আমার যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন মহাকাশযান ফোবিয়ান তার নির্দিষ্ট যাত্রাপথে উড়ে যেতে শুরু করে দিয়েছে। মহাকাশযানে একটি আরামদায়ক মহাকর্ষ বল। আমি নিরাপত্তা বেল্ট খুলে চেয়ার থেকে নেমে এসে ডাকলাম, ফোবি।
বলুন মহামান্য ইবান।
সবকিছু চলছে ঠিকভাবে? চলছে মহামান্য ইবান।
আপনি সুস্থবোধ করছেন তো?
মাথার ভেতরে একটা ভোঁতা ব্যথা, আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে দূরে অপসৃয়মান গ্রহটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, এখনো বিশ্বাস হতে চায় না আমি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অংশ এই অশুভ গ্রহটির ভিতরে একটা বায়োডোমে কাটিয়ে দিয়েছি। আমি মনিটর থেকে চোখ সরাতেই ছোট স্বচ্ছ গোলকটির দিকে চোখ পড়ল, ভেতরে বিচিত্র একটি গাছ, গাছে নীল পাতা তিরতির করে নড়ছে। আমি গাছটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটাই কি সৌভাগ্য-বৃক্ষ?
হ্যাঁ মহামান্য ইবান। এটা সৌভাগ্য-বৃক্ষ।
মানুষের যখন সৌভাগ্য আসে তখন এই গাছে ফুল ফোটে?
সেরকম একটি জনশ্রুতি রয়েছে।
তুমি বিশ্বাস কর?
ফোবি বলল, সৌভাগ্য জিনিসটা কী সেটাকে নতুন করে ব্যাখ্যা করলেই এটা বিশ্বাস করা যায়।
কী রকম?
যেমন আপনি যদি ধরে নেন এই বিচিত্র গাছটির ফুল ফুটতে দেখা একধরনের সৌভাগ্য!
আমি হা হা করে হেসে বললাম, ভালোই বলেছ ফোবি। তুমি নিঃসন্দেহে খুব বুদ্ধিমান।
ধন্যবাদ মহামান্য ইবান।
আমি গাছটিকে ভালো করে লক্ষ করতে করতে বললাম, এই সৌভাগ্য-বৃক্ষ আমি আমার মায়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি জানি।
তোমার কী মনে হয় ফোবি, আমার মা কি এটা পছন্দ করবেন?
নিশ্চয়ই করবেন।
তুমি তো আমার মাকে কখনো দেখ নি, তুমি কেমন করে জানো?
কারণ আপনার মায়ের কাছে জিনিসটির কোনো গুরত্ব নেই, আপনি এনেছেন এই ব্যাপারটির গুরত্ব অনেক। তা ছাড়া সৌভাগ্য-বৃক্ষ নামটির একটা আকর্ষণ আছে। সৌভাগ্যের জন্যে অপেক্ষা করাও মানুষ খুব পছন্দ করে।
আমি একটু হেসে বললাম, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি মানুষকে খুব ভালো বুঝতে পার।
আপনাদের জন্যে ব্যাপারটি সহজাত, আমাদের শিখতে হয়। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষকে বুঝতে শিখি।
আমি সৌভাগ্য-বৃক্ষ থেকে চোখ সরিয়ে হেঁটে জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম, বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার তার মাঝে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে অসংখ্য নক্ষত্র। মহাকাশযানে একটা মৃদু কম্পন এ-ছাড়া প্রচণ্ড গতিবেগের কোনো চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছে মহাকাশযানটি বুঝি একজায়গায় স্থির হয়ে আছে। কিন্তু আমি জানি এটি স্থির হয়ে নেই, প্রচণ্ড গতিবেগে এটি ছুটে চলেছে।
আমি জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে ভিতরে তাকিয়ে বললাম, সৌভাগ্য-বৃক্ষ ছাড়াও এখানে আমার জন্যে আরো একটি জিনিস থাকার কথা।
আপনি মহামতি রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্ক ম্যাপিং-এর কথা বলছেন?
হ্যাঁ। সেটা আছে তো?
