৩. রোলো তার ডেস্কের পাশে

রোলো তার ডেস্কের পাশে বিশাল আর্মচেয়ারে শুয়েছিল। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। কয়েকমিনিট আগে শেলি, গিলোরী আর ডাক্তার চলে গেছে। ওয়েডম্যানও চলে গেছে মিনিট পনের আগে।

রোলো এখন জানে কেমন করে খেলাটা জমাতে হবে। বুড়ো ঘুঘু ডাক্তারটা প্রায় সারাক্ষণ কথার প্যাঁচে ওয়েডম্যানকে ভুলিয়ে রেখেছিল। ব্যাপারটা কি জানতে পারলে রোলো কি ডাক্তারকে খামোকা এক তৃতীয়াংশ দেবার প্রতিশ্রুতি দিত!

দরজায় আস্তে ঠকঠক্ শব্দ হল।

–ভিতরে এস।

 গিলোরী ভিতরে ঢুকল।

–তোমার কি এসব পছন্দ হচ্ছে না গিলোরী? সত্যি কথা বল। দরজাটা বন্ধ করে দাও। ভয় পেওনা। বল আমাকে।

গিলোরী মাথা নেড়ে বলল, এটা ভাল হচ্ছেনা।

–তবুও তুমি কাজটা করবে বলছ?

–হ্যাঁ।

 রোলোর মুখের হাঁ দিয়ে চুরুটের ধোঁয়া বেরিয়ে ভেসে বেড়াতে লাগল। তুমি এখনও মনে কর যে আমার কাছে তুমি ঋণী? সে সব কথা ভুলে যাও।

গিলোরী মাথা নেড়ে বলল–আমি ভুলিনা।

-তোমার মা চমৎকার মহিলা ছিলেন। তিনি এত সুন্দরী আর অহংকারী ছিলেন যে ক্রীতদাসি হয়ে থাকার অনুপযুক্ত। তাই আমি তোমার মাকে সেই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনে এনে স্বাধীন করে দিয়েছিলাম। তুমি এখনও কেন সেই ঋণ শোধ করার জন্যে এত উদগ্রীব?

–তোমাকে বা অন্য কাউকেই আমার পছন্দ নয়। আমার দেশ হাইতিতে ফেরার জন্যে আমি খুব উদগ্রীব। অথচ ঋণ না শোধ করে কেমন করে যাই! এতদিনে যে সুযোগ এসেছে তা শুভ হোক বা অশুভ হোক! আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না, কিন্তু।

— রোলো উৎসাহিত হয়ে বলল, ঐ ওয়েডম্যানটা বেশ পয়সাওলা।

–কে টাকা পেল আর কে পেল না তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। অশুভত্ব ওখানে নয়। তোমরা আমাদের ধর্ম বিকৃত করেছ। ঠাট্টা করছ। এর থেকে ভালোর কিছু জন্ম হতে পারে না। যা আসবে তা অশুভ।

–আমরা মরাটাকে জীবন্ত করে দেবার ভান করছি। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করলে এটা তোমার পক্ষে সম্ভব। তুমি মিথ্যেবাদী।আর ওয়েডম্যান যদি তোমার কথায় বিশ্বাস করে তাহলে সে পাগল। আমি এর থেকে কিছু টাকা পয়সা হাতাতে চাই।

ভাল হবে না।

রোলো গিলোরীর দুঃখী দুঃখী গলার স্বরে অভিভূত হয়ে বলল, কি ঘটতে পারে বলে তুমি মনে কর!

আমি ভবিষ্যতবাণী করতে পারি না। তবু আপনাকে সাবধান করে বলছি নিজের হাত পরিষ্কার রাখুন।

রোলো দাঁত খিচোলো, তুমি বড় অদ্ভুত চরিত্রের। তোমাকে দেখে যা মনে হয়, তার থেকে বেশি জান বোধহয়। মরুক গে। চিন্তার কিছু নেই। যা ঝুঁকি নেবার ডাক্তার সামলাবে।

গিলোরীর চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টিফুটে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকাল সে। ঘড়িতে রাত বারোটা কুড়ি মিনিট। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার মরবে।

রোলো বলে উঠল–পাগলের মতো কি যাতা বকছ!

-আমি বাড়ি যাচ্ছি। আজ রাতে আমার আর করার কিছু নেই।

দাঁড়াও। যাচ্ছো কোথায়? ডাক্তার মরবে এর মানেটা কি?

গিলোরী পকেট থেকে একটা কাঠের পুতুল বার করে সিগার কেসটার গায়ে হেলান দিয়ে দাড় করাল।

–পুতুলটা যে মুহূর্তে পড়বে, বুঝবে ডাক্তার মৃত।

–আমায় ভয় দেখানোর চেষ্টা কোর না। কর্কশ গলায় চেঁচাল রোলো, তোমার ঐ বাঁদুরে চালাকি আমি অনেক দেখেছি। ডাক্তার মরতে যাবে কেন?

