৩. সন্ধে পেরিয়ে রাত

সন্ধে পেরিয়ে রাত নেমে গেছে। আর পঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না অর্জুন। হঠাৎ সে অবাক হয়ে দেখল দৃশ্যটা। একটা সাদা কাপড় টানটান লম্বা হয়ে গেটের দিক দিয়ে এগিয়ে আসছে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে একবার দেখামাত্রই মনে হল সেটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অর্জুন সতর্ক চোখে দেখেও বৃষ্টি ও অন্ধকারের আড়াল সরাতে পারল না। এই সাদা কাপড়ের কথাই তো করিমচাচা বলেছিল। ভূতেরা এভাবে সাদা কাপড় সোজা টাঙিয়ে ঘুরে বেড়াবে কেন? করিমচাচা বলেছিল সমস্ত বাগান একটা কবরখানা হয়ে যাবে এবং সেখান থেকে পচাগলা শরীর দুলতে দুলতে বেরিয়ে আসবে। অর্জুন বাগানের দিকে তাকাল। বৃষ্টি একটু ধরতেই সে গাছগুলোর ডাল আবছা দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু সেই সাদা কাপড় কোথাও নেই।

ব্যাপারগুলোকে ভৌতিক ভাবলে চট করে নস্যাৎ করা যাবে না। খামোকা একটা সাদা কাপড় খাড়া করে ধরে কোনও মানুষ বাড়ির ভেতর বৃষ্টির মধ্যে ঢুকবে কেন? এইরকম ঝড়জলের মধ্যে এই রাত্রে কোনও ড্রাইভার গ্যারাজের দরজা বন্ধ করে ইঞ্জিন চালু করবে? কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না অর্জুন। কিন্তু সে নিশ্চিত এইসব কাজ কোনও ভূত বা আত্মা করছে না। যে মানুষরা করছে তারা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু সেটা কী জন্যে? ওরা নিশ্চয়ই জানে না এই বাড়ির ভেতর সে আছে। মাথা নাড়ল অর্জুন। এতটা আস্থা নিজের ওপর রাখা ঠিক নয়। সে এই বাড়িতে ঢোকামাত্র কেউ যে তার ওপর নজর রাখেনি তা জোর করে বলা যাচ্ছে না। মেঘনার গায়ে প্রায় লুকিয়ে রাখা নৌকার কাছে যাওয়ার আগে কোনও মানুষকে কাছাকাছি দেখতে পায়নি সে। কিন্তু যেই সে হাত বাড়িয়েছিল অমনি লোকটা উদয় হয়েছিল। শুধু উদয় হয়নি রীতিমতো রাগারাগি করে নৌকা নিয়ে চলে গিয়েছিল। ওই লোকটি যে এই বাড়ির রহস্যের সঙ্গে জড়িত নয় তা বলা যায় না।

কিন্তু কেন? কী উদ্দেশ্যে ওরা বাড়িটা রাত্রে দখল করতে চাইছে? ওরা বাড়ির পেছনের জমিটা খোঁড়াখুঁড়ি করেছে। বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ মাটি খোঁড়ে না। ওরা চাষ করার জন্যে মাটি খুঁড়েছে এটা কোনও শিশুও বিশ্বাস করবে না। তা হলে কি ওদের সন্দেহ মাটির নীচে মূল্যবান কিছু আছে?

অর্জুন জানলা বন্ধ করল। এখন বৃষ্টি একদম থেমে গিয়েছে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আর টর্চ জ্বালতে সাহস পেল না। অনুমানে ছাদে ওঠার সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। এইসময় শব্দটা কানে এল, থপ থপ। অর্জুন ধীরে ধীরে ছাদের দরজায় চলে এল। ঈষৎ ফাঁক করে বুঝতে পারল ছাদে কোনও মানুষ নেই, ভূত তো দূরের কথা। সে ছাদে পা রাখল।

হু হু বাতাস বইছে। আকাশে মেঘ নেই বললেই চলে। তারা ফুটেছে। অর্জুন ধীরে ধীরে পেছনের কার্নিশের কাছে চলে এল। তারপর সন্তর্পণে নীচের দিকে তাকাল। অন্ধকার একটু পাতলা হয়ে এলেও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছুটা সময় চেয়ে থাকলে চোখ ধাতস্থ হয়। অর্জুন সেই চেষ্টা করল। কিন্তু সব স্থির। কোনও নড়াচড়া ধরা পড়ল না।

রাত বাড়ছে। বড় ছাদের একেবারে ওপাশে জলের ট্যাঙ্ক রয়েছে। সে ট্যাঙ্কের কাছে চলে এল। ট্যাঙ্কের পেছনে চিলেকোঠার ছাদ। মাঝখানে হাতখানেক জায়গা ফাঁকা রয়েছে। সেই ফাঁকা জায়গায় চলে এল অর্জুন। ছাদে পা দিয়ে কেউ এখন চট করে তাকে দেখতে পাবে না।

কিন্তু ব্যাপারটা কী হল? এই বাড়িতে মানুষ গোপনে আসাযাওয়া করে তার যথেষ্ট প্রমাণ সে পেয়েছে। কিন্তু এতটা সময় কেটে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের দর্শন পাওয়া যাচ্ছে না কেন? উত্তর একটাই। তার উপস্থিতি ওরা জেনে গিয়েছে। আর জানলে এটাও জেনেছে যে সে এই বাড়িতে একদম একাই আছে। এক্ষেত্রে তাকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে দিলেও কেউ টের পাবে না এটাও ওরা জানে। তা হলে সেটা করছে না কেন?

হঠাৎ সামনের গাছে, ছাদের সমান উঁচু গাছের ডালে ঝটপট শব্দ হতে লাগল। তারার আলোয় অস্পষ্ট যা দেখা যাচ্ছিল তাতে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। অর্জুনের মনে হল টর্চের আলো ফেলে ব্যাপারটা দেখলে কেমন হয়। কিন্তু ইচ্ছেটা সংবরণ করল সে। তখনই ঝপাৎ করে শব্দ হল, ডাল ভেঙে কিছু একটা নীচে পড়ল। অর্জুন সন্তর্পণে ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসে বাগানের দিকের ছাদের প্রান্তে চলে এল। মাথাটা একটু ওপরে তুলে নীচের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। অত উঁচু গাছে কী থাকতে পারে যা ডাল ভেঙে নীচে পড়েছে। পড়ার আগে যখন ঝটপটানির আওয়াজ হয়েছে তখন বোঝা যাচ্ছে আত্মরক্ষার লড়াই হয়েছিল।

অর্জুন দেখল মেঘনার ওপর থেকে আবার মেঘ ভেসে আসছে। আকাশের নীল তারাগুলো দ্রুত মুছে যাচ্ছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিজে কাদা হয়ে যেতে হবে। সে দ্রুত সিঁড়িতে চলে এল। দরজা বন্ধ করে দোতলার সেই আসবাবহীন ঘরে পৌঁছে ছিটকিনি তুলে দিতেই তুমুল বৃষ্টি নামল।

এখন তার কিছুই করার নেই। সঙ্গে অস্ত্র থাকলে নীচে নামা যেত। খালি হাতে সেটা করা বোকামি হবে। অর্জুন ঘরের মেঝেতে বসে দেওয়ালে হেলান দিল। ভোর হওয়া পর্যন্ত এভাবে বসে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই।

কতক্ষণ সময় চলে গেছে অর্জুন জানে না। তার ঝিমুনি এসেছিল। হঠাৎ আর্ত চিৎকার কানে ঢুকতেই ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বসল। চিৎকার একবারই হয়েছে এবং তারপর সব চুপচাপ। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। সে উঠে জানলার পাল্লা ঈষৎ খুলে দেখল সরের মতো আলো ছড়িয়ে আছে বাগানে। ঠিক তখনই দুটো লোককে দেখতে পেল সে। ওরা কাউকে বয়ে নিয়ে এল বাড়ির সামনে। তাকে মাটিতে রাখল। এরপর তৃতীয় একজন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে গ্যারাজের দরজা খুলল।

অর্জুন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িগুলো আন্দাজে প্রায় লাফিয়ে নীচে নেমে আসতে না আসতেই লরির ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনতে পেল। লরিটাকে চালু করা হচ্ছে। সে একতলার দরজাটা সন্তর্পণে খুলে অল্প ফাঁক করতেই দেখল লরিটা বেরিয়ে আসছে গ্যারাজ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে ওই দু’জন লোক বয়ে আনা মানুষটাকে লরির পেছনে তুলে দিয়ে তাতে উঠে বসল। এবার লরি গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ঠিকঠাক যেতে পারছে না। গেটের মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেল লরি। ড্রাইভার চিৎকার করে কিছু বললে একটা লোক লাফিয়ে লরি থেকে নেমে পেছনের চাকাগুলো দেখতে দেখতে চেঁচিয়ে উঠল, হাওয়া নাই, একদম পানচার।

