যেতে হল পাশের একটা ছোট ঘরে।
সঙ্গে এল অবলাকান্ত, পাঁচকড়ি কোচম্যান আর হেঁড়ে গলার সেই লোকটা। দেখলুম ঘরে একটা আয়না রয়েছে, আর থিয়েটারের সময়ে যে-সব রং-টং মাখে তা-ও রয়েছে একগাদা। এমন কি, কয়েকটা পরচুলো, নকল গোঁফ, এসবও আমি দেখতে পেলুম।
কিন্তু মানে কী এসবের?
টেনিদা বললে, আপনারা কী চান স্যার? মতলব কী আপনাদের?
—আমাদের মতলব তো সিন্ধুঘোটকের কাছ থেকেই শুনেছ।—সেই হেঁড়ে গলার লোকটা ফস করে টেনিদার মুখে আঠার মতো কী খানিকটা মাখিয়ে দিয়ে বললে, একটা নস্যির কৌটো পাচার করতে হবে।
–কার নস্যির কৌটো?
—বিজয়কুমার?
–নামজাদা ফিল্মস্টার বিজয়কুমার।
অভিনেতা বিজয়কুমার। শুনে আমি একটা খাবি খেলুম। কী সর্বনাশ—তিনি যে একজন নিদারুণ লোক! তাঁর কত ফিল্ম দেখতে-দেখতে আমার মাথার চুল স্রেফ আলপিনের মতো খাড়া হয়ে উঠেছে। ভদ্রলোকের অসাধ্য কাজ নেই। এই সুন্দরবনের জঙ্গলে ধড়াম-ধড়াম করে দুটো বাঘ আর তিনটে কুমির মেরে ফেললেন, এই একটা মোটরবাইকে চড়ে পাঁইপাঁই করে অ্যাঁয়সা ছুট লাগালেন যে, দুরন্ত দস্যুদল ঝড়ের বেগে মোটর ছুটিয়েও তাঁকে ধরতে পারলে না। কখনওবা দারুণ বৃষ্টির ভেতরে বনের মধ্যে দিয়ে যেতে-যেতে করুণ সুরে গান গাইতে লাগলেন। (অত বৃষ্টিতে ভিজেও ওঁর সর্দি হয় না, আর কী জোরালো গলায় গান গাইতে পারেন)। আবার কখনওবা ভারি নরম গলায় কী সব বলতে বলতে, হলসুদ্ধ সবাইকে কাঁদিয়ে-টাঁদিয়ে ফস করে চলে গেলেন। মানে, ভদ্রলোক কী যে পারেন না, তাই-ই আমার জানা নেই!
এহেন বিজয়কুমারের নস্যির কৌটো লোপাট করতে হবে। সেই কৌটোর দাম বড়োজোর আট আনা, তাতে খুব বেশি হলে দু আনার কড়া নস্যি। হীরে নয়, মুক্তো নয়, সোনা-দানা নয়, ঘোরতর দস্যু ডাক্তার ক্যাডাভ্যারাসের দুরন্ত মারণ রশ্মির রহস্যও নয়। এরই জন্যে এত কাণ্ড! কোত্থেকে এক বিদঘুটে সিন্ধুঘোটক, সন্ধ্যোবেলায় গড়ের মাঠে দুটো বিটকেল লোক—অবলাকান্ত আর ঘেঁটুদা—দুটো খেলনা পিস্তল নিয়ে হাজির, একটা লক্কর ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে আমাদের লোপাট করা, ভুতুড়ে পোড় বাড়ি, টেনিদাকে কম্বলরাম আর আমাকে কাঁথারাম সাজানো। এসব ধাষ্ট্যামোর মানে কী?
