এতদিনে সকলেই জেনে গিয়েছে যে, প্রাণপতি খাসনবিশ একজন আলাভোলা মানুষ। তিনি দর্শনশাস্ত্রে এম এ এবং এম ফিল। মুন্ডু এবং ধড়কে যদি আলাদা ভাবে বিচার করা যায়, তা হলে দেখা যাবে, প্রাণপতিবাবুর মুভুটা সর্বদাই নানা রকম দার্শনিক চিন্তায় ডুবে আছে, পৃথিবীটা কি আছে না নেই, সামনের ওই দেওয়ালটা কি সত্যি না মিথ্যে, অস্তিত্ব ব্যাপারটা কি মায়া না মতিভ্রম! আচ্ছা, ওই যে মেটে কলসি করে মেয়েটা জল আনছে, ওই মেটে কলসিটা আসলে কী? মৃৎপাত্র? না, মৃৎপাত্র তো অনেক রকমের হয়। তা হলে কলসি বলতে শুধু মৃৎপাত্র বললে তো হবে না। গোলাকার মৃৎপাত্র? উঁহু, তাতেও পুরো বোঝা যাবে না। জল রাখার জন্য গোলাকার মৃৎপাত্র? উঁহু, ওতেও গণ্ডগোল রয়ে গেল!
এইরকম নানা গুরুতর চিন্তায় তাঁর মাথা সর্বদা ব্যাপৃত থাকে। আর থাকে বলেই নিজের ধড়টাকে তাঁর সব সময় খেয়াল থাকে না। আর থাকে না বলেই মাঝে-মাঝে নীচের দিকে তাকিয়ে তিনি ভারী অবাক হয়ে যান। কারণ মুন্ডুর নীচে, অর্থাৎ ঘাড়ের তলা থেকে তাঁর পরনে পুলিশের পোশাক, কোমরে চওড়া বেল্ট ও ভারী পিস্তল।
প্রাণপতিবাবুর মুন্ডুর সঙ্গে ধড়ের এই খটাখটি বহুকালের। দু’ পক্ষের বনিবনা নেই বললেই হয়।
মাঝে-মাঝে তাঁর ফচকে হেড কনস্টেবল ফটিক তার কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে জানান দেয়, “স্যার, আজ বড্ড উপরে উঠে গিয়েছেন স্যার। আপনার মাথাটা যে গ্যাসবেলুনের মতো নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। এবার একটু নেমে আসুন স্যার।”
প্রাণপতিবাবু তখন নামেন বটে, কিন্তু চারদিককার চুরি, গুন্ডামি, ডাকাতি, খুনজখম, পকেটমারি এসব দেখে ভারী বিরক্ত হন।
আজ সকালের দিকটায় প্রাণপতিবাবু ইনফিনিটি জিনিসটা নিয়ে ভাবছিলেন। ওই ইনফিনিটি বা অসীম ব্যাপারটা কী, তা ভাবতে ভাবতে তাঁর মনপ্রাণ ডানা মেলে একেবারে আকাশে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ঠিক এই সময় তিনি হঠাৎ ‘লাশ’ শব্দটা শুনতে পেলেন।
কে যেন বেশ হেঁকেই বলল, “স্যার, একটা লাশ এসেছে।”
‘লাশ’ শব্দটা তিনি জীবনে কখনও শুনেছেন বলে মনে হল না। লাশ! লাশ মানে কী? লাশ কাকে বলে? লাশ দেখতে কেমন?
ফটিক ফের চেঁচাল, “স্যার, একটা লাশ এসেছে।”
ভারী বিরক্ত হয়ে প্রাণপতিবাবু বললেন, “লাশ এসেছে! সেটা তো পুলিশ কেস! এখানে কেন, ওদের থানায় যেতে বলো।”
“আজ্ঞে, এটাই অষ্টপুরের থানা স্যার। আর আপনিই বড়বাবু।”
অনন্ত আকাশের একদম মগডাল থেকে প্রাণপতিবাবু ঝম করে পারিপার্শ্বিকে নেমে এলেন এবং বুঝতে পারলেন, তিনি অষ্টপুর নামে একটা নষ্ট ও ভ্রষ্ট জায়গায় বড় কষ্টে আছেন।
খুব বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করলেন, “লাশ! লাশ! কীসের লাশ? কার লাশ?”