এবার ড্রাইভিং সিট থেকে লোকটা নেমে এসে চাকা দেখে লাথি মারল একটায়। তারপর বলল, একসঙ্গে দুটো চাকা গেল কী করে। স্টেপনি আছে একটা। নাঃ। ওর কপালে হাসপাতালে যাওয়া নেই। এখানে মরার চেয়ে মেঘনায় ভেসে যাওয়া ভাল।

না স্যর। জেনেবুঝে জ্যান্ত মানুষটাকে মারবেন না। একজন হাতজোড় করল।

তা হলে তোরাই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যা। শক্ত দড়ির সিঁড়ি ছিঁড়ে নীচে পড়ল। ওর কপালে তো বাঁচা ছিল না। এক কাজ কর। লরিটাকে গ্যারাজে আবার ঢুকিয়ে রাখ। হাত চালা। অর্জুন দেখল ওরা ঠেলেঠুলে লরিটাকে গ্যারাজ বন্দি করল। তারপর গোটা চারেক ছোট বাঁশকে একত্রিত করে তাদের সঙ্গে লোকটাকে বাঁধল ড্রাইভারের নির্দেশে। ড্রাইভার বলল, সামনে একজন, পেছনে একজন, ওকে বয়ে নিয়ে যা ডেরা পর্যন্ত। ওখানে যে গাড়িটা আছে তাতে তুলে সোজা ঢাকায় নিয়ে যাবি। এখানকার কোনও হাসপাতালে খবরদার নিয়ে যাবি না।

ড্রাইভার যদি না থাকে? একজন জিজ্ঞাসা করল।

ওর বাপ থাকবে। পকেট থেকে অনেকগুলো নোট বের করে দিল লোকটা।

আহতকে নিয়ে লোক দুটো বেরিয়ে গেলে মুখ ফিরিয়ে বাড়িটাকে দেখল লোকটা। তারপর এগিয়ে গেল লম্বা গাছটার নীচে। সেখান থেকে কিছু একটা তুলে ধীরে ধীরে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। অর্জুন দ্রুত লোকটার পিছু নিল। বাঁধ পেরিয়ে লোকটা মেঘনার দিকে নেমে যাচ্ছে। হাতের বস্তুটি বেশ ভারী বলে মনে হল অর্জুনের। বাঁধের ওপর উঠতে গিয়েও সামলে নিল সে। মুখ ফেরালে লোকটা তাকে দেখতে পাবে। যতটা সম্ভব নিচু হয়ে সে বাঁধের প্রান্তে এসে দেখল লোকটা নৌকায় উঠেছে। ঠিক যে জায়গায় সে আজ নৌকাটাকে দেখেছিল সেই জায়গায় বাঁধা ছিল এখন। তারপর লগি ঠেলে চলে গেল চোখের আড়ালে।

অর্থাৎ আজ রাত্রে ওদের অভিযান এই পর্যন্ত। অর্জুন বাড়িতে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দোতলার একটা শোওয়ার ঘরের খাটে শরীর এলিয়ে দিল। কখন সকাল হয়েছে, রোদ উঠেছে, টের পায়নি সে। একতলার দরজায় বারংবার শব্দ হতে নীচে নেমে এসে দেখল করিমচাচা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, বাবু! আপনি রাতে এখানে ছিলেন?

হ্যাঁ। কখন এসেছেন?

এই কিছু সময় হল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে অবাক হয়ে গেছি।

আপনি রাত্রে থাকবেন একথা বলেননি তো!

আপনি চলে যাওয়ার পর ঠিক করলাম।

ও। ভয় পাননি তো?

না না। বৃষ্টি হচ্ছিল, আরাম করে ঘুমালাম।

করিমচাচা বলল, একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। এই বাগানে বিষধর সাপ যে আছে তা জানি কিন্তু অত বড় সাপের কথা জানতাম না।

কত বড় সাপ?

আসুন, দেখবেন!

করিমচাচা অৰ্জুনকে নিয়ে গেল সেই লম্বা গাছটার নীচে। অর্জুন দেখল একটা মোটা লম্বা সাপ মরে পড়ে আছে। তার মাথাটা থেঁতলে গিয়েছে ভারী কিছুর চাপে। ওপরের দিকে তাকাল সে। অত উঁচু থেকে পড়লে সাপ কি মারা যায়? তখনই মনে পড়ল, লোকটা এখান থেকেই ভারী বস্তুটা তুলে নিয়ে গেছে। কাল রাত্রে যে ঝটপটানির শব্দ কানে এসেছিল তার কারণ অনুমান করল সে। ওই বস্তুটি গাছের ডালে বাঁধা ছিল। নীচ থেকেও ভাঙা ডালের নীচের অংশে দড়ি ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। এই সাপটা বস্তুটাকে জড়িয়ে ধরতে সেটা চাপ সইতে না পেরে নীচে দড়ি ছিঁড়ে পড়েছে। পড়ার সময় সাপটাকেও সঙ্গে নিয়েছে। হয়তো নীচে পড়ার সময় সাপের মাথা তলায় ছিল, বস্তুটি সেই মাথায় আছড়ে পড়ায় বেচারার প্রাণ বেরিয়ে গেছে। কিন্তু ওই ভারী বস্তুটি কী? কে ওটাকে অত ওপরে বেঁধেছিল?

কত লম্বা সাপ, আগে কখনও দেখিনি। করিমচাচা বলল।

সত্যি। খুব বড়। কিন্তু এখানে পড়ে থাকলে পচে গন্ধ ছড়াবে। এটাকে মাটিতে পুঁতে ফেলাই উচিত। অর্জুন বলল।

রেখে দিন। এখনই তো পচবে না। পরে পুঁতে দেব।

আচ্ছা, এই সাপের বিষ আছে কি না তা জানি না। এখানে যে লোকটা বিষ কিনতে এসেছে তার কাছে নিয়ে গেলে হয় না? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

শুনেছি সাপ বড় হলে বিষ থাকে না। অবশ্য বিষ থাকলে এই বাজারে দুশো টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু আমি তো বাবু ওটাকে তুলতেই পারব না।

আপনি তোক ডাকুন। তাকে না হয় কিছু দেবেন! অর্জুন বলল, এখানে কারও যদি গাড়ি থাকত তা হলে অনুরোধ করতাম গাড়িতে সাপটাকে পৌঁছে দিতে!

তা যদি বলেন, ওই লোকটারই তো গাড়ি আছে। ড্রাইভার চালায়। আমি দেখেছি।

খুব ভাল। ওকে একটা খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

অর্জুনের কথা শেষ হতেই গাড়ির আওয়াজ হল। গেট খোলাই ছিল। গাড়ি ভেতরে ঢুকলে হানিফকে দেখতে পেল সে। পেছনের সিট থেকে নামলেন ফয়েজুর রহমান এবং জোনাকি। জোনাকি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন?

অর্জুন ওদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ফার্স্ট ক্লাস। হঠাৎ এই সময়ে?

ফয়েজুর রহমান এগিয়ে এলেন, কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি। আপনি কোন সাহসে এই বাড়িতে রাত কাটালেন তা আমি জানি না। কিন্তু আপনার কোনও ক্ষতি হতেই পারত, হলে আমি কী কৈফিয়ত দিতাম, বলুন!

কী আশ্চর্য! আপনারা অনর্থক ভয় পেয়েছেন। আমি তো দিব্যি ছিলাম। কোনও সমস্যা হয়নি। শুধু ভোরের দিকে একটু খিদে পাচ্ছিল। অর্জুন বলল।

সেকী! আপনার তো রাত্রে খাওয়াদাওয়া হয়নি। চলুন, ঢাকায় ফিরে যাব।

আপনার যদি তাড়া থাকে তা হলে ফিরে যান, কিন্তু আমি তো এখনই যেতে পারব না।

কেন? এখন কী কাজ আছে এখানে? আপনি আমাকে কেন এখানে এনেছেন তা বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন! অর্জুন বলল।

না না, তা ভুলব কেন!

তবে এখন যদি আপনার মনে হয় আমাকে দিয়ে কাজটা করাবেন না তা হলে নিশ্চয়ই আমি ঢাকায় ফিরে কলকাতার প্লেন ধরব।

মাথা ঝাঁকালেন ফয়েজুর রহমান, আমি সেরকম কিছুই বলিনি। আপনি বললেন রাত্রে কোনও অসুবিধে হয়নি। ভাল ছিলেন। তার মানে ভূতের গল্পটা সত্যি নয়। কোনও মানুষ কাল আপনাকে ভয় দেখায়নি। রাত্রেই যখন কোনও সমস্যা হয়নি তখন এই দিনের আলোয় নতুন কিছু ঘটবে বলে মনে হচ্ছে না বলে আপনাকে ঢাকায় যেতে বললাম। কথা বলতে বলতে রুমালে মুখ মুছলেন ফয়েজুর রহমান।

বুঝলাম। এখানে কয়েকটা কাজ করা দরকার। জোনাকি যদি একটু চা আর সামান্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন তা হলে কোনও সমস্যা থাকে না। অর্জুন হাসল।

ফয়েজুর রহমান ইশারা করতেই করিমচাচা বলল, খাবার ঘরে বড় ফ্লাস্ক আছে। নিয়ে যাও।

জোনাকি ভেতরে ঢুকে যেতেই অর্জুন ডাকল, হানিফভাই, আপনার গাড়িটাকে ওই গাছের কাছে নিয়ে আসতে পারবেন?

