বড় চাকরি করার একটা মস্ত অসুবিধে, ছুটির দিন বলে কিছু নেই। এমনকী শনি রবিবারেও এমন কিছু অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা পার্টি থাকে যার সঙ্গে কোম্পানির স্বার্থ জড়িত। আরও একটা অসুবিধে, সব সময়েই যেন কোম্পানির নানা দায়দায়িত্ব ঘাড়ে ভর করে থাকে।
শঙ্কর বসুর এটা তিন নম্বর চাকরি। সেলস ইঞ্জিনিয়ার থেকে এখন রিজিওন্যাল ম্যানেজার। রিচি রোডে মস্ত ফ্ল্যাটে বসবাস। চারটে টেলিফোন। ব্যাঙ্কে মোটামুটি ভদ্রস্থ টাকা জমে যাচ্ছে। ঘরে আধুনিক আসবাবপত্র, গ্যাজেটস এবং ঝি-চাকরের অভাব নেই।
অভাব ব্যাপারটা অবশ্য এইসব বাস্তব সাফল্যের ওপর নির্ভর করে না। অভাব এক ধরনের ধারণা, এক ধরনের অস্থিরতা, হয়তো এক ধরনের ভ্যাকুয়াম।
আজ ছুটির দিন নয়। নটার মধ্যে অফিসে পৌঁছতে হবে। হবেই। সকাল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে সাড়ে ছ’টা অবধি একটু জগিং ও হাটা শেষ করে বাড়ি ফিরেই দাড়ি কামানো আর স্নানের জন্য পনেরো মিনিট ব্যয় করতে হয়। সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে তিনটে খবরের কাগজে চোখ বোলানো। তার পরেই মাপা ব্রেকফাস্ট। সওয়া আটটায় মারুতি এস্টিমে হুস করে বেরিয়ে যাওয়া। তারপর সারাদিন শঙ্কর বসু আর ব্যক্তিগত শঙ্কর বসু নয়। নয় রীণার স্বামী বা পরমার বাবা। সে তখন কেবলই নিকলসনের বড় সাহেব।
আজ সকাল সওয়া সাতটায় শঙ্কর বসুর ব্যস্ত সকাল কিছুটা মন্থর করে দিল খবরের কাগজের একটি ছোট খবর। খবরটা বেরিয়েছে খেলার পাতায়, ডিটেলস বিশেষ নেই। বাসুদেব সেনগুপ্ত বড় খবর হওয়ার মতো লোকও ছিল না। স্কাউড্রেলটা চার দিন আগে মারা গেছে। হার্ট অ্যাটাক। “তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, দুই পুত্র, এক কন্যা ও অসংখ্য গুণমুগ্ধ…”
গুণমুগ্ধ? গুণমুগ্ধ? শঙ্কর ভ্রু কোঁচকাল। শঙ্করের মুখে খারাপ কথা কদাচিৎ কেউ শুনেছে। তার রুচিবোধ প্রবল। তবু আজ শুয়োরের বাচ্চা কথাটা যেন আপনা থেকেই। তার নিঃশব্দ জিবের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এল। খাসবায়ুর সঙ্গে সেটা শব্দ হয়ে অস্ফুটে উচ্চারিতও হয়ে গেল। সামান্য লজ্জিত হল শঙ্কর।
ঘড়িতে পৌনে আটটা। বেশ দেরিই হয়ে গেছে। আজ ব্রেকফাস্টটা স্কিপ করবে নাকি?
