একাদশ পরিচ্ছেদ
বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। শিগগিরই পয়লা জুনের সূর্য–শেষ অব্দি পয়লা জুনই বিয়ের দিন হিশেবে ঠিক হয়েছে–উঠবে রাগৎস-এর দিগন্তে।
এটা আমি বুঝতে পেরেছিলুম যে মাইরা-কচি বয়েসে লোকে এমনিতে অনেককিছু নিয়ে অকারণেই মাথা ঘামায়, কিন্তু মাইরা ঐ দুর্বোধ প্রহেলিকাটিকে তেমন করে আর মনে রাখেনি। এটাও ঠিক যে তার বা তার মায়ের সামনে একবারও অবশ্য ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের নামটাই পাড়া হয়নি।
তার বিশেষ-কোনো সখী ছিলো কি না জানি না, তবে আমিই তার মনের কথা খুলে বলবার অন্তরঙ্গ শ্রোতা হয়ে উঠেছিলুম। পরে কী করবে না-করবে সে-সম্বন্ধে সে কী ভাবছে, তা সে আমায় খুলে বলেছিলো, অবশ্য সেগুলো তার স্বপ্নই, কখনও সফল হবে কি না কে জানে। মার্কের সঙ্গে ফ্রাসে গিয়ে সেখানেই থাকবে বলে কি মনস্থ করেছে? হ্যাঁ, যাবে ফ্রাসে, থাকবেও, তবে এখন নয়, পরে। এক্ষুনি বাবা-মাকে ছেড়ে চলে যেতে হলে ভারি কষ্ট পাবে সে।
তবে, এটাও সে জুড়ে দিয়েছিলো, আপাতত পারী গিয়ে কয়েক হপ্তা কাটিয়ে আসবো-আপনিও আসবেন তো আমাদের সঙ্গে, আসবেন না?
নিশ্চয়ই। তবে সত্যি-সত্যি তোমরা তৃতীয় ব্যক্তিকে সঙ্গে চাইবে কি না কে জানে।
তা ঠিক। নবদম্পতি কোনোকালেই বেড়াতে যাবার যোগ্য সঙ্গী হয় না।
আমি না-হয় অসুবিধেগুলো মেনেই নেবো, অগত্যা যেন মেনেই নিয়েছিলুম আমি।
ডাক্তার রডারিখের কাছে মনে হয়েছিলো ফ্রাসে চলে যাবার এই পরিকল্পনাটা খুবই ভালো। সবদিক বিবেচনা করেই মনে হয়েছে, দু-এক মাসের জন্যে রাগৎস ছেড়ে চলে গেলে ভালোই হবে। মাদাম রডারিখ হয়তো কন্যা কাছে না-থাকায় একটু কষ্ট পাবেন, কিন্তু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে কী আর করা?
আর মার্ক? মাইরার সঙ্গে যখন থাকে, তখন সময় কেমন করে কেটে যায় টেরই পায় না। অন্যসময় সে অরুচিকর প্রসঙ্গটা ভুলেই থাকতে চাইতোকে আর হৃদয় খুঁড়ে অমনতর বিশ্রী জিনিশ নিয়ে মনখারাপ করে থাকে। তবে শুধু আমার কাছেই সে খুলে বলতো তার দুর্ভাবনাগুলো–আমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলেও সবসময় এই আশঙ্কা সে কাটিয়ে উঠতে পারতো না। থেকে-থেকেই আমায় জিগেস করতো, নতুন কিছু হয়েছে নাকি, অঁরি?
না, কিছুই হয়নি, আমি বলতুম, আর মিথ্যেও বলতুম না।
একদিন তার মনে হয়েছে আমাকে বোধহয় আগে থেকে বলে রাখা উচিত।
শহরে কানাঘুষো কিছু কানে এলে, বা মঁসিয় স্টেপার্কের কাছ থেকে কিছু জানতে পেলে–
আমি তোকে হুঁশিয়ার করে দেবো, মার্ক।
সে তুই যা-ই শুনিস না কেন, আমি চাইবো না তুই আমার কাছ থেকে কিছু লুকোস।
আমি-যে কিছুই তোর কাছ থেকে লুকোবো না, সে-বিষয়ে তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। তবে তোকে এই আশ্বাসটুকু দিতে পারি যে এ নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। শহর ফের আগের মতোই দিব্বি নির্ভাবনার পালে ফুরফুরে হাওয়া লাগিয়ে চলেছে। কেউ তার ব্যাবসা দেখছে, কেউ-বা খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রমোদ, আর বাজারদর তো কেবলই বেড়ে চলেছে…
তুই ঠাট্টা করছিস, অঁঁরি।
সেটা তোকে এটাই বোঝাতে যে আমার মনের মধ্যে কোনো শঙ্কা নেই।
অথচ তবু, মার্কের মুখচোখে কালাছায়া পড়েছে, যদি সেই লোকটা–
বাঃ! সে অমন গাড়ল নয়। সে বেশ ভালোই জানে যে হাঙ্গেরির কোথাও পা দেবামাত্র তাকে গ্রেফতার করে হাজতে পোরা হবে। জার্মানিতে অনেক মেলা হয়– সেখানে সে তার ভেলকি দেখিয়ে সবাইতে তাক লাগিয়ে দিতে পারবে।
তাহলে সে-যে ভুতুড়ে পিশাচশক্তি লেলিয়ে দেবার হুমকি দিয়েছিলো–
ছেলেভোলানো গল্প হিশেবে সেগুলো চমৎকার ছিলো, চটকদারও!
তাহলে তুই সে-সবে বিশ্বাস করিস না?
তুই যতটুকু করিস, তার চেয়ে বেশি নিশ্চয়ই নয়। শোন, মার্ক, তুই বরং এখন থেকে প্রহর গোন, হিশেব করে দ্যাখ আর ক-মিনিট বাকি আছে শুভলগ্নের। আর কিছু করার না-থাকলে ফের আবার এক থেকে গুনতে শুরু করতে পারিস।
ধুর! তুই বড় বাজে বকিস।
তুই ভারি ছেলেমানুষি করছিস, মার্ক। মাইরা তোর চাইতে অনেক-বেশি কাণ্ডজ্ঞান ধরে।
সে তো কেবল এইজন্যে যে আমি যা জানি ও তা জানে না।
কী জানিস তুই, বল-তো! এটা জানিস যে লোকটা এখন আর রাগৎস-এ নেই, সে আর এখানে ফিরে আসতে পারবে না–কারণ তার নামে একটা হুলিয়া বেরিয়েছে; এও জানি যে তার সঙ্গে আর-কখনোই আমাদের কোনো মোলাকাৎ হবে না। এত সব জেনেও তুই যদি অবুঝের মতো ভয় পাস…
সে তুই কী জানবি, অঁঁরি। আমার মনের মধ্যে কেবলই কু ডাকছে…
এর চেয়ে হাস্যকর আর-কিছু হয় না, মার্ক! শোন, বরং তুই মাইরার কাছ গিয়েই আড্ডা দে। তখন হয়তো এ-সব আবোলতাবোল ভাবনা ভুলে থাকতে পারবি!
হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস, অঁরি। ওকে আমার ছেড়ে-থাকা ঠিক না–এক মিনিটের জন্যেও ওর কাছছাড়া হওয়া উচিত হবে না।
বেচারা! ওর দিকে তাকাতেও আমার কষ্ট হচ্ছিলো, শুনতেও। যতই বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে ততই তার আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে। আমিও একটু উদ্বিগ্ন বোধ করছিলুম বৈ কি!-মার্কের কথা ভেবেই। তবে মার্ককে যদি-বা মাইরা ঠাণ্ডা রাখতে পারে, কপ্তেন হারালানকে নিয়ে আমি করবো কী? যে-মুহূর্তে সে শুনেছে যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে মেবার্গে দেখা গেছে, সে অমনি সেখানে যাবার জন্যে প্রায় পা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। অনেক কষ্টে, অনেক বুঝিয়ে-শুঝিয়ে, তবে আমি তাকে ঠেকিয়েছি। স্পেমবার্গ মাত্র তো দুশো লিগ দূরে, দিন-চারেকের মধ্যেই এ-পথটুকু পেরিয়ে যাওয়া যায়, অনেক তুইয়ে বুইয়ে তাকে ঠেকিয়েছি বটে, ডাক্তার রডারিখও ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন, তবু সে মন থেকে ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলতে পারেনি–প্রেমবার্গে গিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করে আসবার জন্যে তার হাত-পা যেন নিশপিশ করছিলো। আমার ভাবনা হচ্ছিলো সে হয়তো। আমাদের না-বলেই একদিন চলে যাবে। সেদিন সকালে সে যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, তখন তার ভাবভঙ্গি দেখেই আমার মনে হয়েছে যে সে ওখানে যাবে বলেই মনস্থির করে ফেলেছে।
এটা কিন্তু তোমার করা ঠিক হবে না, হারালান, আমি তাকে আবারও বলেছি, এ-কাজ তুমি কোরো না। ঐ প্রশিয়ানের সঙ্গে তোমার দেখা হওয়া অসম্ভব। আমি তোমাকে অনুনয় করে বলছি, হারালান, রাগৎস ছেড়ে তুমি কোথাও যেয়ো না।
শুনুন, ভিদাল, কাপ্তেনের গলার স্বরে কঠিন দৃঢ়তা, ঐ পাজির পাঝাড়াটাকে একটা কঠিন সাজা দিতেই হবে!
অপকর্মের সাজা সে পাবেই–দু-দিন আগে আর পরে? আমি বলে উঠেছি, এ নিয়ে তুমি মনে কোনো সন্দেহই পুষে রেখো না। তবে তাকে পাকড়াবার দায়িত্ব সেপাইদের–তোমার নয়।
কথাটা তার মনে ধরেছে বটে, কিন্তু তবু সে তার জেদ ছাড়বে না, বলেছে, ভিদাল, আপনি যেভাবে ব্যাপারটাকে দেখছেন, আমি সেভাবে দেখছি না। আমাদের দেখার প্লনটাই ভিন্ন। আমার পরিবারকে–আপনার ভাইও তার অংশ হতে চলেছে–কলুষিত করেছে সে, আর আমি তার কোনো শোধ নেবো না? কোনো হিশেবনিকেশ হবে না। তার?
প্রতিশোধ কোনো কথাই নয়, হারালান। মূল কথা : ন্যায়বিচার। আর তার দায়িত্ব অন্যদের।
কিন্তু লোকটা যদি না-ই ফেরে, তবে তার বিচার হবে কেমন করে? এই-যে আজ রাজ্যপাল বহিষ্কারের ফতোয়ায় সই করেছেন, তাতে স্টোরিৎস তো আর-কখনও এখানে ফিরতেই পারবে না। পর্বত আর মহম্মদ-কে কার কাছে যাবে, ভিদাল? সে যদি না-আসে, তবে আমি গিয়ে তাকে তার ডেরা থেকে টেনে বার করে নিয়ে আসবে। যদি সে মেবার্গে থেকে থাকে–
মানি, আর-কিছুতেই ব্যাপারটার কোনো ফয়সালা না-হলে হয়তো তা-ই করতে হবে আমাদের, তবে অন্তত বোনের বিয়ে-হয়ে-যাওয়াটা অব্দি অপেক্ষা করো। আর তো শুধু কয়েকটা দিন, তারপর আমি নিজেই তোমাকে বলবো, এবার গিয়ে একটা এপার-ওম্পার করে এসো। আমি নিজেই তোমার সঙ্গে প্রেমবার্গ যাবো তখন।
এই কথাটা আমি এতই জোর দিয়ে বলেছি যে আমাদের কথাবার্তা শেষটায় সাঙ্গ হয়েছে প্রায় একটা কথা দিয়েই যে বিয়ে হয়ে-যাওয়ার পর আমি আর-কোনো আপত্তিই করবো না, এবং আমি তখন তার সঙ্গ নেবো।
পয়লা জুন যেন আর আসতেই চাচ্ছে না। অথচ আমার বারেবারে মনে হয়েছে। এই সময়টার মধ্যে কেউ যেন আর ঘাবড়ে না-যায়, তাদের আমি অনবরত চাঙ্গা করে তোলবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার নিজের মন থেকে অস্বস্তিটা কিছুতেই কাটেনি। কাজেই, সে-যে কোন অলুক্ষুণে আশঙ্কা আমায় তাড়িয়ে নিয়ে গেছে জানি না, তবে বারেবারে আমি বুলভার তেকেলির হানাবাড়িটার সামনে দিয়ে যাতায়াত করেছি।
সেপাইরা ছোঁ মেরে পড়বার পর যেমন সীল করে গিয়েছিলো দরজা, হানাবাড়িটা তেমনি পড়ে আছে। দরজা-জানলা বন্ধ, উঠোন বা বাগান পরিত্যক্ত। বুলভার থেকে চারপাশে ছড়িয়ে আছে সেপাইদের সদাজাগ্রত পাহারা। প্রভু বা ভৃত্য–কেউই আর ফিরে। এসে বাড়িতে ঢোকবার চেষ্টা করেনি। অথচ, মার্ক বা হারালানকে পইপই করে যা। বলেছি, নিজেকেও আমি বারেবারে যে-সব কথা বলে বুঝিয়েছি; সব সত্ত্বেও, যেন। একটা ঘোরের মতো, আবেশের মতো, আমার মনে হয়েছে যে যদি চিমনি থেকে কোনো ধোঁয়া উঠতে দেখি, বা কোনো মুখ দেখি জানলায় বা মিনারের পাখির বাসায়, তবে আমি যেন আদৌ অবাক হবো না।
রাগৎস-এর লোকজন যদিও অ্যাদ্দিনে তাদের ভয়টা কাটিয়ে উঠেছে, ঐ-সব আজব কাণ্ড নিয়ে আর-কোনো উচ্চবাচ্যই করছে না কেউ, আমরা নিজেরা-ডাক্তার রডারিখ, মার্ক ভিদাল, কাপ্তেন হারালান এবং আমি, স্বয়ং অঁঁরি ভিদাল–আমরা কেউই যেন ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে মন থেকে তাড়াতে পারছি না, সে যেন নিছক হানাই দিচ্ছে না আমাদের মনে, সেখানে সে যেন একটা মৌরসীপাট্টাই গেড়ে বসেছে।
সেদিন–তিরিশে মেমনের বোঝাটা হালকা করবার জন্যে বিকেলবেলায় আমি দানিউবের তীরে বেড়াতে গিয়েছিলুম; জাহাজঘাটার পাশ দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি একটা হালকা মালখালাশ-নৌকো তরতর করে উজান বেয়ে আসছে। তক্ষুনি আমার মনে পড়ে গেছে, পর-পর পটের গায়ে ছবির মতো, আমার নিজের যাত্রার কথা : কী করে জার্মানটির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তার সেই অপমানকর ব্যবহার, প্রথম দেখেই তার বিরুদ্ধে মনটা আমার কেমন রি-রি করে উঠেছে; তারপরেই, যখন আমি ধরে নিয়েছি যে সে তীরে নেমে গিয়েছে, তখনই কথাগুলো কানের পাশে উচ্চারণ করেছে সে। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সে-ইএ-সব কথা বলে শাসিয়েছিলো, ডাক্তার রডারিখের বৈঠকখানায় তার গলা শুনেই আমি সেটা চিনতে পেরেছি। সেই উচ্চারণের ভঙ্গি, সেই রুক্ষ কর্কশ চোয়াড়ে গলা, সেই আলেমান ঔদ্ধত্য! এ-সব স্মৃতি যখন মনের মধ্যে হানা দিচ্ছে, আমি নিজের অজান্তেই তাকিয়ে ছিলুম যাত্রীদের দিকে–কারা-কারা নামছে রাগৎস-এ। সেই রংজ্বলা মুখ, সেই অদ্ভুত চাউনি, সেই পৈশাচিক অভিব্যক্তিটা খুঁজে বেড়িয়েছে আমার চোখ। কিন্তু, যেমন বইয়ে বলে, অত তাকিয়ে দেখেও কোনো লাভই হয়নি।
ছটার সময় আমি যথারীতি গিয়ে হাজির পারিবারিক ভোজের আসরে। মাদাম রডারিখকে দেখে মনে হয়েছে আগের চাইতে অনেক ভালো আছেন, নিজেকে তিনি চমৎকার সামলে নিয়েছেন। আর আমার ভ্রাতাটি তো মাইরা পাশে থাকলে বিশ্বসংসারই ভুলে যায়। এমনকী কাপ্তেন হারালানকেও বেশ শান্ত দেখাচ্ছিলো, যদিও মুখের মধ্যে একটা কালো ছায়া লেগেই ছিলো।
আমি ঠিক করে রেখেছিলুম যে এদের মন থেকে বিচ্ছিরি স্মৃতিগুলো তাড়িয়ে দিয়ে আনন্দ ফুটিয়ে তোলবার জন্যে দরকার হলে তিনবার ডিগবাজিও খাবো টেবিলটায়। অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলবো। আমার পরিকল্পনাকে চমৎকার সহায়তা করেছিলো মাইরা : সে-ই ছিলো সেই সন্ধের হাসিখুশি হুল্লোড়ের উৎস-আর সন্ধে গড়িয়ে গিয়েছিলো গভীর রাতে। কেউ কিছু না-বলতেই সে গিয়ে বসেছে ক্লাভিকর্ডের কী বোর্ডে, আমরা সবাই গলা মিলিয়ে গান ধরেছি–পুরোনো সব মাগিয়ার গান, যেন সেই জঘন্য ঘৃণাবিদ্বেষের স্তবের রেশটুকুকে মুছে দিতে চাচ্ছি সবাই।
ঠিক যখন আমরা বিদায় নেবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছি, মাইরা হালকা চটুল গলায় মৃদু হেসে বলেছে : ভুলে যাবেন না, মঁসিয় অঁঁরি, যে কালকেই
ভুলবো, মাদামোয়াজেল? আমারও গলা বুঝি সমান চটুলই শুনিয়েছে।
না, ভুলবেন না যে কালকেই আমরা রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে তার অনুমোদন নেবো–
আরে, তা-ই ত, কালকেই তো!
