লিফট বেয়ে ছ’তলায় ওঠার সময় গুমগুম আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল ওদের তিন জনকে নিয়ে রকেটটা পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে। পৃথিবী! সবুজ পৃথিবী! হাসানের চোখে পানি এসে যায় মাটির পৃথিবী, ঘাসের পৃথিবী, আকাশের পৃথিবী মানুষের পৃথিবী—এ জীবনে আর দেখা হল না!
তিরিশ মিনিট পর দেখা গেল লেসার টিউব নির্দিষ্ট দিকে তাক করে রেখে হাসান চুপ করে বসে আছে। হাতে সিগারেট, মাথার উপরে ঘড়ি, লাল কাঁটাটা বার’র উপরে আসতেই তাকে সুইচ টিপে প্রচণ্ড শক্তিশালী লেসার বীম পাঠাতে হবে। অদৃশ্য সেই সসারকে ফুটো করে দেবে সেই রশ্মি! তারপর?
তারপর হাসান আর ভাবতে চায় না ফ্লাইং সসারের পাল্টা আঘাতে তার কি হবে ভেবে কী লাভ?
একত্রিশ মিনিট পর জাহিদ কাউন্টারগুলি থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে কাঁপা গলায় বলল, আমার হিসেবে ভূল না হয়ে থাকলে এড্রোমিডা এ মূহূর্তে ধ্বংস হয়ে গেল।
জাহিদ, কামাল আর জেসমিন এগ্রোমিডা ছেড়ে এসেছে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা আগে। এই চৰ্বিশ ঘন্টার প্রতিটি মুহূর্ত তারা অবর্ণনীয় আতঙ্কের মাঝে কাটিয়েছে। এর আগে এগ্রোমিডাতে হাসান তাদের সব বিপদে-আপদে আগলে রেখেছিল, কিন্তু এখন এই নিঃসঙ্গ মহাকাশযানে তারা সত্যিকার অসহায়। মানসিকভাবে একটা অস্বাভাবিক অবস্থার মাঝে রয়েছে বলে হাসানের জন্যে দুঃখবোধটাও তেমন যন্ত্রণা দিতে পারছে না
পৃথিবীতে পৌঁছুতে তাদের আরো আটচল্লিশ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে। যদি এর আগেই ফ্লাইং সসার আক্রমণ করে বসে তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু ওরা খানিকটা আশাবাদী, কারণ গত চব্বিশ ঘন্টায় আর একটি মহাকাশযানও নূতন করে ধ্বংস হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে হাসানের লেসার রশ্মি সত্যি সত্যি ফ্লাইং সসারকে আঘাত করতে পেরেছিল। কিন্তু আঘাতের পর ফ্লাইং সসার নিজেই ধ্বংস হয়ে গেছে, না শুধুমাত্র অল্প কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। পৃথিবীর সবাই আশা করছে ফ্লাইং সসার ধ্বংস হয়ে গেছে, যদিও মহাকাশযানে এই নিঃসঙ্গ তিনজন ঠিক ততটা বিশ্বাস করতে পারছে না। জাহিদ প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর সাথে আলাপ করছে, রকেটে করে দূরপাল্লার পাড়ি দেয়ার সময় এর আগে তার কখনো নেতৃত্ব দিতে হয় নি। কামাল সতর্ক দৃষ্টিতে রাডারগুলির দিকে নজর রাখছে। যদিও রাডারে ফ্লাইং সসার ধরা পড়লে তাদের কিছু করার নেই, কিন্তু তবুও সে নিজের চোখে জিনিসটা দেখতে চায়। জেসমিনের আপাতত কিছু করার নেই। মনে মনে খোদাকে ডেকে আর হাসানের কথা ভেবে কষ্ট পেয়ে সে সময় পার করছিল।
পৃথিবীতে মহাকাশের সর্বশেষ খবর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জরুরি বেতার আর টেলিভিশনে করে প্রচারিত হচ্ছিল। হাসানের ফ্লাইং সসারকে পাল্টা আঘাত করে আত্মত্যাগ করার খবর পৃথিবীতে প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। দেশ থেকে তাকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ পদক দিয়ে সম্মান করা হয়েছে। হাসানের সাথে সাথে জাহিদ, কামাল আর জেসমিনের নামও পৃথিবীর সবার জানা হয়ে গেছে। এই তিনজন অনভিজ্ঞ তরুণ-তরুণী কিভাবে সময় কাটাচ্ছে, পৃথিবীতে ফিরে আসতে আর কতক্ষণ সময় বাশি রয়েছে, এইসব খবরাখবর খানিকক্ষণ পরেপরেই নিউজ বুলেটিনে প্রচারিত হচ্ছিল।