–আমি ডাক্তারের মুখে মৃত্যুর ছায়া দেখেছি।

ফোন বেজে উঠল। রোলো রিসিভার তুলল, হ্যালো।

একটা চড়া গলা তার কানে ভীষণ জোরে আঘাত করতে লাগল।দয়া করে আপনি আস্তে বলুন। আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিনা। কে?কি পাগলের মত সববলছেন? উত্তেজিত রোলো গিলোরীর হাতে রিসিভারটা দিয়ে বলল, দেখো তো কি বলছে।

–মিঃ ওয়েডম্যান? একটু ধরুন।

–ওয়েডম্যান! কি হয়েছে? কি বলছে? রোলো বিস্ফারিত হয়ে উঠল।

 –ওর ভাইয়ের মৃতদেহটা চুরি হয়ে গেছে, ও কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

 রোলো চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, কি পাগলের মতো বকছো! তুমি ঠিক শুনতে পেয়েছো? মৃতদেহ কে চুরি করবে। ওটা ছাড়া তো আমাদের সব কিছুই ভেস্তে যাবে। কে করতে পারে এ কাজ। রোলো গিলোরীর দিকে তাকালো, ডাক্তারই আমাকে ভ্রাবলক্রসিং করছে নাতো? ওয়েডম্যানকে অপেক্ষা করতে বল আমি যাচ্ছি। আমরা এখুনি যাচ্ছি। সবাইকে জড়ো হতে বলো। ডাক্তারকে ডাক! বুছ বুচ কোথায়? বুচ! গাড়ি বার করতে বল।

–ডাক্তার তো মরে গেছে!

গর্জন করে উঠল রোলো, ফেলে দাও পুতুলটাকে। রোলো দেখল পুতুলটা কখন যেন পড়ে। গেছে।

ফোনের ডায়াল ঘোরাল।

না ধরছে না কেউ। হয়তো কারোর সঙ্গে দেখা করতে গেছে।

–হ্যাঁ। মৃত্যুদূতের সঙ্গে।

–চুপ কর কেলে নিগ্রো কোথাকার। যাও সবাইকে জড়ো কর।

–গিলোরী চলে যেতে রোলো আবার ডায়াল ঘোরাল। না কেউ ফোন ধরছে না।

শেলিকে ফোন করল রোলো।

অনেকক্ষণ পরে শেলি ফোন ধরল।-কে?

এতক্ষণ ফোন ধরছ না কেন?

—কি চাও? আমি ঘুমোচ্ছিলাম। স্বরটা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।

–ডাক্তার কোথায়? গিলোরী বলছে ডাক্তার নাকি মারা গেছে।

-গিলোরী! তীব্র আর্তনাদ করে উঠল শেলি।চীৎকারটা এতটা আঘাত করল রোলোরকানকে যে রিসিভারটাহাত থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। রোলো শুনতে পেল অদ্ভুত একটা গোঙানীর শব্দ আর তারপর মেঝেতে যেন কেউ ধম করে পড়ে গেল।-হ্যালো! হ্যালো শেলি। হ্যালো! কি হল? কোন জবাব নেই।

গিলোরী ফিরে এসে জানাল–গাড়ি রেডি।

–শেলি। শেলির বোধহয় কিছু হয়েছে। রোলো তার মোটা শরীর নিয়ে টুপী হাতে গাড়ির দিকে ছুটল।

বড় প্যাকার্ড গাড়িটার স্টিয়ারিং-এ লংটম বসেছিল।

গাড়ি ছুটল শেলির অ্যাপার্টমেন্টের দিকে।

.

সিঁড়ির মাঝপথেই শেলির সঙ্গে দেখা হল। রোলো দেখল শেলির মুখটা ছাইয়ের মত সাদা। চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সারা মুখ লিপস্টিক-এ মাখামাখি।

–শেলি। কি হয়েছে তোমার শেলি? রোলো ঝুঁকে চীৎকার করে উঠল।

বেরিয়ে যাও। বেরিয়ে যাও এখুনি।

 রোলো আস্তে আস্তে তার বিশাল থাবা দিয়ে শেলির কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল–কি। হয়েছে?

শেলির মাথা এলিয়ে পড়ল। গোঙাতে গোঙাতে বলল সে, আমাকে একলা থাকতে দাও দয়া করে।

রোলো তাকে পাজাকোলা করে তুলে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলবল ডাক্তার সম্বন্ধে কি জান? ডাক্তার কোথায়?

কাঁদতে কাঁদতে শেলি বলল-জানি না। জানি না। কিছু জানিনা।

–ঠিক করে বল। তুমি নিশ্চয় কিছু জান।

–তুমি চলে যাওঁ।

–সময় নষ্ট করছ। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গিলোরী বলল।

ক্ষেপে উঠে রোলো বলল–তুমি এখানে কেন এলে? কে আসতে বলল?

–ওয়েডম্যান অপেক্ষা করছে। মনে হয় সেটা আরও দরকারী।

রোলো শেলিকে ছেড়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে বলল, তোমার ওসব ন্যাকামি ছেড়ে বুচ কোথায় আছে খোঁজ করে বলে দাও ওয়েডম্যানের ওখানে আসতে। দরকারি কাজ আছে আমার। তোমাকে কাল আমি দেখব। তারপরে গিলোরীকে পাশ কাটিয়ে তরতর করে নেমে গেল রোলো।

বাথরুমটা পরিষ্কার কর শেলি। ওখানে মরার গন্ধ। আর কোন কথা না বলে গিলোরী তাড়াতাড়ি নেমে গেল।

.

বসবার ঘরে সেডরিক স্মাইথ অবাক হয়ে বলল, আচ্ছা তুমি তাহলে এখন অভিনয় ছেড়ে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট।

সুদর্শন যুবকটি জেরী লজ্জায় হেসে বলল, অভিনয় আর আমার হলনা। কোন প্রশংসা পেলাম না। সুতরাং

সেডরিক, অনেকদিন পর তার বন্ধু দেখা করতে এসেছে বলে খুব খুশি।

বিয়ারে শেষ চুমুক দিয়ে জেরী বলল, চলি, এখন আমায় থানায় যেতে হবে। মাঝে মধ্যে। আসবখন।

ঘড়িতে এগারটা বাজল। তোমাকে আর আটকিয়ে রাখবো না। সেডরিককে উদ্বিগ্ন দেখাল। মেয়েটা এত ভাল ইদানিং কেমন যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, বুঝতে পারছি না। কি করছে সে এখন!

