বৃহস্পতিবার আঠাশে মে :
অ্যালিয়িস স্টোচর (১৯৩০-১৯৫৩)
ঈশ্বরকে আমরা বিশ্বাস করি…।
ব্লুমেন স্ট্রাচের সমাধির মূল ফলকটার দিকে মাৰ্টেল, ক্লেয়ার আর একটা বুড়ো তাকিয়েছিল। মার্টেল ভাবল এই অ্যালিয়িস লোকটা আবার কে? বুড়োটাকে ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল এই লোকটা কি এখানে কবর দেখতে এসেছিল?
বুড়ো মার্টেলের কথায় সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো। তাহলে বই বিক্রেতা আর বুড়োটা একই কথা বলছে। দিন জিজ্ঞেস করাতেও বলল শনিবার, বই বিক্রেতাও ঐ একই কথা বলেছে। কিন্তু ওয়ার্নারের সঙ্গে অ্যালিয়িসের সম্পর্ক কিরকম ছিল? অ্যালিয়িসের মৃত্যুর সময়টা জানা গেল ফরাসী অধিকারের শেষের দিকে।
ক্লেয়ার এতক্ষণ চুপচাপই ছিল। হঠাৎ ও জিজ্ঞেস করল, আর কে এসেছিল ওর সঙ্গে? লোকটা চুপ করে থাকাতে ক্লেয়ার ওকে অর্থের লোভ দেখিয়ে বলল খোলাখুলি সব কিছু জানালে ওর উপকারই হবে।
তখন লোকটা বলল বেশ খানিক পর, একজন মহিলা এখানে এসেছিল এবং তাকে ও চেনে না, তবে ও প্রতি সপ্তাহে বুধবার আটটা নাগাদ ঘোড়ার গাড়িতে করে এসে কবরে ফুল দিয়ে আবার ঐ গাড়িতেই ফিরে যায়।
এরপরে ওরা মহিলাটির পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ জেনে নিলো। এবং লোকটা যেন দ্রুত কুয়াশার সঙ্গে মিশে গেল।
–তুমি কি লোকটাকে দেখেছো?
মার্টেলের সঙ্গে যে বই বিক্রেতা কথা বলেছিল সেই আবার এডুইন ভিনজ-এর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে থমকে গেল। তারপর অস্বীকার করল। এডুইন তাকে পুলিশের লোক নয় বলে অভয় দিলেও লোকটা একই কথা বলল যে, ওরকম কোন লোক তার দোকানে কোনদিন আসেনি। অগত্যা বিফল হয়ে ভিনজ গাড়ি নিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হলো। বিক্রেটি অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল আর ভাবল একটু আগে যে লোকটা তার দোকানে এসেছিল, ও তাকে খুঁজছে। কিন্তু বিক্রেতা লোকটির সতর্ক চোখ দেখে ফেলেছে, ওর কোটের পকেটে ব্যাজ আছে। বুঝল নয়াজীর লোক। এবার যদি আসে পুলিশ ডাকা ছাড়া কোন উপায় নেই।
***
সুন্দর বিকেল। ভিনজ রেল স্টেশনে দুজনকে ভালভাবে লক্ষ্য রাখতে বলল। বাকীরা সবাই গাড়িতে করে খুঁজবে। ভিনজের লোকেরা সমস্ত হোটেলে হানা দিয়েছে, কোন খোঁজ মেলেনি। এদিকে ভিনজের দুজন লোক সতর্ক দৃষ্টিতে গ্যালাসট্রাসেতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল। ওদিক থেকে মার্টেল, ক্লেয়ারও সাবধানে গাড়িতে এগোচ্ছিল।
ঠিক স্টেশনের সামনেটায় এসে মার্টেল গাড়ি নিয়ে নিচে নেমে গেল। হঠাৎ ক্লেয়ারের পেছনের দিকে লক্ষ্য পড়তে বলে উঠল, কেইথ, আমাদের ঠিক পেছনেই বি. এম. ডবলু। একজনের পকেটে ডেলটা ব্যাজ দেখছি।
মার্টেল মাথা না ঘুরিয়েই ফিসফিসিয়ে বলল, শোন স্পীড বাড়িও না বা ওদের দিকে তাকিও না। কোনরকম পরিবর্তন যেন ওদের চোখে না পড়ে।
ভিনজ ওর স্কোয়াডের প্রতিটা লোককে মার্টেলের নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে রেখেছে। সুতরাং ওকে চিনতে কারোর কোন অসুবিধা হবে না। বি. এম. ডবলুর সামনের লোকটার হাতে রিভালবার।
এখন এই জায়গাটা খুবই শান্ত। ক্লেয়ার খুব সন্তর্পণে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কোলের ওপর ম্যাপ নিয়ে মার্টেল মনযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে ক্লেয়ারকে বলল, ঘাবড়াবার কিছু নেই। ইতিমধ্যে পাশ দিয়ে স্কোয়াডের লোকেদের গাড়িটা ওদের অতিক্রম করে গেল। মনে হল ওরা কোনরকমভাবে টের পায়নি। মার্টেল ক্লেয়ারকে বলল গাড়িটা যেন কোন মতেই লেক বা স্টেশনের সামনে না যায়। মার্টেল ভাবতে লাগলো বি. এম. ডবলুর লোকেরা কিভাবে এখানে চলে এল এবং ওরাই যে ডেলটা সে বিষয়ে কোন সন্দেহই রইল না।
ম্যাপটা কোলের ওপর থেকে তুলতেই ক্লেয়ার দেখল যে মার্টেলের কোলের ওপর ম্যাপের নীচে ৪৫ কোল্ট রিভলভারটা রাখা আছে।
মার্টেল মৃদু হেসে ক্লেয়ারকে বলল, ওরা টের পাওয়া মাত্রই আমি ওদের দুজনের খুলি উড়িয়ে দিতাম।
মার্টেলের মাথায় লম্বা টুপি, দাঁতের মধ্যে চেপে ধরা সিগার পাইপ, চোখে চশুমা এসব পড়ে ওকে বেশ অদ্ভুতই দেখাচ্ছিল। অন্য সময় এরকম দেখায় না।
যাইহোক, এবার ওরা সীমান্তের দিকে এগোতে লাগলো। এখন ওদের গন্তব্যস্থল লিন্ডাউ।
***
বিকেল পেরিয়ে গেছে, ব্রেজেঞ্জ থেকে ভিনজ দিয়েত্রিচকে ফোন করলো। সারা শরীরে ক্লান্তি, অবসন্নতা।
ভিনজ ম্যানফ্রেড লোকটাকে এত ভয় পায় যে কোনমতে এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে। ওদিক থেকে ফোনে দিয়েত্রিচের গলা ভেসে এলো।
সমস্ত ব্যাপার ভিনজ রিপোর্ট করে জানালো যে, কাজটা খুবই শক্ত। সম্ভবতঃ ইংরেজটা এখানে নেই।
দিয়েত্রিচ কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠল। বলল, হতেই পারে না, ওখানেই আছে। ব্রেজেঞ্জ ছোট্ট শহর, ভাল করে খোঁজ।
ভিনজ জানালো, শহরটা খুব একটা ছোট্ট নয়। তার ওপর সারা শহরটা কুয়াশায় ঢাকা, কাছের লোককেও চেনা যাচ্ছে না।
আরও কিছু কথাবার্তার পর ভিনজ ফোন ছাড়লো। সারাদিন কিছু খেতেও সময় পায়নি, খিদেতে পেট জ্বলে যাচ্ছে, ওদিকে দিয়েত্রিচ ওদের সবাইকে গালিগালাজ করে ফিরে আসতে বলেছে।
ভিনজ ভাবল ওয়ার্নারের থেকেও গুপ্তচর হিসেবে মার্টেল আরও বেশী সুচতুর। কিন্তু ধরা ওকে আমার হাতে পড়তেই হবে, ভুল ওকে করতেই হবে। ছদিনের মাথায় সামিট এক্সপ্রেস ব্যাভেরিয়া অতিক্রম করবে। আর সেদিনই মার্টেল ধরা পড়বেই…পড়বে…।
দিয়েত্রিচের এস্টেটের দেওয়ালের বাইরের ঠিক সামনেটায় ছোট একটা জঙ্গল আছে। এস্টেটে ঢোকার মুখে লোহার গেট।
গেটের ভেতর একটা জার্মান শেফার্ড কুকুরকে দেখা গেল মাঝে মাঝেই চীৎকার করছে। যেন অচেনা কাউকে দেখলেই ছিঁড়ে খাবে, টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
দূরের একটা গাছের নীচে একটা মার্সিডিস দাঁড়িয়ে আছে যার মালিক বি. এন. ডি-র চীফ এরিখ স্টোলার। তেতাল্লিশ বছরের লম্বা এরিখের অনুভব ক্ষমতা প্রচণ্ড রকমের তীক্ষ্ণ।
ওর পাশে বসে ওর চীফ অ্যাসিস্ট্যান্ট অটো ওয়াইল্ড। হাতে ছোট আকারের, টেলিলেন্স লাগানো একটা সিনে ক্যামেরা, কুকুরটার চেঁচানিতে ভয় পেয়ে চীফের দিকে তাকালে স্টোলার নির্বিকার চিত্তে গ্যাস পিস্তলটা বের করে ওর হাতে দিয়ে মৃদু হেসে বলল, তেমন দেখলে টিয়ার গ্যাস ছুঁড়বে। কুত্তাটার নাকে লাগলেই…।
–ওরা তো জানে আমরা এখানে, ওদের উচিত আমাদেরকে…।
–বোকার মত কথা বোলনা।
ওরা দিয়েত্রিচের লোহার গেটটার দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর ওদের চোখে পড়ল তিনটে গাড়ি আসছে, যার প্রথমটায় এডুইন ভিনজ। সমস্ত ব্যাপারটা অটোর ক্যামেরায় উঠে যাচ্ছে।
স্টোলার এই জায়গায় প্রথম এলো। বোঝা যাচ্ছে ভিনজ মার্টেলের সাক্ষাৎ পায়নি। স্টোলার সর্ব শক্তি দিয়ে ডেলটার মূল বস-কে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ডেলটার হেডকোয়ার্টার এখানে কোথায় আছে?
