৩. মনের জ্বালা

১১.

মার্টিন আমার কাছ থেকে বেরিয়ে গিয়ে মনের জ্বালা জুড়োতে ওরিয়েন্টাল নামে এক নৈশ ক্লাবে ঢোকে। উন্মাদের মত কয়েক পেগ খেয়ে বিল মিটিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। পাশাপাশি আর একটা ক্লাব, ম্যাকসিন। আবার কিছু দুরে চেজ ভিন্টার। একটাতেও আর যায় না মার্টিন। নেশায় সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। আমস্টারডম ও ডাবলিনের সেই মেয়ে দুটোর কথা মনে পড়ছে। আবার কিছুক্ষণ পর উদাস হয়ে পড়ে মনটা। হ্যারির কথা মনে আসে। রাস্তা সুনসান শুধু বরফ পড়ে যাচ্ছে। তার ইচ্ছে করছেসব ভেঙে ছারখার করে দিতে। তার মনের আগুন আন্নাকে পুড়িয়ে দেবে। এতদিন সে ভাল ছিল কিন্তু কি পেয়েছে? শুধু বঞ্চনা।

রাত তিনটের সময় মার্টিন আন্নার ফ্ল্যাটে এসে বেল বাজায়। এখানে না এসে সে পারেনি। এক অমোঘ আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে এসেছে। বেল বাজিয়ে এখন যেন অস্বস্তি হচ্ছে তার।

এবার আওয়াজ ভেসে আসে–কে?

–আমি মার্টিন।

–তুমি এত রাতে?

–হঠাৎ-ই চলে এলাম।

আন্না দরজা খুলে বিস্মিত হয়। মার্টিনও নিজেকে সামলে নেয়, ভাবে ওকে সব বলে হাল্কা হবে। কিন্তু উত্তেজিত হয়ে মার্টিন বলে–আন্না আমি সব কিছু জেনেছি।

আন্না বলে–আগে বস। এত রাতদুপুরে চিৎকার করে বাড়ির লোকদের জাগিও না। শান্ত হয়ে বস।

দুজনে মুখোমুখি চেয়ারে বসে। আন্না বলে পুলিশ কি তোমায় ধাওয়া করেছে?

 মার্টিন অবাক হয়–পুলিশ!

-হ্যাঁ।

–কই না তো!

–তুমি তো হেচককে গুলি করনি?

হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞাসা করছ?

 করেছ কিনা আগে তাই বল।

না করিনি।

–তুমি এত মদ খেয়েছ কেন?

 মার্টিন চিৎকার করে বলে–বেশ করেছি।

এরপর নিজেকে সংযত করে বলে–ব্রিটিশ পুলিশ বিশ্বাস করেছে যে আমি হেচককে খুন করিনি।

–আশাব্যঞ্জক কথা শোনালে।

তবে হ্যারির ব্যাপারে অনেক কিছু জেনেছি।

তুমি জেনেছ?

–হ্যাঁ।

বল কি জেনেছ?

–ও একটা বিশ্রী ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিল।

–বিশ্রী ব্যাপার?

–ও আমাদের দুজনকেই ঠকিয়েছে। আমি এটা ওর কাছে আশা করিনি। আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে।

আন্না উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে–আমায় সব খুলে বল। সব জানতে চাই আমি।

মার্টিনের কাছ থেকে সব শুনে বলে–আমি তোমার কথা বিশ্বাস করতে পারি? বলে আবার ভাবে মার্টিন মিথ্যা বলছে। হ্যারির কখন এত অধঃপতন হবে? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকে আন্না। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে। আবার বলে–সত্যি বিশ্বাস করতে পারি?

আমি তোমায় মিথ্যে বলছি এ কথা কি করে ভাবলে?

না না শুধু জিজ্ঞাসা করছি। আসলে মানতে পারছি না।

 –আমিও পারছি না। ওর কি এমন দরকার পড়ল এই রাস্তা বেছে নেবার।

–তাই তো ভাবছি, এছাড়া কি অন্য পথ ছিল না?

–তুমিই ভাল বলতে পারবে। ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেশার সুযোগ পেয়েছ।

–আমার সঙ্গে ও বিশ্বাসঘাতকতা করল। ঠগ প্রতারক কোথাকার। ওর কথা শুনতেও ঘৃণা হচ্ছে। রাগে আন্নার চোখ মুখ অন্যরকম হয়ে যায়।

–প্রতারণা শুধু তোমার সঙ্গেই করেনি, আমার সঙ্গেও করেছে। ভাবছি কি করে ও এমন পাল্টে গেল।

–আমি আর ভাবতে পারছি না। ওর কথা আর বল না আমার সামনে, ও মারা গেছে ভালই হয়েছে।

না না, একথা অন্ততঃ তুমি বোল না।

বলতে বাধ্য হচ্ছি।

–তুমি শান্ত হও, বুঝতে পারছি খুব দুঃখ পেয়েছ।

–ও যদি জেলে পচে মরত তাও আমি সহ্য করতাম না।

–জানি এখনও তুমি ওকে ভালবাস।

–আমার একটা কথার জবাব দেবে?

–কি?

–যে হ্যারি টাকার জন্য এ কাজ করল সে বোধহয় আমাদের চেনা ছিল না।

এক এক সময় আমারও তাই মনে হয়।

আমাদের নিয়ে যেন ও ঠাট্টা করে গেছে।

করতেও পারে। সে থাকলে জবাবটা তার কাছ থেকেই চাইতাম। এখন এসব আমাদের মেনে নিতে হবে।

–মেনে নেবে?

তাছাড়া উপায় কি?

–আমি পারব না।

–পারতে যে হবে।

–তুমি ভাবতে পার সেই বাচ্চাগুলোর কথা, যারা মারা গেছে, উন্মাদ হয়েছে।

–মার্টিন, ওসব ভুলে যাও।

–পারছি কোথায়।

–তবু সব কিছু ভোলার চেষ্টা করতে হবে।

–আন্না! মার্টিনের গলা চিড়ে যেন নামটা বেরিয়ে আসে।

–হ্যাঁ, মার্টিন।

 –আমি আর ওকে মনে করতে চাই না।

চাও না?

না, আমি…।

–কি? বল? থামলে কেন?

 –আমি এখন তোমায় ভালবাসি।

 আন্না অবাক হয়ে বলে–আমায়?

–হ্যাঁ আন্না।

–আমিও একটা কথা তোমায় জানাতে চাই।

–কি কথা?

–আমিও তোমাকে ভালবাসি মার্টিন।

–ঠিক বলছ? তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার।

–কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালমত চিনি না।

আন্না ভাবে একবার সে ঠকেছে, দ্বিতীয়বার আর ভুল করতে চায় না। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই মার্টিনকে ভাল লেগেছে। অপরের জন্য ওর মনে দরদ আছে, না হলে মৃত বন্ধুর জন্য এত কে করে!

