মৃত মানুষের আঙুল
প্রাতঃরাশ সাজানো হতেই মিসেস হিগিনসনের হাত থেকে ট্রে-টা নিয়ে ক্যরোশার হলঘরে চলে এলো।
মিসেস হিগিনসন তাকে সর ফেলতে নিষেধ করলো। কিন্তু ক্যরোশার হাত চলকে দুধ পড়ে গেল তার লজ্জাবরণীর উপর। কিন্তু তখন তার তা পরিষ্কার করার সময় নেই, তারপর দোতলায় গিয়ে দেখবে মিস্ আমানদা রেগে আছেন।
মিস আমানদার ঘরের সামনে এসে ক্যরোশা দাঁড়িয়ে পড়ল। তার নিজেকে কেমন যেন দুর্বল লাগছে। সে ক্লান্ত বোধ করলেও নিজের সাজপোশাক ঠিক করল টুপিটাকে মাথার পেছনে ঠেলে দিল। পেয়ালাটাকে একটু সরিয়ে দিলো। এখানে আজ ওর প্রথম দিন।
ক্যরোশা এরপর ট্রে তুলে নিয়ে অন্য দরজায় সংকেত দিলো। ওদিক থেকেও সাগ্রহে সাড়া আসল যেন তার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। ক্যরোশার আজ কাজের প্রথম দিন ছিল। সে ঘরের ভেতরে এসে বিছানার পাশে ছোট টেবিলে রাখলো।
মিসেস আমানদা বৃদ্ধা। মোটা, অসম্ভব ফ্যাকাসে। ওই মহিলা গত ৪০ বছরের মধ্যে হাঁটাচলা করা তো দূরের কথা বিছানার থেকে ওঠেননি। মুখটা রক্তশূন্য, পর পর বালিশ রেখে তিনি এমন ভাবে শুয়ে আছেন দেখলে মনে হয় মাথার নিচে কারোটি বলতে কিছু নেই। গলা পর্যন্ত সুতির চাদর দিয়ে ঢাকা। সারা দেহে তুষারের পাহাড়ের মতো খাঁজখোঁজ। সমস্ত অবয়বের মধ্যে কেবল কোটরে ঢোকা কুকুতে চোখ দুটো সজীব।
উনি ক্যরোশাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে সে নতুন কিনা। উত্তর এলো যে হ্যাঁ, সে অত্যন্ত কমবয়সী। মাত্র ১৬ বছর বয়স তার! যখন তাকে তার গিন্নিমা বয়সের কথা বলল সে বেশ অবাকই হলো।
মিস আমানদা তিন-তিনটে ঘড়ি একসাথে বেজে ওঠায় সে খুব ভয় পেল। কিন্তু ক্যরোশা চমকে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল ঘরে থেকে সে পালায়, কিন্তু পা-দুটো ঝিমঝিম করল। তাই সে নড়তে সাহস পর্যন্ত পায়নি। তাছাড়া ব্যাপারটা খুব অশোভন।
মিস আমানদার হাসিমুখ যেন রাগিয়ে দিল তাকে। আমানদা বললেন যে, তাকে দেখতে ভালো নয় তবে বয়সটা কম হলে সবাই পছন্দ করছে, তাকে খুব সুন্দর দেখতে ছিল। কালো চুল, ফুলের মতো মসৃণ গা। তার বিয়ের প্রস্তাব একশোটা এসেছিল। কিন্তু তিনি পঙ্গু হয়ে রয়েছেন। ক্যরোশা কি করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু বুড়ির জন্য তার কোনো অনুকম্পা জাগছিল না। সেই মুহূর্তে মিসেস হিগিনসনের কাছে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমানদার অনুমতি ছাড়া যাওয়া অসম্ভব।
আমানদা জিজ্ঞাসা করলো তার কোনো প্রেমিক বন্ধু আছে কিনা। ক্যরোশা সম্মতি জানাল। মিস আমানদা ক্যরোশার মুখের দিকে তাকাতে সে অস্বস্তি বোধ করল। ওর ডান হাতের কড়ে আঙুলটা আলাদা আর ভীষণ ছোট! ক্যরোশার মনে হলো অস্থিবিহীন একটা সোহাগী সাপ তার হাতকে পেঁচিয়ে উঠছে।
ক্যরোশাকে বললেন যে, তুমি যা ভাবো, আর পাঁচজন বুড়ির মতো সে ততটা খারাপ নয়। খাওয়া পরা ছাড়া মানুষের জীবনে আরও অনেক কিছু আছে, যার কথা আমি ভাবি। ক্যরোশা শুধু যুবতী হয়ে ভাবছে–এতটা স্বার্থপর যেন সে না হয়।
ক্যরোশা তার কথায় চমকে উঠল। তার প্রেমিকের নাম ডোনাল্ড, সে বলল। ডোনাল্ড লম্বা, ভালো স্বাস্থ্য। ক্যরোশার কাছ থেকে মিস আমানদা জিজ্ঞাসা করলেন কেমন করে তার প্রেমিক তাকে ভালোবাসে।
