৩. বাঁকা মহারাজকে ভয়

পাথরপোতার বাঁকা মহারাজকে ভয় খায় না, এমন লোক কাছেপিঠে পাওয়া ভার। তার কারণও আছে। বাঁকা মহারাজ হয়কে নয় করতে পারেন, কালোকে সাদা, দিনকে রাত করলেন তো পুন্নিমেকে অমাবস্যা। বাঁকা মহারাজের মহিমা শুনে শুনে কয়েক বছর আগে সুধীর গায়েন মহারাজের নজরানা বাবদ পঞ্চাশটা টাকা কোনওমতে জোগাড় করে পাথরপোতায় গিয়ে হাজির হয়েছিল।

একেবারে পা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “বাবা, বেঁটে বলে কেউ পাত্তা দেয় না, মান্যিগণ্যি করে না, ভাল করে তাকিয়েও দ্যাখে না। মনে বড় কষ্ট বাবা। অন্তত ছয় ফুট লম্বা করে দিন। এই তো সেদিন ভজনবাবুর বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়লুম। তা ভজনবাবু দরজা খুলে চারদিক দেখে ‘কোথায় কে’ বলে দরজা প্রায় বন্ধই করে দিচ্ছিলেন। এরকম সব হচ্ছে বাবা। অপমান আর সইছে না।”

বাঁকা মহারাজ চিন্তিত মুখে তার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “লম্বা হতে চাস?”

“যে আজ্ঞে। নইলে গলায় দড়ি দেব।”

বাঁকা মহারাজ বাঁকা হেসে বললেন, “কোন দুঃখে লম্বা হতে যাবি রে? মানুষ যত বেঁটে হয়, তার তত বুদ্ধি। লম্বা হতে চাস তো এক তুড়িতেই তোকে লম্বা করে দিতে পারি। কিন্তু তাতে কী হবে জানিস তো! মাথার যত রসকষ টেনে নিয়ে তোর শরীরটা ঢ্যাঙা হবে। তখন ভ্যাবলা হয়ে যাবি, বোকা হয়ে যাবি, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চারদিকের কাণ্ডকারখানা কিছুই বুঝতে পারবি না। লোকে বলবে, ওই দ্যাখ, একটা হাবাগোবা ঢ্যাঙা লোক যাচ্ছে।”

কথাটা শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসে সুধীর বলে, “তা হলে কি আমি বেশ বুদ্ধিমান লোক বাবা?”

“তা নোস তো কী? বামন অবতারের কথা শুনিসনি? বামন ভগবান তো তোর চেয়েও বেঁটে ছিল। তা বলে ক্ষমতা কম ছিল কি? রাম বেঁটে, কৃষ্ণ বেঁটে, হিটলার বেঁটে, নেপোলিয়ন বেঁটে। ওরে দুনিয়াটা তো বেঁটেদেরই হাতে।”

সুধীর তবু দোনামোনা করে বলে, “কিন্তু লোকে যে আমাকে মোটে লক্ষই করে না বাবা! বড় অপমান লাগে যে!”

“দুর পাগল, লোকের নজরে থাকা কি ভাল! সব সময় মানুষের নজরদারিতে থাকলে যে কাজকর্মে খুবই অসুবিধে। বরং বেঁটে বলে গা-ঢাকা দিয়ে কাজ গুছিয়ে নিতে পারবি। বেঁটে হওয়া তো ভগবানের আশীর্বাদ রে! কত লোক বেঁটে হওয়ার জন্য আমার কাছে এসে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকে।”

সেই দিনই সুধীরের চোখের সামনে থেকে যেন একটা পরদা সরে গেল। তাই তো! বেঁটে হওয়ার সুবিধের দিকগুলো তো তার এতদিন নজরে পড়েনি! এই যে গোপাল সাধুখাঁর বাড়ির ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে সে ক্যাশবাক্স সরিয়ে আনল, লম্বাচওড়া হলে পারত কি? কালীতলার সুখলাল শেঠের গদিতে ধরা পড়তে পড়তেও যে বেঁচে গেল, সে শুধু বেঁটে বলেই না! সুখলালের ছেলেটা তো ধরেই ফেলেছিল প্রায়, চড়চাপড়ও কষিয়েছিল কয়েকটা। কিন্তু সবই হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল। শেঠবাড়ির বড় নর্দমার ফুটো দিয়ে চম্পট দিতে তার তো কোনও অসুবিধেই হয়নি!”

