তল্লাটের সবাই জানে যে, প্রেতসিদ্ধ বগলাপতির দুটো দেহাতি ভূত আছে। একজনের নাম গানা, আর-একজনের নাম বাজানা। সবাই এও জানে যে, ভূতদুটো একটু বাউণ্ডুলে স্বভাবের। তারা খুবই বেড়াতে ভালবাসে এবং মাঝে-মাঝেই তারা বগলাপতিকে না জানিয়েই হাওয়া হয়ে যায়। আর বগলাপতি তখন বিদ্যেধরী নদীর ধারের সাধনপীঠ ছেড়ে টর্চ হাতে তাদের খুঁজতে বেরোন।
লালমোহনবাবু বগলাপতিকে টর্চ হাতে ভূত খুঁজতে দেখে খুব ভালমানুষের মতো বললেন, “আচ্ছা বগলাদা, ভূত খুঁজতে টর্চ লাগে কীসে? আমি তো টর্চ ছাড়াই অন্ধকারে দিব্যি ভূত দেখতে পাই।” বগলাপতি অবাক হয়ে বললেন, “তুমি ভূত দ্যাখো নাকি?”
“প্রায়ই দেখি। ষষ্ঠীতলায় এই তো সেদিন মুকুন্দকে দেখলুম, বসে বসে কী যেন ভাবছে। পিরবাবার থানের পাশে কদমগাছের নীচে নিশাপতি আর তার বউ লতাকে দেখি, হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীলকুঠির মাঠে তো প্রায়ই যোগেন পালোয়ানকে দেখা যায়।”
“কই, কখনও বলেনি তো!”
“আমি তো ভাবি, আমার মতো অন্য সবাই দেখতে পায়। আমাদের মতো ওরাও গাঁয়ে থাকে, এ তো আর নতুন কথা কিছু নয়। কিন্তু কথা হল, অন্ধকারেই তাদের বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, টর্চের দরকার হয় না।”
“টর্চটা ভূতের জন্য নয় হে, সাপখোপের জন্য। তা তুমি সত্যিই ভূত দেখতে পাও, না অন্য সবার মতো ইয়ার্কি মারছ!”
লালমোহন ভড়কে গিয়ে বললেন, “ইয়ার্কি!”
“না, তুমি অবশ্য সেরকম মানুষ নও। তা তোমার ভূতগুলোকে একবার দেখাতে পারবে?”
লালমোহন তাড়াতাড়ি বললেন, “তারা আমার ভূত হতে যাবে কেন? তারা গাঁয়ের ভূত, সকলের ভূত। দেখা শক্ত কিছু নয়, সময়মতো ঠিক জায়গায় গেলেই দিব্যি দেখতে পাবেন।”
“না, না, আমার একা যাওয়াটা ঠিক হবে না। তারা হয়তো আমাকে দেখে ভড়কে যাবে। ভাববে, গানাবাজানার মতো আমি তাদেরও ধরে মন্তর দিয়ে আটকে রাখব।”
“তা অবিশ্যি ঠিক। আপনাকে জ্যান্ত মানুষই ভয় খায়, ভূতেদের তো কথাই নেই। ঠিক আছে, আমিই নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দেব’খন আড়াল থেকে।”
“দিয়ো। আর ইয়ে, কথাটা আবার পাঁচকান কোরো না যেন!”
“আজ্ঞে না। সবাই তো জানে আমি বোকা, তাই কাউকে কিছু বলে লাভ হয় না মশাই। কেউ আমার কথা ধর্তব্যের মধ্যেই নেয় না।”
“বোকা হতে যাবে কেন! তুমি হলে সোজা-সরল মানুষ। গাঁয়ের লোকের স্বভাবই হল ধলোকে কালো দেখা। এই আমাকেও তো কত লোক ভণ্ড, জালি, জোচ্চোর বলে, ওসব কি আমি গায়ে মাখি? ওসব নিয়ে তুমি মন খারাপ কোরো না?”
লালমোহন একগাল হেসে বললেন, “মন খারাপ হবে কোন দুঃখে? আমি যে সত্যিই ভারী বোকা। আর বোকা হয়ে সুখ আছে। মশাই।”
“তাই নাকি? কীরকম?”
“দোষঘাট করে ফেললেও লোকে ক্ষমাঘেন্না করে দেয় কিনা!”
“বটে!”
