যেন ঘোরের মধ্যে গাড়িটার দিকে এগোচ্ছে মুসা। এমন সব ঘটনা ঘটছে, একা আর সমাধান করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। আত্মবিশ্বাস কমে আসছে। নিজের ওপর ভরসা নেই আর তেমন।
কবরগুলোর কাছ থেকে সরে এসে দেখল, একজন অভিনেত্রীর গলা টিপে ধরেছেন রিড়ার। দম বন্ধ করে দিয়ে বোঝাতে চাইছেন, বাতাসের জন্যে ছটফট করে কিভাবে মরতে হবে। পরিচালকের ভাবভঙ্গি দেখে ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেল ওর। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রিডারের চেহারা। যেন অভিনয় নয়, সত্যি সত্যিই মেয়েটাকে মেরে ফেলছেন তিনি।
ঘড়ি দেখল মুসা। আজ আর জাগুয়ারটাকে আনতে যাওয়ার সময় নেই। আগামী দিন ছাড়া হবে না।
বাড়িতে এসে সোজা বেডরুমে ঢুকল। রিসিভার নামিয়ে রাখল। ফোন ধরারও মানসিকতা নেই। কিশোর আর রবিনের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। শুটিং স্পটের। রহস্যগুলো মাথা গরম করে দিয়েছে ওর। ফারিহার সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে রেডিও নিয়ে পড়ে থাকা ভাল। শুনতে চায়, কোনো স্টেশন। বেন ডিলনের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ দেয় কিনা। কিন্তু ওই ব্যাপারে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না কেউ।
পরদিন শনিবার। ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই মনে হল মুসার, কেসটা, এখনও বহাল আছে তো? কাজে যোগ দিতে এসেছে ডিলন? নাকি রহস্যটা রহস্যই থেকে গেছে?
তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরোল সে। গাড়ি নিয়ে রওনা হল পঞ্চাশ মাইল। দক্ষিণের ড্যালটন সিমেট্রিতে। পৌঁছে দেখল অবিকল আগের দিনের মতই দৃশ্য। পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, টেকনিশিয়ান, শ্রমিক সবাই হাজির। কিছুই করার নেই তাদের। ডিলনের জন্যে অপেক্ষা করছে।
অনেক বড় একটা ফলকের ওপাশ থেকে জগিং করতে করতে বেরিয়ে এলেন ব্রাউন অলিংগার। পরনে টেনিস খেলার সাদা হাফপ্যান্ট, গায়ে সাদা শার্ট। মুসাকে দেখেই বলে উঠলেন, এই যে, এলে। বাবা কেমন আছে তোমার?
ভাল। বেন ডিলনের কোন খবর পেলেন?
নাহ, হাসিটা মিলিয়ে গেল অলিংগারের।
পুলিশে খবর দেবেন তো?
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জগিং করতে লাগলেন অলিংগার। হাতঘড়িটা বিপ বিপ করে অ্যালার্ম দিতে শুরু করতেই চাবি টিপে সেটা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, না। এসব অনেক দেখেছি। নাম করে ফেললেই এরকম শুরু করে। সবাইকে টেনশনে রেখে যেন মজা পায়। অবশ্যই অন্যায় করে, তবে অপরাধ নয় যে পুলিশে খবর দিতে হবে।
তাহলে কি করবেন?