সে তাড়াতাড়ি বাঁকা বাবাকে পেন্নাম করে বলল, “বাবা, আপনার আশীর্বাদে আমি যেন চিরকাল বেঁটেই থাকি।”

তা বাঁকা মহারাজের আশীর্বাদে সুধীর এখনও বেঁটেই আছে। আর বেঁটে থাকার আনন্দে তার মনটা মাঝে-মাঝে বড়ই উচাটন হয়। সাবধানের মার নেই বলে সে মাঝে-মাঝেই গিয়ে গোবিন্দপুরের হারু দর্জিকে দিয়ে নিজের মাপ নিয়ে আসে। গত হপ্তাতেই হারু তার মাপ নিয়ে বলল, “না রে, তুই সেই চার ফুট তিন ইঞ্চিই আছিস।”

মাঝেমধ্যে অবশ্য একটু দুশ্চিন্তা হয়। চার ফুট তিন ইঞ্চিটা কি একটু বেশিই লম্বা হয়ে গেল না! এতটা লম্বা হওয়া কি ভাল? বাসন্তী সার্কাসের জোকার হরগোবিন্দ মাত্র আড়াই ফুট। আর চরণগঙ্গার জটেশ্বর চার ফুটের চেয়েও কম। ষষ্ঠীতলার নগেন পাল চার ফুট এক ইঞ্চি। তা হলে কি সে লম্বাদের দলেই পড়ে গেল? আর একটু বেঁটে হলে কি ভাল হত না! আবার এও ভেবে দ্যাখে যে, বাঁকা মহারাজ যখন তাকে বেঁটে বলেছে, তখন সে নির্ঘাত বেঁটেই। তাই সুধীর মাঝে মাঝে গুনগুন করে গায়,

“বড় যদি হতে চাও, বেঁটে হও তবে।
দুনিয়াটা একদিন বেঁটেদেরই হবে।
বেঁটে যার পিতামাতা, বেঁটে যার ভাই,
তার মতো ভাগ্যবান আর কেহ নাই।
বেঁটেগণ যতজন আছে এই ভবে।
একত্রিত হলে তারা দুধেভাতে রবে।
বেঁটে পায়ে হেঁটে হেঁটে যাবে বহু দূর।
দুনিয়া লুটিয়া তারা আনিবে প্রচুর।
জয় বেঁটে, জয় বেঁটে, বেঁটেদের জয়।
বেঁটে হয়ে বেঁচে থাকো সদানন্দময়।”

লম্বা-চওড়া লোক দেখলে আজকাল সুধীরের করুণাই হয়। বেচারারা জানে না, লম্বা হয়ে কী ভুলটাই না করেছে।

বেশ আনন্দেই ছিল বটে সুধীর। কিন্তু তার মতো মনিষ্যিদের একটা দিন ভাল যায় তো পরের দিনটাই খারাপ। আজ পুন্নিমে তো কালই অমাবস্যা। মন্টুরামের হাতে হেনস্থা হওয়ার পর থেকে সবাই দুয়ো দিচ্ছে তাকে। এমন কথাও বলছে যে, আলমারির মধ্যে দম বন্ধ হয়ে মরে গেলেও নাকি সে শহিদের সম্মান পেত আর মোটা ক্ষতিপূরণও আদায় হত। না মরে বড়ই ভুল করে ফেলেছে সে। কালোবাবু তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছেনই, আগামের হাজার টাকাও ফেরত চেয়েছেন। ফেরত না দিলে যে কী হবে, তা ভাবতেও হাত-পা হিম হয়ে আসে। তাই আজকাল সুধীরের ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ে। খিদে হয় না, ঘুম হয় না, বেঁটে হওয়ার দরুন যে আনন্দটা হত, সেটাও হয় না। লাইনের বন্ধুবান্ধবরা আগে খোঁজখবর নিত, তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

