, যেখান থেকে ডাক এসেছে, সেখানে।

বুলবুল চমকে উঠে বলেছিল, না বাবা।

জহুর বলেছিল, হ্যাঁ। তারপর তার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, আয় আমাকে সাহায্য কর।

বুলবুল তখন চোখ মুছে তাকে সাহায্য করেছিল। খালের মাঝে যে নৌকাটা ছিল, জহুর সেই নৌকাটার মাঝে গিয়ে শুয়েছিল। বুলবুলকে বলেছিল, বাবা নৌকার লগি দিয়ে একটা ধাক্কা দে।

বুলবুল লগি দিয়ে নৌকাটাকে ধাক্কা দিতেই সেটা খালের মাঝখানে চলে এল। ভাটির টানে সেটা তরতর করে এগুতে থাকে। জহুর চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, নৌকাটা খাল থেকে যাবে নদীতে, নদী থেকে যাবে সমুদ্রে। সমুদ্রে যেতে যেতে আমি আর থাকব না।

বুলবুল জহুরের হাত ধরে থাকল, জহুর কলল, একটু পরে আমি আর কথা বলতে পারব না, তখন তুই চলে যাস বাবা।

বুলবুল বলল, না বাবা, আমি যেতে চাই না।

তোকে যেতে হবে। কেউ সারা জীবন থাকে না। একদিন তুইও থাকবি না।

না বাবা–

না বলে না বোকা ছেলে। নৌকাটা বেশি দূরে যাবার আগে তুই চলে যাবি। সমুদ্রে জেলে নৌকা থাকে, তাকে পরে দেখে ফেলবে।

বুলবুল কোনো কথা বলল না। জহুর বলল, তুই আমাকে মাপ করে দিস বাবা, তোকে আমি সুন্দর একটা জীবন দিতে পারলাম না।

বুলবুল বলল, তুমি আমাকে অনেক সুন্দর জীবন দিয়েছ।

তুই তো একা একা থাকবি, কিন্তু তাই বলে তুই কিন্তু বন্য হয়ে যাবি।

হব না।

তোকে যেন কোনো দিন কোনো মানুষ খুঁজে না পায়। কিন্তু যদি কখনো পেয়ে যায় তাহলে তুই কিন্তু খুব সাহসী মানুষ হবি। খুব ভালো মানুষ হবি। খুব হৃদয়বান মানুষ হবি।

হব।

হৃদয়বান আর দয়ালু।

হব বাবা।

কেউ যেন বলতে না পারে জহুর তার ছেলেটাকে জংলি একটা ছেলে বানিয়েছে। নিষ্ঠুর একটা ছেলে বানিয়েছে।

বুলবুল বলল, বলবে না বাবা।

জহুর তখন বুলবুলের হাত ধরে বলল, তুই এখন যা বাবা।

বুলবুল চোখ মুছে বলল, আমি যেতে চাই না।

তোকে যেতে হবে। আমি চাই না আমি যখন মারা যাই তখন তুই থাকিস। আমি চাই–

কী চাও বাবা?

আমি চাই তুই আমাকে জীবন্ত মানুষ হিসেবে মনে রাখিস।

বুলবুল তখন তার বাবার গলায় বুকে নিজের মুখ স্পর্শ করে বিদায় নিয়ে নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়েছে, তারপর একবারও পেছনে না তাকিয়ে উড়ে গেছে। বুলবুলের এখনো সেই মুহূর্তটির কথা মনে পড়ে। সাত বছর আগের ঘটনা, কিন্তু তার মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা।

বুলবুল নদীর তীরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর দুই পাখা বিস্তৃত করে ধীরে ধীরে আকাশে উড়ে যায়। ঘুরে ঘুরে সে উপরে উঠতে থাকে, নিচের বনভূমি ছোট হয়ে আসে, বহুঁ দূরের সমুদ্রতট আবছাভাবে ভেসে ওঠে, বাতাসে এক ধরনের হিমেল স্পর্শ পায়, তবুও সে থামে না, সে উপরে উঠতেই থাকে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে মেঘ ভেদ করে সে আকাশে উড়ে যাবে, আকাশের অন্য পাশে কী আছে সে দেখবে।

সন্ধ্যে হওয়ার আগেই সে তার ঘরটাতে ফিরে আসে। বিশাল গাছের ডালগুলোর ওপর তৈরি করা ছবির মতো ঘর। কাঠের মেঝেতে শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি বিছানা। বুলবুল সেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার বাঁশিটা বাজায়। বুনো একটা গাছের নল কেটে সে একটা বাঁশি তৈরি করেছে, ফু দিলে মধুর এক ধরনের শব্দ বের হয়। বুলবুল শুয়ে শুয়ে সেই বাঁশিতে সুর তোলার চেষ্টা করে। প্রচলিত কোনো সুর নয়—অনেকটা কান্নার মতো বিচিত্র এক ধরনের সুর। তার ছোট কাঠের ঘরের ফাঁক ফোকরে বসে থাকা পাখিগুলো গুটিশুটি মেরে বসে বসে বুলবুলের বাঁশির সুর শোনে।

 

ঠিক এভাবে বুলবুলের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল, বৈচিত্র্যহীন একঘেয়ে জীবন নয়, অত্যন্ত বিচিত্র এবং চমকপ্রদ একটা জীবন। কিন্তু প্রতিটা দিনই ছিল। একই রকম বিচিত্র এবং একই রকম চমকপ্রদ। বুলবুলের মাঝে মাঝে মনে হতো, জীবনটা কি একটু অন্য রকম হতে পারে না?

সে জানত না, সত্যি সত্যি তার জীবনটা একটু অন্য রকম হয়ে যাবে তার নিজের অজান্তেই।