০৩.
প্রিন্সেপ স্ট্রীটের একটা ব্লকে ওলাফের জিমনাসিয়াম অর্কিড শহরের পূর্ব দিকে। ওখানে পৌঁছতে কিছুক্ষণ ক্ষয়া পাথরের রাস্তায় হাঁটতে হয়। কাঠের সাইনবোর্ডে লেখা…বক্সিং একাডেমি। মালিক ওলাফ গার।
ঘরের মধ্যে কেমন যেন ঘামের গন্ধ। একটা রিংকে ঘিরে অনেক লোক। নিগ্রোটা অনেকদিন ওলাফের কাছে আছে। কয়েকজন বক্সার বালির বস্তায় ঘুষি মারছে।
ওলাফের অফিস ঘরের দিকে আমি অগ্রসর হই!
‘এই যে ডিক!’ ভিড় ঠেলে হেরাল্ড কাগজের ক্রীড়া সাংবাদিক হাগসন বললো। হাগসন লম্বা চেহারার মাথায় টাকের আভাস। ‘কী ব্যাপার?’
‘ওলাফের খোঁজে এসেছি।‘
‘ওলাফকে অফিসে পাবে।‘ হাগসন আমার মুখের আহত স্থানটি দেখে বলে, ‘খুনের ব্যাপারে নতুন কোন সংবাদ আছে কী? আমি বাজী রেখে বলতে পারি–এ কাজ লীডবেটারের। ব্যাটা এক নম্বরের বজ্জাত। লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের লক্ষ্য করে। একবার আমাকে রীতিমত ভয়…মনে করেছিলাম খচ্চরটা মেয়েটার স্বামী।‘
যেতে যেতে বলি, ‘খুনী, যে কেউ হতে পারে। তুমি বরং পুলিশের বড়কর্তাকে জিজ্ঞেস করতে পার।’
‘আরে, শোন শোন…এত ব্যস্ততা কিসের! একটা মেয়েকে দেখবে? মেয়েটা কে বুঝতে পারছি না।‘
হাগসনের কথামত তাকাই। মেয়েটার মাথায় লাল চুল, বড় বড় চোখ। মেয়েটা তীক্ষ্ণ চোখে নি*গ্রো বক্সারকে দেখছে।
আমি বলি, ‘হ্যাঁ…একটা আগুনের শিখা। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস কর…আলাপ কর।‘
‘থাক থাক! মেয়েটা একটা চাবুক। মনে হয় ওর পেছনে জবরদস্ত লোক আছে।‘
কে যেন হাগসনকে চিৎকার করে ডাকে আর সে এগিয়ে যায়।
ওলাফের অফিসে ঢুকে যাই। টেবিলের উপর অনেকগুলি টেলিফোন। কাছেই চেয়ারে বসে যন্ত্রের মত টাইপ করছে এক স্বর্ণকেশী মহিলা।
ওলাফ একটা চেয়ার দেখিয়ে বলে, ‘কেমন আছে ডিক?’
তিনটে টেলিফোন একসঙ্গে বেজে ওঠে। ওলাফ টেলিফোনে চিৎকার করে বলে, ‘আমি এখন ব্যস্ত।‘
ওলাফ আমার দিকে সিগারের বাক্স এগিয়ে দেয়, ‘তারপর…হ্যাঁ, মেয়েটার খুনের ব্যাপার পড়েছি। দুঃখিত।‘
‘মেয়েটা খুব ভাল ছিল। ওলাফ মিলস্ নামে কোন ছোকরাকে জান?’