–এরকম কেন মনে হল? অটো স্টোলারের প্রশ্নের জবাবে বলে উঠল।
কারণটা আর কিছুই নয়। রেইহার্ড দিয়েত্রিচ তত ব্যাভেরিয়ার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবার জন্যে নির্বাচনে দাঁড়াবে। এই যে এস্টেট–এটা একটা বিরাট…।
–আমি তো তোমাকে ম্যাপ দেখিয়েছি।
এরপর কথাবার্তা বলতে বলতে ওরা দেখল সে গেট খুলছে।
স্টোলার গাড়িটা চালিয়ে এবারে সামনের দিকে এগোলো। কুকুরটা রাস্তায় বেরিয়ে এসে একটা অচিহ্নিত পুলিশের গাড়ির পিছু নিল। স্টোলারের গাড়ির সামনে এসে একটা কুকুর জানলাতে আঁচড়াতে লাগল। এদিকে গাড়িতে করে অন্য দুটো কুকুর ওদের অনুসরণ করছে।
দিয়েত্রিচের ব্যাপারটা কেমন যেন মনে হল। কুকুর গার্ড দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেখে স্টোলার অটোকে বলল, দেখেছো কুকুরগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে ঐ–মানে উইন্ডসাফার।
যাইহোক ওরা সতর্কভাবে দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। ব্যাভেরিয়ার সবচেয়ে দ্রুত ড্রাইভার স্টোলারকে বলা চলে। ও এবার বলে উঠল, গ্যাস পিস্তলের দরকার হতে পারে। আমি রাস্তাটা বন্ধ করে দেবো।
স্টোলার সামনে একটা ফার্ম দেখে ব্রেক কষে দ্রুত পেছোতে লাগল। ওর উদ্দেশ্য গাড়িটা দিয়ে জায়গাটা আটকে রাখা। গ্যাস পিস্তলটা ওয়াইল্ডের হাতে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে একটা গাছের গুঁড়ির পাশে আত্মগোপন করল।
ওয়ার্নার হেগেনের গাড়িটা কাছাকাছি এল, সঙ্গে আরো দুজন। হেগেন একটা খালি মার্সিডিস দেখে গাড়িটা থামিয়ে দুজনকে অপেক্ষা করতে বলে ও বন্দুক নিয়ে এগিয়ে গেল।
দরজাটা খুলে সতর্কভাবে ভেতরে তাকালো হেগেন। পেছনের লোকটা তখন জানলা দিয়ে কি ঘটছে দেখছিল। স্টোলার গাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে গ্যাস পিস্তল তাক করা। হঠাৎ ড্রাইভারের সীটের কাছে একটা মিসাইল সশব্দে ফাটলো। হেগেনের হাত থেকে বন্দুকটা পড়ে গেল। চারিদিকে ধোঁয়ায় কেউই কিছু দেখতে পাচ্ছিল না।
স্টোলার এরপরে আবার তৈরী হয়ে নিল। দ্বিতীয় মিসাইলটা জানলা দিয়ে ঢুকে একেবারে গাড়ির ভেতর ফাটলো।
স্টোলার নিজের সীটে ফিরে এল।
দ্রুত গাড়ি চালিয়ে অদৃশ্য হল আর কোন গাড়িই ওকে অনুসরণ করছিল না।
ওয়াইল্ড বলল, কি ব্যাপার?
–আমি মার্টেলের কথা চিন্তা করছি, টুইড আমাকে বলেছে যে ও ফিরে আসছে।
–ওয়ার্নারের মতো? সহযোগিতা করছে না?
-আরে না, ঠিক তার উল্টোটাই, প্রয়োজন বোধ করলেই ও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তবে আমি ভাবছি, ঠিক এই মুহূর্তে ও এখন কোথায় আছে?
***
বৃহস্পতিবার, আঠাশে মেঃ
মার্টেল একটা গাড়ি ভাড়া করে ব্যাভেরিয়ার মূল এলাকা ধরে ছুটে চলেছে লিন্ডা দ্বীপের উদ্দেশ্যে।
এখন ওর আর ছদ্মবেশ নেই। মাথায় টুপী নেই। হোল্ডারের সিগারেটে টান দিতে দিতে ভাবছে লিন্ডাউ-এ নিশ্চয় ওর ওপরে কেউ নজর রেখেছে।
–ক্লেয়ার ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কি করছ ভেবে দেখছ তো? জার্মানীর সীমান্ত সবেমাত্র ওরা অতিক্রম করেছে।
মার্টেল বলল, বৃটিশ ফ্ল্যাগ দেখা যাচ্ছে, ইউনিয়ন জ্যাক থাকলে আমার সুবিধা হতো।
–ডেলটার নজরে আমরা পড়ে যেতে পারি।
ক্লেয়ারের কথায় মার্টেল জবাব দিল, মনে হয় তাড়াতাড়িই পড়বো।
–তুমি নিজে থেকেই ওদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে তাই না? পাগল-টাগল হয়ে গেছো বোধহয়, তুমি কি জুরিখ, সেন্ট গ্যালেনের কথা ভুলে গেছো? ক্লেয়ার একটু জোর দিয়েই কথাটা বলল।
–আমাকে ওদের তো মনে আছে। আর একটা কথা, আমাদের একটা নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে কাজটা করতে হবে। তুমি বলেছিলে না বেয়ারিশ্চার হোটেল এই দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে ভাল?
–হ্যাঁ। এরপরে হাউপ্টব্যানহফ…।
আমরা ট্রেনেই পৌঁছবো, কিন্তু হোটেলে আমরা আলাদাভাবে নাম রেজিস্ট্রি করবো। আলাদা থাকব, আলাদা খাবো, যেন কেউ কাউকে চিনি না। এরকম ভাবেই তুমি আমাকে গার্ড দিতে পারবে। আর তুমি ওখানে সবসময় তোমার কালো চশমাটা পড়ে থাকবে। ওটায় তোমায় অন্যরকম দেখাবে।
ওরা গাড়িতে করে লেকের কিনারায় এসে পৌঁছলো।
কুয়াশা সরে গিয়ে সূর্য উঁকি মারছে, ক্লেয়ার ম্যাপটা একবার দেখে নিল। কিছুদূরে বিরাট হোটল।
ওরা এখান থেকে ছাড়াছাড়ি হবার সিদ্ধান্ত নিল। ট্যুরিস্টদের একটা জায়গায় ওরা গোপনে দেখা করার ব্যাপারটা ঠিক করলো।
এরপর ওরা দুজন আলাদা হয়ে গেল। রাস্তার একধারে এক শিল্পী বসেছিল, তার নাম ব্রাউন।
মার্টেলকে চিনতে পেরে পেছনে অনুসরণ করলো ওর গাড়িটা।
***
ব্রাউন আজকে ভেরোনার অ্যাম্ফিথিয়েটারের ছবি এঁকেছিল। সামনের ছোট একটা কার্ডবোর্ড বাক্স, তাতে পয়সা রয়েছে। আসল কাজ হল হাউস্টব্যানহফের সামনের দরজায় নজর রাখা। মার্টেলও ওকে দেখেই চিনতে পেরেছিল। সুইজারল্যান্ড থেকে মেন লাইনে এক্সপ্রেস আসতে তখনও বাকী।
শিল্পী ব্রাউন ওকে দেখে প্রথমে থতমত খেয়ে তারপর ভাবল, ঠিক আছে।
গাড়ি দুটো পাশাপাশি চলছিল।
মার্টেল এবার বলে উঠল, কি ব্যাপার বলো তো? বড্ড কৌতূহলী।
মার্টেলের রিভালভারও তখন প্রস্তুত।কাঁচের আয়নায় ও ব্রাউনের কাজকর্ম লক্ষ্য করে যাচ্ছে।
বেশ খানিক পরে গাড়ি থেকে নেমে মার্টেল হোটেলের মধ্যে ঢুকে গেল। মার্টেল কাউন্টারের মেয়েটার কাছে লেকের দিকে ডাবল বেড চাইল এবং সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল।
মার্টেল নির্দিষ্ট ফরমে, পেশার জায়গায় কনসালট্যান্ট–বলে লিখলো। এরপরে ওপরে উঠে বারান্দায় উঁকি মারতে দেখল স্টেশন থেকে ক্লেয়ার বেরিয়ে আসছে।
অদ্ভুত জমকালো পোষাকে ক্লেয়ারকে দারুণ দেখাচ্ছে। সেই শিল্পী ওকে দেখতে পাবেনা। হাউপ্টব্যানহফে ক্লেয়ার সামান্য অপেক্ষা করে একজনকে জার্মানভাষায় হোটেলটা কোথায় জিজ্ঞেস করল। লোকটার সঙ্গে স্ত্রী ছিল।
সে জায়গাটা দেখিয়ে দিল। এদিকে মাৰ্টেল নিজের কাজ ঠিকঠাক করে যাচ্ছে।
ব্রাউন মার্টেলের গাড়ির নাম্বারটা টুকতেই ব্যস্ত।
–এই যে হারামজাদা কি হচ্ছে? মার্টেল ওকে লক্ষ্য করে বলে উঠল। কাপড়ে মোড়া ছোট্ট একটা যন্ত্র নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। একেবারে নীচে এসে লক্ষ্য করলো ক্লেয়ারের সবকিছু করা হয়ে গেছে। ক্লেয়ার উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে এসে দেখল ব্রাউন রাস্তা পেরোচ্ছে।
মার্টেল পাবলিক বুথের দিকে এগিয়ে গেল। একটা হলঘরে সারি সারি ফোন রাখা আছে। মার্টেলের আগে ব্রাউন ঢুকে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
মার্টেল খানিকটা থেমে ডায়ালটা তুললো।
হঠাৎ একটা গোলমাল। মার্টেল একটা বুথে ঢুকে শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে লোকটা চমকে গেল।
মার্টেলের মনে হল ঐ শিল্পী বেশ চালাক-চতুর। মার্টেল ডায়াল করলো কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে ভুল সিগন্যাল আসতে বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিল। কি ঘটছে এ-ব্যাপারে মার্টেল স্থির নিশ্চিত। পরের বুথে ঢুকলো। লোকটাও নিজের কর্তব্যে অটল।
মার্টেল একহাতে ফোন আর অন্য হাতে একটা যন্ত্র কোমর সমান কাঁচের জানলায় চাপ দিতে ওটা স্থিরভাবে বসে গেল। এরপরে হিয়ারিং এড–ঢুকিয়ে একটা তার এমনভাবে লাগালো যাতে লুকিয়ে রাখা যায়।
শিল্পীটার হাতে তখন মামুলি ক্যালিবার। যাই হোক মার্টেলের যন্ত্রটা যে ভালই কাজ করছিল সেটা বোঝা গেল পরের বুথের সমস্ত কথাবার্তা ও শুনতে পাচ্ছিল। অবশ্য ফোনের অপর প্রান্তের কণ্ঠস্বর বোঝা যাচ্ছিল না।
শিল্পী বলল, এডগার ব্রাউন কথা বলছি, ক্লারা…।
হঠাৎ পরের বুথে মার্টেলের উপস্থিতিতে লোকটা কথাবার্তার ভারসাম্য হারিয়ে যা পারলে বলে যেতে লাগলো, যেমনঃ জিনিসটা নিরাপদে বৈরিশ্চার হফ হোটেলে কয়েক মিনিট আগে : দিয়ে আসা…।
–ঠিক কোথায়? ক্লারা নিস্পৃহ স্বরে জিজ্ঞেস করল অপর প্রান্তে।
–ঐ হাউপ্ট ব্যানহফ আর হারবারের মুখোমুখি। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা…। আচ্ছা আমি কি ডিউটি করবো?