মাথা নাড়ল হানিফ। তারপর গাড়ি আনতে চলল।

ফয়েজুর রহমান জিজ্ঞাসা করলেন, গাড়ি ওখানে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?

ওদের সঙ্গে আরও দু’জন যাবে। ওরা বোধহয় টিফিন থেকে চা আনবে। যাওয়ার পথে একজায়গায় দু’জনকে নামিয়ে দেবে। ফেরার সময় একজনই ফিরবে ওদের সঙ্গে। অর্জুনের কথার মধ্যেই গাড়ি চলে এল গাছটার কাছে।

হানিফ বেরিয়ে এলে অর্জুন বলল, ডিকি খুলুন।

ডিকি খোলা হলে অর্জুন বলল, আসুন হানিফভাই, হাত লাগাতে হবে।

সাপটাকে দেখতে পেয়ে হানিফ চিৎকার করে কয়েক পা পিছিয়ে এল। ফয়েজুর রহমান দৌড়ে এলেন। সর্বনাশ। এ তো বিশাল সাপ!

ভয় নেই। উনি দেহ রেখেছেন। অর্জুন বলল।

কে মারল সাপটাকে? কীভাবে মারল?

ওই অত উঁচু ডাল থেকে পড়ে গিয়েছিল বেচারা। ওটা যদি বিক্রি হয় তা হলে করিমচাচা অন্তত দুশো টাকা পেতে পারেন। হানিফভাই, হাত লাগান।

হানিফ লেজের দিকে ধরল, অর্জুন মাথার পাশে। ওটাকে বয়ে নিয়ে যেতে দু’জনের বেশ কষ্ট হল। গাড়ির ডিকিতে ঢোকাতে হল বেশ কসরত করে। ঢোকানোর পরে পেছনের চাকাগুলো একটু নেমে গেল। ডিকি বন্ধ করার পর জোনাকি বাড়ির বাইরে এল ফ্লাস্ক আর একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে। ফয়েজুর রহমান কয়েকটা নোট তার হাতে দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি এসো।

গাড়ি ঘুরিয়ে নিলে হানিফের পাশের সিটে উঠে বসল জোনাকি। বলল, বাথরুমে ঢুকে দেখলাম নতুন টুথব্রাশ আর পেস্ট রয়েছে।

বাঃ, খুব ভাল। বলে পেছনের দরজা খুলে অর্জুন ডাকল, উঠুন করিমচাচা!

ফয়েজুর রহমান অবাক হলেন, চাচা কোথায় যাচ্ছে?

সাপটাকে যে কিনতে পারে তার ঠিকানা আপনি জানেন?

না।

করিমচাচা জেনে নেবেন। উনি এখানকার মানুষ। টাকাটা পেলে ওঁর উপকার হবে।

করিমচাচা বলল, কী বলো ফয়েজ?

যান। দয়া করে সিটের ওপর পা তুলে বসবেন না। ফয়েজুর রহমান বিরক্ত।

গাড়ি বেরিয়ে গেলে অর্জুন বলল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি চট করে বাথরুম থেকে ঘুরে আসছি।

চলুন, আমি ভেতরেই বসছি। ফয়েজুর অর্জুনকে অনুসরণ করলেন। দাঁতে ব্রাশ করে মুখে-ঘাড়ে জল দেওয়ার পর শরীরে বেশ আরাম হল। ব্রাশ নতুন কিন্তু পেস্ট কবে শেষবার ব্যবহৃত হয়েছে তা ঈশ্বর জানেন। কিন্তু অর্জুনের অসুবিধে হল না।

সে বাইরের ঘরে এসে দেখল ফয়েজুর রহমান দরজা-জানলা বন্ধ করে চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। অর্জুন বলল, একী জানলা খোলেননি কেন?

ওই আর কী! আচ্ছা, সত্যি বলুন তো, কাল এখানে কি কোনও গোলমাল হয়নি?

একদম নয়।

ফয়েজুর রহমান হাসার চেষ্টা করলেন, শুনে ভাল লাগছে।

করিমচাচা বলেছিল সামনের বাগানটা একটা কবরখানা হয়ে যায় আর কবর থেকে পচে যাওয়া শরীর বেরিয়ে আসে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও তাই শুনেছি।

আমি বাগানকে কবর হতে দেখিনি। আর যদি পচা শরীর বেরিয়ে আসত তা হলে তারা সাপের ছোবলে আবার মারা যেত। অর্জুন হাসল।

তার মানে?

রাত্রে এই বাগান সাপেদের স্বর্গরাজ্য হয়ে যায়। শুধু সাপ আর সাপ। আমার মনে হচ্ছে ওই কেউটে গোখরোদের দেখে ভয় পেয়ে লম্বা গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের সাপের একজন সঙ্গী থাকে। সেটা কোথাও লুকিয়ে আছে।

সাপ নিয়ে আমি চিন্তা করছি না। দরকার হলে সমস্ত গাছ উপড়ে বাগান পরিষ্কার করিয়ে ফেলব। ক’দিন অ্যাসিড ছড়ালে সবাই চত্বর ছেড়ে পালাবে। আপনি কাল রাত্রে ভূত দেখেননি বলে স্বস্তি হচ্ছে। ফয়েজুর রহমান। বললেন।

ভূত দেখিনি কিন্তু কিছু ঘটনা ঘটেছে যার ব্যাখ্যা পাইনি।

কীরকম?

গ্যারেজের ভেতর থেকে ইঞ্জিন চালু করার আওয়াজ ভেসে এল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে সেটা আর শুনলাম না। আজ সকালে গ্যারাজে ঢুকে দেখলাম আপনার লরির পেছনের চাকা দুটোর হাওয়া বেরিয়ে গেছে।

সেকী!

শুধু তাই নয়। লরির একপাশ তুবড়ে গিয়েছে। সেখানে অন্য গাড়ির রং লেগে রয়েছে। গাড়িটাকে কি মাঝে মাঝে বের করেন? অর্জুন তাকাল।

লরিটাকে? না। তবে মাঝে মাঝে পরিষ্কার করা হয়, হানিফ ইঞ্জিন চালু করে দেখে নেয়। চাকার হাওয়া ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করে। আপনি বলছেন ওই লরি অ্যাকসিডেন্ট করেছে? বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন ফয়েজুর রহমান।

হ্যাঁ। গত দুই-একদিনের মধ্যে।

সেকী! এ তো ভৌতিক ব্যাপার।

দেখতে চান তো দেখে আসুন।

উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন ভদ্রলোক, হানিফ আসুক। ওই দেখুক। আমি আর দেখে কী বুঝব! আমি জানলাম না আর আমার লরি এই বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। করিমচাচাকে মাইনে দিয়ে রেখে কী লাভ হল?

করিমচাচা এই বাড়িতে আসেন সকালে। নিজের বাসায় ফিরে যান বিকেলবেলায়। ওঁর থাকার সময়ে নিশ্চয়ই লরি গ্যারাজের বাইরে বের হয়নি। তারপর তো এই বাড়িতে কোনও পাহারাদার থাকে না। অর্জুন বলল।

আমি কয়েকবার লোক রেখেছি। রাত পোহালেই তারা পালিয়ে গিয়েছে। কেউ সাদা কাপড়কে সোজা হয়ে হাঁটতে দেখেছে, কেউ অন্য কিছু।

অর্জুন একটু ভাবল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ঢাকার পুলিশের বড়কর্তাদের তো আপনি চেনেন?

হ্যাঁ, কয়েকজনকে চিনি। কেন বলুন তো?

কাউকে এখনই ফোন করে একটা খবর নিন। গতরাতে কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছে কি না। অ্যাকসিডেন্ট কেস হলে পুলিশ জানবেই। অবশ্য ঢাকায় অনেক হাসপাতাল আছে। যে হাসপাতাল এখান থেকে যাওয়ার পড়ে প্রথমে পড়ে সেখানেই আগে খোঁজ নিতে বলুন। অর্জুন বলল।

কার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে? ফয়েজুর রহমান অবাক হলেন।

আমি জানি না। উত্তরটা জানার জন্যে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। প্লিজ–!

ফয়েজুর রহমান মোবাইল বের করে একজনের নাম্বারে ফোন করে অনুরোধটা জানালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ঢাকায় কেউ আহত হয়েছে তা আপনি এই বাড়িতে বসে জেনে গেলেন? আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি।

অর্জুন বলল, চলুন, আপনার বাড়িটাকে ঘুরে দেখি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও অর্জুনকে অনুসরণ করলেন ফয়েজুর রহমান। অর্জুন দেখল ভদ্রলোক বেশ সন্তর্পণে হাঁটছেন। সে বলল, এখন সাপেরা ঘুমাতে গিয়েছে। কোনও ভয় নেই।

বাড়ির পেছনে এসে ফয়েজুর রহমান চেঁচিয়ে উঠলেন, একী! এখানকার মাটি খুঁড়ল কে? আমি তো কিছুই জানি না। করিমচাচা তো আমাকে বলেননি!

