তৃতীয় – রাক্ষসমুলুকের শাদা শয়তান
১. সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তর
এ-কদিন যেন একটা ঘোরের মতো কেটেছে। দুঃস্বপ্নের ঘোর।
সে-ই যখন আয়ারটনের খোলশটা খুলে বেরিয়ে এসেছে কুখ্যাত দস্যু বেন জয়েস, যার নামে হুলিয়া বেরিয়েছে, সেই যার সম্বন্ধে এতগুলো কথা ব’লে গেলেন মেজর ম্যাকন্যাব্স, তারপর থেকে মেরি যেন আচ্ছন্নের মতোই হ’য়ে গিয়েছিলো। সেবাশুশ্রূষায় সে সাহায্য করেছে লেডি হেলেনাকে, প্রথমে লর্ড গ্লেনারভনের শুশ্রূষা, আর তারপর ঐ মাল্লাটি যখন ফিরে এলো, প্রায় হতচৈতন্য, ক্ষত থেকে অনর্গল রক্ত বেরুচ্ছে, পিঠে ছুরি-বেঁধা, তখন তাকেও শুশ্রূষা করেছে মেরি, লোকটা মনে হচ্ছে এ-যাত্রায় যেন বেঁচেই গেলো, এমনই তার কচ্ছপের প্রাণ, কিন্তু সারাক্ষণ মেরির মনে হচ্ছিলো সে যেন একটা কলের পুতুল। চারপাশে কোথায় কী হচ্ছে, সে যেন সব চোখে দেখে যাচ্ছে, অথচ কিছুই খেয়াল করছে না, কিছুই যেন তার আচ্ছন্ন মনটায়, কোনো দাগ কেটে যেতে পারছে না। কেউ যদি তাকে জিগেস করে, এর পর কী-কী ঘটেছে, কোথায়-কোথায় গেছেন অভিযাত্রীদল, কী-কী করেছেন, তবে সে সম্ভবত কিছুই তার গুছিয়ে বলতে পারবে না, অথচ সে সবসময়েই দলের সঙ্গে ছিলো, সবাই যা-যা করেছে সেও সে-সমস্তই করেছে, কিন্তু স্বপ্নে যেমন হড়বড় ক’রে কত-কী ঘ’টে যায় অথচ তারপর তার ঝাপসা স্মৃতি ছাড়া আর-কিছুই থাকে না, ঠিক তেমনি হয়েছে তার—সবসময়েই মনে হয়েছে অ্যাদ্দিন তারা কোন বুনোহাঁসের পেছনে ছুটছিলো, কিন্তু এখন সেই বুনোহাঁস আর কোথাও নেই—সেও কোন্ দূরে দিগন্তের পরপারে মিলিয়ে গেছে।
আর তারপর—এখন—এখন এই কাণ্ড। ডানকান জাহাজ গিয়ে পড়েছে বেন জয়েসের হাতে, লর্ড গ্লেনারভনের এত সাধের ডানকান; আর তাঁরা যে সেই ডানকান নিয়ে সাতসমুদ্রতেরোনদী পেরিয়ে দু-দুটো মহাদেশ পেরিয়ে, এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধে এসে পড়েছে, সে তো তারই জন্যে, না, শুধু তার নয়, রবার্টও আছে, আর আছে সেই-ক’বে শেষ-যাঁকে দেখেছিলো সেই বাবার স্মৃতি, কাপ্তেন গ্রান্টের স্মৃতি।
আর কী হবে এখন মিথেমিথ্যি এই দুরাশার পেছনে ছুটে? মেরিকে যেন একটা হালডাঙা ভেলার মতো দেখাচ্ছিলো, সেই-যে ভেলাটায় করে তারা পাড়ি জমিয়েছিলো ক-দিন আগেই ঐ বানভাসি নদীতে, আর জলের তোড়ে যে-ভেলা ভেঙে গিয়েছিলো, সে যেন এখন সেইরকমই এক ভেঙে-পড়া ভেলা। কেউ যদি তাকে জিগেস করে তার মনের অনুভূতিগুলোকে পর-পর সাজিয়ে বলতে, তবে তাও সে পারবে না, শুধু-একটা হালছাড়া হতাশ আচ্ছন্নভাব, তা ছাড়া আর-কিছুই না।
আর নিশ্চয়ই সেইজন্যেই প্রস্তাবটা প্রথমে এলো মেরির কাছ থেকেই। ধরাগলায় থেমে-থেমে সে যা বললে, তার সারমর্ম হ’লো : আর কেন, ঢের তো হ’লো, এবার বরং ফিরেই যাওয়া যাক ইওরোপে। আয়ারটনের সঙ্গে আচমকা ঐ খামারে দেখা হবার পর দপ ক’রে নতুন-একটা আশা জ্বলে উঠেছিলো মনে, আর এ-যেন ঠিক দীপ নেভবার আগে শিখা যেমন দপদপ ক’রে, অনেকটা সেইরকম। এখন তো বোঝাই যাচ্ছে আয়ারটন তাদের ধাপ্পা দিয়েছিলো, হতভাগা ফেরেব্বাজ, সে সম্ভবত কোনোদিনই চিনতো না কাপ্তেন গ্রান্টকে। শুধু কতকগুলো জনরব শুনেছে ব্রিটানিয়া সম্বন্ধে আর নয়তো হয়তো সত্যিকার-আয়ারটন, এই বেন জয়েস-আয়ারটননয়, তার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো কোথাও এই জঙ্গলে সবই সম্ভব, তারপর তার কাগজপত্তর হাতিয়ে নিয়ে এসেই শেষে তা তাদের দেখিয়েছে তাদের প্রতারিত করবার জন্যেই। কিন্তু এখন আর খামকা দুরাশার পেছনে ছুটে লাভ কী? বরং এবার সবাই মিলে ফিরেই যাওয়া যাক ইওরোপে, সত্যি-তো, লর্ড গ্লেনারভন তাদের জন্যে অনেক করেছেন, অনেক লোকসান হয়েছে তাঁর, এমনকী প্রাণহানিও হয়েছে এই অভিযানে বেরিয়ে, আর কেন, বাবাকে তো আর পাওয়াই যাবে না, এবার বরং-
এমনি-সব কথা, ভেঙে-ভেঙে, থেমে-থেমে, ছেঁড়া-ছেঁড়া কতগুলো শব্দ দিয়ে সাজানো। হাজার সান্ত্বনা, হাজার প্রবোধ, হাজার সহানুভূতিও এখন বোধহয় তাকে আর ঐ দুঃসহ হতাশা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
কিন্তু কাপ্তেন জন ম্যাঙ্গল্সও দমবার পাত্র নন। কাপ্তেন গ্রান্টের মতো তিনিও ডাঙার নন, জলেরই মানুষ যেন। তিনিও নাছোড় ব’লে গেলেন কেমন ক’রে তিনি খুঁজে বার করবেন কাপ্তেন গ্রান্টকে, বার করবেনই, দমবার পাত্র নন তিনি, হল ছেড়ে দেয়া তাঁর ধাতেই নেই মোটেই, একদিন-না-একদিন ঠিক তিনি মেরিকে মুখোমুখি দেখা করিয়ে দেবেন তার বাবার সঙ্গে, আর তাতেই প্রমাণ হয়ে যাবে তিনি, জন ম্যাঙ্গল্স, তিনি কাপ্তেন, জাহাজি, কাপ্তেন কথাটা তাঁর পোশাকি বাহারে অভিধা নয়—সেটা তাঁর নামেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সেদিনটা তারপর এমনি-সব কথার পিঠে কথায় কেটে গেলো, ক্লান্তিটা কেউ যেন গায়েই মাখছিলেন না,–মেরির দিকে তাকানো যাচ্ছে না, তাকে অন্তত ঐ সর্বনেশে হতাশা থেকে বার ক’রে আনতেই হবে।
পরের দিন ভোরবেলাতেই জন ম্যাঙ্গল্স বেরিয়ে গেলেন জাহাজঘাটায়, মেরিকে তিনি কথা দিয়েছেন—-অভিযান চলবে, সন্ধান চলবে, তাই গোড়াতেই দরকার একটা জাহাজ-যদি মেলবোর্নে যাবার কোনো জাহাজ জোটে। কিন্তু ইডেন ছোট্ট জায়গা, টুফোল্ড উপসাগরের মুখে জাহাজ খুব-একটা আসে না, সমুদ্র এখানে উত্তাল, ক্ষিপ্ত, বন্য— তাছাড়া ঠিক- এদিকটায় লোকালয়ও তেমন গ’ড়ে ওঠেনি। অনেকক্ষণ জাহাজঘাটায় ঘুরেও মেলবোর্নগামী কোনো জাহাজের খোঁজ পাওয়া গেলো না। কী করবেন তাহ’লে এখন?
আর ঠিক সেইসময়েই মঁসিয় পাঞয়ল মুশকিল আসানের ভঙ্গিতে খবরটা দিলেন। মেলবোর্ন যে যেতেই হবে, এমন মাথার দিব্বি কে দিয়েছে? এখন যখন ডানকান আর ওখানে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে নেই তাঁদের অপেক্ষায়, তখন মেলবোর্ন না-গিয়ে অন্য কোথাও গেলে তো হয়। আগের দিনই তো জাহাজঘাটায় গিয়ে দেখে এসেছিলেন নিউ-জিল্যান্ডের অকল্যান্ডে যাবার জন্যে একটা জাহাজ তোড়জোড় করছে। সেটায় ক’রে অকল্যান্ড চ’লে গেলেও তো হয়, সে যখন একটা দেশের রাজধানী, তখন সেখানে ইওরোপে যাবার মতো কোনো-না-কোনো জাহাজ পাওয়া যাবেই। অকল্যান্ড এখান থেকে বেশি-দূরে নয়, তিনি শুনে এসেছেন দিন-দশেকের বেশি লাগবে না এই হাজার মাইল পাড়ি দিতে। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো-একটা কথা খতিয়ে দেখে নেয়া উচিত। অকল্যান্ড পড়েছে সাঁইত্রিশ ডিগ্রি অক্ষরেখায়—প্রথম থেকেই তো, সেই যখন তাঁরা দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন, তাঁরা এই সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তর ধরেই পাড়ি জমিয়েছেন। এই সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তরেই কোথাও নিশ্চয়ই কাপ্তেন গ্রান্টকে পাওয়া যাবে।
শেষচেষ্টার পরেও একটা বিশেষ-শেষ চেষ্টা, যদি সে-রকম কিছু কখনও হয়।
যখন সমস্ত ব্যাপারটাকে নিছক পণ্ডশ্রম ব’লে মনে হচ্ছে, তখন যদি এমনকী একটা উটকো উড়োখবরও এসে পৌঁছোয়, তখন কেমন যেন নতুন করে একটা উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হ’য়ে যায়। সাফল্য সম্বন্ধে কোনো ভরসাই হয়তো নেই, কিন্তু তবু তো…আর এই তবু অব্যয়টা যথার্থই অব্যয়, সেটা আর-কখনও মরে না-সবসময়েই যেন ঝোড়োসমুদ্রে উত্তাল উথালপাথাল ঢেউয়ের মধ্যে দূরের কোনো আলোকস্তম্ভের মতো আলো দেখাতে থাকে। যখন মেলবোর্নে আপাতত যাওয়া হবে না ব’লে সবাই মনখারাপ ক’রে আছে, তখন এই প্রস্তাব—যেটা নিছক একটা বিকল্প ব্যবস্থার চাইতেও বেশি!
আর সেটাকে এক্ষুনি যেন সজোরে আঁকড়ে ধরলেন সবাই। আর একমুহূর্তও সময় নষ্ট না-ক’রে লর্ড গ্লেনারভনকে নিয়ে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স সটান গিয়ে হাজির সেই জাহাজে। জাহাজিদের নিজেদের মধ্যে নিশ্চয়ই আলাদা-একধরনের বনিবনা থাকে, তাছাড়া জাহাজিদের পরিভাষাও তো কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্সের জানা। ফলে জাহাজটা যতই হতচ্ছাড়া মালবওয়া জাহাজ হোক না কেন, জাহাজের কাপ্তেন বিল হালি যতই রুক্ষ, বেপরোয়া, গোঁয়ার গোছের লোক হোক না কেন, না-ই বা সে জানুক ভদ্রতা বা সহবৎ, পাইপ টেনে-টেনে যতই কেন-না ঠোঁট দুটো কালো ক’রে ফেলুক, কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স তাকে কিন্তু একটুক্ষণের মধ্যেই পটিয়ে ফেললেন। হুম, এটা জানবেন মালবওয়া জাহাজ, কোনো প্রমোদতরী নয়, মাল্লাদেরই থাকার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই, তার ওপরে আবার মহিলা, শ্বেতাঙ্গিনী, উঁহু, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা তাঁদেরই করতে হবে, এমনকী খাবারদাবারের ব্যবস্থাও, এখানকার খাবার দাঁতে কাটা যায় না, এমন অখাদ্য, আর-হ্যাঁ, যখন বিপদে পড়েছেন, নিয়ে যেতে পারি, তবে পঞ্চাশ পাউন্ড ভাড়া লাগবে, আর সেটা আগাম, হাতে-হাতে চাই, ফ্যালো কড়ি মাখো তেল, এ-জাহাজে যাত্রীও যা মালের বস্তাও তা-ই—বরং খোল ভর্তি মাল আরো-দামি, সেগুলো সময়মতো অক্ষত পৌঁছে দিতে না-পারলে শেষটায় তাকেই উলটো খেসারৎ দিতে হবে…ইত্যাদি, এবং ইত্যাদি।
কিন্তু তা-ই সই। কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের মাল্লারা নিজেরাই একটু জায়গা ঝাঁট দিয়ে, ধুয়ে-পুঁছে, সাফসুতরো ক’রে নিলে। ব্যাঙ্কে গিয়ে সেদিনই লর্ড গ্লেনারভনের চেক ভাঙিয়ে নগদ টাকা তুলে এনেছেন মেজর ম্যাকন্যাব্স। তা থেকে আগাম পঞ্চাশ পাউন্ড চুকিয়ে দেয়া হয়েছে বিল হ্যালিকে। মঁসিয় পাঞয়লকে কিনে দেয়া হয়েছে নিউজিল্যান্ডের একটা ম্যাপ। অস্ত্রশস্ত্র সব তো গেছে ভেলাটার সঙ্গে, শুধু তাঁর নিজের রাইফেলটাই বেঁচে ছিলো, এবার সবার জন্যেই নতুন ক’রে অস্ত্রশস্ত্র কেনা হ’লো। আবার একটা নতুন দেশে চলেছেন সবাই—কোথায় কোন্ আপদ তাঁদের জন্যে ওৎ পেতে আছে, সেজন্যে সাবধান থাকাই ভালো। যাত্রীদের নিয়ে বিল হ্যালির কোনো মাথাব্যথা নেই, ছপ্পড় ফুঁড়ে এই অপ্রত্যাশিত কড়কড়ে পাউন্ড পেয়েই সে খুশি, তাঁদের কার কী নাম, কার কী ধাম—সে-সম্বন্ধে তার কোনো উটকো কৌতূহল নেই—’জাহাজ ছাড়বো কাল ঠিক দুপুরবেলায়, কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক সময়ে জাহাজে না-এলে আমি কিন্তু ফালতু সবুর করবো না। আপনাদের না-নিয়েই আমায় জাহাজ ছেড়ে দিতে হবে—আমার বাপু সাফ কথা।’
জাহাজে ওঠবার আগে, শেষবার, এখানেই সাঁইত্রিশ ডিগ্রি অক্ষরেখার কাছে সমুদ্রতীর দেখে এসেছেন লর্ড গ্লেনারভন, বেন জয়েস ডানকান দখল ক’রে নেবার পর টম অস্টিন আর অন্য মাল্লাদের কী হাল করে কে জানে। যদি ধ’রে-ধীরে একেকটা ক’রে মৃতদেহ ভাসিয়ে দিয়ে থাকে জলে, আর সেগুলো যদি ভেসে এসে ডাঙায় ঠেকেও থাকে!
লর্ড গ্লেনারভনের সঙ্গে ছিলেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স। না, তীরে কারু মৃতদেহ প’ড়ে নেই। তবে ডানকান যে এখানে এসেছিলো, তারই চিহ্ন তীরের কাছে ঐ তাঁবু খাটাবার দাগ, আর নিভে-যাওয়া আগুনের কুণ্ড, কয়েদিদের একটা উর্দিও পাওয়া গেছে তার পাশে, আয়ারটন (না কি বেন জয়েস) তো বলেছিলো এখানে ডানকানকে নিয়ে এসে তার সাঙাৎদের জাহাজে তুলে নেবে। এসেছিলো নাকি তাহলে? এ-সব কি তারই চিহ্ন?
ইডেনের শাসনকর্তার সঙ্গে একটা মোলাকাৎ অবশ্য হয়েছিলো। এখানপার ম্যাজিস্ট্রেটকে লর্ড গ্লেনারভন জানাতে গিয়েছিলেন যে তাঁর জাহাজ দখল ক’রে জেলপালানো কয়েদিরা বারদরিয়ায় পাড়ি জামিয়েছে। যদি ভেবে থাকেন যে ম্যাজিস্ট্রেট তাই শুনে বিষম উত্তেজিত হ’য়ে উঠে ডানকান জাহাজের উদ্ধারের জন্যে তোড়জোড় শুরু করে দেবেন, তবে ভুল ভেবেছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট উত্তেজিত হয়েছিলেন বটে, তবে উল্লাসে, আনন্দে প্রায় আত্মহারাই যেন, জেলপালানো দুর্ধর্ষ খুনে-ডাকাতগুলো আর অস্ট্রেলিয়ায় নেই—জাহাজে ক’রে জলে ভেসেছে—এতে অন্তত রাতের ঘুমটা এখন থেকে নির্বিঘ্নে হবে—তাদের ভয়ে আর সারাক্ষণ আধমরা হ’য়ে থাকতে হবে না—সারাক্ষণই তো শঙ্কা ছিলো কোথায় কোন আতঙ্ক লেলিয়ে দেয় বদমায়েশগুলো—এখন বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেলো। খুশি হ’য়ে তিনি চারপাশে তারবার্তা পাঠিয়ে দিলেন—’জোর খবর! খুশির খবর! কয়েদিগুলো অস্ট্রেলিয়ার ডাঙায় আর নেই—জাহাজে করে জলে ভেসেছে!’
সত্যি, এই ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কাপ্তেন বিল হ্যালির যে কী তফাৎ, সেটাই বোঝা দায়। সবাই আছে যে যার তালে। অন্য মানুষদের বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের শান্তি নষ্ট করে কোন্-সে গাড়ল।
এত-সব জায়গা থেকে বিভিন্ন টুকিটাকি সেরে এসে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স দ্যাখেন মঁসিয় পাঞয়ল কি-রকম ছটফট করছেন সারাক্ষণ, একটা খাঁচায় পোরা বাঘের মতো তাঁর দশা।
‘কী ব্যাপার, মঁসিয় পাঞয়ল? আপনাকে যে খুব অস্থির দেখাচ্ছে–আবার-কিছু নতুন উৎপাত জুটেছে নাকি।’
‘উৎপাত নয়!’মঁসিয় পাঞয়ল যেন ফেটেই পড়েছেন। ‘আমরা যে নিউ-জিল্যান্ড যাচ্ছি হুট ক’রে!!
‘কেন? নিউ-জিল্যান্ড যাবার প্রস্তাবটা তো আপনার কাছ থেকেই এসেছিলো।’
‘তা বটে। তবে কি জানেন তখন নতুন দেশে যাবার উত্তেজনার চোটে ভুলেই গিয়েছিলুম যে নিউ-জিল্যান্ডে গেলে কেউ নাকি আর কখনও ফেরে না! এখন ভাবছি কোন কুক্ষণেই যে বাড়ির পড়ার ঘরটা থেকে পা বাড়িয়েছিলুম। কপালে এখন আরো-কত দুর্ভোগ আছে, দেখবেন। আমার ধারণা, এ-যাত্রাতেও আমরা নির্বিঘ্নে দিন কাটাবার বরাৎ ক’রে আসিনি।
অমন ক’রে ভাগ্যকে উসকে না-দিলেই পারতেন বোধহয় মঁসিয় পাঞয়ল। কোন সূক্ষ্ম লুতাতন্তুর জালে যে মানুষের ভাগ্য ঝোলে আর কোন খেয়ালে আপন মনেই যে সে দোল খায় পেণ্ডুলামের মতো, এদিক থেকে ওদিক, তা-ই বা কে জানে। তবে গতিক যে খুব সুবিধের ঠেকছে না তা পরদিন জাহাজে ওঠবামাত্রই টের পাওয়া গিয়েছিলো। বিল হ্যালির কাছ থেকে কেউই খুব বিনীত ভদ্র সুবোধ ব্যবহার আশা করেনি, সে-যে জাহাজে মহিলাদের দেখে বিগলিত হ’য়ে গিয়ে নিজের ক্যাবিনটা তাদের ছেড়ে দেবে না—এটা তো জানা কথাই। কিন্তু পাইপমুখে এই হট্টাকাট্টা ইয়াজোয়ানের কাছে প্রত্যাশা করা গিয়েছিলো যে সে আর কিছু না-হোক, অন্তত নৌচালনবিদ্যেটা ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছে—না-হ’লে একটা আস্ত সচল জাহাজের কাপ্তেন হ’লো কী ক’রে। পরে অবশ্য দেখা গেলো এ-ব্যাপারটা যদি তার জানা থেকেও থাকে, জাহাজ ছাড়বার পর নিখুঁতমসৃণ, ভাবে সেটাকে চালাবার কোনো মাথাব্যথাই নেই তার। নিজে গিয়ে মাল টেনে প’ড়ে থেকেছে নিজের ক্যাবিনে, জাহাজ কোথায় কোন চোরাগোপ্তা ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা খেলো কি খেলো না—তাতে হয়তো তার থোড়াই আসে যায়। আর যেমন কাপ্তেন, তেমনি তার মাল্লারা। তারাও কাপ্তেনের পন্থা অনুসরণ ক’রে অল্পক্ষণবাদেই মদের ঘোরে বেহুঁশ হ’য়ে পড়লো। ‘এ-কী আপদ রে, বাবা! এ-কোন কাপ্তেনের পাল্লায় এসে পড়লুম?’ এ-কথা ভেবে, নিজে থেকে যেচে, আগবাড়িয়ে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স একবার তাকে জাহাজ বিষয়ে পরামর্শ দিতে গিয়েছিলেন, অমনি সে তাঁকে হুংকার দিয়ে নিজের ক্যাবিন থেকে বার ক’রে দিয়েছে : ‘বলি, এ-জাহাজের কাপ্তেন কে? আপনি, না আমি? আমি আমার যেমন-খুশি তেমনিভাবে আমার জাহাজ চালাবো, তাতে আপনি ফোঁপর দালালি ক’রে নাকগলাতে এসেছেন কেন?’
গতিক দেখে ফের মাথায় হাত লর্ড গ্লেনারভনের। জলপথের কোনো-একটা চলনসই চার্ট পর্যন্ত ঝুলছে না সারেঙের ঘরে, যে, সেটা দেখে কোনো অনুমতি বিনাই কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স জাহাজের হাল ধরবেন—আক্ষরিক অর্থেই ধরবেন। ইডেন থেকে অকল্যান্ড যায় এ-জাহাজ, আবার সেখান থেকে ফেরে—ফলে পথটা বিল হ্যালির চেনা। কিন্তু সে তো এখন বেহুঁশ প’ড়ে নাক ডাকাচ্ছে।
‘আগেই বলেছি কোন কুক্ষণেই যে বাড়ি থেকে পা বাড়িয়েছিলুম, ‘মসিয় পাঞয়ল ফের তাঁর কপাল চাপড়াতে লেগে গেছেন, ‘এ-যে দেখছি রাক্ষসমুলুকে পা দেবার আগে থেকে অবস্থা সঙিন হ’য়ে উঠলো!
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স জিগেস করলেন : ‘রাক্ষসমুলুক? সে আবার কী? আমরা তো যাচ্ছি অকল্যান্ডে—নিউ-জিল্যান্ডে!’
‘আরে-হ্যাঁ-তার কথাই তো বলছি। এই মাওরিদের দেশটা যে রাক্ষসদের দেশ—সে সব্বাই জানে।’ মঁসিয় পাঞয়ল একটু তেতে উঠেই বললেন।
‘রাক্ষসদের দেশ মানে?’
‘মানে ক্যানিবালদের রাজত্বি–পড়েননি মঁতেইন—কী-সব লিখে গেছেন এই ক্যানিবালদের বিষয়ে? নরখাদক একেকটা–মানুষখেকো!’
কথোপকথনের ধরনটা দেখে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স-এর ধারণা হ’লো ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হ’য়ে যাচ্ছে। তা আপনার মতেইন এই মাওরিদের দেশে এসেছিলেন বুঝি? প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন? একেবারে রাক্ষসদের পেটের ভেতর থেকে তাঁর বাণী বিতরণ করছেন? না-না, মঁসিয় পাঞয়ল, মঁতেইন কোথায় কোন্ দেশ সম্বন্ধে কী বলেছেন আমি জানি না। জানবার ইচ্ছেও নেই। শুনেছি, মহাকবি শেক্সপীয়ার নাকি এই ক্যানিবাল কথাটা ওলোটপালোট ক’রে দিয়েই ক্যালিবানকে পেয়েছিলেন। কিন্তু সেও— যদ্দূর জানি—আর যা-ই হোক, মানুষখেকো নয়। তা আপনি কি নিউজিল্যান্ডে যেতে চান না নাকি? সত্যিকার মানুষখেকো তো বাঘসিংহ—তা তাই বলে কেউ কি বাঘসিংহের দেশে যায় না?’
এ-কথায় হয়তো যৎকিঞ্চিৎ চৈতন্যোদয় হ’লো মঁসিয় পাঞয়লের। তিনি একটু আপোষ করার ভঙ্গিতে বললেন, ‘না-না, আমি নিউ-জিল্যান্ডে যদি-বা যাইও—উপকূল ছেড়ে ভেতরে যাচ্ছি না। কে জানে, বাপু, কোথায় কোন্ বিপদ উৎকট একটা লাফ দেবে ব’লে উদ্যত হ’য়ে আছে!’
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স নিজের ঘাড়ে হাত বুলোতে-বুলোতে বললেন, ‘কী জানেন, মঁসিয় পাঞয়ল? আমি তো সাগরজলের মানুষ! ঘাড়েগর্দানে নোনা ধ’রে গেছে। আপনার ঐ রাক্ষসরা হয়তো আমার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে থুঃ-থুঃ ক’রেই উগরে ফেলে দেবে। আর, তাছাড়া, মাওরিরা কেমন লোক, সেটা আপনার ঐ প্রাচীন পণ্ডিতদের মতো আমিও জানি না। তবে শাদা শয়তান আমি কয়েকটা দেখেছি—এই আপনার বেন জয়েসের কথাই ধরুন না কেন—পৃথিবীর কোন ক্যানিবালই বা তার চেয়ে অধম হবে, বলুন?’
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স মঁসিয় পাঞয়লের এই জুজুর ভয় দেখে ততটা ভড়কে যাননি। তাঁর বরং ভয়ই হচ্ছিলো, এই ফরাশি পণ্ডিত এমনিতেই একটু ছিটগ্রস্ত আধাপাগলা লোক ছিলেন। এখন এইসব বিদঘুটে উদ্ভট আজগুবি কথাবার্তা যে বলছেন সে কি তার মাথাটা পুরোপুরি বিগড়ে গেছে ব’লেই? না-হ’লে ইনি কেন অবিশ্রাম কন্টিন – কন্টিন—আল্যাণ্ড—আল্যান্ড ক’রে ব’কে মরছেন। যতই কটিন ব’লে বিড়বিড় করুন না কেন, এটা তো সব্বাই জানে যে নিউ-জিল্যান্ড মোটেই কোনো কনটিনেন্ট নয়—সেটা বরং দুটো দ্বীপ মিলিয়ে তৈরি—নর্থ আইল্যান্ড আর সাউথ আইল্যান্ড। তবে কি ফের আরেকবার তিনি চিরকুটগুলো নতুন অর্থ বার করবার জন্যে খেপে উঠেছেন? তিনি কি ভাবতে শুরু ক’রে দিয়েছেন যে কাপ্তেন গ্রান্টের ব্রিটানিয়া শেষটায় ভেঙে পড়েছিলো নিউ-জিল্যান্ডেরই কোনো উপকূলে? তাহলে তো সাড়ে-সর্বনাশ! তিনি একবার ক’রে চিরকুটগুলোর একটা নতুন অর্থ বার করেন, আর তাঁদের ছুটে মরতে হয় এই মুলুক থেকে সেই মুলুকে! শেষটায় কি কিউয়ি পাখির এই দেশটাতে তাঁদের একবার এ-দ্বীপ একবার ও-দ্বীপ ক’রে চর্কি ঘুরতে হবে? তা যদি হয় তাহ’লেই ভাবনার কথা। কোনো-একটা সম্ভাবনা ঘুণাক্ষরে যদি দেখা যায় তাহ’লে কি আর লর্ড গ্লেনারভন সেটার শেষ না-দেখে ছাড়বেন?
ছ-দিন হ’লো পাঞয়ল কেবল কনটিন – কনটিন করেছেন, আর ছ-দিন হ’লো জাহাজ দিব্বি পাল খাটিয়ে জোরালো হাওয়ায় তরতর ক’রে ভেসে চলেছে, তবে সমুদ্রে জাহাজ চালানোর সময় এমনিতেই সবসময়ে খেয়াল রাখতে হয় খুব যেন দোল না—খায় অথবা ঝাঁকুনি লাগে। হ্যালির জাহাজ যেন ছুটে চলেছে নিজের খেয়ালখুশি মাফিকই, জাহাজের গতি মসৃণ না ঝাঁকি-খেতে-খেতে-চলা, সে-বিষয়ে নজর রাখার জন্যে আর যে-ই থাকুক, অন্তত বিল হ্যালি যে নেই, সেটা হয়তো না-বললেও চলে। অতএব ঝাঁকুনির চোটে যদি সকলেরই মনে হয় সিন্ধুপীড়ার দাপটে পেটের নাড়িভুঁড়ি শুধুই উলটে আসতে চাচ্ছে, তবে বলতেই হয় যে সেটা এ-কদিনে কারুই আর তেমন অপ্রত্যাশিত ব’লে মনে হয়নি।
তার ওপর ফের শুরু হয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধের গ্রীষ্মকালের সেই সুবিখ্যাত বর্ষা। বৃষ্টির ঝাপট দাপট এমনই প্রচণ্ড যে খোলের ভেতরে সেঁধিয়েও যেন তার হাত থেকে নিস্তার নেই। শেষটায় মেরিকে নিয়ে লেডি হেলেনাকে বেরিয়ে আসতে হ’লো খোল ছেড়ে বাইরে। একে তো মালপত্রের জন্যে একফোঁটাও জায়গা নেই, তার ওপর এই বিষম খেলা চলেছে সমুদ্রের, এই সাগরদোলা নাগরদোলার দাপট এমনই যে শেষটায় বাধ্য হ’য়েই মেরিকে নিয়ে খোল থেকে বেরিয়ে আসতে হ’লো। এমন তুলকালাম ঝাঁকুনির মধ্যে মালপত্রের গায়ে বেমক্কা ধাক্কা খাওয়ার চাইতে ডেকে গিয়ে সকলের সঙ্গে সমানভাবে জাহাজের দুলুনিটা ভাগ ক’রে নেয়াও ভালো। মঁসিয় পাঞয়ল অবশ্য ফরাশিদের স্বভাবসুলভ শিভালরিবশত মহিলাদের মনস্তুষ্টির জন্যে বিস্তর প্রমোদ জোগাবার চেষ্টা করলেন, তবু সর্বদিক বিবেচনা ক’রে বলতেই হয় এমন অবস্থায় কি কারু মুখেই হাসি ফুটতে পারতো?
কিন্তু মেরি বা লেডি হেলেনার চাইতেও অনেক বেশি কাহিল দশা খোদ লর্ড গ্লেনারভনের। তাঁর বেজায় মনখারাপ। বার-বার ডেকে এসে পায়চারি করেন, তাকিয়ে থাকেন বৃষ্টিতে-ঝাপসা দিগন্তের দিকে, আর ভিজে নেয়ে একশা হ’য়ে যান। শেষটায় আর থাকতে না-পেরে, লর্ড গ্লেনারভনকে চোখে দুরবিন সেঁটে দিগন্ত হাড়াতে দেখে, কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স সারাসরি জিগেসই ক’রে বসলেন : ‘কী খুঁজছেন, বলুন তো?’
‘ডানকানকে।’
‘ঈশ্বর করুন আমরা যেন ডানকানকে আর না-দেখি।’
‘এ-কী কথা, জন? কী বলতে চাচ্ছো তুমি?‘
‘ঠিক কথাই বলছি। ডানকান এখন জলদস্যুদের জাহাজ। আমাদের দেখতে পেলে বে-হাল করে ছাড়বে। এটা কি খেয়াল আছে যে আমাদের সঙ্গে মহিলারা আছেন?’
কী-রকম মিইয়ে গিয়ে লর্ড গ্লেনারভন বললেন : ‘এদিকে তো ডাঙার চিহ্নমাত্র দেখছি না। ছত্রিশ ঘণ্টা আগেই তো আমাদের ডাঙা দেখতে পাবার কথা।’
ঝড়ের তোড় ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বেলা শেষ হ’য়ে রাত যখন নামলো, হাওয়ার গর্জানি তখনও একফোঁটাও কমেনি। বিল হ্যালির শরীরে বোধহয় রক্তের বদলে আছে কোহল আর সমুদ্রের নোনাজল। এটা জানতে তার ঠিকে ভুল হয়নি যে গতিক খুব একটা সুবিধের না। মত্ত অবস্থাতেই টলতে-টলতে সে চলে এলো ডেকে, রক্তরাঙা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো দুর্যোগকে, তারপর পাল ঠিক ক’রে দিলে।
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখলেন তার পাকাহাতের কাজ, কিন্তু কোনো কথা বললেন না। একবার যখন সাহায্য করার প্রস্তাব নিজে থেকেই উপযাচক হ’য়ে গিয়েছিলেন, তখন বিল হ্যালি তাঁকে যেভাবে তাঁর অধিকারের মাত্রা সম্বন্ধে সচেতন ক’রে দিয়েছিলো, সেই অপমানের কথা তিনি এখনও ভুলে যাননি।
সমুদ্র যেন খেপে উঠেছে। বড়ো-বড়ো উথালপাথাল ঢেউ। জাহাজ একবার ঢেউয়ের ওপর উঠছে, পরক্ষণেই কাৎ হ’য়ে নেমে আসছে। ডেকের ওপর দিয়ে কবার বড়ো-বড়ো ঢেউ গড়িয়ে গেলো। ঢেউয়ের জল প্রবলবেগে বেরিয়ে যাবার সময় একবার লম্বা ছিপটাকেও নিয়ে গেলো সঙ্গে—ভাসিয়ে নিয়ে গেলো দূরে—বাঁধন ছিঁড়ে গেছে তার।
ঝড়ের মধ্যেই ডেকে দাঁড়িয়ে রইলেন গ্লেনারভন আর ম্যাঙ্গল্স। দুশ্চিন্তায় দুজনেরই চোখ কপালে উঠেছে। এই অচেনা সাগরে শেষটায় এই জাহাজ ডুবে যাবে না তো?
রাত যখন সাড়ে-এগারোটা, তখন মিশকালো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ভেসে এলো অন্যরকম একটা শব্দ—এবার যেন ঢেউ গিয়ে কোনো বালিয়াড়ির গায়ে ভেঙে পড়ছে।
‘ডাঙা!’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স বলে উঠলেন, ‘ডাঙা।’
শিশের ওজন বাঁধা দড়ি জলে ফেলে দিয়ে জলের গভীরতা মাপলে একজন মাল্লা। হিশেব ক’রে বললে, ‘তিন ফ্যাদম!’
শোনবামাত্র কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। বিল হ্যালিকে গিয়ে বললেন : ‘সর্বনাশ হ’তে চলেছে যে! জাহাজ যে এখন ডুবোপাহাড়ের ওপর দিয়ে চলেছে!’
বিল হ্যালির হিশেবে একটা মস্ত ভুল হয়েছিলো। সে ভেবেছিলো, ডাঙা বুঝি এখনও ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে আছে। ঝড়ের মধ্যে মদের ঘোরে সে দূরত্বটা ঠাহর করতে পারেনি। এখন মাত্র মাইল-আষ্টেক দূরে ডাঙা চলে এসেছে দেখে সে কী-রকম যেন ঘাবড়ে গেলো। আর তার ঐ বেকুব রাঙা দৃষ্টির ফ্যালফ্যাল ভাবটা দেখে এবার খোদ ম্যাঙ্গল্স গিয়েই হাল ধরলেন!
মুশকিলটা কম ছিলো না। এখানকার সমুদ্রে চার্ট কখনও দ্যাখেনি ম্যাঙ্গল্স, এখানে নৌচালনার অভিজ্ঞতাও নেই। এটুকু শুধু আন্দাজ করা যাচ্ছে, এখানকার জলে চারদিকেই ডুবোপাহাড় গিশগিশ করছে। একে ঘুটঘুটে অন্ধকার, হাওয়ার অবিশ্রাম শোঁ-শোঁ, ঢেউয়ের উত্তাল কলরোল—শুধু অনুমানে ভর দিয়েই জাহাজ চালাতে হবে, একটু এদিক-ওদিক হ’নেই ডুবোপাহাড়ের গায়ে আছড়ে প’ড়ে জাহাজের তলি ফেঁসে যেতে পারে। আর, বুঝি-ই হ’তে চলেছে। আচমকা কীসের সঙ্গে একটা প্রচণ্ড ঘা লেগে থরথর করে কেঁ ে উঠেই দাঁড়িয়ে গেলো জাহাজ। তলিটা তাহ’লে কোনো চড়ায় গিয়ে লেগেছে! পরক্ষণেই বিশাল এক ঢেউ এসে লাফিয়ে পড়লো জাহাজে, একধাক্কায় তাকে আরো ভালো ক’রে নিয়ে গেলো চড়ার ওপর। ফোরকাস্ল ভেঙে পড়লো, বিষম একটা আর্তনাদ ক’রে যেন মাস্তুল ভেঙে পড়লো। ক্যাবিনগুলোর কাচের শার্শি ঝনঝন ক’রে উঠলো, ভাঙলোও বোধহয়। ম্যাঙ্গল্স-এর বুঝতে অসুবিধে হ’লো না জাহাজ ডাঙায় উঠে পড়েছে। কিন্তু এ-কোন ভাঙা —?