ফটিক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আজ্ঞে, মানুষেরই লাশ।”
বাস্তব জগতের সঙ্গে প্রাণপতিবাবুর খটাখটি বহু দিনের। এই বাস্তব জগতে এমন বহু ঘটনা ঘটে, যেগুলোর কোনও অর্থ হয় না, না ঘটলেও চলে যেত, ঘটা উচিত ছিল না। তবু ঘটে। এই যে একটা লাশের কথা তিনি শুনছেন, যদি ঠিক শুনে থাকেন, তা হলে ওই লাশ নিয়ে তাঁকে এখন বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হবে।
অত্যন্ত হতাশ হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “বডিটা কার?”
“নামধাম জানা যায়নি স্যার, তবে গায়ে কয়েদির পোশাক আছে। মনে হয়, সদরের জেলখানা থেকে পালিয়ে এসেছে। একটু আগেই অবনী ঘোষালের পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। তারপর হাটুরে কিল খেয়ে অক্কা পেয়েছে।”
“এটা অত্যন্ত অন্যায়।”
ঘটনাক্রমের ভিতর অনেক অন্যায়ের গন্ধ আছে বলে পরিষ্কার থাকার জন্য ফটিক জিজ্ঞেস করল, “কোনটা অন্যায় স্যার?”
“সদরের জেলখানা থেকে পালিয়ে মরার জন্য অষ্টপুর ছাড়া কি আর জায়গা ছিল না লোকটার?”
“সবাই যদি বুদ্ধিমান আর বিবেচক হত, তা হলে তো কথাই ছিল না স্যার।”
ছোট কনস্টেবল বক্রেশ্বরের ধ্যানজ্ঞান হল হোমিয়োপ্যাথি। অবসর সময়ে বসে ‘সহজ পারিবারিক চিকিৎসা’ বা ‘হোমিয়োপ্যাথি শিক্ষা’ ইত্যাদি বই পড়ে। সর্বদাই ছোট একখানা কাঠের বাক্স থাকে তার কাছে। মানুষ তো বটেই, গোরু-ছাগলকেও সে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ খাওয়ায় বলে শোনা গিয়েছে।
বক্রেশ্বর ঘরে ঢুকে একখানা স্যালুট ঠুকে বলল, “মনে হয়, বেঁচেও যেতে পারে স্যার। নাক্স ভমিকা আর আর্নিকা ঠুসে দিয়েছি। ঘণ্টাখানেক বাদে আরও দুটো ওষুধ দেব। নাড়ি এখনও বসে যায়নি, মাঝে-মাঝে কেঁপে-কেঁপে উঠছে।”
নিজের ভাগ্যের উপর খুব একটা ভরসা নেই প্রাণপতির। ভাগ্য ভাল বা চলনসই হলেও দর্শনশাস্ত্রে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত প্রাণপতির শেষ পর্যন্ত পুলিশের চাকরি জুটত না। আর মুন্ডু ও ধড়ের বিবাদে নিয়ত দ্বিখণ্ডিত হতে হত না তাকে। তবু প্রাণপতি মিনমিন করে বললেন, “দেখো, কী হয়।”
বক্রেশ্বরের ওষুধের গুণেই হোক কিংবা প্রাণপতির বিরূপ ভাগ্য হঠাৎ সদয় হওয়াতেই হোক, ঘণ্টাখানেক পরে লাশটার নাড়ি চলতে শুরু করল, শ্বাসপ্রশ্বাসও চালু হল। শশধর ডাক্তার এসে লোকটির ক্ষতস্থানে মলম আর পুলটিস লাগাতে লাগাতে দুঃখ করে বললেন, “ছ্যাঃ ছ্যাঃ, আজকাল কী সব পকেটমার হয়েছে বলুন তো, ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়! হ্যাঁ, পকেটমার ছিল বটে আমাদের আমলের কালু বারুই। ইয়া বুকের ছাতি, ইয়া হাতের গুলি। ফুলবাড়ির দারোগা হেরম্ববাবু তো তাকে গাছে বেঁধে আধবেলা বাঁশপেটা করেছিলেন। তারপর তারই সর্বাঙ্গে ব্যথা। কালু তো হেসেই খুন।”
প্রাণপতিবাবু শশধর ডাক্তারের উপর ভরসা রাখেন না। তার মেয়ের আমাশা শশধর এখনও সারাতে পারেননি। তার ওষুধে কারও কিছু সারে বলেও শোনা যায় না। তবু জিজ্ঞেস করলেন, “অবস্থা কেমন দেখছেন ডাক্তারবাবু?”
