৩. পেটে কিছু পড়লেই

পেটে কিছু পড়লেই বিষ্ণুরাম দারোগার ঘুম পায়। মোটাসোটা মানুষ, খোরাকটাও একটু বেশিই। তা বলে বিষ্ণুরামকে কেউ অলস ভাবলে ভুল করবে। বছরতিনেক আগে যখন এখানে প্রথম এল, তখন এসেই ট্র্যাড়া পিটিয়ে পাঁচ গাঁয়ের লোককে জড়ো করে একটা বক্তৃতা দিয়েছিল। সেই অগ্নিবর্ষী বক্তৃতায় বলেছিল, “ভাইসব, এলাকার শান্তি যেন বজায় থাকে। আমি জানি, চোর ভারতবাসী, ডাকাত ভারতবাসী, খুনি ভারতবাসী, জোচ্চোর এবং ঘুষখোর ভারতবাসী আমার ভাই। তাদের ধমনীতে যে রক্ত বইছে, আমার ধমনীতেও সেই রক্তই বইছে। তাদের শরীরের এক ফোঁটা রক্তপাত হলে সেটা হবে আমারই রক্তপাত। তাদের দণ্ডদান করা মানে আমাকেই দণ্ডদান করা। তাই কবি বলেছেন, দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতাও যখন কাঁদেন তখন সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। সুতরাং কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও বলতে চাই, আজ থেকে যেন ময়নাগড় এবং আশপাশের অঞ্চলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। তাই আমি বলি, এসো চোরগণ, শুচি করি মন, ধরো ডাকাতের হাত, মোর অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, অকারণে কেউ পোড়ো না কো ধরা, সবার হরষে হরষিত মোরা দুঃখ কী রে?

“আমি তাদের কবির অমোঘ বাণী স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট, রক্তজমাট শিকলপূজার পাষাণবেদী। আমি জানি অনেকেই পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে আমাকে প্রশ্ন করবেন, এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি তাদের বলব, তোমার মিলন লাগি আমি আসছি কবে থেকে। বাউলের গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে আজ আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আমি আইলাম রে, খাটাইশ্যা বৈরাগী, রূপে গুণে ষোলো আনা ওজনে ভারী। আমি জানি এই হানাহানি, কানাকানি এবং টানাটানির যুগে শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস। তবু ভাইসব, শত্রুপক্ষ আচমকা যদি ছোঁড়ে কামান, বলব বৎস, সভ্যতা যেন থাকে বজায়, চোখ বুজে কোনও কোকিলের দিকে ফেরাব কান। বিশদ করে বলতে গেলে বলতে হয়, ধরুন দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া, হঠাৎ শুনলেন রাতের কড়া নাড়া। হেঁড়ে গলায় কেউ ডেকে উঠল, অবনী বাড়ি আছ? খবর্দার জবাব দেবেন না কিন্তু, দরজাও খুলবেন না। তবে যদি সে নিতান্তই দরজা ভেঙে টেঙে ফেলে তা হলে চটবেন না। হেসে বলবেন, ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারই হউক জয়।”

বক্তৃতা শুনে ভয় খেয়ে পঁচাশি বছরের নন্দকিশোর নব্বই বছর বয়সী কৃষ্ণকিশোরকে বললেন, “এ তো দেখছি একটা চোরডাকাতের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠল!”

কৃষ্ণকিশোর কানে শোনেন না। একগাল হেসে বললেন, “তাই নাকি? আমি তো আগেই বলেছিলুম, এই দারোগা গাঁয়ে পা দেওয়ার পরই আমার বাঁ চোখ নাচছে। অতি শুভ লক্ষণ, বাঁ হাঁটুর ব্যথাটাও তেমন টের পাচ্ছি না। হপ্তাখানেক আগে আমার দুধেল গাই নন্দরানি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। গতকাল নন্দরানি দিব্যি গুটিগুটি ফিরে এসেছে। চারদিকেই শুভ লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। আর বক্তৃতাটাও কেমন বলো! সেই উনিশশো তেইশে গাঁধীজির বক্তৃতা শুনেছিলুম, আর এই শুনলুম, কী তেজ, কী বীরত্ব, কী বলব রে ভাই, বক্তৃতার হলকায় তো কানে আঙুল দিতে হয়।”

দিনতিনেক বাদে গোবিন্দলাল থানায় গিয়েছিল ঘটি চুরির নালিশ জানাতে।

বিষ্ণুরাম হাসিহাসি মুখ করে বলল, “মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ কী জানো?”

“আজ্ঞে! জানি, তবে ঠিক স্মরণ হচ্ছে না।”

“মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ হল ক্ষমা। সারাদিন যত পারো ক্ষমা করে যাও। যাকে সুমুখে পাবে তাকেই ক্ষমা করে দেবে।”

“যে আজ্ঞে, সে না হয় করলুম, কিন্তু এই ঘটিচুরির বৃত্তান্তটা একটু শুনুন।”

“যিশু খ্রিষ্ট কী বলেছিলেন?”

“আজ্ঞে, জানতুম, তবে এখন ঠিক স্মরণ হচ্ছে না। ইংরিজিতে বলতেন তো!”

“যিশু বলেছিলেন, কেউ তোমাকে এক গালে চড় মারলে আর এক গাল এগিয়ে দাও। সে গালেও যদি চড় মারে তবে ফের আগের গালটা এগিয়ে দাও। যদি সে গালেও মারে তবে ফের দ্বিতীয় গাল এগিয়ে দাও। সেও চড় মেরে যাবে তুমিও গালের পর গাল এগিয়ে দিতে থাকবে। এইভাবে মারতে মারতে আর কত পারবে সেই চড়বাজ! দেখবে সে একটা সময়ে চড় মারতে মারতে হেদিয়ে পড়ে মাটিতে বসে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাচ্ছে। বুঝলে?”

“আজ্ঞে, জলের মতো। তবে কিনা ঘটিচোর আমাকে চড় মারেনি, তাকে জাপটে ধরেছিলুম বলে সে আমাকে কামড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।”

“একটা টেট ভ্যাক ইনজেকশন নিয়ে নাও। আর ঘটিচোর তোমার একটা ঘটি নিয়ে গেছে, তাতে কী? তাকে পেলে আর একটা ঘটি দিও। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কী বলেছেন?”

“আজ্ঞে, ঠিক স্মরণ হচ্ছে না।”

“শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, নমো হে নমো, ক্ষমো হে ক্ষমো, পিত্তরসে চিত্ত মম… আর কী সব আছে যেন। মোট কথা মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ হল, ক্ষমা। মনে থাকবে তো!”

“আজ্ঞে, মৃত্যুর দিন অবধি মনে থাকবে। ঘটিচুরির শোক কি সহজে ভোলা যায়! যতবার ঘটিচুরির কথা মনে পড়বে ততবার আপনার কথাও মনে পড়বে।”

গত দশবছর ধরে বিষ্ণুরাম চারদিকে ক্ষমার গঙ্গাজল ছিটিয়ে ছিটিয়ে জায়গাটাকে একেবারে জব্দ করে রেখেছে। থানায় বড় কেউ একটা নালিশ করতে আসে না। চোরছ্যাচড়-ডাকাতরা বিষ্ণুরামকে খুবই শ্রদ্ধাভক্তি করে। কাজকর্ম তেমন না থাকায় বিষ্ণুরাম আর তার সেপাইরা যে যার চেয়ার বা টুলে বসে দিবানিদ্রাটি সেরে নিতে পারে।

আজ বিষ্ণুরামের বউ সকালে ঢাকাই পরোটা আর মাংসের ঘুঘনি করেছিল। সুতরাং সকালে গুরুতর জলযোগের পর বিষ্ণুরাম থানায় এসে নিজের চেয়ারটিতে বসে ঢুলছে। কোমরের পিস্তল সমেত বেল্টটি খুলে টেবিলের ওপর রাখা। গুরুভোজনের পর বিষ্ণুরাম কোনও দিনই কোমরে বেল্ট পরা পছন্দ করে না।

একটু বেলার দিকে রোগামতো একটা ক্যাকলাস চেহারার লোক ভারী সন্তর্পণে নিঃশব্দে থানায় ঢুকল। পরনে পাজামা, গায়ে একখানা সবুজ কুর্তা, মাথায় জরি বসানো একটা পুরনো কাশ্মীরি টুপি। থুতনিতে একটু ছাগুলে দাড়ি আছে, চিনেদের মতো গোঁফজোড়া দু’দিকে ঝুল খেয়ে আছে। মুখে একখানা হাসি, বড় বড় দাঁতে পানের ছোপ।

বিষ্ণুরামের ঘরে ঢুকে সে একটা গলা খাঁকারি দিয়ে ভারী বিগলিত মুখে বলল, “বড়বাবু কি চোখ বুজে আছেন?”

