৩. শেষরাত্রির বাঁশি

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – শেষরাত্রির বাঁশি

শেষ হয়ে গেছে জাগালীর পালা। মাঠের বাদশারা ফিরেছে ঘরে। এখন পশ্চিমের ঘুমন্ত মাঠে বসে রইল ডানা মেলে নির্জনতার পরী। কাঠকুড়োনি মেয়েদের ক্লান্ত পায়ের স্পর্শেও সরে যায় না। কোনো শব্দ আর সেখানে তরঙ্গ তুলতে পারে না। বড় ঘুমের ঋতু এখন এই মাঠে। বড় নিঃসঙ্গতা। রোদ কাঁপে লি লি করে। মনে হয় সেই পরীর হাসি।

আর ধীরে ধীরে সরে গেছে শেতলার নিষ্ঠুর ছায়াটা। মুক্ত আকাশের নীচে ম্লান মুখ অবসন্ন গ্রাম নিশ্বাস ফেলেছে স্বস্তির। অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর। অনেক সুন্দরকে বীভৎস করে অনেক রূপের লাবণ্যের সীমানায় যন্ত্রণায় ছবি এঁকে রেখে আবার কোন দেশ দেশান্তর সরে গেছে সেই অদৃশ্য ভয়ঙ্করী। লাঞ্ছিত হয়েছে ছকুলালের রূপ। বাঁ চোখটা ছোট হয়ে গেছে। মুখে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। হলুদরঙে কালো কালো ছোপ। আয়নায় চেহারা দেখে হেসে ফেলে সে। ভালো হয়েছে, সোন্দর হয়েছে। পনর্জন্মো হয়ে যেয়েছে একেবারে!

ওলাঙ্গিনী বলে, মানত দিতে হবে মাকে। মোনে মোনে মানসা করে এখেছি যে গো।

—মানত? মোন চাইলে দেবে।

—তুমার মোন চায় না?

—সংসারে একফোঁটা বিষের দব্য আমি ওলাঙ্গিনী। বুজেচো, নীলকণ্ঠ শিবঠাকুর হাঁচতে যেয়ে উগরে দিয়েছে গো! হো হো হাসে ছকুলাল। বুজলা না?

—কী জানি বাপু। তুমার বচনের অত্থটা কী। ওলাঙ্গিনী আহত মনে আপনকাজে যেতে চায়। ডাকে ছকুলাল, অসময়ে যাও কতি তুমি, লম্ফটা জ্বালো। মশায় ছিঁড়ে খেলে একেবারে।

—ঘাট থেকে আসি আগে।

—কতিকার ঘাট, যমুনানদীর নাকি? খুব হাসে ছকুলাল।

অবাক হয় ওলাঙ্গিনী। রেগে ওঠে। হ্যাঁ, কিষ্টোর বাঁশি বাজছে কিনা। ওগ থেকে উঠে কী যেন হচ্ছে দিন দিন মানুষটা। রেগে বেরিয়ে যায়।

নিজের প্রতি নিজেও অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ছকুলাল। আর মনে হয়, একটা অবলম্বন চাই। আত্মহত্যার কথা ভাবে সে। আর ভাবতে গিয়ে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ও দীনুপদ, দীনুপদ। উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকে লাঠিতে শরীরের ভর রেখে।—দীনু আছিস রে মামা?

শুনতে পেয়ে দীনু আসে। দীনুর ভাগ্য, মঙ্গলাকে নিষ্ঠুর হাতে শেষ করে দিয়েছে শেতলাবুড়ি, চারটি বাচ্চার দুটো সে গিলেছে টুকরো টুকরো কেটে। দুটো রয়ে গেল দীনুর কোলে। দুটোই মেয়ে।

দীনু এসে বলে, ডাকছিলে মামা?

—হ্যাঁ রে বাছা। কেমন তরাস পেইছিলাম।

—কেনে গো?

—কী জানি বাবা। থেকে থেকে বড় তরাস লাগে গো। একা একা থাকতে পারিনে!

—মামি কতি গেল?

—তুর মামি থাকলেও বাঁচোয়া নাই দীনুপদ। সিকথা কহা কঠিন। বড় দুঃখুর কথা বাবা।

দীনু অবাক হয়। কী গোপন কথা বলবে গায়েনমামা তাকে? নিরুত্তর মুখে প্রশ্ন এঁকে তাকিয়ে থাকে সে।

—দ্যাখ বাবা দীনুপদ, তুর আগের মামিরা মরে গেলে কিছুদিন বড় তাস লাগতো এমনি। কিছুতেই কাটাতে পারতাম না। উটা একটা বেধি রে বাছা, মহাবেধি। সি বেধিটা আবার জমেছে দেখছি।

—এখন তো মামি আছে গো মামা।

—তা আছে! কিন্তুক…

হাতড়ায় ছকুলাল। কথা খুঁজে পায় না। স্মৃতির প্রান্ত ধরে আনমনে টান দিয়ে চলে। উন্মোচিত হয় পুরোনো দিন। এই তরাসের জন্যে সে স্যাঙা করত। এর হাত থেকে বাঁচতে যত অনাসৃষ্টি। তবে কি সে আবার ফিরে যাচ্ছে তার পুরনো জগতে? কিন্তু কেন? এ যেন বিষম একটা পরস্পর বিরোধিতা। কিছু দেখে লাভ নেই, নিজের পথে চলো—এই পুরনো ধুয়ো, তবে কি নিত্যন্ত অবুঝ মনকে চোখঠার দেওয়া? নৈলে এমন হয় কেন?

—না, না, না। বিড়বিড় করে ছকুলাল।

দীনুপদ ধরে তাকে। ও মামা, তুমার শরীলের ঠিক নাই, চলো, শোবে যেয়ে। শুয়ে পড়ে ছকুলাল। ওলাঙ্গিনী ফিরে আসে এতক্ষণে। দীনুপদ আড়ালে ডাকে তাকে। ফিসফিস করে বলে, মামাকে ওঝার চিকিচ্ছে করাও মামি। অমানুষে পেয়েছে!

চমকে ওঠে ওলাঙ্গিনী। কেনে?

—যখন তখন একা থাকতে তরাস পায়! ক্ষ্যাপার মতো কী সব বিড়বিড় করে বকছে গো! খিল খিল করে হাসে ওলাঙ্গিনী। উ কিছু লয় গো ভাগনে। ব্যারামের সময় থেকে অমনধারা কচ্ছে। খারাপ ব্যামো তো। যা তা লয় বাবা, মা শেতলা। তরাসটা ঘোচেনি মোন থেকে।

—তুমি কুথাও যেয়োনা মামি, উকে একা ফেলে!

—আমি কাছে থাকলেও অমন করে। ওলাঙ্গিনী দীনুর কোলে বাচ্চাটা টেনে নেয় কোলে।

—তাহলে ঠিক অমানুষের আশ্রয় মামি।

—যাঃ ছোঁড়া, বুড়োমি করিসনে। ওলাঙ্গিনী কপট চোখ রাঙায়। শেতলার দংশনে উটা হয়। কতো দেখেছি বাপু!

—তা হোক। তুমি আর মাঠে ঘাটে যেয়োনা মামি।

—খাবো কী বাছা?

—আমাকে খামাকা অতগুলান ধান দিলে মামা। কিছু ফেরত লিয়ে আসি।

শুনতে পায় ছকুলাল। ডাকে—দীনুপদ, কীসের ধান?

—জাগালীর।

—কী হল?

—বলছি কিছু ধান তুমি ফেরত লাও। অক্ষম শরীলে খাটতে পারছো না। দীনু লেয্য হিসেব করে সকলকে দিয়ে যেয়েছে। আর আমি অলেয্য করবো, ইটা কেমন হয়?

—খাওয়া আবার ভয় বাবা?

ওলাঙ্গিনী টিপ্পনী কাটে, শেষে সম্বল একতারা তো আছেই।

মাথা নাড়ে ছকুলাল। তা আছে।

—গান ছেড়ে দেবার পিতিজ্ঞে?

গম্ভীর স্বর ছকুলালের। যিনি পিতিজ্ঞে করেছিলেন তিনি পশ্চিম মাঠে গত।

ওলাঙ্গিনীর মুখ দেখতে পায়না কেউ। নতুনকেনা নাকছাবিতে আঙুল তার। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙুলে গত বাদলায় নরম হয়ে থাকা মাটি খুঁড়ছে। তার শরীরে কেমন গন্ধ। সুন্দর সুবাস। ছেলে কোলে নিতে গিয়ে টের পায় দীনু। পাশ দিয়ে যাবার সময় আবার নাকে আসে। দীনু জানে ওটা লাল সাবানের ওষুধ—ওষুধ গন্ধ। একটু থামে সে। কী বলতে ইচ্ছে তার। বলা হয় না, ওলাঙ্গিনী ঘরে ঢুকছে। ধীরে ধীরে চলে যায় সে।

এমনি করে দিন কাটে। উচ্ছ্বাসিনী বর্ণহীন অকারণ দিন। ওলাঙ্গিনীর মাঠে যাওয়া বন্ধ হয় না। মাঠের রোদ্দুরে সিঁথির সিঁদুর তেমনি জ্বল জ্বল করে। তাঁতের নকশিপাড় রঙিন শাড়িতে আকাশের সবটুকু ছটা। কুড়েনো ধান বেচে নিজের কেনা কাপড় পরে গরবিনী ওলাঙ্গিনী। দিনে দিনে কী যেন গোপন সন্তর্পণ আনন্দের ভারে থরথর অঙ্গ ডাগর হয়ে ওঠে। বুকের দিকে চাইতে ভয়। চোখ মেলে চাইতে লজ্জা। শরীরে মাতাল নদীর ঢেউ রহস্যের আভাষে উত্তাল। ছকুলাল দেখতে চায় না। আর এদিকে নেত্যবালা চলে যাওয়ার পর আরেক সঙ্গী জুটেছে নীলকান্ত। শৌখিন চ্যাংড়া উড়ু উড়ু মন নীলকান্ত নয়। এ যেন গত বাদলার ডানাভাঙা পাখি। ওলাঙ্গিনী বলে মানিকজোড়।

ঠিক মানিকজোড় দুটিতে। রোদ্দুরে বসে বসে দিন কাটায়। শুধু মুখে—মুখে তাকানো আর বিড়ি খাওয়া। ওলাঙ্গিনী বিরক্ত হয়ে ওঠে। বাড়িটা যেন মরার মতো খাঁ খাঁ। এত লোক, তবু সহজ কথা নেই। ওদের কথা যেন শান্ত বদ্ধ ডোবার জলে বুজকুড়ি। নীলকান্তর সাজে। আহা রূপসী কিশোরী বউ। চপলা চঞ্চলা দুরন্ত মেয়ে নেত্য। তাকে হারিয়ে আর কী থাকে নীলকান্তর! কিন্তু ছকুলাল?

বায়তুল্লা আসে সবসময়। বলে—পাপের জাগালী লিব না গায়েন।

—কী করবা?

—ভাগচাষ।

—জমি?

—জোগাড়ে আছি।

—হালের গোরু?

উৎসাহে জাঁকিয়ে বসে বায়তুল্লা। —ভাই গায়েন, দুজনে চেষ্টা কলে কি সব মিলে না হে?

—শরীল অচল ভাই। তুমি দ্যাখো।

মুষড়ে পড়ে বায়তুল্লা। ভাই গায়েন দা, আজ আটবছর হেঁদুর কাছে বসবাস। বঁধুটা চলে গেল। কিন্তুক আর কতি মোন মিলাবো ভাই? স্বজাতিকুটুমকে ভালো চিনে লিইছি।

ছকুলাল তার মনের কথা ধরতে পারে। বায়তুল্লা আর হয়তো জীবনে সুখী হবে না। কিন্তু জমি পেলে ছকুলাল যাবে এর সঙ্গে? কেন? সে বলে, আমার কিছু ভালো লাগে না ভাই।

বায়তুল্লা ছকুলালের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। চলে যায়। ওলাঙ্গিনী গজরায়। ছকুলাল শোনে না। আর এতদিনে সন্দেহের রোমশ পোকা ওলাঙ্গিনীর মনে। সে ভয় পেয়ে যায়। ছকুলাল কী ভেবেছে তবে? কী জেনেছে তার? এই উত্তাপহীন আশ্চর্য আচরণের অন্য কী মানে থাকতে পারে? হাঁপিয়ে ওঠে সে। আর তার সেই লালিমা মলিন হতে থাকে—শীত শেষের গাছে গাছে যেমন করে পাতাগুলো হলুদ হয়ে উঠেছে এখন থরে বিথরে। ওলাঙ্গিনী ফিরে যায় তার স্যাঙার আগের জীবনের নৈঃসঙ্গে। অশান্তি আর ক্লান্তি ঘেরা পুরনো কয়লাকুড়োনো দিনগুলিকে তার মনে পড়ে। যখন দুটো সমান্তরাল লোহার পাতে দাঁড়িয়ে থই পেতনা পথের। অমিল দুটো পথরেখা যেখানে চলে গেছে, কেবলই চলে গেছে পরিচিত বিশ্বের সীমানা পেরিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশে! কোথাও ওরা মেলেনি হয়তো। এবং তখন তার শরীর থেকে আরেক শরীর জেগে ওঠার আয়োজন চলেছে। ফুলের ভাবে নুয়ে পড়া গাছে রক্তিম ফলের মুখ। নীচের কঠিন সাদা মাটিতে রসের কোনো সঞ্জীবন নেই।

নির্জন জগৎ থেকে গানের জ্যোতি এসে রাঙিয়ে দিয়েছে ছকুলালের ঠোঁট। ডেকে ওঠে সে। ও নীলকান্ত, একতারা দে। শীগগিরি একতারা দে!

—কতি এখেছ গো;

—হুই দিয়ালে ঝুলছে।

ঝংকার ওঠে পুরনো একতারা থেকে—

দেখে এলাম বাঁকনদীর ধারে।

(তার) তিনটি শাখা আঁকাবাঁকা বুকেতে বক চরে।।

ওলাং চমকে ওঠে উঠানে। ঝাঁঝাল গলায় বলে, আবার ভিক্ষেয় বেরোবা? জবাব দেয় না ছকুলাল। যন্ত্রণার এক প্রতীকীসত্তা রূপ পেয়ে দাওয়ায় বসে গান ধরেছে। আঃ কী যন্ত্রণা ওই সাদা বকটার গো, শিকেরি তির হানছে তার বুকে। কোন লক্ষ্য আছে কি? ছকুলাল গাইতে গাইতে বলে নীলকান্তকে।

বলে নীলকান্ত, আহা বেচারি বক!