“বেঁচে যেতেও পারে। মারা যাওয়াও বিচিত্র নয়। সবই ভগবানের হাত, বুঝলেন তো!”
প্রাণপতি বুঝলেন। বুঝতে তার কোনও অসুবিধেই হল না।
নবীন হামাগুড়ি দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ পেরনোর চেষ্টা করছিল। ভারী পিছল সুড়ঙ্গ, তার উপর বেশ চড়াই, কাজটা সহজ নয়। একটু দূরেই অবশ্য সুড়ঙ্গের মুখ দেখা যাচ্ছে। আর পাঁচ-সাতবার হামা টানতে পারলেই পৌঁছে যাবে। আর এখানে পৌঁছে যেতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। নবীন তাই হাঁচোড়-পাঁচোড় করে যত তাড়াতাড়ি
সম্ভব শেষ পথটুকু পেরনোর চেষ্টা করছে। পৌঁছেই গিয়েছে প্রায়। আর একটু…
সুড়ঙ্গের মুখে একটা লোক হামাগুড়ির ভঙ্গিতেই খাপ পেতে বসে তাকে জুলজুল করে দেখছে। মাথায় কঁকড়া চুল, কটা চোখ, তোম্বাপানা মুখ। তার দিকে একখানা হাত বাড়িয়ে বলল, “হাতটা চেপে ধরো হে, টেনে তুলে নিচ্ছি।”
হাঁফাতে হাঁফাতে নবীন খপ করে হাতটা চেপে ধরল। কিন্তু মুশকিল হল, নবীনের পিছন দিকেও একটা টান আছে। লোকটা হেঁইও জোরে টানছে বটে, কিন্তু নবীনকে ঠিক টেনে তুলতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে বলল, “আহা, তোমার কি বেরিয়ে আসার গা নেই নাকি? একটু চাড় মেরে বেরিয়ে আসতে পারছ না?”
নবীন কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “চেষ্টা তো করছি মশাই, কিন্তু কেবল পিছলে নেমে যাচ্ছি যে!”
লোকটা আরও খানিকক্ষণ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, “না হে বাপু, তোমার বেরিয়ে আসার ইচ্ছেটাই নেই। কিন্তু বাপু, ফিরে গিয়ে লাভটা কী বলো তো! সেই তো বিষব্যথার মধ্যে গিয়ে পড়বে। তোমার সর্বাঙ্গে ক’টা কালশিটে জানো? গুনে দেখেছি, দুশো ছাপান্নটা। তিন জায়গায় হাড়ে চিড় ধরেছে। নাক-মুখ-চোখ ফুলে ঢোল, মাথায় দুটো ঢিবি। আর ক্ষতস্থানের তো লেখাজোখা নেই। এক কলসি রক্তপাত হয়েছে, ও শরীরের আর আছেটা কী বলো তো? ফিরে গিয়ে ব্যথা-বেদনায় ককিয়ে মরতে হবে। আর যদি বেঁচেও যাও, ফের গিয়ে ফাঁসিতে লটকাবে। আর যদি ফাঁসি না-ও হয়, তা হলে নগেন পাকড়াশি তোমাকে ছেড়ে কথা কইবে ভেবেছ? এতক্ষণে বোধ হয় দা, কুড়ুল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তাই তোমার ভালর জন্যই বলছি হে, একটা হেস্তনেস্ত করে উঠে এসো তো বাপু।”
“একটু জিরোতে দিন। তারপর ফের চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনি কে?”