এই হুলুস্থুল সংঘর্ষ ও ঝাঁকুনির পর সকলেই বেরিয়ে এসেছিলেন ডেকে। উৎকণ্ঠিত সুরে গ্লেনারভন জিগেস করলেন : ‘ভেঙে গেছে নাকি জাহাজ? ডুবছে?’
‘না। তবে এখন এই অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। সকাল না-হ’লে বোঝা যাবে না কোথায় এসে পৌঁছেছি। সকাল হ’লে নৌকো নামানো যাবে।’
বিল হ্যালি আর তার মাল্লারা ঠিক বুঝতে পারছে না কী করবে। তারা অস্থির হ’য়ে ছুটোছুটি করছে।
গ্লেনারভন যাত্রীদের নিয়ে খোলে নেমে পড়লেন। ওপরে ডেকে অনেকক্ষণ ধরে বিল হ্যালির সাগরেদদের চীৎকার চ্যাঁচামেচি ছুটোছুটি চললো। তারপর একসময়ে সমুদ্র শান্ত হ’য়ে এলো, ঝড় থেমেছে, অন্তত ঐ প্রচণ্ড তুফানটা আর নেই, আর তার সঙ্গে তাল রেখে বোধহয় বিল হ্যালি আর তার অনুচরদের দাপাদাপিও অনেকটা ক’মে এসেছে।
সকালবেলায় আলো ফুটতেই ম্যাঙ্গল্স ছুটে চ’লে এলেন ডেকে।
দূরে ডাঙা দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু জাহাজে বিল হ্যালি বা তার মাল্লারা কেউ নেই। একমাত্র যে-নৌকোটা অক্ষত ছিলো সেটা নিয়েই ঝড় থামতেই তারা কেটে পড়েছে।
তাহ’লে এঁরা এখন ডাঙায় যাবেন কী ক’রে? তীর দেখা যাচ্ছে, অথচ সেখানে যাবার উপায় নেই।
‘উপায় যদি থাকতো,’ এরই মধ্যে মঁসিয় পাঞয়ল আবার গোঁ ধরেছেন, ‘তাহ’লেও আমি নামতুম না। ক্যানিবালদের পাল্লায় পড়তে চাই না—শুনেছি এখানকার আদিবাসীরা সবাই মানুষখেকো। এ একটা রাক্ষসের দেশ।’
‘তা যদি হয়, তবে জাহাজকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া দরকার।’ কাঁটা-কম্পাস, সেক্সটান্ট দিয়ে হিশেব করতে-করতে বললেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স। ‘আমরা অকল্যান্ড থেকে আরো-দক্ষিণে চ’লে এসেছি—৩৮° ডিগ্রি অক্ষরেখায়। আরো অন্তত কুড়ি মাইল গেলেই আমরা নিউ-জিল্যান্ডের রাজধানীতে পৌঁছুতে পারবো।’
তারপরেই নিজেদের মাঝিমাল্লা নিয়ে ব্যস্ত হ’য়ে পড়লেন জন ম্যাঙ্গল্স। খোলের মধ্যে প্রায় দুশো টন চামড়া ছিলো—সেটা ফেলে দেয়া হ’লো, আর জাহাজ অমনি ঐ ওজনটা ফেলে দিতেই খাড়া হ’য়ে দাঁড়ালো। চড়ায় ঘা লেগে যে-দিকটা কাৎ হ’য়ে পড়েছিলো, সেদিকটায় একটু ভাঙচুর হয়েছে। দ্রুত হাতে তামার তাপ্পি লাগিয়ে সেদিকটা মেরামত করা হ’লো। জোয়ার এলেই যাতে যাওয়া যায়, সেজন্যেই তৈরি থাকতে হবে।
কিন্তু জোয়ার যখন এলো, জাহাজ দাঁড়িয়ে রইলো যেমনকে তেমন। একটুও নড়লো না। শুধু একদিকে নোঙর ফেলে কোনোরকমে জাহাজটাকে খাড়া করাই গেলো। অর্থাৎ পরের জোয়ারের জন্যে সবুর ক’রে থাকতে হবে।
আর তারই মধ্যে পাঞয়ল বায়না ধরেছেন, তিনি নিউ-জিল্যান্ডের অচেনা মাটিতে পা-ই দেবেন না। অকল্যান্ডের মতো রাজধানী শহর হ’লে না-হয় কথা ছিলো, সেখানে শাদারা বসতি বানিয়েছে, শাসনের একটা ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যে-সব জায়গায় মাওরিদের রাজত্ব এখনও কায়েম হয়ে আছে, সেখানে পদে-পদে বিপদ হ’তে পারে। এই রাক্ষস মুলুকে নামবে কে? জলপথে না-হয় এখান থেকে ভেসে চ’লে যাবারই ব্যবস্থা করতে হবে- সোজা অকল্যান্ড অব্দি।
পরের বার জোয়ার যখন এলো, নিশুত রাতে, জাহাজ একটু দুললো বটে, কিন্তু এমনভাবে চড়ায় আটকে গিয়েছে যে তাকে নড়ানো গেলো না।
‘উঁহু, এভাবে ব’সে থাকলে চলবে না,’ দেখা গেলো কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স-এর এই কথায় লর্ড গ্লেনারভনেরও সায় আছে।’ ঐ ভাঙা মাস্তুল, কাঠের সিন্দুক—এ-সব দিয়েই একটা ভেলা বানিয়ে নিতে হবে আমাদের–হাত-পা গুটিয়ে ব’সে-থাকা মানেই বিপদকে ডেকে নিয়ে আসা। আরেকবার যদি অমন তুলকালাম তুফান ওঠে, তাহ’লে এই নড়বড়ে জাহাজটাকে আর দেখতে হবে না—ভেঙে টুকরো-টুকরো হ’য়ে যাবে।
সঙ্গে-সঙ্গে ব্যস্তসমস্ত হ’য়ে সবাই ভেলা বানানোর কাজে হাত লাগালেন। ভেলাটার ওপর পর-পর কাঠের বাক্স চাপিয়ে, কোনোরকমে একটা পাটাতনমতো তৈরি হলো, যাতে ঢেউ উঠলেও জল এসে পাটাতনে পৌছুতে না-পারে একটা মাস্তুলও বসানো হ’লো, যাতে পাল খাটানো যায়। আর একদিকে রইলো হাল, অন্যদিকে নোঙর।
জাহাজ থেকে ভেলায় নামিয়ে নেয়া হ’লো বিস্কুট আর নোনা মাছ। কিন্তু সর্বাগ্রে ভেলায় তোলা হ’লো অস্ত্রশস্ত্র, এগুলি এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।
এইবারে সত্যি-সত্যি বোঝা যাবে জন ম্যাঙ্গসের কেরামতি। নৌচালনায় তিনি যে কতটা ওস্তাদ, এটা যেন তারই একটা হাতেকলমে পরীক্ষা।
কেমন ক’রে যে তারপর সেই ভেলায় ক’রে পাড়ি দিয়েছেন তাঁরা, সেটা কেউ স্পষ্ট ক’রে জানেনই না যেন। কোনো লগবুক নেই যে নথি রাখবে কেউ। দশ মাইল পথ পেরুতে দু-দিন লাগলো। অবিরাম যুঝতে হ’লো আদিম দেবতাদের সঙ্গে—জল, হাওয়া—আর মাঝে-মাঝেই আকাশের মুখ কালো হ’য়ে যায় ঘন মেঘে। তবে, না, সে-রকম তুফান নয়। শুধু পাগল হাওয়া যখন ভেলাটাকে একঝটকায় একটা চোরা পাথরে এনে আছড়ে ফেললো, তখন কয়েক পা এগুলেই মূল মাটি।
কোনোরকমে সাবধানে, কত জল দেখে নিয়ে, ঐ কয়েক পা পেরিয়ে এলেন সকলে। আর অবশেষে পা দেয়া গেলো ডাঙায়, বিজনবিভুঁয়ে।
লর্ড এডওয়ার্ড বলেছিলেন, এই অচেনা জায়গায় আর সবুর না-ক’রে সরাসরি হাঁটা দেবেন অকল্যান্ডের উদ্দেশে। কিন্তু আকাশ কালো ক’রে যেমন ক’রে মেঘ এলো, তাতে এই ইচ্ছেটা আপাতত স্থগিত রাখতে হ’লো। এক্ষুনি বরং কোনোরকমে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেয়া উচিত। বৃষ্টি নামবার আগেই।
জায়গাটা ফাঁকা, উঁচুনিচু পাথর, পাঞয়ল পাথরের নমুনা দেখে বললেন যে আগুনের পাহাড় ছিলো এখানে—নিয়মিত যে অগ্নুৎপাত হ’তো, তারই প্রমাণ এই ছড়ানো পাথর।
উইলসন যখন একটা গুহা আবিষ্কার করলে, ততক্ষণে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। একমুহূর্তও দেরি না-ক’রে, ভিজতে-ভিজতেই, ছুটে এসে গুহায় ঢুকলেন সকলে। ভেতরটা কিন্তু, আশ্চর্য, দিব্বি শুকনো। বোঝা গেলো, এই গুহায় সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস ঢোকে না। বিস্তর শুকনো ঘাসপাতা পড়েছিলো ভেতরে—তা যেন প্রায় একটা জাজিমের মতো বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। কিছু ঘাসপাতা নিয়ে যাওয়া হ’লো গুহার মুখে—আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে নিতে হবে।
বৃষ্টি ধরলেই অকল্যান্ড রওনা হওয়া যাবে।
কিন্তু কাজটা যে খুব সহজ হবে, তা নয়। বেশ ক-বছর ধ’রেই মাওরিদের সঙ্গে ইংরেজদের ফাটাফাটি লড়াই চলেছে। মিথ্যে ধাপ্পা দিয়ে শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকরা দখল ক’রে বসতে লাগলো নিউ-জিল্যান্ডের প্রধান দ্বীপ দুটো—নর্থ আইল্যান্ড আর সাউথ আইল্যান্ড, যারা দ্বীপ দুটোর সত্যিকার মালিক, তারা ক্রমশ পিছু হঠতে লাগলো। আর স্বাধীনতা বিপন্ন দেখে মরণপণ ক’রে মাওরিয়া লড়াই চালাতে লাগলো ইংরেজদের সঙ্গে। সে-লড়াই এখনও চলছে, কিন্তু মাওরিরা বাধ্য হচ্ছে দ্বীপগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছেড়ে দূর-দুর্গম অঞ্চলে চ’লে যেতে। কিন্তু তাই ব’লে হার স্বীকার ক’রে আত্মসমর্পণ করেনি এখনও।
‘খুবই বিপজ্জনক মুহূর্তে এখানে এসে পৌঁছেছি আমরা,’মঁসিয় পাঞয়ল বললেন, ‘অকল্যান্ডে পৌঁছুতে পারলেও না-হয় কথা ছিলো। কিন্তু এখানে, পথের মাঝখানে, অতর্কিতে যদি মাওরিদের সঙ্গে আমাদের দেখা হ’য়ে যায়, তারা যে আমাদের ছেড়ে কথা কইবে না—এটা মনে রাখা উচিত।’
‘তাহ’লে আমরা কী করবো এখন?’
‘আমরা যেখানটায় এসে নেমেছি, সেখানটাতেই বিষম যুদ্ধ চলেছে এখন—এই এখান থেকে অকল্যান্ড অব্দি—ফলে বিপদ এখানটাতেই সবচেয়ে-বেশি।’
‘কিন্তু এখানে এই গুহায় ব’সে থাকলে তো চলবে না—অকল্যান্ডে আমাদের যেতে হবেই—’ লর্ড গ্লেনারভন মনে করিয়ে দিয়েছেন।
উত্তরদিক দিয়ে অকল্যান্ডে যাবার চেষ্টা করাই ভালো—ঘোরাপথ হবে বটে, তবু খেপে-যাওয়া মাওরিদের মুখে পড়ার সম্ভবনা কম। কিন্তু সমুদ্রের ধার দিয়ে যাওয়া চলবে না—সেদিকটা মোটেই নিরাপদ নয়। বরং চেষ্টা করতে হবে ওয়াইপো আর ওয়াইকাতো নদীর মোহানায় যদি পৌঁছুনো যায় –
‘এবার বুঝতে পারছি,’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স বললেন, ‘ঝড় কমতেই ঐ একটা মাত্র নৌকোয় ক’রে বিল হ্যালি তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে সটকে পড়েছে কেন। সে নিশ্চয়ই ঐ ক্ষুব্ধ মাওরিদের মুখোমুখি পড়তে চায়নি।’
পরদিন বৃষ্টি ধরতেই রওনা হলেন সবাই। পাঞয়লের কথামতোই ঘোরাপথটাই বেছে নেয়া হ’লো। উত্তরে তিরিশ মাইল পথ যেতে হবে। কোনোরকমে ঐ নদী দুটির মোহানায় পৌঁছুতে পারলে পরের পঞ্চাশ মাইল পথ যেতে আর তেমন অসুবিধে হবে না।
তৃতীয় দিনের দিন ধুঁকতে ধুঁকতে অভিযাত্রীরা পৌঁছুলেন দুই নদীর সংগমে। প্রচণ্ড গর্জন করে স্রোত লাফিয়ে পড়ছে পাথর থেকে পাথরে, ছিটকে উঠছে জল, মিহি একটা কুয়াশার আস্তর ঢেকে রেখেছে সব, এদিকে সন্ধেও হ’য়ে এসেছে। ক্লান্তিতে সকলের শরীর এলিয়ে আসছিলো। পথে কখনও কৌটো থেকে নোনা মাছ খেয়েছেন তাঁরা, একবার বেলাভূমি থেকে ঝিনুক কুড়িয়েও খেয়েছিলেন। এখন একটু নোনা মাছ আর শুকনো বিস্কুট খেয়ে ক্লান্ত অভিযাত্রীরা বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন। কাল দিনের আলো ফুটলে এখান থেকে যত-তাড়াতাড়ি সম্ভব আরো এগিয়ে যেতে হবে।
.
কুয়াশাটা প্রধানত তৈরি করেছিলো জলের ঝাপটা, আর তা থেকে ছিটকে-পড়া মিহিজলের কুচি। সেই কুয়াশা দেখা গেলো সকালবেলাতেও আছে। পরে যখন রোদের তেজ বাড়লো, শুধু তখনই কুয়াশা স’রে গেলো—আর অমনি উন্মোচিত হ’লো ওয়াইপা আর ওয়াইকাতো নদী দুটো—যেখানে এসে তারা মিলেছে, গোড়ায় খানিকটা গেছে পাশাপাশি, তারপরেই দুটো খাত পুরোপুরি এক হ’য়ে গেছে—আর সেখান থেকেই বিশাল ধারা অপেক্ষাকৃত শান্তভাবে এগিয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে।
আর সেই নদী দিয়েই ছুটে চলেছে বিশাল—একটি ক্যানু—তার গলুই প্রায় সত্তর ফিট লম্বা, আর দু-ধার দিয়ে প্রায় তিন ফিট উঠে গিয়েছে ধার। সরু লম্বা ছিপ, তরতর ক’রে ছুটে চলেছে মাঝনদী দিয়ে। মস্ত-একটা দেবদারু গাছ ফোঁপরা ক’রে নিয়ে তার খোলটা দিয়ে বানানো হয়েছে এই ক্যানু, ভেতরটায় ঝাউ-দেবদারুর পাতা আর ঝুরি বিছিয়েই তৈরি করা হয়েছে পুরু আর নরম একটা জাজিম। আটজোড়া দাঁড় সামনে জলে পড়ছে, প্রায় যেন পিছলে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্যানুকে। শক্ত হাতে হাল ধ’রে আছে আরো-একজন। সে মাওরি, ঠিক তার সঙ্গীদের মতোই; শক্ত সুঠাম দেহ, বুকের খাঁচাটা চওড়া, যেমন চওড়া তার কাঁধ। বলিষ্ঠ বাহুতে আর পায়ের গোছে যেন নেচে বেড়াচ্ছে পেশীগুলো। কপালে জটিল ঝুরির মতো কত যে রেখা কাটাকুটি ক’রে গেছে। সারা গায়ে উলকি-কাটা, এমনকী মুখেও। তার ভাবভঙ্গি দেখে এটা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয় যে সে হেজিপেঁজি কেউ নয়, বরং সাধারণ মাওরিদের চাইতে একটু আলাদাই। অর্থাৎ কোনো-একটা গোষ্ঠীর সর্দারই হবে সে। গায়ে তার বুনোকুকুরের ফারের আলখাল্লা, কানে পোখরাজের দুল, আর মাওরিরা যাকে পুনা পাথর ব’লে সেই পাথরের মালা গলায়, তার কাঁধে ঝুলছে একটা বন্দুক, নিশ্চয়ই ইংরেজদের কারখানাতেই তৈরি—নইলে এরা আর আগ্নেয়াস্ত্রর নির্মাণকৌশল জানবে কী ক’রে, আর আছে একটা দু-হাত লম্বা খঞ্জর–তার দু-দিকের ফলাতেই ধার, রোদ প’ড়ে ঝিকিয়ে উঠছে ফলাটা, আর সবুজ পাথরের হাতলটাও রোদ্দুরে ঝলমল ক’রে উঠেছে।
সর্দারের পাশে বসে আছে আরো নজন সশস্ত্র যোদ্ধা। যারা দাঁড় টানছে তারা নিশ্চয়ই সর্দারের অনুচর-যোদ্ধারা যদি সহযোগী হয়, এরা তবে অনুগত প্ৰজা!
আর ক্যানুর, ঠিক মাঝখানে প’ড়ে আছে পা-বাঁধা দশজন শ্বেতাঙ্গ বন্দী — তাদের হাতে অবশ্য কোনো বাঁধন নেই। এঁরা আর-কেউ নন : অভিযাত্রীরা : লর্ড ও লেডি গ্লেনারভন, মেরি ও রবার্ট গ্রান্ট, মঁসিয় পাঞয়ল, মেজর ম্যাকন্যাব্স, কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স, আর ডানকানের স্টুয়ার্ড আলবিনেট আর দুজন মাল্লা—উইলসন আর মূলারাডি।
কাল রাত্তিরে একটা মস্ত ভুল হ’য়েছিলো অভিযাত্রীদের। একে ঘুটঘুটে কালো রাত্রি, তায় পাঁজা-পাঁজা কুয়াশা, আর তারই জন্যে তাঁরা খেয়াল করেননি যে তাঁরা মাওরিদের একটা আড্ডায় ঢুকে পড়েছেন। তাঁরা ঘুমিয়ে পড়তেই মাওরিরা নিঃশব্দে এসে পাকড়েছে তাদের, পা বেঁধে ফেলেছে, কেড়ে নিয়েছে যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র, কিন্তু কোনোরকম শারীরিক নির্যাতন করেনি।
সর্দারের নাম কাই-কুমু—নামের মানে দুশমনের হাত যে চিবিয়ে খায়—আক্ষরিকভাবে খায় না হয়তো, কিন্তু আলংকারিক ও সম্প্রসারিত অর্থ দাঁড়ায় যে শত্রুদের ঠুটো ক’রে ফ্যালে। কাই-কুমুর মতো বেপরোয়া ডাকাবুকো লোক সহজে দেখা যায় না; যেমন দুর্ধর্ষ তেমনি দুর্দান্ত। ইংরেজরা তার মাথার জন্যে ইনাম ঘোষণা করেছে—জীবিত বা মৃত তাকে ধ’রে দিতে পারলেই পুরস্কার। অতিসম্প্রতি মুখোমুখি একটা সংঘর্ষে হেরে যেতে হয়েছে কাই-কুমুকে, তাই সে তার কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে নিয়ে সে চলেছেওয়াইকাতো নদীর উৎসের দিকে—সেখানে গিয়ে আরো লোকজন জড়ো ক’রে ফের গিয়ে আক্রমণ শানাবে।
পর-পর যত ঘটনা ঘটেছে, তাতে বোধহয় লর্ড গ্লেনারভনের আঁৎকে ওঠার ক্ষমতাটাও বিলুপ্ত হয়েছিলো। তাছাড়া, কপালের লেখা কে খণ্ডাবে—কপালে যদি আরো-নতুন-কোনো দুর্ভোগ লেখা থাকে, তবে তা-ই হবে। এ ঠিক সুখেদুঃখে-নির্বিকারবাদী স্টোয়িকদেরমনোভাব নয়, বরং নিয়তিমানা কোনো মানুষের মনের ধাত। এবং এই মাওরিরা তো তাঁদের সঙ্গে গায়ে প’ড়ে কোনো বাড়তি দুর্ব্যবহারও করছে না, শুধু অস্ত্রগুলো ছিনিয়ে নিয়েছে, আর পা বেঁধে রেখেছে। সর্দারকে একবার জিগেসও করেছিলেন : ‘আমাদের ধ’রে নিয়ে যাচ্ছো কেন? আমাদের নিয়ে তোমরা কী করবে?’ উত্তরে সর্দার বেশ স্পষ্টগলায় ইংরেজিতেই বলেছিলো : ‘ইংরেজদের হাতে আমাদের যারা বন্দী হ’য়ে আছে, তাদের সঙ্গে তোমাদের বদল করতে চাই। ইংরেজরা তোমাদের চায় কি না তারই ওপর তোমাদের জীবন নির্ভর করছে। বদল না-করতে চাইলে তোমাদের অবশ্য মেরে ফেলা হবে!’
তার স্পষ্ট কথা শুনে লর্ড গ্লেনারভন এটুকু অন্তত বুঝেছিলেন যে আপাতত এদের হাতে তাঁর কোনো ভয় নেই। যতক্ষণ-না তারা বন্দী বদলাবদলির ব্যাপারটায় একটা ফয়সালা করছে, ততক্ষণ অন্তত তাঁদের কিছু করবে না। নিশ্চয় মাওরিদের যে-যোদ্ধারা ইংরেজদের হাতে বন্দী হ’য়ে আছে তাদের জীবন এদের কাছে বিশেষ-মূল্যবান। এবং তাই কোনো-একটা বিনিময়ের সুযোগ এরা সহজে হাতছাড়া করতে চাইবে না।
এই ওয়াইপা অর ওয়াইকাতো নদীদুটো নিউ-জিল্যান্ডের আদিবাসিন্দাদের বেজায় গর্বের বস্তু। ওয়াইকাতো নদী সবশুদ্ধু ২২০ মাইল অর্থাৎ ৩৫৪ কিলোমিটার লম্বা—নর্থ আইল্যান্ডের উত্তরপশ্চিম থেকে বেরিয়ে এসে তাসমান সাগরে পড়েছে। ঠিক এমনি একটা নদী বেরিয়েছে সাউথ আইল্যান্ডের দক্ষিণপুব থেকে—সেটা ১৩৫ মাইল অর্থাৎ ২১৭ কিলোমিটার লম্বা—সোজা পুব-দক্ষিণপুব ধ’রে সেটা নেমে এসে পড়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে। ওয়াইকাতোরই বুকে এসে পড়েছে ওয়াইপো। মানচিত্র দেখে এবং অন্য পর্যটকদের বিবরণ মনে করবার চেষ্টা ক’রে মঁসিয় পাঞয়ল অনুমান করে নিতে চাচ্ছিলেন এই ওয়াইকাতোর উৎসমুখে কী আছে।
সর্দার যখন তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেছিলো তখন দু-একটা কথা বারে বারেই কানে ভেসে আসছিলো—তার মধ্যে এই কথা কটি কেমন যেন চেনা-চেনা লাগলো মঁসিয় পাঞয়লের : তুয়াকাউ, তুয়াহেনি পয়েন্ট, তুয়াই, তাইরাঙা। এ-সব নাম শুনে সবকিছু স্পষ্ট বোঝা না-গেলেও এটুকু মোটামুটি ধ’রে নেয়া গেলো নর্থ আইল্যান্ডের দক্ষিণের দিকে চলেছেন তাঁরা—ওয়েলিংটন পেরিয়েই হয়তো, পার্বত্যঅঞ্চলে, সম্ভবত সেখানেই কোনো হ্রদ থেকে বেরিয়ে এসেছে ওয়াইকাতো নদী, যেভাবে সহজসাবলীল ভাবে ক্যানু ছুটেছে, তাতে রাতে বিশ্রামের সময় বাদ দিয়ে, অনুমান করা যায় দিন-চারেক পরে তাঁরা ওয়াইকাতোর উৎসমুখে গিয়ে পৌঁছবেন।
এমনিতে সারাদিন ক্ষিপ্রবেগে চলে ক্যানু, যারা দাঁড় টানে তারা যে কী-রকম ওস্তাদ সেটা বোঝা যায় যে-রকম মসৃণ সাবলীল ছন্দে ক্যানু এগোয়, বোঝাই যায় কাই-কুমু তাদের এইজন্যেই দাঁড় বাইবার কাজে লাগিয়েছে, রাত হ’লেই তীরে এসে ক্যানু বেঁধে ডাঙায় তারা রাত কাটায়। এইভাবে দু-দিন কেটে যাবার পরে আরো-একটা ক্যানু এসে কাই-কুমুর নাগাল ধরলে। তারা যে সদ্য-কোথাও থেকে লড়াই ক’রে ফিরছে, সে তাদের রক্তমাখা অস্ত্রশস্ত্র দেখেই অনুমান করা যায়। তারা কিন্তু বন্দীদের দেখে অযথা কোনো কৌতূহল দেখালে না, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাতেই তারা তন্ময়—উটকো কয়েকজন শ্বেতাঙ্গকে নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
তারও দু-দিন পরে ক্যানু পৌঁছুলো এমন-এক জায়গায় সেখানকার জল যেন সবসময়েই টববগ করে ফুটছে। বুড়বুড়ি উঠছে জলে, আর সেগুলো ফেটে গিয়ে কীরকম যেন গ্যাস বেরুচ্ছে অবিশ্রাম। হাওয়ায় গন্ধকের গন্ধ, মাটিতে লৌহ আকরিকের রক্তিম আভা। দু-পাশের তীর ধরে সার-সার গেছে উষ্ণ প্রস্রবণ, ফুটন্ত জল ফোয়ারার মতো উঠে যাচ্ছে শূন্যে, আর সূক্ষ্মজাল জলের শীকরে রোদ্দুর ঠিকরোচ্ছে, ছিটিয়ে দিচ্ছে রামধনুর সাতরঙের বর্ণালি। নিউ-জিল্যান্ডের জ্যান্ত আগ্নেয়গিরি টোনাগিরি আর ওয়াইকেরির জ্বালামুখ দিয়ে তপ্ত বাষ্প আর জ্বলন্ত তরল বেরুবার পথ না-পেয়ে যেন পাহাড়ের হাজার চিড় আর ফাটল দিয়ে হাজার ধারায় বেরিয়ে আসছে টগবগে জল আর বাষ্প। হাওয়া পর্যন্ত কেমন যেন থমথমে, তপ্ত, এমনকী নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। তারই মধ্যে প্রায় আড়াই মাইল পথ গিয়ে বাঁক ফিরে হ্রদের মধ্যে ঢুকলো ক্যানু—দু-পাশে দুটো বিশাল-উঁচু পাহাড়, রক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে মাঙ্গাকিনো আর মাঙ্গাপেহি, আর তারই মধ্যে এই হ্রদ। হ্রদের একপাশে একটা কুঁড়ে তার মাথায় উড়ছে একটা নিশেন
মাওরিদের জাতীয় পতাকা।
২. প্রাণ হাতে ক’রে পালিয়ে
হ্রদের দুই পাশে উত্তুঙ্গ দুই পর্বত—মাঙ্গাকিনো আর মাঙ্গাপেহি, তার একটু দূরেই মোকাই—একটা জনপদ। নর্থ আইল্যান্ডের প্রায় মাঝখানে এই দুটি পাহাড়—অকল্যান্ড থেকে যতটা দূরে, প্রায় ততটা দূরেই আছে ওয়েলিংটন। অর্থাৎ মাওরিরা দু-দিক থেকে ইংরেজদের হাতে মার খেতে-খেতে শেষটায় একেবারে নর্থ আইল্যান্ডের দুর্গম- মাঝখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে—সম্ভবত শ্বেতাঙ্গ কোনো পর্যটক এখনও এখানে পা দেয়নি, হয়তো জানেই না যে এখানে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সানুদেশে স্বাধীন মাওরিরা তাদের স্বাধীনতার শেষ লড়াই লড়বার জন্যে এসে জড়ো হয়েছে।
এতটা রাস্তা পেরিয়ে এসে এখানে ঢোকবামাত্র মনে হয় যেন ভূস্বর্গে এসে পৌঁছেছে কেউ। বিস্তীর্ণ শনখেতে ফুল ফুটে আছে, আর সেই ফুলের মধু খাবে ব’লে হরেক রঙের জানা-অজানা পাখি উড়ছে সেখানে। শনের ডাঁটা থেকে আঠা হয়, প্রায় মোমের মতো ঘন—কত-যে কাজে লাগে। পাতা থেকে তৈরি হয় কাগজ, আর শুকনো পাতা থেকে হয় জ্বালানি, শন কেটে পাকিয়ে দড়ি আর সুতো দিয়ে বোনা হয় গায়ের ঢোলা জামা, মাদুর, চাটাই। মাওরিরা লাল আর কালো রঙে রাঙিয়ে নেয় এই জামা, আর এটাই সম্ভবত তাদের প্রিয়পসন্দ—কেননা অনেকেরই পরনে এই লাল-কালো আলখাল্লা। একটা গোটা অর্থনীতিই শুধু নয়, জীবনযাপনের যাবতীয় উপকরণ যেন জোগায় এই শনখেতে—যা গজায় উর্বর জলাভূমিতে—কোনো হ্রদ বা নদীর ধারে কিংবা সমুদ্রতীরে।
তীর থেকে দুই ফার্লং দূরে পাহাড়ের ঢালে মাওরিদের একটা নগরদুর্গ—তাদের ভাষায় তারা তাকে ব’লে পাহ্। এই পাহ্ ঘেরা তিন দিক থেকে তিন পল্লা বেড়া দিয়ে—বাকি দিকটা যেন পাহাড়ের ঢালে বসানো।
প্রথম বেড়া ছুঁচলো লাঠি দিয়ে তৈরি—প্রায় পনেরো ফিট উঁচু। তারপর শক্ত খুঁটির বেড়া, সবশেষে পাকানো বেত বেঁকিয়ে আরেকটা পল্লা। তারই মধ্য দিয়ে গেছে ভেতরে যাবার দরজা। বেড়া তিনটে পেরিয়ে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের গায়েই সমতল খানিকটা জায়গা। সেখানে পর-পর সাজানো রয়েছে চল্লিশটা কুঁড়েঘর।
কিন্তু যে-দৃশ্যটা দেখে আতঙ্কে বন্দীদের চোখ বিস্ফারিত হ’য়ে গেলো, সেটা আর কিছু নয়, দ্বিতীয় বেড়ার খুঁটিগুলোর ওপরে সারি-সারি গেঁথে-রাখা নরমুণ্ড, শূন্য কোটার থেকে মণিবিহীন চোখ মেলে পলকহীন যেন বন্দীদের দিকেই তাকিয়ে আছে নরমুণ্ডগুলো। শত্রুপক্ষের লোকদের মুণ্ড কেটে এইভাবে সাজিয়ে রাখার রীতিই আছে মাওরিদের মধ্যে—তাঁর সেই রহস্য বার করে ফেলেছে, সেই প্রক্রিয়াটা, যার সাহায্যে নৃমুণ্ডের অভ্যন্তর থেকে মগজ এবং চোখের কোটর থেকে চোখের তারা বার ক’রে এনে দীর্ঘ দিন অবিকৃত রেখে দিতে পারে মুণ্ডগুলো। আর এগুলো তো তাদের পুঁথিপুরাণইতিহাসের অংশ—একেকটা মুগুর সঙ্গে জড়ানো আছে শৌর্যবীর্য-দেশদ্রোহিতা-বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম-প্রত্যেকটা মুণ্ডই যেন একেকটা কাহিনী শোনাতে চাচ্ছে।
কাই-কুমুর কুঁড়েঘরটা এই নগরদুর্গ পাহ্-এর একেবারে শেষমাথায়। দৈর্ঘ্যে বিশ ফিট, প্রস্থে পনেরো ফিট আর উচ্চতায় দশফিট—এই কুঁড়ের চাল ঘরের দেয়াল ছুঁয়ে মাটি অব্দি নেমে গিয়েছে। কুঁড়ের সামনে প’ড়ে আছে খানিকটা ফাঁকা জমি, সেখানে দরকার হ’লে অন্য কুঁড়ে থেকে লোকজন এসে জমায়েৎ হয়, কখনও-কখনও এই ফাঁকা জমিতেই ব্যবস্থা হয় রণসাজে সেজে কুচকাওয়াজের। ঘরের দেয়ালগুলো কিন্তু অজস্র ছবিতে ভরা—যেমন আছে গাছপালা জীবজন্তুর ছবি-ঐ-তো একটা কিউয়ে পাখির ছবি—তেমনি আছে ঘটনাপরম্পরারও ছবি—যেন সরল ও গতিময় টানটোনের মধ্যে শিল্পী ধরে রাখতে চেয়েছে তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। দুরমুশপেটানো মাটির মেঝেয় শুকনো ঝাউপাতা দেবদারুপাতা বেছানো, আর তার ওপরেই পেতে রাখা হয়েছে টাইফা-পাতার মাদুর, লাল আর কালোয় তার ওপরেও আছে অলংকরণ। মেঝের ঠিক মাঝখানটাতেই পাথরঢাকা একটা মস্ত গর্ত—এটাই তাদের চুল্লি–আর তারই মাথাবরাবর চালেও একটা ফোকর—সেখান দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে যায় বাইরে। নর্থ আইল্যান্ডের প্রচণ্ড ঠাণ্ডার দিনে ঘর গরম রাখবার জন্যে এভাবেই ব্যবস্থা ক’রে রেখেছে এরা—এদের ফায়ারপ্লেসও কোনোদিক থেকেই কম কাজের নয়।
যেখানে তার শোবার ব্যবস্থা করা, তার পাশেই তার ভাঁড়ারঘর। অনেক ধরনের উদ্ভিদ, গাছের পাতা, শেকড়বাকড় জমানো রয়েছে সেখানে। একপাশে রসুই পাকাবার জন্যে তোলাউনুন রয়েছে—আর তারপরেই তার কোরাল—শুওর ছাগল রাখার জায়গা—সেই যবে কাপ্তেন কুক এই জীবনজন্তুগুলোকে নিউ-জিল্যান্ডে আমদানি করেছিলেন, সেই-থেকেই এরা ক্রমাগত বংশবৃদ্ধি ক’রে মাওরিদের খাদ্য জুগিয়ে গেছে।
কাছেই ফাঁকা একটা কুঁড়েঘরে বন্দীদের নিয়ে ঢোকানো হ’লো। এখনও অব্দি মাওরিদের কাছ থেকে ব্যবহারে ভয় পাবার মতো কিছু পাওয়া যায়নি, আবার আশ্বস্ত হবার মতো কোনো ভরসাও কোথাও জোটেনি—তাঁদের সম্বন্ধে সকলেরই মধ্যে নির্লিপ্ত ও নির্বিকার-একটা ঔদাসীন্যের ভাব বন্দীরা লক্ষ করেছেন। সোজা একেবারে পাহ্-এর অর্থাৎ নগরদুর্গের মধ্যে এনে হাজির করেছে ব’লেই বন্দীদের উৎকণ্ঠার ভাবটা বেশি। কী মর্জি হবে এদের, কে জানে। শুধু কি সর্দারের ইচ্ছেতেই সবকিছু হয়, না কি অন্যসকলের কাছ থেকেও মতামত চাওয়া হয়? ভাবগতিক দেখে কিছুই বোঝবার জো নেই। বন্দীবিনিময়ের প্রস্তাবটায় যদি ইংরেজ কর্তৃপক্ষ রাজি না-হয়, তাহ’লে নিশ্চয়ই এরা তাঁদের গায়ে আঁচড়টি না-কেটেই ছেড়ে দেবে না? মনের মধ্যে আরো-কোনো দুরভিসন্ধি নেই তো?