এইসব করোশারের মোটেই ভালো লাগছিল না। সে পালিয়ে যেতে চাইছিল, ছায়া ঘর, রোগশয্যা ঘড়ি ও ডান হাতের বাঁকা আঙুল সব কিছুই তাকে ক্লান্ত করে তুলল।
হঠাৎ মনে হলো মিস আমানদার উৎসাহ যেন এক ছুঁয়ে নিভিয়ে দিয়েছে। ক্যরোশার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ক্যরোশাকে নিচে যেতে বলা হলো।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ক্যরোশা চোখের জল আটকে রাখলো। ডোনাল্ডকে তার ডাকতে ইচ্ছে করল। যাকে সে ভালোবাসে। রান্নাঘরে ঢুকে ক্যরোশা দ্রুত হিগিনসনকে পাশ কাটিয়ে গেলো। সে চৌবাচ্চায় গিয়ে জল দিয়ে মুখ ধুতে লাগল,তার খেতে ইচ্ছে করছিল না।
হিগিনসন বুঝতে পারল বুড়ি তাকে কিছু বলেছে। সে বলল যে বুড়ির কাছে কাজ করা খুব মুশকিল। এটা খুব অদ্ভুত। এখানে প্রতিটা পদক্ষেপ মেপে চলতে হয়, কেউ এখানে বেশিদিন থাকে না। বিশেষত কমবয়সী মেয়েরা। তারা কিছুদিন পর নকল করতে থাকে ম্যাডামকে। একবার একটি মেয়ে মিস আমানদার গলার স্বর নকল করত। হঠাৎ দুদিন যেতে না যেতে সে আত্মহত্যা করে গলায় দড়ি দিয়ে। কোথাও কোনো কারণ নেই। অন্য লোক তো দূরের কথা, পুলিশ কিছু বুঝতে পারল না, ক্যরোশার দুচোখ ভরে জল আসছিল। মিসেস হিগিনসন তাকে বুড়ির কথায় কান না দিতে বললেন।
যতটা সময় গেল ক্যরোশার মাথার যন্ত্রণা বাড়তে লাগল। সে অন্যমনস্ক হলো। সে বাসনকোসন ধুলো, কুটনো কুটল তারপর তার কাজ সারল। দু-একটা মামুলি কথা ছাড়া মিস আমানদা মুখ খোলেননি। ও যেন একটা চিন্তার মধ্যে ছিল। তার শুধু মনে হচ্ছিল যে আটটায় ডোনাল্ড তার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে।
দাঁত চেপে সে খাবার নিয়ে ওপরে উঠতে গেলো তার পা থেকে মাথা এমন জ্বলে গেল যে হাত থেকে ট্রে-টা কেঁপে গেল। মিস আমানদা তাকে বকবেন বা আদর করবেন এটা মনে হচ্ছিল, ক্যরোশা তখন মনে মনে খুশী হয়েই ভাবছিল। ডাইনিবুড়ির উপর চোটপাট করতে করতে ও ঘর ছেড়ে বেরুবে, কিন্তু তা কিছুই ঘটল না। ও মনে সাহস নিয়ে ট্রে-টা নামাল। ও কিছু বলতে পারছিল না। ওর যে কি হয়েছে ও নিজেই জানে না। জীবনে কখনও এরকম কষ্ট পায়নি।
রাত্তিরে সব কাজ শেষ করে সে ডোনাল্ডের জন্য অপেক্ষা করল, সবে কোটের বোতাম লাগাতে শুরু করেছে, হঠাৎ জানালা দিয়ে ঘোড়ার গাড়িটা দেখতে পেলো–ডোনাল্ড চালক হয়ে চাবুক হাঁকাচ্ছে, ক্যরোশা ভাবল যে ডোনাল্ডকে যদি সব বলে দেয় এখুনি সে বাড়িতে আগুন ধরাবে। ক্যরোশা তাড়াতাড়ি টুপি পরল, মিস আমানদার ঘর থেকে ঘন্টি বেজে উঠল।
হিগিনসন বললেন যে, ক্যরোশাকে ডাকা হয়েছে। তাকে বলবেন উপরে উঠে দেখা করতে। তিনি তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলবেন। ক্যরোশা ভেবেছিলো আর ওই বুড়িটার সঙ্গে দেখা করতে হবে না। তবুও তাকে করতে হবে।
তাকে ম্যাডাম বললেন যে, সে তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, এ সময় তার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার জন্য তিনি দুঃখিত। এ বিষয়টা ক্যরোশার মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না। ডোনাল্ডের কথা জিজ্ঞেসা করলেন ম্যাডাম।