-হ্যাঁ। তোমার ব্যাপারটা আমি রিপোর্ট…।
–শোনো…।
–ইতিমধ্যে সংযোগ ছিন্ন হল। মার্টেল জিনিপত্রগুলো লুকিয়ে ফেলেছে। ব্রাউনের কণ্ঠস্বর এবার খানিকটা পাল্টে গেছে। মার্টেল এবার স্থির নিশ্চিত যে স্টোলারের ব্যাপারে সে ভালরকম তথ্য পেয়ে গেছে।
**৮
দিয়েত্রিচের হেডকোয়ার্টার থেকে মাইল খানেকের মত দূরত্বে এগাবরাতলা একটা বিল্ডিং। তারই একটা অ্যাপার্টমেন্টেক্লারা সবেমাত্র ফোনটা নামিয়ে রেখেছে। সিগারেট ধরিয়ে নিজের মনেই বললো, ব্রাউনটা যে কি করবে…।
এবারে রেইনহার্ড দিয়েচিকে ফোন করল। ক্লারার সৌন্দর্য দিয়েত্রিচের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। খানিক পরে ও দিয়েত্রিচকে স্কলস-এর নাম্বারে ফোন করলে, ওপ্রান্ত থেকে দিয়েত্রিচের উচ্ছলকণ্ঠস্বর ভেসে এলো। কিছু মামুলি কথা হবার পর ক্লারা বলে উঠল, দ্বিতীয় চুক্তি দেওয়া হয়েছে, আমি শুনেছি। লিন্ডাউ-এর হোটেলে বৈরিশ্চারে…। দিয়েত্রিচ বলল, আজ সন্ধ্যেবেলা ওখানে আমার সঙ্গে দেখা করবে। জেটে করে একেবারে লিন্ডাউ-এর কাছে এয়ার স্ট্রিপে নামবে। ওখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে হোটেলে ঘর ঠিক করা থাকবে, ওখানে উঠবে। তোমার সাহায্য প্রয়োজনে লাগতে পারে,বলে দিয়েত্রিচ একটা গাড়ির রেজিস্ট্রেশান নাম্বার দুবার পুনরাবৃত্তি করল, তারপর উভয়েই ফোন রেখে দিলো। কেইথ মার্টেলের ব্যাপারেও ক্লারা দিয়েত্রিচকে অবগত করল।
খানিক পরে ও শোবার ঘরে এসে একেবারে নগ্ন হয়ে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে ভাবলো, এতেই প্রলোভিত করা যাবে মার্টেলকে আর দিয়েত্রিচের ব্যাপারটা মেনে নিতে আপত্তি নেই। এবারে শুয়ে পড়লে, চোখের সামনে ভাসতে লাগলো নিজের কাজের পরিকল্পনা। একটা ইনজেশানের সূচ। ওটাকেই ধীরে ধীরে…।
***
এদিকে দিয়েত্রিচ সারারাত কাটাবার জন্যে একটা বড় গোছের স্যুটকেশ নিয়ে আসতে বলল, ওর দেওয়ালের মধ্যে খোপে নানারকম আকারের সুটকেশ রয়েছে। ও ইন্টারকমে সদ্য ব্রেজেঞ্জ প্রত্যাগত ভিনজকে ডেকে পাঠালো।
শোন ভিনজ তোমার কাজ একটা মেয়ে করছে। আমি এই মুহূর্তে লিন্ডাউ-এর বৈরিশ্চার হোটেলে যাচ্ছি। ওখানেই মাৰ্টেল সদ্য উঠেছে। তুমি উপযুক্ত লোক সঙ্গে নিয়ে এই হোটেলে চলে এসো।
–আমরা এবার ওকে নিশ্চয়ই পাবো। ভিনজ বলল।
দিয়েত্রিচ তার সৌখিন মার্সিডিসে চড়ে ড্রাইভারকে বলল, ঝড়ের মতো লিন্ডাউ-এর দিকে চলো।
***
লিন্ডাউ-এর হাউপ্টব্যানহফের হোটেল। মার্টেল একটা ফোন বুথের বাইরে খানিকক্ষণ থামল। একটা সিগারেট ধরালো।
ব্রাউন ইতিমধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। মার্টেল অপেক্ষা করতে লাগল যদি জার্মানটাকে আবার দেখতে পায়। কিন্তু না ব্রাউনকে আর দেখা গেল না।
মার্টেল দ্রুত বাইরে এগিয়ে এলো। ব্রাউনকে এবার দেখা গেল। মার্টেল দ্রুত একটা গাড়িতে উঠে বললো পোস্ট অফিস। তাড়াতাড়ি…।
পোস্ট অপিসে পৌঁছেই ফোনের কাউন্টারে গিয়ে টুইডকে ফোন করল।
টুইডকে পাওয়াও গেল। এরপরে মার্টেল কোড নাম্বারে কাজ এগোতে লাগল। বাক্যগুলো এইরকমঃ
ওয়ার্নারকে ব্রেজেঞ্জে দেখা গেছে–অ্যালিয়িস ষ্টোর-এর সমাধি-১৯৩০-১৯৫৩..ফরাসী অধিকারের সময়..বুধবার সকাল…সুবেশী রমণী…ওয়ার্নার ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল…সমস্ত জায়গাতেই ডেলটা সক্রিয়…ব্রেজেঞ্জের একটা গাড়িতে দুজন লোক…।
টুইড জিগ্যেস করলো, ওরা কি তোমায় দেখেছে? আবার কথা আরম্ভ হলো :
আমরা দেখেছি…এখন লিন্ডাউ-এর হোটেল বৈরিশ্চার..ব্রাউন পেভমেন্ট আর্টিস্ট। ডেলটার লোক…স্টোলার…স্টার্টগার্ট-এর ফোন নাম্বার..ক্লারা…।
হঠাৎ টুইড ওকে থামতে বলে ফোন নামিয়ে রাখলো। রেকর্ডিং মেশিনটা বন্ধ করে দিয়েছে। ম্যাকনেইল। মেয়েটা খুব চটপটে। জীবনে কখনও ট্যাক্সি নেয়নি।
টুইড ওকে বলল, শোন ম্যাকনেইল মার্টেল ভীষণ বিপদে পড়েছে। স্টোলারকে ফোনে তাড়াতাড়ি ডাক। ভীষণ জরুরী।
অকারণে তখন মেঘের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
***
বৃহস্পতিবার, আঠাশে মেঃ
মার্টেল আর ক্লেয়ারের মধ্যে সংকেতের ব্যাপারটা ঠিকঠাক রয়েছে। ওরা দুজনে ডাইনিং রুমে এমনভাবে ঢুকবে যেন কেউ কাউকে চেনেনা।
ক্লেয়ার জানে কেউ ঢুকলে সিগারেট ধরিয়ে সংকেত দিতে হবে। একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক হলে ঢুকলো।
দিয়েত্রিচ হলে ঢুকে বসলো মার্টেলের একেবারে বিপরীত দিকের জানলাটার কাছে। ঢুকেই গোঁফে হাত বুলোতে বুলোতে প্রতিটা টেবিলের প্রত্যেককে দেখতে লাগলো। ও আসার পরই হলের পরিবেশটা পাল্টে গেল। সুসজ্জিতা মহিলারা মিলিওনিয়ার ব্যক্তিটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। মার্টেল ভাবতে লাগল টাকার গ্লামারই সবচাইতে বেশি।
মিনিট দুয়েক বাদে ক্লেয়ার টেবিল ছেড়ে রিসেপশান হলে গেল। মার্টেল লাউঞ্জে একটা আর্মচেয়ারে বসে ম্যাগাজিন দেখতে লাগল। এখন শুধুই প্রতীক্ষা।
আর এক নতুন অতিথি কুলি সঙ্গে নিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। ক্লেয়ার কাউন্টারে কেম্পটন-এর ট্রেন কটায় জিজ্ঞেস করার ভান করে জেনে নিল, ঐ যে মেয়েটা এল, মনে হয় চেনা। ওকি থাকবে…?
–সম্ভবতঃ এটাই ওর প্রথম আসা…।
ক্লেয়ার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে মার্টেলের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওটা ফেলে দিল। হ্যান্ডব্যাগে পিস্তলটা নিরাপদেই আছে। মার্টেল কাগজটা কুড়িয়ে নিল। সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে ওরা খানিকক্ষণ ফিসফিস্ করে কথা বলে নিলো।
ক্লেয়ার বলল, ওই যে মেয়েটা এলো ওর নাম ক্লারা। স্টার্টগার্ট থেকে আসছে।
–হ্যায়নারা একে একে জড়ো হচ্ছে। ডাইনিং রুমের লোকটা কুখ্যাত দিয়েছি। তাইতো?
–হ্যাঁ। ওর ছবি আমি কাগজে দেখেছি।
এরপরে ব্যাগের ভেতরে পিস্তলটা এমনভাবে রাখলো যাতে তাড়াতাড়ি বের করা যায়। দুজন লোক রিসেপশানে এসে দাঁড়ালো। ক্লেয়ার চিনত, একজন এরউইন ভিনজ আর ওর সহকারীর গ্রস, সুটকেশ হাতে।
ক্লেয়ার পিস্তলটা বের করে কোলের ওপর কাগজের নীচে লুকিয়ে রাখলো। ব্রেজেঞ্জ গ্যালাস-স্ট্রাসেতে এই গ্ৰসই ডেলটার গাড়িটা চালাচ্ছিল।
এদিকে দুজনে লাউঞ্জের চারদিকে তাকাতে লাগল। গ্রস একবার মনে হল মার্টেলের দিকে তাকালো, কিন্তু ভিনজের সেদিকে দৃষ্টি নেই।
ওরা রেজিস্ট্রেশান ফরম পূরণ করছিল। ক্লেয়ার দেওয়ালে একটা ছবি দেখার ভান করে ওদের সমস্ত কথাবার্তা শুনতে লাগলো।
ঠিক সেই সময়ে দিয়েত্ৰিচ করিডরের দিকে এগোচ্ছিল। মুখে বড় সিগারেট লাউঞ্জের ওপর দিয়ে যাবার সময় ও মার্টেলের একেবারে সামনাসামনি এসে পৌঁছালো।
***
রেইনহার্ড দিয়েত্রিচ তোমার কোন কাজে লাগতে পারে। তুমিই…?