আর আপনি আপনার ভাইয়ের তরফে সাক্ষী হবেন।
আমাকে মনে করিয়ে দিয়ে খুব ভালো করেছেন, মাদমোয়াজেল মাইরা। আমার ভাইয়ের তরফে সাক্ষী! আমি যে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলুম।
আমি অবশ্য তাতে মোটেই অবাক হইনি। দেখছি, ক-দিন ধরেই আপনি যেন কীসের–বা কার-ধ্যান করে চলেছেন।
কবুল করছি, ঘাট হয়েছে। তবে কথা দিচ্ছি আর ও-রকম ভুল হবে না। আর মার্ক যতক্ষণ না-ভুলছে…
তার হয়ে আমিই কথা দিচ্ছি। তাহলে ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় চারটেয়।
চারটেয়, মাদমোয়াজেল মাইরা? কী কাণ্ড, এদিকে আমি ভেবেছিলুম বুঝি সাড়ে পাঁচটায়… ঠিক আছে, ভেবো না। আমি চারটে বাজতে দশ মিনিটেই ওখানে হাজির হয়ে যাব।
তাহলে, শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি, মাদমোয়াজেল মাইরা!
পরদিন সকালে মার্কের কতগুলো জায়গায় যাবার কথা ছিলো। আমি ভেবেছি, সে বুঝি তার ভয়-টয় কাটিয়ে উঠেছে, তাই তাকে যেতে দিয়েছি।
তবে, সাবধানের মার নেই ভেবে, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যে শেষ মুহূর্তে এখানে
এসে হাজির হয়নি, এটা জানতে আমি সরাসরি টাউনহলে গিয়ে হাজির হয়েছি।
আমাকে দেখেই মঁসিয় স্টেপার্ক আমার প্রশ্নটা বুঝে নিয়েছেন। বলেছেন, না, মঁসিয় ভিদাল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন–আমাদের শ্রীমানকে রাগৎস-এর কোত্থাওই দেখা যায়নি।
এখনও মেবার্গেই আছে নাকি সে?
এটুকু শুধু বলতে পারি যে চারদিন আগেও সে ওখানেই ছিলো।
আপনি নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবরটা পেয়েছেন?
হ্যাঁ, আলেমান পুলিশের এক চর মারফৎ।
যাক, আশ্বস্ত হওয়া গেলো।
আমি কিন্তু বড্ড বিরক্তি বোধ করছি। এই পিশাচটা-পিশাচ ছাড়া একে আর কী নামে ডাকবো, বলুন–পিশাচটা কিছুতেই সীমান্ত পেরিয়ে এখানে আসতে চাচ্ছে না! অপেক্ষা করে-করে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।
না-এলেই কিন্তু ভালো, মঁসিয় স্টেপার্ক।
আপনাদের পক্ষে হয়তো ভালো। তবে পুলিশ তার ঘাড়েটাড়ে হাত রাখতে পারলে খুশি হতুম আমি। পিশাচটাকে জেলে পুরতে পারলে স্বস্তি পেতুম! যাক–সে না-হয় পরে কোনোদিন করা যাবে।
এ-কথার পর তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ফিরে এসেছি।
বিকেল চারটের সময় আবার আমরা সকলে রডারিখ-ভবনে জমায়েৎ হয়েছি। বুলভার তেকেলিতে দুটো কোচবাক্স অপেক্ষা করছিলো : একটায় যাবে তার বাবা-মা। এবং পারিবারিক বন্ধু বিচারপতি নয়মানের সঙ্গে মাইরা; অন্যটায় মার্ক, কাপ্তেন হারালান, তার জিগরি দোস্ত লিউটেনান্ট আমগাড়, আর আমি। মঁসিয় নয়মান আর কাপ্তেন হারালান কনের দিককার সাক্ষী; লিউটেনান্ট আর্মগড় আর আমি বরের পক্ষের সাক্ষী।
কাপ্তেন হারালান আগেই আমাকে এখানকার দস্তুরটা বুঝিয়ে বলেছিলো। এটা আসলে বিয়ে নয় ঠিক, বরং তার প্রস্তুতি। রাজ্যপালের অনুমোদন পাবার পরই শুধু, কাল, ক্যাথিড্রালে বিয়ের আসল অনুষ্ঠানটা হবে। ততক্ষণ অব্দি, বাগদত্তরা আইনের চোখে বিবাহিত দম্পতি নয়, তবে তার প্রায় পনেরো-আনা কাছাকাছি–কেননা তারপর যদি কোনো অভাবিত বিপত্তির ফলে বিয়েটা না-হয় তাহলে তাদের সারাজীবন অবিবাহিত থেকে যেতে হবে।
ফ্রানসের ফিউড্যাল ব্যবস্থায় এরই কাছাকাছি একটা নিয়ম ছিলো, যা থেকে পিতৃতান্ত্রিকতার বাড়াবাড়িটা বোঝা যায় : সমাজপতি নিজেকে সমাজের পিতা বলেই গণ্য করতেন–আর সেই প্রথাটা আজও রাগৎস-এ বজায় আছে।
কনের পরনে চমৎকার একটা ঝলমলে ঘাগরা; মাদাম রডারিখও সূক্ষ্মভাবে সেজেছেন, তবে ভঙ্গিটা শাদাসিধে হলে কী হবে, ভীষণ দামি তার সাজপোশাক, ডাক্তার এবং বিচারপতি পরেছেন রাজভবনে যাবার উপযোগী পোশাক, যেমন পরেছি আমি আর মার্ক, আর সামরিক বাহিনীর অফিসার দুজন পরেছে পুরোদস্তুর সামরিক উর্দি।
বুলভারে অনেকেই জমায়েৎ হয়েছিলো, বর-কনের গাড়ি কখন এখান দিয়ে যায়; বেশির ভাগই কিশোরী এবং বয়স্কা মহিলা, তাদের কাছে যে-কোনো বিয়েই বোধহয় দারুণ উত্তেজনার খোরাক। তবে পরদিন যে ক্যাথিড্রালে মস্ত ভিড় জমে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই–রডারিখ পরিবারের যা নামডাক, তাতে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
কোচগাড়ি দুটো রডারিখ-ভবন থেকে বেরিয়ে সরাসরি রাজভবনের দিকেই ছুটেছে। শহরের রাস্তায় আর রাজভবনের সামনে দস্তুরমতো ভিড়ই জমে গিয়েছে। সম্ভবত বিয়েটাকে ঘিরে আগে যা-সব আজব ব্যাপার ঘটে গিয়েছে তাতেই তারা এত কৌতূহলী হয়ে উঠেছে, হয়তো ভেবেছে যে আবার-কোন্ নতুন ফ্যাসাদ বেধে যায় এখন!
কোচগাড়ি দুটো তারপর সোজা রাজভবনের চকমেলানো সিঁড়ির সামনে গিয়ে। থেমেছে। পরক্ষণেই বাবার বাহু ধরে নেমে এসেছে মাইরা, মঁসিয় নয়মানের বাহু ধরে নেমেছেন মাদাম রডারিখ, তারপর মার্ক, কাপ্তেন হারালান, লিউটেনান্ট আর্মাড় আর আমি দরবারঘরে আমাদের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেছি। ঘরের মাঝখানে বড়ো একটা টেবিল, তাতে দুটো ঝুড়ি ভর্তি ফুল ঝলমল করে উঠেছে।
কনের বাবা-মা হিশেবে রডারিখ দম্পতি বসেছেন বাগদত্ত দুজনের দু-পাশে দুটি বিশাল আরামকেদারায়। তাদের পেছনে বসেছি আমরা–সাক্ষী চারজন। ঘোষক
জানিয়েছে রাজ্যপালের আগমনবার্তা : তিনি ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে।
তার সিংহাসনে বসবার পর রাজ্যপাল সরকারিভাবে কনের পিতামাতাকে জিগেস করেছেন মার্ক ভিদালের সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে তাদের সম্মতি আছে কি না। তারপরে তিনি হবু দম্পতিকে আলাদা-আলাদা করে প্রথাগত প্রশ্ন জিগেস করেছেন।
মার্ক ভিদাল, তুমি মাইরা রডারিখকে তোমার বৈধ পত্নী হিশেবে গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছো কি?
আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম, মাগিয়ার আদবকায়দা মার্ক বেশ তালিম দিয়েছিলো।
মাইরা রডারিখ, তুমি মার্ক ভিদালকে বৈধ পতি হিশেবে গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছো কি?
আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম,কথার কোনো খেলাপই হবে না, এমনি একটা ভঙ্গি করে বলেছে মাদমোয়াজেল মাইরা!
আমরা, রাগৎস-এর রাজ্যপাল, রাজ্যপাল ঘোষণা করেছেন, আমাদের উপর সম্রাজ্ঞীর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, রাগৎস-এর যুগসঞ্চিত প্রথা অনুযায়ী, মাইরা রডারিখের সহিত মার্ক ভিদালের শুভ পরিণয়ে অনুমোদন প্রদান করিলাম। ইহাই আমাদের অভিপ্রায় ও নির্দেশ যে উক্ত বিবাহ-অনুষ্ঠান যেন নগরীর ক্যাথিড্রালে যথাবিহিত প্রথা অনুযায়ী সমাধা হয়।
সবকিছুই দস্তুর অনুযায়ী সোজাসুজি শেষ হয়ে গেলো। যারা এতে অংশ নিয়েছে। তাদের অস্বস্তির কোনো কারণ ঘটেনি। যে-কাগজটায় আমরা সবাই সই করেছি, কোনো অদৃশ্য হাত ভেলকি দেখিয়ে সেটা শূন্যে তুলে নিয়ে কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে ফ্যালেনি–কিংবা সই করবার আগে কোনো ভূতপ্রেত এসে আমাদের হাত থেকে কলমটা কেড়ে নেয়নি।
ভিলহেল্ম স্টোরিৎস তাহলে সত্যিই নিশ্চয়ই প্রেমবার্গেই থেকে গিয়েছে। জার্মানদের মনে হর্ষ জাগিয়ে তাদের মধ্যেই সে না-হয় কাটিয়ে দিক তার চিরটা কাল। আর যদি সে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে রাগস এসে থাকে, তাহলে তার সব জাদুবলই হয়তো উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু এই পিশাচসিদ্ধ ভেলকিবাজ এখন চাক বা না-চাক, মাইরা রডারিখ এখন শুধু মার্ক ভিদালের পত্নীই হবে, তা না-হলে-আর-কারুই নয়।
.
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
এসে পৌঁছেছি পয়লা জুনে। অবশেষে একসময়। অথচ সময় এমনই ধীর লয়ে কাটছিলো যে মনে হচ্ছিলো বহুপ্রতীক্ষিত এই পয়লা জুন বুঝি আর আসবেই না। কিন্তু ক্যালেণ্ডারের পাতায় যথানিয়মেই সে এসে হাজির এখন। আর মাত্রই কয়েকটা ঘণ্টা, তারপরেই রাগৎস-এর ক্যাথিড্রালে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে যাবে।
পনেরো দিন আগে যে-দুর্বোধ্য প্রহেলিকার মুখোমুখি হয়ে আমরা একেবারেই ভড়কে গিয়েছিলুম, আর তার জের হিশেবে যে-শঙ্কার বোধ মনের মধ্যে হানা দিচ্ছিলো, রাজ্যপাল সকাশে গিয়ে তা এখন একেবারেই মুছে গিয়েছে।
আমি উঠেছি ভোরবেলাতেই। ভেবেছি, বড্ড আগেই বুঝি ঘুমটা ভেঙে গেলো, কিন্তু উঠে দেখি মার্ক আমারও আগে উঠে পড়েছে। আমি যখন সাজপোশাক পরছি, সে পুরোদস্তুর সাজগোজ করে আমার ঘরে এসে হাজির। বরের সাজই পরে ফেলেছে। সে। মুখটা আনন্দে ঝলমল করছে, কোথাও কোনো ছায়া নেই সেই আনন্দের মধ্যে। সে আমাকে উদ্ভাসিত সুরে সুপ্রভাত জানিয়েছে, আর আমি তার হাতে হাত রেখেছি।
মাইরা তোমায় বলতে বলেছে যে– সে বেশ গুছিয়েই শুরু করেছিলো, কিন্তু আমি হো-হো করে হেসে ফেলেছি, বলেছি, যে, মহাকাণ্ডটা আজকেই হবে। তা, তুই ওকে বলে দিস যে রাজভবনে যখন দেরি করে যাইনি, তখন ক্যাথিড্রালেও দেরি হবে না। কাল আমি একেবারে চার্চের বড়োঘড়িটার সঙ্গে আমার ঘড়ি মিলিয়েছি। তবে তোর, মার্ক, তোর উচিত হবে না ওদের অপেক্ষা করিয়ে রাখা! তোর উপস্থিতি কতটা জরুরি, সেটা নিশ্চয়ই জানিস তুই : ওরা তোকে ছাড়া কিছু শুরু করতেই পারবে না!
মার্ক অমনি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেছে আর আমিও তাড়াহুড়ো করে আমার কাজ শেষ করেছি–অথচ তখন কিন্তু সকাল নটাও বাজেনি।
ডাক্তার রডারিখের বাড়ি গিয়ে দেখা করার কথা আমাদের। সেখান থেকেই কোচগাড়িগুলো পর-পর বেরুবে। সময়ানুবর্তিতার বদলে বেশ-একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি আমি, যখন গিয়ে পৌঁছুনো উচিত তার ঢের আগেই চলে এসেছি এবং তা দেখে কনে ফিক করে হেসেছে একটু। আমি গিয়ে তারপর বসেছি ড্রয়িংরুমে।
একের পর এক অতিথিরা আসতে শুরু করেছে, বিশেষ করে যারা রাজভবনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলো। সব্বাই, তখনও যেমন, আজকেও তেমন–যেন পাল্লা দিয়ে মাঞ্জা দিয়েছে। সামরিক বাহিনীর অফিসার দুজন ফিটফাট সেজে আছে পুরোপুরি সামরিক পোশাকে, পদক-ভূষণ সমেত।
মাইরা রডারিখ–তা মাইরা ভিদাল বললেই বা ক্ষতি কী এখন? যেহেতু বাগদত্তরা এখন রাজ্যপালের ফরমান-বলে চিরবন্ধনে আবদ্ধ–মাইরা, শুক্লবসনাসুন্দরী, হালকা ফিনফিনে রেশমি আঁচল বিছিয়ে আছে পেছনে, নারঙ্গি মুকুলও আছে যথারীতি, কোমরে ফুলের কটিহার, আর ঝলমলে সোনালি চুলে দারুণ মানিয়েছে বিয়ের মুকুটটিকে, তার তলা থেকেই মুখের ওপর বেছানো জালি-ওড়না। এই মুকুটটাই বাগানে কুড়িয়ে পেয়েছে বলে মার্ক তাকে এনে দিয়েছিলো–এটা ছাড়া আর-কোনো মুকুট সে পরবেই না। মায়ের, সঙ্গে মরালগতিতে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই সোজা সে আমার দিকে এসে তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি সেটা স্নেহভরে আমার হাতে টেনে নিয়ে ঝাঁকিয়েছি। তারপর, চোখ দুটো থেকে আলো ঝরে পড়ছে যেন, সে বলে উঠেছে : দাদা! কী-যে খুশি হয়েছি, কী বলবো!
এর আগে, এই বিয়ে নিয়েই, এই বাড়ির ওপর দিয়ে যে-ঝড় বয়ে গিয়েছে, এখন আর তার কোনো চিহ্নই নেই। শুধু কাপ্তেন হারালানই সব কথা মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি, কিন্তু সেও আমার হাতে হাত মিলিয়ে বলেছে, নাঃ, ও-সব বাজে ব্যাপারে আর মাথা ঘামানো ঠিক হবে না!
দিনের কাজের সূচি সকলেরই মনের মতো করে ঠিক করা হয়েছিলো। কাঁটায় কাটায় পৌনে দশটায় আমরা ক্যাথিড্রালের উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়বো, যেখানে স্বয়ং রাজ্যপাল শহরের অন্যান্য মান্যগণ্যদের নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন। বিয়ের জন্যে চার্চের খ্রিষ্টযাগ হবে, আর সন্ত মিখায়েলের সুরক্ষিত স্যাক্রিস্টিতে সঞ্চিত নথিসেরেস্তায় সই করা হবে-অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ইত্যাদি। তারপর ফিরে-আসা হবে মধ্যাহ্নভোজে-মোটমাট জনপঞ্চাশ নিকট-বন্ধু থাকবেন তাতে। সন্ধেবেলায় নৃত্যগীত, বল, আনন্দ-মজলিশ, তার জন্যে এরই মধ্যে দুশো নিমন্ত্রণপত্র বিলি হয়ে গেছে।
যাবার সময় কোচগুলিতে বসবার ব্যবস্থা ছিলো আগের দিনটারই মতন। ক্যাথিড্রাল থেকে ফেরবার সময় মার্ক আর মাইরা ভিদাল বসবে একই কোচবাক্সে–এবার তারা চিরকালের মতো যুগলবন্দী। অন্য কোচগাড়িগুলোয় আসবে বাকি সব লোক।
পৌনে দশটার সময় কোচগাড়িগুলো রডারিখ-ভবন থেকে বেরুলো। আবহাওয়া চমৎকার, সূর্য উঠে এসেছে অনেকটাই, ঝিরঝিরে হাওয়া পাঠিয়ে দিয়েছে দানিউব, প্রায় একটা শোভাযাত্রাই যেন চলেছে ক্যাথিড্রালের দিকে, রাস্তা থেকেও লোক এসে যোগ দিয়েছে। সবাই তাকিয়ে আছে সামনের কোচগাড়িটার দিকে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সবাই কনের দিকে, মার্কের প্রতিও কম তারিফের ভাব নেই। রাস্তার দু-পাশের খোলা জানলায় হাস্যোজ্জ্বল সব মুখ, চারপাশ থেকে আসছে অভিনন্দনের ধ্বনি–এত লোক যে ডাক্তার রডারিখদের গুণমুগ্ধ, এই শোভাযাত্রা না-দেখলে তা বিশ্বাস করা শক্ত হতো।
আমি আমার মনোভাব ধ্বনিতেই ব্যক্ত করেছিলুম : এই শহর থেকে আনন্দ স্মৃতি নিয়েই ফ্রাসে ফিরে যাবো দেখছি!
