পরিশেষ – অতি সুখনিদ্রা! অতি শান্তি-দায়িনী নিদ্রা!
বৈদ্য বলিলেন,–এই যে নিদ্রাটি দেখিতেছেন, ইহা সুনিদ্রা। বিকারের ঘোর নহে। বিকার কাটিয়া গিয়াছে। নাড়ী পরিষ্কার হইয়াছে। এক্ষণে বাড়িতে যেন শব্দ হয় না! নিদ্রাটি যেন ভঙ্গ হয় না।–বৈদ্য প্রস্থান করিলেন। অঘোর অচৈতন্য হইয়া রোগী নিদ্রা যাইতে লাগিলেন। বাড়ীতে সকলেই চুপি চুপি কথা কহিতে লাগিলেন। বাড়ীতে পিপীলিকার পদশব্দটি পৰ্য্যন্ত নাই। মাতা কাছে বসিয়া রহিলেন। এক একবার কেবল কন্যার নাসিকার নিকট হাত রাখিয়া দেখিতে লাগিলেন, রীতিমত নিশ্বাস-প্রশ্বাস বহিতেছে কি না?
আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া, মা আজ বাইশ দিন কন্যার নিকট এইরূপে বসিয়া আছেন। প্রাণসম কন্যাকে লইয়া যমের সহিত তুমুল যুদ্ধ করিতেছেন। প্রবল বিকারের উত্তেজনায় কন্যা যখন উঠিয়া বসেন, মা তখন আস্তে আস্তে পুনরায় তাঁহাকে চুপ করিতে বলেন। সুধাময় মার বাক্য শুনিয়া বিকারের আগুনও কিছুক্ষণের নিমিত্ত নির্ম্মাণ হয়।
কন্যা নিদ্রিত! চক্ষু মুদ্রিত করিয়া আছেন। বহুদিন অনাহারে, প্রবল দুরন্ত জুরে, ঘোরতর বিকারে, দেহ এখন তার শীর্ণ, মুখ এখন মলিন। তবুও তার মধুর রূপ দেখিলে সংসার সুন্দর বলিয়া প্রতীতি হয়। মা সেই অপূর্ব্ব রূপরাশি অবলোকন করিতেছেন।
রাত্রি প্রভাত হইল। বেলা হইল। তবুও রোগীর নিদ্রাভঙ্গ হইল না। মা কাছে বসিয়া রহিলেন। নিঃশব্দে ভগিনী আসিয়া মার কাছে বসিলেন।
রোগীর ওষ্ঠদ্বয় একবার ঈষৎ নড়িল। অপরিস্ফুট স্বরে কি বলিলেন। শুনিবার নিমিত্ত ভগিনী মস্তক অবনত করিলেন। শুনিতে পাইলেন না, বুঝিতে পারিলেন না। আবার ওষ্ঠ নড়িল, রোগী আবার কি বলিলেন। মা এইবার সে কথা বুঝিতে পারিলেন।
মা বলিলেন,—খেতু খেতু করিয়াই বাছা আমার সারা হইলেন, আজ কয়দিন মুখে কেবল ঐ নাম। এখন যদি চারি হাত এক করিতে পারি, তবেই মনের কালি যায়।
মার সুমধুর কণ্ঠস্বর কন্যার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। সম্পূর্ণরূপে জাগরিত হইয়া, মাকে জিজ্ঞাসা করিলে কঙ্কাবতী বলিলেনও প্রলাপ রহিয়াছে, ধীরে ধীরে তিনি চক্ষু উন্মীলন করিলেন। বিস্মিত-বদনে চারি দিক্ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। মা বলিলেন,–বিকার সম্পূর্ণরূপে এখনও কাটে নাই। চক্ষুতে এখনও সুদৃষ্টি হয় নাই। আজ উনিশ দিন মা আমার কাহাকেও চিনিতে পারেন নাই।
ভগিনী জিজ্ঞাসা করিলেন,—কঙ্কাবতী! তুমি আমাকে চিনিতে পার?
কঙ্কাবতী অতি মৃদুস্বরে উত্তর করিলেন,—পারি, তুমি বড় দিদি।
ভগিনী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,—ইনি কে বল দেখি? কঙ্কাবতী বলিলেন,–মা। তনু রায় ঘরের ভিতর আসিলেন। তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন,–কঙ্কাবতী! আজ কেমন আছ মা? কঙ্কাবতী বলিলেন,–ভাল আছি, বাবা।
তনু রায় একটু কাছে বসিলেন। স্নেহের সহিত কন্যার গায় মাথায় একটু হাত বুলাইলেন। তাহার পর বাহিরে চলিয়া গেলেন।
কঙ্কাবতী ভাবিলেন,—মা, ভগিনী পিতা সকলকেই দেখিতেছি আমার সহিত স্বর্গে আসিয়াছেন। পৃথিবীতে পিতার স্নেহ কখনও পাই নাই। আজ স্বর্গে আসিয়া পাইলাম। পৃথিবীতে আমাদের যেরূপ বাড়ী, আমার যেরূপ ঘর ছিল, স্বর্গেও দেখিতেছি সেইরূপ। কিন্তু যাঁহার সহিত সহমরণ যাইলাম, তিনি কোথায়?
অনেকক্ষণ কঙ্কাবতী তার প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন। তিনি আসিলেন না।
অবশেষে কঙ্কাবতী মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—মা, তিনি কোথায়?
মা জিজ্ঞাসা করিলেন,—তিনি কে?–কঙ্কাবতী বলিলেন,—সেই যিনি বাঘ হইয়াছিলেন। মা বলিলেন,–এখনও ঘোর বিকার রহিয়াছে, এখনও প্রলাপ রহিয়াছে।
মার কথা শুনিয়া কঙ্কাবতী চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। শরীর তাঁহার নিতান্ত দুৰ্ব্বল, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন। অল্প অল্প করিয়া তাঁহার পূৰ্ব্ব কথা সব স্মরণপথে আসিতে লাগিল।–কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,–মা। আমার কি অতিশয় পীড়া হইয়াছিল?
মা বলিলেন,—হাঁ বাছা। আজ বাইশ দিন তুমি শয্যাগত। তোমার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না। এবার যে তুমি বাঁচিবে, সে আশা ছিল না।
কঙ্কাবতী বলিলেন,—মা। আমি আশ্বৰ্য্য স্বপ্ন দেখিয়াছি। স্বপ্নটি আমার মনে এরূপ গাঁথা রহিয়াছে যে, প্রকৃত ঘটনা বলিয়া আমার বিশ্বাস হইতেছে। এখন আমার মনে নানা কথা আসিতেছে। তাঁহার ভিতর আবার কোনটি স্বপ্ন, তাহা আমি স্থির করিতে পারিতেছি না। তাই মা তোমাকে গুটিকতক কথা জিজ্ঞাসা করি। আচ্ছা মা জনার্দ্দন চৌধুরীর স্ত্রীযিয়োগ হইয়াছে, সে কথা সত্য?
মা বলিলেন,–সে কথা সত্য। তাই লইয়াই তো আমাদের যত বিপদ। কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,–মা। বরফ লইয়া কি দলাদলি হইয়াছিল, সে কথা কি সত্য? মা উত্তর করিলেন,—হাঁ বাছা। সে কথাও সত্য। সেই কথা লইয়া পাড়ার লোকে খেতুর মাকে অপমান করিয়াছিল। কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,–তিনি এখন কোথায় মা।
মা বলিলেন,—তিনি আসেন এই সমস্ত দিন এইখানেই থাকেন। আমার চেয়ে তিনি তোমাকে ভালবাসেন। তার হাতে তোমাকে একবার সঁপিয়া দিতে পারিলেই, এখন আমার সকল দুঃখ যায়। কৰ্ত্তার মত হইয়াছে, সকলের মত হইয়াছে, এখন তুমি ভাল হইলেই হয়। কঙ্কাবতী বুঝিলেন যে, তবে খেতুর মার মৃত্যু হয় নাই, সে কথাটি স্বপ্ন।
কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,–এই দলাদলির পর আমার জ্বর হয়, না মা?
তাহার পর, মা, আমি নদীর ঘাটে গিয়া একখানি নৌকার উপর চড়ি, না মা?
মা বলিলেন,–বালাই! তুমি নৌকায় চড়িবে কেন মা? সেই অবধি তুমি শয্যাগত।
কঙ্কাবতী বলিলেন,–মা! কত যে কি আশ্চর্য্য স্বপ্ন দেখিয়াছি, তাহা আর তোমায় কি বলিব; সে সব কথা মনে হইলে হাসিও পায় কান্নাও পায়। স্বপ্নে দেখিলাম কি মা, যে, গায়ের জ্বালায় আমি নদীর ঘাটে গিয়া জল মাখিতে লাগিলাম। তাহার পর একখানি নৌকাতে চড়িয়া নদীর মাঝখানে যাইলাম। নৌকখানি আমার ড়ুবিয়া গেল! মাছেরা আমাকে তাদের রাণী করিল। তাহার পর কিছুদিন গোয়ালিনী মাসীর বাড়ীতে রহিলাম। সেখান হইতে শশ্মানঘাটে যাইলাম! তাহার পর পুনরায় বাড়ী আসিলাম। এক বৎসর পরে আমাদের বাটীতে একটি বাঘ আসিল। সেই বাঘের সহিত আমি বনে যাইলাম। তার পর ভূতিনী, ব্যাঙ, মশা কত কি দেখিলাম। তার পর মা আকাশে উঠিলাম, কত কি করিলাম, কত কি দেখিলাম, স্বপ্নটি যেন আমার ঠিক সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে। হাঁ মা! সে দলাদলির কি হইল?–মা উত্তর করিলেন,—যে দলাদলি সব মিটিয়া গিয়াছে। যখন তোমার সমূহ পীড়া, যখন তুমি অজ্ঞান অভিভূত হইয়া পড়িয়া আছ, আজ আট নয় দিনের কথা আমি বলিতেছি, সেই সময় জনার্দ্দন চৌধুরীর একটি পৌত্রেব হঠাৎ মৃত্যু হইল। জনার্দ্দন চৌধূরী সেই পৌত্রটিকে অতিশয় ভালবাসিতেন।
তিনি শোকে অধীর হইয়া পড়িলেন। সেই সময় গোবর্ধন শিরোমণিরও সঙ্কটাপন্ন পীড়া হইল। আর আমাদের বাটীতে তো তোমাকে লইয়া সমূহ বিপদ। জনার্দ্দন চৌধুরীর সুমুতি হইল। তিনি রামহরিকে আনিতে পাঠাইলেন। রামহরি সপরিবারে কলিকাতা হইতে দেশে আসিলেন। রামহরি জনার্দ্দন চৌধুরী অনেকক্ষণ পরামর্শ করিলেন। তাহার পর রামহরি নিরঞ্জনকে ডাকিয়া আনিলেন।
রামহরি, নিরঞ্জন, আমাদের কর্ত্তাটি ও খেতু সকলে মিলিযা জনার্দ্দন চৌধুরীর বাটীতে যাইলেন। জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,–আমি পাগল হইয়াছিলাম যে, এই বৃদ্ধ বয়সে আমি পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম! নিরঞ্জনকে আমি দেশত্যাগী করিয়াছি, খেতু বালক, তাঁহার প্রতি আমি ঘোরতর অত্যাচার করিয়াছি। সেই অবধি নানাদিকে আমাদের অনিষ্ট ঘটিতেছে। লোকের টাকা আত্মসাৎ করিয়া ষাঁড়েশ্বব কয়েদ হইয়াছে! গোবর্ধন শিরোমণি পক্ষাঘাত রোগে মরণাপন্ন হইয়া আছেন।
বৃদ্ধ বয়সে আমাকে এক দারুণ শোক পাইতে হইল। এঁর কন্যাটিও রক্ষা পাওয়া ভার। এই কথা বলিয়া তিনি নিরঞ্জনকে অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া তাঁহার ভূমি ফিরিয়া দিলেন। নিরঞ্জন এখন আপনার বাটীতে বাস করিতেছেন। খেতুকে অনেক আশীর্বাদ করিয়া জনার্দ্দন চৌধুরী সান্ত্বনা করিলেন।
আমাদের কর্তাটি আর সে মানুষ নাই। এক্ষণে তাঁহার মনে স্নেহ-মায়া দয়া-ধৰ্ম্ম হইয়াছে। বিপদে পড়িলে লোকের এইরূপ সুমতি হয়। তোমার দাদাও এখন আর সেরূপ নাই। মাকে যেরূপ আস্থা-ভক্তি করিতে হয় সুপুত্রের, তোমার দাদাও এক্ষণে আমাকে আস্থা-ভক্তি করে। তোমার পীড়ার সময় খেতু, খেতুর মা, রামহরি, সীতা প্রভৃতি সকলেই প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছেন। এক্ষণে সকল কথা শুনিলে এখন আর অধিক কথা কহিয়া কাজ নাই। এখনও তুমি অতিশয় দুর্বল। পুনরায় অসুখ হইতে পারে।
কঙ্কাবতী অনেক দিন দুৰ্বল রহিলেন। ভাল হইয়া সারিতে তাঁহার অনেক বিলম্ব হইল। সীতা তাঁহার নিকট আসিয়া সৰ্ব্বদা বসিতেন। স্বপ্ন-কথা তিনি সীতার নিকট সমুদয় গল্প করিলেন। সীতা মাকে বলিলেন, বৌদিদি খেতুকে বলিলেন, এইরূপে কঙ্কাবতীর আশ্চৰ্য্য স্বপ্ন-কথা পাড়ার স্ত্রী-পুরুষ সকলেই শুনিলেন! স্বপ্ন-কথা আদ্যোপাপ্ত শুনিয়া কঙ্কাবতীর উপর সীতার বড় অভিমান হইল।
সীতা বলিলেন,—সমুদয় নক্ষত্রগুলি তুমি নিজে পরিলে, আর আপনার পচাজলকে দিলে। আমার জন্য একটিও রাখিলে না। আমাকে তুমি ভালবাস না, তুমি তোমার পচাজলকে ভালবাস। আমি তোমার সহিত কথা কহিব না।
কঙ্কাবতী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিলেন। পূর্ব্বের ন্যায় পুনরায় সবল হইলেন। পীড়া হইতে উঠিয়া তিনি খেতুর সম্মুখে একটু-আধটু বাহির হইতেন। একদিন খেতু কঙ্কাবতীদের বাটীতে গিয়াছিলেন। সেইখানে একটি মশা উড়িতেছিল খেতু সেই মশাটিকে ধরিয়া কঙ্কাবতীতে জিজ্ঞাসা করিলেন,—দেখ দেখি কঙ্কাবতী এই মশাটি তো তোমার পচাজল নয়? আহা! রক্তবতী আজ অনেক দিন তাঁহার পচাজলকে দেখিতে পায় নাই। তাঁহার মন কেমন করিতেছে। তাই সে হয় তত তোমাকে খুঁজিতে আসিয়াছে।
লজ্জায় কঙ্কাবতী গিয়া ঘরে লুকাইলেন। সেই অবধি আর খেতুর সম্মুখে বাহির হইতেন না।
নিরঞ্জন একদিন খেতুকে বলিলেন,—খেতু! কঙ্কাবতীর অদ্ভুত স্বপ্নকথা আমি শুনিয়াছি। কি আশ্চর্য্য স্বপ্ন! কিন্তু স্বপ্ন বা বিকারের প্রলাপ বলিয়া তুমি উপহাস করিও না। স্বপ্ন,—কি নয়? তাহাই বুঝিতে পারি না। এই আমাদের জীবন, আমাদের আশাভরসা, সুখ-দুঃখ সকলই স্বপ্নবৎ বলিয়া বোধ হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই অপূৰ্ব্ব মায়া কিছুই বুঝিতে পারি না। সামান্য একটি পদার্থের কথাই আমরা ভালরূপ অবগত নহি।
এই দেখ, আমার হাতে এখন যে পুস্তকখানি রহিয়াছে, প্রকৃত ইহা কি, তাঁহার কিছুই জানি না। আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা কেবল কতকগুলি গুণ অনুভব হয়। চক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, ইহার দৈর্ঘ্য প্রস্থ সুলতা ও বর্ণ আছে ত্বকের দ্বারা জানিতে পারি যে, ইহার কাঠিমা আছে নাসিকা দ্বারা ইহার ঘ্রাণ জিহ্বার দ্বারা ইহার স্বাদ অনুভব করি। প্রকৃত পুস্তকখানি আমরা দেখিতে পাই না, যাহাকে পুস্তকের গুণ বলি তাহাই আমরা অনুভব করিতে পারি। কিন্তু সে গুণগুলি পুস্তকের কি আমাদের ইন্দ্রিয়ের? আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক প্রভৃতি এখন যে ভাবে গঠিত, সেই ভাবে আমরা গুণাদি অনুভব করি। যদি আমাদের ইন্দ্রিয় সমুদয় অন্যরূপে গঠিত হইত, তাহা হইলে পৃথিবীস্থ সমস্ত পদার্থ আবার অন্যরূপ ধারণ করিত।এই পুস্তকের পত্রগুলি এখন শুভ্র ও কৃষ্ণবর্ণ দেখাইতেছে। যদি পাণ্ডুরোগে আক্রান্ত হইয়া কিঞ্চিত্মাত্র আমার চক্ষুর গঠন পরিবর্তিত হয় তাহা হইলে এই পুস্তকখানিই আবার আমার চক্ষে পীতবর্ণ দেখাইবে।
তাই দেখ, প্রথম তো পুস্তকখানি দেখিতে পাই না, কতকগুলি গুণ কেবল অনুভব করি। আবার বলিতে গেলে সেইগুণগুলি পুস্তকের নয়, আমাদের ইন্দ্রিয়ের। তবে পুস্তক রহিল কোথা? কোনও বিষয়ের প্রকৃত তত্ত্ব জানিতে না পরিয়া স্বপ্ন সৃজিত কাল্পনিক জীবের ন্যায় আমরা সকলেই এই সংসারে যেন বিচরণ করিতেছি।
সে জন্য কঙ্কাবতীর স্বপ্নকে আমরা সকলে উপহাস করিব কেন? সমুদয় বাহ্যজগৎ যেরূপ আমাদের জাগরিত ইন্দ্রিয়-কল্পিত, কঙ্কাবতীর স্বপ্নজগৎও সেইরূপ কঙ্কাবতীর সুযুপ্ত ইন্দ্রিয় নির্ম্মিত হইয়াছিল। স্বপ্নের আদি হইতে অন্ত পর্যন্ত সকল স্থানেই কঙ্কাবতী বর্তমান। কঙ্কাবতী দেখিতেছে, কি শুনিতেছে, কি বলিতেছে, তা ছাড়া স্বপ্নে আর কিছুই নাই। কঙ্কাবতীর যেরূপ ভ্রম হওয়া সম্ভব, স্থানে স্থানে সেইরূপ নাও দেখিতে পাই। হাতীদিগের মন মশাদিগের নাক পরিবর্ধিত হইয়া হইয়া শুড়া হয় না, আবার অন্য স্থানে, যেমন আকাশে, কল্পনা-দেবী কঙ্কাবতীর সহিত কিছু ক্রীড়া কবিয়াছেন। যাহা হউক, স্বপ্নটি অদ্ভুত বলিয়া মানিতে হইবে। আমি আশ্চর্য্য হই, কঙ্কাবতী সেই মশাদিগের সংস্কৃত শ্লোকটি কি করিয়া বচনটি রচনা করিযাছিল। এ অনেক দিনের কথা। একখানি কাগজে ইহা লিখিয়া রাখিয়াছিলাম। কিছু দিন পবে কাগজখানি ফেলিয়া দিই। কঙ্কাবতী বোধ হয় সেই কাগজখানি দেখিয়া থাকিবে।
কঙ্কাবতী উত্তরমরূপে আরোগ্য লাভ করিলে, শুভ দিনে শুভ লগ্নে খেতু ও কঙ্কাবতীর শুভ বিবাহ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইল। ঘোরতর দুঃখের পর এই কাৰ্য্য সুসম্পন্ন হইল, সে জন্য সপ্তগ্রাম সমাজের লোক সকলেই আনন্দিত হইলেন। বিশেষতঃ জনার্দ্দন চৌধুরী পরম প্রীতিলাভ করিলেন।
তাঁহার বৃদ্ধ বয়স ও কফের ধাত, কিন্তু সে জন্য তিনি কিছু মাত্র উপেক্ষা করেন নাই। বিবাহের দিন সমস্ত রাত্রি তিনি তনু রায়ের বাটীতে উপস্থিত ছিলেন। চুপি চুপি তিনি কলিকাতা হইতে প্রচুর পরিমাণে বরফ আনয়ন করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ-ভোজনের সময় পরিহাসচ্ছলে সকলকে তিনি বলিলেন, বর যে একেলা বরফ খাইয়া শরীর সুশীতল করিবে, তাহা হইবে না, আমরাও আমাদের শরীর যৎসামান্য স্নিগ্ধ করিব।
দেশের লোক, যাঁহারা কখনও বরফ দেখেন নাই, আজ বরফ দেখিয়া সকলেই চমৎকৃত হইলেন। আগ্রহের সহিত অল্প কাঁচা বরফ লইয়াগেলেন।
শুদ্রভোজনের সময় গদাধর ঘোষ তিন লোটা বরফজল পান করিলেন। আর প্রায় এক সের সেই করাতের মত কৰ্ত্তনশীল বরফ দন্ত দ্বার চিবাইয়া খাইলেন।
কঙ্কাবতীর মা যখন কঙ্কাবতীকে খেতুর মার হাতে সঁপিয়া দিয়া বলিলেন,–দিদি। এই নাও, তোমার কঙ্কাবতী নাও তখন দুই জনের আহ্লাদ রাখিতে পৃথিবীতে কি আর স্থান হইল? মনের আনন্দে তখন খেতুর মা কি পুত্র ও পুত্রবধুকে বরণ করিয়া ঘরে লন নাই? বরণের সময় লজ্জায় খেতুকে কি ঘাড় হেঁট করিয়াছিলেন না? কলাবৌয়ের মত কঙ্কাবতীর কি তখন এক হাত ঘোমটা ছিল না? তা দেখিয়া পাড়ার একটি শিশু ছেলে কি সেই ঘোমটার ভিতর মুখ দিয়া টুঃ দেয় নাই? এ সব কথার আর উত্তর দিবার আবশ্যক নাই।–যে সময় বরণ হইতে ছিল, সেই সময় রামহরির স্ত্রী খেতুর বৌ-দিদি কি করিয়াছিলেন, তা জানেন? অতি উত্তম করিয়া খেতুর কানটি তিনি অল্প মলিয়া দিয়াছিলেন।–কান-মলা খাইয়া খেতু কি বলিলেন, তা জানেন? খেতু বলিলেন,–যাও বৌ-দিদি ছি!
পাড়ার স্ত্রীগণ তখন কি করিলেন, তা শুনিয়াছেন? কমলের স্ত্রী ঠান্দিদি বলিলেন,–শালা বরখ খায়। ও সীতার মা, ওলো, শালার কান দুইটা একেবারে ছিঁড়িয়া দে! ছিঁডিয়া দে?–তাহার পর কি হইল? তাহার পর খেতুর অনেক টাকা হইল। সকলে সুখ-স্বাচ্ছন্দে ঘরকন্না করিতে লাগিলেন। খেতুর অনেকগুলি ছেলেপিলে হইল। তনু রায় তাহাদিগের সহিত খেলা করিতে ভালবাসিতেন। পাড়ার বালক-বালিকারা তাব দৌহিত্রদিগকে মারিলে তাহাদের ঠাকুরমার সহিত তনু রায় হাত নাড়িয়া ঝগড়া করিতেন।–তাহার পর? বার বার তাহার পর তাহার পর করিলে চলিবে না। দেখিতে দেখিতে পুস্তকখানি বৃহৎ হইয়া পড়িয়াছে। ইহার মূল্য দেয় কে? তাঁহার ঠিক নাই, কাজেই তাড়াতাড়ি শেষ করিতে বাধ্য হলাম।–তাহার পর কি হইল? তাহার পর আমার গল্পটি ফুরাইল। নোটে গাছটির কপালে যাহা লেখা ছিল, তাহা ঘটিল! সেই ঘটনা লইয়া কত অভিযোগ উপস্থিত হইল।
-০-