৩. নিহত নরেন মল্লিকের গৃহ

নিহত নরেন মল্লিকের গৃহ থেকে ফিরবার পর থেকেই কয়েক দিন ধরে কিরীটীর সমস্ত ঘটনার মধ্যে এবং মল্লিক-গৃহে যে যে মুখগুলি কিরীটী দেখেছিল তাদের মধ্যে বিশেষ একটি মুখ—যেটা তার দেখবার সৌভাগ্য হলো না, দীর্ঘ অবগুণ্ঠনের আড়ালে ঢাকাই ছিল, সেই অদেখা মুখখানির কথাই বার বার তার মনে পড়ছিল। মুখখানি কেমন কে জানে! তবে দেহের রং ও হাতের পায়ের ও দেহের গঠন দেখে মনে হয় মুখখানি নিশ্চয় ছিল সুন্দর।

কিন্তু সুন্দরই যদি মুখখানি হবে তবে তাকে সর্বদা সযতনে অবগুণ্ঠনে ঢেকে রাখবার টী বলতে কেউ তো দেখে নি বা শোনেই নি, এমন কি কেউ তার অবগুণ্ঠন উন্মোচিত মুখখানিও নাকি দেখে নি।

কেন? কি কারণে তার নিজেকে ঐভাবে সযতনে আড়াল করে রাখবার প্রয়াস? বাড়ি বললেন বর্ধমানে এবং স্বামী তো নেই—এমন কি কোন আত্মীয়স্বজনও নাকি নেই তার। এবং পেটের দায়েই যখন তিনি মল্লিক-গৃহে এসে চাকরি নিয়েছিলেন তখন, আর চাকরিই বা এখন করবেন না কেন? সুবিমলবাবুকে ইতিমধ্যে চাকরি ছাড়বার নোটিশ পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিলেন। চাকরি করবেন না আবার দেশেও ফিরে যাবেন কিনা বলতে পারলেন না।

কারো সঙ্গে মল্লিক-গৃহে কথা বলতেন না, অবগুণ্ঠনের অন্তরালে সর্বদা নিজেকে গোপন করে রাখতেন অথচ সর্ব ব্যাপারেই নজর ছিল তার। এমন কি ঐ গৃহে কৃষ্ণা বা কাবেরীর যাতায়াতের ব্যাপারটাও তার অজ্ঞাত ছিল না। আত্মগোপনেচ্ছু অথচ সজাগ।

কয়েক দিন ধরে অনবরত চিন্তার পর কিরীটী তার পকেট-ডাইরীটা খুলে সেদিন সন্ধ্যার দিকে সোফার ওপরে বসে নিজের ঘরে পাতা উল্টোতে লাগল।

এক জায়গায় এসে তার চোখের দৃষ্টি স্থির হলো।

সেই পাতার মধ্যস্থলে কালিতে একটি বৃত্ত আঁকা। বৃত্তের মধ্যস্থলে লেখা নিহত নরেন মল্লিক। এবং বৃত্তের গা থেকে তিনটি এ্যারো (তীরচিহ্ন) টানা। একটির মাথায় লেখা কৃষ্ণা, একটির মাথায় কাবেরী ও একটির মাথায় লেখা সঞ্জীব চৌধুরী। কিরীটী পকেট থেকে কলমটা বের করে বৃত্তটির গায়ে আর একটি নতুন তীরচিহ্ন আঁকলো এবং তার শেষপ্রান্তে লিখল বিনতা দেবী–রহস্যময়ী। সঙ্কেতময়ী।

সিঁড়িতে এমন সময় পদশব্দ পাওয়া গেল। ভারী জুতা পায়ে দিয়ে কে যেন দ্রুত উপরে উঠে আসছে।

পদশব্দ কিরীটীর পরিচিত এবং তাই বুঝতে কষ্ট হয় না আগন্তুক স্বয়ং রহমান সাহেব। রহমান সাহেব বেশ দ্রুতই এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট একটা উত্তেজনার আভাস যেন চিক চিক করছে।

মিঃ রায়!

বসুন–বসুন রহমান সাহেব। কি ব্যাপার, কি এমন নতুন ব্যাপার হঠাৎ আবিষ্কার করলেন?