কাই- -কুমুর মনের মধ্যে কী আছে না-জানা গেলেও অন্যদের মনের ভাব যে কী, তা একটু জানা গেলো যখন দল বেঁধে মেয়েরা এসে হাজির হ’লো বন্দীদের দেখতে। কোলাহল-কলরবের মধ্যে থেকে দু-একটা যা ইংরেজি কথাবার্তা কানে এলো, তা থেকে বোঝা গেলো-এরা কেউই মোটেই করুণাময়ী বা মমতাময়ী দেবীপ্রতিমা নয়—বরং সকলেরই সাধ যেন বন্দীদের প্রকাশ্যে মুণ্ডচ্ছেদ হয়। প্রতিশোধ নেবার জন্যে তেরিয়া মেজাজ একেকজনের। এদেরই কারু ছেলে, কারু ভাই, কারু স্বামী ইংরেজদের আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে প্রাণ হারিয়েছে—এতদিন ধ’রে এই সংঘর্ষ চলেছে যে কতজনের যে জীবননাশ হয়েছে তার ঠিক নেই; নানারকম নিগ্রহ-নিপীড়ন হয়তো সহ্য করতে হয়েছে এদের প্রত্যেককেই, মৃত্যু হানা দিয়েছে অনবরত, আর ছিনিয়ে নিয়ে গেছে তাদের আপনজনদের। এদের চক্ষু দিয়ে যদি অনবরত দয়া অশ্রু দরদর ক’রে ব’য়ে যেতো, তাহ’লেই বরং অবাক হবার কিছু থাকতো। না-জেনে, অপ্রস্তুত অবস্থায়, নিউ-জিল্যান্ডের ইতিহাসের এমন-একটা দুঃসময়ে তাঁরা এখানে এসে পা দিয়েছেন, যে এখন তাঁদের নিজেদেরই জীবন বিষম একটা সংকটে পড়েছে।
বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হ’লো না। একটু পরেই সামনের ফাঁকা মাঠটায় দলে-দলে মাওরিরা এসে হাজির হলো, আর তাদের আসতে দেখে মাওরি মেয়েরাও গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিলে। নানা বয়সের সব মানুষ। নেহাৎই কচি-কচি সব কিশোর থেকে মুখে বলিরেখার কুঞ্চনেভরা অতিবৃদ্ধ মাওরি—কেউই বোধহয় বাদ যায়নি। সকলেরই মুখ গম্ভীর, শোকাচ্ছন্ন। কেউ এখানে ফুর্তি করতে আসেনি, এটা তাদের জীবনে উৎসবের কোনো মুহূর্ত নয়, যে তারা আনন্দের হাট বসাবে। যারা লড়াই করতে গিয়েছিলো, তাদের মধ্যে অধিকাংশই আর ফিরে আসেনি। কাই-কুমুর নিশ্চয়ই তার সঙ্গে মাত্র এই ক-জন সহযোদ্ধা নিয়ে যায়নি—তাকেও রণস্থল থেকে ফিরতে হয়েছে বেশিরভাগকেই পেছনে ফেলে রেখে।
কাই-কুমু কী যেন বললে সবাইকে সম্ভাষণ ক’রে; শান্ত হ’য়ে চুপচাপ তার কথা শুনলে সবাই। কিন্তু তার কথা থামতেই শুরু হ’য়ে গেলো বিষম কোলাহল—সকলেই যেন একসঙ্গে কথা কইতে চাচ্ছে; বুড়ো-বুড়িরা কেউ কপাল চাপড়াচ্ছে, কেউ-বা চাপড়াচ্ছে বুক। হাত-পা ছুঁড়ে অন্যরা যা বলছে, তা জানবার জন্যে হয়তো ভাষাও জানতে হয় না—কেননা তাদের বলার স্বর ক্রুদ্ধ ও রুষ্ট, প্রায় যেন সহ্যের শেষসীমায় এসে পৌঁছেছে তারা।
বন্দীরা তাঁদের খুপরিটা থেকে সবাই যেন চোখ দিয়ে গিলছিলেন। কানে যা আওয়াজ আসছিলো তার মর্মার্থ বুঝতে এখন আর বাকি নেই। জমায়েতের বেশির ভাগেরই মনোভাব ঠিক তাঁদের অনুকূলে নয়। তবে তাঁদের নিয়ে এরা যে কী করবে এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কারণ আবার একটা হাত তুলে কাই-কুমু সবাইকে থামিয়ে দিয়েছে, তারপর সবাই চুপ করলে পর কী যেন বলেছে তাদের হাত-পা নেড়ে। তারপরেই দেখা গেলো কাই-কুমুর পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা একজন মাওরি এই বন্দীদের খুপরিটার দিকে আসছে।
এখনই তবে জানা যাবে জমায়েতের সিদ্ধান্ত কী হ’লো।
হঠাৎ লেডি হেলেনা লর্ড এডওয়ার্ডের কাছে এসে তাঁর হাতটা ধ’রে শান্ত কিন্তু ধরাগলায় বললেন, ‘এডওয়ার্ড, অন্তত একটা জিনিশ তোমাকে করতেই হবে। জীবন থাকতেও আমাকে বা মেরিকে এই মাওরিরা যেন তোমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে নিয়ে যেতে না-পারে। মরতে হ’লে সবাই একসঙ্গে মরবো।’ তারপর জামার ভাঁজের মধ্য থেকে একটা ছোট্ট চকচকে রিভলভার বার করে লর্ড এডওয়ার্ডের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন : ‘এই রিভলভারটা আমি আমার পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলুম। এরা কেউ আমার গায়ে হাতও দেয়নি, আমাকে তেমন ক’রে খানাতল্লাশ ও করেনি—সেইজন্যেই এতক্ষণ লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলুম। এখন এটা আমি তোমাকেই দিলুম। তুমি এটা দিয়ে যা ভালো বোঝো, তা-ই কোরো।’
লেডি হেলেনার হাতে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে একটা চাপ দিয়ে লর্ড এডওয়ার্ড চট করে সেটা তাঁর পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে ফেললেন। তাঁর মুখটা কি-রকম কালো হ’য়ে গিয়েছে, শুকনো, ছায়াবিধুর আর গম্ভীর।
ঠিক সময়মতো রিভলভারটা লুকোতে পেরেছিলেন লর্ড এডওয়ার্ড, কেননা পরক্ষণেই খুপরিটার দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো একজন মাওরি, লোকটা তাঁদের চেনা—ক্যানুতে সে কাই-কুমুর সঙ্গেই ছিলো, হয়তো তার ডানহাতই সে। সে ইঙ্গিতে সবাইকে বললে তাকে অনুসরণ ক’রে বাইরে বেরিয়ে আসতে।
তারই পেছন-পেছন, জমায়েতের একটা ধার দিয়ে, কাই-কুমুর কাছে গিয়ে হাজির হলেন সবাই। জমায়েতের লোকেরা চুপচাপ হা করে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে—তাদের মধ্যে উত্তেজনার একটা ঢেউ খেলে গিয়েছে, যেই তাঁরা পর-পর এসে দাঁড়িয়েছেন কাই-কুমুর সামনে। তাদের চোখমুখ দিয়ে আগুন ঝরছে; মানুষের দৃষ্টি যদি কাউকে ভস্ম ক’রে ফেলতে পারতো, তাহ’লে এক্ষুনি হয়তো তাঁরা জীবন্তই ঝলসে মরতেন।
কাই-কুমুকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের অনেককেই আগে তাঁরা দেখেছেন ক্যানুতে। পরে মাঝপথে আরো একটা ক্যানুতে ক’রে যারা এসে যোগ দিয়েছিলো তাদেরও কাউকে-কাউকেও সেখানে জটলার মধ্যে দেখা গেলো। দ্বিতীয়-ক্যানুর সর্বদারটিকে লর্ড এডওয়ার্ডের মনে ছিলো, কেননা প্রায় একটা দৈত্যের মতো আকার তার, মুখে ভয়-ডরের কোনো লেশ নেই, সর্বাঙ্গের উলকিগুলোয় ভীষণ-সব জীবজন্তুর হা করা মুখ, যেন গিলে খাবে শত্রুকে। তার বয়সও বেশি নয়, অন্তত চল্লিশের বেশি হবে না। হট্টাকট্টা জোয়ান। পথে কাই-কুমুকে দেখা গিয়েছিলো এর সঙ্গে বেশ সমীহ করেই কথা বলতে। নিশ্চয়ই দলের লোকদের ওপর তার প্রচণ্ড প্রভাব আছে—কাই-কুমু তাতে যদি মনে-মনে একটু ঘাবড়ে গিয়েও থাকে, মুখে সেটা সে প্রকাশ করেনি—তবে একে চটিয়ে দেবার মতোও কিছু করেনি, এমন খাতির ক’রে চলেছে যেন সে কিছুতেই কাই-কুমুর ওপর খেপে না-যায়। মাওরিরা যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকারও দাবিদাওয়া নিয়ে লড়ছে, তখন সে অহেতুক কোনো গৃহযুদ্ধের কারণ ঘটতে দিতে চায় না—দুজনের মধ্যে দ্বেষবিদ্বেষ রেষারেষি যা আছে তা না-হয় আপাতত চাপাই থাকুক। এই বেপরোয়া মাওরিটির নাম কারা-টিটি—আর এমন নামেই মালুম তার প্রকৃতিটা কী—কারণ তাদের ভাষায় কারা-টিটি কথার মানে রগচটা, বদমেজাজি। সে এখন কাই-কুমুর পাশে দাঁড়িয়ে বেশ-তালেবর ভঙ্গিতে সবকিছুর ওপর নজর রেখে যাচ্ছে। বন্দীদের আসতে দেখেই তার মুখচোখে উৎকট-একটা হাসি ফুটে উঠলো।
লর্ড গ্লেনারভন কাছে এসে দাঁড়াতেই কাই-কুমু জিগেস করলে : ‘তোমরা কারা? ইংলণ্ডের লোক?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমাদের যদি আমরা ইংরেজ সরকারের হাতে তুলে দিই, তবে কি তারা এর বিনিময়ে আমাদের দলের লোকদের ছেড়ে দেবে? বিশেষ করে আমাদের পুরুৎ তোহোনগাকে?’
‘জানি না।’
‘জানো না মানে?
‘আমরা নেহাৎই সাধারণ লোক। আমরা যে এখনে এসেছি, তা-ই ইংরেজ সরকারের কেউ জানে না। তাছাড়া আমরা কেউ জাঁদরেল সেনাপতিও নই, পুরুত্ত নই।
‘কিন্তু আমরা তোমার বদলে আমাদের পুরোহিতকে ফেরৎ চাই। তোমাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
‘আমি কী ব্যবস্থা করতে পারি—সরকারের কাছে আমার তো কানাকড়িও দাম নেই।’ তারপরেই লর্ড গ্লেনারভনের চোখ প’ড়ে গেলো লেডি হেলেনা আর মেরির ওপর। অমনি গলার স্বর পালটে তিনি বললেন : ‘তবে সরকার হয়তো এঁদের কথা বিবেচনা করবেন।’ মেয়েদের দিকে দেখালেন তিনি।’এরা আমাদের দেশের অভিজাত সমাজের মানুষ—সরকারের কাছে নিশ্চয়ই এঁদের মূল্য অনেক।’
কথাটা কানে যেতেই কাই-কুমুর মুখে একটা ধূর্ত মৃদুহাসি খেলে গেলো। ‘তুমি কি আমাদের বোকা ঠাউরেছো? ভেবেছো, যা-খুশি তা-ই বাৎলে দিয়ে পার পাবে? কাই-কুমুর চোখকে ধুলো দেবে?’ শেষ কথাটা বলবার সময় কাই-কুমুর গলার স্বরে যেন যতরাজ্যের উষ্মা ঝরে পড়লো। আঙুল তুলে লেডি হেলেনাকে দেখিয়ে সে বললে : ‘এ তো তোমার বৌ—এ যদি কোনো ওপরমহলের মেয়ে হয়, তাহ’লে তুমি বুঝি ওপরমহলের কেউ নও?’
লর্ড গ্লেনারভন কিছু বলবার আগেই কাই-কুমুর পাশ থেকে এগিয়ে এলো কারা-টিটি, সোজা গিয়ে লেডি হেলেনার একটা হাত ধ’রে বললে : ‘এ যদি ওর বৌ না-হয়, তবে তো বোঝাই যাচ্ছে—এ আমার বৌ—’ কারা-টিটি আর কী বলতো, কোনোদিনই জানা যাবে না। কেননা তার কথা শেষ হবার আগেই তড়িৎগতিতে লর্ড গ্লেনারভনের হাতে উঠে এসেছে সেই খুদে রিভলভারটা, আর এমনকী ঠিকমতো তাগ ঠিক না-ক’রেই লর্ড গ্লেনারভন ঘোড়াটা টিপে দিয়েছেন : ‘গুড়ুম!’ এবং, পরক্ষণেই, মাটিতে লেডি হেলেনার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে কারা-টিটির প্রাণহীন দেহ, ব্যাপারটা ঘটতে সময় লেগেছে বোধহয় চোখের একটা পলক, কেননা কারা-টিটির দেহটা যখন মাটিতে আছড়ে পড়েছে তখনও রিভলভারের নল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
কিন্তু ততক্ষণে লর্ড গ্লেনারভনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাই-কুমুর দেহরক্ষীরা—এক হ্যাঁচকা টেনে কেড়ে নিয়েছে তাঁর হাতের রিভলভারটা। তারা হয়তো লর্ড গ্লেনারভনকে ছিঁড়েই ফেলতো, যদি–না সেই মুহূর্তে শোনা যেতো কাই-কুমুর বজ্রনির্ঘোষ : ‘ছাড়ো! ছাড়ো! এর গায়ে হাত দেয়া চলবে না। অমঙ্গল! অমঙ্গল!’
আর যেন মন্ত্রের মতো কাজ করেছে কথাগুলো—প্রায় ছিটকেই লর্ড গ্লেনারভনের কাছ থেকে স’রে গিয়েছে দেহরক্ষীরা, যদি ধর্মবিরুদ্ধ ব’লে কাউকে স্পর্শ করাও নিষিদ্ধ ক’রে দেয়া হয়, যদি ট্যাবু বলা হয় তাকে, যদি বলা হয় অমঙ্গল, যেমন বলে পলিনেশিয়ার আদিবাসিন্দারা, তবে কেউ তাকে ছোঁয় সাধ্য কী!
ট্যাবু কথাটা এসেছে পলিনেশিয়ার দ্বীপের আদিবাসিন্দার ভাষা তোঙ্গান থেকে—আর তাদের এই ট্যাবুর প্রয়োগই দেখা গেছে ভিন্ন-ভিন্ন দ্বীপে ও দেশে—তাদের আদিবাসীদের মধ্যে, তারা কখনও বলেছে অমঙ্গল বা অভিশাপ, কখনও-বা বলেছে ধর্মবিরুদ্ধ বা দেবতার রোষ, আর কতকগুলি বস্তু বা জীবকে পুরে দিয়েছে নিষেধের পটভূমিকায়।
আর এমন না-করেই তাদের কোনো উপায় ছিলো না। বেঁচে থাকার জন্যেই তাদের এমন ক’রে নিতে হয়েছিলো। আর এই পুরো ধারণাটা উৎসারিত হয়েছিলো আদিম একটা প্রবৃত্তি—ভয় থেকে, আতঙ্ক থেকে। বিশেষ ক’রে কাউকে যদি থাকতে হয় কোনো একটা দ্বীপে, যেখানে সমুদ্র গর্জায় আক্রোশে, ঝঞ্ঝা হানে ধ্বংস, অগ্ন্যুদ্গার করে আগ্নেয়গিরি, যেখানে যা অজানা, অচেনা তারই মধ্য থেকে হঠাৎ দুম ক’রে বেরিয়ে আসে সর্বনাশ, যেমন ঐ-যে শিকড়বাকড় তা থেকে যদি আসে গরল, ঐ-যে লতাপাতা ঐ-যে সুন্দর দেখতে ফল তার ভেতর লুকিয়ে থাকে হলাহল, তাহলে সাবধান না-থেকে উপায় নেই, কেননা সাবধানের মার নেই—আবার মারেরও তো সাবধান নেই—কোত্থেকে যে সে কখন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক কী যেমনভাবে মা তার শিশুকে ভয় দেখায় না-না, আগুনে হাত দিতে নেই, তেমনিভাবেই কোনো-কোনো গোষ্ঠীকে ঠিক ক’রে নিতে হয়—না-না, এটা ছোঁয়াও চলবে না, ছুঁলেই বিপদ হবে, সর্বনাশ হবে, ভয়ংকর-কিছু-একটা হবে যেটাকে আর-কিছুতেই শামাল দিয়ে ওঠা যাবে না। এমনতর যে হ’লো, তা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এই রুক্ষ বন্ধুর সিন্ধুজলে ঘেরা মাটির একরত্তি একটা জায়গাতে এসেই প্রাণ তার জয়ের নিশান উড়িয়েছে, আর সে-জায়গাটাকে সুরক্ষিত রাখতে হবে, সাবধানে আগলে-আগলে রাখতে হবে, ঐ তো দ্যাখোনি সেবার বন্যায় সব কুড়েবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গেলো, নদী কী-রকম ফুলে ফেঁপে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো গোটা লোকায়ের ওপর—ফলে নদীকে কখনও চটতে দিলে চলবে না, দেখতে হবে কিছুতেই নদীর যেন আবার মেজাজ খারাপ না-হয়, সে যেন আবার সকলের ওপর রাগ না-করে বসে! তেমনি আগুনের পাহাড়াটাকেও চটিয়ে দিলে চলবে না, ঝড়ের রাতের ঐ বাজবিদ্যুৎকেও না; বরং যে-সব জায়গায় থাকলে অতর্কিতে মরণ এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, সে-সব জায়গা থেকে হাজার হাত দূরে থাকাই ভালো, এখনও তো ভালো ক’রে জানা নেই কেন মাটি কেঁপে ওঠে হঠাৎ-হঠাৎ আর পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে বড়ো-বড়ো পাথরের চাঁই, ভেঙে পড়ে গাছপালা, ঘরবাড়ি, গোটা-গোটা সব পাহ। অমঙ্গল! অমঙ্গল! ঘোর অমঙ্গল! ছিকে দূরে স’রে এসো তার কাছ থেকে—কিছুতেই আর তার সঙ্গে গাঁ ঘেঁসাঘেঁসি করতে যেয়ো না–বন্ধুভাবেও না, শত্রুভাবেও না—জানো না তো কীসে সে খেপে উঠবে, তারপর একেবারেই আর বাগ মানানো যাবে না তাকে!
আর এই বোধ থেকেই জন্ম নিলো রীতিনীতি পালপার্বণ অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান। কেননা কাকে কীভাবে ছুঁলেই যে তার ভেতর জেগে ওঠে প্রচণ্ড অতিপ্রাকৃত শক্তি অথবা সে দুষিত হ’য়ে গিয়ে সবকিছু বিপজ্জনকভাবে নষ্ট ক’রে যায়—তার কোনো হদিশই তো জানা নেই। ন্যায়নীতিই হোক, রুচিকুরুচিই হোক—কোনো-কোনো জিনিশ তাই গর্হিত, কোনো-কোনো কাজের মধ্যে তাই মারাত্মক ঝুঁকি আছে, কোনো-কোনো বস্তুর মধ্যে তাই লুকিয়ে আছে অপরিসীম রহস্যময় কোনো শক্তি, মানুষের চাইতেও বড়ো, —যেটা হয়তো পান থেকে চুন খসলেই লাগামছেঁড়া কোনো দুর্যোগের মতো ধেয়ে আসবে ও।
আর এই মঙ্গল-অমঙ্গলের বোধই ধ’রে রেখেছে গোটা সমাজটাকে।
যে-মুহূর্তে তাই কাই-কুমু চেঁচিয়ে উঠলো : ‘ছাড়ো-ছাড়ো! এর গায়ে হাত দেয়া চলবে না! অমঙ্গল! অমঙ্গল!’, অমনি তার দলের লোকেরা আঁৎকে উঠে পেছিয়ে এলো, লর্ড গ্লেনারভনকে ছেড়ে দিলো।
লর্ড গ্লেনারভনকে ধ’রে তার দলের লোকেরা যখন ছিঁড়ে ফেলতে গেছে, তখনই কেন কাই-কুমু অমঙ্গল! অমঙ্গল! ব’লে চেঁচিয়ে উঠেছে? সে কি তবে ভেবেছে যে তাঁর মধ্যে অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তি আছে—যার বলে নিরস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও জামার ভেতর থেকে বার-ক’রে এনেছেন আগুনওগরানো রিভলভার? না কি সে ভেবেছে, লর্ড গ্লেনারভনকে মেরে ফেললে কিছুতেই আর দরকষাকষি করা যাবে না ইংরেজদের সঙ্গে, তাঁর বিনিময়ে মুক্তি কিনে-আনা যাবে না তাদের জাদুজানা অসীম শক্তিধর পুরুৎপ্রধান তোহোনগার? না কি সে হঠাৎ আবিষ্কার ক’রে বসেছে এই লর্ড গ্লেনারভনের জন্যেই এখন অপসৃত হয়েছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী, তারই পদাকাঙ্ক্ষী রগচটা ঐ কারা-টিটি, আর তাই এইমুহূর্তে সে কৃতজ্ঞতার বশেই প্রাণে মেরে ফেলতে চায়নি লর্ড গ্লেনারভনকে?
কারণ যা-ই থাক না কেন, কাই-কুমুর নির্দেশে মাওরিরা লর্ড গ্লেনারভনের সঙ্গে অন্য বন্দীদেরও টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেলো পাহাড়ের ঢালে, আরো ওপরে, যেখানে তাদের দেবতার মন্দির। তারপর মন্দিরের ভেতরে তাদের ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ ক’রে দিয়ে চ’লে গেলো মাওরিরা—বাইরে কড়া পাহারায় রইলো সশস্ত্র একদল প্রহরী।
আর ঠিক তক্ষুনি লর্ড গ্লেনারভন আবিষ্কার করলেন, মঁসিয় পাঞয়ল আর রবার্ট ছাড়া তাঁরা সবাই আছেন এখানে। মেরির অবস্থা ক্রমশই সঙিন হ’য়ে উঠেছে। আর তাকে সান্ত্বনা দেবার মতো কোনো কথাও ঠিক খুঁজে পাচ্ছেন না লেডি হেলেনা। জন ম্যাঙ্গল্স সমুদ্রের তুলকালাম ঝড়েও কোনো ভয় পান না, এখন তিনিও কী-রকম যেন ঘাবড়ে গিয়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছেন। মেজর ম্যাকন্যাব্সকে সবাই জানে হাজার বিপদেও চিরকাল মাথা ঠাণ্ডা রাখেন, আর মাথা হয়তো এখনও তার ঠাণ্ডাই আছে, কিন্তু এটা তিনি জানেন না মাঙ্গাকিনো আর মাঙ্গাপেহির মাঝখানে, এই পাহাড়ঘেরা উপত্যকায়, মাওরিদের এই মন্দিরে এইভাবে যে তিনি বন্দী হয়ে আছেন—এই অবস্থায় তিনি ঠিক কী করবেন। কারা-টিটিকে ও-রকম অতর্কিতে অপ্রত্যাশিতভাবে হত্যা করার জন্যে লর্ড গ্লেনারভনকে একটা মাশুল দিতেই হবে, এবং সেটা মৃত্যু–আর একবার যদি তাঁকে এরা হত্যা করে, তবে অন্যদেরও এরা নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা কইবে না। কাই-কুমুর মনের মধ্যে যে সত্যি কী আছে, সেটা অনুমান করাও অসম্ভব—যতই ‘অমঙ্গল! অমলঙ্গল!’ বলে সে চেঁচিয়ে ট্যাবুর স্মরণ নিক, তাঁদের সে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেবার জন্যেই নিশ্চয়ই এখানে বন্দী ক’রে আনেনি। আর—কোথায় গেছে রবার্ট গ্রান্ট—আর সেই সঙ্গে, ঐ আধপাগলা ফরাশি পণ্ডিত—জাক পাঞয়ল? তাদের কি এর মধ্যেই বধ্যভূমিতে নিয়ে গেছে এরা? কোথায় তাহ’লে সেই বধ্যভূমি?
এইসব বিদঘুটে সব ভাবনায় তাঁর মাথার মধ্যেটা কেমন যেন অস্থির হ’য়ে উঠতে চাচ্ছে। ছটফট ক’রেই কেটেছে সারা রাত—কিন্তু রবার্ট আর জাক পাঞয়লের কী হ’লো, সেটা জানবার কোনো উপায় খুঁজে পাননি মেজর ম্যাকন্যাব্স—বাইরে যে সশস্ত্র যোদ্ধার দল পাহারা দিচ্ছে, তারা হয়তো জানে ঐ দুজনের হদিশ—কিন্তু তাদের জিগেস করবার কোনো সুযোগ হয়নি—কেননা তারা কখনও এমনকী এই বন্দীশালার দরজার কাছেও আসেনি।
অথচ সময় যখন থেমে গেছে ব’লে মনে হচ্ছে, তখনও একসময় ভোর হ’য়ে এলো। মাওরিদের দিক থেকে তবু কোনো সাড়া এলো না। সারাদিন কাটলো সেই অস্থির জিজ্ঞাসায় কী করতে চাচ্ছে এরা, তাঁদের বন্দী করে রেখে? যদি দেবতার কাছে বলি দেবে ব’লেই ঠিক করে থাকে, তাহলে তাদের আর খোঁজখবর নিচ্ছে না কেন? পুরুরা কি কোনো বিশেষ লগ্নের অপেক্ষায় আছে এখন? তারা কি এমন-কোনো বিশেষ ক্ষণের অপেক্ষা করছে, যখন এই-যারা তাদের অমঙ্গল ডেকে এনেছে, তাদের মহাধুমধাম ক’রে বলি দিলে দেবতারা আর রুষ্ট হবেন না? না কি বন্দী-বিনিময়ের ভাবনাটাই কাই-কুমু এখন বাতিল করে দিয়েছে?
নিজেদের মধ্যে কথা বলতেও ইচ্ছে হচ্ছিলো না। মেজর ম্যাকন্যাব্সের শুধু মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছিলো, কারা-টিটিকে হত্যা ক’রে লর্ড গ্লেনারভন বোধকরি কাই-কুমুর শত্রুকেই উৎপাটিত করেছেন—তার হয়তো মনে হয়েছে যে সে কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলেছে, যে-প্রতিদ্বন্দ্বীকে সে তার পথ থেকে সরাতে চাচ্ছিলো, তাকে হত্যা ক’রে লর্ড গ্লেনারভন হয়তো তার সাহায্যই করেছেন?
পর-পর তিন দিন বাইরে শয়ান রইলো কারা-টিটির মৃতদেহ, প্রায় রাজকীয় শোকপালনের মতোই যেন ব্যাপারটা। তারপরে তারা তার অন্ত্যোষ্টি সারবে, আর তখনই নিশ্চয়ই বন্দীদের সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেবে। অন্তত তিনদিন পরে যখন বন্দীশালার দরজা খুলে দেয়া হ’লো, তা-ই মনে হ’লো মেজর ম্যাকন্যাব্সের : এবার একটা-কিছু ফয়সালা হবে। কারণ নগরদুর্গের বড়ো চটকায় জড়ো হয়েছে কয়েকশো মাওরি নারীপুরুষ—আবালবৃদ্ধবনিতা—কিন্তু তারা কেমন থম মেরে আছে, অস্বাভাবিক শান্ত, যেন ঠিক ঝড়ের আগেকার আকাশ-বাতাস।
কাই- -কুমু এসে উঠে দাঁড়িয়েছে একটা ছোট্ট ঢিবির ওপর। তার পেছনে চাঁদের কলার মতো অর্ধবৃত্তাকারে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন মাওরি যোদ্ধা। আর পাহারারা এসে বন্দীদের নিয়ে গেলো কাই-কুমুর সামনে।
বন্দীরা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, গম্ভীর গলায় লর্ড গ্লেনারভনকে জিগেস করলে কাই-কুমু : ‘কারা-টিটিকে তুমি হত্যা করেছো?’
এমন প্রশ্নের উত্তর কী হয়? ‘হ্যাঁ।’
‘কাল সকালে সূর্যোদয়ের সময় তোমার মরণ হবে।’
‘শুধু আমার?’
‘শুধু তোমার। অন্যরা থাকবে, তোহোনগাকে ফিরিয়ে আনবার জন্যে তাদের চাই—বদলাবদলির জন্যে দরকার হবে।’
ঠিক এমন সময়ে একটা উত্তেজিত কোলাহল উঠলো জমায়েতের একপ্রান্তে। দেখা গেলো, দ্রুতপায়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে একজন যোদ্ধা, তার সারা-গা ধূলিধূসর মুখে প্রচণ্ড ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু কোন-এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় সে তবু এগিয়েও আসছে এইদিকেই।
তাকে দেখেই কাই-কুমু কেমন যেন উদ্বিগ্ন হ’য়ে উঠলো। বন্দীরা যাতে বুঝতে পারে, সম্ভবত সেইজন্যেই পরিষ্কার ইংরেজিতে জিগেস করলে : ‘পাকিহাসের (শ্বেতাঙ্গদের) শিবির থেকে আসছো?’
সে শুধু ঘাড় নেড়ে জানালে, ‘হ্যাঁ।’
‘এখনও কি তোহোনগা সেখানে আছে? তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?’
‘দেখেছিলাম একবার, যখন ইংরেজরা তাকে একটা খুঁটির গায়ে বেঁধে গুলি করে মেরে ফেললো!’
এইই তবে শেষ! ফায়ারিংস্কোয়াডের গুলিতে তোহোনগার এই মৃত্যু বন্দী বিনিময়ের সমস্ত চেষ্টাকেই যেন বিষম উপহাস করে একধাক্কায় ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
ঘুরে দাঁড়ালে কাই-কুমু। ‘কাল সকালে সূর্য ওঠবার সময়,’ খুব শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে সে বললে, ‘তোমাদের প্রত্যেককে মরতে হবে।’
ব’লেই সে আবার ব্যস্ত হ’য়ে পড়লো। তার নিজের ভাষায় সে অনুচরদের দিকে ফিরে হুকুম দিলে কারা-টিটির অন্ত্যোষ্টির—আর অমনি জমায়েতের মধ্য থেকে উঠলো হাহাকারের রোল—বুক চাপড়ে টেনে-টেনে সুর করে কাঁদতে লাগলো মাওরিরা।
আসলে এই অপঘাতমৃত্যু তো শুধু কারা-টিটির নয়—তার সঙ্গে-সঙ্গে এখন পরলোকে যেতে হবে তার স্ত্রীকেও–কেননা মৃত্যুর পরপারে গিয়েও তাকে সঙ্গ দিতে হবে তার স্বামীকে, যাতে সে একা-একা হন্যে হ’য়ে প্রেতলোক থেকে ফিরে এসে পুরো পাহ্-র ওপর হানা না-দেয়। বেঁচে থাকবার সময় কারা-টিটি যেভাবে জীবনযাপন করতো, মৃত্যুর পরেও সে যাতে সেইভাবেই তার দিন কাটাতে পারে, সেইজন্যেই শুধু তার স্ত্রীকেই নয়, যারা তার সেবা করতো সেই অনুচর-পরিচরদেও এবার মৃত্যুর পরপারে যেতে হবে তাকে সঙ্গ দেবার জন্যে। আর এরা যাতে মৃত্যুর জন্যে তৈরি হ’তে পারে সেইজন্যেই কারা-টিটির মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা করতে এই তিনটে দিন গেছে। অর্থাৎ, মরা নেতার যাতে সেবার কোনো ত্রুটি না-হয়, সেইজন্যে মরতে হবে অন্যমানুষদেরও। বহুযুগের ওপার থেকে এই-যে অনড় এবং অমোঘ নিয়ম চ’লে আসছে, এটা সমাজের সবাই জানে : এই ব্যবস্থাই তো চ’লে আসছে যুগ থেকে যুগে, স্মরণাতীত কাল থেকে। এই নিয়ম যে কখনও বাতিল ক’রে দেয়া যায়, এটা কখনোই কারু মাথায় আসে না—সবাইকে বরং বিনাপ্রতিবাদে মেনে নিতে হয় এই মৃত্যু—এবং যারা মরবে তাদের ঘিরে বেজে ওঠে ডুকরে-ওঠা হাহাকার; কিন্তু এই হাহাকার বোধহয় যারা এখন মরবে, তাদের জন্যে নয়, বরং যে আগেই ম’রে গিয়েছে, তার জন্যে। মাঙ্গাপোহি পাহাড়ের চূড়ায়, এখান থেকে দূরে, তৈরি হয়েছে সমাধিভবন—তার চারপাশে লালরং-করা সারি-সারি খুঁটি বসানো—একটা চৌখোপ মতো—সেখানে নিয়ে-যাওয়া হবে স্বামী-স্ত্রীর মৃতদেহ, সঙ্গে তাদের সেবকদের প্রাণহীন দেহও যাবে—সেখানে এরই মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রেতাত্মাদের তৃপ্তির জন্যে খাদ্য ও পানীয়, আর চারপাশে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র, বাসনকোসন, গয়নাগাটি আর সাজগোজের আয়োজন—যাতে কোনোরকম কষ্টই না-হয় এই মৃতদের। আর একবার সেখানে তাদের রেখে আসার পর ঐ লাল খুঁটি দিয়ে ঘেরা জায়গায় আর-কারু যাবার অধিকার থাকবে না—এটা তখন হ’য়ে যাবে কারা-টিটির জায়গা, বাকিদের কাছে এ-জায়গা হবে নিষিদ্ধ, সেখানে অনধিকার প্রবেশ ক’রে মৃতের শান্তিভঙ্গ করার কথা এমনকী দুঃস্বপ্নেও আর-কারু মনে হবে না, এ-জায়গাটা অন্যদের কাছে ট্যাবু হয়ে যাবে, অমঙ্গলের অকুস্থল—কেননা যে-ই এখানে পা দেবে তারই কাঁধে বসবে প্রেতাত্মা—আর গোটা গোষ্ঠীর জীবনই তাতে বিপন্ন হ’য়ে উঠবে।
যখন শোভাযাত্রা ক’রে মৃতদেহ নিয়ে-যাওয়া হ’লো ঐ লাল খুঁটিতে ঘেরা প্রেতভবনে, বন্দীদের ফের ফিরিয়ে আনা হ’লো মন্দিরের সেই বন্দীশালায়। পরদিন মাঙ্গাকিনোর ওপর সূর্যের প্রথম আলো পড়বার সঙ্গে-সঙ্গেই বন্দীদের নিয়ে-যাওয়া হবে বধ্যভূমিতে। মাত্র একটা রাত, তারপরেই সব শেষ হ’য়ে যাবে।
এরই মধ্যে তাঁদের জন্যে বন্দীশালায় খাদ্য ও পানীয় রেখে গেছে প্রহরীরা। নিঃশব্দে সবাই তাঁদের শেষ পানভোজন শেষ করলেন—কারু মুখে টু শব্দটি নেই, কে যে কী ভাবছে কেউ জানে না; সত্যি-তো, কী ভাবে লোকে, যখন জানে আর কয়েক ঘন্টা বাদেই অমোঘ মৃত্যু এসে হানা দেবে? কিশোরী মেরি গ্রান্ট কী ভাবছে এখন; কাপ্তেন জন ম্যাঙ্গসের সঙ্গে তার যে মন-দেয়া-নেয়ার পালা শুরু হয়েছিলো এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায়, তার যে পরিণাম এমন হবে, সে কি কখনও তা স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলো—ব্যর্থ, বিফল, অপূর্ণ! আর লেডি হেলেনা ও লর্ড গ্লেনারভন—তাঁরা সবে তাঁদের প্রমোদতরী তৈরি ক’রে মহড়া দিতে বেরিয়েছিলেন সমুদ্রে, আর হঠাৎ একটা হাঙরের পেট থেকে বেরিয়ে পড়লো একটা বোতল—আর জলে-ধুয়ে-যাওয়া তিনটে চিরকুট! আর সেটাই যেন ছিলো নিয়তির ডাক—এত-পথ তাঁদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে শেষটায় এনে হাজির করেছে এই কোন বিদেশ-বিভুঁইয়ে, ঠিক মৃত্যুর আগের রাতটায়! বেচারি রবার্ট গ্রান্ট—ভেবেছিল কাপ্তেন গ্রান্টের মতোই জাহাজ চালাবে, সে এমনকী জাহাজ চালাবার ঘাতঘোঁৎ এখনও শিখে উঠতেই পারেনি, যতই কেননা তার থাক দুর্মর অধ্যবসায় আর দুর্জয় উৎসাহ! আর কাপ্তেন জন ম্যাঙ্গল্স—সদ্য একটা চমৎকার স্টিমশিপের পূর্ণদায়িত্ব পেয়েছিলেন—আর মনে হয়েছিলো এই বুঝি তাঁর জীবনে সুদিন সবেমাত্র শুরু হ’লো, কেননা প্রায়-তৎক্ষণাৎ তাঁর পরিচয়—আর ঘনিষ্ঠতাও—হ’লো তরুণী মেরি গ্রান্টের সঙ্গে—কিন্তু সব পথ এসে শেষকালে শেষ হ’য়ে গেলো এই মৃত্যুপুরীতে! মেজর ম্যাকন্যাব্স—তাঁর এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে কমবার তো মুখোমুখি হয়নি মৃত্যুর—কিন্তু তিনিও কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন এমনিভাবে একদিন মৃত্যু তার ভয়াল চোখ মেলে তাঁর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকবে?
চারদিন আগে লাঞ্ছনার ভয়ে নিজের জামার মধ্যে লুকোনো রিভলভারটা লর্ড গ্লেনারভনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন লেডি হেলেনা, ‘যদি দ্যাখো আমার ইজ্জতে টান পড়েছে, আমাকে গুলি ক’রে মারতে দ্বিধা কোরো না,’ বলেছিলেন এইরকম কোনো কথা, এখন সেই রিভলভার কেড়ে নিয়ে গেছে মাওরিরা—কারা-টিটিকে গুলি করার পর। এখন আর-কোনো অস্ত্রই নেই তাঁদের হাতে। না কি আছে আর কোনো শেষঅস্ত্র?
গ্লেনারভন চাপাগলায় জন ম্যাঙ্গল্সকে জিগেস করলেন : ‘জন, মেরি তোমাকে যা বলেছে, সেটা তুমি করতে পারবে তো? হাত কাঁপবে না তো?