করিমচাচা তো এদিকে আসে না যে জানবে। ওর পক্ষে এই বয়সে এত মাটি খোঁড়া সম্ভবও নয়। আপনি কি অনুমান করতে পারেন কেন এখানকার মাটি খোঁড়া হয়েছে?

না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ফয়েজুর রহমান হতভম্ব।

অর্জুন দেখল কাল যা দেখেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি গর্ত হয়েছে এক জায়গায়। সে বাড়ির গায়ে বুনো ঝোঁপের পাশে গিয়ে দেখল দড়ির সিঁড়ির ওপরের দিকটা ছিঁড়ে পড়েছে। সেটা দেখে ফয়েজুর রহমান চেঁচিয়ে উঠলেন, একী! এখানে ওটা কে লাগাল?

যে বা যারা এখানকার মাটি খুঁড়েছে তারাই আপনার বাড়ির ছাদে ওঠার ব্যবস্থা এভাবে করেছিল। ওদের দুর্ভাগ্য যে সিঁড়ির দড়ি ছিঁড়ে গিয়েছিল।

কিন্তু কেন খুঁড়েছিল? কী দিয়ে খুঁড়েছিল?

আশেপাশে তল্লাশি করে খানিকটা দূরের এক গর্তের মধ্যে কোদাল এবং শাবল পাওয়া গেল। অর্জুন বলল, আপনি ঠিকই সন্দেহ করেছেন। ভূত কখনও মাটি খোঁড়ে না। ছাদে যাওয়ার জন্যে সিঁড়ির দরকার হয় না। চলুন, ছাদটা দেখে আসি।

.

ওরা ছাদে উঠল। ছাদের কোণে নজর গেল ওদের। এক ঝুড়ি জিনিসপত্র রয়েছে সেখানে। এটা গতকাল ওখানে দ্যাখেনি অর্জুন। ফয়েজুর জিজ্ঞাসা করলেন, ওটা কী?

অর্জুন হাসল, আচ্ছা, আপনার বাড়ির জিনিস। আমি কী করে বলব!

ফয়েজুর রহমান এগিয়ে গেলেন কৌতূহলী হয়ে। ঝুড়ির কাছে যেতেই চিৎকার করে দশ পা পিছিয়ে এলেন। ততক্ষণে ঝুড়ির পেছন থেকে একটা সাপ সোজা হয়ে ফণা তুলেছে। সাপের মাথায় দাগ দেখে অর্জুন বুঝল ওটা শঙ্খচুড়। এই সাপটা এখানে এল কী করে? সে গাছটার দিকে তাকাল। ওর ডাল থেকে বাঁদর লাফিয়ে ছাদে আসতে পারে, শঙ্খচূড় কি তা পেরেছে? সাপটা ফণা দোলাচ্ছে। ওর চোখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

ফয়েজুর রহমান ফিসফিস করে বললেন, চলুন, নীচে চলুন।

অর্জুন বাঁ দিকে তাকাল। সেখানে অ্যাসিডের টিনটা এখনও থেকে গেছে। সে ঝট করে সরে এসে টিনটা তুলতেই সাপটা ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলে কিছুটা এগিয়ে এসে থেমে গেল। অর্জুন ধীরে ধীরে ছাদের ওপর অ্যাসিড ঢেলে দিতেই সেটা গড়িয়ে সাপের দিকে যেতে লাগল। অ্যাসিডের গন্ধ পাওয়ামাত্র সাপ পেছন ফিরল। প্রথমে ঝুড়িটার দিকে চলে গেল। অ্যাসিড এগিয়ে আসছে দেখে সাপ ঝুড়ির ওপর উঠে পড়ল। সেখান থেকে ছাদের পাঁচিল হয়ে কার্নিশ নেমে দৌড়ে গেল ছেঁড়া দড়ির সিঁড়ির দিকে। সেই সিঁড়ি বেয়ে একটু নেমে ঝুলতে লাগল কিছুক্ষণ। তারপর লাফিয়ে পড়ল নীচে। পড়ে বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে গেল। ফয়েজুর রহমান বললেন, খুব জোর বেঁচে গেছি। আপনি না থাকলে এতক্ষণে এই শরীরটা লাশ হয়ে যেত। কিন্তু ব্যাটা ওপরে উঠল কী করে?

ওঠেনি। ওই গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে এখানে নেমেছে। কিন্তু কথা হল সাপটা এতবড় ঝুঁকি কেন নিল? অর্জুন বলল।

ঠিক। আচ্ছা, ওই অ্যাসিডের টিনটা ওখানে কে রাখল?

সেটা তো আপনারই জানার কথা।

বিশ্বাস করুন, আমি জানি না। করিমচাচাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।

আপনি ভুলে যাচ্ছেন, করিমচাচার পক্ষে ওই শরীর নিয়ে ছাদে ওঠা সম্ভব নয়। অর্জুন ঝুড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ওপরে কিছু পাথর রয়েছে। তলায় ঝুড়িভরতি মাটি। অর্জুন সন্তর্পণে মাটি সরাতেই দেখতে পেল ডিমগুলোকে। ওগুলো যে সাপের ডিম তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সাপের ডিমগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে ঝুড়িতে চাপিয়ে ছাদে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কেন? এখন বোঝা যাচ্ছে শঙ্খচূড়টা কেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ছাদে এসেছিল। এই ডিমগুলো নিশ্চয়ই ওই শঙ্খচূড়ের। ফয়েজুর রহমানও দেখতে পেয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ওগুলো কীসের ডিম?

অর্জুন বলল, ডিমগুলো থেকে বাচ্চা না বের হলে বোঝা যাবে না।

আশ্চর্য! ওগুলোকে এত যত্ন করে কে নিয়ে এল ছাদে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তার মানে, এই বাড়িতে বাইরের লোকজন যা ইচ্ছে তাই করছে?

ফয়েজুর রহমানের মোবাইল বেজে উঠল। তিনি কথা বললেন। ধন্যবাদ দিলেন। তারপর অর্জুনকে বললেন, না ভাই, আপনার অনুমান মিথ্যে হল। কাল রাত্রে অ্যাক্সিডেন্টে আহত কোনও লোক ঢাকার হাসপাতালে ভরতি হয়নি। আমার পুলিশকর্তা বন্ধু জানালেন।

অর্জুন খুশি হল, খুব ভাল হল। আপনি সোনার গাঁয়ের থানার বড়বাবুকে তো জানেন। ওঁকে ফোন করুন। লাইন পেলে আমাকে কথা বলতে দেবেন।

ফয়েজুর রহমান ফোন ধরিয়ে দিলেন। অর্জুন বলল, নমস্কার, আমি অর্জুন বলছি। আপনার এলাকায় নিশ্চয়ই কোনও হাসপাতাল আছে?

হ্যাঁ, আছে।

কাল রাত্রে একজন আহতকে ওখানে ভরতি করা হয়েছে। ঢাকায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল ওর বন্ধুরা, অবস্থা খারাপ হচ্ছে দেখে নিয়ে যেতে পারেনি বলে আমার ধারণা।

হ্যাঁ। আজ সকালে হাসপাতাল থেকে আমাদের রিপোর্ট করেছে। অজ্ঞান হয়ে আছে শুনে আমরা তদন্ত আরম্ভ করিনি।

দয়া করে ওকে পাহারা দেওয়ার জন্যে পুলিশ পাঠান। আমরা আসছি।

কেন বলুন তো?

মোবাইলে সব বলা যাবে না, গিয়ে বলছি।

যন্ত্রটা ফিরিয়ে দিতে ফয়েজুর রহমান বললেন, এই লোকটাকে চিনলেন কী করে?

কাকতালীয় ব্যাপার। বাকিটা অনুমান করেছিলাম, মিলে গেল।

নীচে গাড়ির আওয়াজ হল। ফয়েজুর রহমান বললেন, ওরা চা নিয়ে এসেছে। কিন্তু ওই ঝুড়িটাকে নিয়ে কী করবেন?

ডিমগুলো ফাটুক। দেখি, কী বের হয়! চলুন।

.

জোনাকি চায়ের টেবিল সাজাচ্ছিল। নিমকি এবং শিঙাড়া নিয়ে এসেছে। বাইরের দরজায় হানিফ দাঁড়িয়ে ছিল, পাশে লাঠি হাতে করিমচাচা।

করিমচাচা বলল, আমার কপালটাই খারাপ, বাবু।

কেন?

করিমচাচা বলার আগেই হানিফ বলল, যে সাপ কেনে সে নাকি বাইরে গিয়েছে। কিন্তু তার কাছের লোক বলল, ওরা মরা সাপ কেনে না। তা ছাড়া সাপটা মারা গিয়েছে মাথায় চোট পেয়ে। বিষ থাকলে তখনই বেরিয়ে গিয়েছে।

ও। সাপটা ফেরত এনেছ?