লিভিং রুমের প্রিয় রিক্লাইনিং চেয়ারটি ছেড়ে শঙ্কর উঠে পড়ল। নাউ টু ড্রেস আপ। এই ড্রেস আপে তার কিছু সময় লাগে। এমন নয় যে সে খুব সাজগোেজ করে। কিন্তু ভারিক্কি চাকরির কিছু দাবি থাকেই। প্রায় রোজই অফিসের পর কনফারেন্স বা মিটিং বা বড়কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক থাকেই। পোশাকটা সাবধানে না করলে কিছু ভ্রু কুঞ্চিত হয়।
বেশির ভাগ দিনই সুট। আজও তাই। নেভি ব্লু ট্রপিক্যাল সুট টাই সহযোগে পরে যখন ডাইনিং হলে ঢুকল তখন আটটা দশ। হঠাৎ আজ তার একটু গরম লাগছে। সে বেয়ারা। রামুকে বলল, এয়ারকুলারটা চালিয়ে দে তো। দুটোই চালা।
দুটো এয়ারকুলারে ঘর ঠান্ডা হচ্ছিল বটে, কিন্তু শঙ্করের মনে হল, এটা ঠিক সেই গরম নয়। বহুদিনকার পুরনো একটা রাগ আর অপমানই ঝটকা মেরেছে আজ। শরীরে মৃদু একটা রি-রি ভাব। রীণার চলাফেরা আজও স্বপ্নের মতো। ওর হাঁটা আজও ভেসে যাওয়ার মতো সাবলীল। রীণার পুতুল পুতুল চেহারা অনেক পালটে গেছে বটে। কিন্তু এখনও রীণাকে ঠিক রিয়েল বলে মনে হয় না শঙ্করের।
রীণা ঘরে এসেই ভ্রু কুঁচকে বলল, এ কী। আজ তো গরম নয়। এয়ারকুলার চালিয়েছ কেন রামু?
সাহেব বললেন।
শঙ্কর ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্টের শূন্য প্লেটের দিকে চেয়ে বসে ছিল। রামু গরম টোস্টে মাখন মাখাচ্ছে।
শঙ্কর বলল, বাসুদেব মারা গেছে।
রীণা সামান্য বিস্মিত হয়ে থমকাল, কে মারা গেছে?
সেই স্কাউলেটা।
রীণা বিহুলের মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, কে খবর দিল?
বাংলা খবরের কাগজের শেষ পাতায় আছে। দেখে নিয়ে।
রীণার তাতে উৎসাহ দেখা দিল না। সে শঙ্করের উলটো দিকে চেয়ারে বসে দুহাতে মাথাটা চেপে একটু বসে রইল।
আর ইউ শকড?
রীণা ধীরে মুখটা তুলে বলল, আর ইউ হ্যাপি?
শঙ্কর নিজেকে সংযত করে নিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলল, আই শ্যাল নেভার বি হ্যাপি।
রামু সযত্নে মাখন মাখানো টোস্ট তার প্লেটে স্থাপন করল বটে, কিন্তু শঙ্কর সেটা ছুঁলই। রামুর দিকে চেয়ে বলল, থাক, আর দিস না। আজ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। বরং হাফ কাপ কফি দে। একটু তাড়াতাড়ি।
রীণা প্রায় একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে। চোখের পলকও যেন পড়ছে না। চোখের দৃষ্টি অবশ্য নিস্তেজ।
কফিতে উপর্যুপরি দুটো চুমুক দিয়ে শঙ্কর বলল, আই অ্যাম সরি ফর মাই রি অ্যাকশনস।
রীণা কিছুই বলল না। কেমন একটা বিহুল চাহনি নিয়ে বসে রইল। ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়েই উঠে পড়ল শঙ্কর। বলল, চলি। ব্যাপারটা ভুলতে শঙ্করের দেরি হবে না। অফিসে গিয়ে কাজে ও কথায় অন্য একটা জগতে চলে যাবে সে। বাসুদেব সেনগুপ্ত নামে একটি রাহুর কথা তার মনে থাকবে না।
শঙ্কর চলে যাওয়ার পর লিভিং রুমে গিয়ে খবরের কাগজটা দেখল রীণা। খুব সামান্য খবর হিসেবেই ছেপেছে। একটা ছবি অবধি নেই। গত ছ’বছরে বাসুদেবের চেহারার কীরকম ভাঙচুর হয়েছিল কে জানে!
