৩। সময়-পর্যটকের প্রত্যাবর্তন
তখনও কিন্তু আমাদের কেউই টাইম মেশিনকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। দুনিয়ায় একশ্রেণির মানুষ আছে, যাদের চতুরতার পরিমাপ করা সাধারণ মানুষের সাধ্য নয়। চতুর-চূড়ামণি সময়-পর্যটকও এই শ্রেণির মানুষ। নিত্যনতুন ফন্দি যাঁর মাথায় অহরহ গজাচ্ছে, তাঁর সব কথা হট করে বিশ্বাস করে বোকা বনতে মন চায় না কিছুতেই। ডাক্তারের সঙ্গে এ-বিষয়ে পরে আমার কথা হয়েছিল। তিনি তো বললেন, এ একটা রীতিমতো উন্নত ধরনের ম্যাজিক ছাড়া কিছুই নয়। মোমবাতি নিবে যাওয়ার সঙ্গে মেশিন উধাও হওয়ার নিশ্চয় সম্পর্ক আছে। কিন্তু সে-সম্পর্কটা যে কী তা তিনি অনেক গবেষণা করেও আবিষ্কার করতে পারলেন না।
সেদিন সময়-পর্যটকের ড্রয়িং রুমে কয়েকজন রোজকার অতিথির মধ্যে আমিও ছিলাম। তাই পরের বেস্পতিবার যথাসময়ে হাজির হলাম রিচমন্ডে। গিয়ে দেখি আমার আগেই জনা চার-পাঁচ ভদ্রলোক জমায়েত হয়েছেন। একতাল কাগজ হাতে আগুনের চুল্লির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ডাক্তার। কিন্তু আশপাশে কোথাও সময়-পর্যটকের টিকিটি দেখতে পেলাম না।
সাড়ে সাতটা বেজে গেল, ডাক্তারই প্রথমে কথা বললেন, এবার ডিনার শুরু করা উচিত, কী বলেন?
কিন্তু গৃহস্বামী গেলেন কোথায়? শুধাই আমি।
এখনও এসে পৌঁছাননি। অবশ্য আমাকে একটা চিরকুটে লিখে গেছেন যে, তাঁর জন্য অপেক্ষা না করে আমরা যেন সময়মতো ডিনার খেয়ে নিই।
ডিনার ঠান্ডা হতে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় মোটেই। বললেন নামকরা একটা দৈনিক সম্পাদক।
সুতরাং ঘণ্টা বাজিয়ে ডিনারের আদেশ দিলেন ডাক্তার।
অভ্যাগতদের মধ্যে আমি আর ডাক্তার ছাড়াও ছিলেন মনোবিজ্ঞানী, ব্ল্যাঙ্ক নামধারী সম্পাদক ভদ্রলোক, আরও দু-জন সাংবাদিক। এঁদের মধ্যে আবার দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি এমনই মুখচোরা যে, সারাটা সময় একবারও মুখ খুলতে দেখলাম না তাঁকে। ছুরি-কাঁটার সঙ্গে সমানে মুখও চলতে শুরু করে। গত হপ্তার রোমাঞ্চকর এক্সপেরিমেন্টের হাতসাফাইয়ের বর্ণনাটা বেশ রসিয়ে রসিয়ে শোনাচ্ছেন মনোবিজ্ঞানী, সম্পাদকমশাইও তাল মিলিয়ে মাঝে মাঝে রসালো টিপ্পনী ছাড়ছেন, এমন সময়ে কোনওরকম শব্দ না করে খুব আস্তে আস্তে বারান্দার দরজাটা ফাঁক হয়ে যেতে লাগল।
দরজার দিকে মুখ করে আমি বসেছিলাম, তাই আমারই চোখে পড়ল প্রথম। দরজাটা আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ খুলে যেতেই দেখলাম, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সময়-পর্যটক স্বয়ং।
এ কী ব্যাপার? অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠি আমি।
কী করে হল এমন অবস্থা? এবার ডাক্তারের চোখে পড়েন তিনি।