‘নিশ্চয়ই,’ব’লেই জামার ভেতর থেকে একটা ছোরা বার ক’রে দেখালেন কাপ্তেন, ‘আপনি কারা-টিটিকে গুলি করবামাত্র যে-হুলুস্থুলু বেঁধে গিয়েছিলো, সেই সুযোগে আমি কোমর থেকে ছুরিটা টেনে নিয়েছিলুম।’
মেজর ম্যাকন্যাব্স শান্তগলায় শুধু বললেন, ‘দুম করে হঠাৎ কিছু ক’রে-বসা ঠিক হবে না।’
লর্ড গ্লেনারভন দৃঢ়ভাবে বললেন : ‘আমরা তো সবাই মরতেই বসেছি—তাহলে মিথ্যে আর মরণকে অত ভয় পাবো কেন? কিন্তু মৃত্যুর বাড়াও একটা জিনিশ আছে—সেটা কারু ইজ্জৎ, মানসম্মান—তাতে কোনো আঁচড় পড়ুক, তা আমি চাই না।
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স উঠে গেলেন একবার, দরজায় মাদুরের পল্লা ঝোলানো, সেটার একটা কোণা তুলে উঁকি দিলেন বাইরে। দূরে, ঘন অন্ধকারের মধ্যে একটা আগুনের কুণ্ড জ্বলছে। তার পাশ থেকেই জনা পঁচিশ সশস্ত্র প্রহরা কড়ানজর রেখে যাচ্ছে এইদিকে। সেখান থেকে সরু-একটা পথ পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে এসেছে দরজাটা অব্দি—সজাগ পাহারার চোখ এড়িয়ে এ-পথ দিয়ে দু-পাও যাওয়া যাবে না। এছাড়া এই বন্দীশালার দু-পাশ দিয়ে নেমে গেছে গভীর খাদ, কম ক’রেও একশোফিট গভীর খাদ—পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে সোজা, খাড়াই সরাসরি ঘন অন্ধকারের মধ্যে—সেখান দিয়ে বেয়ে পালাতে পারবে শুধু-কোনো সরীসৃপ, আর-কেউ নয়। অর্থাৎ : পালাবার কোনো রাস্তা নেই কোথাও।
আকাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঘন মেঘে ঢাকা পড়েছে চাঁদ আর তারারা, কেমন যেন থমথম করছে সব, শুধু উদ্দাম হাওয়ার ঝাপটা আসছে মাঝে-মাঝে, আর দপদপ ক’রে লাফিয়ে উঠছে আগুনের শিখা। অমনি চোখে প’ড়ে যাচ্ছে পাহারাদের, কেউ ব’সে কেউ-বা দাঁড়িয়ে, তাদের কারু চোখে ঘুম নেই।
ঘুমকে অবশ্য বিদায় দিয়েছেন বন্দীরাও, সেইসঙ্গে বিদায় নিয়েছে কথা, হয়তো এখন আর চিন্তারও কোনো অবকাশ নেই কারু মনের মধ্যে—বুকের মধ্যেটা কি-রকম ফাঁকা লাগছে, যেন যেখানে হৃৎপিণ্ড ছিলো সেখানে শুধু ফাঁকা-একটা গহ্বরের মধ্যে ধুপ-ধাপ শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই।
আর কখন যে এরই মধ্যে রাত চারটে বেজে গেছে কারু খেয়াল ছিলো না। হঠাৎ অন্যমনস্ক মেজরের কানে কি-রকম অস্পষ্ট একটা আওয়াজ এসে পৌঁছুলো। উৎকর্ণ হ’য়ে শুনলেন মেজর-আওয়াজটা যেন আসছে বন্দীশালার পেছন দিক থেকে। কীসের আওয়াজ ওটা? কেউ যেন মাটি আঁচড়াচ্ছে। না-না, কেউ বোধহয় মাটি খুঁড়তে চাচ্ছে।
নিঃশব্দে মেজর ম্যাকন্যাব্স উঠে গেলে লর্ড গ্লেনারভন আর জন ম্যাঙ্গসের কাছে। ঝুঁকে, চাপাগলায়, প্রায় ফিশফিশ ক’রেই যেন বললেন, ‘ঐ শোনো!’
আওয়াজটা যেন ক্রমশই স্পষ্ট হ’য়ে উঠেছে। কেউ যেন কোনো ধারালো যন্ত্রের ঘায়ে মাটি খসিয়ে দিচ্ছে—একটা খশখশ শব্দ হচ্ছে, আর ঝুরঝুর করে গুঁড়োমাটি ঝ’রে প’ড়ে যাচ্ছে।
কেউ নিশ্চয় বাইরে থেকে গর্ত খুঁড়ে এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে! তক্ষুনি এদিক থেকেও হাত লাগিয়ে দিলেন এঁরা। ছোরা আছে একটাই, সেটা কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের কাছে, কিন্তু তার জন্যে যেন আর তর সইছিলো না -আর-কিছু না-থাকে তো আঙুল তো আছে, আঙুলে তো নখ আছে এরই মধ্যে একবার মাদুরের পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে এলো মুলারাডি। না, প্রহরীরা কিছু টের পায়নি। তারা সজাগ কিন্তু নিশ্চিন্ত ব’সে আছে এখন-নিভুনিভু ঐ আগুনের কুণ্ডটা ঘিরে।
এদিকে আওয়াজটা এখন আগের চাইতে অনেক জোরালো হয়ে উঠেছে। নিশ্চয়ই কেউ একটা ফাঁকফোকর তৈরি করতে চাচ্ছে দেয়ালে। কিন্তু কেন? মতলব কী তার? সে কি কোনো অজ্ঞাত বন্ধু? শত্রুই যদি হবে, মাওরিদেরই কেউ, তাহ’লে সে খামকা কেন এভাবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইবে?
এ-কথা ভাবামাত্র পাঁচজোড়া হাত চললো দুনো উৎসাহে ভর দিয়ে। নখের ডগা ভেঙে গেলো, রক্ত ঝরতে লাগলো, বিশ্রীরকম ব্যথা করছে, কিন্তু তবু কারু মধ্যে দ’মে যাবার কোনো লক্ষণ নেই। প্রায় হাত-তিনেক গর্ত হ’য়ে যাবার পর হঠাৎ ধারালো একটা-কিছুতে হাত কেটে গেলো মেজর ম্যাকন্যাব্সের। অস্ফুট আর্তনাদটা গিলে ফেলে ম্যাক্ন্যাস একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে হাতটা সরিয়ে আনলেন
আর অমনি দেয়ালের গায়ের ফোকর দিয়ে বেরিয়ে এলো ছুরি-সমেত একটা হাত কিছু না-ভেবেই তক্ষুনি কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স শক্ত ক’রে চেপে ধরেছেন মণিবন্ধটা, আর কব্জিতে চাপ পড়তেই ছুরিটা মুঠো থেকে খসে প’ড়ে গেল। কিন্তু হাতটা কার? এ তো কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের চওড়া ও কঠিন মণিবন্ধ নয়। কোনো মেয়ের? কোনো অল্পবয়সি ছেলের? কিন্তু যারই হাত হোক না কেন—এটা কোনো মাওরি হাত নয়, একজন শ্বেতাঙ্গের হাত।
নিচু গলায় অনুমানটা উচ্চারণ ক’রেই ফেললেন লর্ড গ্লেনারভন : ‘রবার্ট!‘
এইসব অর্ধস্ফুট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো লেডি হেলেনার। মেরি নামটা শুনেই প্রায় যেন ছিটকে চ’লে এলো ফোকরটার কাছে, সরু মণিবন্ধটা চেপে ধরে কম্পিত বিহ্বল স্বরে বলে উঠলো : ‘রবার্ট! রবার্ট!’
ফোকরটার মধ্যে দিয়ে ভেসে এলো রবার্টের গলা : ‘হ্যাঁ, আমি সব্বাইকে উদ্ধার ক’রে নিয়ে যেতে এসেছি।’
‘ছেলেটা দেখছি বেপরোয়া—একটুও ভয়ডর নেই,’ গ্লেনারভন ব’লে উঠেছেন তখন।
ওধার থেকে নিচুগলায় আওয়াজ এলো : ‘আগে দেখে নিন—ওখানে পাহারারা কী করছে?’
মুলারাডি জানালে, ‘শুধু চারজন দাঁড়িয়ে আছে—বাকিরা বোধহয় ব’সে-ব’সে ঢুলছে।’
এদিকে কিন্তু সেই গর্তের মুখটা বড়ো ও সুপরিসর করার কাজ অবিশ্রাম চলেছে। আর তারপরেই তার মধ্যে দিয়ে বুকে হেঁটে ভেতরে গ’লে এলো রবার্ট। সারা গায়ে জড়ানো ঐ শনের দড়ি—যে-শন দিয়ে সব কাজই সারে মাওরিরা।
‘কেমন ক’রে পালিয়েছিলি তুই,’এতক্ষণে আবেগবিহ্বল মেরির মুখে বুলি ফুটেছে।
‘ঐ যখন হুলুস্থূল প’ড়ে গেলো—কারা-টিটি ম’রে যেতেই—কেউ কি তখন আর অন্য কোনোদিকে তাকাচ্ছিলো নাকি? দু-দিন দু-রাত জঙ্গলের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়েছিলুম, তারপর মাওরিরা যখন অন্ত্যোষ্টির জন্যে দলে-দলে নিজেদের কুঁড়ে ছেড়ে বেরিয়ে গেলো, তখন ফাঁকা-একটা কুঁড়েঘরের মধ্য থেকে এই দড়ি আর ছোরা নিয়ে এসেছি তোদের নিয়ে যেতে। বুনো আগাছার চাপড়া আর কাঁটাগাছের ঝোপ ধীরে ওপরে বেয়ে উঠেছি কোনোরকমে—তারপর বেশ খানিকটা উঠে আসার পর একটা পইঠার মতো পেয়ে গেলুম—ধস নেমে একটা জায়গা বেশ-একটা সিঁড়ির ধাপের মতো হ’য়ে উঠেছে। তারপর ছোরার ঘায়ে মাটি খসাতে-খসাতে—এই-তো, আমি এখন তোদের কাছে এসে হাজির। চল, আর দেরি নয়। দিন হবার আগেই আমাদের কেটে পড়তে হবে।’
‘মঁসিয় পাঞয়ল বুঝি নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন?’ গ্লেনারভন জিগেস করলেন।
এবার করিৎকর্মা রবার্টের একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবার পালা। ‘কই—না তো?’
‘মঁসিয় পাঞয়ল তোমার সঙ্গে পালাননি? ‘
‘না। আমি তো ভেবেছি উনিও আপনাদের সঙ্গেই বন্দী হ’য়ে আছেন।’
আরো হয়তো কথা চলতো, কিন্তু মেজর ম্যাকন্যা তাড়া লাগিয়েছে তখন—’মঁসিয় পাঞয়লের কথা পরে বরং ভেবে দেখা যাবে। এখন চটপট এখান থেকে আমাদের স’রে-পড়া উচিত?’
ঐ গর্তটা দিয়ে কোনোরকমে শরীরটা গলিয়ে নিয়ে এক-এক করে সবাই নেমে এলেন পাহাড়ের গায়ে ধস নেমে-গ’ড়ে ওঠা সেই খাঁজটায়-রবার্ট যেটাকে সিঁড়ির ধাপ ব’লে বর্ণনা করেছিলো। তারপরেই কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স একটা তেরচামতো প্রকাণ্ড পাথরের গায়ে বেঁধে দিয়েছেন দড়ি। ঐ দড়ি বেয়েই নেমে যেতে হবে নিচে, খুব সাবধানে, একটু ফসকালেই নিচে খাদে পড়ে যেতে হবে।
সবচাইতে আগে নেমে গেলো রবার্ট—দড়ি ধ’রে ঝুলতে সে ওস্তাদ, কতবার ডানকানের মাস্তুলের দড়ি বেয়ে বেয়ে সে ওঠানামা করেছে। তারপর একে-একে নামলেন ম্যালকম কালের তরুণ দম্পতি—লর্ড গ্লেনারভন ও তাঁর স্ত্রী। আর লেডি হেলেনার পা বোধহয় একটু বেকাদায় পড়েছিলো পাহাড়ের ঢালে—কতকগুলো আলগা নুড়িপাথর বেশ শব্দ ক’রেই খ’সে পড়লো নিচে।
অমনি ওপর থেকে নিচুগলায় ‘শশ!’ বলে সাবধান ক’রে দিলেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স। গ্লেনারভনরা তখনও পুরো নেমে যেতে পারেননি, দড়ি ধ’রেই তাঁরা শূন্যে ঝুলতে লাগলেন।
উইলসন তখনও পাহারায় ছিলো বন্দীশালার মাদুরের পাশে। সে দেখতে পেলে, ঐ পাথর খ’সে-পড়ার আওয়াজ শুনে পাহারাদের একজন এদিকে চলে আসছে ব্যাপার কী দেখতে, আর অমনি সে সাবধান করে দিয়েছে কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্সকে। মাওরিটি কিন্তু বন্দীশালার দরজার কাছে এসেও ভেতরে ঢোকেনি বা মাদুরের পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে মাথা গলায়নি—হয়তো তার সেই অধিকার ছিলো না। সে একটুক্ষণ চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে কানখাড়া ক’রে রইলো, কিন্তু আর-কোনো সন্দেহজনক আওয়াজ না-শুনে সে আবার আগুনের কুণ্ডের দিকেই ফিরে গেলো।
উইলসন হালকা একটা শিস দিয়ে জানালে, রাস্তা সাফ, অমনি কাপ্তেন ম্যাঙ্গস সবাইকে জানালেন সাবধানে নিচে নেমে যেতে, খুব হুঁশিয়ার, ও-রকম শব্দ যেন আর না-হয়।
তারপর নেমে এলেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স নিজে, মেরিকে নিয়ে, এবং তারপর এক-এক ক’রে বাকি সবাই।
এবং সবাই নেমে আসতেই আর দেরি নয়। সবাই খুব-সন্তর্পণে প্রেতপাহাড়ের দিকে চললেন। পা টিপে টিপে, চুপি-চুপি, প্রাণ হাতে ক’রে—একটুও শব্দ যেন না-হয়, অথচ যত-তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে। আর একটু পরেই দিনের আলো ফুটবে—আর তারপরেই ফাঁস হ’য়ে যাবে বন্দীশালায় কেউ নেই, বরং পেছনের দেয়ালে একটা গর্ত—যেটা দেখে সবচেয়ে আকাট বোকারও বুঝতে অসুবিধে হবে না বন্দীরা কোন পথ দিয়ে পালিয়েছেন।
আর তারপরেই উঠে এলো সূর্য!
আর অমনি চারপাশে খ্যাপা কোলাহল, চীৎকার, চ্যাঁচামেচি, হুলুস্থূল!
পুরো পাহাড়টাই যেন ঘুম ভেঙে ধড়মড় ক’রে উঠে পড়েছে। আর তাঁদের পেছনে
হৈ-হৈ ক’রে ছুটে চ’লে আসছে মাওরিরা, হন্যে, ক্ষিপ্র, সশস্ত্র।
এবার আর গোপনে গাঢাকা দিয়ে চলা নয়—প্রাণ হাতে করে ছোটা।
আরো অন্তত শ-খানেক ফিট উঠে গেলে, পাহাড়ের চুড়োয় পৌঁছুনো যাবে, তারপর ছুটে নামতে হবে অন্যদিকের ঢালটা বেয়ে। কোথায় যাবে—কারু জানা নেই। কিন্তু যে-ক’রেই হোক, এখন এদের নাগাল থেকে পালাতে হবে। এবার এদের কবলে পড়লে শুধু-যে মৃত্যুই অবধারিত তা নয়—নিশ্চয় তার আগে নৃশংসভাবে তাদের নির্যাতন করবে মাওরিরা। হাতের শিকার এভাবে পালিয়ে গেলে কেউই খুব-একটা খুশি হয় না। পেছনের রে-রে চীৎকার আর হৈ-হৈ হাঁকডাক ক্ৰমেই কাছে এগিয়ে আসছে। আরো জোরে না-ছুটলে প্রায় ধ’রেই ফেলবে তাঁদের।
‘চলো, চলো, পেছনে তাকিয়ো না, সোজা ছোটো সামনে।’লর্ড গ্লেনারভন কেবল তাতাচ্ছে সহযাত্রীদের। অনবরত কথা ব’লে তিনি যেন নিজের ভেতরকার সব শঙ্কাকেও দূর ক’রে দিতে চাচ্ছেন।
হাঁফাতে-হাঁফাতে যখন গিরিশিখরে পৌঁছুলেন সকলে, শুধু তখনই মনে হ’লো পেছন ফিরে তাকিয়ে একঝলক দ্যাখেন, যারা তাঁদের তাড়া করে আসছে, তারা এখন কতদূরে আছে।মাওরিদের তখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—দু-দলের ব্যবধান তখন পাঁচশো ফিটও হবে কি না সন্দেহ। আরেকটু পরেই নিশ্চয়ই তারা নাগাল ধ’রে ফেলবে। এক্ষুনি যদি শিখর থেকে অন্যদিকে নেমে না-আসেন, তাহলে আর রক্ষে নেই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অন্যদিকে নেমে গেলেও যে নিস্তার আছে তা হয়তো নয়, কিন্তু এই উঁচু থেকে নিচে দেখা যাচ্ছে, রোদ প’ড়ে ঝিকিয়ে উঠেছে তাওপো হ্রদের স্বচ্ছনীল জল। ডানদিকে দূরে টোনগারিরো পাহাড়ের জ্বালামুখ থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, কিন্তু পুবদিকে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াইহিতির ছোটো-বড়ো শিখরগুলো–হয়তো ঐ দিকেই কোনো ছোটো শুঁড়িপথ পাওয়া যাবে কোথাও!
আবার তাড়া লাগালেন লর্ড গ্লেনারভন, ‘চলো! চলো! ছুটে নামো—আর একফোঁটাও সময় নেই!’
ক্লান্তিতে তখন সকলের হাঁটুর জোড়া যেন খুলে আসতে চাচ্ছে। এমনভাবে পাহাড় বেয়ে ছুটে ওঠা বা নামার অভ্যাস নেই কারু—শেষটায় এতটা পালিয়ে এসেও ধরা প’ড়ে যেতে হবে কাই-কুমুর লোকজনদের হাতে!
ছুটে নামতে যাবেন, হঠাৎ বাধা দিলেন মেজর ম্যাকন্যাব্স, ‘থামো! আর বোধহয় প্রাণ হাতে করে ছুটতে হবে না আমাদের। ঐ দ্যাখো, কী-রকম অদ্ভুতভাবে থমকে পড়েছে মাওরিরা! আশ্চর্য! ওরা আর তাড়া করে আসছে না কেন?
আশ্চর্যই বটে। যেন আচমকা একটা অদৃশ্য দেয়ালে এসে ধাক্কা খেয়েছে কাই-কুমুর দলবল। দূরে দাঁড়িয়েই তারা চ্যাঁচাচ্ছে, নানারকম উৎকট অঙ্গভঙ্গি করছে, কিন্তু একপাও এগুচ্ছে না কেউ! সে-কার অদেখা হাত তার অঙ্গুলিহেলনে মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছে তাদের? সে-কোন মন্ত্রবলে পায়ে শিকড় গজিয়ে তারা থমকে থেমে পড়েছে পাঁচশো ফিট দূরে?
হঠাৎ অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠেছেন জন ম্যাঙ্গল্স, সামনেই চূড়ার পাশে কী-একটা যেন দেখাচ্ছে তাঁর হাত!
মাত্র কয়েক পা দূরে, সারি-সারি লাল-লাল খুঁটি ঘিরে আছে একটা ছোটো কুঁড়ে।
দেখেই লাফিয়ে উঠলো রবার্ট : ‘কারা-টিটির সমাধিভবন!’
‘তা-ই বুঝি?’ জানতে চেয়েছে লর্ড গ্লেনারভন।
‘হ্যাঁ, কারা-টিটিরই সমাধিভবন! দু-দিন জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে থেকে আমি সব খেয়াল ক’রে দেখেছি। দেখেছি, অন্ত্যোষ্টির সময় ওরা কোনদিকে ব’য়ে নিয়ে যাচ্ছিলো মৃতদেহগুলো—’
না, কোনোই ভুল হয়নি রবার্টের। তাঁরা যে কখন প্রাণ নিয়ে ছোটবার সময় এই সমাধিভবনের দিকেই হুড়মুড় ক’রে এগিয়ে এসেছেন, সেটা কেউ এতক্ষণ খেয়ালই করেননি।
আর মৃতের এই আবাসই তাঁদের বাঁচিয়ে দিয়েছে।
এই পাহাড় এখন নিষিদ্ধ অঞ্চল মাওরিদের কাছে—ট্যাবু—অমঙ্গলভূমি। প্ৰাণ গেলেও তারা আর এদিকে এগুবে না। কারণ এটা এখন প্রেতাত্মার আবাস— সদ্য তারা এখানে রেখে গেছে কারা-টিটিকে। তার ক্ষুধিত প্রেতাত্মা এখনও শান্ত হয়নি—পুরো অঞ্চলটা এখন তার দখলে। এখানে তার দলের কারু আসারই অধিকার নেই আর। কেউ যদি ভুল করেও এদিকটায় পা দেয়, তবে তার যা পাপ হবে, তাতে সবাই শুদ্ধু মরবে, সর্বনাশ হ’য়ে যাবে কারা-টিটির গোষ্ঠীর। হয়তো প্রকৃতি গা ঝাড়া দেবে আচম্বিতে, হয়তো জ্বালমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে আগুনের হলকা আর তরল লাভা! কার সাধ্যি, এখন এই অমঙ্গলের গণ্ডি পেরিয়ে আসে!
আর তাদের জন্মজন্মান্তরের বিশ্বাস, তাদের রীতিনীতিসংস্কার, ট্যাবু সম্বন্ধে তাদের আতঙ্ক—সব মিলিয়ে এখন বাঁচিয়ে দিয়েছে পলাতকদের। অন্তত এই জায়গাটায় আপাতত মাওরিরা কেউ আর আসবে না।
সমাধিভবনের দিকে এগুতে গিয়েও, এবার যেন কোন-এক আতঙ্কের হ্যাঁচকা টানে, থমকে পেছিয়ে এলেন পলাতকেরাই।
ঐ-তো, কে-একজন ব’সে আছে সমাধিভবনে।
মাওরিরা তবে কি আজকাল আর ট্যাবু মানে না? নিষিদ্ধ ভূমিতেও পা দেয়? না কি কেউ-একজন বেপরোয়া স্পর্ধায় অস্বীকার ক’রে বসেছে তার জাতির বিশ্বাস? মেজর ম্যাকন্যাব্সের যেন বাক্স্ফূৰ্তি হ’তে চাচ্ছিলো না : ‘প্রেতের বাসায়ও জ্যান্ত মানুষ? অসম্ভব!’
‘অসম্ভব নয়—ঐ দ্যাখো—সত্যি—’
ভেতরটা অন্ধকারে ঢাকা। কিন্তু তারই মধ্যে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে কে-একজন মাওরিদের ঐ লাল-কালো ঢোলা জামার গা-মাথা মুড়ে ব’সে আছে—শুধু-যে ব’সে আছে তা-ই নয়–ব’সে-ব’সে একমনে কী যেন খাচ্ছে। কোনোদিকেই তার কোনো দৃকপাত নেই। আপাতত যেন ক্ষুন্নিবৃত্তির এই প্রক্রিয়াটা ছাড়া আর-কিছুই সে জানে না।
লর্ড গ্লেনারভন কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মুখের কথাটা তাঁকে তক্ষুনি খপ ক’রে গিলে ফেলতে হ’লো। সেই লাল-কালো জামায় আপাদমস্তক মোড়া লোকটা হাত নেড়ে তাঁদেরই ডাকছে, উচ্চারণে তার বিদেশীর গলার সুর, কিন্তু ইংরেজিভাষাটা স্পষ্ট, পরিষ্কার, প্রাঞ্জল :
‘ব’সে পড়ুন, লর্ড গ্লেনারভন। ছোটোহাজরি তৈরি—চটপট ডান হাতের কাজ শুরু ক’রে দিন।’
গলার সুর শুনে চিনতে কারুই ভুল হ’লো না।
মঁসিয় পাঞয়ল!
আপনি এখানে। কিন্তু মাওরিরা কোথায়?’
‘মাওরিরা আবার কোথায় থাকবে—যেখানে ছিলো, সেখানেই আছে! এ-জায়গাটা ওদের কাছে নিষিদ্ধ না? ট্যাবু না? এখানে তো অমঙ্গল ওৎ পেতে আছে!’
সত্যি, পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখা গেলো, মাওরিরা সেই অদৃশ্য গণ্ডির কাছে এসে তেমনি থমকে দাঁড়িয়ে আছে—হাত-পা নাড়ছে, উৎকট নাচ জুড়ে দিয়েছে, চীৎকারও করছে—কিন্তু একপাও আর এগোয়নি।
‘কিন্তু নিষিদ্ধ কেন? কালকেই তো এখানে এসেছিলো!’
‘আর তাইতেই তো গোল বাধিয়েছে! কাল এখানে এসে কারা-টিটিকে এখানে সমাহিত করেছে না? তারপর থেকেই এ-জায়গাটা শুধু অপবিত্র হ’য়ে যায়নি, অমঙ্গলের ডিপো হ’য়ে গেছে। সোজা কথা নাকি? ভূত-পেত্নি দত্যিদানার আস্তানা! কার ঘাড়ে ক-টা মাথা আর একপা এগুবে? প্রেতাত্মা তার অশরীরী হাত বাড়িয়ে ঘাড় মটকে দেবে না?’
‘অর্থাৎ?’
‘অর্থাৎ কারা-টিটিকে কাল ওরা এখানে মাটির তলায় শুইয়ে রেখে গেছে ব’লেই আজ আমরা এখানে নিরাপদ। এটা যে ওদের কাছে নিষিদ্ধ এলাকা হয়ে গেলো, সেইজন্যেই তো সকলের চোখে ধুলো দিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি আমি!’
‘কিন্তু ওরা যে এখনও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে! এ তো একটা মানুষের তৈরি পরিখা হ’য়ে গেলো আর-কি! আমরা কি তাহলে আর এ-জায়গা ছেড়ে একপাও নড়তে পারবো না—এখানেই ঠায় ব’সে থাকতে হবে আমাদের?’
‘তা কেন? এটুকু ঠিক যে ওরা মাঝাখানে ঐ জমিটা পেরিয়ে অ্যাদ্দুর আর আসবে না। কিন্তু এখান থেকে কেটে পড়বার একটা উপায় বার ক’রে নিতে হবে আর কি আমাদের। নিন, হাত লাগান, কিছু খাবার দাঁতে কাটুন।’
এই প্রায়-কল্পনাতীত উপায়ে আপাতত রেহাই পেয়ে গিয়ে অভিযাত্রীরা সব উত্তেজনার শেষে এখন যেন গা ছেড়ে দিয়েছেন। সত্যি-তো, এখানে যখন আচমকা কোনো হামলা হবে না, তখন উদ্ধারের কথা না-হয় একটু ধীরে-সুস্থে পরেই ভাবা যাবে, সবদিক বিবেচনা ক’রে দেখতে হবে তো!
জায়গাটা অবিশ্যি মৃতের সুখ-সুবিধে-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবেই তৈরি, জ্যান্ত মানুষের কথা আদৌ ভাবেনি মাওরিরা, সেটা তাদের রীতিও নয়, তবে সুখের চাইতে স্বস্তি ভালো। অন্তত এক্ষুনি তো আর প্রাণ হাতে ক’রে পালাতে হবে না!
কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার! মঁসিয় পাঞয়ল কারু-অনুরোধেই নিজের কাহন নিয়ে একটি কথাও বলতে চাচ্ছেন না। সকলের সব প্রশ্নের উত্তরেই ইলেকট্রিক ঈল মাছের মতো হাত পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছেন যেন। সেদিন তিনি ঐ হৈ-চৈ-এর মধ্যে মাওরিদের হাত এড়িয়ে কীভাবেই যে প্রাণ নিয়ে সটকেছিলেন, সে-সম্বন্ধে যেন টু-শব্দটি করতে তিনি রাজি নন।
ব্যাপার দেখে সবচেয়ে অবাক মানলেন মেজর ম্যাকন্যাব্স। এ-কী কাণ্ড! মঁসিয় পাঞয়ল হঠাৎ এমন পালটে গিয়েছেন কী ক’রে? যিনি সবসময় হাজার কথায় নিজের কেরামতি দেখাতে পারলে আর-কিছুই চান না, তাঁর স্বভাবের এমন আদ্যোপান্ত বদল সম্ভব হ’লো কী ক’রে? শেষটায় কারা-টিটির প্রেতাত্মা এসেই তাঁর কাঁধে ভর করেছে নাকি? তার ওপর, এ আবার কী কাণ্ড? তাঁর দিকে তাকালেই কী-রকম যেন কুঁকড়ে গুটিয়ে যাচ্ছেন। গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন ঐ শনের ফেঁসোর তৈরি লাল-কালো আলখাল্লা, পারলে যেন গুটিয়ে কোনো খোলের মধ্যে ঢুকে যাবেন শামুকের মতো।
যাক-গে! মঁসিয় পাঞয়লের মাথায় যে ছিট আছে, সবাই জানে। কোনো নতুন খেয়াল চেপেছে হয়তো মাথায়। খামকা এ নিয়ে আর প্রশ্ন ক’রে তাঁকে বিব্রত করে লাভ কী? কারা-টিটির ভূত এসে যতই তাঁর ঘাড়ে চেপে বসুক না কেন, একসময়-না-একসময় তো পেট ফুলে মরেই যাবেন ভূগোল-বিশারদ এই পণ্ডিতমানুষ—পেটের মধ্যে যত কথা গিজগিজ করছে, সে-সব তিনি কতক্ষণ আর চেপে রাখবেন।
তাঁকে মিথ্যে নানা প্রশ্ন ক’রে উত্ত্যক্ত না-করে, তাঁর পরামর্শমতো কাজ করাই বরং ভালো এখন। পেটে যখন যতরাজ্যের ছুঁচো ডনবৈঠক দিচ্ছে তখন তাঁর সাজিয়ে-রাখা ছোটোহাজরির সদ্ব্যবহার করাই ভালো।
অন্যদের মতো মেজর ম্যাকন্যাব্সও শেষটায় খাবারের দিকে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন।
৩. একদিকে তপ্ত তাওয়া অন্যদিকে জ্বলন্ত আগুন
কথা বলাবার জন্যে শ্রীল-শ্রীযুক্ত জাক-য়েলিয়াস ফ্রাঁসোয়া মারি পাঞয়লকে সাধ্যসাধনা করতে হচ্ছে, এমনটা তো সাধারণত হয় না। তার মানেই হ’লো বিষম গোলমেলে কিছু-একটা হয়েছে, বিদঘুটে কোনো-এক বিড়ম্বনা, আর তাইতেই রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল অ্যাড ইস্ট-ইন্ডিয়া ইনটিটিউটের এই মাননীয় সদস্য এতটা বিব্রত বোধ করছেন। অতএব আপাতত তাঁকে আর ঘাঁটানো খুব যে সুবিবেচনার কাজ হবে, এমনটা লর্ড গ্লেনারভনের বোধ হ’লো না।
কিন্তু কথা সম্ভবত হাঁচোড় পাঁচোড় ক’রে পেট থেকে বেরুতে চাচ্ছিলো, ফলে তাঁদের এই প’ড়ে-পাওয়া ছোটোহাজরি শেষ হবার আগেই অবশ্য পাঞয়ল তাঁর কাহন শুনিয়ে ফেললেন। তারও মধ্যে তো-তো বিব্রতভাব, কিন্তু শেষ অব্দি তিনি যা বললেন তার সারংসক্ষেপ করলে এইরকম দাঁড়ায় :
রবার্টের মতোই, কারা-টিটির মৃতদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়বার সময়, যে-হুলুস্থূল কাণ্ড শুরু হ’য়েছিলো, তারই সুযোগ নিয়ে সটকে পড়েছিলেন পাঞয়ল। কিন্তু কপাল মন্দ হ’লে যা হয়। চম্পট দিতে গিয়ে পড়বি তো পড়, পড়লেন আরেকদল মাওরির খপ্পরে। এদের সর্দারের চেহারাছিরি ভালো, ঘটের মধ্যে বুদ্ধিও ধ’রে ঢের—সে শুধু নামকাওয়াস্তেই বাপঠাকুরদার দৌলতেই সর্দার হ’য়ে বসেনি, বেশ জানে-শোনে; তাছাড়া ইংরেজ মিশনারিদের সঙ্গে এককালে বেশ মাখামাখি হয়েছিলো ব’লে ইংরেজি ভাষা বলতে-কইতেও পারে, শাদাআদমিদের ধরনধারণ ভালোই জানা ছিলো তার। পাঞয়লকে দেখে বেশ ক’রেই জড়িয়ে ধরে নাকে নাক ঘষে যথাবিধি অভ্যর্থনা ও জানিয়েছিলো সে। ককখনো এমনভাব করেনি যে পাঞয়ল তাদের বন্দী। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গিয়েছিলো যে ঐ সর্দার সঙ্গে না-থাকলে কোথাও এক পাও যাবার অধিকার নেই তাঁর—সারাক্ষণই সে তার পায়ে-পায়ে ঘুরঘুর করছে, ছায়ার মতোই লেপটে থাকছে পাশে।
নাম তার হি-হি, যার মানে রোদ্দুর। মানুষটা দিব্বি। পাঞয়লের নাকের ডগায় চশমা আর বুকে-ঝোলানো দূরবিন দেখে শ্রদ্ধায় এতটাই অভিভূত হ’য়ে গিয়েছিলো যে তাঁকে সে কোথায় রাখবে—পায়ে, না মাথায়—এটাই বোধহয় ঠিক করতে পারেনি—সেইজন্যেই অনেক মাথা খাটিয়ে সে একটা উপায় বার করে নিয়েছিলো, দড়ি দিয়ে একেবারে নিজের সঙ্গেই বেঁধে রেখে দিয়েছিলো তাঁকে। এইভাবেই গেছে তিন-তিনটে দিন। এ যেন তপ্ত তাওয়া থেকে পালাতে গিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ খাওয়া।
‘তবে যে বললেন, রীতিমতো আদর ক’রেই রেখেছিলো—কখনও আপনাকে বুঝতেই দেয়নি যে আপনি হি-হি-র বন্দী?’ মৃদু হেসে জিগেস করেছেন গ্লেনারভন।
পাঞয়ল উত্তরে বলেছেন : ‘কথাটা ঠিক। বন্দীও বটে, আবার নয়ও বটে। এমনিতে দারুণ খাতিরদারি করছে, আরামেগরমে রাখছে—অথচ কাছ ছাড়ছে না একমুহূর্তের জন্যেও। একে যদি বন্দিত্ব বলে, তবে তা-ই। মোটমাট এইভাবেই কেটেছে তিনটে দিন—কিন্তু শেষটায় এত আদরযত্ন আমার আর সহ্য হয়নি। শেষটায় একদিন হি-হি যেই একটু চোখ মুদেছে, অমনি দড়ি কেটে ফের চম্পট দিয়েছি।’
আর এবার পালিয়ে এসে দেখতে পেলেন, বেশ-জমকালো অনুষ্ঠান ক’রেই কারা-টিটিকে অন্ত্যোষ্টির জন্যে মিছিল ক’রে এই পাহাড়টায় নিয়ে-আসা হচ্ছে। ‘ও-সব ট্যাবু-ফ্যাবুর কথা আমার বেশ জানাই ছিলো। এর আগে পারী থেকে একপাও না-বেরুলে কী হয়, পলিনেশিয়ার কোথায়-কোথায় ট্যাবুর চল আছে, সে-সব আমি পুথি প’ড়ে একেবারে গুলেই খেয়েছিলুম, ফলে এটাও তক্ষুনি ধরতে পেরেছিলুম যে একবার পাহাড়ের এই অনুষ্ঠানটা শেষ হ’য়ে গেলেই এ-পাহাড়টা এদের কাছে নিষিদ্ধ পাহাড় হ’য়ে যাবে—আর-কেউ ভুলেও এ-তল্লাট পায়ে মাড়াবে না। তাই মাওরিরা সবাই চ’লে যাবার পর লুকিয়ে এই পাহাড়ে এসে সোজা এই সমাধিভবনেই আশ্রয় নিয়েছি আমি। আপনাদের কার কী গতি হ’লো—সেটা না-জেনে কোথায় যাই, বলুন? সেজন্যেই সেই থেকে এখানেই র’য়ে গেছি।’
জাক পাঞয়ল এত-সব বললেন, বটে, তবু খটকাটা কিন্তু কাটলো না। তিনি যেন সব কথা খুলে বলছেন না, কী যেন এখনও চেপে যাচ্ছেন, কিন্তু সেটা যে কী তা হয়তো তাঁর পেটে বোমা মারলেও এখন আর জানা যাবে না। ফের কখনও শুভলগ্ন এলে তিনি নিজেই হয়তো সব ফাঁস ক’রে দেবেন, এই কথা ভেবে তাঁকে আর কেউ খোঁচালেন না। বরং এখন তো শিরে-সংক্রান্তি—এখানে মৌরসি পাট্টা গেড়ে ব’সে থেকে তো কোনো লাভ নেই—বরং এখন ভাবতে হবে, এখান থেকে কী ক’রে পালানো যায়। পালাবার রাস্তা তো একটাই—এই অন্য ঢালটা দিয়ে নেমে গিয়ে একবার ঐ উলটোদিকের পাহাড়ের মধ্যে ঢুকতে পারলে আপাতত অন্তত কাই-কুমুর রোষ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। গ্লাসগো থেকে তাঁরা সেই-কবে-যেন বেরিয়েছিলেন ব্রিটানিয়ার খোঁজে, তো সেই ব্রিটানিয়ার কোনো হদিশ তো মিললোই না—বরং এখন তাঁদের হন্যে হ’য়ে খুঁজতে হবে তাঁদের নিজেদের জাহাজ ডানকান কোথায় গেছে। আর ডানকানকে খুঁজে পেতে হ’লেও তো এইসব পাহাড়পর্বত পেরিয়ে উপকূলের দিকে যেতে হয়, যেখানে সমুদ্র আছে। অন্তত কোনো বন্দরে গিয়ে জাহাজিদের কাছে এই খোঁজটা নেয়া যায়— ডানকান কোথায় গেছে, সে-খবর তারা কেউ জানে কি না।
আলোচনা করে আপাতত এটাই সাব্যস্ত হ’লো যে এই পাহাড়ের ঢাল থেকে নেমে দূরের ঐ অন্য পাহাড়গুলোর মধ্যে অন্তত ঢুকে-পড়া যাক। আর সে-চেষ্টা করতে গিয়েই বোঝা গেলো, কাই-কুমু মোটেই অমন হাঁদা নয়। খুব-একটা মাথা না-খাটিয়েও সেও এটা ধরতে পেরেছে যে পলাতকেরা এখন এই অন্য ঢালটা দিয়ে নেমেই কেটে পড়বার তালে থাকবে। সেইজন্যে সে তক্ষুনি কড়া পাহারা বসিয়ে দিয়েছে। পাহারা অবশ্যি দূরেই থাকবে, এদিকটার ছায়াও মাড়াবে না কেউ, কিন্তু রাইফেলের গুলি তো আর এখানে আসতে ভয় পাবে না—দূর থেকে এঁদের তাগ ক’রে গুলি করলেই বাছাধনদের আর এখান থেকে বেরুতে হবে না।
নিশ্চয়ই এ-কথাই ভেবেছিলো কাই-কুমু। কেননা একটু নেমে যাবার পরেই তাঁদের তোপ দেগে সম্বর্ধনা জানাবার মতো ক’রেই ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুটে এলো বন্দুকের গুলি। ফের ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে পাহাড়ের চুড়োর আশ্রয় নিয়ে তবে স্বস্তি।
কতকগুলো কাগজ উড়ে এসেছিলো বন্দুকের গুলির সঙ্গে। পাঞয়লের কৌতূহল উদগ্র—তাছাড়া বইয়ের পাতা দেখলে সেটায় কী লেখা আছে না-জানা অব্দি তাঁর শান্তি নেই। একটা কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে প’ড়ে দেখলেন পাঞয়ল। ‘আরে! এ-যে দেখছি বাইবেল-এর একটা পাতা। হতচ্ছাড়ারা দেখছি বাইবেলের পাতা ছিঁড়ে বন্দুকে বারুদ ঠাশে। এই শুনুন, কী লিখেছে—’মহাবিপদে পতিত হইয়া আমি কায়মনোবাক্যে সদাপ্রভুকে ডাকিয়াছিলাম, এবং প্রভু তাহা শুনিয়াছিলেন’।
‘ঠিক কথা—প্রভুকে কায়মনোবাক্যে ডাকলে তিনি তা শুনবেন না কেন?’ এই বিপদের মধ্যে বাইবেল-এর এই বয়ান একটু পরিহাসের মতোই ঠেকেছিলো গ্লেনারভনের, কিন্তু এটাও মনে হ’লো হঠাৎ বিশেষ করে এই পাতাটা কুড়িয়ে পাবার মধ্যেই হয়তো ঈশ্বরের অপার করুণার কোনো ইঙ্গিত আছে। ‘আমরা তো সেই থেকে তাঁকেই একমনে ডেকে যাচ্ছি—নিশ্চয়ই এই সংকট থেকে তিনিই আমাদের উদ্ধার করবেন।’
আর যেন ঠিক তাঁর কথার উত্তরেই পায়ের তলায় থেকে-থেকে কেঁপে উঠলো পাহাড়। কাকতাল? না অন্যকিছু? আরো-কোনো বিষম সংকটের ইঙ্গিত নাকি এই ভূকম্পন?
