৩. পরদিন সকালে গোবিন্দ

পরদিন সকালে গোবিন্দ চলে গেল। যাওয়ার আগে বলল, “আমি জায়গাটা বিশেষ ভাল বুঝছি না বাপু। বড় যেন কেমন-কেমন। তা বড়বাবুকে গিয়ে আমি বলব’খন যেন এখানে তোমাকে আর না রাখেন। ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যাওয়া ভাল।”

একথায় হরির চোখে জল এসে গেল। বাবা যে তাকে একরকম বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, একথাটা তার অল্প বুদ্ধিতেও বুঝতে কষ্ট হয়নি। অভিমানে তার বুক ভারী হয়ে উঠল। সে মাথা নেড়ে বলল, “না গোবিন্দদা, এ-জায়গা ছেড়ে আমি যাব না। মরি তো মরব।”

“বালাই ষাট, মরবে কেন?” বলে গোবিন্দ তার পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে বলল, “চারদিকে লক্ষ রেখো। রাত্রিবেলা টর্চবাতি আর লাঠি হাতের কাছে রাখবে। ঠক-জোচ্চোরদের পাল্লায় পোড়ো না। পেট ভরে খেও। আর পাগলা-সাহেবটাকে দেখলে সেলাম কোরো।”

হরি অবাক হয়ে বলল, “পাগলা-সাহেব! সে আবার কে?”

গোবিন্দ হাত উলটে বলল, “কী করে তা বলি! দুপুরে একটু হাঁটাহাঁটি করতে পথে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দেখি একটা সাদা ঘোড়ায় চেপে এক সাহেব যাচ্ছে। হঠাৎ আমার দিকে কটমট করে চেয়ে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে পেল্লায় ধমক দিল, ‘অ্যাও, সেলাম কাহে নাহি কিয়া? আমি তো ভয়ে মূর্ছা যাই আর কি। চিচি করে কী বললাম, সাহেব তা বুঝল না। হাতের চাবুকটা তুলে সপাং করে চালাল। ভাগ্যিস লাগেনি। পড়ি কি মড়ি করে পালিয়ে বাঁচি। ফিরে এসে জগুরামকে সব বলছিলাম। কিন্তু ব্যাটা এমন পাষণ্ড যে, একটা জবাবও দিল না। শুধু রাক্ষুসে চোখে একবার চেয়ে যেমন বাগানের ঘাস নিড়ড়াচ্ছিল তেমনি নিছড়াতে লাগল। একটা বিড়ি দিতে গেলুম, নিল না। দুটো মন-ভেজানো কথা বললুম, কানেই তুলল না। দুর্গা, দুর্গা, কী হবে কে জানে। আমি হলে বাপু আর এক দণ্ডও এখানে থাকতুম না। তোমার জন্য বড় চিন্তা রইল।”

হরি গম্ভীর মুখে বলল, “আমার কথা আর চিন্তা কোরো না। আমাকে ভুলে যাও গোবিন্দদা।”

গাড়ির সময় হয়ে গিয়েছিল বলে কথা আর গড়াল না। গোবিন্দ রওনা হয়ে যাওয়ার পর স্নান-খাওয়া সেরে দুরুদুরু বুকে স্কুলে রওনা হল হরি।

ক্লাসে ঢুকতেই বাঁ দিকের থার্ড বেঞ্চ থেকে গোপাল তাকে ডাকল, “এই যে ভাই, এখানে এসে বোসো। তোমার জন্য জায়গা রেখেছি।”

হরি গিয়ে ঝুপ করে গোপালের পাশে বসে পড়ল। আর বসবার পরেই বুঝল, ক্লাসটা কেমন যেন নিশ্ৰুপ হয়ে গেল। সকলেই তার দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না বা করছে না।

গোপাল মৃদু স্বরে বলল, “ভয় পেও না। আজ হয়তো ওরা তোমাকে কিছু করবে না।”

“কেন, করবে না কেন?”