ছত্রিশ ঘন্টার মাথায় পৃথিবী থেকে জাহিদকে জানানো হল, পৃথিবীবাসীর অনুরোধে আধ ঘন্টা সময় তাদেরকে সরাসরি পৃথিবীর সব টেলিভিশনে দেখানো হবে। তারা কী করছে না-করছে সে সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ আগ্রহী। কয়েকজন বিখ্যাত সাংবাদিক মহাকাশ স্টেশনে তাদের সাথে আলাপ করার জন্যে যাবে। মহাকাশ স্টেশন থেকে ওদের বারবার বলে দেয়া হল কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব সতর্ক থাকতে। দেশ এবং জাতির সম্মান জড়িত রয়েছে ওদের উপর।
নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই তারা খুব নার্ভাস হয়ে পড়ল। জাহিদ কিংবা কামাল এর আগে কখনোই রেডিও বা টেলিভিশনের সামনে সাক্ষাৎকার দেয় নি। জেসমিন সাক্ষাৎকার না দিলেও ছেলেবেলায় টেলিভিশনে নিয়মিত বিজ্ঞানের উপর অনুষ্ঠান করত। কিন্তু এবারের এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ একই সাথে তাদেরকে দেখবে, তাদের কথাবার্তা শুনবে। ঠিক কীভাবে থাকতে হবে, কী বলতে হবে, এরা ঠিক বুঝতে পারছিল না। অনুষ্ঠান শুরুর আগে আগে তারা চুলগুলি আঁচড়ে নিয়ে নার্ভাস হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
পৃথিবীর সব টেলিভিশনে গত কয়েক ঘন্টা থেকে এই অনুষ্ঠানটির সম্পর্কে। ঘোষণা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীর তিন শ’ কোটি লোকের প্রায় সবাই টেলিভিশনের সামনে আগ্রহ নিয়ে বসে রইল। প্রথমে ঘোষক এসে জানিয়ে গেল মহাকাশ থেকে টেলিভিশনে পাঠানো অনুষ্ঠানটি সরাসরি পৃথিবীতে প্রচার করা হচ্ছে। অনুষ্ঠান পরিচালনায় সাহায্য করছেন পৃথিবীর নামকরা কয়জন সাংবাদিক। ধীরে ধীরে টেলিভিশনের স্ক্রীনে একটা ছুঁচালো সিলিন্ডারের মতো মহাকাশযানের ছবি ভেসে উঠল। যদিও সেটি স্থির হয়ে রয়েছে—কিন্তু আসলে এটি ঘন্টায় চল্লিশ হাজার মাইল বেগে ছুটে আসছে। আস্তে আস্তে মহাকাশযানটি ঝাপসা হয়ে গেল, তার জায়গায় ফুটে উঠল যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ মহাকাশযানটির কন্ট্রোল রুম—তিনজন তরুণ-তরুণী সেখানে চুপচাপ অপেক্ষা করে রয়েছে। ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র জাহিদ সোজা হয়ে বসে ধীরে ধীরে বলল, নিঃসঙ্গ মহাকাশযানের তিনজন নিঃসঙ্গ তরুণ-তরুণী পৃথিবীর মানুষকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
আপনাদের সাথে আমি এই মহাকাশযানের অভিযাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দিই।
জাহিদ খুব দক্ষতার সাথে পরিচয়পর্ব শেষ করল। সাথে সাথেই একজন সাংবাদিক পৃথিবী থেকে জিজ্ঞেস করল, অনিশ্চিত অবস্থা আপনাদের কেমন লাগছে?
জেসমিন উত্তর দিল, অনিশ্চিত অবস্থা কখনো ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু পৃথিবীর সবাই আমাদের জন্যে অনুভব করছে ভেবে খুব ভালো লাগছে।
ফ্লাইং সসার সম্পর্কে আপনাদের কী অভিমত?
