ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৩. শ্বাপদ ও দ্বিপদ

৩. শ্বাপদ ও দ্বিপদ

অরণ্যময় শিলাকীর্ণ পার্বতপথ অতিক্রম করে চলেছে আজাক্স, সঙ্গে অশ্বের বলগা ধরে পদচালনা করছে সুবন্ধু।

হঠাৎ সঙ্গীর দিকে ফিরল আজাক্স, অনর্থক কষ্ট করছ কেন? তুমি অশ্বারোহণে অগ্রসর হও।

সুবন্ধু হাসল, আমার সঙ্গী পদচালনা করবে আমি তার পাশে অশ্বারোহণে অগ্রসর হব, এমন কথা ভাবতেই পারি না। তবে তুমি ইচ্ছা করলে অশ্বপৃষ্ঠে আমার সঙ্গী হতে পারো। আমার নির্দেশ পেলে অঞ্জন তোমাকে বহন করতে রাজি হবে।

কিন্তু আমি রাজি হব না। তুমি যদি ভেবে থাকো–হঠাৎ চমকে ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সম্মুখে অঙ্গুলিনির্দেশ করল আজাক্স, অতি মৃদুস্বরে বলল, দেখেছ?

সুবন্ধুও থমকে দাঁড়িয়েছে, সঙ্গেসঙ্গে থেমে গেছে তার অশ্ব অশ্বের দুই চক্ষু ও নারারন্ধ্র বিস্ফারিত! অস্ফুট নাসিকাধ্বনি করে সে বলগায় টান দিল। তার গ্রীবায় মৃদু চাপড় মেরে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল সুবন্ধু।

যে-দৃশ্য অশ্ব ও মানুষের মধ্যে আকস্মিক উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল, সেই চমকপ্রদ দৃশ্যের অবতারণা করেছে প্রান্তরের উপর ক্রীড়ারত দুটি সিংহশাবক! নিবিড় লতাগুল্ম ও সারিবদ্ধ বৃক্ষের ভিতর দিয়ে অরণ্য পথে দণ্ডায়মান মানুষ ও ঘোটক সিংহশিশুদের নজরে ধরা পড়ে নি। প্রান্তরের বিপরীত দিকে শিলাকীর্ণ উচ্চভূমির উপর ছড়িয়ে রয়েছে হালকা ঘাস-জঙ্গল, সম্ভবতঃ সেইখানেই কোথাও অবস্থান করছে শাবক দুটির আস্তানা।

ক্রীড়ারত সিংহশাবকদের দিকে তাকিয়ে পরস্পরের সঙ্গে নতস্বরে কথা বলছিল আজাক্স ও সুবন্ধু। আজাক্স সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতেই সুবন্ধু তার হাত ধরল, চলো আমরা অন্য পথে যাই।

আজাক্স অধৈর্য হলেও কণ্ঠস্বর মৃদু রাখল, অন্য পথে যাব কেন? সম্রাটের জন্য অন্ততঃ একটি জীবন্ত উপহার সংগ্রহ করতে পারলেই আমরা এই পথে অগ্রসর হব।

সুবন্ধু গম্ভীরস্বরে বলল, ওই পথ মৃত্যুর পথ। গ্রীক! আমার কথা শোনো অন্য পথে চলো। শাবকদের জননী নিকটেই আছে। শাবকের নিকটস্থ হলেই সে আমাদের আক্রমণ করবে। অনর্থক প্রাণবিপন্ন করে লাভ কী?

ভ্রুকুঞ্চিত করে গ্রীকযোদ্ধা বলল, আমি সিংহীকে ভয় করি না। তোমার যদি ভয় হয়, তাহলে এইখানে দাঁড়িয়ে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো। অন্ততঃ একটি সিংহশিশুকে ধরতে পারলেই আমি ফিরে আসব।

আজাক্স সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার উপক্রম করতেই সুবন্ধু তার হাত চেপে ধরল, শোনো গ্রীক! আমি যে খুব সহজে ভীত হই না, তার কিছু প্রমাণ তুমি পেয়েছ। কিন্তু সিংহশাবকের স্বাধীনতা হরণ করে সম্রাটকে তুষ্ট করার জন্য আমি প্রাণবিপন্ন করতে রাজি নই- বুঝেছ?… আচ্ছা যাও, আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।

আজাক্স নিঃশব্দে এগিয়ে গেল, তারপর হঠাৎ বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে তীর বেগে ছুটে গেল ক্রীড়ামত্ত সিংহশিশুদের দিকে। সে আশা করছিল বিস্ময়ের চমক সামলে ওঠার আগেই সে সিংহশাবকদের মধ্যে অন্ততঃ একটিকে ধরে ফেলতে পারবে। কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না প্রায় তার হাতের তলা থেকেই ছিটকে সরে গেল শাবক দুটি, পরক্ষণেই বিদ্যুতের মত অন্তর্ধান করল অগভীর ঘাসজঙ্গলের মধ্যে। তাদের পিছু নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হল গ্রীকসৈনিক আজাক্স এবং অশ্বের বলগা ধরে অপেক্ষা করতে লাগল সুবন্ধু..

আচম্বিতে দূর অরণ্য থেকে ভেসে এল শ্বাপদকণ্ঠের বজ্রনাদ! সভয়ে মুখ তুলল সুবন্ধুর অশ্ব অঞ্জন, তার দুই চক্ষু আতঙ্কে বিস্ফারিত!

আবার গর্জনধ্বনি! কিন্তু আগের মতো গগনবিদারী আওয়াজ নয়– অবরুদ্ধ রোষ যেমন ফেটে পড়ছে ঘন ঘন চাপা গর্জনে!

কয়েকমুহূর্ত স্থাণু রইল সুবন্ধু, তারপর তার চমক ভাঙ্গল;–এক লাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে সে শব্দ লক্ষ্য করে বাহনকে চালনা করল দ্রুতবেগে…