এমনকী, কানাই দারোগা পর্যন্ত তাকে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, “ওরে চোর-পুলিশের সম্পর্কটা তো আজকের নয়, হাজার হাজার বছরের পুরনো সম্পর্ক। চোর ছাড়া যেমন পুলিশের চলে না, তেমনি পুলিশ ছাড়া চোরের মহিমা থাকে না। বুঝলি? সম্পর্কটা অনেকটা বাপ-ব্যাটার মতো। আবহমান কালের ব্যাপার। তাই তোর ভালর জন্যই বলি, বিদ্যেটা একটু ভাল করে ঝালিয়ে নিয়ে তবে কাজে নামিস বাবা! মন্টুরাম তোর নামে একটা ডায়েরি করে রেখেছে বটে, তবে তুই কাঁচা চোর বলে আমি কেস দিচ্ছি না।”

এ কথা শুনে সুধীরের ভারী আবেগ এসে পড়ায় সে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “আর চুরিটুরি করব না বড়বাবু।”

তাতে কানাই দারোগা ভারী অবাক হয়ে বলল, “চুরি করবি না! চুরি করবি না কেন রে? চুরি না করলে তোরই বা চলবে কী করে, আমাদেরই বা চলবে কী করে? বলছি কী, হাত মকশো করে নিয়ে কাজে লেগে যা। আর পুলিশের সঙ্গে যে তোর বাপ-ব্যাটার সম্পর্ক, সেটা ভুলিস না। খোরপোশ বাবদ কিছু করে দিয়ে যাস বাবা।”

“যে আজ্ঞে।”

“এখন যা বাবা, আমার বাড়ির কাজের মেয়েটা তিনদিন ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে। এই তিনটে দিন ঘরের ছেলের মতো আমার বাড়ির কাজগুলো করে দে। বেশি কিছু নয় রে, ঘরদোর ঝাড়পোছ করবি। কাপড়চোপড় কেচে দিবি আর বাসনগুলো মেজে দিবি। আর ওই সঙ্গে বাগানটাও একটু কুপিয়ে দিস বাবা।”

এটা যে আরও বড় অপমান, সেটাও সুধীর হাড়ে হাড়ে টের পেল। এর চেয়ে জেল খাটলেও সেটা সম্মানের ব্যাপার হত। অপমানে অপমানে সে যেন আরও বেঁটে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেঁটে হওয়ার আনন্দ টের পাচ্ছে না।

চৈতন্যপুরের খালধারে বাঁধানো বটতলায় একটা গামছা পেতে শুয়ে নিজের দুঃখের কথাই ভাবছিল সুধীর গায়েন। ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্ৰামতো এসে গিয়েছিল। এমন সময় টের পেল, তার শিয়রের কাছে কে যেন এসে সাবধানে বলল, “কালোবাবু নয় তো!” কালোবাবু এমনি ভাবেই হঠাৎ-হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে হাজির হয়ে যান, কখনও যেন বাতাস থেকে শরীর ধরেন। কখন কোথায় হাজির হবেন, তার ঠিক নেই। কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা ওই মূর্তিকে দেখলে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। তাই সুধীর জোর করে চোখ বন্ধ রেখে মটকা মেরে পড়ে রইল।

শিয়রের কাছে বসা লোকটা যেন উসখুস করল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, “উঃ! এখানে বড্ড চোর চোর গন্ধ পাচ্ছি।”

কথাটা শুনে সুধীর টক করে উঠে বসল। খিঁচিয়ে উঠে বলল, “চোর চোর গন্ধ পাচ্ছেন মানে! গন্ধ পেলেই হল? চোরের গায়ে কি আলাদা গন্ধ থাকে নাকি?”