আর সবাই যা করে। অপেক্ষা করব, ওর আসার। গোয়েন্দাগিরি লাগবে না। দয়া করে কিছু করতে যেও না। আমার আপত্তি আছে।
চুপ করে ভাবতে লাগল মুসা, কি করা উচিত? কিশোর হলে কি করত? ডিলনের বাড়িতে যে সব কাণ্ড হয়ে আছে, তার কি জবাব? আর ভাঙা কাচ? তার মতে, তদন্ত একটা অবশ্যই হওয়া দরকার। এবং এখনই। কিন্তু অলিংগার যেভাবে মানা করছেন…
আবার সঙ্কেত দিতে লাগল অলিংগারের ঘড়ি। চাবি টিপে বন্ধ করে বললেন, আমাকে যেতে হচ্ছে। পরে কথা বলব।
দ্বিধায় পড়ে গেল মুসা। হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এল নিজের গাড়ির কাছে। অলিংগার প্রযোজক, অনেক ছবিরই প্রযোজনা করেছেন, অভিজ্ঞতা আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি চেনেন অভিনেতাদেরকে। হয়ত ঠিকই বলেছেন, সময় হলেই এসে হাজির হবে ডিলন। ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এখন তার গাড়ি আনতে যাওয়া উচিত। ওটাই তার আসল কাজ।
গাড়ি চালিয়ে রাস্তার মাথায় ফোন বুদে চলে এল সে। মেরিচাচীর বোনের ছেলে, নিকি পাঞ্চকে ফোন করার জন্যে। রকি বীচে এসেছে বেশিদিন হয়নি নিকি। একেক জনের কাছে সে একেক রকম। মুসার কাছে মোটর গাড়ির জাদুকর।
রবিনের কাছে এক বিরাট প্রশ্ন। কখন যে বিশ্বাস করা যাবে নিকিকে বলার উপায় নেই।
কিশোরের কাছে। একটা আগাগোড়া চমক। একদিন যেন আকাশ থেকে রকি বীচের মাটিতে খসে পড়েই বোমার মত ফাটল বুউউউম! সৃষ্টি করল এক জটিল রহস্য।
সেই নিকি পাঞ্চ উধাও হয়ে গিয়ে আবার হাজির হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়, অর্ধেক সময় ব্যয় করে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে, পুরানো গাড়ির পার্টস খোঁজে আর মুসাকে শেখায় কি করে ইঞ্জিন ফাইন-টিউন করতে হয়, বাকি অর্ধেক সময় কোথায় থাকে সে-ই জানে।
একটা গ্যারেজের ওপরের ঘরে থাকে নিকি। সপ্তমবার রিং হওয়ার পর ফোন তুলল। যাক, আজ তাড়াতাড়িই ধরল। সাধারণত বারোবারের মাথায় ছাড়া সে ধরে না। ধরেই জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
আমি, মুসা। একটা জাগুয়ার আনতে যাচ্ছি।
নিকির মুখে কফি, বরবর আওয়াজ হল, গিলে ফেলল তাড়াতাড়ি। জাগুয়ারের তালা খোলা খুব সহজ, কিন্তু চাবি ছাড়া স্টার্ট দেয়া বড় কঠিন।
নিকি ভাই, চুরি নয়, কিনে আনতে যাচ্ছি।
হেসে উঠল নিকি। জাগুয়ার কিনবে? আর লজ্জা দিও না। জান কত…?