মার্টেল হঠাৎ দেখল বিরাট হাত করমর্দনের ভঙ্গিতে ওরই দিকে এগিয়ে এসেছে। মার্টেল উপেক্ষা করে সিগারেট ধরালো।
দিয়েত্রিচ গায়ে মাখলো না। ওর হাতের কাছে ওয়েটার এক গ্লাস পানীয় রেখে গেল।
–তুমি ইংরেজ?
–হ্যাঁ, আমি ইংরেজ।
–আচ্ছা! আমাদের সুন্দর ব্যাভেরিয়াতে ছুটি কাটানো হচ্ছে নিশ্চয়ই?
মার্টেল এবার সেই বিখ্যাত শিল্পপতির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে খানিকটা অধৈর্যের ভঙ্গিতে বলে উঠলো, তুমি তো একজন নাজী। এই নাজীদের পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
যদি না পৃথিবীটার উত্তরাধিকার পাই। সামনের স্টেট ইলেকশানে নিশ্চিত যে টফলার জিতছেনা। জার্মানীর মতো বড় রাষ্ট্রে কমিউনিস্টপ্রভাব কেমন লাগবে? পশ্চিমের মূল কাজ হলো ওদের একেবারে শেষ করে দেওয়া…সোভিয়েট বিপক্ষে।
–আমি কমিউনিস্ট আর নাজীদের পার্থক্য দেখতে পাইনা। ওরা দুজনেই সমান। এক নায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী। দুজনেরই গুপ্ত পুলিশ বাহিনী কে. জে. বি নয়তো গেষ্টপো। এরা অপরিবর্তনীয়। এদের সিস্টেমটাই তাই। আমি চ্যান্সেলার ল্যাংগের পাটকেই বরং পছন্দ করি। আর এখন যদি কিছু না মনে করো…।
–নাও একটা সিগার। এগুলো হাভানার।
–কিউবার? মার্টেল উঠে দাঁড়ালোকঠিন মুখভঙ্গীতে জার্মানটার দিকে তাকালো,বলে উঠল, ধন্যবাদ। কিন্তু আমি শুধু সিগারেটই খাই। যাই হোক আলাপ হয়ে ভাল লাগল। শুভরাত্রি।
বলে ও এগিয়ে গেল। দিয়েত্রিচ অসন্তুষ্টির দৃষ্টিতে একভাবে তাকিয়ে রইল ওর যাওয়ার দিকে।
মার্টেল লিফটের সামনে পৌঁছতেই রিসেপশনিস্টের সঙ্গে যে মেয়েটা কথা বলছিল সে দৌড়ে গিয়ে হঠাৎই লিফটে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল, দিয়েত্রিচের চোখের সামনে।
***
চারতলাটা একেবারে খাঁ খাঁ করছে। লিফট থেকে মার্টেল আর ক্লেয়ার বেরোলো। মার্টেল ক্লেয়ারকে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে গেল। বাথরুমটা ভালভাবে দেখে নিল। পর্দাগুলো সমস্ত জানলায় টেনে দিল।
আধো অন্ধকারময় আলোর পরিবেশে ক্লেয়ার বলতে শুরু করল
–আমি, ঐ দুজন যখন রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করছিল তখন ওদের চিনেছিলাম একজন ভিন আর একজন ওর সহকারী ব্রেজেঞ্জ…।
–আমি জানি…। ওরা পেশাদার খুনী। আমার আশার চেয়েও দ্রুত কাজ হচ্ছে। দিয়েত্রিচ দেখতে এসেছে সেন্ট গ্যালেন, ব্রেজেঞ্জ আর জুরিখের মত এখানেও ওর সাকরেদরা আমাকে সরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয় কিনা। কাজটা সারবে ভিনজ আর গ্রস। ক্লারা পেছনে আছে।
ক্লেয়ার বলল, ঐ মহিলাকে ভাল করে নজর রাখা প্রয়োজন..। আচ্ছা দিয়েত্রিচ কি আজ রাতে কিছু করতে পারে?
না। কারণ ও নিজেও এই হোটেলে আছে। এরকম ঝুঁকি ও নেবেনা। আজ রাতে আমরা রিভালবার হাতে পালা করে ঘুমবো।
একটু থেমে মার্টেল অবার বলল, প্রথমে আগামীকাল লিন্ডাউকে জলপুলিশের সার্জেন্ট ডরনারকে সব বলবো। এই লোকটাই ওয়ার্নারের দেহটা এনেছিল। দ্বিতীয়তঃ ডেলটার এখানে একটা ফাঁদ আছে।
ক্লেয়ার গম্ভীর মুখে বলে উঠলো, আমার যেন কেমন নার্ভাস লাগছে। দুটো খুনী,একটা ভয়ঙ্কর মেয়ে আর স্বয়ং দিয়েত্রিচ। আমার মনে হচ্ছে তুমি যা ভাবছে তা থেকেও দ্রুত গতিতে সবকিছু এগোচ্ছে।
অস্পষ্ট–আলোয় ক্লেয়ারের মুখটা ঝাপসা দেখাচ্ছিল।
***
বৃহস্পতিবার, আঠাশে মে :
ঠিক রাত এগারোট নাগাদ বোঝা গেল ক্লেয়ারের কথাই ঠিক। দিয়েত্রিচ বলা যায় আন্ডার এস্টিমেট করেছিল।
ঘরটা একেবারে অন্ধকার। মার্টেল পিস্তল হাতে বসে। কিছু একটা আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো।
জানলার পর্দা সরিয়ে নিচে তাকালো। দেখল একটা মার্সিডিস দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির সামনে একটা সোফার। হঠাৎ দিয়েত্রি হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চেপে বসতে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। বন্দরের দিক থেকে একটা গোঙানীর মত শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
মার্টেল সুটকেশটার কাছে এগোলো। একটা হালকা রেনকোট গায়ে চাপিয়ে নিল। ক্লেয়ারকে ডাকতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বলল, কেন কিছু ঘটেছে?
মার্টেল বলে উঠল, দিয়েত্রিচ আমাদের সঙ্গে চালাকি করছিল। এমন একটা ভাব দেখাচ্ছিল যেন আজ রাতে এখানে থাকবে কিন্তু এইমাত্র গাড়িতে বেরিয়ে গেল। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
–আমরা কি করবো? ক্লেয়ার জিজ্ঞেস করল।
আমাদের একমাত্র করণীয় হলো ওরা যেন মোটেই জানতে না পারে আমরা কোথায়?
–একটু থেমে মার্টেল বলল, যাও এবার শুতে যাও। কেউ যেন দেখতে না পায়।
ক্লেয়ার বলল, তুমি কি করবে?
মার্টেল বলল, আমি এখন স্থানীয় পুলিশ সার্জেন্ট ডরনারের সঙ্গে দেখা করব। লিন্ডাউতে একমাত্র এই লোকটাকেই বিশ্বাস করা চলে। চারিদিকে ঘন কুয়াশা নামছে। ক্লেয়ার শুতে গেল। মার্টেল দরজা খুললো।
***
রাতের অন্ধকারে মার্টেল বেরিয়ে এল। পাতলা কোট ভেদ করে মার্টেলের ঠাণ্ডা লাগছে। ও লুভউ ইগস্টাসের দিকে এগোতে লাগলো। এদিক দিয়ে সোজা গেলেই পুলিশ হেড কোয়ার্টার।
কোন কিছুই দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু একটা শব্দ বারবার ভেসে আসছিল। সোজা এগোতে থাকল।
রাবার সোলের জন্যে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটা সত্ত্বেও কোন আওয়াজ হচ্ছেনা। রিভালবারটা যথাস্থানে আছে। সারা রাস্তা জুড়ে এক থমথমে ভাব।
কিছু একটা শব্দ শুনে ওর মনে হল কেউ যেন ওর পেছনে আছে।
হাউপ্টব্যানহফে চরটা ছিল, কিন্তু ও ওদের কিছু কথা শুনতে পায়নি। হঠাৎ ওর যেন মনে হল মার্টেল বেরিয়ে যাচ্ছে।
মার্টেল এবার দাঁড়িয়ে গেল, শব্দটাও থেমে গেল। মার্টেল সমস্যায় পড়লো। নিশ্চয়ই ওকে কেউ অনুসরণ করছে। হঠাৎ মার্টেল চলতে আরম্ভ করলো। ওর যেন মনে হলো কুয়াশার মধ্যে আরো কিছু লোক ওকে অনুসরণ করছে। ডেলটা সমস্ত কিছুই নিখুঁতভাবে করে থাকে। জুরিখের ব্যাপারটা ও ভোলেনি। রাস্তায় একটা লেখা চোখে পড়ল ক্ৰমডান্স্যাসে।
মার্টেল দ্রুত দরজার দিকে এগোতে লাগলো। মার্টেলের গুলি লোকটার মাথায় সজোরে লেগেছে। নোকটা পড়ে গেল।
মার্টেল এবার দৌড়ে গলিটা দিয়ে ঢুকে, ডানদিকে বাঁকলো। রাস্তার সামান্য আলোয় লেখাটা চোখে পড়তে দরজার সামনে গিয়ে দরজাটা দ্রুত খুলতেই একটা পুলিশ প্রহরী ওর দিকে কুঁচকে তাকালো।
কাউন্টারে গিয়ে ও একটা কার্ড সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। পিস্তলটা ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলো।
কাউন্টারের লোকটাকে বলল, সার্জেন্ট ডরনার তাড়াতাড়ি। বাড়িতে থাকলে বিছানা থেকে তুলে আনো। আমার চিহ্নটা দেখাও গিয়ে। ক্র্যাম্যাগসেতে দুটো লোক পাঠাও। ওখানে মৃতদেহটা আসার আগেই…।
***
উনত্রিশে মে,শুক্রবার :
বৈরিশ্চার হফে রুদ্ধদ্বার শলা-পরামর্শ করলো তিনজনে–কেইথ মাৰ্টেল, সার্জেন্ট ডরনার আর এরিখ স্টোলার।
এদিকে টুইউ তার ফ্লাটে সেন্ট গ্যালেন থেকে মার্টেলের পাঠানো রিপোর্টের টেপ পরীক্ষা করছিল। মোট পাঁচবার শুনল ওর রেকর্ডটা।
ক্লেয়ারের রিপোর্ট অনুযায়ী ওয়ার্নারের অপারেশন ক্রোকোডাইলের তিনটে দিক আছে।
সেদিনে আরও একটা ব্যাপার ঘটছিল। হাওয়ার্ডের প্যারিসে বিমানে করে যাবার কথা। ওখানে চারজন সিকিউরিটি চীফের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। কারণ একজন ভি, আই পি প্যারিস থেকে সামিট এসে ভিয়েনার দিকে যাবে। আর পাঁচদিন বাকি।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যাটলান্টিকের ওপর দিয়ে সোজা ওরাল এয়ারপোর্টে পৌঁছবে। তারপর সেখানে থেকে দ্রুত গতিতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে অন্যান্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।
রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যে আমেরিকান সিক্রেট সাভির্সের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান টিম ও’মিয়েরার ওপরে সমস্ত কিছু দায়িত্ব ন্যাস্ত করা হয়েছে। একে টুইড মাত্র একবারই দেখেছে। সাক্ষাৎকার সম্প্রতিই ঘটেছিল। চারনম্বর ভি. আই. পি হচ্ছে পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলার কার্ট ল্যাংগার। এর পরের দিন সকালেই থাকবার কথা।
ক্লারা বেক হাতে একটা বাইনোকুলার নিয়ে সীটে বসেছিল। ও কিন্তু একেবারেই ভোলেনি যে, মার্টেল ওর উপস্থিতির কথা সার্জেন্ট ডরনার আর স্টোলারকে আগের রাতেই জানিয়েছে।
মার্টেল ফোন করতেই ডরনার বলে উঠেছিল, আমার লোক আগেই জানিয়েছে ক্লারা বেক হোটেলে উঠেছে।
হু। মার্টেল বলেছিল।
এবারে স্টোলার বলেছিল, কেন?