আছে মহামান্য ইবান। এখনো উপস্থাপন করা হয় নি। আপনি যখন চাইবেন আমাকে জানাবেন, আমি উপস্থাপিত করে দেব।
বেশ। আরো কিছু সময় যাক। আমি এই মানুষটির সাথে কথা বলতে খুব আগ্রহী তাই আগেই বলে ফেলতে চাই না। একটু অপেক্ষা করতে চাই।
ঠিক আছে মহামান্য ইবান।
আমি আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, কালো আকাশে নক্ষত্রগুলি দেখে বুকের ভিতরে আবার একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি।
আমি মহাকাশযান ফোবিয়ানের বিভিন্ন স্তরে ঘুরে ঘুরে পুরোটা পরীক্ষা করে নেই। বাতাসের চাপ, আর্দ্রতা, জ্বালানির পরিমাণ, নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়া, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, অস্ত্রের সরবরাহ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন খাবার বা বিনোদনের ব্যবস্থা সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। পুরো মহাকাশযানটির মাঝেই একটা যত্নের ছাপ রয়েছে। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে এটাকে দাঁড় করানো হয়েছে। যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে, আমি মুগ্ধ হয়ে ফোবিয়ানের যান্ত্রিক উল্কর্ষ দেখে দেখে সময় কাটিয়ে দিতে লাগলাম।
মহাকাশযানটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অংশটি আমি যাত্রার শুরতেই করে নিতে চাইছি কারণ এখন এর ভেতরে একটা আরামদায়ক মহাকর্ষ বল রয়েছে। মহাকাশযানটির গতিবেগ প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে, তার তুরণের জন্যে এখানে মহাকর্ষ বল— ইঞ্জিন দুটো বন্ধ করে দেবার পর এখানে আর মহাকর্ষ বল থাকবে না। মহাকাশযানটিকে এর অক্ষের উপর ঘুরিয়ে আবার মহাকর্ষ বল তৈরি করতে হবে, সেটা হবে বাইরের দিকে। মহাকাশযান ফোবিয়ানটিকে কাছাকাছি একটা নিউট্রন স্টারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার মহাকর্ষ বলকে ব্যবহার করে মহাকাশযানটিকে আবার প্রচণ্ড একটি গতিবেগ দেয়া হবে।
কয়েকদিনের মাঝেই আমি এই মহাকাশযানটিতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। আমার জন্যে সুসজ্জিত একটি ঘর থাকা সত্ত্বেও আমি কন্ট্রোল প্যানেলের নিচে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঘুমিয়ে যেতাম। যেটুকু না-খেলেই নয় আমি সেটুকু খেয়ে সময় কাটিয়ে দিতাম। একা-একা আছি বলে নিজের চেহারার দিকে কখনো ঘুরে তাকাতাম না এবং দেখতে দেখতে আমার মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল হয়ে গেল। অবসর সময় আমি প্রাচীন সঙ্গীত শুনে সময় কাটাতাম এবং কখনো কখনো সময় কাটানো সমস্যা হয়ে গেলে একটুকরো কৃত্রিম কাঠের টুকরো কুঁদে কুঁদে মানুষের ভাস্কর্য তৈরি করতে শুরু করতাম। কয়েকদিনের মাঝেই মহাকাশযানটি তার প্রয়োজনীয় গতিবেগ অর্জন করে ফেলবে, মূল ইঞ্জিন। দুটি বন্ধ করে দেয়ার পর আমি আবার ভরশূন্য পরিবেশে ফিরে যাব।
মহাকাশযানের জীবনযাত্রায় আমি যখন পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম তখন একদিন আমার রিতুন ক্লিসের মুখোমুখি হবার ইচ্ছে করল। আমি ফোবিকে বললাম রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্কের ম্যাপিংটিকে ফোবিয়ানের নিউরাল নেটওয়ার্কে উপস্থাপন করতে।
এধরনের কাজ অল্প কিছু সময়ের মাঝেই হয়ে যাবার কথা কিন্তু দেখা গেল পুরোটুকু শেষ করতে ফোবির দীর্ঘ সময় লেগে গেল। নিউরাল নেটওয়ার্কে উপস্থাপন শেষ করে ফোবি আমাকে নিচু গলায় বলল, মহামান্য ইবান, আপনি এখন ইচ্ছে করলে মহামান্য রিতুন ক্লিসের সাথে কথা বলতে পারেন।
কীভাবে বলব? কোথায় রিতুন ক্লিস?