হাঙ্গেরীয়রা আপনাদের সম্মান দেখাবার চলে আসলে ফ্রান্সকেই সম্মান জানাচ্ছে, মঁসিয় ভিদাল, লিউটেনান্ট আর্মগাড় আমার কথা শুনে বলেছে, আর এই বিয়ে মারফৎ রডারিখ পরিবারে এখন যে একজন ফরাশি সদস্যও আছে, তাতেও তারা ভারি খুশি।
চকের সামনে পৌঁছুবামাত্র এত ভিড় জমে গেছে যে ঘোড়াগুলো শুধু আস্তে, দুলকি চালেই, এগুতে পেরেছে।
দূরে ক্যাথিড্রালের মিনার থেকে ঘণ্টার উল্লাস ফেটে পড়েছে, আর পুব-থেকে আসা হাওয়া সেই ধ্বনিই উড়িয়ে নিয়ে এসেছে এদিকে, আর ঠিক দশটার সময় প্রহরতোরণের সুমধুর প্রহরঘণ্টার সঙ্গে মিশেছে সন্ত মিখায়েলের ধ্বনিগম্ভীর গভীর নাদ। আর তার পাঁচ মিনিট পরে আমাদের কোচগাড়ি দুটো এসে থেমেছে সিঁড়ির সামনে, ক্যাথিড্রালের প্রধান দুয়ারের কবাটগুলো খোলা, আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে।
সবচেয়ে আগে নেমেছেন ডাক্তার রডারিখ, তারপর নেমেছে তার মেয়ে, নেমেই তার বাহু আঁকড়ে ধরেছে। মঁসিয় নয়মান তার বাহু বাড়িয়ে দিয়েছেন মাদাম রডারিখের দিকে, তারপর গিয়েছি আমরা, মার্কের পেছন-পেছন, দর্শকদের সারির মধ্য দিয়ে, আর সেই মুহূর্তেই ক্যাথিড্রালের বিশাল অর্গানটা বেজে উঠেছে, আর সেই ধ্বনিমহিমার মধ্যেই শোভাযাত্রা ঢুকেছে সেই পবিত্র খ্রিষ্টমন্দিরে।
উঁচু বেদিটার সামনেই দুটো চেয়ার পাশাপাশি পাতা, মার্ক আর মাইরা এগিয়ে গেছে তাদেরই দিকে। তাদের পেছনে কনের বাবা-মা এবং সাক্ষীরা গিয়ে যে-যার নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়েছে।
অগুনতি অভ্যগত এরই মধ্যে ভরিয়ে ফেলেছে সারি-সারি আসনগুলো : রাগৎস এর রাজ্যপাল ধর্মাধিকরণের বিচারপতিরা, দুর্গের সমস্ত উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার, শাসনব্যবস্থায় যাঁদেরই একটু প্রতাপ আছে তাঁদের সবাই, স্বজনবন্ধু, এবং তাদের সকলের শেষে ব্যাবসাবাণিজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। মহিলাদের জন্যে ভিন্ন ব্যবস্থা ছিলো বসবার, সেখানে একটাও আসন শূন্য ছিলো না-ঝলমলে সাজপোশাকে সেখানে যেন প্রজাপতির হাট বসে গিয়েছিলো।
আর শহরের অন্য লোকেরা? তারা যেন উপচে পড়েছিলো চার্চ ছাপিয়ে, যে যেখানে পেরেছে কোনোরকমে কোনো আসনে বসে পড়েছিলো–কিন্তু তাছাড়াও কত লোক যে ভেতরে ঢুকতে পারেনি, তারা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, সিঁড়িতে।
এই জমায়েতের যদি কয়েকজন লোকেরও মনে থেকে থাকে কিছুদিন আগে সে কোন তাজ্জব ভেলকির খেলা শহরটাতে আলোড়ন তুলেছিলা, তারা কি তবু ভাবতে পেরেছিলো যে ক্যাথিড্রালেও তার কোনো পুনরাবৃত্তি হবে? নিশ্চয়ই না, কারণ লোকে তখন ভেবেছিলো সে-সব পিশাচসিদ্ধ কারু কাজ, শয়তানের কোনো চেলার; সাধ্য কী যে সে ফের এই দিব্যভূমি চার্চে এসে কোনো গোল পাকায়? শয়তানের সব জারিজুরি কি চার্চের চৌকাঠেই খতম হয়ে যায় না!
গায়কদের সারির ডান দিক থেকে এসেছেন প্রধান যাজক, এবং তারপর তার সহযোগীরা–পদমর্যাদা অনুযায়ী পর-পর, সব-শেষে শিশুগায়কদের দল।
যা-কিছু মহিমা আছে আনুষ্ঠানিক খ্রিষ্টযাগের কিছু বাদ যায়নি, আবারও নতুন করে উঁচু পর্দায় বেজেছে কিরিয়ে ইলাইসন আর গ্লোরিয়া।
তারপর যেই ঘণ্টা বেজেছে সুগম্ভীর, আস্ত জমায়েৎ উঠে দাঁড়িয়েছে, যাজক গেয়ে শুনিয়েছেন মথি লিখিত সুসমাচার; তারপর প্রধানযাজক, মার্ক আর মাইরার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সরাসরি ভাবগম্ভীর ভঙ্গিতে, তাদের উদ্দেশ করে তার কথা বলেছেন। তার গলা তেমন জোরালো ছিলো না। পকেশ লোলচর্ম কোনো বৃদ্ধের গলা সেটা, কিন্তু যা বলেছেন তা এমন সহজসরল ও শাদাসিধে যে তা যেন সরাসরি গিয়ে মাইরার অন্তর স্পর্শ করেছিলো। তিনি গুণকীর্তন করেছেন তার সন্ত্রান্ত বংশের, বলেছেন বংশানুক্রমিকভাবে কীভাবে এই পরিবার আর্ত ও দুঃস্থের সেবা করে এসেছে। তিনি আশীর্বাদ করেছেন এই বিবাহবন্ধনকে–যা কোনো ফরাশির সঙ্গে কোনো হাঙ্গেরীয়কে বাঁধবে আত্মীয়তার সূত্রে, তারপর প্রার্থনা করেছেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
মার্ক আর মাইরা তাদের আসন ছেড়ে উঠে বেদির পইঠার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর, চুম্বন করেছে পরম্পরকে, চুম্বন করেছে খ্রিষ্টের নৈশভোজের রুটি রাখার রেকাবিকে, তারপর আর ফিরে এসে বসেছে যে যার আসনে। মাইরাকে এমন ঝলমলে সুন্দরী–না, এর আগে আর-কখনোই দেখায়নি, আর সেই রূপকে ঘিরে যেন জ্যোতির্বলয়ের মতো ছটা ছড়াচ্ছিলো কোনো সুখস্বপ্ন।
প্রধানযাজক তারপর তার দুজন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে এসেছেন মার্ক আর মাইরার দিকে।
সব স্তব্ধ তখন, আর তারই মধ্যে শোনা গেছে তার কম্পিত, দুর্বল কণ্ঠস্বর : মার্ক ভিদাল, তুমি কি মাইরা রডারিখকে তোমার বৈধ পত্নী রূপে গ্রহণ করতে রাজি আছো?
হ্যাঁ।
মাইরা রডারিখ, তুমি কি মার্ক ভিদালকে তোমার বৈধ পতি রূপে গ্রহণ করতে রাজি আছো?
হ্যাঁ। মাইরার গলাটা যেন স্নিগ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস।
আধ্যাত্মিক সংস্কারের প্রথাবিহিত কথাগুলো বলবার আগে প্রধানযাজক মার্কের কাছ থেকে বিয়ের আংটি দুটো নিয়ে তাদের আশিস করেছেন, তারপর একটু ঝুঁকে নববধুর অনামিকায় পরাতে গেছেন সেই আংটি…
আর অমনি… অমনি সারা চার্চ কাঁপিয়ে শোনা গেছে এক আর্তনাদ, দারুণ দুঃখে ফেটে-পড়া।
আর আমি যা তখন নিজের চোখে দেখেছি, আরো হাজার জনও তা বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখেছে। যাজকের সহকারীদের কেউ যেন ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে, টালমাটাল হটিয়ে দিচ্ছে–যেন ভয়ংকর কোনো শক্তি হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে কোন অন্ধকার থেকে; প্রধানযাজক-তার ঠোঁট দুটো থরথর কাঁপছে-তার মুখে নিদারুণ যাতনার ছাপ, চোখে দুর্নিবার আতঙ্ক–যেন কোনো অদৃশ্য পিশাচের সঙ্গে যুঝতে-যুঝতে শেষটায় দুমড়ে পড়ে গেছেন হাঁটু মুড়ে…
তারপরেই, বিদ্যুৎবেগে, চকিতের মধ্যে ঘটনাগুলো ঘটে গেলো, কেউ যে গিয়ে বাধা দেবে তারও যেন অবসর হয়নি, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে সবাই, যেন চোখের সামনে যা ঘটে যাচ্ছে তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না, বুঝতেও পারছে না। আদপেই : কেউ যেন শূন্য থেকে আছাড় মেরে ছুঁড়ে ফেলেছে মার্ক আর মাইরাকে, ঐ বেদির সামনেটায়…..
তারপর কুলুঙ্গির ওপর দিকে শূন্যে ছুটেছে আংটি দুটো, একটা আবার আমার নাকে প্রচণ্ড একটা ঘুষির মতো পড়েছে…
আর সেই মুহূর্তে আমি শুনেছি, এবং আমার সঙ্গে-সঙ্গে সমবেত হাজার জনেও শুনেছে, কার যেন চোয়াড়ে ভয়ংকর গলা থেকে বিকট চীৎকারে বেরিয়ে আসছে এই কথা ক-টি-সে-কার গলা, তা আমরা সবাই জানি, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর গলা :
অভিশপ্ত হোক নবদম্পতি-অভিশপ্ত!
যেন লণ্ডভণ্ড ঘরের মধ্যেই চীৎকার করে সে এই অভিশাপ দিচ্ছে; আর এই অভিশাপের সঙ্গে-সঙ্গে যেন কাছেই, জনতার মধ্য থেকে, প্রচণ্ড আতঙ্কের ধ্বনি উঠেছে। তারপরেই এক নিদারুণ আওয়াজ! এক বুকভাঙা আর্তনাদ! মাইরা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছিলো মেঝে থেকে, এক বুকফাটা চীৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়েছে আতঙ্কিত মার্কের দু-বাহুর মাঝে!
.
এয়োদশ পরিচ্ছেদ
ক্যাথিড্রালে যে-অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা ঘটেছে, রডারিখ-ভবনে যে-আজব ঘটনা ঘটেছিলো, দুয়েরই উদ্দেশ্য ছিলো এক। তাদের উৎসও ছিলো এক। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস, শুধু ভিলহেল্ম স্টোরিৎসই এই তুলকালাম হুলুস্থুলের জন্যে দায়ী। হাতসাফাই? ম্যাজিক? জাদুবিদ্যা? ভেলকির খেলা?… এর উত্তর হবে একটাই : না। ক্যাথিড্রালে কেলেঙ্কারি বা মুকুট নিয়ে মোক্ষম মার–কোনোটাকেই নিছক কারু হাতের কৌশল বলা যাবে না। মামুলি ম্যাজিক কখনও এমনতর হয় না।
এই জার্মানটি নিশ্চয়ই তার বাবার কাছ থেকে কোনো গোপন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পেয়েছে, হয়তো আবিষ্কার করেছে এমন-কোনো সূত্র বা সংকেত, যার মারফৎ সে নিজেকে ইচ্ছেমতো অদৃশ্য করে ফেলতে পারে।… আর, তা, অসম্ভবই বা হবে কেন? …এমন-কতগুলো রশ্মি তত থাকতেই পারে যা অনচ্ছ-কিছুর মধ্যে দিয়ে বয়ে যেতে পারে, যেন সেগুলো স্বভাবস্বচ্ছ কোনো পদার্থ?… কিন্তু না, আমার ভাবনারা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।… অদৃশ্য মানুষ! বাজে কথা! আজগুবি! এমন-একটা আজগুবি, যে কাউকে সে-কথা বললেই সে ভাববে যে এ-সব আজব কাণ্ড দেখে আমার মাথাটাই, বুঝি বিগড়ে গেছে!
মাইরাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তখনও তার জ্ঞান ফেরেনি; তাকে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়া হয়েছে তার বিছানায়, কিন্তু সমস্ত সেবাযত্নই ব্যর্থ হয়েছে, সে পড়ে থেকেছে হতচেতন, অবশাঙ্গ, ডাক্তার রডারিখের সমস্ত চেষ্টা সত্ত্বেও তার আর জ্ঞান ফেরেনি। অথচ তার নিশ্বাস পড়ছে কিন্তু, সে এখনও বেঁচেই আছে। আমার বরং এই ভেবেই অবাক লাগছে যে পর-পর এতসব বিপর্যয়ের পরেও, বিশেষত ক্যাথিড্রালের এই কেলেঙ্কারির পরেও, সে-যে মরে যায়নি, এটাই বরং ভারি আশ্চর্য।
ডাক্তার রডারিখের বিস্তর বন্ধু ও সহব্যবসায়ীরা তাকে সাহায্য করবার জন্যে তক্ষুনি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাইরার বিছানাটা ঘিরে চারপাশে দাঁড়িয়ে থেকেছেন তারা : সে পড়ে আছে অনড়, নিশ্চল, নিমীলিতনয়ন, মুখটা যেন মোমের মতো রক্তহীন, হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত স্পন্দনের তালে-তালে ক্ষীণভাবে বুকটা উঠছে-নামছে, নিশ্বাস পড়ছে ক্ষীণ-অতি মৃদু-দীর্ঘশ্বাসের মতো–যা থেকে প্রতিমুহূর্তেই কেউ যেন নিংড়ে বার করে দিচ্ছে প্রাণশক্তি!
মার্ক তার পাশেই আছে, তার হাত ধরে। কাঁদছে সে, ধরাগলায় বারেবারে ডেকেছে তাকে : মাইরা, চোখ মেল, তাকিয়ে দ্যাখ, এই-যে, আমি তোর মা?
মাইরার মুদিতনয়ন মুদিতই থেকেছে। কারু ডাকই যেন সে শুনতে পায়নি।
চিকিৎসকেরা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন, একবার মনেও হয়েছিলো–এই বুঝি জ্ঞান ফিরে এলো… অস্ফুট স্বরে কী যেন বলেছিলো সে বিড়বিড় করে, এমনই জড়ানো ছিলো কথাগুলো যে কিছুই বোঝা যায়নি, তার আঙুলগুলো থরথর করে একটু কেঁপেছে মার্কের মুঠোয়, তার চোখের পাতা বুঝি একটুখানি খুলেছে। কিন্তু কী-যে ফাঁকা দৃষ্টি ঐ আয়ো নিমীলিত নয়নে, কী-যে অদ্ভুত-কাঁপা নীরব অর্থহীন দৃষ্টি!
মার্ক বুঝি বুঝতে পেরেছে কী সেটা! হঠাৎ সে চমকে পেছিয়ে এসে আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছে :
পাগল! পাগল! একেবারে পাগলের দৃষ্টি।
মার্কের দিকে ছুটে গিয়েছি আমি, ভেবেছি এও কি আবার নিজের মাথাটা খেয়ে বসেছে নাকি? এ-ঘরে ডাক্তারেরা একটা বিষম সংকট নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন–এমন এক সংকট যে মাইরার জীবনটাই এখন বিষম সংশয়ে আছে। সেখানে মার্কের এই আর্ত ডুকরানি! তাকে তক্ষুনি পাশের একটা ঘরে নিয়ে যেতে হলো।
কীভাবে শেষ হবে এই পালার? শোচনীয়? বিয়োগান্ত? আমরা কি দুঃসাহসে ভর করে এই আশাটা করতে পারবো যে মাইরা আবার তার কাণ্ডজ্ঞান ফিরে পাবে; যে, সেবাযত্ন শেষটায় তার বুদ্ধিভ্রংশতা সারিয়ে তুলবে; যে, এ নেহাৎই একটা সাময়িক উন্মত্ততা?
একবার কাপ্তেন হারালান আমাদের সঙ্গে একটু একা হতেই বলেছে :যে-করেই। হোক এই পৈশাচিক ব্যাপারটায় একটা ইতি টানতে হবে!
ইতি টানতে হবে? কী বলতে চাচ্ছে সে? যে, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস ফের রাগৎস ফিরে এসেছে; যে, সে-ই এই অনাচারের জন্যে দায়ী; যে, আমাদের মধ্যে এ নিয়ে এখন আর-কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে আমরা পাবো কোথায়? কেমন করে পাকড়াবো ধরাছোঁয়ার-বাইরেকার এই মানুষটাকে?