এটা আসলে ফ্লাইং সসার কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলা যাবে না। তবে এটি যাই হোক না কেন, তার উদ্দেশ্য ভালো নয়।
কামাল উত্তপ্ত হয়ে বলল, যদি ধ্বংস না হয়ে থাকে তবে ওটাকে যেভাবে হোক ধ্বংস করতে হবে।
আপনারা কি মনে করেন, এন্ড্রোমিডার অধিপতি হাসান ওটাকে ধ্বংস করতে পেরেছেন?
আমাদের মনে করা না-করায় কিছু আসে যায় না। তবে হাসান স্যার ওটাকে আঘাত করতে পেরেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেরই কৃত্রিম গ্রহ এবং উপগ্রহ রয়েছে, যেগুলিতে ভয়ানক সব পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। সেগুলি কি ফ্লাইং সসারকে আঘাত করতে পারত না?
জাহিদ সাবধানে উত্তর দিল। বলল, ফ্লাইং সসারটিকে রাডারে খুব কাছে না আসা পর্যন্ত দেখা যায় না। তাই হাসান স্যারের আগে আর কেউ এটাকে আঘাত করতে পারে নি।
এন্ড্রোমিডার অধিনায়ক হাসান সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
কামাল ভারী গলায় বলল, হাসান স্যার সম্পর্কে বলতে হলে আধ ঘন্টার অনুষ্ঠান যথেষ্ট নয়—কয়েক যুগব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে খাটি মানুষ হাসান স্যার–
জাহিদ বাধা দিয়ে বলল, হাসান স্যারের কথা প্রসঙ্গে আমার একটি কথা মনে। হল। স্যার আমাকে একটা চিঠি দিয়েছেন পৃথিবীতে পৌঁছে দেবার জন্যে। স্যার মারা যাবার পর চিঠিটা আমি খুলে পড়েছি পৃথিবীতে পাঠানোর জন্যে। আপনাদের আবার পড়ে শোনাচ্ছি।
মহাকাশ বিজ্ঞান সর্বাধিনায়ক।
আমার সুদীর্ঘ চাকরিজীবনে আমি যে পারিশ্রমিক পেয়েছি এবং বিভিন্ন জাতীয় পুরস্কারে আমার যে-অর্থপ্রাপ্তি হয়েছে তার পুরোটুকু জাতীয় অনাথাশ্রমে দিয়ে দিলে বাধিত হব।
বিনীত—
হাসান।
আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, একজন মানুষ কতটুকু মহান হলে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে এরকম চিঠি লিখে যেতে পারে—
সর্বনাশ! জেসমিন চিলের মতো তীক্ষ্ম স্বরে চিৎকার করে উঠল-চিৎকার শুনে জাহিদ আর কামালের সাথে সাথে পৃথিবীর তিন শত কোটি মানুষ একসাথে চমকে উঠল।
রাডার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে কামাল ফ্যাকাসে রক্তশূন্য মুখে বলল, ফ্লাই-ইং- স-সার!!