‘হ্যাঁ জানি। মেয়েছেলের ব্যাপারে না থাকলে ছোকরা বক্সিংয়ে অনেক উঁচুতে উঠতে পারতো। কিন্তু ওই মেয়েছেলের ব্যাপার…ছমাস আগে মিলস্ এখান থেকে চলে যায়।‘
আমি বলি, ‘আমার সামান্য বিরোধ হয়েছিল ওর সঙ্গে। দ্যাখ, ছোকরা বুট দিয়ে কি অবস্থা করেছে।‘
‘হারামী এক নম্বরের!’ ওলাফ বলে,’ব্যাপারটা ভুলে যাও। মিলস্ সাংঘাতিক। ওর সঙ্গে কেন তোমার বিরোধ হয়েছিল?’
‘চাকরী গার্ডের…।’
ওলাফ বিস্ফারিত চোখে তাকায়, ‘কিন্তু ওর অর্থের অভাব নেই…মনে হচ্ছে অন্যের কথা তুমি বলছে। তাই মনে হয় ওর চাল-চলন দেখে। ওর যা পোশাক। যেমন দামী গাড়ি ব্যবহার করে…ও থাকে ফেয়ারভিউতে। উঃ, ভাবা যায়।‘
বলতে থাকে ওলাফ, ‘মিলস্ কিভাবে এত অর্থ পায়।‘
‘ছোকরা খুব ওস্তাদ মেয়েদের বশ করতে।‘
‘ধন্যবাদ ওলাফ। ছোকরাকে আমি একদিন উচিত শিক্ষা দেব।‘
গম্ভীর মুখে ওলাফ বলে, ‘ছোকরা খুব দ্রুত মারতে জানে। যদি ঠিক মত ওকে আঘাত করতে পার–মানে ঘুষিতে জোর থাকা চাই।‘
‘ওলাফ, লাল চুলের মেয়েটি কে? ওই যে বাইরে, চেয়ারে বসে বক্সিং প্র্যাকটিস দেখছে, ওই মেয়েটি।‘
ওলাফ হেসে বলে, ‘গেইল? গেইল বোলাস। আরে, ওকে কয়েক সপ্তাহ যাবৎ দেখিনি। কাইজার মিলস্ সম্পর্কে মেয়েটি অনেক কিছু জানে। মিস বোলাস বক্সিং নিয়ে পাগল। মিলস্ বক্সিং ট্রেনিং নেওয়া বন্ধ করলে–মিস ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। মেয়েটা বড্ড কড়া ধাতের।‘
‘ওলাফ, ওর সঙ্গে আমাকে একটু আলাপ করিয়ে দাও।’
.
ফিনেগান রেস্তোরাঁয় দুপুরে অসম্ভব ভিড় থাকে। কিন্তু বাগানের দিকে কিছুটা ঘেরা জায়গায় ফিনেগানের বিশেষ খাতিরের লোকদের বসার ব্যবস্থা আছে।
বেনি আর কারমান দুর থেকে আমাকে ইশারা করে। ঘেরা জায়গায় আমি মিস বোলাসকে নিয়ে বসি। ওরা আমাদের সঙ্গে যোগদান কবে কিন্তু কিছুটা মাতাল মনে হয়।
মিস বোলাসকে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে।
ওদের চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করে বলি, ‘চুপচাপ চেয়ারে বস সুবোধ বালকের মত।‘
বেনি কারমানকে বলে, ‘ডিকের কাণ্ডটা দেখলে! আমাদের কলুর বলদের মত খাটাচ্ছে। আর নিজে মেয়েছেলে নিয়ে মশগুল।‘
কারমান মিস বোলাসকে নত হয়ে সেলাম ঠুকে বলে, ‘ম্যাডাম, আমাদের বন্ধু ডিক ম্যালয় থেকে সাবধানে থাকবেন। ও যুবতী মেয়েদের চিবিয়ে খায়। অনেক মেয়ের বাপ ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি কী আপনাকে আপনার মার কাছে পৌঁছে দেব?
বেনি বলে, ম্যাডাম চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।
মিস বোলাস আমাকে বলে, ওরা কি সবসময় মাতাল থাকে?