গিন্নিমা কিছু চান কিনা জিজ্ঞাসা করতে তিনি বালিশ কমাতে বললেন। এটা করে চলে যাবার মুহূর্তে মিস আমানদা শক্ত করে ওর কাঁধ টানলেন ও বিছানায় টেনে আনলেন। ওর হাতে এত শক্তি থাকতে পারে ক্যরোশা স্বপ্নেও ভাবেনি। ক্যরোশা মুক্তি চাইছিল। তার মাথা যন্ত্রণায় কাঁপছে। ম্যাডাম বললেন যে তাকে ছাড়া হবে না। তুমি কখনও বন্ধুর কাছে ফিরতে পারবে না। ও জানতে পারবে না তুমি ক্যরোশা নও।
ক্যরোশার ভায়ানক অস্বস্তি লাগল। চীনা ঘড়ির বাজনা, অন্ধকার হওয়ার পর মনকে আরো অদ্ভুত করে তুলল। কয়েক মুহূর্ত পরেই চোখের কোটর ছাড়া ও মিস আমানদার মুখটা দেখতে পেলো না। তারপর চোখের কোটর অন্ধকার কোথায় মিলিয়ে গেল।
ঘরের পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তার পায়ে পাতা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল যন্ত্রণা। সে স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখলো লেপতোষকের মধ্যে ও শুয়ে আছে। ওর সামনে মিস আমানদা দরজা খুলে বেরোচ্ছেন। সে পায়ের শব্দ শুনলেও তাকে অনুসরণ করতে পারল না। এমন কি বিছানা থেকে উঠে সে আয়নায় মুখ দেখবে তারও কোনো উপায় নেই। তার ডান হাতের কড়ে আঙুল ছোট হয়ে কেন বাঁকল সে বুঝল না। তবে সে যে আর মুক্তি পাবে না তা বুঝতে পারল।
ডোনাল্ডের কথা মনে হতে সে জানালা দিয়ে দেখল যে ডোনাল্ড গাড়ির উপর বসে রয়েছে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ও হাসছে।
ক্যরোশা স্পষ্ট শুনল ডোনাল্ডের ভরাট কণ্ঠস্বরে। সে বলছে যে তোমার জন্য বসে আছি। ক্যরোশা তাকে দেখে চিৎকার করে বলল চোর চোর। হিগিনসন ঝড়ের মতো ছুটে এলেন। তিনি শুনলেন যে মেয়েটি আংটি নিয়ে পালাচ্ছে।
হিগিনসন বাইরে গিয়ে টেনে হিঁচড়ে মেয়েটিকে ঘরের মধ্যে নিয়ে এলেন। ডোনাল্ড মুহূর্তের মধ্যে বুদ্ধ বনে গেল। হিগিনসন মেয়েটাকে ঘরের মধ্যে এনে ফেলল।
ডোনাল্ড ঘন ঘন দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল। সে কিছুই করতে পারছিল না। একটু পরে সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। একসময়ে দরজা ঠেলে হিগিনসন মেয়েটাকে ঢুকিয়ে দিল।
ক্যরোশা তাকে দেখতে মিসেস হিগিনসন বলল, সে তার থেকে আংটিটা আদায় করতে পারে। তবে পুলিশে খবর দিতে পারেন। ক্যরোশাকে বললেন মিস আমানদা যে এভাবে তাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখা যাবে না। তার মতে সবই বাক্সে আছে যা পুলিশ জানতে পারলে তাকেই নিয়ে টানাটানি করবে। সে ডোনাল্ডের কাছে যাবে।
ক্যরোশা নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। ক্যরো-র গলাটা ধরে ফেলল। ওর মাংসল হাতদুটো যে এত ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে যেতে পারে সে সম্পর্কে ক্যরোশার ধারণা ছিল না। তক্ষুনি আমানদার গলায় সে টিপে দিল।
হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ এল। ভারী বুটের শব্দ যখন বারান্দা পেরিয়ে খোলা দরজায় দাঁড়াল তখন ক্যরোশা অমানুষিক মেয়েটির গলা টিপে আছে। ডান হাতের কড়ে আঙুলটা অদ্ভুতভাবে উঁচিয়ে আছে।
হিগিনসন বললে যে, ভদ্রমহিলা প্রায় ৪০ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন তাকে যদি সাহায্য করতে না পারলেন তাহলে দেশে আইনশৃঙ্খলা থাকার কি প্রয়োজন।