আপনি অনুমতি দিলে আমি তার হলোগ্রাফিক ত্রিমাত্রিক একটি প্রতিচ্ছবি আপনার সামনে উপস্থিত করতে পারি।
বেশ, তুমি উপস্থাপন কর।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝামাঝি জায়গায় মধ্যবয়স্ক একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল। মানুষটি একটা ঢিলে আলখাল্লার মতো শাদা পোশাক পরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খুব ধীরে ধীরে সেই মানুষটি আমার দিকে ঘুরে তাকাল। মানুষটিকে দেখে আমি নিজের শরীরে একধরনের শিহরণ অনুভব করলাম কারণ আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এটি একটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি নয়, এটি সত্যিই একজন মানুষ। মানুষটি আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায়?
আমি দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন করে বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনি মহাকাশযান ফোবিয়ানে।
আমি এখানে কেন?
আপনার সাথে কথা বলার জন্যে আমি আপনার মস্তিষ্কের ম্যাপিংকে মহাকাশযানের নিউরাল নেটওয়ার্ক উপস্থাপন করেছি।
মহামান্য রিতুনের মুখে হঠাৎ একটি গভীর বেদনার ছায়া পড়ল। তিনি বিষণ্ণ গলায় বললেন, তুমি শুধুমাত্র আমার সাথে কথা বলার জন্যে আমাকে এই ভয়ঙ্কর অমানবিক পরিবেশে নিয়ে এসেছ?
ভয়ঙ্কর অমানবিক পরিবেশ?
হ্যাঁ, এটি একজন মানুষের জন্যে একটি ভয়ঙ্কর পরিবেশ, একটি অসহনীয় পরিবেশ।
আমি একটু চমকে উঠে বললাম, আমি আসলে বুঝতে পারি নি এই পরিবেশটি আপনার কাছে এত অসহনীয় মনে হবে।
বুঝতে পার নি? মহাকাশযানের নিউরাল নেটওয়ার্কের বিশাল শূন্যতার মাঝে আমি একা অনন্তকালের জন্যে আটকা পড়ে আছি, আমার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আদি নেই, অন্ত নেই, শুরু নেই, শেষ নেই এটি যদি অমানবিক না হয় তাহলে কোনটি অমানবিক?
আমি আসলে বুঝতে পারি নি—
মহামান্য রিতুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার চোখের দিকে তাকালেন, বললেন, তুমি বুঝতে পার নি?
না।
বুঝতে চেষ্টা করেছ?
আমি অপরাধীর মতো বললাম, আসলে চেষ্টাও করি নি। আমি ভেবেছিলাম এটি আরো একটি মস্তিষ্কের ম্যাপিং— আসলে আপনি যে সত্যিকার একজন মানুষ হিসেবে আসবেন সেটি একবারও বুঝতে পারি নি।
হ্যাঁ, তুমি বিশ্বাস কর, আমি সত্যিকারের একজন মানুষ। আমি রিতুন ক্লিসের মস্তিষ্কের ম্যাপিং নই আমিই রিতুন ক্লিস। রক্তমাংসের রিতুন ক্লিস যেটুকু জীবন্ত ছিল আমি ঠিক ততটুকু জীবন্ত।
আমি বিশ্বাস করেছি। আমি আগে বুঝতে পারি নি কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি।
রিতুন ক্লিস আমার দিকে দুই পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী যুবক?
আমার নাম ইবান।
তুমি কে?
আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।
রিতুন ক্লিস কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর কাতর গলায় বললেন, ইবান, তুমি আমাকে মুক্তি দাও।
আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বললাম, অবশ্যি আমি আপনাকে মুক্ত করে দেব। অবশ্যি দেব। কীভাবে করতে হয়। আমাকে সেটা বলে দেন—
আমাকে এই নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে সরিয়ে নাও। আমার অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দাও।
ধ্বংস করে দেব?
হ্যাঁ। আমাকে ধ্বংস করে দাও।
আমি রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ করে আমার ভিতরে একধরনের আতঙ্ক এসে ভর করল। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ইবান?
আপনি এত জীবন্ত, আপনাকে ধ্বংস করা তো আপনাকে হত্যা করার মতো। আমি কীভাবে আপনাকে হত্যা করব?
রিতুন ক্লিস বিপন্ন গলায় বললেন, তুমি কী বলতে চাইছ ইবান?
আমি— আমি এখন কী করব? আমি আপনাকে এই নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে মুক্ত করতে চাই, কিন্তু সেটি তো একটা হত্যাকাণ্ডের মতো–
রিতুন ক্লিস কাতর গলায় বললেন, তাহলে কি এখান থেকে আমার মুক্তি নেই?