চেঁচায় ওলাঙ্গিনী, সাঁওতাল জুটেছে সব কতি থেকে। কে বুজে বাপু সাঁওতালের বচন? দিবো একদিন একতারাটা আগুনে ফেলে!

হাসে নীলকান্ত। কেনে গো বউদিদি, উ পন্থা শ্যাষ পন্থা। উটা গেলে থাকে কী?

ফণা তোলে উত্তেজিতা সাপিনী—তুমার না হয় মাগছেলে নাই, উর তো আছে।

আহত নীলকান্ত মুখ ফিরিয়ে ডুবকিতে ঘা দেয়। বলে চলে ওলাঙ্গিনী, আর কী তবে! ইবার বেরিয়ে পড়ো দুই ষণ্ডায় পথে পথে ভিক্ষের ঝোলা কাঁধে। অক্ষম, অথপ্প, মানুষ….কেঁদে ফেলে সে। গান তবু থামে না। আপন বেগে অর্থের ভারে জেগে উঠেছে উচ্ছল পদগুলো।

এই ছিলো শ্যাষে আমার কপালে? ঘরসংসার করার সাধ আহ্লাদ সবই কি বেসজ্জন দিতে হবে? ফুলে ফুলে কাঁদে ওলাঙ্গিনী। কপালে করাঘাত করে। পাতলা বেণী হারানো চুলগুলো পিঠে এলিয়ে পড়ে বিষণ্ণ সন্ধ্যার মতো।

গাইতে গাইতে দেখে ছকুলাল। আর হঠাৎ থেমে যায়। বিস্রস্ত দেহাবরণ সরে গিয়ে উন্মোচিত হয়েছে আসন্ন অমৃতের স্বাদে ডাগর উচ্ছলিত স্তনযুগল। আশ্চর্য এক লালিমা। শীর্ণ হয়ে ওঠা পাঁজরের নীচে বসন বাগ মানে না। উন্নত স্ফীত জঠরে গর্বের স্মিত ভঙ্গিমা। একটি জন্মের ভারবহন করা নিটোল ঔদ্ধত্য।

একতারা খসে পড়ে হাত থেকে। লাফিয়ে নামে দাওয়া থেকে নীচে। ছুটে গিয়ে হাত ধরে টেনে তোলে। —উটো, উঠো। কী হল তুমার ওলাং?

ওলাং। প্রথম ডেকে ওঠা নতুন নাম। তিনটি অক্ষরে গাঁথা নামে কী অর্থ ঢুকিয়ে দিল গায়েন? ওলাঙ্গিনী কেশ বাঁধে। উঠে দাঁড়ায়। অশ্রু মোছে চোখ থেকে আঁচল টেনে। শীর্ণ চোখ। কিন্তু যে নীলিমা ঘনিয়ে আছে তাতে—সেকি শুধু একটি শিশুর জন্যে, না ওটা ছদ্মবেশী কোনো মায়া? ছকুলাল বুঝতে পারে না।

বিন্দুবাসিনী অবাক। অবাক সুঁদিপুরের চৈত্রমাসের বিকেল। উঠোনে নুয়েপড়া ঘনপত্রপল্লব গাবগাছে কোকিলের কুহুকুহু ডাক। লাল আবীরে রাঙানো দিগন্তের আকাশে উড়োজাহাজ গুঞ্জন।

ছকুলাল উঠোনে বসে বিড়ি বের করে। আগুন দ্যাও এট্টু। দেশলাই আনতে ভুলে যেয়েছি।

উনুন থেকে গনগনে অঙ্গার নিয়ে আসে বিন্দু। হাতে লোফালুফি করে আনে। ইস! কী চেহারা হয়েচে গায়েন।

—তা হয়েচে বাছা। তুমাদের ইদিকেও তো হয়েছিলো গো।

—হ্যাঁ। সে এক দারুন দিন। কিন্তুক আমার মোন বলছিলো নিশ্চয় গায়েনের কিছু হয়েছে।

—কেনে?

তার জবাব দিতে পারে না বিন্দু। বলে—কী জানি কেনে! আহা খুব কষ্ট চলছে তুমার কপালে।

—কষ্ট? না তো। বেশ আছি। বুজলে গো, বেশ আছি আমি। আর আবার খুব গান গাইতে মত্ত হয়েছি। সত্যি, খুব গান।

—খুব ভালো গান তুমার গায়েন। শুনতে ইচ্চে করে খুব।

হঠাৎ বলে ছকুলাল, —কিন্তুক গায়েনের সম্বাদ তো আখোনি।

মুখ নীচু করে বলে বিন্দু—সি দোষ আমার। নজ্জা হত গো। সি আত্তির থেকে আমার চোখে তন্দ্রা নাই গায়েন। ভাবনায় আমাকে বিনেশ কল্লে।

পুঁটুলি খোলে ছকুলাল। —যদি কিছু না মোনে করো, এট্টু পাঘনা।

—কী;

—এই জালখানা কিনে এনেছি ঝিকটিপোতা হতে। যতীনের তৈরি গো। যতীনকে চেনো না।

—ছি, ছি, আমি যে জাল কিনেছি গায়েন। লোকে দুষবে।

—লোককে না বল্লেই হল।

—কেনে? তুমি কী বলছ, কেনে বলছো উকথা গায়েন?

—তুমি আগ করলে বিন্দুবাসিনী—আমি ছোট জাত বলে?

—আমিও ছোট জাত গায়েন।

—তাহলে তো উত্তম কথা।

—জাল আমি লিতে পারবো না।

—কেনে গো! করুণ চোখে বেলাশেষের আলো টলমলিয়ে উঠেছে। বিন্দু দেখে না। আবার বলে ছকুলাল,—সত্যি লিবা না;

—না। কঠোর স্বর বিন্দুর।

—তুমি কি ভাবো আমি ভিক্ষে দিছি?

—না।

—তুমি কি ভাবো ইটা উপকারের পিতিদান?

—না।

—তবে।

—জানিনে। বিন্দু ছুটে ঘর ঢোকে। আহত ছকুলাল জালখানা পুঁটুলিতে বাঁধে ধীরে ধীরে। উঠে দাঁড়ায়। ঘরের দিকে লক্ষ্য করে বলে—বড় দুঃখু থেকে গেল বিন্দুবাসিনী, ম’লে তো দেখা হত না। যদি মরতাম, পরকালে এই ছোট সাধটা সঙ্গে যেত আমার।

এবার বাইরে আসে বিন্দু। বলে,—তা বলে কুটুমের বাড়ি এসে খালিমুখে যাবা গায়েন? সই যে দুষবে গো।

—কে সই তুমার বিন্দু;

—তুমার গিন্নি গো। কুটুম পাতাব বলেছিল। সিটা আজই হোক না। হাসে বিন্দু।

মরিয়া হয়ে বলে ছকুলাল, —কুটুমকে যদি দান দিই, গেহন কত্তে হবে না; আদান পেদান না হলে কুটুম কীসের বিন্দুবাসিনী।

এবার বিন্দুর কথা নেই। আলতো হাসি। ছকুলাল তাকে জয় করেছে।

সন্ধ্যার আঁধার আজ লাল হয়ে আছে আকাশের রঙে। পশ্চিমের আকাশে মাত্র একটি লাল তারা। কেন যে মনে হয় ছকুলালের—একটু লাল ওই সিঁথিতে থাকলে কী হত তবে? চরাচরের সব কিছু অমিল নাশ হয়ে গেলে কোনো মানে থাকত না বেঁচে থাকার?

খেলা সেরে ছেলে আসে ঘরে। ছকুলালকে দেখে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। মা বলে, তুমার কাকা। চণ্ডালিকের গায়েনকাকা।

লম্ফ জ্বেলে দাওয়ায় বসে বই খোলে ছেলে। বিন্দু গর্বে তাকিয়ে থাকে। বলে ছকুলাল, আমার অতনকুমারের সঙ্গে তুমার বেটার বঁধু পাতিয়ে দেব বিন্দু। অমনি বয়স। কলকেতায় পড়ে মেমসায়েবদের ইস্কুলে। আমার ভগ্নী থাকে কিনা সেখানে।

খানিক পরে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ছকুলাল। বাঁকী নদী পেরিয়ে আসে। নদীর পাড়ে বাঁশবনের মাথায় চাঁদের মুখ। পশ্চিমদিগন্তে লালরং তখনো ফুরোয়নি। দমকা বাতাসে বাঁশের বনে মর্মরধ্বনি। অচেনা ফুলের গন্ধ। দূরে বিলের ব্যানাবনে ঘরফেরা রাখালেরা বুঝি আগুন জ্বেলে দিয়েছে। বাঁ—পাশে শেয়াল ছুটে পালাচ্ছে। পলকে চেয়ে দেখে খুশি হয় সে। বাঁক পেরিয়ে সুমুখে একপাল কালো কালো মোষ। চমকে ওঠে মুহূর্তের জন্যে। পাশ কাটিয়ে যেতে মোষের পিঠে দীর্ঘ লাঠি হাতে কে লোকটা? বড় চেনা মুখ।

—কে যায়?

—বাড়ি চণ্ডালিকে। ছকুলাল দ্রুত পা চালায়। স্মৃতির আনাচে—কানাচে খুঁজতে খুঁজতে চলে। চেনা মুখ। নাকি কোন দুঃস্বপ্নের ঘোরে দেখা?

পেছনে উল্লাস ঘোষ মোষ ডাকাচ্ছে—ধোঃ ধোঃ।

সে রাত্তিরে আকাশের চাঁদ দেখে না বিন্দু। দেখে চাঁদের আলোয় মেলে ধরে আনকোরা নতুন জালখানা। বেসাল জাল। দুখানা বাঁকানো বাঁশে আটকানো থাকবে। জোড়ের একই তফাতে আরেক খানা আড়াআড়ি ছোট্ট বাঁশ। সেটা হাতে ধরে জোড়টা হাঁটুতে রেখে এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে জাল পেতে রাখবে। বাঁশ রাখা হাঁড়ির গলায় দড়ি জড়ানো। সে দড়ি বাঁধা থাকবে কোমরে। মুখে খেজুর পাতা আটকানো হাঁড়ি পাশে পাশে ভেসে বেড়াবে।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বিন্দু। ঝিকটিপোতার যতীন জেলের নামডাক ভারী। ষাট নম্বর সুতোর বোনা মিহিপাতির জাল। কুচোচিংড়িরও সাধ্য নেই গলিয়ে যায়। এত সুন্দর এত দামী জাল এনেছে গায়েন তার জন্যে।

আগের কেনা মোটা জালখানা গাছে ঝুলছে সারাদিন। রোদ্দুরে শুকোতে দিয়েছে গাবফলের কষ মাখিয়ে। কালো রং ধরবে। মজবুত হবে।

হঠাৎ কী যে শখ হল বিন্দুর। গাব—না দেওয়া আনকোরা এই জালখানা বাঁধতে বসল বাঁকানো বাঁশে। ছেলেকে ভাত বেড়ে দিয়ে চলল জলপরীর মতো তখনি। নামল অকারণ বাঁকি নদীর দহে। মিষ্টি জ্যোৎস্নায় ঝিকিমিকি দহের জল। মৃদু কাঁপন জলে। শ্যাওলাভরা শীতলকালো জল। জাল পেতে রইল পুবমুখে দাঁড়িয়ে। পুবে চাঁদ। পুবে চলে গেছে নদী অনেক দূর। তারপর বাঁক নিয়ে আবার উত্তরে।

খানিক পরে জাল তোলে বিন্দু। প্রথম সাইত। এর ওপর নির্ভর করে জালখানার ভবিষ্যৎ। ব্যগ্রহাতে জাল তোলে সে। চাঁদের আলোয় জালে জলের বিন্দু হাজার মুক্তোর মতো ঝকঝক করে ওঠে। খসে পড়ে টুপটুপ সেই সব মুক্তো। আর তীক্ষ্ন চোখে তাকায় সে। মোটা একটা চিংড়ীর চোখে মুক্তোর ছটা। ধারাল শুঁড়ে ঠিকরানো আলো। জ্যোৎস্না দিয়ে তৈরি একখান ছুঁচ। আরও কয়েকটা। তাড়াতাড়ি হাঁড়িতে রাখে বিন্দু। শিউরে ওঠে। যদি না উঠত এরা। এই নিষ্ফল জলে কী সাহসে প্রথম জাল পাতাতে এল সে।

জ্যোৎস্নার কাঁপন জলে। হাসছে দহের জল। বিন্দু হাসে। হাসতে হাসতে দেখে জলের বুকে হাসি। অকারণ হাসি। সারাক্ষণ হাসবে—হেসেছে অবিরল রাতের পর রাত জ্যোৎস্নার নদী। কেউ দেখে না, কেউ কোনো মনে করে না। অথচ জল হাসে।

রতিকান্তর মতো হাসে। সব সময় ঠোঁটের কোণে এমনি জ্যোৎস্নার ধারা। রতিকান্তকে মনে পড়েছে বিন্দুর। এমনি ভাবে জাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকত একবুক জলে। পাশফিরে পাশে দাঁড়ানো হাঁড়ি ধরে থাক। বিন্দুকে মুখ দেখাত। মুখ নয়, হাসি। বিন্দুর মনে পড়েছে রতিকান্তর মুখ। বুদ্ধুদের মধ্যিখানে তার স্বর গভীর জল থেকে উঠে এসে বেরুতে চায় ফাঁকা আকাশে। বিন্দু কান পাতে শুনতে। ফেটে যায় বুদ্বুদ। বাতাসে মিশিয়ে যায় যেন তার স্বামীর বলতে চাওয়া ইচ্ছে।

বিন্দু ব্যাকুল হয়ে ওঠে। শিথিল হাত থেকে জালখানা বুঝি খসে যায়। আর সেইসময় একপাল মোষের পায়ের আঘাতে নির্জন জলের জ্যোৎস্নার স্বপ্ন চুরমার হয়ে সশব্দে মিশে যায় দুইতীরের তৃণময় মাটিতে। হুড়মুড় করে জলে নেমেছে ওরা। বিন্দুর উপর দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে নদী। রতিকান্তর হাসি পলকে মিশিয়ে গেছে কোথায়। চেঁচিয়ে ওঠে বিন্দু। কোন আবাগীর বেটা রে, চোখের মাথা খেয়েছে নাকিন? জালখানা ছিঁড়ে যেল দেখছে না মিনসে?