মার্টিন বলে–তুমি হ্যারিকে মন থেকে মুছে ফেলতে পার না?

–কি করে পারব?

জানি আমি, নইলে ও কথা জিজ্ঞাসা করতে না।

বল, হ্যারিকে কি করে ভুলি?

–মার্টিন অভিমান করে বলে–যা হেরচকের মামলা মিটলে ভিয়েনা ছেড়ে চলে যাব।

চলে যাবে?

–হ্যাঁ।

 হতাশ গলায় প্রশ্ন করে আন্না–কেন?

–এখানে থেকে কি করব? তাছাড়া হ্যারিকে কে খুন করল তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। যে ওকে খুন করেছে ঠিকই করেছে।নইলে এই পরিস্থিতিতে আমিই হয়ত ওকে খুন করতাম।

–তুমি? আন্না চমকে উঠে বলে।

–হা হা আমি।

কখনোই পারতে না। ..

–ঠিক পারতাম।

তুমি রেগে গিয়ে বলছ। একটু শান্ত হও।

শান্তই আছি, আর আমার অত তাড়াতাড়ি রাগও হয় না। ছিঃ ছিঃ শেষে হ্যারি কি না…। ওর জন্য গর্ব হত আমার, সবাইকে ওর কথা বলতাম।

একটু থেমে আবার বলে–আর তুমি এখনও ঐ জঘন্য লোকটাকে ভালবাস।

হ্যাঁ, ওকে আজও ভালবাসি। ওর ব্যাপারে তুমি এত কিছু জেনেছ বলে আমার ভালবাসায় বিন্দুমাত্র চিড় খাবে না। তবে এটা ঠিক এসব জানার পর আমি স্তম্ভিত।

–তুমি যে ভাবে কথা বলছ তাতে আমার রাগ হচ্ছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে আর তুমি বকে চলেছ।

–আমি তোমাকে এখানে আসতে বলিনি, নিজেই এসেছ।

–তুমি কিন্তু রাগিয়ে দিচ্ছ।

আন্না হেসে বলে একে রাত তিনটের সময় এলে, তারপর রেগে আছ। এখন কি করলে তুমি খুশী হবে।

–আমি এভাবে কখনও তোমায় হাসতে দেখিনি আর একবার হাস।

দুবার হাসার মত কোন ঘটনা ঘটেনি।

–আমি খুব ক্লান্ত, সারাদিন খুব ধকল গেছে।

জানালার কাছ থেকে সরে এস।

–কেন?

–ওখানে পর্দা নেই।

 –এত রাতে কেউ দেখবে না।

 মার্টিন আস্তে বলে–আন্না এখনও তুমি হ্যারিকে ভালবাস তাই না।

-হ্যাঁ।

সম্ভবত আমিও। কিন্তু কেন জানি না…।

আচ্ছা আজ উঠি।

 মার্টিন উত্তরের অপেক্ষা না করে রাস্তায় চলে আসে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় কেউ তাকে অনুসরণ করছে। পিছন ফিরে তাকাতেই একটা রোগা লোককে দেওয়ালের দিকে চলে যেতে দেখল।মার্টিন চিৎকার করে–কে ওখানে? জবাবদাও? আওয়াজে একটা ঘরের পর্দা উঠে, আলো এসে পড়ল রাস্তায়। কাউকে দেখতে পেল না মার্টিন। অবাক হয় কোথায় গেল? উবে গেল নাকি? স্বচক্ষে দেখেছে তাকে। হতভম্বের মত সামনে এগিয়ে চলে সে।

.

১২.

সকালে মার্টিন আমার অফিসে আসতে অবাক হয়ে যাই, এভাবে আসবে ভাবিনি। সুপ্রভাত জানিয়ে বসতে বলি। জিজ্ঞাসা করি–হঠাৎ কি মনে করে?

–একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই কর্নেল।

–কি? –

-আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?

ভূত?

–হ্যাঁ।

না। আমার মনে হয় মাতালেরা ইঁদুর বা ঐ জাতীয় কিছু দেখলেও ভূতের ভয় পায়। গতকালের আন্না স্মিডের কথা বলার পর বলল একটা লোক তাকে অনুসরণ করছিল, মার্টিন পিছু নিতে কোথায় মিলিয়ে গেল। মনে হয়েছে হ্যারি লাইম যেন এসেছিল।

আমি বললাম–একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

করুন।

 –তখন আপনি পান করেছিলেন?

–কেন বলুন তো?

–আগে বলুন, তারপর বলছি।

–হ্যাঁ।

যা ভেবেছি ঠিক তাই।

–কি ভেবেছিলেন?

–ও সব মদের খেয়ালে…

–কিন্তু তখন আমার এমন অবস্থা নয় যে ভুল করব। আর মদ তো নতুন খাচ্ছি না।

যাইহোক তারপর কি করলেন?

–কিছুদূরে একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে এক পেগ মদ খেলাম।

–তখনই ভূতটা আবার ফিরে এসেছিল।

–না, আসেনি। ঐ রাতে আবার আন্নার ফ্ল্যাটে চলে গেছিলাম।

মার্টিনের কথা শুনে মনে হল, যে তোক অনুসরণ করছিল সে হ্যারি নয়। মার্টিনকে আমার সঙ্গে কথা বলতে দেখে দলের লোককে সাবধান করে দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।

মার্টিন আবার যখন আন্নার ফ্ল্যাটে যায় তখন চারটে বাজে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে শোনে নীচে তার নাম ধরে কে ডাকছে। নীচে তাকিয়ে বলে আমায় কিছু বলছেন?

হ্যা।

বলুন।

–আন্তর্জাতিক টহলদারী পুলিশ আন্নাকে তুলে নিয়ে গেছে।

–আমাকে?

–হ্যাঁ।

–কি যা তা বলছেন!

–ঠিকই বলছি উপরে গেলেই দেখতে পাবেন।

আসলে রাশিয়ার ওপর এখন নিরাপত্তার ভার। রাশিয়ার কাছে খবর ছিল আমা তাদেরই নাগরিক।

–আন্না রাশিয়ান নাগরিক?

–হ্যাঁ তাই বলেছে। এখানকার কাগজপত্র জাল।

–জাল?