কারণটা হচ্ছে ডেলটা ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি যে আমি জানি যে ক্লারা ওদের চেনে। ক্লারা এখানে আসার পরে দিয়েত্রিচ বা ভিনজ কিংবা রন্ড গ্রস কারোর সঙ্গেই ওর যোগাযোগ হয়নি। সুতরাং গুপ্তচর হিসেবে ঐ সবচাইতে উপযুক্ত। সকালবেলা আমি ওকে…।
সেই মতোই কাজ এগোচ্ছে। এখন মার্টেল ক্লারাকে ব্যবহার করতে চাইছে। ক্লেয়ার নির্দেশমত বাইনোকুলার দিয়ে চারিদিক দেখছিল। ক্লারাও তাই। এবার দুজনেরই বাইনোকুলার সরাসরি মার্টেলের দিকে এগোতে লাগলো।
ক্লেয়ার আপন মনেই বলে উঠলো, প্রিয়তম তুমি খুব তাড়াতাড়ি এগোচ্ছো।
ক্লেয়ার একসময় ওর জায়গা ছেড়ে বন্দরের সামনের জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ালো। চারিদিকে সূর্যের আলো ঝলমল করছে। ও বেকের সীটের একেবারে কাছাকাছি চলে এলো। ক্লারা তখন, উঠে বৈরিশ্চার হফের প্রবেশের মুখটায় এগিয়ে গেছে। মার্টেল তখন ওয়েটারের সঙ্গে কথা বলছিল। এদিকে বেক রাস্তায় পৌঁছে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়েছে। তারপরেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
হাউপ্টব্যানহফ। দ্রুত এগিয়ে সামনের একটা দরজা খুলেই ক্লেয়ার বাঁ দিকে তাকালো। বেক তখন টেলিফোন বুথে ফোন করতে ব্যস্ত। ক্লেয়ার একটা বইয়ের স্টলে বই উল্টে দেখতে লাগল।
***
ক্লারা তখন ভেতরে স্থানীয় একটা নম্বরেই ডায়াল করেছে। বারবার ও স্টেশনের সামনের দিকটায় তাকাচ্ছে। ওখানে কেউ নেই।
ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, হেগেন কথা বলছি…।
–ওয়ানবার, আমি ক্লারা।
–আমরা প্রস্তুত।
–মাল লঞ্চ ঠিকঠাক করে নিয়েছে। এবারে যাওয়ার পালা।
সংযোগ ছিন্ন করে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলো। ধীরে ধীরে হোটেলের দিকে এগোল।
সামনে পেভমেন্টে শিল্পীটার কাছে একবার থামলো, ভাবখানা এমন যেন ওর আঁকা ছবি দেখছে। কিন্তু ও ফিসফিস্ করে বলে গেল যা হলো, পুলিশের ওপর নজর রাখো। লঞ্চ নিয়ে আসছে।
সিগারেট ধরিয়ে ক্লারা লাউঞ্জের দিকে এগিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো। এবার দ্বিতীয় ইংরেজটারও শেষ হবার পালা।
লুডউইগস্ট্রাসেতে বন্দরের দিকে সার্জেন্ট ডরনার অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল।
আচমকাই একজন মহিলার সঙ্গে ওর ধাক্কা লাগলো। লাগতেই দুহাতে ও মহিলাটির কাঁধ দুটো ধরে চেঁচিয়ে বললো, কিছু মনে কোরনা। দোষ আমারই, দেখতে পাইনি। মহিলাটি ততক্ষণে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ও আর কেউ নয় স্বয়ং ক্লেয়ার হফার। ডরনারের পরনে সিভিলিয়ান ড্রেস।
এরপরে কানের কাছে ফিসফিস্ করে উঠলো, সমস্ত কিছু ঠিকঠাক আছে। এখন থেকে পনের মিনিটের মধ্যে দ্বীপটাকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এরপরেই ডরনার ক্লেয়ারকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল এবং ক্লেয়ারওঁ বন্দরের রাস্তায় যাবার জন্যে সোজা রাস্তা ধরলো। মার্টিন তখন লঞ্চ নিয়ে ব্যস্ত। বাঁধের সামনে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ও নামছিল লঞ্চের ভেতরে।
ক্লেয়ার একবার ডানদিকে তাকাতেই দেখতে পেল সেই শিল্পীব্রাউন পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লেয়ার তখন মাথায় একটা লাল রুমাল জড়িয়েছে।
মার্টেল লাল রুমালের সংকেত পেয়েই বুঝলো সবকিছু ঠিকঠাক জায়গাতেই আছে। একবার দেখলো সার্জেন্ট ডরনার যে দিকে একটা বিরাট লঞ্চ রয়েছে ঠিক সেই দিকে এগিয়ে চলেছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ও ক্লেয়ারকে লক্ষ্য করতে লাগল। ও তখন খোলামেলা গোছের স্নানের জায়গাটার দিকে এগোচ্ছিল। লেকের কাছে একটা পাঁচিলের আড়ালে স্নানের জায়গা।
পুলের কাছে পৌঁছে ও একটা ঘরে ঢুকলো। টিকিট আগেই কাটা ছিল। সেখানে সব কিছু খুলে ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে পিস্তলটাও রাখলো। তারপর ব্যাগটাকে কব্জির সঙ্গে একটা চামড়ার ফালি দিয়ে আটকাল।
এরপরে ঘরের মধ্যে ওর আর একটা ব্যাগ ফাঁকা অবস্থাতেই পড়ে রইল। দরজাটা বন্ধ করলো। ঘড়িটা দেখে নিল। তারপর বাইরে এসে ধীরে ধীরে সরোবরের দিকে এগিয়ে গেল। এবার ঝাঁপিয়ে পড়ার পালা।
এদিকে মার্টেল দড়ি বেয়ে লঞ্চের ভেতরকার হুইল ঘরের মধ্যে ঢুকছে। ঘড়িটা একবার দেখল। ও আগেই ডরনার আর. ক্লেয়ারের সঙ্গে ঘড়িটা মিলিয়ে নিয়ছে। আর দুমিনিট বাকি ও একটা সিগারেট ধরালো।
কোনস্ট্রাঞ্জ লেকের কুয়াশায় অস্টিন উপকুল মোটেই দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু এদিকে মাৰ্টেল, ডরনার আর স্টোলারের সঙ্গে পরিকল্পনা করে নিয়েছে।
এই মুহূর্তেই স্ট্যান্ড পোলিজির অফিস থেকে বি. এন. ভির, প্রধান ব্যক্তিটি অপারেশন নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে।
মার্টেল বন্দরের পূর্বদিকে তাকায়নি। দুটো লঞ্চ কাছি দিয়ে নোঙর করা। ঐ জলপুলিশের লঞ্চ দুটোর নেতৃত্বে আছে সার্জেন্ট ডরনার, ডেকের নীচে পোক বদলে ও দাঁড়িয়ে আছে। মার্টেল আবার ঘড়িটা দেখল। একটা নিঃশ্বাস ফেলে এগোতে লাগলো।
এদিকে স্ট্যান্ডপোলিজির অফিসের মধ্যে এরিখ স্টোলার জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। ট্যুরিস্টরা সব টেবিলে বসে খাচ্ছে। ওর ভারী টেবিলটার পেছনে একটা ট্রানস্কিভার। অপারেটরও আছে। চাবি কিন্তু স্টোলারের নিয়ন্ত্রণে।
ট্রানস্কিভারটা ব্যবহার করলে রাস্তা, ব্রীজের ওপরে পুলিশের গাড়িগুলো, রেলওয়ে এমব্যাকমেন্টের কাছে মূল রাস্তার গাড়িগুলোর খবরের ব্যাপারে সুবিধা হয়। এখন এটার যোগাযোগ সরাসরি একটা পুলিশ লঞ্চের সঙ্গে, যেখান থেকে ডরনার রিপোর্ট করল যে, মার্টেল এগিয়ে চলেছে।
উপকূল জায়গাটা বরাবর কুয়াশায় ঢাকা। পাঁচজন উইন্ড সারফার তীর ধরে এগোচ্ছিল। ওরা লিন্ডাউ আর ব্রেজেঞ্জের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। ওদের নেতা ওয়ার্নার হেগেন ওদের দিকেই আসছিল। ও ক্লারা বেকের একটা ফোনের জন্যে অপেক্ষা করছিল।
-ও লিন্ডাউ বন্দর ছাড়ছে।
ও নৌকোয় এগোতে এগোতে বলল, ধূসর রঙের। মার্টেল একা।
আর যারা নৌকো চালাচ্ছিল তাদের পরনে সাঁতারের পোষাক, প্রত্যেকের কজীতেই একটা করে বেল্ট আর তাতে ছুরি আটকানো। বাতাস শান্তভাবে বয়ে চলেছে।
ওদের পোষাকে একটা করে ব্যাজ আটকানো আছে। লিন্ডাউ বন্দর থেকে আধ মাইল দূরে। ওয়ার্নার হেগেনের নেতৃত্বে ঘাতক দলটা এগিয়ে চলেছে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এত কুয়াশার মধ্যেও তোমাকে দেখতে পেয়েছি তার জন্যে…।
ক্লেয়ার ততক্ষণে মাৰ্টেলের লঞ্চের ওপর বসে আছে। মার্টেল ওর চামড়ার থলিটা খুলে ওয়াটার প্রুফ ব্যাগটা পাশে রাখলো।
লঞ্চটা এখন দাঁড়িয়ে আছে। মার্টেল বন্দর থেকে ঠিকঠাকই এটাকে বের করে নিয়ে এসেছে।
বাতাস বয়ে চলেছে। আইনভঙ্গ করেনি কোনরকম। ক্লেয়ার বেশ খানিকটা পরিশ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ওরা কি আসবে?