মোষের পিঠে উল্লাস ঘোষ। হা হা করে হাসছে—কে বটে গো, বিন্দুবাসিনী নাকি?

চমকে ওঠে বিন্দু। কথা বলে না। জালখানা জলের নীচে রেখেই আস্তে আস্তে পিছু হাঁটে। ঘাট থেকে একটু দূরে জলের বুকে ঝুঁকে পড়া একটা কাঁটাঝোপের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কী একটা পাখি ডানা নেড়ে উড়ে গেল ঝোপ থেকে। ঝোপে সাদা সাদা ফুল।

নদীর পাড়ে উল্লাসের কণ্ঠস্বর। রাগ করোনা বিন্দু, একখানা জাল না হয় ক্ষতিপূরণ দেবো।

একঝাঁক শকুন কী তীব্রবেগে নেমে আসছে নীল আকাশ কাঁপিয়ে।

বন্দুকটা তুলে ধরল শরবিন্দু। ওদের একটিকে লক্ষ্য করার ভঙ্গিতে। একমুহূর্ত। আবার নামাল বন্দুক। একটু হাসল। ঝাব্বু সিং আর হাসিম শেখ অস্পষ্টস্বরে খেদোক্তি করল একটু তফাতে নিশ্চিন্দি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। গুলির শব্দ আর রক্তাক্ত শকুনের স্বপ্ন নিষ্ফল! ঘটলে দুজনেই খুশি হত খুব।

চণ্ডালিকার পূর্বমাঠে ফার্মের ক্যাম্প। বন্দুক হাতে দাঁড়িয়েছিল শরবিন্দু। সেই সময় ঘটছিল এসব। তারপর সে চোখ ফেরাল দূর দিগন্তে। যেখানে ন্যাশানাল হাইওয়ের অ্যাসফন্টের ওপর ঝড়ের মতো ছুটেছে যান্ত্রিক যানবাহনের অবিশ্রাম মিছিল। এখান থেকে একটা ডহর পথ গিয়ে মিলেছে পশ্চিমে সুঁদিপুরের কাছাকাছি স্টেশন থেকে আসা কাঁচা সড়কে। সড়কটা বাঁকী নদীর কিনারা ঘেঁষে পূর্বে চলে গেছে সোনাডাঙার পাশ দিয়ে একেবারে হাইওয়েতে। নদীর কিনারায় উঁচু বাঁধ এখন। আগে বর্ষার মরশুমে প্রায় একমাইল পথ পাড়ি দিতে হত নৌকা কিংবা তালগাছের গুঁড়ি কেটে বানানো ডোঙায়। এখন কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু বর্ষার সময় জলে কাদায় একাকার।

এই রাস্তাটা পাকা করতে হবে। ভাবছিল সে। দ্বিতীয় পরিকল্পনার মধ্যে যাতে ঢোকানো যায়, তার জন্যে অনেকদিন থেকে তদ্বির করছে শরদিন্দু। চণ্ডালিকা স্টেশন—ভায়া সোনাডাঙা হাইওয়ে রাস্তার জন্যে দাদা অর্ধেন্দুও ঝিকটিপোতায় বসে উদ্বিগ্ন।

আগে বাঁধ ছিল না। তাই পূর্বমাঠের এই নাবাল জমি পড়ে থাকত অনাবাদি। বিদেশ থেকে কৃষিতে ডিগ্রি নিয়ে এখন শরদিন্দু কৃষি ফার্ম খুলে বসেছে এখানে। বাঁধটা মজবুত বলে নিশ্চিন্ত মনে ইচ্ছেকে রূপ দিতে ভারী আয়োজন তার।

ক্যালিফোর্নিয়া, ইস্রায়েল কিংবা ইউক্রেনের মাঠে কৃষিখামারগুলোর গেটওয়েতে দাঁড়িয়ে এমনি ভাবত সে। ভাবত ভারতবর্ষের মাঠে মাঠে এমনি দিগন্তবিশারী ফসলের সম্ভাবনার কথা। বিজ্ঞানের কলাকৌশলে প্রকৃতির হাত থেকে কেড়ে নেওয়া অপ্রমেয় ঐশ্বর্যসম্ভার।

এই নাবাল জমির একপ্রান্তে একটু উঁচুতে করগেট শেড আর ছিটেবেড়ার দেয়াল ঘিরে বানানো তার ক্যাম্প। চারপাশে তারকাঁটার বেড়া। গোডাউন আর বসবাসের ঘর। নিজে ট্রাক্টর চালায় শরদিন্দু। বীজ থেকে শুরু করে ফসল ওঠা পর্যন্ত নানান যন্ত্র নিয়ে প্রাণপাত পরিশ্রম করে। মাইনে করা মেসিনম্যান হিসেবে একমাত্র মুকুন্দ নায়েক। মরশুমে দরকার মতো দিনমজুরিতে লোকও আনতে হয়। এখানে অনেক পরীক্ষা চলে তার। হাতে কলমে পরীক্ষা। প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়ে জমিতে। অতি উৎসাহে চেয়ে থাকে শস্যের চারার দিকে। হাতে করে তুলে ধরে পুষ্ট সতেজ পাতা কাণ্ড ফুল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ক্যাম্পের মধ্যে বড় বড় জারের ভেতর জিয়ানো বিবর্ণ গাছগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে পাতার পর পাতা রিপোর্ট লেখে। কৃত্রিম আলো বাতাস আবহাওয়া। মাইক্রোস্কোপে চোখ দিয়ে সূক্ষ্মতম স্তরের কোষগুলো নিরীক্ষণ করে সে। একজাতের সঙ্গে আর একজাতের কলম বানিয়ে মেটাবলিজমের প্রক্রিয়া জানতে চায়। নতুন পরিবেশে চারাগুলোর মধ্যে যে অস্থিরতা জেগে ওঠে, গভীর কৌতূহলে তার পরিমাপ করে তুলনামূলকভাবে। সূক্ষ্মতম বিচিত্রদর্শন যন্ত্রপাতি দেশিবিদেশি ওষুধপত্তর সার কীটনাশক বিষ এসবে ভরা তার ঘরখানা। ছোটখাটো একটা ল্যাবরেটরি। আর অজস্র কৃষিবিদ্যা—উদ্ভিদবিদ্যা—জীববিজ্ঞানের মোটা বই এলোমেলো ছড়ানো।

বেশ ছোটোখাটো একটা উপনিবেশ।

গোডাউনের সুমুখে একটু ফাঁকা জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে দুটো ট্রাক্টর। ডিস্ক হ্যারোর চওড়া পাতে আকাশের রোদ্দুর চকচক করে। হার্ভেস্টার কম্বাইনে রিপার পিকার থে সার এসব যন্ত্রগুলো সারসার সাজানো। প্লাউয়িং ট্রান্স—প্ল্যান্টারের কাছে দাঁড়িয়ে নদেচাঁদ ঠাকুর তাজ্জব হয়ে ফোকলা দাঁতে হাসতে থাকে তারপর।

ঝাব্বু সিং চেঁচায়—আপনা কাম দেখো ভেইয়া। মেসিনকা সাথ দিললাগীকা ক্যা ফায়দা? নদেচাঁদ যমের মতো ভয় করে লোকটাকে। ছুটে গিয়ে কয়লার উনুনে খামোকা খোঁচাখুঁচি করতে থাকে।

এখানে শরদিন্দু তার বাবা অম্বিকা চক্রবর্তী আর গয়জদ্দি মণ্ডলকে নিয়ে মেতে উঠেছে ততক্ষণে।

ম্যালথাসের মতবাদ। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, যুদ্ধ। বলে জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা। তারপর নামের ইস্তাহার ছড়ায়। অপরিচিত বিদেশি নাম সব। ডারউইন লেমার্ক ভাইসম্যান মেন্ডেল মরগ্যান….মিচুরিন লাইসেংকো।….

না বুঝেও মাথা নাড়ে দুই বুড়ো।

বলে শরদিন্দু কৃষি সমবায় ছাড়া কোনো উপায় নেই। এত জন্মবৃদ্ধির হার দেশে।

গয়জদ্দি বলে, কুকুর বেড়ালের মতো বিয়োচ্চে সব।

এবার রাশিয়ান কলখোজের কথা। সেটা কী বটে বাবা?

আবার খানিক বলে শরদিন্দু। শেষে বলে, অনেক টাকার দরকার। অনেক অনেক। লাইসেংকার আবিষ্কারের সত্যতা যাচাই করতে হলে টাকা চাই। কিন্তু অত টাকা কোথায়? একা এক এসব কোনোদিনই সম্ভব নয়।

সমবায় না হলে কিছু করা যাবে না।

গয়জদ্দি মণ্ডল কেটে পড়ে এতক্ষণে। দেড়ফুট শিষ গমের স্বপ্নে বিশ্বাস নেই তার। আসল তত্ত্ব তবে কিছু টাকা আর স্বনামে বেনামে রাখা এমাঠের নাবাল জমি। সমবায়ের অর্থ বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে তার কাছে। রাজা শংকরীপ্রসাদ ঠিকই বলেছিলেন। ওসব ছেলেমানুষির পাল্লায় পড়ে শেষমেশ ডুলির কড়ি জোগাতে বিবি বিকিয়ে যাবে।

আরও আসে অনেকে। খানিক দুর্বোধ্য খানিক অবিশ্বাস্য কথা শোনে। তারপর আপন জমির ফসলের রোগ বর্ণনা করে ওষুধ চায়। শরদিন্দু চটে ওঠে। ঝাব্বু সিং হাসিম সেখ—দুই পালোয়ান দারোয়ান চোখ পাকায়। কেটে পড়ে তারা।

এমনি করে দিন কাটে তার। কখনো বেরোয় বন্দুক কাঁধে মাঠের মধ্যে। শিকারে নয়। এক অদ্ভুত আতঙ্ক তাকে ঘিরে আছে এই মাঠে। এ মাঠের জন্যে অনেক রক্ত ঝরেছে। তার বন্দুকের গুলিতে গত বছর দুজন জখম হয়েছিল। দাদা অর্ধেন্দু জাঁদরেল উকিল। ফাঁড়া সহজেই কেটে ছিল।

তবু তার রক্তে মিশে আছে এ মাঠের মাটির এক আশ্চর্য স্বাদ। একে ছেড়ে কোথাও সে থাকতে চায় না। টেস্টটিউবে রসায়নে ভিজিয়ে রাখা বীজের পরিণতি লক্ষ্য করতে করতে আনমনে বেরিয়ে আসে বাইরে। চেয়ে থাকে অনেক সময় ধরে। সুমুখে অনন্ত সম্ভাবনা ভর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। আসন্ন প্রসবের শারীরিক লালিত্যে স্নিগ্ধ মাঠ।

ফসল বাড়াতেই হবে। এক ঋতুর ফসল অন্য ঋতুতে ফলিয়ে একই জমিতে বিভিন্ন ফসল তুলতে হবে। একর পিছু বাড়াতে হবে ফসল। নৈলে মানুষের চিৎপ্রকর্ষের শ্রেষ্ঠতম সম্পদে ভরা এই মহাকাশযুগের প্রাজ্ঞ পৃথিবী মানুষের মুখ দেখবে না আর।

এক মারাত্মক ব্যাধির মতো তাকে এসব গ্রাস করে রেখেছে। এর বাইরে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বাইরে সরে এলে সে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যাবে।

তা বেড়েছে ফলন। কাঁচা রাস্তা দিয়ে ট্রাকবোঝাই ফসল পাঠায় সে শহরে। অর্ধেন্দুর একটা ব্যবসাও আছে। আড়ত আর থানা মার্কেটিং কোঅপারেটিভ। অর্ধেন্দু স্বয়ং সেক্রেটারি। তার ওপর সে ঝিকটিপোতা মুনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানও।

ফসল লুঠ হয়েছিল দুবার। ট্রাক আটক করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো গ্রাম—গ্রামান্তরের চাষিরা। ড্রাইভার দৌড়ে পালিয়ে এসেছিল। লোকজনসহ পৌঁছানোর আগেই সব খতম। এঞ্জিনে আগুন জ্বেলে দিয়ে পালিয়েছে লুঠেরারা। ট্রাকখানা জলের দামে বেচে দিলে অর্ধেন্দু। আর কিনতে দেয়নি ভাইকে। ভাড়া করা ট্রাকের অভাব নেই।

ক’দিন পরে পুড়ল বারোবিঘে আখ।

তারপর বহাল হল জাগাল হিসেবে দশজন দুর্ধর্ষ লেঠেল। এলাকার নামজাদা দাগী সব।

এ—মাঠে সহজে নামতে চায় না মাঠচরানি মেয়েরা। ক্যাম্পের পাশে উঁকি মারলে কানে আঙুল দিয়ে পালাতে হবে যেদিকে চোখ যায়। নন্দীভৃঙ্গীর মতো বসে আছে হাসিম সেখ আর প’ছে ঝাব্বু সিং। দুই মহাবীর হনুমানের মতো পাঁয়তারা কষে যে বচন ঝাড়বে, শুনলে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে।

হাসে শরদিন্দু। এসব ভাষা কোথায় শিখলে হাসিম?

—আঁজ্ঞে সার। উটা শালীদের মাতৃভাষা। বুঝবে ভালো।

—সার! নদেচাঁদ ঠাকুর ছুটে আসে।

—ডাক তো মেয়েদুটোকে।

সহজে আসেনা টগর এলোকেশী। সহজে আসবে না জেনেই হাসিম বা ঝাব্বুকে পাঠায় শরদিন্দু। নদেচাঁদ গ্রামের লোক। সাদাসিদে মানুষ। ভয়ে ভয়ে আসে ওরা। মাথা নীচু করে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপে। —নাম কী তোমার?

—আমার? বলে টগর। আমার নাম টগরবালা দাসী। উ এলোকেশী।

—কাদের তোমরা?

—আমরা কুনাই বটি বাবু।

—বাড়ি?