ওদের কথাবার্তা এরকম। আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই। এই যে পরিচ্ছন্ন মাতালটির নাম জ্যাক কারমান। আর অন্যটি এড বেনি। ওরা চ্যাংড়া হলেও ক্ষতিকর নয়। এই যে বাছারা, মিস বোলাসের সঙ্গে পরিচিত হও।
বেনি বলে, ওর চোখদুটো দারুণ আর ওই ঘাড়ের নরম ভঙ্গি…ভাবা যায় না।
কারমান উচ্ছ্বাসের আবেগে গড়গড় করে একটি কবিতা বলে যায়।
আমাদের জন্যে বেয়ারা খাবার নিয়ে এল। কারমান বেয়ারাটিকে আদেশ দেয়, এক বোতল আইরিশ দিয়ে যাও। মিস বোলাসের দিকে ঝুঁকে বলে, আপনাকে কি মদ্যপান করতে অনুরোধ করতে পারি?
মিস বোলাস বলে, লোকটা পাগল। ওরা কী সবসময় এ রকম ব্যবহার করে?
অধিকাংশ সময়।
কারমান বেনিকে বলে, ডিকের দিকে চেয়ে দ্যাখ। মনে হচ্ছে ব্যাটাকে জোর ধোলাই দিয়েছে কেউ।
বেনি তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে দেখে বলে, কে এমন করল? এই মেয়েটা কি?
বাজে বকবক বন্ধ করে বসো, সব বলছি। আমি মিলসের কথা সব বলি।
বেনি বলে, ঘাড়ে লাথি খেয়ে সেই কেচ্ছা আবার রসিয়ে বলতে তোমার লজ্জা করে না। গুল দিচ্ছ না তো?
বেশ তো, মিলসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব মিস বোলাস জানে মিলস্ কেমন মস্তান, এক সময় সেরা বক্সার ছিল।
পেলব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বোলাস বলে, মিলস্ ভাল বক্সার হলেও, গতি দ্রুত হলে ওকে সহজেই কাবু করা যায়।
উহ ব্যাপারটা অত সহজ নয়। মিলস্ ডান হাতে ঘুষি মারলে তার দফারফা। মিস বোলাস আমাদের সাহায্য করবে। অপরাধতত্ত্ব সম্পর্কে ওর খুব উৎসাহ।
বেনি বোলাসের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে, আমি আর আপনি রাতের দিকে কাজ করবো। আপনার অপরাধতত্ত্ব সম্পর্কে প্রবন্ধ আমি পড়বো।
বেয়ারাকে আইরিশ হুইস্কি দিতে বলি। তারপর বেনি আর কারমানের দিকে কমকরে তাকাই; অনেক হয়েছে…এবার ছ্যাবলামো বন্ধ করে কাজের কথায় আসা যাক।
মিস বোলাস মদ স্পর্শ করে না। সে জানায় রাত সাতটার আগে তার মদ্যপানে আনন্দ হয় না।
গ্লাসে মদ ঢেলে বলি, কারমান লীডবেটার সম্পর্কে কী জানলে?
লীডবেটারের সঙ্গে দেখা করেছি, কিন্তু সে আমাকে বিশেষ কিছু বলে নি। লোকটা অদ্ভুত ধরনের। বালিয়াড়ির কাছে ওর একটা ছোট্ট বাড়ি–ছাদে টেলিস্কোপ ফিট করা। দিনরাতের অধিকাংশ সে টেলিস্কোপে দু চোখ লাগিয়ে কি যেন লক্ষ্য করে।
আসল কথা কিছু জানতে পারলে?
লোকটা অনেক কিছু জানে। ওর গল্প এরকম মাছ ধরা দেখার সময় নাকি ওর নজরে ডানার হাত ব্যাগ আসতেই পাশে রক্তের দাগ দেখে পুলিশে খবর দেয় এবং জানায় কাউকে সে দেখেনি। আমি অর্থের লোভ দেখালে ও বলে, ঠিক মনে নেই কাউকে দেখেছে কিনা। ব্যাপারটা আরো ভাবতে চায়।
এসব লীডবেটার মিফিনকে জানায় নি?
