৩. ভীম দাসের গলা

বক্তৃতার শেষদিকে ভীম দাসের গলা আবেগে কাঁপতে লাগল। সে বলল, “ভাইসব, এই কুঞ্জপুকুর, হরিহরপুর, বেলডাঙা, চরণডাঙা, সোনাডিহি, নায়েবগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় বরাবরই বাংলার সুসন্তানরা জন্মগ্রহণ করেছেন। মনে রাখবেন এখানে কালু সদারের মতো প্রাতঃস্মরণীয় ডাকাত, গোপাল গায়েনের মতো চিরস্মরণীয় চোর, কৈলাস দাসের মতো দেশবরেণ্য জাল নোট তৈরির কারিগর, দিনে ওস্তাদের মতো শ্রদ্ধেয় ছিনতাইশিল্পী এবং খুনে নবার মতো ডাকাবুকো খুনি কাজকারবার করেছেন। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এখানে নব-নব প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে। তাঁরা আজ নেই বটে, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁদের ঐতিহ্য। তবে আমরা সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারিনি। বাংলার ভাগ্যাকাশে হঠাৎ দেখা দিয়েছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। শশীবাবুর ভূতুড়ে হাত আমাদের সঙ্গে শত্রুতা শুরু করায় এই অঞ্চলের গৌরব রবি অস্তমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আর ভয় নেই ভাইসব, ওই দ্যাখো প্রভাত-উদয়। চিরকাল তো অন্যায় আর অবিচার টিকে থাকতে পারে না। আসিছে নামিয়া ন্যায়ের দণ্ড রুদ্র দীপ্ত মূর্তিমান! শশীবাবু মৃত্যুশয্যায়। তাঁর ভুতুড়ে হাতও আজ নিস্পন্দ। এবার দিনবদলের পালা। আমাদের এখন দলাদলি, ব্যক্তিগত আক্রোশ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কর্মযজ্ঞে, ঐতিহ্যকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত। কথাটার মানে আপনারা সবাই জানেন। এর মানে হল, ওঠো, জাগো, নিজের পাওনা-গণ্ডা আদায় করে নাও।”

সবাই চটপট হাততালি দিল। কেউ-কেউ কেয়াবাৎ’ বলে তারিফ করল। মিটিংটা বসেছে কালু সদারের শ্মশানকালী মন্দিরের চত্বরে, বটগাছের তলায়। সন্ধেবেলা, চারদিকে মশাল জ্বলছে। জনাপঞ্চাশেক কালো কালো চেহারার চোর-গুণ্ডা-বদমাশ-ডাকাত জড়ো হয়েছে। মিটিং থেকে একটু তফাতে একটা ঝোঁপের আড়ালে একজন বেঁটে আর একজন লম্বা লোক অলসভাবে বসে আছে। বেঁটে লোকটা বলল, “ফুঃ, এ লোকটার ঘটে বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। বুঝলি ঝিকু, একে মন্ত্রী করা যাবে না।”

ঝিকু বলল, “তোমার তো কাউকেই পছন্দ হচ্ছে না দিনুদাদা। জটেশ্বর অত ভাল বক্তৃতা দিল, তাকেও মনে ধরল না। গৌরহরি কেমন বিচক্ষণের মতো কথাবাতা কইল, তাকেও বাতিল করে দিলে। তা হলে মন্ত্রীটা করবে কাকে?”

দিনু বলল, “এরা সব চুনোপুঁটি, বুঝলি? এদের কারও সত্যিকারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। উঁচু নজরের লোক না হলে সুবিধে হবে না কিনা।”

কাছাকাছি একটা মুশকো চেহারার লোক বসে ঢুলছিল। হঠাৎ সে তড়াক করে উঠে বলল, “কে হে তুমি, খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে যাচ্ছ তখন থেকে? আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো বুকের পাটা পেলে কোথায়?”