“ওরা বোধহয় কালকের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত।”

আশ্চর্যের বিষয়, রাস্তবিকই আজ দুষ্টু ছেলেগুলো হরির দিকে একেবারেই মনোযোগ দিচ্ছিল না। নিজেদের মধ্যে চেঁচামেচি, ঝগড়া-মারামাবি করছিল বটে, কিন্তু হরিকে ‘রাঙামুলো’ বলে ডাকল না একবারও, কিল চড় ঘুসিও কেউ দিল না।

গোপাল মৃদু স্বরে ছেলেদের চিনিয়ে দিচ্ছিল, “লাস্ট বেঞ্চের বাঁ দিকের কোণে যে ছেলেটা বসে আছে, তাকে ভাল করে দেখে নাও। ও হল ভজন। ডেনজারাস ছেলে। দুর্দান্ত ফুটবল খেলোয়াড় আর তেমনি মারকুট্টা। ওপাশের ফোর্থ বেঞ্চে বসে আছে তিনটে ছেলে। ওদের বলা হয় থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। গদাধর, অনিল আর দীপঙ্কর। লোকে বলে, ওরা একটা ডাকাতের দলে আছে। আমাদের পিছনের বেঞ্চে ডান দিকের কোণে বসে আছে রাজর্ষি। চেহারাটা খুব লালটু। দারুণ বড়লোকের ছেলে। ও নাকি ওদের একজন চাকরকে বন্দুকের গুলিতে জখম করেছিল বেয়াদবির জন্য। খুব সাংঘাতিক ছেলে। ও-পাশের সেকেণ্ড বেঞ্চে দ্যাখো, কোণের ওই যে নীল শার্ট আর তার পাশে হলুদ গেঞ্জি পরা দু’জন, ওদের নাম পার্থ আর শিবশঙ্কর। পার্থ খুব ভাল ওয়েট লিফটার আর শিবু কারাটিকা। ওই দু’জনের মতো পাজি খুব কম আছে। এদের আপাতত চিনে রাখো। সাধ্যমতো এড়িয়ে চোলো।”

হরি সব ক’জনকেই চিনতে পারল। এরাই কাল তার ওপর অত্যাচার করেছে সবচেয়ে বেশি।

সে গোপালের দিকে চেয়ে বলল, “কিন্তু ওরা আজ আমাকে ছেড়ে দিচ্ছে কেন বলো তো! তোমার জন্য?”

গোপাল মাথা নেড়ে বলল, “না, না। আমার জন্য কেন হবে?”

হরি তবু গোপালকে ভাল করে একবার দেখল। অসাধারণ কিছুই নেই গোপালের মধ্যে। কালো, ছিপছিপে, লম্বাটে গড়ন। গায়ে এমন কিছু আহামরি জোর থাকার কথা নয়। মুখোনাও নিপাট ভালমানুষের মতোই। ষণ্ডাগুণ্ডা বলে মনে হয় না। তবে তার চোখ দুখানা বেশ তীক্ষ্ণ।

ক্লাস শুরু হওয়ার পর হরি লক্ষ করল, মাস্টারমশাইরাও কেন যেন গোপালকে এড়িয়ে যান। একমাত্র হেডস্যারের ভূগোল ক্লাস আর জাহ্নবীবাবুর অঙ্ক ক্লাস ছাড়া আর কোনও ক্লাসে কোনও মাস্টারমশাই গোপালকে কোনও. প্রশ্ন করলেন না।

হরি আর-একটা জিনিসও লক্ষ করল। এ ক্লাসের সব ছেলেই বেশ বড়-বড়। বেশির ভাগেরই বয়স পনেরো-ষোলোলা থেকে উনিশ কুড়ি। বোঝা যায় যে, এরা বহুবার গাড়ু মেরে ক্লাস সেভেনে উঠেছে। গোপালেরও বয়স সতেরো-আঠারো হরে। দুই ক্লাসের ফাঁকে একবার সে গোপালকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি ভাই অনেকবার ফেল করেছ?”

গোপাল মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, “না, তবে লেখাপড়া শুরু করতেই আমার অনেক দেরি হয়েছে।”

“কেন?”

সে অনেক কথা। তবে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম! অনেক দিন পালিয়ে-বেড়িয়ে থাকার ফলে পড়াশুনো হয়নি।”

“কেন পালিয়েছিলে?”