করিমচাচা মাথা নাড়ল। ওই জঞ্জাল ফেরত এনে কী হবে? একজন বিশ টাকা দিল, তাকেই দিয়ে দিলাম। ফতুয়ার পকেট থেকে টাকা বের করল করিমচাচা।

ওটা আপনি রাখুন। যে সাপ কেনে সে কোথায় গিয়েছে, কখন ফিরে আসবে তা কি জানতে পেরেছেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

না। দু’জনে একসঙ্গে মাথা নাড়ল।

চা খেয়ে অর্জুন বলল, আমি প্রথমে থানায় যেতে চাই। আপনি কী করবেন?

ভেবেছিলাম ঢাকায় ফিরে যাব। জরুরি মিটিং আছে।

তাই যান।

যাব কী? যা সব ঘটনা ঘটছে ফেলে যাওয়া যায়? চলুন। ও হ্যাঁ, জোনাকি, তুমি এই বাড়িতে থাকো। দিনের বেলায় কোনও ভয় নেই। আমরা চলে গেলে কেউ আসে কি না লক্ষ রেখো। করিমচাচা তো ভাল দেখতেই পায় না! ফয়েজুর রহমান বললেন।

এখানে থাকব? গলার স্বর করুণ শোনাল জোনাকির।

অর্জুন হাসল। কোনও ভয় নেই। এক কাজ করুন। একটা চেয়ার বা টুল নিয়ে ছাদে চলে যান। আকাশ মেঘলা, রোদে কষ্ট হবে না। ছাদে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলে কেউ আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

ফয়েজুর রহমান বললেন, হানিফ ছাদে একটা টুল দিয়ে এসো।

.

ফয়েজুর রহমানের গাড়ি নদীর ধার দিয়ে বাঁকের কাছে আসামাত্র অর্জুনের খেয়াল হল সে গাড়িটাকে থামাতে বলল। ফয়েজুর রহমান অবাক হলেন, নামবেন নাকি?

অর্জুন চারপাশে তাকাল। নদীর এপারে গাছপালা, কয়েকটা ছোট বাড়ি তার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে। সে বলল, একটু নেমে দেখে গেলে ভাল হয়।

কী দেখবেন?

করিমচাচা বললেন যে লোকটা সাপ কেনে সে বাইরে গিয়েছে কিন্তু তার কাছের লোক বাড়িতে আছে। বলা যায় না, আসল লোক ফিরেও আসতে পারে। এলে জানা যেত জ্যান্ত সাপ কিনে ওরা ঠিক কী করে! অর্জুন বলল।

একটাই উত্তর শুনবেন। ওষুধের কোম্পানির কাছে সাপের বিষ বিক্রি করি।

হ্যাঁ, এটা বলাই স্বাভাবিক। তবু ওদের ডেরাটাকে চোখে দেখে আসতে চাই। অর্জুন দেখল একটা লোক সাইকেলে চেপে আসছে। গাড়ির দরজা খুলে নিজে নেমে তাকে থামাল সে, এক মিনিট ভাই।

লোকটা সাইকেল দাঁড় করালে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এখানে একজন থাকেন যিনি জ্যান্ত সাপ কেনেন। তাঁর বাসাটা কোথায় বলতে পারবেন?

আমি কেন, যে-কোনও বাচ্চা বলে দিতে পারবে। যারা সাপ বেচতে আসে তারা ছাড়া কেউ ধারে কাছে যায় না। ওই যে বটগাছটা দেখতে পাচ্ছেন তার পেছনেই ওর বাসা। লোহার গেট খুললেই ভেতর থেকে কেউ না কেউ আওয়াজ দেবে। আপনারা কি সাপ বেচতে এসেছেন?

না। সাপের বিষ কিনতে এসেছি। অর্জুন গম্ভীর গলায় বলল।

লোকটার চোখ বড় হয়ে গেল। আর কথা না বলে সাইকেল চালিয়ে দ্রুত চলে গেল সামনে থেকে। অর্জুন ফয়েজুর রহমানের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, চলুন, দেখে আসি।

ফয়েজুর মাথা নাড়লেন, আমি এখানেই আছি, আপনি ঘুরে আসুন।

পিচের পথ থেকে মাটির রাস্তায় নেমে অর্জুন বুঝতে পারল এখানে গাড়ির যাতায়াত আছে। দু’পাশে আম আর কাঁঠালগাছ। ফলে জায়গাটা ছায়ায় ঘেরা। বটগাছের পেছনে যেতেই লোহার গেট নজরে পড়ল। গেটের ওপাশে ন্যাড়া জমি, একটা ঘাসও নেই। তারপরে একতলা বাড়ি। অর্জুন লোহার গেট খুলতেই শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে গলা ভেসে এল। কে? কে ওখানে?

অর্জুন ভেতরে ঢুকে গেট বন্ধ করে জবাব দিল, আমি অর্জুন।

ততক্ষণে ভেতর থেকে একটি মানুষ বেরিয়ে এসেছে। মানুষটির মুখে একদা হয়ে যাওয়া বসন্তের ক্ষতচিহ্ন বিপুলভাবে রয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করল, কী চাই।

অর্জুন এগিয়ে গেল সামনে, শুনেছি আপনারা বিষধর সাপ কিনে থাকেন। আমরা একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি যাতে সাপের বিষ দরকার। বেশি নয়, দুই আউন্স হলেই চলবে। সেটাই কিনতে এসেছি।

এখান থেকে সাপের বিষ বিক্রি করা হয় না।

সেটাও আমি শুনেছি। কিন্তু নিজেরা তো সাপ ধরতে পারি না যে ধরে বিষ বের করে নেব। আপনারা যদি বিক্রি করেন, টাকার জন্যে চিন্তা করবেন না। আমরা পাঁচ হাজার পর্যন্ত দিতে পারি! অর্জুন বলল।

পাঁচ হাজার! লোকটি অবাক।

হ্যাঁ, তবে সেটা জাতসাপের বিষ হওয়া চাই। যেমন ধরুন, শঙ্খচুড়, গোখরো, কালকেউটে। এইসব সাপ তো চাইলেই পাওয়া যায় না। অর্জুন কথা বলার সময় লক্ষ করছিল লোকটিকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।

দেখুন, আমি কিছুই বলতে পারব না। লোকটি বলল, মালিক বাইরে গিয়েছেন। তিনি ফিরলে আসবেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলে নেবেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, তাতে আপনার তো কোনও লাভ হবে না। ধরুন, আপনার মালিক আজ এলেন না, আমি অপেক্ষা করে চলে গেলাম। বাংলাদেশে তো শুধু এইখানেই সাপের বিষ পাওয়া যায় তা তো নয়। অন্য জায়গায় গিয়ে কিনে নিলাম। তাতে আপনার মালিকের বেশি ক্ষতি হবে না কিন্তু আপনার তো হবে। জাতসাপের বিষের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা তো কম নয়।

ওরে বাবা! ওই বিষের শিশিতে হাত দিলেই মালিক ধরে ফেলবে আর জ্যান্ত সাপের মুখ থেকে বিষ বের করতে আমি পারি না। মালিক পারে।

ব্যাপারটা খুব সাধারণ। সাপের মাথার পেছনে চেপে ধরে মুখটা খুলিয়ে সেখানে একটা পাত্র ধরলেই টপটপ করে বিষ বেরিয়ে আসবে। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, শঙ্খচূড় আছে?

আছে। তবে বিষ বের করে নিয়েছে মালিক।

সেটাকে কি মেরে ফেলেছে?

না না। অন্ধকার ঘরে ডিম পাহারা দিচ্ছে।

ডিম পাহারা দিচ্ছে? কীসের ডিম?

ডিমের মতো দেখতে পাথর। মালিকের এটা খেয়াল। সাপের বিষ বের করে নিয়েই ওই পাথরগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়। সাপ প্রথমে ছোবল মারে, ব্যথা পায়। তারপর ওগুলোর ওপর শুয়ে থাকে। কিন্তু কেউ যদি ওই পাথর তুলে আনার চেষ্টা করে তা হলেই ফণা তোলে। সেটা দেখে খুব মজা পায় মালিক। লোকটা বলল।

আমাকে দৃশ্যটা একবার দেখাতে পারবে?

তা পারব না কেন? কিন্তু আমার লাভের কথা কী বলছিলেন?

বিষ দিলে বিস্তার লাভ হত।

কাল একটা নতুন গোখরো এসেছে। আপনি যদি পারেন তা হলে বিষ বের করে নিন। আমি যে বিষ বের করতে পারি না তা মালিক জানে। তাই নিজে চেষ্টা করেও বিষ না পেলেও আমাকে সন্দেহ করবে না, আসুন।

পা বাড়াল অর্জুন, তোমার মালিক কি এখানেই থাকে?