আর গোটা শহরটার ওপরই বা এই ভ্রষ্টাচারের প্রভাব কী হয়েছে? লোকে কি এ-সব ব্যাপারের কোনো সাধারণ-না, সাধারণ নয়, তবে স্বাভাবিক–ব্যাখ্যা মেনে নেবে? আমরা তো আর ফ্রাসে নেই এখানে, যেখানে হয়তো এ-সব ব্যাপার হাসিঠাট্টার বিষয় হয়ে উঠতো, হাসির গান গেয়ে যেখানে লোকে একে বিদ্রূপ করতো। এই দেশে–হাঙ্গেরিতে–সব বিষয়ই তো অন্যরকম।
মাগিয়ারদের মধ্যে যে অলৌকিকের প্রতি একটু বিশেষ প্রীতি আছে, সেটা তো আমি আগেই বলেছি। তাদের কুসংস্কার–বিশেষত অশিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে–প্রায় অনপনেয়। অত্যন্ত শিক্ষিত লোকদের হয়তো বোঝানো যেতে পারে যে এ-সব কোনো ভৌতবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা বা রসায়নিক শাস্ত্রে বিশেষ-গবেষণালব্ধ জ্ঞান। কিন্তু যখন অনালোকিত মনের কথা ভাবা যায়, তখন পদার্থবিদ্যা নয়, অপবিদ্যাই প্রধান হয়ে ওঠে, সব হয়ে ওঠে শয়তানের চেলার কীর্তি, প্রেতসিদ্ধ পিশাচসিদ্ধ কারু কেরামতি, আর ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে তারা বীলজেবাবের চেলা নয়, খোদ শয়তানেরই প্রতিমূর্তি বলে ভাববে।
তাছাড়া রাগৎস-এর রাজ্যপাল যে-বিদেশীর বহিষ্কারের জন্যে ফরমান জারি করেছেন, সে-যে এই অসহ্য ও অপার্থিব ঘটনাগুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত, এ-তথ্য আমরা এখন আর লুকোবো কী করে? এতদিন আমরা অনেক করে সযত্নে যে-সব ব্যাপার চাপা দিয়ে রেখেছি, সন্ত মিখায়েলের ক্যাথিড্রালে এই বিষম কেলেঙ্কারির পর, সে-সব এখন আর অস্পষ্ট আবছায়ায় ঢেকে রাখা যাবে না।
পরদিন থেকে তুমুল এক হুলুস্থুলু উঠে গেলো শহরে। রডারিখ-ভবনে আগে যা যা হয়েছিলো, তার সঙ্গে এবার ক্যাথিড্রালের ঘটনাকে জড়িয়ে নিলে লোকে। লোকের মধ্যে যে-শান্তসুস্থির ভাবটা নেমেছিলো, এবার তা নতুন শোরগোলে উবে গেলো। প্রত্যেক বাড়িতে, প্রতিটি পরিবারে, যখনই কেউ ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর নাম করে, অমনি এ-সব বিদঘুঁটে উদ্ভট ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি জেগে ওঠে, অথবা যেন এই অদ্ভুত লোকটা-লোক? না পিশাচ?যে তার আস্ত জীবনটাই বুলভার তেকেলির ঐ হানাবাড়ির বদ্ধ জানালা আর স্তব্ধ দেয়ালের মধ্যে কাটিয়েছে, সবসময় সে যেন লোকের ঘাড়ে তার ফেস-ফোঁস নিশ্বাস ফ্যালে। কাজেই এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই যে সব ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবার পর গোটা শহরের লোকজন গিয়ে ভিড় করেছে বুলভারে, তারা নিজেরাও বুঝিয়ে বলতে পারবে না সে-কোন্ অপ্রতিরোধ্য শক্তি তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেছে সেখানে।
এমনিভাবেই দলে-দলে লোক গিয়ে ভিড় করেছিলো প্রেমবার্গের কবরখানায়, সেখানে অবশ্য এই প্রেতসাধকের (?) বিজ্ঞানসাধকের (?) দেশবাসী আশা করেছিলো নিজের চোখে তাকিয়ে দেখবে কোনো অবিশ্বাস্য উদ্ভট ঘটনা-কোনো শত্রুতার ভাবই তাদের সেখানে তাড়িয়ে নিয়ে যায়নি। এখানে, ঠিক তার উলটো : তুলকালাম প্রকাশ পেয়েছে রি-রি ঘৃণা, প্রতিহিংসার বোধ–কোনো গণশত্রুর যা প্রাপ্য। আর এও ভুললে চলবে না ধর্মপ্রাণ লোকেরা ক্যাথিড্রালে এই কেলেঙ্কারি দেখে কী-সাংঘাতিক বিহ্বল হয়ে পড়েছে। এই অতি-উত্তেজনা শুধু যে বেড়েই চলবে তাতে কোনো সন্দেহই নেই: বেশির ভাগ লোকই এই দুর্বোধ্য প্রহেলিকার কোনো স্বাভাবিক ব্যাখ্যা যে থাকতে পারে, তা বিশ্বাসই করবে না।
রাগৎস-এর রাজ্যপালকে আবার গোটা শহরের মনের ভাবটাকেও হিশেবে ধরতে হয়েছে; পরিস্থিতি যেমন-যেমন দাবি করবে, পুলিশ যেন তক্ষুনি তেমন-তেমন ব্যবস্থা নেয়–এই মর্মে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন মঁসিয় স্টেপার্ককে। লোকে ভয় পেয়ে যখন দেয়ালে গিয়ে পিঠ ঠেকায়, তখন যে কী ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, সে-সম্বন্ধে তাকে শুধু সচেতন থাকলেই চলবে না, অবস্থাটা যাতে আয়ত্তের বাইরে চলে না-যায় তারও ব্যবস্থা করতে হবে। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস নামটা উচ্চারণ করতে যতক্ষণ সময় লাগে, তার মধ্যেই লোকে গিয়ে তছনছ করে আসতে পারে বুলভার তেকেলির ঐ বাড়ি–তারা লুঠতরাজ শুরু করতে পারে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইতে পারে বাড়িটা–আর রাজ্যপাল হিশেবে তার দায়িত্ব কিছুতেই যাতে শহরের শান্তিশৃঙ্খলা ভেঙে না পড়ে সে বিষয়ে নজর রাখা। এদিকে আমি কিছুতেই মন থেকে আমার ধারণাগুলো তাড়াতে পারিনি, বরং সেগুলো যেন ক্রমেই দানা বাঁধছে। আগে যে-অনুমানটাকে উদ্ভট বলে ঝেড়ে ফেলেছিলুম, এখন সেই ধারণাটাকে নিয়েই গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছি। আমি। যদি এই অনুমানটা নিছকই জল্পনা না-হয়, যদি কোনো লোক নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলবার কোনো সূত্র আয়ত্ত করে থাকে, তাহলে লোকের স্বস্তি যাবে, শান্তি যাবে, শহরটা একটা আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলার ডিপো হয়ে উঠবে। আমার মনে পড়ে গেছে প্লাতো-র প্রজাতন্ত্রর সেই কাহন, যেখানে গাইগেস নামে এক রাখাল এক দৈত্যের কবরখানায় এমন-একটা আংটি পেয়ে গিয়েছিলো, যেটা একটু বিশেষভাবে ঘোরালে সে অদৃশ্য হয়ে যেতো; সেটাকে কাজে খাঁটিয়েই সে রাজা কানদাউলের রাজসভায় গিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার সব ক্ষমতা দখল করে বসেছিলো। সেই গ্রীক উপকথাই যদি আজ সত্যি হয়ে যায়, তবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বলে কারু আর-কিছু থাকবে না।
ভিলহেল্ম স্টোরিৎস রাগৎস-এ ফিরে এসেছে, অথচ কেউ তাকে চর্মচক্ষে দ্যাখেনি; সে-যে এখানে আছে-অথবা নেই–এটা কেউ কী করে বুঝবে, যদি তাকে চোখেই দেখা না-যায়! তাছাড়া, এই আবিষ্কারটা সম্ভবত তার বাবার, কিন্তু সে কি সূত্রটা গোপন রেখেছে নিজের কাছে? তার কাজের লোক হেরমানও কি ওভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে? অন্যরাও কি পারবে? নিজেদের সুবধের জন্যে–কিংবা ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকেই মদত দেবার জন্যে? ইচ্ছেমতো লোকের বাড়িতে তখন ঢুকে-পড়া যাবে–শুধু তা-ই নয়, অন্য লোকের জীবনকেও চালানো যাবে অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে। লোকের কি কোনো ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকবে তখন, কোনো আপন কথা? নিজের বাড়িতে শুয়ে বসেও কি কেউ নিশ্চিত হতে পারবে যে, ঘাড়ের ওপর থেকে কেউ তার ওপর সারাক্ষণ নজর রেখে যাচ্ছে না? শুনছে না সব মনের কথা? একেবারে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে মিশে না-গেলে কে কী করছে না-করছে, তা সব ফাঁস হয়ে যাবে। আর রাস্তায়–সারাক্ষণ এই-যে ভয় কেউ-একজন অদৃশ্য পেছন-পেছন আসছে, যে তোমাকে কিছুতেই তোমাকে নজর থেকে সরে যেতে দেবে না, যে তোমাকে নিয়ে যা-খুশি তা-ই করতে পারবে, সে-ভয়টার বিরুদ্ধেই বা কেউ লড়বে কী করে? বেড়াল যখন ইঁদুরকে নিয়ে খেলে, তখন ইঁদুর তাকে দেখতে পায়–কিন্তু ভাবো এমন ইঁদুরের কথা, যে বেড়ালটাকে দেখতে পাচ্ছে না, অথচ বেড়ালটা সারাক্ষণই পাশে-পাশে আছে! কী করে লোকে আত্মরক্ষা করবে, অদৃশ্যের এই হামলার কাছ থেকে? তা কি কিছুদিনের মধ্যেই সমাজজীবনের সমূহ সর্বনাশ করে দেবে না?
তারপরেই আমার মনে পড়ে গেছে, কাপ্তেন হারালান আর আমি সেদিন গঞ্জের বাজারে কী দেখেছিলুম : একটা লোককে কে যেন (অদৃশ্য মানুষ?) ভীষণ জোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে পেড়ে ফেলেছে। এখন তো আর সন্দেহ নেই যে সে-যে অদৃশ্য হামলার কথা বলেছিলো, সেটা ঠিকই বলেছিলো। সত্যিই তাকে কেউ ধাক্কা দিয়েছিলো। কে সে? ভিলহেল্ম স্টোরিৎস, নাকি হেরমান, না কি অন্য-কেউ!
আরো-সব খুঁটিনাটি ভিড় করে এসেছে আমার স্মৃতিতে। ক্যাথিড্রালের গা থেকে উপড়ে ছিঁড়ে-ফেলা সেই বিজ্ঞপ্তি, আর বুলভার তেকেলিতে আমরা যখন খানাতল্লাশ চালাচ্ছি, সেই-যে বিভিন্ন ঘরে আমরা পায়ের আওয়াজ শুনেছি, সেই-যে শিশিটা ছোঁবার আগেইপড়ে গিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিলো। হা-হা, আর-কোনো সন্দেহই নেই : উনপাঁজুরে হতচ্ছাড়াটা সেখানেই ছিলো তখন, হয়তো তার হেরমানও ছিলো তার সঙ্গে। আমরা যে ভেবেছিলুম সে শহর ছেড়ে চম্পট দিয়েছে, সেটা ভুল ভেবেছিলুম। কেননা শুধু তাতেই ব্যাখ্যা করা যায় গামলার মধ্যে সাবানজল, রান্নাঘরের উনুনে জ্বলন্ত অঙ্গার। … হা-হা, তারা দুজনেই অদৃশ্য থেকে মজা দেখাচ্ছিলো, যখন আমরা পাঁতিপাঁতি করে খুঁজছিলুম বাগান, লন, উঠোন, বাড়ির মধ্যেটা। যদি বিয়ের মুকুটটা সেদিন মিনারের পাখির বাসায় আমরা পেয়ে থাকি, তবে তা শুধু এইজন্যেই যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এই অতর্কিত হামলায় তখন আর সময়ই পায়নি সেটাকে নিয়ে চলে যাবার। আর, আমি তো এও জানি, যখন ডরোথি জাহাজে করে দানিউব দিয়ে আসছিলুম তখন যে-সব রহস্যময় ঘটনা ঘটেছিলো, আজও সে-সবের কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। যে-যাত্রীকে ভেবেছিলুম তীরে নেমে গেছে, সে তবে পাশেই ছিলো আমাদের, অথচ কেউই তাকে দেখতে পায়নি।
কাজেই, নিজেকে আমি বারেবারে ভজিয়েছি, সে জানে কেমন করে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে হয়। ইচ্ছেমতো সে আবির্ভূত হতে পারে, কিংবা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, যেন সে জাদুদণ্ড হাতে কোনো ওস্তাদ জাদুগর, তবে সে যদিও যে পোশাক পড়ে আছে তাকে অদৃশ্য করে দিতে পারে, হাতে-ধরা কোনোকিছু কিন্তু সে এখনও হাওয়া করে দিতে পারে না–দেখেছি তো কী করে কুচিকুচি করে ছিঁড়েছিলো বিয়ের হলফনামা, ফুলের ঐ তোড়া, কী করে সকলের চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো বিয়ের মুকুট, কিংবা ছুঁড়ে-ছুঁড়ে মেরেছিলো বিয়ের আংটিগুলো, ক্যাথিড্রালে।
অথচ এ-কোনো ভেলকিবাজি নয়, নয় কোনো গুহ্য মন্ত্রতন্ত্রের ব্যাপার, নয় কোনো বাজিকরের চিচিংফাঁক, অথবা পিশাচসাধনা। বাস্তব তথ্যগুলো কী, সেগুলোই বরং খতিয়ে দেখা যাক। ভিলহেল্ম স্টোরিংস নিশ্চয়ই এমন-কোনো রাসায়নিকের সূত্র জেনেছে, যা পান করলেই অদৃশ্য হয়ে-যাওয়া যায়… কোন-সে রাসায়নিক পানীয়? নিশ্চয়ই ঐ শিশির মধ্যে যা ছিলো, যেটা ভেঙে-যাবামাত্র ভাপ হয়ে উঠে গিয়েছিলো। কোন সূত্র, কোন ফর্মুলা ব্যবহার করে এই রাসায়নিক পানীয় বানায়, তা আমরা এখনও জানি না–কিন্তু সেটা আমাদের এক্ষুনি জানা উচিত; যদিও-খুবই-সম্ভব যে সেটা আমরা কোনোদিনই জানতে পাবো না!…।
আর খোদ ভিলহেল্ম স্টোরিৎস? এখন যখন সে অদৃশ্য মানুষ, তাকে পাকড়ানো কি একেবারেই অসম্ভব? সে দৃষ্টির অগোচর হতে পারে, কিন্তু স্পর্শেরও কি অগোচর? ধরাছোঁয়ার বাইরে? যে-ত্রিরায়তনিক কাঠামো থাকে মানুষের, সেই তিনটি আয়তন তো আর সে হারায়নি-হারায়নি তার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ। এখনও সে আছে তার ঐ শরীর নিয়ে, রক্তমাংসে-সশরীর। অদৃশ্য বটে, তবে স্পর্শাতীত নয়। সে হয়তো ভূতপ্রেতপিশাচের বেলায় খাটে, কিন্তু আমরা তো আর কোনো ভূতপ্রেত নিয়ে কারবার করছি না! যদি কোনো সুযোগে একবার পাকড়ে ফেলা যায় তার ঠ্যাং, কিংবা হাতদুটোই, কিংবা যদি বাছাধনের মাথাটাই চেপে-ধরা যায়, অন্তত আমরা তার গায়ে প্রাণপণে লেপটে থাকতে পারবো তো! আর যতই চমকপ্রদ কারসাজি সে জানুক না কেন, কোনো জেলখানার দেয়াল ফুঁড়ে বেরুবে সে কী করে!
আমি তো কেবল ভেবেছিই কথাগুলো, মোটামুটি গ্রাহ্য করার মতোই অনুমান, প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি যা-হলে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু পরিস্থিতি তাই বলে কম গুরুতর নয়, একটা বদখত অবস্থায় বেশামাল আছি আমরা, গোটা নিরাপত্তারই গেছে! এখন থেকে শুধু এক ভয়াবহ বিপদের মধ্যেই থাকতে হবে আমাদের। আর-ককখনো আমরা নিজেদের নিরাপদ বলে ভাবতে পারবো না-না-ঘরে, না-বাইরে, দিনে বা রাত্রে কখনোই নয়। কোথায় কোন ঘরে একটু মৃদু আওয়াজ উঠলো, মেঝের নড়বোড়ে কাঠ কাঁচকেঁচ করে উঠলো, হাওয়ায় নড়ে গেলো জানলার খড়খড়ি, কিংবা জোরে ঘুরপাক খেলো ছাতের ওপর হাওয়ামোরগ, কানে শুনতে পেলুম ঝিঁঝির ডাক, দরজার ফোকর দিয়ে বয়ে গেলো শোঁ-শোঁ হাওয়া–আর অমনি আমরা আঁৎকে উঠবো। সারা পৃথিবীটাই যেন সন্দেহে গিজগিজ করছে। প্রতিদিনকার জীবনযাপন, খাবার সময়ে টেবিল, সন্ধের সময় আড্ডা, রাত্তিরবেলায় ঘুম–যদি ধরেও নেয়া যায় মনের এই তীব্র অশান্তির মধ্যে ঘুম সম্ভবআমরা কিছুতেই নিঃসন্দেহ হয়ে জানতে পাবো না কোনো অনাহুত আগন্তুক আছে কি না বাড়ির মধ্যে, জানতে পারবো না ভিলহেল্ম স্টোরিৎস অথবা তার কোনো অনুচর সারাক্ষণ নজর রেখে যাচ্ছে কি না–আমরা কী করছি, কী বলছি, কী মৎলব আঁটছি–সব জেনে ফেলছে কি না, এমনকী ঢুকে পড়েছে কি না দেরাজে, যেখানে লুকোনো আছে গোটা-কয়েক পারিবারিক কঙ্কাল, গোপন-সব কাশুন্দি।
এই জার্মান হয়তো রাগস ছেড়ে এতক্ষণে প্রেমবার্গেই চলে গিয়েছে। কিন্তু ডাক্তার রডারিখ ও কাপ্তেন হারালান, স্বয়ং রাজ্যপাল ও পুলিশের বডোকর্তা–সকলের সঙ্গে আলোচনা করে এটাই বুঝেছি, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যে আরো-কিছু জঘন্য মৎলব এঁটে বসে সেগুলো করবে বলে সারাক্ষণ তাকে-তাকে বসে নেই, এটা কী করে জানা যাবে? রাজ্যপাল যখন বিয়ের অনুমোদন দিয়েছিলেন, তখন যে সে কোনো বিদঘুঁটে কাণ্ড করে বসেনি, সে-তো নিশ্চয়ই এই কারণেই যে সে তখনও প্রেমবার্গ থেকে ফিরে আসেনি। কিন্তু বিয়ের আসল অনুষ্ঠানটায় সে বিচ্ছিরি নাটুকেপনা করে বাগড়া দিয়েছে। মাইরা যদি সেরেও যায়, সে কি আবারও বিয়েটা ভণ্ডুল করে দিতে চাইবে না? ডাক্তার রডারিখের প্রতি যে-বিজাতীয় ঘৃণা সে প্রকাশ করেছে, সে-তো আর তার কোনো হার্দ্য পরিবর্তনে মৈত্রীতে বদলে যায়নি–সে বরং আরো-কোনো নারকীয় মৎলব হয়তো এঁটে বসে আছে, যাতে ডাক্তারের জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে? যে-বাজখাঁই গলায় সেদিন সে অভিসম্পাত দিয়েছে ক্যাথিড্রালে, তা-ই কি বোঝায় না যে সে একটা হেস্তনেস্ত না-করে ছাড়বে না? না-না, ব্যাপারটা আদপেই এখনও শেষ হয়ে যায়নি, আর যখন মনে পড়ে যায় প্রতিশোধ নেবার জন্যে যে কী-আশ্চর্য সুযোগ আছে তার দখলে, তখন যে-কোনোকিছু থেকেই নতুন-কোনো আপদ এসে হাজির হতে পারে! ডাক্তার রডারিখের বাড়িতে যদিও চব্বিশ ঘণ্টাই পাহারা আছে এখন–তবু তার পক্ষে ভেতরে ঢুকে যেতে অসুবিধে কোথায়? আর একবার ভেতরে যেতে পারলে সে-যে কী করবে, তা স্বয়ং বীলজেবাবও জানে কি না সন্দেহ।
এই থেকেই বোঝা যাবে আতঙ্কটা কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। কুসংস্কারে বিশ্বাস করলে তো কথাই নেই, কিন্তু তথ্যে আস্থা রেখেও কি কেউ আশঙ্কা থেকে রেহাই পাবে? তাছাড়া, সত্যি-তো, তাকে ঠেকাবার উপায়টাই বা কী? কীসে মুশকিল আসান? আমি তো কবুলই করছি যে আমার মাথায় কোনো ফন্দি আসছে না। মার্ক আর মাইরা যদি এখান থেকে চলেও যায় তাতেও অবস্থার একচুলও তারতম্য হবে না। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস কি আর তাদের সহজেই অনুসরণ করে যেতে পারবে না? তাছাড়া, মাইরার শরীরের এখন যে-হাল, তাতে রাগৎস ছেড়ে চলে যাবার কোনো কথাই ওঠে না!