দিনু হাতজোড় করে বলল, “মাপ করে দাও ভাই। ঠাট্টা করছিলুম।”

“ঠাট্টা! খুব রসিক লোক দেখছি। আলোতে মুখখানা একটু বাড়াও তো বাছাধন, বদনখানা একটু দেখে রাখি। তোমাকে একটু চিনে রাখা দরকার।”

মাটিতে পোঁতা একটা মশাল তুলে নোকটা ফস করে দিনুর মুখের সামনে ধরে বলল, “মুখখানা যে চেনা-চেনা ঠেকছে বাপ।”

দিনু খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আমি সামান্য মানুষ, পথেঘাটেই দেখে থাকবেন।”

“সামান্য মানুষ! তবে যে মন্ত্রী খুঁজছিলে? মন্ত্রী কাদের থাকে জানো? রাজাদের। তা তুমি কোথাকার ছদ্মবেশী রাজা, তা বড় জানতে ইচ্ছে করছে।”

দিনু অধোবদন হয়ে বলল, “আর লজ্জা দেবেন না ওস্তাদ। বছরতিনেক আগে পালঘাটে খুব মারধর খেয়েছিলুম পাবলিকের হাতে। মাথায় চোট হল, সেই থেকে কেমন খ্যাপাটে মেরে গেলুম। কেবল মনে হত, আমি হরিণগড়ের রাজা। আশ্চর্য কথা, হরিণগড় কোথায় তাও জানি না। যাই হোক, তিনটি বছর পাগলাগারদে থেকে এই হালে ছাড়া পেয়েছি।”

এদিকে যখন এসব কথাবার্তা হচ্ছে তখন মিটিংয়ে একটা স্লোগান উঠল, “শশীবাবুর সাদা হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। শশীবাবুর নোংরা হাত নিপাত যাক, নিপাত যাক।”

স্লোগানের মাঝখানেই হস্তশিল্পী গৌরহরি উঠে দাঁড়িয়ে অমায়িক মুখে বলল, “ভাইসব, আপনারা হক কথাই বলেছেন। শশীবাবুর অলক্ষুনে হাতটা ধরাধামে থাকলে আমাদের জীবনে শান্তি বলে কিছু থাকবে না। সুতরাং আমরা ঠিক করেছি, হাতটা তুলে এনে আমরা এই শ্মশানকালীর সামনে বলি দেব। তারপর টুকরো-টুকরো করে কেটে আগুনে আহুতি দিয়ে ফেলব। এই পবিত্র কাজে বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। কথায় বলে শুভস্য শীঘ্রম। আগামীকাল কুঞ্জপুকুরে ভৈরব অপেরা যাত্রাগানের আসর বসাবে। গাঁয়ের লোক ঝেটিয়ে যাবে যাত্রাগান শুনতে। সেই ফাঁকে আপনাদের সহযোগিতায় এই অধম সামান্য হস্তশিল্পী ওই হাত শশীবাবুর বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলবে। কালই এখানে হাত বলি হবে। আপনাদের সকলের উপস্থিতি প্রার্থনীয়।”

কথাটা কানে যেতেই দিনু বলল, “সর্বনাশ! হাত বলি দিলে যে সব ভেস্তে যাবে!” বলেই সে উঠতে যাচ্ছিল।

মুশকো লোকটা তাকে একটা থাবড়া মেরে বসিয়ে দিয়ে বলল, “গল্পটা বেশ কেঁদেছ বাপ। ভেবেছ পাগল সেজে আমার হাত থেকে রেহাই পাবে? অত সহজ নয়। আমার একটা দোষ হল, পুরনো কথা মনে থাকে না। যতক্ষণ তোমার ওই চাঁদবদনটি কোথায় দেখেছি তা মনে না পড়ছে, ততক্ষণ তোমাকে সরে পড়তে দিচ্ছি না। এখন বলো তো কোথায় তোমাকে দেখেছি!”