বাধা দিয়ে মুসা বলল, জানি। সত্যিই কিনব। আমার জন্যে না। একটা ফিল্ম। কোম্পানি…
ও, তাই বলো। যাব। গাড়ি পছন্দ করতে ভাল লাগে নিকির, খুশি হয়েই রাজি হল।
সকালটা শেষ হওয়ার আগেই এক্সকুসিভ কারসের শোরুমে এসে ঢুকল মুসা আর নিকি। দোকানটার আরেকটা ডাকনাম রয়েছে ওখানে, এক্সপেনসিভ কারস, অর্থাৎ অনেক দামি গাড়ি।
হলিউডে ব্রাউন অলিংগারের নাম শুনলেই অনেক বড় বড় দোকানদার গদগদ। হয়ে যায়। গাড়ির দোকানদারও তাদের মধ্যে একজন। নতুন গাড়ি, পছন্দ করতে সময় লাগল না। ঘন্টাখানেক বাদেই কালচে সবুজ একটা জাগুয়ার এক্স জে সিক্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা।
রকি বীচে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে বেড়াল। নিকি ঘুরল গাড়িটার কোথাও কোন গোলমাল আছে কিনা বোঝার জন্যে, আর মুসা ঘুরল ওখানকার পরিচিত মানুষকে দেখানর জন্য যে সে একটা জাগুয়ার চালাচ্ছে। ঘোরার আরও একটা কারণ, বেন ডিলনের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া। ঘরময় ছড়ান ভাঙা কাচ, স্ফটিক, আর বোনহেডের রহস্যময় হুশিয়ারির ব্যাপারগুলোও ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
এসব কথা তোমার দুই দোস্তকে না বলে আমাকে বলছ কেন? নিকি বলল।
আমি একাই সারতে চাই।
হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে নিকি বলল, বেশ, দেখো চেষ্টা করে।
চালিয়ে-টালিয়ে অবশেষে মুসার গুহায় এসে ঢুকল ওরা। মুসার গুহা নামটা দিয়েছে কিশোর। ইয়ার্ডের জঞ্জালের ভেতরে লুকান ট্রেলার যেটাতে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার, তার পাশেই তৈরি করা হয়েছে মুসার এই ব্যক্তিগত গ্যারেজ। গাড়িটাড়ি সব এখানে এনেই মেরামত করে সে।
অনেক সময় আছে কাজটা সারার, পুরো দেড় দিন, মুসা বলল।
অত সময় লাগবে না, একটা স্কুড্রাইভার দিয়ে উইশীল্ড-ওয়াশারের ফ্লুইড ট্যাঙ্কটায় টোকা দিয়ে বলল নিকি। এটা সরিয়ে প্রথমে আরও বড় একটা লাগাতে হবে।
লাগাতে বেশিক্ষণ লাগল না। চাপ বাড়ানোর জন্য ছোট একটা এয়ার পাম্পও লাগিয়ে দিল। তারপর, শেষ বিকেলে বাড়িতে ছুটল মুসা, ওর বাবার কাছ থেকে কিছু কৃত্রিম রক্ত নেয়ার জন্যে। ছবির প্রয়োজনে এই রক্ত রাখতে হয় মিস্টার আমানকে।
রক্ত আনার পর নিকি বলল, দেখো লাগিয়ে, কাজ হয় কিনা।
ওয়াশার বাটন টিপে দিল মুসা। ওয়াশার নজল দিয়ে পিচকারির মত ছিটকে বেরোল রক্ত। কিন্তু উইণ্ডশীল্ডে না লেগে লাগল গিয়ে ছাতে।
হলো না! বলে উঠল সে। গাড়িটার এই অবস্থা দেখলে আমাদের হৃৎপিণ্ড টেনে ছিঁড়বেন রিডার। হঠাৎ করেই মুসা অনুভব করল আবার তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ভারি কিছু চেপে বসছে বুকে। দুহাতে স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরল সে।
কি হলো? জিজ্ঞেস করল নিকি।
জানি না, বলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল মুসা, দম নেয়ার জন্যে। তার মনে হতে লাগল এটা সেই জিন, সাফোকেশনের জিন। স্ফটিকটার কারসাজিও হতে পারে। প্যান্টের পকেট থেকে বের করল ওটা। হাতে আবার গরম লাগল।
কি ওটা? জানতে চাইল নিকি।
মুসার পেছন থেকে জবাব এল, স্ফটিক। কোয়ার্জ কিংবা টুরম্যালাইন হবে, ভালমত পালিশ করা। এক মাথা চোখা তাই একে বলা হয় সিঙ্গল-টারমিনেটেড ক্রিস্টাল।
এভাবে কথা কেবল একজনই বলে। ঝট করে ফিরে তাকাল মুসা। কিশোর পাশা দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোঁকড়া চুল এলোমেলো হয়ে আছে। গায়ে টকটকে লাল টি-শার্ট, বুকের কাছে বড় বড় করে লেখা রয়েছেঃ লাভ টয়, সাম অ্যাসেম্বলি রিকয়ার্ড। পাশে দাঁড়িয়ে আছে রবিন।
মুসাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কিন্তু এই জিনিস তোমার কাছে কেন?
