৩. বিজয় রায়ের বাড়িতে

তা বিজয় রায়ের বাড়িতে লখাইয়ের অবারিত দ্বার, খালুইভর্তি মাছ রোজ সে রায়বাড়িতেই বিক্রি করে পয়সা তাঁকে খুঁজে বাড়ি ফেরে। তাই সে একদিন বিজয়বাবুকে গিয়ে ধরল।

বিজয়বাবুর ঘরখানা দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। ঘরের চারখানা দেওয়াল যেন ইট গেঁথে তৈরি হয়নি, হয়েছে বই গেঁথে। মেঝে থেকে ছাদ অবধি তাক-ভর্তি শুধু বই আর বই। টেবিলে বই, চেয়ারে বই, বিছানায় বই, মেঝেতেও স্থূপ হয়ে পড়ে আছে বই। শোনা যায়, বিজয়বাবুর স্নানের ঘরেও নাকি মেলা বই। বিজয়বাবুকে বই ছাড়া কমই দেখা যায়। সর্বদাই চোখে ভারী চশমা এঁটে নাকের সামনে বই মেলে ধরে পড়ে যাচ্ছেন তো পড়েই যাচ্ছেন।

লখাই ঘরে ঢুকে জুত করে বিজয়বাবুর পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়ে বলল, “বাবু, একটা কথা আছে।”

বিজয়বাবু চোখের সামনে থেকে বইখানা ঈষৎ সরিয়ে বললেন, “লখাই নাকি রে? কী দরকার?”

“আজ্ঞে, একটা সমিস্যেয় পড়ে আসা।”

“কীসের সমস্যা?”

“সমিস্যেটা ভূত নিয়ে।”

“অ। তা আমার কাছে কেন রে? পীতাম্বর ওঝার কাছে গেলেই তো হয়। না হলে বিভূতি ডাক্তারকে ডেকে মৃগীর চিকিৎসা করা।”

“আজ্ঞে, কাউকে ভূতে ধরেনি আজ্ঞে।”

“ধরেনি? তা হলে সমস্যা কীসের?”

“ভূত জিনিসটা কী দিয়ে তৈরি আর মরার পরও তারা বেঁচে থাকেন কী করে, এ দুটো জিনিস একটু বলে দিলে ভাল হয়।”

বিজয়বাবু অট্টহাসিটা ভালই হাসেন। অনেকটা ঔরঙ্গজেবের মতো। যাত্রাপালাটা দেখেছে লখাই। হেসে নিয়ে বিজয়বাবু বললেন, “শোন, ভূত বলে কিছুই নেই, আর মরার পর তারা কেউ বেঁচেও নেই, বুঝলি! এখন যা, মাথায় ঠান্ডা জল চাপড়ে ভাত খেয়ে গিয়ে ঘুমো৷”

লখাই শশব্যস্তে বলল, “আজ্ঞে, না মশাই, বগাদার সঙ্গে যে প্রায়ই আমার দেখা হয়, কথাবার্তাও হয়।”

“বগাটা আবার কে?”

“বগা সামন্ত, আজ্ঞে। একশো বছর আগে সাপকাটিতে মারা গিয়েছিল। তা তিনিই কথাটা জানতে চেয়েছেন।”

বিজয়বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “তা ভূত যদি আমার কাছে এসে জানতে চায়, তা হলে না হয় দেখা যাবে। এখন যা তো, বিরক্ত করিস না।”

লখাই মনখারাপ করে ফিরে এল। পরদিন বগাকে বলল, “না বগাদা, উনি মোটে মাথাই পাতলেন না। ভূতকে ভারী তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন বলেই মনে হল।”

বগাও হতাশ হয়ে বলল, “তা কী আর করবি? আমাদের কপালই খারাপ।”

তিন-চারদিন পর অবশ্য বিজয়বাবুকে একটু নড়েচড়ে বসতে হল।

রাত তখন বারোটা বেজে গিয়েছে। বিজয়বাবু বসে একমনে একখানা বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়ছেন। বাহ্যজ্ঞান নেই।

ঠিক এই সময় কে যেন খুব বিনয়ের সঙ্গে একটু গলাখাঁকারি দিয়ে ডাকল, “বাবু, একটু নিবেদন ছিল, আজ্ঞে!”

বিজয়বাবু অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর সামনে হাতজোড় করে একজন বুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে।

বিজয়বাবুদের বিরাট পরিবার, বাড়িটাও বিশাল বড়। আত্মীয়স্বজনে ভর্তি। তা ছাড়া কাজের লোকও মেলা। সবাইকে বিজয়বাবু চেনেনও না।

বললেন, “কী চাই?”

“আজ্ঞে, আমাকে সুধীরবাবু পাঠালেন। উনি একটু মিটিং নিয়ে ব্যস্ত বলে নিজে আসতে পারলেন না। তাই আমাকেই পাঠিয়েছেন কথাটা বলতে।”

বিজয়বাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “সুধীরবাবু! সুধীরবাবুটা আবার কে?”

লোকটা শশব্যস্তে বলল, “আজ্ঞে, ন’পাড়ার সুধীরবাবুর কথাই বলছি। সুধীর ঘোষ।”

বিজয়বাবু অবাক হয়ে বললেন, “সুধীর ঘোষ! তা কী করে হয়? গত বিস্তার না শুক্রবার, কবে যেন তার শ্রাদ্ধের ভোজ খেয়ে এলাম যে?”

লোকটা হাত কচলে ভারী আহ্লাদের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে, তা ভোজটা কেমন ছিল বাবু?”

বিজয়বাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “তা ভালই তো ছিল। লুচি, বেগুনভাজা, মোচার চপ, ধোঁকার ডালনা, ছানা ভাপে, ছোলার ডাল, চাপড়ঘণ্ট, ফুলকপির রোস্ট, আমসত্ত্বের চাটনি, দই, সন্দেশ, রসগোল্লা, রসমালাই। হ্যাঁ, তা বেশ ভালই খাইয়েছিল। যার শ্রাদ্ধ হয়ে গিয়েছে, সেই লোক তোমাকে পাঠায় কী করে?”

লোকটা হেঁ হেঁ করে একটু হেসে বলল, “আজ্ঞে, সেটাই তো সমস্যা। এই সমস্যার একটা বিহিত যে আপনাকে করে দিতেই হবে!”

“তুমি কি বলতে চাও যে, সুধীর ঘোষ আদৌ মারা যাননি? তা হলে কি মারা যাওয়ার আগেই তার ছেলেরা আগাম শ্রাদ্ধ করে রাখল? কিন্তু তাই বা হয় কী করে? সেরকম তো নিয়ম নয়! লোকে নিজের আগাম শ্রাদ্ধ করে রাখতে পারে বটে, কিন্তু ছেলেরা কি তা পারে?”

লোকটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “না বাবু না, তিনি নির্যস মরেছেন। সুধীর ঘোষ মোটেই বেঁচে নেই। আবার মরেও বেঁচে আছেন, আর এইটেই সমস্যা। এই আমি যেমন। গত বছর বোশেখ মাসে সান্নিপাতিকে মরেছি। কিন্তু দেখুন, এখনও কেমন টিকে আছি!”

বিজয়বাবু আঁতকে উঠে বললেন, “মরেছ মানে? মরেছ বললেই হবে?”

লোকটা করুণ গলায় বলল, “ওই তো আপনাদের দোষ! পণ্ডিত মানুষরা সহজে কিছু বিশ্বাস করতে চান না। ঠিক আছে, তা হলে নিজের চোখেই দেখুন, বেঁচে আছি কি না।”

বলেই লোকটা বিজয়বাবু চোখের সামনেই ফুস করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বিজয়বাবু হাঁ। তারপর তার চোখের সামনেই যেন একটা অদৃশ্য দরজা খুলে গ্যালগ্যালে হাসিমুখে বেরিয়ে এসে লোকটা হাতজোড় করে বলল, “দেখলেন তো?”