–হ্যাঁ। নাগরিকত্ব ভাঙিয়ে এখানে বসবাস করছে।

এখানে বলে রাখি ভিয়েনা মিলিটারী পুলিশী ব্যবস্থাগুলো অদ্ভুত ধরণের। এক অঞ্চলের লোকদের পক্ষে অন্য অঞ্চলের লোকদের ধরা মুশকিলের ব্যাপার। প্রত্যেকটা অঞ্চলের খুঁটিনাটি শাসন ব্যবস্থা অন্য অঞ্চলের লোককে মেনে চলতে হয়।

আন্নার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করার আগে আমেরিকান পুলিশ জার্মানী ভাষায় জিজ্ঞাসা করল রাশিয়ানটাকে–কি ব্যাপার। রাশিয়ানটা জার্মান ভাষা বোঝে না, শুধু কতগুলো কাগজ ওর দিকে এগিয়ে দিল। কাগজ দেখে আর কিছু না বলে এগিয়ে যায় তারা। ব্রিটিশ সৈন্যটা ওপরে না উঠে আমায় ফোন করে। কিছুক্ষণ পরই মার্টিন আমায় ফোন করে। তাকে আমি সব জানিয়ে দিই। আমি ফোন পেয়ে আন্নার ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হই। রাস্তাতেই ওদের সঙ্গে দেখা হয় আমার। ব্রিটিশ সৈনন্যর কথায় তারা হেড অফিসে যাচ্ছিল কাগজপত্র পরীক্ষা করতে। ওদের সঙ্গেই রয়েছে আন্না। রাশিয়ানটাকে জিজ্ঞাসা করি, কি হয়েছে তারপর কাগজগুলো দেখে নিয়ে বলি–আন্নার বিরুদ্ধে কোন অপরাধমূলক কাজকর্মের প্রমাণ নেই। ওর বিরুদ্ধে তদন্ত করে তারপর রিপোের্ট পাঠাব। আপাততঃ এখন ওকে ছেড়ে দাও।

.

১৩.

মার্টিন যখন ভূতের গল্প বলছিল আমি বিশ্বাস করিনি। তাছাড়া হ্যারি লাইমের মত লোক মদের ঝোঁকে ভুল দেখেছে তাও মানতে পারছি না। ভিয়েনার ম্যাপটা খুলে বসলাম, ফোন করে জুনিয়ার অফিসারকে হারবিলের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। জানা গেল পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে অন্য অঞ্চলে গেছে। এখন মনে হচ্ছে কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেই ঠিক ছিল। একটু পরে আবার ফোন পেলাম; জানা গেল হারবিল খুন হয়েছে। হারবিলের ব্যাপারে বিস্তারিত খবর জানতে বলে ফোন রেখে মার্টিনকে বললাম–সেই লোকটা যেখানে অদৃশ্য হয়েছে সে জায়গাটা মনে আছে?

-হ্যাঁ।

চলুন যেতে হবে।

–কিন্তু আন্নার কি হবে? ওকে যদি আবার হয়রান করে?

–চিন্তার কিছু নেই। ওর বাড়িতে পুলিশ পাহারা রেখেছি। চলুন যাওয়া যাক।

গাড়ি না নিয়ে সাধারণ পোশাকে ট্রামে করে চলেছি। আজকের আবহাওয়া ভাল। নির্দিষ্ট জায়গায় ট্রাম থেকে নেমে কিছুটা হাঁটার পর মার্টিন বলল কর্নেল এইখানে।

দেখিসামনে একটা পুরনোপাঁচিল,শ্যাওলা পড়া,আগাছায় ভর্তি।এগিয়ে গিয়ে পাঁচিলটা দেখতে চমকে উঠলাম, পাঁচিলের গায়ে একটা দরজা। কি মনেহতে দরজায় টান মারলাম।দরজাটা যে খুলে যাবে ভাবিনি। ভিতরে তাকিয়ে দেখি সিঁড়ি নেমে গেছে। মার্টিন বলে–এসব ঘটবে কে জানত!

-সত্যি কারুর জানার কথা নয়, এখানে দরজার কথা কেউ ভাববেই না।

–আমার মনে হয় নোকটাকে ঠিক দেখেছি।

এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে।

কর্নেল, এই সিঁড়িগুলো কোথায় গেছে?

যতদূর মনে হয় যুদ্ধের সময় তৈরী হয়েছিল।

যুদ্ধের সময়?

–হ্যাঁ।

 –সে তো অনেক দিনের ব্যাপার। তা কোথায় গিয়ে মিলেছে এগুলো?

-সুড়ঙ্গের সঙ্গে। ভিয়েনার নীচে এই সুড়ঙ্গগুলো একটার সঙ্গে একটা যুক্ত, শহরের প্রধান ড্রেনের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। এরকম দরজা সারা ভিয়েনাতেই আছে। আসলে এগুলো তৈরী হয়েছিল বোম্বিং-এর হাত থেকে রেহাই পেতে। এইগুলোকে পাহারা দেবার জন্য অস্ট্রিয়ানদের  বিশেষ পুলিশ বাহিনী আছে। এর যে কোন একটা দরজা দিয়ে ঢুকে ভিয়েনার যে কোন অঞ্চলে ওঠা যায়।

মার্টিন অবাক–বলেন কি?

–এই হচ্ছে সেই রাস্তা যেখান দিয়ে আপনাদের বন্ধু হ্যারি হাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

–হ্যারি? মার্টিন চমকে ওঠে।

–হ্যাঁ।

–কি করে হবে! ওকে তো কবর দেওয়া হয়েছে।

–আমি ঠিকই বলছি, সমস্ত প্রমাণ তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

–কিন্তু…

 কিন্তু কি?

–একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। ওরা কাকে কবর দিল তাহলে?

এখনও জানি না। তবে একটা কাজ করতে বলে এসেছি।

–কোন কাজ? অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে।

–না না আপত্তির কিছু নেই। কবরটা তুলে ফেলার নির্দেশ দিয়েছি।

কবরটা?

হ্যাঁ।

–কিন্তু কবরটা যদি সরিয়ে ফেলে?

এখনও ফেলেনি। সে খবর আমার কাছে আছে। আর এতক্ষণে হয়ত তোলাও হয়ে গেছে। আর একটা কথা শুধু হেরচকই খুন হয়নি আরও একজন খুন হয়েছে।

–আরও একজন?

–হ্যাঁ।

–কে?

 –এখন বলতে পারছি না।

বলতে পারছেন না, না বলবেন না?

–জানি না, জানলে বলতাম। আর বাজী ধরে বলতে পারি–হ্যারি এই সুড়ঙ্গের কোথাও লুকিয়ে আছে।

–হ্যারি এর মধ্যে রয়েছে।

–আমার তো তাই মনে হচ্ছে। হ্যারির মৃত্যু, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সব সাজান ছিল।

মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না।

–খুব স্বাভাবিক।

দুর্ঘটনার পর হেরচক তো হ্যারির মুখ দেখেছিল, বলেছিল সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে। সত্যি ব্যাপারটার মধ্যে এত রহস্য আছে কে জানত! একবার হ্যারির সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হত।

–তা ঠিক।

তবে ওকে পাচ্ছি কোথায়?