ইয়ে…একজন…একটা লোক আমাকে দিয়েছে, আমতা আমতা করে বলল মুসা। ছবির লোকেশনে।
নিশ্চয় ফারিহার জন্যে উপহার, রবিন বলল। তার গায়ে একটা বাটন-ডাউন অক্সফোর্ড শার্ট, পরনে চিনোজ আর পায়ে মোকাসিন, মোজা বাদে। এককালের মুখচোরা, রোগাটে রবিন এখন সারা স্কুলে দারুণ জনপ্রিয়। অনেক লম্বা হয়েছে, সুদর্শন, কিশোর প্রায় শেষ, যুবকই বলা চলে।
আরে নাহ, হাত নাড়ল মুসা। ফারিহার জন্যে হতে যাবে কেন?
কিছু বলতে যাচ্ছিল রবিন, হা হা করে উঠল নিকি, আরে সর সর, ওভাবে ঘেঁষে দাঁড়িও না! ক্রোমের চকচকানি নষ্ট করে দেবে তো।
আমার ফোক্সওয়াগেনটাকে ফকিরা লাগছে এটার কাছে, জাগুয়ারটাকে দেখিয়ে রবিন বলল। মুসাকে জিজ্ঞেস করল, কার এটা?
জ্যাক রিডারের। হরর ছবির পরিচালক।
আহ্, এরকম একটা জিনিস যদি পেতাম! পরক্ষণেই ঠোঁট ওল্টাল, থাকগে, সবার তো আর সব হয় না। শোন, আইস ক্রিমারিতে যাচ্ছি আমরা। যাবে?
নাহ, সময় নেই, দুই বন্ধুকে অবাক করে দিয়ে মাথা নাড়ল মুসা। কিশোর, অভিনেতাদের ব্যাপারে তো অনেক কিছু জান তুমি। টাইমলি আসা নিয়ে গোলমাল করে?
করে মানে? হেসে উঠল কিশোর। যত বড় অভিনেতা, তত বেশি ভোগাবে, অপেক্ষা করিয়ে রাখবে, এটাই যেন নিয়ম হয়ে গেছে।
আরেকটা কথা। ধরো, কোন বাড়িতে প্রচুর কাচ ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। অথচ গ্লাস, জানালার কাচ কিংবা ফুলদানী সব ঠিকঠাক রইল। কোত্থেকে আসতে পারে?
একটা ভুরু উঁচু হয়ে গেল কিশোরের। ব্যাপারটা কি বলো তো?
কিছু না। চট করে একবার নিকির চোখে চোখে তাকাল মুসা। মানে, জরুরী কিছু না। পরে বলব।
কিশোর আর রবিন চলে গেলে গাড়িটা নিয়ে পড়ল আবার দুই মেকানিক কয়েক মিনিট পরেই ঝামেলা এসে হাজির। মুসার গার্লফ্রেণ্ড ফারিহা। পরনে নীল জিনস, গায়ে পুরুষের ঢোলা শার্ট। এসেই মুসার হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিতে দিতে অপরিচিত মানুষের ভঙ্গিতে বলল, শুনুন, আমি ফারিহা গিলবার্ট। আপনি নিশ্চয় মুসা আমান?
কি হলো? মুসা অবাক, এরকম করে কথা বলছ কেন?
ভুলেই তো যাওয়ার কথা, তাই না? পুরো দুটো দিন দুটো রাত তোমার কোন খোঁজ নেই। চিনতে পেরেছ তাহলে?
পারব না কেন? কাজ ছিল।
হু। সে তো বুঝতেই পারছি। কিশোর আর রবিনকে যেতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলল আইসক্রীম খেতে যাচ্ছে। চলো না, আমরাও যাই?