বিজয়বাবু হাতের বইটা পাশের টেবিলে রেখে খুব চিন্তিত মুখে বললেন, “তাই তো! এ তো খুব মুশকিলে ফেলে দিলে দেখছি। কয়েকদিন আগে আমাদের লখাইও এরকম কী একটা বলতে এসেছিল।”

“তা বাবু এবার একটু বইপত্তর ঘেঁটে দেখবেন নাকি, আমাদের কথা কিছু লেখা আছে কি না?”

“দেখছি। ভূতের উপরেও কিছু বই আমার আছে বটে! সেগুলো ভাল করে পড়া হয়নি। এবার পড়তেই হবে।”

লোকটা তাঁকে একটা নমো ঠুকে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার পর বিজয়বাবু কিছুক্ষণ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল, আমি কি সত্যিই ভূত দেখলাম? আঁ, ভূত দেখলাম নাকি আমি? ওরে বাবা! আমি যে ভূত দেখে ফেললাম! বলতে বলতেই তাঁর নোম খাড়া হয়ে উঠল। মাথার চুল সব শজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে যেতে লাগল। শরীর ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। গলা দিয়ে স্বর ফুটতে চাইছিল না। তবু প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়ে তিনি বিকট গলায় চেঁচাতে লাগলেন, “ভূত! ভূত! ভূ-উ-ত! ভূ…!”

ওই বিকট চেঁচানিতে ঘুম ভেঙে বাড়ির লোকজন সব ছুটে এল। হাতপাখা এল, জল এল, মহা শোরগোল পড়ে গেল চারদিকে।

পরদিন সকালেও নিজের ডেকচেয়ারটিতে কাহিল হয়ে এলিয়ে বসে বিজয়বাবু আপনমনে বিড়বিড় করে যাচ্ছিলেন, “আমি কি ভূত দেখে ফেললাম নাকি রে বাবা? ওরে বাবা, আমি যে ভূত দেখে ফেললাম! আঁ, সত্যিই কি দেখে ফেললাম নাকি? বাপ রে! তবে কি দেখেই ফেললাম? অ্যাঁ?”

হাড়কিপটে নীলমণি ঘোষ এসে বললেন, “আহা, দেখেই যখন ফেলেছ তখন তো ল্যাটা চুকেই গিয়েছে। এ হল শীতকালে জলে ডুব দেওয়ার মতো। প্রথম ডুবটা দিয়ে ফেললেই হল, তারপর যত খুশি ডুব দাও। একবার ভূত দেখে ফেললে তো আড় ভেঙেই গেল হে! আর ভয়টা কীসের?”

বিজয়বাবু এতই আনমনা যে, প্রথমটায় নীলমণি ঘোষকে চিনতেই পারলেন না। শুধু বললেন, “ওরে বাবা রে, আমি যে ভূত দেখেছি! দেখেই ফেলেছি! একেবারে স্বচক্ষে দেখে ফেললাম যে!”

স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক বিধুভূষণ চাকি এসে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বললেন, “ভূত দেখেছেন মানে? ভূত অমনি

দেখলেই হল? এর পর তো লোকে সাপের পা, ডুমুরের ফুল এসবও দেখতে পাবে? না না, বিজয়বাবু, আপনাকে আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক, শিক্ষিত, যুক্তিবাদী লোক বলে জানতাম। শেষ অবধি আপনিও যদি ওসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তা হলে তো দেশ উচ্ছন্নে যাবে?”

শুটকো অনাদি মিত্তির খ্যাক করে উঠে বললেন, “বেশি ফ্যাচফ্যাচ কোরো না তো বিধু! বিলেতের একটা ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা নিয়মিত ভূত দেখতে পায়। আর সেটা একজন বৈজ্ঞানিকেরই ভূত।”

“এ খবর আমিও পড়েছি। তারা ভুল দেখেছে।” হরেন কাঁড়ার বুড়োমানুষ। দাড়ি নেড়ে বললেন, “গোপালহাটির দুটো জিনিস খুব বিখ্যাত। একটা হল, ষষ্ঠী ময়রার মাখাসন্দেশ, আর হল, এখানকার ভূত! আগে তো সাহেবসুবোরাও জুড়িগাড়ি চেপে গোপালহাটির ভূত দেখতে আসত। সন্ধের পর ভূতেরাও সব সেজেগুঁজে বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু সেই দিনকাল কি আর আছে? ষষ্ঠী ময়রার মাখাসন্দেশেও আর সেই সোয়াদ নেই, ভূতেরাও সব গায়েব। তা বিজয়ভায়ার ভাগ্য ভাল যে, অন্তত একখানা ভূতের দেখা পেয়েছে। তাতে গোপালহাটির মানটা অন্তত বাঁচল!”

গদাধর সমাদ্দার প্রতিবাদ করে বলল, “না না, হরেনজ্যাঠা, এ আপনি কী বলছেন? গোপালহাটিতে এখনও ভূত গিজগিজ করছে। এই তো সেদিন নীলকুঠিতে সন্ধেবেলা স্বচক্ষে আমি একজোড়া সাহেব-মেমকে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে দেখেছি।”

গোপীনাথ সামন্ত ডন-বৈঠক করে, ছোলা খায়, গুলি ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সে তেজালো গলায় বলে উঠল, “ওসব ভূতফুত কিচ্ছু নয়। আসুক দেখি ভূত আমার সামনে, কেমন বুকের পাটা? ভূতের গুষ্টির তুষ্টি করে ছেড়ে দেব না!”  

মৃগেন মিত্তির রোগাভোগা হলেও গলার জোর আছে। হেঁকে বলল, “অত বীরত্ব ফলিয়ো না হে! ভূতের সঙ্গে লড়তে চাও তো একবার আমার শ্বশুরবাড়ি গ্যাদরাপোতা থেকে ঘুরে এসো, বীরত্ব চুপসে যাবে। সেখানে চালে ভূত, ডালে ভূত, জলে ভূত, গাছে ভূত, ছাদে ভূত, একেবারে ভূতে ভূতাক্কার। আমার শাশুড়ি তো সেদিন কাঁচকলা ভেবে একটা ভূতকেই ভাতে সেদ্ধ দিয়েছিলেন। গরমভাত থেকে তুলে ছাল ছাড়াতে যাবেন, অমনি কাঁচকলাটা লাফ দিয়ে উঠে ফের গিয়ে গাছে ঝুলে পড়ল। ভূত-সেদ্ধ হওয়া ভাত তো আর খাওয়া যায় না। একহাঁড়ি ভাত ফেলা গেল!”

দোলগোবিন্দ প্রামাণিক খুব হুশিয়ার মানুষ বলে সবাই জানে। কখনও কারও নাম ভুল হয় না। জন্মে সে কোনও দিন পয়সা, চশমা, কলম, চটি, আংটি বা ঘড়ি হারায়নি। বাজার থেকে সতেরোটা জিনিস আনতে দেওয়া হলে কখনও ষোলোটা আনেনি। সেই দোলগোবিন্দ খুব চিন্তিত মুখে বলল, “ভৌতিক কাণ্ড যে একটা হচ্ছে সেটা আমারও মনে হয়। সবাই জানে যে, আমার বড় একটা ভুল-টুল হয় না। তা গতকাল বুকপকেটে বাহান্ন টাকা নিয়ে বাজারে গিয়েছি। দাম দিতে গিয়ে দেখি, টাকাটা নেই। সাবধানের মার নেই বলে আমি বুকপকেটে সেফটিপিন দিয়ে টাকা আটকে রাখি, যাতে পকেটমার না হয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, সেফটিপিন যেমন ছিল তেমনই আছে, কিন্তু টাকাটা হাওয়া। আমার জীবনে এমন কাণ্ড এই প্রথম। হাঁ করে আকাশ-পাতাল ভাবছি, হঠাৎ প্যান্টের বাঁ পকেটে হাত দিয়ে দেখি, সেই বাহান্ন টাকা আমার বাঁ পকেটে ঢুকে বসে আছে। ভৌতিক কাণ্ড ছাড়া একে আর কী বলা যায় বলো তো?”