দিনু অতিশয় নরম গলায় বলল, “পাগলা গারদেই দেখে থাকবেন। সেখানে রোজ কত বড় বড় মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হত। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বোম্বাই ছবির হিরো।”

মুশকো লোকটা মশালটা দিনুর মুখের আরও কাছাকাছি এনে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, “উঁহু, অত সোজা পাত্তর তুমি নও।”

দিনু মুখটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “মুখটা যে পুড়িয়ে ফেলবেন মশাই। পোড়া মুখ লোককে দেখাব কী করে?”

মুশকো লোকটা একটু হেসে বলল, “কিন্তু তোমাকে যে চিনে ফেলেছি বাছাধন! তুমি একসময়ে শশীবাবুর বাড়ির ভৃত্য ছিলে না? চুরিটুরি করে বদনাম করেছিলে। শশীবাবু তোমাকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। ঠিক কি না?”

দিনু ভারি লজ্জিত হয়ে বলল, “আজ্ঞে, ঠিকই বলেছেন। শশীবাবুর বাড়িতেই প্রথম হাতেখড়ি। তারপর অবশ্য বিদ্যেটা আর বেশিদূর এগোয়নি। আপনাদের কাছে তো শিখতেই আসা। এখানে মেলা গুণিজন আজ আসবেন জেনে চলে এসেছি। ভাল ওস্তাদ পেলে নাড়া বেঁধে ফেলব।”

লোকটা হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে সবাইকে বলল, “ওরে, এখানে এক মস্ত মানুষ এসেছে আজ। এর পানে একটু তাকা।”

সবাই তার দিকে তাকাতেই দিনু হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে আমি তুচ্ছ মানুষ। আপনারা ব্যস্ত হবেন না।”

মুশকো লোকটা বলল, “এ শশীবাবুর ভৃত্য ছিল। এতক্ষণ বসে বসে কাকে মন্ত্রী করবে, কাকে সেনাপতি করবে, এইসব নিয়ে কথা বলছিল। ধরা পড়ে পাগল সাজছে।”

কে একজন বলে উঠল, “ব্যাটা শয়তান! গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে।”

ভীম দাস বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, “নিয়ে আয় তো ধরে। মা বহুকাল মানুষের রক্ত পায়নি। আজ ওটাকে উচ্ছুরু করে নরবলি দিয়ে দিই।”

রে-রে করে গোটাদশেক লোক ধেয়ে এল তার দিকে। দিনু অবশ্য উত্তেজিত হল না। হাসি-হাসি মুখ করে বসে রইল।

ঝিকু বলল, “পালাও দিনুদা।”

দিনু বলল, “দাঁড়া না। কেরানিটা দেখি একটু।”

অত লোক এসে যখন হামলে পড়ল দিনুর ওপর, তখনই দিনুর এলেম বোঝা গেল। ওই হাত-পা-শরীরের ভিড়ে বেঁটে দিনু যেন তালগোল পাকিয়ে একখানা বলের মতো একটা ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে গেল শুধু। যখন উঠে দাঁড়াল, তখনও হাতচারেক দূরে সবাই মিলে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। একটু হাসল দিনু, তবে আর দাঁড়াল না। একটু জোর পায়ে হাঁটা দিল।

রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ঘরেজমশাইয়ের জানলায় একটু ঠুকঠুক শব্দ হল। নন্দ কবিরাজ জেগেই ছিলেন। এসে জানলা খুলে দিয়ে বললেন, “আমার নাতি কেমন আছে, সত্যি কথা বলো।”

“আজ্ঞে, আমরা সত্যি কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করে না। সেই দুঃখে সত্যি কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। তবু আজ আপনাকে একটা সত্যি কথাই বলার চেষ্টা করছি, আপনিও বিশ্বাস করার চেষ্টা করুন। আপনার নাতি ভালই আছে। খুব ভাল। এমন কি, সে বাড়ি আসতেই চাইছে না।”

“মিথ্যে কথা।”

“ওই দেখুন, যা বলেছিলাম সত্যি কি না। আমরা সত্যি কথা বললেও কোনও লাভ হয় না।”

“হাতটা পেলেই তাকে ফেরত দেবে তো?”