জেরী বলল–বেশ তো, আইন ভাঙলে আমার কাছে আসতেই হবে। সত্যি বলতে কি সেডরিক আমি এখন একটা জব্বর কেসের আসায় দিন গুনছি।যদি দেখ কেউ কাউকে খুন করতে চাইছে আমাকে একটা ফোন করে দিও।

জেরী চলে যেতে গ্লাসগুলো ধুয়ে শোবার ঘরের দিকে এগোল সেডরিক। হঠাৎ বেলটা বেজে উঠল। সেডরিক চমকে উঠল। রাত সওয়া এগারোটায় আবার কে এল?

সিঁড়ির ধাপের উপর চোখ পড়তে সেডরিক দেখতে পেল ওখানে জো ক্রফোর্ড দাঁড়িয়ে। মিস হেডারের জন্যে আমি একটা জিনিস এনেছি। শীতল কঠিন দৃষ্টিতে সে তাকাল সেডরিকের দিকে।

জো-কে সে এত রাতে আশা করেনি। সেডরিক পিছিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কি? কি চাও তুমি রাত দুপুরে? হঠাৎ তার নজরে এলো একটা ট্যাক্সি আর একটা স্টিল ট্রাংক।

–এটা কি নিয়ে যাব? ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।

দাঁড়াও আমি ধরছি–জো বলল।

–কি আছে এতে? ভয় ভয়ে প্রশ্ন করল সেডরিক।

চুপ কর। ওর ঘর কোথায়?

 –তুমি কে? এসব কি?

জো সেডরিককে চেপে ধরে কাছে টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল–অ্যাই মোটকু, বল্ ওর ঘর কোথায়? চুপচাপ ঘরটা দেখিয়ে দে।

সেডরিক ভয়ে বাক্যহারা হয়ে ওপরে উঠতে থাকল। জো আর ড্রাইভার পেছন পেছন ট্রাংকটাকে বয়ে নিয়ে চলল।

সুশানের ঘরের দরজা খুলে দিল। আলো জ্বালিয়ে সেডরিক বলল–সুশান নিশ্চয় জানে? তাড়াতাড়ি এখানে রেখে চলে যাও। এটা মেয়েদের ঘর, দাঁড়িও না।

ওরা নীচে নেমে এলো। গাড়িতে চড়ে বসে জো সেডরিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে বলবে আমি না বলা পর্যন্ত ও যেন ট্রাংকটা না ছোঁয়।

ঘর থেকে পালিয়ে সেডরিক রান্নাঘরে ঢুকল। এককাপ চা বানিয়ে আবার ঘরে গিয়ে বসল। না সুশানকে ব্যাপারটা জানাতেই হবে। মেয়েটা তার পছন্দ, তাই দুটো দিন তার বিশ্রী কেটেছে।

ট্রাংকটার কথা মনে পড়তেই একটা বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে লেগে রয়েছে মনে হল। গন্ধটা কিসের? কোথায় সে গন্ধটা আগে পেয়েছ? কি আছে ঐ ট্রাংকটার মধ্যে?

রাত সাড়ে বারোটার সময় সুশান বাড়িতে ঢুকে সেডরিককে বসার ঘরে দেখে অবাক।-শুভ সন্ধ্যা মিঃ সেডরিক! আমি ভেবেছিলাম, আপনি বোধহয় শুয়ে পড়েছেন।

গম্ভীরভাবে সেডরিক বলল তোমার সঙ্গে কথা আছে বলে বসে আছি। যদিও জানি ও ব্যাপারে আমার নাক না গলানো উচিত, তাহলেও আমার তোমার কাছে একটা ব্যাখ্যা দাবী করা অমূলক হবেনা।

সুশান ভয় পেয়ে বলল–কেন মিঃ সেডরিক? কি ব্যাপার? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

দয়া করে দুমিনিট সময় আমার ঘরে এসে বস। আচ্ছা মিস্ হেডার ঐ হতচ্ছাড়া লোকটা কে, যে তোমার জন্যে চিঠি আর ট্রাংক রেখে যায়?

সুশান তাকিয়ে রইল–ট্রাংক?

-হ্যাঁ এক ঘণ্টা আগে রেখে গেছে সে। আমার সঙ্গে এমন ভাষায় কথা বলেছে, তোমার বন্ধু না হলে আমি পুলিশ ডাকতাম।

পুলিশ? না না।

সুশানকে সে আর আঘাত দিতে চাইল না।অবশ্য তোমাকে না জিজ্ঞেস করে তা করতাম না। তারপর একটু থেমে বলল–আমি একজন প্রাক্তন সৈনিক, একথা ভুলে যেও না। তাছাড়া ট্রাংকটা দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।

–দেখছি, আমি গিয়ে দেখছি।

তার আগে আমাকে এসবের একটা ব্যাখ্যা দিয়ে যাওয়া উচিত।

সুশান হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল–আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নানা গলানোই আমি বেশি পছন্দ করি। তা না হলে আমি আপনাকে বোর্ডিং ছাড়ার নোটিশ দোব।

সেডরিক সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বললনা, না, আমি দুঃখিত। আসলে আমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।

ঠিক আছে মিঃ সেডরিক। যা ঘটেছে তার জন্যে আমি দুঃখিত। মিঃ ক্রফোর্ডের সঙ্গে কথা বলে দেখব। সুশান ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকল। জো যে বলেছিল একটা স্টিলের বাক্স পাঠাবে তার বদলে ট্রাংক? ওয়েডম্যানকে ক্লাবে না আসতে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওয়েডম্যান এসেছিলেন। কি যে ব্যাপার!দরজা খুলতেই কানে এল টেলিফোন বাজছে। ফোনটা ধরতে গিয়েই নাকে বিচ্ছিরি গন্ধটা এল। সঙ্গে সঙ্গে শবযাত্রার ফুলের কথা মনে এল।হ্যালো!কালো ট্রাংকের দিকে সুশানের চোখ।

–জো বলছি।

–কি হয়েছে? ট্রাংকটাই বা পাঠালে কেন?