বৃন্দাবন কর্মকার বলে উঠল, “ওহে, ওরকম কাণ্ড তো আমার পরপর দু’দিন হল। আমার ডান দিকের ট্র্যাকে নস্যির ডিবে থাকে, বহুঁকালের অভ্যেস। দু’দিন হল দেখছি, ডিবেটা যতই ডান ট্র্যাকে খুঁজি না কেন, সেটা ঠিক আমার বাঁ ট্র্যাকে চলে আসছে। ভূতটুত আমি বিশ্বাস করি না বটে, কিন্তু কাণ্ডটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝেও উঠতে পারছি না।”

অনাদি মিত্তির বললেন, “তোমাদের কথায় মনে পড়ল, আমার বাড়িতেও কিন্তু অশৈলী কাণ্ড হয়েছে। গত দু’দিন হল দেখছি, দরজা এঁটে রাতে আমরা শুতে যাই, কিন্তু সকালে উঠে দেখি, খিল, ছিটকিনি সব খোলা। ঘরের জিনিসপত্র কিছু খোয়া যায়নি ঠিকই, কিন্তু জিনিসপত্র কে যেন উলটে-পালটে রেখে গিয়েছে। যেমন আলমারির মাথায় রাখা চামড়ার সুটকেসখানা কে যেন দরদালানে আলনার নীচের তাকে রেখে গিয়েছে। টেবিলঘড়িখানা রেখে গিয়েছে ঠাকুরঘরে। রোজ সকালে গীতা পাঠ করি বলে সেখানা আমার শিয়রে একটা টুলের উপর থাকে। তা দেখি, কে যেন গীতাখানা বইয়ের তাকে তুলে রেখে তার বদলে ‘সচিত্র গোপালভাঁড়’ বইখানা শিয়রে রেখে গিয়েছে।”

বিধুভূষণ চাকি মাথা চুলকে বললেন, “এসব আসলে মনের ভুল ছাড়া কিছু নয়। দু’দিন হল দেখছি, আমার ড্রয়ারে রাখা চাবি বালিশের তলায় পাওয়া যাচ্ছে। আমার গিন্নির দোক্তার কৌটো গিয়ে সবজির ঝুড়িতে ঘাপটি মেরে আছে। তা বলে কি আর এসব ভুতুড়ে ব্যাপার!”

বিজয়বাবু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে এসব কথা শুনছিলেন। কিন্তু তাঁর মাথায় কিছুই সেঁধোচ্ছিল না। মগজটা বড্ড ভোম্বল হয়ে আছে আজ।

দুপুরবেলা যখন ঘরখানা নিরিবিলি হল, তখন খুব ভয়ে-ভয়ে অনেক দোনোমোনো করে তাঁর বইয়ের তাক থেকে ভূত বিষয়ক বইগুলো খুঁজেপেতে বের করলেন। বুকটা একটু ধুকপুক করছে বটে, তবু চারদিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে বই খুলে বসে গেলেন। তিনি হলেন জাতপড়ুয়া। একবার বই খুলে ফেললেই তিনি তাতে ডুবে যান, আর বাহ্যজ্ঞান থাকে না। যখন বেলা পড়ে বাইরের আলো মরে এল, তখন চোখ তুলে বাইরেটা দেখলেন জানালা দিয়ে। তাই তো, সন্ধে যে হয়-হয়! আলো জ্বালাবার জন্য যেই উঠতে যাচ্ছেন, অমনি আঁতকে উঠে দেখলেন, তাঁর সামনেই মেঝের উপর খাপ পেতে উবু হয়ে বসে একটা আধবুড়ো লোক তাঁকে জুলজুল করে দেখছে। কাঁচাপাকা চুল, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। তাঁর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা এমন উত্তেজিত হয়ে উঠল যে, ইস্তফা দেয় আর কী! তিনি প্রথমটায় বাক্যহারা, তারপর কোঁক করে একটা শব্দ বেরোল, তারপর ক্ষীণ গলায় বলে উঠলেন, “ভূ-ভূত! ভূ-ভূত! ভূ-ত! আঁ-আঁ-আঁ…!”

লোকটা টপ করে উঠে এসে দুটো শক্ত হাতে তাঁকে ধরে বসিয়ে দিয়ে ভারী অমায়িক গলায় বলল, “আজ্ঞে, আমি ঠিক ভূত নই।”

কথাটা শুনে লোকটাকে ভারী ভাল লোক বলে মনে হল বিজয়বাবুর। যারা ভূত নয় তাদের মতো ভাল আর কে আছে? তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললেন, “ভূত নন?”

লোকটা যেন একটু চিন্তায় পড়ে গেল। মাথাটাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, ভূত হতে বেশি বাকিও নেই। তিনকুড়ি বয়স তো আর ছেলে-ছোঁকরার বয়স নয়। তবে ভূত হতে গেলে মরারও একটা নিয়ম আছে কিনা! তা সেটা আমার এখনও হয়ে ওঠেনি।”

বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন “তবে আপনি কে?” একগাল হেসে লোকটা বলল, “আমি হলুম একজন লোক।”

শুনে বিজয়বাবু ভারী খুশি। আহ্লাদের গলায় বললেন, “লোক হলেই হবে। লোকেদের মতে ভাল লোক আমি কোথাও দেখিনি।”

লোকটা তাড়াতাড়ি বলল, “আজ্ঞে, নির্যস লোক। তবে ভাল লোক কি না তা বলা ভারী মুশকিল।”

বিজয়বাবু অত্যন্ত উদার গলায় বললেন, “আহা, খারাপটাই বা কী? দিব্যি হাত-পা-মুন্ডু রয়েছে, বাতাসে ফুস করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন না, আর চাই কী? আমার তো কিছু খারাপ মনে হচ্ছে না আপনাকে!”

লোকটা একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, সেটা আমারও মনে হয়। তবে কিনা আমার একটু বদনামও আছে।”

“আহা, সে তো আমারও আছে।” লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলল, “আপনার বদনাম? বলেন কী মশাই? আপনার আবার বদনাম কীসের? সাতে নেই, পাঁচে নেই, দিনরাত বই-বোকা হয়ে বসে আছেন, বদনাম হতে যাবে কেন?”

“বইপোকা বললেন নাকি?”

“না। আমি তো বললাম বই-বোকা, আপনি কি পোকা শুনলেন নাকি?”

“সেরকমই যেন মনে হল। তা সে যাকগে। আমারও বেশ বদনাম আছে কিন্তু…!”

“সেটা কীরকম?”

“আচ্ছা, আপনি ‘কোকাই কার্তিক’ কথাটার মানে জানেন?”

“আজ্ঞে, না। আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ!”

“তা হলে ‘ফুস্‌কামলে’ কাকে বলে তা কি জানা আছে?”

“এই তো মুশকিলে ফেললেন। এসব তো শক্ত-শক্ত কথা!”

“তা হলে অন্তত ‘গোবরগণেশ’টা তো নিশ্চয়ই জানেন?”

লোকটা একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, খুব জানি, খুব।”

“তা লোকে আমাকে কোকাই কার্তিক, ফুস্কামলে এবং গোবরগণেশও বলে থাকে। আমি অবশ্য এসবের মানে জানি না। তবে খুব ভাল কথা বলে মনে হয় না। কী বলেন?”

“আজ্ঞে, আমারও মনে হচ্ছে, এগুলো খুব একটা ভাল কথা নয়।”

“তা ছাড়া লোকে আমাকে ‘জ্ঞানী গেঁড়ে’, “কুমড়োমুখো’, ‘বিদ্যাছাগল’ও বলে থাকে। তবেই বুঝুন, আমারও বদনাম কিছু কম নেই। তা আপনার বদনামটা কোন লাইনে?”

এ কথায় লোকটা ভারী লজ্জা পেয়ে বলল, “সে আর আপনার শুনে কাজ নেই।”

“দেখুন মশাই, আমি শ্রমের মর্যাদা বুঝি। পৃথিবীতে কোনও কাজই ফ্যালনা নয়। সব কাজেরই বিহিত-মর্যাদা আছে, তা চুরি ডাকাতি হলেও।”

“বাঃ, আপনি তো বড় ভাল-ভাল কথা বলেন মশাই? প্রাণটা জল হয়ে গেল! তা আমার বদনামটা ওই লাইনেই। পকেটমারি, চুরি, কেপমারি, এইসব আর কী! তা ধরুন, পেটের দায়ে আমাদের তো বাছাবাছি চলে না। যখন যেটা হয় আর কী!”