পুলিশকে ও খুব ভয় পায়। মনে হয় ও যেন কী ফন্দি আঁটছে।
ভ্রু কুঁচকে বলি, হয়ত খুনীকে কজা করার তালে আছে। তারপর ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবে। ওকে একটু ভয় দেখানো দরকার। আমি নিজে ওর সঙ্গে কথা বলবো যদি কাজ হয়।
দেখতে পার চেষ্টা করে। তবে ব্রান্ডননের কথা মনে রেখ।
জানি। আর কিছু বলার আছে?
সান্টা রোসা স্টেটের সামনে বড় পেট্রোল পাম্পের কাছে গিয়েছি। ভেবেছি মিসেস কার্ফের দেখা পাবো। যখন আমি একজন মেকানিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন মিঃ কার্ফের ফিলিপাইন দেশীয় ড্রাইভার হাজির। পাঁচ পাউন্ডের বিনিময়ে ব্যাটা মুখ খোলে। বলে মিসেস কার্ফ প্যাকার্ড গাড়ি নিয়ে উধাও হয়েছে।
কারমানের দিকে তাকিয়ে বলি, মিসেস কার্ফ বাড়ি ফেরেনি।
ড্রাইভার তাই জানায়।
হু, দেখা যাচ্ছে মিসেস কার্ফ খুনের ঘটনা জানে, তাই তাড়াতাড়ি আত্মগোপন করেছে।
কারমান বলে, আমারও তাই মনে হয়। অবশ্য প্যাকার্ড গাড়ির নম্বর টুকে রেখেছি।
গাড়ির খোঁজে লেগে পড়। দশ মাইলের মধ্যে সমস্ত হোটেল, গ্যারেজ। রাস্তার পাশে দাঁড় করানোনা গাড়ির ওপর নজর রাখ।
মিস বোলাস বলল, নাইট ক্লাবগুলিও খোঁজা দরকার।
আমি বলি, মিস বোলাস ঠিক কথা বলেছে। লা এটোলিতে খোঁজা দরকার। বেনিকে বলি, তুমি কি সকালে ওখানে গিয়েছিলে?
বেনি বলে, ওখানে কাউকে দেখিনি। ব্যানিস্টারকে দেখেছি কিন্তু ও আমাকে দেখেনি।
কারমানকে বলি, লা এটোলির ওপর নজর রেখ। ডানা ওখানে গিয়েছিল কিনা, প্যাকার্ড গাড়ি আছে কিনা আর অনিতা কার্ক আছে কিনা।
বেনি বলে, ডিক, বাজে বকবে না।
আমাদের স্বীকার করতেই হবে খবর পাওয়ার জন্যে মিসেস কার্ফ আমাকে এক হাজার ডলার দিতে চেয়েছিল। আমাকে টলাতে পারেনি। আধ ঘণ্টা পর ডানার ফ্ল্যাটে মিসেস কার্ফকে দেখা যায়। পরদিন ভোরে ডানার গদির নিচে একটা বহু মূল্যবান হীরের নেকলেশ পাওয়া যায়। ডানাকে মিসেস কার্ফ মূল্যবান জিনিষের লোভ দেখিয়ে কাবু করেছে…
বেনি রেগে বলে, ডিক, তোমার ধারণা দ্রুত বদলায়। একবার বললে ডানার ফ্ল্যাটে মিস কার্ফ নেকলেশটা রেখেছে। আবার বলছ অন্য কথাব্যাপারটা কী?