বুড়োসুড়ো লোকটা ধুতির খুঁটে নাক চেপে ছিল। জুলজুল করে সুধীরের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “তা থাকে বই কী বাপু। চোরের গন্ধ আমি খুব চিনি। একটু চামসে গন্ধ। কাঁচা চামড়া রোদে দিলে যেমনটা হয়। তা বাপু, তুমি কি চোর নাকি?”

সুধীর গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, “না। চুরি ছেড়ে দিয়েছি।”

লোকটা যেন একটু আঁতকে উঠল, তারপর ভারী অবাক হয়ে বলল, “বলো কী? ছেড়ে দিয়েছ?”

“হ্যাঁ। ও কর্ম আমার জন্য নয়।”

“ছেড়ে দিয়েছ, কিন্তু গন্ধ যে একেবারে ম ম করছে হে!”

“মোটেই আমার গায়ে কোনও চামসে গন্ধ নেই। আমি রোজ গায়ে মাটি মেখে চান করি।”

“ও কি আর গায়ের গন্ধ হে! ও হল গুণের গন্ধ, সবাই কি ও গন্ধ টের পায়?”

সুধীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “গুণ-টুন আমার নেই মশাই। আমি ঠিক করেছি, এই বটতলাতেই একটা তেলেভাজার দোকান দেব।”

লোকটা চাপা আর্তনাদ করে উঠল, “সর্বনাশ! এত ক্ষমতা, এত বুদ্ধি, এত এলেম নিয়ে শেষে তেলেভাজার দোকান! এ যে হাতি দিয়ে হালচাষ! গদা দিয়ে পেরেক পোঁতা! পুকুরে জাহাজ ভাসানো?”

সুধীর একটু ভড়কে গিয়ে বলে, “মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে বলুন তো মশাই! আপনি কি সাঁটে কিছু বলতে চাইছেন?”

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে হাল-ছাড়া গলায় বলে, “মৃগনাভির কথা শুনেছ তো! কোটিতে গুটিক মেলে। কত লোক মৃগনাভির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু সেই হরিণ খুঁজে পাওয়া ভারী কঠিন কাজ। বুঝলে?”

“বুঝলুম মশাই। কিন্তু মৃগনাভিতে আমাদের কী প্রয়োজন?”

“তা ধরো কেন, আমি আজ সেই দুষ্প্রাপ্য মৃগনাভির হরিণই খুঁজে পেয়েছি। চামসে গন্ধ শুনে তুমি রাগ করলে বটে, কিন্তু ওই চামসে গন্ধওলা লোক খুঁজে খুঁজে কত মানুষ যে হয়রান হয়ে যাচ্ছে, তা জানো?”

“কেন মশাই, এত মানুষ থাকতে হঠাৎ চামসে গন্ধওলা লোককেই সবাই খুঁজছে কেন?”

“সেটাই তো লাখ টাকার প্রশ্ন হে। শুধু কি খুঁজছে? টাকার থলি হাতে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পেলেই আগাম ধরিয়ে দিয়ে কাজে লাগিয়ে দেবে। তবে কী জানো, যার ওই গন্ধ আছে, সে নিজেও টের পায় কিনা। এই যেমন তুমি। এত গুণ নিয়ে ভরদুপুরে বটতলায় গামছা পেতে শুয়ে আছ। একেই বলে প্রতিভার অপচয়। ক্ষমতার অপব্যবহার, বেনারসি পরে বাসন মাজা।”

সুধীর হাঁ হয়ে লোকটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর খানিকটা বাতাস খেয়ে ফেলে বলল, “আপনি কি বলতে চান যে, আমি একজন ভাল চোর?”

লোকটা ঘনঘন ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, “নানা, গন্ধওলা চোরকে আমরা ভাল চোর মোটেই বলি না।”

সুধীর কুঁসে উঠে বলে, “ভালই যদি না হবে, তা হলে এত কথা হচ্ছে কীসের মশাই?”