“বাঃ, শুনে খুব খুশি হলাম।”

“তা মশাই, আপনার ঘরে যে বই একেবারে গিজগিজ করছে? ঘরখানা কি আপনি ইটের বদলে বই দিয়েই বানিয়েছেন?”

“আরে না না, বইয়ের পিছনে ইটও আছে।”

“আছে? যাক, শুনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল! শুধু বই দিয়ে দেওয়াল গাঁথলে বৃষ্টিবাদলা হলে মুশকিল কিনা! তা এত বই পড়ে কে?”

“কেন, আমিই পড়ি।” লোকটা বড়-বড় চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, “একা?”

“একাই! আমার বাড়িতে আর কেউ তেমন পড়ুয়া নয়।”

“একা এত বই সাপটে ওঠা তো চাট্টিখানি কথা নয় মশাই! আরও দু-চারটে লোক লাগিয়ে দিলে আপনার এত মেহনত করতে হত না। ভাগ-ভাগ করে পড়ে ফেলতেন। দশে মিলি করি কাজ হারি-জিতি নাহি লাজ। তা মশাই, এত লেখাপড়া করতে হচ্ছে কেন আপনাকে? সামনে কি কোনও পাশের পরীক্ষা আছে? গতবার কি পরীক্ষায় ফেল হয়েছিলেন?”

বিজয়বাবু মহা অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে বললেন, “আরে না না, কী মুশকিল, পরীক্ষা-টরিক্ষা নয়। লোকে জানার জন্যই বই পড়ে।”

লোকটা একগাল হেসে বলল, “কী যে বলেন বাবু! বই পড়ে কি কিছু জানা যায়? আমাদের শশধরমাস্টার তো এত বই ঘাঁটে, ঝিঙে আর ধুধুলের বিচির তফাত ধরতে পারল কি?”

কথাটা শুনে বিজয়বাবু ভারী চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাই তো! ঝিঙের বিচি আর ধুধুলের বিচির তফাত তো তাঁরও জানা নেই। সত্যি কথা বলতে কী, বিচি কেন, স্বয়ং ঝিঙে বা ধূধুলকেও তাঁর মনে পড়ল না। অথচ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি ঝিঙে এবং ধুধুলের নাম শুনেছেন এবং সম্ভবত, খেয়েও থাকবেন।

লোকটা জুলজুল করে তাঁর দিকে চেয়ে আছে দেখে বিজয়বাবু একটু বেকায়দায় পড়ে গেলেন। মিনমিন করে বললেন, “ইয়ে, বলছিলাম কী, পৃথিবীতে কত কিছু জানার আছে। তাই না?”

“আছে বই কী! কত কী জানার আছে, তবে কেতাব পড়ে সেসব জানার জো নেই কিনা! ধরুন, ধান আর চিটের তফাত একজন মুখ চাষা লহমায় বুঝে ফেলবে। আপনি সাতশো কেতাব ঘেঁটেও পেরে উঠবেন না।”

এই রে! ধান আর চিটের তফাত যে তিনিও জানেন না! লজ্জা পেয়ে বিজয়বাবু যেন গুটিয়ে ছোট্টটি হয়ে গেলেন। মনে মনে তাঁকে স্বীকার করতে হল যে, এসব জরুরি জিনিস তাঁর জেনে রাখা উচিত ছিল। বই পড়ে তিনি অনেক কিছু জেনেছেন বটে, কিন্তু এখনও জ্ঞানের তেপান্তর সামনে পড়ে আছে। জ্ঞানের দিক থেকে তিনি যে নিতান্তই বেঁটেখাটো একরত্তি একটা মানুষ, এটা আজই প্রথম টের পেলেন তিনি। আমতা আমতা করে বললেন, “তা আপনি বেশ জানেন-শোনেন দেখছি!”

লোকটা ভারী অমায়িক গলায় বলল, “এ আর এমন কী? এই যে কাল রাত্তিরে আপনি ভূত দেখলেন, তা ভূত কী বস্তু দিয়ে তৈরি তা বুঝতে পারলেন কি?”

বিজয়বাবু সাগ্রহে বললেন, “না তো! আপনার জানা আছে নাকি?”

“তা আর জানি না! ফুলের রেণু, প্রজাপতির পাখনা আর মাকড়সার লালা, এই তিন বস্তু মিলিয়ে ভূত তৈরি হয়। ভারী মিহিন জিনিস, হাত দিলে বস্তুটা টেরই পাওয়া যায় না।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান, কথাগুলো টুকে রাখি।”

ডান হাতে খালুইভরা মাছ আর বাঁ কাঁধে ফাঁদি জালটা নিয়ে অন্ধকারে ফিরছিল লখাই। জংলা জায়গাটা পেরিয়ে রাস্তায় ওঠার মুখে থমকাল। অন্ধকারটা তার চোখে সয়ে গিয়েছে। দেখল, দুটো লোক দাঁড়িয়ে এদিক পানেই চেয়ে আছে। ভূতের ভয়টা আজকাল মন থেকে উবে গিয়েছে তার। কিন্তু ভয়-ভীতি তো নানারকম আছে। কে জানে কেন, তার বুকটা একটু দুরুদুরু করে উঠল।

হঠাৎ একটা টর্চের জোরালো আলো তার মুখে এসে পড়ল। কে যেন বলে উঠল, “কে রে তুই?”

লখাই ভয় খেয়ে বলল, “আমি লখাই।”

“কে লখাই? চোর-ছ্যাচোড় নাকি রে?”

“আজ্ঞে, না।”

“ধুস! চোর-ছ্যাঁচোড় হলেই বরং আমাদের সুবিধে হত। তা কী মাছ ধরলি রে? চুনো পুঁটি, না রাঘববোয়াল?”

“আজ্ঞে, চুনোপুঁটি।”

“বেশ বেশ! মাছধরা তো খুব ভাল জিনিস। মৎস্য মারিব খাইব সুখে, কী বলিস?”

“যে আজ্ঞে!”

এবার দ্বিতীয় লোকটা দু পা এগিয়ে এসে বলল, “কিছু মনে কোরো না বাপু লখাই, আমরা একটু বিপদে পড়েই এসেছি। আসলে কী জানো, আমাদের বাবা হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। গত দু’দিন ধরে আমরা গায়ে-গাঁয়ে ঘুরে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। মজবুত চেহারার ষাট-বাষট্টি বছর বয়সের একজন বুড়ো মানুষকে কি দেখেছ? মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। পরনে টাইট করে পরা ধুতি আর গায়ে ফতুয়া?” লখাই সভয়ে মাথা নেড়ে বলল,”আজ্ঞে না।”

“আহা, অত তাড়াহুড়ো করে জবাব দেওয়ার দরকার নেই। একটু ভেবেচিন্তেই হয় বললে!”

“গায়ে লোক এলে জানাজানি হয়ে উপায় আছে? না মশাই, উনি এ গাঁয়ে আসেননি।”

“ঠিক আছে। আমরা ঘুরেফিরে আবার আসব’খন। যদি খবর দিতে পারো তো বখশিশ পাবে।”

“যে আজ্ঞে।”

লোক দুটো হেলতে-দুলতে চলে গেল। একটু দূর থেকে শোনা, দু’জনের একজন দিব্যি শিস দিতে দিতে যাচ্ছে। যার বাপ হারায় তার কি শিস দেওয়ার কথা?

বিজয়বাবুর বাড়িতে মাছটা পৌঁছে দিতে গিয়ে আজ তাজ্জব হয়ে গেল লখাই। সেই বুড়ো লোকটা, টাইট ধুতি, খোঁচা চুল, খোঁচা দাড়ি, বিজয়বাবুর পড়ার ঘরে বসে দিব্যি গল্প জুড়ে দিয়েছে যে!