শোক নয়, হাহাকার নয়। আজ রীণার বড় লজ্জা করছে। আজ তার কান্নাও এচ্ছে। বাসুদেব যে কেন এসেছিল তার জীবনে! অনেকদিন আগে তারা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাসুদেব ডিভোর্স করবে শিখাকে, রীণা ডিভোর্স করবে শঙ্করকে। তারপর বাসুদেব আর রীণা বিয়ে করবে। করলে আজ কী হত?
রীণা জানালার ধারে বসে রইল চুপচাপ৷
সাড়ে আটটায় অজু ফিরল। অজু মানে অজাতশত্রু। রীণার ছেলে, কিন্তু শঙ্করের ছেলে নয়। অজু বাসুদেবের ছেলে। রীণার সন্দেহ হয়, সে বা শঙ্কর অজুকে ঘটনাটা কখনও না জানালেও কোনও না কোনও ভাবে অজু সেটা জানে।
অজুর ইস্কুল-কলেজের খাতায় বাবা হিসেবে শঙ্কর বসুর নাম আছে। বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে অজু আজও শঙ্করের নামই বলে। কিন্তু হয়তো যা বলে তা বিশ্বাস করে না। কী করে অজু জানে বা সন্দেহ করে তা রীণা বলতে পারবে না। হতে পারে, বাসুদেবই ওকে জানিয়েছে। অন্তত সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দশ বছর আগে বাসুদেবের সঙ্গে যখন রীণা সম্পর্ক ছেদ করে তখন বলে কয়েই করেছিল। বাসুদেব অপমান বোধ করেছিল তাতে। আর সেই অপমানের প্রতিশোধ এভাবেই হয়তো নিয়েছে। এমনও হতে পারে, শঙ্করই জানিয়েছে ওকে। কারণ জন্মাবধি অজাতশত্রুকে শঙ্কর সহ্য করতে পারেনি কখনও। কোলে নেওয়া, আদর করা তো দূরে থাক, শিশুটির দিকে তাকাতেও শঙ্কর ঘেন্না পেত। তথাকথিত বাবার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার পেয়ে অজাতশত্রু অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সে কখনও শঙ্করের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি। কিন্তু পরমার প্রতি শঙ্কর ছিল অন্যরকম। পরমা বলতে শঙ্কর অজ্ঞান। আর পরমার মুখে বাপের মুখশ্রীর অবিকল ছাপ। অজাতশত্রু সেটাও লক্ষ করেছে নিশ্চয়ই। দুই সন্তানের প্রতি এই যে দু’রকম ব্যবহার এটা থেকে অজাতশত্রু নিজেও কিছু অনুমান করে নিয়ে থাকতে পারে। সে প্রখর বুদ্ধিমান।
বলতে নেই, অজুর চেহারাটা চমৎকার, দীঘল, অ্যাথলেটের মতো শরীর। মুখখানায় রীণার মুখ যেন বসানো। কিন্তু শরীর? শরীরের গঠনে এবং শারীরিক প্রকৃতিতে সে অবিকল বাসুদেব। আঠেরো বছর বয়সেই সে বেশ নামকরা স্পোর্টসম্যান। স্কুল এবং জেলা স্তরে স্পোর্টসে গাদা গাদা প্রাইজ পেত। এখন টেনিস খেলছে মন দিয়ে। ভালই খেলে। ক্রিকেটেও চমৎকার হাত। সে ভারতের সবচেয়ে দুরন্ত ফাস্ট বোলার হওয়ার চেষ্টা করছে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি অজু অচিরেই নিজের অর্জনে দাঁড়িয়ে যাবে। রীণা সেই চেষ্টাই করেছে, যাতে অজু তাড়াতাড়ি দাঁড়ায় এবং শঙ্করের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। শঙ্কর রীণাকে আকণ্ঠ ভালবাসত, হয়তো এখনও বাসে। কিন্তু অজুর জন্যই তাদের ভালবাসাটা শঙ্করের কাছে নিষ্কণ্টক হয়নি কখনও। অজু একটা চক্ষুশূল ছাড়া আর কিছু নয় শঙ্করের কাছে। বরাবর ছেলেকে নিজের পাখনার আড়ালে আগলে রেখেছে রীণা। অজু জারজ ঠিকই কিন্তু রীণা তো মা।