—ই চণ্ডালিকে গো।

—পরের জমির ফসল কুড়োচ্ছ। বরং মজুরনির কাজ করলে তো পারো।

—আজ্ঞে….মুখ নত করে ওরা। ভাষা জোগায় না মুখে। আতঙ্কে শরীর নীল হয়ে গেছে।

নদেচাঁদ জবাব দেয়—সেটা দেশে প্রথা নাই সার। সাঁওতাল মেয়েরা অবশ্যি খাটে।

বাধা দেয় শরদিন্দু। প্রথা করে নিতে দোষ কী। পরের গাল খাওয়ার চেয়ে মেহনত করে দু’পয়সা রোজগার করবে। শোন তোমরা, কাল থেকে এখানে কাজ করতে পারবে? চৈতালি মাড়াই হচ্ছে মেসিনে। তোমরা শুধু ঝেড়ে খোসা কুটো বাছাই করবে। পারবে? কত মজুরি চাও?

কথা বলতে পারে না টগর। পারে না এলোকেশী।

আবার বলে শরদিন্দু, কী হল?

নিশ্চিন্দিগাছের ছায়ায় বসে হাসিম সেখ ঝাব্বু সিং খৈনী চিবুচ্ছে। গতিক দেখে আকর্ণ হাসে। খানিক পরে বলে টগর বাড়িতে শুধোতে হবে বাবু।

—কে আছে বাড়িতে?

—আজ্ঞে?

—সিঁদুর পরছে যখন, স্বামী আছে নিশ্চয়। তাকে বলবে আমার নাম করে। গ্রামেও খবর দেবে। যত মেয়ে কাজ চায়, দেব আমি। যাও এখন।

ওরা মিলিয়ে যায় দূরে। তারপর একটা গমের শিষ কোন রূপসীর মুখ তুলে ধরেছে এভাবে দুহাতে ধরে রাখে শরদিন্দু। মুখ একটু এগিয়ে নিয়ে যায়।

দেখে নদেচাঁদ হাসিম আর ঝাব্বু সিং পরস্পরকে লুকিয়ে ফিক ফিক করে হাসে। হুজুরসাব প্যার করতা!

ওখানে লুকিয়ে কুড়ানো গমের শিষটা হাতে তুলে ধরে টগর।

বলে এলোকেশী, সত্যি আসবি নাকিন রে;

আনমনে জবাব দেয় টগর, কতি?

—বাবুর কেম্পে?

—জানিনে।

—কেনে?

—জান্নে।

—বুলবিনে?

—না।

একঝাঁক বগাড়ী উড়ে যায় পায়ের ফাঁক দিয়ে। চমকে ওঠে টগর। হঠাৎ ছুটতে থাকে হাসিমুখে। চেঁচিয়ে বলে, আমাকে ধরতে পাল্লে বুলবো।

এলোকেশীও ছোটে। পাশ দিয়ে অগ্নিকোণে একটা ঘূর্ণীবাতাস চলে যায় একরাশ শুকনো খড়কুটো আর ধুলো ছড়িয়ে। অনেক উঁচুতে উঠে গেছে একটা পাতা। তর তর করে ঘুরছে।

অনেক রাত্তির অবধি পড়াশুনা পরীক্ষা—নিরীক্ষা নিয়ে থাকে শরদিন্দু। তাই সকালে উঠতে একটু দেরি হয়। আজ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। বাঁধা সময়ের আগে। লাল চোখে ভারী গলায় ডাকে সে, ঝাব্বু!

—হুজুর সাব।

—বাহারমে এতনা ঝামেলা কৌন করতা। বলেই বন্দুকে হাত রাখে সে।

—আপ উসরোজ বোলা না, উও লড়কী সব আসলো হুজুর। সবকোই মিলে ঝামেলা করতে আছে।

—গিনতি কিয়া তুম?

—উঃ রামজী, কমসে কম শও তো না হোবে।

—একশো?

বেরিয়ে আসে টলতে টলতে শরদিন্দু। স্লিপারটা বাইরে বেরিয়ে থাকে গোড়ালি থেকে। পরনে পাজামা। গায়ে ডোরাকাটা বুকখোলা জামা।

এলোমেলো চুলে কপাল ঢেকে আছে। বিরক্ত হয়ে বেরোয় সে। বেরিয়ে অবাক।

ঝাব্বু সিং মিথ্যা বলেনি। চারপাশের গ্রামে থেকে রোগা হাগিলে কুশ্রী বাচ্চাওয়ালিরাও এসেছে। সব রকম বয়সের মেয়ে। পরনের কাপড় দেখলে ঘেন্না আসে। তাতে ছেঁড়াফাটা। কোনোমতে অঙ্গ ঢেকে আছে। পরিছন্ন ভালো কাপড়েও গুটিকয়। তাঁর মধ্যে টগর এলোকেশী শরদিন্দুর চেনা। একমুহূর্ত ইতস্তত করে সে। তারপর ডাকে, হাসিম, ঝাব্বু সিং।

—হুজুর সাব!

—সব এক লাইন পর খাড়া কর দো।

—জী সাব।

—ফিন আচ্ছা আচ্ছা লড়কীকো বাছাই করো। আই মিন, যো কামকে লিয়ে আচ্ছা হ্যায়।

আকর্ণ হেসে দাঁড়ানোর হুকুম জারি করে ওরা। গায়ে হাত দিয়ে ঠেলে দাঁড়ানোর ব্যাপার সমঝে দেয়। মেয়েরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কেউ চেঁচিয়ে ওঠে, গায়ে হাত দিয়ো না বাছা। তারপর হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে সলজ্জ হাসি তবু ফুরোয় না।

ঝাব্বু সিং সকলকে নম্বর মাফিক সাজায়। এবার বাছাই করে হাসিম। সায় দিয়ে যায় ঝাব্বু। ঠিক ঠিক! ঠিক হোগা, আচ্ছা হোগা।

বেছে বেছে তেরো জন আচ্ছালড়কী মেলে। বাদবাকি সব বাতিল।

মাথা নীচু করে চলে যায় তারা। একটু দূরে গিয়ে ঘেন্নায় থু থু ফেলে কেউ। কে বলছে—নীলকান্তর মা বুঝি—রূপযৈবন থাকলেই সোমসারে খাঁটি। নামুনে ডাকত, পাপিষ্ঠ। আর উই যে দেখছো নন্দীভিরিঙ্গী উদের হাড়মাস কখন শকুনে ছিঁড়ে খাবে ভগবান।

সারবন্দি দাঁড়িয়েছে তেরোটি মেয়ে। হাসিম ঝাব্বুর চোখ ঝুটা নয়। আচ্ছা চীজ পরখ করে নিয়েছে। ডাগর শরীরে যৌবন এসে সব অসঙ্গতি নিঃশেষে ঘুচিয়ে দিয়েছে। পূর্বমাঠে ঝিকিমিকি রোদ্দুরে জ্বলছে তেরোটি দুর্মর যৌবন। চৈত্রের আকাশের নীচে তেরোটি সুবাস ফুল। দাঁতে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে হুকুম দেয় শরদিন্দু—কাম সমঝা দেও। টগর কী বলতে গিয়ে থেকে যায়। হাসিম সেকের চোখে চোখ পড়ে। বুঝি মজুরির হার শুধোত সে। হাসিম সেখ মাথায় লাল গামছার পাগড়ি বাঁধছে আর হাসছে। সে চোখে সে হাসিতে কী একটা আছে, যা লম্পটের নয়। খুনের। টগরের সঙ্গে সঙ্গে সব মেয়েই একই অনুভূতি পায়। অজানা আতঙ্কে বুক ছমছমিয়ে ওঠে। তবু কাজ তো একটা। দিনের শেষে পয়সা মিলবে। তাই ওরা সোৎসাহে এগিয়ে যায় সেখানে একটা অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রে ফসল মাড়াই হচ্ছে। কাছে গিয়ে শিউরে ওঠে কে।

অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে যন্ত্রটার হাঁকরানি দেখে। উঃ মাগো!

ওলাঙ্গিনী না?

গ্রাম থেকে ঢালু হয়ে নেমেছে শূন্য মাঠ। তারপর এক মাইল সমতল নাবাল জমি। তার পূর্বে আবার ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে। সেখানে বুকের উপর পড়ে আছে হাইওয়ে। একটা নালা এই নাবাল ফার্মের মাঠকে দুভাগ করে চলে গেছে দক্ষিণে। উত্তরে কাঁচাসড়কে—বাঁধে এক হয়ে আছে যেখানে। সেখানে স্লুইস গেট আছে একটা। বাঁকীর সঙ্গে মিলেছে খাল। প্রস্থে কুড়ি হাতের বেশি নয়। স্লুইসগেট থেকে এর জল নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। খালের পশ্চিমপাড়ে দিন রাত্তির যান্ত্রিক নাদে গম গম করে ক্যাম্প। শহরের আড়তদার ব্যাপারী দালাল সব সময় আসে যায়। পাত্তা পায় না কেউ। দাদার আড়ত আর মার্কেটিং কোঅপারেটিভে সব ফসল চালান দেয়। ওখানে দুভায়ের নামে হাজার টাকা করে শেয়ার—বাবার নামে আমানত পাঁচ হাজার। অর্ধেন্দু ফিকিরে আছে এই ফার্মের ওপর একটা এগ্রিকালচারাল কোঅপারেটিভ করার। কিন্তু অসুবিধা অনেক টুকরো জমি নিয়ে। গয়জদ্দি মণ্ডল শংকরীপ্রসাদ যুগেশ্বর আর সোনাডাঙার ইনতাজ সরদার তার মালিক। চেষ্টা সত্ত্বেও সার্থক হয় না স্বপ্ন। তবু অর্ধেন্দুর বিরাম নেই। জাঁদরেল উকিল। অবিশ্রাম টোপ ফেলে চলে বাগে পেলে। গেলে না কেউ।

অবশ্য অর্ধেন্দুর প্ল্যান মতো চললে কবে কাজ শুরু হয়ে যেত। কিন্তু মত নেই শরদিন্দুর। সে শুধু সরকারি লোন আর অন্য ধরনের সহায়তা চায় না। একটা সত্যকার কোঅপারেটিভ। দাদা ভাইয়ে এটুকু মাত্র বিরোধ। নেহাত আদর্শগত। অগত্যা অর্ধেন্দু ভাইয়ের মতে মত দিয়েছে। কারণ ততদিনে সে রাজনীতি করার স্বপ্নে মেতে উঠেছে। আর শরদিন্দু চারপাশের সব জমিগুলো সমবায়ের মধ্যে আসবে, যাতে করে বিরূপ জনসাধারণের মনোভাব বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা গড়ে উঠবে দিনের পর দিন। এই একটা ব্যাধির মতো অবস্থা। শরদিন্দু চায় জনসাধারণকে। আবার সবচেয়ে ক্রোধও তার জনসাধারণের ওপর। সব মিলিয়ে একটা জটিল মানসিক উৎকণ্ঠা তাকে সব সময় ঘিরে রাখে।

শয়তান নিরক্ষর জনসাধারণ। আক্রোশে চেঁচিয়ে ওঠে শরদিন্দু, ড্যাম ইওর ডেমোক্র্যাসি ড্যাম দি পিপল। চাপড় মারে টেবিলে। দি হেল।

ঘরর….ঘরর….

হার্ভেস্টার কম্বাইনের গর্জনে চৈত্রের মাঠ থরথর করে কাঁপে।

সোনাডাঙার বউ বীণা বলে লরক, লরক!

চৈতালি বাতাসে খোস উড়িয়ে ফসল বাছাই করছে সারসার দাঁড়িয়ে তেরোটি মেয়ে। রিপারে গম কাটা হচ্ছে নালার ওপারে। মুকুন্দ নায়েক এখানে ট্রাকটরের স্টিয়ারিং ধরে দাঁড়িয়ে একবার চেয়ে দেখছে এদের। পিকার মেসিনটা ছোলার জমিতে বুনো শুয়োরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এখানে দুটো থেসার অবিশ্রাম মাড়াই করে চলেছে।

আবার মুখ বেঁকিয়ে বলে বীণা, লরক।

গোডাউনের দরজায় ট্রাকে বস্তা বোঝাই করছে কুলিরা। হেসে ওঠে বীণার কথা শুনে।

চণ্ডালিকার সরসীবালা শুধোয়—কেনে?

—দেখছো না কেমন হাঁকরাছে আক্ষসের মতো।

হেসে ওঠে তেরোটি ঠোঁট। বীণার সব থেকে ভাব ওলাংএর সঙ্গে। ছকুলালের আগের বউ আদরকীর সুনন্দাপিসির ভাইপোর গিন্নি বীণা। তাই দুজনে গলাগলি। ইনিয়ে বিনিয়ে সুখদুঃখের কথা বলে অবসর পেলে। মুকুন্দ বলে, ললিতাবিশাখা। এগিয়ে এসে একমুখ সিগ্রেটের ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। ঠোঁট চুমু দেওয়ার ভঙ্গিতে চুকচুক করে। বিব্রতা ওলাং নাকিস্বরে চেঁচায়, ও সিংজীবাবা, ও স্যাকবাবা।

মুকুন্দ ছুটে আবার ট্রাক্টরের দিকে পালায়।

কিন্তু ভারী হুঁশিয়ার ঝাব্বু সিং আর হাসিম সেখ। এ তেরো জনের বাচ্চা নেই একথাটা ভালো ভাবে পুছে নিয়েছে। সাচ্চা মাল। জেরা সে খুঁত নেই। অবশ্যি তিনটি গর্ভিণী তেরোজনে। বলেছে ঝাব্বু সিং উতিন কাহিল হোতে হোতে চৈতালি ভি খতম!

হাসিম শুধোয়, যখন বোরাধান ওঠেগা?

—ঠারো। আভি পুছকে আতা হ্যায় হাম।

ছুটে যায় ঝাব্বু শরদিন্দুর কাছে। সদ্য আমদানি একটা ডিগারে চৈতালি আলু তুলছে সে। নাকে ধুলো বাঁচানোর জন্যে রুমাল জড়ানো। ঝাব্বুকে দেখে ক্যাম্বিশের মতো পুরু একটা কাপড় ঝুলছে পা অবধি। ঝাব্বুকে দেখে মেসিন বন্ধ করে তীক্ষ্নচোখে তাকায়। কৈ ঝামেলা?