বেনি,জানি আমার কথা তুমি পছন্দ করছনা, কিন্তু মিসেস কার্ফকে বের করতেই হবে। আমার ধারণা হয় লা এটোলিতে নয় বার্কলের বাড়িতে ও আছে। শহরে না থাকলে অবশ্য অন্য কথা। আমি বার্কলের কাছে যাব। বেনি, তুমি কাজে লেগে যাও। যেখানে ডানার বডি পাওয়া গেছে–সে জায়গাটা চষে ফেলল। আর কারমান, তুমি প্যাকার্ড গাড়ির খোঁজ কর, ঢু মার লা এটোলিতে।
মিস বোলাস বলে, লা এটোলিতে আমি যেতে পারি। আমি ওই ক্লাবের মেম্বার।
অবাক হয়ে বলি, আপনি যেতে চান?
ওই ক্লাবে সাঁতার কাটতে তো যাবোই। চারিদিকটা একটুনজর দেওয়া এমনকি শক্ত ব্যাপার।
বেনি বলে, আঃ, সাঁতারের পোশাকে আপনাকে যা দারুণ দেখাবে।
মিস বোলাস বলে, ওই পোশাক ছাড়াও আমাকে সুন্দর দেখায়। আমাকে গাড়ির বর্ণনা দিন। দেখি কিছু করতে পারি কিনা।
কারমান তার কার্ডের পেছনে গাড়ির নম্বর, ও বর্ণনা লিখে দেয়।
সবাইকে কাঁপিয়ে মিস বোলাস চলে যায়। বেনি বলে, আঃ, কী একখানা…!
কারমান বলে, ডিক, মেয়েটাকে কোথায় পেলে?
জবাবে বলি, মেয়েটার সম্পর্কে কিছুই জানিনা। ওলাফ ক্রুগার মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। আমার ধারণা মেয়েটাকে দিয়ে অনেক কাজ হবে।
***
ডানার হত্যাকারীর চেয়ে আমি বেশি ভাবছি মিলস্ ছোকরা সম্পর্কে। কিন্তু আমার উচিত আগে ডানার খুনীকে খোঁজা।
তবুও মিলসকে নিয়ে ভাবছি। একটা ওষুধের দোকানে ঢুকে টেলিফোনের বই খুলি। সহজেই পাই মিলসের ঠিকানা দুশো পঁয়ত্রিশ, বীচউড এভেনিউ, ফেয়ার ভিউ ৩৪২৫৭।
ল্যান্ড রেকর্ড অফিসে যাই। দুশো পঁয়ত্রিশ বীচউড এভেনিউ মিস কার্ফ এক বছর আগে কিনেছে।
বাঃ, আবিস্কারের আনন্দে নিজেকে হালকা লাগে। রোলস বয়েস গাড়িও কাফদের। হয়ত এসব ঘটনা ডানার হত্যাকারীর সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। হয়ত মিলস্ গোটা কার্ফ ফ্যামিলিকে প্রতারণা করছে।
ডানাকে খুন করা মিলসের পক্ষে অসম্ভব নয়। যদি মিলসকে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যেতে পারি…
এবার আমি উইল্টশায়ার এভেনিউতে বার্কলের বাড়ি যাই। চারিদিকে দ্রুত তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকি। বেশ সুন্দর বাগান। পঞ্চাশ গজ দূরে লন। তারপর সুন্দর দোতলা বাড়ি। বারান্দা দিয়ে উপরে উঠে গেছে সিঁড়ি। দোতলায় চারটে ফ্ল্যাট। সামনের দরজার কাছে গিয়ে কলিং বেল বাজাই। কোন সাড়া না পেয়ে আবার বাজাই। টের পাই, বাড়িতে কেউ নেই।
বাড়ির ভেতরে ঢোকা মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। দ্রুত একবার বাড়ির ভেতরটা দেখলে হয়ত কোন সূত্র পেয়ে যেতে পারি। কিন্তু গাড়ি যে গেটের বাইরে।