“আমি হলুম খগেন দাস, ফস্টারসাহেবের খাজাঞ্চি।”
“ফস্টারসাহেব কে?”
“মস্ত কুঠিয়াল ছিলেন হে। তরোয়াল দিয়ে কত মুন্ডুই যে কেটেছেন!”
“ওরে বাবা!”
“আহা, তোমার ভয় কী? তুমি নাকি ভারী ভাল কবাডি খেলতে পারো?”
একগাল হেসে নবীন বলে, “তা পারি।”
“তবে তো হয়েই গেল। ফস্টারসাহেব কবাডি খেলার পাগল। নাও বাপু, অনেকক্ষণ জিরিয়েছ, এবার হাতটা যেন কষে চেপে ধরো তো! এক ঝটকায় তোমাকে বের করে আনছি!”
তা ধরল নবীন, কষেই ধরল। কিন্তু পিছনের টানটা বড্ড জোর লেগেছে। সে ফের পিছলে নেমে যাচ্ছে নীচে।
খগেন দাস অবশ্য বেশ পালোয়ান লোক। ফের তাকে খানিক টেনে তুলে বলল, “ইচ্ছেশক্তিকে কাজে লাগাও হে, এই অন্তিম মুহূর্তটাই গোলমেলে। চাড় মারো, জোরসে চাড় মারো।”
তা মারছিল নবীন। একটু উপরের দিকে উঠলও যেন! খগেন বলল, “আর শোনোনা, খবরদার ওই ঝাড়ুদারটার সঙ্গে ভাব করতে যেয়ো না যেন! খুব খারাপ লোক।”
অবাক হয়ে নবীন বলে, “কে ঝাড়ুদার? কার কথা বলছেন?”
“ওই যে শীতলসাহেবের গির্জা ঝাঁটায় যে লোকটা, ওর নাম পল। একদম পাত্তা দিয়ো না ওকে। ওর মাথার ব্যামো আছে।”
“যে আজ্ঞে, তাই হবে। কিন্তু আমি যে আর পেরে উঠছি না মশাই, আমার পা ধরে কে যেন বেজায় জোরে টানছে।”
“আহা, সে তত টানবেই। ঝটকা মেরে পা ছাড়িয়ে নাও, তারপর উঠে এসো। শরীরটা ছেড়ে গেলেই দেখবে ফুরফুরে আরাম লাগবে।”
কিন্তু নীচের দিকের টানটাই বড্ড বেশি হয়ে উঠল। খগেন দাসের জোরালো মুঠিও ঠিক সামাল দিতে পারল না। হাতটা হড়কে গিয়ে সুড়ঙ্গ বেয়ে সুড়সুড় করে নীচে নামতে লাগল নবীন। তার পর ঝড়াক করে এক জায়গায় থামল। আর থামতেই মনে হল, চারদিক থেকে যেন হাজারটা ভিমরুল হুল দিচ্ছে তাকে। সর্বাঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথা টনটন করছে, গাঁটে-গাঁটে যন্ত্রণার হাট বসে গিয়েছে, কানে ঝিঁঝি ডাকছে, চোখে অন্ধকার দেখছে সে।
খানিকক্ষণ পর নবীন বুঝতে পারল যে, মরতে মরতেও সে মরেনি। তার হাত-পা অবশ হলেও একটু-আধটু নাড়াচাড়া করতে পারছে। তার গায়ে বোধ হয় খুব জ্বর। বড্ড শীতও করছে তার।
তার মাথাটা তুলে কে যেন তাকে কিছু একটা খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। গরম দুধ নাকি? তাই হবে বোধ হয়। তবে দুধে কেমন একটা স্পিরিট-স্পিরিট গন্ধ।
আবার ঘুমিয়ে পড়ল নবীন। ঘুমনোর আগে আবছা শুনতে পেল, কে যেন কাকে জিজ্ঞেস করছে, “ছেলেটা কি বাঁচবে?”