পরবর্তী তিরিশ সেকেণ্ড সবাই ওদের তিনজনকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার ভয়াবহ দৃশ্য দেখার আশঙ্কায় রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কিছুই ঘটল না। জাহিদ কাঁপা গলায় বলল, আমরা আর কতক্ষণ বেঁচে থাকব জানি না। ফ্লাইং সসারটিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। যে-কোনো মুহূর্তে আমাদের আঘাত করতে পারে—আমাদের কিছু করার নেই। ওটা এখন খুব কাছে চলে এসেছে। সোজা আমাদের দিকে আসছে। কোথাও এত কাছে কখনও এটি আসে নি। আমরা ওটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কুৎসিত ধাতব একটি চাকতির মতো, উপরে গোল গোল বৃত্ত—বোধ করি জানালা। তিন পাশ দিয়ে নীলাভ আগুন বেরুতে থাকে। প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে আসছে।
জাহিদ জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ওটা আরও কাছে এগিয়ে আসছে। আমাদের আঘাত করার বোধ করি কোনো ইচ্ছে নেই কিন্তু কী করতে চাইছে বুঝতে পারছি না। আরো কাছে এসেছে—আরো কাছে আরো কাছে—
টেলিভিশনের স্ক্রীন বারকয়েক কেঁপে স্থির হয়ে গেল। সুদর্শন ঘোষক এসে স্নান মুখে বলল, তিনজন তরুণ-তরুণীর ভাগ্যে কী ঘটেছে আমরা বলতে পারছি না। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে খবর আসামাত্রই আপনাদের জানানো হবে। এখন দেখুন ছায়াছবি রবোটিক ম্যান।
পৃথিবীর তিন শ’ কোটি মানুষ বসে বসে বিরক্তিকর ছায়াছবি রবোটিক ম্যান দেখতে লাগল।
পরদিন ভোরে পৃথিবীর মানুষ খবর পেল জাহিদ, কামাল আর জেসমিনকে ফ্লাইং সসারের প্রাণীরা ধরে নিয়ে গেছে। ওদের শূন্য রকেটটি পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। রকেটের দেয়াল গোল করে কাটা।
ফ্লাইং সসারের দেয়ালে পিঠ দিয়ে ওরা তিনজন প্রায় মিনিট সাতেক হল দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরকে যেভাবে রকেট থেকে টেনে বের করে আনা হয়েছে—একটু ভুল। হলেই ওরা মারা যেতে পারত। ফ্লাইং সসারটি রকেটের গায়ে স্পর্শ করে ও ধারদেয়াল কেটে বাতাসের চাপকে ব্যবহার করে ওদের তিনজনকে টেনে এনেছে। ওদের সাথে সাথে রকেটের ভেতরকার অনেক টুকরো টুকরো ছোটখাটো যন্ত্রপাতি খুচরা জিনিসপত্র এখানে চলে এসেছে। কামাল তার ভেতর থেকে বেছে বেছে একটা শক্ত লোহার রড হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে—ফ্লাইং সসারের অধিবাসীদের বিপজ্জনক কিছু করতে দেখলে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে?
জাহিদ অনেকক্ষণ হল ধাতব দেয়ালটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল। কী দেখে কামালকে ডেকে বলল, কামাল, এই স্কুটা দেখে তোর কী মনে হয়?
কামাল উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে! এটা তো ফাইভ পয়েন্ট ফাইভ স্কু! পৃথিবীর তৈরি জিনিস!
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, মানে?
মানে এটা পৃথিবীতে তৈরি। পৃথিবীর মানুষের কারসাজি। নিশ্চয়ই কিছু পাজি লোক মিলে তৈরি করেছে।
শুধু পাজি বলিস না জাহিদ বাধা দিয়ে বলল, পাজি এবং প্রতিভাবান। যেসব ইঞ্জিনিয়ারিং খেল দেখাচ্ছে, মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড়।
হাতে পেলে টুটি ছিড়ে ফেলতাম—
সাথে সাথে খুট করে একটা দরজা খুলে গেল এবং একজন দীর্ঘ লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। দুই পাশ থেকে দু’ জন লোক হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে প্রথমে ঘরে ঢুকে ঘরের দু’পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। কামালকে ইঙ্গিত করল হাতের রডটা ফেলে দিতে। কামাল নীরস মুখে রডটা ছুঁড়ে দিতেই দীর্ঘ লোকটি এসে ঢুকল।
গাঢ় নীল রংয়ের জ্যাকেট আর সাদা পান্ট পরনে। মাথায় লম্বা চুল অবিন্যস্ত, মুখে খোঁচা লালচে দাড়ি। গায়ের রং অস্বাভাবিক ফর্সা, তীক্ষ্ণ খাড়া নাক, শক্ত চোয়াল এবং রক্তাক্ত চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
জাহিদের মনে হল লোকটিকে কোথায় যেন দেখেছে, কিন্তু মনে করতে পারছিল না। কামাল বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, তুমি হারুন হাকশী।
সাথে সাথে জাহিদ লোকটিকে চিনতে পারল। অসাধারণ প্রতিভাবান হারুন হাকশী মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে নোবেল পুরষ্কারের জন্যে মনোনীত হয়েছিল—বয়স কম বলে সেবার দেয়া হয়নি। এক অজ্ঞাত কারণে এত প্রতিভাবান হওয়ার পরও তার রক্তে অপরাধের বীজ ঢুকে গেছে দু’টি খুন করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল—নাম পাল্টে কিছুদিন এক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করেছে। ধরা পড়ে মাস ছয়েক জেল খেটে জেল থেকে পালিয়ে যাবার পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।
জাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে স্যারদের কাছে হাকশীর গল্প শুনত। প্রতিভাবান ব্যক্তিরা নাকি একটু পাগলাটে হয়, কিন্তু তারা যে ক্রিমিনালও হতে পারে হাকশী সেই প্রমাণ রেখে গেছে।
হারুন হাকশী খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করল, তারপর খসখসে রুক্ষ গলায় বলল, লেসার বীম দিয়ে তোমাদের মাঝে কে আমার ফোবোসে আঘাত করেছিলে?