“এই তো সেদিন বনবিহারীবাবুর আড্ডায় পেটের চর্বি নিয়ে কথা হচ্ছিল। শেষে সাব্যস্ত হল, পেটে চর্বি হওয়া মোটেই ভাল নয়। ওতে শরীর ভারী দুর্বল হয়ে পড়ে। তা কথাটা সেই থেকে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। গত বেস্পতিবার মগনের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি, গোপাল গুচ্ছাইত তার দলবল নিয়ে বসে চা খাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, গোপালের যেন বেশ একটু ভুড়ি হয়েছে! তখন ভাবলাম, ষণ্ডাগুন্ডাদের পেটে চর্বি হলে তো সর্বনাশ। শরীর দুর্বল হলে গুন্ডামি করবে কীসের জোরে? গোপালের সত্যিই ভুড়ি হয়েছে, নাকি লুঙ্গির গিট উঁচু হয়ে আছে সেটা পরখ করার জন্য কাছে গিয়ে ভুড়িটায় একটা খাবলা দিলাম। কে জানত মশাই যে, গোপালের অমন কাতুকুতু আছে! খাবলা দিতেই বাপ রে বলে চায়ের গেলাস উলটে গাঁক-গাঁক করে চেঁচাতে লাগল। তার দলের লোকেরা এসে আমাকে চেপে ধরতেই আমি চিচি করে বললাম, “গোপালবাবুর পেটে চর্বি হয়েছে কি না দেখছিলাম! গোপাল গুচ্ছাইত কিন্তু রাগ করল না। সবাইকে বলল, ‘লালুবাবু বোকাসোকা লোক, সবাই জানে। ছেড়ে দে, মারধর করিস না। আসুন লালুবাবু, চা খান। পেটে চর্বির কথা বলে ভাল করেছেন। আবার ব্যায়াম শুরু করতে হবে। আমার সত্যিই পেটে একটু চর্বি হয়েছে?”
“তোমার সাহস আছে হে লালমোহন। গোপাল গুন্ডাকে কাতুকুতু দেওয়া যার-তার কর্ম নয়!”
“পশুপতি টাটের বাড়িতে সেদিন সন্ধেবেলায় বসে আছি, হঠাৎ চারটে মুশকো চেহারার লোক হাতে রড, ভোজালি, পাইপগান নিয়ে ঘরে ঢুকেই বলল, ‘যা আছে চটপট দিয়ে দিন। আমরা ডাকাতি করতে এসেছি। হাতে একদম সময় নেই। আরও চার বাড়ি যেতে হবে। জলদি করুন।’ ডাকাত দেখে পশুপতিবাবু আঁ-আঁ করে উঠলেন বটে, কিন্তু আমার বেশ আহ্লাদ হল। জীবনে কখনও ডাকাতি দেখিনি কিনা!”
“দেখলে নাকি?”
“আজ্ঞে, দেখলুম বইকী! ডাকাতদের পিছুপিছু ঘুরে-ঘুরে দিব্যি দেখলুম। দু চোখ সার্থক। ডাকাতরা একটা পাকার পেন ফেলে যাচ্ছিল, সেটা ধরিয়ে দিলুম, একটা লক্ষ্মীর ঘটও দেখিয়ে দিলুম। শেষে যাওয়ার সময় কার হাত থেকে যেন দুটো কাঁচা টাকা পড়ে গিয়েছিল। কুড়িয়ে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে সর্দারের হাতে দিয়ে দিলুম। তাতে পশুপতিবাবুর কী রাগ আমার উপর! এই মারেন কি সেই মারেন। ঘরশত্রু বিভীষণ, ডাকাতদের চর, মিটমিটে ভাম, কত কী বললেন। শেষমেশ পাড়ার লোক এসে তাকে ঠান্ডা করে বোঝাল যে, “লালুবাবু যে বোকা তা কে না জানে বলুন! বোকা লোকেরা অন্য রকম হলেই ভয়ের কথা!’ তবু পশুপতির টাটের রাগ কমে না। কেবল বলছিলেন, সবই তো গেল, দুটো টাকা পড়ে গিয়েছিল, সেটা না হয় ঘর বলতে থাকত, তাও ওই আহাম্মকের জন্য গেল!”
“না, না, মাত্র দুটো টাকার জন্য পশুপতির ওরকম করা উচিত হয়নি!”
“হ্যাঁ। পরে অবশ্য ঠান্ডা হয়ে তিনি চা-ও খাইয়েছেন। তাই বলছিলুম, বোকা হওয়ার কিছু সুবিধেও আছে মশাই!”