দিনু ভারি বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে, সে তো বটেই। তবে কিনা ওইসঙ্গে শশীবাবুর ব্যাপারটাও মিটিয়ে ফেললে বড্ড ভাল হয়।”

“শশীবাবুর কী ব্যাপার?”

“ওই যে কথায় বলে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। তা, শশীবাবুর শ্বাস যতক্ষণ চলছে ততক্ষণ আমাদের আশা নেই। তাই বলছিলাম তাঁর একটা বিলিব্যবস্থা হয়ে যাক, তারপর নাতি।”

“তা হবে না। হাতটা এনে দিতে পারি, তার বিনিময়ে বাবলুকে অক্ষত শরীরে ফেরত দিতে হবে।”

দিনু মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে, তা হয় না।”

“কেন হয় না?”

“শশীবাবু যদি বেঁচে ওঠেন, তা হলে আমার বিপদ আছে। হাত যেখানে যার কাছেই থাকুক, শশীবাবুর হুকুম তামিল করবে। কাজেই উনি বেঁচে থাকতে হাত দিয়ে আমাদের লাভ হবে না মশাই।”

“তা হলে?”

“আমার আর-একটা কথাও আজ আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। সেটা হল, হাতটা যদি আমাকে হস্তান্তর নাও করেন, তা হলেও রক্ষা করতে পারবেন না। ওই হাত কালই গুণ্ডা বদমাশরা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করে ফেলবে। আমার কাছে পাকা খবর আছে।”

“আমার নাতির পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। তার মা, ঠাকুমা, বাপ, কাকা, পিসি সবাই কান্নাকাটি করছে। তোমার কি মায়াদয়া নেই বাপু?”

“খুব আছে কবরেজমশাই, খুব আছে। তাকে তো আমি পুষ্যি নিয়েই ফেলেছি প্রায়। ছেলেটাও বড্ড মিষ্টি। ফেরত দিতে আমার কষ্ট হবে।”

নন্দ কবিরাজ একটু ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, “তাকে যদি কষ্ট দাও, তা হলে তোমার ভাল হবে না।”

“চিন্তা করবেন না। সে তোফা আছে। কাল সকালেই হাতটা একটু হাত-সাফাই করে নিয়ে আসুন। রাত্রিবেলা আমি এসে নিয়ে যাব। তারপর মাত্র কয়েকটা দিন। শশীবাবু পটল তুললেই নাতি ফেরত পাবেন।”

“ভগবানের নামে দিব্যি করে বলো।”

“ভগবান! তাঁর নামে দিব্যি করে কী হবে? কথা না রাখলেও ভগবানের গায়ে আঁচড়টিও পড়বে না।”

“তবু বলো।”

“যে আজ্ঞে। আপনি বয়স্ক, শ্রদ্ধেয় মানুষ। ভগবানের দিব্যি করেই বলছি, হাতে হাত, শশী কাত, ফেরত নাত।”

“তার মানে কী?”

“মানে খুব সোজা। হাতে হাত, মানে শশীবাবুর হাতটি যখন আমার হাতে আসবে। শশী কাত, মানে শশীবাবু যখন মহাপ্রয়াণ করবেন। আর ফেরত নাত, মানে আপনার নাতি তখনই ফেরত আসবে। জলবৎ-তরলং।”

নন্দ কবিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কাল রাতে এসো।”

“আপনার মতো বিচক্ষণ লোক দুটি দেখিনি মশাই। যত দেখছি ততই শ্রদ্ধা হচ্ছে। আপনার মতো মানুষের সঙ্গে কাজকারবার করে সুখ আছে। তা ইয়ে, কবরেজমশাই, আমি এই আপনার মতোই একজন বিচক্ষণ মন্ত্রী খুঁজছি। আপনি যদি রাজি হয়ে যান, তা হলে আর বৃথা খোঁজাখুঁজির হয়রানির মধ্যে যাওয়ার মানে হয় না।”