“বলা যাচ্ছে না। ইনফেকশন না হলে বেঁচে যেতেও পারে।”
“বেঁচেই বা কী লাভ? শুনছি ফাঁসির আসামি।”
ওই ‘ফাঁসির আসামি’ কথাটা কানে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল নবীন। কতক্ষণ পর তার ঘুম ভাঙল, কে জানে। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই তার মনে পড়ল, সে ফাঁসির আসামি।
শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা এখন একটু যেন সহ্যের মধ্যে এসেছে। চোখ দুটো পুরো খুলতে পারছে না বটে, কিন্তু সামান্য একটু ফাঁক করতে পারছে। আবছা চোখে সে গরাদের আভাস দেখতে পেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। পালিয়েও লাভ হল না। এরা আবার ধরে এনেছে তাকে। ফাঁসিতেই ঝোলাবে। ভারী হতাশ হয়ে চোখ বুজল নবীন। খগেন দাস ঠিকই বলেছিল, সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই বোধ হয় ভাল হত।
গরাদের ওপাশে কে একজন যেন এসে দাঁড়িয়েছে।
গরাদের ওপাশে যে লোকটা পঁড়িয়ে আছে, সে লম্বা, রোগা, পরনে লুঙ্গি আর গায়ে কামিজ। বয়স চল্লিশের উপর। গালে রুখু দাড়ি আর গোঁফ। জুলজুল করে তাকে দেখছিল।
নবীন চোখ খুলতে লোকটা উবু হয়ে বসে বলল, “কত কাল লাইনে নেমেছ বাপু?”
নবীন হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “নামিনি তো!”
“নামোনি! কিন্তু পষ্ট যে নিজের চোখে তোমার কাণ্ডটা দেখলুম।”
নবীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখে জলও আসছিল তার। আর যাই হোক, তাদের বংশের কারও চোর বদনাম নেই। নবীনই বোধ হয় প্রথম এই কাজ করে ফেলেছিল। এখন তার বড্ড অনুতাপ হচ্ছে। সেই পাপের জন্য এখন যদি তার ফাঁসিই হয়, সেও ভি আচ্ছা। ফঁসিই হোক।
“ও বাপ! চোখে জল দেখছি! বলি, মরদ মানুষের চোখে জল কেন হে বাপু? কঁচা কাজ করলে তো কেলেঙ্কারি হবেই। হাত পাকিয়ে তবে না কাজে নামতে হয়।”
“আমি চোর নই। হাত পাকানোরও দরকার নেই। আপনি যান।”
লোকটা তার দিকে আরও কিছুক্ষণ জুলজুলে চোখে চেয়ে থেকে বলে, “চোর নও? তবে গায়ে কয়েদির পোশাক কেন?”
“সে অনেক কথা। আমি ফাঁসির আসামি।”
“বাবা। তবে তো শাহেনশা লোক হে। ক’টা খুন করেছ?”
“একটাও না।”
“বটে? তা হলে ফাঁসি হচ্ছে কোন সুবাদে?”
“সে আপনি বুঝবেন না। কপাল খারাপ হলে কত কী হয়! কিন্তু আপনি কে বলুন তো?”
“আমার নাম উদ্ধব খটিক। সেদিন তোমার কাণ্ড দেখে ভেবেছিলুম, সুযোগ পেলে তোমাকে একটু তালিম দেব, কিন্তু এখন দেখছি সবাইকে দিয়ে সব কাজ হওয়ার নয়। চোর, বাটপাড়, খুনে, গুন্ডা-বদমাশ আমি বিস্তর দেখেছি। কিন্তু তোমাকে দেখে কোনওটাই মনে হচ্ছে না। যাক গে, তোমার গায়ের বিষ আগে মরুক, তারপর তোমার ঘটনাটা শোনা যাবে।”
উদ্ধব খটিক চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল।
.
কে যেন জিজ্ঞেস করছিল, “বড়বাবু কি বাড়িতে আছেন? বড়বাবু কি বাড়িতে আছেন?”