“তাই দেখছি। তা এসো, আমার সাধনপীঠে একটু বসে যাও। এক ভক্ত একছড়া কলা দিয়ে গেছে। দুটো কলা খেয়ে দেখবে চলো।”
বগলাপতির সাধনপীঠ বেশ নিরিবিলি জায়গা। সামনেই বিদ্যেধরীর ঘাট। গোটা কয়েক বটগাছ আছে, কাছেই শ্মশান, বগলাপতির একখানা কুটির আছে, আঙিনায় একখানা পাথর বাঁধানো বেদি।
এত রাতে বগলাপতির ভক্তরা কেউ থাকে না। কিন্তু ধুনির আলোয় দেখা গেল বেদির সামনে ধুতি আর শার্ট পরা একজন লোক বসে আছে। তাকে দেখে বগলাপতি ভারী খুশি হয়ে বললেন, “কামাখ্যা নাকি রে? বহুদিন পর দেখা! তা এত রাতে কী মনে করে?”
সিঁড়িঙ্গে চেহারার হাড়গিলে লোকটা কাঁচুমাচু মুখ করে বিরস গলায় বলল, “কামাখ্যা নই মশাই, আমার নাম বৃন্দাবন।”
বগলাপতি খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “বৃন্দাবন! বৃন্দাবনটা আবার কে? স্পষ্ট দেখছি সামনে কামাখ্যা বসে আছে, আর বলছিস, তুই বৃন্দাবন? আমার চোখে চালসেও ধরেনি, ভীমরতিও হয়নি।”
“আজ্ঞে, আমি নিয্যস বৃন্দাবনই বটে! আপনার ভুল হচ্ছে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বগলাপতি বেদির উপর পাতা কুটকুটে কম্বলের আসনে আসনপিড়ি হয়ে বসে বললেন, “কামাখ্যা হল নীলপর্বতে, প্রাগজ্যোতিষপুরের কাছে। আর বৃন্দাবন হল সেই উত্তরাখণ্ডে, হস্তিনাপুর না কী যেন জায়গাটা, তার কাছে। তা কামাখ্যা ছেড়ে তুই বৃন্দাবনগামী হলি কবে?”
জামার তলায় কোমরে প্যাচানো গামছাখানা খুলে এনে লোকটা মুখ মুছে বলল, “কারণ আছে। আমার বড় বিপদ, আমি হলুম চর হেতমপুরের বৃন্দাবন ঘোষ।”
“দ্যাখ কামাখ্যা, তুই যদি বৃন্দাবন হোস, তবে আমিও গাঁধীজি। যদি ভেবে থাকিস যে বুড়ো বয়সে আমার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, তা হলে ভুল করবি। কারণ, আমি বুড়ো হইনি। মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে বুড়ো হওয়া শক্ত।”
পাশ থেকে লালমোহনবাবু অত্যন্ত উদ্বেগের গলায় বলে উঠলেন, “গেল হপ্তায় যে বললেন ছাপ্পান্ন!”
“বলেছিনাকি? ওরে বাপু, আত্মার বয়সও হয় না, সে বুড়োও হয়, মরে না, জন্মায় না। নৈনং ছিদ্দন্তি শস্ত্রাণি, নৈনং দহতি পাবকঃ। মানে জানো? ওর মানে হচ্ছে আত্মা অজর অমর। তার আটচল্লিশই বা কী আর ছাপ্পান্নই বা কী?”
লালমোহনবাবু ভারী অবাক হয়ে বললেন, “তা হলে এই লোকটার বৃন্দাবন হতে আটকাচ্ছে কীসে? আত্মার বৃন্দাবনই বা কী, কামাখ্যাই বা কী!”
“আটকায় হে আটকায়, আইনে আটকায়!” হাড়গিলে লোকটা বলল, আমি কামাখ্যা না হয়ে বৃন্দাবন হলে কার কী ক্ষতি হচ্ছে বলুন তো! দুনিয়া তো আর উলটে যাচ্ছে না, চন্দ্র-সূর্যও উলটো বাগে উঠবে না।”
বগলাপতি নিমীলিত চোখে চেয়ে বললেন, “অত বড়বড় কাণ্ড
হলেও ছোটখাটো ফ্যাকড়া তো বাধতে পারে। তা হ্যাঁ রে কামাখ্যা, চুরি-ডাকাতি করে ফেরার হয়েছিস, নাকি খুনখারাবি করে এসেছিস?”
কামাখ্যা ওরফে বৃন্দাবন অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, “খুনটা আমি করতে যাব কেন! করল তো বাটু পরিহারের লোক!”