পাওয়া যাবে হয়ত। আপনি একমাত্র লোক যার সঙ্গে হ্যারি কথা বলতে আপত্তি করবেনা, যদিও এটা আপনার পক্ষে বিপজ্জনক।

বিপজ্জনক কেন বলছেন? হ্যারিতো আমার বন্ধু।

–কিন্তু আপনি ওর সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে ফেলেছেন।

–তা অবশ্য ঠিক। তবু ও আমার ক্ষতি করবে না।

না করলেই ভাল।

করবে না আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

–আপনার বিশ্বাস অটুট থাক।

–আমি এক পলক ওকে দেখেছিলাম, তাই ভাবছি সত্যি ও কিনা। বলুন কি ভাবে এগোব?

আমার মনে হয় ও এ অঞ্চল ছেড়ে কোথাও যাবে না।

–কেন বলুন তো?

–গেলে অসুবিধে হবে।

–কি ধরনের অসুবিধে? নিরাপত্তার অভাব?

 –তা হতে পারে; হ্যাঁ যা বলছিলাম। আপনি হ্যারিকে সুড়ঙ্গের বাইরে আনতে পারেন।

 –আমি বললে ও কথা রাখবে?

–তা ঠিক। রাখলেও রাখতে পারে। যদি এখনও বন্ধু হিসেবে মনে করে।

করবেনা। সেই ছেটোবেলার বন্ধু আমরা,তবেতার আগেকার্টসের সঙ্গে একবার দেখাকরব।

 কার্টসের সঙ্গে?

–হ্যাঁ।

তবে এ ব্যাপারে আপনাকে সাবধান করতে চাই।

–কেন বলুন তো।

–আমার অঞ্চল থেকে গেলে আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিতে পারব না, আর হ্যারিও চাইবে না যে আপনি আমার অঞ্চল ছেড়ে রাশিয়ান অঞ্চলে যান।

মার্টিন থমকে গেলেও তারপর দৃঢ় স্বরে বলে–আমি পুরো ব্যাপারটা ভাল ভাবে বুঝে নিতে চাই তাই কার্টসের সঙ্গে দেখা করা দরকার।

.

১৪.

রবিবারের দুপুরবেলা মেঘলা আকাশ,বরফও পড়ছেনা। রাস্তায় লোক প্রায় নেই বললেই চলে। মার্টিন চলেছে কার্টসের বাড়ির দিকে। রাস্তার একজায়গায় বোর্ডে লেখা রাশিয়ান অঞ্চল।

কার্টসের বাড়ি পৌঁছে বেল বাজায় মার্টিন।ইচ্ছা করেই আগে জানান দিয়ে আসেনি সে।দরজা খুলে মার্টিনকে দেখে অবাক। বলে–আপনি?

মার্টিনের মনে হয় সে হয়ত কারও জন্য অপেক্ষা করছিল। মার্টিন এবার লক্ষ্য করে কার্টসের মাথায় পরচুলা নেই।

কার্টস অসন্তুষ্ট ভাবে বলে ওঠে–এখানে আসার আগে ফোন করে আসা উচিত ছিল।

মার্টিন–তার জন্য ক্ষমা চাইছি।

–আমি তো একটু পরেই বেরিয়ে যেতাম।

একটু পরে বেরতেন এখন তো নয়। আমি কি এবার ভিতরে আসতে পারি?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আহ্বান জানায়-আসুন।

ঘরে ঢুকে দেখে ভোলা আলমারি থেকে কার্টসের ওভারকোট, বর্ষাতি, কয়েকটা টুপী আর পরচুলা উঁকি মারছে।

পরিহাস করে বলে মার্টিন–তাহলে আপনার মাথায় চুল উঠেছে?

কার্টসের মুখের চেহারা সামনের ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে দেখে মার্টিন। এবার মুখোমুখি হতে বলে কার্টস মাঝে মাঝে চুলটা খুলে রাখি, আর ওটা পরলে মাথা বেশ গরম থাকে।

কার মাথা? দুর্ঘটনার সময় পরচুলা পরে থাকলে সহজে অন্যের চোখকে ফাঁকি দেওয়া। সম্ভব না।

কার্টস কোন জবাব দেয় না।

মার্টিন বলে–যা সে কথা, আমি হ্যারির সঙ্গে দেখা করতে চাই।

–হ্যারি! চমকে ওঠে কার্টস।

–হ্যাঁ। ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলব।

কথা

?–হ্যাঁ।

–ওর সঙ্গে?

হু।

–পাগল হয়ে গেছেন নাকি?

–কে? আমি?

তাই তো মনে হচ্ছে।

–আমার একটু তাড়া আছে, তাই আপনার কথার কোন জবাব দিলাম না।

–শুনে খুশী হলাম।

 –এবার আমায় খুশী করুন।

–খুশী করব আপনাকে?

–হ্যাঁ।

–কিভাবে?

দয়া করে এই পাগলের কথা শুনুন তাহলেই হবে।

বলুন কি বলবেন?

যদি হ্যারি বা হ্যারির প্রেতাত্মার সঙ্গে আপনার দেখা হয় তাহলে আমার কথাটা জানিয়ে দেবেন। আমি দুঘন্টা প্রাটারের ভাঙা গীর্জার কাছে যে বটগাছটা আছে ওখানে থাকব।

এখন আসি। ও হ্যাঁ মনে রাখবেন আমি হ্যারির বিশ্বস্ত বন্ধু।

এমন সময় ভেতরের ঘর থেকে কিসের যেন একটা আওয়াজ আসে। মার্টিন শব্দটা অনুসরণ করে দরজার কাছে এসে দরজাটা খুলে ফেলে। দেখে রান্নাঘরের মধ্যে একটা চেয়ারে ডাঃউইস্কলোর বসে আছে। মার্টিন অবাক, কাছে গিয়ে বলে আপনি এখানে? কি ব্যাপার?

ডাক্তার ইতস্ততঃ করে–মানে…।

মানে কি? মার্টিন কোন কথা না বলে কার্টসের কাছে এসে বলে ডাক্তারকে আমার পাগলামোর কথা বলবেন যদি ওষুধ দিতে পারেন। হ্যাঁ, আবার বলছি ঐটারের গীর্জার কাছে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য থাকব।

প্রাটারের গীর্জার সেই বটগাছটার কাছে মার্টিন ঘণ্টা খানেক হল এসেছে। হ্যারির কোন দেখা নেই। আদৌ সে কি আসবে?

চারদিকে তাকায় মার্টিন। পাহাড়ী এলাকা সামনে ছোটনদী।হাওয়াটা বেশ ঠাণ্ডা। হঠাৎ চমকে ওঠে সে। তার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দটা তার কানে বিধছে। হ্যারির সেই পরিচিত গানের সুর। চারদিকে দেখে কোথাও কেউ নেই। কিন্তু সে তো ভুল শোনেনি। তাহলে নিশ্চয়ই কাছেই হ্যারি আছে। সহসা পিছন থেকে কে ডেকে ওঠে-রোলো মার্টিন। চমকে পিছন ফিরে দেখে হ্যারি। হ্যারি হেসে বলে হ্যালো মার্টিন, কেমন আছ?