–বেশি কথা না বলে শোন। ওয়েডম্যান আমাকে ধোঁকা দিয়ে ক্লাবে গিয়েছিল। ওর ভাইয়ের মরা দেহটা ঔষধ প্রয়োগে সুরক্ষিত করা হয়েছিল। ওরা ভেবেছিল ওটাকেই জীবন্ত করবে। রোলো ভাওতা মেরে কিছু টাকা বাগিয়ে নেবার তালে ছিল। এখন আমি দেহটা লুকিয়ে ফেলেছি। আর চালাকি চলবে না।

-তুমি কি বলতে চাইছ জো?

–ট্রাংকের ভেতরটা তোমার না দেখলেও চলবে।

–না। সুশান চীৎকার করে উঠল।–ও জো প্লীজ।

–আমি আর কিছু বলতে চাই না। মনে হচ্ছে কারা যেন আসছে। এক মুহূর্ত বিরতির পর জো আবার বলল, ওরা এসে গেছে। ওয়েডম্যান ডেকে পাঠিয়েছেন। ফোনের লাইনটা কেটে গেল।

সুশান ট্রাংকটার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত আর্তনাদ করে দু-হাতে চোখ ঢাকল। ফোনটা হাত থেকে খসে পড়ল।

জো ফোনটা নামিয়ে দেখল রোলো আর গিলোরী ভাবলেশহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে। ওয়েডম্যানের চোখে বেদনার ছায়া।

–এই হচ্ছে জো। আশা করি ও আমাদের সাহায্য করতে পারবে। জো তুমি কোথায় ছিলে? করনেলিয়াস চলে গেছে। কেউ তাকে নিয়ে পালিয়েছে। জো অনুভব করল রোলো তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে।

–গেছেন মানে কি? তিনি তো মারা গিয়েছেন। ওয়েডম্যান বললেন।

 রোলো ক্রেস্টারকে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমার। তার আগে আমি জো-এর সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি ক্লান্ত, বিশ্রাম নিন।

গিলোরী ওয়েডম্যানকে শুতে যেতে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। প্রতিবাদ সত্ত্বেও তাকে নিয়ে চলে গেল। রোলো আর জো দুজন মুখোমুখি। তাহলে তুমিই জো। কাকে ফোন করছিলে এইমাত্র?

–আমার বান্ধবীকে।

 বান্ধবীর নাম বল।

–ওটা আমার নিজস্ব ব্যাপার। তুমি জানতে চাওয়ার কে?

-তোমার মালিক কেন প্রশ্ন করল তুমি কোথায় ছিলে?তুমি কি বাইরে গিয়েছিলে? জিঘাংসা ভরা গলায় রোলো বলল।

–তুমি আর নিগ্রোটা বেরিয়ে যাও এখান থেকে।

–তোমার মালিক আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন।

গিলোরী ফিরে এলো। রোলো প্রশ্ন করল-করনেলিয়াসকে তুমিই সরিয়েছ। তাই না জো?

–ঐ মড়াটা নিয়ে আমার কি দরকার?

–বেশি চালাক সেজোনা জো। ওয়েডম্যান মৃতদেহ ফেরত পাবার জন্যে প্রচুর খরচা করতে রাজি। সময় নষ্ট না করে এসো আমরা দুজন পার্টনার হই।

–আমি জানলে তো!

যার কাছে মৃতদেহটা রেখে এসেছে তার ফোন ছিল। তাই না?

জোর মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না।

–তোমাকে কি করে কথা বলিয়ে নিতে হয় আমার ভাল জানা আছে। কিন্তু আমি তা চাই না। আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে সহযোগিতা কর।

জানলে তো বলব। জো বলল।

এই সময়ে কুচ ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে জোর ঘরে ঢুকল।

–ঠিক সময়ে এসে গেছে। এই হচ্ছে জো।

হ্যাঁ। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বুচ বলল–আমাদের দুজনের আগেই দেখা হয়েছে।

কালো জামা পরা লোকটাকে দেখে জো তার সপ্রতিভ হারালো। তার সাহস, আশা, শক্তি দৃঢ়তা গলে জল হয়ে গেল। জো ভয়ে কেঁপে উঠল।

জো তুমি বলবে, না বুচের সঙ্গে তোমায় একা রেখে যাব? জো সঙ্গে সঙ্গে ভেবে নিল, বুচের মোকাবিলা করার মতো সাহস বা শক্তি তার নেই। অত্যাচার সহ্য করার মত ক্ষমতাও তার নেই। সে কি সব বলে দেবে? কিন্তু বললেই বুচ তাকে হত্যা করে সুশানের কাছে পাঠিয়ে দেবে। তারপর মৃতদেহটা বাগাবে। পরে হয়তো সুশান আর মোটা লোকটাকেও হত্যা করবে। তারপর ওয়েডম্যানের রক্ত শুষে ছিবড়ে করে ফেলবে। এ সমস্তই হবে তার দৃঢ়তার অভাবে। আর বুচও তাকে হয়তো ঘন্টার পর ঘণ্টা যন্ত্রণা দিয়ে মারবে। সে বড় কঠিন। মৃত্যুকে সে ভয় পায়না। মরতে তাকে হবেই। তাই পর ঘণ্টা যন্ত্রণা দিয়ে মারলেসুমই হবে তার দৃঢ়