গায়ে সাদা টি-শার্ট, পরনে শর্টস, পায়ে কেডস অজু হলঘরে ঢুকে পাখার নীচে শরীর জুড়োচ্ছে। সকালে অনেকটা দৌড়োয় অজু। এবং ইচ্ছে করেই সাড়ে আটটার পর ফেরে। হিসেব করেই ফেরে, যাতে শঙ্করের সঙ্গে মুখোমুখি না হতে হয়। প্রায় বাল্যকাল থেকেই শঙ্করের সঙ্গে এই টাইমিং-এর পার্থক্য রাখতে অভ্যাস করে ফেলেছে সে। তারা একই টেবিলে বসে খায়, তবে বিভিন্ন সময়ে, তাই খাওয়ার টেবিলে দেখা হয় না। একই ঘরের বাতাসে দু’জনে কখনও একসঙ্গে খাস নেয় না। অজু কখনও এর জন্য অভিযোগ করেনি। জন্মাবধি ব্যাপারটা হয়ে আসছে বলে তার কাছে বোধহয় অস্বাভাবিকও লাগে না।
অজু পোশাক ছেড়ে স্নান করতে গেল।
ছেলেটা খেতে ভালবাসে। শরীরের পরিশ্রমের জন্যই ওর খিদে বেশি। রীণা উঠল। গিয়ে দেখল টেবিলে খাবারদাবার ঠিকমতো সাজানো হয়েছে কি না।
রামু ছ’বছরের পুরনো লোক। সবই জানে। এও জানে এ বাড়ির কর্তার সঙ্গে অজুর সম্পর্ক ভাল নয়। তাই রামুর ব্যবহারে অজুর প্রতি সূক্ষ্ম অবহেলা থাকতে পারে, এই ভয়ে ছেলের খাওয়ার সময় রীণা কাছেপিঠে থাকে।
রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রীণা রাঁধুনি অম্বিকাকে বলল, ফ্রিজের খাবার মাইক্রোওয়েভে বসিয়েছ?
না বউদি।
বসাও। অজু চানে গেছে। মাছটা রান্না হয়েছে তো?
হয়েছে।
তাড়াতাড়ি করো। ও মা। আলুভাজা এখনও চড়াওনি যে!
চড়াচ্ছি।
বিরক্ত রীণা বলে, আগে বসাওনি কেন? আলুভাজা হতে সময় লাগে, জানো না?
সরু করে কাটছি, হয়ে যাবে বউদি।
রীণা ফের লিভিংরুমে এসে বসল। খবরের কাগজগুলো সরিয়ে ফেলবে কি না ভাবল একবার। অজু অবশ্য খবরের কাগজ কমই দেখে। দেখলে খেলার পাতাটা। আর এই পাতাতেই খবরটা আছে।
না লুকিয়ে লাভ নেই। বরং দেখলে দেখুক। দশ বছরের বেশিই হয়েছে বাসুদেবের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার। তখন অজুর দশ-এগারো বছর বয়স। লোকটা বোজ আসে কেন, মায়ের সঙ্গে এত কী কথা, এসব জিজ্ঞেস করত অজু। এবং বাসুদেবকে একদমই পছন্দ করত না সে। বাসুদেব এক নিষ্ঠুর প্রকৃতির পুরুষ। অজু তার ছেলে জেনেও কোনওদিন ছেলেটাকে কাছে ডাকেনি বা আদরটাদর করেনি।
রীণার হঠাৎ মনে হল আজ কি অজুর মাছটাছ খাওয়া উচিত? বাপ মরলে ছেলের তো হিন্দুমতে অশৌচ হয়। অশৌচের অন্যান্য নিয়ম পালন না-ই করল, অন্তত আমিষ খাওয়াটা বন্ধ রাখা উচিত নয় কি?
রীণা উঠে ফের রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়।
অম্বিকা, একটা কাজ করো, আজ অজুকে মাছটাছ দিয়ো না।
অম্বিকা অবাক হয়ে বলে, দেব না?