—নেহি সাব। ফিন ঝামেলা ক্যা। তাকত হ্যায় কিসিকা?

—তবু? নেপোলিয়ানের ভঙ্গিতে দাঁড়ায় শরদিন্দু।

—হাম পুছতা হ্যায় কি যব এ চৈতালি খতম হো যায়েগা, উও লড়কী লোগেকা ক্যা কাম হ্যায়?

হেসে ওঠে শরদিন্দু। বুড়বক কাঁহিকা। আব ইসকো তো খতম হোনে দো। উ বাত পিছে। ঝাব্বু সিং চলে আসে খাল পেরিয়ে। সাবকা মতলব পরভু রামজীভি না জানতা ভেইয়া, হামলোক কৌন হ্যায়।

ট্রাকদুটো চলে যায় গেট পেরিয়ে। একরাশ ধুলো উড়িয়ে ডহর ধরে চলে।

রিনঠিন চুড়ি বাজে। তেরো জোড়া সুঠাম বাহুতে কেঁপে ওঠে যৌবনের পুষ্পিত লতা। রুক্ষ ধুলোকুটোমাখা চুলে বাতাসের কাঁপন। ঝর ঝর করে পড়ে পায়ের নীচে স্তূপীকৃত ফসল।

কে চেঁচায়—গায়ে পড়ছে দেখছ না!

—কী আমার সুবরণীরে, সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেল।

—আঃ কী করিস বাপু। চোখেমুখে পড়ছে দেখিসনে;

টগর বলে—একসারে দাঁড়া না ভাই। তাহলে কাকেও লাগবেনা।

—দেখলি আঁটকুড়ির কাণ্ডটা? চোখ চেপে বসে পড়ে একজন।

সকলে খিলখিল করে হাসে। কার কুলো ধরে ঝাঁকুনি দেয় কে। আঃ মিশে গেল সব!

—যাঃ বারোভাতারি। হেসে হেসে গাল দিচ্ছে বীণা।

গর্জে ওঠে হাসিম সেখ,—এই হারামজাদি শয়তানের ছা! এই ভাতারওলি মাগিরা!

পলকে থেকে গেছে স্পন্দন। একমুহূর্তে কাঠের পুতুল সব। তারপর মাথা নীচু করে কাজ করে চলে। চাপাগলায় বলে টগর—ইর থেকে জাগলের গাল অনেক ভালো। ছিঃ!

—আর আসব না কাল হতে।

—ভাতারে ঠেঙাবে যে গো কন্যে।

—তা বলে বেজাতের গাল? ছিঃ!

একটু হাসে টগর। কৌতুকের দীপ্তি তার চোখে। বলে নেত্যবালার কথা।—কারুর কাছে ভাতারের পীরিতি বিষের তুল্যি। আর জাগালের ধারালো দাঁতের কামড় অমৃত্যের মতো লো, মিষ্টিমাখা।

—খেয়ে আয় না এট্টু অমৃত্যো স্যাক ভেয়ের কাছে।

—এবার ঝাব্বু লাঠি ঠোকে। ঘবরদার মৌগী লোক!

আবার কথা নেই। আবার ঝরঝর সর সর শব্দ। উড়ন্ত খোসায় চৈতালি রোদ্দুর।

উদাস দুপুরের পাখির ডাকে ঘুমের ছায়া। খৈনি গালে ভরে ঝিমোয় বসে ঝাব্বু। সিং উপাধিটা এখানে জুটেছে। আসলে জাতে ভুঁইহার বামুন। ছাপরা জিলার লোক। দেশছাড়া আজ বিশবছর। চরকির মতো শুধু ঘুরছে সে। কলকাতায় কাটিয়েছে বেশ কিছু দিন। তারপর এখানে। বয়সে প্রৌঢ়। কিন্তু শরীরখানা মজবুত রেখেছে সে। একবার দেখলে এদেশী বীরপুরুষের বুক চমকে ওঠে। খাড়া নাকে রক্তের ছোপ যৌবনের ঔদ্ধত্যকে প্রকাশ করে এখনো।

তন্দ্রার আমেজ। মোড়ায় বসে নিশ্চিন্দিগাছে ঠেস দিয়ে শরীর এলিয়েছে সে। গাল বেয়ে লাল ঝরছে।

চৈতালি আকাশের নীচে বুঝি এখন তার মন সরে যাচ্চে ঘুমের ঢেউ বেয়ে অনেক অনেক দূর। ঝাব্বু সিং এক গভীর দুর্গম স্মৃতির অন্ধকারে উত্তীর্ণ হতে চাইছে। এখন তার এলানো শরীর, চোখের পাতায় নেমে আসা নেশার বিকার, সবটুকু দেখলে মনে হয় লোকটা ভারী খাঁটি। অনন্ত সরসীবালা তাই বলে। বলে, আহা বেচারা!

ভুট্টার খেতে মেয়েদের গান। কতযুগ আগে শোনা। নীল নীল পাহাড়ে মুখ লুকানো দিগন্তে বেলা শেষের সূর্য। মায়ের পেছন পেছন আসছিল সে। গিনঠিয়ার মাঠে লাল আলো। কুয়োর ধারে নির্মলার মল ঝমর ঝমর বাজছে। হেসে ফেলে নির্মলা। মা ক্ষেপে ওঠে, কাহে হাস রহলে গে, কাহে?

নিরুত্তরা মেয়ে। মাথায় তুলে নিয়ে চলে যায় মল বাজিয়ে। ঝমর ঝমর ঝম দূরে মজুরনিদের গান। ঘরে ফিরছে খেত থেকে। গিনঠিয়ার আকাশে লাল আবীর। হোলীর উৎসব হয়ে গেছে কদিন আগে। নির্মলার দেওয়া রংটুকু জামার বুকে তখনো অম্লান। আর এখন সবার কাপড়ে মিশলো বেলা শেষের সূর্যের আলো। নির্মলার বুকখানও আগুনের মতো জ্বলছিল।

ঘরে ফেরা মেয়েদের একটানা গান। নির্মলা এসে তাকে ধাক্কা দিয়েছে।

—আঃ পরভূ রামজী! মোড়া থেকে পড়ে গেছে মাটিতে। হাতে তুড়ি দিয়ে লাফিয়ে ওঠে ঝাব্বু। সিয়ারাম, সিয়ারাম।

হি হি হি হি….

গান থামিয়ে হাসছে মেয়েরা। হাসছে রোগাপটকা মুকুন্দ নায়েক ট্রাক্টরের চেন ফ্রেমের নীচে থেকে শুয়ে। তারপর কালিঝুলি মাথা গতর নিয়ে বেরিয়ে আসছে হাসতে হাসতে।

—এই বেশরম খবিস। হাঁক নিয়ে উঠেছে হাসিম সেখ। জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে মেয়েদের দিকে ছুটেছে সে।

—হাসিম ভেইয়া! ডাকে ঝাব্বু। যানে দো।

মেজাজ কেমন আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে ঝাব্বুর। চোখ মুখ মুছে টলতে টলতে এগোয় সে। ঘটিটা হাতে নিয়ে খালের দিকে চলে যায়। দিনশেষের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছে চণ্ডালিকা প্রান্তে!

ক্যাম্পের বেড়ার একপাশে দাঁড়িয়ে কাতর ছকুলাল। ঝাব্বু সিং তেড়ে আসে। ক্যা মাংতা? ভিখ নেই মিলতা ইঁহা।

—ভিখ লয় বাছা। আমার পরিবার মাংতা গো।

বিব্রত ছকুলাল। পরনের কাপড়টা এত ময়লা কোনোদিন পরত না সে। কিন্তু দিনে দিনে কেমন আলসেমি ভর করেছে তাকে। তাছাড়া ওলাং সারাদিন এখানে থাকে। কেচে দেবার লোকও নেই। তাই ভিখিরির মতো দেখাচ্ছে।

রসিকতা করে ঝাব্বু—হামলোক পরিবার বানাতা হ্যায় না ক্যা?

—না গো বাছা। উই যি মোটাপানা মেয়েটা, হুই একপাশে………..আঙুল তুলে দেখায় ছকুলাল। আকর্ণ হেসে হাসিম সেখ এগিয়ে আসে।

—গায়েনের কী সংবাদ?

হেঁ হেঁ! ভারী খুশি হয় ছকুলাল। এই সে স্যাকভাই! আমার পরিবারকে এটু পেয়োজন তাই এলাম।

ওলাংকে ডেকে আনে হাসিম।

—বিন্দুবাসিনী এসেছে গো, তোমার সই।

খুশিতে ফেটে পড়ে ওলাং। —সত্যি নাকিন? তারপর পেছনে ঘুরে তাকায়। মুষড়ে পড়ে হঠাৎ যদি যেতে না দ্যায় বাবু!

—কেনে? উর কেনা বাঁদী নাকিন? ছকুলাল বলে, বাবুকে বলো। আম্মো স্যাকভাইকে বলি। ও স্যাকভাই!

হাসিম সাড়া দেয়। —কহো গায়েন। সুচালো দাড়ির ডগা পাক দেয় বসে—বসে।

—এট্টু ছাড়তে হবে ইয়াকে। ঘরে কুটুম এসেছে গো। ইয়ার সই।

—কতিকার সই হে গায়েন?

—সুঁদিপুরের।

—অ। সেই বাগদিনী বুঝি। তা ভালো। হাসিম সব খবরই রাখে। বিন্দুবাসিনীর গত আশ্বিনের সেই রোমাঞ্চকর কীর্তি চণ্ডালিকা পরগনায় ছড়িয়ে গিয়েছিল ক্রমে।

অনুনয় ছকুলালের। —এট্টু ছেড়ে দ্যাও ভাই আজকের মতো।

জবাব দেয় না হাসিম।

—স্যাকভাই।

এবার ধমক দেয় হাসিম। —কী স্যাকভাই করো হে?

ছকুলাল ভারী দুঃখিত। বলে—ওলাং!

—বলো।

—বেরিয়ে এসো।

ওলাং পাংশুমুখে বলে, কী করে?

ছকুলাল দেখে গেটে তালাবন্ধ। বলে, খুলবানা স্যাকভাই?

—হুকুম নাই।

চেঁচিয়ে ওঠে ছকুলাল। —ও বাবু, ছোটবাবু। সাড়া নেই। শরদিন্দু মাঠের কোথাও আছে অনেক দূরে। এখানে ঝাব্বু সিং হাসিম হাহা হাসছে নিশ্চিন্দি তলায় খাটিয়ায় বসে।

—ইটা তো বন্দিশালা ওলাং। আগে জানলে কিছুতে পাঠাতাম না তুমাকে। লোকের বারণ না শুনে বড় ঠকেছি ওলাং। আর ইখেনে এসোনা তুমি।

ছকুলালের স্বর শুনে কান্না পায় ওলাং—এর। মুখ নীচু করে ফিরে যায় কাজে। ছকুলাল ফিরে আসে। পেছনে নদেচাঁদ বলে—সায়েবের হুকুমটা যেন কী! একটা মুনিষ গেলে কী ক্ষতি হত এমন! যত সব!

হাসিম ধমক দেয়—এইয়ো নেমকহারাম! নদেচাঁদ চুপ।

বাড়ি চলে আসে ছকুলাল। এসেই ধপ করে বসে পড়ে দাওয়ায়। শুধোয় বিন্দু—এলোনা?

—আসতে দিলে না। কাজের চাপ খুব বেশি কিনা। তা না আসুক এখন। তুমি থাকো বিন্দু—নাগাদ সানজে উ আসবে। আত্তিরটা থেকে যাও কুটুমের বাড়ি।

থাকবে বিন্দু? ভাবছে সে ছেলের কাঁধে হাত রেখে। দুষবেনা লোকে? সাদা কাপড়ে কালির ছিটে। কত সহজে ধরা দেয়। একদিন কত যত্নে বাঁচিয়ে এসেছে নিজেকে কত প্রলুব্ধ দৃষ্টি থেকে—কত সন্তর্পণ দুর্বলতা থেকে। অথচ কোথায় কোন প্রান্তে কীটের মতো কী বসে আছে গোপনে। রোমশ মাকড়সার মতো মমতার জাল বুনে রেখেছে। মমতাই বটে মমতার সূক্ষ্ম জাল বেয়ে ছুটে আসে পোকাটা। কোন অতলে অনুভবের এক সূক্ষ্মতম স্তরে দংশন করে চলে যায়। জন্মে দিয়ে যায় বিষ মনের গহনে। বিন্দু তখন কাতর। নির্জন নিঝুম রাত্তিরে যখন পাখির ডাকও নেমে গেছে—বেরিয়ে এসে দাওয়ায় বসে। মনের ভিতর নিশ্চুপ কান্না। গত আশ্বিনের এক বিকেলকে স্মৃতির থেকে কিছুতেই সরানো যায় না। স্মৃতির অরণ্যে যেন একঝলক আগুন জ্বলে উঠেছে সেদিন থেকে। চোখের জলে নিবিয়ে রাখে। তবু ঘোচে না স্ফুলিঙ্গটুকু। আবার জ্বলে ওঠে সেই কি টানে তাকে এখানে আসতে? তার নাম বুঝি মমতা?

কিন্তু কে তার মুখে হাসির রেখা টানে যখন সুঁদিপুরের আকাশে উল্লাস গয়লার বাঁশির সুর নদীর জল থেকে উঠে আসে একরাশ আলোর মতো তার অন্ধকার দিশায়? মোহ? উল্লাস ঘোষ। সুঁদিপুরে দুর্ধর্ষ যৌবন। মাথায় লাল পাগড়ি। হাতে লাঠি আর বাঁশি। মোষের পিঠে চেপে নদী পেরোয়। জাল ছেঁড়ে তেজি মোষের পায়ের আঘাতে। সেই তো প্রথম ঢেউ; ছালাৎ করে লাগাল বুকে। হেসে উঠল বাঁকীনদীর জল। হেসে উঠল উল্লাস। বিন্দু দেখেনি। শুনল কানে। জলের ঢেউ ভিজিয়ে দিয়েছিল বুকের আবরণ। ভিজে গেছে উন্নত বুকের উজ্জ্বল উদ্বেল লুকিয়ে থাকা ঐশ্বর্য। রক্তে জেগেছিল গতিবেগ।

আর সেই জলের মুখ, রতিকান্তর মুখ, রতিকান্তর বুদ্ধুদেব ভাষা মিশে গেল নিমেষে চারপাশের দুর্গমতায়। আর উঠবে না রতিকান্ত জলের গভীর থেকে। কোনোদিন।

অথচ রতিকান্তর ছেলে বেঁচে আছে—এই এক অদ্ভুত পরিহাস।

শিউরে ওঠে বিন্দু। ছেলেকে বুকের কাছে টানে। বলে—উঠি তবে গায়েন।

—না বিন্দু। ইটা বড় খারাপ হয়। তুমি তো আমার গান শুনবা বলেছিলা, আজ সনজেয় শোনাবো গো। আসুক তুমার সই।

—না গায়েন।

—শুনবানা গান;

—শুনবো আরেকদিন।

—তবে চালডাল দিই। চাট্টি আন্না করে খেয়ে যাও। ছেলের মুখ শুকনো। কখন এসেছ।

—থাক।

—তুমার সই দুঃখু পাবে বাছা। দুষবে আমাকে।

হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে ফিসফিস করে বলে বিন্দু—লোকে যে আমাকেও দুষবে গায়েন।

পলকে লাল হয়ে ওঠে ছকুলাল। করুণ কণ্ঠে বলে—কেনে বিন্দু?