আর কোনখানেই বা আছে সে এখন, আমাদের এই বেপরোয়া ও অধরা দুশমন? যদি-না পর-পর এ-সব বিদঘুঁটে ঘটনা ঘটে যেতো, আঘাতের পর আঘাত হেনে, তাহলে হয়তো কারু পক্ষেই এটা নিশ্চয় করে বলা সম্ভব হতো না যে সে এখনও তাদের মধ্যেই আছে, অসহ স্পর্ধায় দম্ভে সে যাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে, আতঙ্কে যাদের সে প্রায় জবুথবু ও অকর্মণ্য করে তুলতে পারে!
এ-সব ঘটনার প্রথমটা আমাদের হতচকিত দশাকে যেন নিরাশার শেষসীমায় নিয়ে গিয়েছিলো। সন্ত মিখায়েলের ক্যাথিড্রালের ঐ বিপর্যয়ের পর দু-দুটো দিন কেটে গিয়েছে অথচ মাইরা বেচারির অবস্থার কোনোই উন্নতি হয়নি–এখনও তার সুস্থবুদ্ধি ফিরে আসেনি, এখনও সে শুয়ে আছে বিছানায়, এখনও জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দুলছে তার প্রাণ।
চৌঠা জুন, মধ্যাহ্নভোজনের পর, রডারিখ পরিবারের সবাই,-তার মধ্যে মার্কও আছে, আমিও আছি,-বসে আছি গ্যালারিতে, উত্তেজিতভাবে আলোচনা করছি কীভাবে এই বীলজেবাবের চেলাকে জব্দ করা যায়, এমন সময়ে সত্যিকার একটা পৈশাচিক হাসির রক্তজল-করা দমকা উঠলো ঘরের ভেতর।
আঁৎকে, ধড়মড় করে, যে যার আসন থেকে উঠে পড়েছি আমরা। মার্ক আর কাপ্তেন হারালান যেন ঘোরের মধ্যেই তেড়ে গিয়েছে গ্যালারির যেদিক থেকে এই অট্টহাসির তুবড়ি ফেটে পড়েছে, কিন্তু কয়েক পা গিয়েই তারা থমকে থেমে গিয়েছে।
সবকিছুই ঘটে গেছে মাত্রই দুটি মুহূর্তে। ঐ দুই মুহূর্তের মধ্যেই আমি দেখেছি। আলো ঝিকিয়ে উঠেছে রক্তলোলুপ একটা ছুরির দ্রুতধাবমান ফলায়; দেখেছি মার্ক টালমাটাল থুবড়ে পড়বার আগেই দুই বাহুর মধ্যে তাকে ধরে ফেলেছে কাপ্তেন হারালান…
আমি ছুটে গিয়েছি তাদের সাহায্যে, আর সেই মুহূর্তে একটা বাজখাই রুক্ষ কর্কশ স্বর–সেই গলাটা এতদিনে আমরা সবাই চিনে ফেলেছি-দুর্ধর্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় বলে উঠেছে : মাইরা রডারিখ ককখনো মার্ক ভিদালের বউ হবে না! ককখনো না!
তারপরেই এক প্রচণ্ড দমকা হাওয়ার ঝাঁপটায় থরথর করে কেঁপে উঠেছে ঝাড়লণ্ঠনগুলো, বাগানে যাবার দরজাটা দুম করে খুলে গিয়েই বন্দুকের গুলির মতো আওয়াজ করে আবার বন্ধ হয়ে গেছে, আর আমরা আবারও হাত কামড়াতে-কামড়াতেই বুঝি উপলব্ধি করেছি যে আমাদের এই অপ্রশম্য দুশমন ফের আমাদের নাগাল থেকে পালিয়ে গিয়েছে!
একটা ডিভানের ওপর এনে মার্ককে তারপর শুইয়েছি আমরা, ডাক্তার রডারিখ মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন জখমটা। ভাগ্যি ভালো, ছোরাটা বেশি গভীরে বেঁধেনি! বাম কাঁধের হাড়ের ওপর দিয়ে হড়কে গিয়েছিলা, শুধু লম্বা একটা কাটা দাগ, যদিও দেখাচ্ছে রাগি-লাল, তেমন গুরুতর নয় আসলে, কয়েকদিনেই সেরে যাবে। এবার হয়তো আততায়ী তাড়াহুড়োয় লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি, কিন্তু পরের বার কি সে আবারও ফসকাবে?
মার্ককে কিছুক্ষণ শুশ্রূষার পর হোটেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। আমি গিয়ে বসে রইলুম তার বিছানার পাশে, আর সেখানে যে তার ওপর শুধুই নজর রেখেছি তা নয়, মনে-মনে সারাক্ষণ নাড়াচাড়া করেছি সমস্যাটা নিয়ে। বুদ্ধির খেলায় এই শয়তানকে যদি হারানো না-যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত কত জনকে প্রাণ দিয়ে তার প্রতিহিংসার বলি হতে হবে?
এটা কবুল করা ভালো যে আমি যেদিক দিয়ে তদন্ত করলে ব্যাপারটার মীমাংসা করা যাবে বলে ভেবেছিলুম, সেদিকে কিছু করার আগেই অন্য-সব অপঘটনা এসে ব্যাপারটাকে আরো-জটিল করে তুলেছে। খুব-একটা পিলেচমকানো নাটুকে যদি-বা নাও হয়, এই অপঘটনাগুলো সত্যি ভারি কিম্ভুতকিমাকার আর অসংলগ্ন ও অপ্রত্যাশিত ছিলো। অবশ্য সবকিছুই তো ছিলো অপ্রত্যাশিত ও অতর্কিত। কিন্তু তাদের নিয়ে ভাবতে হবে অনেক, শুধু বিহ্বল হয়ে বসে থাকলেই চলবে না।
সেই দিনই–সেই চৌঠা জুনের-সন্ধেবেলায়, দারুণ জোরালো একটা আলো দেখা গিয়েছিলো অনেক দূর থেকে, ঘণ্টাঘরের সবচেয়ে উঁচু জানলাটা থেকে আলোর ছটা পড়েছিলো সন্ধ্যার আকাশে। যেন একটা জ্বলন্ত মশাল উঠছে আর নামছে, এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে, যেন কোনো গুণ্ডা এসে বিদ্বেষবশে কোনো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিতে চাচ্ছে।
পুলিশের বড়োকর্তা স্বয়ং তার সঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে হুড়মুড় করে উঠে পড়েছিলেন ঘণ্টাঘরে। আলোটা ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে, আর মঁসিয় স্টেপার্ক যেমন ভেবে বসেছিলেন, তাই-ই ঠিক হয়েছে : কাউকেই আর অকুস্থলে পাওয়া যায়নি। মেঝের ওপর পড়েছিলো একটা নিবে-যাওয়া মশাল, তা থেকে রজনের গন্ধ বেরুচ্ছে-যে-লোকটা আগুন ধরাতে এসেছিলো, তার কোনো পাত্তাই নেই কোথাও।
হয় সেই লোকটা-তর্কের খাতিরে না-হয় ধরেই নেয়া যাক যে খোদ ভিলহেল্ম স্টোরিৎসই সে-পিঠটান দেবার যথেষ্ট সময় পেয়েছে, অথবা সেখানেই গা-ঢাকা দিয়ে আছে, ঐ ঘণ্টাঘরেরই কোথাও, এবং তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
চকে যে-জনতা এসে জমায়েৎ হয়েছিলো, তাদের প্রতিহিংসার জিগির নিষ্ফল হ
লোবরং সে-সব দেখেশুনে বদমায়েশটার নিশ্চয়ই হাসিই পাচ্ছিলো।
পরদিন, সকালবেলায়, অধোন্মত্ত শহরের উদ্দেশে ছুঁড়ে মারা হলো আত্মম্ভরিতার আরো-সব জমকালো নিদর্শন।
সবেমাত্র তখন সাড়ে-দশটার প্রহর বেজেছে, এমন সময় ঢং-ঢং করে বেজে উঠেছে গা-শিউরে-তোলা ভয়ংকর ঘণ্টার শব্দ ঢং ঢং ঢং, যেন কারু অন্ত্যেষ্টির ঘোষণা, যেন আতঙ্কেরই কোনো বাদনধ্বনি।
কোনো-একজন লোকের পক্ষে এমনভাবে ক্যাথিড্রালের ঘণ্টাগুলো পর-পর ঢং ঢং করে বাজানো সম্ভব হতো না। ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের নিশ্চয়ই আরো-সব স্যাঙাৎ ছিলো সঙ্গে–আর অনেক কেউ যদি নাও হয়, তার কাজের লোক হেরমান তো ছিলোই।
শহরের লোকেরা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলো সন্ত মিখায়েলের চকে, ছুটে এসেছিলো শহরের দূর-দূর কোণা থেকে, এই পারলৌকিক বাদনধ্বনি যেন বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিলো সারা শহরে। আবারও একবার দলবল নিয়ে অকুস্থলে ছুটে গিয়েছেন মঁসিয় স্টেপার্ক। উত্তরমিনারের ঘোরানো সিঁড়ির দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেছেন তারা, ছুটে ছুটে উঠেছেন সিঁড়ি বেয়ে, ঢুকেছেন সেই ঘরটার যেখানে পর-পর সব ঘণ্টাগুলো বসানো, স্কাইলাইটগুলো দিয়ে আলো এসে ঘরটাকে ফটফটে দিনের আলোয় যেন ধুয়ে যাচ্ছিলো…
কিন্তু মিথ্যেই তারা তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন ঘরটা, খুঁজেছেন ওপরের গ্যালারিটা… কেউ নেই! কেউ-না!… পুলিশ যখন গিয়ে ঘরটায় পৌঁছেছে, তখন ঘণ্টাগুলো এমনকী দুলছিলোও না, স্তব্ধ পড়ে ছিলো পর-পর… অদৃশ্য ঘণ্টাবাজিয়েরা যেন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে সে-ঘর থেকে।
.
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
তাহলে, আমি যা ভয় করেছিলুম, তা-ই হয়েছে। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস মোটেই রাগৎস ছেড়ে চলে যায়নি, আর ডাক্তার রডারিখদের বাড়িতেও সে দিব্বি অনায়াসেই ঢুকে পড়েছিলো। এটা ঠিক যে, সে লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। কিন্তু সেটা তো আর ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি হতে পারে না। একবার সে যা করবার চেষ্টা করেছে, আবারও সে তা-ই করবে, আর পরের বার হয়তো সে মোটেই তাগ ফসকাবে না। কাজেই সেই দুরাচারের কাছ থেকে আবারও কোনো আঘাত আসার আগেই আমাদের প্রতিরোধব্যবস্থাটাকে অটুট করে তুলতে হবে।
কী-যে করা যায়, সেটা ঠিক করে নিতে আমাকে মোটেই বেগ পেতে হয়নি। যাদের-যাদের সে হুমকি দিয়েছে, তাদের সব্বাইকে একজায়গায় জড়ো করে এমন একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল তাদের চারপাশে তুলে দিতে হবে, যাতে কারু পক্ষেই তাদের ধারে-কাছে ঘেঁসা সম্ভব না-হয়। কী করে সেটা করা যায়, সেটাই গোড়ায় ভেবে দেখতে হবে।
ছয়ই জুন সকালবেলায়, হামলা হবার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই, মার্ককে সরিয়ে ফেলা হলো রডারিখ-ভবনে, মাইরা যে-ঘরে আছে ঠিক তার পাশের ঘরটাতেই। ভাগ্যিশ মার্কের কাঁধের জখমটা তেমন গুরুতর হয়নি–এর মধ্যেই সেটা শুকোতে শুরু করেছিলো, রক্তপাতও এমন-কিছু হয়নি যে খুব দুর্বল হয়ে পড়বে। প্রথমে মার্কের একটা ব্যবস্থা করবার পরই আমি আমার পরিকল্পনাটা ডাক্তার রডারিখকে খুলে বলেছি, আর সব শুনে তিনি সেটা পুরোপুরি অনুমোদনও করেছেন। আমার হাতে প্রায় সব দায়িত্বই ছেড়ে দিয়েছেন ডাক্তার রডারিখ, তার মতে আমিই নাকি আক্রান্ত দুর্গের প্রধান সেনাধিপতি।
এবং তৎক্ষণাৎ আমি সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। মার্ক আর মাইরার পাহারায় শুধু একজন কাজের লোককে রেখে–সেই ঝুঁকিটা আমাকে নিতেই হয়েছে!গোড়ায় আমি খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছি বাড়ির চারপাশ। অবশ্য পুরো বাড়িটা সরেজমিন তদন্ত করে দেখতে সকলেই আমায় সাহায্য করেছেন, মায় কাপ্তেন হারালান ও মাদাম রডারিখ শুদু। আমার নির্দেশেই তিনি মাইরার শয্যার পাশ থেকে উঠে এসেছিলেন।
আমরা শুরু করেছিলুম ওপর থেকে। কনুইতে কনুই ঠেকিয়ে, আমরা চিলেকোঠার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি। তারপর খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখেছি সবগুলো ঘর; কোনো কোনাখামচি, কোনো কুলুঙ্গি, কোনো ফাঁকফোকর–কিছু বাদ দিইনি–মানুষ তো দূরের কথা কোনো নেংটি ইঁদুরও ও-সব ফাঁকফোকরে লুকিয়ে থাকতে পারতো না। পর্দা তুলে দেখেছি আমরা, চেয়ারগুলো জায়গাবদল করেছি অনবরত, খাটের তলায় ঢুকে গিয়ে দেখেছি, দেরাজের মধ্যেও হাড়েছি, আর একবারও, এক মুহূর্তের জন্যেও, পরস্পরের স্পর্শচ্যুত হইনি আমরা, কনুইতে কনুই ঠেকিয়ে পাশাপাশি থেকেছি। একেকটা করে ঘর দেখা সাঙ্গ হয়েছে, আমরা দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিয়েছি–এবং চাবিটা আমি আমারই পকেটে রেখেছি।
এতে দু-ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে আমাদের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজটা সুষ্ঠুভাবেই সমাধা হয়েছে, আর এই করে-করে গিয়ে পৌঁছেছি বহির্ঘারে, নিশ্চিত হয়েছি, সুনিশ্চিত, বস্তুপৃথিবীতে যতটা নিশ্চিত হওয়া যায় ততটাই, যে, কোনো বহিরাগত এসে বাড়ির মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে নেই! তারপর বাইরের দরজার কবাট এঁটে কুলুপ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, হুড়কোও, তারপর তালা বন্ধ করে দিয়ে চাবিটা আমিই পকেটে রেখেছি। এখন আমাদের অনুমতি ছাড়া কেউই হুট করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারবে না। আর আমি নিজেকে পইপই করে বলেছি, সবসময় তোমাকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে, অঁরি, যাতে চেনা লোককে ভেতরে ঢুকতে দেবার সময় লুকিয়ে, অদৃশ্য হয়ে, কেউই ভেতরে অনধিকার প্রবেশ করতে না-পারে।
আর সেই মুহূর্ত থেকে, কেউ এসে দরজা ধাক্কালে বা কড়া নাড়লে, আমি, শুধু আমি একাই দরজা খুলে দিয়েছি। এই দ্বারপালের কাজ করার সময় হয় আমার সঙ্গে থেকেছে কাপ্তেন হারালান, অথবা কাজের লোকদের কেউ, যাকে আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। । বাট শুধু একটুখানি ভোলা হতো, আর পাল্লা সরালে যতটা ফাঁক হতো তাতে। গিয়ে আমি নিজে দাঁড়াতুম, আমার সঙ্গী থাকতো আমার পেছনেই। অভ্যাগতকে কি ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে? যদি হয়, তবে তিনজনে গায়ে গা ঠেকিয়ে, পায়ে-পায়ে পেছিয়ে এসেছি আমরা, আর দরজাটা ফের বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সন্তর্পণে, সাবধানে। অর্থাৎ এখন নিশ্চয়ই রডারিখ-ভবন একটা সত্যিকার দুর্গই হয়ে উঠেছে, সুরক্ষিত ও নিরাপদ।
জানি-জানি, আমার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সে-কোন আপত্তি তোলা হবে! দুর্গ তো নয়, যেন এক বন্দীশালা! তবে সাময়িক বন্দিত্ব সওয়া যায়, অন্তত জীবননাশের চাইতে তো সেটা ভালো। আর আমরা তো আর যাবজ্জীবন বন্দী থাকবো না এভাবে, এই দশা বেশিদিন থাকবে না বলেই আমার আশা। কেননা ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর গুপ্ত রহস্যটার পুরোপুরি মীমাংসা করে না-ফেললেও আমি ব্যাপারটা সমাধান করার দিকে খানিকটা অন্তত এগিয়েছি বৈ কি! সেটা, না-হয় নিরেস ঠেকলেও, তত্ত্বকথা বলে মনে হলেও, একটু নেড়ে-চেড়ে দেখা যাক।
যখন কোনো ত্রিশিরা কাঁচের ফলার মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো ঝলমল করে ওঠে, তখন সে সাত-সাতটা রঙে ভেঙে পড়ে যায়, যেগুলোর মিশোল থেকেই জ্বলে ওঠে শাদা আলো। এই রঙগুলো-বেগুনি, নীল, আশমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল বেনীআসহকলা]-তৈরি করে দেয় সৌরবর্ণালি।