আর, তারপরেই সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে তাঁর ওপর।
ঝোড়ো কাকের মতো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ধুলোভরা কোটটা এখানে সেখানে ছিঁড়ে গেছে, হাতাতে লেগেছে সবুজ রঙের ছোপ। উশকোখুশকো চুল; আর, অন্তত আমার তো মনে হল, ধুলোময়লার জন্যেই হোক বা সত্য সত্যই ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়ার জন্যেই হোক, চুলগুলো আগের চাইতে যেন অনেক সাদা হয়ে গেছে। মুখ তার বিরং, বিবর্ণ, পাণ্ডুর। চিবুকে একটা দগদগে কাটার চিহ্ন, আর একটা শুকিয়ে এসেছে। দারুণ পরিশ্রমে তাঁর ভাবভঙ্গি কেমন জানি অবসাদময়, ক্লান্তিতে শিথিল। হঠাৎ জোর আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেলে যেমন হয়, তেমনিভাবে মুহূর্তের জন্য দোরগোড়ায় পা ঘষটালেন তিনি, তারপর ঘরে ঢুকলেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে। নির্বাক হয়ে আমরা তাকিয়ে রইলাম তাঁর পানে।
একটা কথাও বললেন না তিনি। বেদনায় মুখ বিকৃত করে টেবিলের কাছে এসে শ্যাম্পেনের দিকে আঙুল তুলে দেখলেন। তাড়াতাড়ি একটা গেলাস তাঁর দিকে এগিয়ে দিলেন সম্পাদক ভদ্রলোক। এক চুমুকে সেটা নিঃশেষ করে দিয়ে যখন মুখ তুললেন, তখন ঠোঁটের কোণে তাঁর পুরানো হাসি আবার ফুটে উঠেছে ম্লান হয়ে।
ডাক্তার শুধান, কী ব্যাপার বলুন তো আপনার?
প্রশ্নটা সময়-পর্যটকের কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। নীরবে আর-এক গেলাস শ্যাম্পেন শেষ করে উঠে দাঁড়ান তিনি। গালে-মুখে-চিবুকে রক্তের আভা একটু একটু করে ফুটে উঠছিল। থেমে থেমে বললেন তিনি, এখন চলি আমি… হাত-মুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে আসছি এখুনি। আমার জন্যে শুধু কিছু মাটন রেখে দিন–অনাহারে নাড়িভুড়িসুদ্ধ শুকিয়ে এসেছে। বলে পা টেনে টেনে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। আর তখনই লক্ষ করলাম, তাঁর পায়ে জুতো নেই; ছেঁড়া মোজাজোড়া রক্তে মাখামাখি। আর কিছু দেখার আগেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
আবার গুঞ্জন শুরু হয় ডিনার টেবিলে। সম্পাদক ভদ্রলোক আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন, প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর আশ্চর্য ব্যবহার। বোধহয় পরের দিনের কাগজের শিরোনামটাই আওড়ে নেন তিনি।
আমি বললাম, জল্পনা-কল্পনা আপাতত বন্ধ রেখে আসুন। আধ-খাওয়া খানাটা এবার শেষ করা যাক। উনি ফিরে এলে সবকিছু শোনা যাবেখন।
উত্তম প্রস্তাব। বলে ছুরি-কাঁটা তুলে নিলেন সম্পাদক ভদ্রলোক। আচ্ছা মশায়, ভদ্রলোক না-হয় মেশিনে চড়ে এক পাক ঘুরেই এলেন। কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষগুলোর কাছে কি কোট ঝাড়বার ব্রাশ বা চুল আঁচড়াবার কোনও চিরুনিও নেই?