লোকগুলো ফসফস করে আঠাফাটা দিয়ে আমার মুখে খানিকটা যাচ্ছেতাই গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে দিলে, তা থেকে আবার শুটকো চামচিকের মতো কী রকম যেন বিচ্ছিরি গন্ধ আসছিল। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চেহারা দেখে আমার তাক লেগে গেল—ঠিক আমাদের পাড়ার ন্যাদাপাগলার মতো দেখাচ্ছে—যে-লোকটা হাঁটু অবধি একটা খাকি শার্ট ঝুলিয়ে, গলায় ছেড়া জুতোর মালা পরে, হাতে একটা ভাঙা লাঠি নিয়ে মাঝে মাঝে রাস্তায় ট্র্যাফিক কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করে। আর টেনিদার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা তিন-চারদিনের না-কামানো দাড়ি, নাকের পাশে ইয়া বড়া এক কটকটে জড়ল।
আমি কাঁথারাম কিংবা ন্যাদাপাগলা যাই হই, টেনিদা যে মোম একটি কম্বলরাম, তাতে আমার আর এতটুকু সন্দেহ রইল না। এমন কি, একথাও মনে হতে লাগল যে, আসলে টেনিদা ছদ্মবেশী কম্বলরাম ছাড়া আর কিছুই নয়! কিন্তু সব মিলিয়ে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? এসব সাজগোজ করে আমরা যাব কোথায়, আর এই রাতে? এই পোডড়াবাড়িতে, ফিল্মস্টার বিজয়কুমারের পকেটটাই বা পাওয়া যাবে কোথায় যে, আমরা ফস করে তা থেকে নস্যির কৌটো লোপাট করে দেব?
আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললুম, বিজয়কুমার কোথায় আছেন স্যার?
যে-লোকটা আমার মুখে দাড়ি গোঁফ লাগাচ্ছিল, সে বললে, আছে কাছাকাছি কোথাও। সময় হলেই জানতে পারবে।
কিন্তু তাঁর পকেট মারবার জন্যে আমাদের ধরে আনা কেন?—টেনিদা গোঁ-গোঁ করে বললে, আমরা ওসব কাজ কোনওদিন করিনি। আমরা ভালো ছেলে কলেজে পড়ি।
আর একজন বললে, থামো হে কম্বলরাম, বেশি ফটফট কোরো না। তোমার গুণের কথা কে জানে না, তাই শুনি? বলি, বিজয়কুমারের খাস চাকর হিসেবে তার পকেট থেকে রোজ পয়সা হাতাওনি তুমি? দুবার সে তোমায় বলেনি,—এই ব্যাটা কম্বল, তোর জ্বালায় আমি আর পারি না তুই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা? নেহাত কান্নাকাটি করেছিলে বলে আর তোমার রান্না মোগলাইকারী না হলে বিজয়কুমারের খাওয়া হয় না বলেই তোমার চাকরিটা থেকে যায়নি? তুমি বলতে চাও, এগুলো সব মিথ্যে কথা?
টেনিদা ঘোঁতঘোঁত করে বললে, কেন বারবার বাজে কথা বলছেন? আমি কম্বলরাম নই।
—এতক্ষণ ছিলে না। কিন্তু এখন আর সে কথা বলবার জো নেই। শ্রীমান কম্বলরাম নিজে সামনে এসে দাঁড়ালেও এখন ফয়সালা করা শক্ত হবে—কে আসল আর কে নকল! বুঝলে ছোকরা, আমার হাতের কাজই আলাদা। টালা থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত যত থিয়েটার হয়, তাদের কোনও মেক-আপ ম্যান আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। তোমাকে যা সাজিয়েছি না,—চোখ থাকলে তার কদর বুঝতে।
–কদর বুঝে আর দরকার নেই। এখন বলুন, আমাদের এই সং সাজিয়ে আপনাদের কী লাভ হচ্ছে।
–এত কষ্ট করে তোমাকে কম্বলরাম বানালুম, আর তুমি বলছ সং!-লোকটা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : মনে ভারি ব্যথা পেলুম হে ছোকরা, ভারি ব্যথা পেলুম। নাও, চলো এখন সিন্ধুঘোটকের কাছে। তিনিই বলে দেবেন, কী করতে হবে।