কিন্তু দৃশ্যমান এই বর্ণচ্ছটা হয়তো গোটা বর্ণালির নিছকই একটা অংশমাত্র ছাড়া আর-কিছু নয়। অন্য কোনো-কোনো রঙও থাকতে পারে, যেগুলো নেত্রপটের অগোচর; এই-যে এখনও-অজানা সব রশ্মি, তাদের হয়তো এমন-সব বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো আমাদের জানা সৌররশ্মির চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন, পুরোপুরি আলাদা। আমাদের চেনা সৌর বর্ণালি অনেক নিরেট জিনিশের মধ্য দিয়েই চলে যেতে পারে–যেমন, কাঁচ–আর তা যদি হয়, তবে এই অজানা রশ্মিগুলো সমস্ত নিরেট জিনিশের মধ্য দিয়েই বা চলে যেতে পারবে না কেন? [ অঁঁরি ভিদাল এই পাণ্ডুলিপি লেখার পর অবলোহিত বা রঙ্গপূর্ব ও বেগনিপারের আলো অন্তত অনেকটাই মঁসিয় ভিদালের এই অনুমানকে সত্য বলে প্রমাণ করেছে।-জুল ভের্ন-এর টীকা ] সত্যি-যদি তা হয়, তাহলে খালি চোখে দেখে সেগুলো কিছুই বোঝা যাবে না–আমাদের নেত্রপট মোটেই এ-সব রশ্মির দ্বারা প্রভাবিত হয় না-যদি অবশ্য আমরা ধরে নিই যে এমন-সব রশ্মি আছে।
আর এটা হতেই পারে যে, এমনতর বিশিষ্টিতাসংবলিত রশ্মিগুলোকে অটো স্টোরিৎস একদিন আবিষ্কার করে বসেছিলেন; তিনি কোনো রাসায়নিকেরও একটা সূত্র পেয়ে গিয়েছিলেন, যেটা কোনো সজীব বস্তুর মধ্যে সংক্রমিত করা হলে, দুটো বৈশিষ্ট্য পেয়ে যায়-উপরিতল দিয়ে পুরো পরিণাহ বা পরিকাঠামোতেই তখন সে ছড়িয়ে যায়, আর সৌরবর্ণালির মধ্যে বিভিন্ন রশ্মির স্বভাব বা প্রকৃতিকেও আমূল বদলে ফ্যালে।
আর এই অনুমানটা মেনে নিলেই শুধু সবকিছু ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আলো, কোনো অনচ্ছ বস্তুর উপরিতলে পৌঁছুবার পর এই রাসায়নিক পদার্থে ভরপুর হয়ে যায়, আলাদা আলাদা হয়ে যায় বর্ণচ্ছটাগুলো, আর যে-সব রশ্মি তাদের রচনা করে তারা নির্বিচারে রূপান্তরিত হয়ে যায় এইসব অন্যান্য স্বতঃপ্রভ এখনও-অগোচর রশ্মিতে, যার অস্তিত্ব আছে বলেই আমি ধরে নিয়েছি। এইসব রশ্মি তখন বস্তুর নিরেট জমির মধ্য দিয়ে অনায়াসেই বয়ে যাবে। তারপর, তারা যখন উৎসারিত হবে, তারা আবার একটা বিপরীত রূপান্তরণের মধ্য দিয়ে যাবে, ফিরে পেয়ে যাবে তাদের নিজস্ব মৌলরূপ আর এমনভাবে আমাদের নেত্রপটের ওপর প্রভাব ফেলবে যেন ঐ অনচ্ছ বস্তুর কোনো অস্তিত্বই নেই।
সন্দেহ নেই, কতগুলো বিষয় তবু অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে। কেমন করে এটা ব্যাখ্যা করবো যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে যেমন খালি চোখে দেখা যায় না তেমনি তার পোশাকআশাকও দেখা যায় না, অথচ যা-কিছু সে হাতে ধরে থাকে, তা তখনও দৃশ্যমান থেকে যায়? আর কী সেই রাসায়নিক যেটা এমন আশ্চর্য প্রভাব ফেলতে পারে, যার মধ্যে সে ঢুকে পড়ে, তারই ওপর? সেটা আমার জানা নেই, আর এতে আমার বেশ মনখারাপই হয়ে গেছে, কারণ তাহলে আমি নিজের ওপর সেটা ব্যবহার করে আমাদের এই শত্রুর সঙ্গে সমানে-সমানে যুঝতে পারতাম। তবে, শেষ অব্দি, হয়তো, এই বাড়তি সুবিধেটুকু ছাড়াই বুদ্ধির খেলায় দুশমনকে কুপোকাৎ করে দেয়া যাবে।
অবস্থাটা উভয়সংকটের মতো : এই অজানা রাসায়নিকটা যা-ই হোক না কেন, তার প্রভাব হয় তাৎক্ষণিক হবে, আর নয়তো, চিরস্থায়ী। প্রথমটাই যদি সত্যি হয়, ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে তাহলে হয়তো নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট মাত্রায় এই রাসায়নিক নিজের শরীরে ঢোকাতে হয়–পান করে, অথবা পুঁই কুঁড়ে। তার প্রভাবটা যদি চিরস্থায়ী হয়, তবে প্রতিষেধক কোনো ওষুধ দিয়ে, ঠিক উলটো-কোনো রাসায়নিক দিয়ে তাকে আগের রাসায়নিকের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে হয়, কেননা এমন-অনেক পরিস্থিতি আসবে যখন অদৃশ্য-হওয়াটা সুবিধে হওয়ার বদলে বরং অসুবিধেই হয়ে উঠবে। দুটোর মধ্যে যেটাই সত্য হোক না কেন, সে নিশ্চয়ই বাধ্য হবে আগে থেকেই বেশি পরিমাণে ঐ রাসায়নিক মজুত করে রাখতে, কেননা যে-পরিমাণ রাসায়নিক সে সবসময় পকেটে রাখতে পারবে তা তো আর তেমন-বেশি হবে না।
এদিকটার তো একটা না-হয় যেমন-তেমন ব্যাখ্যা হলো, কিন্তু চার্চে গিয়ে ঐ ঢং ঢঙা ঢং ঘণ্টা বাজানোই বা কেন, কিংবা মশাল জ্বেলে আলার ছটা ক্ষিপ্রবেগে নাড়ানোই বা কেন? কী মানে হতে পারে এর? কী-রকম খাপছাড়া, উদ্ভট, অসংলগ্ন বলে মনে হয় তাদের–তখনই আমার তা মনে হয়েছে। এ থেকে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস, ক্ষমতার মদে মত্ত হয়ে, এ-সব অর্থহীন কাণ্ড করে নিছকই বারফট্টাই করেছে, জাঁক দেখিয়েছে? না কি তার মাথাটাই বিগড়ে যেতে বসেছে!
এমন-সব সাত-পাঁচ ভাবনা নিয়েই আমি মঁসিয় স্টেপার্কের খোঁজে বেরিয়েছি। তাকে আমি আমার মনের কথা খুলে বলেছি, আর সঙ্গে-সঙ্গেই ঠিক হয়েছে যে বুলভার তেকেলির বাড়িটার ওপর আরো-কড়া নজরদারি দরকার-সেজন্যে দরকার হলে সেনাবাহিনীরও সাহায্য নেয়া হবে। এমনভাবে পাহারা বসাতে হবে, গায়ে গা ঠেকিয়ে সারি সারি সেপাই বা পল্টন, যাতে বাড়ির মালিকের পক্ষে রক্তমাংসের শরীর নিয়ে ভেতরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। সে অদৃশ্য হয়ে যাবার ক্ষমতা ধরে বটে, কিন্তু শরীরটা তো রক্তমাংসের! তাতে সে যেমন তার ল্যাবরেটরিতে ঢুকতে পাবে না, তেমনি তার গোপন ভাড়ারও তার নাগালের বাইরে থেকে যাবে। আর বিপাকে পড়ে তখন তাকে আগেই তোক বা ক-দিন পরেই হোক, আবার ঐ মানুষী চেহারাই নিতে হবে, অথবা অদৃশ্য মানুষ হিশেবেই চিরটা কাল কাটিয়ে দিতে হবে–আর সেটাই তখন হয়ে উঠবে তার আকিলিসের গোড়ালি, তার দুর্বলতা। আর তার যে ক্রমেই মাথাখারাপ হয়ে যাচ্ছে, এই অনুমানটা যদি ভিত্তিহীন না-হয়, তবে এইসব বাধাবিপত্তিদুর্বিপাক তাকে বাধ্য করবে রাস্তায়-রাস্তায় ঘরছাড়া দিকহারা ঘুরে বেড়াতে, এবং মাথাটা তখন আরো যাবে।
মঁসিয় স্টেপার্ক হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেছেন বটে, আমাকে কিন্তু তার সঙ্গে যেতে বলেননি। তাহলে কি তিনিও কোনো ফন্দি এঁটেছেন, কোনো রণকৌশল ঠিক করেছেন, যা থেকে–তার ধারণা–আমি তাঁকে বিরত করবার চেষ্টা করবো? তিনি কি সেই অসম্ভবেরই প্রত্যাশা করে আছেন যে আচমকা একসময় তার সঙ্গে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এর মুখোমুখি দেখা হয়ে যাবে? প্রেমবার্গে যাকে খবর আনতে পাঠিয়েছিলেন, তার ফিরে-আসার অপেক্ষা করছেন কি? ভাবছেন কি যে সে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর পাকা খবর এনে দেবে, বলবে কোথায় তাকে পাওয়া যাবে? আমি নিশ্চয়ই তাকে টেনে ধরে রাখতুম না। বরং তার সঙ্গেই যেতুম, এই সমাজবিরোধকে পাকড়াবার ব্যাপারে তাকে বরং সাহায্যই করতুম। কিন্তু সে-রকম কিছু হবার সম্ভাবনা আছে কি-মুখোমুখি দেখা হবার? নিশ্চয়ই না। রাগৎস-এ তো নয়ই, অন্যকোথাওও নয়।
এগারো জুন সন্ধেবেলায় মার্কের সঙ্গে আমার একটা দীর্ঘ শলাপরামর্শ হয়েছে। ভারি কাতর হয়ে পড়েছে মার্ক, বিহ্বল; আগের চাইতেও অনেক-বেশি; আমার তো ভয়ই হচ্ছিলো পাছে সে কঠিন-কোনো অসুখ বাধিয়ে বসে। তাকে যদি এই শহরটা থেকেই সরিয়ে দেয়া যেতো, ফ্রাসে যদি নিয়ে যাওয়া যেতো, তবে ভালো হতো; কিন্তু আমি এও জানতুম সে কিছুতেই এই মুহূর্তে মাইরার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইবে না। আচ্ছা, গোটা রডারিখ পরিবারকেই যদি কিছুদিনের জন্যে রাগৎস থেকে অন্য-কোথাও নিয়ে-যাওয়া যায়? এটাও কি বিবেচনা করে দেখার মতো একটা প্রস্তাব নয়? আচ্ছা, পরে একসময় স্বয়ং ডাক্তারের সঙ্গে এ-বিষয়ে আলাপ করে দেখতে হবে।
সেদিন, মার্কের সঙ্গে নানা কথাবার্তার পর, আমি বলেছি :শোন, মার্ক, দেখতে পাচ্ছি তুই একেবারে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছিস। এটা কিন্তু তুই ভুল করছিস, মার্ক। মাইরার তো আর জীবনসংশয় নয়–সব ডাক্তারই বলেছেন, এ-যাত্রায় সে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। আর যদি তার যৎকিঞ্চিৎ বুদ্ধিভ্রংশ বা মতিভ্রম হয়ে থাকে, তবে সেও নিতান্তই সাময়িক। বিশ্বাস কর আমায়–এটা কোনো মিথ্যে স্তোক নয়। আবার তার চৈতন্য ফিরে আসবে, কাণ্ডজ্ঞান ফিরে আসবে, আবার সে আগেকার মাইরা হয়ে উঠবে, নিজেই নিজের মতো।
তুমি চাচ্ছো আমি যাতে আশা ছেড়ে না-দিই, মার্কের গলাটা বুঝি ধরে এসেছে। কিন্তু বেচারি যদি আবার বুদ্ধিশুদ্ধি ফিরে পায়, তখনও কি সে ঐ রাক্ষসটার দয়ার ওপর নির্ভর করবে না? তোমার কি ধারণা ঐ দুবৃত্তটা এ-যাবৎ যা অপকীর্তি করেছে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে? যদি সে তার প্রতিহিংসাটাকে আরো-বহুদূরে টেনে নিয়ে যেতে চায়? … যদি, চায়?… বুঝতে পারছো, অঁরি, আমি কী বলতে চাচ্ছি? সে-তো যা-খুশি তা-ই করতে পারে, আমরা তাকে ঠেকাবো কেমন করে?
না, না, মার্ক, তক্ষুনি আমি সজোরে আপত্তি জানিয়েছি, তার সঙ্গে যোঝা যাবে–মোটেই অসম্ভব নয় তা
কিন্তু কেমন করে? মার্ক বুঝি ডুবন্ত মানুষের মতো নিছক একটা খড়কুটোই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। কীভাবে?-না, অঁরি, তুমি সত্যি যা ভাবছো তা কিন্তু মোটেই খুলে বলছে না। না, এই পিশাচটার কাছে আমরা অসহায়, প্রতিরোধহীন! তাকে এড়াবার * উপায় তো একটাই : যাবজ্জীবন একটা দুর্গে বন্দী হয়ে থাকা। আর তারপরেও আমরা জানি না কখনও কোনো ফাঁক পেয়ে এই দুর্ভেদ্য দুর্গেও সে ঢুকে পড়বে কি না?
মার্কের উত্তেজনা আর হতাশা আমার যেন দম আটকে দিয়েছে। সে কেবল নিজের কথাই শুনছে, আর-কারু কথা কানেই নিচ্ছে না। আমার হাত দুটি চেপে ধরে সে আবার বলেছে :
কে বলবে এখানে আমরা দুজনেই শুধু আছি কি না! আমি এ-ঘর থেকে ও ঘর যাই, ড্রয়িংরুমে যাই, গ্যালারিতে যাই, আর সবসময় মনে-মনে বলি, ঐ নিশ্চয়ই সে আসছে আমার পেছন-পেছন! সবসময় কেউ যেন আমার সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটছে! অথচ সে আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে নেই, কেবলই নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে… যেই তাকে চেপে ধরতে যাই, অমনি সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, এড়িয়ে যায় আমাকে…
ধরা গলায় আর্তভাবে ভাঙা-ভাঙা কথা বলতে-বলতে সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে ছুটে বেরিয়েছে মার্ক, যেন কাউকে তাড়া করে যাবার চেষ্টা করেছে। কিছুতেই তাকে আর শান্ত করা যাচ্ছে না, কোনো সান্ত্বনাই কাজ দিচ্ছে না। সবচেয়ে ভালো হয়, ওকে যদি এখান থেকে দূরে-কোথাও নিয়ে যাই, দূরে, অনেক দূরে!
কে জানে, বলেই চলেছে সে ছেঁড়া-ছেঁড়া কথাগুলো, আমরা এতক্ষণ যা আলোচনা করেছি সব সে আড়ি পেতে শুনেছে কি না! আমরা ভাবছি, বেশ আছি, সে অনেক দূরে আছে। কিন্তু সে-যে এখানে, এই মুহূর্তে এখানে, নেই তা কে বলতে পারবে?-ঐ তো! দরজার ওপাশে আমি তার পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি! ঐ যে, ওখানে!… কই? যাও, পাকড়াও গিয়ে ওকে, পেড়ে ফ্যালো!… কিন্তু পারবে কি তুমি কখনও?…এ কি আদৌ সম্ভব?… এই পিশাচ-তার মাথায় এখন মরণ ভর করেছে!…।
আমার ছোটোভাইটির অবস্থা এখন এমনই শোচনীয় দশায় গিয়ে পৌঁছেছে! আমি কি আগেই এই আশঙ্কা করিনি যে বিষম সংকটের মধ্যে গিয়ে পড়লে মাইরার মতো তারও বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাবে! অটো স্টোরিৎস যদি দুর্দান্ত বৈজ্ঞানিকই হবেন, তবে তার কি এমন অভিশপ্ত কোনো রাসায়নিক আবিষ্কার না-করলেই চলছিলো না? কেন এমন একটা হাতিয়ার এমন লোকের হাতে তুলে দিয়েছেন যার ধাতটাই স্বভাবদুবৃত্তের, বিপথগামী! বৈজ্ঞানিকেরা তো দার্শনিকও হন–তাঁরা কী বুঝতে পারেন না কোন আবিষ্কারে কী হয়?
শহরের হালচালও মোটেই ভালো না। যদিও সেই ক্যাথিড্রালের ঘণ্টাবাদনের পর আর-কোনো ঘটনাই শহরের লোকজনকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়নি, তবু শহরটা যেন ধুকছে, ভয়েই আধমরা। সকলের বাড়িই যেন হানাবাড়ি হয়ে উঠেছে, যেন অদৃশ্য-কেউ এসে ভর করেছে বাড়িটায়। অদৃশ্যের উপস্থিতি! কী দুর্দান্ত পরিহাস! ক্যাথিড্রালে ঐ ঘটনা ঘটার পর জিশুর শরণ নিয়েও যেন আর-কারু পার নেই। কর্তৃপক্ষ মিথ্যেই চেষ্টা করছেন শহরের সন্ত্রস্ত মানুষজনকে আশ্বস্ত করতে-মিথ্যেই, কেননা এই আতঙ্ককে ঠেকাবার সাধ্য যেন কিছুরই নেই! একটা নজির দিলেই বোঝা যাবে, শহরের মনোবল কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
বারোই জুন সকালে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম পুলিশের বডোেকর্তার সঙ্গে দেখা করতে যাবো বলে। সন্ত মিখায়েলের চক থেকে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে পৌঁছেছি, দেখি কাপ্তেন হারালান। তাকে দেখেই আমি বলেছি : আমি মঁসিয় স্টেপার্কের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। সঙ্গে আসতে চাও, কাপ্তেন? কোনো উত্তর না দিয়ে একটা কলের পুতুলের মতো সে আমাকে অনুসরণ করেছে। আমরা যেই একটা চকের কাছে পৌঁছেছি, অমনি কানে এসেছে তুলকালাম আতঙ্কের ধ্বনি।
একটা ঘোড়ায়টানা ডাকের গাড়ি জোরকদমে ছুটে আসছিলো রাস্তা দিয়ে, দিগ্বিদিকহারা, রাশ না-টানা; পথচারী যে যেদিকে পারে ডানে-বাঁয়ে ছিটকে পড়েছে। দেখে মনে হয়েছে, কোনো কোচোয়ানই নেই গাড়িতে, ঘোড়াগুলো নিজেরাই ছুটেছে, চালকবিহীন! হয়তো চালক কোথাও টাল সামলাতে না-পেরে পড়ে গিয়েছে রাস্তায়। কিন্তু তার ফলে যা হয়েছে, তাকে কি চোখে না-দেখলে বিশ্বাস করা যায়? ঐ পাগলা ঘোড়াদেরই মতোই জনাকয়েক পথচারীর মাথায় একটা পোকা যেন কুটুস করে কামড়েছে–তাদের মনে হয়েছে কোনো অদৃশ্য কোচোয়ানই বুঝি গাড়িটা চালাচ্ছে! খোদ ভিলহেল্ম স্টোরিৎসই বসেছে চালকের আসনে! আর্ত চীৎকার ছিঁড়েছে আকাশ বাতাস : ঐ সে! খোদ লুসিফার! শয়তানটা নিজেই! ভিলহেল্ম স্টোরিৎস!