আপনি কি নিজেকে নিজে মুক্ত করতে পারেন না?
আমি জানি না। আমি যখন বেঁচে ছিলাম তখন প্রযুক্তি এরকম ছিল না। এরকম নিউরাল নেটওয়ার্ক ছিল না, সেখানে মানুষের মস্তিষ্ক ম্যাপিং করা যেত না।
হয়ত ফোবি বলতে পারবে। আমি উচ্চস্বরে ডাকলাম, ফোবি— ফোবি–
ফোবি নিচু গলায় বলল, বলুন মহামান্য ইবান।
তুমি কি নিউরাল নেটওয়ার্কে এমন ব্যবস্থা করে দিতে পারবে যেন মহামান্য রিতুন ক্লিস নিজেকে নিজে মুছে দিতে পারবেন? অস্তিত্বকে সরিয়ে দিতে পারবেন?
ফোবি উত্তর দিতে কয়েকমুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, নেটওয়ার্কের কোনো প্রক্রিয়া নিজে থেকে নিজে ধ্বংস করা অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ। সেটি সচরাচর করা হয় না।
কিন্তু করা কি সম্ভব?
ফোবি আবার কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, হ্যাঁ, অত্যন্ত বিশেষ প্রয়োজনে সেটি করা সম্ভব। আপনি যদি নিজে ঝুঁকি নিয়ে সেটি করতে চান, সেটা করা যেতে পারে।
বেশ, তাহলে তুমি ব্যবস্থা করে দাও যেন মহামান্য ইবান নিজেকে নিজে নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে অপসারিত করতে পারেন।
ফোবি আবার কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলল, আপনি যদি চান, তাহলে তাই করে দেব।
আমি এবারে রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনাকে যেন এই নিউরাল নেটওয়ার্কে আটকা পড়ে থাকতে না হয় তার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে, আপনি নিজেকে নিজে অপসারিত করে নিতে পারবেন।
মহামান্য রিতুন কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হাসার চেষ্টা করে বললেন, তার অর্থ তুমি হত্যা করতে চাও না বলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না, একটু হতচকিত হয়ে রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ তাহলে তাই হোক।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা রিতুন ক্লিসের প্রতিচ্ছবিটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডাকলাম, ফোবি।
বলুন মহামান্য ইবান।
এই সুদীর্ঘ অভিযানে আমি একা, ভেবেছিলাম মহামান্য রিতুন ক্লিসের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাব, কিন্তু দেখতে পেলে কী হলো?
আমি দুঃখিত মহামান্য ইবান।
আসলে তুমি দুঃখিত নও ফোবি। তোমার দুঃখিত হবার ক্ষমতাও নেই।
আপনি ঠিকই বলেছেন মহামান্য ইবান।
এই মহাকাশযানে সময় কাটানো নিয়ে আমার খুব বড় সমস্যা হয়ে যাবে। খুব বড় সমস্যা।
আমি তখন ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করি নি যে আমার এই কথাটি আসলে ভয়ঙ্করভাবে ভুল প্রমাণিত হবে।
এরপরের কয়দিন অবশ্যি আমার সময় কাটানো নিয়ে বড় কোনো সমস্যা হলো না, মহাকাশযানটি প্রয়োজনীয় গতিবেগ অর্জন করে ফেলেছে এখন ইঞ্জিন দুটো বন্ধ করে দিতে হবে। মহাকাশযান পরিচালনার নিয়মকানুনে ইঞ্জিন দুটো হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারে নানারকম বিধিনিষেধ রয়েছে। এর আগে আমি কখনোই একা কোনো মহাকাশযানে ছিলাম না, কাজেই নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়েছে। এবারে সে-ধরনের কোনো সমস্যা নেই, কাজেই আমি ইঞ্জিন দুটো এক সাথে হঠাৎ করে বন্ধ করে দেবার প্রস্তুতি নিলাম। ফোবি আমার পরিকল্পনা আন্দাজ করে আমাকে সাবধান করার চেষ্টা করল, বলল, মহামান্য ইবান, মহাকাশযানের ইঞ্জিন হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া চতুর্থ মাত্রার অনিয়ম।
তার মানে জানো?