মার্টিন উত্তেজিত–হ্যারি তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।

নিশ্চয়ই তা তো থাকবেই। তোমাকে যখন আসতে লিখেছি, সত্যি মার্টিন এতদিন পর তোমায় দেখে কি যে ভাল লাগছে।

-কেন? আমি তো তোমার অন্ত্যেষ্টির সময় উপস্থিত ছিলাম।

 হ্যারি হেসে বলে-লোককে কেমন ফাঁকি দিয়েছি বল!

–তোমার প্রেমিকাকে ফাঁকি দিয়ে কিন্তু মোটেই ভাল করনি।

তুমি আন্নার কথা বলছ?

–হ্যাঁ। ও ভীষণ কাঁদছিল।

–সত্যি মেয়েটা ভাল। আমি ভালবাসি ওকে।

–তোমার সম্বন্ধে পুলিশ যা বলছে আমি বিশ্বাস করিনি। আচ্ছা কি ব্যাপার বলতো?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে হ্যারি–তোমাকে কোনদিন কিছু লুকোইনি, আজও সব খুলেই বলব।

– হ্যারির মনে তোলপাড় চলছে। চুপ করে থাকে। মার্টিন নীরবতা ভঙ্গ করে বলে–শিশু হাসপাতালটাকে দেখেছ? দেখলেই বুঝবে কি অবস্থা হয়েছে?

–জানি। একবার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখ।

–কেন? কি আছে?

–দেখই না।

নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে লোক যাতায়াত করছে, ওপর থেকে বিন্দুর মত দেখাচ্ছে।

হ্যারিলে নিচের ঐবিন্দুগুলো যদিদুচারটে থেমে যায় তাহলে সমাজের কি খুবক্ষতি হবে?

-তুমি কি বলছ? তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?

না বন্ধু। একটা বিন্দু থেমে গেলে তোমার পকেটে যদি কুড়ি হাজার পাউন্ড আসে তাহলে কেমন হয়?

–তুমি টায়ারের ব্যবসায় থাকলে না কেন?

–ওতে লাভ কম হয়।

–তাতে তো মনে শান্তি পেতে।

–শান্তি।

–হ্যাঁ।

কুলারের মতন। না না এত ছোট কাজে আমি নেই। তুমি দেখ পুলিশ আমায় ধরতে পারবে না। আমি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াব।

–কিন্তু সেটা কি বাঁচা?

মার্টিন দুঃখ পায় ভাবে হ্যারি আজ কোথায় নেমে গেছে। তার মনে হয় তাকে যদি এখান থেকে ধাক্কা দেয় তাহলেই সব শেষ। হ্যারির বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকবে না।

আবার বলে মার্টিন–তুমি জান পুলিশ তোমার কবর খুঁড়েছে?

–শুনেছি।

–তবু তুমি নির্বিকার। একটা কথার জবাব দেবে?

–কি?

বল দেবে কি না?

–দেবার হলে নিশ্চয়ই দেব।

–ঐ কবরে কার মৃতদেহ?

হারবিল।

–হারবিল?

হ্যাঁ।

মার্টিন স্তব্ধ। তার মাথায় যেন কিছুই আসছেনা। মানুষ কত কি করতে পারে। দুনিয়ায় টাকাই সব, আর বিবেক?

মার্টিন রেগে গিয়ে বলে-তোমায় কি করতে ইচ্ছা করছে জান?

-কি?

–বলব? এই পাহাড়ের ওপর থেকে ঠেলে নিচে ফেলে দিতে।

না তুমি পারবে না। কারণ এর আগে আমার বহু অপরাধ ক্ষমা করেছ। তোমাকে আমি বিশ্বাস করি তাই তোমার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারিনি। (একটু থেমে) এখানে আসতে কার্টস মানা করেছিল। আসলে তোমায় যে ভালবাসি।–

-ভালবাস?

–হ্যাঁ।

কার্টস কি বলেছে জান? তোমায় মেরে ফেলতে।

–মেরে ফেলতে?

–-হ্যাঁ।

 –কিন্তু হ্যারি গায়ের জোরে তুমি তো আমার সঙ্গে পারবে না।

সব সময় কি গায়ের জোর দরকার হয়?

–তা অবশ্য ঠিক।

তাছাড়া আমার রিভলবার আছে।

–তা তো থাকবেই।

–থাকবেই কেন বলছ?

নইলে তোমায় মানাবে কি করে?

বুঝলাম না কথাটা।

 খুব সোজা।

–সোজাটাই শুনি।

–একদিন যে হাতে ছুরি কাঁচি ধরতে শিখেছিলে আজ সে হাতে পিস্তল, সত্যি ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস।

–ও সব তত্ত্ব কথা ছাড়।

–তা নয়ত কি?

–চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।

রাখ তোমার ধর্মের কাহিনী।

–তা তো বলবেই।

–জান তুমি নিচে পড়ে গেলে তোমার চিহ্ন কেউ খুঁজে পাবে না। ও সব ডাক্তারী কথা তুমি জানবেই বা কি করে।

এবার হ্যারি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে কি বোকার মত আমরা করছি। বাদ দাও। চলো মার্টিন ফেরা যাক।

–ফিরবে?

হ্যাঁ।

–কোথায়?

আগে তুমি বল কার্টস আর ডাক্তারের পিছনে পুলিশ লাগিয়ে দেবে না।

–সেটা পরের কথা।

–জান কার্টস তোমায় মেরে ফেলতে বলেনি। আমি একটু ঠাট্টা করছিলাম।

ঠাট্টা।

–হ্যাঁ, বিশ্বাস কর। বানিয়ে বলছিনা। বলেই হ্যারি যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। মার্টিন চিৎকার করে হ্যারি!

পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ডাক ফিরে আসে; হ্যারি! হ্যারি! হ্যারি!

.

১৫.

রবিবার সন্ধ্যায় যোশেফস্টড থিয়েটারে আন্নার অভিনয় ছিল। মার্টিন তার সঙ্গে দেখা করবে বলে থিয়েটার শেষ হতে তার ঘরে গেল।

আন্না প্রশ্ন করে কি খবর?

শুনলে তুমি চমকে উঠবে।

–তাই বুঝি?

–হ্যাঁ।

–তা খবরটা কি?

–আগে বল কথাটা বিশ্বাস করবে?

বিশ্বাস না করার কি আছে?

–হ্যারি…।

–কি, বল, থামলে কেন?

–হ্যারি বেঁচে আছে।

–হ্যারি বেঁচে আছে?

–হ্যাঁ।

না না, মিথ্যে কথা।

মিথ্যে?

–হ্যাঁ।

–আন্না বিশ্বাস কর। মিথ্যে বলে আমার লাভ!