বগলাপতি একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “তাই বল। তা হলে খুন একটা হয়েছে।”
লোকটা কিছুক্ষণ গুম মেরে মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর মুখ তুলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমার যে বড় বিপদ বগলাদাদা!”
“খোলসা হ’ কামাখ্যা, খোলসা হ’। কথা যত চেপে রাখবি তত মুশকিলে পড়বি। খুনটা হল কে?”
“আজ্ঞে, তা জানি না। ফরসামতো একটা লোক, লম্বাপানা।”
“নিজের চোখে দেখলি?”
“দেখার ইচ্ছে ছিল না দাদা,তবে দুপুরে নদীর ধারের মাঠে গোরু বাঁধতে গিয়ে দেখি,দুটো মুনিশ গোছের লোক আর-একটা লোককে মাটিতে ফেলে গলা টিপে মারছে।”
লালমোহনবাবু চুকচুক করে একটা আপশোশের শব্দ করে বললেন, “এ, নিজের চোখে একটা খুন দেখব বলে কত কালের ইচ্ছে আমার। ডাকাতি দেখা হয়ে গেছে, এখন একটা খুন দেখতে পেলেই–”।
কামাখ্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সে সাধ আমারও ছিল মশাই। কিন্তু এ খুনটা দেখার পর সাধ ঘুচে গেছে। এখন নিজে কবে খুন হয়ে যাই সেই ভয়ে মরছি।”
বগলাপতি বিরক্ত হয়ে বলল, “অন্য লোকে খুন হল বলে তোর বিপদ কীসের? তুই খুন হবি কেন?”
“আমি যে খুনের সাক্ষী! তারা আমাকে চিনেও রেখেছে।”
বগলাপতি মাথা নেড়ে হতাশ গলায় বললেন, “কেন যে খুনটুনগুলো দেখতে যাস কে জানে বাবা! খুন কি দেখার জিনিস? এ তো আর থিয়েটার বায়োস্কোপ নয় রে বাপু। তা খুনিগুলো কি তোকে শাসিয়েছে নাকি?”
মাথা নেড়ে কামাখ্যা বলল, “নাঃ। বরং দুর্বুদ্ধির বশে আমিই একটা কাঁচা কাজ করে ফেলেছি!”
“কী কাজ?”
“ভাবলুম মতিলালের জমিটা বায়না করে রেখেছি, টাকার জোগাড় নেই বলে রেজিস্ট্রি হচ্ছে না। তা এই মওকায় পেঁয়ো খুনিগুলোর কাছ থেকে কিছু কেঁপে নিই। খুন-হওয়া লোকটার গলায় সোনার চেন, হাতে হিরের আংটি, পকেটে পুরুষ্টু মানিব্যাগ দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। ফস করে হাজার টাকা চেয়ে বসলাম। শাস্ত্রেই আছে বর্বরস্য ধনক্ষয়ং’।”
“বলিস কী? তুই তো ডাকাত! টাকাও খেয়েছিস?”
“না দাদা, বলল, তারা বাটু পরিহারের লোক, তার হুকুম না হলে টাকা দিতে পারবে না। শুনেই তো আমার হাত-পা সিঁটিয়ে গেল। কেঁপেকেঁপে অস্থির। বাটুর কানে যদি কথাটা ওঠে তা হলে আমার কী দশা হবে তা বুঝতে পারছেন?”
বগলাপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এ আর বোঝা শক্ত কী? শুনেছি বাটু মানুষকে বেশি কষ্ট দেয় না। কচ করে মুণ্ডখানা নামিয়ে দেয়।”
লোকটা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, “আপনি যোগীপুরুষ দাদা, আমার প্রাণটা রক্ষে করুন! বাটু পরিহারের কাছে টাকা চেয়েছি, এত বড় আস্পদ্দা সে কি সহ্য করবে? আমার বউ বলেছে, তুমি যে কাণ্ড করেছ তাতে সর্বনাশ হবে। বাটু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে যাবে। তুমি বরং ফেরার হয়ে যাও। কিন্তু কী করে ফেরার হতে হয় তাও তো ছাই জানি না! তাই আপনার কাছে আসা। নামধাম পালটেছি বটে, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করছে না। আমি চরহেতমপুরের বৃন্দাবন ঘোষ শুনে সবাই হাসছে। আপনি প্রেসিদ্ধ মানুষ, আমার একটা উপায় করুন!”