সত্যি নতুন আবিষ্কারই বটে। তবে বুঝলেন কি করে? বসতে বসতে রহমান সাহেব বললেন।

আপনার চোখ-মুখই যে তারস্বরে বলছে রহমান সাহেব।

কিন্তু আবিষ্কারটা কি বলুন তো?

এ কেসের ব্যাপারে একটা দামী ডকুমেন্ট। বলতে পারেন হয়ত সূত্রও।

সূত্র!

হাঁ—একটা ডাইরী।

কার? মৃত নরেন মল্লিকের বোধ হয়?

আশ্চর্য! তাই। এই দেখুন—বলতে বলতে পকেট থেকে রহমান সাহেব একটা কালো মরোক্কোয় বাঁধা ছোট ডাইরী বের করে এগিয়ে দিলেন কিরীটীর দিকে।

আগ্রহে ও কৌতূহলে ডাইরীটা রহমান সাহেবের হাত থেকে নিয়ে কিরীটী ডাইরীটার পাতা উল্টাতে শুরু করলো। হাতের লেখাটি বিশেষ সুবিধার নয়। তবে নেহাত পড়তে কষ্ট হয় না। ইংরাজীতে লেখা ডাইরী। নিয়মিত সন তারিখ দিয়ে সুসংবদ্ধ ডাইরী নয়।

এলোমেলো খণ্ড খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত সব ঘটনা বা সংবাদ নোট করা হয়েছে ইংরাজীতে।

একের চার অংশ ডাইরীর পাতাগুলো পড়ে পড়ে চোখ বুলিয়ে উল্টিয়েও বিশেষ তেমন কোন আগ্রহের সৃষ্টি করে না বা মনের কোথাও কৌতূহল জাগায় না, তবু কিরীটী পাতাগুলো উল্টে যেতে থাকে।

হঠাৎ মাঝামাঝি জায়গায় একটা পাতায় এসে তার নজর পড়ল, লেখা আছে— কলকাতায় বাড়ি কিনলাম। সমীর এই বাড়ি কেনার ব্যাপারে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। বাড়িটা আমার পছন্দসই হয়েছে।

ব্যাস্ ঐ পর্যন্তই।

তারপর কয়েকটা পাতায় হিসাবের অঙ্ক। আবার কিরীটী উল্টে চলে পৃষ্ঠা। এবং সাত আট পৃষ্ঠা বাদে আবার এক জায়গায় এসে তার দৃষ্টি সজাগ হয়ে ওঠে। লেখা আছে কি আশ্চর্য! হঠাৎ যেন চমকে উঠেছিলাম ওর কণ্ঠস্বরে। কত দিন হয়ে গেছে, তবু যেন ভুলতে পারি নি আদৌ সে কণ্ঠস্বর। অদ্ভুত আশ্চর্য মেয়ে! শোনা মাত্রই মনে হলো যেন এ সেই তারই কণ্ঠস্বর। দূর, এসব কি ভাবছি! কোথাকার কে তার ঠিক নেই। তাছাড়া কত সময় একের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে অন্যের কণ্ঠস্বরের তো কত আশ্চর্য মিলই না থাকে। এও হয়ত তাই।

এ আমার মনের ভুল নিশ্চয়ই।

আবার কয়েক পৃষ্ঠা পরে একটা পৃষ্ঠা। —আশ্চর্য! ওর কণ্ঠস্বর শুনলে এবং ওর চলা দেখলে তার কথাই আমার মনে পড়ে কেন? সে তো কবে মরে ভূত হয়ে গিয়েছে রেল গাড়িতে কাটা পড়ে। না না, এ আমার মনের ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। মিথ্যে কল্পনা।

কয়েক পৃষ্ঠা পরেই আবার এক পৃষ্ঠায়।

আশ্চর্য! কদিন থেকে কেবলই মনে হচ্ছে, কে যেন অনুক্ষণ আমাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকি মনে হয় যেন ছায়ামূর্তি আমার পিছনে পিছনে ফিরছে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছিলাম। তিনি বললেন, নিউরোসিস। স্নায়ুর দুর্বলতা শেষ পর্যন্ত কিনা আমার মধ্যে দেখা দিল!