না। তার চেয়ে বরং গরম ভাতে একটু ঘি দিয়ো। আর ফ্রিজে ছানা আছে, টক করে একটু ছানার ডালনা বেঁধে দাও।
তাতে তো সময় লাগবে বউদি।
লাগুক। আমি ওকে একটু বসিয়ে রাখবখন। ডালনার আলুটা মাইক্রোওয়েভে সেদ্ধ করে নাও। তা হলে ডালনা করতে দশ-পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না।
রীণার ভয়, এসব নিয়ম পালন না করলে যদি ছেলেটার অমঙ্গল হয়! অভিশাপ নিয়েই জন্মেছে। দিনরাত ওর মৃত্যুই কি কামনা করে না শঙ্কর?
প্রায় পনেরো মিনিট বাদেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং হলের টেবিলে মাকে দেখে অজু হাসল, হাই মা, মুখটা অমন শুকনো করে বসে আছ কেন?
নিজের মুখটা দেখতে পাচ্ছে না রীণা। বলল, এমনি।
মা ছাড়া অজুর আপনজন আর কেউ নেই, এটা একমাত্র রীগা জানে। তাই ছেলেটার জন্য তার বুকের মধ্যে একটা ভয় সবসময় পাখা ঝাঁপটায়। সে বেঁচে থাকতে থাকতে অজুটা যদি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায় তবেই রক্ষে।
শঙ্কর সংকীর্ণমনা নয়। তবু কিছুদিন আগে শঙ্কর রাতে শোওয়ার সময় তাকে বলেছিল, দেখো রীণা, আমার ইচ্ছে নয় যে, আমি মারা গেলে আমার বিষয় সম্পত্তি বা টাকাপয়সার ভাগীদার অজু হয়। মনে হয় ব্যাপারটা অজুকে আগে থেকে বলে রাখা ভাল। নইলে ওর হয়তো একটা এক্সপেকটেশন তৈরি হয়ে যাবে।
রীণা অসহায়ভাবে বলেছিল, কীভাবে বলব?
সেটা তোমার দায়িত্ব, আমার নয়। পিতৃপরিচয়টা মিথ্যে হলেও তোমার মুখ চেয়ে স্বীকার করে নিয়েছি। কিন্তু ওয়ারিশন হিসেবে ওকে মেনে নিতে পারি না।
আমাকে একটু সময় দাও। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব।
সেটাই ভাল। আমার তো মনে হয়, ইট ইজ হাই টাইম টু টেল হিম দি টুথ। লেট হিম গো টু হিজ বায়োলজিক্যাল ফাদার অ্যান্ড লিভ উইথ দ্যাট স্কাউড্রেল। আমি তো অনেক দিন ওর দায়িত্ব পালন করেছি, যা আমার পালন করার কথাই নয়।
শঙ্করকে একটুও দোষ দেয় না রীণা। শঙ্কর বরং ভদ্রলোক বলেই সব সয়ে নিয়েছে। শুধু রীণার মুখ চেয়ে। শুধু এক অদ্ভুত ভালবাসা ও মায়া কাটাতে পারেনি বলে রীণার সব অমূলক শর্ত মেনে নিয়েও সে রীণাকে ছাড়তে চায়নি। পৌরুষের সব অপমান হজম করে গেছে। আজ যদি তার ক্ষতবিক্ষত মন কিছু বিদ্রোহ ঘোষণাই করে তাতে দোষ কোথায়?
কিন্তু রীণা যে জিনিসটা আজও বুঝে উঠতে পারে না, তা হল শঙ্করের তার প্রতি ভালবাসা। এরকমও হয়? এরকম কেন হয়? শঙ্কর কি ভীষণ ভাল একজন মানুষ? শঙ্কর কি খুব মহান?