জানি মহামান্য ইবান।
তার মানে এটি মহাকাশযানের কোনো বড় ধরনের ক্ষতি করবে না।
কিন্তু আপনার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
মনে হয় না। সেই ছেলেবেলা উঁচু দেয়াল থেকে লাফিয়ে পড়তাম— হঠাৎ করে ভরশূন্য পরিবেশের অনুভূতি খুব। চমৎকার অনুভূতি। আমার মনে হয় আমার ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়ে যাবে।
আপনি ছাদে গিয়ে আঘাত করবেন, আপনার সাথে সাথে সকল খোলা যন্ত্রপাতি ছাদে আঘাত করবে, সমস্ত মহাকাশযান প্রচণ্ড একটা ঝাকুনিতে কেঁপে উঠবে, নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি—
আহ্ ফোবি, তুমি থামবে? আমি একটা বাচ্চা খোকা নই আর তুমি আমার মা নও! তুমি যদি ভুলে গিয়ে থাক তাহলে তোমাকে মনে করিয়ে দিই, আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।
ফোবি নরম গলায় বলল, আমি আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র অসম্মান প্রদর্শন করছি না মহামান্য ইবান, আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।
চমৎকার! তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো, আমি আমার দায়িত্ব পালন করি!
আমি শরীরকে আসন্ন ঘটনার জন্যে প্রস্তুত করে সুইচকে স্পর্শ করে এক সাথে দুটো ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলাম। মনে হলো সাথে সাথে মহাকাশযানে প্রলয় কাণ্ড ঘটে গেল, প্রচণ্ড শব্দ করে মহাকাশযানটি কেঁপে উঠল, এবং আমি আক্ষরিক অর্থে উড়ে গিয়ে ছাদে আঘাত করলাম, মহাকাশযানের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে আমি শারীরিক কোনো আঘাত পেলাম না, তবে উড়ে আসা নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, আমার অভুক্ত খাবার, জমে থাকা জঞ্জাল এবং অব্যবহৃত পোশাক থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বেশ বেগ পেতে হলো।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ভাসমান যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য জঞ্জাল সরিয়ে আমি ঘরটিকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করতে বেশ কিছু সময় লাগল। ভেসে ভেসে আবার নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে এসে ফোবিকে বললাম, দেখলে, এটি কোনো ব্যাপার নয়।
দেখলাম। তবে আপনি সতর্ক না থাকলে উড়ে আসা যন্ত্রপাতি থেকে আঘাত পেতে পারতেন।
কিন্তু আমি সতর্ক থাকব না কেন?
সেটি অবশ্যি সত্যিই বলেছেন।
আমি পদার্থ-প্রতিপদার্থের অব্যবহৃত জ্বালানি চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে আবদ্ধ করে নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিশ্চিত করলাম। যাত্রাপথটি ছক করে নিউট্রন স্টারে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে সেটি বের করে নিলাম, পুরো মহাকাশযানের খুঁটিনাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে মহাকাশযানের অধিনায়কের দৈনন্দিন কাজ করতে শুরু করলাম। মহাকাশযানে পুরোপুরি একা থাকার একটি সুবিধে রয়েছে যেটা আমি মাত্র টের পেতে শুরু করেছি, এখানে আমার এখন কোনো নিয়ম মানতে হয় না।
সমস্ত কাজ শেষ করতে করতে বেশ অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল, দীর্ঘদিন মহাকর্ষ বলের মাঝে থেকে হঠাৎ করে ভরশূন্য পরিবেশে এসে যাওয়ায় অভ্যস্ত হতে একটু সময় নিচ্ছে। অধিনায়কের দৈনন্দিন তথ্য প্রবেশ করে আমি ঘুমানোর আয়োজন করলাম, এতদিন তবু একটু স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঘুমিয়েছি, এখন আর তারও প্রয়োজন নেই, আমি শূন্যে শুয়ে পড়তে পারি, ভেসে ভেসে দূরে কোথাও না চলে যাই সে-জন্যে একটা ফিতা দিয়ে একটা পা কন্ট্রোল প্যানেলের সাথে বেঁধে নিলাম। আমি শূন্যে ভাসতে ভাসতে ঘুমানোর জন্যে চোখ বন্ধ করেছি তখন আবার ফোবির কথা শুনতে পেলাম, মহামান্য ইবান, আপনি কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ছেন। এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য।