“শাস্ত্রে গন্ধওলা চোরকে বলে চূড়ামণি চোর। তারা তস্করশ্রেষ্ঠ। তারা হল গে পরস্পাপহরক কুলের রাজা। দশ-বিশ বছরে এরকম মানুষ একটা-দুটো মাত্র জন্মায়। শুধু ভাল চোর বললে যে তাদের বেজায় অপমান হয় হে!”

কথাটা শুনে সুধীর থম ধরে কিছুক্ষণ বসে রইল। স্বপ্ন দেখছে কি, তা কিছুক্ষণ বুঝতে পারল না।

লোকটার চোখ এড়িয়ে নিজের বা বগলটা একটু তুলে গন্ধ শোকারও একটা চেষ্টা করল সে। কিন্তু তেমন কোনও চামসে গন্ধ আছে বলে মনে হল না তার।

লোকটা ভারী উদাস আর করুণ গলায় বলল, “নিজের গায়ের গন্ধ টের পায় না বলে এমন কত প্রতিভাই যে চর্চার অভাবে মাটি হয়ে গেল, তার হিসেব নেই। যার শ্রেষ্ঠ চোর হয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা সে হয়তো দেখা গেল, থানার সেপাই হয়ে টুলে বসে খইনি ডলছে, কিংবা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হয়ে ছাত্র ঠ্যাঙাচ্ছে, নয়তো বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীপুজো করে গামছায় চালকলা বেঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরছে কিংবা বটতলায় বসে তোলা উনুনে ভেজাল তেলে ফুলুরি বেগুনি ভাজছে। ভাবলেও মনটা হাহাকারে ভরে যায় হে। বটগাছের বীজ থেকে আসশ্যাওড়া জন্মালে কার না দুঃখ হয় বলো।”

সুধীর উদাস নয়নে দুরের মাঠঘাটের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, অনেক ভেবে দেখেছি, চুরি করা মোটেই ভাল কাজ নয়। ওতে বড় পাপ হয়। ও আমি ছেড়েই দিয়েছি।”

লোকটা ভারী মোলায়েম গলায় বলে, “কথাটা আমিও শুনেছি বটে। চুরি করা মহাপাপ। তা এ হল বহু পুরনো কথা। সাহেব আমলের টানাপাখা কি এখন চলে, বলো! না কি আমরা এখনও সেই আগেকার মানুষের মতো কাঁচা মাংস খাই! বন্দুক পিস্তলের যুগে কেউ কি আজ তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে নামে! অর্থশাস্ত্রটা পড়ে দ্যাখো বাপু, চুরি করা একরকম সমাজসেবা বই নয়। ধরো না কেন, তুমি একজন পয়সাওলা লোকের কাছ থেকে একশো টাকা চুরি করলে, তারপর সেই একশো টাকা থেকে দু’টাকার মুড়ি-বাতাসা কিনে খেলে, এক টাকার বিড়ি কিনলে, দু’ কিলো চাল, এক পো ডাল, এক শিশি তেল, নুন, লঙ্কা, আখের গুড়, কিনলে তো! তাতে মুড়িওলা, বাতাসাওলা, বিড়িওয়ালা, সবজিওয়ালা সবাই কিছু কিছু পেল। এখন দ্যাখো, যার একশো টাকা ছিল সে একটু নামল, আর মুড়িওলা, বাতাসাওয়ালা, বিড়িওয়ালা, সবজিওলারা একটু উঠল। আর এইভাবে অল্প অল্প করে চোরেরা সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে সাহায্য করছে কি না তা ভেবে দ্যাখো। মানুষ বিপ্লব করে যা করতে চাইছে, চোরেরা তো সেটাই করছে রে বাপু। প্রাণ হাতে করে, রাত জেগে, পুলিশের কিল-গুঁতো খেয়ে, জেল খেটে তারা যা করছে, একদিন লোকে তার মূল্য বুঝবে আর ধন্যি ধন্যি করবে।”

সুধীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চোরের যে এত মহিমা, চোর যে আসলে বিপ্লবী, তা মোটেই জানতাম না মশাই।”

লোকটা একটু অবাক হয়ে বলল, “কথাটা কি তোমার ন্যায্য মনে হল না বাপু?”