গাড়িটাকে চালিয়ে বেশ কিছুটা দূরে একটা গাছের নিচে রেখে বার্কলের বাড়িতে ফিরে আসি। ছুরির সাহায্যে একটা জানালা খুলে ভেতরে ঢুকি। নিঃশব্দে চারিদিকে নজর রেখে এগিয়ে যাই। (বসবাসের)।
ঘরটায় পুরুষের বসবাসের চিহ্ন। বুনো তরবারি আর প্রাচীনকালের যুদ্ধাস্ত দেয়ালে শোভিত। টেবিলে নানা ধরণের মদের বোতল। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যাই।
হয়ত বার্কলে ঘুমুচ্ছে। কান পেতে শুনি উহ, শাস-প্রশ্বাসের কোন শব্দ নেই। কাছেই একটা ঘর। সাহসের সঙ্গে দরজা খুলি।
একটা পুরুষদের বাথরুম। পাশের ঘরে ঢুকি। বড় বিছানা, দুজনের শোবার উপযোগী। একটা ড্রেসিং টেবিল, পোশাকের আলমারী।
দরজা খোলা রেখে ড্রয়ার খুলি। একটা ঝকমকে ছবি চোখে পড়ে। মিসেস কার্ফের গায়ে পোশাক নেই বললেই চলে। ছবির নিচে লেখা প্রিয়তম জর্জের জন্যে ভালবাসাসহ অনিতা।
ছবিটা এত বড় যে পকেটে ঢোকানো যাবে না তাই ফ্রেম থেকে খুলে ছবিটা উল্টো করি। রবার স্ট্যাম্প করা একটা ঠিকানা : লুই, ফটোগ্রাফার, স্যানফ্রানসিসকো।
ছবিটা কয়েক বছর আগের। তখন মিসেস কাফের চেহারা অনেক সজীব ছিল এখনকার মত রুক্ষ্মভাব ছিল না।
আঃ, কী অপূর্ব সুযোগ আমি নষ্ট করেছি। মিসেস কার্ফের এরকম ছবি আগে দেখলে সেদিন নিশ্চয়ই সাড়া দিতে পারতাম।
যথাস্থানে ছবি রেখে পোশাকের আলমারি ঘাঁটতে শুরু করি। অসংখ্য স্যুট, টুপী আর জুতোর ছড়াছড়ি। সট সরিয়ে আলমারির ভেতরে উঁকি মারি।
অত্যন্ত পরিচিত নীল কোট ও স্কার্ট চোখে পড়ল। যে রাত্রে ডানা নিহত হয়, ওর পরনে ওই পোশাক ছিল। তবে কী বার্কলে…।
একতলায় পায়ের শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি পোশাক দুটি বান্ডিল করে দরজার দিকে ছুটে যাই। ড্রয়ার খোলার শব্দ শুনি। কাগজ ওল্টানোর শব্দ। চুপিচুপিব্যালকনিতে এসে নিচের দিকে তাকাই।
টেবিলের সামনে মিলস্ দাঁড়িয়ে। আমি তাড়াতাড়ি শোবার ঘরে গিয়ে ছবিটা ডানার কোটে আর স্কার্টের মধ্যে খুঁজে নিয়ে জানলা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম।
.
কড়া চোখে মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে। বেনির দৃষ্টিতে আহত বিস্ময়।
ঠিক ভুল সময়ে এসে তুমি আমার বারোটা বাজিয়ে দাও।
ব্যাপারটা কি বেনি? মেয়েটার দিকে হাঁ করে…জীবনে কখনো মেয়ে দেখনি?
মেয়েটাকে বলছিলাম ওর মত সুন্দরী আমি দেখিনি।
এই কী তোমার কাজের নমুনা? যাকগে, এবার বল কতদূর অগ্রসর হলে?
গাড়ির কাছে চল।
গতরাত্রে ডানাকে দেখেছে এমন কারুর খোঁজ পাইনি। কিন্তু অনিতা কার্ফকে দেখেছে এমন দুজনের সন্ধান পেয়েছি।
অনিতা কার্ফ?