“বাড়িতে ভাল লাগে না। পৃথিবীটা কী বিশাল, আর বাড়িটা কত ছোট।”

আজ টিফিন পিরিয়ডে হরি আর গোপাল একসঙ্গে বেরোল। জামতলায় একজন চিনেবাদামওলা বসেছিল। তার কাছ থেকে দু’জনে বাদাম কিনে গাছের ছায়ায় বসে বসে গল্প করল। গোপাল নিজে বেশি কথা বলল না, বরং হরিকে প্রশ্ন করে করে তার বাড়ির কথা আর এখানে

আসার ইতিহাস সব জেনে নিল। হরি বলল, “ও, ভাল কথা, আমাদের বাড়িটার নাম কুসুমকুঞ্জ নয়, গ্রিন ভ্যালি।”

গোপাল হাসল; বলল, “জানি। কালই খোঁজ নিয়েছি। খুব ভাল আতা হয় ওবাড়িতে। ভাল জাতের ল্যাংড়া আমও ফলে। একবার আম চুরি করতে গিয়ে ওই জগুরামের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম।”

“বটে? তারপর কী হল?”

“জগুরাম কুস্তিগির ছিল, তা জানো?”

“না। তবে ওরকমই চেহারা। তোমাকে মারল নাকি?” গোপাল একটু হেসে বলল, “মারতেই চেয়েছিল। তবে পারেনি।”

“কেন পারেনি?”

“পাগলা-সাহেব এসে পড়ল যে!”

“পাগলা-সাহেব কে বলল তো? কালও একজন বলছিল, সে নাকি সাদা ঘোড়ায় চেপে একজন সাহেবকে যেতে দেখেছে।”

“ঠিকই দেখেছে।”

“পাগলা-সাহেব কি সত্যিই পাগল?”

“তা কে জানে! লোকে বলে পাগলা-সাহেব, আমরাও তাই বলি। তবে…”

“তবে কী?”

“পাগলা-সাহেবকে কিন্তু সবাই দেখতে পায় না। কেউ-কেউ পায়।”

“তার মানে কী?”

গোপাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু টিফিন শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজায় কথাটা আর এগোল না।

টিফিনের পরের ঘন্টাগুলোও আজ বেশ শান্তিতেই কেটে গেল। শুধু ইতিহাসের ক্লাসে আকবরের ছেলের নাম বলতে না পারায় হরিবন্ধুকে একটি মোলায়েম কানমলা খেতে হল। তা সেটা গায়ে না মাখলেও চলে। মারধোর তার কাছে কিছুই নয়।

ছুটির ঘন্টা বাজবার একটু আগে গোপাল বলল, “আজও তোমাকে একটু এগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নোয়াপাড়ার সঙ্গে আজ একটা কাবাডি ম্যাচ আছে।”

হরিবন্ধু লজ্জিত হয়ে বলে, “না না, এগিয়ে দিতে হবে না।”

আজ আর ছুটির পর হরিবন্ধু অপেক্ষা করল না। বইখাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। স্কুলের ফটক থেকেই গোপাল অন্য দিকে রওনা হয়ে যাওয়ার পর হরি একা, ছেলেদের দঙ্গল থেকে একটু তফাতে থেকে বাড়িমুখো হাঁটতে লাগল। হাঁটতে-হাঁটতে সে গোপালের কথাই ভাবছিল। এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ক্লাসের সব ছেলেই গোপালকে ভয় পায়, কিন্তু কেন পায় সেটাই তাকে খুঁজে বের করতে হবে। মাস্টারমশাইরাও দেখা যাচ্ছে পারতপক্ষে গোপালকে ঘাঁটান না, তারই বা রহস্য কী? আর গোপাল তাকেই বা এমন করে আগলে রাখল কেন!