দমকা হাসিতে ফেটে পড়ে সবাই। আবহাওয়া অনেকটা লঘু হয়ে যাওয়ায় মনোবিজ্ঞানী আবার গত হপ্তার এক্সপেরিমেন্টের সরস বর্ণনা শুরু করেন। কিন্তু তা শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসেন সময়-পর্যটক। সাধারণ সান্ধ্য পোশাক তাঁর পরনে। চোখের দৃষ্টি তখনও কেমন জানি উদভ্রান্ত।
সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠেন সম্পাদক, কী ব্যাপার মশায়? শুনলাম নাকি আগামী দিনগুলোতে বেড়াতে গিয়েছিলেন আপনি? তা রোজবেরির কী খবর শুনে এলেন, বলুন শুনি।
নীরবে চেয়ারে এসে বসলেন সময়-পর্যটক। স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, আমার মাটন কোথায়?
গল্প আগে! চেঁচিয়ে ওঠেন সম্পাদক।
চুলোয় যাক গল্প। পেটে দানাপানি না পড়লে একটা কথাও বলতে পারব না আমি। ধমনিতে বেশ কিছু পেপটোনের দরকার এখন।
একটা কথা শুধু বলুন। সত্যই কি সময়ের পথে বেরিয়ে এলেন?
হ্যাঁ। মুখভরা মাংস চিবুতে চিবুতে জবাব দিলেন সময়-পর্যটক।
আপনি যা-ই বলুন-না কেন, লাইনপিছু এক শিলিং দেব আমি। প্রত্যুত্তরে আর-এক গেলাস শ্যাম্পেন পান করলেন সময়-পর্যটক।
ডিনারের বাকি সময়টুকু আর বিশেষ কোনও কথা জমে না। খাওয়া শেষ হলে পর একটা সিগার ধরিয়ে বললেন তিনি, যে-কাহিনি আপনাদের শোনাব, তা যেমনি অবিশ্বাস্য, তেমনি আশ্চর্য রকমের সত্য৷ বিশ্বাস করা, না-করা অবশ্য আপনাদের অভিরুচি। বেলা চারটের সময়ে ল্যাবরেটরিতে ছিলাম আমি… তারপর থেকে পুরো আটটা দিন কাটিয়েছি আমি… এমনভাবে কাটিয়েছি, যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না… কিন্তু সে বিরাট কাহিনি। শুনতে হলে আসুন, স্মোকিং রুমে গিয়ে বসি।
স্মোকিং রুমে আরামকেদারায় বসার পর আবার শুরু করলেন, একটা শুধু শর্ত আছে, আমাকে কেউ বাধা দেবেন না। রাজি থাকেন তো বলুন।
কিন্তু একটা অলীক ব্যাপার শুনতে হলে মুখ খোলেন সম্পাদক।
আজ রাত্রে কোনও তর্ক নয়, বড় শ্রান্ত আমি। অথচ না বললেও ঘুম হবে না আমার। যা বলব, তা-ই শুনতে হবে। কোনও বাধা নয়, রাজি?
রাজি। বললাম সবাই।
তখন শুরু হল সময়-পর্যটকের আশ্চর্য ভ্রমণকাহিনি। চেয়ারে হেলে পড়ে বলে যাচ্ছিলেন তিনি দ্রুততর গতিতে। লিখতে লিখতে কনুই পর্যন্ত টনটনিয়ে উঠছিল আমার। নিশ্চয় খুব মন দিয়ে একাহিনি পড়ছেন আপনারা। কিন্তু তবুও ল্যাম্পের আলোক-বলয়ের মাঝে বক্তার ফ্যাকাশে মুখ আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না। শুনতে পাচ্ছেন না তাঁর আবেগ-কাঁপা গমগমে কণ্ঠস্বর। আলোক-সীমানার বাইরে অন্ধকারে বসে রইলাম আমরা। আর দক্ষ শিল্পীর মিড়-গড়ক-গমক-মূৰ্জনা সৃষ্টির মতো শব্দের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখে দিলেন সময়-পর্যটক।