বিষ্ণুরাম ঘুমের মধ্যেই জবাব দিল, “আছি।”

“বুজেই কি থাকবেন?”

“থাকব।”

“হেঃ হেঃ, আপনি যে বোজা চোখেও সব দেখতে পান তা কে

জানে! শুধু দেখা! দু খানা করে চোখ তো আমাদেরও আছে, কিন্তু কতটুকুই বা দেখি আমরা! গোরুকে মোষ দেখছি, মেয়েছেলেকে ব্যাটাছেলে দেখছি। কালোকে সাদা দেখছি। পূর্ণিমাকে অমাবস্যা দেখছি, পিসেকে জ্যাঠা দেখছি, সাপকে বেজি দেখছি। চোখ থেকেও নেই। আর লোকে বলে, বিষ্ণু দারোগাকে দেখে মনে হয় বটে যে, ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু তার দু খানা চোখ হাটে মাঠে ঘাটে ঠিক ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই তো সে দিন মদন সরখেল বলছিল, গোরু বেচে টাকে টাকা নিয়ে ফেরার সময় মাঝরাত্তিরে পালঘাটের শ্মশানের কাছে বটতলায় অন্ধকারে দু’খানা জ্বলন্ত চোখকে ঘুরে ঘুরে চারদিকে নজর রাখতে দেখেছে। বলছিল টাকে গোরু বিক্রির টাকা ছিল বলে ভয়ে ভয়ে আসছিলুম বটে, বিষ্ণু দারোগার চোখ দুটো দেখেই ভয় কেটে গেল। মনে হল আর কীসের ভয়! বিষ্ণু দারোগার জয়।”

“বলে নাকি?”

“তা বলবে না? দিনু কুণ্ডুও তো বলল, ভাই, বাড়িতে জামাই এসেছে বলে রোজকার মতোই গিন্নীর নথ বন্ধক রেখে বাজারে গিয়ে একটা ইলিশ মাছ আশি টাকা দিয়ে কিনে এক হাতে আনাজপাতি অন্য হাতে মাছের থলে নিয়ে ফিরছি। ফেরার পথে শীতলার থানে পেন্নাম করব বলে মাছের থলিটা বাইরের রকে রেখে জুতো ছেড়ে মন্দিরে ঢুকেছি। এমন সময়ে ন্যাড়া পোদ্দারের সঙ্গে দেখা। পোদ্দারের পো এমনিতেই বেশি কথা কয়। সেদিন আবার তার পিসশ্বশুরের বাতব্যাধির কথা পেড়ে ফেলায় কিছুতেই ছাড়াতে পারি না। যাই হোক ওইসব কথাবার্তার ফাঁকেই মাছের কথা বেবাক ভুলে বাড়ি আসতেই গিন্নি যখন চিল-চেঁচানি চেঁচিয়ে উঠল, ওকী গো, জামাই এয়েছে বলে মাছ আনতে পাঠালুম নথ বাঁধা দিয়ে, আর তুমি খালি হাতে ফিরে এলে যে বড়! তখন খেয়াল হল, তাই তো, মাছটা তো শীতলা মন্দিরের বাইরের রকে ফেলে এসেছি! চটকা ভাঙতেই ছুট, ছুট! গিয়ে কী দেখলুম জানো? বললে বিশ্বাস হবে না, যেমনকে তেমন থলিবন্দি হয়ে পড়ে আছে, গাঁয়ে আঁচড়টুকু লাগেনি। কুকুর-বেড়াল বা কাক পক্ষী কাছেও ঘেঁষেনি। আর দেখলুম বি দারোগার দুখানা বাঘা চোখ আম গাছটার ওপর বসে মাছটার ওপর নজর রাখছে। যাতে কেউ মাছের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে না পারে।”

নাকের ডাকের মধ্যেই বিষ্ণুরাম অভ্যাসবশে বলে উঠল, “বটে!”

“তবে আর বলছি কী বড়বাবু! চোখ বুজে আছেন বটে, লোকে দেখলে ভাববে ঘুমোচ্ছেন, কিন্তু এলাকার শান্তি বজায় রাখতে আপনি যে দু’চোখের পাতা কখনও এক করেন না সেটা শুধু আমরা কয়েকজন ভুক্তভোগীই জানি।”

“বলে যা।”

বিগলিত হয়ে লোকটা বলল, “আজ্ঞে। বলব বলেই আসা। আপনার চাটা ভাঙলে ধীরেসুস্থে বলা যাবে।”

বিষ্ণুরাম রক্তচক্ষু মেলে চেয়ে ঘড়ি দেখল। বলল, “বারোটা বাজে যে! আমার তো এখন খিদে পাওয়ার কথা।”

“আজ্ঞে, পেয়েছেও। কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকেন, আপনার কি আর নাওয়া-খাওয়ার কথা খেয়াল থাকে? শরীরটা হয়তো এখানে পড়ে আছে, আপনি কি আর হেথায় আছেন! হয়তো শরীরটা ফেলে রেখে আপনি এখন অশরীরে কালীপদর আমবাগান পাহারা দিচ্ছেন। কালীপদর আমবাগানে এবার আমের গুটিও ধরেছে কেঁপে, দুষ্টু ছেলে আর হনুমানের উৎপাতে কালীপদ জেরবার। কিংবা হয়তো সত্যগোপালের বাড়িতে যে-চোরটা ক’দিন আগে ঢুকে দুটো ফুলদানি নিয়ে গিয়েছিল তারই পিছু-পিছু ধাওয়া করে

আলায় বালায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিংবা যে-দুটো সন্দেহজনক লোক ক’দিন হল ময়নাগড়ে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে তাদের খেদিয়ে নিয়ে তেপান্তরের মাঠ পার করে দিচ্ছেন। তাই বলছিলুম, ওই দেহে কি আর খিদেতেষ্টা আছে? আছে শুধু কাজ, শুধু কর্তব্য, শুধু দায়-দায়িত্ব। দারোগা মানে তো ধরুন একরকম দেশের রাজাই।”

বিষ্ণুরাম একটা প্রকাণ্ড হাই তুলে বলল, “দ্যাখ নবু, তোর একটা দোষ কী জানিস? বড্ড বেশি কথা কয়ে ফেলিস। আজই যদি সব কথা বলিস তাহলে কালকের জন্য থাকবে কী?”

নবু ভারী গ্যালগ্যালে হয়ে বলল, “আজ্ঞে আপনার কথা ভাবলেই আমার কেমন বেগ এসে পড়ে। সামলাতে পারি না।”

“দ্যাখ তোর বলা-কওয়া কিছু খারাপও নয়, আর উচিত কথাই বলিস। শুনতে ভালও লাগে। এই যে সেদিন তুই আমার তৃতীয় নয়ন, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, জাগ্রত বিবেক আর ব্যাঘ্র-বিক্রমের কথা বলছিলি সেগুলো হয়তো তেমন মিথ্যেও নয়। তবু ভাবি কী জানিস! ভাবি, সত্যিই কি তাই? নবুটা হয়তো বাড়িয়ে বলছে। অত গুণ থাকলে কি আমি এই অখদ্দে ময়নাগড়ে পড়ে আছি! কবে প্রমোশন পেয়ে ভাল জায়গায় চলে যেতাম।”

চোখ বড় বড় করে ডুকরে উঠে নবু বলল, “আপনি চলে গেলে যে ময়নাগড়ের অবস্থা শচীমাতার মতো হয়ে দাঁড়াবে। কাঁদে ময়নাগড় কোথা বিষ্ণুরাম, প্রতিধ্বনি বলে থাম, থাম, থাম, ময়নাগড়ে আর নাই ঘনশ্যাম। সেদিন পরেশ পালও বলছিল, বিষ্ণু দারোগা চলে গেলে ময়নাগড় জঙ্গলের রাজত্ব হয়ে উঠবে। দিনে-দুপুরে বাঘ ডাকবে, গণ্ডায় গণ্ডায় গণ্ডার রাস্তায় ঘাটে ঘুরে

বেড়াবে, হাতির পাল ঢুকে পড়বে ঘরেদোরে।”

“বলে নাকি?”