হা। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার বালিয়াড়ি পর্যন্ত অনিতা কার্ফকে নিয়ে গেছে। মিসেস কার্ফের ভাবভঙ্গি তার অন্যরকম মনে হয়েছিল। আরো অদ্ভুত যে এমন একটা নির্জন জায়গায় নেমে তাকে অপেক্ষা করতে বলল।
তখন রাত কটা হবে?
মধ্যরাতের পর।
অন্য লোকটি কে?
একজন জেলে। সে একজন মহিলাকে সন্ধ্যাকালীন পোশাক পরে বালিয়াড়ির দিকে যেতে দেখেছে। মনে হচ্ছে যখন ডানাকে গুলি করা হয় সেখানে অনিতা কার্ফ উপস্থিত ছিল। হয়ত কোথাও আড়ালে লুকিয়ে ছিল।
বেনি চিন্তান্বিত মুখে বলে, সমস্ত ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু কেউ ডানাকে দেখে নি।
গাড়ির পেছনের সিট থেকে ডানার কোট আর স্কার্ট এনে বলি, একবার তাকিয়ে দ্যাখ।
বেনির চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে, আশ্চর্য!
ডানার এই পোশাক বার্কলের পোশাকের আলমারিতে পাওয়া গেছে।
বেনি বলে, মনে হয় তবে ডানাকে বার্কলে খুন করেছে।
জানি না, বেনি। সব সময় মনে হয়, কিছু একটা পেয়েছি। তারপর অন্যকিছু আবিষ্কার হয়। ফলে প্রথম ধারণা বাতিল হয়। এখন লীডবেটারের কাছে যাচ্ছি। বেনি, আমার সঙ্গে চল।
গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বলি, লীডবেটারের সঙ্গে কথা বলে আমরা অফিসে যাব। এখন থেকে সাবধান না হলে আমরা আর সঠিক পথে যেতে পারবো না।
বেনি বলে, বার্কলের বাড়িতে মিলস্ কি উদ্দেশ্যে যেতে পারে?
জানি না। তবে এর আগে আমি না গেলে অনিতা কার্ফের ছবিটা পেতাম না। আর স্যানফ্রানসিসকোতে গিয়ে তোমাকে অনিতা কাচের অতীত জেনে আসতে হবে। হয়ত কিছু দরকারী তথ্য মিলতে পারে।
আমার অথবা লীডবেটারের বাড়ির কাছে গাড়ি থামাই। ডানার পোশাক আর অনিতা কার্ফের ছবি গাড়ির পেছনেই রেখে আমরা এগিয়ে যাই।
হাঁটতে হাঁটতে বলি, কাল রাত্রে চাঁদের আলো তীব্র ছিল। লীডবেটার টেলিস্কোপেহয়ত অনেক কিছুই দেখেছে।
বেনি বলল, লোকটাকে অর্থের লোভ দেখাতে চাও নাকি?
জানি না। যদি ঠিকমত কজা করতে পারি–হয়ত ঘুষের প্রয়োগ হবে না।
লীডবেটারের টেবিলের সামনে আমরা দাঁড়াই। চারিদিকে সুনসান। আমরা এগিয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মারি শোবার ঘরের দিকে। পুরনো আসবাব। টেবিলের ওপর অসমাপ্ত খাবার।
বেনি দরজায় কয়েকবার আঘাত করতে দরজা খুলে যায়। আমরা নোংরা ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাই কোন শব্দ নেই।
বেনি বলে, ব্যাটা হয়ত টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে ন্যাংটো মেয়েদের স্নান দেখেছে।
চল, ছাদে যাই।
মই বেয়ে ছাদে উঠি। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আমরা বিরাট টেলিস্কোপের দিকে তাকিয়ে থাকি। পাশেই লীডবেটার চিৎ হয়ে শুয়ে, ওর কপালের মাঝখানে একটা গর্ত, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ।
আমার বাহু দুহাতে জড়িয়ে বেনি বলে, উঃ ভাবা যায় না।