ছেলের দঙ্গল বিভিন্ন পথ ধরে যে-যার বাড়ির দিকে চলে গেল। রাস্তা নির্জন হয়ে এল। চৌপথি থেকে ডান হাতে বাঁক ঘুরতেই একটা নির্জন কালীবাড়ি। গতকালও লক্ষ করেছে হরি, চারদিকে মস্ত-মস্ত তেঁতুলগাছ। খুব ঝুপসি ছায়া আর নির্জনতার মধ্যে খুদে কালীবাড়িটা গাছপালার জন্য প্রায় নজরেই পড়ে না। কালী-দুগা শিব-কৃষ্ণ যা-ই হোক, ঠাকুর-দেবতার স্থান দেখলেই প্রণাম করা হরির স্বভাব। কাল ঠাহর পায়নি বলে প্রণামটা করা হয়নি। আজ ভক্তিভরে হাতজোড় করে চোখ বুজে ডবল প্রণাম ঠুকল সে মা-কালীকে, মাস্টারমশাইদের রাগ কমিয়ে দাও মা, বজ্জাত ছেলেগুলোর সুমতি দাও মা, গোপালের সঙ্গে যেন কখনও আড়ি না হয় মা, পাগলা-সাহেবের চাবুক যেন পিঠে না পড়ে মা, বাবার মনটা যেন নরম হয়ে যায় মা, আমি যেন বাড়ি ফিরে যেতে পারি মা… ইত্যাদি।

প্রণাম সেরে চোখ খুলতেই কিন্তু সে থতমত খেয়ে গেল। সামনে গোটা-চারেক হুমদো-হুঁমদো ছেলে দাঁড়িয়ে। তার ক্লাসেরই ছেলে। গোপাল এদেরই চিনিয়ে দিয়েছিল। গদাধর, অনিল, দীপঙ্কর আর রাজর্ষি।

গদাধরের চেহারা যেমন বিকট, গলার স্বরটাও পিলে চমকে দেওয়ার মতো বাজখাঁই। সে হরির থুতনিতে একটা ঠোনা মেরে সেই বাজ-ডাকা গলায় বলল, “গোপালের সঙ্গে ভাব করা হয়েছে চাঁদু? ভেবেছ পার পেয়ে যাবে? আমরা অত সোজা লোক নই হে। এখন বলো তো চাঁদু, গোপালকে কী ঘুষ দিয়ে হাত করেছ।”

ভয়ে সিঁটিয়ে গেল হরি। একটু আগে মা-কালীকে রীতিমত ভক্তির সঙ্গে ডাকাডাকি করেছে। তার এ কী পরিণাম? সে আমতা-আমতা করে বলল, “ঘুঘুষ কেন দেব? গোপালই তো বন্ধুত্ব পাতিয়েছে।”

“গোপাল বন্ধু পাতানোর ছেলে! ওকে চিনি না ভেবেছ? তা ঘুষটা ওকে না দিয়ে আমাদেরও তো দিলে পারতে। একটু ঘুষ-টুষ পেলে আমরা কি কম বন্ধুত্ব করতে জানি?”

কী জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিল না হরি।

গদাধরকে ঠেলে একদিকে সরিয়ে রাজর্ষি এগিয়ে এল। রাজপুত্রের মতো চেহারা। কিন্তু চোখ দুটোয় কেমন অস্বাভাবিক নিষ্ঠুর দৃষ্টি। রক্ত হিম হয়ে যায়। সেই রক্ত-জল-করা চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে সে বলল, “একটা কথার জবাব দেবে?”

“কী কথা?”

“গোপাল আমাদের কথা তোমাকে কী বলেছে?”

হরি মাথা নেড়ে বলল, “কিছু বলেনি।”

“তার মানে বলবে না?”

হরি ভয় খেয়ে বলল, “তেমন কিছু বলেনি।”

“কী বলেছে তা আমরা শুনতে চাই।”

হরি বিপন্ন গলায় বলল, “সেটা তোমরা কেন গোপালকেই জিজ্ঞেস করো না।”

“সেটা আমরা বুঝব। তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি জবাব দাও।”

হরিবন্ধু হঠাৎ সাহস করে বলে ফেলল, “তোমরা কি গোপালকে ভয় পাও?”