সত্যিই কি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি? না এটা বয়সের দোষ? অন্য আর একটি পৃষ্ঠায়।

সত্যি, আশ্চর্য মুখের সৌসাদৃশ্য তো! যেন একেবারে তারই প্রতিচ্ছবি। কতকাল আগেকার কথা—স্মৃতির পৃষ্ঠা ঝাপসা হয়ে এসেছে, তবু সেই ঝাপসা পটে আজও যে দুচারটে রেখা মনে আছে তার সঙ্গে যেন কোন পার্থক্য নেই।

নতুন আর একটি পৃষ্ঠা।

মাঝে মাঝে লোভ হচ্ছে বটে ককে নিয়ে ঘর বাঁধি। কিন্তু সাহস হয় না। এই জ্বলন্ত অগ্নিশিখাকে ঘরের মধ্যে হয়ত ধরে রাখতে পারব না। হয়ত বৃথাই পুড়ে ঝলসে যাব। তার চাইতে এই ভালো। থাক সে অবন্ধনা। চট করে ছেড়ে আমাকে যাবে না। কারণ অর্থের খাকতি আছে। ও অবিশ্যি ভাবে যে আমি সেটা বুঝি বুঝতে পারছি না, কিন্তু জানে না তো ওদের মত মেয়েদের অন্তত আমার আর চিনতে বাকী নেই।

আমি ওদের ভাল করেই চিনি।

তারপর ডাইরীর আরো কয়েকটা পৃষ্ঠা কিরীটী উল্টে যায়, কিন্তু বিশেষ তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য চোখে পড়ে না। ডাইরীটা অতঃপর ধীরে ধীরে মুড়ে তাকালো রহমান সাহেবের মুখের দিকে।

এতক্ষণ রহমান সাহেব নিঃশব্দেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলেন। কিরীটী

ওঁর মুখের দিকে তাকাতেই বললেন, পড়লেন?

হাঁ। কোথায় পেলেন এ ডাইরীটা?

নরেন মল্লিকের বেড়রুমে বিছানার নিচে ছিল। ডাইরীটা মধুই গতকাল বিছানাপত্র রোদে দিতে গিয়ে পায়। তারপর আজ বিকেলে থানায় এসে দিয়ে গেল আমাকে।

মধু এসেছিল আজ থানায়?

হ্যাঁ, বললাম তো সে দিয়ে গেল।

মল্লিক-গৃহের আর কোন নতুন খবর পেলেন?

নতুন খবর আর কি পাবো! পাবার মত আর আমাদের আছেই বা কি? বিনতা দেবীর কোন সংবাদ জানেন?

বিনতা দেবী!

হ্যাঁ, উনি তো সেদিন বলছিলেন সুবিমলবাবুকে চাকরি ছাড়বার নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন। তা তিনি চলে গিয়েছেন, না আছেন এখনো জানেন কিছু?

হ্যাঁ, মধুই নিজে থেকে বলল বিনতা দেবী দিন পাঁচেক হলে চলে গিয়েছেন। তারপর একটু থেমে রহমান সাহেব প্রশ্ন করলেন, ডাইরীটা পড়ে কিছু বুঝতে পারলেন মিঃ রায়?

বিশেষ তেমন কিছুই আপাততঃ বুঝতে পারছি না। তবে একটা কথা আমার কি মনে হচ্ছে জানেন?

কি? রহমান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

নিহত নরেন মল্লিক সম্পর্কে আমরা আজ পর্যন্ত যেটুকু তার অতীতের জীবন থেকে জেনেছি সেটা সামান্যই।

কি রকম?

তাই। আমার মনে হচ্ছে নিহত নরেন মল্লিকের অতীত জীবনের পৃষ্ঠাগুলোতে এমন কিছু আছে যেখানে হয়ত তার এই আকস্মিক হত্যা রহস্যের কোন বড় রকমের একটি জটিল সূত্র রয়ে গিয়েছে।

অর্থাৎ?