ফোবোস মানে?
ফোবোস হচ্ছে এই মহাকাশযান। পৃথিবীর মানুষেরা যেটাকে ফ্লাইং সসার ভেবে ভয়ে ভিরমি খাচ্ছে।
ও। জাহিদ তাচ্ছিল্যের স্বরে জিজ্ঞেস করল, লেসার বীম তেমন ক্ষতি করতে পারে নি তা হলে?
ক্ষতি যা করার ঠিকই করেছে তিন ইঞ্চি ব্যাসের ফুটো করে ফেলেছে আগাগোড়া, কিন্তু ঠিক করে ফেলতে সময় লেগেছে মাত্র চব্বিশ ঘন্টা। কে আঘাত করেছিলে, তুমি?
জাহিদের খুব লোভ হচ্ছিল, সে প্রশংসাটুকু নিয়ে হাকশীকে একটু ভয় পাইয়ে দেয়। কিন্তু কী ভেবে সত্যি কথাই বলল। আঘাত আমরা কেউ করি নি, করেছিলেন হাসান স্যার।
কোথায় সে।
এড্রোমিডাতে শেষ পর্যন্ত ছিলেন।
ও। ভালোই লক্ষ্যভেদ করেছিল, প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে লেসার বীম নিয়ে লড়তে আসা ছেলেমানুষি—
কামাল চটে উঠে বলল, ঐ ছেলেমানুষি অস্ত্রই তো তোমার ফোবোসের বারটা বাজিয়ে দিয়েছিল।
কক্ষণো না। ওটা কোনো আঘাতই হয় নি। দেখতে দেখতে আমার টেকনিশিয়ানরা সেরে ফেলেছিল।
আর যারা মারা গেছে, জাহিদ জিজ্ঞেস না করে পারল না; তাদেরকেও কি দেখতে দেখতে প্রাণ দিয়ে দিয়েছ?
হাকশী চমকে উঠে বলল, মারা গেছে, তুমি কেমন করে জানলে?
জাহিদ নির্দোষ মুখে বলল, জানতাম না, এখন জানলাম।
হাকশীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। জাহিদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান দেখছি। কী কর তুমি?
তুমি শুনে কী করবে?
হাকশীর হাসি এক মুহূর্তে মুছে গেল। থমথমে গলায় বলল, শুনবে কী করব?
কী?
তোমাদের এক্ষুণি মেরে বাইরে ফেলে দেব, না আরও কয়েকটা দিন বাচিয়ে রাখব, সেটা ঠিক করব।
জাহিদ শান্ত স্বরে বলল, মেরে ফেলার হলে আগেই মেরে ফেলতে, কষ্ট করে দেয়াল কেটে বের করে আনতে না।
হ্যাঁ—কিন্তু দেয়াল কেটে বের করে এনে যদি দেখি কয়েকটা নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবী নিয়ে এসেছি—ছুঁড়ে ফেলে দেব মহাকাশে। বল, তুমি কী কর?
আমি একজন পদার্থবিজ্ঞানী। জাহিদ ঠান্ডা স্বরে বলল, তাত্ত্বিক নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে গত বছর ডক্টরেট করেছি।
চমৎকার। হাকশীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তোমাকে আমার দরকার। বেঁচে গেলে এবার!
হাকশী এবার কামালের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, তুমিও কি পদার্থবিজ্ঞানী?
না। আমি নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর-ইঞ্জিনিয়ার।
কয় বছরের অভিজ্ঞতা আছে?