মাঝে মাঝে। বড় মানুষের মতি বোঝার চেষ্টা করি না।

ভেতরে ছোট উঠোন। উঠোনের চারপাশের ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। লোকটা অর্জুনকে উঠোনের এককোণে নিয়ে গেল। বলল, দেখুন।

মাটির ওপর চাপা দেওয়া ভারী তক্তাগুলোর একটা সরাল লোকটা। কুয়োর মতো গভীর গর্ত। সেখানে আলো পৌঁছাতেই হিস হিস শব্দ শুরু হয়ে গেল। লোকটা বলল, এগুলো সব বিষ বের করা সাপ। আবার বিষ জমে গেলেই মালিক ওপরে তুলবে। নোকটা তক্তাটা আবার আগের মতো রেখে দিল। তারপর পাশের ঘরের দরজা খুলে দেওয়ালে ঝোলানো টর্চ হাতে নিয়ে আলো ফেলল সামনে। সেখানে একটা কাঁচের বাক্সে সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে। লোকটা বলল, এটা শঙ্খচূড়। বিষ বের করে নেওয়ার পর নেতিয়ে গিয়েছিল। ওর পেটের নীচে দেখুন, সাদা পাথরগুলো চেপে ধরে শুয়ে আছে।

অর্জুন দেখতে পেল পাথরগুলোকে। ছোট ছোট ডিমের আকারের পাথর। সে জিজ্ঞাসা করল, পাথরগুলোকে কি সাপটা ডিম ভাবছে?

জানি না। মালিক বলতে পারবেন। তবে ওই পাথর তুলতে গেলেই সাপটা ছোবল মারবে। দেখবেন? লোকটা জিজ্ঞাসা করল।

না, থাক।

তা হলে চলুন, গোখরো সাপটার বিষ বের করে নিন।

আমাকে মিনিট দশেক সময় দাও। আমার এক সাথিকে ডেকে নিয়ে আসি। বিষ বের করার ব্যাপারে সে এক্সপার্ট। তোমার মালিক তো এখনই ফিরে আসছে না। পনেরো মিনিটের মধ্যে সব কাজ শেষ করে তোমাকে পেমেন্ট দিয়ে আমরা চলে যাব। ঠিক আছে? অর্জুন খুব গম্ভীর দলায় বলল।

যা করবেন তাড়াতাড়ি করুন। লোকটা যেন উদাস গলায় বলল।

অর্জুন দ্রুত পা চালাল। গাড়ির কাছে এসে দেখল ফয়েজুর রহমান চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। সে দরজা খুলতেই তিনি তাকালেন। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি গোখরো সাপের মুখ থেকে বিষ বের করতে পারেন?

অ্যাঁ? আপনি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? ভদ্রলোক অবাক হলেন।

গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি চালু করতে বলে অর্জুন যা দেখে এসেছে তা বর্ণনা করল। শোনার পর ফয়েজুর রহমান বললেন, আপনি যা বললেন তা যদি সত্যি হয় তা হলে ভয়ানক ব্যাপার বলতে হবে। যে কেউ সাপের বিষের ব্যাবসা করতে পারে কি? এদের কি সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া আছে? তা ছাড়া এত বিষধর সাপ যদি কোনওরকমে বাইরে বেরিয়ে আসে তা হলে কত মানুষ মারা যাবে ভাবুন তো? ব্যাপারটা পুলিশকে জানাতে হবে।

অর্জুন মাথা নাড়ল। না। এখনই কাউকে জানাবার দরকার নেই।

কেন? ফয়েজুর রহমান জিজ্ঞাসা করলেন।

দেখা যাবে এই সাপগুলোর মূল আস্তানা আপনার বাড়িতেই। ওখান থেকে ধরে লোকজন এখানে বিক্রি করেছে অথবা এরাই লোক পাঠিয়ে ধরে নিয়ে এসেছে। এটা জানলে পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। অর্জুন বলল।

ফয়েজুর রহমান একটু মিইয়ে গেলেন, আমার ওখানে সাপ আছে ঠিক কথা কিন্তু বিষ সাপ্লাই দেওয়ার জন্যে সেই সাপগুলোকে ধরে আনছে এটা সত্যি কথা নয়। তা হলে এতদিনে আমার বাগানে একটাও সাপ থাকত না। লোকটাকে দেখতে পেলেন না?

না। কখন ফিরবে তা কাজের লোক বলতে পারল না। অর্জুন বলল।

রহস্যজনক ব্যাপার।

অবশ্যই। সেইজন্যেই আপনাকে বলছি এখনই পুলিশকে জানাবার দরকার নেই। লোকটার সঙ্গে আগে কথা বলি, তারপর প্রয়োজন হলে আপনি পুলিশকে জানাবেন। অর্জুন বলল, কিন্তু তার আগে জানতে হবে বিষ কিনে লোকটা কাদের কাছে বিক্রি করে? ঢাকার কোন কোম্পানি বিষ কিনতে এখানে আসে? সেই বিষ দিয়ে কী ওষুধ বানায়? অর্জুন যেন নিজেকেই প্রশ্ন করতে লাগল।

এসব জেনে আমাদের কী লাভ? ফয়েজুর রহমান জিজ্ঞাসা করলেন।

লোকটা ঠিকঠাক বিষ বিক্রি করার ব্যাখ্যা করছে জানলে সমস্যা অনেক কমে যাবে। আর এই ব্যাবসা তো অনন্তকাল চলবে না। এত সাপ কোথায় পাওয়া যাবে! একবার বিষ বের করে নেওয়ার কতদিন পরে আবার বিষ জমে সাপের মুখে? ব্যাবসা টিকিয়ে রাখার জন্যে লোকটা কী ব্যবস্থা নেয়। অর্জুন বলল।

নিশ্চয়ই কিছু একটা করে। ফয়েজুর রহমান বললেন।

আবার কিছু নাও করতে পারে। হাসল অর্জুন।

তার মানে?

এমন হতে পারে বিষ কেনাটা একটা বাহানা। আসল উদ্দেশ্য অন্য কিছু।

কী সেটা?

অর্জুন উত্তর দিল না। ছুটন্ত গাড়িতে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকল।

.

থানায় পৌঁছে ওরা বড়বাবুর ঘরে ঢুকল।

ওসি বললেন, আসুন আসুন। সমস্যাটা কী বলুন তো?

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কেমন আছে?

কন্ডিশন ভাল না। মেরুদণ্ডে চোট লেগেছে। পেইনকিলারের ইঞ্জেকশনের কারণে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার বলছেন এখানে ওর ট্রিটমেন্ট সম্ভব নয়। ঢাকাতে পাঠাতে হবে। ওর নাম শওকত আলি। ওসি বললেন।

নামটা কি ও নিজেই বলেছে?

সেই ক্ষমতা ছিল না। যখন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল তখন প্রচণ্ড চিৎকার করছিল যন্ত্রণায়। যারা ভরতি করেছিল তারাই নাম বলেছিল।

ঠিকানা বলেছে? যারা ভরতি করেছিল তারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছে?

অত রাত্রে সেসব হাসপাতালের কর্মচারী নিতে পারেনি। ওরা আজ সকালে এলে নিয়ে নেবে। কী ব্যাপার বলুন তো?

অর্জুন বলল, আমার মনে হচ্ছে লোকটার নাম শওকত আলি নয়। ওকে পাহারা দিতে লোক পাঠিয়েছেন তো?

অবশ্যই। কিন্তু আপনারা এত ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছেন কেন?

কারণ ওই লোকটা ফয়েজুর রহমানের বাড়ির ছাদে উঠতে গিয়ে দড়ির সিঁড়ি ছিঁড়ে নীচে পড়ে গিয়েছিল। অর্জুন বলল।

সেকী?

বুঝতেই পারছেন ওইভাবে যে উঠবে তার উদ্দেশ্য ভাল হতে পারে না। ওর লোকজন চেয়েছিল ওকে ঢাকায় নিয়ে যেতে। অবস্থা ভাল নয় বলে নিয়ে যেতে পারেনি। বেচারা পড়ে গিয়েছিল বলে ওরা কাল কাজ শেষ করতে পারেনি। অফিসার, ব্যাপারটা দীর্ঘ। বলতে সময় লাগবে। অর্জুন বলমাত্র ফয়েজুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, আরে এসব কথা তো আপনি আমাকেও বলেননি!

অর্জুন বলল, আপনার বাড়ি, আপনাকে বলব না, তা কি হয়। ভেবেছিলাম পুরোটা দেখে আপনাকে বলব। অফিসার, আর একটা প্রশ্ন, এখানে একজন সাপের বিষ কিনতে এসেছে। মানুষ দুশো টাকা পাওয়ার আশায় বিষধর সাপ নিয়ে ওর কাছে যাচ্ছে। শুনলাম সাপটা যদি মরে যায় তা হলে টাকা পাওয়া যাবে না। এই লোকটার কোনও খবর আপনার কাছে আছে?

অফিসার হাসলেন। বললেন, এতদিন থানায় কেউ এলে আমরাই তাকে প্রশ্ন করতাম। যতক্ষণ না সন্তুষ্ট হচ্ছি ততক্ষণ তাকে প্রশ্ন করে নাজেহাল করতাম। আজ দেখছি আপনি আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। মিস্টার রহমান আপনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। ঠিক আছে, কী যেন জিজ্ঞাসা করছিলেন, ও হ্যাঁ, শুনেছি ওইরকম কেউ এসে সাপের বিষ কিনছে। এটা একটা ব্যাবসা। সাপের বিষ বিক্রি করে ভাল টাকা পাওয়া যায়। যেহেতু এটা নিয়ে কোনও গোলমাল হয়নি, কেউ অভিযোগ জানায়নি তাই আমি মাথা ঘামাইনি। কিন্তু কী ব্যাপার? ওই ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার কাছে কোনও খবর আছে?