–বেশ আমি বলছি। মৃতদেহটা এ বাড়ির ওপরে আছে। ওপরে চলো। আমি দেখাচ্ছি।

চালাকি করলে মরবে, রোলো ঝুঁকে পড়ে বলল।

–ওপরে আছে। তোমরা সবাই চলো।

না, আমরা এখানেই আছি। বুচ তুমি যাও। কিন্তু সতর্ক থেকে ছোকরার ধান্দা খারাপ আছে।

 চল। চালাকি করলে কান দুটো উপড়ে নেব। বুচ বলল।

জো চুপচাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। তাকে যে মরতে হবে সে জানে কিন্তু তার অবর্তমানে সুশান কি তার চিঠির কথার মত কাজ করতে পারবে? তার যতটুকু করার সে করেছে।

আস্তে চল, দৌড়বে না, বুচ বলল।

সিঁড়ির মাঝপথে এসে জো ভাবল এবার একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু হাঁটু দুটো দুর্বল লাগছে। হৃদপিণ্ডের শব্দে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে। তারা সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে গেছে। এরপর আর সিঁড়ি থাকবে না। একটু ভুল করলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। যা থাকে কপালে। কিছু করতেই হবে–

হঠাৎ সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুহাতে বুচের বুকে মারল এক ধাক্কা। বুচ চীৎকার করে উঠলো। বুচ জোর হাত ধরে টাল সামলাবার চেষ্টা করলে জো তার পেটে সজোরে এক লাথি কষাল। জোর হাত ফস্কে বুচ সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে পড়তে থাকল।

জো কোন দিকে তাকিয়ে একটা ছোট জানলারদিকে ছুটেচলল।জানলার পাশেছাদ। পেছনে বোধহয় রোলো চীৎকার করে ছুটে আসছে। জানলার ফ্রেমটা ধরে প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকুনি দিল।নড়ছে না। ভয়ে জোরদম আটকে আসতে লাগল। শুনতে পেল রোলো গাঁক গাঁক করে ছুটে আসছে আর বুচ সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের ধুলো, রঙ আরনা খোলার জন্যে জানলাটা অনড়। জো কাঁধ দিয়ে জানলার কাঁচ ভেঙ্গে পাশের ছাদে লাফিয়ে পড়ল।

বুচ দৌড়ে আসতে আসতে চীৎকার করে উঠল, থাম।

জো তার কথায় কান না দিয়ে টালি আঁকড়ে তিন কোণা ছাদের প্রান্তে গিয়ে থামল। বুচ হিংস্র, আর সতর্কতায়পূর্ণ মুখটা বাড়াল। তার থেকে জোর দুরত্ব বড় জোর কুড়ি ফুট।

গর্জন করে উঠল বুচ–তুমি আসবে, না আমি যাবো?

জোর মাথা ঝিমঝিম করছে, তবু সে বুচকে দাঁত বের করে ভেংচাল। বুচ এখন আর তার কিছু করতে পারবে না।

রোলো কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বুচকে সরিয়ে দিয়ে জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে জো-কে দেখে বুচকে বলল–তখনই বলেছিলাম ছোকরাটাকে লক্ষ্য রাখ। এখন কি করবে?

–আমি যাচ্ছি।

-পাগল হয়েছে? ঐ ঢালু জায়গায় তোমার পা ফসকাবে। তারপর একটু নরম গলায় জোরে বলল, লক্ষ্মীছেলে কোন দুর্ঘটনা ঘটার আগে চলে এস।

লাফ মারব সেও ভাল, কিন্তু ধরা পড়লেই আমাকে বলতে হবে।

–রোলোর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শিহরণ খেলে গেল–বোকামী কোর না।

না। যদিও ভয়ে, ঠাণ্ডায় জোর দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হচ্ছিল।

–রোলো ফিসফিসিয়ে বুচকে বলল, একটা দড়ি জোগাড় কর। ওটাকে ফাঁস লাগিয়ে ধরতে হবে। জো তুমি অকালে মারা পড়বে কেন, তার চেয়ে মড়াটা কোথায় বলে দাও, আমি তোমাকে দশ হাজার পাউন্ড দোব।

তুমি জানো এরা আমার কি উপকার করেছে। তোমরা কোন চালাকি করে করনেলিয়াসের দেহ খুঁজে পাবেনা, কোন দিনই। এই জন্যই আমি মরতে চাই।

বুচ দড়ি নিয়ে ফিরে এল। তুমি ছেলেটাকে কথা বলাতে থাক। আমি অন্য দিক থেকে দড়িটা ছুঁড়ছি।

রোলো কপালের ঘাম মুছে বলল-সাবধান কিন্তু, ছোঁড়াটা পাগল। এ মরে গেলে মৃতদেহ আর পাওয়া যাবে না। রোলো ঝুঁকে পড়ে জোকে বলল, জো, আমরা তোমার সাহায্য ছাড়াই মৃতদেহ খুঁজে নোব, তাই তোমায় ছেড়ে দেবার মনস্থ করেছি। আমরা যাচ্ছি।

–বিশ্বাস করি না।

বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখ, আমাদের চলে যেতে দেখতে পাবে।

–তোমরা আবার ফিরে আসবে। এরকম সুযোগ হয়ত আমি আর পাবো না।

–আমি কাগজে লিখে দিচ্ছি যে, আমরা জোকে একলা থাকতে দোব। বল ঝাঁপ দেবে না?

জোর ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে ভয় লাগছিল। রোলোর লিখে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে সে একটা আশার আলো পেল। কারণ জো যে সমাজ থেকে এসেছে, সই করা কাগজের ওপর গভীর আস্থা আছে তাদের।

জো দেখল রোলো পকেট থেকে কাগজ আর কলম বার করে কি যেন লিখতে লাগল আর বলল-কিভাবে শুরু করব? কাকে সম্বোধন করব?