সন্ধেবেলা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে বড় জা শশীমুখী, বিজয়বাবুর গিন্নি মূর্ছনাদেবী, সেজো জা নয়নতারা আর ছোট জা বাসবী আংড়া জ্বেলে তার কাছে বসে আগুন পোয়াতে-পোয়াতে গল্পগাছা করছেন। ঠিক এই সময় বিজয়বাবু হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “ওগো, এককাপ চা পাঠিয়ে দাও শিগগির। অনেকদিন বাদে মৃগাঙ্কদা এসেছেন।”

মূৰ্ছনাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “মৃগাঙ্কা! মৃগাঙ্কদাটা আবার কে?”

“আহা, আমাদের মৃগাঙ্ক সান্ডেল গো। বাবুপাড়ার মৃগাঙ্কদা।”

এবার শশীমুখী অবাক হয়ে বললেন, “তোমার কি মাথা খারাপ হল ঠাকুরপো? মৃগাঙ্ক সান্ডেল আসবে কী করে?”

“কী করে মানে? আসতে নেই নাকি?”

শশীমুখী মুখঝামটা দিয়ে বললেন, “না, নেই! মৃগাঙ্ক সান্ডেল যে দু বছর হল মরেছে!”

“অ্যাঁ!” বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন বিজয়বাবু। বললেন, “তাই তো! এসব হচ্ছে কী?”

আবার মূৰ্ছার মতো অবস্থা হল। জল এল, পাখা এল। খবর পেয়ে বুড়ো ডাক্তার যতীন পত্রনবিশও এসে হাজির। বুকে নল বসিয়ে, নাড়ি টিপে বিস্তর পরীক্ষা করে বললেন, “এ হয় সিজোফ্রেনিয়া, নয়তো বায়ু থেকে হ্যাঁলুসিনেশন।”

“বায়ু!” কথাটা খুব পছন্দ হল বিজয়বাবুর দাদা অজয় রায়ের। তাঁর পরনে গামছা, হাতে ঘটি। তিনি বললেন, “বায়ু হবে না! কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেই তো বায়ু হয়। ডবল ডোজের জোলাপ ঠেসে দিন, বায়ু হাওয়া হয়ে যাবে।”

অজয়বাবুর কাছে কোষ্ঠকাঠিন্য ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও সমস্যাই নেই। সব রোগ, সব অশান্তি, সব গণ্ডগোলের মূলেই রয়েছে কোষ্ঠকাঠিন্য। এই জন্যই তিনি দিন-রাত হত্তুকি, ত্রিফলা, চিরতা, ইসবগুল খেয়ে থাকেন এবং দিনমানের বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে গামছা পরা অবস্থায় ঘটি হাতে পায়চারি করতে দেখা যায়।

মূর্ঘনাদেবী ঝংকার দিয়ে বললেন, “বায়ু নয় ডাক্তারবাবু, মাথার ব্যামো হয়েছে। তা মাথার ব্যামোর আর দোষ কী? দিন-রাত বই মুখে করে বসে থাকলে ভূত-প্রেত তো দেখবেই।”

শশীমুখী বললেন, “সত্যি কথা বাছা, ওসব ঝুরঝুরে পুরনো বইয়ের মধ্যে ভূত-প্রেতের বাসা হলে আশ্চর্যের কিছু নয়। বইগুলো এবার সেরদরে পতিতপাবনের কাছে বেচে দে মূৰ্ছনা! সব ঠোঙা হয়ে যাক।”

একথা শুনে নির্জীব বিজয়বাবু পট করে উঠে বসলেন। বললেন, “সর্বনাশ! ও কাজও কোরো না! মৃগাঙ্কদা তো সেই কথাই বলতে এসেছিলেন!”

মূর্ঘনাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “কোন কথা?”

বিজয়বাবু খুব চিন্তিতভাবে মূর্ঘনাদেবীর মুখের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বললেন, “বইয়ের কথাই কী যেন বলছিলেন। এখন ঠিক মনে পড়ছে না।”

শশীমুখী রাগ করে বললেন, “সব বাড়িতেই এক-আধটা পাগল থাকে ঠিকই। এই তো পালবুড়ো সারাদিন বিড়বিড় করে বকছে আর কাকে যেন কী দেখাচ্ছে। সামন্তবাড়ির বড়গিন্নি দিনরাত বাড়ির ছেলে-বুড়োকে গোবরজলে নাইয়ে ছাড়ছেন। ঘোষবাড়ির মেয়ে শেফালির বিয়ে হল না বলে সারাদিন বউ সেজে বসে থাকে। তা সে এক-আধটা পাগল তবু সামলানো যায়। কিন্তু এ বাড়ির সব ক’টাই যে পাগল! কেউ কোষ্ঠপাগল, কেউ বইপাগল, কেউ স্বাস্থ্যপাগল, কেউ মিচকেপাগল, আর ছোটজন তো বদ্ধপাগল।”

শশীমুখীর মুখের উপর কথা কয় এমন সাহস এ বাড়ির কারও নেই। বড়কর্তা অজয়পদ গিন্নির মেজাজ দেখে সুড়সুড় করে বাথরুমের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। সেজোভাই ব্যায়ামবীর সুজয়পদ মেজদাকে ময়ূরাসন শেখাবে বলে এসেছিল, বড়বউদির মেজাজ দেখে সে আর দাঁড়াল না। সান্ধ্য ব্যায়ামে হাজির হতে ব্যায়ামাগারের দিকে হাঁটা দিল। গন্ধক আর নিশিন্দা মিশিয়ে ধোঁয়া দিলে ভূত-প্রেত পালায় কি না সেটা দেখার জন্য সলিউশনটা একটা কাঁচের পাত্রে নিয়ে এসেছিল অভয়পদ, অবস্থা বেগতিক দেখে সেও পিছু হটে নিজের রসায়নাগারে গিয়ে সেঁধিয়ে পড়ল। ছোট গুরুপদ নানা অপরাধে অপরাধী বলে সাহস করে ঘরে ঢোকেনি। বাইরে বসেই উঁকিঝুঁকি মারছিল। বড়বউদির গলা শুনেই সুট করে সরে পড়ল।

যতীনডাক্তার ব্যাগ গুটিয়ে উঠে পড়ে বললেন, “ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই বউমা। বংশটাও তো দেখতে হবে। ওদের বাপ শিবপদকে দ্যাখোনি? উঠোনে গর্ত করে তার ভিতর সেঁধিয়ে তন্ত্রসাধনা করত। এ বাড়িতে ভূতের পত্তন যদি কেউ করে থাকে, তবে সে-ই করে গিয়েছে। এখন ভূত-প্রেতের আনাগোনা হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। তোমরা বরং বিরিঞ্চিওঝাকে খবর দাও গে!”

ডাক্তার বিদেয় হওয়ার পর মূর্ঘনাদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠলেন। শশীমুখী কিছু মিছে কথা বলেননি। এ বাড়ির লোকগুলো একটু মেনধারা যেন আছে বাপু! তাঁর দেওর সুজয়পদ এমনিতে কিছু খারাপ নয়, কিন্তু তার সারা শরীরে চামড়ার নীচে যেন কিলবিলিয়ে মাগুরমাছ ঘুরে বেড়ায়। মূৰ্ছনাদেবী মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন, “হ্যাঁ রে সুজয়, তোর গায়ে যে সারাদিন মাগুরমাছ ঘঘারে, তোর কাতুকুতু লাগে না?”

হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হেসে সুজয় বলল, “তুমি এর মর্ম কী বুঝবে মেজোবউদি, এ হল গিয়ে মাসল, মাল। এই হল বাইসেপ, এই হল ট্রাইসেপ, এই হল ল্যাটিসমাস আর এই হল সিম প্যাক।” বলে যখন নানা অঙ্গভঙ্গি করে সুজয়পদ আর মাগুরমাছগুলো আরও খলবলিয়ে ওঠে, তখন মূছনাদেবীর মূর্ছা যাওয়ার দশা। কিন্তু গায়ে জোর থাকলেই হবে? বাড়িতে সেদিন চোর আসতেই সুজয়পদ সবার আগে গিয়ে খাটের তলায় সেঁধিয়েছিল। অভয়পদ আর এক কাঠি সরেস। এম এসসি না কি ছাইভস্ম পাশ করে বাড়িতে একখানা রসায়নাগার খুলে নানারকম ওষুধবিষুধ তৈরি করছে দিনরাত। একদিন একটা শিশি হাতে নিয়ে বেরিয়ে সবাইকে দেখাল, এই যে দেখছ, সারাবাড়িতে ছড়িয়ে দিলে একটাও মশা থাকবে না। তা দিল ছড়িয়ে। তাতে মশা গেল কি না বোঝা গেল না, কিন্তু মাছির উৎপাতে সবাই অতিষ্ঠ। শুয়োপোকা তাড়াতে শিউলি গাছে ওষুধ দিয়েছিল। তাতে শুয়োপোকার সঙ্গে গাছটাও গেল মরে!