অজু পোশাক পরে খেতে এল। এ সময়ে তার চোখে মুখে পেটের সাংঘাতিক খিদেটা ফুটে ওঠে।
মা, একটা ভাল খবর আছে। কী খবর? নেক্সট উইকে আমাদের প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং-এর জন্য পুরী নিয়ে যাবে। এক সপ্তাহের টুর।
রীণা মৃদু স্বরে বলল, ভালই তো।
রামু খাবার নিয়ে এল। গোগ্রাসে খাচ্ছে অজু। বলল, বাঃ, আজ ঘি দিয়েছ! ফাইন!
রীণা সতর্ক গলায় বলল, আজ কিন্তু নিরামিষ।
ভ্রু কুঁচকে তাকাল অজু, নিরামিষ! নিরামিষ কেন?
এমনি।
অজু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, এন্টায়ার মিলটাই নিরামিষ। জীবনে শুধু নিরামিষ তো কখনও খাইনি।
আজ খা। খেয়ে দেখ, খারাপ লাগবে না। মাঝে মাঝে নিরামিষ খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল।
তার মানে এখন থেকে কি মাঝে মাঝেই নিরামিষ হবে নাকি?
সেটাই ভাবছি।
তা হলে বাইরে সাঁটাতে হবে।
রীণা দৃঢ় গলায় বলল, না। বাইরেও খাবে না।
বিস্মিত অজু বলে, বাইরেও না?
রীণা নরম হয়ে বলল, মাঝে মাঝে নিরামিষ খাওয়া যখন ভাল, তখন বাইরেই বা খাবি কেন? এটুকু সংযম নেই?
অজু কঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, নিরামিষ খেলে কি পেট ভরে? মনে হয় খাওয়াই হয়নি৷
একটা মোটে দিন তো!
আচ্ছা, ঠিক আছে।
একটা দিন, মাত্র একটা দিনই হয়তো নিয়মটা রক্ষা করতে পারবে রীণা। কিন্তু তারপর আর পারবে না। পারতে হলে সত্য উদঘাটন করতে হয়। তার চেয়ে বড় যন্ত্রণাদায়ক আর কী আছে? যাক, একদিনই নিরামিষ খাক। নিয়মরক্ষা হলেই হল। অমঙ্গলের ভয়টা হয়তো তার অমূলক। সাহেবদের তো এসব নিয়ম নেই, কই তাদের তো কিছু হয় না।
অজু হঠাৎ বলল, আজ তোমাকে একটু আউট অফ ফর্ম দেখাচ্ছে। কেন বলো তো! ঝগড়াটগড়া হয়নি তো।
অবাক হয়ে রীণা বলে, ঝগড়া! ঝগড়া কেন হবে?
সেটাই তো ভাবছি। তোমাদের তো কখনও ঝগড়া হয় না। ইজ সামথিং রং?
সামথিং ইজ ভেরি মাচ রং। কিন্তু সেটা রীণা কবুল করে কী করে? সে মৃদু স্বরে মিথ্যে কথা বলল, শরীরটা ভাল নেই।
কী হয়েছে?
তেমন কিছু নয়। মাঝে মাঝে তো শরীরটা খারাপ হতেই পারে। বয়স হচ্ছে না?
তোমার আর এমন কী বয়স হল মা? মিড ফটিজ হয়তো।
কম নাকি? মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি।
নতুন একটা পা খুলেছে এ পাড়ায়। যাবে? শাওনা বাথ, ম্যাসাজ সব আছে। দে উইল মেক ইউ ফাইটিং ফিট।
ও বাবা! জন্মে ওসব করিনি, এখন সহ্য হবে না।
আরে না। কত বুড়বুড়ি যাচ্ছে। তোমরা বাঙালি মেয়েরা ফিটনেস জিনিসটাই বোঝো না । গ্যাস অম্বল প্রেশার টেনশন নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে থাকো। চলো না মা, এটাতে খুব আলট্রা মডার্ন গ্যাজেটস আছে।
শরীর দিয়ে আর হবেটা কী?