একথায় হঠাৎ চারজনই কেমন স্থির হয়ে গেল। তারপর পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাকি করে নিল। রাজর্ষি বলল, “আমরা কাউকে ভয় পাই না। গোপালের সঙ্গে আমাদের বোঝাঁপড়া পরে হবে। এখন বলো, গোপাল তোমাকে কী বলেছে।”

চারজনের দ্বিধার ভাব দেখে হরিবন্ধুর আর সন্দেহ রইল না যে, মুখে যতই বারফাট্টাই করুক, এরা গোপালকে ভয় পায়। এটা বুঝতে পেরে তার বুকে যথেষ্ট সাহস এল। সে বুক চিতিয়ে বলল, “আমি বলব না।”

রাজর্ষি আর গদাধর এই জবাবে খুবই যেন অবাক হয়ে গেল। কেমন যেন দ্বিধার ভাবও তাদের হাবভাবে। রাজর্ষি বলল, “আমার সম্পর্কে তোমাকে ও কিছু বলেছে?”

“বলতে পারে।”

“কী বলেছে সেটা আমি জানতে চাই।”

“জেনে কী করবে? মারবে গোপালকে?”

“সেটা ভেবে দেখব।”

হরি ঘুরে দাঁড়িয়ে বাড়িমুখো হাঁটা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, “তা হলে বাড়ি গিয়ে ভাবো গে যাও। কাল তোমার প্রশ্নের জবাব দেব।”

আশ্চর্যের বিষয়, ছেলেগুলো তার পিছু নিল না বা শাসাল না, মারা তো দূরের কথা। একটু এগিয়ে গিয়ে একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে হরি দেখল, তেঁতুলতলার ছায়ায় চারটে ছেলে এখনও ভূতের মতো দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। গোপাল বলেছিল, ওই চারজনের তিনটে ডাকাত, একটা খুনে। হতেও পারে। তবে আপাতত চারজনের মাথাতেই যেন ধুলোপড়া পড়েছে।

হরি যখন বাড়ি ফিরল, তখন বেলা মরে এসেছে। সে ঘরে ঢুকতেই জগুরামের বউ ঝুমরি একটা কেরোসিনের টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে ঘরে দিয়ে গেল। হরি বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে আসতেই ঝুমরি মস্ত এক বাটিতে বিশাল এক তাল ছাতুমাখা নিয়ে এল।

ছাতু হরি কখনও খায়নি। দেখেই তার খিদে উবে গেল। সে বলল, “ওসব আমি খাই না। নিয়ে যাও।”

ঝুমরি বড় একটা কথা কয় না। এবারও কিছু বলল না। টেবিলের ওপর ছাতুর বাটির পাশে এক গ্লাস জল গড়িয়ে রেখে দিয়ে চলে গেল।

ছাতু দেখে যতই অনিচ্ছে হোক, পেটে তার সাঙ্ঘাতিক খিদে। এখানকার জল-হাওয়া ভাল বলেই সে শুনেছে। তাই দোনোমোনো করে সে ছাতুর তাল থেকে একটু খুঁটে মুখে তুলল। মনে হচ্ছে আচারের তেল এবং আরও দু-একটা অদ্ভুত মশলা দিয়ে মাখা। টক, ঝাল, নোনতা স্বাদটাও বেশ ভাল। নিজের অজান্তেই আনমনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে হরি ছাতুর তাল থেকে ভেঙে-ভেঙে খেতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর বাটিতে হাত দিয়ে সে অবাক হয়ে দেখল, ছাতুর তালটা আর নেই। বাটি একেবারে ভোঁভাঁ। ভারী অবাক হল সে। ইঁদুর বা ছুঁচো এসে নিয়ে যায়নি তো মুখে করে?

না। সে টের পেল ছাতুর তালটা উধাও হয়েছে বটে, কিন্তু পুরোটাই সেঁধিয়েছে তার পেটে। নিজের পেটের দিকে অবিশ্বাসভরে চেয়ে রইল হরি। যখন আর সন্দেহ রইল না, তখন ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিল।

বাইরে বেশ ঘুটঘুট্টি অন্ধকার জমে উঠেছে। পুরনো বাড়ির নানা জায়গা থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ আসছে। একটা আলগা পাল্লা মাঝে-মাঝে খটাস করে বন্ধ হচ্ছে, আবার ক্যাঁচক্যাঁচ করে খুলে যাচ্ছে। ধেড়ে ইঁদুর ডেকে উঠল যেন কোনও ঘরে। একটা বেড়াল মিউমিউ করে দোতলার কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাছেপিঠে কোথায় যেন শিয়াল ডেকে উঠল এক ঝাঁক।

এবাড়িতে একা ঘরে রাতটা কী করে সে কাটাবে? শুধু একটা রাতই তো নয়, রাতের পর রাত!

আবার পরমুহূর্তেই বাড়ির কথা ভেবে তার মনটা রা, আর অভিমানে ভরে গেল। একা এই নিবান্ধব পুরীতে তাকে নির্বাসনেই তো পাঠানো হয়েছে। সে মরুক বাঁচুক, তাতে কার কী আসে-যায়? ভাবতে ভাবতে তার চোখে জল চলে এল। গোবিন্দদার হাত দিয়ে সে মা’কে একটা চিঠি পাঠিয়েছে : ‘আমি এখানে থাকলে বেশিদিন বাঁচব না, তোমার পায়ে পড়ি মা, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাবাকে বলো।

এখন তার চিঠিটার জন্য লজ্জা করতে লাগল। ওরকম চিঠি না লিখলেই পারত।

স্কুলে অনেক টাস্ক দিয়েছে। এই স্কুলে হোমটাস্ক জিনিসটা সাঙ্ঘাতিক। প্রত্যেকটা খাতা খুঁটিয়ে পড়া হয়, নম্বর দেওয়া হয়। টাস্ক না করলে লাঞ্ছনা-অপমানের একশেষ।

চোখের জল মুছে টেবিলের ওপর বইখাতা সাজিয়ে বসে গেল হরি। টাস্ক করতে করতে ভয়ের ভাবটাও কমে আসতে লাগল। মাঝে-মাঝে জানালা দিয়ে চেয়ে সে দরোয়ান জগুরামের ঘরে টেমির আলো দেখতে পাচ্ছিল। ঝুমরি বোধহয় রান্না করতে করতে একখানা গান ধরল। দেহাতি গান। অনেকটা কান্নার মতো বিষণ্ণ সুর। মাঝে-মাঝে আনমনে শুনতে পাচ্ছিল হরি।

রাত দশটা নাগাদ হরির হঠাৎ খেয়াল হল, কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। শরীরের মধ্যে যেন একটা ফাঁকা-ফাঁকা ভাব। পেনসিলটা দাঁতে কামড়ে ব্যাপারটা একটু বুঝবার চেষ্টা করল হরি। খানিকক্ষণ চিন্তা করার পর হঠাৎই ব্যাপারটা তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ফাঁকাই বটে, তার পেটটাই বিলকুল ফাঁকা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বিকেলে যে। প্রকাণ্ড ছাতুর তালটা সে আনমনে খেয়ে নিয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে পেট থেকে। মোতিগঞ্জের জল-হাওয়া বোধহয় খুবই ভাল।

আরও আশ্চর্যের বিষয়, খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল ঝুমরি। হাতে থালা। থালার ওপর গরম ধোঁয়ানো ভাতের একটা পাহাড়। সঙ্গে অড়হরের ডাল, তরকারি।

ভাতের পরিমাণ দেখে আঁতকে উঠে হরি বলল, “অত আমি খেতে পারব না। কমিয়ে আনো।”

ঝুমরি কথাটা গায়েই মাখল না। থালা রেখে জল গড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।

অগত্যা হরি খেতে বসল। আশ্চর্যের বিষয়, পাহাড়টা অর্ধেক তার পেটে সেঁধিয়ে যাওয়ার পরও পেটটা বেশ ফাঁকা-ফাঁকাই লাগছিল হরির। একা-একা বসেও এত ভাত খেতে হরির একটু লজ্জা লাগতে লাগল।

পুরো পাহাড়টা শেষ করে যখন উঠল হরি, তখন নিজের খাওয়ার বহর দেখে সে নিজেও অবাক হয়ে গেল।