মাটির নিচে পাতালে আগুন জ্বলছে—আর তারই ধাক্কায় কি পাহাড় কেঁপে উঠেছে এখন? অসম্ভব নয়। এখানটায় আসবার সময় যখন ওয়াইকাতো পেরিয়ে আসছিলেন, তখনই দেখেছিলেন অগুনতি উষ্ণ প্রস্রবণ।…মনে প’ড়ে গেলো ভাপে দম আটকে যেতে চাচ্ছিলো, গন্ধকের গন্ধ ঝিম ধরিয়ে দিয়েছিলো হাওয়ায়।
অর্থাৎ আগুনের পাহাড় আছে এখানে–হয়তো পুরো তল্লাটটা জুড়ে ভূগর্ভে একটাই মস্ত আগুনের কুণ্ড জ্বলছে, আর তার জ্বালামুখও আছে অজস্র। মাটি এখানে যেন ঝাঁঝরা হ’য়ে গেছে—কোথাও একটু ফাটল থাকলেই তার ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে আগুন, তপ্ত খ্যাপাজল, গন্ধকের গন্ধেভরা কুণ্ডলিপাকানো বাষ্প সেইজন্যেই হাওয়া এখানে কেমন ঝিম-ধরা, যেন থম মেরে গেছে সবকিছু।
কোন্টাকে যে বেশি ভয় পাওয়া উচিত—কাই-কুমুর লোকদের গুলিবর্ষণ, না পাহাড়ের এই আচম্বিতকম্পন—সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না। পাঞয়ল বললেন, ‘এই পাহাড়ও একদিন আগুন ওগরাবে। মাটির তলায় যত গ্যাস জ’মে আছে, তা পাহাড় ফাটিয়ে বেরিয়ে আসবে।’
‘কিন্তু এখন? হঠাৎ এমনভাবে মাটি কাঁপছে কেন?’ গ্লেনারভন বুঝি একটু শঙ্কিত বোধ করছেন। ‘ডানকানেরবয়লারও তো জাহাজ যখন জোরে ছোটে, কেমন থরথর ক’রে কাঁপে? এও কি সে-রকমই কিছু? না কি একটা-কোনো মারাত্মক-
তাঁর মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়েই যেন বলেছেন মেজর ম্যাকন্যাব্স : ‘বয়লারও পুরোনো হ’লে ফেটে যায়। অথবা তাকে দিয়ে যদি তার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু করাবার চেষ্টা করা হয়—’
পাঞয়ল সায় দিয়ে বলেছেন, ‘হ্যাঁ। ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না। এখানে বেশিক্ষণ থাকা আদৌ নিরাপদ নয়। হঠাৎ পাহাড়ের এই জেগে-ওঠাটাকে খুব ভালো লক্ষণ ব’লে মনে হচ্ছে না। এ যেন হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠবার চেষ্টা করছে!’
গত্যন্তর না-দেখে আবার এসে কারা-টিটির সমাধিভবনে ঢুকেছেন পলাতকেরা- আর দূর থেকেই তা দেখে মাওরিরা যেন আরো চ’টে গেছে। শুধু গায়ের ঝাল মেটাবার জন্যেই এলোপাথারি গুলি চালাতে শুরু করেছে তারা, যদিও জানে যে এত-দূর অব্দি তাদের গুলি পৌঁছুবে না।
শক্ত কাঠের খুঁটি বসিয়ে মজবুত বেড়া বেঁধেছে মাওরিরা এই সমাধিভবনের চারদিকে। ভেতরে মৃত যোদ্ধার স্মরণে রেখে গিয়েছে বিস্তর গোলাবারুদ আর পান্নার হাতল দেয়া খঞ্জর—যাতে প্রেতাত্মা অস্ত্রের অভাবে শিকার করা থেকে বঞ্চিত না-হয়। তাছাড়া রয়েছে অন্তত ক-দিনের উপযোগী খাবারদাবার অর্থাৎ ফলমূল, আর পানীয় জল। আছে রাঙাআলু, নানারকম কন্দমূল, আলুও—কিন্তু ফলমূল, কাঁচা যদি-বা খাওয়া যায়, ঐ আলু ইত্যাদি রান্না না-ক’রে খাওয়া যাবে কী ক’রে? এখানে কতদিন এভাবে আটকে থাকতে হবে কে জানে। রান্না না-ক’রে এ-সব তাঁরা খাবেন কী করে? ভাঁড়ারের হাল দেখে মস্ত-একটা সমস্যাতেই প’ড়ে গেছেন পলাতকেরা।
কিন্তু পাঞয়লের মগজে কতরকম যে উদ্ভাবনীকৌশল খেলে যায়। ফাটল দিয়ে গ্যাস বেরুচ্ছে দেখে তাঁর মাথায় চমৎকার একটা মলব খেলে গিয়েছে। এ-সব আলু রাঙাআলুকে মাটিতে পুঁতে দিলেই তো হয়—দিব্বি গ্যাসের আঁচে ঝলসানো যাবে এদের।
এবং অলবিনেটকে ডেকে তার ব্যবস্থা করতেই বলে দিয়েছেন পাঞয়ল।’কোনো তাপমানযন্ত্র থাকলে বোঝা যেতো ঐ-সব ফাটলের কাছে জমি কতটা তেতে আছে—প্রায় দেড়শো ডিগ্রি ফারেনহাইট তো হবেই। তবে আর ভাবনা কী?’
তাঁর পরামর্শ শুনে মাটি খুঁড়তে গিয়ে অলবিনেট তো বুঝি নিজেই জ্যান্ত ঝলসে মরে। একটু গর্ত করা মাত্র সেখান দিয়ে হিসহিস ক’রে বেরিয়ে এলো গরম বাষ্প—আরেকটু হ’লেই ছোবল মারতো বুঝি অলবিনেটকে। সে যদি আঁৎকে চিৎপটাং হয়ে না-পড়তো, তবে আর-কিছু না-হোক, তার শ্রীমুখটি যে ঝলসে যেতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অবস্থা সঙিন দেখে হুড়মুড় ক’রে ছুটে এলেন মেজর ম্যাকন্যাব্স–আরো দুজন মাল্লাও এলো সঙ্গে। তাড়াহুড়ো ক’রে মাটি আর পাথর দিয়ে বুজিয়ে দেয়া হ’লো গর্তের মুখ—কিন্তু পাতালের ঐ গ্যাসের গায়ে যেন হাজারটা দানবের শক্তি (‘দানবের নয়, অশ্বশক্তি বলুন,’তো-তো ক’রে বলতে চেয়েছেন পাঞয়ল)—ঐ পাথর ঠেলেই যেন সে বেরিয়ে আসবে। বোতলের ছিপি খুলে দিতেই যেমন বিপদ হয়েছিলো আরব্যরজনীর জেলেটির—বেরিয়ে এসেছিলো জিন—সে তো এই বাষ্পের মতোই। গর্তের মুখটায় কিছুতেই যেন আর এই মাটিপাথরের ছিপিটা আটকানো যাচ্ছে না।
গোড়ায় পাঞয়লের মুখটা একটু বিমর্ষ হ’য়ে উঠেছিলো। তাঁর পরামর্শই তো নতুন ক’রে একটা ভয়ংকর কেলেঙ্কারি ঘটাতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তাঁর মগজে হরদম নতুন-নতুন ভাবনা খেলে যায়—হয়তো মাথার খুলি ফাটিয়েই বেরিয়ে আসতে চায় ঐ বাষ্পের মতো। কেননা পরক্ষণেই তিনি লাফিয়ে উঠেছেন। ‘ইউরেকা! ইউরেকা! নিজেকে বোধহয় ঊনবিংশ শতাব্দীর নতুন-কোনো আর্কিমিদেস ব’লেই মনে হয়েছে তাঁর। ‘আবার আমাদের কপাল ভালো। একবার পেলুম কারা-টিটির জন্যে রেখে-যাওয়া খাবার, এখন পাচ্ছি মাটির তলার আগুন! এ-যে দেখছি মেঘ না-চাইতেই জল! এ-পাহাড় তো আমাদের সবকিছু জুগিয়ে দিচ্ছে!’
‘হ্যাঁ, তা জোগাচ্ছে—যতক্ষণ-না বয়লারের মতো ফেটে যায়,’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স অন্তত জাহাজের বয়লারের তুলনাটা সহজে ভোলবার পাত্র নন।
‘আরে! এতে এত ভয় পাবার কী আছে!’ পাঞয়ল অভয় দেবার ভঙ্গিতে বলেছেন। ‘এত বছর যখন পাহাড়ের খোলটার বাঁধন সয়েছে, তখন নিশ্চয়ই আরো ক-দিন সইতে পারবে। আর তার মধ্যেই আমরা পালাবো। কিছু-একটা উপায় তার মধ্যে বার ক’রে নিতে পারবোই। ‘
পাহাড়ের দুলুনি কমেনি বটে, তবে গোড়ায় যেমন থরহরি কাঁপছিলো, এখন আর সে-রকম কাঁপছে না।
‘ছোটোহাজরি তৈয়ার,’ গম্ভীরভাবে জানালে অলবিনেট। ভাবখানা এমন, যেন সে ডানকান জাহাজেই তার স্টুয়ার্ডগিরির কেরামতি দেখাচ্ছে।
ঝাউগাছের শেকড় আর পোড়া রাঙাআলু খিদের মুখে তেমন মন্দ লাগেনি। চটপট ডানহাতের কাজ সেরেই তাজা হ’য়ে গিয়ে পরামর্শসভা বসাতে হবে।
আর পরামর্শসভায় ঐক্যমত্য হ’তে একটুও দেরি হ’লো না। আজ রাতের আঁধারেই গা ঢাকা দিয়ে পালাতে হবে। মাওরিদের গুলির আওয়াজ থেমে গিয়েছে এখন—তবে তারা নিশ্চয়ই কাছে-পিঠেই আছে সজাগচক্ষু পাহারায়। ঠিক হ’লো, গোড়ায় লর্ড গ্লেনারভনই ম্যাঙ্গল্সকে নিয়ে একটা সরেজমিন তদন্ত ক’রে আসবেন মাওরিরা কোথায়-কোথায় ঘাপটি মেরে আছে। পথ পরিষ্কার কি না দেখে এসে জানালে সবাই মিলে বেরুতে হবে। পথ না-থাকলেও যে-ক’রেই হোক একটা পথ ক’রে নিতে হবে—পথ কেউ অমনি-অমনি দেয় না।
তাঁরা যখন সমাধিভবন থেকে বেরুলেন, তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে একটাও তারা নেই—মেঘ ঝুলে আছে নিচু আর ভারি আর কালো। ঐ দূরে ছোট্ট-একটা আগুনের কুণ্ড জ্বলছে—নিশ্চয়ই সেখানে কাই-কুমু সদলবলে ওৎ পেতে আছে পাহারায়। সরু যে-আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথটা নিচে নেমেছিলো, সেটা ঐ মাওরিদের ঘাঁটির পাশ দিয়েই গেছে। সেইজন্যেই রাস্তা আটকে তারা ওখানটাতেই আগুন জ্বালিয়েছে। কিন্তু সেই আগুনের আলো কতদূর অব্দি পৌঁছুবে? যদি কোনোমতে আলোর নাগালের বাইরে আঁধারে গা-ঢাকা দিয়ে ওটুকু পথ পেরুনো যায়, তাহ’লেই তাঁদের আর পায় কে? কিন্তু তা বুঝি আর হয় না। গ্লেনারভন আর ম্যাঙ্গল্স যেই চুপিসারে একটু এগিয়ে গেছেন আগুনের কুণ্ড লক্ষ্য ক’রে, অমনি আচমকা তাঁদের সব আশায় বাদ সেধে ডানদিক থেকে পর-পর কতগুলো বন্দুক গর্জে উঠেছে! দুটো গুলি তো গ্লেনারভনের কাঁধ ঘেঁসেই বেরিয়ে গেছে! অমনি ছুটে পালিয়ে আসতে হয়েছে তাঁদের।
অসম্ভব! এরা বন্দুক চালাতে জানে, মোটেই আনাড়ি নয়; তাছাড়া অন্ধকারে বনে-জঙ্গলে থেকে-থেকে এদের চোখ যেন বেড়ালের মতোই অন্ধকারেও দেখতে পায়। এদের নজর এড়িয়ে পালানো যাবে না।
তাহ’লে উপায়?
আধোঘুম আর. আধোজাগরণের মধ্যেই কারা-টিটির সমাধিভনের মধ্যে রাত কাটিয়ে দিলেন সবাই। তারপর যখন দিনের আলো ফুটলো, বাইরে এসে দাঁড়ালেন সবাই। দিনের অলোয় দূরের ঐ আগুনের কুণ্ডের আলো এখন মিইয়ে এসেছে—কিন্তু কাই-কুমুর সাঙ্গোপাঙ্গরা যে ওখানেই আছে এবং সজাগই আছে, তার প্রমাণ হ’লো, তাঁদের বাইরে বেরুতে দেখেই তারা সমস্বরে বিকট আওয়াজ ক’রে উঠেছে!
একটু ঘাবড়ে গেলেও এটা তারা জানেন যে ঐ দূর থেকেই তারা খ্যাপার মতো চ্যাচাবে, এই ট্যাবু ভেঙে যে ওপরে উঠবে সেই দুঃসাহস তাদের আর হবে না। চারদিক থেকে কুয়াশা তখনও মেলায়নি। কিন্তু ঝিরঝিরে একটা হাওয়া দিয়েছে। হাওয়ার জোর অবশ্য এমন নয় যে সে এক্ষুনি এক ঝটকায় এই কুয়াশাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
হঠাৎ ফের পাঞয়লের মাথায় যেন কারা-টিটির ভূত এসে চেপেছে। তিনি ফের চেঁচিয়ে উঠেছেন : ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’
তাঁর মাথায় কোনো ফন্দি এলেই তিনি যে কেন গ্রিক বলেন, সেটা বোঝা দায়!
‘আমরা এদের বিশ্বাস আর সংস্কারকেই কাজে লাগাবো।’
মেজর ম্যাকন্যাব্স বুঝি অনবরত তাঁর এই ইউরেকা! ইউরেকা! হুংকার শুনে একটু বিরক্তই হচ্ছিলেন। মনের ভাবটা না-চেপেই তিনি ব’লে উঠেছেন, ‘কিন্তু সেটা কীভাবে কাজে লাগাবেন তা এই অধমদের একটু খুলে বললেই পারেন।’
‘এদের তো বিশ্বাস এটাই যে ট্যাবু ভেঙে যে-ই এই পাহাড়ের ওপরে ওঠবে, দেবতাদের রোষ তাকে প্রাণে মারবে। বেশ-তো, কাই-কুমু তাহ’লে ভেবে নিক যে আমরা ট্যাবুনা-মানার জন্যে জ্যান্ত ঝলসে মরেছি—দেবতাদের অগ্নিচক্ষু আমাদের ভস্ম করে ফেলেছে! একবার যদি তাদের মনে হয় যে আগুনের দেবতা আমাদের কাউকেই রেহাই দেয়নি, তাহ’লে তারা তাদের পাহারা তুলে নিয়ে যে যার নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। তখন ফাঁকা রাস্তা পেয়ে আমরাও এখান থেকে কেটে পড়বো।’
‘সেটা আপনি ওদের বিশ্বাস করাবেন কী ক’রে?’ একটা ফ্যাকড়া তুলেছেন লর্ড গ্লেনারভন। ‘বিশ্বাস করাতে পারলে হয়তো মুশকিল আসান হ’তো। কিন্তু ওরা তো দেখেছে—দিব্বি চব্বিশ ঘন্টার ওপর হ’লো আমরা বহাল তবিয়তে এখানে কাটিয়ে দিয়েছি—ওদের দেবতা আমাদের গায়ে আঁচড়টিও কাটেননি।’
‘কাটবেন, কাটবেন,’ আশ্বাস দিয়েই বলেছেন পাঞয়ল। ‘দেবতার রোষ তো দাউ-দাউ জ্বলছেই মাটির তলায়-এখন ছিপি খুলে তাকে বের করে আনলেই হয়!’
‘সর্বনাশ!’ ম্যাঙ্গল্স যেন চোখের সামনে বিভীষিকা দেখেছেন। ‘আপনি কি আগ্নেগিরির কাঁচাঘুমটা ভাঙিয়ে দিতে চাইছেন নাকি? মুখ খুলে দিতে চাচ্ছেন জ্বালামুখের? জানেন তো, বোতলের ছিপি খুলে দেবার পর জিন এসে প্রথমে যাকে পায় তারই ঘাড় মটকে দেয়।’
‘আগ্নেয়গিরিকে জাগিয়ে দেবার কথা কে বলছে?’ পাঞয়ল যেন বোকা ছাত্রদের মাথায় গজাল মেরে কথাটা ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে। ‘আমরা একটা নকল অগ্ন্যুৎপাত বানাবো—যেটা আমরা নিজেদের বশে রাখতে পারবো, নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো। যে-সব ফাঁকফোকরফাটল দিয়ে আগুন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, আমরা তাকে আর বাধা দেবো না—বরং সহজে যাতে বেরিয়ে আসতে পারে, তারই ব্যবস্থা ক’রে দেবো। নকল একটা লাভার স্রোত বইয়ে দেবো, যাতে তারা ভয় পেয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, সেটা স্রেফ ওদের ধাপ্পা দেবার জন্যেই করতে হবে—আমরা আস্ত আগ্নেয়গিরিটাকে জাগিয়ে দিতে চাচ্ছি না।’
‘যদি অগ্ন্যুদগারটাকে নিজের বশে রাখতে পারেন,’ মেজর ম্যাকন্যাব্সের কথায় তারিফ আর অবিশ্বাসের একটা বিচ্ছিরি মিশেল ছিলো, ‘তবে পাগলা ঘোড়াকে বশে আনার চাইতেও সেটা অনেক কঠিন। যদি ভাবনারা হ’তো পক্ষিরাজ ঘোড়া—’ আউড়েছেন তিনি পুরোনো প্রবচন।
‘আমরা শুধু এমন-একটা ধারণার সৃষ্টি করবো, যাতে ওরা ভেবে নেয় যে ওদের দেশের অগ্নিদেবতা আমাদের তাঁর লেলিহান লোলশিখায় ঝলসে খেয়েছেন। আসলে যখন এখান দিয়ে আগুন বেরুবে, আমরা সবাই কারা-টিটির সমাধিঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকবো!’
‘কিন্তু কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবো?’ গ্লেনারভনের সংশয় যেন কিছুতেই যাবে না। ‘একবার আগুনের লকলক শিখা যদি পাতাল থেকে বেরিয়ে এসে আকাশ চাটতে শুরু ক’রে দেয়, তবে আগুন কি আমাদের দেখেশুনে ছেড়ে দিয়ে শুধু বেছে-বেছে অন্যকিছু ভস্ম ক’রে দেবে?
‘তাছাড়া সত্যি আমরা পুড়ে মরেছি কি না দেখবার জন্যে ওরা যদি পাহাড় বেয়ে উঠে আসে?’ ম্যাঙ্গসের সংশয়ও মোটেই কাটেনি।
‘আসবে না,’ আহাম্মক কতগুলো ছাত্র জুটেছে যেন পাঞয়লের, সহজ কথাটা পর্যন্ত বুঝতে চায় না। ‘নিষিদ্ধ পাহাড়ে এসে আস্তানা গেড়েছি ব’লেই তো আগুন আমাদের খেলো। তারপরও তারা ট্যাবু ভেঙে পাহাড়ে উঠতে সাহস করবে নাকি? তারা তো নিজের চোখেই জুলজুল ক’রে দেখবে–ট্যাবু ভাঙলে কী মারাত্মক সাজা পেতে হয়।’
‘আমাদের যখন এমনিতে এখান থেকে পালাবার কোনো রাস্তাই খোলা নেই, সম্ভবত মেজর ম্যাকন্যাব্সের এখন এই ফন্দিটা আর তেমন আজগুবি ঠেকছে না, ‘তখন একবার চেষ্টা ক’রে দেখাই যাক না। এমনিতেও তো এখানে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে আমাদের তিলে-তিলে মরতে হবে—তার চেয়ে বরং আগুন-লাভাকে বশে না-রাখতে পারলে একঝাপটাতেই ম’রে যাবো। তপ্ত তাওয়া থেকে যখন জ্বলন্ত উনুনে পড়ে মাছ—তখন তার দশা খুব-একটা পালটায় কি? অবস্থার কি খুব-একটা হেরফের হয় তার?’
ঠিক হ’লো, দিনের বেলায় কিছু করা হবে না, রাতের আঁধার নামলে পরই উসকে দিতে হবে আগুন, খুঁচিয়ে তুলতে হবে পাতালের ঐ অগ্নিকুণ্ড—কিন্তু এদিকটাতেও নজর রাখতে হবে যাতে অগ্ন্যুদগারটা এমন প্রচণ্ড না-হয় যে তাঁদের পালাবার পথই আটকে গেলো। মাওরিদের যেটা এতকালের সংস্কার, এতকালের বিশ্বাস, শুধু সেটাকে আরো, চাগিয়ে তোলবার জন্যে যতটুকু আগুন আর লাভা চাই, শুধু ততটুকুরই ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু এ কী আর ইয়র্কশিয়র পুডিং নাকি—নিজের মনোমতো হুকুমমাফিক একটা অগ্ন্যুৎপাত তৈরি করা যাবে? একটু এদিক-ওদিক হ’লেই সাড়ে-সর্বনাশ : নকল অগ্নুৎপাত হ’লেও উৎপাতটা তৈরি করবে তো আসল আগ্নেয়গিরিই। আর সে কি কারু হুকুমের চাকর যে যা বলা হবে তা-ই ‘জো হুজুর ব’লে তামিল করতে লেগে যাবে? একটা বদ্ধ জায়গা থেকে বাষ্প, লাভা আর গ্যাসকে টেনে বার করবার পর তাকে কি আর পোষমানানো যাবে? একটু আগেই তো অলবিনেট বেচারির চিৎপটাং দশা থেকে একটু শিক্ষা নেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু কিছু না-ক’রে হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেও তো রেহাই নেই। একবার যদি মাওরিদের মনে বিশ্বাসটা উসকে দেয়া যায় যে দেবতার অভিশাপ লেগেছে, ট্যাবু ভাঙবার জন্যে অগ্নিদেবতা খেপে উঠেছেন, জুড়ে দিয়েছেন তাঁর তাণ্ডবনাচ—তাহ’লে তারা প্রাণের ভয়ে শুধু যে এখান থেকে ভোঁ-দৌড় দেবে তা-ই নয়, পালাতে-পালাতে ভাববে, উচিত শিক্ষাই পেয়েছে শাদারা, যেমন নিষেধ মানেনি তেমনি উপযুক্ত সাজাই পেয়েছে।
পরিকল্পনাটা উলটেপালটে, চিৎ ক’রে, উপুড় ক’রে, নানাদিক থেকে দেখা হ’লো—কিন্তু তাতেও যেন সময় আর কাটতেই চায় না। একেকটা ছোট্ট মুহূর্তকেই কে যেন টেনে বিষম লম্বা ক’রে দিয়েছে। তবে শুধু আলোচনাই করেননি সারাক্ষণ, পালতকেরা পালাবার সমস্ত আয়োজনও সাঙ্গ করেছেন, ছোটো ছোটো পুঁটুলি ক’রে বেঁধে নিয়েছেন খাবার, কারা-টিটির সমাধির পাশে যত অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ছিলো, তাও নিজেদের সঙ্গে নিয়েছেন। অলবিনেট সন্ধে ছটা নাগাদ খাবার পরিবেশন করলে—এটাই তাঁদের লাস্ট সাপার বা শেষ ভোজ কি না কে জানে। আর খেতে-খেতেই দেখা গেলো মেঘ জমছে দিগন্তে, দু-একবার বিদ্যুৎও চমকালো। আর তাই দেখে পাঞয়ল বেশ খুশিই হ’য়ে উঠলেন। একবার তাঁরা নিজেরাই একসঙ্গে জল আর আগুনের লীলাখেলা দেখেছেন সেদিন—অভিজ্ঞতাটা তাজ্জব হ’লেও তেমন মুখোরোচক হয়নি। এবার মাওরিরাও দেখবে—ওপরে ঝড় গর্জাবে, নিচে পাহাড় ফেটে আগুন ছড়াবে। আর তাতে হয়তো তারা ভাববে যে ট্যাবুভাঙায় আদিম দেবতারা সব্বাই এতটাই রেগে গিয়েছেন যে আজ বুঝি আর-কারু রক্ষে নেই
আটটা বাজতে না-বাজতেই অন্ধকার যেন নিশ্ছিদ্র হ’য়ে নেমে এলো। এমনিতে হয়তো আকাশে চাঁদ আর তারা থাকতো—কিন্তু মেঘের দাপটে আজ রাতে তারাও কোথায় মুখ লুকিয়েছে। আর এটাই সুবর্ণসুযোগ। মাওরিরা জঙ্গলে অন্ধকারে থেকে অভ্যস্ত হ’লেও আজকের মতো নিরেট-নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে এতদূরে কিছুই দেখতে পাবে না—দেখতেই পাবে না এই উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা উটকো শ্বেতাঙ্গরা কী করছে।
কারা-টিটিকে যেখানে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে, তা থেকে প্রায় তিরিশ হাত দূরে মস্ত একটা ভারি পাথর ছিলো—দেখে মনে হতে পারতো এই মস্ত পাথরটা দিয়ে কেউ যেন কোনো খুদে জ্বালামুখের মুখে ছিপির মতো আটকে দিয়েছে। কেননা পাথরটার চারপাশ দিয়ে সামান্য যা ফাটল আছে—পুরো মুখটা বোধহয় খাপে খাপে বোজেনি—তা দিয়ে এতক্ষণ হিস-হিস ক’রে গ্যাস বেরুচ্ছিলো। এখন পাথরটাকেই ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে—তাহ’লেই, মুখটা খুলে যেতেই বেরিয়ে আসবে জ্বলন্ত বাষ্প, আগুনের শিখা, তপ্ততরল লাভা—আর বিজ্ঞান তো বলে তরল পদার্থ গড়িয়ে নিচে নেমে যায়, ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠে না—অতএব সে-সব নেমে যাবে নিচের দিকে, কারা-টিটির সমাধিভবনের দিকে বেয়ে-বেয়ে উঠে আসবে না।
কিন্তু তার আগে মাটি কেটে একটা খাত তৈরি ক’রে দিতে হবে, যাতে সেই খাতটা দিয়েই নিচে গড়িয়ে নামে লাভা। পাথরটাকেও ঠেলে সরাতে গেলে খেয়াল রাখতে হবে সেটা যাতে এলোপাথারি নিচে নেমে না-যায়—ঐ খাত ধ’রেই সে যেন গড়গড় করে নেমে যায়। সমাধিভবনের একটা কাঠের খুঁটি উপড়ে এনে সেটা খাঁজের মধ্যে পাথরের তলায় আড়কাঠের মতো চালান ক’রে দিয়ে সবাই মিলে ‘হেঁইয়ো-জোয়ান’ ব’লে একটা বিষম হ্যাঁচকা চাড় দিলেন। আর আচমকা ঠেলা লেগে পাথরটা যে শুধু কাই হলো, তা নয়—ঐ খাঁজ-কাটা খাত দিয়ে গড়িয়ে পড়লো।
আর অমনি যেন শুরু হলো প্রলয়। দুম করে ফেটে গেলো মাটির পাৎলা আস্তর—গর্ত ফেটে বেরিয়ে এলো জ্বলন্ত গ্যাস, আর তারপর একটার পর একটা বিস্ফোরণ, মাটি কেঁপে উঠলো, যেন অ্যাটলাসের কাঁধের ওপর আস্ত পৃথিবীটাই বিষম ন’ড়ে উঠেছে, আর তরল আগুনের স্রোত নামতে শুরু করলো ঢাল বেয়ে।
নিশ্চয়ই কুণ্ডলী পাকিয়ে নিচে থেকে এতক্ষণ অবিশ্রাম ঠেলা দিচ্ছিলো গ্যাস, একটু ফাঁক পেয়ে এখন এমন তোড়ে বেরুতে শুরু করেছে যে চারপাশের মাটির চাঙাড় ভেঙে নিচে প’ড়ে গেলো, আর জ্বালামুখের বেড়টা আচমকা অনেকটাই বড়ো হ’য়ে গেলো, গলগল ক’রে বেরুতে লাগলো লাভা।
আর ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বার সময় সেই লাভা সঙ্গে ক’রে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নুড়িপাথর কাঠকুটো যা সামনে পাচ্ছে তা-ই। আঁৎকে, সবাই হুড়মুড় ক’রে গিয়ে ঢুকলেন কারা-টিটির সমাধিঘরেই। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! সেদিন গ্লেনারভনের হাতেই মরেছে কারা-টিটি, কিন্তু বারে বারে তাঁকে আর তাঁর সঙ্গীদের ফিরে আসতে হচ্ছে যেখানে সে তার শেষনিদ্রায় শুয়ে আছে—কিছুতেই সে যেন এঁদের কাউকেই তার কাছ ছেড়ে যেতে দেবে না—কোন্-এক তাজ্জব আর অদৃশ্য বাঁধন দিয়ে সে যেন আটকে রেখে দিতে চাচ্ছে সবাইকে।
সারাটা আকাশ ততক্ষণে লালে-লাল! এ কোনো যেমন-তেমন লাল নয়, রাগি লাল, খ্যাপা লাল! আর নিচে মাওরিদের মধ্যে হুলুস্থুল প’ড়ে গিয়েছে। নিষিদ্ধ পাহাড়ে পা দিয়েছে ব’লে খেপে গিয়েছেন পাতালের আগুনদেবতা, আগুন ওগরাতে শুরু করেছে নিষিদ্ধ পাহাড়, পালাও, পালাও, প্রাণ হাতে ক’রে পালাও, এক্ষুনি! ‘অমঙ্গল! অমঙ্গল!’ সম্মিলিত চীৎকার : ‘ট্যাবু! ট্যাবু!’ আর সেই আতঙ্কের চীৎকারও এখন মিশে যাচ্ছে অগ্ন্যুদগারের নির্ঘোষের সঙ্গে।
পাঞয়লের বুদ্ধিটা বোধহয় সর্বনাশই নিয়ে এসেছে ডেকে! এতদিন যা ছিলো পাথরচাপা, এখন তা খোলা মুখ পেয়ে প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসছে। এতকাল এখানকার বাষ্পের চাপ টোনগারিরোর জাগ্রত জ্বালামুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতো, কিন্তু এখন সব গ্যাস, সব লাভা বেরিয়ে আসছে এই নতুন মুখটা দিয়ে। আর বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে সমস্ত পাহাড়। অ্যাটলাস বুঝি আর তার কাঁধের ওপর বইতে পারছে না পৃথিবীকে—তার বুঝি পা টলছে। আর এই ভূকম্পন, বিস্ফোরণ আর অগ্নিবমনের সঙ্গে তাল রেখেই খেপে উঠেছে আকাশ, বিদ্যুৎ ফালা ফালা ক’রে চিরছে অন্ধকারকে, বজ্র হুংকার দিয়ে উঠছে ঘন-ঘন।
‘অবরুদ্ধ ছিলো বাষ্প, বিস্ফোরণ দীর্ণ করে ঢাকা-
উদ্দাম বেরিয়ে আসে পাতালের চাপা-পড়া রোষ—
তরল আগুনে নাচে ক্ষিপ্তলাল মৃত্যুরই পতাকা—
সমস্ত না-ধ্বংস হ’লে শান্ত বুঝি হবে না আক্রোশ!’