ওই তো তোমাদের দোষ। শরীর ছাড়া কিছু নেই মা। শরীর ঠিক না থাকলে আর সবই তো মিনিংলেস হয়ে যাবে।
অজু খাওয়া শেষ করে উঠল। মুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ হাত মুছতে মুছতে বলল, আমার খুব ইচ্ছে করে পরমাটাকেও ভরতি করে দিতে। বারো মাস অ্যালার্জিতে ভোগে। একটু ব্যায়ামট্যায়াম করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আশ্চর্যের বিষয়, পরমাকে অজু বড্ড ভালবাসে। আর পরমাও দাদার ভীষণ ভক্ত। দু’জনের মধ্যে বয়সের অনেক তফাত বলে পিঠোপিঠি ভাইবোনের মতো তাদের ঝগড়াঝাঁটি হয় না। আর লক্ষ করার বিষয় হল, পরমা যে-কোনও ব্যাপারে তার দাদাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করতে চায় না। কিন্তু পরমা বাচ্চা পরমাও জানে, তার বাবা তার দাদাকে পছন্দ করে না। আর সেই জন্যই বাবার সামনে সে কখনও তার দাদার কাছে বড় একটা ঘেঁষে না।
রীণা বলল, ব্যায়াম ছাড়া তুই আর কিছু বুঝিস না, না?
লিভিংরুমের মস্ত কাঁচের শার্সি দিয়ে সকালের রোদ এসে ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে। ঘন নীল আর সাদা স্ট্রাইপের টি-শার্ট আর ক্রিম রঙের প্যান্ট পরা অজু যখন সেই রোদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল তখন হঠাৎ যেন বাসুদেবের একটা চিত্র ফুটে উঠল তার অবয়বে। রীণার বুক
সর্বনাশের আশঙ্কায় কেঁপে গেল কি হঠাৎ? অজু কি জানে?
অজু খবরের কাগজগুলো একের পর এক তুলে টপাটপ চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। রীণার বুক কাঁপছে।
অজু যেমন অবহেলায় কাগজ তুলে নিয়েছিল তেমনি অবহেলায় রেখে দিয়ে বলল, চলি মা।
এসো গিয়ে।
অজু বেরিয়ে গেলে এক কাপ চা খেল রীণা। এখন আর তার কিছু করার নেই। পরমার মর্নিং স্কুল শেষ হবে সাড়ে দশটায়। ফিরতে ফিরতে পৌনে এগারোটা। ততক্ষণ নিজেকে নিয়ে বসে থাকা মাত্র।
কিন্তু বসে থাকা গেল না। ফোন বাজছে। এ বাড়িতে দুটো ফোন। কখন যে কোনটা বাজে ধরা যায় না।
রামু কর্ডলেস টেলিফোনটা এনে তার হাতে দিয়ে বলল, আপনার।
হ্যালো।
একটা মোটা গলা বলল, কেমন আছেন মিসেস বোস?
গলাটা চেনা ঠেকল না রীণার কাছে। সে বলল, কে বলছেন?
প্রশ্নটা অপ্রাসঙ্গিক। আমাকে আপনি চেনেন না।
ও। কী বলবেন বলুন।
আজকে খবরের কাগজে একটা খবর আছে, দেখেছেন?
রীণার বুকটা ফের ধক করে উঠল। সে স্তিমিত গলায় বলল, কোন খবর?
দেখেননি! অবশ্য খবরটা এতই ছোট যে চোখে পড়ার মতো নয়। এনি ওয়ে, খবরটা খেলার পাতায় খুঁজলেই পেয়ে যাবেন।
রীণা একটা অজানা আশঙ্কায় শীতল হয়ে যাচ্ছিল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কে বলছেন?
বললাম তো আমাকে চিনবেন না। আপনি বরং খেলার পাতাটা চেক করুন। আমি ফোন ধরে আছি।
রীণা আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কোন খবরের কথা বলছেন তা বুঝতে পারছি না।
কণ্ঠস্বর সামান্য একটু হেসে বলল, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল নাকি মিসেস বোস? খবরটা জনসাধারণের কাছে ছোট হলেও আপনার কাছে তো ছোট নয়। ইট ইজ এ বিগ নিউজ ফর ইউ।
রীণা জানে, তার আর বাসুদেবের সম্পর্কটা তত গোপন কিছু নয়। কেউ কেউ জানে বা অনুমান করে। কিন্তু সময়ও তো অনেক বয়ে গেছে। তবু এই অচেনা গলা শুনে তার বুক কাঁপে কেন? সারা জীবনের অপরাধবোধ কি ঘুলিয়ে উঠছে? সে আরও দুর্বল গলায় বলল, আমাকে বিরক্ত করবেন না, প্লিজ।
আপনি কি শোকাভিভূত?