ফোবি। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি আমার মা নও, তুমি আমার স্ত্রী নও, তুমি আমার কোনো অভিভাবকও নও। আমাকে বিরক্ত কোরো না, ঘুমুতে দাও।
ফোবি আমাকে আর বিরক্ত করল না এবং আমি কিছুক্ষণের মাঝেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।
আমি হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম, কেন আমার হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল আমি জানি না। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে। আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যেতে গিয়ে মনে পড়ল আমি আসলে বিছানায় শুয়ে নেই, শূন্যে ঝুলে আছি। আমি তখন চোখ খুলে তাকালাম এবং হঠাৎ করে আতঙ্কে আমার সারা শরীর শীতল হয়ে গেল।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মূল আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে বলে এখানে আবছা এক ধরনের অন্ধকার, ইঞ্জিনগুলো বন্ধ করে দেয়ার ফলে কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। এই ভয়ংকর নৈঃশব্দ এবং আলো-আঁধারিতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝামাঝি থেকে একজন তরণী স্থির হয়ে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি চিঙ্কার করে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম, নিশ্চয়ই আমি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু আমি ততক্ষণ। পুরোপুরি জেগে উঠেছি, আমি জানি আমি স্বপ্ন দেখছি না। আমার সামনে একটি তরণী ভাসছে। একটুকরা নিওপলিমার দিয়ে শরীরকে ঢেকে রেখেছে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পরিশোধিত বাতাসের প্রবাহে সেই কাপড়টা উড়ছে। আমি স্থির দৃষ্টিতে তরণীটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, এটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক কোনো প্রতিচ্ছবি নয়— তাহলে আমি দেখতে পেতাম দেয়ালের ভিডি টিউব থেকে আলো বের হয়ে আসছে। এটি সত্যি-সত্যি রক্তমাংশের একজন তরণী।
আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?
আমার কথায় মেয়েটি ভয়ানক চমকে উঠল এবং আমি দেখতে পেলাম তার মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্কের ছায়া পড়েছে। মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল তারপর আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, তুমি কে?
আমি বললাম, আমার নাম ইবান। আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।
অধিনায়ক? মেয়েটা খুব অবাক হয়ে বলল, অধিনায়ক তুমি?
হ্যাঁ।
তাহলে তোমাকে বেঁধে রেখেছে কেন?
আমি অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, ঘুমানোর আগে আমি যেন ভেসে কোথাও না চলে যাই সে-জন্যে ফিতা দিয়ে একটা পা বেঁধে রাখার ব্যাপারটি মেয়েটিকে বিস্মিত করেছে। আমি পা থেকে ফিতাটি খুলে বললাম, কোথাও যেন ভেসে চলে না যাই সেজন্যে বেঁধে রেখেছিলাম।
কেন তুমি ভেসে চলে যাবে? আমি শুনেছি মহাকাশযানে অধিনায়কদের খুব সুন্দর ঘর থাকে।
তুমি ঠিকই শুনেছ—
তাহলে তুমি সেখানে না ঘুমিয়ে এখানে নিজেকে বেঁধে রেখে শূন্যে ঝুলে ঝুলে ঘুমাচ্ছ কেন?
আমি ঠিক নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলাম না যে এরকম বিচিত্র একটা পরিবেশে আমি এধরনের আলাপে জড়িয়ে পড়ছি। আমি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, দেখ, এসব ব্যাপার নিয়ে আমরা পরেও কথা। বলতে পারব। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমার জানা প্রয়োজন তুমি হঠাৎ করে কোথা থেকে হাজির হয়েছ।
মেয়েটি আমার প্রশ্ন শুনে কেন জানি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে বলল, তুমি যদি মহাকাশযানের অধিনায়ক হয়ে থাক তাহলে তোমার জানা উচিত আমি কোথা থেকে হাজির হয়েছি।
আমি বিপন্ন গলায় বললাম, দেখতেই পাচ্ছ আমি জানি না। সেজন্যেই ব্যাপারটি জরুরি–
কেন ব্যাপাটি জরুরি?