আমি ঘাড় ফিরিয়ে কাপ্তেন হারালানকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলুম, দেখি সে তখন আর পেছনে নেই, সোজা সে ছুটেছে পাঁই-পাই কোচগাড়ির দিকে, সামনে এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা সে থামাবে!
তখন বাজারহাটের সময়, রাস্তাঘাট ভর্তি লোকজনে, আর সবখান থেকেই ধ্বনি উঠছে : ভিলহেল্ম স্টোরিৎস! ভিলহেল্ম স্টোরিৎস! পাগলা ঘোড়াগুলোকে তাগ করে ঢিল ছুঁড়েছে লোকে, মোড়ের মাথার পাহারাওলা তার গাদাবন্দুক ছুঁড়েছে একবার! হৈ হৈ রৈ রৈ বেশামাল অবস্থা!
একটা ঘোড়া থুবড়ে পড়েছে রাস্তায়, তার পায়ে গুলি লেগেছে! আর গাড়িটা, টালমাটাল, দু-বার পাক খেয়ে উলটে পড়েছে ঘোড়াটারই গায়ে। তক্ষুনি ক্রুদ্ধ জনতা ছুটে গেছে গাড়িটার দিকে, মুহূর্তে সব লণ্ডভণ্ড ছত্রভঙ্গ, কেউ খুলেছে চাকা, কেউ মুগুর মেরেছে গাড়িতে, একজন খুলে নিয়েছে অক্ষদণ্ডটাই! একশো-জোড়া হাত নিশপিশ করে ছুটে গিয়েছে ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের টুটি টিপে ধরবে বলে!… বদলে, তারা শুধু আঁকড়ে ধরেছে শূন্যতাই!
তাহলে সেই অদৃশ্য চালক গাড়িটা ওলটাবার আগেই লাফিয়ে নেমে পালিয়ে গিয়েছে! কারণ, শহরের লোককে আবার একটা নতুন অপকর্ম করে সে-যে ঘাবড়ে দিতে চেয়েছিলো, এ নিয়ে লোকের মনে কোনো সন্দেহই ছিলো না। পরক্ষণেই অবশ্য জানা গেছে আসল ব্যাপারটা–অমন-কিছুই হয়নি! তক্ষুনি এসে হাজির এক চাষী, সে গাঁ থেকে তার ঘোড়ার গাড়িতে করে এসেছিলো গঞ্জে, এটা মোটেই ডাকের গাড়ি নয়, গাড়িটা রাস্তায় রেখে সে একটা দোকানে গিয়ে ঢুকেছিলো, অমনি ঘোড়াগুলো উধ্বশ্বাসে ছুট লাগায়। একটা ঘোড়াকে চিৎপাত রক্তাপ্লুত হাড়গোড়ভাঙা পড়ে থাকতে দেখে সে তো রেগে কাই! লোকে তার কথা শুনলে তো! আমার মনে হচ্ছিলো এই কাণ্ডজ্ঞানহারানো জনতার ক্ষিপ্ত রোষের হাত থেকে এই চাষীরই বুঝি আর পরিত্রাণ নেই। অনেক কষ্ট করে সব্বাইকে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে তবে এই চাষীটিকে বাঁচিয়েছি আমরা!
কাপ্তেন হারালানকে আমি ডেকে নিয়ে গিয়েছি সঙ্গে, সেটু শব্দটি না-করেই আমার সঙ্গে গিয়েছে টাউনহলে। রাস্তায় কী হয়েছে, সেটা এর মধ্যেই জেনে গিয়েছিলেন সিয়। স্টেপার্ক। গোটা শহরটাই পাগল হয়ে গেছে,আমাকে তিনি আপশোশ করে বলেছেন, আর এ-পাগলামি যে শেষটায় কী করে বসবে, তা-ই কেউ জানে না।
আমি প্রথমেই পুরোনো প্রশ্নটা করে নিয়েছি। নতুন-কিছু খবর পেলেন?
হ্যাঁ, মঁসিয় স্টেপার্ক জানিয়েছেন, খবর পেয়েছি, ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে নাকি মেবার্গে দেখা গেছে।
স্প্রেমবার্গে! অস্ফুট স্বরে বলে উঠেছে কাপ্তেন হারালান। তারপর আমার দিকে ফিরে বলেছে : তাহলে চলুন! এক্ষুনি প্রেমবার্গ চলুন! আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন।
উত্তরে যে কী বলবো, তা আমি ভেবে পাইনি। কেননা আমি নিশ্চিত জানি খামকাই আমরা বুনোহাঁসের পেছনে তাড়া করে যাবো!
সবুর, কাপ্তেন, সবুর! মঁসিয় স্টেপার্কই তাকে থামিয়েছেন। খবরটা ঠিক কি না জানতে আমি মেবার্গে লোক পাঠিয়েছি। যে-কোনো মুহূর্তে সে এসে পড়বে।
আধঘণ্টাও কাটেনি, আর্দালি এসে একটা চিরকুট এনে দিয়েছে, দ্রুত ডাকের গাড়িতে স্পেমবার্গ থেকেই এসেছে সেটা। আগে যে-খবরটা এসেছিলো, তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি নেই। ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে আদপেই দেখা যায়নি ওখানে, বরং এটাই বিশ্বাস করবার যুক্তিসংগত কারণ আছে যে সে সম্ভবত রাগৎস ছেড়েই বেরোয়নি।
আরো দু-দিন কেটেছে, মাইরার অবস্থার কোনো বদল হয়নি। মার্ককে বরং আগের চাইতে একটু শান্ত দেখিয়েছে। আমি শুধু ফাঁক খুঁজেছি কখন ডাক্তার রডারিখের কাছে শহর ছেড়ে চলে যাবার কথাটা পাড়বো।
চোদ্দই জুন দিনটা কিন্তু আগের কয়েকদিনের মতো শান্ত ছিলো না। লোকের উত্তেজনা আর রোষ গিয়ে চরমে পৌঁছেছে, কর্তৃপক্ষ বুঝতে শুরু করেছেন এই উত্তেজনা প্রশমন করার ব্যাপারে তাঁরা কতটাই অক্ষম।
এগারোটা নাগাদ, আমি যখন দানিউবের তীর ধরে হাঁটছি, আমার কানে এই কথাগুলো এলো :
ফিরে এসেছে!… ফিরে এসেছে!
কে-যে ফিরে এসেছে, সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধে হবারই কথা নয়। তবু একজন পথচারীকে ডেকে আমি জিগেস করেছি কী ব্যাপার। তাতে সে বলেছে : তার বাড়ির চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। অন্য-একজন অমনি গায়ে পড়ে বলেছে: মিনারের জানলায় তার ঐ অতি-বদখৎ বিশ্রী মুখটা দেখা গেছে।
এ-সব কথা বিশ্বাস করা ঠিক হবে কি না কে জানে। আমি নিজেই তখন হনহন করে গেছি বুলভার তেকেলির দিকে।
অমন বেপরোয়াভাবে কি ভিলহেল্ম স্টোরিৎস নিজেকে জাহির করবে? শুধু বেপরোয়াই নয়, একটু হাঁদার মতোই ঠেকেছে ব্যাপারটা। কেউ যদি তাকে একবার বাগে পায়, তবে তার যে কী দশা হবে সে কি তা জানে না? অকারণে সে অমনতর ঝুঁকি দেবে কেন? কেন তার অতিপরিচিতবিশ্রীমুখ সে দেখাতে দেবে তার বাড়ির জানলায়?
সত্য হোক, মিথ্যা হোক, খবরটার মাহাত্ম ছিলো। আমি গিয়ে দেখি, এর মধ্যেই কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়েছে সেখানে, পুলিশ বেষ্টনী বানিয়ে কর্ডন করে তাদের ঠেকাতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। শুধু-যে বাড়ির চারপাশেই, তা নয়। আশপাশের রাস্তাতেও ভিড় উপচে পড়ছে। আর বারেবারেই চীৎকার করে জিগির তুলছে : ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর কালো হাত-ভেঙে দাও, খুঁড়িয়ে দাও! ভিলহেল্ম স্টোরিৎস–মুর্দাবাদ!
অযৌক্তিক কিন্তু অমোচনেয়–কী কারণ থাকতে পারে এই বিশ্বাসের পেছনে যে সে ওখানে আছে, সে, আর তার সঙ্গে আছে তারই অজস্র অদৃশ্য সাগরেদ? এই অভিশপ্ত বাড়িটার গায়ে যে উম্মাদ জনতা বাঁধভাঙা প্রস্রবণের মতো ভেঙে পড়েছে, এই উত্তাল জলতরঙ্গ রোধিবে কে? পারবে পুলিশ তাদের ঠেকাতে? আর ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যদি সেখানে থেকে থাকে, পারবে সে এই উম্মাদ জনতার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে? আর জানলায় যদি তাকে দেখা গিয়েই থাকে, সে তবে তখন মোটেই অদৃশ্য ছিলো, তার বস্তুচেহারাই দেখেছে লোকে। আবার অদৃশ্য হয়ে যাবার আগেই তো সে ধরা পড়ে যাবে, আর তাকে ছিঁড়ে খাবে জনতা।
কর্ডন সত্ত্বেও, মঁসিয় স্টেপার্কের অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও, রেলিঙগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, বাড়ির মধ্যে হামলে পড়েছে ভিড়, দরজা ভেঙেছে, চুরমার হয়ে গেছে জানলার কাঁচ, ভেতর থেকে আশবাব ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে উঠোনেলনে, ল্যাবরেটরির সব যন্ত্রপাতি চূর্ণবিচূর্ণ, পদদলিত। তারপর একতলা থেকে লেলিহান লোলজিহ্বা মেলে দিয়ে হাওয়া চেটেছে আগুন, তারপর পাকে-পাকে শিখা পেঁচিয়ে ধরেছে গোটা বাড়িটাই, আর হানাবাড়িটা থুবড়ে পড়েছে দাউদাউ আগুনে, হয়তো-বা জাহান্নামেরই আগুন সেটা।
আর ভিলহেল্ম স্টোরিৎস? মিথ্যেই লোকে তাকে হাড়ে বেরিয়েছে বাড়িটায়, বাগানে, উঠোনে। সে এ-সব জায়গার কোথাও নেই–অথবা এও বলা যায়, তাকে খুঁজে পাওয়া ছিলো অসম্ভব।
দশ জায়গা থেকে আগুনের জিভ লকলক চেটেছে বাড়িটাকে, আস্ত গিলে খেয়েছে, একঘণ্টা পরে পড়ে থেকেছে শুধু চারটে ভাঙাচোরা দগ্ধ দীর্ণ দেয়াল।
হয়তো বাড়িটা যে ধ্বংস হয়ে গেছে, সে একদিক থেকে ভালোই হলো। কে জানে, এতে রাগৎসের লোকের উত্তেজনার প্রশমন হলেও হতে পারে। তারা হয়তো ভেবে বসতে পারে যে হানাবাড়িটার সঙ্গে-সঙ্গে অভিশপ্ত ভিলহেল্ম স্টোরিৎসও ভস্মীভূত হয়ে গেছে–অদৃশ্যই হোক, আর দৃশ্যই হোক।
কিন্তু কোথায় তার ঐ ভস্মাবশেষ?
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
হানাবাড়িটা ধ্বংস হয়ে যাবার পর শহরের টগবগ উত্তেজনা একটু শান্ত হয়েছে, অন্তত লোকে এই ভেবে আশ্বাস পেয়েছে যে শয়তানের ডেরাটা ধ্বংস করে দেয়া গেছে বটে। অনেকে আবার এও ভেবে নিয়েছে যে এই পিশাচসিদ্ধ স্বয়ং ছিলো তখন বাড়িটায়, আর সেও ঐ বহ্নিমান চিতায় পুড়ে মরেছে। আসলে কিন্তু ছাইভস্ম তন্নতন্ন করে খুঁজেও এই বিশ্বাসের যাথার্থ্য আদৌ প্রমাণ করা যায়নি। বাড়িটা আক্রান্ত হবার সময় ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যদি বাড়িতে থেকেও থাকে তবে সে এমন-কোথাও লুকিয়েছিলো আগুন অনেক খুঁজেও যেখানে তার সন্ধান পায়নি।
এদিকে, স্পেমবার্গ থেকে আরো চিঠি এসেছে, আর তাদের বয়ান অবিকল এক না-হলেও একটা বিষয়ে সবাই একমত : তাকে সেখানে দেখা যায়নি, তার স্যাঙাৎ হেরমানকেও সেখানে দেখা যায়নি, আর এরা দুজনে যে কোথায় গিয়ে আস্তানা গেড়েছে সে-বিষয়ে কারুই কোনো ধারণা নেই।
দুর্ভাগ্য এটাই যে শহরের উত্তেজনা কিঞ্চিৎ প্রশমিত হলেও রডারিখ-ভবনে কিন্তু ঠিক তার উলটোটাই ঘটেছে। মাইরার মানসিক ভারসাম্যহীনতার কোনো হেরফের হয়নি। অচৈতন্য, সমস্ত সেবাযত্নে নিঃসাড়, সে এখনও কাউকে চিনতেই পারে না–শুধু ফ্যালফ্যাল করে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এতদিনে ডাক্তাররা আর আশা দেখাবার মতো দুঃসাহস পাচ্ছেন না। তবে, যদিও অতিরিক্ত দুর্বল সে, তার জীবনের কোনো আশঙ্কা নেই। সে শুধু পড়ে আছে এলায়িত, আলুথালু, অনড়, মৃত্যুর মতো বিবর্ণ। যদি কেউ তাকে তুলে ধরে বসাতে চায়, তার বুক থেকে বেরিয়ে আসে চাপা কান্না, চোখে ফুটে ওঠে সাতরাজ্যের আতঙ্ক, হাতদুটো অস্থির ওঠে-নামে, অসংলগ্ন সব কথা অস্ফুট বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে। তবে কি তার স্মৃতি ফিরে আসছে ধীরে, অতি ধীরে? সে কি আবার মনে-মনে বেঁচে নিচ্ছে সেইসব দুঃসহ আতঙ্ক, সান্ধ্য-মজলিশের দৃশ্য, ক্যাথিড্রালের কেলেঙ্কারি? এখনও কি তার কানে বেজে যাচ্ছে তার আর মার্কের প্রতি উদ্দিষ্ট সেই ভয়ংকর অভিসম্পাত? হোক বিভীষিকা, তবু এও ভালো, যে তার মন অতীতের স্মৃতিকে রক্ষা করতে পেরেছে।
ভাবা কি যায়, কীভাবে বেঁচে আছে এই বাড়ির মানুষগুলো? মার্ক বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়ে না। ডাক্তার আর মাদাম রডারিখের সঙ্গে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মাইরার রোগশয্যার পাশে, রোগিণীকে নিজের হাতে দাওয়াই দেয় পথ্য খাওয়ায়, আর তার অস্থির চোখ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় মাইরার চোখে চৈতন্যের কোনো ছাপ ফুটে উঠছে কি না।
ষোলো তারিখের বিকেলবেলায় আমি একা-একাই এলোমেলো ঘুরে বেড়িয়েছি রাগৎসের পথে-পথে, হঠাৎ মাথায় একটা ভাবনার উদয় হয়েছে : দানিউবের ডান তীরে–ওপারে–চলে গেলে কেমন হয়। অনেকদিনই ভেবেছি, একদিন যেতে হবে ওদিকটায়, কিন্তু এ-সব বিপর্যয়ের মধ্যে অ্যাদ্দিন একফোঁটাও ফুরসৎ পাইনি যে নিজের খেয়ালখুশি মতো বেড়াবো। তাছাড়া বেড়াবার আনন্দের প্রশ্ন অবশ্য এমন অবস্থায় ওঠেই না। তবু আমি এগিয়ে গেছি সেতুর দিকে, পেরিয়ে গেছি নদীর মাঝখানকার দ্বীপটা, শেষটায় এসে পা রেখেছি সারবিয়ার তীরে।
ভেবেছিলুম একটু বেড়িয়েই ফিরে আসবো, শেষে কিন্তু অনেকটাই সময় কেটে গেলো। সেতুর কাছে যখন ফিরে এসেছি, তখন সাড়ে-আটটার ঘণ্টা বেজেছে; নদীর পাড়েই একটা সারবিয় সরাইখানায় সেরে নিয়েছি ডিনার। জানি না মাথায় তখন কোন ভূত চেপেছিলো। সরাসরি ফিরে-যাবার বদলে, আমি শুধু সেতুটার প্রথম অর্ধেকটা পেরিয়েছি, তারপর নেমে গিয়েছি মস্ত সেই সড়কটা দিয়ে সোজা মাঝনদীর সেই দ্বীপটাতে।
দশ গজও গিয়েছি কি না সন্দেহ, আমার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গিয়েছে মঁসিয় স্টেপার্কের। তার সঙ্গে আর কেউ ছিলো না; আমাকে দেখবামাত্র আমার কাছে এসে আলাপ জুড়ে দিয়েছেন, এবং ঘুরে-ফিরে তো সেই একই কথা–ভিলহেল্ম স্টোরিৎস বিনা তো কোনো গীত নেই।
দুজনে মিলে হাঁটতে-হাঁটতেই আলোচনা করছিলুম। হয়তো বিশ মিনিটের বেশি হবে না, আমরা পৌঁছে গেছি দ্বীপটার উত্তরবিন্দুতে। সবে রাত নেমে এসেছে তখন, গাছপালার তলায় ফাঁকা পরিত্যক্ত রাস্তায় ছায়া ঘনিয়েছে। শ্যালেগুলো সব রুদ্ধদ্বার, পথে কারু সঙ্গেই আমাদের দেখা হয়নি।
রাগৎস-এ ফিরে যাবার সময় হয়েছে। আমরা ফিরে আসতে যাবো, এমন সময় হঠাৎ কতগুলো কথা আমার কানে পৌঁছুলো। তক্ষুনি আমি থমকে পড়েছি, মঁসিয় স্টেপার্কের হাতটা চেপে ধরে তাকেও থামিয়েছি। তারপর ঝুঁকে ফিশফিশ করে তার কানে-কানে বলেছি-যাতে আর-কেউ শুনতে না-পায়- ঐ শুনুন! কে যেন কথা বলছে… আর ঐ গলা–রুক্ষ, চেয়াড়ে… ঐ গলা তো ভিলহেল্ম স্টোরিসের!
তেমনি নিচু গলায় মঁসিয় স্টেপার্ক বলে উঠেছেন, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস!
হ্যাঁ ।
আমাদের ও দেখতে পায়নি!