বিন্দু তাকায়। গায়েনের চোখের ভাষা পড়ে। শিশুর অবোধ ভাষা। ছলহারা দিশাহারা চোখের কোনো প্রান্তে কোনো কামনার ছন্দ নেই। উল্লাসের সঙ্গে কত তফাত। টানা ভুরুতে গতি। যার ব্যঞ্জনা মহাশূন্যে ভেসে যাওয়ার। যেখানে কথা নেই গান নেই রং নেই। বিন্দু ভয় পায়। বিন্দু পালাতে চায়।

সেইসময় ঢোকে সুদামসখীর মা। ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে থাকে ওকে দেখে। —অম্মা, কুটুম দেখছি গো।

—বেড়াতে এসেছিলাম বাছা।

—আসবে বইকি মা। আসবানা কেনে? তা ওলাং বুঝি ঘরে নাই? দাঁড়াও ডেকে দি সুদাংকে। অ সুদাং! সুদাং রে!

বাচ্চা বগলে সুদাং আসে। বিন্দুর হাত ধরে হাসে খানিক। —পথ ভুলে নাকিন দিদি? বিন্দুও হেসে ওঠে। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আবার ধপ করে বসে পড়ে। দুজনে মেতে ওঠে কথায়। ছকুলাল বেরিয়ে যায় আনন্দে।

পথেই নীলকান্ত। ছুটে আসছে কী বলে চেঁচাতে চেঁচাতে। ঘুরে দাঁড়ায় ছকুলাল। —চেল্লাও কেনে বাছা?

—কাজলদি আসছে গো, কাজলদি। হুই দ্যাখো।

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায় ছকুলাল। তারপর ছুটে যায় রায়দিঘির পাড় ধরে। হাতে সুটকেশ, চিরকেলে বেশেই আসছে কাজল। বেশ মুটকী হয়ে গেছে এবার। থলথল করছে গায়ের মাংস। আগের মতো হাঁটতে পারে না ভারী শরীর নিয়ে। রং আরও ফরসা হয়ে উঠেছে। দৌড়ে গিয়ে হাত থেকে সুটকেশ কেড়ে নেয় ছকুলাল। পিঠে হাত রাখে বোনের। —এই একটা বছর গেল, আসতে কি মোন ওঠেনি রে বাছা? দাদার কথা মোন হতে বেসজ্জন দিইছিলি?

ছকুলালের কান্না আসেনা কোনো দিন। নইলে খানিক কাঁদত বুঝি সে। বলতে গলার স্বর ভেঙে যায়। পায়ের ধুলো নেয় কাজল। বলে ছকুলাল—থাক থাক। চ, ঘরে চ।

কথা বলে কাজল। শান্ত স্বর। —ইস কী চেহারা হয়েছে দাদা? তোমারও পকস হয়েছিল লেখোনি তো?

নীলকান্ত বলে,—মলে তিনমাস হত। কত ফাঁড়া গেল কাজলদিদি।

—কপালে চোট কীসের দাদা? কাজলের নজর এড়ানো যায় না।

—সি এক কাণ্ড। পরে শুনবি।

নীলকান্ত বলে—জাগালী কত্তে যেয়ে গোয়ালের মার খেয়েছিল গো। আধমরা করে বিলে ফেলে দিইছিল। তার পরে………

ধমক দেয় ছকুলাল—এট্টু থামো তো নীলকান্ত।

এগিয়ে আসে পাড়ার মেয়েরা। —ছকুর বেটাকে আনোনা কেনে বাছা, দেখতে কত সাধ হয়। সেই অতটুকুনে দেখেছি।

আরও অনেক কথা চারপাশ থেকে। স্বল্প দু—এক কথায় বুঝিয়ে চলে কাজল। এখানে ওখানে চোখ রাখে। অগ্নিকোণে ছাতিম গাছটা এখনও মরেনি।

কে বলে—মঙ্গলার কাল হয়েছে গো।

কাজলের ছেলেবেলার আরেক সই মঙ্গলা। কাজল বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। ছেলেবুড়ো মিলিয়ে পাড়ায় সাতজনের কাল হয়েছে। ব্যথিত মনে চোখ ফেরায়। রায়দিঘির জলে মেঘলা আকাশের ছবি। মনে স্মৃতির আলতো ছায়া। বাড়ি ঢোকে সে। শিমুল গাছের ডগা অবধি দেখে নেয়। দেখে উঠোনের একপ্রান্তে লেবুগাছটা—তার হাতেই লাগানো। দেখে ঘরের পেছনে নোনা আতার গাছ। ঘন পাতার মধ্যে ছেলেবেলায় লুকোচুরি খেলত। ঘরের চালে জাগালী করে পাওয়া নতুন খড়ে গোঁজ দেওয়া হয়েছে। হলুদ চালে বুনো একঝাঁক পায়রা ধান খুঁজছে হন্তদন্ত হয়ে।

তারপর দেখে একটি মেয়েকে। বড়োবড়ো বিস্মিত চোখে সে চেয়ে আছে।

—এই তবে নতুন বউ? ছেলেটা কে?

লজ্জায় মুখ নীচু করে বিন্দু। গালে সিঁদুরের রং। থতোমতো খেয়ে বলে—না। আমি সুঁদিপুরের…..তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়েছে বিন্দু। সাহসিকা, বাগদিনী কলকাতার মেয়ের উজ্জ্বল চোখের ছটায় ক্ষুরধার কথার তেড়ে হঠাৎ ঘায়েল হয়ে গিয়েছিল।

—ও। তা গিন্নিটা কই দাদা? মাঠে?

—আর বলিস কেনে রে। শরদিন্দু বাবুর কেম্পে চৈতালি ঝাড়ছে। পাড়ার সকলের সঙ্গে যায়। দিন—টাকা—টাকা মজুরি। কাঠ—ঘুঁটে কুড়ানোর চেয়ে উত্তুম।

হাতমুখ ধোয় কাজল। সুদাং এক বালতি জল এনে দিয়েছে ততক্ষণে। ছকুলাল অকারণ ঘর—বাহির করে। বলে—আন্নার জোগাড়যন্ত কত্তেই যেছিলাম গো। তাহলে আন্না চাপাই। আত্তিরের ভিজে ভাত আছে চাট্টি। তা তো তুমাদের চলবে না।

হাঁড়ি বের করে দেয় ছকুলাল। সুদাং রান্না চাপায়।

—তা তুম্মো আন্না চাপাও বিন্দুবাসিনী। তুমার সই এল বলে।

বিন্দু বলে—থাক। উঠি তাহলে। দিদি এল অনেকদূর থেকে।

হঠাৎ কাছে এসে বসে কাজল। —তা কি হয় ভাই, কুটুমবাড়ি এসেছ না খেয়ে যেতে আছে? এদের হাতে তো খাবে না। রান্না করো।

মিষ্টি কথায় গলে যায় বিন্দু। ছেলেটা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। বলে কাজল—তা এটি রেখেই বুঝি স্বামী গত হল?

কলকাতার মেয়ের চোখ। সব বুঝে নিয়েছে পলকে। বিন্দুর অপ্রস্তুত ভাব কেটে যায়। সহজ হয় আগের মতো। বলে রতিকান্তর কথা। তার অসহায় মৃত্যুর কথা। এ বাড়ির সঙ্গে তার পরিচয়ের কথা বলতে এসেই থেমে যায়।

তখন বলে সুদাং। ইনিয়েবিনিয়ে ফেনিয়ে ফুলিয়ে এক চমকপ্রদ ‘বিত্যেন্ত’। উনুনে হু—হু আগুন। তেমন উত্তাপ যেন তিনটি মেয়ের মনে। কাজল বিন্দুর শরীর টিপে পরখ করে। হাসে টিপতে টিপতে। বলে—সত্যি, এত শক্তি তোমার?

সন্ধেয় ফেরে ওলাং। একটু হকচকিয়ে যায় বাড়িভরা লোক দেখে। তারপর বিন্দুকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে হাত ধরে। কী বলতে যায়। আর থেমে যায় কাজলকে দেখে। কাজলের চোখের দীপ্তি স্বল্প আলোয় বিদ্যুতের মতো বিঁধছে তার চোখে। কাজল বুঝি ওলাং—এর কপালের লেখা পড়ছিল।

—এসো বৌদি।

কেউ আলাপ করিয়ে দেবার আগেই বিন্দু মুখরা। বলে, তুমার কলকেতার ননদ গো!

দুদিন পরে ফিরে গেল কাজল। স্বভাবমতো খানিক ঝগড়াও করেছিল। তুফানীর মতো নয় ওলাং। ছকুলালকে সে সমর্থন করেনি। বরং কাজল যাওয়ার পর বলল, ঠিক কথা বলেছে দিদি।

ঠিক কথা? দুঃখিত স্বরে বলল ছকুলাল। কী চায় কাজল তার কাছে। ঘরনি আনলে তার মুখ ভারী হয়ে ওঠে। ঘরনিহীন সংসারের পুরুষ তো বাউণ্ডুলে! সম্বল এই একতারা। অথচ তাতেও কাজলবালা ব্যাজার। ভয়ে ভয়ে ছেলের কথা তুলেছিল ছকুলাল। কাজল সেকথা কানেই তুলল না। ওলাং বলল, থাক না দিদির কাছে। বেশ তো ইস্কুলে নেখাপড়া শিখছে। এখানে এলেই পাঁচটার সঙ্গে মিশে গোল্লায় যাবে। ……..কেন, একদিন একবেলাও কি আনা যায় না ছেলেটা? কাজল জবাব দেয়নি। বলল ওলাং—তুমি যেয়ে দেখে এসো। আম্মো সঙ্গে যাবো। জেবনে কলকাতা তো দেখা ঘটল না, ইবার যদি হয়। কাজল একথারও জবাব দেয়নি। রাজাবাবুর কাছ থেকে ফিরে এসে ভারী মুখে চলল কলকাতা। দাদার ভিটের জন্যে বড় দরদ কাজলের। তাই বুঝি তার হেস্তনেস্ত করতে গিয়েছিল। খুব হেসেছে ছকুলাল। দাদার মুখ দেখতে ঘেন্না যার, সে দেখবে ওই ভগ্নীর মুখ! আর তাছাড়া ঘেন্না কি কাজলবালারও আছে; যে লম্পট হয়তো তার যৌবন সম্পদ লুটতে পায়নি বলে আজও রাখুরাজার দান এই ভিটেটুকুর উপর দখল ছাড়তে চায় না, তার কাছে বাড়ি এসেই দৌড়। কেনে বাপু; অত নেকাপড়া শিখেছিস, বুদ্ধিতে শান পড়েনি এখনও?

মুখফুটে বলে ফেলেছিল ছকুলাল। —ভগ্নী, তুর অসম্মানের জায়গায় যেতে কি লাজলজ্জা কিছু আসে না মনে?

—কেন? কে বললে সেকথা?

আশ্চর্য। কাজলই প্রকারান্তরে একথা রটিয়েছিল। আজ আবার উলটো গায়। কিছু বোঝা যায় না ব্যাপারটা।

দরকার কী বুঝে? অত ভেবে শরীরে মনে শুধু অযথা জ্বলুনি। ছকুলাল আর কিছু জানবে না। ক্যাম্পে বেরিয়ে যাচ্ছে ওলাং। আবার খানিক গজগজ করছে সে। কাজলের কথাগুলি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছে। ছকুলাল ভাবে বলা তো স্বাভাবিক। কাজল ওকে খুব ভালোবেসে গেছে। যাবার সময় শাড়ি ব্লাউজ সায়া আর নানান প্রসাধনের উপচারে সাজানো সুটকেশটা ওকে দিয়ে গেছে। বলে গেছে, কোলেপিঠে হলে ওলাং যেন সঙ্গে সঙ্গে চিঠি দেয়। আর শুনিয়ে গেছে রতনকুমারের গল্প। ছকুলাল ভেতর ভেতর ভারী উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। বাইরে দাওয়ায় শুয়েছিল ঘরের ভিতর তিনটি মেয়ের স্বর। ওলাং বিন্দু আর কাজল। বাইরে অন্ধকার।

চেহারায় নাকি বাপবেটার কোনো মিল নেই। কেলাস ফোরে পড়ে কলকাতার ইস্কুলে। চলনে ঢঙে পুরোদস্তুর ভদ্দর লোক।

আর রতনকুমার উনিকে বাবা বলে। মা বলে কাজলকে। জ্ঞান হয়ে এমনি দেখছে শিখছে। বলবে না কেন। সেই ছোট বেলা থেকে দেখছে। তা উনিও ভারী ভালো মানুষ। ছোট জাতের ছেলে বলে একটুও ছি ঘেন্না নেই। হবে না কেন বলো? ত্রিসংসারে আপন বলতে কেউ নেই। চিরদিন ভবঘুরে হয়ে কাটালেন। এতদিনে কাজলের সঙ্গে সংসার পেতেছেন একটু শান্তির জন্যে।

ভাগ্যে ছিল ভাই!