দাঁড়াও বলছি। তার আগে আমি আলো জ্বেলে নিই।
আমি আলো জ্বালানোর জন্যে একটু এগিয়ে যেতেই মেয়েটি চিৎকার করে বলল, খবরদার তুমি আমার কাছে আসবে না।
আমি একটু অপমানিত বোধ করলাম, কিন্তু এই মুহুর্তে মান-অপমান নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। আমি গলার স্বর শান্ত রেখে বললাম, তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, আমি তোমার কাছে আসব না।
নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সুইচ স্পর্শ করামাত্র নিয়ন্ত্রণ কক্ষটি উজ্জ্বল আলোতে ভেসে গেল এবং মেয়েটি হাত দিয়ে নিজের চোখ আড়াল করে দাঁড়াল। আমি দেখতে পেলাম মেয়েটি কমবয়সী এবং অপূর্ব সুন্দরী। মসৃণ ত্বক, কালো চুল এবং সুগঠিত দেহ। মেয়েটির চেহারায় একধরনের নির্দোষ সারল্য রয়েছে যেটি আমি বহুদিন কারো মাঝে দেখি নি। মেয়েটি ভরশূন্য পরিবেশে অভ্যস্ত নয়, প্রতি মুহূর্তে সে ভাবছে সে পড়ে যাবে, কিন্তু ভরশূন্য পরিবেশে কেউ কোথাও পড়ে যেতে পারে না এবং এই বিচিত্র অনুভূতির সাথে সে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে দাঁড়িয়ে পুরো প্যানেলটিতে একবার চোখ বুলিয়ে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে কি না দেখার চেষ্টা করলাম–কিন্তু সেরকম কিছু চোখে পড়ল না। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?
মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিও পলিমারের চাদরটি টেনে নিজের শরীরকে ভালো করে ঢাকার চেষ্টা করে বলল, আমার শীত করছে।
এই পাতলা নিওপলিমারের টুকরো দিয়ে শরীর ঢাকার চেষ্টা করলে শীত করতেই পারে। আমি তোমার গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
মেয়েটি কোনো কথা না বলে আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?
আমার নাম মিত্তিকা।
মিত্তিকা, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
আমি জানি না। হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে গেল, আমি ঘুম থেকে উঠে ভাসতে ভাসতে এদিকে এসেছি–
তার মানে তুমি কার্গো বেতে রাখা শীতল ক্যাপসুল থেকে উঠে এসেছ?
আমি সেটা জানি না। আমি রিশি নক্ষত্রপুঞ্জে যাবার জন্যে রেজিস্ট্রি করিয়েছিলাম, কথা ছিল সেখানে পৌঁছার পর আমাকে জাগানো হবে। কিন্তু–
মেয়েটি অভিযাগের সুরে আরো কিছু কথা বলতে থাকে কিন্তু আমি ভালো করে সেটা শুনতে পেলাম না, হঠাৎ করে একধরনের অশুভ আশঙ্কায় আমার ভুর কুঞ্চিত হয়ে উঠলাম। আমি চাপা গলায় ডাকলাম, ফোবি।
ফোবি একেবারে কানের কাছ থেকে ফিসফিস করে বলল, বলুন মহামান্য ইবান।
এটা কী করে হলো? এই মেয়েটি ঘুম থেকে জেগে উঠল কেমন করে?
বলতে পারছি না মহামান্য ইবান। আমার দুটি সম্ভাবনার কথা মনে হচ্ছে।
কী সম্ভাবনা?
ফোবি উত্তর দেবার আগেই মিত্তিকা ভয়-পাওয়া-গলায় চিল্কার করে উঠল, তুমি কার সাথে কথা বলছ?
আমি মিত্তিকাকে ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বললাম, ফোবির সঙ্গে। ফোবি হচ্ছে এই মহাকাশযানের মানুষের সাথে যোগাযোগ করার ইন্টারফেস।
সে কোথায়?
তুমি তাকে দেখতে পাবে না।
মিত্তিকা আমার কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না, কেমন জানি ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ফোবিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী সম্ভাবনার কথা বলছ?
আপনি যখন ফোবিয়ানের দুটি ইঞ্জিন একসাথে বন্ধ করে দিয়েছিলেন তখন প্রচণ্ড ঝাকুনিতে কোনো একটি শীতল ক্যাপসুল খুলে গিয়েছে, নিরাপত্তা সার্কিট তখন ভেতরের মানুষটিকে বাঁচিয়ে তুলেছে।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না। সেটা খুব সম্ভবযোগ্য মনে হচ্ছে না। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা কী?
রিতুন ক্লিসকে যখন আমরা নিজেকে নিজে অপসারণক্ষমতা দিয়েছি তখন নিউরাল নেটওয়ার্কের স্মৃতির একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তার ফল হিসেবে শীতল ক্যাপসুলের মানুষেরা জেগে উঠছে।
সর্বনাশ!
মিত্তিকা একটু এগিয়ে আসার চেষ্টা করে গলার স্বর উঁচু করে বলল, সর্বনাশ কেন?