জো বাঁচার আশায় এমনই বিভোর বুচ যে নল বেয়ে উঠে আসছে, তা খেয়াল ছিল না।

রোলো কাগজটা জোরে জোরে পড়তে থাকল আর জো চোখের কোণা দিয়ে কিছু নড়তে দেখতে পেয়ে ঝটকা মেরে সরে যাওয়ার আগেই তার গায়ের ওপর দড়ির একটা ফাস আছড়িয়ে পড়ল। তাহলে এটাও চালাকি! এবার তাকে মরতেই হবে। মুহূর্তের মধ্যে সে দড়ির ফাসটা গলার ওপর নিয়ে এল।

বুচ আর রোলোলা চিৎকার করে উঠল। গলায় ফাঁস এঁটে বসে যাচ্ছে। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে। জোর মুখ সাদা। অসহায় মৃতদেহটা ঝুলে পড়ল।

.

 সেডরিক স্মাইথ কোটটা খুলে শোবার আয়োজন করতে যাচ্ছে, হঠাৎসুশানের ভয়ার্ত চীৎকার শুনে সে সুশানের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। মিস হেডার! কি হয়েছে? কোন শব্দ নেই। সেডরিক সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেল দড়াম করে একটা দরজা বন্ধ হল। চাবি লাগানোর শব্দ।

-হে ভগবান! কি হয়েছে মিস্ হেডার? আমি তো ভয়ে মরতে বসেছিলাম।

–তোমায় এখন কিছু বলার সময় নেই। আমায় ছেড়ে দাও। সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নেমে গেল সে। কোথাও কোন বাড়িতে রাত দুটো বাজল। ফুলহ্যাম রোড ধরে পুটনী ব্রীজের দিকে ছোটা শুরু করল। জোর সঙ্গে দেখা করার চিন্তায় তার মন তোলপাড় করছে। ট্রাংকের মৃতদেহটা জোকে এখুনি নিয়ে যেতে বলবে সে। পুলিশের ঝাটে একমুহূর্তের জন্যও থাকবে না সে।

একটা ট্যাক্সি ধরে গ্রীনম্যানে নেমে বিশাল পাথরের গেট পেরিয়ে ড্রাইভওয়ের ওপর দিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে চলল। ড্রাইভওয়েটা একটা বনের ভেতর চলে গেছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতে একটা প্যাকার্ড গাড়ি নজরে এল। সঙ্গে সঙ্গে জোর কথা মনে পড়ল। পরক্ষণেই সে একটা ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে উঁকি মেরে দেখতে পেল একটা লম্বা রোগা লোক ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে।

এমনই সময় একটা গলার শব্দ তার কানে এল–ছুঁচোটাকে টেনে তুলতে পারছি না। দড়িটা কেটে দি, হতচ্ছাড়াটা নীচে পড়ুক।

সুশান সবকিছুর অস্তিত্ব ভুলে ওপর দিকে তাকিয়ে রইল।কালো জামা পড়া লোকটা তেকোণা ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে। দড়ির আগায় যে দেহটা ঝুলছে, তার চুল দেখে সুশানের চিনতে ভুল হলনা। হঠাৎ দেহটা দড়ি ছিঁড়ে মাটিতে আছড়িয়ে পড়ল। সুশান অনুভবকরল মাটির ওপর সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছে। তারপর সব অন্ধকার।

আবার সজাগ হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে সে চিনতে পারল বুচ, গিলোরী আর রোলোকে। সবাই মৃতদেহকে ঘিরে জড় হয়ে দাঁড়িয়ে। শুয়ে শুয়ে নিঃসাড় ভোতা অনুভূতি নিয়ে সে বুঝতে পারল মৃতদেহটাকে কবর দেওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছে। বুচ টমকে এক ধাক্কা মেরে কোদাল আনতে পাঠাল।

গিলোরী বলল–কেউ যেন আমাদের লুকিয়ে লক্ষ্য করছে। আমি অনুভব করছি।

রোলো বলল–কে? কোথায়?

সুশান যে ঝোঁপের আড়ালে শুয়েছিল সেদিকে তাকিয়ে মৃতদেহটা নিয়ে টম আর গিলোরী এগিয়ে আসতে লাগল। বুচ আর রোলো কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসতে লাগল।

এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করে সে লাফিয়ে উঠে ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে দৌড় দিল। শুনতে পেল একটা ভারী শরীর তার দিকে এগিয়ে আসছে। রোলোকে তার এত ভয় নেই, কিন্তু কালো জামা পড়া লোকটাকেই ভয়। ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে ছুটতে লাগল। বুচও ছোটা শুরু করেছে।

রোলোর হাতির মত ধুপধাপ ছুটে চলার জন্যে বুচ দিক ঠিক করতে পারছিল না। রোলোকে থামতে বলে বুচ কান পেতে শোনবার চেষ্টা করল। ডান দিকে সে শুনতে পেল সুশান জঙ্গলে পথ হাতড়াচ্ছে। সুশান খুব দ্রুত দৌড়তে লাগল। পিছনে বুশ। হঠাৎ সে ছোটা থামিয়ে একটা ঘন-ঝোপে ঢুকে গেল। বুচও সুশানের পায়ের শব্দ না পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সুশান মাত্র বারগজ দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করছে আর ভগবানকে প্রার্থনা জানাচ্ছে।