দেখছ না ব্যস্ত?
তা তো দেখছি। কিন্তু আমার যে একলা যেতে ভাল লাগে না। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছে ফারিহা। লম্বা চুল ছড়িয়ে পড়েছে কাঁধে। ওকে এভাবে খুব সুন্দরী লাগে।
কি করব বলো? কাজটা সত্যি জরুরী। নইলে আমিও কি আর আইসক্রীম ছাড়ি?
তা বটে। গাড়িটার ওপর দৃষ্টি ঘুরছে ফারিহার। কার এটা? এত সুন্দর?
সিনেমার লোকের। ছবিতে কাজ করছি তো।
তাই নাকি? গাড়িটার ওপর থেকে দৃষ্টি সরছে না ফারিহার। মুসা, গাড়িটা দাও না, একটা ঘোরান দিয়ে আনি? ইস, জাগুয়ার চালাতে যা মজা!
সরি, অন্যের জিনিস…
তাহলে তুমি চলো?
আমার সময় নেই বললামই তো।
কাল সকালে?
ফারিহা, তুমি বুঝতে পারছ না, আমি ব্যস্ত। তাছাড়া একটা কেসের কিনারা করতে… বলেই থেমে গেল মুসা। লাথি মারতে ইচ্ছে করল নিজেকে, পেটে কথা রাখতে পারে না বলে।
মুখ বাঁকাল ফারিহা। কেস? ছাগল পেয়েছ আমাকে? কেসের কিনারা করছ, অথচ আলাদা হয়ে আছ দুই দোস্তের কাছ থেকে, একথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো? একা পারবে?
কেন পারব না? রেগে গেল মুসা। মাঝে মাঝে সত্যিই রাগিয়ে দাও তুমি…
ফারিহাও রেগে গেল। ওরকম আচরণ করছ কেন আমার সঙ্গে?
কি করলাম? তুমিই তো এসেতক টিটকারি দিয়ে চলেছ!
আরও রেগে গেল ফারিহা। গটমট করে গিয়ে নিজের গাড়িতে উঠল। দড়াম করে দরজা লাগিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বের করে বলল, চললাম! গুড বাই!
জবাব দিল না মুসা।
গাড়ির নাক ঘুরিয়ে নিয়ে ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গেল ফারিহা।
নিকি বলল, মেয়েটাকে অযথা রাগালে।
আমি কি করলাম? হাত ওল্টাল মুসা, নিজেই আজেবাজে কথা বলল, বাগল। আসল কথা, নিয়ে বেরোলাম না কেন। আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন?
মাথা চুলকাল নিকি। জবাব দিতে না পেরে হাত নেড়ে বলল, বাদ দাও। এসো, কাজটা সেরে ফেলি।
প্যান্টে হাত ডলে মুছতে গিয়ে পকেটের স্ফটিকটা হাতে লাগল মুসার। ডলনের কথা ভাবল। আবার দম আটকে আসা অনুভূতিটা হলো।
হ্যাঁ, সেরে ফেলা দরকার, মুসা বলল। শুটিং স্পটে যেতে হবে আবার। তদন্তটা বাকি এখনও।
যতটা সহজ হবে ভেবেছিল, তত সহজ হলো না কাজটা। পুরোটা রাত খাটাখাটনি করল ওরা, পরদিন সকাল আটটা নাগাদ শেষ হলো কাজ। সেদিন রোববার। শুটিং হবে না, কর্মচারীদের ছুটি। সারাদিন ধরে ফোনে ফারিহার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করল মুসা, পেল না ওকে। বাড়িতে নেই। আর কোন কাজ না থাকায় বাবাকেই একটা স্পেশাল ইফেক্ট জিনিস তৈরির কাজে সাহায্য করল।
পরদিন সোমবার। স্কুল খোলা। কাজেই স্কুল শেষ করার আগে আর জাগুয়ারটা নিয়ে বেরোতে পারল না।