আবার সুড়সুড় করে দোতলায় যেতে হল আমাদের। কথা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই—সে তো বোঝাই যাচ্ছে। শুধু এইটেই বোঝা যাচ্ছে না যে, বিজয়কুমারের পকেট হাতড়াবার জন্যে আমাদের ধরে আনা কেন? ও তো সিন্ধুঘোটকের দলের যে কেউ করতে পারত–লোকগুলোকে দেখলেই ছ্যাঁচড়া আর গাঁটকাটা বলে সন্দেহ হয়।
তা ছাড়া পকেট মারতে গিয়ে যদি ধরা পড়ি–
ধরা পড়লে কী হবে তা অবিশ্যি বলবার দরকার নেই। তখন রাস্তাসুদু লোক একেবারে পাইকারী হারে কিলোতে আরম্ভ করবে। হিতোপদেশের সেই কীলোৎপাটীত বানরঃ—অর্থাৎ কিনা কিলের চোটে দাঁতের পাটি-ফাটি সব উপড়ে যাবে আমাদের।
কিন্তু কাজটা বোধহয় টেনিদা—ওরফে কম্বলরামকেই করতে হবে, কাজেই কিলচড় আমার বরাতে না-ও জুটতে পারে। তা ছাড়া টেনিদার ঠ্যাং দুটোও বেশ লম্বা-লম্বা। বেগতিক বুঝলে তিনলাফে এক মাইল রাস্তা পাড়ি দিতে পারে। দেখাই যাক না–কী হয়।
আর সত্যি বলতে কী, এতক্ষণে আমারও কেমন একটা উত্তেজনা হচ্ছিল। কলকাতায় এই দারুণ গরম—চটচটে ঘাম আর রাত্তিরে বিচ্ছিরি গুমোট—সব মিলে মন-মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এমন কি, গঙ্গার ধারের শীতল সমীরেও যে খুব আরাম হচ্ছিল তা নয়। তারপরেই ঘেটুদা আর অবলাকান্ত এসে হাজির। দিব্যি জমে উঠেছিল, বিরাট একটা সিন্ধুঘোটক ছিল, বেশ একটা ভীষণ রকমের কিছু রোমাঞ্চকর ব্যাপার ঘটবে এমনি মনে হচ্ছিল, কিন্তু একটা নস্যির কৌটোতেই সব গোলমাল করে দিচ্ছে। একটা হীরে-মুক্তো হলেও ব্যাপারটা কিছু বোঝা যেত, কিন্তু–
সিন্ধুঘোটক সমানে গড়গড়া টানছে—আশ্চর্য, কলকে যে নেই সেটা কি ওর খেয়ালই হয় না? নাকি, বিনা কলকেতেই গড়গড়া খাওয়াই ওর অভ্যেস। কে জানে!
আমরা ঘরে যেতেই সিন্ধুঘোটক কটমট করে তাকাল আমার দিকে।
—এটা আবার কে? কোন পাগলাগারদ থেকে একে ধরে আনলে?
—আজ্ঞে, পাগলাগারদের আসামী নয়, ও কাঁথারাম।
–ওটাকে সাজাতে গেলে কেন?
–এমনি একটু হাতমক্শ করলুম, আজ্ঞে যে আমার মুখে বাব্লু গোঁফদাড়ি লাগিয়ে দিয়েছিল, সে একগাল হেসে জবাব দিলে।
–কম্বলরামটা খাসা হয়েছে। হাঁ–নিখুঁত।—সিন্ধুঘোটক গড়াগড়া রেখে উঠে দাঁড়াল, তারপর এগিয়ে এল আমাদের দিকে। ঠিক যেন শুড়কাটা একটা হাতি দু পায়ে এগিয়ে এল দুলতে-দুলতে।
প্রথমেই টেনিদার নাকটা নেড়েচেড়ে দেখল, তারপর আঙুল নিয়ে জড়লটা পরখ করল, তারপর একটা কান ধরে একটু টানল। টেনিদার মুখটা রাগের চোটে ঠিক একটা বেগুনের মতো হয়ে যাচ্ছিল—এ আমি পষ্ট দেখতে পেলাম। কিন্তু কিছু করবার জো নেই—অনেকগুলো লোক রয়েছে চারপাশে, টেনিদা শুধু গোঁ-গোঁ করতে লাগল।
–কান ধরছেন কেন, স্যার?
–কেন, অপমান হল নাকি?—সিন্ধুঘোটক একরাশ দাঁত বের করে খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে উঠল : ওহে, মজার কথা শুনেছ? কম্বলরামের অপমান হচ্ছে।
ঘরসুদ্ধ লোক অমনি একসঙ্গে ঘোঁকঘোঁক করে হেসে উঠল। সব চাইতে বেশি করে হাসল ঘেঁটুদা, টেনিদা যাকে ল্যাং মেরে গোবরের ভেতর ফেলে দিয়েছিল।
হাসি থামলে সিন্ধুঘোটক বললে, যাক—আর সময় নষ্ট করে দরকার নেই। এবার অ্যাঁকশন।
—অ্যাঁকশন!—শুনেই আমার পিলে-টিলে কেমন চমকে উঠল, আমি টেনিদার দিকে। চাইলাম। দেখলুম, খাঁড়ার মতো নাকটা যেন অনেকখানি খাড়া হয়ে উঠেছে, রাগে চোখ দুটো দিয়ে আগুন ছুটছে।