ছোট দেওর গুরুপদরও গুণের ঘাটতি নেই। পড়াশোনা গোল্লায় দিয়ে সাপুড়েদের কাছে সাপধরা শিখছে। জাদুকরের কাছে শিখছে জাদুবিদ্যা। কিছুদিন তান্ত্রিকের কাছে তালিম নিয়েছিল, তবলচির কাছে তবলা। যখন যেটা মাথায় চাপে সেটাই শিখতে লেগে যায়। এই তো কয়েকদিন আগে মদনপুরের হাট থেকে একটা বুড়োকে ধরে এনে বাড়িতে তুলেছে।

মূৰ্ছনাদেবী ভারী রেগে গিয়ে বললেন, “ওটা কাকে ধরে আনলি রে হতভাগা?”

একগাল হেসে গুরুপদবলল, “ইনি কত গুণী লোক মেজোবউদি। এঁর একটা ইশকুল আছে।”

মূৰ্ছনাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “স্কুল আছে তো থাক না। এ বাড়িতে এনে জোটালি কী করতে?”

গুরুপদ মাথা চুলকে বলল, “আসলে উনি স্কুলটা এ গাঁয়েই তুলে আনতে চান।”

“ও মা! গোপালহাটিতে সত্যশরণ মেমোরিয়াল স্কুল থাকতে আবার স্কুল কীসের?”

কাঁচুমাচু হয়ে গুরুপদ বলল, “এটা ঠিক ওরকম স্কুল নয় মেজোবউদি। এ হল একটা কারিগরি বিদ্যার স্কুল।”

কারিগরি বিদ্যা-টিদ্যা বোঝেন না মূর্ঘনাদেবী। তবে এটা বোঝেন যে, তার এই ছোট দেওরটিরও মাথার দোষ আছে। আর বুড়ো লোকটাও যেন কেমনধারা! সবসময় জুলজুল করে চারদিকে চেয়ে নজর রাখছে। মূর্ঘনাদেবী মোটেই ভাল বুঝছেন না।

রাতে রান্নাঘরে রুটি বেলতে বসে তিনি শশীমুখীকে বলেই ফেললেন, “বুঝলে দিদি, ওই বটু সর্দার এ বাড়িতে আসার পরই কিন্তু ভূত-প্রেতের উৎপাত শুরু হয়েছে।”

শশীমুখী বললেন, “তাই তো! কথাটা তো আমার খেয়াল হয়নি। প্যাঁড়া, আজই লোকটাকে ঝেটিয়ে তাড়াব।”

মূর্ঘনাদেবী আর্তনাদ করে বললেন, “না না দিদি, ওসব করতে যেয়ো না। ভূত-প্রেত নিয়ে যারা ঘোরে তারা অনেক কিছু করতে পারে। শেষে হিতে বিপরীত হবে যে! তার চেয়ে যাতে মানে-মানে বিদেয় নেয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”

পাঁচটা গা ঘুরলেও এক সময় রবির মতো পাকা হাতের লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। বাপ-পিতেমোর আমল থেকেই তারা ঝাড়েবংশে চোর। হামা দেওয়া অবস্থা থেকেই তার তালিম শুরু। বাবা চোর, জ্যাঠা চোর, কাকা চোর। চোরে-চোরে ধুল পরিমাণ। তবে দিনেকালে দেখা গেল, রবি তার বাপ-দাদাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। হেন দরজা বা জানলা নেই যা সে লহমায় হাট করে খুলতে পারে না। এমন বাক্স বা লোহার সিন্দুক নেই যা খুলে ফেলতে তার তিন মিনিটের বেশি সময় লাগে। ভাল চোরের আর-একটা লক্ষণ হল, আগাম খবর রাখা। যেমন-তেমন বাড়িতে ঢুকে ছিচকে চুরি করলে খাটুনিতে পোষায় না। রবি কখনও ছোটখাটো কাজ করেনি। তঙ্কে তকে থেকে, নানা সূত্রে খবর নিয়ে বরাবর ঝোঁপ বুঝে কোপ মেরেছে।

ফলে নীচের মহলে রবির নাম ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। বিশ বছর বয়সেই সে দামি সাইকেল কিনে ফেলল। বাড়িতে রেডিয়ো আনল। মাকে গরদের শাড়ি দিয়ে পুজোর সময় প্রণামও করে ফেলল। রবির হাতযশে সকলেই বেশ খুশি। তার তিরিক্ষি মেজাজে বাপ পর্যন্ত তার সঙ্গে হুশিয়ার হয়ে কথা বলতেন।

শুধু তার স্কুলের মাস্টার ব্রজবিলাসবাবু তাকে মাঝে-মাঝে স্মরণ করিয়ে দিতেন, “ওরে রবি, কত বড় একজন মানুষের নামের সঙ্গে তোর নাম জড়িয়ে আছে বাবা, কথাটা কিন্তু ভুলিস না। নামের মর্যাদা রাখিস।”

“তা কী করব মাস্টারমশাই? পদ্য লিখব, না দাড়ি রাখব?”

“আরে না না, ওসব তোকে করতে হবে না। শুধু রবীন্দ্রনাথ নামটা খেয়াল রাখতে বলছি। তুই যে-সে মান্না নোস, রবীন্দ্রনাথ মান্না এটা মনে রাখলেই হবে।”

“তা মা-বাপ যদি আমার একটা ভুল নাম রেখেই থাকেন, তা হলেই বা আমার কী করার আছে বলুন!”

“ওরে, তোকে কিছু করার কথা বলিনি, বরং না-করার কথাই বলছি। রবীন্দ্রনাথ যা-যা করে গিয়েছেন তা যদি না-ও পেরে উঠিস বাবা, তা হলে অন্তত রবীন্দ্রনাথ যা-যা করেননি সেগুলো করতে যাসনি। ওটুকু বুঝে চলতে পারলেই যথেষ্ট।”

কথাটার মধ্যে একটা লাটুর মত প্যাঁচ ছিল। বুদ্ধিমান রবি সেটা ধরতেও পারল। কিন্তু নাম-পুজো করলে যে পেট-পুজোয় টান পড়বে, এটাও তো সত্যি!

এর পর যখন সে বিয়ে করল, তখন তার পিছনে লাগল বউ পটলরানি। রোজ ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, “ওগো, তুমি চুরিটুরি ছেড়ে দাও। ওসব পাপ আর কোরো না। আমি চোরের বউ হয়ে জীবন কাটাতে চাই না। তার চেয়ে ভিক্ষে করা ভাল।”

শুনে ভারী রেগে যেত রবি। বলে কী রে মেয়েটা? সে বুক চিতিয়ে বলত, “আরে। আমি কি হাতা-ন্যাতা চোর নাকি? পাঁচটা গা ঘুরে এসো তো, তল্লাটের সব চোর আমার নাম শুনে কপালে হাত ঠেকায় কি না দেখে এস। আমার কত নামডাক, কত খাতির তা জানো?”