প্লিজ।
আরে, শোকের কী আছে? একটা বজ্জাত লোক দুনিয়া থেকে কমে গেছে এ তো ভাল খবর।
প্লিজ।
শুনুন, শুধু খবরটা দেওয়ার জন্যই আপনাকে ফোন করছি না। কারণ আমার সন্দেহ, আমি দেওয়ার আগেই খবরটা আপনি পেয়ে গেছেন।
তা হলে কেন ফোন করছেন?
কাগজে লিখেছে বাসুদেব সেনগুপ্ত হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। কিন্তু ঘটনাটা তা নয়।
রীণা চুপ করে থাকল।
শুনছেন?
হ্যাঁ।
হার্ট অ্যাটাক বটে, তবে হার্ট অ্যাটাকটা খুব নিপুণভাবে ঘটানো হয়েছিল।
তার মানে?
একজন অতিশয় দক্ষ হত্যা-শিল্পী অত্যন্ত নিখুঁতভাবে একটা বদমাশকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। প্লিজ। এবার ছাড়ছি।
ছাড়বেন? তা ছাড়তে পারেন। সেটা আপনার ইচ্ছে। কিন্তু ফোনের লাইন কেটে দিলেই কি সব ঘটনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন মিসেস বোস? ইউ হ্যাভ এ পাস্ট।
রীণা ফোন ছাড়ল না, শক্ত করেই ধরে রইল। কিন্তু কিছু বলতেও পারল না সে, চুপ।
মিসেস বোস?
বলুন, শুনছি।
দ্যাটস গুড। কথার মাঝখানে লাইন কেটে দেওয়া আমার অপমানজনক বলে মনে হয়।
বুঝলাম। কিন্তু এসব কথা আমাকে কেন বলছেন?
বলার একটা গুরুতর কারণ আছে।
কী কারণ?
বাসুদেবের ফ্ল্যাটে তার মৃত্যুর পরদিন সকালে একজন লোক তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিল। শ্রদ্ধাদ্ধা আসলে একটা হাস্যকর লোকদেখানো ব্যাপার। আপনি ভালই জানেন শ্রদ্ধা পাওয়ার মতো লোক বাসুদেব ছিল না। যারা এসেছিল নিতান্ত দায়ে পড়ে, ভদ্রতার খাতিরেই এসেছিল। যাকগে, যার কথা বলছিলাম। লোকটা গোয়েন্দা পুলিশের একজন টিকটিকি। নাম শবর দাশগুপ্ত। বাসুদেবের মৃত্যুটা যে অস্বাভাবিক তা সন্দেহ করার কারণ তার এখনও নেই। তবু বলে রাখি, সে বাড়ির দারোয়ান এবং আরও দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে গেছে। হতে পারে হি হ্যাজ এ হাঞ্চ।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
বুঝবেন। মানুষের মস্তিষ্ক এক অত্যাশ্চর্য স্টোরহাউস। এখন যা বুঝতে পারছেন না বলে মনে হচ্ছে তা হঠাৎ পরে এক সময়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে গেলেই বুঝতে পারবেন। বাই দি বাই, আপনার ছেলেটির নাম যেন কী?
কেন?
এমনি জিজ্ঞেস করছি। ইচ্ছে না থাকলে বলবেন না।
না, বলতে বাধা কী? তার নাম অজাতশত্রু বসু।
বসু? ওঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসু ছাড়া আর কীই বা হতে পারে?
আপনি নোংরা এবং ইতর।
আমি? হাঃ হাঃ, হাসালেন ম্যাডাম। এনি ওয়ে, বাই..