বেশি না। পাঁচ বছর।
ভেরি গুড। তোমাকে আমার আরও বেশি দরকার। আর এই যে মেয়ে, তুমি কী কর?
আমি জীববিজ্ঞানী। গত বছর ডক্টরেট করেছি মাইক্রো—ঠোট উল্টাল, হাকশী বলল, তোমাকে আমার দরকার নেই।
জেসমিন ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। জাহিদ তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল, মানে?
মানে অতি সহজ। এই মেয়েটির আমার কোনো দরকার নেই। ওকে এক্ষুণি মহাকাশে ফেলে দেয়া হবে—না-না, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি এমনিতে জ্যান্ত মানুষ মহাকাশে ফেলে দিই না—তার আগে—এখানেই তাকে মেরে নেয়া হবে।
লোকটা ঠাট্টা করছে, না সত্যি সত্যি জেসমিনকে এখানে মেরে ফেলতে চাইছে, জাহিদ প্রথমে বুঝতে পারল না। যখন বুঝতে পারল সত্যি সত্যি সে জেসমিনকে এখানেই গুলি করতে চায়—চিৎকার করে হাকশীর দিকে ছুটে গেল, তুমি পেয়েছটা কি? ভেবেছ—আমরা বেঁচে থাকতে তুমি ওর গায়ে হাত তুলতে পারবে?
কামাল জেসমিনকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, ওকে মারতে চাইলে আগে আমাদের মারতে হবে। আর যদি আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে চাও, জেসমিনকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
হাকশী একটু অবাক হল মনে হল। খানিকক্ষণ চপচাপ দাঁড়িয়ে বলল, বেশ, এবারে বেঁচে গেলে জেসমিন না কী যেন নাম তোমার। কিন্তু আমার এখানে কেউ চুপচাপ থাকতে পারে না—একটা-না-একটা কাজ করতে হবে বলে রাখলাম।
জাহিদ ভুরু কুঁচকে বলল, আর যদি না করি?
ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল হাকশী। হাসতে হাসতে বলল, তোমার সাহস তো মন্দ নয় ছেলে। আমার এখানে থাকবে অথচ কাজ করবে না? দেখাই যাক না কাজ নাকরে পার কি না!
কামাল চাপা স্বরে বলল, তোমার নিজের উপর বিশ্বাস খুব বেশি মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, আত্মবিশ্বাস আছে বলে পুরো পৃথিবীকে আমি শাসন করতে যাচ্ছি।
দেখা যাবে কীভাবে তুমি পৃথিবীকে শাসন কর।
হাকশী সরু চোখে কামালের দিকে তাকাল। বলল, মানে? তুমি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
হ্যাঁ, দেখাচ্ছি। কামাল গোয়ারের মত বলল, আমি সুযোগ পেলে তোমার টুঁটি চেপে ধরে…
হাকশীর অট্টহাসিতে সব শব্দ চাপা পড়ে গেল। কামালের পিঠ চাপড়ে হাসতে হাসতে বলল, সাবাশ ছেলে, সাবাশ! হাকশীর মুখে মুখে এরকম কথা বলার সাহস দেখিয়েছ, তার জন্যে কংগ্রাচুলেশান।
কামাল একটু চটে উঠে বলল, ঠাট্টা করছ?
মোটেও না। তোমাদের মতো সাহসী ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। এখানে যাদের ধরে এনেছি, তাদের অনেকেই আমার টুটি চেপে ধরতে চায়। অথচ প্রথম কথাটি মুখ ফুটে বলার সাহস দেখালে তুমি। তোমার স্পষ্টবাদিতা দেখে ভারি খুশি হলাম। শোন ছেলেরা, তোমাদের নামটা কি জানি না, যাই হোক, তোমাদের আমি অনুমতি দিলাম—তোমরা ইচ্ছে করলে আমার টুটি চেপে ধরতে পার।
এখনই যদি ধরি।
ঐ দু’জন লোক তাদের ট্রিগার চেপে ধরলে অন্তত দুইশত বুলেট তোমাদের মোরর মতো কেচে ফেলবে। অন্য কখনো যদি সুযোগ পাও, আমাকে হত্যা করার। চেষ্টা করে দেখতে পার। আমি এটাকে তোমাদের শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ভাবব না।
সত্যি বলছ?
হাকশী মিথ্যা কথা বলে না।