না। থাকার কথাও নয়। আমি গতকাল এখানে এসেছি। কিন্তু একজন লোক হঠাৎ বাইরে থেকে এখানে এসে সাপের বিষ কিনছে শুনে মনে হল লোকটা জানল কী করে এখানে প্রচুর বিষধর সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে? আপনি কি জানেন খবরটা? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

না। প্রচুর নয়, মাঝেমধ্যে দু-একটা সাপের কথা কানে আসে।

দ্বিতীয়ত, বিষ বের করে নেওয়ার পর সাপটাকে নিয়ে কী করা হয়? দুশো টাকার লোভে লোকে ওদের বিষ দিয়ে কি সাপটা ফেরত নিয়ে। যায়? ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। তা হলে কি সাপটাকে মেরে ফেলা হয়? মেরে ফেললে সেটা কি অপরাধের মধ্যে পড়ে না? আমাদের দেশে তো বন্যপ্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে কি সেই আইন নেই? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। অফিসার কথা বলতে বলতে হাত বাড়ালেন। টেলিফোন বাজছিল। কথা বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি, আপনারা যাবেন নাকি?

ফয়েজুর রহমান এতক্ষণে কথা বললেন, চলুন।

.

লোকটা শুয়ে ছিল চিত হয়ে। অফিসার একজন ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়েছিলেন হাসপাতালে ঢুকে। ওরা বিছানার কাছে যেতেই ডাক্তার বললেন, আধঘণ্টা হল জ্ঞান ফিরেছে। এই যে ভাই, এদিকে তাকাও। লোকটা মুখ ফেরাতেই অর্জুন চিনতে পারল। এই লোকটাই কাল তাকে ধমক দিয়ে নৌকায় চেপে চলে গিয়েছিল।

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, কী করে অ্যাকসিডেন্ট হল?

কপালে আঙুল ছোঁয়াল লোকটা। একটু কাশল। কাশতেই বোধহয় ব্যথা বোধ করল। অফিসার জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে যারা এখানে ভরতি করে গেছে তারা বাড়িতে খবর দেয়নি? কেউ আসেনি কেন?

জানি না। লোকটার কণ্ঠস্বর খুব দুর্বল।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম কী ভাই?

লোকটা এবার অর্জুনের দিকে তাকাল। তার চোখে যেন অস্বস্তি, কপালে ভাঁজ। অফিসার বললেন, নামটা মনে নেই তোমার?

কামাল। বিড়বিড় করে শব্দটা উচ্চারণ করল লোকটা।

অফিসার অবাক হলেন, কী বললে?

লোকটা এবার স্পষ্ট উচ্চারণ করল। কামাল।

ফয়েজুর রহমান ডাক্তারকে বললেন, আপনাদের রেজিস্টারে কামাল নামটা কি লেখা হয়েছে?

অফিসার জবাব দিলেন, না, হয়নি।

ডাক্তার বললেন, নাম যাই হোক, ওর যখন সেন্স ফিরে এসেছে তখন এখনই ঢাকার হাসপাতালে ট্রান্সফার করা দরকার। মুশকিল হল ওর কোনও আত্মীয় বা বন্ধু দেখা করতে আসছে না। তাদের না জানিয়ে ওকে পাঠানো উচিত হবে না। আবার ওকে জিজ্ঞাসা করেও ঠিকানা জানতে পারা যায়নি। এই যে কামাল নামটা বলছে এটাও ঠিক নাম কি না বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে ওর স্মরণশক্তি কাজ করছে না।

অর্জুন এগিয়ে গেল লোকটার কাছে, তোমার নাম কামাল নয়।

কী জানি?

তুমি নৌকা নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে কাল?

লোকটা তাকাল। মুখ ফিরিয়ে নিল।

অর্জুন আবার বলল, তোমার সব মনে আছে কিছুই ভুলে যাওনি। শোনো, তোমার মেরুদণ্ডে চোট লেগেছে। প্রথমবার ঝুড়ি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছিলে। সেই ওজনেই দড়ি আধছেঁড়া হয়ে গিয়েছিল। নামার সময় আর ভার সইতে পারেনি। যার জন্যে তুমি ওসব করছিলে সে তোমাকে একবারও দেখতে আসেনি। এখন যদি নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাও তা হলে সত্যি কথা বলো।

অর্জুনের কথা শুনে অন্যান্যরা অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। ফয়েজুর রহমান কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু অর্জুন তাকে হাতের ইশারায় থামতে বলল। লোকটার চোখ বন্ধ। অর্জুন আবার বলল, যদি বড় হাসপাতালে তোমাকে নিয়ে না যাওয়া হয় তা হলে তুমি মারা যাবে।

না, আমি কিছু জানি না। না বললেও মারা যাব, বললেও মরব। উঃ।

লোকটার যন্ত্রণা ফিরে আসছিল। ডাক্তার বললেন, আবার ওকে ইঞ্জেকশন দিতে হবে। এ যে কী ভয়ংকর যন্ত্রণা ভাবতে পারবেন না।

অর্জুন বলল, তোমার নাম শওকত আলি কামাল নয়। কী নাম। তোমার?

সালাম। সালামউদ্দিন।

বাসা কোথায়?

মেঘনার ওপারে। গ্রামে।

গ্রামের নাম কী?

হাটখোলা।

কে কে আছে তোমার?

কেউ নেই। বউ ছিল, ভেগে গিয়েছে। উঃ, ব্যথা হচ্ছে, ওঃ।

ঝুড়িতে কী ছিল? কী নিয়ে ছাদে উঠেছিলে?

জিনিস। ওপরে সাপের ডিম ছিল! বলতে বলতে লোকটা যেন দুমড়ে গেল যন্ত্রণায়। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার নার্সের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ইঞ্জেকশন দিলেন। দিয়ে বললেন, ব্যথা না কমলে ওর সেন্স আসবে না। এখনই ওকে ঢাকায় পাঠানো উচিত।

অর্জুন অফিসারকে বলল, হাটখোলা নামে কোনও গ্রাম আছে?

অফিসার বললেন, হ্যাঁ, আছে। মেঘনার ওপারে। ওখানে আমাদের থানাও আছে।

একটু কথা বলতে পারবেন? সালামউদ্দিন নামে কেউ ওখানে থাকত কি না?

হাসপাতালের বারান্দায় বেরিয়ে অফিসার ফোন করলেন। অর্জুন দেখল একজন সেপাই দরজায় পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলে অফিসার জানালেন, হ্যাঁ, লোকটার বাড়ি ওখানেই। একা থাকে। দু’বার জেল খেটেছে। ইদানীং ওর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই।

ফয়েজুর রহমান বললেন, চলুন যাওয়া যাক।

অফিসার বললেন, আমি একবার আপনার বাড়ির ভেতরটা দেখতে চাই। বাইরে থেকে অবশ্য কয়েকবার দেখেছি। কিন্তু অ্যাকসিডেন্টটা যখন ওই বাড়িতে হয়েছে–।

ফয়েজুর রহমান বললেন, চলুন।

.

করিমচাচা শুয়েছিল খোলা দরজার সামনে। তাই দেখে ফয়েজুর রহমান বললেন, দেখুন, কীরকম পাহারা দিচ্ছে? পুরনো দিনের লোক তাই ছাড়াতে পারছি না।

অর্জুন অফিসারকে বাড়ির পেছনে নিয়ে এসে ছেঁড়া দড়ির সিঁড়ি দেখাল। ভদ্রলোক খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, অত ওপর থেকে পড়ে বাঁচল কী করে?

ফয়েজুর রহমান বললেন, ও আর কতদিন বাঁচবে কে জানে। কিন্তু দেখছেন এখানকার মাটি কী ভয়ংকরভাবে খোঁড়া হয়েছে।

কেন খুঁড়ল? অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।

সেটাই তো রহস্য। অর্জুন বলল। ফয়েজুর রহমান ওপরের দিকে মুখ করে চিৎকার করলেন, জোনাকি, জোনাকি, একবার ছাদের এপাশে এসো। কিন্তু কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, জোনাকি কে?

আমার স্টাফ। ছাদে রেখে গিয়েছি পাহারা দেওয়ার জন্যে। ফয়েজুর রহমান বললেন, ঘুমিয়ে পড়ল নাকি।

ওরা বাড়ির সামনে এসে আবিষ্কার করল করিমচাচা ঘুমিয়ে নেই, জ্ঞান হারিয়েছে। অর্জুন তার মুখে জল দেওয়ার পর চোখ মেলল করিমচাচা। ফয়েজুর রহমান জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে তোমার?

করিমচাচা দু’হাতে মাথা আঁকড়ে ধরে বলল, কে যেন পেছন থেকে মাথায় মারল। উঃ। কিছু বুঝতে পারার আগে চোখে আঁধার দেখলাম!