বগলাপতি গম্ভীর হয়ে বললেন, “প্রেতসিদ্ধ কি আর এমনি এমনি হওয়া যায় রে? অনেক মেহনত লাগে। খরচাপাতিও আছে। তার উপর তুই বাটু পরিহারের কোপে পড়েছিস, তোকে লুকিয়ে রাখার বিপদ আছে। সব দিক বিচার-বিবেচনা করলে খরচা বড় কম হবে না রে!”
কোমরে প্যাচানো লম্বা গোঁজ বের করে টাকা গুনতে-গুনতে কামাখ্যা বলল, “এই পাঁচশো টাকা এখন রাখুন, পরে দেখা যাবে।”
বগলাপতি উদাস গলায় বললেন, “তা হ্যাঁ রে কামাখ্যা, আমি তো বাজারহাটে যাই না, তাই দরদামও জানি না। তা মানুষের প্রাণের দাম এখন কত করে যাচ্ছে তার খবর রাখিস?”
লালমোহনবাবু বলে উঠলেন, “সকলের প্রাণের দাম এক নয় দাদা। ল্যাংড়া আমের যা দাম, ফজলির তো আর তা নয়!”
বগলাপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যার দশখানা গাঁ জুড়ে ফলাও সুদের কারবার, যার একখানা মাছের আড়ত আর দু’খানা চালু দোকান আছে, তার প্রাণের দাম কত হবে বলে তোমার মনে হয় হে লালমোহন?”
“হিসেব করতে হবে বগলাদা। দরটা চড়া হবে বলেই মনে হয়।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে। তাই বলছি, এখানে তোর সুবিধে হবেনা রে কামাখ্যা, তুই বরং কোনও সস্তা-গণ্ডা জায়গা খুঁজে দ্যাখ। এ হল সাধনপীঠ। স্বয়ং শিব ত্রিশূল হাতে সারা রাত ওই ধুতরো গাছের তলায় চেপে বসে থাকেন। আমার গানাভূত ওই উত্তর পশ্চিম দিকটায় টহল দেয়, বাজানা-ভূত সামলায় পুব আর দক্ষিণ দিক। গোটা চত্বর মন্ত্র দিয়ে বন্ধন করা থাকে, মাছিটিও গলে আসতে পারে না। তোর মতো মহাজনের প্রাণের দাম বাবদ মাত্র পাঁচশো টাকা নিয়েছি শুনলে শিবঠাকুর কি আর আমার মুখদর্শন করবেন রে? নাকি গানা আর বাজানাই আমাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করবে? নাকি মন্ত্রেরই আর জোর থাকবে? তখন বাটু এসে খাঁড়া হাতে দাঁড়ালে আটকাবে কে বাপ? আমার সাধনপীঠে যে রক্তগঙ্গা বইবে!”
লালমোহনবাবু অত্যন্ত উদ্বেগের গলায় বললেন, “বাটুর কি বন্দুক-পিস্তল নেই? খাঁড়া দিয়ে লোকের গলা কাটা, ওটা কীরকম ব্যবহার? ছিঃ ছিঃ, রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটানো তো বর্বরের কাজ! তার চেয়ে গুলিটুলি অনেক ভাল। সাহেবি কেতার জিনিস, তেমন রক্তটক্তেরও ব্যাপার নেই। মরেও সুখ। পাঁচজনকে বুক ফুলিয়ে বলা যায় যে, গুলি খেয়ে মরেছি! কী বলেন বগলাদা?”
বগলাপতি কথাটার জবাব দিলেন না। একটু ধ্যানের ভাব এল বোধ হয়।
কামাখ্যা গেঁজে খুলে আর পাঁচশো টাকা বের করে বলল, “আমার মতো মনিষ্যির প্রাণের আর ক’টা টাকাই বা দাম? মশা মাছি বই তো নই। সেদিন হরিসভার পরানঠাকুর বলছিলেন বটে যে, প্রাণ অতি বায়বীয় জিনিস। দেখাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না, আকৃতি-ওজনও কিছু নেই। তা ওরকম হালকাপলকা জিনিসের দাম যে হঠাৎ আজ এত ঠেলে উঠবে তা কে জানত! তা এই হাজার টাকায় কী হবে মশাই? নাকি নয়নপুরে ভায়রাভাইয়ের বাড়ি রওনা দেব!”
একটু সটান হয়ে বগলাপতি চোখ খুলে বললেন, “আহা, আমরা আপনজনেরা থাকতে ভায়রাভাই কেন? বিপদে পড়ে এসেছিস, ফেলি কী করে?”