 –তুমিই জান।

–আর কিছু বলার নেই তাহলে।

আন্নাচুপ, মার্টিন ভেবেছিল আন্না কথাটা শুনলে খুশী হবে।তবেসত্মিকথা হ্যারির কোন ব্যাপারে আর আন্না খুশী হোক সে চায় না। আন্নার দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। আস্তে আস্তে সমস্ত কথা সে আন্নাকে বলে। মার্টিনের মনে হয় সে যেন মন দিয়ে শুনছে না।

মার্টিনের কথা শেষ হলে, চোখ মুছে আন্না বলে–এর চেয়ে হ্যারি মারা গেলেই ভাল ছিল।

ঠিকই বলেছ। ও আমাদের ভালবাসার কোন দামই দিল না। সত্যি লজ্জার কথা।

–ও মারা গেলে অনেক বিপদের হাত থেকে বাঁচত।

সেই হতভাগ্য বাচ্চাগুলোর ছবি আন্নার টেবিলে রাখল। আন্না সেগুলো দেখার পর। বলল–হ্যারিকে এ অঞ্চলে আনতে না পারলে পুলিশ ওকে ধরতে পারবে না।

হু।

–তোমার সাহায্য দরকার।

–আমার সাহায্য।

–হ্যাঁ।

–আমার ধারণা ছিল তুমি তার প্রকৃত বন্ধু।

বন্ধু ছিলাম।

–ছিলে?

 হ্যাঁ। এখন নেই।

—তাহলে তো ধরিয়ে দিতে চাইবেই।

–হ্যাঁ চাইছি। সে তোমার ভালবাসার কোন মূল্য দিয়েছে? তোমায় ঠকিয়েছে, তোমায় নিঃস্ব করেছে।

–তবু হ্যারিকে ধরতে তোমায় সাহায্য করব না।

করবেনা?

না, তবে…।

 –তবে কি?

 –আমি আর ওকে দেখতেও চাই না। গলার স্বরও শুনতে চাইনা।

–সত্যি তুমি একজন অভিনেত্রী।

হঠাৎ এ কথা? বলতে বাধ্য হচ্ছি।

 –কিসের জন্য?

সার্থক তোমার অভিনয়। এখনো হ্যারির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ।

–আমি অভিনয় করছি?

–তা নাতো কি?

কথাটা বুঝিয়ে বলবে?

 জলের মত পরিষ্কার।

–তবু শুনতে চাই।

–হ্যারির সঙ্গে দেখা করবেনা, গলার আওয়াজও শুনবেনা তবুও তাকে ধরিয়ে দিতে তোমার বাঁধছে। সত্যি তোমাদের নমস্কার। সার্থক সৃষ্টি ভগবানের। তোমাদের কোনটা হা, কোনটা না, আজও বোঝা গেল না। হাসতেও যেমন সময় লাগে না, কাঁদতেও তাই।

তুমি আমাকে যতই আঘাত দিয়ে কথা বল আমি ও কাজ করব না।

বাঃ চমৎকার।

–এটাও জেনে রাখ এমন কোন কাজ করব না যাতে হ্যারির কোন ক্ষতি হয়।

–সুন্দর! সুন্দর! হাততালি পাবার মত সংলাপ। তুমি কি এখনও হ্যারিকে চাও।

 –তাকে চাই না ঠিকই কিন্তু…।

–কিন্তু কি?

–আমার রক্তের সঙ্গে ও মিশে একাকার হয়ে গেছে, আমার কাছে হারিই এখনও স্বপ্নের পুরুষ, অন্য কেউ নয়।

মার্টিন আর অপমানিত হতে চায় না, তাই কোন কথা না বলে বেরিয়ে আসে।

কর্নেলের কাছে এসে বলে–আমায় কি করতে হবে বলুন?

এবার শেষ দৃশ্যের অভিনয় হবে।

এত তাড়াতাড়ি সম্ভব?

 –চেষ্টার তো ত্রুটি করিনি।

 –ও হ্যাঁ। কফিন থেকে মৃতদেহ তোলা হয়েছে?

–হ্যাঁ।

কার?

 হারবিলের।

—তাহলে হ্যারি ঠিকই বলেছে।

–আমরা এবার কুলার ও ডাক্তারকে গ্রেফতার করতে পারি।

–তাহলে ভাল হয়।

–তবে কার্টস ও ড্রাইভার হাতের বাইরে।

–কেন?

রাশিয়ানদের অনুমতি লাগবে।

–একটা কাজ করতে পারবেন?

—কি?

–আপনি কুলারকে সাবধান করে আসুন।

–আমি?

–হ্যাঁ।

–তাতে কি ভাল হবে?

হবে।

–যদি বিপরীত ফল হয়?

–মানে? কুলারের সন্দেহ হবে? পালিয়ে যাবে তাই?

–হ্যাঁ।

–আমি চাই কুলার পালিয়ে যাক। তাতে বড় শিকারটা জালে পড়বে।

–কেন?

–আপনার উপর হ্যারির বিশ্বাস জন্মাবে ঘণ্টা তিনেক পর হ্যারিকে খবর পাঠাবেন। পুলিশ আপনাকে খুঁজছে এ সময় লুকিয়ে থাকাই ভাল নইলে বিপদ ঘটবে। কি? এ প্রস্তাবে রাজী?

সেই অসুস্থ বিকৃত বাচ্চাগুলোর ছবির দিকে তাকিয়ে বলিরাজী।

ধন্যবাদ।

 –আমি খুনীর সঙ্গে কখনও আঁতাত করব না।

–এই তো চাই, সাবাস!

.

১৬.

পরিকল্পনা মত সবই ঠিকঠাক চলছে। কুলারকে সাবধান করার জন্য ডাক্তারের গ্রেফতারী পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মার্টিন আবার কুলারের সঙ্গে দেখা করে। কুলার মার্টিনকে খুশী হয়েই স্বাগত জানায়। বলে কর্নেলের সঙ্গে নিশ্চয়ই ঝামেলা চুকে গেছে। মার্টিন জানায় একটু তো গণ্ডগোল হয়েছে। এ কথায় কুলার চমকে ওঠে। দমে না গিয়ে বলে–হেরচকের ব্যাপারে কর্নেলকে জানিয়েছি বলে কিছু মনে করেননি তো?

 –এতে মনে করার কি আছে?

শুনে খুশী হলাম, আর আপনি তো নির্দোষ।

 –কি করে জানলেন?

-জানি।

–জেনে থাকলে ভাল।

–সুতরাং ভয়ের কারণ নেই আপনার, আর একজন নাগরিক হিসেবে কর্নেলকে সব জানান কর্তব্য।

–আপনি যেমন হ্যারির সময় পুলিশের কাছেমিথ্যে বলে ভদ্রনাগরিকের পরিচয় দিয়েছিলেন!