“তা বলবে না? তখন ঘরে ঘরে অরন্ধন হবে, মেয়েরা চুল বাঁধবে না, ছেলেরা টেরি কাটতে ভুলে যাবে, জটাধারী বোষ্টম ন্যাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াবে। অশোকবনে সীতার মতো অবস্থা হবে ময়নাগড়ের।”

বিষ্ণুরাম ফোঁস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সরকার বাহাদুর কি আর চিরকাল আমাকে এখানে রাখবে রে? চারদিক থেকেই যে ডাক আসছে। উত্তরমেরু মোরে ডাকে ভাই, দক্ষিণমেরু টানে। তা সেসব কথা থাক। বলি চারদিককার খবরটবর আনলি কিছু?”

একগাল হেসে ঘাড়টাড় চুলকে নবু বলে, “আজ্ঞে, খবর তো মেলা। ননীগোপালবাবুর ছাগল হারিয়েছে, বিন্ধ্যবাসিনী দেবী বেলপানা খেতে গিয়ে তার বাঁধানো দাঁত গিলে ফেলেছেন, মদন সাঁপুই কাঁঠাল পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে, গণেশ তফাদার কেলো মণ্ডলকে হনুমান বলায় কেলো মণ্ডল তাকে জাম্বুবান বলেছে এবং দু’জনে হাতাহাতি লেগে যাওয়ায় গণেশের তিন ছেলের সঙ্গে কেলোর পাঁচ ছেলের মারপিট হয়েছে। চুরি ছিচকেমির কয়েকটা ঘটনা আছে বটে, কিন্তু সেগুলো আপনার পাতে দেওয়ার যুগ্যি নয়। আর নয়নপুর ঘোষবাড়ি, কালিরহাটে নরেন দাসের বাড়ি, পঞ্চাননতলায় গিরিন পোদ্দারের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। তবে ওসব আপনার গায়ে মাখবার দরকার নেই। ঘোষ, দাস আর পোদ্দারেরা আপনার কথামতো ডাকাতদের ক্ষমাঘেন্না করেও দিয়েছে। তবে কিনা বড়বাবু, দুটো সন্দেহজনক লোক বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটার তো ঘটোৎকচের মতো চেহারা, অন্যটা কাপ্তেনের মতো।”

“তারা কারা?”

“বলছে কোনও রাজবাড়ির লোক। কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না। তারা চোরাই জিনিস খুঁজছে।”

বিষ্ণুরাম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, “তা খুঁজছে খুঁজুক না। তাদের ঘাঁটানোর দরকারটা কী? ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে শেষে থানায় এসে আবদার করবে চোরাই জিনিস খুঁজে দিতে। শান্তিতে কি থাকার জো আছে রে? মানুষের যেন আর নালিশের শেষ নেই। এই তো সেদিন সুধন্যবাবু নস্যির ডিবে খুঁজে পাচ্ছেন না বলে থানায় এফ আই আর করতে এসেছিলেন।

হাত কচলে নবু বলল, “এ একেবারে ন্যায্য কথা। মাথামোটা লোকগুলোর তো আক্কেল নেই। তারা বোঝেও না যে, বড় দারোগার গুরুতর সব কাজ থাকে। ছোটখাটো ব্যাপারে নজর দেওয়ার তার সময় কোথায়! তবে কিনা বড়বাবু, অভয় দেন তো শ্রীচরণে একটু গুহ্য কথা নিবেদন করি। কয়েকদিন আগে একটা পাগলামতো দাড়ি-গোঁফওয়ালা তোক বাড়ি বাড়ি ঘুরে হরেকরকম চোরাই জিনিস বিক্রি করছিল। সে বলেছিল বটে যে, কোনও রাজবাড়ি থেকে নিলামে কিনে এনেছে, কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করার মতো নয়। ভারী শস্তায় দিচ্ছিল বলে লোকে কিনেও নিচ্ছিল। লোকটা যে পাগল আর গবেট তাতে সন্দেহ নেই। তার কারণ, তিনখানা নাকি সোনার রেকাবি– তা ধরুন পঞ্চাশ ভরি ওজন তো হবেই- মাত্র দেড়শো টাকায়, আর দুখানা হিরের আংটি মাত্র একশো টাকায় আপনার বাড়ির গিন্নিমার কাছেই বেচে গেছে।”

“বলিস কী?”

“আজ্ঞে, তাই তো বলছিলাম, যে লোকদুটো চোরাই জিনিসের সন্ধানে এসেছে তারা যদি গন্ধ পায় তা হলে–”

বিষ্ণুরাম তার মোটা শরীর নিয়েও তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পিস্তলটা খাপ থেকে বের করে বিকট গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “এক্ষুনি লোক দুটোকে ধরে এনে ফাটকে পোরা দরকার, এক্ষুনি! ওরে কে কোথায় আছিস–”

নবু বিচলিত না হয়ে ঠাণ্ডা গলায় ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “হুটপাট করার দরকার নেই বড়বাবু। রেকাবি তিনটে আর আংটি দুটো মা ঠাকরোন খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছেন, কাকপক্ষীতেও জানে না।”

উত্তেজিত বিষ্ণুরাম বলল, “তা হলে তুই জানলি কী করে?”

নবু একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, আমি যে ইনফরমার, না জানলে কি আমার পেট চলবে?”

বিষ্ণুরাম ধপ করে ফের চেয়ারে বসে পড়ল। বড় বড় শ্বাস ফেলে বলল, “সোনার রেকাবি? ঠিক জানিস?”

“গিন্নিমা যে কালোবরণ স্যাঁকরাকে দিয়ে যাচাই করেছেন।”

“তার মানে কালোবরণও জানে! না না, এত জানাজানি তো ভাল কথা নয়।”

“আজ্ঞে, সোনা যাচাই করতে হলে স্যাঁকরা ছাড়া উপায় নেই কিনা।”

উত্তেজিত হয়ে বিষ্ণুরাম বলল, “গিন্নির আক্কেল দেখে বলিহারি যাই! একবার আমাকে বলবে তো! ঘরে অত সোনা, ভালরকম পাহারা বসানো দরকার।”

বিগলিত হয়ে নবু বলে, “আপনার বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর আমাদের যেমন অগাধ আস্থা, গিন্নিমার বোধহয় ততটা নেই। না থেকে একরকম ভালই হয়েছে। বাড়িতে সেপাইসান্ত্রি বসালে পাঁচজনের সন্দেহ হতে পারে।”

বিষ্ণুরাম ভ্রুকুটিকুটিল চোখে নবর দিকে চেয়ে বলল, “কথাটা পাঁচকান করার দরকার নেই।”

“কোন কথাটা আজ্ঞে?”

“ওই যে, আমার ওপর যে গিন্নির আস্থা নেই। ওসব কথা চাউর হলে লোকে কি আর আমাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করবে?”

“কী যে বলেন বড়বাবু, কথাটা তো আমি ভুলেই গেছি।”

“লোক দুটো এখন কোথায়?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নবুবলল, “তাদের বড় দুঃসাহস বড়বাবু।” বিষ্ণুরাম চোখ পাকিয়ে বলে, “দুঃসাহস! কেন, আমি কি মরে গেছি নাকি রে!”

মুগ্ধ চোখে দারোগা বিষ্ণুরামের দিকে চেয়ে নবু গদ গদ হয়ে বলে, “সেই পোজ, সেই পশ্চার, সেই গলা! আহা, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!”

“কে? কার কথা কইছিস!”

“আজ্ঞে, টিপু সুলতানের কথাই বলছি। গেলবার শীতলা মন্দিরের পাশের মাঠটায় টিপু সুলতান পালা নেমেছিল। জয় হনুমান অপেরা। নটসিংহ মহেন্দ্র বরাট টিপুসুলতানের ভূমিকায়। কী তেজ, কী গলা, কী দাপট। সেই দেখেছিলাম, আর এই আজ দেখছি। কোথায় লাগে মহেন্দ্র বরাট!”

উত্তেজিত হয়ে বিষ্ণুরাম বলে, “তারা এসে পড়লে কি আর সোনাদানা কিছু ঘরে থাকবে রে! সব যে চেঁছেচুছে নিয়ে যাবে?”

“কোন আইনে?”

“আইন! আইনের কথা উঠছে কেন?”

নবু বিজ্ঞের মতো একটু হেসে বলল, “দেশে কি আইন নেই বড়বাবু? আইনের মাথায় নৈবেদ্যের ওপর কাঠালি কলার মতো আপনিও তো আছেন! তারা এসে হাত পেতে দাঁড়ালেই তো হবে না। রেকাবি আর আংটি যে গিন্নিমার হেফাজতে আছে এটা কারও জানার কথা নয়। আর থাকলেই বা কী? ওটা গিন্নিমার পৈতৃক সম্পত্তি যে নয় তার প্রমাণ কী? মালটা যে চুরি গিয়েছিল তারই বা সাক্ষী কোথায়? আপনি গ্যাঁট হয়ে বসে থাকুন তো।”

নবু কথা শেষ করার আগেই নরেন্দ্রনারায়ণ ঘরে ঢুকল, পিছনে সেই বিশাল চেহারার লোকটা।

নরেন্দ্রনারায়ণকে দেখেই বিষ্ণুরাম হঠাৎ ফের দাঁড়িয়ে বিকট গলায় চেঁচাতে লাগল। “কে তোরা! অ্যাঁ! কে তোরা! থানায় ঢুকেছিস যে বড়, সাহস তো কম নয়! অ্যাঁ! কী চাই? কী চাই? কী মতলব? অ্যাঁ?”

বিষ্ণুরামের চেঁচামেচিতে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল নরেন্দ্রনারায়ণ। একটু অবাক হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আমরা একটু খোঁজখবর করতে এসেছি।”

বিষ্ণুরাম রিভলভার উঁচিয়ে বিকট গলায় বলে, “কীসের খোঁজ খবর, অ্যাঁ! কীসের খোঁজখবর? সোনার রেকাবি চাই? নাকি হিরের আংটি চাই? অ্যাঁ! মামাবাড়ির আবদার! ওসব এখানে নেই, বুঝলে! নেই! এখন বিদেয় হও তো দেখি! নইলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব, এই বলে রাখলাম!”

নরেন্দ্রনারায়ণ আর তার সঙ্গী একটু মুখ-তাকাতাকি করে নিল। তারপর নরেন্দ্রনারায়ণ মুচকি একটু হেসে বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। এখানে নেই তো কী হয়েছে? অন্য কোথাও আছে হয়তো।”

বিষ্ণুরামের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখ লালবর্ণ ধারণ করল, সে গর্জন করতে গিয়ে দেখল গলা ফেঁসে ফ্যাঁস ফ্যাঁসে আওয়াজ বেরোচ্ছে। সে সেই গলাতেই বলল, “ভেবেছ আমার গিন্নির কাছে আছে? অ্যাঁ! আমার গিন্নির কাছে আছে? খবর্দার ওসব ভুলেও মনে এনো না। তা হলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। আমার গিন্নি মোটেই তিনটে সোনার রেকাবি দেড়শো টাকা দিয়ে কেনেনি, মোটেই একশো টাকা দিয়ে এক জোড়া হিরের আংটি কেনেনি। কী রে নবু, কিনেছে? বল না হেঁকে।”

নবু হাত কচলে বলল, “কী যে বলেন! গিন্নিমা কোত্থেকে কিনবেন? উনি তো তখন বাপের বাড়িতে।”

বিষ্ণুরাম রিভলভার আপসাতে আপসাতে বলল, “শুনলে তো! ওসব জিনিস এখানে নেই। এবার তোমরা বিদেয় হও। ফের কোনওদিন থানার ত্রিসীমানায় দেখলে গুলি চালিয়ে দেব। বুঝলে?”

নরেন্দ্রনারায়ণ ঘাড় কাত করে বলল, “আজ্ঞে, বুঝেছি। কিন্তু জিনিসগুলো গেল কোথায় বলুন তো দারোগাবাবু! তিন তিনটে সোনার রেকাবি-র ওজন–”

বিষ্ণুরাম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “পঞ্চাশ ভরি, বলবে তো! ওসব চালাকি আমি জানি। হুঁ হুঁ বাবা, ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দ্যাখোনি। যতই চালাকি করে পেট থেকে কথা বের করার চেষ্টা করো না কেন, লাভ কিছু হবে না। তোমাদের মতো বদমাশ চরিয়েই আমি খাই। এখন মানে মানে বিদেয় হও।”

নরেন্দ্রনারায়ণ স্মিতহাস্য করে বলল, “আচ্ছা না হয় পঞ্চাশ ভরিই হল, তাতেই বা কী যায় আসে বলুন!”

বিষ্ণুরাম অগ্নিশর্মা হয়ে বলে, “সন্দেহ করছ বুঝি! ভেবেছ, কালোবরণ স্যাঁকরা মিথ্যে কথা বলে গেছে? দারোগার বাড়িতে এসে মিছে কথা কইবে, তার ঘাড়ে কটা মাথা? কথার প্যাঁচে ফেলে রেকাবির ওজন জেনে যাবে সেটি হবে না। বুঝলে!”

“আজ্ঞে, বুঝলাম।”

“কী বুঝলে?”

“বুঝলাম যে, আপনার গিন্নি মোটেই পঞ্চাশ ভরির তিনটে সোনার রেকাবি আর দুটো হিরের আংটি মোট আড়াইশো টাকায় কেনেননি। তিনি তখন বাপের বাড়িতে ছিলেন, আর কালোবরণ স্যাঁকরা মোটেই রেকাবির ওজন কমিয়ে বা বাড়িয়ে বলেনি। ঠিক তো?”

বিষ্ণুরাম রিভলভারটা ফের খাপে ভরে বলল, “হ্যাঁ। কথাটা মনে থাকে যেন! আমি ভাল থাকলে গঙ্গাজল, রাগলে মুচির কুকুর, বুঝেছ?”

 “সে আর বুঝিনি! খুব বুঝেছি। তবে কী জানেন দারোগাবাবু, কেতুগড়ের রাজবাড়ি থেকে জিনিসগুলো যে সরিয়েছে সে সাধারণ চোর নয়। কোনও সিন্দুক বা লোহার আলমারিই তার কাছে কিছু নয়। তাই বলছিলাম, একটু সাবধান থাকবেন।”

“তার মানে?”

“আমাদের কাছে খবর আছে এদিক পানেই এসেছে চোর মশাই। অমন চোর লাখে একটা জন্মায়। আপনাকে একটু সাবধান করতেই আসা। আচ্ছা চলি। নমস্কার।”

লোকদুটো বিদেয় হওয়ার পর বিষ্ণুরাম ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে ফের রুমালে কপালের ঘাম মুছে বলে, “জোর বাঁচা গেছে। দেখলি তো নবু, লোকটাকে কেমন বোকা বানিয়ে ছাড়লাম। এসেছিল পেটের কথা টেনে বের করতে। কেমন ঘোলটা খাওয়ালাম বল।”

নবু বড় বড় দাঁত বের করে খুব হেসেটেসে বিগলিত হয়ে বলল, “তা আর দেখিনি! চোখের সামনে যেন আলিবাবা নাটক দেখছিলাম। একেবারে চিচিং ফাঁক। রেকাবি, আংটি আর আপনার আক্কেল সব যেন দাঁত কেলিয়ে বেরিয়ে পড়ল।“

বিষ্ণুরাম একগাল হেসে বলে, “তবেই বল।”

নবু মাথা নেড়ে বলল, “ওঃ, বুদ্ধিও বটে আপনার। যা কস্মিনকালেও বলার নয় তাও কেমন গড়গড় করে বলে দিলেন। থলি থেকে যেন ম্যাও বেরোল। লোকে কি আর সাধে আপনাকে অকাল কুম্মাণ্ড বলে!”

বিষ্ণুরাম গর্জন করে উঠে বলে, “কার এত সাহস! কার এত বুকের পাটা?”

ভারী বিনয়ের সঙ্গে নবু বলল, “আদর করেই বলে, ভালবেসেই বলে। কুমড়ো কি আর খারাপ জিনিস বড়বাবু? ঘাট বলুন, চচ্চড়ি বলুন, ছোলা দিয়ে ছক্কা বলুন, পোড়ের ভাজা বলুন-কোনটা কুমড়ো ছাড়া চলে? এক ফোঁটা সর্ষের তেল আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে কুমড়ো সেদ্ধ খেয়ে দেখুন, অমৃত। ঘরে ঘরে কুমড়োর আদর।”

বিষ্ণুরাম স্তিমিত হয়ে বলল, “সত্যি বলছিস যে, আদর করে বলে।”

“আদর মানে! তারা তো আদরের চাঁদরে মুড়ে রেখেছে। আপনাকে। আদর করে তারা যে আপনাকে গোবর গণেশ, সাক্ষীগোপাল, অকালঘেঁড়েও বলে সে তো আর এমনি এমনি নয়। গুণের কদর করে বলেই বলে।”

“তুই কি বলতে চাস ওগুলোও ভাল ভাল কথা?”

“তা নয় তো কী! গোবর অতি পবিত্র জিনিস, সকাল বিকেল গোবর ছড়া না দিলে ঘরদোর শুদ্ধ হয় না। না হয় বাড়ির গিন্নিমাকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন আর গণেশবাবার কথা কী আর বলব, সিদ্ধিদাতা স্বয়ং। তারপর ধরুন সাক্ষীগোপাল। কত বড় জাগ্রত দেবতা বলুন, এক জায়গায় বসে বসে গোটা দুনিয়ার লাগাম কষছেন। আর অকালঘেঁড়ে? তাও ধরতে গেলে একটা ভাল কথাই। মানেটা আমার জানা নেই বটে, কিন্তু লোকে যখন আদর করে বলছে তখন খারাপ কিছু হবে না।”

“তুই যখন বলছিস তখন না হয় মেনে নিচ্ছি। কিন্তু কথাগুলোকে আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।”

.

গত সাত দিন ধরে বাঁশিটা নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে বটেশ্বর। কিন্তু ব্যাদড়া বাঁশি আজ অবধি একটা পোঁ শব্দ অবধি ছাড়েনি। বটেশ্বর যতবার ফুঁ দেয় ততবারই খানিক বাতাস দীর্ঘশ্বাসের শব্দ তুলে বেরিয়ে যায়। ভাগ্যিস রাতের দিকটায় দিঘির পাড়ে লোকজন থাকে না, তাই রক্ষে। নইলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি হত।

আজও বাঁশি নিয়ে এসে ঘাটের পৈঠায় অন্ধকারে বসে আছে বটেশ্বর। চারদিকে অন্ধকার, তার মনে অন্ধকার, বাঁশিতে অন্ধকার। থোকা থোকা জোনাকি পোকা যেন অন্ধকারকে আরও নিরেট করে তুলেছে। ঘণ্টা খানেক বাঁশিতে আওয়াজ তোলার চেষ্টা করে এখন দমসম হয়ে পড়েছে সে।

পরশুদিন সে বাঁশি নিয়ে দুপুরবেলায় গোবিন্দপুরে ইরফান গাজির কাছে চুপিচুপি গিয়ে হাজির হয়েছিল। এই তল্লাটে ইরফানের মতো ওস্তাদ বাঁশুরিয়া আর নেই। তবে বুড়ো ভয়ংকর খিটখিটে আর বদমেজাজি। কেউ নাড়া বাঁধতে গেলে হাতের কাছে বদনা, গাডু, লাঠি যা পায় তাই নিয়ে তাড়া করে আর চেঁচায়, “বেরো! বেরো সুমুখ থেকে! দূর হয়ে যা বেসুরোর দল! পেটে সুরের স নেই, আম্বা আছে!” ভয়ের চোটে সাহস করে কেউ তার কাছে বড় একটা ঘেঁষে না। তবু প্রাণ হাতে করে বটেশ্বর গিয়েছিল। এই বাঁশিটা তাকে এমন হিপনোটাইজ করেছে যে, এখন সে সব কষ্ট স্বীকার করতে রাজি।

ইরফান গাজির চাকর বদরুদ্দিন আসলে চাকর নয়। সে বড়লোকের ছেলে। ইরফানের কাছে বাঁশি শিখবে বলে চাকর সেজে কাজে ঢুকেছে। ভোরবেলা যখন ইরফান রেওয়াজ করে তখন সে আড়াল থেকে যা পারে শিখে নেয়।

বদরুদ্দিনের কাছেই বটেশ্বর শুনেছে, ইরফানের মিষ্টি খাওয়া বারণ। ডাক্তার বলেছে, ইরফানের পক্ষে মিষ্টি বিষতুল্য। কিন্তু ওই মিষ্টিতেই ইরফান কাত। রসগোল্লা দেখলে তার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। বাড়ির লোকের সঙ্গে তার এই নিয়ে রোজ কাজিয়া হয়। অবশেষে বড় নাতনির শাসনে এখন ইরফান মিষ্টি খাওয়া ছেড়েছে। তবে নাতনির চোখের আড়ালে আবডালে লুকিয়েছাপিয়ে এক-আধটা খেয়ে ফেলে। বদরুদ্দিন বটেশ্বরকে বলল, “তুই দুপুরের দিকে যাস, ওই সময়ে মেহেরুন্নেসা ইস্কুলে থাকে।”

ময়নাগড়ের বিখ্যাত ময়রা রামগোপাল ঘোষের এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে গিয়েছিল বটেশ্বর। বাঁশিটা পিছনে মালকোচার সঙ্গে খুঁজে নিয়েছিল। গিয়ে বাইরে থেকে “গাজিসাহেব! গাজিসাহেব!” বলে ডাকাডাকি করতেই ইরফান বেরিয়ে এল। সাদাদাড়িতে মেহেন্দির রং, পরনে সাদা লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। চেহারাটা রোগা হলেও পোক্ত, চোখে শ্যেন দৃষ্টি। হেঁড়ে গলায় বলল, “কী চাই?”

“আজ্ঞে, এই একটু রসগোল্লা এনেছিলুম।”

ইরফানের রোখা ভাবটা একটু নরম হল, তবু তেজের গলায় বলল, “কে তুই? কী মতলব?”

“আজ্ঞে, আপনি গুণী মানুষ, তাই–”

“আমার গুণের তুই কী বুঝিস?”

তটস্থ বটেশ্বর বলে, “আমরা মুখ মানুষ, কী বুঝব! লোকে বলে, তাই শুনেই জানি।”

“আমার যে রসগোল্লা খাওয়া বারণ তা জানিস না?”

একগাল হেসে বটেশ্বর বলল, “রসগোল্লা খাওয়া বারণ হবে কেন? আপনার তো মিষ্টি খাওয়া বারণ! তাই তো আমি রামগোপাল ঘোষের বিখ্যাত নোতা রসগোল্লা অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছি। এতে মিষ্টির ম-টাও পাবেন না।”

ইরফান ঘোড়েল লোক। ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে গলা তুলে বাড়ির লোক যাতে শুনতে পায় এমনভাবে বলল, “ও তাই বল। রামগোপালের সেই বিখ্যাত নমকিন রসগোল্লা তো! তা নিয়ে আয় তো, দেখি কেমন বানায়। খুব নাম শুনেছি বটে, এখনও চেখে দেখা হয়নি।”

চালাকিটা অবশ্য খাটল না। বাড়ির লোকেরা মোনতা রসগোল্লায় তেমন বিশ্বাসী নয়। তাই রসগোল্লার হাঁড়ি কেড়ে নিয়ে গেল।

ততক্ষণে অবশ্য ইরফান গোটাতিনেক টপাটপ মেরে দিয়ে বলছিল, “বাঃ বাঃ, নুন দিয়ে জারিয়েছে তো ভাল!”

রসগোল্লা নিয়ে বাড়িতে যে চেঁচামিচিটা হল সেটা একটু স্থিমিত হতেই বাঁশিটা বের করে ইরফানকে দেখাল বটেশ্বর, “ওস্তাদ, এ বাঁশিটায় শব্দ বের হয় না কেন বলবেন? বাঁশিটা কি খারাপ?”

ইরফান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বাঁশিটা দেখে বলল, “এটা কোথায় পেয়েছিস?”

“আজ্ঞে, একটা লোক একশো টাকায় বেচে দিয়ে গেছে।”

ভ্রু কুঁচকে ইরফান বলল, “মোটে একশো? এর দাম তো লাখ টাকারও বেশি।”

“বলেন কী!” ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাঁশিটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “একে রসাভাস, দুইয়ে নিদ্রাপাশ, তিনে সর্বনাশ।”

“তার মানে?”

“যদি ভাল চাস তো ও বাঁশি কখনও বাজাসনে। ও হল মোহন রায়ের বাঁশি। কেতুগড় রাজবাড়ির জিনিস।”

“আপনি কি মোহন রায়কে চিনতেন?”

“তুই কি বুরবক? মোহন রায়ের এন্তেকাল হয়েছে একশো বছরেরও আগে।”

“এ বাঁশিতে তাহলে রহস্যটা কী?”

“তা আমি জানি না। এখন বিদেয় হ। আর মনে রাখিস ও বাঁশি বাজাতে নেই। যার কর্ম তারে সাজে, অন্যের হাতে লাঠি বাজে। যা, যা, বাঁশিটা বাঁশির জায়গামতো রেখে আয়।”

“আজ্ঞে ওস্তাদ, আপনি যদি একবার বাঁশিটা একটু বাজিয়ে শোনাতেন তা হলে ধন্য হতাম। শুনেছি বাঁশিটায় নাকি ভর হয়।”

ইরফান হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে একটা সুপুরি কাটার ভারী জাতি নিয়ে তাকে তাড়া করেছিল।

গাজিসাহেবের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি বটেশ্বর। শুধু এটুকু বুঝেছে যে, বাঁশিটা এলেবেলে বাঁশি নয়। কিন্তু লাখ টাকা দামের এই বাঁশির মহিমা কী। সেটাও বোঝা দরকার। বটেশ্বর ভারী বিভ্রান্ত বোধ করছে। আর ওই তিনটে কথারই বা মানে কী? একে রসাভাস, দুইয়ে নিদ্রাপাশ, তিনে সর্বনাশ!

অন্ধকারে কাছেপিঠে কোথাও একটা মৃদু গলা খাঁকারির শব্দ হল। সচকিত হয়ে বটেশ্বর বাঁশিটা তার জামার তলায় লুকিয়ে ফেলল। এ সময়ে এদিকপানে কারও আসার কথা নয়। তাই একটু উৎকর্ণ হল বটেশ্বর। অন্ধকারটা তার চোখ-সওয়া হয়ে গেছে। আবছামতো সবই দেখতে পাচ্ছে সে। ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে কেউ ঘাপটি মেরে নজর রাখছে না তো!

বটেশ্বর টপ করে উঠে পড়ল। গাজিসাহেব বলেছিল বাঁশিটার দাম লাখ টাকা। হতেও পারে বা। সে চারদিকে নজর রাখতে রাখতে ঘাট ছেড়ে নির্জন পথ ধরে গায়ের দিকে রওনা হল।

কিন্তু কয়েক কদম যেতে না যেতেই তার মনে হল কে বা কারা তার পিছু নিয়েছে। মনটায় বড় অস্বস্তি হচ্ছে তার। জায়গাটায় এত গাছগাছালি আর ঝোঁপঝাড় যে, কেউ লুকিয়ে পিছু নিলেও নজরে পড়া কঠিন। বটেশ্বর ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে লাগল।

কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। আচমকাই একটা মস্ত লম্বা আর পেল্লায় চেহারার লোক অন্ধকার কুঁড়ে বেরিয়ে এসে তার পথ আটকে দাঁড়াল।

বটেশ্বর চেঁচাবে বলে সবে হাঁ করেছিল, কিন্তু গলায় স্বর ফোঁটার আগেই গদাম করে মুগুরের মতো একটা ঘুষি এসে তার মুখে পড়ল, আর সে চোখে অন্ধকার আর আলোর ফুলকি দেখতে দেখতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

পিছন থেকে লম্বাপানা ধুতি পাঞ্জাবি পরা আরও একটা লোক এগিয়ে এসে বটেশ্বরের মুখে জোরালো একটা টর্চের আলো ফেলে বিশাল চেহারার লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “তোকে দেখেছে?”

“দেখেছে।”

“তবে সাক্ষী রাখার দরকার নেই। গলার নলিটা কেটে দে।”

লোকটা নিচু হয়ে বটেশ্বরের শিথিল হাত থেকে গড়িয়ে পড়া বাঁশিটা তুলে নিয়ে রোগা লোকটার হাতে দিল। তারপর কোমর থেকে একটা ঝকঝকে ল্যাজা বের করে বটেশ্বরের গলা লক্ষ্য করে তুলল।

.

এখন হয়েছে কী, বটেশ্বরকে বিদেয় করার পর থেকে ইরফান গাজির মনটা খুঁতখুঁত করছিল। একটা আনাড়ির হাতে বাঁশিটা ছেড়ে দেওয়া কি উচিত কাজ হল। যদিও ওই বাঁশি বাজানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার তবু কিছু বলাও যায় না। মোহন রায়ের ওই মোহন বাঁশি যে কার ফুয়ে বেজে উঠবে তা কে জানে!

খেয়েদেয়ে দুপুরে খাঁটিয়ার বিছানায় একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল ইরফান। কিন্তু কী যেন বড্ড কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমোনোর চেষ্টা করে বিরক্ত হয়ে উঠে বসে ইরফান রাগারাগি করতে লাগল, “আমার বিছানায় যে ছারপোকা হয়েছে এটা কি কারও জানা নেই নাকি!”

তার বউ এসে বলল, “তোমার বিছানায় ছারপোকা! অবাক করলে যে! ওই বিছানা আমি নিজে রোজ রোদে দিই, ঝাড়ি।”

“তবে কামড়াচ্ছে কেন?”

ইরফানের বউ বিছানাটা তন্ন তন্ন করে উলটে পালটে দেখে বলে, “কোথায় ছারপোকা! পিঁপড়েও তো নেই। এ তোমার মনের বাতিক।”

ইরফান বোকা বনে অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকার পর হঠাৎ বুঝতে পারল, তাকে যা কামড়াচ্ছে তা ছারপোকা বা পিঁপড়ে নয়। কামড়াচ্ছে তার বিবেক। আনাড়ির হাতে বিপজ্জনক বাঁশিটা ছেড়ে দেওয়া অবিবেচকের কাজ হয়েছে।

সুতরাং ইরফান উঠে পায়জামা কুর্তা পরে হাতে একটা ঘেঁটে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ময়নাগড় তাকে আরও একটা কারণে আকর্ষণ করছিল। বটেশ্বর যে অমৃত খাইয়ে গেছে সেই রামগোপালের রসগোল্লা আরও গোটাকতক খেতে না পারলে মনটা ঠাণ্ডা হচ্ছে না।

ময়নাগড়ে পৌঁছে সে সোজা রামগোপাল ঘোষের দোকানে হাজির হয়ে হাঁক মারল, “কই হে রামগোপাল, দাও তো গোটাচারেক গরম গরম রসগোল্লা।”

রামগোপাল ইরফানকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, “মাপ করবেন গাজি সাহেব, ওটি পারব না। আপনার মিষ্টি খাওয়া বারণ আমি জানি, রসগোল্লা আপনার পক্ষে বিষতুল্য।”

ইরফান মিটমিট করে রামগোপালের দিকে খানিক চেয়ে থেকে একটু হেসে গলা নামিয়ে বলল, “আহা, না হয় রসটা নিংড়েই দাও না।”

“না গাজিসাহেব, তা হলে আমাকে নরকে যেতে হবে।”

ইরফান হুঙ্কার দিয়ে বলল, “আর ক্ষুধার্তকে খাদ্য না দিলে বুঝি পাপ হয় না? তখন দোজখে যেতে হবে না?”

“খাবেন না কেন, অবশ্যই খাবেন। ভাল নিমকি আছে, ঘুঘনি আছে কচুরি আছে।”

“দুর, দুর! ওসব তো ইবলিশের খাদ্য। ভদ্রলোকের খাদ্য হল মেঠাই।”

“তা হলে গরম চপ আর মুড়ি!”

“না হে, উঠি। একটা মর্কটকে খুঁজে বের করতে হবে। তাড়া আছে।”

কিন্তু তাড়া থাকলেও তাড়াতাড়ি করার উপায় ছিল না। পথে তাকে দেখে সবাই সসম্ভ্রমে নমস্কার জানায়, দু-চারটে কথাও কয়। এই করতে করতে দেরি হয়ে অন্ধকার নেমে পড়ল। বটেশ্বরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলে তার বউ বলল, “দেখুন তো গাজিসাহেব, লোকটার যে কী হয়েছে, সর্বদাই অন্যমনস্ক থাকে। সন্ধের পর কোথায় যে যায় কে জানে। সেদিন আমাদের গয়লা রামবচন বলল, দিঘির পাড়ে খোঁটা-ওপড়ানো গোরু খুঁজতে গিয়ে নাকি ওকে দেখেছে একটা লাঠি হাতে নিয়ে বসে আছে।”

“দিঘি! সে তো গাঁয়ের বাইরে।”

“হ্যাঁ, সাপখোপ আছে, সন্ধের পর অন্য ভয়ও আছে, কিন্তু কথা মোটে কানে তোলে না।”

চিন্তিত ইরফান তাড়াতাড়ি হাঁটা দিল। লক্ষণ ভাল ঠেকছে না। ছোঁকরা বাঁশিটা বাজানোর তাল করছে।

তাড়াতাড়ি করেও দেরি হয়ে গেল ইরফানের। আরও একটু দেরি হলে অবশ্য আর বটেশ্বরকে পাওয়া যেত না।

অন্ধকার দিঘির ধারে দূর থেকে একটা হুটপাট এবং তারপর টর্চের আলো দেখে ইরফানের হঠাৎ মনে হল, একটা বিপদ ঘটছে। কেন মনে হল কে জানে। হঠাৎ ঘেঁটে লাঠিটা বাগিয়ে সে ছুটপায়ে গিয়ে আবছা অন্ধকারেও ল্যাজার ঝিলিকটা দেখতে পেল। বাঘের মতো লাফিয়ে চিন্তা ভাবনা না করেই সে ঘেঁটে লাঠিটা লোকটার কোমরে সপাটে বসিয়ে দিল।

লোকটা ‘বাপ রে’ বলে লাফিয়ে উঠতেই আরও এক ঘা। ল্যাজাটা ছিটকে পড়ল হাত থেকে। লোকটা চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। সঙ্গে আরও একটা লোকও দৌড়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।

ইরফান বটেশ্বরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আপনমনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “আহাম্মক কোথাকার, বাঁশির জন্য প্রাণটাই যে যাচ্ছিল তোর!”

দিঘি থেকে এক আঁজলা জল তুলে এনে মুখে ঝটকা দিতেই উঠে বসল বটেশ্বর। তারপর ডুকরে উঠে বলল, “গাজিসাহেব, বাঁশিটা যে নিয়ে গেল।”

“তোকে বলেছিলুম কি না, জায়গার জিনিস জায়গায় রেখে আয়!”

“কিন্তু এখন কী হবে?”

“সর্বনাশ করে বসে আছিস। শয়তানদের হাতে পড়লে এ-জায়গা শ্মশান করে ছেড়ে দেবে। এখন ওঠ বাপু, ঘরে যা, প্রাণে যে বেঁচে আছিস সেই ঢের। আমারও কাজ বাড়ালি।”

“আপনি বুড়ো মানুষ, কী করবেন?”

ইরফান খিঁচিয়ে উঠে বলে, “বুড়ো মানুষের লাঠির জোর ছিল বলেই তো বেঁচে গেলি।”

কাপড়ের খুঁটে নাকটা চেপে ধরে বটেশ্বর বলল, “তা ঠিক। তবে কিনা বারবার কি ওরকম হবে? তার চেয়ে গাঁয়ের লোকদের জানাই চলুন।”

“অতি সন্নিসিতে যে গাজন নষ্ট।”

“না গাজিসাহেব, আপনি একলা অত সাহস করবেন না। যে লোকটা আমাকে মেরেছে তার বিশাল চেহারা, গায়ে পেল্লায় জোর।”

ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তাই করি চল। গাঁয়ের লোকদেরই জানাই।”

ঘণ্টাখানেক বাদে হাটখোলার মাঠে মেলা লোক জড়ো হয়েছে। দশ-বারোটা হ্যাজাক জ্বলছে। মাইকে দাঁড়িয়ে সত্যগোপাল কম্বুকণ্ঠে ভাষণ দিচ্ছিল, “ভাইসব, ময়নাগড় আর সেই ময়নাগড় নেই। এই ময়নাগড়কে নিয়েই কবি গান বেঁধেছিলেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। এখানে গাছে গাছে মলয় পবনের মর্মরধ্বনি, নদীর কুলু কুলু তান, কোকিলের কুহু কুহু গান শোনা যেত। খেতে ধান, গোয়ালে গোরু, মুখে হাসি, এই ছিল ময়নাগড়ের চিরপরিচিত দৃশ্য। আজ সেই সোনার ময়নাগড় সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্যে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।” ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিষ্ণুরামদারোগা উঠে বজ্রকণ্ঠে বলল, “এই যে আজ সমাজবিরোধীর ঘুসিতে বটেশ্বরের নাক কেটে রক্ত পড়েছে, বীরের এই রক্তস্রোত, মাতার এই অশ্রুধারা, এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা? আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া। প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস, লেখা হয় যেন আমার রক্তলেখায় তাদের সাশ। ভাইসব, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে। যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভাল? বলুন আপনারা, এই দেশের জন্যই কি শহিদ ক্ষুদিরাম, শহিদ ভগৎ সিং, শহিদ গোষ্ঠ পাল প্রাণ দিয়ে গেছেন?”

কানের ব্যথা নিয়ে সভায় এসেছিল কালীপদ। খানিক বাদে নড়েচড়ে বসে পাশে বসা হাঁদু মল্লিককে বলল, “বুঝলে দুদা, কানের কটকটানিটা সেরে গিয়ে এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। বিষ্ণুরামদারোগা কেমন সত্যগোপালকে টেক্কা মেরে বেরিয়ে গেল দেখলে?”

হাঁদু মুখ শুকনো করে বলে, “সে না হয় হল। কিন্তু গঞ্জে সমাজবিরোধীরা আনাগোনা করছে, এ তো ভাল কথা নয় রে ভাই। দুটো পয়সা নাড়াচাড়া করতে হয়, পয়সা ছাড়া গরিবের আর আছেটাই বা কী বলল! তাতেও তো দেখছি শনি এসে ঢুকল। এরকম হলে কাজ কারবার তুলে দিয়ে যে আমাকে কাশীবাসী হতে হবে।”

পিছন থেকে রাখাল বলল, “আহা, কাশীটাই বা কী এমন সুখের জায়গা বলল। এই তো হরেন ব্ৰহ্ম কাশীতে তীর্থ করতে গিয়ে বাটপাড়ের হাতে সর্বস্ব খুইয়ে এসেছে। তবু যদি যেতে হয় এক বস্ত্রে যেও। তোমার কারবার আমিই দেখেশুনে রাখব ’খন।”

বিশু একটা তাচ্ছিল্যের মুখভঙ্গি করে বলল, “ছোঃ, যে ছত্রিশের কত নামে আর কত হাতে থাকে তাই জানে না সে আবার কারবারি!”

আর একটু হলেই হদুর সঙ্গে বিশুর হাতাহাতি লেগে যাচ্ছিল, এমন সময় হেডস্যার পান্নালালবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বেঁটে তলোয়ারের মতো ঝকঝকে ল্যাজাটা তুলে ধরে জনসাধারণকে দেখিয়ে বললেন, “ভাইসব, এই সেই ল্যাজা। এই ল্যাজা দিয়েই দুষ্কৃতী বটেশ্বরের মুড়ো কাটতে চেয়েছিল। ল্যাজা দিয়ে মুড়ো কাটার এই অপচেষ্টা গাজিসাহেবের বীরত্বে ব্যর্থ হয়েছে বটে, কিন্তু লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, এই অপচেষ্টা আবার হবে। ল্যাজা দিয়ে মুড়ো কাটার এই অপসংস্কৃতি ময়নাগড় থেকে দূর করতেই হবে, নইলে আমাদের শান্তি নেই। বন্ধুগণ, আজ হাজার কণ্ঠে আপনারা আওয়াজ তুলুন, ল্যাজা দিয়ে মুড়ো কাটা চলবে না, চলবে না …”

সঙ্গে সঙ্গে জনতা গর্জন করে উঠল, “চলবে না, চলবে না।”

এর পর উঠল ইরফান গাজি। সে বলল, “ভাইসব, আমি কথাটথা বিশেষ কইতে পারি না। বক্তৃতা দিতে জানি না। শুধু বলি, সামনে ঘোর বিপদ। সব কথা প্রকাশ্যে ভেঙে বলা যাবে না। শুধু বলি, মোহন রায়ের বাঁশি যদি বদমাশদের হাতে পড়ে থাকে তা হলে এটা ভূতপ্রেতের রাজ্য হয়ে যাবে। তাই এখনই বদমাশ দুটোকে ধরতে হবে। নইলে রক্ষে নেই।”

ভিড়ের পিছনে, একটু দুরে, অন্ধকারে দুই মূর্তি পাশাপাশি বসা।

পরাণ মৃদুস্বরে বলল, “ওস্তাদজি, গাজিসাহেব যা বলল তা কি সত্যি?”

শ্রীনিবাস মাথা নেড়ে বলে, “সেরকমই তো জানি। তবে সত্যি মিথ্যে যাচাই তো হয়নি। কেতুগড় রাজবাড়ির মহাফেজখানার পুঁথিপত্রে সেরকমই লেখা আছে।”

“মোহন রায়টা কে বলুন তো?”

“দেড়শো বছর আগে রাজা শশাঙ্কনারায়ণের সভায় বাঁশি বাজাত, গুণী মানুষ।”

“আর একটু ভেঙে বললে হয় না ওস্তাদ?”

“সব কথা একবারে শুনলে তোর মাথায় জট পাকিয়ে যাবে। অল্প অল্প করে শোনাই তো ভাল। তোর মাথায় যে গোবর সেটা কি ভুলে গেলি?”

“আপনার কাছে ক’দিন তালিম নিয়ে মাথাটা একটু খোলসা হয়েছে কিন্তু।”

“বটে! কীরকম?”

“এই ধরুন আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, বাঁশিটার মধ্যে মন্ত্র তন্ত্রের একটা ব্যাপার আছে। বাঁশিটা বাজলে হয়তো ঘূর্ণি ঝড় উঠবে বা নদীতে বান আসবে বা ভূমিকম্প গোছের কিছু হবে।”

“বাপ রে! তোর তো দেখছি গুরুমারা বিদ্যে!”

“ঠিক বলিনি?”

“অনেকটাই বলেছিস বাপু। আর বলতে কী, কিছু খারাপও বলিসনি।”

“তবেই বুঝুন, আমার মাথায় সবটুকুই গোবর নয়। আগে আমি নিজের মাথা থেকে একটা গোবর-গোবর গন্ধও পেতুম। আজকাল কিন্তু পাচ্ছি না।”

“বোধহয় গোবরের রস মরে ঘুঁটে হয়েছে। তবু বলি আন্দাজ করেছিস মন্দ নয়।”

“এবার তা হলে ভেঙে বলুন।”

“ভেঙে বলিই বা কী করে? মোহন রায় তো খোলসা করে সব লিখে যায়নি। সাঁটে লিখে গেছে। একে রসাভাস, দুইয়ে নিদ্রাপাশ, তিনে সর্বনাশ।”

“এ যে আরও গুবলেট হয়ে গেল ওস্তাদ। বুদ্ধিটা সবে ঘুম ভেঙে হাই তুলছে। এখনও আড় ভাঙেনি। এখনই কি আর অত শক্ত শক্ত অঙ্ক পারব?”

“অঙ্ক তো আমার নয় রে, মোহন রায়ের। তবে বাঁশিটার নীচের দিকে তিনটে ঘঁাদা আছে। তিনটেই ছিপি দিয়ে আঁট করে বন্ধ। প্রথম ছিপিটা খুলে দিলে বাঁশির সুরে চারদিকে আনন্দের লহরী বইবে। লোকে সেই সুরে মাতাল হয়ে ঝুঁদ হয়ে থাকবে। যদি প্রথম ‘ছ্যাঁদা বন্ধ রেখে দু’নম্বর ছ্যাঁদার ছিপি খোলা যায় তা হলে ওই নিদ্রাপাশ। মানে যতদুর বাঁশির শব্দ যাবে ততদূর মানুষজন পশুপাখি সব ঢলাঢল ঘুমিয়ে পড়বে। পাশ মানে জানিস?”

“আজ্ঞে, কথাটা শোনা শোনা ঠেকছে। এই যেমন আপনি আমার পাশে, সেই পাশ কি?”

“আরও একটু গভীর। পাশ মানে বন্ধন। নিদ্রাপাশ মানে ঘুমের বন্ধন। খুব আঁট করে ঘুমের দড়িতে সবাই বাঁধা পড়বে। বুঝলি?”

“এ তো বড় ভাল জিনিস ওস্তাদ। সবাইকে যদি ঘুম পাড়িয়ে ফেলা যায় তা হলে তো আমাদের একেবারে খোলা মাঠ। চেঁছেপুঁছে আনা যাবে। এক রাতেই রাজা।”

“অত লাফাসনি। যারা বাঁশি কেড়ে নিয়ে গেছে তারাও ওই মতলবেই নিয়েছে।”

“আর তিন নম্বর স্থাদা?”

“সেটা ওই তুই যা বললি। ঘূর্ণি ঝড় বা বান বা ভূমিকম্প। সাঁটেও তাই বলা আছে। তিনে সর্বনাশ। তাই যার-তার হাতে ও জিনিস গেলে বড় বিপদের কথা।”

“তা হলে আমরা আর দেরি করছি কেন ওস্তাদ?”

“তুই এক্ষুনি তেড়েফুঁড়ে উঠে একটা কিছু করতে চাস বুঝতে পারছি। কিন্তু মনে রাখিস সবুরে মেওয়া ফলে। বাঁশিচোর কি তোর হাতে ধরা দেবে বলে দু’হাত বাড়িয়ে বসে আছে? তার ওপর ভেবে দ্যাখ, সেই গুণ্ডাটা যদি চড়াও হয় তা হলে এই ল্যাকপ্যাকে শরীর নিয়ে লড়াই দিতে পারবি কি না।”

উঠতে গিয়েও ফের বসে পড়ল পরাণ। বলল, “যতই যাই করতে যাই আপনি কেন যে তাতে জল ঢেলে দেন কে জানে।”

“হুটপাট করে কাজ পণ্ড করার চেয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করা ভাল। কাজের পিছনে চিন্তা হল ছেলের পিছনে মা।”

একগাল হেসে পরাণ বলল, “এবার বুঝেছি। যেমন ডালের পিছনে শুকতো, দুইয়ের পিছনে এক, হাতের পিছনে বগল, রামের পিছনে রামায়ণ, মুর্গির পিছনে ডিম, সওদার পিছনে পয়সা, কাশীর পিছনে গয়া, দইয়ের পিছনে দুধ, ভেঁকুরের পিছনে ভোজ…”।

“ওরে ক্ষ্যামা দে। যথেষ্ট হয়েছে। জলের মতো বুঝেছিস।”

“বলছিলুম না আপনাকে, মাথা থেকে গোবরের গন্ধটা গায়েব হয়েছে!”

“তা তো হয়েছে, এখন বল তো, পিছনে ওই কাঁঠালতলায় ঘাপটি মেরে অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে বসে আছে, ওই লোকটা কে!”

পরাণ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বলল, “কোথায় কে? জোনাকি পোকা ছাড়া আর তো কিছু দেখা যাচ্ছে না ওস্তাদ!”

“তুই কি বলতে চাস, আমি ভুল দেখছি? বারবারই আমার চোখ চলে যাচ্ছে ওইদিকে। ওই দ্যাখ না, একটা সাদাটে জোব্বামতো পরা… ওই যে এইমাত্র উঠে দাঁড়াল, দেখেছিস?”

পরাণ ফের ঘাড় ঘুরিয়ে ভাল করে দেখে বলল, “আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না ওস্তাদ!”

শ্রীনিবাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চলে গেল!”

পরাণ চিন্তিত হয়ে বলল, “ওস্তাদ, চোখে ছানিটানি পড়েনি তো! ছানি হয়ে থাকলে তো খুবই দুশ্চিন্তার কথা। কাজকারবার হবে কী করে?”

শ্রীনিবাস গম্ভীর মুখে বলে, “ছানি নয় রে, দূরদৃষ্টি, যা দেখেছি ঠিকই দেখেছি। ও জিনিস তোর দেখার নয়। দেখতে যে পাসনি তাতে ভালই হয়েছে।”

শশব্যস্তে পরাণ বলল, ‘জিনিসটা কী ওস্তাদ? সেই জিনিস নাকি, সন্ধের পর যার নাম করতে নেই? রাম রাম রাম রাম…”

“কিছু একটা হবে। এখন বাড়ি চল তো। বউমাকে আজ লাউ পোস্ত রাঁধতে বলে এসেছি। বুড়ো বয়সে আমার একটু নোলা হয়েছে। ভিতরটা কেবল খাই খাই করে।”

“আজ্ঞে, সে আমারও করে।”

“কিন্তু তা বলে ঠেসে খাসনে। আজ রাতে একটু কাজে বেরোতে হবে। কাজের সবচেয়ে বড় শত্রু হল খাওয়া। বুঝেছিস?”

“তা আর বুঝিনি! চোরের শত্রু পুলিশ, ওলের শত্রু তেতুঁল, জোঁকের শত্রু নুন, ধারের শত্রু সুদ, কালীর শত্রু কেষ্টঠাকুর, বরের শত্রু বউ, খিদের শত্রু ভাত…।”

“বুঝেছি; বুঝেছি! এখন পা চালিয়ে চল তো।”

“যে আজ্ঞে।”