বুচ বুঝল সে কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে আছে। চীৎকার করে বলল, আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি কিন্তু সুশানের দিকে বুচের পিঠ। সুশান বুঝল বুচ দেখতে পায়নি। সুযোগ বুঝে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আবার উল্টো দিকে ছুটতে লাগল। কিন্তু রোলোর লৌহ কঠিন মুঠিতে তার হাত ধরা পড়ল। তাহলে তুমিই জো-এর বান্ধবী।

রোলো গর্জন করে উঠল, বুচ, এদিকে এস। পেয়েছি। বুচের পায়ের শব্দ পেয়ে সুশান রোলোর মাংস ভেদ করা তীক্ষ্ণ দাঁতের কামড় বসালে রোলো হাত ছেড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটা শুরু করে দিল সুশান। নিজের হরিণ গতিতে ছোটায় নিজেই অবাক। রোলোনুড়িপাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ল। এখন সে গ্রীনম্যানের দিকে ছুটে চলেছে। হঠাৎ পেছনের পদধ্বনি মিলিয়ে গেল। সুশান থেমে গেল। পেছনে এক ছায়ামূর্তি তাকে লক্ষ্য করল। সামনে এক পুলিসম্যান বক্রদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে চলে গেল।

.

জ্যাক ফ্রেসবী সন্দিগ্ধ চোখে সুশানের দিকে তাকিয়ে গোঁফে তা দিতে লাগল। মেয়েটা সারারাত বাড়ি ছিলনা, ওর নিশ্চয়ই স্নায়ু বিপর্যয় ঘটেছে।

এগারটা কুড়ি হয়ে গেছে। জো আজ এখনও ফোন করেনি। অথচ মেয়েটা বাক্সটা চাইতে এসেছে। তবে কি জোর কিছু ঘটেছে? বাক্সটা কি দেবে? চালাকি করতে গিয়ে যদি জোর ফাঁদে পা দেয়?

–কিসের বাক্স? যে কেউ এসে বাক্স চাইলেই দিতে হবে? আমার কি বাক্সর ব্যবসা! একটু খেলাবার চেষ্টা করল ফ্রেসবী।

সুশান দৃঢ়ভাবে বলল–কোন্ বাক্স তা তুমি ভাল করেই জান। বাড়াবাড়ি করলে পুলিশের কাছে যাব।

ফ্রেসবী ফিসফিস করে বলল, জো কি বলেছে? কি জান তুমি?

–তা তুমিও জান আর আমিও জানি। ঐসব নোংরা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না।

–জো-এর কি হয়েছে?

সুশান উঠে দাঁড়াল।–হয় বাক্সটা দাও নয়তো আমি চললাম। এখানে বাজে সময় নষ্ট করার সময় আমার নেই।

–আহা। যদি জানতে পারতাম জোর কি হয়েছে তাহলে মেয়েটার মজা দেখাতাম। সেদিন মেয়েটাও একলা এসেছিল। অথচ জো এই বাড়িতেই ছিল, তাকে মৃতদেহটা টেনে নীচে নিয়ে যেতে দেখেছি। এটাই তার সর্বনাশের মূল। আজও যদি কেউ ঐরকম দেখে ফেলে। আজও–মেয়েটা সুন্দরী। ইচ্ছে হচ্ছে ধর্ষণ আর খুনের। বহু কষ্টে ফ্রেসবী নিজেকে সংযত করে বলল–এই নাও টিকিট। এটা গ্রীক স্ট্রিটের হেবিং অ্যান্ড হব নামে একটা দোকানে দশ শিলিং দিলে, ওরা তোমায় বাক্সটা দেবে।

সুশান ছোঁ মেরে টিকিট নিয়ে বলল–আমি আবার আসব। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

ঘণ্টাখানেক পরে লায়ন্স টিপসে বসে বাক্সটা জোর পাঠানো চাবি দিয়ে খুলে সুশান অবাক হলো। এক গোছ টাকা আর তলায় একটা চিঠি। জো লিখছে, তুমি যখন এ চিঠি পড়বে আমি তখন মৃত। কালো জামা পরা লোকটা আমাকে ধমকী দিয়ে গেছে। ও আমাকে শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ওয়েডম্যানকে ছিবড়ে করার চেষ্টা করবে। পুলিসের ভয় দেখালেই ফ্রেসবী তোমায় সাহায্য করতে রাজি হবে তবে লোকটা বিপজ্জনক। তোমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করলে তুমি শুধু ওকে বলবে, তুমি জান ভেরা কোথায়। তোমার মিথ্যেটা ও যেন বুঝতে না পারে। ব্যাস ঐ টুকুতেই কাজ হবে। ফ্রেসবী সম্বন্ধে অযথা জানার চেষ্টা কোরো না। অনর্থক ঝামেলায় পড়বে। যাই হোক পুলিশের কাছে যাবে না। তুমি ছাড়া ক্রেস্টারকে সাহায্য করার কেউ রইল না। এজন্যই টাকাটা দিলাম।

সুশান বুঝতে পারল না, সে কিভাবে ক্রেস্টারকে সাহায্য করবে! তবে জো বিশ্বাসী লোক। বিশ্বাসীদের তার পছন্দ।

তিনশো পাউন্ড! অনেক টাকা। ক্রেস্টারকে সাহায্য না করলে টাকাটাও তার প্রাপ্য হলো না।

ট্রাংকটার কথা ভাবল সে। জো বলেছে মৃতদেহ যেন কেউ না পায়। কিন্তু মড়াটাকে ঘর থেকে সরাতে হবে।

সেডরিক যদি খুলে দেখে ফেলে! ফ্রেসবীর কাছে সাহায্য চাইতেই হবে।

–তুমি আবার এসেছে।? আমি কিছু করতে পারব না।

–জো মারা গেছে, বলে ফ্রেসবীর মুখে সন্তুষ্ট ভাব লক্ষ্য করল। জো আমায় বলে গেছে ভেরা কোথায় আছে।

–ফ্রেসবী ধপ করে বসে পড়ে বলল–আর কাকে বলেছে? তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছ। তুমি আর বেশিদিন পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না।

আমি আগেই সাবধান হয়ে গেছি। আমার ব্যাংক ম্যানেজারকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছি, সাতদিন আমাকে দেখতে না পেলে ওটা খুলতে। ফ্রেসবী ধপ্ করে বসে পড়ে বলল–ভুল করলে। পুলিশ তোমায় দোসর ভাববে।

–তুমি কি চাও আমি সব কথা পুলিশকে খুলে বলি?