–সত্যি। কর্নেলের ব্যাপারে আপনি খুব রেগে আছেন।

-পুলিশ সেই কবরটা খুঁড়ে ফেলেছে জানেন তো। আর ডাক্তার ও আপনাকে তাড়াতাড়ি গ্রেফতার করবে।

–গ্রেফতার? ঠিক বুঝলাম না।

–ঠিকই বুঝেছেন। মার্টিন আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।

আমাদের প্রাথমিক কাজ শেষ এবার শুধু জাল পাতা বাকি। ভিয়েনার ম্যাপ দেখে মনে হল হ্যারির বের হবার এটাই ভাল রাস্তা। এই দরজার পঞ্চাশ গজ দূরে একটা রেস্তোরাঁ। আর কোন দরজার কাছে এসব নেই। সুতরাং হ্যারি বন্ধুকে বাঁচাবার জন্য অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে পঞ্চাশ গজ রাস্তা পার হয়ে ক্লাব থেকে বন্ধুকে নিয়ে আবার ঐ পথেই চলে যাবে।হ্যারিরকাছে এই কায়দাটা নতুন কিন্তু আমাদের নয়। সুড়ঙ্গ পাহারা দেবার জন্য একটা দল রাত বারটায় যায় আর রাত দুটোয়– আর এক দল আসে, হ্যারি এই সময়টাকেই বাছবে বন্ধুকে নিয়ে যাবার জন্য।

সেই অনুযায়ী মার্টিন ঐ রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করছে। মার্টিনকে একটা রিভলবার দিয়েছি আত্মরক্ষার জন্য। সেই নির্দিষ্ট দরজার অদূরে সাদা পোষাকে পুলিশ লুকিয়ে আছে। সুড়ঙ্গ পাহারা দেবার একটা বিরাট দল আমার নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। আমি সংকেত দিলেই সব ম্যানহোল বন্ধ করে দেবে। আর শহরের প্রান্ত ভাগ থেকে টহল দিতে দিতে এদিকে আসবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল হ্যারি সুড়ঙ্গে ঢোকার আগে ধরা পড়ুক। এতে মার্টিনেরও বিপদ কম হবে, ঝামেলাও কম হবে।

রেস্তোরাঁতে এখন অনেক নোক। বাইরে ভালই ঠাণ্ডা চলছে। মার্টিন যেখানটা বসে আছে সেখানটাও খোলা মেলা। তাই কফি খেয়ে শরীর গরম করছে।

মার্টিনের কিছু দূরে আমার একটা লোক বসিয়ে রেখেছি আর পাছে কারুর সন্দেহ হয় তাই এক লোককে বেশীক্ষণ রাখছি না। আমি কিছুটা দূরে ফোন নিয়ে বসে আছি। একঘন্টার ওপর হয়ে গেল হ্যারির দেখা নেই। হঠাৎ ফোন বেজে উঠতে ব্যস্তভাবে রিসিভার তুললাম, মার্টিন এর ফোন–আমি ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি কর্নেল।

–হ্যাঁ, খুব ঠাণ্ডা।

 –প্রায় শোওয়া একটা বাজে।

–সত্যি অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে।

–আর কি অপেক্ষা করব?

–হ্যাঁ অবশ্যই।

 –হু।

–আপনাকে আমার টেলিফোন করা উচিত হয়নি। যেমন চুপচাপ বসে আছেন বসে থাকুন।

অনেক কাপ কফি খেয়ে ফেলেছি।

আরও খান।

শরীর খারাপ করছে।

–দেখুন মিঃ মার্টিন হ্যারি যদি আসে তবে আর বোধহয় দেরী করবে না।

 –আর এসেছে!

 –অন্ততঃ আর মিনিট পনের কুড়ি অপেক্ষা করুন।

–ঠিক আছে।

 —-আর ভুলেও আমায় ফোন করবেন না।

–হায় ভগবান! ঐ তো হ্যারি, সঙ্গে সঙ্গে মার্টিনের ফোন বন্ধ। আমি ফোন নামিয়ে রেখে নির্দেশ দিই ম্যানহোলগুলো বন্ধ করতে। টহলদারী পুলিশকে বলি এবার আমরা নীচে নামব।

এদিকে হ্যারি মার্টিনকে ফোনে কথা বলতে দেখে সাবধান হয়ে পড়েছিল। তাই মার্টিন রিসিভার নামিয়ে রাখার আগেই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসে। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই সময় আমারও কোন লোক সেখানে ছিল না। আসলে একজন উঠে গিয়ে আর একজন যে যাচ্ছিল তার পাশ দিয়েই হ্যারি বেরিয়ে গেল। মার্টিন বাইরে বেরিয়ে আমার লোককে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু যখন চিৎকার করে বলল ঐ তো হ্যারি, ততক্ষণে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে গেছে সে।

আমরাও সুড়ঙ্গে নেমে এসেছি হাতে টর্চ। চারদিক দিয়ে জল পড়ার আওয়াজ আসছে। সব সুড়ঙ্গগুলো কোমর পর্যন্ত জলে ভর্তি। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। সুড়ঙ্গের আসল রাস্তাটা টেমসের প্রায় অর্ধেক। জলে স্রোত রয়েছে বলে পা ফেলতে অসুবিধে হচ্ছে। বাঁকের মুখে কাদা জমে আছে। পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে হ্যারি কোন দিকে গেছে। আমার প্রহরীর এক হাতে টর্চ এক হাতে রিভলবার। মার্টিনকে চাপা গলায় সে বলল–আপনি আমার পিছনে আসুন।

-পিছনে গেলে অসুবিধে হবে না?

না।

–ওকে আপনি চিনতে পারবেন?

–হ্যাঁ। পিছনে যেতে বলছি কেন না ও আপনাকে গুলি করতে পারে।

–তাহলে আপনিই বা সামনে থাকবেন কেন?

 –এটা আমার চাকরীর অঙ্গ।

প্রত্যেকটা ম্যানহোলে পাহারা রয়েছে, সমস্ত সুড়ঙ্গটা আমরা ঘিরে ফেলেছি। ছোট ছোট গলি পথ ধরে আসল পথটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

প্রহরীটা বাঁশী বাজালে পাশ থেকে অনেকগুলো বাঁশীর আওয়াজ ভেসে আসল। প্রহরী বলল–আমার টহলদারী বন্ধুরা সবাই এখানে এসে গেছে, এই জায়গাটা সবার নখদর্পণে। সামনের। দিকে কি আছে দেখার জন্য টর্চ তুলতেই গুলি ছুটে এল। প্রহরীটা যন্ত্রণায় কাতরে উঠল, হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বললাম–কোথায় লেগেছে?

– তেমন কিছু না। হাতটা বোধহয় ছড়ে গেছে। আমার সঙ্গে আর একটা টর্চ আছে, এটা ধরুন। ততক্ষণে ক্ষতস্থানটা বেঁধেনি। কিন্তু স্যার টর্চটা জ্বালাবেন না। ও বোধহয় কাছের কোন গলিতে লুকিয়ে আছে। গুলির প্রতিশব্দ মিলিয়ে যেতে বাঁশীর আওয়াজ শোনা গেল। প্রহরীটিও বাঁশী বাজিয়ে উত্তর দিল। মার্টিন এবার প্রহরীটিকে জিজ্ঞাসা করে–আপনার নামটা এখনও জানা হয়নি।

-বেটস্। আজ এখানে আমার আসার কথা নয়। শুধু স্পেশাল ডিউটি বলেই এসেছি।

আমি এবার সামনে থাকব। হ্যারি আমায় গুলি করবে বলে মনে হয় না। আর হ্যারির সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।

–কিন্তু স্যার, আমি দুঃখিত।

–কেন?