পটলরানি চোখের জল ফেলে বলত, “অমন নামডাকের মুখে ছাই। আমার অমন নামডাকের দরকার নেই। শাক-ভাত, নুন-ভাত খাব, তবু হকের পয়সায় খাব, চুরির পয়সায় নয়।”

দু’-দু’বার রাগ করে পটলরানি বাপের বাড়িও চলে গিয়েছিল। তাও হয়তো রবি চুরি ছাড়ত না। কিন্তু শেষ অবধি বোধ হয় ব্রজবিলাসবাবু আর পটলরানির অভিশাপেই ছাড়তে হল। সে ভারী লজ্জার ঘটনা। এক রাতে যন্ত্রপাতির থলি নিয়ে সবে বেরিয়েছে, এমন সময় পাঁচ-সাতজন মুশকো লোক চারদিক থেকে এসে তাকে জাপটে ধরে বেঁধে ফেলল। তারপর টানতে টানতে শ্মশানেশ্বরী কালীমন্দিরের চাতালে নিয়ে ফেলল। লোকগুলোকে ভালই চেনে রবি। চত্বরের যত চোর আর ডাকাত! রবির হাতযশের ফলে এদের ইদানীং হাঁড়ির হাল হয়েছে। যে বাড়িতেই ঢোকে সেই বাড়িতেই রবি আগে ঢুকে জিনিসপত্র সাফ করে ফেলেছে। তাই সবাই মিলে মিটিং করে ঠিক করেছে, কালীর সামনে রীতিমতো মন্ত্রপাঠ করে তাকে বলি দেবে।

প্রাণের ভয়ে রবি বিস্তর কান্নাকাটি করেছিল। তার যে এমন পরিণতি ঘটতে পারে সেটা সে আন্দাজ করেনি। শেষে জৌ গ্রামের প্রবীণ মানুষ পাঁচুগোপাল মধ্যস্থ হয়ে বলল, “এর বয়স কম, ঘরে কচি বউ আর বিধবা মা আছে। ওর কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে বরং একটা সুযোগ দাও তোমরা। আবার যদি চুরিতে নামে তখন আর ছাড়া হবে না।”

মুচলেকা নয়, তাকে মা কালীর পা ছুঁয়ে শপথ করতে হয়েছিল যে, জীবনে আর চুরি করবে না।

প্রাণে বেঁচে ফিরে এল রবি। পরদিন থেকে আর চুরি করতে বেরোত না। চুরি ছেড়েই দিল সে। কিন্তু কেন ছাড়ল সেটা আর লজ্জায় কারও কাছে প্রকাশ করতে পারত না।

রবি রাতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয় দেখে তার মা বিন্ধ্যবাসিনী আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। একদিন সকালবেলা তাকে ধরে বললেন, “ও বাবা রবি, তুই যে বড় রাতের বেলা নাক ডাকিয়ে ঘুমোস! কাজকর্ম যে লাটে উঠবে বাবা!”

রবি গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি চুরি ছেড়ে দিয়েছি মা!”

বিন্ধ্যবাসিনী বিস্ময়ে হাঁ, “কী সব্বোনেশে কথা! চুরি ছেড়েছিস মানে? তোরা হলি ঝাড়েবংশে চোর। কুলধর্ম ছেড়ে দেওয়া যে মহাপাতক! লক্ষ্মী কুপিতা হবেন, পূর্বপুরুষের আত্মা অভিশাপ দেবে। কুলধর্ম কি ছাড়তে আছে বাবা? বংশমর্যাদার কথাটা কি ভুলে গেলি? শেষে বাপ-দাদার নাম ডোবাবি নাকি হতভাগা? ওসব কথা বলতে নেই বাবা, পাপ হয়!”

বিন্ধ্যবাসিনীকে আর বোঝানোর চেষ্টা করেনি রবি। হাতে যা টাকাপয়সা ছিল আর পটলরানি স্বেচ্ছায় তার গয়না খুলে দেওয়ায় তা দিয়ে সে বাজারে একখানা চা-মিষ্টির দোকান দিল।

দোকান খুব একটা খারাপ চলে না। কষ্টেসৃষ্টে রবির সংসার চলে যায়। বিন্ধ্যবাসিনী রোজই দু ঘণ্টা ধরে নিয়মিত বিলাপ করেন বটে, কিন্তু পটলরানি খুব খুশি।

রবি যে খুব সুখে আছে তা বলা যায় না, তবে অবস্থাটা তাকে মেনে নিতে হয়েছে।

শীতকালে সন্ধের পর দোকানে আর খদ্দের থাকে না। উনুনের পাশটিতে চৌকিতে বসে হ্যারিকেনের আলোয় রবি বিকিকিনির হিসেব লিখছিল। এমন সময় দুটো অচেনা লোক এসে বেঞ্চে বসল।

লম্বামতো লোকটা বলল, “চা হবে?”

রবি বলল, “দুধ নেই। লাল চা হতে পারে।”

“চলবে। খুব গরম দু’কাপ চা দাও তো।”

ফটিক তার কাজের লোক। তাকে দু’কাপ চা করতে বলে রবি আড়চোখে লোক দুটোকে লক্ষ করল। অপরাধ জগতের লোকজন চিনতে তার বড় একটা ভুল হয় না। তবে কিনা সে আজকাল আর সাতে-পাঁচে থাকে না।

চা খেতে খেতে একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, “ওহে দোকানি, একজন বুড়োমতো মানুষকে দেখেছ? বছর ষাট-বাষট্টি বয়স, মজবুত চেহারা, খোঁচা-খোঁচা চুল?”

রবি একটু উদাস গলায় বলল, “কত লোকই তো আসছে যাচ্ছে।”

লোকটা ঠান্ডা করে বলল, “ওরে বাপ রে! গোপালহাটি আবার এত তালেবর জায়গা কবে হল যে, বাইরের লোক বেড়াতে আসবে?”

রবি একটু হেসে বলল, “তা গোপালহাটি খুব ফ্যালনা জায়গাও নয়। এখানে নীলকুঠি আছে, পুরনো গির্জা আছে, জনসাহেবের কবর আছে। শুনেছি রাজা কুম্ভের মিনারও ছিল। আগে গোপালহাটিতে লোকে বেড়াতেও এসেছে মশাই।”

বেঁটে লোকটা বলে উঠল, “জনসাহেবের কবর! জনসাহেবটা কে?”

রবি মাথা নেড়ে বলল, “তা জানি না। শুনেছি, সাহেব খুব ভাল মানুষ ছিলেন।”

“এ গাঁয়ের কি আগে অন্য কোনও নাম ছিল দোকানি?”

“ছিল বোধ হয়। আমার ঠাকুরদার আমলে এ গাঁ’কে অনেকে আছাপুর বলত বলে শুনেছি।”

লোক দুটো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বেঁটেজন নিচু গলায় বলল, “আছাপুর মানে আর্চারপুর নয় তো রে নিতাই?”

লম্বাজন অর্থাৎ নিতাইও নিচু গলায় বলল, “হতেই পারে, বোধ হয় গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে নামটা আছাপুর হয়ে গিয়েছে।”

“তা হলে কি ঠিক জায়গাতেই এসেছি বলছিস?”

“অত নিশ্চয়ই করে বলি কী করে বল? বটু সর্দার যদি গন্ধে গন্ধে এখানে এসে থাকে, তবে ধরে নিতে হবে, এটাই সেই জায়গা। আরও একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার। লোকটা তো আর হাওয়া হয়ে যেতে পারে না!”

কথাগুলো এমন নিচু গলায় বলা যে, রবির শুনতে পাওয়ার কথাই নয়। কিন্তু যখন চুরি করত তখন রবি নিজের নাক, কান আর চোখকে সজাগ রাখার বিদ্যে শিখেছিল। লোকের ঠোঁট নড়া দেখে কথা আন্দাজ করতেও সে ছিল ওস্তাদ। নইলে লোকের হাঁড়ির খবর জানবে কী করে?

বেঁটেজন রবির দিকে চেয়ে বলল, “ওহে দোকানি, আমরা যার খোঁজে বেরিয়েছি, তিনি আমার বাবা। একটু মাথার দোষ আছে। হুটহাট মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে যান। একটু ভাল করে ভেবে দ্যাখো তো, মাঝারি লম্বা, বেশ গাট্টাগোট্টা চেহারার ষাট বাষট্টি বছর বয়সি কাঁচা-পাকা খোঁচা-খোঁচা চুলওয়ালা একজন বুড়ো মানুষকে এই অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছ কি না?”