প্রাণপতি খাসনবিশ কথাটার অর্থ কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। কে বড়বাবু, কেনই বা তিনি বাড়িতে থাকতে যাবেন, এসব তার কাছে হেঁয়ালি বলেই মনে হচ্ছিল। সামনে কে একটা আবছা মতো দাঁড়িয়েও আছে বটে, কিন্তু সেটা অলীক বা কুহেলিকাও হতে পারে।
কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চমবারও একই প্রশ্ন বারবার হাতুড়ির মতো তাঁর কানে এসে পড়ায় হঠাৎ তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। তাই তো! প্রশ্নটা তো তাকেই করা হচ্ছে বটে! এবং তিনিই তো অষ্টপুর থানার বড়বাবু বটে!
তিনি শশব্যস্তে সোজা সটান হয়ে বসে চারদিকটা ভাল করে
দেখে নিয়ে বললেন, “না না, আমি এখন বাড়িতে নেই তো! আমি
তো থানায় বসে আছি বলেই মনে হচ্ছে।”
সামনের চেয়ারে বসা একটা লোক হেসে বলল, “যে আজ্ঞে, আপনি থানাতেই বসে আছেন। আপনি নিজের মধ্যে আছেন কি না, সেটাই জানতে চাইছিলাম।”
লোকটা অবনী ঘোষাল, শ্রীনিবাস আচার্যির ছোট জামাই এবং এই লোকটাই যত নষ্টের গোড়া। পলু পাকড়াশিকে গণধোলাই দেওয়ানোর মূলে ছিল এরই প্ররোচনা। আর তার ফলেই খুনের আসামিটাকে নিয়ে প্রাণপতিকে ঝামেলা পোয়াতে হচ্ছে। এই মরে কি সেই মরে।
মুখে খাতির দেখিয়ে প্রাণপতি বললেন, “অবনীবাবু যে, বসুন, বসুন।”
অবনী গম্ভীর মুখে বলে, “আমি তো বসেই আছি।”
“ওঃ, তাই তো! হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন?”
“এখনও বলিনি। তবে বলতেই আসা। আপনি কি জানেন, সরকার বাহাদুর ওই মারাত্মক খুনি আর ফেরারি আসামিকে ধরার জন্য কোনও পুরস্কার ঘোষণা করেছে কি না।”
“আজ্ঞে না, এখনও ঘোষণা হয়নি।”
“হবে বলে কি মনে হয়?”
“তা হতেও পারে।”
“তা হলে পুরস্কারটা কিন্তু আমারই পাওনা। আপনি আমার কথা কি উপর মহলে জানিয়েছেন?”
“আমাদের এফ আই আর-এ স্পষ্ট করেই সব লেখা আছে অবনীবাবু। মিস্টার অবনী ঘোষাল, দি সন-ইন-ল অফ শ্রীনিবাস আচার্য, অ্যাপ্রিহেন্ডেড দি কালপ্রিট পল্টু পাকড়াশি অলমোস্ট সিঙ্গল হ্যান্ডেডলি অ্যান্ড বাই হিজ ওন এফোর্ট। বাট দি আইরেট অ্যান্ড আনরুলি ক্রাউড ম্যালহ্যান্ডলড দি কালপ্রিট ভেরি ব্যাডলি।”
“বাঃ, বেশ লিখেছেন মশাই। কিন্তু পুরস্কারটা ঘোষণা হচ্ছে না কেন বলুন তো! আমি তো ঠিক করে রেখেছি, টাকাটা পেলেই একখানা ভাল দেখে মোটরবাইক কিনে ফেলব।”
“সে আর বেশি কথা কী। তবে কিনা সরকার বাহাদুর পুরস্কার যদি দেয়, তা হলে জ্যান্ত পল্টু পাকড়াশির জন্য দেবে। কিন্তু ছোঁকরার যা অবস্থা, তাতে বাঁচলে হয়।”
“সর্বনাশ! বাঁচবে না মানে? না বাঁচলে ছাড়ব নাকি? আপনি ওর ভাল রকম চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। দরকার হলে আমি চিকিৎসার খরচ দেব। ফল, মাছ, দুধ, ভিটামিন সব দিন। এই হাজারখানেক টাকা রেখে যাচ্ছি। কোনও অযত্ন না হয় দেখবেন।”
“যে আজ্ঞে। আপনার মনটা বড্ড নরম।”