ঘরে কাজলের দীর্ঘশ্বাস। ছকুলাল কান খাড়া করে শুনছিল। বালিশ থেকে মুখ তুলে শুনছিল। শেষে কথা না বলে পারে না। —তাহলে ছেলাকে বাপের নাম ভুলিয়েছে বলো।

তামাশায় তিনটি মেয়ে কলকণ্ঠ হাসচে ঘরের মধ্যে।

অনেক বই এনেছিল কাজল। টকীর গান গাইছিল গুনগুনিয়ে। ‘প্রেমের ফাঁদ’ নামে একটা বই থেকে গল্প পড়ছিল সকালে। খানিক শুনে বিন্দু চলে গেল।

ওলাং বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বলে ছকুলাল, তুমার ওজগার খাই বলে এত খোঁটা দিছো;

কী কথায় কী। ওলাং কথা বন্ধ করে। এত উত্তেজিত কোনোদিন দেখেনি সে তার নিরেট সোয়ামীটাকে। পাশ দিয়ে ঝড়ের মতো ছকুলাল কোথাও চলে যায়। ওলাং পায়ে পায়ে এগোয়। আজ একটু দেরিই হয়ে গেছে। তাতে দুদিন কামাই। হাসিম ঝাব্বুর গাল খাওয়ার ভয়ে ঝিমিয়ে গেছে মন।

সন্ধেয় ফিরল ওলাং। বাড়ি ঢোকার মুখে সুদাংকে দেখে কথার ঝড় তোলে। কেম্পের বিত্যেন্ত! আর সেখানে যাবে না সে। —সোনাডাঙার বীণাকে কী বেইজ্জতী কল্লে ভাই! লোভী বউটা চাট্টি ছোলা লুকিয়ে নিয়ে পালাচ্ছিল। কী ভাবে ধরা পড়ে যায়। হাসিম স্যাক তাকে উলঙ্গ করে গামছা পরিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। হা মুখপুড়ী, লোভে পাপ। পাপে মিত্যু। বড্ড মোনে আঘাত পেলাম ভাই। বাবুর তো রাজার ভাণ্ডার! দুটি ছোলায় কি এমন সব্বনাশটা হত!

—বাবু কিছু বললে না?

—বাবু অবিশ্যি ছিল না। থাকলেও কী হত আর। হাসিম স্যাক হুকুমের চাকর বই তো লয়।

—তা বটে। আমি যাইনি ভালো করেছি হে!

সুদাং ভুলে যায় যে তাকে বাদ দিয়েছিল নন্দীভৃঙ্গীরা। ঝোঁকের বশে বলেই লজ্জা পায় একটু। তাড়াতাড়ি বলে,—আর যাসনে সই। কবে কী ছুতো করে তুকে আবার না অপমান করে ফেলে!

—তা আর বলছো তুমি! আজ হতে পথে কাঁটা দিলাম ভাই। কী পাপিষ্টি বসেছে মাঠে। ছি, ছি!

বাড়ি ঢুকে অবাক ওলাং। দাওয়ায় তালাই বিছিয়ে একটা বড়ো বাক্স থেকে কীসব ‘রঙ ঝিলিমিলি দব্য’ বের করছে ছকুলাল। পাশে সোৎসাহে বসে নীলকান্ত নাড়াচাড়া করছে সেগুলো। সে হেসে ওঠে ওলাংকে দেখে।

—মজা দ্যাখো বউদি, কী হচ্ছে ইবার।

—উসব কী গো?

—মনিহারী দব্য গো, মনিহারী! দুজনে বেবসা করবো। ইষ্টিশেনে এগজিগিবশেন মেলা বসেছে। জানো না বুঝি? নীলকান্ত সদম্ভে জানায়।

একপলক ছকুলালের মুখ দেখে নেয় ওলাং। তারপর বলে,—দিদির টাকাগুলান অই অঙচঙ কিনে বেসজ্জন দিলা?

—কীরূপ? গম্ভীর হয়ে তাকায় ছকুলাল।

—তুমার কম্ম বেবসা করা?

শান্তকণ্ঠে বলে ছকুলাল। —তাহলে তুমার বিবেচনায় আমার কম্মটা কী বলো দিকিন?

—ছাইএর দড়ি পাকানো। মুখ বেঁকিয়ে জবাব দেয় ওলাং। তারপর ঘাটের দিয়ে যায়। ছকুলাল গোছাতে থাকে জিনিসগুলো। নীলকান্ত চেঁচিয়ে সুর ধরে হেঁকে ওঠে, চুড়ি সাবান তেল হিমানী পাওডার।

এবার নতুন জীবন। নতুন দিন। স্টেশনের পাশে রিফিউজি কলোনির ছেলেদের খেলার মাঠে সরকারি কৃষি প্রদর্শনীর মেলা। দেশ—দেশান্তরের চেনামুখের ভীড়। গায়েন দুকান পেতছে দেখছি হে! ভালো, ভালো!

কী উত্তেজনা আর আনন্দ ছকুলালের! আবার সেই মানুষেরা—যারা তার গান শুনত। ভালোবেসে গায়েন বলে ডাকত। একা একা থেকে নিজেকে দ্বীপান্তরে লুকিয়ে রাখলে কী হবে, আসলে সে জনতাপ্রেমিক! এই সত্যটা কেন যে ভুলে যায় মধ্যে মধ্যে! তাই বুঝি যত অশান্তি কাজল আর তার নিজের সঙ্গে একটা সমন্বয় ঘটিয়ে দিয়েছে এই মেলায় দোকান খুলে বসা। ভারী খুশি হয়েছে ছকুলাল। ওলাং—এর উপর ক্রোধ কমেছে। আর কাকেও চায় না সে। এই কলরোলমুখর মহাজীবনের জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে এবার তর চিরকেলে অস্তিত্বটা নিজের পুরনো মানে ফিরে পেয়েচে যেন। গায়েনদাদার দুকান! চলো, চলো কিছু কিনি না কিনি এট্টু গল্প করে আসি!

মানুষ এত ভালোবাসে তাকে, চণ্ডালিকার পশ্চিম মাঠের জাগালী জীবনের সত্তাটাকে নয়। এই বাউণ্ডুলে গায়েনকে। এখানে গয়লারা নেই। শংকরীপ্রসাদ নেই। কাজল নেই। এখানে কী হাস্যকর লাগে ওলাং—এর বচনগুলো! দুলেদুলে বাচ্চদের ভেঁপুবাঁশি বাজায় ছকুলাল। একটুও বেমানান ঠেকে না এই কলরবঘন মেলার উচ্ছ্বসিত স্রোতমালায় সেই তুচ্ছ ধ্বনিটুকু।

প্রদর্শনীর মেলা চণ্ডালিকা পরগনায় এই নতুন। একটু দেরিতে বসল। প্রদর্শনীর দ্রষ্টব্যগুলো সাতজেলা ঘুরে ইতিমধ্যে বিবর্ণ হয়ে গেছে। শরদিন্দুর চাষের গৌরব ঘোষণা কৃষিজাত ফসলের লম্বা স্টলটা। চৌদ্দইঞ্চি ধানের শিষ! দেড় পোয়া আলু! গমের শিষটা মেপে দেখে চাষিরা। একেবারে পৌনে এক হাত! মানুষখাড়াই মটর শুঁটির ঝাড় অতিকষ্টে জিয়নো আছে টবের মধ্যে। মা রাঢ়দেশের পাথুরে মাটির এত সম্পদ কীভাবে আদায় করছে লোকটা! মা বসুমতীর ডাগর স্তনের বোঁটা খুঁজে পেয়েছে। রক্তচোষা টান দিচ্ছে শরদিন্দু। পুতানারাক্ষসীর মতো কাঁপছে থরথরিয়ে চণ্ডালিকার পূর্ব মাঠ।

তেমনি চাষের যন্ত্রপাতি স্টলে সাজানো। মালক্ষ্মীদের তরকারি কোটার যন্ত্রও।

আর আছে অদেখা জীবজন্তুর জিয়ানো শরীর।

রাত্তিরে কলকাতার যাত্রা। শেখ গোমহানী দেওয়ানের কবিগান। সরকারি লোকরঞ্জন বিভাগের থিয়েটার। পূর্ণদাসের বাউল গান।

ছকুলাল মনকে নিয়ে খেলায় বসে। দেখ, দেখ, কী তোমার চারপাশে। এত জীবন, এত আনন্দ, এত দেখাশোনার। সংসারে এত আছে। শুধু খুঁজে নিতে হবে। —ও নীলকান্ত, দুকানে বসোদিকি বাছা। আমি এট্টু আসি।

—কতি গো;

—হুজুরদের কাছে পাত্থনা করে আসি—এক আসর গাইবো।

—ধুর! মাথা খারাপ হয়েচে তুমার?

—কেনে?

আসলে নীলকান্ত বলতে চায়, অতবড় আসরে ছকুলাল হাঁ করতে পারবে না। ভড়কে যাবে একেবারে। বলতে পারে না সে কথা। বলে—এতবড় দুকানটা একা একা আগলাতে পারি আমি;

—তা বটে বাছা। হয়তো ছকুলালও আসল কথাটা ভাবছে মনে মনে।

ওলাং এল সন্ধ্যায়। সঙ্গে বিন্দু আর টগর এলোকেশীদের দল। সন্ধ্যায় মেলা জেঁকে ওঠে। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর বিশ্রাম আনন্দের অবসর। লোকে লোকারণ্য। আসে কাছাকাছি গ্রামের মেয়েরা। প্রদর্শনীর বাইরে বেসরকারি দোকানগুলো। দোকানে কেনাকাটার হিড়িক। দোকানে বড় ভীড়। ছকুলাল বিন্দুকে একটা চট এগিয়ে দেয় বসতে। বসবে কোথায় লোকের ভীড়ে। বিন্দু দাঁড়িয়ে থাকে। বড় বড় চোখে মনোহারির জিনিসপত্তর দেখে ভাবে, সঙ্গে তার ছেলে অলককে আনলে হত। ছেলের বুঝি ঘুম পাবে। গান শুনে অত রাত্তিরে ফিরে যেতে সারাপথ বইতে হবে ছেলেকে। তাই রেখে এল ঠাকুরঝির কাছে।

—ছেলেটা আনলানা? ছকুলাল কি মনের লেখা পড়তে পারে?

—কে বইবে বাপু সারাপথ? ফিরব সেই কখন।

—ফিসফিস করে ঠাট্টা করে ওলাং—তুমর সয়াকে কাঁধে আনতে গতর এলে যায়নি?

লজ্জা পায় বিন্দু। বলে—কী কথার সঙ্গে কী!

বুড়েমি করে এলোকেশী। বলে—তখন একটা বেপদের সুময়। তখন শরীলে শক্তি চারগুণ বাড়ে। নাকি হে বিন্দুদিদি?

ওর গালে মৃদু টোকা দেয় বিন্দু। ঝুঁকে পড়ে একটা আয়নায় হাত বাড়ায়।

ঠাট্টা করে টগর—সয়ার আয়নায় উপ দেখবে নাকিন হে?

আয়না রেখে দেয় বিন্দু! মৃদু হেসে ওঠে। —আয়নায় মুখ দেখে কী হবে ভাই! দেখতে কেমন চকচক করছে, তাই হাতে নিলাম। আপনমনে বলে আবার, কতকাল হল মুখ দেখিনি লিজের।

—মুখ পুড়ে গেছে নাকিন সই? দেগবানা কেনে? এই লাও, দেখো। ওলাং স্বামীর দোকানের আয়না বলে সগর্বে হাতে তুলে দিতে আসে আয়নাটা!

ছকুলাল বসে বসে হাসে। বিন্দু হাত বাড়ায় না। বলে—থাক।

কিন্তু ছকুলাল শশব্যস্ত জিনিসপত্তর উপর হাত বাড়িয়েছে ততক্ষণে। একশিশি ফুলের তেল, একটা যশুরে চিরুণী, একটা আয়না। কেন মুখ দেখবে না বিন্দু, যে মুখ দেখে মৃতের জীবন ফিরে আসে! সাজাবে বিস্রস্ত কালো কেশ। আর ওই সোন্দর মুখে আলতারং নিটোল গালে নরম করে বুলোবে শিশির জমানো (ছকুলাল জানে আকাশের শিশির জমিয়ে হিমানি তৈরি হয়) সুবাস খানিক হিমানি। তারপর নামো না খালেবিলে নদীর জলে জাল পেতে কিছু মাছের আশায়! মুখ তোমার ভিজবে না। ফুলের গন্ধভরা ঘনকালো তোমার খোঁপায় জড়িয়ে থাকবে প্রজাপতি। পলকে করুণ হয় ছকুলাল। ছি, ছি একি ভাবছে সে! বিন্দুর পায়ে চোখ রেখে এগিয়ে দেয় উপহারগুলো। বলে, তুমার সইয়ের পক্ষ থেকে দান দিলাম ই দব্যগুলান। গ্রহণ কল্লে খুশি হবো বিন্দুবাসিনী;

ব্যস্ত হয়ে পিছিয়ে আসে বিন্দু—ছি ছি উসব কী জন্যে গায়েন?

ওলাং বলে—দানের দব্য লিতে দোষ কী সই! টগর চিমটি কাটে এলোকেশীকে। হেসে ওঠে পাড়ার মেয়েরা কলস্বরে। বিন্দু নতমুখী। কান অবধি লাল। ঘামছে লজ্জায় অস্বস্তিতে। ছি ছি এত লোকের ভীড়ে একটুও আক্কেল নেই গায়েনের?

