যুধিষ্ঠিরের নরকদর্শনের কারণ কথন
বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির অতি অল্পকাল সেই অপবিত্র স্থানে অবস্থান করিলে, মূৰ্ত্তিমান ধৰ্ম্ম ও ইন্দ্রাদি দেবগণ তথায় আগমন করিলেন। তখন সেই তেজসীদিগের সমাগমে তত্রত্য তিমিররাশি একেবারে তিরোহিত, হইল। বৈতরণীনদী, কূট-শাল্মলী, লোহকুম্ভী-নরক, উত্তপ্ত লৌহফলক ও পাপাত্মাদিগের যাতনাসমুদয় আর লক্ষিত হইলো না। মহাত্মা যুধিষ্ঠির ইতিপূর্ব্বে যেসমুদয় বিকৃত শরীর দর্শন করিতেছিলেন, তৎসমুদয়ও এককালে অদৃশ্য হইয়া গেল এবং পবিত্ৰগন্ধযুক্ত সুখস্পর্শ সুশীতল বায়ু চারিদিকে প্রবাহিত হইতে লাগিল।
অনন্তর ইন্দ্রের সহিত মরুগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সহিত বসুগণ এবং সাধ্য, রুদ্র, আদিত্য, সিদ্ধ, পরমর্ষি ও অন্যান্য দেবগণ ধৰ্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের নিকট সমুপস্থিত হইলেন। তখন দেবরাজ ধৰ্ম্মরাজকে সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! সমুদয় দেবতা তোমার প্রতি প্রীত হইয়াছেন। অতঃপর আর তোমাকে কষ্টভোগ করিতে হইবে না। এক্ষণে তুমি আমার সহিত আগমন কর। তোমার পরমসিদ্ধি ও অক্ষয়লোকলাভ হইয়াছে। তোমার নরকদর্শন হইল বলিয়া তুমি আমাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হইও না। সকল রাজাকেই এক একবার নরকদর্শন করিতে হয়। মনুষ্যমাত্রেরই পাপ ও পুণ্য এই উভয়ের শ্রেণী বিদ্যমান থাকে। যে ব্যক্তি প্রথমে স্বর্গভোগ করে, পশ্চাতে তাহাকে নরকযন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়, আর যে ব্যক্তি প্রথমে নরকভোগ করে, সে পশ্চাৎ স্বর্গসুখের. অধিকারী হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি অশেষবিধ পাপকার্য্যের অনুষ্ঠান ও অল্পমাত্র পুণ্যসঞ্চয় করে, সে প্রথমে স্বর্গসুখ অনুভব করিয়া থাকে; আর যে ব্যক্তি অধিক পুণ্যসঞ্চয় ও অণুমাত্র পাপানুষ্ঠান করে, তাহার প্রথমে নরকভোগ ও পশ্চাৎ স্বৰ্গভোগ হয়। এই নিমিত্ত আমি তোমার শ্ৰেয়োলাভার্থী হইয়া তোমাকেই প্রথমে নরকদর্শন করাইলাম।
অশ্বত্থামার মৃত্যুরূপ মিথ্যাকথনের শাস্তি
“পূৰ্ব্বে তুমি ছলপূৰ্ব্বক গুরু দ্রোণাচার্য্যের নিকট অশ্বত্থামার বিনাশ কীৰ্ত্তন করিয়া তাঁহাকে বঞ্চনা করিয়াছিলে, এই নিমিত্ত তোমাকে ছলক্রমে নরক প্রদর্শন করান হইল এবং তোমার ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদী সেই পাপে ছলক্রমে নরকভোগ করিলেন। এক্ষণে তোমার ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদী সেই নরক হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছেন। তোমার পক্ষীয় সমুদয় ভূপতিরই স্বর্গলাভ হইয়াছে এবং তোমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহাধনুর্দ্ধর কর্ণও পরমসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। এক্ষণে তুমি শোকপরিত্যাগপূৰ্ব্বক আমার সহিত আগমন কর। অনায়াসে তাঁহাদিগকে স্ব স্ব স্থানে অবস্থিত দেখিয়া পরমপরিতোষ লাভ করিতে পারিবে। আদিত্যসদৃশ কর্ণের নিমিত্ত আর তোমার অনুতাপ করিবার আবশ্যকতা নাই। তোমার