রবি খুব দেখেছে। শুধু দেখাই বা কেন, বটু সর্দারের সঙ্গে গতকালও কত সুখ-দুঃখের কথা হল। একসময় বটুর কাছে কিছুদিন তালিম নিয়েছিল রবি। সেসব কথাও হচ্ছিল। তবে হঠাৎ গোপালহাটিতে তার আগমন কেন সেটা বটু সর্দার ভেঙে বলেনি। রবি জানে যে, বটু মোটে বিয়েই করেনি, তার ছেলেপুলে হওয়ার কথাও ওঠে না।

রবি ভালমানুষের মতো মুখ করে বলল, “এ গাঁয়ে নতুন লোক এলে জানতে পারব না, তা কি হয় মশাই? আপনার বাবা এ গাঁয়ে আসেননি।”

নিতাই বেঁটেজনের দিকে চেয়ে নিচু গলায় বলল, “লোকের কথায় বিশ্বাস নেই রে পানু। হুশিয়ার থেকে নজর রাখতে হবে।”

বেঁটে লোকটা অর্থাৎ পানু ফের রবির দিকে চেয়ে বলল, “আচ্ছা, জনসাহেবের কবরটা কোন দিকে বলতে পারো?”

রবি উদাস গলায় বলল, “বলতে পারব না কেন? এখানেই আমার জন্মকর্ম, এত বছর এখানেই কাটিয়ে দিলাম, আর জনসাহেবের কবর কোথায় তা জানব না?”

“তা তো বটেই হে দোকানি। তা ভাবছিলাম, এসেই যখন পড়া গিয়েছে তখন জনসাহেবের কবরটা একবার দেখেই যাই।”

“তা বেশ তো! গাঁ ছাড়িয়ে পুব দিকে বেশ খানিকটা এগোলে কালিন্দীর জঙ্গল পাবেন। বেশ ঘন জঙ্গল, কাঁটা-ঝোঁপটোপ আছে। সাপখোপও মেলা। ভাঙা গির্জার চাতাল ছাড়িয়ে খানিক এগোলেই ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে জনসাহেবের কবর খুঁজে পাবেন। আজকাল আর কেউ তেমন যায় না বলে আগাছা হয়ে কবর ঢাকা পড়ে গিয়েছে। খুঁজে বের করা শক্ত হবে।”

পানু একটু হেসে বলল, “শক্ত কাজ করতেই আমরা পছন্দ করি। তুমি বেশ ভাল লোক হে দোকানি, অনেক খবর-টবর দিলে।”

রবি ঠোঁট উলটে বলল, “কোথায় আর দিলাম? আপনার

হারানো বাবার খবরই তো দিতে পারলাম না।”

পানু বলল, “বাবার জন্য তেমন চিন্তা নেই। মাথা-পাগলা লোক তো! মাঝে মাঝে হারিয়ে যান বটে, কিছুদিন পর আবার ফিরেও আসেন। তবে যতদূর জানি, এখানে তিনি ঠিকই আসবেন। এলে একটু খবরটা দিয়ে। বাড়ির সবাই বড্ড উচাটন হয়ে আছে।”

“তা খবরটা দেব কোথায়?”

“আমরা আশপাশেই কোথাও থাকব। মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যাব’খন।” বলে চায়ের দাম দিয়ে দু’জনেই উঠল। দু’জনের কাঁধেই একটা করে বড়সড় ব্যাগ। রবির অনুমান হল, ওই দু’টির মধ্যে স্লিপিংব্যাগ বা ছোট তাঁবু গোছের কিছু আছে।

বটু সর্দার কী জিনিস দিয়ে তৈরি তা যদি তাকে কেউ জিজ্ঞেস করে, তবে রবি বলতে পারবে না। কখনও মনে হয়, হাওয়া-বাতাস দিয়ে তৈরি। কখনও মনে হয়, স্রেফ রবার। আবার কখনও বা মনে হয়, বুঝি লোহার মুষল। পানু আর নিতাই কেন বটু সর্দারকে খুঁজছে তা রবি অবশ্য জানে না। কিন্তু খুব ভাল উদ্দেশ্যে যে খুঁজছে না, সেটা আন্দাজ করা শক্ত নয়। ভয় হল, বটু সর্দার যতই যোগ-প্রক্রিয়া জানুক, বা যতই বুদ্ধি ধরুক, বন্দুক-পিস্তলের সঙ্গে তো আর পেরে উঠবে না? পানু আর নিতাইয়ের ব্যাগের মধ্যে ওসব জিনিস থাকা বিচিত্র নয়। সেক্ষেত্রে বটু সর্দারের সমূহ বিপদের আশঙ্কা।

দোকান বন্ধ করে রবি বাড়ি যাওয়ার পথে একটু ঘুরে রায়বাড়ির পিছন দিক দিয়ে গিয়ে একটা বিশেষ জানলায় খুব মৃদু তিনটে টোকা দিল। কিছুক্ষণ পর ফের একটা।

জানলাটা নিঃশব্দে একটু ফাঁক হল। ফাঁকে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা একটা মুখ।

“পানু আর নিতাই আপনাকে খুঁজছে।”

“হু।”

“জনসাহেবের কবরেরও খোঁজ হচ্ছে।” বটু সর্দার নির্বিকার গলায় বলল, “সেরকমই তো হওয়ার কথা, হলেই আশ্চর্যির ব্যাপার ছিল। এইটুকু থেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে লায়েক করে দিলুম, সে কি আর আহাম্মকি করতে পারে? করলে ভাবতুম, আমার শিক্ষেটাই বৃথা গিয়েছে।”

“কে? কার কথা বলছেন বলুন তো!” বটু মিটমিট করে চেয়ে বলল, “নিতাইয়ের কথাই তো হচ্ছে।”

“তা সে যদি আপনারই চেলা, তা হলে আর ভাবনা কী? আমি তো ভাবলুম, সে অন্য কোনও মতলবে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

“তা তো খুঁজছেই। তার ভয়েই তো গা ঢাকা দিয়ে আছি।”

“তবে যে বললেন, এইটুকু বয়স থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে লায়েক করেছেন?”

“তা তো করেছিই। ফুটবল খেলা দেখিসনি?”

“তা দেখব না কেন?”

“ধর, দুটো ভাই দু দলে খেলছে। তা ভাই বলে কি একজন আর-একজনকে ছেড়ে কথা কইবে? নিতাইয়ের সঙ্গে এখন আমার সেই সম্পর্ক।”

“তা আপনাকে পেলে নিতাই কী করতে চায়?”

“সে আর শুনতে চাসনি। রাতের ঘুম নষ্ট হবে। বাড়ি যা।”

“আর-একটা কথা শুনেই চলে যাব। নিতাইকে পেলে আপনি কী করবেন?”

বটু মিটমিট করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, “আমার কিছু করার নেই।”

“তবে কি মরবেন?”

বটু নির্বিকার গলায় বলল, “আমাকে না মেরে নিতাইয়ের উপায় নেই কিনা।”

“আপনি খুব গোলমেলে লোক।”

“কেন বল তো?”

“নিতাই আপনাকে মারতে চায় জেনেও কেন যেন হেলদোল নেই আপনার।”

বটু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বিকিকিনি শেষ হলে দোকানদাররা দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেয়! তাই না?”

“তা তো দেয়ই। আপনারও কি ঝাঁপ ফেলার সময় হয়েছে?”

এবার একটু হাসল বটু। তারপর বলল, “ঠিক ধরেছিস। অনেক চোর-ছ্যাঁচোড় তৈরি করেছি, পাপটাপও বড় কম জমেনি, বুঝলি!”

“আর-একটা কথা, জনসাহেবের কবর নিয়ে কথা উঠছে কেন?”

“উঠছে নাকি? তা উঠলে আমি কী করব?”

“তার মানে আপনি বলবেন না?”

“সব গুহ্যকথা জেনে তোর হবেটা কী? যত জানবি তো বিপদ। বিপদ-আপদকে কি ডেকে এনে পিঁড়ি পেতে বসাতে আছে?”

“জনসাহেবের কবরের কথা আমিই নিতাই আর পানুকে বলেছি। কাজটা ভুল হল কি না বুঝতে পারছি না।” নির্বিকার গলাতেই বটু বলল, “তুই না বললেও আর কেউ বলত। তুই কিছু ভুল করিসনি।”