আপনার যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেই নির্দেশই আছে।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে। মার্টিন বেটসকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যায়। চিৎকার করে ডাকে–হ্যারি। হ্যারি।

কথাটা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আবার বলে–হ্যারি লুকিয়ে থেকে লাভ নেই। তুমি বেরিয়ে এস। হঠাৎ কাছ থেকে হ্যারির গলার আওয়াজে সবাই চমকে যায়। হ্যারি বলেবন্ধু, তুমি আমায় ক করতে বলছ?

মাথার ওপর হাত তুলে বেরিয়ে এস হ্যারি।

আমার সাথে টর্চ নেই। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

 পিছন থেকে বেটস বলল-স্যার সাবধান।

মার্টিন বলে–আপনারা দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ান। ও আমায় কখনও গুলি করবে না।

আবার হ্যারিকে বলে–হ্যারি টর্চ জ্বালছি, বেরিয়ে এস। আর কোন উপায় নেই, ধরা তোমায় দিতেই হবে।

টর্চ জ্বললে কুড়ি গজ দূর থেকে হ্যারি বেরিয়ে এল। মার্টিন বলল–মাথার ওপর হাত রাখ। হ্যারি হাত তোলার ভান করে গুলি চালায়। গুলি মার্টিনের গায়ে না লেগে সুড়ঙ্গের দেওয়ালে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে বেটস চিৎকার করে সার্চ লাইট জ্বালতে বলে। আলো জ্বললে দেখা যায় সবাইকে। বেটস জলে উপুড় হয়ে আছে যন্ত্রণায় কাতর। মার্টিন থর থর করে কাঁপছে। হ্যারি কিছুটা দূরে। মার্টিনের গুলি লাগার ভয়ে আমরা হ্যারিকেও গুলি করতে পারছি না। আমরা আস্তে আস্তে এগোতে থাকি। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় হ্যারি কোন উপায় না দেখে বড় সুড়ঙ্গের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সার্চ লাইট ঘোরাবার আগেই ডুব দিয়েছিল তার ওপর স্রোত থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল। মার্টিন সার্চ লাইটের আলো যতদূর যায় তার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে হাতে রিভলবার। হঠাৎ আমার মনে হল সামনে কি যেন নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললাম-মিঃ মার্টিন আপনার বাঁ দিকে গুলি করুন। মার্টিন তৎক্ষণাৎ গুলি চালাল। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রনার শব্দ ভেসে উঠল। সামনে এগোতে গিয়ে দেখি রেটসের প্রাণহীন দেহ। মার্টিনের ছোঁড়া গুলি তার গায়ে লেগেছে। সামনে তাকিয়ে দেখি মার্টিন নেই।নাম ধরে ডাকতে থাকি কিন্তু জলের শব্দে কিছুই যেন শোনা যায় না। পরক্ষণেই একটা গুলির আওয়াজ পেলাম। মার্টিন অন্ধকারে খানিকটা এগিয়ে গেছিল, টর্চ ইচ্ছা করে জ্বালেনি। হ্যারি মার্টিনের গুলিতে আহত হয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে থাকে। ত্রিশ ফুট উঁচু ম্যানহোল-এর মুখ থেকে সিঁড়িটা নেমে এসেছে। হ্যারি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করলেও ওপরে উঠতে পারল না। আর তখনই যেন সেই পরিচিত সুরটা শিস দিয়ে ডাকছিল। শিসের শব্দে এগিয়ে গিয়ে ডাকল মার্টিন হ্যারিকে। ঠিক তখনই আবার শিস থেমে গেল। আর কিছুদূর এগিয়ে যেতে মার্টিনের পায়ে কিছু ঠেকল। আলো জ্বললে দেখি হ্যারি পড়ে আছে হাতে বন্দুক নেই। মনে হল মারা গেছে কিন্তু যন্ত্রণায় কাতরানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। মার্টিন কানের কাছে মুখ এনে ডাকে–হ্যারি! হ্যারি!

হ্যারি চোখ তুলে কিছু বলার চেষ্টা করল। আমি মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে স্পষ্ট শুনি বলছে–বোকা কোথাকার! মার্টিন বলে–আমি আজও বুঝতে পারিনি হ্যারি কেন ওকথা বলেছিল। আজ আমার মনে পড়ছে, যে আমি জীবনে একটা খরগোস মারিনি সেই আমি প্রাণের বন্ধুকে মেরে ফেললাম, সত্যি ভগবানের কী খেলা! আমি মার্টিনকে সান্ত্বনা দিই–মিঃ মার্টিন এখন আমাদের এসব ভুলতে হবে। মার্টিন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়-না কর্নেল আমি অন্তত পারব না।

.

১৭.

মেঘলাভাব কেটে গেছে। ইলেকট্রিক ড্রিল দিয়ে কবর খোঁড়ার দরকার আজ আর নেই, চারিদিকের আবহাওয়া জানিয়ে দিচ্ছে এখন বসন্তকাল প্রকৃতিও যেন হ্যারীর উপর প্রসন্ন।

হ্যারীর প্রিয়জনের প্রায় কেউ নেই ডাক্তার ও কার্টস প্রায় অনুপস্থিত। কেবল সেই মেয়েটি দ্রুত রাস্তায় দিকে এগিয়ে গেল। তখন একটা ট্রাম খুঁড়ো বরফ ঠেলে এগিয়ে চলেছে। আমি মার্টিনকে প্রশ্ন করি–আপনার সঙ্গে গাড়ী আছে? নাকি আমি পৌঁছে দেব?

না, ধন্যবাদ, আমি ট্রামে যাব?

আমি বলি–শেষ পর্যন্ত আপনিই জিতলেন, আর আমি হেরে গেলাম।

মার্টিন ব্যথিত কণ্ঠে বলে-না, না, কর্ণেল, আপনি একথা বলবেন না। আমি সব হারিয়ে ফেলেছি।…সব হারিয়ে ফেলেছি।

তারপর মার্টিন একটাও কথা না বলে বড়-বড় পা ফেলে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়। আমি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, ওরা পাশাপাশি হাঁটছে। মনে হয় ওরা নীরবে হেঁটে চলেছে। একটা বোবা দুঃখ তাদেরকে ঘিরে রয়েছে।

সত্যি, বলা যায় না বিপদ কখন আসবে, কার দ্বারা সে শত্রুই হোক আর কোনও প্রিয়জনই হোক।