মনস্তাপ দূর হউক। তুমি প্রথমে বহুতর কষ্টভোগ করিয়াছ। এক্ষণে শোকবিহীন হইয়া আমার সহিত পরমসুখে অবস্থানপূর্ব্বক তপস্যা, দান ও অন্যান্য পুণ্যকার্য্যের ফলভোগ কর। আজ অবধি গন্ধৰ্ব্ব ও অপ্সরাগণ সতত তোমার শুশ্রূষা করিবে। অতঃপর তুমি রাজসূয়জিত লোকসমুদয় ও তপস্যার মহাফল উপভোগে প্রবৃত্ত হও। মহারাজ হরিশ্চন্দ্র, মান্ধাতা, ভগীরথ ও ভরত অন্যান্য ভূপতিসমুদয় অপেক্ষা যে অতি উৎকৃষ্ট লোক লাভ করিয়াছেন, তুমি সেই লোকে অবস্থিত হইয়া পরমসুখ ভোগ করিবে। ঐ দেখ, তোমার অনতিদূরে ত্রৈলোক্যপাবনী দেবনদী মন্দাকিনী বিরাজমান রহিয়াছেন, তুমি উঁহার পবিত্ৰজলে অবগাহন করিলেই তোমার শোকসন্তাপ ও বৈর প্রভৃতি মানুষভাবসমুদয় একেবারে তিরোহিত হইবে।”
যুধিষ্ঠিরের ধৰ্ম্ম-পরীক্ষান্তে মায়ানরক-নিবাস
দেবরাজ এই কথা কহিলে, ভগবান্ ধর্ম্ম স্বীয় পুত্র যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! আমি তোমার ধর্ম্মপরায়ণতা, সত্যনিষ্ঠা, ক্ষমা ও দমগুণদর্শনে নিতান্ত প্রীত হইয়াছি। এই আমি তৃতীয়বার তোমাকে পরীক্ষা করিলাম। কিন্তু এবারেও তোমাকে স্বভাব হইতে পরিচালিত করিতে সমর্থ হইলাম না। পূর্ব্বে তোমার দ্বৈতবনে অবস্থানসময়ে আমি অরণিকাষ্ঠ অপহরণ করিয়া মায়াবলে তোমার ভ্রাতৃগণকে সংহারপূর্ব্বক তোমার নিকটে যেসমুদয় প্রশ্ন করিয়াছিলাম, তুমি অনায়াসে তাহার উত্তর করিয়াছিলে। তৎপরে তোমার মহাপ্রস্থানসময়ে আমি কুক্কুররূপে তোমাকে পরীক্ষা করিয়াও তোমার বুদ্ধি বিচালিত করিতে পারি নাই; আর এক্ষণেও তুমি ভ্রাতৃগণকে পরিত্যাগ করিয়া স্বৰ্গভোগ করিবে না, ইহা আমার বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম হইল। এখন বুঝিলাম, তোমার তুল্য বিশুদ্ধস্বভাব আর কেহই নাই। অতঃপর তুমি স্বচ্ছন্দে স্বর্গসুখ অনুভব কর। তোমার ভ্রাতৃগণ নরকভোগের যোগ্যপাত্র নহে; তুমি উহাদিগকে যে নরকভোগ করিতে দেখিয়াছ, দেবরাজ ইন্দ্র মায়াবলে ঐ নরকের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। সমুদয় রাজাকে অবশ্যই একবার নরক দর্শন করিতে হয়, এই নিমিত্তই মুহূর্ত্তকাল তোমাকে সেই ক্লেশ সহ্য করিতে হইয়াছে। মহাত্মা অৰ্জ্জুন, ভীমসেন, নকুল, সহদেব, কর্ণ ও রাজপুত্রী দ্রৌপদী ইহাদিগের সকলেরই স্বর্গলাভ হইয়াছে। এক্ষণে তুমি আমার সহিত আগমন করিয়া ঐ মন্দাকিনীর পবিত্ৰজলে অবগাহন কর।”
ভগবান্ ধৰ্ম্ম এই কথা কহিলে ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা যুধিষ্ঠির অচিরাৎ দেবগণের সহিত সেই ত্রিলোকপাবনী মন্দাকিনীর তীরে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহার পবিত্ৰজলে অবগাহন করিলেন। ঐ সলিলে অবগাহন করিবামাত্র তাঁহার মানুষদেহ তিরোহিত ও দিব্যমূৰ্ত্তি সমুৎপন্ন হইল এবং তাঁহার অন্তর হইতে শোক ও বৈরভাব একেবারে দূরীভূত হইয়া গেল; তখন তিনি ধর্ম্ম ও অন্যান্য দেবগণে পরিবৃত হইয়া ঋষিদিগের স্তুতিবাদ শ্রবণ করিতে করিতে যে স্থলে তাঁহার ভ্রাতৃচতুষ্টয় ও ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ ক্রোধবিহীন হইয়া পরমসুখে অবস্থান করিতেছিলেন, সেই স্থলে গমন করিলেন।