—দোষ কী সই? বয়েস তো যায়নি মোটে। ওলাং বলে।

এলোকেশী বলে—তুদের যেন কী বাছা! কানাইকুড়রের মেয়েরা বেধবা হলে মানেনা কিছু। কিন্তুক উরা যে মানে টানে সব।

বিন্দু সরে যাবে এখান থেকে? বিধবা পরনারী সে। কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হয়ে যাচ্ছে যে। বলে ছকুলাল—তুমি তো কিছুই মানো না। কিছুতে ভয় নাই তুমার বিন্দু।

পাগলকে কে বোঝাবে; মনে মনে বলে, এত অবুঝ তুমি গায়েন। এই সাদা কথাটাও বুঝতে পারো না! বিপন্না বিন্দুকে ওলাং টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। মেয়ে হয়ে মেয়ের লজ্জা বোঝে সে। তাই সরে যায় মেলার ভেতর দিকে। প্রদর্শনীর গেটে গিয়ে দাঁড়ায়। ছকুলাল খদ্দের নিয়ে পড়ে। কী নেবা বাছারা? নীলকান্ত ক্রমাগত ফুঁ দিচ্ছে একটা নাগিন মার্কা বাঁশিতে।

ওখানে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে বিন্দু চোখ রেখেছে একটা দোকানের একঝাঁক রঙিন বেলুনে। সারসার লাউয়ের মতো ঝুলছে। আলতো বাতাসে দুলছে এলোমেলো। এই স্থূল কর্কশ ঘটনাটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। ছকুলাল একটা নির্বোধ শিশু। অপটু কারিগর। হিজিবিজি টানে অকারণ। সূক্ষ্ম কাজ জানে না। মাটিকোপানো মজুরের মতো সাদামাটা একটা জ্যান্ত বস্তু মাত্র। কারিগরি চাতুর্য নেই তার জীবনেরও কোনোখানে। ওলাং ঠিকই বলে, পাথরের ডেলা। এবার সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটেছে বিন্দুর চোখের কোণে। বেলুনগুলো দুলছে আর দুলছেই।

রাত্রি অনেক হয়। ওরা ফিরে যাচ্ছে বাড়ি। স্টলের সরকারি দোকানে জিনিসের দাম এত বেশি কেন—এনিয়ে কলরব করে এগোচ্ছে ওলাংরা। আজ গান হবে না। দল এসে পৌঁছায়নি। ছকুলালকে সংবাদটা জানিয়ে ফিরে যাচ্ছে বাড়ি।

হঠাৎ ডাকে ছকুলাল। বিন্দুকে ডাকে। বলে—উরা যাক। তুমি এট্টু পরে যেয়ো। পেয়োজন আছে।

আবার সেই স্থূলতা। বিন্দুর আবছা ক্রোধ মনে। —কেনে গায়েন? একা যাবো কী করে?

—আমি এগিয়ে দেবো। সি ভয় করোনা।

—কী প্রয়োজন শুনি?

—আছে। উদের যেতে বলো।

কী বলবে এই নির্বোধ মানুষটা। বিন্দু জিভ কাটে। —ছি, ছি, কী ভাববে উরা।

—ভাবুক বিন্দু। এত সাওস তুমার—সব কি হারিয়ে যেয়েছে আজ?

সাহস! তা আছে বিন্দু। এগিয়ে যায় সে। কীভাবে বলবে একথা ওলাংদের। কী ভাববে ওরা? পলকে মত ঠিক করে নেয় সে। কৌতূহল আর কী যেন প্রত্যাশা (আচমকা একথা কেন ভাবে বিন্দু, এই প্রত্যাশার কথা?) তাকে আবার সাহসিকা করে তুলছে। ভাবুক যে যা খুশি। কেউ কি অন্নদাতা তার?

ওলাং একলা মেলার শেষ প্রান্তে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিন্দুকে দেখে হেসে ওঠে—আচ্ছা মানুষ বটে সই। ভাবলাম সঙ্গে আসতে আসতে হারিয়ে গেল কতি!

—টগর বালারা চলে গেল?

—উরা এগিয়ে যেয়েচে আমাকে ফেলে। ভারী বজ্জাত মাগিগুলান। বলে, তুর ভাতার আছে। তুর সই আছে, ভাবনা কী!

ফিসফিস করে বলে বিন্দু ছকুলালের কথা। ওলাং অবাক। একমুহূর্ত চেয়ে থাকে বিন্দুর দিকে।

তারপর হঠাৎ কোনো কথা না বলে দৌড়ে চলে যায়। কী ভাবল ওলাং! ছি ছি!

রাগ হল বিন্দুর। আচ্ছা মেয়ে বাবা। একটু ভেবেচিন্তে তলিয়ে দেখাশোনা নেই, শোনামাত্র দ্দে ছুট! যা ভাববে ভাবো তুমি। গেরাহ্যি করবো না কিছু। আজ যেন দীর্ঘকালের জেরটানা কোনো সমস্যার—গোপন কোনো ব্যাপারের চরম মীমাংসা করতে যাচ্ছে, আসন্ন ঘটনাটা এইভাবে মনে মনে কল্পনায় বানায় বিন্দু। সেই কল্পনার মধ্যে কিছু পুলক, কিছু হাস্যকর কারুণ্য আর কিছু উত্তেজনা মিশিয়ে ছকুলালের দোকানে গিয়ে দাঁড়ায় বিন্দু।

—এসেছি গায়েন!

কী বলবে তাকে চণ্ডালিকার গায়েন? শুনে হয়তো হাসি পাবে তাঁর।

ছকুলাল তাকে দেখে উঠে আসে দোকান থেকে। নিঃশব্দে অনুসরণ করে বিন্দু। মেলার সীমানা পার হয়ে যায়। স্টেশনের গেট পেরিয়ে পূর্বমুখে লাইন ধরে চলতে থাকে।

অনেকটা চলে ছকুলাল। বিন্দু কাঁপে না। কৌতূহল আর কী একটা অজানা অস্পষ্ট প্রাপ্যের গন্ধ টের পাচ্ছে সে। একটু দাঁড়ায় ছকুলাল। বুঝি জায়গা পছন্দ হয় না। আবার চলে। এবার সেই অচেনা জিনিসটা ভয়ের মুখোশ পরে চোখ রাঙাচ্ছে বিন্দুর মনে। গায়েন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? কী দরকারে? ফিরে যাবে সে, দৌড়ে পালিয়ে যাবে এই অপগণ্ড অদ্ভুত জীবের আক্রমণ থেকে জীবন বাঁচাতে?

এতক্ষণে বসে পড়ে ছকুলাল একটা ব্রিজের কিনারায় মজবুতভাবে বাঁধানো ইঁটের একফালি চত্বরে। দুপাশে ফাঁকা মাঠ। উত্তরে মাঠের মধ্যে অনেকটা দূরে শরদিন্দুর ফার্মের আলো। দক্ষিণে রেল লাইনের সমান্তরাল চলে গেছে একটা ক্যানেল। বিন্দু বসে একটু তফাতে। নির্জন গভীর রাত্তির। চৈত্রের বাতাসে স্নিগ্ধতা। আকাশে ডাগর চাঁদ।

কী কথা বলবে তাকে গায়েন;

খানিক স্তব্ধতা। শুধু টেলিগ্রামের তারে অবিরাম গুঞ্জন।

তারপর বলে ছকুলাল, বিন্দুবাসিনী!

—বলো। প্রস্তুত হয় বিন্দু। গায়েন তার কাছে যদি কিছু চায়, হাত ভরে দেবে সে। এতদূর এসেছে যখন, আর দ্বিধা কীসের।

—জেবনে খাঁটি কথা কওয়ার ব্যক্তি কেউ নাই আমার। তাই তুমাকে ডাকলাম। তুমি মেয়েছেলা। ইটা মেনেও তুমাকে ডাকলাম কেনে?

—তুমিই জানো গায়েন।

—তুমি আমাকে মমতা করো বিন্দু। ইকথা বিশ্বেস করি বলে ডাকলাম।

বিন্দু মমতা করে তাকে? গায়েন ধরে ফেলেছে তবে। কেন, কীসের মমতা। বিন্দু তিল তিল খুঁজতে থাকে মনের পরতে পরতে। সেই মমতার জন্যেই কি এই অস্তিত্ব—উজাড় করার প্রস্তুতি। এতদিন একথা শুনলে এত ঢেউ উঠত না মনের গহন নদীতে। এই জানাটার অতীতে এতদিনের কুটিল নিষ্ফল অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে বসে থাকত তার কপট বাসনাকাতর মন। বাইরের স্বচ্ছ আলোয় পা ফেলে সহজ হয়ে এসে বসত গায়েনের জীবনের একপ্রান্তে। হঠাৎ নিষ্ঠুর কঠোর এক প্রশ্নের ধারালো ছুরিতে তার চেতনার কেন্দ্রটা বিঁধতে শুরু করেছে এবার। কী যন্ত্রণা এ জীবনে বেঁচে থাকার!

নুয়ে পড়া লতার কানে বাতাসের স্বর। ছকুলাল বলে, না শুনলে বলা উচিত হবে না। কিন্তুক না বললেও জেবনটা পরিপূর্ণ থাকে না বিন্দু।

পরিপূর্ণ কার জীবন গায়েন? এত নির্বোধ তুমি! অথচ এত কুটিল! মাথা নত করে শোনে বিন্দু। কঠোর হয়ে বলে, বলো। শুনব।

কাছে সরে আসে ছকুলাল। আচমকা হাত রাখে বিন্দুর জানুতে। সাপিনীর হিমরক্তে আগুনের স্রোত।

—উপরে চন্দ্রদেব, নীচে মা বসুমতী ইট বিশ্বকর্মার জায়গা বটে (বাঁ হাতের আঙুল তুলে রেল লাইন দেখায় ছকুলাল) তুমার গায়ে হাত দিয়ে বলছি বিন্দু, ইকথা সারা জেবন আমার ভেতরে থেকে যেত। তুমি না এলে কাকেও বলা হত না।

—বলো। হাত সরিয়ে দিতে লজ্জা পায় বিন্দু।

কিন্তু সরিয়ে নেয় ছকুলাল। ইবার তুমি আমার গায়ে হাত দিয়ে পিতিজ্ঞে করো, কাকেও বলবে না। জেবনে যদ্দিন বাঁচবে, কেউ একথা শুনবে না তুমার মুখ থেকে।

সম্বিতহারা বিন্দু ছকুলালের উষ্ণবুকে রাখে তার হাত দুখানি। পাথরে নতুন কোনো স্পন্দন নেই। চিরকেলে ধ্বনি শুধু। আনমনা হাত চলে গেছে সেখানে, যেখানে একদিন মিশেছিল তার কবোষ্ণ বুক। আশ্বিনের বিকেলে কুড়িয়ে পাওয়া পুরুষের হিমশীতল বুকের মাংসের স্তরে স্তরে যুগিয়ে দিতে চেয়েছিল নিজের মাংসের কিছু তাপ।

—এবার বলে।

কী বলবে ছকুলাল! বলবে বিন্দুকে সে চায়, চেয়েছে এতদিন ধরে, তার বিন্দু তাই বেরিয়ে পড়ুক তার হাত ধরে!

—আলোয় কিছু বলবো না। জেবনে কোনো পরনারীকে অল্যায় কিছু বলিনি।

—তবে? চমকে উঠে হাত সরিয়ে নেয় বিন্দু।

মুখ একটু এগিয়ে আনে ছকুলাল। চারপাশটা একপাশ দেখে নেয়। কী যন্ত্রণা পুরুষের উষ্ণ নিশ্বাসে গন্ধে, ছকুলাল ভারী গলায় চাপা স্বরে বলে, তুমার সই লষ্টা।

ট্রেনের তীব্র আলো দুজনের শরীরে। খানিক স্তব্ধতা। কী লজ্জা, বিন্দুর পাপী মনে কুৎসিত অভিসন্ধির উপর ছকুলালের গোপন সংবাদটা যেন এই আগুন জ্বেলে সবটুকু পুড়িয়ে দিল। বিন্দু মাটির ফাটলে লুকোতে চায়। কী তীব্র আলো! গতিবান মেল ট্রেন পাশ দিয়ে সশব্দে চলে যায়। সরে তফাতে দাঁড়িয়েছিল বিন্দু। ট্রেন গেলে আবার এসে বসে পড়ে। পাথরের কথা চৈতালি বাতাসের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে।

—উর গভভে আমার সন্তান উটা লয়।

বিন্দু অন্যমনস্কভাবে হেসে ওঠে। বলে, কীসে বুঝলে?

—পষ্ট দেখেছি বিন্দু। একেবারে পষ্ট।

—তুমার চোখের ভুল গায়েন। সইকে আমি চিনি।

—আমার চোখ বিন্দু, আপন চোখ আমার।

উঠে দাঁড়ায় বিন্দু। এই কথা তুমার?

—হ্যাঁ।

ছকুলালও ওঠে। দুজনে ফিরে চলে আবার। যেতে যেতে বলে বিন্দু, কী ইচ্ছে তুমার তাহলে?

—ইচ্ছে? সব ইচ্ছে বেসজ্জন দিইছি। চণ্ডালিবাঁধার বিলে।

বিন্দু কেন যে ব্যাকুল এবার। এ চলে যাওয়া যেন কী হারিয়ে যাওয়ার মতো। কী ক্ষতি হত আরও অনেক সময় বসে থাকলে? যেতে যেতে নতমুখী বিন্দু মুখ তোলে। কী বলতে চায়। পারে না। ছকুলাল দ্রুত চলেছে আগে আগে। ও গায়েন, আমি চলতে পারছিনে। হাত ধরো আমার। আমি তলিয়ে যাচ্ছি নিষ্ফল কোনো শূন্যতর মধ্যিখানে বোবা—যন্ত্রণার চোরাবালিতে। আমার মুখে তাই কথা আসে না। স্টেশনগেটের কাছে গিয়ে কথা ফোটে বিন্দুর। এক পা এগিয়ে পিঠ স্পর্শ করে ছকুলালের। মরিয়া হয়ে বলে, কী সব দান দিতে চেয়েছিলে। ভুলে গেলে নাকিন গো?

ছকুলাল খুশি। ভারী খুশি। হালকা মন। ভারমুক্ত সফল মন।

আর চলল বিন্দু কাতর ক্লান্ত বিভ্রান্ত। মধুর স্বপ্নটা কী প্রমত্ত গতিতে চলে গেল ওই ট্রেনটার মতো একটা পাথর বুকের জগৎ বেয়ে। পাথরগুলো কেঁপে কেঁপে নড়ে উঠল শুধু। ধরতে পারল না তার স্বপ্নকে।

বিন্দুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবার পথে চাঁদ পশ্চিম দিগন্তে ঝুলে পড়েছে। কর্কশ গলায় কে চেঁচায় পথের পাশে। কে যায় এত রাত্তিরে?

—আমি চণ্ডালিকের গায়েন গো।

—এত আত্তিরে?

—কুটুমবাড়ি গিয়েছিলাম বাছা।

মোষের পিঠে উল্লাস ঘোষ। বাঁশিতে ফুঁ দিয়েছে। প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে যাচ্ছে দূরান্তর। শেষ রাত্রির বাঁশি। শুনতে ভারী মিঠে। মন পাগল করা।

ছকুলাল মেলায় যায়।