–দেখা যাক্।
ক্লেয়ার ব্যাগ থেকে পোষাক আর ন মিলিমিটার পিস্তলটা বের করলো। বলে উঠলো, এটা পড়লে কি ভাল হবে…।
মার্টেল ওর নিজের ৪৫ কোল্টটা একবার দেখে নিয়ে কাঁধের আবরণীর মধ্যে রেখে দিলো।
ক্লেয়ার বলে উঠলো, পোষাকটা সিনথেটিক…।
মার্টেল তখন অন্য জগতে। ইঞ্জিন বন্ধ অবস্থায় লঞ্চটা ধীরে ধীরে হাওয়াতেই ভেসে চলেছে। ধূসর কুয়াশা আস্তে আস্তে ভেসে চলেছে।
ক্লেয়ার জিজ্ঞেস করল, তোমার কি মনে হয় ওরা আসবে?
–এইটাই তীরভূমি থেকে সবচেয়ে কম দূরত্বের। মিনিট খানেকের মধ্যে তুমি মুখোশটা পরে নাও, ওদের কেউ যাতে তোমাকে না চিনতে পারে।
আরে এটা? স্টাইল হাউসের ছোট চার্ট টেবিলের ওপরে যন্ত্রটা পড়ে ছিল। বেশ বড়ো। আবার বলল, এটা রাডার নাকি?
না। এটা একটা টেপ-রেকর্ড করা সিগন্যাল, যার দুটো ব্যাপার আছে। যখন আমি একটা বোতাম টিপবো তখন ওটা স্টোলারের হেড-কোয়ার্টারে সিগন্যাল দেবে, আর তখন ওরা বুঝবে আমরা বিপদে পড়েছি। আর সিগন্যালটা যখন অনবরত হবে তখন ডরনার পুলিশ লঞ্চ থেকে বুঝবে আমরা কোথায় আছি।
–বাঃ, চমৎকার ব্যাপার।
–কেননা ওয়ার্নার মারা যেতেই বুঝেছি আমাদের বিপক্ষ ব্যক্তি অতিরিক্ত বুদ্ধিমান…।
–রেইনহার্ড দিয়েত্রিচ?
না। ও আর একজন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী, নাম ম্যানফ্রেড।
মার্টেল হুইল হাউসের ভেতর ইঞ্জিন স্টার্ট দেবার অপেক্ষায়।
মার্টেল এবার বললো, নাও মুখোশটা পরে চুপচাপ বসো।
বলেই মার্টেল ইঞ্জিন স্টার্ট করলো। পশ্চিমের কুয়াশা সরে গিয়ে জলের রঙটা নীল দেখাচ্ছিল। লিন্ডাউ বন্দরের পূর্বদিকের পাঁচিলের ওপর ব্যাভেরিয়ার সিংহটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ক্লেয়ার মুখোশটা ঠিক করে নিলো। প্যান্টের ওপরের দিকে পিস্তলটা ঠিক রাখা আছে কিনা দেখে নিল।
ওয়ার্নারের বেলাতে ওরা যেমন এসেছিল, ঠিক যদি ওরা তেমনই আসে তাহলে আমার একজনকে দরকার।
মার্টেল লঞ্চের স্পীডটা অল্প বাড়িয়ে দিতে লঞ্চটা ধীরে ধীরে নির্জন জায়গার ভেতর দিকে এগোতে থাকলো। ওয়ার্নার এখানেই এসেছিল।
মার্টেল একটা ব্যাপারে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। পূর্বদিকে লঞ্চ আর অস্ট্রিয়ান ঘাট বরাবর একটা ধূসর কুয়াশা যেন সবটা ঢেকে আছে। অন্য কারোর পক্ষে ওকে খুঁজে পাওয়া অসুবিধাজনক হবে। লঞ্চে ওপরে উঠলে তবেই দেখা পাবে, সেটাও আর ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
অপর পাঁচজন উইন্ড সাফারকেও সংকেত করলো। ওরা পরস্পর একে অন্যের কাছাকাছি রয়েছে, যাতে কেউ কাউকে না হারায়।
এবারে ওরা লক্ষ্যবস্তু দেখা যাচ্ছে বুঝতে পেরে এগিয়ে যেতে লাগলো। কুয়াশা তখন সরে যেতে আরম্ভ করেছে।
হেগেন সমস্ত ব্যাপারটা ঠিক সময় মতো করছে। ওর একটা চোখ পর্দায় আর একটি চোখ দেওয়ালের দিকে। এবারে বাঁ-হাতে মাস্তুলটা আর ডানহাতে সেই বিশেষ ধরনের ছুরি যেটা ওয়ার্নারের পেছনে ডেলটা প্রতীক এঁকে দিয়েছিল।
এবার ও লঞ্চটা আসতে দেখেই অন্যদের আসতে সংকেত দিলো।
সমস্ত দলটা অর্ধচন্দ্রাকারে এমনভাব এগিয়ে আসতে লাগলো যাতে মার্টেলকে জোর করে আটকাতে পারে।
ব্যাপারটা ঘটছিল অত্যন্ত দ্রুতভাবে। মাঝে কুয়াশায় হুইল হাউসের মধ্যে থেকে আসা ছবিটা । অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ছজন উইন্ড সার্ফার-এর মধ্যে তিনজন এমনভাবে এগোচ্ছিল যাতে মার্টেলকে যেন তেন প্রকারেণ আটকানো যায়।
ধর ঠিক এইখানে এখন। মার্টেল ক্লেয়ারকে বলতে বলতে বোতামটা টিপল।
–আমি ওদের দেখতে পেয়েছি। বলেই ক্লেয়ার পিস্তল বের করে সামনের দিকে উঁচিয়ে ধরলো।
-ওরা আক্রান্ত।
রাডারের পর্দায় বেতার সংকেতটা ফুটে উঠেছে। সার্জেন্ট ডরনার পুলিশ লঞ্চের ভেতরে।
সংকেত পাওয়ামাত্র ও ইঞ্জিনটা স্টার্ট করতেই বিকট শব্দ করে লঞ্চটা এগোতে থাকলো।
এই সময় কোন লেক স্টীমার ভেতর ঢোকেনা, ডরনার একথা জানা সত্ত্বেও নিয়ম মেনেই ও সাইরেন বাজাতে বাজাতে এগোতে লাগলো।
বাইরের দিকটায় এসে গর্জন থামাল।ওর লঞ্চনব্বই ডিগ্রি কোণ বরাবর ভেসে যেতে লাগলো। তারপর দুটো প্রাচীরের মাঝামাঝি এসে ইঞ্জিনটা আবার স্টার্ট করলো। সাইরেনও একটানা বেজে যেতে লাগল। পর্দায় তখন বেতার সংকেত হচ্ছে।
ওখানে ঠিক সময়ে পৌঁছতে হবেই–ডরনারের ঈশ্বরের কাছে এখন এই প্রার্থনা।
***
ক্লারা বেক ঠিক করেছিল যে ব্রাউনের সঙ্গে কোন উত্তেজনায় যাবে না। টেলিফোনটা করার পর সামনের দিকের সীটে বসে স্বচ্ছ মেজাজে টুরিস্ট্রের মতো চারদিক দেখছিল। হঠাৎ পুলিশ লঞ্চটা আসতেই ও দ্রুত রাস্তা পার হয়ে হাউস্টব্যানহফের দিকে এগোতে লাগলো।
তারপর যে জায়গায় থামলো সেখানে সারি সারি টেলিফোন বুথ, কিন্তু সবগুলোতেই স্টিকার লাগানো টেলিফোন খারাপ বলে।
ঠিক সেই সময়ে একটা পুলিশকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ও খুব ভয় পেল।
পুলিশটা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি ফোন করতে চাও?
–সব কটাই তো খারাপ। ক্লারা একটু জোরে বলে উঠল।
–হ্যাঁ। সেইরকমই তো দেখছি। পুলিশটা নরম স্বরে বলল, সবগুলোই খারাপ।
ধন্যবাদ।
হাউপ্টব্যানহফ থেকে বেরিয়ে ক্লারা দ্রুত বৈরিশ্চার-এর দিকে এগোতে থাকলো। ঘরে পৌঁছে ফোনে একটা নম্বর ডায়াল করল। অপরপ্রান্তে একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
–আমি দুঃখিত। ফোনগুলো সব হঠাৎই সাময়িক খারাপ হয়ে গেছে। তুমি চটপট আমায় নম্বরটা দাও। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব…।
ব্যাপারটা জরুরীনয়। উত্তেজনাকে প্রাণপণে দমন করে ক্লারা রিসিভারটা রেখে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। কি ব্যাপার ঘটছে। কে জানে। দিয়েত্রিচের কাছে না আবার ধমক খেতে হয়।
.