হলিউডের মুভি স্টুডিওতে সেট সাজিয়েছেন সেদিন জ্যাক রিডার। গেটে মুসাকে আটকাল গার্ড। একবার মাত্র ওয়াশার দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে দিতে হলো উইন্ডশীল্ডে, আর বাধা দিল না গার্ড। ছেড়ে দিল ওকে।
সাত নম্বর স্টেজে সেট সাজান হয়েছে। কালো পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন রিডার। হাতে কোন কিছুর খোঁচা খেয়েছেন। টিপে ধরে আছেন জায়গাটা।
মুসা ভেবেছিল গাড়িটা দেখলে খুশি হবেন তিনি, কিন্তু তাকালেনই না।
মিস্টার রিডার, ডেকে বলল মুসা, আপনার গাড়ি…
হ্যাঁ, খুব ভাল, একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন রিডার। অলিংগারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। চাইলে আসতে পারো।
পিছে পিছে চলল মুসা। আরও কয়েকজন চলল সাথে। রিডারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। দোতলা একটা কাঠের বাড়ির দিকে চলেছে। বাড়িটা কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল অন্যেরা, মুসা আর রিডার এগিয়ে চলল।
ব্রাউন অলিংগারের অফিসে এসে ঢুকল ওরা। অনেক বড় একটা ঘর। দেয়ালে দেয়ালে সিনেমার পোস্টার, স্টিল, আর বিখ্যাত তারকাদের ছবি সাঁটা। মিটিং শুরু হয়ে গেছে।
ওয়ালনাট কাঠে তৈরি বিশাল টেবিলের ওপাশে বসেছেন অলিংগার। আর পাঁচজন লোক রয়েছে ঘরে। ছবির কাহিনীকার, ডিরেকটর অভ ফটোগ্রাফি, স্টাফ কোঅরডিনেটর, কসটিউম ডিজাইনার, মেকআপ আর্টিস্ট।
এসো, এসো, মুসাকে দেখে বললেন অলিংগার, বসো। কেমন আছ? জ্যাক বসো। ক্লান্ত শোনাল তার কণ্ঠ।
রিডারের পাশে একটা চামড়ায় মোড়া চেয়ারে বসল মুসা।
অলিংগার বললেন, ডিলন তো মনে হয় ভালমতই ডুব দিয়েছে। কেন যে একাজ করল! কিন্তু আমরা তো আর বসে থাকতে পারি না। তার যখন ইচ্ছে হয় আসবে। আমরা ইতিমধ্যে দুর্গের কাজগুলো সেরে ফেলতে পারি।
ওখানকার সেট সাজাতেই তিন দিন লেগে যাবে, বলল খাড়া খাড়া কালো চুল এক মহিলা।
হতাশ হয়েই চেয়ারে হেলান দিল মুসা। গাড়ির দৃশ্য গেল! এখন কয়েক হপ্তা আর জাগুয়ারটার দিকে ফিরেও তাকাবেন না রিডার।
তাতে আর কি? জাল কণ্ঠে বললেন রিডার। এমনিতেই দেরি হয়েছে আমাদের। নাহয় লাগল আরও তিন দিন।
সঙ্কেত দিতে আরম্ভ করল অলিংগারের ঘড়ি। মিনিটখানেক পরেই ট্রেতে করে একগাদা চিঠিপত্র নিয়ে ঢুকল তার সেক্রেটারি। একটা খামের ওপরে পার্সোন্যাল লেখা রয়েছে। সেটা তুলে নিয়ে ধীরে সুস্থে খুলতে লাগলেন অলিংগার। পোড়া মাংসের কথায় আসতেই গুঙিয়ে উঠলেন তিনি, সর্বনাশ!
কি হলো? রিডার জিজ্ঞেস করলেন, ভয় লাগছে? অত রক্তপাত সহ্য হবে না?
ওসব না! ডিলন! ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে!