৩. পানারের মানুষখেকো
০১.
১৯০৭ সালে যখন চম্পাবতের মানুষখেকোর শিকারে ফিরছিলাম, তখন শুনেছিলাম একটি মানুষখেকো চিতার কথা; সেটি আলমোড়া জেলার পূর্ব-সীমানার গ্রামগুলির অধিবাসীদের ত্রাসিত করছিল। হাউস অফ কমসে এর বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং এই চিতাটি বহু নামে পরিচিত ছিল; সে চারশো মানুষ মেরেছে বলে বলা হচ্ছিল। জানোয়ারটিকে আমি জানতাম পানারের মানুষখেকো নামে এবং অতএব, আমার গল্পের উদ্দেশ্যে আমি এই নামটিই ব্যবহার করব।’
১৯০৫ সালের আগে সরকারী নথিপত্রে, মানুষখেকো বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই এবং দেখে ধারণা হয়, চম্পাবতের বাঘ এবং পানারের চিতার আগমনের আগে কুমায়ুনে মানুষখেকোরা অজানিত ছিল। সেইজন্যে যখন এই দুটি জানোয়ার এসে দেখা দিল,–দুটিতে মিলে আটশো ছত্রিশটি মানুষ মেরেছিল–সরকার এক সঙ্গিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হল; কেন না এদের বিরুদ্ধে কার্যকর করবার মত কোনো ব্যবস্থা সরকারের ছিল না, শিকারীদের কাছে ব্যক্তিগত আবেদন জানাবার ওপরেই ভরসা করতে হল। দুর্ভাগ্যবশত কুমায়ুনে সে সময়ে অতি অল্প শিকারীই ছিলেন যাদের এই নতুন জাতের শিকারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল এবং এ শিকারকে মনে করা হত কয়েক বছর বাদে এভারেস্ট বিজয়ে উইলসনের একক প্রচেষ্টার মতই অনিশ্চিত-বিপদপূর্ণ, তা সে ঠিক অথবা ভুল, যাই হক। এভারেস্টের বিষয়ে উইলসন যেমন, মানুষখেকোদের বিষয়ে আমিও তেমনি সমান অজ্ঞই ছিলাম এবং আমি যে আমার প্রচেষ্টায় সফল হই, যখন স্পষ্টই দেখা গেল তার প্রচেষ্টায়, তিনি বিফল হলেন, এ একেবারে ভাগ্যের দয়ায়।
চম্পাবতের বাঘ মারার পর যখন নৈনিতালে স্ব-গৃহে ফিরে এলাম, পানারের চিতা শিকারের ভার নিতে আমাকে সরকারের তরফে অনুরোধ জানানো হল। সে সময়ে জীবিকার্জনের জন্য আমি কঠিন শ্রম করছিলাম আর এ কাজের ভার নেবার সময় পেতে আমার কয়েক হপ্তা কেটে গেল; তারপর, চিতাটি যেখানে কার্যকলাপ চালাচ্ছে, আলমোড়া জেলার সেই সীমান্ত অঞ্চলে রওনা হতে যেই প্রস্তুত হলাম; মুক্তেশ্বর, যেখানে একটি মানুষখেকো বাঘ এক সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে সেখানকার লোকদের সাহায্যার্থে যাবার জন্যে নৈনিতালের ডেপুটি কমিশনার বারহাউডের কাছ থেকে এক জরুরী তার পেলাম। বাঘটিকে শিকার করার পর, যার এক বিবরণী আমি দিয়েছি, আমি পানারের চিতার সন্ধানে গেলাম।
যে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চিতাটি তার কার্যকলাপ চালাচ্ছিল, যেহেতু সেখানে আগে যাই নি, আমি গেলাম আলমোড়া হয়ে, আলমোড়ায় ডেপুটি কমিশনার স্টিফের কাছ থেকে চিতাটির বিষয়ে যা পারি জেনে নিয়ে যেতে। ভদ্রতা করে ও আমাকে লাঞ্চে নেমন্তন্ন করল, ম্যাপ জুটিয়ে দিল, তারপর যখন বিদায়েচ্ছা জানাচ্ছে, সবরকম বিপদের সম্ভাবনা আমি বিবেচনা করে দেখেছি কি না, আমার উইল লিখে সে বিপদের জন্যে প্রস্তুত হয়েছি কি না, তখন এ কথা জিজ্ঞেস করে আমায় খানিকটা ঘাবড়ে দিল।
আমার ম্যাপগুলিতে দেখা গেল, আক্রান্ত অঞ্চলে পৌঁছবার দুটি পথ; একটি পিথোরগড় রোডে অবস্থিত পানোয়ানালা দিয়ে; অপরটি দাবিধূরা রোডে অবস্থিত লাগারা দিয়ে। পরের পথটি বেছে নিলাম আমি আর একটি ভৃত্য ও আমার মালবাহী চারজন লোকসহ লাঞ্চের পরই বেরিয়ে পড়লাম, সে উইলের উল্লেখ সত্ত্বেও–খোশমেজাজেই। আমার নোকজন ও আমি ইতিমধ্যেই খৈরনা থেকে চোদ্দ মাইল কষ্টসাধ্য পদযাত্রা করে এসেছি, কিন্তু তরুণ বয়স্ক এবং সুস্বাস্থ্যবান হওয়ার দরুণ ক্ষান্ত দেবার আগে আমরা আরেক দীর্ঘ পথ হাঁটতে প্রস্তুত ছিলাম।
পূর্ণিমার চাঁদ যখন উঠছে আমরা পৌঁছলাম ছোট একটি জনবসতি থেকে দূরে এক নিরালা বাড়িতে; তার দেওয়ালের হিজিবিজি লেখা আর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছেঁড়া কাগজের টুকরো থেকে আমরা ধরে নিলাম ওটি এক স্কুল হিসেবে ব্যবহার হয়। আমার পক্ষে কোনো তাঁবু ছিল না, এবং যেহেতু বাড়িটির দরজা তালাবন্ধ, আমার লোকজন সহ উঠোনে রাত কাটানো স্থির করলাম; সম্পূর্ণ নিরাপদ এ ব্যবস্থা কেন না এখনো আমার মানুষখেকোটির শিকার ক্ষেত্র থেকে বহু মাইল দূর। এই উঠোনটি প্রায় কুড়ি ফুট সম-চতুষ্কোণ, সরকারী পথের ওপর ঝুলছে এটি এবং তিনদিকে এটি দুই ফুট উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। চতুর্থ দিকে স্কুলবাড়িটি এর সীমানা।
স্কুলের পেছনের জঙ্গলে ছিল প্রচুর জ্বালানী কাঠ, ভৃত্য আমার রাতের খানা রাঁধবে বলে উঠোনের এক কোণে আমার লোকজন শীঘ্রই, গনগনে আগুন জ্বালিয়ে দিল। বন্ধ দরজায় পিঠ ঠেস দিয়ে বসেছিলাম আমি; ধূমপান করছিলাম; পথের সবচেয়ে কাছের নিচু পাঁচিলের ওপর আমার ভৃত্য তখনি রেখেছে একটা পাঠার ঠ্যাং আর ঘুরে বসেছে আগুনটা ঠিকঠাক করতে; তখনি আমি দেখলাম পাঁঠার ঠ্যাংটির কাছের পাঁচিলটির ওপারে জেগে উঠল একটি চিতার মাথা। মুগ্ধ হয়ে নিস্পন্দে বসে আমি দেখতে থাকলাম, কেন না চিতাটি আমার মুখোমুখি–আর ভৃত্যটি যখন কয়েক ফুট সরেছে সবে, চিতাটি মাংসটি কামড়ে ধরল আর রাস্তা লাফিয়ে ওপারের জঙ্গলে চলে গেল। মাংসটি রাখা হয়েছিল একটা বড় কাগজে, মাংসে সেঁটে গিয়েছিল সেটা, যখন আমার ভৃত্য কাগজের খসখস শুনল আর দেখল, ও ভেবেছিল কুকুর; মাংসটা নিয়ে পালাচ্ছে–ও চেঁচাতে চেঁচাতে সামনে ছুটে গেল; কিন্তু সামান্য এক কুকুরের নয়, এক চিতার পেছনে ছুটছে বুঝেই ও উলটো মুখে ঘুরল এবং আরো জোরে ছুটে এল আমার দিকে। দুপুরের রোদে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া অন্যান্য কারণেও প্রাচ্যের সকল শ্বেতাঙ্গই অল্প-বিস্তর খ্যাপা বলে খ্যাত; এবং আমার আশঙ্কা, যখন আমায় হাসতে দেখল, আমার সুভৃত্যটি ভাবল আমার মত অধিকাংশের চেয়ে আমি একটু বেশি খ্যাপা, কেন না ও অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘চিতাটা নিয়ে গেল আপনারই খানা আর আপনি খান এমন আমার আর কিছুই নেই। যাহ’ক সময়ে ও এমন খানা হাজির করল যাতে ওকে তারিফ করতে হয় এবং এই খানার প্রতি আমি যা করলাম ক্ষুধার্ত চিতাটি তার উৎকৃষ্ট পাঁঠার ঠ্যাঙের প্রতি সেই সুবিচার করেছে বলেই আমার বিশ্বাস।
পরদিন সকালে ভোর-ভোর রওনা হয়ে আমরা খাওয়ার জন্যে লামগারায় একটু বসলাম, এবং সন্ধের মধ্যে পৌঁছলাম মানুষখেকোটির সাম্রাজ্য সীমায় ডোল ডাকবাংলোয়। বাংলোতে আমার লোকজনদের রেখে পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম মানুষখেকোটির ঘবর যোগাড়ের চেষ্টায়। যেতে যেতে, চিতার থাবার ছাপের জন্য গ্রাম থেকে গ্রামে সংযযাককারী পায়ে চলা পথগুলি নিরীক্ষণ করতে করতে সন্ধ্যা পেরোলে আমি এক বসতি-বিচ্ছিন্ন খামারে পৌঁছলাম; তাতে আছে স্লেটপাথরের ছাত-দেওয়া, পাথরে তৈরি একটিমাত্র বাড়ি; কয়েক বিঘা আবাদী জমির মধ্যে সেটি অবস্থিত এবং আগাছার জঙ্গলে পরিবৃত। এই খামার-মুখো পায়ে চলা পথে আমি একটা বড় মদ্দা চিতার থাবার ছাপ দেখলাম।
বাড়ির কাছে যেমন এগিয়েছি, সংকীর্ণ ঝুলবারান্দায় বেরিয়ে এল একটি লোক এবং সামান্য কয়টি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে উঠোন পেরিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। সে এক জোয়ান, হয়তো বাইশ বছর বয়স, এবং সে অত্যন্ত বিপন্ন। জানা গেল, আগের দিন রাতে, বাড়ি বলতে যে একটিমাত্র ঘর তার মেঝেতে ও আর ওর বউ ঘুমাচ্ছিল; এপ্রিল মাস, বেজায় গরম, তাই দোর ছিল খোলা, তখন নরখাদকটি ঝুলবারান্দায় উঠে আসে এবং ওর স্ত্রীর গলা কামড়াতে পেরে মেয়েটিকে ঘর থেকে মাথার দিকে টেনে বের করতে থাকে। রুদ্ধ আর্তনাদে মেয়েটি একটা হাত ছুঁড়ে দেয় স্বামীর গায়ে আর কি ঘটছে তা নিমেষে বুঝে ফেলে তার স্বামী। সে তৎক্ষণাৎ এক হাতে মেয়েটির বাহু ধরে আর ঠেকা দেবার জন্যে আরেকটা হাত চেপে ধরে চৌকাঠের গায়ে, মেয়েটিকে ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নেয় চিতার কাছ থেকে আর দরজা বন্ধ করে দেয়। বাকি রাতটা ধরে লোকটি এবং ওর স্ত্রী ঘরের এক কোণে সিটিয়ে থাকে ভয়ে, ওদিকে চিতাটা চেষ্টা করে দরজা ভেঙে ফেলতে। বায়ুপ্রবাহ বর্জিত গরম ঘরে মেয়েটির জখমগুলো সেপটিকে দাঁড়াতে থাকে এবং সকালের মধ্যে যন্ত্রণা ও ভয় ওকে অচৈতন্য করে ফেলে।
সারাদিন লোকটি ওর স্ত্রীর কাছে থাকল; তাকে রেখে যেতে পারল না এই ভয়ে যদি চিতাটি ফিরে এসে তাকে নিয়ে যায় এবং ও ওর নিকটতম প্রতিবেশীর কাছে, পৌঁছতে মধ্যবর্তী এক মাইল ব্যাপী আগাছার জঙ্গল পেরতে ভরসা পাচ্ছিল না। দিনের যবনিকা যখন নামছে, হতভাগ্য লোকটি আরও আতঙ্কজনক রাতের সম্মুখীন হতে চলেছে, আমাকে বাড়ির দিকে আসতে দেখল ও; এবং ও যে আমার দিকে ছুটে এল, কাঁদতে কাঁদতে পড়ল আমার পায়ে, তাতে আর অবাক হলাম না আমি, যখন ওর কাহিনী শুনলাম।
এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম আমি। যে-অঞ্চলে এক নরখাদক কার্যকলাপ চালাচ্ছে সেখানকার লোকদের প্রাথমিক-চিকিৎসার সরঞ্জাম যোগান দেবার জন্যে তখনো সরকারের সমীপস্থ হই নি আমি; তাই আলমোড়ার এদিকে কোনো ডাক্তারী বা অন্য সহায়তা পাবার উপায় নেই এবং আলমোড়া পঁচিশ মাইল দূরে। মেয়েটির জন্য সাহায্য আনতে হলে সে জন্য আমাকে নিজে যেতে হয় এবং তার মানে দাঁড়ায় লোকটিকে উন্মাদ হবার দণ্ড দেওয়া; কোনো মানুষের পক্ষে যতখানি সহ্য করা সম্ভব তা ও ইতিমধ্যেই সয়েছে; এবং চিতাটা ফিরে আসার ও ঢাকার প্রচেষ্টার সম্ভাবনা নিয়ে ও ঘরে আর একটি রাত থাকলে ওকে উন্মাদাগারে যেতে হত তা সুনিশ্চিত।
ছেলেটির স্ত্রী, একটি আঠার বছরের মেয়ে, চিত হয়ে শুয়েছিল, যখন চিতাটা ওর গলায় দাঁত বসায় এবং পুরুষটি যখন স্ত্রীর হাত চেপে ধরে পেছনে টানতে শুরু করে–তখন চিতাটা, আরো ভালভাবে ধরবার জন্যে একটা থাবার নখ ওর বুকে বিধিয়ে দেয়। শেষ ধস্তাধস্তির সময়ে চারটে গভীর ক্ষত রেখে নখগুলো মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। ছোট ঘরটিতে শুধু একটি দরজা, জানলা নেই, এক ঝাক মাছি ভনভন করছে সেখানে। উত্তাপে মেয়েটির গলা ও বক্ষের সব জখমগুলোই সেপটিকে পঁড়িয়েছে এবং ডাক্তারী সহায়তা যোগাড় করা যাক বা না যাক, ওর বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম; তাই সাহায্যের চেষ্টায় যাওয়ার পরিবর্তে আমি লোকটির সঙ্গে রাতটা থাকা ঠিক করলাম। চিতা অথবা বাঘ গলা কামড়ে ধরার দুর্ভাগ্য যে মানুষ বা জানোয়ারের হয়েছে, তার যন্ত্রণা চোখে দেখার অথবা কানে শোনার দণ্ড যেন যাঁরা এ কাহিনী পড়ছেন তাদের কখনো না হয়, এ আমি আন্তরিক কামনা করি–বিশেষ, যখন সে যন্ত্রণা কমাতে বা শেষ করতে একটি বুলেট ব্যতীত অন্য উপায় হাতে নেই।
ঝুলবারান্দাটি ঘিরে আছে সারা বাড়িটি; দু-মুখেই তার তক্তা আঁটা; সেটি প্রায় পনের ফুট লম্বা আর চার ফুট চওড়া; একটি পাইন চারাগাছে খাঁজকাটা সিঁড়ি দিয়ে তাতে ওঠা যায়। এই সিঁড়িগুলির মুখে মুখে হচ্ছে বাড়ির একটি দরজা, আর ঝুলবারান্দার নিচে জ্বালানী কাঠ রাখার জন্য চার ফুট লম্বা ও চার ফুট চওড়া একটি উন্মুক্ত খুপরি।
ওর স্ত্রী এবং ওর সঙ্গে ঘরে থাকতেই আমাকে অনুরোধ জানাল লোকটি কিন্তু তা করা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে; কেন না যদিও আমি পিটপিটে নই তবু ঘরের ভেতর গন্ধ একেবারে প্রচণ্ড তীব্র এবং আমার সহ্যসীমার বাইরে। তাই ঝুলবারান্দার নিচের খুপরির একপাশ থেকে ও আর আমি জ্বালানী কাঠ সরিয়ে একটু ছোট্ট জায়গা বের করলাম, সেখানে আমি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসতে পারি। এখন রাত ঘনিয়ে আসছে তাই কাছের একটি ঝরনা থেকে হাত মুখ ধুয়ে জল খেয়ে আমি বসে গেলাম নিজের কোণটিতে আর লোকটিকে বললাম স্ত্রীর কাছে যেতে, ঘরের দরজা খুলে রাখতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ও শুধোল, চিতাটা তো আপনাকে নির্ঘাত মারবে সাহেব, তখন আমি কি করব? আমি জবাব দিলাম, দরজা বন্ধ করে দেবে আর সকাল হবার অপেক্ষা করবে।
চাঁদ পূর্ণিমায় পৌঁছতে তখনো দু-রাত বাকি আর এখনো সংক্ষিপ্ত সময়কাল অন্ধকার থাকবে। এই অন্ধকারের সময়টুকু উদ্বিগ্ন করছিল আমাকে। লোকটি যেমন বলেছে, চিতাটা যদি সেইমত সকালের আলো ফোঁটা অব্দি দরজা আঁচড়ে থাকে, ওটা খুব দূরে যাবে না; এখনো ওটা ঝোপগুলোর ভেতরে ওৎ পেতে থাকতে পারে আমার ওপর নজর রেখে। এক ঠায়ে রইলাম আমি আধঘণ্টা, অন্ধকারায়িত রাতের ভেতর চোখ চালিয়ে চালিয়ে, পুবের পাহাড়গুলোর ওপর চাঁদ উঠুক এ প্রার্থনা জানাতে জানাতে, তখন একটা শেয়াল বিপদ সংকেতের ডাক ডা। প্রাণীটির ফুসফুসের সকল শক্তি দিয়ে ডাকা এ ডাক শোনা যায় বহুদুর ঝোপে; একে বর্ণনা করা যায় ‘ফিয়াও!’ ‘ফিয়াও’ বলে; যে বিপদ শেয়ালটিকে শঙ্কিত করছে তা যতক্ষণ দৃষ্টিগোচর থাকে ততক্ষণ ডাকটি বারবার হতে থাকে। উদ্দিষ্ট শিকারকে মৃগয়া করার অথবা তার কাছে আসার সময়ে চিতা চলে খুব মন্দবেগে; ধরে নিচ্ছি এটা মানুষখেকোটাই, আর এটা আমাদের মাঝখানের আধমাইলটুকু পেরোবার আগে বহু মিনিট কাটবে; আর যদি এর মধ্যে চাঁদ ওপরে নাও ওঠে তবু গুলি ছোঁড়ার মত যথেষ্ট আলো চাঁদ দেবে, তাই আমি আরেকটু সহজভাবে নিজেকে আলগা করতে ও নিশ্বাস নিতে পারলাম।
মিনিটগুলো চলল টেনে টেনে। শেয়ালটা ডাক থামাল। পাহাড়ের ওপরে উঠে গেল চাঁদ আমার সামনের জমিতে অত্যুজ্জ্বল আলোর বান ডাকিয়ে। কোথাও কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ে না আর আমার ওপরে নিঃশ্বাসের জন্য হতভাগ্য মেয়েটির যন্ত্রণার্ত ব্যাকুলতাই সারা পৃথিবীতে একটি শব্দ, যা শোনা যাচ্ছে। মিনিট গড়িয়ে দাঁড়াল ঘণ্টায়। চাঁদ উঠে গেল অমরায় তারপর নামতে শুরু করল পশ্চিমে, যে জমির ওপর নজর রেখে আছি তাতে বাড়িটির ছায়া ফেলে। বিপদের আরেক সময়কাল, কেননা চিতাটা, যদি আমায় দেখে থাকে, তবে এই দীর্ঘায়মান ছায়াগুলি ওর নড়াচড়াকে গোপন করবে বলে ও অপেক্ষা করবে চিতার স্বভাব-ধৈর্য্যে। কিছুই ঘটল না। বার ঘন্টা আগে, আশপাশের যেখানে চাঁদ উঠেছিল, সে জায়গাটি সূর্যালোকে দীপ্ত হল।
তার আগের রাত পাহারা জাগার পর লোকটি প্রগাঢ় ঘুম ঘুমিয়েছিল, এবং আমি যখন আমার কোণটি ছেড়ে আমার ব্যাথাকনকনে হাড়গুলোকে আরাম দিচ্ছি–যাঁরা কঠিন মাটিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিস্পন্দ বসে থেকেছেন, শুধু তারাই জানবেন হাড় কেমন কনকন করতে পারে–লোকটি সিঁড়ি ধরে নেমে এল। সামান্য কয়েকটি বুনো র্যাম্পবেরি ছাড়া আমি চব্বিশ ঘণ্টায় কিছুই খাই নি; এবং আর বেশি সময় থাকলে কোনো প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না, তাই আমি লোকটিকে বিদায় জানালাম আর মেয়েটির জন্যে সাহায্য তলব করতে ও আমার লোকজনের সঙ্গে ফিরে জুটতে আমি আট মাইল দুরে ডোল ডাকবাংলোয় রওনা হলাম। মাত্র কয়েক মাইল গিয়েছি, আমার লোকজনের সঙ্গে দেখা হল। আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে শঙ্কিত হয়ে ওরা আমার জিনিসপত্র গুছিয়েছে, ডাকবাংলোয় আমার দেয় টাকা মিটিয়েছে, তারপর আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। ওদের সঙ্গে যখন কথা বলছি, তখন যে রোড ওভারশিয়ারের কথা আমার মন্দিরের বাঘের গল্পে বলেছি, তিনি এলেন। একটি গাঁট্টাগোট্টা ভুটিয়া টাট্টতে বসেছিলেন উনি, এবং উনি চলেছেন আলমোড়ার পথে–স্টিফের কাছে আমার একটি চিঠি পৌঁছে দেবার ভার উনি সানন্দে নিলেন। আর চিঠি পেয়ে স্টিফ মেয়েটির জন্যে চিকিৎসা সহায়তা পাঠায় তবে যখন তা এসে পৌঁছল তখন মেয়েটির যন্ত্রণার অবসান ঘটেছে।
এই রোড ওভারশিয়ারই আমাকে সেই মানুষ মারা পড়ার খবর দেয় যে জন্যে আমি দাবিধূরায় যাই; আমার এ-তাবৎ যত শিকার অভিজ্ঞতা ঘটেছে তার মধ্যে অন্যতম সর্বাধিক চিত্তাকর্ষক ও উত্তেজক একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেখানে। সে অভিজ্ঞতার পর আমি দাবিধূরা মন্দিরের বৃদ্ধ পুরোহিতকে প্রশ্ন করি, আমি যে বাঘটিকে মারতে ব্যর্থ হলাম, নরখাদকটি সে বাঘের মতই কার্যকরী বরাভয় পেয়ে থাকে না কি তার মন্দির থেকে, এবং তিনি উত্তর দেন, “না না সাহেব। এই শয়তানটি বহুজনকে মেরেছে, তারা আমার মন্দিরে পুজো করত এবং আপনি যা করবেন বলে বলছেন, ওকে মারতে ফিরে আসবেন যখন, আমি সকালে সাঁঝে আপনার সাফল্যের জন্য প্রার্থনা জানাব।
.
০২.
আমাদের জীবন যত সুখে পরিপূর্ণ হয়ে থাকুক না কেন, কোনো কোনো সময় আছে, তার দিকে ফিরে চাই আমরা বিশেষ কৃতজ্ঞতায়। ১৯১০ বছরটি আমার কাছে তেমনি এক সময়, কেননা সে বছরই আমি মুক্তেশ্বরের মানুষখেকো বাঘ ও পানারের মানুষখেকো চিতাকে মারি, এবং দুইয়ের মাঝামাজি–আমার কাছে তা দারুণ এক ব্যাপার–আমার লোকজন ও আমি মোকামাঘাটে কোনো যন্ত্রীর সহায়তা ব্যতীত একটি কাজের দিনে পাঁচ হাজার পাঁচশো টন মাল ওঠানো নামানো করে এক সর্বকালীন রেকর্ড স্থাপন করি।
পানারের চিতাকে মারার জন্য আমার প্রথম প্রচেষ্টা করা হয়েছিল ১৯১০ সালের এপ্রিলে; আর দ্বিতীয় প্রচেষ্টা করার জন্য আমি সে বছরের সেপ্টেম্বরের আগে সময় দিতে পারি নি। এপ্রিল ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে চিতাটির দ্বারা কতজন মানুষ নিহত হয় আমার কোনো ধারণাই নেই, কেননা সরকার কর্তৃক কোনো বুলেটিন প্রকাশিত হত না এবং হাউস অফ কমসে জিজ্ঞাসিত প্রশ্নগুলির বাইরে-আমার যতদূর জানা আছে চিতাটির বিষয়ে ভারতীয় সংবাদপত্রসমূহে কোনো উল্লেখ করা হয় নি। রুদ্রপ্রয়াগের চিতার দ্বারা নিহত একশো পঁচিশজনের বিপক্ষে পানারের চিতাটিকে চারশো মানুষ মেরেছে বলে দায়ী করা হয়; এবং প্রথমটি এত সামান্য প্রচারকার্য আকর্ষণ করে যখন পরেরটি ভারতের সর্বত্র প্রধান সংবাদের সম্মান পায় এ ঘটনাদি সম্পূর্ণ এই কারণে; যে বহুল ব্যবহৃত পথ থেকে বহুদূরের এক দুর্গম অঞ্চলে পানারের চিতা কার্যকলাপ চালিয়েছিল, যখন রুদ্রপ্রয়াগের চিতা কার্যকলাপ চালাচ্ছিল এমন এক অঞ্চলে যেখানে প্রতি বছর যেত দেশের নগণ্যতম থেকে শুরু করে উচ্চতম পর্যন্ত ষাট হাজার তীর্থযাত্রী এবং তাদের সকলকেই মানুষখেকোটির প্রদত্ত শাস্তি ভোগ করতে হত। এই তীর্থযাত্রীরা এবং সরকার কর্তৃক প্রকাশিত দৈনিক বুলেটিন রুদ্রপ্রয়াগের চিতাকে এমন বিখ্যাত করে তুলেছিল, যদিও পানারের চিতাটির চেয়ে এটি মানুষের কম যন্ত্রণা ঘটিয়েছিল।
পানারের চিতাকে মারার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা কালে ১০ই সেপ্টেম্বর আমি নৈনিতাল থেকে যাত্রা করলাম একটি ভৃত্য ও আমার ভাবুর সাজসরঞ্জাম ও রসদবাহী চারজন লোক সহ। ভোর চারটেয় যখন বাড়ি ছেড়ে বেরোই তখনি আকাশ ছিল মেঘনিবিড় এবং আমরা সবে সামান্য কয় মাইল গিয়েছি, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। সারাদিন ধরে বৃষ্টি পড়ল আর ভিজে জুবজুবে হয়ে আটাশ মাইলের এক পদযাত্রা করে আমরা পৌঁছলাম আলমোড়া। আমার সে রাতটা স্টিফের সঙ্গে কাটাবার কথা কিন্তু পরার মত এক সুতো শুকনো পোশাকও ছিল না বলে আমি মাপ চাইলাম এবং রাতটা কাটালাম ডাকবাংলোয়। সেখানে আর কোনো যাত্রী ছিল না এবং ভারপ্রাপ্ত লোকটি অতীব দয়ায় আমাকে দুটি কামরা ছেড়ে দিল; দুটোতেই গনগনে কাঠের আগুন ছিল এবং এবং সকালের মধ্যে যাত্রা করে চলার পক্ষে আমার মালপত্র যথেষ্ট শুকিয়ে গেল।
এপ্রিলে যে পথে গিয়েছি আলমোড়া থেকে সেই একই পথে যাওয়া এবং যে বাড়িতে মেয়েটি জখম থেকে মারা গিয়েছিল সেই বাড়ি থেকে চিতাটি শিকারাভিযান শুরু করা আমার উদ্দেশ্য ছিল। নৈনিতালে আমাদের ছুটছাট কাজ করত পানোয়া নামে এক মিস্ত্রী, আমি যখন প্রাতরাশ খাচ্ছি সে এসে হাজির হল। পানোয়ার বাড়ি পানার উপত্যকায় এবং আমি মানুষখেকোটিকে শিকার করার চেষ্টায় চলেছি এ কথা আমার লোকজনের কাছে জেনে সে আমাদের দলে যোগদানের অনুমতি চাইল; কেননা সে বাড়ি যেতে চায় আর একা যাবার ঝুঁকি নিতে ভয় পাচ্ছে। পানোয়া তল্লাটটি চেনে, ওর পরামর্শে আমি পরিকল্পনা পালটালাম এবং দাবিধূরার পথ ধরে যে স্কুলে চিতা আমার রাতের খানা খেয়েছিল তা হয়ে না গিয়ে আমি পিথোরগড়ের যাত্রী পথটি ধরলাম। রাতটা পানোয়ানালার ডাকবাংলোয় কাটিয়ে পরদিন সকালে খুব ভোর-ভোর রওনা হলাম এবং কয়েক মাইল এগগাবার পর ডান দিক নির্দেশকারী এক পায়েচলা পথ ধরতে পিথোরগড় রোড ছাড়লাম। আমরা এখন মানুষখেকোটির রাজ্যসীমায়, সেখানে কোনো পথ নেই, গ্রাম থেকে গ্রামে যাবার পায়েচলা পথই হল একমাত্র সংযোগব্যবস্থা।
অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর কেন না তল্লাটের বহু শত বর্গমাইল ব্যাপী গ্রামগুলি অত্যন্ত ছড়ানো ছেটানো এবং যেহেতু মানুষখেকোটির সঠিক ঠিকানা জানা নাই সেহেতু খোঁজখবর নিতে প্রতিটি গ্রামে যাওয়া প্রয়োজন হল। সালা বরগোত পট্টি (কয়েকটি গ্রাম নিয়ে পট্টি গঠিত) দিয়ে গিয়ে চতুর্থ দিনের সন্ধ্যা শেষে পৌঁছলাম চাকাতিতে; সেখানে গ্রামমোড়লের কাছে জানলাম পানার নদীর দূর পার্শ্ব অঞ্চলে সানেলি নামে এক গ্রামে কয়েকদিন আগে একটি মানুষ মারা পড়েছে। সম্প্রতি প্রচুর বর্ষণের কারণে পানার নদীতে বান ডেকেছে এবং গ্রামমোড়ল আমাকে ওর গ্রামে রাত কাটাতে পরামর্শ দিল; পানার নদীতে সেতু নেই তাই নদী পেরোবার একমাত্র নিরাপদ জায়গাটি দেখাবার জন্য পরদিন সকালে এক পথপ্রদর্শক সঙ্গে দেবার প্রতিশ্রুতি দিল ও।
এক সারবন্ধ দোতলা বাড়ির এক প্রান্তে আমি আর গ্রামমোড়ল কথাবার্তা কইছিলাম আর যখন তার পরামর্শে আমি এ গ্রামে রাত কাটাব বলে ঠিক করলাম, ও বলল, ওপরতলায় আমার এবং আমার নোকজনের জন্যে ও দুটি ঘর খালি করিয়ে দেবে। ওর সঙ্গে কথা কইবার সময়েই আমি লক্ষ করেছিলাম একতলার শেষ কামরাটিতে কোনো বাসিন্দা নেই; তাই আমি তাকে বললাম আমি এই ঘরে থাকব এবং আমার লোকদের জন্যে ওপরতলার একটি কামরা খালি করিয়ে দিলেই হবে। যে কামরায় থাকব ঠিক করলাম তাতে কোনো দরজা নেই কিন্তু তাতে এসে যায় নি কিছু, কেননা আমাকে বলা হয়েছিল শেষ মানুষটি মারা পড়েছে নদীর দূর পার্শ্ব অঞ্চলে এবং আমি জানতাম, নদীটিতে যখন বান ডেকেছে তখন মানুষখেকোটি তা পেরোবার কোনো চেষ্টাই করবে না।
ঘরটিতে কোনোরকম আসবাবই ছিল না এবং সে ঘর থেকে সমস্ত খড় ও ন্যাকড়ার টুকরো বঁট দিয়ে বের করল আমার লোকজন; করতে করতে অভিযোগ করল শেষ বাসিন্দাটি নিশ্চয় বেজায় নোংরা এক লোক; ওরা মাটির মেঝেতে আমার শতরঞ্জি বিছাল ও আমার বিছানা পাতল। উঠোনে খোলা জায়গায় আগুন জ্বেলে ভৃত্য আমার খানা বানাল, আমি তা বিছানায় বসেই খেলাম; আর যে বার ঘন্টা সিধে হয়ে ছিলাম তাতে আমি যেহেতু প্রচুর হাঁটা হেঁটেছি, ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হল না আমার। পরদিন সকালে ঘরটি আলোয় ভাসিয়ে সূর্য সবে উঠছে, তখন ঘরে একটা ছোট্ট আওয়াজ শুনে আমি চোখ খুললাম এবং আমার বিছানার কাছে মেঝেতে একটি লোককে বসে থাকতে দেখলাম। তার বয়স বছর পঞ্চাশেক, আর সে তখন কুষ্ঠ রোগের শেষ পর্যায়ে। আমি জেগেছি দেখে এই হতভাগ্য জীবমৃতটি বলল, ও আশা করছে ওর ঘরে আমি আরামেই রাত কাটিয়েছি। ও বলে চলল, এক সংলগ্ন গ্রামে দু-দিন ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল এবং ফিরে এসে ওর কামরায় আমাকে ঘুমোতে দেখে আমার বিছানার কাছে বসেছিল এবং আমার জাগবার অপেক্ষা করছিল।
প্রাচ্যের সকল ব্যাধির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক, সবচেয়ে ছোঁয়াচে এই কুষ্ঠ। কুমায়ুনের সর্বত্র অতি ব্যাপক, বিশেষত আলমোড়া জেলায় তা বিশেষ বিদ্যমান। ভাগ্যবাদী হওয়ার দরুণ জনসাধারণ ব্যাধিটিকে ঈশ্বরের অভিশাপ বলে দেখে এবং না করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পৃথক, না করে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কোনো সাবধানতা অবলম্বন। তাই, স্পষ্টতই গ্রামমোড়লটি আমাকে সতর্ক করা প্রয়োজন মনে করে নি, যে ঘরটি আমি থাকব বলে নির্বাচন করেছি তাতে বহু বছর ধরে এক কুষ্ঠরোগীর আবাস। সেই সকালে পোশাক পরে নিতে দেরি হল না আমার এবং আমাদের পথপ্রদর্শক প্রস্তুত হতেই আমরা গ্রাম ছাড়লাম।
কুমায়ুনে যেমন ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি, বরাবরই কুষ্ঠ বিষয়ে ভয় করেছি আমি, এবং সেই গরিব হতভাগ্যের ঘরে রাত কাটিয়ে আমার যেমন নোংরা বোধ হচ্ছিল, তেমনটি আর কখনো হয় নি। প্রথম নদীটিতে পৌঁছেই ভৃত্য আমার প্রাতরাশ প্রস্তুত করবে বলে এবং আমার লোকজন খেয়ে নেবে বলে যাত্রা স্থগিত করলাম। লোকজনকে আমার শতরঞ্জি ধুতে ও আমার বিছানা রোদে মেলে দিতে বলে আমি কার্বলিক সাবানের একটি বার নিলাম, এবং বড় বড় পাথরের চাঁইয়ে ঘিরে নদীটিতে যেখানে ছোট্ট একটি জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে, চলে গেলাম সেখানে। ও ঘরে যে জামাকাপড় পরেছিলাম সেগুলি সব খুলে ফেলে ধুলাম জলাশয়ে এবং পাথরের চাঁইয়ে তা মেলে দিয়ে, নিজেকে আগে কখনো যেমন করে ঘসি নি তেমনি করে ঘসে বাকি সাবানটুকু খরচ করলাম। এই কড়া ধোলাইয়ের পর পোশাকগুলো খানিক কুঁচকাল, দু ঘণ্টা বাদে তাই পরে লোকজনদের কাছে ফিরে এলাম আমি; আবার নিজেকে পরিষ্কার বোধ হল, আর প্রাতরাশের খিদেটা হল শিকারীজনোচিত।
আমাদের পথপ্রদর্শক প্রায় চারফুট ছ ইঞ্চি লম্বা একটি মানুষ, তার মস্ত মাথায় একরাশ লম্বা চুল, মস্ত পিপের মত শরীর, খাটো পা এবং কম কথার মানুষ ও। যখন জিজ্ঞেস করলাম খুব খাড়া চড়াই ভাঙতে হবে কি না, ও মুখ খুলে হাতটি মেলে দিয়ে জবাব দিল, এই রকম সমানে যাব। এ কথা বলেই ও আমাদের নিয়ে গেল এক অত্যন্ত খাড়াই পাহাড়ের উত্রাইয়ের গভীরে এক উপত্যকায়। আশা করেছিলাম এখানে ও, মোড় ঘুরবে এবং যেখানে নদী ও উপত্যকার সঙ্গমস্থল, উপত্যকাটি হেঁটে সেখানে যাব। কিন্তু না। একটি কথা না বলে, একবারও মাথা না ফিরিয়ে ও ফাঁকা জায়গাটি পেরোল এবং ও প্রান্তের পাহাড় ধরে সিধে উঠে গেল। অত্যন্ত খাড়াই এবং কাটা ঝোপে ঢাকার ওপর এ পাহাড়ে ছিল আলগা নুড়িপাথর, তাতে চলা খুব কষ্টকর হচ্ছিল আর সূর্য যেহেতু মাথার ওপর, রোদ বেজায় চড়া, আমরা ঘামে নেয়ে পাহাড়ের চূড়োয় পৌঁছলাম। আমাদের পথপ্রদর্শকটির কিছুই হয় নি, ওর ঠ্যাং দুটো মনে হল পাহাড় চড়ার জন্যেই তৈরি।
পাহাড়ের চুড়ো থেকে চারধার সুবিস্তীর্ণ দেখা যাচ্ছিল, এবং যখন পথপ্রদর্শকটি জানাল, পানার নদীতে পৌঁছবার আগে আমাদের এখনো সামনের জমির দুটি উঁচু পাহাড়ে চড়তে হবে; পানোয়া, সেই মিস্ত্রী, ওর পরিবারের জন্যে উপহারাদির একটা পোঁটলা এবং ভারি গাঢ়রঙের কাপড়ে তৈরি একটা ওভারকোট বইছিল–সে কোটটি পথপ্রদর্শককে দিল এবং বলল, যেহেতু সে আমাদের কুমায়ুনের সকল পাহাড়ে চড়তে বাধ্য করছে, যেহেতু বাকি পথটা ওই ওভারকোটটি বইতে পারে। শরীরে জড়িয়ে রাখা একগাছা ছাগলের লোমের রশি খুলে নিয়ে পথপ্রদর্শকটি কোটটি ভাঁজ করে পিঠে বেঁধে নিল আঁট করে। ওপর থেকে নিচে এবং নিচ থেকে ওপরে আমরা চললাম, তারপর নিচে, দূরে, এক উপত্যকার গভীরে দেখলাম নদীটি। এ পর্যন্ত আমরা হেঁটেছি পথচিহ্নহীন মাটিতে, একটি গ্রামও চোখে পড়ে নি, কিন্তু এখন আমরা পৌঁছলাম এক সংকীর্ণ পথে, তা সিধে পৌঁছেছে নদীতে। নদীর যত কাছে এলাম আমরা, নদীর চেহারা তত কম পছন্দ হল আমার। যে পথটি জল অব্দি, এবং জলের ওপার দিয়ে গেছে, তার চেহারায় মালুম হল এখানে একটি পারঘাট ছিল, কিন্তু নদীতে এখন বান, আমার মনে হল পার হওয়া খুব বিপজ্জনক হবে। তবে পথপ্রদর্শকটি ভরসা দিল পার হওয়া সম্পূর্ণই নিরাপদ, তাই আমার জুতো মোজা খুলে . আমি পানোয়ার হাতে হাত জড়িয়ে জলে নামলাম। নদীটি আন্দাজ চল্লিশ গজ চওড়া এবং তার বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ দেখে আমার মনে হল খুব এবড়োখেবড়ো বুকের ওপর বইছে নদীটি। এ আমি ঠিকই ধরেছিলাম, এবং কয়েকবার পায়ের আঙুলে মোচড় খেয়ে, পা হড়কে ভেসে যাওয়া কোনোমতে বাঁচিয়ে আমরা কোনোরকমে দুরের পাড়ে উঠলাম।
পথপ্রদর্শকটি আমাদের পেছু পেছু নদীতে নেমেছিল। এবং পিছন ফিরে চেয়ে দেখি ছোটখাট মানুষটি বিপদে পড়েছে। যে জল আমাদের ক্ষেত্রে উরু অব্দি গভীর, সে ওর ক্ষেত্রে কোমর-জল, এবং মুখ্য নদীস্রোতে পৌঁছে স্রোতের বিরুদ্ধে পিঠ ঠেকিয়ে কাঁকড়ার মত বেঁকে না হেঁটে অত্যন্ত বোকার মত ও স্রোতের মুখোমুখি দাঁড়াল; ফল হল ও পিছনে উলটে পড়ল এবং দ্রুত স্রোতে ভেসে গেল। আমার পা খালি, ধারাল পাথরের ওপর আমি অকেজো, কিন্তু পানোয়ার কাছে ধারাল পাথর কোনো বাধাই নয়; যে পোঁটলা বইছিল তা ফেলে দিল ও এবং এক লহমাও ইতস্তত না করে ও ছুটল নদীর পাড় ধরে; সেখানে আরো পঞ্চাশ গজ ভাটিতে এক ভয়াবহ নদীপ্রপাতের মুখে একটা বিশাল পাথরের চাই নদীর ওপরে ঝুলে এগিয়ে আছে। দৌড়ে এই ভিজে ও পিছলে পাথরে উঠে পানোয়া উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল এবং ডুবন্ত লোকটি যখন ভেসে বেরিয়ে যাচ্ছে, পানোয়া চেপে ধরল ওর লম্বা চুল এবং মরিয়া লড়াই করে ওকে সে-পাথরে টেনে ওঠাল। ওরা দুজন যখন আমার কাছে আবার এল–পথপ্রদর্শকটিকে ডোবা ইঁদুরের মত দেখাচ্ছিল–নিজের জীবন অত্যন্ত বিপন্ন করে এই ছোট্ট মানুষটির প্রাণ বাঁচাবার জন্য আমি পানোয়াকে তার মহান দুঃসাহসিক কাজের জন্য প্রশংসা করলাম। কিছুক্ষণ সবিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে থেকে পানোয়া বলল, ‘আরে, ওর জীবন নয়, ওর পিঠে আমার যে নতুন কোট বাঁধা ছিল তাই বাঁচাচ্ছিলাম আমি! যাক, সে উদ্দেশ্য যাই হক না কেন, একটা ট্রাজিডী বাঁচানো গেছে, এবং আমার লোকজন হাতে-হাত বেঁধে নিরাপদে পার হবার পর আমি ঠিক করলাম আজ ক্ষান্ত দেওয়া যাক এবং নদীর পাড়ে রাতটা কাটানো যাক। নদীর উজানে পাঁচ মাইল দূরে পানোয়ার গ্রাম, ও এখন আমায় ছেড়ে চলে গেল, সঙ্গে নিয়ে গেল পথপ্রদর্শককে, সে দ্বিতীয়বার নদী পেরোতে ভয় পাচ্ছিল।
.
০৩.
যেখানে শেষ মানুষটি মারা পড়েছে, পরদিন সকালে আমার সেই সানৌলি খুঁজতে বেরোলাম। সেদিন সন্ধ্যাশেষে আমরা পৌঁছলাম, এক বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত উপত্যকায়; আর যেহেতু কোনো জনপদ চোখে পড়ল না, রাতটা ফাঁকা জমিতে কাটাব স্থির করলাম। আমরা এখন মানুষখেকোর দেশের একবারে মধ্যিখানে, এবং ঠাণ্ডা, ভিজে মাটিতে এক অত্যন্ত অস্বস্তিকর রাত কাটিয়ে দুপুর নাগাদ পৌঁছলাম সানৌলিতে। এই ছোট্ট গ্রামের বাসিন্দারা আমাদের দেখে অতি আহ্লাদিত হল এবং সানন্দে আমার লোকজনকে ছেড়ে দিল একটি ঘর এবং খড়ের চালের নিচে এক খোলা চাতালে আমায় থাকতে দিল।
গ্রামটি গড়ে উঠেছে একটি পাহাড়ের গায়ে; পাহাড়ের মুখোমুখি একটি উপত্যকা; উপত্যকাটিতে আলবাঁধা ধাপ-কাটা খেত; খেত থেকে সম্প্রতি এক ফলন ধান কাটা হয়েছে। উপত্যকার দূর প্রান্তে পাহাড়টি অতি ধীর ঢালে উঠেছে; এবং আবাদী জমি থেকে একশো গজ দূরে প্রায় ষাট বিঘা জুড়ে এক নিরেট খণ্ড গুলুবন। এই গুল্মবন-খণ্ডের ওপরে শৈলপ্রান্তে একটি গ্রাম, আর ডাইনে পাহাড়ের ঢালে আরেকটি গ্রাম। ধাপ-কাটা খেতগুলি বাঁয়ে উপত্যকাটি বেঁধে ফেলেছে একটি ঘাস ঢাকা খাড়া পাহাড়। তাই, আসলে, গুল্মবন-খণ্ডটি তিন দিকে আবাদী জমিতে ঘেরা, চতুর্থ দিকে উন্মুক্ত ঘেসো জমি।
প্রাতরাশ যখন তৈরি হচ্ছে, গ্রামের লোকেরা আমায় ঘিরে বসে কথা কইতে থাকল. মার্চের দ্বিতীয়ার্ধ এবং এপ্রিলের প্রথমার্ধে এ অঞ্চলে চারটি মানুষ নরখাদকটির হাতে নিহত হয়েছে। পাহাড়ের গায়ের গ্রামে প্রথম মানুষটি মারা পড়ে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জন মারা পড়ে শৈলপ্রান্তের গ্রামে, চতুর্থ জন সানৌলিতে। চারজন নিহতই মারা পড়ে রাতে, পাঁচশো গজ টেনে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় গুল্ম বনখণ্ডে, সেখানে চিতাটি তাদের খায় ধীরে সুস্থে; কেননা কোনো আগ্নেয়াস্ত্র না থাকায়, মৃতদেহ উদ্ধারের কোনো প্রচেষ্টা চালাতে তিনটি গ্রামের বাসিন্দাই খুব ভয় পেয়েছিল। ছয়দিন আগে শেষ মানুষটি মারা পড়েছে এবং আমার তথ্যদাতারা স্ববিশ্বাসে স্থির যে চিতাটি তখনো ওই গুল্মবন খণ্ডেই আছে।
সেদিন সকালের দিকে একটা গ্রাম দিয়ে আসি, আসার সময় আমি দুটি তরুণ মদ্দা ছাগল কিনেছিলাম, এবং সন্ধ্যার দিকে আমি ওর মধ্যে যেটি ছোট সেটিকে নিয়ে, চিতাটি ওর আড়ালেই আছে গ্রামবাসীদের এ ধারণা পরখ করতে আগাছা জঙ্গলের পথের কিনারে সেটিকে বেঁধে দিলাম। ছাগলটির টোপ ফেলে আমি বসলাম না কেননা কাছাকাছি কোনো উপযোগী গাছ ছিল না; মেঘও জমছিল আর দেখে মনে হল রাতে বৃষ্টি হতে পারে। আমার ব্যবহারের জন্য যে চাতালটি দেওয়া হয় সেটির চারপাশই খোলা; তাই তার কাছে আমি এই আশায় দ্বিতীয় ছাগলটি বাঁধলাম। ভাবলাম যদি রাতে চিতাটি গ্রামে এসে দেখা দেয়, তবে ছিবড়ে মাংসের একটা অব্দি দুটি ছাগলকে পরস্পর ডাকতে শুনলাম আমি। তাতে আমার আরো বিশ্বাস হল চিতাটি শ্রবণ-গোচর পাল্লার মধ্যে নেই। যাই হক, ও কেন এ অঞ্চলে ফিরবে না তার কোনো যুক্তি নেই; তাই যা হলে সবচেয়ে ভাল তারই প্রত্যাশা নিয়ে ঘুমোতে গেলাম আমি।
রাতে সামান্য এক পশলা বৃষ্টি পড়েছিল আর নির্মেঘ আকাশে সূর্য উঠল যখন, তখন প্রতিটি পাতা, ঘাসের প্রতিটি ডগা বৃষ্টি বিন্দুতে ঝলমল করছে এবং যে পাখিটির গান গাইবার গলা আছে, সে গান গেয়ে দিনটিকে আনন্দে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আমার চাতালের কাছের ছাগলটি তৃপ্তিতে একটি ঝোপে পাতা খুঁজছিল এবং মাঝে মধ্যে ডাকছিল, ওদিকে উপত্যকার ওধারের ছাগলটি মৌন। ভৃত্যকে আমার প্রাতরাশ গরম রাখতে বলে আমি উপত্যকা পার হলাম এবং যেখানে ছোট ছাগলটিকে বেঁধেছিলাম, সেই জায়গায় গেলাম। এখানে এসে দেখলাম, বৃষ্টি আসার কিছুক্ষণ আগে একটি চিতা ছাগলটিকে মেরেছে, রশি ছিঁড়েছে, এবং টেনে নিয়ে গেছে মড়ি। হেঁচড়ে নেবার দাগ বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে কিন্তু তাতে এসে যায় না কিছু, কেননা একটি মাত্র জায়গায় চিতাটি তার মড়ি নিয়ে গিয়ে থাকতে পারে আর তা হল এই নিবিড় আগাছার জঙ্গলে।
মড়িসহ চিতা অথবা বাঘের পেছু পেছু যাওয়া হচ্ছে, আমি যত রকম চিত্তাকর্ষক ধরন জানি শিকারের, তার মধ্যে অন্যতম একটি; তবে অবস্থা সকল যখন অনুকূল তখনি সাফল্যের কোন প্রত্যাশা মনে রেখে এতে রত হওয়া যায়। এখানে অবস্থাগুলি অনুকুল নয় কেননা নিঃশব্দে প্রবেশ করতে পারার পক্ষে আগাছার জঙ্গলটি অত্যন্ত নিবিড়। গ্রামে ফিরে এসে আমি প্রাতরাশ খেলাম, তারপর আশপাশের অঞ্চল বিষয়ে পরামর্শ করব বলে সব গ্রামবাসীদের একত্রে ডাকলাম। মড়িটি আমার দেখতে যাওয়া দরকার, কারণ চিতাটি শিকারে বসবার মতো যথেষ্ট হাড়গোড় রেখে গেছে কিনা তা দেখবার জন্য, এবং তা করতে গেলে চিতাটিকে বিরক্ত করা আমি এড়িয়ে যেতে পারব না। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে আমি যা জানতে চেয়েছিলাম তা হল, আমার দ্বারা বিরক্ত হলে যেখানে চিতাটি চলে যেতে পারে কাছাকাছির মধ্যে তেমন কোনো গা-ঢাকা দেবার মত ভাল জায়গা আছে কি না। আমাকে বলা হল দু মাইলের এদিকে তেমন কোনো জায়গা নেই, এবং সেখানে পৌঁছতে হলে চিতাটিকে অনেকখানি আবাদী জমি পেরোতে হবে।
দুপুরে আমি ফিরে গেলাম সেই আগাছার জঙ্গলে এবং যেখানে ওটাকে মেরেছে, তা থেকে একশো গজ দূরে পেয়ে গেলাম ছাগলটির যা কিছু ফেলে গেছে চিতাটি-খুর, শিং এবং পাকস্থলীর কিয়দংশ। যেহেতু দিনের এ সময়ে এ আশ্রয় ছেড়ে চিতাটির দু মাইল দূরের জঙ্গলে চলে যাবার ভয় নেই, অনেক ঘণ্টা ধরে বুলবুল, ফিঙে, দামা এবং ঠোঁটবাঁকা ছাতায়েদের সহায়তায় আমি চিতাটির খোঁজ পাবার চেষ্টা করলাম; ওরা সবাই চিতাটির প্রতিটি নড়াচড়ার খোঁজ দিচ্ছিল আমাকে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, কেন তিনটি গ্রামের পুরুষদের জড়ো করি নি আমি; তাদের বাধ্য করি নি চিতাটিকে হাঁকিয়ে ফাঁকা জায়গায় বের করতে; যেখানে সেটাকে গুলি করতে পারতাম; এ কথা বলা দরকার যে যারা বন হাঁকাবে তাদের অত্যন্ত বিপন্ন না করে সে চেষ্টা করা যেত না। যেই চিতাটি দেখত তাকে তাড়িয়ে ফাঁকা জমিতে বের করা হচ্ছে, সে পিছিয়ে পালাতে যেত এবং যে কেউ তার পথে বাধা সৃষ্টি করত, তাকেই করত আক্রমণ।
চিতাটিকে গুলি করার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর গ্রামে ফিরে ম্যালেরিয়ার বিশ্রী এক তাড়সে আমি কাত হলাম এবং পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা চাতালে পড়ে রইলাম আচ্ছন্নভাবে। পরদিন সন্ধ্যার মধ্যে জ্বর ছেড়ে গেল এবং আমি শিকারাভিযান চালাতে পারলাম। আগের রাতে নিজেদের উদ্যোগেই আমার লোকজন প্রথম ছাগলটি যেখানে মারা পড়ে সেখানে বেঁধে দিয়েছিল দ্বিতীয় ছাগলটিকে; কিন্তু চিতাটি সেটাকে ছোঁয় নি। এ খুব ভাল হল কেননা চিতাটি এখন ক্ষুধার্ত এবং আশাভরে আমি তৃতীয় সন্ধ্যায় যাত্রা করলাম।
আগাছার জঙ্গলের কাছাকাছি জায়গায়, দু রাত আগে যেখানে ছাগলটি নিহত হয়, সেখান থেকে আন্দাজ একশো গজ দূরে একটি বুড়ো ওক গাছ। দুটি ধাপ-কাট খেতের মধ্যের একটি ছ-ফুট উঁচু পাড় থেকে গজিয়েছে গাছুটি এবং এমন এক কোণ সৃষ্টি করে পাহাড়টি থেকে বাইরে হেলে আছে যে আমার পক্ষে রবারের সোলের জুতো পরে গুঁড়িটি বেয়ে হেঁটে ওঠা সম্ভব হল। গুঁড়িটির তলের দিকে এবং মাটি থেকে পনের ফুট উঁচুতে একটি ডাল নিচের খেতের ওপর দিয়ে এগিয়ে এসেছে। ডালটি এক ফুট আন্দাজ মোটা এবং ফাঁপা ও পচা বলে ওটার ওপর বসা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তবে, যেহেতু সে গাছে ওটিই একমাত্র ডাল, এবং যেহেতু বহুশত গজ বৃত্তের মধ্যে আর অন্য কোনো গাছ নেই তাই আমি ডালটিতে বসার ঝুঁকি নেওয়া স্থির করলাম।
আগাছার জঙ্গলে আমি যে থাবার ছাপ দেখি, এপ্রিলে যেখানে মেয়েটি নিহত হয় সেই খামার অভিমুখী পথের পাশে যে থাবার ছাপ দেখেছি, তার সঙ্গে এর মিল থাকাতে যে চিতার সঙ্গে আমি মোকাবিলা করছি সেই যে পানারের মানুষখেকো একথা বিশ্বাস করার সবরকম কারণ ছিল আমার। আমার লোকজনকে বেশ কিছু লতানে বনগোলাপের লম্বা কাটাসুদ্ধ ডগা কাটতে বললাম। গাছটির গায়ে ঠেস দিয়ে ডালে পা ছড়িয়ে বসার পর আমি ওদের দিয়ে কাটাডগাগুলোর বাণ্ডিল বাঁধালাম, সেগুলো গাছের গুঁড়িতে রাখালাম এবং শক্ত দড়ি দিয়ে সেগুলো গাছের গুঁড়ির সঙ্গে আঁট করে বাঁধালাম। আমার স্থির বিশ্বাস এই ছোট ছোট কাজগুলি দক্ষভাবে সম্পন্ন করার ওপরই আমার জীবন নির্ভর করছে।
দশ থেকে বিশ ফুট অবধি লম্বা অনেকগুলো কাটা-ডগা গাছের দুপাশে বেরিয়ে ছিল; এবং ভারসাম্য রক্ষার জন্য ধরার মত আমার কিছু ছিল না বলে আমি ডগাগুলো আমার দুদিকে টেনে নিলাম এবং আমার বাহু ও শরীরের মাঝখানে শক্ত করে চেপে রাখলাম। পাঁচটার মধ্যে আমার প্রস্তুতি খতম হয়ে গেল। গলাটা বাঁচাবার জন্য সামনে কোটের কলার ভাল করে তুলে, ঘাড়ের পেছনটা বাঁচাবার জন্যে আমার নরম টুপিটা পেছনপানে টেনে নামিয়ে গাছের ডালটিতে আমি শক্ত করে চেপে বসে থাকলাম। আমার সামনে তিরিশ গজ দুরে খেতে পোঁতা এক খুঁটিতে ছাগলটি বাঁধা এবং আমার লোকজন খেতে বসে ধূমপান করছিল ও জোরে জোরে কথা বলছিল।
এ পর্যন্ত সে আগাছার জঙ্গলে সবই ছিল চুপচাপ কিন্তু এখন একটি অসিছাতারে কান ফাটানো ডাকে আশঙ্কা-সংকেত জানাল এবং এক অথবা দুটি মিনিট বাদে তার অনুসরণে অনেকগুলো রসিক-দামা কিচমিচ করল। পার্বত্য অঞ্চলে সংবাদদাতাদের মধ্যে এই দুই প্রজাতির পাখি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং ওদের ডাক শুনে আমি ইশারায় আমার লোকজনদের গ্রামে ফিরতে বললাম। মনে হল, এ কাজটি করল তারা পরমানন্দে এবং জোরে জোরে কথা বলতে বলতে ওরা যেমন চলে যেতে থাকল, ছাগলটি শুরু করল ডাকতে। পরের আধ ঘণ্টা কিছুই ঘটল না এবং তারপর, গ্রামের উপরকার পাহাড়ে যেমন রোদ পড়ে আসছিল, আমার ওপরে গাছে যে দুটি ফিঙে বসেছিল তারা উড়ে গেল; আমার এবং আগাছার জঙ্গলের মাঝখানের ফাঁকা জমিতে কোন জানোয়ারকে ঠোকরাতে শুরু করল। ডাকার সময় ছাগলটি গ্রামের দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল এবং এখন সে মুখ ঘোরাল, আমার মুখোমুখি হল ও ডাকাডাকি থামাল। ফিঙেরা যাকে ঠোকরাচ্ছে, ছাগলটির আগ্রহ যাতে, সে জানোয়ারটির চলাফেরা আমি অনুসরণ করতে পারছিলাম ছাগলটিকে নজরে রেখে এবং একমাত্র চিতাই হতে পারে এই জানোয়ার।
চাঁদ ছিল তৃতীয় যামে এবং বহু ঘন্টা ব্যাপী অন্ধকার থাকবে। আলোর অবস্থা যখন অনুকূলে থাকবে না তখন চিতাটির আসার কথা অনুমান করে নিয়ে আমি নিজেকে সশস্ত্র করেছিলাম গুলি বোঝাই একটি টুয়ে-বোর দোনলা শটগানে; কেননা আটটি গুলিতে চিতাটিকে বিধবার সম্ভাবনা, একটি মাত্র রাইফেল বুলেটে বিধবার সম্ভাবনার চেয়ে আমার বেশিই। আমি যে সময়ের কথা লিখছি, তখন রাত-শিকারের সহায়ক হিসেবে ভারতে বিজলী বাতি ও টর্চ ব্যবহার হত না এবং সঠিক নিশানার জন্য নির্ভর করার জন্য ছিল শুধু অস্ত্রটির নলে জড়িয়ে বাঁধা এক ফালি সাদা কাপড়।
আবার বহু মিনিট ধরে কিছুই হল না, তারপর, আমি যে কাটা-ডগাগুলো ধরে আছি তাতে একটা আলতো টান পড়ল; এবং পূর্ব চিন্তাবশে হেলানে গাছটিতে কাটা-ডগাগুলো বেঁধেছি বলে আমি ধন্যবাদ দিলাম নিজেকে, কেননা নিজেকে বাঁচাতে আমি পিছু ফিরতে পারব না এবং যত ভালই হক, আমার কোট ও টুপির আমাকে বাঁচাবার ক্ষমতা সামান্যই। আমি এক মানুষখেকোর সঙ্গেই এবং এক অতি দৃঢ় সংকল্প মানুষখেকোর সঙ্গে মোকাবিলা করছি, এখন আর প্রশ্ন নেই তাতে। কাটার ওপর দিয়ে গাছে চড়তে পারবে না দেখে, প্রথম টান-মারার পর চিতাটি দাঁতে কামড়ে ধরেছে কাটা-ডগার গোড়াগুলো। সেগুলো ঝাঁকাচ্ছে সজোরে, আমাকে টেনে চেপে ধরেছে শক্ত করে গাছের গুঁড়ির গায়ে। এখন দিবালোকের শেষটুকও মিলিয়ে গেল আকাশ থেকে; চিতাটি তার সব মানুষকে শিকার করে অন্ধকারে, ও এখন স্বরাজ্যে সম্রাট, আমি তা নই কেননা অন্ধকারে মানুষ হল সকল প্রাণীর মতো সবচেয়ে অসহায়। এবং নিজের কথাই বলি–তখন সাহস খুব কমে যায়। চারশো মানুষকে রাতে মারার ফলে চিতাটি আমার বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্ভয়–যখন গোড়া ধরে টান মারছে, গ্রাম থেকে মানুষদের উদ্বেগে শোনার মত যথেষ্ট জোরে ও গরগর করছে এই ঘটনাই তার প্রমাণ। লোজনরা আমাকে পরে বলেছিল এ গরগরানি ওদের আতঙ্কিত করছিল, কিন্তু এখানে আমার ওপর হচ্ছিল বিপরীত প্রতিক্রিয়া কেননা তাতে আমাকে জানতে দিচ্ছিল চিতাটি কোথায় আছে এবং সে কি করছে। যখন সে চুপ করে থাকছিল তখনি আমি সব চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিলাম, কেননা আমি জানি না এরপরে ও কি করবে। সবলে গোড়াগুলিতে টান মেরে ও বহুবার আমাকে প্রায় ফেলে দিল আসন থেকে এবং হঠাৎ ওগুলো টানা ছেড়ে দিচ্ছিল; আর এখন যেহেতু অন্ধকার, শক্ত করে আঁকড়ে ধরার কিছু নেই আমারও নিশ্চিত মনে হল যদি লাফ মারে, আমাকে হুড়মুড়িয়ে মাটিতে ফেলে দেবার জন্য ওর আমাকে ছোঁবার ওয়াস্তা শুধু।
নৈঃশব্দের এমন এক স্নায়ু-ছিড়ে ফেলা বিরতির পর চিতাটি উঁচু পাড় থেকে লাফিয়ে নামল ও ছাগলটির দিকে তেড়ে গেল। শিকার করার মত যথেষ্ট আলো থাকতে থাকতেই চিতাটি আসবে এই আশায়, চিতাটি ছাগলটির ওপর গিয়ে পড়ার আগেই ওকে মারার সময় পাবার জন্যে আমি ছাগলটিকে গাছটা থেকে ত্রিশ গজ দূরে বেঁধেছিলাম। কিন্তু এখন এই অন্ধকারে আমি ছাগলটির প্রাণ বাঁচাতে পারলাম না-সাদা হওয়ার দরুণ আমি ওটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম অস্পষ্ট একটা ধ্যাবড়া দাগের মত–তাই ওটা লাফাঝাঁপি বন্ধ করা অব্দি আমি অপেক্ষা করলাম এবং যেখানে চিতাটা থাকবে বলে ভাবলাম সেদিকে তাক করে ট্রিগার টিপলাম। আমার গুলির জবাব দিল এক ক্রুদ্ধ গর্জন করে চিতাটি যেমন পেছনে পড়ে গেল ও আরেকটি উঁচু পাড়ের নিচে ওপারের খেতে মিলিয়ে গেল, আমি একটা সাদা ঝলক দেখলাম।
চিতাটির কাছ থেকে আরো আওয়াজের জন্য দশ বা পনের মিনিট আমি কান পেতে থাকলাম, এবং তখন আমার লোকজন চেঁচিয়ে ডাকল ও জিজ্ঞেস করল ওরা আমার কাছে আসবে কি না। ওরা যদি ভাঙা জমি ধরে আসে তাহলে ওদের আসা এখন সম্পূর্ণই নিরাপদ। তাই আমি ওদের পাইন কাঠের মশাল জ্বালাতে এবং আমার পরবর্তী নির্দেশ পালন করতে বললাম। জীবিত গাছ কেটে কেটে নেওয়া বার থেকে আটার ইঞ্চি লম্বা রজন-নিষিক্ত পাইন কাঠের টুকরোর এই মশালগুলি উজ্জ্বলে আলো দেয় এবং কুমায়ুনের সুদূরের গ্রামগুলিতে এই মশালগুলিই একমাত্র আলোকসজ্জা, যা ওরা জানে।
প্রচুর চেঁচামেচি, ছোটাছুটির পর আন্দাজ বিশ জন তোক প্রত্যেকে একটি মশাল নিয়ে গ্রাম ছেড়ে বেরোল এবং আমার নির্দেশ অনুসরণে ধাপ-কাটা খেতগুলি থেকে উঁচু জায়গা দিয়ে ঘুরে আমার গাছটির পেছন দিক থেকে এল। গাছের সঙ্গে কাটা বুনো গোলাপের ডগাগুলি বাঁধা দড়িটির গিঠগুলি চিতাটি টেনে এমন আঁট করে ফেলেছিল, যে সেগুলো কাটতে হল। কাটাগুলো সরিয়ে ফেলবার পর ওরা গাছে চড়ে আমাকে ধরে নামাল কেন না অসুবিধে করে বসার ফলে আমার পায়ে খিচ ধরেছিল।
সে ক্ষেতে নিহত ছাগলটি পড়েছিল, মশালের মিলিত আলো সেটি আলোকিত করে তুলল কিন্তু তার ওপারের ধাপ-কাটা খেতটিতে ছায়া। সিগারেট বিলি হবার পর আমি লোকদের বললাম যে আমি চিতাটিকে জখম করেছি তবে কত গুরুতর ভাবে তা জানি না; আমরা এখন গ্রামে ফিরব এবং আমি সকালে,জখম জানোয়ারটির খোঁজ করব। এতে গভীর আশাভঙ্গ প্রকাশ পেল। আপনি যদি চিতাটিকে জখম করে থাকেন, ওটা নিশ্চয় এতক্ষণে মরে গেছে। এখানে আমরা অনেকে আছি, আর আপনারও বন্দুক আছে একটা, তাই কোনো ভয় নেই। অন্তত খেতটার কিনারা যতটা তদূর অব্দি যাই আমরা আর দেখি চিতাটা রক্তের নিশানা রেখে গেছে কি না। চিতাটিকে এখনি খোঁজ করতে যাবার সপক্ষে ও বিপক্ষে সব যুক্তি ফুরিয়ে যাবার পর আমার সুবুদ্ধি যা বলে, সে বিচারবোধের বিরুদ্ধেই আমি খেতটির কিনারা অব্দি যেতে রাজী হলাম; সেখান থেকে আমরা নিচের ধাপ-কাটা খেতে চেয়ে দেখতে পারব।
ওদের অনুরোধ মেনে নেবার পর আমি লোকদের দিয়ে শপথ করালাম যে ওরা লাইন বেঁধে আমার পেছনে আসবে; ওদের মশালগুলো উঁচিয়ে ধরবে; যদি চিতাটা আক্রমণ করে আমাকে আঁধারে ফেলে রেখে পালাবে না। অতীব আগ্রহে ওরা কথা দিল এবং মশাল বদলে সেগুলি ভাল করে জ্বলার পর আমরা রওনা হলাম; আমি সামনে সামনে হাঁটতে থাকলাম, লোকজন পাঁচ গজ পেছনে আসতে লাগল।
ছাগলটির কাছে যেতে ত্রিশ গজ, খেতের কিনারে পৌঁছতে আরা বিশ গজ। খুব ধীরে, নীরবে আমরা সামনে এগোলাম। যখন ছাগলটির কাছে পৌঁছলাম, নিচের খেতটির দূর প্রান্তটি চোখে পড়ল, এখন আর রক্তের নিশানা খোঁজার সময় নেই। কিনারের যত কাছে এগোলাম, এই খেতটি আরো বেশি দেখা যেতে থাকল এবং যখন মশালের আলোর ওদিকে মাত্র এক সংকীর্ণ জমির ফালিতে শুধু ছায়া-চিতাটা ক্রমান্বয়ে ক্রুদ্ধ গর্জন করতে করতে পাড়ের ওপর লাফিয়ে উঠল এবং তার পুরোটাই দেখা গেল।
আক্রমণ করতে যাচ্ছে যে চিতা, তার ক্রুদ্ধ গর্জনে ভয়ংকর ভয়ধরানো কি যেন আছে, এবং যারা বাঘের সামনে নির্ভীক তেমন এক সার হাতিকে আমি দেখেছি আক্রমণোদ্যত চিতার সামনে ফিরে প্রাণভয়ে ইতস্তত পালাতে; তাই যখন আমার সঙ্গীরা–সকলেই তারা নিরস্ত্র–একসঙ্গে পেছন ফিরে পালাল, আমি অবাক হলাম না। আমার সৌভাগ্যক্রমে পালিয়ে যাবার ব্যস্ততায় ওদের পরস্পরে ধাক্কা লাগে ও ওদের হাতে আক্সা করে ধরা কয়েকটি জ্বলন্ত পাইন কাঠের চ্যালা মাটিতে পড়ে যায়, দপদপ করতেই থাকে এবং চিতাটির বুকে কতকগুলো গুলি বেঁধাবার জন্য আমাকে যথেষ্ট আলো দেয়।
আমার গুলি শুনে ওরা ছুট থামাল এবং আমি একজনকে বলতে শুনলাম, আরে না। উনি আমাদের উপর রাগ করবেন না, কেননা উনি জানেন, এ-শয়তানটা আমাদের সাহস জল করে দিয়েছে। হা, গাছের ওপর আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি যে মানুষখেকোর ভয় মানুষের সাহস কেড়ে নেয়। আর দৌড়নোর কথা, আমি যদি মশালধারীদের একজন হতাম, সেরা ছুটেয়েটির সঙ্গে ভাগতাম। তাই আমার রাগ করবার কিছুই ছিল না। ওদের অপ্রস্তুতি কাটাবার জন্যে আমি যখন চিতাটাকে খুঁটিয়ে দেখার ভান করছি, তখন অচিরে ওরা দুজন-তিনজন করে ফিরে এল। ওরা জড়ো হলে পরে আমি মুখ না তুলেই বললাম, চিতাটাকে গ্রামে বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে তোমরা একটা বাঁশের খুঁটি আর দড়ি এনেছিলে কি? ওরা সাগ্রহে জবাব দিল, “হ্যাঁ সেগুলো আমরা গাছের নিচে ছেড়ে এসেছি। আমি বললাম, “যাও, সেগুলো আন গে। কেননা এক কাপ গরমচায়ের জন্যে আমি গ্রামে ফিরে যেতে চাই। উত্তর থেকে বয়ে আসা শীতল রাতের বাতাস ম্যালেরিয়ার আরেকটি তাড়স এনেছে এবং সব উত্তেজনার অবসানে, পায়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতেই আমার কষ্ট হচ্ছিল।
বহু বছরের মধ্যে আজ রাতে এই প্রথম সানৌলির লোকরা সন্ত্রাস মুক্ত হয়ে রাত্তিরে ঘুমোল, এবং নির্ভয়ে তারা ঘুমুতে থাকল।