সুধীর ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলে, “অন্যায্যও নয়। তবে কিনা কথাটার মধ্যে কোথায় যেন একটা পাঁচ আছে। সেইটে ধরতে পারছি না।”

“ওরে বাপু, পাঁচ না থাকলে লাটু ঘোরে না, পাঁচ ছাড়া জিলিপি হয় না, ঘুড়ি কাটে না, লতা গাছ বেয়ে উঠতে পারে না। পাঁচ কি ফ্যালনা জিনিস?”

“তা অবিশ্যি ঠিক।” লোকটা খুশি হয়ে বলল, “এই তো বুঝেছ! বুঝতেই হবে। তুমি শুধু গন্ধওলা মানুষই নও, তার উপর নাটা। যত নাটা, তত বুদ্ধি। সাইজটাও একেবারে জুতসই। যাকে বলে সোনায় সোহাগা। মাথায় ফুলঝুরির মতো বুদ্ধি, হাতে কেউটের ছোবলের মতো কাজ, পায়ে হরিণের মতো দৌড়। আর চাইবে কী বাপু, ভগবান তো তোমাকে একেবারে বরপুত্র করেই পাঠিয়েছেন!”

সুধীরের কেন যেন একটু ঠ্যাং দোলাতে ইচ্ছে যাচ্ছিল, তাই সে কিছুক্ষণ নীরবে ঠ্যাং দোলাল।

সাদা দাড়ি-গোঁফ আর সাদা বাবরি চুলের বুড়ো লোকটা তাকে কিছুক্ষণ জুলজুল করে দেখে জামার ভিতরের পকেট থেকে সাবধানে কিছু টাকা বের করে বলল, “দ্যাখো বাপু, গুণী মানুষের কদর করতে পারি, তেমন সাধ্যি আমার নেই। তবু এই হাজার দেড়েক টাকা রাখো।”

সুধীর ভারী অবাক হয়ে মাথা নিচু করে লাজুক গলায় বলল, “আহা, টাকা কীসের জন্য? আমি তো কিছু করিনি এখনও।”।

“তাতে কী? তোমার সময়টা যে ভাল যাচ্ছে না, তা তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি।”

সুধীর গদগদ হয়ে বলে, “বড় উপকার করলেন মশাই। অনেক ধারকর্জ হয়ে আছে। সেগুলো শোধ হয়ে যাবে।”

“আর একটু কথা ছিল বাপু। কানাঘুষো শুনেছি, দশ-বারো বছর আগে তোমার যখন ছোঁকরা বয়স, সে সময় তুমি নাকি জাদুকর মদন তপাদারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলে?”

সুধীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “অ্যাসিস্ট্যান্ট বললে বাড়াবাড়ি হবে। তবে আমি তাঁর তল্পিতল্পা বইতাম বটে। ইচ্ছে ছিল, ম্যাজিক শিখে আমিও খেলা দেখিয়ে বেড়াব।”

“তা শিখলে?”

“শিখেছিলাম। তবে তাঁর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বুঝলাম যে, ম্যাজিকের তেমন বাজার নেই। মদনবাবু তেমন বড় ম্যাজিশিয়ান তো ছিলেন না। আগে সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখাতেন। অনেক টাকা মাইনে ছিল। পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যাওয়ায় সার্কাসের চাকরি যায়। তখন পেটের দায়ে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন।”

“তা বাপু, তার ম্যাজিকের বাক্সখানা তো তুমি নিশ্চয়ই মেলা নাড়া-ঘাঁটা করেছ? তাতে কী ছিল মনে আছে?”

“তা থাকবে না কেন? আমিই তো গুছিয়ে রাখতুম। কিন্তু বিশেষ কিছুই ছিল না মশাই। গোটা আষ্টেক থ্রোয়িং নাইফ, কয়েকটা লোহার বল, কয়েক প্যাকেট তাস, আর ম্যাজিকের চোঙা, খেলনা পিস্তল, মন্ত্ৰপড়া রুমাল, এইসব আর কী!”