হঠাৎ কার যেন একটা কবিতার টুকরো মনে পড়ে গেলো পাঞয়লের।
সারারাত আগ্নেয়গিরি তার আক্রোশ ঢেলে দিলে লাভার আকারে। ভোরবেলাতেও তার রোষ আদৌ প্রশমিত হয়নি। ঝড়ও সমানতালে বাজ ফাটাচ্ছে—যেন হাততালি দিচ্ছে দৃশ্যটাকে। আর, নিচে, মাওরিদের মধ্যে আতঙ্ক যেন ক্রমশই সব সীমা ছাপিয়ে যাচ্ছে।
তারই মধ্যে কাই-কুমু এসে নতুন ক’রে ট্যাবুজারি ক’রে গেলো, শুধু-যে আগুনের পাহাড়টাই পুরোপুরি নিষিদ্ধ হ’লো, তা নয়—নিষিদ্ধ হ’লো পাহাড়তলিও। আর তারপর এই রাক্ষুসে-অমঙ্গলের জায়গা ছেড়ে চ’লে গেলো মাওরিরা—আজ থেকে এই তল্লাটই তারা আর মাড়াবে না।
সেই অর্থে পাঞয়লের ফন্দিটা কাজে খেটে গেছে। এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে কখন থামে আগুনের এই সংহারলীলা।
আর অপেক্ষাতেই কাটলো সারাটা দিন। বিকেলের দিক থেকে অগ্ন্যুদগারের প্রথম চোটটা একটু কমলো। রাত নটা নাগাদ শান্ত হ’য়ে এলো পাহাড়, জ্বালামুখ দিয়ে শুধু ধোঁয়া উঠছে এখন—বাষ্পের সেই তেজ আর নেই, আর বেরুচ্ছে না তরল আগুন। কিন্তু এটা যে একটা অগ্ন্যুদগার থেকে আরেকটা অগ্ন্যুদগারের মধ্যকার সাময়িক বিরতি নয়, তা কে জানে? আর একমুহূর্তও দেরি নয়। পলাতকেরা ঠিক করেছেন, এক্ষুনি এখান থেকে নেমে যাবেন, সোজা ছুটবেন উপসাগরের দিকে। পাঞয়ল সমস্ত বিপদ আপদের মধ্যে একবারের জন্যেও নিউ-জিল্যাণ্ডের মানচিত্র কাছ-ছাড়া করেননি। তিনি মোটামুটি ছক ক’ষে নিয়েছেন— কোনদিকে গেলে উপসাগর পড়বে। এখন শুধু সেদিক দিয়েই তাঁদের চলতে হবে, যতক্ষণ-না তাঁরা গিয়ে উপসাগরের তীরে পৌঁছোন।
সেই-যে তাঁরা চলতে শুরু করেছেন, তারপর যে কতক্ষণ কেটেছে, কারু খেয়াল ছিলো না। সকাল নটায় ক্লান্ত দেহগুলিকে প্রায় টেনেহিঁচড়েই যেন নিয়ে যেতে হচ্ছিলো তাঁদের। শুধু স্নায়ুর জোর আর অপ্রশম্য উত্তেজনাই একনাগাড়ে প্রায় বারো ঘন্টা হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে তাঁদের। সামান্য বিশ্রামের পর আবার শুরু হলো তাঁদের পথচলা। এখন তাঁরা যে-জায়গাটার মধ্যে দিয়ে চলেছেন, সেটাকে প্রায় আগুনের দেশই বলা যায়—এখনও তাঁরা আগ্নেয়গিরির পাল্লা থেকে বেরুতে পারেননি। মাইলের পর মাইল জুড়ে পর-পর এসেছে ছোটোবড়ো আগুনজ্বালা হ্রদ, ফোয়ারার মতো গরম বাষ্পে ভরা জল আকাশ লক্ষ্য ক’রে উগরেছে উষ্ণ প্রস্রবণ, গন্ধকের ঝর্না থেকে বেরিয়ে এসেছে ঝাঁঝালো দম আটকানো গন্ধ।
পাঞয়ল মোটামুটি আন্দাজ ক’রে নিয়েছেন কোনদিক দিয়ে যেতে হবে—কিন্তু দু-একটা ছোটোখাটো হুঁ-হাঁ ছাড়া তাঁর মুখে আর-কোনো বুলি নেই, যে-মুখে সারাক্ষণ খই ফুটতো সে-মুখ এখন চুপ, কেমন যেন গম্ভীরও, কী-একটা অদ্ভুত বদল এসেছে তাঁর মধ্যে, সেই লাল-কালো আলখাল্লাটা মুড়ি দিয়ে সারাক্ষণ কী যেন ভাবতে-ভাবতে কলের মতো পথ চলেছেন তিনি।
আর এইভাবেই দিনের পর দিন। কখন ছাড়িয়ে এসেছেন আগ্নেয়গিরির অঞ্চল, কবে ঢুকেছেন গভীর জঙ্গলে, কবে যে পেরিয়ে এসেছেন সেই জঙ্গলও, সেটাই যেন কারু খেয়াল নেই। শুধু হুঁশিয়ার থাকতে হয়, যখন মনে হয় কাছেই আছে মাওরিদের বসতি, না-হলে শুধু ধুঁকতে ধুঁকতে একটানা চলো, যতক্ষণ-না চোখের সামনে দেখতে পাও বিশাল-নীল জলের বিস্তার। যেন একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে চলেছেন সবাই, কি-রকম একটা আচ্ছন্নভাব, তার মধ্যে আশাও নেই—হতাশাও নেই, শুধু মোহ্যমান বিধুর দশা—যেন পাঞয়লেরই ছোঁয়াচে রোগটা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, সকলের মুখ থেকেই সব কথা ফুরিয়ে গিয়েছে, কেউ যেন আর-কিছু ভাবতেও চাইছে না, কে যেন অদৃশ্য থেকে সমানে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাঁদের।
আর এইভাবে যখন শেষটায় প্রশান্ত মহাসাগরের কাছে বসতির মধ্যে এসে পৌঁছুলেন সবাই, তখন আবার নতুন-একটা বিভীষিকারই যেন মুখোমুখি হ’তে হলো। একটা বিধ্বস্ত গ্রাম। শূন্য-সব কুঁড়েবাড়ি। ছারখার সব খেতখামার। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাওরিদের মৃতদেহ—সেগুলো প’চেও যায়নি। যার মানে হ’লো সদ্য সেখানে শাদাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিলো মাওরিদের, আর ত্রস্ত ও বিপর্যস্ত—যে যেদিকে পারে পালিয়েছে, যারা পালাতে পারেনি—শিশুনারীবৃদ্ধ—তাদের মৃতদেহ প’ড়ে আছে শেয়াল ও শকুনের খাদ্য হবে ব’লে।
আর একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে, ডাঙাটা অন্তরীপের মতো সরু ফালি হ’য়ে ঢুকে পড়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের জলে। মৃতের এলাকায় এসে যতটা মনখারাপ হয়েছিলো, এই দূর নীল জলের ঢেউ ঠিক ততটাই নূতন উদ্যম এনে দিলে সকলের মাঝে। আর তারপরেই একটা হৈ-হৈ রৈ-রৈ চীৎকারে যেন চটকাটাই ভেঙে গেলো আচমকা পেছনে রে-রে ক’রে তেড়ে আসছে একদল মাওরি। হয়তো তারা তাকে-তাকে ছিলো, কীভাবে বদলা নেবে, কীভাবে শাদাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবে তাদের প্রতিহিংসা, আর এই বিধ্বস্ত ছোট্ট দলটাকে দেখেই আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে তাড়া ক’রে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই চেঁচিয়ে উঠেছেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স : ‘নৌকো! নৌকো! ‘ কাছেই, সমুদ্রের ধারেই বালিয়াড়ির মধ্যে প’ড়ে আছে ছয়-দাঁড়ের একটা ছিপছিপে ক্যানু। ভাবার কোনো সময় নেই। তক্ষুনি ক্যানুতে চেপে সেটা তাঁরা ভাসিয়ে দিলেন সাগরজলে, দেখতে পেলেন মাওরিরা ডাঙায় দাঁড়িয়ে তাঁদের দিকে চেয়ে অস্ত্রশস্ত্র নেড়ে উৎকট আস্ফালন করছে। কিন্তু এদের হাত এড়িয়ে তো জলে ভেসে-পড়া গেছে। আর ভয় কী? ম্যাঙ্গল্স তীর থেকে বেশি-দূরে নিয়ে যেতে দেননি ক্যানুটা, তীরের সমান্তরাল প্রায় মাইলখানেক দূর দিয়ে যাবেন ব’লেই হালে ব’সে দিক ঠিক করেছেন, আর অন্যরা সবেগে দাঁড়া বাইছে।
কিন্তু কাপ্তেন ম্যাঙ্গলসের পরিল্পনায় জলাঞ্জলি দিতে হ’লো কয়েক মিনিটের মধ্যেই। অন্তরীপের মুখ থেকে তাঁদের ক্যানুকে লক্ষ্য ক’রে ছুটে আসছে মাওরিদের তিনটে ক্যানু—সেগুলো আরো-লম্বা, আরো বেশি দাঁড়ের, আরো-দ্রুতগামী। নাগাল প্রায় ধ’রেই ফ্যালে দেখে প্রমাদ গুনলেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স। কিছু না-ভেবেই ক্যানুটার মুখ ঘুরিয়ে দিলেন বারদরিয়ার দিকে।
আর শুরু হ’লো নৌকোর বাইচ। অসমান এক প্রতিযোগিতা। এঁরা সবাই পথের ধকলে ধুঁকছেন, মাওরিরা যুদ্ধে বিপর্যস্ত হ’লেও এঁদের মতো এখন নেতিয়ে পড়েনি, বরং প্রচণ্ড তেজেই এগুচ্ছে। আর তারপর যেই পাল্লার মধ্যে এসেছে তাঁদের ক্যানু, মাওরিদের কাছ থেকে সম্ভাষণ এসেছে ঝাঁকে-ঝাঁকে বন্দুকের গুলিতে।
সামনে অথৈ দরিয়া, পেছনে বন্দুকের গুলি! কিন্তু বন্দুকের গুলি তো সাক্ষাৎ মৃত্যু! তার চেয়ে বরং সমুদ্র লক্ষ্য ক’রে চলাই ভালো। মরণ যদি আসে, তবে সে আসুক সিন্ধুজলেই। তারা তো ডানকাননিয়ে জলেই ভেসেছিলেন একদিন—কবে, সে এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়, কিন্তু দূরের সমুদ্রের দিকে তাকিয়েই গ্লেনারভন চিৎকার ক’রে উঠলেন খ্যাপার মতো : ‘জাহাজ! জাহাজ!’
অমনি পাঞয়ল তাঁর চোখ রাখলেন তাঁর টেলিস্কোপে, যে-টেলিস্কোপ তাঁর বুকেই ঝোলে সারাক্ষণ, দড়ি দিয়ে বাঁধা।
সত্যি তো, একটা স্টীমশিপ ছুটে আসছে এদিকটায়, আর ছুটে আসছে পুরোদমে, ভলকে-ভলকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে তার চোঙ দিয়ে, পেছনে শুধু ঢেউয়ের রেখা এঁকেই এগুচ্ছে না, আকাশেও যেন এঁকে দিচ্ছে ধোঁয়ার পুচ্ছ।
আর এটাই যেন নতুন উৎসাহ এনে দিয়েছে সকলের মধ্যে। চৌদুনে সবাই দাঁড় চালাচ্ছে এখন। বাষ্পেচলা জাহাজটা অনেটকাই কাছে এসে পড়েছে এখন। দুটো মাস্তুল দেখা যাচ্ছে। পেছনে কিন্তু মাওরিদের ক্যানুগুলো থেকে বিরামহীন গুলি আসছে ঝাঁকে-ঝাঁকে। তবে যদি জাহাজটাকে ধরে ফেলা যায় এক্ষুনি—
পরক্ষণেই দূরবিনে চোখ লাগিয়ে গ্লেনারভনের মুখ পাংশু হয়ে গেলো—এক-নিমেষে কেউ যেন সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে তাঁর মুখ থেকে।’ডানকান! বোম্বেটেজাহাজ ডানকান!
কেউ কি কখনও ভেবেছিলো, একদিন লর্ড গ্লেনারভন নিজের এত সাধের জাহাজটাকে দেখে আতঙ্কে নীল হ’য়ে যাবেন? এটা যদি নিয়তির নির্মম পরিহাস না হয়, তবে পরিহাস আর কাকে বলে?
‘ডানকান!’সঙ্গে-সঙ্গে হাল থেকে লাফিয়ে উঠেছেন জন ম্যাঙ্গল্স। ডানকান শুধু লর্ড গ্লেনারভনেরই জাহাজ নয়—তাঁরও জাহাজ! তিনিই ঐ জাহাজের কাপ্তেন।
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ডানকান!’গ্লেনারভন বোধহয় এবার পাগলই হ’য়ে গেছেন বুঝি। সামনে মৃত্যু—ডানকান! পেছনেও মৃত্যু—মাওরিদের ক্যানু!
আর যেন তাঁর খ্যাপা হাহাকারের উত্তরেই ডানকানের ডেক থেকে গ’র্জে উঠলো কামান—তুলকালাম আওয়াজ ক’রে মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেলো কামানের গোলা। আর পেছন থেকে, সমানে তখনও বন্দুকের গুলি ছুটে আসছে তাঁদের ক্যানু লক্ষ্য ক’রে।
সামনে কামান, পেছনে বন্দুক! দুইই আগুন ওগরাচ্ছে! সামনে বোম্বেটেরা–পেছনে মাওরিরা! দু-দলই মায়াদয়ার ধার ধারে না!
কিন্তু ততক্ষণে জন ম্যান্সল্সকে সজোরে আঁকড়ে ধরেছে রবার্ট : ‘টম অস্টিন! টম অস্টিন! ঐ তো দাঁড়িয়ে আছে ডেকের ওপর! হ্যাঁ-হ্যাঁ, টম অস্টিনই! আমাদের চিনতে পেরেছে—ঐ যে মাথার টুপি খুলে নাড়ছে—সে-তো আমাদের দেখেই—–’
জন ম্যাঙ্গল্স ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়ে রইলেন ডানকানেরদিকে! এও কি সম্ভব? কিন্তু পরক্ষণেই ডানকানের ডেক থেকে আবার গ’র্জে উঠলো কামান। আর গোলাটা এবার চাঁদমারি খুঁজে পেয়েছে। মথার ওপর দিয়ে তীব্র ও ধারালো শিস তুলে ছুটে গিয়েছে মাওরিদের একটা ক্যানুর দিকে—আর সেটা গোলার ঘায়ে দু-টুকরো হ’য়ে যেতে-যেতে যেন জল থেকে একটা বিষম লাফ দিয়েছে শূন্যে!
আর মাঝখানের ক্যানুটা গোলায় উড়ে যেতেই থমকে পড়েছে অন্য ক্যানু দুটো।
তারপর আবারও একটা কামানের গর্জন!
আর এই তৃতীয় গোলাটা উড়ে গিয়ে মাওরিদের কোনো ক্যানুতে পড়বার আগেই মাওরিরা বেগতিক দেখে, প্রায় যেন হতভম্বভাবেই, উলটোদিকে— তীরের দিকে—তাদের ক্যানুর মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে!
কখন যে তারপরে লর্ড গ্লেনারভনেরা নিজেদের জাহাজের ডেকে পা রেখেছেন, তা তাঁরা নিজেরাই জানেন না। পুরো ব্যাপারটাই কোনো অতিকায় স্বপ্ন নয়তো? স্বপ্নে যেমন সব থাকে ছেঁড়া-ছেঁড়া, কার্যকারণসম্পর্কবিহীন, কাকতালের উল্লাসে ভরা এলোমেলো সংলগ্ন-অসংলগ্ন সব দৃশ্য-এও তার মতো কিছু নয়তো?
তাঁরা কি তবে সত্যি এসে উঠেছেন ডানকানে? সে কি তবে বোম্বেটের জাহাজ নয় এখনও?
৪. কৌতুকের ঘূর্ণিপাকে
মাত্র তিনমাস আগে যাঁরা, আশায় ভরপুর, ডানকান থেকে নিঃশঙ্ক চিত্তে ও উৎফুল্ল আননে নেমে গিয়েছিলেন, আজ তাঁরাই—না, পরিকল্পনামাফিক নয়, বরং মানুষের কষা সমস্ত গণিতকেই বানচাল করে দিয়ে—অপ্রত্যাশিতভাবে যেন নেহাৎ কপালজোরেই ফিরে এসেছেন ডানকানের ডেকে। কিন্তু এ-কী হতশ্রী চেহারা তাঁদের? ছেঁড়াখোঁড়া জীর্ণ পোশাক, উদ্ভ্রান্ত ব্যাকুল শুষ্কশীর্ণ মুখ, চোখে এ-কী-রকম অসহায় ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি? গ্লেনারভন এমন কল্পনাতীতভাবে ডানকানেউঠে এসে তখনও যেন বুঝে উঠতে পারেননি গোটাটাই কোনো স্বপ্ন, না কি সত্য। জাহাজের মাঝিমাল্লারা অবশ্যি হঠাৎ তাঁদের ফিরে পেয়ে তুমুল হৈ-চৈ জুড়ে দিয়েছে। কিন্তু লেডি হেলেনা আর লর্ড এডওয়ার্ডের দশা যেন তাদের পুনর্মিলনের উৎসবে একটু ঠাণ্ডাজলই ঢেলে দিলে।
খিদেয় প্রায় নুয়ে পড়েছেন, অবসাদে দেহ ভেঙে পড়েছে—তবুও লর্ড গ্লেনারভন কিন্তু প্রথমেই টম অস্টিনের কাছে জানতে চাইলেন, টুফোল্ড উপসাগরের মুখে না-গিয়ে-ডানকান নিউ-জিল্যাল্ডের পুব-উপকূলে কী করতে এসেছে? তবে কি জাহাজটাকে নরাধম দস্যু বেন জয়েস দখল করতে পারেনি? তাছাড়া জেল থেকে পালানো সেইসব কয়েদিরাই বা কোথায়?
‘জেলপালানো কয়েদি?’ টম অস্টিন যেন আকাশ থেকেই পড়েছে। এ-কথার অর্থ? লর্ড গ্লেনারভন কি জানেন, তিনি কী-সব আবোলতাবোল বকছেন?
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ! ঐ যারা জাহাজটা দখল ক’রে নেবে ব’লে হানা দিয়েছিলো?’
বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়! এবারে বিভ্রান্ত ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি বুঝি-বা টম অস্টিনেরই। ‘জাহাজে হানা দিয়েছিলো? কারা? কোন জাহাজে?’
‘কেন? ডানকানে! বেন জয়েস আসেনি ডানকানে?’
‘কে বেন জয়েস? আমি তার নামও শুনিনি কখনও, চোখে দেখা তো দূরের কথা!’
‘দ্যাখোনি? তাহ’লে টুফোল্ডের মুখে না-গিয়ে ডানকান এখানে—নিউ-জিল্যান্ডের এই পূর্ব-উপকূলে কী করছে?’’বাঃ রে, সে তো আপনার হুকুমেই এখানে এসেছি।’
‘আমার হুকুমে?!’
‘নিশ্চয়ই। না-হ’লে আমরা খামকা মেলবোর্ন ছেড়ে বেরুবো কেন? চোদ্দই জানুয়ারি যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, কালবিলম্ব না করে তক্ষুনি তো পালন করেছি—অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র থেকে বেরিয়ে পড়েছি।’
‘আমার চিঠি? আমি তোমাকে চিঠিতে অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে নিউ-জিল্যান্ডে চ’লে আসতে বলেছিলুম?’
এ-কোন চিঠির কথা বলছে টম অস্টিন? একটা চিঠি তিনি লিখেছিলেন—না, তিনি নিজের হাতে লেখেননি, জখম হ’য়ে গিয়ে ব্যথায়-অবশ হাতটা তিনি তখন প্রায় নাড়তেই পারতেন না, তবে তাঁরই বয়ান অনুযায়ী সেটা গোটা-গোটা হরফে স্পষ্ট ক’রে লিখে দিয়েছিলেন জাক পাঞ্চয়ল। তিনি চিঠিটা না-প’ড়েই কোনোমতেই শুধু তলায় নাম সই ক’রে দিয়েছিলেন।
গ্লেনারভনের মাথাটা আবার কেমন যেন ঘুরে গেলো। সব গোলমাল হ’য়ে যাচ্ছে। অন্যারা পাশেই দাঁড়িয়ে এতক্ষণ এই কথোপকথন শুনছিলো, তারাও সবাই কি-রকম যেন বোমকে গিয়েছে। টম অস্টিন যে কী বলতে চাচ্ছে, তা-ই কারু মাথায় ঢুকছে না। ডানকানযে নিউ-জিল্যান্ডের পূর্ব-উপকূলে সমুদ্রে টলহ দিয়ে বেড়াচ্ছে, তা নাকি লর্ড গ্লেনারভনেরই নির্দেশমাফিক!
আবেশটা কাটিয়ে ওঠবার চেষ্টা করেছেন তখন গ্লেনারভন। ‘এ আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না তো?…আচ্ছা, এক-এক ক’রে সব শুনি। প্রথমেই—টম, সত্যি করে বলো, তুমি কি আমার কোনো চিঠি পেয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ। পেয়েছি।’
‘মেলবোর্নে?’
‘মেলবোর্নেই। আমরা তখন ডানকানের মেরামতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলুম।’
‘চিঠিটা কী-রকম? আমার লেখা?’
‘না, হাতের লেখাটা আপনার ছিলো না বটে, আপনার বকলমে নিশ্চয়ই আর-কেউ লিখেছিলেন, তবে তলায় আপনার নাম সই ছিলো।’
‘চিঠিটা কে নিয়ে এসেছিলো? বেন জয়েস? সেই ভয়ংকর দস্যু, যার নামে অস্ট্রেলিয়ায় হুলিয়া বেরিয়েছিলো?’
‘কই, না তো। চিঠি যে নিয়ে এসেছিলো তার নাম তো আয়ারটন। সে তো ব্রিটানিয়া জাহাজের কোয়ার্টারমাস্টার ছিলো।’
‘আয়ারটন আর বেন জয়েস একই লোক। কিন্তু কী লেখা ছিলো চিঠিতে?’
‘লেখা ছিলো : চিঠি পাবামাত্র যেন একমুহূর্তও দেরি না-ক’রে—’
অত কথা শোনবার মতো ধৈর্য বুঝি তখন ছিলো না গ্লেনারভনের। ‘অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব-উপকূলে টুফোল্ড উপসাগরের মুখে যেতে বলেছিলুম।’
এবার আবারও হতভম্ব হবার পালা বেচারা টম অস্টিনের। ‘অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব-উপকূলে? না তো। স্পষ্ট ক’রে লেখা ছিলো, একমুহূর্তও দেরি না-ক’রে যেন নিউ-জিল্যান্ডের পূর্ব-উপকূলে চ’লে আসি।’
‘না! না! না!’ এতক্ষণ যারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই কথোপকথন শুনছিলো, এবার তারা সকলেই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছে।
টম অস্টিন এবার সত্যি ঘাবড়ে গিয়েছে। একটা চিঠিও কি সে ঠিকমতো পড়তে পারে না? মাত্র দু-তিনটে লাইন? চিঠি প’ড়ে সে তো যেমন নির্দেশ ছিলো তা-ই করেছে। তবে কি চিঠিটা পড়তেই তার ভুল হয়েছে?
এতদিন সে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই সব কাজ ক’রে এসেছে। সকলেই বলতো তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। একদিন নিজেই সে কোনো জাহাজ চালাবার ভার পাবে—খোদ কাপ্তেন হ’য়ে উঠবে। আর ঠিক যখনই একটা জাহাজ নিজে থেকে চালাবার ভার পেয়েছে, মহড়া দিচ্ছে কাপ্তেনগিরির, ট্রায়াল রানযাকে বলে, ঠিক তখনই এত-বড়ো একটা মারাত্মক ভুল! তার এতদিনের সুনামের পাশে অ্যাদ্দিনে একটা মস্ত কালো ট্যাড়া প’ড়ে গেলো? পারলে সে যেন কোনো শামুকের মতো এক্ষুনি তার খোলার ভেতর গুটিয়ে যেতো!
তার লাল-হ’য়ে-যাওয়া মুখটা দেখে কেমন যেন দয়াই হয়েছে গ্লেনারভনের। তিনি সান্ত্বনার সুরে বলেছেন : ‘অত মনখারাপ কোরো না। তোমার ভুলে বরং শাপেবরই হয়েছে—ঐ ভুলটা না-করলে আজ আর তোমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে পারতুম না।’
ততক্ষণে টম অস্টিন নিজেকে সামলে নিয়েছে। ‘মাপকরবেন, মি-লর্ড। এত-বড়ো কোনো ভুল আমি করতেই পারি না। সে-চিঠি শুধু আমিই পড়িনি, আয়ারটনও পড়েছে। সে বরং চিঠি প’ড়ে হম্বিতম্বি করছিলো। বলছিলো, চিঠিতে ভুল লেখা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব-উপকূলে জাহাজটাকে নিয়ে যাবার জন্যে সে বরং জোরজবরদস্তি করতে চাচ্ছিলো।’
‘আয়ারটন?!’
‘হ্যাঁ। সে ধুয়ো ধরেছিলো, চিঠিতে নাকি ভুল লেখা হয়েছে। আপনি নাকি ডানকানকে টুফোল্ড উপসাগরের মুখেই নিয়ে যেতে বলেছেন।
এতক্ষণে অকুস্থলে নেমে পড়েছেন মেজর ম্যাকন্যাব্স। তাঁর মাথার মধ্যে সমস্তকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। ‘টম, চিঠিখানা কোথায়? সেটা দেখলই তো সব ভুলবোঝাবুঝি দূর হ’য়ে যাবে।’
‘আনছি’। ব’লেই ঊর্ধ্বশ্বাসে নিজের ক্যাবিনে ছুটে গিয়েছে টম অস্টিন।
আর সে চ’লে যেতেই সবাই একসঙ্গে কলরব ক’রে উঠেছেন। এ আবার কেমনতর প্রহেলিকা! ছিলো অস্ট্রেলিয়া, হ’য়ে গেলো নিউ-জিল্যাণ্ড। ব্যাঙাচির ল্যাজ খ’সে পড়লে ব্যাঙ হ’য়ে যায়, এটা সবাই জানে। কিন্তু কোথায় AUSTRALIA, আর কোথায় NEW ZELANAD!
মেজর ম্যাকন্যাব্স এই কলরবে যোগ না-দিয়ে বরং সরাসরি জাক পাঞ্চয়লের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। ‘মঁসিয় পাঞয়ল, ব্যাপারটা খুব গোলমেলে হ’য়ে গেলো না তো?’
‘গোলমেলে? মানে?’ জাক পাঞ্চয়ল কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।
আর তক্ষুনি হন্তদন্ত হ’য়ে চিঠিটা হাতে ক’রে নিয়ে এসেছে টম অস্টিন। নাঃ, চিঠিটায় কোনো গোলমাল নেই—কেউ চিঠিটা জাল করেনি। এটা সেই চিঠিই, যা লিখেছিলেন মঁসিয় পাঞয়ল, আর যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন লর্ড গ্লেনারভন।
টম অস্টিন চিঠিটা লর্ড গ্লেনারভনের দিকেই বাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘আপনিই পড়ুন।’
গ্লেনারভন পড়লেন :
টম অস্টিনকে হুকুম দিচ্ছি সে যেন এক্ষুনি ডানকানকে নিউ-জিল্যাণ্ডের পূর্ব-উপকূলে নিয়ে যায়।’
‘নিউ-জিল্যাণ্ড!’ গ্লেনারভনের হাত থেকে চিঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়েছেন মঁসি পাঞয়ল। আর চিঠিটার ওপর চোখ বুলিয়েই তিনি যেন আঁৎকে উঠেছেন। ‘নিউ-জিল্যাণ্ড!’ তাঁর চোখদুটো ছানাবড়া হ’য়ে উঠেছে, তাতে সাতরাজ্যের বিস্ময়, আর হাত থেকে খ’সে প’ড়ে গিয়েছে চিঠিটা।
মেজর ম্যাকন্যাব্স তাঁর কাঁধে হাত রেখেছেন। প্রায় তারিফ করার ভঙ্গি ক’রেই বলেছেন : ‘বাহবা, মঁসিয় পাঞয়ল। আপনি যে ডানকানকে কোচিন-চিনে পাঠিয়ে দেননি, এজন্যে আপনাকে শাবাশি দিতেই হবে!’
বেচারা জাক পাঞ্চয়ল! জাহাজশুদ্ধু সবাই এমনভাবে হো-হো করে হেসে উঠেছে যে তাঁর মনে হয়েছে পারলে বুঝি কোনো-একটা গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে সেঁধিয়ে যান।
কিন্তু এ-কী! মেজর ম্যাকন্যাব্সের ঠাট্টায় পাঞয়লের মাথাটা পুরোপুরি বিগড়ে গেলো নাকি? তাঁর মুখচোখের চেহারা দুম ক’রে পালটে গিয়েছে। একটু আগেই যেন লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিলো, এখন এক তুলকালাম উৎসাহে একবার দৌড়ে গেলেন জাহাজের সামনে, একবার পেছনে, প্রায় একটা পুরো-পাকই খেয়েছেন জাহাজের ডেকে। তিড়িং-তিড়িংক’রে লাফিয়েছেন। কী-যে করবেন, কিছুই যেন ভেবে পাচ্ছেন না। মাথা নাড়ছেন আপন মনে, কী যেন বিড়বিড় ক’রে বকছেন—খেয়ালই নেই কখন কোথায় যাচ্ছেন! হনহন ক’রে একবার উঠে গেছেন ক্যাবিনের সিঁড়ি বেয়ে, পরক্ষণেই তিন লাফেই ফের নেমে এসেছেন ডেকে, সোজা ছুটে গেছেন ফোরকালের দিকে, আর তারপরেই ঘটেছে দুর্ঘটনাটা! হঠাৎ পা জড়িয়ে গেছে কুণ্ডলীপাকানো কাছিতে, মুখ থুবড়ে পড়তে-পড়তে সজোরে চেপে ধরেছেন সামনে যে-দড়িটা ঝুলছিলো তাকেই—
আর তক্ষুনি প্রচণ্ড আওয়াজ ক’রে গর্জে উঠেছে কামান, গোলা ছুটে গিয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের অস্থির জলের ওপর দিয়ে। বারুদঠাশা কামানের দড়িটা পাকড়ে ধ’রেই প’ড়ে যেতে-যেতে টাল সামলেছেন পাঞয়ল। আর কামানের এই তুলকালাম আওয়াজ শুনে বেজায় ভড়কে গিয়ে পিছোতে গিয়ে চিৎপাত পড়েছেন হালের চাকার ওপর। প’ড়েই নটনড়নচড়ন নট কিচ্ছু। এ আবার কোন ফ্যাসদ-ভদ্রলোক হার্টফেল ক’রেই ম’রে গেছেন নাকি? সবাই হন্তদন্ত হ’য়ে ছুটে গেছেন তাঁর দিকে। না, মারা যাননি পাঞয়ল, তবে ভির্মি খেয়েছেন, কেমন একটা দাঁতকপাটি লেগে গেছে! সবাই তাঁকে ধরাধরি ক’রে নিয়ে এলো জাহাজের পেছন দিককার উঁচু মাচাটায়।
বেচারি পাঞয়লের দশা দেখে ততক্ষণে মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে সবার! মেজর ম্যাকন্যাব্স ফৌজে থাকার সময় কতবারই কতজনের প্রাথমিক চিকিৎসার ভার নিয়েছেন, ফার্স্টএইড দিয়েছেন। তিনি ঝুঁকে প’ড়ে পাঞয়লের সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ লাল-কালো ঢোলাজামাটা ক্ষতস্থান দেখছেন ব’লে যেই না হাত দিয়েছেন, অমনি তিড়িং-বিড়িংক’রে লাফিয়ে উঠেছেন ভির্মি-খাওয়া মানুষটা – যেন তাঁর দেহে বিদ্যুৎ ঝাঁকুনি দিয়েছে।
‘না, না, ককখনো না,’ ছোঁড়াখোঁড়া জামাটা টেনেটুনে এমনি তড়িৎগতিতে তিনি ফের সারা গা ঢেকে দিয়েছেন যে সবাই ভারি তাজ্জব হ’য়ে গেছেন। মাথায় চোট খেয়ে শেষটায় পুরোপুরি বিগড়ে গিয়েছে নাকি মগজটা?
মেজর তো-তো ক’রে শুধু বলতে চেয়েছেন—’কিন্তু, তাহ’লে–‘
মুখের মাথা কেড়ে নিয়েই বলেছেন পাঞয়ল—’গায়ে হাত দিলে ভালো হবে না বলছি।’
‘এ তো আচ্ছা জ্বালা হ’লো দেখছি! দেখতে হবে না হাড়গোড় কোথাও ভাঙলো কি না!’
‘যা ভেঙেছে, সেটা সারাতে ছুতোর লাগবে।’
‘অ্যাঁ!’
‘কী ভেঙেছে!’
‘এ-যে মাথাটাই গেছে!’
সবাইকার একসঙ্গে এই ধরনের কথাবার্তার উত্তরে পাঞয়ল ভাবলেশহীন মুখে জানিয়েছেন—’ভেঙেছে তো খুঁটিটা—যেটার ওপর আছাড় খেয়েছিলুম।’
এবার আর হেসে না-উঠে পারেননি কেউই। যাক, ভদ্রলোক শুধু পাগলই নন—নিরেটও। কামানের সঙ্গে কোলাকুলি করার পরিণামে তাঁর দেহে অন্তত কোনো জখম হয়নি—কিন্তু কোথায় কোনো আঁচড় পড়েছে কি না, সেটা ঠিক বোঝা যায়নি। তা, তিনি যখন কাউকেই দেখাতে দেবেন না কী হয়েছে, তখন বোঝাই যাচ্ছে তেমন গুরুতর কোনো আঘাত লাগেনি।
গ্লেনারভন কিন্তু নাছোড়ের মতো লেগে রয়েছেন। আচ্ছা, এবার পুরো ব্যাপারটার জট খুলে দিন তো, মঁসিয় পাঞয়ল! চিঠি লেখার সময় আপনি এই মস্ত ভুলটা না-করলে ডানকান বোম্বেটেজাহাজ হ’য়ে যেতো ঠিকই—আর আমরাও হয়তো মাওরিদের হাত থেকে কিছুতেই রেহাই পেতুম না। আপনার এই ভুলটার কাছে তাই আমাদের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। কিন্তু আমি যেটা বুঝতে পারছি না আপনি এই ভুলটা করলেন কী করে? অস্ট্রেলিয়া লিখতে গিয়ে নিউ-জিল্যাণ্ড লিখতে তো দুর্দান্ত প্রতিভা লাগে—ব্যারন মুনখাউসেনের প্রতিভাতেও তা সম্ভব হ’তো কি না, কে জানে!
‘শুনুন তবে, লর্ড এডওয়ার্ড। সর্বসমক্ষে আমি কবুল করছি আমি একটা আস্ত গাড়ল, আকাট বোকা! সেই গোড়া থেকেই একটার পর একটা ভুলই ক’রে চলেছি শুধু।
এমন স্বীকারোক্তির পর কী-যে বলা যায়, সেটা এমনকী দুদে ম্যাক্ন্যাসেরও মাথায় আসেনি।
কিন্তু গ্লেনারভন এবার ফের টম অস্টিনকে নিয়েই পড়েছেন। ‘আচ্ছা, টম, হঠাৎ নিউ-জিল্যাণ্ড যাবার হুকুম পেয়ে তোমার মনে কোনো খটকা জাগেনি?
‘জেগেছিলো। আমি একটু অবাকই হয়েছিলুম। কিন্তু আমি জাহাজের ফার্স্টমেট—ওপর থেকে হুকুম এলে আমার দিক থেকে প্রশ্ন করা মানায় না—আমি শুধু হুকুম তামিল করতেই শিখেছি। আমি যদি নির্দেশমতো কাজ না-করতুম আর আপনাদের যদি মস্ত কোনো বিপদ ঘ’টে যেতো, তবে আমিই কি তার জন্যে দায়ী হতুম না? আচ্ছা, কাপ্তেন, ম্যাঙ্গসের দিকে কাতরভাবে তাকিয়ে সে জিগেস করেছে, ‘আপনি হ’লে কী করতেন?’
‘তুমি যা করেছো, তা-ই করতুম।’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের কথায় কোনো দ্বিধা নেই। ‘কিন্তু এ-রকম একটা অদ্ভুত হুকুম প’ড়ে তোমার কিছুই মনে হয়নি?’ গ্লেনারভন জেদ ধরেছেন : ব্যাপারটার একটা ফয়সালা না-ক’রেই তিনি ছাড়বেন না।
‘আমার মনে হয়েছিলো, আপনারা নিশ্চয়ই কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো খোঁজ পেয়ে একমুহূর্তও সবুর না-করে সোজা নিউজিল্যাণ্ডের পুব-উপকূলের দিকে অন্যকোনো জাহাজে করে চ’লে গিয়েছেন—আমাকেও আসতে বলেছেন ডানকান নিয়ে। তাই কাউকে কিছু না-বলেই আমি তৎক্ষণাৎ জাহাজ ছেড়ে দিই। বারদরিয়ায় পড়ার আগে জাহাজের আর-কেউই জানতে পারেনি আমরা কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু তারপরেই এমন-একটা ঘটনা ঘটলো যে সব তালগোল পাকিয়ে গেলো।’
‘কী ঘটলো?’
‘জাহাজ ছেড়ে দেবার পরেরদিন আয়ারটন যখন শুনলে যে জাহাজ যাচ্ছে—’
‘আয়ারটন! সে এখনও জাহাজে আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ। আছে। ঐ সামনের ক্যাবিনে। পাহারার জন্যে আমি একজনকে মোতায়েন ক’রে রেখেছি। চব্বিশ ঘন্টাই পাহারা থাকে।’
‘কেন? ওকে কয়েদ করেছো কেন?‘
‘ডানকাননিউ-জিল্যাণ্ডে যাচ্ছে শুনে সে এমনই খেপে যায় যে তাকে সামলানোই দায় হ’য়ে পড়ে। বলে যে জাহাজের মুখ ঘোরাতেই হবে, জোরজুলুমও করেছিলো, এমনকী মাঝিমাল্লাদের খেপিয়ে তুলে একটা মিউটিনি বাধাবারও চেষ্টা করে। অগত্যা, নাচার হ’য়েই, আমাকে তাকে বন্দী করতে হয়।’
‘হ্যাঁ, এটা ঠিকই করেছো। কিন্তু তারপর?’
‘তারপর থেকে ঐ ক্যাবিনেই আছে। আর ওকে বেরুতে দেয়া হয়নি।’
‘ঠিক আছে। তাহ’লে ওকে এক্ষুনি এখানে নিয়ে-আসার ব্যবস্থা করো!’
আয়ারটন যখন এসেছে, সঙ্গে পাহারা, তখন তার পা একবারও কাঁপেনি। মুখটা শুকনো গম্ভীর, কিন্তু তাতে একটা তেরিয়া জেদেরও ভাব। গ্লেনারভনের সামনে এসে সে বুকের ওপর দু-হাত ভাঁজ ক’রে দাঁড়িয়ে থেকেছে জেরার প্রতীক্ষায়।
‘আবার তাহ’লে আমাদের দেখা হ’লো, আয়ারটন,’ কোনো ভনিতা না-করে সোজাসুজি বলেছেন গ্লেনারভন। ‘অবশ্য দেখা হ’লো সেই জাহাজেই যেটা তুমি জেলপালানো দস্যুদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলে।’
আয়ারটনের মুখচোখ গোঁয়ারের মতো। সে কোনো কথা না-বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছে।
গ্লেনারভনও নাছোড়। ‘কী? জবাব দাও, আয়ারটন। বলো, তোমার কী বলার আছে। আমি তোমার কাছ থেকে একটা জবাবদিহি চাই।’
আয়ারটনের চোখদুটো একবার জ্ব’লে উঠেই পরক্ষণেই নিভে গিয়েছে! ঠাণ্ডাগলায় বলেছে, ‘আমার কৈফিয়ৎ দেবার কিছু নেই। আমাকে নিয়ে আপনারা যা প্রাণে চায় করতে পারেন।’
‘এ-কথা বললে তো চলবে না, আয়ারটন। আমি সোজাসুজি কয়েকটা প্রশ্ন করবো তোমাকে, এবং এও চাইবো যে তুমিও সোজাসুজি সে-সব কথার জবাব দেবে! আমার প্রথম প্রশ্ন হ’লো : তুমি কি কোনোকালে সত্যি-সত্যি ব্রিটানিয়ার কোয়ার্টারমাস্টার ছিলে?’
প্রশ্নটা যেন আয়ারটনের কানেই ঢোকেনি। সে বিকারহীন মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছে।
গ্লেনারভনের ধৈর্যের বাঁধ বোধহয় ভেঙেই যেতে চেয়েছে। ‘ব্রিটানিয়া জাহাজ থেকে তুমি অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলে কীভাবে? এবং কেন?’
আয়ারটন দাঁড়িয়ে থেকেছে নিরুত্তর।
‘আয়ারটন, আমি তোমার ভালোর জন্যেই জিগেস করছি। আমি এই প্রশ্নগুলোর জবাব চাই।’
এবার আয়ারটন সোজাসুজি তাকিয়েছে গ্লেনারভনের চোখে। ‘আমার কিছুই বলার নেই। আমার বিরুদ্ধে আপনার যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তবে সেটা প্রমাণ করবার দায় আপনার-আমার নয়।’
‘প্রমাণ? প্রমাণ করাটা কি খুব কঠিন হবে?’