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফ্রেসবী বলল, আচ্ছা, কি চাও তুমি?

সুশান ঝড়ের বেগে ওয়েডম্যান, করনেলিয়াস, রোলো, জো সকলের কথা বলে গেল। ওয়েডম্যান মিলিওনীয়ার, টাকার গন্ধ আছে এই ভেবে ফ্রেসবী বলল, আমায় কি করতে হবে?

–মৃতদেহটা লুকোতে হবে।

–পারব না।

 সুশান পঁচিশ পাউন্ড বার করে ফ্রেসবীকে বলল, বিনিময়ে এটা রাখ।

–ওতে হবে না কাজ।

ওতে যখন হবে না তখন হয় তোমায় বিনাপয়সায় কাজটা করতে হবে নয়তো পুলিসকে আমায় সব কথা জানাতে হবে।

সুশান ভাবতে লাগল, ফ্রেসবী কি তাকে সাহায্য করবে?

ফ্রেসবী ভাবল, মেয়েটা যদি এই ধরনের ব্যবহার করতে থাকে তবে ওকে খুন করতেই হবে।

 হঠাৎ ফ্রেসবী ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল-দাও টাকাটা দাও।

-কোথায় লুকোবে?

–বিয়ারিং ক্রসে।

-না ওটা গন্ধ ছড়াচ্ছে। সুশান বাইরে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখল কালো জামা পরা লোকটা আসছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে সে ফ্রেসবীর কাছে লুকোবার জন্য সাহায্য চাইতে ফ্রেসবী গোঁয়ারের মতো বসে রইল, তখন সুশান আলমারীর ভিতর গিয়ে লুকোলো।

আর তখনই বুচ ঘরে ঢুকে ফ্রেসবীকে নরম গলায় প্রশ্ন করল, সুশান হেডার কে?

 ফ্রেসবী বুচের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে চিন্তা করে নিল সাবধানে কথা বলতে হবে।

–কে, সুশান? সুশান কি?

ভাওতা দিও না চাঁদু, তুমি জান আমি কার কথা জিজ্ঞেস করছি।

ফ্রেসবী মাথা ঝাঁকাল, আমার মনে পড়ছে না কোন্ হেডার?

আমাদের সঙ্গে দুশমনী নিশ্চয়ই করতে চাও না! তাহলে চটপট বলে ফেলো, যাকে তুমি গিল্ডেড ক্লাবে পাঠিয়েছিলে।

–ও! তার নাম তো সুশান হেডার নয়। বেটি, তার নাম বেটি ফ্রিম্যান। ফ্রেসবী বুঝল বুচ ধাপ্পাটা বোঝেনি।

নাম যাই হোক! মেয়েটার সম্বন্ধে বলল।

 কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফ্রেসবী বলল-আরে মেয়েরা আমার কাছে কাজের ধান্দায় আসে।বায়না দেয়। তাদের নাড়ীনক্ষত্র জানার আমার কি দরকার?

মার্শ বলেছে তুমি মেয়েটার চাকরীর জন্যে খুব চাপ দিয়েছিলে।

ফ্রেসবী বুঝল বুচ অবিশ্বাস করছেনা। দৃঢ়তার সঙ্গে বলল-কড়কড়ে পঁচিশ পাউন্ডের লোভ সামলানো যায়?

দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে কি ভাবল।

বুচ বলল-তাহলে সত্যিই তুমি জান না সে কে? কোথায় পাবো তাকে?

–কেন, কেন, কোন গণ্ডগোল?

–তা জানি না তবে রোলো ঐ মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে একশ পাউন্ড খরচ করতে রাজি আছে। আজ রাতের মধ্যে ওটাকে না পাওয়া গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। তুমি খোঁজ দিতে পারলে টাকাটা পাবে।

ফ্রেসবী একবার আলমারীটার দিকে তাকিয়ে ভাবল, না থাক হতচ্ছাড়ীটা ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে চিঠি দিয়ে রেখেছে।

রোলো এত টাকা কেন খরচ করতে চাইছে?

–তোমার অত সতর কি দরকার। এর পর ক্লাবে মেয়ে ঢোকাবার আগে আমায় জানাবে। নইলে তোমার ব্যবস্থা করে ছাড়বো।

ফ্রেসবী ভয়ে ভয়ে বলল–ঠিক আছে মাইক। আমি খোঁজ করব।

 বুচ চলে যেতেও সুশানকে ডাকলো না। গভীর চিন্তায় ডুবে আছে সে। মড়াটাকে নিয়েই এত কাণ্ড। আবার অনেক টাকার মামলা। মড়াটার জন্যেই মেয়েটার খোঁজ।মড়াটা তার হাতের মুঠোয়। চেষ্টা করলে মোটা উপার্জন করা যায়।

সুশান বেরিয়ে এলো বিবর্ণ মুখে।

–সবই শুনেছ নিশ্চয়ই। ঠিক আছে এসো আমরা দুজনে মিলেমিশে কাজ করব। আমার মাথায় একটা চমৎকার বুদ্ধি এসেছে। মড়াটা কোথায় লুকোবে!