তোমাকে নিয়ে আমি সর্বনাশ বলছি না।
তাহলে কাকে নিয়ে সর্বনাশ বলছ?
তোমাদের সাথে ম্যাঙ্গেল ক্বাস নামে একজন ভয়ংকর ডাকাত রয়েছে, তাকে নিয়ে বলছি। এই মানুষটি যদি জেগে উঠে থাকে তাহলে আমাদের খুব বড় বিপদ।
ফোবি নিচু গলায় আমাকে ডাকল, মহামান্য ইবান।
বল।
কিছু-একটা নিয়ে একটু সমস্যা আছে। কার্গো-বেতে যোগযোগ করা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।
আমি হঠাৎ করে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করলাম, সত্যিই যদি মিত্তিকার মতো ম্যাঙ্গেল ক্বাসও জেগে উঠে থাকে তাহলে কী হবে? আমি চাপা গলায় ডাকলাম, ফোবি।
বলুন মহামান্য ইবান।
আমার একটু কার্গো বেতে যেতে হবে।
ফোবি কোনো কথা বলল না।
কী হয়েছে নিজের চোখে দেখে আসতে হবে।
এবারেও ফোবি কোনো কথা বলল না।
ফোবি।
বলুন মহামান্য ইবান।
আমার মনে হয় খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। অস্ত্রাগার থেকে একটা অস্ত্র নিয়ে যাই। কী বল?
ঠিক আছে।
মিত্তিকা চোখ বড় বড় করে আমাদের কথা শুনছিল, এবারে ভয়ার্ত গলায় বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
কার্গো বেতে। তুমি এখানে একটু অপেক্ষা কর।
না, আমার ভয় করে।
এখানে ভয়ের কিছু নেই।
যদি ভয়ের কিছু না থাকে তাহলে হাতে অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছ কেন?
প্রশ্নটির ভালো কোনো উত্তর ভেবে পেলাম না, মিত্তিকা নিজেই বলল, আমি তোমার সাথে যাব।
তুমি তো ভরশূন্য পরিবেশে অভ্যস্ত নও, ভেসে ভেসে যেতে পারবে না।
ভেসে ভেসে যদি যেতে না পারি তাহলে এখানে এসেছি কেমন করে?
আমি এই প্রশ্নটারও উত্তর দিতে পারলাম না, মাথা নেড়ে বললাম, ঠিক আছে চল।
আমি মিত্তিকাকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মূল করিডোর ধরে ভেসে ভেসে ফোবিয়ানের মাঝামাঝি সুরক্ষিত ঘরটি থেকে একটা শক্তিশালী অস্ত্র তুলে নিলাম, লেজার রশ্মি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে লক্ষ করে শক্তিশালি বিস্ফোরক ছুড়ে দেবার। একটি অতি প্রাচীন কিন্তু কার্যকর অস্ত্র।
অস্ত্রটি উরর সাথে বেঁধে নিয়ে আবার আমি ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যেতে থাকি, ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে ভেসে যাওয়া নিয়ে মিত্তিকা যদিও খুব বড়গলায় কথা বলেছে কিন্তু আসলে অভ্যস্ত না থাকায় সহজে এগিয়ে যেতে পারছিল না, আমি তাকে একহাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম।
কার্গো বে-এর দরজা হাট করে খোলা, ভিতরে আবছা অন্ধকার। আমি আলো জ্বালালাম, ঘরের মাঝামাঝি একটা ক্যাপসুল ওলটপালট খেয়ে ভাসছে। ক্যাপসুলটি হা করে খোলা। আমি চাপাগলায় জিজ্ঞেস করলাম, মিত্তিকা, এটা কি তোমার ক্যাপসুল?
মিত্তিকা মাথা নাড়ল, বলল, না। আমারটা ওই পাশে।
আমি উর থেকে খুলে অস্ত্রটা হাতে নিয়ে একটা ঝটকা দিয়ে ক্যাপসুলের দিকে এগিয়ে গেলাম। ক্যাপসুলের দরজা খোলা, ভেতরে কেউ নেই। ক্যাপসুলের পাশে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের নাম লেখা— এটাতে তাকে আটকে রাখা ছিল।
ভয়ের একটা শীতল স্রোত আমার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল, ম্যাঙ্গেল ক্বাস ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছে।
এই মহাকাশযানের কোথাও সে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।