‘কঠিন নয়!’ এবার টিটকিরি দিয়েছে আয়ারটন। ‘আপনি তালেবর লোক, লর্ডসাহেব, তাই তড়িঘড়ি সব ঠিক ক’রে ফেলছেন। কিন্তু কোনো আদালতের সবচেয়ে কড়া হাকিমও আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারবে না। কাপ্তেন গ্রান্ট যখন নেই তখন কে এসে বলবে যে আমি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলাম কেন? এবং আমিই যে বেন জয়েস, তা-ই বা কে বলবে? পুলিশ তো আমায় কখনও পাকড়াতে পারেনি। আমার যারা সাগরেদ ছিলো, তারাও তো সবাই পুলিশের খপ্পর থেকে পালিয়েছে। আমি যে সত্যি-সত্যি কোনো অপরাধ করেছি, সেটা প্রমাণ করবে কে? আমি যে জেল পালানো দস্যুদের হাতে এ-জাহাজটা তুলে দিতে চেয়েছিলাম, তা কি কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে? কেউ পারবে না। আপনি শুধু কতগুলো সন্দেহের কথা তুলেছেন—কিন্তু শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে কারু কখনও সাজা হয় না। যতক্ষণ-না সাক্ষীসাবুদ প্রমাণ জোগাড় করতে পারছেন ততক্ষণ আমি ব্রিটানিয়ার কোয়ার্টারমাস্টার আয়ারটন ছাড়া আর-কেউ নই।’
গ্লেনারভন এতক্ষণ তার কথায় কোনো বাধা দেননি। এবার সে থামতেই বলেছেন, ‘আমি তোমায় বিচার করতে বসিনি, আয়ারটন—তোমাকে সাজা দেবার কোনো বাসনাও আমার নেই। আমি এও জানতে চাচ্চি না তুমি নিজের অপরাধের জন্য কতরকম ওজর বা কৈফিয়ৎ খাড়া করো। অন্তত এটুকু বলো, কোথায় গেলে তাঁকে খুঁজে পাবো।
আয়ারটনের মুখে কোনো বিকার নেই। সে ঘাড় গুঁজে চুপ ক’রে থেকেছে।
‘ব্রিটানিয়াঠিক কোনখানে ডুবে গিয়েছিলো, সেটা বলতে নিশ্চয়ই তোমার কোনো আপত্তি নেই?’
‘আছে।’
এবার গ্লেনারভন কী-যে করবেন, ভেবেই পাননি। একটু চুপ করে থেকে শেষটায় বলেছেন, ‘আয়ারটন, অন্তত এই ছেলেমেয়ে দুটির মুখ চেয়ে বলো কাপ্তেন গ্রান্ট এখন কোথায় আছেন?’
এই-প্রথম আয়ারটনের মুখটা কেমন কোমল হ’য়ে এলো, একটু যেন দোটানায় পড়েছে সে। যেন ভেবেই পাচ্ছে না কী বলবে। কিন্তু সে শুধু মুহূর্তের দুর্বলতা। পরক্ষণেই রুক্ষস্বরে বলে উঠেছে। ‘উঁহু, আমি এ-বিষয়ে কিছুই বলবো না। কী করবেন? আমাকে ফাঁসি দেবেন!’
‘ফাঁসি দেবো?’এবার গ্লেনারভনও আর রাগ সামলাতে পারেননি। ‘না, আয়ারটন, না। আমি জজসাহেবও নই, জল্লাদও নই। কোনো জজ থেকে জল্লাদ হ’তে চাই না আমি। প্রথমে যে-বন্দরে গিয়ে পৌঁছুবো, সেখানেই নৌ কর্তৃপক্ষের হাতে তোমাকে তুলে দেবো। তোমাকে নিয়ে নৌ কর্তৃপক্ষ কী করবে, সে তাদের ভাবনা।
‘আমিও তো তা-ই চাইছি।’ ব’লেই আয়ারটন ফিরে গিয়েছে নিজের ক্যাবিনে—সঙ্গে গেছে জাহাজের দুজন মাল্লা, তার সর্বক্ষণের পাহারা।
আয়ারটন ভাঙবে, তবু মচকাবে না। তাকে কিছুতেই টলানো গেলো না। কিন্তু এখন তাহলে তাঁরা কী করবেন? ব্রিটানিয়ার কোনো হদিশই আজ অব্দি পাওয়া যায়নি। বোতলে-পাওয়া সেই চিরকুটগুলো জুড়ে দিয়েও আজও তার কোনো অর্থোদ্ধার করা যায়নি। ৩৭° দেশান্তরে আর তো কোনো ডাঙা নেই। তাহ’লে কি ইওরোপেই ফিরে যাবে ডানকান?
অগত্যা। জাহাজে যা কয়লা আছে, তাতে বড়োজোর দিন-পনেরো চলবে। কাজেই ডানকান তালকাউয়ানো উপসাগরে ফিরে গিয়ে কয়লা ও অন্যান্য রসদ নিয়ে কেপ হর্ন ঘুরে ফের অ্যাটলান্টিক পেরিয়ে ফিরে যাবে স্বদেশেই।
সেই মর্মেই নির্দেশ দিয়েছেন লর্ড গ্লেনারভন, এবং আধঘন্টা বাদেই জাহাজের মুখ ঘুরেছে সেই পথে। তার খানিক বাদে পেছনে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে নিউ-জিল্যাণ্ডের তটরেখা
জাহাজ চলেছে, যেহেতু সে কলের জাহাজ, বয়লার জ্বলছে, সারেঙ দিক ঠিক করে দিচ্ছে, কিন্তু মানুষগুলো?
অভিযান যখন শুরু হয়েছিলো তখন কী উৎসাহ ছিলো সবাইকার, কতটা আশা, কতটা উদ্দীপনা। এখন কে যেন নিংড়ে বার ক’রে দিয়েছে সব। কি-রকম হতাশ, ব্যর্থ, নিষ্পল লাগছে সবাইকার, কী-ভীষণ মনখারাপ। কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো হদিশ যে জানে, সে ঐ আয়ারটন। কিন্তু সে তার মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। কানে গুঁজেছে তুলো, পিঠে বেঁধেছে কুলো। লর্ড গ্লেনারভনের কোনো ক্ষমতাই নেই যে তার মুখ থেকে টু-শব্দটি বার করবেন।
মেরি আর রবার্টের দিকে এখন আর তাকানোই যাচ্ছে না। যে-রবার্ট সারাক্ষণ টগবগ ক’রে ফুটতো, পথের এত বিপদেও যার মুখ থেকে কখনও হাসিটি মিলিয়ে যায়নি, সে পর্যন্ত কেমন যেন বিধ্বস্ত, মনমরা, হতাশ। ত্রোনিদো একদিন তাকে বলেছিলো, ‘এখন তুমি আর ছোট্টটি নও, রবার্ট, এখন তুমি বড়ো হ’য়ে গেছো সেই ত্রোনিদোই এখন তাকে দেখতে পেলে ভাঙাগলায় হয়তো ব’লে উঠতো, ‘তুমি তো বড়ো হওনি, রবার্ট, তুমি যে একেবারে বুড়িয়ে গেছো!’ আর মেরি? সে গিয়ে সটান ঢুকেছে তার ক্যাবিনে, গিয়ে দরজা বন্ধ ক’রে শুয়ে পড়েছে।
এ-সব দেখে লেডি হেলেনা আর থাকতে পারেননি। তিনি কি কিছু করতে পারেন না? তিনি কি বোঝাতে পারবেন না আয়ারটনকে? তিনি কি একবার শেষচেষ্টা ক’রে দেখবেন না? গ্লেনারভনকে বলে-ব’লে শেষটায় রাজি করিয়েছেন হেলেনা, তিনি নিজে আয়ারটনের ক্যাবিনে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করবেন, সঙ্গে থাকবে শুধু মেরি, আর-কেউ নয়। অন্য-কারু সামনে হয়তো আয়ারটন কোনো কথা বলবে না। যদি শুধু তাঁদের কাছেই মুখ খোলে….
পাঁচই মার্চ আয়ারটনের ক্যাবিনেই মেরিকে নিয়ে গিয়েছেন লেডি হেলেনা। একঘন্টারও ওপর কত কাকুতিমিনতি, কত সাধ্য-সাধনা করেছেন তাকে, কত বুঝিয়েছেন—কিন্তু আয়ারটনের বোধহয় বুক নেই, হৃদয় যেখানে থাকে সেখানে বোধহয় আছে শুধু পাষাণ—সে একফোঁটাও টলেনি।
লেডি হেলেনার কিন্তু জেদ চেপে গিয়েছিলো। ফিরেই তো চলেছেন—কিন্তু ফিরে যাবার আগে কোনোমতে যদি আয়ারটনের মুখ থেকে একটা কথা খসানো যায়—! পরদিন তিনি আবার গেলেন আয়ারটনের ক্যাবিনে, এবার একেবারে একা। মেরিকেও নিয়ে যাননি। মেরি বেচারি আয়ারটনের নির্বিকার নির্লিপ্তভাব সইতে পারেনি, সে বরং আরো ভেঙে পড়েছে। তারপর দু-ঘন্টা লেডি হেলেনা মুখোমুখি বসে থেকেছেন আয়ারটনের, তাকে বুঝিয়েছেন, একবারও মেজাজ খারাপ করেননি, তর্ক করেননি, হুমকি দেননি, শুধু অনুনয়-বিনয়।
আর বাইরে অস্থিরভাবে পায়চারি করেছেন অন্যরা। কী-রকম হাত কামড়াতে ইচ্ছে করেছে সকলের, এমন অসহায় আর অক্ষম লাগছিলো।
দু-ঘন্টা পরে লেডি হেলেনা বেরিয়ে আসতেই অধীরস্বরে গ্লেনারভন শুধিয়েছেন : ‘কী? মুখ খুলেছে?’
‘না। তবে তোমার সঙ্গে নিরিবিলি দেখা করতে চাচ্ছে।’
‘তাহ’লে কি একটু টলেছে ওর মন?’
‘বোধহয়।’
তুমি কি ওকে কোনো কথা দিয়ে এসেছো? কোনো প্রতিশ্রুতি? ‘
‘আমি তোমার হ’য়ে ওকে কথা দিয়েছি যে ওর শাস্তিটা যাতে লঘু হয় সেজন্যে তুমি তোমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব, তা-ই করবে।’
‘বেশ। তাহ’লে আমি এক্ষুনি ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি।’
আয়ারটন যখন গ্লেনারভনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন তার মুখচোখে তেমন কোনো বদল দেখা যায়নি যা থেকে মনে হ’তে পারে অকস্মাৎ তার কোনো হার্দ্য পরিবর্তন হয়েছে।
‘এবার তুমি আমার কাছে সব কথা খুলে বলবে তো, আয়ারটন? ‘
আয়ারটন ঘাড় হেলিয়ে তার সম্মতি জানিয়েছে। তারপর বলেছে :
‘তবে আমি যখন কথা বলবো তখন এখানে যদি মঁসিয় পাঞয়ল আর মেজর ম্যাকন্যাব্স উপস্থিত থাকেন, তাহ’লে ভালো হয়।’
‘কার ভালো হয়?’
‘আমার’। খুব শান্তস্বরে আয়ারটন বলেছে।
তার দিকে তাকিয়ে তার আপাদমস্তক একবার নিরীক্ষণ করেছেন গ্লেনারভন। তারপর ডেকে পাঠিয়েছেন পাঞয়ল আর ম্যাক্ন্যাসকে।
তাঁরা এসে হাজির হ’তেই গ্লেনারভন বলেছেন : ‘এবার বলো।’
আয়ারটন কী যেন ভেবে নিয়ে বলেছে : দুই পক্ষের মধ্যে যখন কোনো রফা হয়, তখন সাক্ষী থাকলে ভালো হয় ব’লেই আমি মেজর ম্যাকন্যাব্স আর ফুঁসি পাঞয়লকে এখানে থাকতে বলেছি। কেননা আমি এখন আপনার সঙ্গে একটা রফানিষ্পত্তিতে আসতে চাই।’
‘রফানিষ্পত্তি? কী-ধরনের রফা?’
‘আপনি চান এমন-কিছু খবর যা শুধু আমিই জোগাতে পারি। আর আমি চাই এমন-কিছু সুবিধে যা শুধু আপনিই আমাকে দিতে পারবেন।’
‘হ্যাঁ,’মঁসিয় পাঞয়ল এই ভনিতায় একটু অধীর হ’য়ে উঠেছেন, ‘কিন্তু, কী এমন খবর তুমি আমাদের দিতে পারো, যা আর-কেউই জোগাতে পারবে না?’
‘উঁহু,’ গ্লেনারভন তাঁকে থামিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি জানতে চাই কী এমন সুবিধে আমি তোমাকে দিতে পারি, যার জন্যে তুমি এমন দরাদরি করছো?’
‘আপনি তো আমাকে ইংরেজ গবর্নরের হাতে তুলে দিতে চাইছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘অর্থাৎ আপনি আমাকে ছেড়ে দিতে চান না?’
এ একটা বিষম সংকটের মধ্যে পড়েছেন গ্লেনারভন। উত্তরে তিনি কী বলবেন তার ওপরই নির্ভর করছে কাপ্তেন গ্রান্ট ভাগ্য—তাছাড়া মেরি আর রবার্টের কথাও তাঁকে ভাবতে হবে। অথচ আয়ারটন যে-ভয়ানক অপরাধ করেছে, তার যদি কোনো সাজা না-হয়, তাহ’লে তো ন্যায়নীতি ব’লে কিছুই থাকবে না। শেষটায় কঠিনসুরে তিনি বললেন, ‘না আয়ারটন। আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি না। কেউ যদি ছেড়ে দিতে পারেন, তবে সে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ।’
‘কিন্তু আমি তো তা চাইছি না?’
‘তবে তুমি কী চাচ্ছো??
‘আমি কখনও এ-কথা বলিনি যে আমাকে আপনারা এমনি-এমনি ছেড়ে দিন। আমি ফাঁসির দড়িও চাইছি না—অথবা বেকসুর খালাস পেতেও চাইছি না—চাইছি এরই মাঝামাঝি কিছু-একটা।’
‘সেটা কী?’
‘আমাকে বরং প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো নির্জন দ্বীপেই ছেড়ে দিন আপনারা, সঙ্গে দিন সামান্য-কিছু খাবার-দাবার। কষ্টেসৃষ্টেই না-হয় দিন কাটাবো সেখানে-আর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো।’
ঠিক এমন-কোনো প্রস্তাব যে আসতে পারে, গ্লেনারভন সেটা প্রত্যাশাই করেননি। কী-রকম অপ্রস্তুত চোখে ম্যাকন্যাব্স আর পাঞয়লের মুখের ওপর চোখ বুলিয়েছেন তিনি। দুজনের কারু কাছ থেকেই কোনো সাড়া আসেনি। যা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেটা নিতে হবে স্বয়ং গ্লেনারভনকেই। সারা সেলুনঘরটা হঠাৎ কী রকম যেন স্তব্ধ হ’য়ে গেছে। শুধু জানলা দিয়ে একটানা ভেসে আসছে জলের ছলছল আর এনজিনের গুঞ্জন। একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে শেষটায় গ্লেনারভন বলেছেন, ‘তোমার কথা যদি রাখি, তবে তুমি যা জানো সব বলবে তো, আয়ারটন? ‘
‘হ্যাঁ, মি-লর্ড। কাপ্তেন গ্রান্ট অর ব্রিটানিয়া সম্বন্ধে যা জানি, সব খুলে বলবো। কোনো কথাই বাদ দেবো না।’
‘সব বলবে? সত্যি?’
‘সত্যি। আমি হলফ করে বলছি—’
কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে একটু অসহিষ্ণুস্বরেই গ্লেনারভন বলে উঠেছেন, ‘কিন্তু তুমি যে সত্যিকথা বলছো, তা আমরা বুঝবো কী ক’রে? তুমি যে আগের মতোই সব বানিয়ে-বানিয়ে বলবে না, তা আমরা যাচাই ক’রে নেবো কী ক’রে?’
‘বিশ্বাস আপনাকে করতেই হবে। আমি বদমায়েশ, বিশ্বাসঘাতক, মহাপাতক—তবুও আমার কথা আপনাদের বিশ্বাস করতেই হবে। এছাড়া তো আর-কোনো চারা নেই।’
‘বেশ। আমরা তাহ’লে ধরেই নেবো যে তুমি যা বলছো, তার কিছুই মিথ্যে নয়।’
‘যদি পরে দ্যাখেন, আমি আবার আপনাদের সঙ্গে ফেরেব্বাজি করেছি, তাহ’লে তো অনায়াসেই কঠোর সাজা দিতে পারবেন—’
‘কীভাবে?’
‘যে-জনমানবহীন দ্বীপটায় আমাকে নামিয়ে দেবেন, সেখান থেকেই ফের আমায় পাকড়ে আনতে পারবেন।
এ-কথার পর অবশ্য আয়ারটনকে আর অবিশ্বাস করার কোনো কথাই ওঠে না। আয়ারটন বলেছে, ‘আপনাদের আমি গোড়াতেই ব’লে দিতে চাই—আমার কাছ থেকে আপনারা বেশি কিছু প্রত্যাশা করবেন না। কাপ্তেন গ্রান্ট সম্বন্ধে খুব-বেশি কথা আমি জানি না।’
‘সে-কী? তাহ’লে-–‘
‘হ্যাঁ,মি লর্ড। আমি যতটুকু জানি, ততটুকুই আমার খবর। কিন্তু তা থেকে ব্রিটানিয়া জাহাজ যে কোথায় ডুবেছে, সে-কথা আপনারা জানতেই পারবেন না—’
ঘরটার মধ্যে যেন বিনামেঘেবজ্রাঘাত হয়েছে। এই কথাবর্তার সূচনায় সবাই ভেবেছিলেন, এতদিনে বুঝি শেষটায় কাপ্তেন গ্রান্টের ঠিকানা মিললো। আর এখন কি না আয়ারটন নিজেই বলছে যে সে যা বলবে তা থেকে কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো পাত্তাই পাওয়া যাবে না।
আয়ারটন ফের বলেছে, ‘আমি আপনাদের আগেই বলেছি, মি-লর্ড, এই রফায় যদি কারু কোনো সুবিধে হয়, সে আমার। আপনাদের কোনো লাভই হবে না।’
‘ঠিক আছে। তোমার প্রস্তাবটাই মেনে নিচ্ছি,’ বলেছেন গ্লেনারভন। ‘কিন্তু মনে রেখো, প্রশান্ত মহাসাগরের যে-দ্বীপটায় তোমাকে নামিয়ে দেবো, সেটা কিন্তু সম্পূর্ণ জনমানবমশূন্য হবে-
‘আমি তো তা-ই বলেছি, মি-লর্ড। কোনো নিরিবিলি দ্বীপে আমি পুরোপুরি-একা আমার নিজের মুখোমুখি হ’তে চাই।’
ভারি-অদ্ভুত একটা কথা বলছে আয়ারটন। নিজের মুখোমুখি হবে। একা-একাই। অথচ তার মুখে অনুশোচনার কোনো চিহ্নই নেই। সম্পূর্ণ বিকারহীন একটা মুখ। মনে হচ্ছে—সে যে সব কথা খুলে বলতে রাজি হয়েছে, তা যেন নিজের কথা ভেবে নয়—অন্য-কারু কথা ভেবেই।
গ্লেনারভন এবার শুরু করেছেন একেবারে গোড়া থেকে। ‘আচ্ছা, আগে তুমি তোমার পরিচয় দাও। সত্যি ক’রে বলো, তুমি কে!’
‘আমার নাম টম আয়ারটন। আর এ-কথাটাও মিথ্যে নয় যে আমি ব্রিটানিয়ার কোয়ার্টারমাস্টার ছিলাম। কিন্তু গোড়া থেকেই কাপ্তেন গ্রান্টের সঙ্গে তুচ্ছ-সব কারণে খটাখটি লাগছিলো। শেষটায় আমি অন্য মাঝিমাল্লাদের খেপিয়ে দিয়ে ব্রিটানিয়াদখল ক’রে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি ভালো ক’রে ঘোঁট পাকাবার আগেই কাপ্তেন গ্রান্ট আমায় অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে নামিয়ে দিয়ে চ’লে যান।’
‘অস্ট্রেলিয়ায়?’এবারে চমকে উঠেছেন মেজর ম্যাকন্যাব্স। তার মানে ব্রিটানিয়া যখন কাইয়াওতে পৌঁছোয়, তখন তুমি জাহাজে ছিলে না?’
‘না।কাইয়াওতে যাবার আগেই আমাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিলো। প্যাডি ও মুরের খামারবাড়িতে যে কাইয়াওর নাম বলেছিলাম, সে শুধু আপনাদের মুখে পুরোকাহনটা শোনবার পরই।’
‘হুঁ!’ জিগেস করেছেন গ্লেনারভন, ‘কিন্তু তারপর কী হলো?’
‘অস্ট্রেলিয়ায় আমার সঙ্গে একদল জেলপালানো কয়েদির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ক-দিনের মধ্যেই আমি তাদের পাণ্ডা হ’য়ে উঠি, আড়াই বছর ধরে অবাধে খুনজখম লুঠতরাজ চালিয়ে যাই। সেখানে বেন জয়েস নামেই পুলিশ আমাকে চিনতো—আমার সত্যিকার পরিচয় কারু জানা ছিলো না। আমাকে আগে যারা চিনতো, তারা সবাই ব্রিটানিয়ারসঙ্গেই অথই পাথারে ভেসে গিয়েছিলো। কিন্তু পুলিশ যখন বেন জয়েসের নামে হুলিয়া বার ক’রে দিলে, আর অনবরত পুলিশের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ হ’তে লাগলো, তখন আমি ভেবেছিলাম – ধুর ছাই, ডাঙায় আর নয়। আর তাই ১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফের আয়ারটন সেজে প্যাডি ওমুরের খামারে গিয়ে চাকরি নিয়েছিলাম। শুধু-যে পুলিশের চোখে ধুলো দেয়াই উদ্দেশ্য ছিলো তা নয়। প্যাডি ও মুরের খামারটা সমুদ্রের একেবারে গা ঘেঁষে ব’লেই অনবরত জাহাজ এসে ভেড়ে সেখানে। মলব ছিলো, সুযোগ পেলেই কোনো-একটা জাহাজে দখল করে বসবো। তারপর আর আমায় পায় কে? পুরো সমুদ্দুরটাই আমার দখলে চ’লে আসবে। অনবরত আর পুলিশের সঙ্গে টক্কর দিতে হবে না। আমিই যে বেন জয়েস, প্যাডি ও মুর সেটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। আমার কাজে সে মোটামুটি খুশিই ছিলো। হঠাৎ এমন সময় দু-মাস বাদে একদিন এসে হাজির ডানকান। আপনাদের মুখেই খাবারটেবিলে ব’সে-ব’সে জানতে পেলাম যে কাইয়াও যাবার পথে হঠাৎ একদিন ব্রিটানিয়া নিখোঁজ হ’য়ে গেছে—বোতলে পাওয়া একটা চিরকুট প’ড়ে শুধু এটুকুই জানা গেছে সে নাকি সাঁইত্রিশ ডিগ্রি দেশান্তরের কোথাও। অমনি মনে-মনে ফন্দি এঁটে ফেললাম, এটাই সুযোগ, এই ডানকানকেইদখল ক’রে নিতে হবে। নৌবাহিনীর সেরা জাহাজটাকেও টেক্কা দিতে পারে ডানকান—যদি কোনো জাহাজ নিয়ে সমুদ্রকে শাসন ক’রে বেড়াতে হয় তবে তো এমন-কোনো জাহাজই চাই। কিন্তু ডানকানকে ছোটোখাটো ভাঙচুর মেরামত করতে হবে শুনে তখন আর তাকে বাধা দিইনি, মেলবোর্নে যেতে দিয়েছি। আপনাদের গাইড সেজে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছি অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব-উপকূলে। ডানকানের হদিশ পেয়েই আমি আর আমার দলের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তারা আমাদের সঙ্গে-সঙ্গেই চলেছিলো, কখনও আমাদের আগে-আগে গেছে, কখনও গেছে পেছন-পেছন। তারাই মিছেমিছি ট্রেন উলটে দিয়ে, ক্যামডেন ব্রিজের কাছে লুঠতরাজ চালায়—তখন ঠিক এভাবে নিজেদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা ওদের উচিত হয়নি। সেটাই আমাদের চালে সবচেয়ে বড়ো ভুল হয়েছিলো। আমি অনেক-বড়ো স্বপ্ন দেখেছিলাম, ভেবেছিলাম অত-বড়ো সমুদ্র ছাড়া আর কিছুতেই আমি আঁটবো না। পথ দেখিয়ে আপনাদের নিয়ে এসেছিলাম স্নোয়ি নদী অব্দি, পথে একটা-একটা ক’রে মেরেছি ঘোড়া আর বলদগুলোকে, যাতে আপনারা মেলবোর্ন অব্দি পুরো রাস্তাটা একসঙ্গে যেতে না-পারেন। শেষটায় একদিন কাদার মধ্যে গাড়িটাকে ডাবিয়ে দিয়েছি আমিই। মঁসিয় পাঞয়ল যদি অন্যমনস্ক হ’য়ে চিঠিটায় নিউ-জিল্যান্ড কথাটা না-লিখতেন অ্যাদ্দিনে আমিই তবে ডানকানের মালিক হ’য়ে বসতাম। এছাড়া আর-কিছুই আমার বলার নেই, মি-লর্ড। কাপ্তেন গ্রান্ট কোথায় আছেন আমি জানি না। কিন্তু আপনারা তো আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন—আমারই সুবিধে হবে জেনেও আপনারা আমায় কোনো-একটা নির্জন দ্বীপে নামিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন।’
আয়ারটনের পুরো কাহনটা শেষ হবার পরেও বেশ-কয়েক মিনিট কারু মুখে কোনো কথা নেই। বাইরে জলের উচ্ছল রোল আর এনজিনের গুঞ্জন। ঘরের মধ্যে সবাই চুপচাপ। এটুকু অন্তত তিনজনেই বুঝতে পেরেছেন, আয়ারটন নরাধম হ’তে পারে, কিন্তু এবার সে একটাও মিথ্যেকথা বলেনি। তার সব ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল হ’য়ে গেছে মঁসিয় পাঞয়লের অন্যমনস্কতায়। কারু-কোনো অন্যমনস্কতাও যে অনেক সময় মহাবিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে, এটা বোধহয় তারই অনন্য নজির। আবার কৌতুক এটাই যে পাঞয়লের অন্যমনস্কতায় নরাধম আয়ারটনের মুঠোর মধ্যে এসেও হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে ডানকান।
‘কবে তোমাকে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে নামিয়ে দেয়া হয়েছিলো?’ জিগেস করেছেন মেজর ম্যাকন্যাব্স। ‘১৮৬২ সালের আটই এপ্রিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘কাপ্তেন গ্রান্ট কোথায় যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন?’
‘ঠিক জানি না।’
‘যতটুকু জানো, বলো।’
‘নিউ-জিল্যাণ্ড যেতে চেয়েছিলেন। কাইয়াও থেকে বেরিয়ে নিশ্চয়ই ঐদিকেই গিয়েছিলেন। চিরকুটের তারিখের সঙ্গে কিন্তু ব্রিটানিয়ারডুবে-যাবার তারিখটাও মিলে যাচ্ছে।’
এবার পাঞয়লও সায় দিয়েছেন। ‘তা ঠিক।’
কিন্তু গ্লেনারভন সে-কথা শুনতেই চাননি। ‘কিন্তু নিউ-জিল্যাণ্ডের কোনো নামগন্ধই তো নেই চিরকুটগুলোয়।’
‘এ-বিষয়ে আমার ঠিক কিছুই জানা নেই,’ বলেছে আয়ারটন। ‘নিউ-জিল্যাণ্ড যাবার কথা আলোচনা হয়েছিলো অবশ্য ব্রিটানিয়ায়।
গ্লেনারভন বলেছেন, ‘যাক-গে। তুমি তোমার কথা রেখেছো যখন, তখন আমিও আমার কথা রাখবো। জবানের কোনো নড়চড় হবে না। ঠিক কোন দ্বীপে যে তোমায় নামিয়ে দেয়া যায়, এবার সেটাই ঠিক করা যাক।’
‘আমার কোনো পছন্দ নেই। যেখানে হয় নামিয়ে দিলেই হবে।‘
‘বেশ, তাহ’লে এখন তোমার ক্যাবিনে ফিরে যাও।’
পাহারারা আয়ারটনকে তার ক্যাবিনে নিয়ে গেছে তারপর।
সে চ’লে যেতেই বেশ খানিকটা আপশোস ক’রেই বলেছেন গ্লেনারভন : ‘আয়ারটনের জন্যে আমার ভারি কষ্ট হয়। লোকটা কু-পথে না-গেলে অনেক উঁচুতে উঠতে পারতো। ওর মাথা আছে, সাহস আছে, নিজের ক্ষমতার ওপর অপরিসীম বিশ্বাস আছে। কিন্তু আয়ারটনের কথা এখন থাক। এটা বোধহয় ধ’রে নেয়াই যেতে পারে যে কাপ্তেন গ্রান্টের আশা এবার আমাদের ছাড়তে হবে। কেউ জানে না তিনি কোথায়। শেষ ভরসা ছিলো আয়ারটন—এখন তো সেটাও গেলো।
‘কেউ জানে না মানে?’ হঠাৎ পাঞয়ল উত্তেজিত হ’য়ে ব’লে উঠেছেন। ‘আমি জানি। আমি—জাক পাঞ্চয়ল।’
গত ক-দিন ধরেই মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন পাঞয়ল। আর হঠাৎ এমন বোমা ফাটালেন সেই-তিনিই।
‘আপনি জানেন?’
‘আলবৎ।’
‘কীভাবে জানলেন? ‘
‘ঐ চিরকুটগুলো প’ড়েই।’
‘ধেত্তোরি,’ যাও-বা আশা হয়েছিলো, তাও চুপসে গেলো। মেজর ম্যাকন্যা আর-কখনও ঐ চিরকুট নিংড়ে কোনো অর্থ বার করবার কথা বিশ্বাসই করেন না।
এবার পাঞয়ল প্রায় খেপেই উঠেছেন। ‘কথাটা আগে শুনে নিন, ফুঃ ক’রে উড়িয়ে দেবেন পরে। অ্যাদ্দিন কিছু বলিনি কেউই আমার কথা বিশ্বাস করবে না ব’লে। কিন্তু এখন আর আমার কোনো সন্দেহ নেই। আয়ারটনও আমার কথায় সায় দিয়ে গেছে এইমাত্র। সেইজন্যেই আজ আমি সব কথা খুলে বলবো—
‘নিউ-জিল্যাণ্ডে—’
কী-একটা বলতে চেয়েছেন গ্লেনারভন, কিন্তু পাঞয়ল অধীরভাবে তাঁকে থামিয়ে দিয়েছেন। ‘কথাটা আগে শুনুন। স্নোয়ি নদীর তীরে বলদে-টানা গাড়িটার মধ্যে ব’সে আপনার শ্রুতিলিখন শুনে-শুনে চিঠিটা লেখবার সময় ভুলটা আমার অকারণে হয়নি। আমার মাথায় তখন নিউ-জিল্যাণ্ড শব্দটাই ঘুরছিলো। NEW ZEALAND | অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্ড নিউ-জিল্যাণ্ড গেজেটটা ভাঁজ-করা প’ড়ে ছিলো মেঝেয়—এমনভাবে যে শুধু ALAND হরফগুলোই দেখা যাচ্ছিলো। আর তা-ই দেখেই আমার মাথায় নিউ-জিল্যাণ্ড শব্দটা বিদ্যুতের মতো খেলে গিয়েছিলো। মনে আছে নিশ্চয়ই—চিরকুটে aland কথাটাও ছিলো—কিন্তু আমরা তার অন্যরকম অর্থ-করেছিলুম।’
‘তখনই যদি কথাটা আপনার মাথায় খেলে গিয়ে থাকে, তবে অ্যাদ্দিন মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন কেন?’ জিগেস করেছেন গ্লেনারভন।
‘ফের মিথ্যে একটা আশা দিয়ে সবাইকে নাচিয়ে তুলতে চাইনি ব’লে। তাছাড়া, চিরকুটে লেখা সাঁইত্রিশ ডিগ্রি দেশান্তর অনুযায়ী অকল্যাণ্ডের দিকেই তো যাচ্ছিলুম।’
‘কিন্তু সে-রাস্তা থেকে এখন তো আমরা স’রে এলুম,’ গ্লেনারভন প্রায় চেপেই ধরেছেন তাঁকে, ‘যখন ডানকানের মুখ ঘোরানো হয়েছে ফিরতিপথে, তখনও কেন সে, কথা বলেননি?’
‘ব’লে কোনো লাভ হতো না ব’লে। কাপ্তেন গ্রান্টের হদিশ আপনি পেতেন কোথায়?’
‘তার মানে?’
‘নিউ-জিল্যাণ্ডের উপকূলে জাহাজডুবির পর দু-বছর যে-মানুষের খোঁজ নেই, হয় তিনি ডুবে মরেছেন, আর নয়তো মিশেল মঁতেইন-এর ক্যানিবালদের পেটেই গেছেন। এটা তো রাক্ষসমুলুক—না, কী?’
গ্লেনারভন এতক্ষণ দুই হাতের মধ্যে মাথা রেখে চুপচাপ ব’সে থেকেছেন। ম্যাক্ন্যাসের মুখেও কোনো কথা নেই। একটুবাদে হাতের ফাঁক থেকে মুখ তুলে কী-রকম যেন জীর্ণগলায় গ্লেনারভন বলেছেন, ‘মঁসিয় পাঞয়ল, আমায় যে-কথা বলেছেন—বলেছেন। খবরদার—এ-কথা আর কাউকে বলবেন না। কাপ্তেন গ্রান্টের,ছেলেমেয়েদের যা বলবার আমিই সময়সুযোগমতো ব’লে দেবো!’
৫. অন্যমনস্কতা, জিন্দাবাদ!
দীর্ঘজীবী হোক, ভুলোমনেরা!
দীর্ঘজীবী হোক, কিউয়ি পাখি!
অথচ তবু কেমন ক’রে যেন সারা জাহাজেই খবরটা ছড়িয়ে গিয়েছে।
আয়ারটন জানে না, কাপ্তেন গ্রান্ট কোথায়। আর সেইজন্যেই প্রশান্ত মহাসাগরের অজস্র জনমানবহীন ছোটো দ্বীপের একটায় তাকে নামিয়ে দিয়ে ডানকান ইওরোপে ফিরে যাবে।
পাঞয়ল আর ম্যাঙ্গল্স—দুজনেই মানচিত্রের ওপর হুমড়ি খেয়ে প’ড়ে আছেন। সাঁইত্রিশ ডিগ্রি দেশান্তর বরাবর একটা জনমানবহীন পাথুরে দ্বীপ আছে, যেটা আমেরিকা থেকে ৩৬০০ মাইল আর নিউ-জিল্যান্ড থেকে ১৫০০ মাইল দূরে। দ্বীপটায় কোনো মানুষ থাকে না। হয়তো শুধু গাংচিলেরাই উড়তে-উড়তে ক্লান্ত হ’য়ে গেলে এই দ্বীপে নেমে অবসন্ন ডানা জিরিয়ে নেয়—কোনো জাহাজই সমুদ্রের সে-দিকটায় মাড়ায় না। একেবারেই বিজনবিভুঁই একখণ্ড মস্ত পাথর যেন একদিন সমুদ্র থেকে মাথা বার ক’রে আকাশ হাতড়েছিলো।
আয়ারটন কিন্তু সেই দ্বীপটাতেই নামতে রাজি হয়েছে। দ্বীপটায় কেউ কখনও যায় না বটে, তবু তার একটা বাহারে নাম আছে; মারিয়া তেরেসা। ডানকান এখন সেই দ্বীপটা লক্ষ্য ক’রেই চলেছে।
দু-দিন দু-রাত একটানা যাবার পর পর একদিন শেষবিকালের আলোয় দূরে দেখা গেলো মারিয়া তেরেসাকে। প্রায় তিরিশ মাইল দূর থেকে দেখা গেলো, দ্বীপটার ওপর সরু সুতোর মতো পাকিয়ে-পাকিয়ে শূন্যে উঠে গেছে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। আশ্চর্য! দ্বীপটা কি তবে কোনো আগ্নেয়গিরি? প্রশান্ত মহাসাগরের এমন কত দ্বীপ আছে, যা একদিন জলের ওপর মাথা তুলেছিলো কোনো অগ্ন্যুৎপাতের ফলে, তারপর একদিন আবার আগুনের উদ্গিরণেই ফের সমুদ্রের তলায় ডুবে গিয়েছে। এ কী তাহ’লে সেইরকমই কোনো আগ্নেয় দ্বীপ? দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ছোটো-বড়ো কয়েকটা পাহাড়ের চুড়োও
তখন বিকেল পাঁচটা। পাঞয়ল তাঁর টেলিস্কোপে চোখ রেখে দ্বীপটাকে দেখছিলেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স শুধোলেন : কী মনে হচ্ছে? কোনো আগ্নেয়গিরি?’
‘কী জানি, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কোনো ভৌগোলিকের বিবরণেই তো মারিয়া তেরেসার কোনো উল্লেখ নেই। তবে হয়তো অগ্ন্যুৎপাতের ফলেই একদিন জলের মধ্য থেকে মাথা তুলেছিলো—ফলে এ যদি আগ্নেয়গিরি হয়ও, তাতে অবাক হবার কিছুই নেই।’
‘কিন্তু’, গ্লেনারভন একটু শঙ্কিত স্বরেই বললেন, ‘অগ্ন্যুৎপাতের ফলে যদি দ্বীপটা গজিয়ে থাকে, তবে তো অগ্ন্যুৎপাতের ফলেই একদিন জলের তলায় ফের তলিয়ে যেতেও পারে।’
‘তা নাও হ’তে পারে। মারিয়া তেরেসা দ্বীপ অন্তত কয়েকশো বছরের পুরোনো।’
গ্লেনারভন জিগেস করলেন, ‘জন, রাত্তিরেই দ্বীপে নামা যাবে তো?’