“আর কিছু?”

“একটা ধুকধুকি ছিল, মনে আছে। মদনবাবু সেটায় হাত দিতে বারণ করতেন। দস্তার একটা চৌকোমতো কাঁচ, তাতে একটা পালোয়ানের ছবি খোদাই করা। আমি অনেক নেড়ে-ঘেঁটে দেখেছি মশাই, তা থেকে দৈত্য-দানো কিছুই বেরোয়নি।”

“মদনবাবু যে রাতে নিরুদ্দেশ হন, সে রাতে তুমি তার কাছে ছিলে?”

ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুধীর বলে, “ছিলুম মশাই। এক বন্ধুর বাড়িতে তার বোনের বিয়ের ভোজ খেয়ে অনেক রাতে এসে মদনবাবুর পায়ের কাছে বস্তা পেতে শুয়েছিলুম।”

“তারপর?”

“তারপর শুনবেন? সেটা আমার পক্ষে বড় লজ্জার কথা। তবে অনেক দিন হয়ে গিয়েছে, এখন বলতে লজ্জা নেই। তার উপর এত টাকা দিলেন, তারও তো একটা প্রতিদান আছে! সেই রাতে মন্টুরামের বাড়িতে আমি চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিলাম।”

“বটে!”

“হ্যাঁ! পলকা দরজা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। আমার ভিতরকার ঘুমন্ত চোরটা জেগে উঠেছিল। কিছু বাসনকোসন, একটা ঘড়া, সাইকেল আর ঘড়ি। পরে শুনেছি মন্টুরাম আর তার বাড়ির লোকেরা চোর বলে মদনবাবুকে খুব অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।”

“তোমার সঙ্গে মদন তপাদারের আর দেখা হয়নি?”

“আজ্ঞে না। খুব মনস্তাপ হয়েছিল আমার। গাঁয়ে-গঞ্জে, হাটে বাজারে আমি অনেক খুঁজে দেখেছি। মনে হয় ম্যাজিকের বাক্সটা হাতছাড়া হওয়ায় মদনবাবু না খেয়েই মারা গিয়েছেন। সেইজন্য আমি অনেকদিন কান্নাকাটি করেছি। মদনবাবু ভালই জানতেন চুরিটা আমিই করেছিলাম, তবু মন্টুরামের কাছে আমার নাম বলেননি।”

“বাক্সটা দেখলে চিনতে পারবে?”

“সে কী কথা! ও বাক্স মাথায় করে করে মদনবাবুর সঙ্গে কি কম ঘুরেছি মশাই! সেই ঘেঁড়াখোঁড়া বাক্সটার যে এখন এত দাম হবে, কে জানত! ভয়ংকর-ভয়ংকর সব লোকেরা বাক্সটার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে।”

“তারা কারা জানো?”

“কালোবাবু আর ফুটু সর্দার। দু’জনেই সাংঘাতিক লোক মশাই। কিন্তু ওই বাক্সের মধ্যে কী এমন আছে, তাই তো ভেবে পাই না।”

“হু, চিন্তার কথাই হে।”

“আজ্ঞে, খুবই চিন্তার কথা। তা মশাই, আপনিও কি ওই বাক্সের একজন উমেদার নাকি?”

বুড়ো মানুষটি দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটু হেসে বলল, “না হে বাপু, এই একটু খোঁজখবর নিচ্ছিলাম আর কী! তবে আমি যতদূর জানি, ওই বাক্সের একজন ওয়ারিশান আছে।”

“বুঝেছি, কিন্তু ওয়ারিশান ও বাক্স বেচলেও তো তাতে বিশেষ কিছু পাবে না। কেন এত দাবিদার জুটছে, তা কি বলতে পারেন? মনে হচ্ছে আপনিও বাক্সটার খোঁজেই এসেছেন।”

“তোমার খোঁজেও। তুমি বেশ ভাল লোক।” “ওকথা কবেন না কর্তা, শুনলে পাপ হয়।”