“মন্ত্রী!” বলে নন্দ কবিরাজ হাঁ হয়ে রইলেন। বিনয়ী দিনু বলল, “মন্ত্রীদেরই এখন রবরবা। কবরেজি করে আর ক’ পয়সাই বা হয় আপনার! মন্ত্রীর বেতন ভাল, উপরি আছে, ক্ষমতাও কম নয়। তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। মাথাটি ঠাণ্ডা রেখে দু’দিন ভাবুন। ভেবেই বলবেন।”

দিনু আর দাঁড়াল না। সরে পড়ল। পিছু-পিছু আসতে আসতে ঝিকু বলল, “এঃ, তুমি যে কবরেজমশাইকে মন্ত্রীর অ্যাপয়েন্টমেন্টটা দিয়েই ফেললে দিনুদাদা! তা আমার ব্যবস্থাটা কী হবে?”

“কেন, তুই হবি আমার কোটাল।”

“কোটাল! কোটাল মানে কী?”

“মানে কি আমিই জানি? শুনেছি রাজাদের একটা করে কোটাল থাকে, তাই বললাম। তা কোটালের কাজও খারাপ হওয়ার কথা নয়। বেতন আছে, উপরি আছে, ক্ষমতাও কম নয়।”

“রাজা তা হলে তুমি হচ্ছই?”

“ওরে, রাজা না হয়ে আমার উপায়ও নেই কিনা। আমার কোষ্ঠীতে যে রাজা হওয়ার যোগ আছে। ইচ্ছে না থাকলেও রাজা আমাকে হতেই হচ্ছে। রাজা হওয়ার ঝকমারি কি কম?”

“তুমি যে শশীবাবুর ভৃত্য ছিলে, আর চুরি করেছিলে বলে শশীবাবু যে তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এ কথাটা কিন্তু আমাকে বলোনি কখনও।”

দিনু একটু হাসল। বলল, “দুঃখের কথা কি মনে রাখতে আছে। রে? ওসব ভুলে যাওয়াই ভাল। আমার জীবনটা দুঃখে-দুঃখে একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে আছে, বুঝলি? সেই যখন ছোট্ট ছিলুম ৪৪

তখন থেকেই বেঁটে বলে ছেলেরা আমার পেছনে লাগত। যখন-তখন মাথায় উঁটি কষাত। কারও সঙ্গে পারতুম না।”

“তারপর?”

“তারপর কত ঝঞ্ঝাট গেছে। শশীবাবুর বাড়িতে চাকরি পেয়ে প্রথম প্রথম খুব সুখ ছিল। ভারি ভালবাসতেন আমায়। একেবারে নিজের ছেলের মতো।”

“তা হলে তাড়াল কেন?”

“সেইটেই তো ভাবি। দোষও কিছু তেমন করিনি। ক্ষান্তদিদির একটা বালা সরিয়ে রেখেছিলুম, সেই হল অপরাধ।”

“চুরি করেছিলে?”

“ওসব চুরিটুরি কথাগুলো ফস করে মুখে আসে কেন তোর? আমার এখন একটা সামাজিক মান-মর্যাদা হতে যাচ্ছে। ওসব অসভ্য কথা খবরদার উচ্চারণ করবি না। ব্যাপারটা চুরির পর্যায়েও পড়ে না। নিতান্তই ঘরের ছেলে হিসেবে একটা জিনিস এধার থেকে নিয়ে ওধারে রেখেছিলুম। ওই বদমাশ হাতটা না থাকলে ধরাও পড়তুম না।”

“হাতটা যদি বদমাশই হবে, তা হলে সেটার জন্য এমন হন্যে হয়ে পড়েছ কেন?”