না। রাত সবই সমান করে দেয়–আমাদেরও ওর মতোই অদৃশ্য করে দেয়।
গলাটা অস্পষ্টভাবে কানে আসছে–কিংবা বলা যায় গলাগুলো, কারণ অন্তত দুজন লোক নিশ্চয়ই আছে ঐ আবছায়ায়।
হুঁ… একা নয়, মঁসিয় স্টেপার্ক ফিশফিশ করে বলেছেন।
না… সম্ভবত ওর সেই কাজের লোক
মঁসিয় স্টেপার্ক আমাকে একরকম টেনেই নিয়ে গেছেন একটা গাছতলায়, মাটিতে গুড়ি মেরে বসে পড়েছেন। অন্ধকারকে ধন্যবাদ, হয়তো তার সৌজন্যে আমরা কোনোরকমে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে আরো-একটু কাছে গিয়ে স্পষ্ট করে শুনতে পাবো এরা কী বলছে। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যেখানে আছে বলে আন্দাজ করেছি তার থেকে দশ-পা দুরে গিয়ে আমরা গুঁড়ি মেরে লুকিয়ে আছি। তাদের আমরা দেখতেই পাইনি, দেখতে পাবো বলেও আশা করিনি-আর সেইজন্যেই নিরাশও বোধ করিনি। বরং কেমন যেন চনমনেই বোধ করেছি। তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেবার পর থেকে আমাদের এই পহেলা দুশমনটি যে কোথায় আছে আর কী-সব বদ মৎলব আঁটছে সেটা জানবার কোনো সুযোগই আমরা পাইনি। হয়তো আজ একে পাকড়াবারও একটা মওকা মিলে যাবে।
উৎকর্ণ হয়ে সব শুনছি আমরা। আমরা যে ধারে-কাছেই কোথাও আছি, তা বোধহয় ভিলহেল্ম স্টোরিৎস ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেনি। ডালপালার মাঝে গুঁড়ি মেরে, ঝুঁকে, শ্বাস ফেলবারও সাহস হচ্ছে না, আমরা অবর্ণনীয় মানসিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে-যেতে কান পেতে শুনছি কী-শলাপরামর্শ করছে তারা, কখনও স্পষ্ট কখনও একটু-বা অস্পষ্ট, কেননা প্রভুভৃত্য এই গাছপালার ফাঁকে পায়চারি করতে করতেই বলছিলো কথাবার্তা।
প্রথম যে-কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি, সেটা ভিলহেল্ম স্টোরিসের।আমরা কাল থেকে ওখানে যেতে পারবে তো?
কাল থেকে, বলেছে তার অদৃশ্য সহচর–সম্ভবত তার কাজের লোক হেরমান, আর আমরা যে কোথায় আছি তা কাকপক্ষীতেও টের পাবে না।
কখন তুমি রাগৎসে ফিরে গিয়েছিলো?
আজ সকালেই।
বেশ… আর ঐ বাড়িটা? ভাড়া নেয়া হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, বেনামে।
তুমি ঠিক জানো যে আমরা খোলাখুলিই থাকতে পারবো ওখানে? কেউ আমাদের চেনে না ঐ–
হতাশাটা কোন পর্যায়ে পৌঁছুতে পারে, তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করাই যায়। কী দুর্ভাগ্য! ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যখন শহরটার নাম বলেছে, কথা বলতে-বলতে সে দূরে চলে গিয়েছে আমাদের কাছ থেকে, শহরটার নাম আমরা শুনতেও পারিনি। তবে যতটুকু শুনেছি, তাতেই বোঝা গেছে আমাদের এই দুশমনটি আর খুব-একটা দেরি না-করেই যাতে দৃশ্যমান হয়ে-যাওয়া যায়, মানুষী রূপ ফিরে পায়, তার ওপরই নির্ভর করে আছে। এত তাড়া কীসের তার? কেনই-বা এ-রকম একটা ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে? তবে কি বেশিদিন অদৃশ্য থাকলে ঐ রাসায়নিকের প্রভাবে স্বাস্থ্যের খুব ক্ষতি হয়?
স্বরগুলো আবার যখন কাছে ফিরে এলো, হেরমান তখন কী-একটা কথা পেড়ে তারই জের টেনে বলে চলেছে যাব শেষটুকুই শুধু আমরা শুনতে পেয়েছি :ঐ ছদ্মনাম নিলে রাৎসের আহাম্মক পুলিশগুলো আমাদের কোনোদিনই খুঁজে বার করতে পারবে না।
রাগৎসের পুলিশ?… তার মানে হাঙ্গেরিরই কোথাও তারা থাকতে চাচ্ছে?
তারপর আবার তাদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলো। তার ফলেই মঁসিয় স্টেপার্ক প্রায় অশ্রুস্ট স্বরে বলতে পেরেছেন,কোন্ শহর? কী-সব ছদ্মনাম? প্রথমে আমাদের এই তথ্যগুলোই জেনে নিতে হবে-যে-করেই হোক।
আমি কোনো উত্তর দেবার আগেই পায়ের আওয়াজ কাছে এসে পড়েছে, আমাদের চেয়ে মাত্র কয়েক পা দূরে এসে তারা থেমেছে।
স্প্রেমবার্গে যাওয়া কি, জিগেস করেছে হেরমান, এতই জরুরি?
ভীষণ। কারণ টাকাকড়ি সব সেখানকারই ব্যাঙ্কে আছে। এখানেও আছে, তবে। এখানে ব্যাঙ্কের ধারে-কাছেও নিরাপদে যাওয়া যাবে না। আর ওখানে
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে রক্তমাংসের শরীরে গিয়ে সেখানে দেখা দেবেন?
অগত্যা। তাছাড়া আর উপায়ই বা কী? চোখে না-দেখে কেউ তো আর ঝুলি থেকে কানাকড়িও বার করবে না।
তাহলে আমি যা ভেবেছিলুম, সেটাই ঘটেছে। স্টোরিৎস এখন এমন-একটা জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে অদৃশ্য হয়ে-থাকাটা তার পক্ষে আর মোটেই সুবিধেজনক। নয়। তার এখন টাকা চাই, আর সেইজন্যে এখন তাকে তার এই আশ্চর্য ক্ষমতাটাকে ত্যাগ করতে হবে। সে কিন্তু তখনও বলে চলেছে : সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো এটাই যে কী-যে করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ঐ আকাটগুলো গিয়ে আমার ল্যাবরেটরিটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে–দু-নম্বর সলিউশনের একটা শিশিও আর নেই। ভাগ্যিশ গাড়লগুলো বাগানের মধ্যকার গোপন জায়গাটা খুঁজে পায়নি, কিন্তু এখন তো সেটাও ঐ ধ্বংসস্তৃপের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে। সে-জায়গাটা গিয়ে তোমায় সাফ করে দিতে হবে।
যেমন বলবেন, তা-ই হবে, বলেছে হেরমান।
পরশু দশটা নাগাদ এসো। দিন বা রাত্রি–সবই তো সমান এখন আমাদের কাছে, তবে একটু স্পষ্ট দেখা যাবে, এই যা।
কেন? কাল নয় কেন?
কাল আমাকে অন্য-একটা কাজ করতে হবে। আবার একটা জম্পেশ গোছের তাকলাগানো কাণ্ডের ফন্দি এঁটেছি আমি–আর আমরা তো জানিই কে-সে এ-কাজটা খুব-একটা পছন্দ করবে না।
দুজনে আবার পায়চারি করতে-করতে দূরে চলে গিয়েছে। ফের যখন কাছে ফিরে এসেছে, তখন :
না, আমি রাগস ছেড়ে চলে যাবো না, কিছুতেই না, গররর করে উঠেছে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস। যতক্ষণ মাইরা আর ঐ ফরাশি ছোকরা এখানে থাকবে, পরিবারটাকে আমি মজা দেখিয়ে ছাড়বো। কী-যে ঘৃণা করি ওদের!
একটা যেন ক্রুদ্ধ গর্জন বেরিয়ে এসেছে তার মুখ থেকে, মানুষের ভাষার বদলে। তখন সে আমাদের একেবারে কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো, হয়তো হাত বাড়ালেই তাকে পাকড়ে ফেলা যেতো তখন। কিন্তু আমাদের সমস্ত মনোযোগ তখন হেরমানের কথার ওপর গিয়ে পড়েছে :এখন রাগৎ-এ সব্বাই জানে যে আমরা ইচ্ছে করলেই অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি, কিন্তু কেমন করে, সেটা জানে না।
আর, সেটা তারা কোনোদিনই জানবেও না, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস ঘোষণা করেছে। রাগ্রৎস্ এখনও আমার শেষ দ্যাখেনি। ভেবেছে, আমার বাড়ি পুড়িয়ে ফেলে বুঝি আমার সব গোপন কথাই পুড়িয়ে ফেলেছে!–গাড়লের দল!… না, রাগৎ আমার প্রতিহিংসার হাত থেকে রেহাই পাবে না। এই শহরের একটা ইট, একটা পাথরও আমি আস্ত রাখবো না!
শহরের সর্বনাশ ঘটাবার সংকল্প যেখানে ঝনঝন করে বেজে উঠেছে, সেই কথাগুলো তখনও বোধহয় শেষ হয়নি, গাছপালাগুলো ভীষণভাবে নড়ে উঠেছে। মঁসিয় স্টেপার্ক আর নিজেকে সামলাতে না-পেরে বুনো মোষের মতো কণ্ঠস্বরগুলোর দিকে ছুটে গেছেন, চীৎকার করে বলে উঠেছেন, আমি একটাকে পাকড়েছি, ভিদাল! আপনি অন্যটাকে পাকড়ান!
তাঁর হাত, দৃশ্যমান না-হলেও, রক্তমাংসেরই কোনো শরীরের ওপর পড়েছে। কিন্তু তাকে এমন জোরে ধাক্কা দিয়েছে কেউ, যে উলটে তিনিই চিৎপটাং পড়ে যাচ্ছিলেন, শুধু শেষ মুহূর্তে আমি তাকে আঁকড়ে ধরে ধাক্কার বেগটা কমিয়ে দিয়েছি।
আমি ভেবেছিলুম, আমরাই বেকায়দায় পড়েছি, আমরা তো আর আমাদের শত্রুদের দেখতে পাচ্ছি না–এরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বরং হো-হো করে আমাদের বামদিকে কেউ বিদ্রুপের সুরে অট্টহাসি হেসে উঠেছে, আর তারপরেই দূরে মিলিয়ে গেছে ছুটন্ত পায়ের শব্দ।
শয়তানটাকে বাগে পেয়েও কাবু করতে পারিনি! আপশোশ করে চেঁচিয়ে উঠেছেন মঁসিয় স্টেপার্ক। তবে একটা জিনিশ এখন আমরা নিঃসংশয়ে জেনে গিয়েছি –অদৃশ্য হয়েছে বলে এদের শরীর যে আঁকড়ে ধরতে পারবো না, তা নয়।
কিন্তু বরাৎটাই খারাপ, তারা তবু আমাদের হাত এড়িয়ে পিঠটান দিয়েছে, এবং কোথায় যে তাদের গা-ঢাকা দেবার আস্তানা, তার কোনো হদিশই আমাদের জানা নেই। তা সত্ত্বেও মঁসিয় স্টেপার্কের উৎফুল্লভাবটার কোনো কমতিই হয়নি।
এবার বাছাধনদের বাগে পেয়েছি, ফেরবার পথে নিচু গলায় কোনো গোপন কথা আমায় ফাঁস করে দেবার ভঙ্গিতে তিনি আমায় বলেছেন, শত্রুদের দুর্বল জায়গাটা আমরা জানি, জানি যে স্টোরিৎস তার ভাঙা বাড়িটায় পরশুদিন যাবে। তাতে আমরা দু-ভাবে তাকে কজা করতে পারবো। একটা ভেস্তে গেলেও অন্যটা সফল হবেই!
মঁসিয় স্টেপার্কের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর আমি রডারিখ-ভবনেই ফিরে গিয়েছি। সেখানে, মাদাম রডারিখ আর মার্ক যখন মাইরার শুশ্রূষা করবার জন্যে রোগিণীর ঘরেই থেকে গেছে, আমি ডাক্তার রডারিখের সঙ্গে একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে তাকে খুলে বলেছি এইমাত্র দ্বীপে কী হয়েছে।
ডাক্তারের মনে হয়েছে ভিলহেল্ম স্টেরিৎস যেভাবে হুমকি দিয়েছে, গোটা রাগৎস সমেত রডারিখ পরিবারের ওপর যেভাবে বদলা নেবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়ে আছে, তাতে বোধহয় সবাইকে নিয়ে রাস ছেড়ে চলে যাওয়াই মঙ্গল। এবার এখান থেকে পালাতে হবে সবাইকে, এবং পালাতে হবে গোপনে–যত শিগগির পারা যায়, ততই ভালো।
আমিও আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, আমি তার প্রস্তাবে সায় দিয়েছি, তবে আমার শুধু একটাই খটকা আছে। মাইরার শরীরের যা অবস্থা, তাতে সে কি পথের ধকল সইতে পারবে?
তার স্বাস্থ্যের কোনো ঊনিশবিশ হয়নি নতুন করে, ডাক্তার রডারিখ আমায় জানিয়েছেন, শরীরে তার কোনো কষ্ট নেই। শুধু তার মনের ওপর দিয়েই দারুণ একটা ঝড় চলেছে।
সেটা সে সময়ে সামলে উঠবে, আমি আশ্বাস দিয়েছি, হাওয়াবদল হলে এমনিতেই মনমেজাজ ভালো হয়ে যায়, তার ওপর এমন-কোনো দেশে যদি যায় যেখানে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই
কিন্তু হায়! খেদ ব্যক্ত করেছেন ডাক্তার, আমরা কি এখান থেকে চলে গিয়েই বিপদটাকে এড়াতে পারবো? ভিলহেল্ম স্টোরিৎস কি আর কোনো দুষ্ট গ্রহের মতো আমাদের পেছন নেবে না?
কোথায় যেতে চাচ্ছি, কখন যেতে চাচ্ছি, এ-সব যদি আমরা গোপন রাখতে পারি, তাহলে সে আমাদের পেছন নেবে কী করে?
আর গোপন! মন-খারাপ-করা সুরে বলে উঠেছেন ডাক্তার।
মার্কের মতো স্বয়ং ডাক্তার রডারিখও তাহলে এখন জিগেস করছেন, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর কাছ থেকে কোনোকিছুই গোপন রাখা যায় কি না! সে হয়তো এখন এই ঘরে বসে-বসে আমাদেরই সব আলোচনা শুনছে!
তবু যাওয়াই ঠিক হয়েছে, এবং মাদাম রডারিখও কোনো আপত্তি তোলেননি। তারও ধারণা, হাওয়াবদল করলেই বোধহয় মাইরা সেরে উঠবে। মার্কেরও কোনো দ্বিমত নেই। আমি অবশ্য তাকে দ্বীপের ঘটনাটা খুলে বলিনি, বলে ফায়দাটাই বা কী হতো, মাঝখান থেকে সে আরো-ঘাবড়ে যেতো! তবে কাপ্তেন হারালানকে আমি আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে সব খুলে বলেছি। যাবার ব্যাপারে তারও কোনো আপত্তি নেই। সে শুধু জিগেস করেছে : আপনিও আসবেন তত আপনার ভাইয়ের সঙ্গে?
আর কীই-বা করতে পারি, বলো–
আমি কিন্তু যাবো না। এমন দৃঢ় গলায় সে কথাটা বলেছে যে মনে হয়েছে তার এই সংকল্পের আর-কোনো নড়চড় হবে না।
যাবে না?…
না… আমি রাগৎ-এই থাকবো, কেননা শয়তানের বাচ্চাটাও এখানেই আছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, থেকে গেলেই আমি ভালো করবো।
তর্ক করে কোনো লাভ নেই, অতএব এ নিয়ে আমি কোনো তর্কই করিনি, বরং বলেছি, বেশ, তাহলে তা-ই হবে, কাপ্তেন।
আমি কিন্তু আপনার ওপর ভরসা করে আছি, মঁসিয় ভিদাল–আপনি আমার বদলে বাড়ির সকলের কাছে-কাছেই থাকুন। এখন তো আপনি আমাদেরই একজন হয়ে গেছেন।
সে তুমি আমার ওপর ভরসা করতে পারো, আমি তাকে আশ্বাস দিয়েছি।
আর তার পরেই আমি যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করেছি। দিনে-দিনেই বেরিয়ে গিয়ে দুটো ভালো দেখে গাড়ি ভাড়া করেছি, যাতে আরামে যাওয়া যায়, তারপর মঁসিয়। স্টেপার্কের সঙ্গে দেখা করতে গেছি : আমাদের পরিকল্পনাটা তাকে অন্তত জানিয়ে যাওয়া উচিত। তিনিও আমাদেরই তরফে রায় দিয়েছেন, এটা আপনারা খুব ভালো ভেবেছেন। শহরশুদু লোকজনও যদি তা-ই করতে পারতো তো খুবই ভালো হতো!
তাঁকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। দেখাবে না-ই বা কেন? কাল রাতে আমরা নিজের কানে যা শুনে এসেছি তারপর কেই-বা আর স্বস্তিতে থাকতে পারে?
সাতটার সময় আমাকে শহরে গিয়ে নিজের চোখে একবার দেখে আসতে হবে সব ঠিকঠাক ব্যবস্থা হয়েছে কি না।
আটটার সময় ঘোড়ায়-টানা গাড়িগুলো এসে হাজির হয়েছে। একটাতে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন রডারিখদম্পতি, অন্যটায় আমি আর মার্ক। দুটো গাড়ি দুটো আলাদা রাস্তা দিয়ে শহরের বাইরে যাবে–যাতে পর-পর দুটো গাড়ি দেখে কারু মনে কোনো সন্দেহ উঁকি না-মারে।
আর ঠিক তখনই এমন-একটা ঘটনা ঘটেছে, যেটা ছিলো কল্পনাতীত-নাটুকে ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভীষণ, ভয়াবহ।
গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে তৈরি, একটা প্রধান ফটকে, অন্যটা বাগানের দিকে, খিড়কির পাশে। ডাক্তার রডারিখ মার্ককে নিয়ে মাইরার ঘরে গেছেন, তাকে ধরাধরি করে নিচে নামিয়ে আনবেন বলে।
আতঙ্কে হতচকিত, স্তম্ভিত হয়ে, তারা দাঁড়িয়ে পড়েছেন চৌকাঠে।
বিছানা শূন্য!
মাইরা যেন হাওয়ায় উবে গিয়েছে!!