-মেনল্যান্ডের-এর সব লাইন কেটে দাও…।
মার্টেলের এই সংকেত পাওয়া মাত্রই এরিখ স্টোলার সমস্ত পুলিশ স্টেশনে নির্দেশ পাঠিয়ে দিলো। লিন্ডা দ্বীপে টেলিফোনে যোগাযোগের আর কোন ব্যবস্থাই রইলনা। বাইরের পৃথিবী। থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল লিন্ডাউ।
নির্দেশ পাওয়ামাত্রই দ্বিতীয় পুলিশটা ঘর থেকে বেরিয়ে রেডিও কন্ট্রোল অফিসে গেল। পেট্রোলকার গুলোতেও সংকেত পাঠিয়ে দেওয়া হল। মূল ভূখণ্ডে যাবার সেতুটা আটকে দেওয়া হলো। মূল ভূ-খণ্ডের রেলওয়ে এমব্যাংকমেন্টের একেবারে শেষ প্রান্তে আরও একটা পেট্রোলকার দেখা গেল। সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হলো।
লিন্ডাউ-এর সিগন্যাল বক্স নিয়ন্ত্রণ, রেল ট্রাফিকে ত্রুটি বেরোনোর ফলে সমস্ত ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল। এখন কি ঘটছে কে জানে?
***
ওয়ার্নার হেগেনের নিজের ওপর প্রচুর আস্থা। উইন্ড সার্ফার-এর টীমটা ওর নেতৃত্বে আছে। লঞ্চটাকে সবাই গোল হয়ে ঘিরে ধরবে। সমস্ত ব্যাপারটাতেই, চমক।
সোনালী চুলের দৈত্যটা স্থির লঞ্চটার দিকে প্রথম পৌঁছলো। ঐ জায়গাটাতেই খালি পা-টা রাখলো। ডান হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে বড় ব্লেডের ছুরি।
প্রথমেই যা দেখে ও অবাক হলো। একটা মুখোশ মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মার্টেল খানিক পরে বেরিয়ে এলো। হুইল হাউসের মধ্যে নৌকোর হুকটা এমনভাবে আটকানো যে হেগেনের মাথাটা একপাশে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা খেল। ধাক্কা খেয়েই মার্টেলের লঞ্চের মধ্যে ছিটকে এসে পড়ল। আর মার্টেল ওর বন্দুকের কুঁদো সরাসরি ওর মাথায় আঘাত করতেই সঙ্গে সঙ্গে হেগেন চেতনা হারালো। এবারে দ্বিতীয় লোকটা ছুরি হাতে এগিয়ে এলো। ক্লেয়ার লোকটার বুকে তিনবার গুলি চালালো। রক্তে ভেসে গেল চারিদিক। মার্টেল চারদিকটা একবার ভাল করে দেখে নিল। চারজন পালিয়েছে। তিনজন তখনও ঘিরে আছে। আর এগিয়ে আসার জন্যে উদ্যোগ নিচ্ছে। ও ক্লেয়ারকে সতর্ক করে দিয়ে হুইল হাউসে ঢুকে লঞ্চটাকে পূর্ণ বেগে চালিয়ে দিল।
তিনজন তখনও ওর জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে। লঞ্চ দ্রুতবেগে এগোতে এগোতে হঠাৎ থেমে গেল তারপর এত জোরে এগোলো যে বাড়ানো অংশটাতে রীতিমত আঘাত সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিলনা। ধাক্কার আঘাতে একজন ছিটকে পড়ে যেতে যেতে আর্তনাদ করে উঠল। মনে হল নোকটার পুরো শরীরটাই ভেঙ্গে গেছে। আর দুজন লোক জলে ভাসতে লাগলো। সমস্ত জল রক্তে লাল। ওদের মাস্তুলগুলো ভেঙ্গে চুরমার।
–আমাদের পেছনে আর একজন…। ক্লেয়ার বলে উঠল।
মার্টেলের লঞ্চটা এবার পেছন দিকে এগোতে লাগলো ঠিক লোকটাকে লক্ষ্য করে। প্রচণ্ড আঘাতে লোকটা ছিটকে প্রপেলারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মার্টেল বলে উঠলো, ক্লেয়ার চলো পালাই, এখুনি ডরনার এসে পড়বে। মনে হয়।
***
উনত্রিশে মে, শুক্রবার :
প্যারিসের এক উজ্জ্বল দিন। হাওয়ার্ড চার্লস দ্যগলে উড়ে গিয়ে পৌঁছল। সামিট এক্সপ্রেসের নিরাপত্তার ব্যাপারে আজই চূড়ান্ত কনফারেন্স। অদ্ভুতভাবেই ও দেশীয় পোষাকে ভ্রমণ করছে।
বিমানবন্দরে অ্যালেন ফ্ল্যাড্রেসের পাঠিয়ে দেওয়া গাড়িতে ও সারেটের অফিসিয়াল হেডকোয়ার্টার এগারো নং রু দ্য সাউসেইসে এসে পৌঁছলো। অত্যন্ত সংকীর্ণ জায়গা বলে টুরিস্টদের কদাচিৎ দেখা যায়। খিলান আকৃতির প্রবেশপথে উর্দি পরা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।
এই ধরনের মিটিং-এর জন্যে ফ্ল্যান্ড্রেস একেবারে সুরক্ষিত পুরোন বিল্ডিংটাই ঠিক করেছে। সাদা পোষাকের গোয়েন্দাদের অবিরত আনাগোনা। তিনজন সিভিলিয়ান তিনটে পৃথক গাড়িতে আসায় তেমন একটা উত্তেজনার সঞ্চার হল না। ফরাসী সিক্রেট সার্ভিসের প্রধান হাওয়ার্ডকে অভ্যর্থনা জানালো। তিনতলার একটা টেবিলে বসে ছিল ও।
হাওয়ার্ড বলে উঠলো, অ্যালেন তোমাকে দেখে আমি ভীষণ আনন্দ পেলাম।
প্রিয়তম বন্ধু। তোমাকে আমি প্যারিসে স্বাগত জানাচ্ছি।
ফ্ল্যান্ড্রেস ওর সঙ্গে করমর্দন করতে করতে বলে উঠলো।
পাশেই একজন বসেছিল। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠলো, তুমি নিশ্চয়ই টিম ওমিয়েবাকে চেন। সবেমাত্র ওয়াশিংটন থেকে…।
বাঃ, চমৎকার হবে। আমেরিকান ভদ্রলোক বলে উঠলো। চেয়ার থেকে না উঠেই হাওয়ার্ডের সঙ্গে করমর্দন করল। গোলাকার টেবিলের চারপাশে সবাই বসল। ফ্ল্যান্ড্রেস মদের গেলাসগুলো সাজাতে আরম্ভ করল। হাওয়ার্ড ওর সামনে একটা নতুন প্যাড আর পেনসিল রাখলো। ওমিয়েবার দেহটা সুগঠিত, চোখে চশমা আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর। ওমিয়েবার মুখমণ্ডলে কোনরকম ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না।
টিম ও’মিয়েরাই আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিসের একমাত্র প্রধান যে গত একবছরে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিযুক্ত ছিল না।
ফ্ল্যান্ড্রেস মদের ব্যবস্থা করতে করতে চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। লাউঞ্জ স্যুটে ওকে দারুণ স্মার্ট দেখাচ্ছিল। কালো সরু গোঁফ ও ব্রাশ করা চুলের সঙ্গে ফরাসীদের মতো মসৃণ দেহটা মানানসই লাগছিল ওকে।
যে কোন মুহূর্তে জার্মানী থেকে এরিখ স্টোলার আসতে পারে। পরক্ষণেই গ্লাসটা সামনের দিকে তুলে ধরে বলল, ভদ্রমহোদয়রা সুস্বাগতম!
বিয়ারে এবার ও চুমুক দিল। হাওয়ার্ড ততক্ষণে এক চুমুকে সবটুকু সাবাড় করে দিয়েছে। ফ্ল্যান্ড্রেস লক্ষ্য করছে ক্রমশ সকলের মুখে একটা কঠিনভাব জেগে উঠছে আর প্রত্যেককেই কেমন যেন নার্ভাস বলে মনে হচ্ছে।
হঠাৎ দরজা খুলে এরিখ স্টোলার প্রবেশ করল আর সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
প্রথমেই দেরীতে আসার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করলো।
–একটা অবাঞ্ছিত সমস্যার ব্যাপারে বলা যাক…। বলা আরম্ভ করলও।
তখন সবে বিকেল হতে আরম্ভ করেছিল। সকালে যে সবদিক থেকে বিচ্ছিন্ন লিন্ডাউ দ্বীপে ও ছিল এটা প্রকাশ করার মোটেই ইচ্ছে ছিল না ওর। প্যারিসে আসার জন্যে মরিয়া হয়ে মিউনিক বিমান বন্দর থেকে প্লেন ধরে ওর এখানে পদার্পণ।
–খানিকটা বিয়ার খেয়ে ও আবার স্থির হয়ে গেলো। ও অসম্ভব মনঃ বিশেষজ্ঞ।
খানিকক্ষণ বাদে বলে উঠল, টুইড কোথায়? আমি আশা করেছিলাম।
হাওয়ার্ড নীরসভাবে উত্তর দিলো, টুইড এখন বাড়িতে।
-তাই নাকি? তোমরা দুজন তো একই বয়েসী,বলে স্টোলার গ্লাসে আর একটু বিয়ার ঢেলে চুমুক দিলো।
হাওয়ার্ডের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল, বললো, ব্যাপারটা ওর এক্তিয়ারে নয়। হতে পারে কোন বিষয়ে আমরা দুজনেই এখন প্যারিসে…।
-ঠিক আছে। ফ্ল্যান্ড্রেস বলে উঠলো। একটু থেমে আবার বলল, আমার কাছে সামিট এক্সপ্রেসের রুটটা আছে,বলে ও একটা বড় আকারের উত্তর-ইউরোপের ম্যাপ খুলতেই সবাই ম্যাপটার ওপরে ঝুঁকে পড়ল। রুটটা লাল রঙে চিহ্নিত। এরপর ও একটা সিগারেট ধরাল।
অ্যালেন ফ্লানড্রেসের স্বভাব অনেকটা নাটকীয় ধরনের। ম্যাপটা দেখতে দেখতে ও হালকা কিছু মন্তব্য করলো।
কার্লেন্সকে দেখা গেছে–ম্যানফ্রেড তুমি যা ইচ্ছে, সেরকম বলতে পারো। আজ সকালেই লন্ডন থেকে পাওয়া পিকাডিলী…।
ম্যানফ্রেড। তুমি কি করে জানলে লন্ডনে কি ঘটছে? তাছাড়া কেউ কি আমাকে বলবে যে, ও সত্যিই কার্লোস কিনা?