দিনু গম্ভীর হয়ে বলে, “তার কারণ আছে। শশীবাবু মস্ত আহাম্মক। তিনি হাতটা হাতে পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি। কেবল সৎ কাজ করতে লাগলেন। সৎ কাজের দাম কী বল! হাতটার মর্যাদাই উনি বুঝতে পারলেন না। আলাদিনের আশ্চর্য পিদিম যা, এও হল তাই। যা করতে বলা হবে, তাই করবে। শশীবাবু যদি হুকুম করতেন, যাও গিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে দু কোটি টাকা নিয়ে এসো, তা হলে হাত তাই করত। তাতে পাপও হত না। নিজে তো আর করছেন না, পাপটাপ যা হওয়ার তা ওই হাতের ওপরেই অশাবে। নরকে যেতে হয় তো হাতই যাবে। কথাটা আমি ঠারেঠোরে শশীবাবুকে বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু আহাম্মকরা যদি ভাল কথা বুঝতেই পারবে, তা হলে আর তাদের আহাম্মক বলেছে কেন?”

“তুমি কি হাতটা দিয়ে চুরি-ডাকাতি করাবে নাকি?”

“ফের ‘চুরি’ কথাটা উচ্চারণ করলি! চুরির ব্যাপারই নয়। তোকে একটা কথা বুঝিয়ে বলছি, মন দিয়ে শোন। দুনিয়াটা ভগবানের, ঠিক তো?”

“তা বটে।”

“এই দুনিয়ায় গরিব-বড়লোক মিলে আমরা যারা আছি, সবাই তো ভগবানেরই সন্তান, না কি?”

“তাই তো মনে হয়।”

“আর দুনিয়ার যত টাকা-পয়সা, ধনদৌলত, এসবও হরেদরে ভগবানেরই। ঠিক কথা বলছি তো! ভুল বললে ধরিস।”

“ঠিকই বলছ।”

“তা হলে দ্যাখ, রাপের পাঁচ ছেলে যেমন বাপের সম্পত্তির সমান হিস্যাদার, আমরাও ঠিক তেমনই ভগবানের সব জিনিসেরই সমান হিন্যাদার। বুঝলি? ভুল বললে শুধরে দিস।”

“কথাটা তো ন্যায্যই মনে হচ্ছে।”

“তা হলেই দ্যাখ, ভগবানের দুনিয়ায় কিছু লোক লুটেপুটে খায়, কিছু লোক আঙুল চোষে, এরকমটা হওয়া কি ভাল?”

“মোটেই নয়।”

“তা হলে আমি যা করতে যাচ্ছি, সেটাই যা খারাপ হবে কেন? যাদের ফালতু টাকা আছে, তাদের কাছ থেকে খানিকটা নিয়ে গরিবকে দিলাম। তাতে বড়লোকটা একটু নামল, গরিবটা একটু উঠল। একটা বেশ সমান-সমান ভাব এসে গেল। তাই না?”

“খুব ঠিক।”

“তুই দেবী চৌধুরানী বা রবিন হুডের নাম শুনেছিস?”

“কস্মিনকালেও না। তারা কারা?”

“নমস্য ডাকাত। তাদের নাম শুনলে আজও কত সাধুপুরুষও মাথা নোওয়ায়। তা, তারা যা করেছে, তার চেয়ে আমি আর খারাপটা কী করব বল! দুনিয়ায় যে ভগবানের সন্তানদের প্রতি অবিচার চলছে, তার একটা বিহিত করতেই আমার জন্ম। আরও একটা কথা শুনে রাখ।”

“কী কথা দিনুদাদা?”

“আগের দিনে যত রাজারাজড়া ছিল, যত জমিদার মহাজন, সবাই ছিল আদতে ডাকাত আর লুঠেরা। দলবল আর টাকার জোরে দলবাজ সর্দাররাই রাজাগজা হয়ে বসেছিল। বুঝতে পারছিস তো? না বুঝলে বলিস, আবার বুঝিয়ে দেব।”

“দিব্যি বুঝতে পারছি।”

“তা হলে চোর-ডাকাতের সঙ্গে রাজা-মহারাজাদের আর তফাতটা রইল কী, বল! আলেকজাণ্ডার, তৈমুরলঙ, মামুদ, চেঙ্গিস খানের সঙ্গে রঘু ডাকাত বা কালু সদারের কোনও ফারাক দেখতে পাস?”