‘নামা হয়তো যাবে—তবে নামা কিন্তু ঠিক হবে না। যদি কোথাও কোনো চোরাপাহাড় থেকে থাকে, তাহ’লে ডানকান বিপদে পড়বে।’
রাত তখন আটটা, মারিয়া তেরেসা দ্বীপের প্রায় পাঁচ মাইল দূরে এসেই কাপ্তেন তার এনজিন বন্ধ ক’রে দিলেও আস্তে-আস্তে তারই দিকে ভেসে চলেছে ডানকান, শুধু পালের হাওয়ার ওপর নির্ভর ক’রেই। নটা নাগাদ দ্বীপ যখন আরো কাছে এগিয়ে এলো, তখন অন্ধকারের মধ্যে একটা নিবাতনিষ্কম্প স্থির উজ্জ্বল আলো দেখা গেলো।
‘এ আলো কি আগ্নেয়গিরিরই চিহ্ন না কি?’ পাঞয়ল একটু আঁৎকেই উঠলেন।
‘কিন্তু অগ্ন্যুৎপাতের কোনো আওয়াজ তো শুনছি না,’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স একটু অবাক সুরেই বললেন।
‘এ হয়তো এমন আগ্নেয়গিরি যে শুধু আগুনই ছড়ায়, কোনো আওয়াজ করে না। নিঃশব্দেই নিজের কাজ ক’রে যেতে ভালোবাসে।’
কিন্তু জাক পাঞ্চয়লের এই ব্যাখ্যানায় কোনো কান না-দিয়েই জন ম্যাঙ্গল্স চেঁচিয়ে উঠলেন : ‘এ-কী! ঐ-যে আরেকটা আগুন দেখছি! ঐ দেখুন—তীরে – বালিয়াড়ির ওপর! দেখুন! দেখুন! এ-আলোটা যে নড়ছে!
না, জন ম্যাঙ্গসের দেখায় কোনো ভুল হয়নি। সত্যিই একটা আলো জ্বলছে বেলাভূমিতে। হাওয়ায় কখনও নিভু নিভু হ’য়ে যাচ্ছে, পরক্ষণেই আবার দ্বিগুণ তেজে জ্ব’লে উঠছে।
‘তার মানে,’গ্লেনারভন ব’লে উঠলেন, ‘এ-দ্বীপে লোক থাকে। এ আলো প্রকৃতির দান নয়—মানুষেরই হাতে জ্বালানো!’
‘তাহ’লে তো আয়ারটনকে এই দ্বীপে নামানো যাবে না!
‘না।’ মেজর ম্যাকন্যাব্স সায় দিয়ে বললেন, ‘দ্বীপে যদি বন্য বর্বরেরা থেকে থাকে, তাহলে আয়ারটনের কপালে দুঃখ আছে। জেনে-শুনে এমন দ্বীপে আয়ারটনকে রেখে আসা যাবে না।’
রাত এগারোটার সময় কাপ্তেন শুদ্ধু সবাই যে যাঁর ক্যাবিনে চ’লে গেলেন। ভোর না-হওয়া অব্দি ডানকান তীরের কাছে এখানেই অপেক্ষা করবে। তারপর দিনের আলোয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।
কেউ যখন ডেকে নেই, এমন সময় ডেকে এসে দাঁড়ালে মেরি আর রবার্ট। আর সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু তাদের চোখে কোনো ঘুম নেই
রেলিঙে ভর দিয়ে দুজনেই তাকিয়ে রইলো ফসফর-জ্বলা নীল জলের দিকে। কে জানে, তাদের দুজনের জন্যে ভবিষ্যৎ কী সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখন তো অতীতও গেলো। কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো খবরই আর পাওয়া যাবে না। তিনি কি এখনও বেঁচে আছেন? কোথায় আছেন? কোথায়?
হঠাৎ স্তব্ধতা ভেঙে ফিশফিশ ক’রে রবার্ট ব’লে উঠলো : ‘মেরি! আমি কিন্তু এখনও আশা ছাড়িনি। কখনও ছাড়বোও না। বাবাকে আমি খুব ভালো ক’রে চিনি। সহজে হাল ছেড়ে দেবার মানুষ তিনি নন। ‘
মেরি তেমনি ফিশফিশ ক’রেই জিগেস করলে, ‘কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স কী বলেন? উনি কি এখনও কোনো আশা রাখেন?’
‘নিশ্চয়ই। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স আমাদের সত্যিকার বন্ধু—উনি আমাদের কিছুতেই হতাশার মুখে ঠেলে দেবেন না। ওঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে—উনি আমাকে জাহাজ চালাতে শেখাবেন। আমিও একদিন জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়বো। বাবাকে খুঁজতে বেরুবো।’
‘বাঃরে, তাহ’লে তো তোর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হ’য়ে যাবে।’
‘তা হয়তো হবে—কিন্তু একলা তো থাকবি না। লেডি হেলেনা কিছুতেই তোকে কাছছাড়া করবেন না। তাছাড়া কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্সের ইচ্ছে যে—’
কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের ইচ্ছেটা যে কী, সেটা মেরিরও অজানা নেই। তবু রবার্টের মুখ থেকে কথাটা বেরুতেই তার মুখ আরক্ত হ’য়ে উঠেছিলো, ভাগ্যিশ এত-রাত ব’লে ডেকে আলোছায়ার খেলা চলছিলো, রবার্ট নিশ্চয়ই তার মুখখানা দেখতে পায়নি। কিন্তু রবার্টের কথাটা যেমন অসমাপ্ত রয়ে গেলো, মেরির লজ্জাবিজড়িত ভাবনাটাও তেমনি মাঝখানে কোন্-এক হ্যাঁচকা টানে যেন ছিঁড়ে গেলো।
হঠাৎ অন্ধকারের মধ্য থেকে কার যেন অস্ফুট কাতর স্বর ভেসে এসেছে : ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’
রবার্ট অমনি কথা ঘুরিয়ে বললে : ‘মেরি, তুই কিছু শুনতে পেলি!‘
রেলিঙ ধ’রে ঝুঁকে পড়লো দুজনে। অন্ধকারের মধ্যে ভালো ক’রে কিছুই ঠাহর হয় না।
কিন্তু কোন-এক তীব্র আবেগে মেরির আরক্ত মুখটা হঠাৎ পাংশু হ’য়ে উঠলো। ধরাগলায় বললে, ‘রবার্ট…রবার্ট…মনে হ’লো…না, না, তা কী ক’রে হবে… আমি বোধহয় ভুলই শুনেছি! ‘
সঙ্গে-সঙ্গে হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে এলো আবার সেই আর্ত হাহাকার : ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ মনে হ’লো ঢেউয়ের ফসফরের মধ্য দিয়েই আবছা নীল আলোর মতো ভেসে এলো স্বরটা।
এবং এবার রবার্টের আর ভুল হ’লো না। আর সে নিজেকে সামলে রাখতে পারলে না। আকুলস্বরে ডেকে উঠলো : ‘বাবা! বাবা!’ যেন অন্ধকারের মধ্যেই তার গলার স্বর বাবাকে খুঁজতে সিন্ধুহাওয়ায় উড়ে চ’লে গেলো।
মেরি আর সহ্য করতে পারেনি, ততক্ষণে সে তীব্র আবেগের চাপেই বুঝি মূর্ছিত হ’য়ে প’ড়ে যেতো—যদি-না শেষমুহূর্তে রবার্ট তাকে ধ’রে ফেলতো। রবার্ট যে কী ভেবেছিলো কে জানে। মেরির মূর্ছিত চেতনাহীন দেহটা জড়িয়ে ধরেই সে চেঁচিয়ে উঠলো : ‘কে কোথায় আছে! এক্ষুনি এসো! বাবা ডাকছেন! এসো, বাঁচাও! — ‘
যে-সব মাল্লারা যে-যার কাজে তখনও ব্যস্ত ছিলো, তারা সবাই ছুটে এলো! চীৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গিয়েছে অন্যদের। তাঁরা সবাই যে যার ক্যাবিন থেকে ছুটে এসেছেন।
এই মাঝ রাত্তিরে এ-কী ব্যাপার! কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো খোঁজ আর পাওয়া যাবে না জানবার পরে দুই ভাইবোনের কি মাথাই বিগড়ে গেছে নাকি! ঢেউয়ের দিকে আঙুল তুলে বুকভাঙা আর্তস্বরে রবার্ট শুধু একই কথা বলছে : ‘বাবা! বাবা! ঐ-যে ঐখানে, অন্ধকারে…’ মেরিকে সে তখন ব্যাকুলভাবে আঁকড়ে ধ’রে আছে। ‘কী? শুনতে পাচ্ছেন না? বাবা আছেন—সাহায্য চেয়ে ডাকছেন—ঐ-যে—শুনুন…বাঁচাও! বাঁচাও! মেরিও শুনেছে, শুনে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি—জ্ঞান হারিয়ে গেছে ওর…কিন্তু ঐ শুনুন…’
এ কী নিশির ডাক শুনেছে নাকি? এখনও কি স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে আছে? ঠিক জানে, সে কী বলছে?
রবার্টের কাঁধে হাত রেখে লর্ড গ্লেনারভন জিগেস করলেন : ‘কী বলছে। রবার্ট? তুমি কাপ্তেন গ্রান্টের গলা শুনতে পেয়েছো?’
‘হ্যাঁ…হ্যাঁ…মেরিও শুনেছে। একজনের ভুল হ’তে পারে, কিন্তু একসঙ্গে দুজনেরই একই ভুল হবে কী ক’রে? হঠাৎ গলাটা শুনতে পেয়েই তো মেরি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে—’
লেডি হেলেনা এসে ততক্ষণে মেরির দেহটা ধ’রে দাঁড়িয়েছেন
ত্রোনিদো যতই বলুক না কেন, ‘এখন তুমি বড়ো হ’য়ে গেছো, রবার্ট,’ তবু তো রবার্ট সত্যি এখনও ছেলেমানুষই আছে! কী শুনতে কী শুনেছে…আর ঠিক নিজের ইচ্ছাপূরণের মতো করেই রাতের হাওয়ায় শুনে ফেলেছে বাবার গলা!
কিন্তু যতই ইচ্ছা পূরণের অলীক কল্পনা হোক না কেন, এর ভুলটা তো এখুনি, বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই ভাঙিয়ে দিতে হয়! হাল ধ’রে যে-নাবিকটি দাঁড়িয়েছিলো, তাকেই ডেকে গ্লেনারভন জিগেস করলেন : ‘হকিন্স, মিস মেরি অজ্ঞান হ’য়ে যাবার সময় তুমি হালেই ছিলে তো?’
‘হ্যাঁ, মি-লর্ড।’
‘কিছু শুনেছো?’
‘না, মি-লর্ড। জলের আর হাওয়ার শব্দ ছাড়া আর-কিছুই শুনিনি। শুধু ওখানে দাঁড়িয়ে ওঁরা দুজনে কথা বলছিলেন!’
‘না-না। আমি সত্যি শুনেছি। খুবই চাপা অস্ফুট স্বর—হকিন্স হয়তো খেয়াল করেনি, তাই শুনতে পায়নি—কিন্তু নৌকো নিয়ে একবার চলুন না দ্বীপটায়—ওখানে গিয়েই তো সন্দেহভঞ্জন করা যায়—’
পাঞয়ল হঠাৎ রেলিঙ ধ’রে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সবাইকে চুপ করতে বললেন। সকলেই উৎকৰ্ণ হ’য়ে আছেন, যদি কিছু কানে আসে। কিন্তু জলের একটানা ফিশফিশ শব্দ ছাড়া আর-কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছে না—এমনকী হাওয়াও এখন ম’রে এসেছে—হাওয়ার শোঁ-শোঁ শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না এখন।
পাঞয়ল নিজের মনেই অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘অদ্ভুত! সত্যিই, বুদ্ধিতে এর কোনো ব্যাখ্যাই চলে না। আবেগ আর অনুভূতির কোন চরম বিপর্যয়ের মধ্যে যে মানুষ নিজের ইচ্ছাপূরণ করার জন্যে কত-কী শুনতে পায়! অদ্ভুত! ভারি অদ্ভুত!’
লর্ড গ্লেনারভন নিজেই রবার্টকে ধ’রে-ধীরে নিয়ে গেলেন তাঁর ক্যাবিনে। লেডি হেলেনা ততক্ষণে মেরিকে নিয়ে চ’লে গিয়েছেন। আজ রাতে তো আর কিছুই করার নেই, কাল দিনের আলোয় না-হয় দ্বীপে নেমে দেখা যাবে।
পরের দিন, আটই মার্চ, ভোর হবামাত্র রবার্ট আবার ডেকে এসে দাঁড়ালে। সারারাত সে একফোঁটাও ঘুমোয়নি। উদ্ভ্রান্ত চোখমুখ। যেন বড়ো-একটা ঝড় বয়ে যাবার পর কোনো একটা গাছ আবার সোজা হ’য়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে।
আস্তে-আস্তে অন্ধকার থেকে ফুটে উঠেছে দ্বীপটা— ডানকানমাত্র একমাইল দূরে নোঙর ফেলেছে।
অন্যরাও ততক্ষণে ডেকে এসে হাজির হয়েছেন। সবাই টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে দেখতে চাচ্ছে দ্বীপটাকে।
হঠাৎ আবার চীৎকার ক’রে উঠলো রবার্ট, গত রাত্তিরের মতোই। এবার সে কিন্তু শোনেনি, বরং দেখেছে যে দুজন লোক একটা পতাকা নাড়তে নাড়তে বেলাভূমির দিকে ছুটে আসছে!
দূরবিনে চোখ লাগিয়েই চীৎকার ক’রে উঠলেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স—’এ-কী! এ-যে ইউনিয়ন জ্যাক, গ্রেটবিটেনের পতাকা!’
ততক্ষণে জাক পাঞ্চয়ল কেমন বিস্ফারিত চোখে, তাঁর টেলিস্কোপ থেকে নজর সরিয়ে কেমন-একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন রবার্টকে। শুধু বললেন : ‘হ্যাঁ, এটা ইউনিয়ন জ্যাকই!’
এতই হকচকিয়ে গিয়েছেন সবাই যে পরের কয়েকটা মুহূর্ত কারু মুখেই কোনো কথা নেই! তারপরেই প্রচণ্ড আবেগে রবার্টের কম্পিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো : ‘মি-লর্ড! মি-লর্ড! এক্ষুনি যদি নৌকো না-নামান তো আমি কিন্তু জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁৎরেই চ’লে যাবো! দয়া করুন, মি-লর্ড! আমায় যেতে দিন!’
কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের নির্দেশে ততক্ষণে একটা নৌকো নেমে পড়েছে জলে। দড়ির সিঁড়ি বেয়ে পর-পর নেমে এলেন লর্ড গ্লেনারভন, কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স আর জাক পাঞ্চয়ল, তারপর মেরি আর রবার্ট। ছ-জন মাল্লা বসলো দাঁড় টানতে, আর কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স নিজে গিয়ে বসলেন হালে।
তীর থেকে যখন বিশ-পঁচিশ হাত দূরে, তখনই উত্তেজিত স্বরে মেরি চেঁচিয়ে উঠলো : ‘বাবা!’
বেলাভূমিতে দুই লম্বাচওড়া পুরুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শীর্ণ কিন্তু দীর্ঘদেহী তৃতীয় একজন পুরুষ। আর মেরির গলা শুনেই সেই মানুষটি যেন সামনের দিকে তাকিয়ে হাওয়া আঁকড়ে ধরতে চেয়ে লুটিয়ে প’ড়ে গেলেন বালির ওপর!
কাপ্তেন গ্রান্ট!
শুধু যে দুঃখেই বুক ফাটে তা নয়, আনন্দেও কখনও-কখনও বুক ফেটে যায়। কিন্তু একটু শুশ্রূষার পরেই কাপ্তেন গ্রান্ট আবার সাড় ফিরে পেয়েছেন। তারপরই তাঁকে আর তাঁর দুই সাথীকে নিয়ে ডানকানে ফিরে এলো নৌকো। আর নৌকোয় আসতে-আসতেই দু-চারকথায় ছাড়া ছাড়া ভাবে কাপ্তেন গ্রান্ট শুনেছেন ডানকানের ইতিহাস। দুই ভাই-বোনই একসঙ্গে কথা কইতে যাচ্ছিলো, তারপর দুজনেই হঠাৎ-হঠাৎ একসঙ্গে থেমে যাচ্ছিলো, তারপর ফের আবার কাহনের খেই ধরেছিলো দুজনেই একসঙ্গে। ডানকানে এসেই কাপ্তেন গ্রান্ট প্রথমে প্রত্যেককে আলাদা-আলাদা ক’রে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানালেন, কিন্তু বার-বার ধন্যবাদ দিয়েও যেন অনুভূতির শান্তি নেই। এটা স্কটল্যাণ্ডেরই জাহাজ, তাঁরই দেশের জাহাজ। একবার নতজানু হ’য়ে ব’সে ঝুঁকে এমনকী ডানকানেরই ডেককে চুম্বন করলেন কাপ্তেন গ্রান্ট—এই জাহাজ তো তাঁরই স্বদেশের সম্প্রসারিত ভূমি—সাতসাগর তেরোনদী পেরিয়ে এই মারিয়া তেরেসা দ্বীপের কাছেই যেন এসে পড়েছে।
আর একবারও চোখ ফেরাত পারেননি ছেলেমেয়ের ওপর থেকে। মেরি শুধু বয়েসেই বাড়েনি, রূপ ফেটে পড়ছে তার সুগঠিত দেহবল্লরী থেকে। আর রবার্ট? তার চেহারাটা কিশোরেরই, কিন্তু দেখে মনে হয় যেন কত বড়োটি হয়ে গেছে। মাত্র দুটো বছরেই এত বদল হয় লোকের?
তারপর যখন সকলের সঙ্গে এক-এক করে পরিচিত হবার সময় জন ম্যাঙ্গল্স—একটা ঝকঝকে নতুন জাহাজের কাপ্তেন—কেমন যেন লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে গুটিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন আর মুখ টিপে টিপে হাসছিলেন লেডি হেলেনা, তখন কাপ্তেন গ্রান্টের বুঝতে দেরি হয়নি এই তরুণ কাপ্তেনের সঙ্গে তাঁর মেয়ের সম্পর্কটা কী দাঁড়িয়েছে। আর তক্ষুনি মেয়েকে ডেকে সকলের সামনেই তিনি জন আর মেরির হাত মিলিয়ে দিলেন—আর শুভকামনায় যেন ফেটে পড়লো আস্ত জাহাজটাই। আজ শুধু পুনর্মিলনেরই দিন নয়, নূতন জীবন শুরু করারও দিন।
এই উৎসবের আবহাওয়ার ভেতর মনখারাপের শুধু একটাই বিষয়। আয়ারটনকে এই দ্বীপেই নির্বাসন দিতে হবে। তার আগেই অবশ্য কাপ্তেন গ্রান্ট আবারও একবার নেমেছেন দ্বীপটায়, যে-দ্বীপটা দু-বছর তাঁদের আশ্রয় দিয়েছে। ঘুরে-ঘুরে সবাইকে দেখিয়েছেন আস্ত দ্বীপটাই।
ছোট্ট দ্বীপ মারিয়া তেরেসা। দৈর্ঘ্যে পাঁচ মাইল, প্রস্থে মোটে দু-মাইল। জাক পাঞ্চয়ল সত্যিই ধরেছিলেন—আসলে দ্বীপটা একটা মস্ত অগ্নিগিরির চূড়া কিন্তু আগ্নেয়গিরি এখন আর জাগ্রত নয়। কবেই যে সে ম’রে গিয়েছে তা কেউ জানে না। পলি জমেছে বোজানো জ্বালামুখে। গাছপালা গজিয়েছে, হয়তো কোনোদিন সমুদ্রপাখিরা ঠোঁটে ক’রে এনেছিলো কোনো উদ্ভিদের বীজ। একবার একদল তিমি শিকারি এখানে থেমেছিলো, তারা ছেড়ে দিয়ে গেছে শুওর আর ছাগল—এতদিনে তারা শুধু বংশবৃদ্ধিই করেনি, এমনকী ছাগলগুলোও বন্য হ’য়ে গিয়েছে, শুওরগুলোর তো কথাই নেই। ছোট্ট একটা ঝর্না আছে, কী মিষ্টি তার জল! আর বারোমাস জল থাকে সেখানে, শুধু বর্ষার জলের জন্যে হা-পিত্যেশ ক’রে থাকতে হয় না। দ্বীপের এ-দিকটাতেই ঝড় এসে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলেছিলো ব্রিটানিয়াকে। শুধু এঁরা তিনজন ছাড়া সেই করাল তুফানের হাত থেকে আর-কেউ রেহাই পায়নি। দুই সাথীকে নিয়ে সেখানেই ঘর বাধেন কাপ্তেন গ্রান্ট, আরো একটা ‘রবিনসনেডই বুঝি, শুধু তাঁর দুজন সঙ্গী ছিলো প্রথম থেকেই—আর কোনো ফ্রাইডেও একদিন এখানে এসে হাজির হয়নি। ভাঙাচোরা ব্রিটানিয়ার ধ্বংসাবশেষ থেকেই কাঠকুটো এনে কুঠি তৈরি করেন তাঁরা। ভারি কেম্বিসকাপড়ের পালে আলকাত্রা মাখিয়ে গোড়ায় ছাত বানান। পরে অবশ্য অন্য কাঠকুটো এনে সেটাকে শক্ত করা হয়। ভাঙা জাহাজে কিছু বীজও পেয়েছিলেন—তাই থেকে ছোট্ট আবাদও তৈরি হয়। দুটি বুনো ছাগলকে ধ’রে এনে পোষ মানিয়ে নেয়। ব্রেডফুট গাছ জোগায়–না, রুটি ঠিক নয়, তবে তারই মতো কিছু-একটা। আর এইভাবেই কেটে গিয়েছে আড়াই বছর। এই দ্বীপ কোনো জাহাজ যাবার পথে পড়ে না। সবচেয়ে কাছে আছে নিউ-জিল্যান্ড, সেও তো দেড়হাজার মাইল দূরে। তবু তাঁরা পালা করে পাহাড়ের চূড়োয় উঠে দেখতেন দূরে কোথাও কোনো জাহাজ দেখা যায় কি না। আড়াই বছরে মাত্র তিনটে জাহাজ দেখেছেন— কোনোটাই থামেনি—অনেক দূর দিয়ে চ’লে গিয়েছে।
কিন্তু গতকাল যখন দেখতে পেলেন চোঙ দিয়ে ভলকে ভলকে ধোঁয়া ছেড়ে একটা জাহাজ এই দ্বীপের দিকেই আসছে, তখন সবাই উল্লাসে ফেটে পড়েছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেই ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। জাহাজ থেকে লোক যাতে টের পায় দ্বীপে কেউ থাকে, সেইজন্যে পাহাড়ের চুড়োয় তাঁরা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কাপ্তেন গ্রান্ট তার পরেও কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। জাহাজ মাত্র মাইলখানেক দূরে এসে গেছে, অথচ তাঁদের জ্বালানো আগুন দেখেও কোনো সাড়া দিচ্ছে না, তখন জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলেন, সাঁৎরেই জাহাজে চ’লে যাবেন বলে। কিন্তু জাহাজ অব্দি যেতে পারেননি—মাঝপথেই যখন গেছেন, তখন দ্যাখেন জাহাজটা মুখ ঘুরিয়েছে। এতক্ষণ সাঁতার দিয়ে ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছিলেন, দম ফুরিয়ে যাচ্ছিলো, তবু শেষমুহূর্তে ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন। তাঁর দুই সঙ্গী কোনোমতে জল থেকে তাঁকে উদ্ধার করে আনে। ঠিক করেছিলেন, পরদিন ভোরেই তীরে জলের কাছে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে পতাকা নেড়ে জাহাজের দৃষ্টিআকর্ষণ করার চেষ্টা করবেন।
এতক্ষণ ধরে সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে-দেখতেই কাপ্তেন গ্রান্ট পুরো কাহনটা শোনাচ্ছিলেন। কিন্তু শুনতে-শুনতে সারাক্ষণই উশখুশ করেছেন পাঞয়ল। একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ ধরেই তাঁর মাথার মধ্যে কামড়াচ্ছিলো, এবার কাপ্তেন গ্রান্ট থামতেই আর চুপ ক’রে থাকতে পারলেন না, ফস ক’রে জিগেস করে বসলেন : ‘আচ্ছা, চিরকুটগুলোয় কী লিখেছিলেন মনে আছে? সেই যে-লেখাটা বোতলে পুরে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন? ‘
‘নিশ্চয়ই মনে আছে। প্রত্যেকটা কথাই মনে আছে। তিন ভাষাতেই একই কথা লিখেছিলুম। শুনুন, আপনাকে আগে ফরাশি বয়ানটাই শোনাই,’ ব’লে স্পষ্ট ক’রে প্রত্যেকটা কথা শুনিয়ে দিলেন কাপ্তেন গ্রান্ট :
বিস্মিত পাঞয়লের মুখ দিয়ে একটা উৎকট আওয়াজ বেরিয়ে এলো।
কাপ্তেন গ্রান্ট একবারও না-থেমে বাকিটুকুও বলে দিলেন :
Täbor কথাটা শুনেই বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন পাঞয়ল, এখন প্রায় ঝগড়া করার ভঙ্গিতেই বললেন—যেমন তিনি ব’লে থাকেন কোনো পণ্ডিতজনের আলোচনাসভায় –’কিন্তু সে-কী! আপনি টেবর আইল্যাণ্ড বলছেন কাকে? এটা তো মারিয়া তেরেসা দ্বীপ! ‘
দুটোই ঠিক, মঁসিয় পাঞয়ল। কাপ্তেন গ্রান্ট স্মিতমুখে বললেন, ‘ইংরেজি আর আলেমান ভাষায় যাকে মারিয়া তেরেসা বলে, ফরাশিতে তারই নাম টেবর।’
ঠিক তক্ষুনি বিষম একটা থাবা পড়লো মঁসিয় পাঞয়লের কাঁধে। থাবাটা মেজর ম্যাকন্যাব্সের। ঠোঁট বেঁকিয়ে ব’লেই ফেলেন : ‘ধুত্তোরি ভূগোলের! কিন্তু শত ধিক ভূগোলের পণ্ডিতদের!’
পাঞয়ল সে-কথা কানেই নেননি। তখন তিনি নিজেই ধুলোয় মিশিয়ে যেতে, পারলে বাঁচেন। এমনকী কাঁধের ঐ চাপড়টা পর্যন্ত তিনি টের পাননি। শতধিক কী বলছেন মেজর, সহস্র ধিক, লক্ষ ধিক! এত-বড়ো ভূগোলবিশারদ হ’য়েও তিনি কি না জানতেন না যে একটা ছোট্ট দ্বীপের দু-দুটো ভিন্ন নাম! ছি-ছি-ছি, এত তিনি জাঁক দেখাতেন নিজের জ্ঞানগরিমা নিয়ে। অথচ এই তুচ্ছ কথাটাই কি না তিনি জানতেন না! ‘না-না,’ পারলে বুঝি মাথার চুলগুলোই ছিঁড়ে ফেলতেন তিনি, ‘ভৌগোলিক সমিতির সচিব হবার কোনো যোগ্যতাই আমার নেই! এক্ষুনি ইস্তফা দেবো—এক্ষুনি পদত্যাগপত্র দাখিল করবো—‘
লেডি হেলেনা একটু সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন : ‘এ আর এমন কী ভুল! অত মনখারাপ করার কী হ’লো?’
‘মনখারাপ করবো না?’ আবারও মাথার চুল ছিঁড়েছেন পাঞয়ল, ‘আমি একটা গাধা! একটা আহাম্মক একটা আকাট মূর্খ!’
কিন্তু ততক্ষণে চিরকুটটির যে-সব শব্দের ভুল অর্থ করা হয়েছিলো, হরফ জলে ভিজে মুছে যে-ব্যাসকুট তৈরি করেছিলো, এখন সে-সবও স্পষ্ট হ’য়ে গেছে। যেমন Contin মানে Continent নয়, Continual; Indi হবে না India বা Indegenese–হবে Indigence!
আর এই নিয়ে কত-কী বলাবলি করতে-করতেই ফের ডানকানে ফিরে এলেন সবাই।
বিকেলবেলায় ডেকের ওপর আয়ারটনকে নিয়ে-আসা হ’লো কাপ্তেন গ্রান্টের সামনে। গ্রান্ট শুধু ছোট্ট ক’রে বললেন : ‘আয়ারটন, আমি আবার ফিরে এসেছি।’ আয়ারটনের মুখে কিন্তু এতটুকু ভাবান্তর হ’লো না। শুধু বললে : ‘এসেছেন? বেশ ভালো হ’লো। সুখী হলাম।’
‘আমি কিন্তু মস্ত একটা ভুল করেছিলুম, আয়ারটন। তোমাকে আমি নামিয়ে দিয়েছিলুম লোকালয়ে, মানুষ যেখানে থাকে। কিন্তু তুমি তো অন্য মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবার যোগ্য নও!’
‘হয়তো।’
‘এবার কিন্তু আর সেই ভুল হবে না। আমি অ্যাদ্দিন যে-নির্জন দ্বীপটায় ছিলুম, এখন থেকে আমার বদলে তুমিই সেখানে থাকবে। আমাদের দুজনেরই ভূমিকা উলটে যাবে। এখানে একা-একা তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে। বিধাতা তোমায় দেখবেন।
‘তা-ই হবে,’ আয়ারটনের স্বর একটুও কাঁপলো না।
গ্লেনারভন আবারও জিগেস করলেন : ‘এখনও তুমি একা-একা এই দ্বীপে থাকতে চাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহ’লে এই কথাগুলো শুনে রাখো। কাপ্তেন গ্রান্টের মতো তুমি কিন্তু মোটেই হারিয়ে যাবে না। আমরা সবাই জানবো, তুমি কোথায় আছো। তোমার কথা আমাদের মনে থাকবে। এও জানা থাকবে, কোথায় গেলে তোমায় পাওয়া যাবে। কাকতাল কিন্তু বার-বার হয় না বলেই সেটা কাকতাল। ডানকান দৈবাৎ এদিকটায় এসে পড়েছিলো ব’লেই কাপ্তেন গ্রান্ট বেঁচে গিয়েছেন। তোমার বেলায় আমরা আর ঐ দৈব যোগাযোগের ওপর নির্ভর করবো না। আমরা একদিন আবার ফিরে আসবো, তোমাকে মানুষের মাঝখানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।’
‘তা-ই হবে।’
আর একটা কথাও বললো না আয়ারটন, নৌকোয় গিয়ে উঠলো। তার জন্যে নৌকোয় আগেই তুলে রাখা হয়েছিলো শুখা মাংস, কাপড়চোপড়, কিছু যন্ত্রপাতি, বন্দুক, গুলিবারুদ—আর সবচাইতে বড়ো-একটা হাতিয়ার—সে হলো বাইবেল।
সবাই ডেকের ওপর সার দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। লেডি হেলেনা একটু বিচলিত বোধ করেছেন। মেরির চোখ দুটি জলে ভরে উঠেছে। অন্যরা কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করেছেন। লেডি হেলেনা একবার ব’লেই ফেলেন, ‘এড, ওকে কি নির্বাসন না-দিলেই নয়?’তাঁর মনে প’ড়ে গেছে তাঁর সঙ্গে কথা বলবার পরই আয়ারটন লর্ড গ্লেনারভনের সঙ্গে একটা রফানিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলো—এই শাস্তিটা সে নিজেই বেছে নিয়েছে নিজের জন্যে।
গ্লেনারভন কিছু বলবার আগেই আয়ারটন শান্ত অবিচলিত স্বরে বললে : ‘আমাকে আপনারা আমার পাপের সাজাই ভোগ করতে দিন। কোনো সহানুভূতি দেখিয়ে আমায় দুর্বল ক’রে দেবেন না।’
নৌকো তাকে নিয়ে দ্বীপে গিয়ে পৌঁছুতেই লাফিয়ে নেমে পড়লো আয়ারটন। নৌকো ফিরে এলো জাহাজে। ডেক থেকে দেখা গেলো, বালিয়াড়িতে একটা পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল নিষ্কম্প দাঁড়িয়ে আছে আয়ারটন—তাকিয়ে আছে ডানকানেরই দিকে।
ও-দিকে সূর্যাস্তের রঙে তখন রাঙা হ’য়ে উঠতে শুরু করেছে সাগরজল। জন ম্যাঙ্গল্স প্রায় ফিশফিশ ক’রেই অনুমতি চাইলেন : ‘জাহাজ ছাড়ি?’
‘ছাড়ো,’ ব’লেই দ্রুতপদে ডেক ছেড়ে চলে গেলেন গ্লেনারভন।
আর রাত আটটা নাগাদ অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেলো টেবর আইল্যান্ডের পাহাড়ের চুড়ো।
.
ফেরবার পথে অমন যে অবিচলিত নির্বিকার মেজর ম্যাকন্যাব্স তিনি পর্যন্ত পাঞয়লের একটা ব্যাপার দেখে কৌতূহলে প্রায় ফেটেই পড়বেন যেন। সেই-যে তালকাউয়ানো ছেড়ে অ্যাটলান্টিক ধরেছেন তাঁরা, তখন থেকেই তাঁর কৌতূহলটা আরো-উগ্র হ’য়ে উঠতে শুরু করেছে।
বিষম গরমে সকলে যখন হাঁসফাঁস করছে, প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত, তখনও কি না মঁসিয় পাঞয়ল শুধু-যে তাঁর লম্বা ওভারকোট প’রেই থাকেন, তা নয়, গলা পর্যন্ত বোতাম আটকে রাখেন, আর দরদর ক’রে ঘামেন, আর আইঢাই করেন। ব্যাপারটা কী? ভুলোমন? অন্যমনস্কতা? দিনের পর দিন তিনি কি ভুলেই যাচ্ছেন যে এখন ওভারকোট গায়ে দেবার মরশুম নয়—অন্তত গরম নিশ্চয়ই কথাটা তাঁকে জানান দেয়। তবে?
দশই মে বেলা এগারোটায় ডামবারটনে নোঙর ফেলেছে ডানকান। আর বেলা দুটোয় ম্যালকম কাসলে এসে ঢুকেছেন অভিযাত্রীরা।
সারা তল্লাটটায় আনন্দের হুল্লোড় প’ড়ে গেলো। আসর সরগরম। রোজ বড়ো-বড়ো মজলিশ হয়। আর এমনি একটা মজলিশে মেজর ম্যাকন্যাব্সের এক তুতোবোনের সঙ্গে আলাপ হ’য়ে গেলো মঁসিয় পাঞয়লের। আর দেখবামাত্র মহিলাটি পাঞয়লের প্রেমে প’ড়ে গেলেন। মহিলাটির টাকার অভাব নেই, রূপও আছে, কিন্তু মাথায় একটু ছিট আছে—তাই অ্যাদ্দিন কাউকে ধারে-কাছে ঘেঁসতেই দেননি। অথচ এবারে পাঞয়লকে দেখেই ভদ্রমহিলা কুপোকাত। পাঞয়লেরও যে তাঁকে পছন্দ হয়নি, তা নয়। কিন্তু কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেন না।
শেষটায় বেজায় চ’টে গিয়ে মেজর ম্যাকন্যাব্সই একদিন চেপে ধরলেন পাঞয়লকে। যখন চেপে ধরেছিলেন, তখনও জানতেন না যে এবারই ওভারকোটরহস্যটার একটা সমাধান হ’য়ে যাবে।
‘ব্যাপারটা কী, মঁসিয় পাঞয়ল? মিস অ্যারাবেলাকে যদি পছন্দ না-হয় তো সাফসুফ ব’লে দিলেই পারেন। অমন ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন?’
‘পছন্দ হবে না কেন? খুব হয়েছে। চাঁদেও তো কলঙ্ক থাকে—মিস অ্যারাবেলারই কোনো খুঁত নেই।’
‘তা থাকবে না কেন। দোষে-গুণে মিশিয়েই তো মানুষ হয়। কিন্তু ওঁকে যদি মনে ধরেই থাকে, তবে বিয়েটা ক’রে ফেলছেন না কেন?’
‘না-না, সে হয় না। কিছুতেই বিয়ে হ’তে পারে না।’
কিন্তু মেজর ম্যাকন্যাব্স নাছোড়। তাঁর গোঁ আছে। তিনি যেটা করবেন বলে ধরেন, সেটার একেবারে শেষ না-দেখে ছাড়েন না। শেষটায় তাঁর বিষম চাপ আর সহ্য হ’লো না পাঞয়লের। একদিন মেজরের কানে-কানে গুপ্ত রহস্যটা ফাঁস ক’রে দিলেন। শুনে মেজর তো হেসেই বাঁচেন না। ‘আরে! এই কথা! শুধু যদি এটাই বাধা হয় তবে এ তো মোটেই ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। অ্যারাবেলা তো দেখছি আপনার প্রেমে আরো হাবুডুবু খাবে। এমন-কোনো বর তো সে আর কোথাও খুঁজে পাবে না।
মেজর ম্যাকন্যাব্সের উদ্যোগেই পনেরোদিন পরে মহাধুমধাম করে মিস অ্যারাবেলার সঙ্গে মঁসিয় পাঞয়লের বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের আসরেও দেখা গেলো একটা মস্ত ওভারকোট পরে আছেন পাঞয়ল, তেমনি গলা অব্দি বোতাম আঁটা। এটাই কি ফ্রাসের হালফ্যাশান নাকি?
পাঞয়লের গুপ্তরহস্য অবশ্যি কেউই কোনোদিন জানতে পারতেন না, যদি-না মেজর একদিন চুপি-চুপি কথাটা ব’লে দিতেন গ্লেনারভনকে, গ্লেনারভন ব’লে দিতেন হেলেনাকে, হেলেনা বলতেন মিসেস ম্যাঙ্গল্স ওরফে মেরিকে, আর মেরি বলতো মিসেস অলবিনেটকে, আর তারপর এ থেকে সে, সে থেকে ও—এইভাবে গোপন কথাটি আর গোপনই রইলো না আস্ত স্কটল্যাণ্ডে।
মাওরিদের ঘাঁটিতে যখন তিনদিন বন্দী হ’য়ে কাটিয়েছিলেন মঁসিয় পাঞয়ল, তখন মাওরিরা জোর ক’রে তাদের কুলের চিহ্ন কিউয়ি পাখির উলকি দেগে দিয়েছে তাঁর বুকে : দু-পাশে ডানাছড়ানো মস্ত-একটা কিউয়ি; আর পাঞয়ল অ্যাদ্দিন ধ’রে বুকে লুকিয়ে রেখেছেন নিউ-জিল্যাণ্ডের ঐ পাখিকে!