হাওয়ার্ড একরকম কেটে পড়ায় ফ্লানড্রেস একটু আশ্চর্য হলো।
ফ্রেঞ্চম্যান এবার স্বাভাবিক স্বরেই বলতে লাগলো, আমার সহযোগী একটা মেয়ে, রেণী ডুভাল, এই মুহূর্তে ফরাসী দূতাবাসে কাজ করছে। ওর কাছ থেকেই টেলেক্সটা পাওয়া গেছে। বাকিটা তোমার কাগজে।
ফেঞ্চম্যানের দেওয়া কাগজটা ও পড়তে লাগলো। এরিখ স্টোলার কার্লোস-এর ব্যাপারে বলতে লাগলো, কার্লোস-এর কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। ম্যানফ্রেডেরও নেই। কার্লোস ও ম্যানফ্রেডের ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নয়। লোহার বেড়াজালের মধ্যে থেকে মাঝে মধ্যে কার্লোস বেরিয়ে আসে, ম্যানফ্রেডও তাই। দুজনেই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। কেবলমাত্র প্রয়োজনে ওরা অবশ্য কে. জি. বি-কে সহযোগিতা করে।
–তাহলে দুজন? হাওয়ার্ড বলল।
–অথবা, মিয়েরা বলে উঠলো এবার। প্রকৃত কার্লোস তাহলে কে? তুমি এটা আমাকে বলল এরিখ, যদি দুজনেই থাকে, তাহলে দুজনেই দুর্ধর্ষ খুনী..।
ফ্ল্যানড্রেস অ্যামেরিকান। পরবর্তী কথায় হাওয়ার্ড ভুরুটা কুঁচকালো।
তুমি আমাকে লন্ডনের ব্যাপারটা ভালভাবে বলতে পারো? ও কেমন পোষাক পড়েছিল? কেনই বা ওকে এত সহজে চেনা যাবে?
হাওয়ার্ড অস্ফুটস্বরে বললো, ওর স্বাভাবিক পোষাক উইন্ডচিটার, জিন,কালোরঙের বেরেট আর বড় চশমা।
এবারে জার্মান ভদ্রলোক বলে উঠল, তুমি ঘটনাটা আমাকে একটু বিশদভাবে বল তো?
রাস্তায় টহল দেবার সময় একটা পুলিশ ওকে চিনতে পারে কার্লোস বলে, অবশ্য ও যদি সত্যিই কার্লোস হয়ে থাকে। রিজেন্ট স্ট্রিট দিয়ে গিয়ে সোয়ালো স্ট্রিটে ও কোথায় উধাও হয়ে যায়। পুলিশটা ওকে অনুসরণ করেছিল কিন্তু ও ভীড়ের মধ্যে কোথায় মিশে যায়। পরে মার্টিন রোডের একজন সহকারী ওকে দেখতে পায়। উইন্ডচিটার চেয়ারে বসে, চশমাটা ওপরের দিকে। ঠিক আটত্রিশ তলায় স্মিথ অ্যান্ড ওয়েলসন। একেবারে লোডেড বুঝেছ ব্যাপারটা…।
পেট্রোল পুলিশ। লোকটা রাস্তার ঐ বিশেষ জায়গাতেই চলাফেরা করছিল? স্টোলার বলে উঠল।
–আমার মনে হয় তাই। আই. আর. এ. সন্দেহ করেই একটা চোখ অন্ততঃ খোলা রেখেছিল। তাতেই বা কি? হাওয়ার্ড বলে উঠল।
–কেউ যদি ওরকম পোকই পড়ে, তাহলেও পুলিশ কি করে নিশ্চিত হয় যে ওকেই দেখেছে অথবা অদৃশ্য হয়ে গেছে?
–এই একই কথা আমিও ভাবছি…।
ও’মিয়েরা সিগারেট ধরালো। স্টোলার এতক্ষণ উত্তেজিত কথাবার্তা বলার পর একেবারে ঠাণ্ডা। ফ্ল্যানড্রেস দেখলো জার্মানটা একজনকেই গভীরভাবে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। কিন্তু বি. এন. ডির প্রধান…।
এবারে ওরা সবাই ভিয়েনা সামিটে রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যে সব জায়গায় ট্রেনগুলোকে থামানো হবে, জায়গাগুলো ম্যাপে লাল রঙে চিহ্নিত করা আছে।
রুটটা এরকম। প্যারিস থেকে স্ট্রামবুর্গ। তারপর স্ট্রামবুর্গ থেকে স্টাটগার্ট আর মিউনিখ হয়ে স্যালজবুর্গ তারপর জার্মানী। একেবারে শেষ পর্যায়ে স্যালজবুর্গ থেকে ভিয়েনা..অ্যামেরিকা, এতে অস্ট্রিয়ানদের সামান্য সহযোগিতা প্রয়োজন। অ্যালেনই রসিকতার মেজাজে বেশির ভাগ কথা বলে যাচ্ছিল।
হাওয়ার্ডের ভ্রাম্যমান টীম তিনটে সেক্টর দেখবে। ফ্ল্যানড্রেস নিখুঁতভাবে ওর সেক্টরগুলো দেখে যেসব জায়গায় ও সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে সেগুলো বিপজ্জনক অঞ্চল বলে চিহ্নিত করলো।
এবারে এরিখের পালা। ও’মিয়েরা এক্ষেত্রে গভীরভাবে আবির্ভূত। জার্মান ভদ্রলোক ম্যাপের একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে এসে থামলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। বাতাসহীন। ঘরে একটা উত্তেজনা ঘনিয়ে উঠতে লাগল।
–ঠিক এই জায়গাতে এক্সপ্রেস ব্যাভেরিয়া অতিক্রম করবে। এই জায়গাটা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। দূর্ভাগ্যের ব্যাপার হল ট্রেন এই অঞ্চলটা দিয়ে যাবার পরই স্টেটের নির্বাচন।
–এখানেই নয়া নাজীদের তৎপরতা? ডেলটা? হাওয়ার্ড ভ্রূ কুঁচকে বললো।
–টফলার। ও’মিয়েরা বলল। অনেকটা কৈফিয়তের ভঙ্গীমায় বলে উঠল, ডেলটা পোষাক . আর অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে ওর সমর্থনও বেড়ে যাচ্ছে। টফলারকে প্রায় কমিউনিস্ট বলা যায়। ওর আসল উদ্দেশ্য হল পশ্চিম জার্মানী থেকে ব্যাভেরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে অস্ট্রিয়ার মতো একটা নিরপেক্ষ রাষ্ট্র তৈরী করা। এতে গ্যাটের প্রতিপত্তি একেবারে শেষ হয়ে যাবে। পশ্চিম ইউরোপে সোভিয়েটের হাতই শক্ত হবে।
স্টোলার শান্তভাবে বলে উঠল, চ্যান্সেলার ল্যাংগারের পরামর্শদাতারা ভবিষ্যতবাণী করেছে যে টফলার জিততে পারবে না।
আলোচনা এইভাবে সন্ধ্যে অবধি গড়িয়ে চলল। একইসাথে খাওয়াদাওয়াও চলতে থাকলো। ফরাসী ভদ্রলোক গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে পাশের বন্ধুদের দিকে তাকাচ্ছিল। বাতাসে একটা উষ্ণ, আঠালো ভাব। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর একটা মন্তব্যে ঘরের মধ্যে যেন বোমা ফাটল।
ভদ্রমহোদয়রা, আমি যেটা চিন্তা করছি সেটা হচ্ছে আমাদের কাজের জন্যে আরও স্ট্যামিনার প্রয়োজন।
ঠিক এই মুহূর্তে একজন সশস্ত্র প্রহরী ঢুকে ওকে একটা চিঠি দিতেই ও পড়ে হাওয়ার্ডের দিকে তাকালো। বলল, এতে লেখা আছে রাষ্ট্রদূত বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।ও একটা জরুরী সংকেত দেবে যা তোমাদের অবশ্যই জানা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রদূত? তার মানে তুমি বলতে চাইছে ও একজন দূত পাঠিয়েছে?
ফ্ল্যান্ড্রেস দৃঢ়ভাবে বলে উঠলো, রাষ্ট্রদূত নিজে। তুমি যখন এই মিটিং-এ উপস্থিত আছে তখন আমার ধারণা তোমার হাতেই ও সংকেতটা দেবে।
হাওয়ার্ড প্রহরীকে রাষ্ট্রদূতকে আনার জন্যে অনুরোধ করলো। খানিক বাদে সাদা গোঁফওলা, লম্বাটে একটা লোক হাতে এক টুকরো কাগজ নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো। রাষ্ট্রদূত স্যার হেনরী ক্রফোর্ড কাগজটা হাওয়ার্ডের হাতে দিয়ে বলল, এটা আমার হাতে এসেছে আমার ব্যক্তিগত কোডে অ্যান্টনীর মাধ্যমে। ব্যাপারটা আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা। বিশেষ অনুরোধেই আমি নিজে এখানে এসেছি। অবশ্য তার পেছনে যুক্তিও আছে। পড়, পড়লেই বুঝতে পারবে।
ঘরের চারদিকে, সবার দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, তোমাদের সবাইকে দেখে আমি আনন্দ পেলাম। এখন যদি তোমরা আমাকে ক্ষমা করো…।
উঠে দাঁড়ানো অবস্থাতেই হাওয়ার্ড কাগজটা পড়তে লাগলো। তারপর সবার দিকে তাকালো। ওর অভিব্যক্তিতে কিছু বোঝা গেলনা। ইংরেজ ভদ্রলোক কোন আবেগ প্রকাশ না করে শান্তভাবে বলল, লন্ডন থেকে টুইড এই সংকেত পাঠিয়েছে। ও নিশ্চিত। সোর্সের অবশ্য কোন প্রমাণ ও দেয়নি। শুধুমাত্র এই পরিস্থিতিতে এটা তোমার কাছে পৌঁছে দেওয়া…।
ফ্ল্যান্ড্রেস বলল, যদি টুইড নিশ্চিত হয় তাহলে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে ওর এরকম করার পেছনে কারণ আছে। সবচাইতে সিরিয়াস হল, এটা প্রকাশ পেলে সংবাদদাতার জীবন বিপন্ন…।
–ঠিক তাই। হাওয়ার্ড সতর্কভাবে বলল। তারপর গলাটা পরিষ্কার করে সবারদিকে তাকিয়ে খবরটা পড়তে আরম্ভ করল–
বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া গেছে যে, একজন অজানা ঘাতক সামিট এক্সপ্রেসের চারজন ভি.. আই. পি-র একজনকে হত্যা করতে চেষ্টা করবে। চারজনের মধ্যে লক্ষ্যটা কার ওপরে তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। টুইড।
***