শোনামাত্র অর্জুন দ্রুত সিঁড়ির দিকে ছুটল, তাড়াতাড়ি আসুন আপনারা।

ছাদে ঢোকার দরজা হাঁ করে খোলা। ছাদে পা দিতেই জোনাকির শরীর নজরে এল। পাশ ফিরে পড়ে আছে। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে ওর নাকের পাশে আঙুল রাখল। না। মরে যায়নি। ফয়েজুর রহমান পৌঁছে গিয়েছিলেন, একী! কী হয়েছে জোনাকির?

অজ্ঞান হয়ে আছে। জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করুন। অর্জুন চারপাশে তাকাল। আর কাউকে চোখে পড়ছে না। কিন্তু ঝুড়ির ওপাশে কিছু আছে। ফোঁস ফোঁস শব্দ ভেসে আসছে। অর্জুন অ্যাসিডের খালি টিনটা তুলে সেদিকে ছুঁড়ে মারতেই সাপটা বেরিয়ে এল। এবার আর ফণা তুলল না। সড়সড় করে ছাদের দেওয়ালে উঠে ওপাশের কার্নিশে নেমে গেল। অর্জুনের মনে হল এটা সেই সাপটা যাকে সে তাড়িয়েছিল। দেওয়ালের গায়ে এসে ঝুঁকে অর্জুন দেখল সাপটা নীচে না নেমে কার্নিশের ওপর চুপচাপ পড়ে আছে। এই সময় অফিসার চিৎকার করে বললেন, আরে। সাপ, সাপ!

অর্জুন সোজা হয়ে দেখল ডিমগুলো থেকে একের পর এক সাপের বাচ্চা বেরিয়ে আসছে। সরু, চকচকে শিশুসাপগুলো পৃথিবীটা কী তা বোঝার চেষ্টা করছে। দেখতে দেখতে ঝুড়িটা ভরে গেল। তারপর ওরা এক এক করে নীচে নামতে লাগল।

ফয়েজুর রহমান গিয়েছিলেন নীচে, জল আনতে। সেটা এনে জোনাকির মুখে দেওয়ার আগে এই দৃশ্য দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বললেন, মেরে ফেলুন, মেরে ফেলুন। সাপের বাচ্চাগুলো বড় হয়ে গেলে আরও বিপদ বাড়বে।

বাচ্চাগুলো কোথায় যাবে বুঝতে না পেরে ছাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। কিন্তু যেদিকে অ্যাসিড পড়েছিল বা টিনটা রয়েছে সেদিকে যাচ্ছিল না। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, এদের কি বিষ আছে?

না এখনও বিষধর হয়নি।

তা হলে ঝুড়িতে যা আছে ফেলে দিয়ে এদের চাপা দিন। পরে ঠিক করা যাবে এদের কী করা হবে। অফিসার বললেন।

জল পেয়ে জোনাকির চেতনা ফিরে এল। সে জানাল, তাকেও পেছন থেকে মারার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু জ্ঞান হারানোর আগে সে একঝলক লোকটাকে দেখেছে।

ফয়েজুর রহমান জিজ্ঞাসা করলেন, আগে কখনও দেখেছ?

না। মাথা নাড়ল জোনাকি।

অর্জুন ঝুড়ির মাটি ছাদে ফেলে দিল। বাচ্চা সাপগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে তাদের ওপর ঝুড়ি উপুড় করে রাখল। এখন আর ওরা বাইরে আসতে পারবে না। হঠাৎ অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, মাটির ভেতরে ওটা কী চকচক করছে?

অর্জুন স্তূপ হয়ে থাকা মাটি একটু সরাতেই সাত হিরের হারটা বেরিয়ে এল। সাতটা বেশ বড় হিরে সোনার চেনে আটকানো।

ফয়েজুর রহমান চেঁচিয়ে উঠলেন, একী! এটা কোত্থেকে এল?

অর্জুন ততক্ষণে হিরে এবং সোনার গায়ে লেগে থাকা মাটি সরাতে চেষ্টা করছে। সে ওটা ওপরে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এই সম্পদের কথা আগে শুনেছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু ওটা কোথায় আছে তা কেউ জানত না।

ভুল কথা। নিশ্চয়ই কেউ জানত। জানত বলে রাতের পর রাত এর সন্ধান করে গেছে এখানে। দিনের আলোয় করা সম্ভব ছিল না। রাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আপনার বাগানের সাপগুলো। কিন্তু আমার ধারণা যে এই সম্পদের খোঁজে এসেছিল সে জানত না ঝুড়িতে মাটি চাপা দিয়ে ওর এক অনুচর ছাদে নিয়ে গিয়েছে। তার লোভ এত বেড়ে গিয়েছিল যে সে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে গিয়েছিল। নামার সময় পড়ে যায়। অথবা এই ধারণা ভুলও হতে পারে। নিরাপদে রাখতে ওই লোকটাই ঝুড়ির ভেতর মাটিতে এটা রেখে ওপরে সাপের ডিম সাজিয়ে ওপরে পাঠিয়েছিল। অর্জুন বলল।

ওগুলো কি সত্যি সত্যি হিরে? জোনাকির গলায় শিহরন।

তাই তো মনে হয়। আর এই সাইজের হিরের দাম কত তা আমি আন্দাজেও বলতে পারব না। কিন্তু আমাদের অনুপস্থিতিতে যে করিমচাচাকে প্রথমে পরে জোনাকিকে অজ্ঞান করে ছাদে উঠে এসেছিল সে কেন এটা নিয়ে গেল না?

হয়তো খুঁজে পায়নি। অফিসার বললেন।

এটা কোথায় আছে জানা থাকলে সমস্যা হত না, জানা থাকলেও সে অবশ্যই ঝুড়ির মাটি খুঁজে দেখত। অর্জুন আবার ছাদের দেওয়ালের কাছে গিয়ে নীচে তাকাল। সাপটা প্রায় নির্জীবের মতো কার্নিশের ওপর পড়ে আছে।

সে চেঁচিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি চলুন। লোকটাকে পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

কোথায়? অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।

যে লোকটা সাপের বিষ কেনে তার কাছে। অর্জুন নীচে নামতে নামতে বলল।

ফয়েজুর রহমান বললেন, তাকে তো পাওয়া যায়নি। করিমচাচারা গিয়েছিল। হয়তো তখন এই বাড়ির আশেপাশে ছিল সে–।

ওরা গাড়িতে উঠল। হানিফ গেট থেকে গাড়ি বের করতেই অর্জুন বলল, একটু দাঁড়ান তো। সে দরজা খুলে দৌড়ে উঠে এল বাঁধের ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল নৌকাটাকে। সেখানকার স্রোতহীন জলে ভাসছে বাঁধনহীন অবস্থায়। ভাল করে লক্ষ করে বুঝল তার অনুমান সত্যি। নৌকায় একজন মানুষ রয়েছি চিত হয়ে শুয়ে।

.

অফিসারের ব্যবস্থায় লোকজনদের দিয়ে নৌকাটাকে তীরে আনা হলে দেখা গেল মানুষটি মৃত। তার শার্ট ছিঁড়ে হাতের কনুই-এর নীচে এবং ওপরে দুটো বাঁধন দেওয়া হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মানুষটা নৌকা পর্যন্ত যেতে পেরেছে সেই কারণে।

অর্জুন ফয়েজুর রহমানকে জিজ্ঞাসা করল, একে চেনেন?

খুব চেনা লাগছে। আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ভাই-এর সঙ্গে মিল আছে।

যারা নৌকোটাকে টেনে এনেছিল তারা বলল, ইনিই তো সাপের বিষ কেনেন। আপনার বাড়িতে ঢুকে সাপ ধরে আনতে বলতেন। ডাবল দাম দেবেন বলতেন। আমরা সাহস পেতাম না। বোধহয় ওই বাড়ির সাপই ওঁকে কামড়েছিল।

অর্জুন বলল, একদম ঠিক কথা। আমরা ছাদ থেকে চলে যাওয়ার পরে সাপ আবার ফিরে গিয়েছিল তার ডিমগুলোর টানে। মাতৃস্নেহ একেই বলে। এই মানুষটা তা জানত না। দু’জনকে অজ্ঞান করে সে যখন ঝুড়িতে হাত ঢোকাচ্ছে তখনই সাপটা তার আঙুলে ছোবল মারে। লোকটা নার্ভাস হয়ে গেলেও শার্ট ছিঁড়ে বাঁধন দেয় হাতে। কিন্তু মৃত্যুভয় পেয়ে আর ওখানে না। দাঁড়িয়ে নৌকায় ফিরে যেতে চায় ওপারে। সাপটাকে নেতিয়ে পড়ে থাকতে দেখে বুঝেছিলাম তার অবস্থা ভাল নয়। একেই ছাদে আসা-যাওয়ার ধকল ছিল তার ওপর কাউকে কামড়ে ও নেতিয়ে পড়েছিল। অর্জুন হিরে বসানো চেনটা ফয়েজুরের হাতে তুলে দিয়ে বলল, আমার কাজ শেষ। এইসময় অফিসারের ফোন বেজে উঠল। কথা বলে তিনি মাথা নাড়লেন, লোকটাকে আর ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে না। ওপরে চলে গেছে।