“কাদের কথা বলছ গো! গণ্ডার, লবঙ্গ, ঝিঙে কীসব বলে গেলে, এরা কারা?”

“ঐতিহাসিক লোক। তোর বুঝে কাজ নেই। এখন চুপ করে থাক। আমাকে একটা গুরুতর কথা ভাবতে হচ্ছে।”

“ভাবো দিনুদা। এই আমি চুপ মারলাম।”

দিনুকে সত্যিই ভাবতে হচ্ছে। কারণ, সে যখন শশীবাবুর বাড়িতে কাজ করত, তখন হাতের কেরামতি দেখে সে তাজ্জব হয়ে যায়। হাতখানা কীভাবে ক্রিয়া করে, সেদিকে তার খুব নজর ছিল। কিন্তু শশীকতাও সোজা লোক নন। যা করার করতেন খুব চুপিচুপি, ঘরের দরজা এঁটে।

তবে দিনু হাল ছাড়ার পাত্র নয়। দিনের পর দিন সে বন্ধ দরজায় আড়ি পাতত। দরজায় গোপনে একটা ছিদ্রও করে রেখেছিল সে। সেই ছিদ্র দিয়ে দেখারও চেষ্টা করত। অনেক দিনের চেষ্টায় সে বুঝতে পেরেছিল, হাতটাকে শক্তি সঞ্চার করার একটা মন্ত্র আছে। প্রত্যেকদিন সকালবেলায়, ব্রাহ্মমুহূর্তে হাতটাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। না তুললে হাতটা কাজ করে না।

কিন্তু মন্ত্রটা কী, তা জানা যাবে কী করে? শশীকর্তা বন্ধ ঘরের মধ্যে ব্রাহ্মমুহূর্তে কী মন্ত্র পাঠ করেন, তা শোনার তো উপায় নেই। তবে বুদ্ধি থাকলে উপায় হয়। পাড়ার বসন্ত পাল কানে কম শোনেন। তাঁর একটা কানে শোনার যন্ত্র ছিল। স্নানের সময় সেটা খুলে রাখতে হত। দিনু একদিন ফাঁক বুঝে বসন্ত পালের বাড়ি থেকে সেটা সরিয়ে ফেলল। তারপর যন্ত্রটা কানে লাগিয়ে রোজ ব্রাহ্মমুহূর্তে গিয়ে শশীবাবুর দরজায় কান পাতত।

প্রথম কয়েকদিন তেমন সুবিধে হয়নি। তারপর ধীরে-ধীরে যন্ত্রটা কানে সেট করে গেলে একদিন শুনতে পেল, শশীবাবু মন্ত্রটা পড়লেন, “আ মরণ, ফিনাইলের ড্রাম।”

কিন্তু কথাটার তেমন মানে হয় না। ‘আ মরণ, ফিনাইলের ড্রাম’ কি কোনও মন্ত্র হতে পারে?

আর-একদিন মনে হল, আগুন ও পেত্নির ধাম’। এ কথাটারও কোনও মানে খুঁজে পেল না সে। তবে রোজ কান পাততে-পাততে একদিন মনে হল, সঠিক মন্ত্রটা হচ্ছে,’আন উনো, ফেরে…’ ব্যস, বাকিটা আর ধরতে পারেনি। পরদিনই তাকে তাড়ানো হয়। হাতটা হাতানোর ইচ্ছে ছিল। তাও হল না। কারণ শশীবাবুর কাছ থেকে বিদায় হওয়ার পর সে একটা চুরির কেসে ফেঁসে গিয়ে তিনটি বছর জেলে কয়েদ ছিল।