অর্থাৎ আমি বলতে চাই নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারটা আকস্মিক নয় বা আচমকাও নয়। তার হত্যার বীজ রোপিত হয়েছিল অনেক অনেক দিন আগে। হত্যালিপ্সা মনের মধ্যে পোষণ করে হত্যাকারী সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় ছিল মাত্র এবং তারই যোগাযোগ হচ্ছে হত্যার ব্যাপারটা। অবিশ্যি যোগাযযাগটা পরে ঘটনাচক্রে বা আকস্মিকও হতে পারে। হত্যাকারীকে আমাদের খুঁজে বের করতে হলে যে উপায়েই হোক আমাদের ফিরে যেতে হবে নরেন মল্লিকের অতীত জীবনে। যেখানে ঘটনাচক্রে রোপিত হয়েছিল সেদিন হত্যার বীজ। তাই তো বলছিলাম, শুধু নরেন মল্লিকের গৃহই আর একবার ভাল করে খুঁজে দেখা নয়, কলকাতায় আসবার আগে যেখানে সে ছিল সেখানকার ইতিহাসও তো কম দিনের নয় নেহাৎ। সেটাও যথাসম্ভব অনুসন্ধান করে দেখতে হবে এবং কলকাতা ছেড়ে বর্মায় গিয়ে ব্যবসা ফঁদবার আগেকার দিনের ইতিহাসটাও আমাদের সাধ্যমত সংগ্রহ করতে হবে। এমনি সে কলকাতা ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে বর্মায় গিয়েছিল, না অন্য কোনভাবে নিরুপায় হয়ে সে স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল!

সে সংবাদটা সংগ্রহ করা হয় বিশেষ কষ্টসাধ্য হবে না। রহমান সাহেব বলেন।

দুজনের মধ্যে যখন কথা হচ্ছে তালুকদার এসে ঘরে প্রবেশ করল।

এসো তালুকদার, কি খবর? কিরীটী আহ্বান জানাল।

নরেন মল্লিকের হত্যারহস্যের কোন কিনারা করতে পারলে রায়?

এতক্ষণ ধরে রহমান সাহেবের সঙ্গে সেই আলোচনাই করছিলাম।

কিন্তু কদিন তোমার কোন পাত্তাই ছিল না, ব্যাপার কি?

আর ভাই বল কেন? একটা রেলওয়ে ডাকাতির ব্যাপারে তদন্তে এলাহাবাদ পর্যন্ত ছুটতে হয়েছিল। আজ সকালেই ফিরেছি। অফিসে এসে ভাবলাম যাই তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। যদি কোন নতুন ডেভেলপমেন্ট হয়ে থাকে।

অন্ধকারে ক্ষীণ একটা আলোর শিখা ধরতে পেরেছি। মনে হচ্ছে এবারে হয়ত কিছুটা আরো এগুনো যাবে।

কথাটা শুনে তালুকদার সাহেব উৎসাহিত হয়ে ওঠে, বলে, বটে!

হ্যাঁ, মধুর কাছ থেকে মৃত নরেন মল্লিকের একটা ডাইরী পাওয়া গিয়েছে।

সংক্ষেপে কিরীটী অতঃপর তালুকদারকে ডাইরীর ব্যাপারটা বলে যায়। এবং এও বলে ঐ সঙ্গে, তাই বলছিলাম রহমান সাহেবকে নরেন মল্লিকের অতীত জীবনের ইতিহাসটা যতটা সম্ভব খুঁজে বের করবার জন্য।

সমীরবাবুর কাছে ছাড়াও নরেন মল্লিকের কলকাতা ত্যাগ করে বর্মা যাবার পূর্বের ইতিহাস কিছু কিছু আমি সংগ্রহ করেছিলাম।

করেছিলে নাকি! কই এ কথা তো আমাকে জানাও নি!

হঠাৎ এলাহাবাদ চলে যেতে হলো তাই জানাতে পারি নি, তালুকদার বললে।

কেমন করে কার কাছ থেকে শুনলে?

সেও এক আশ্চর্য ব্যাপার।

কি রকম?

আমার বন্ধু ব্যারিস্টার অমল ঘোষকে তো তুমি চেন?

না চিনি না, তবে নাম শুনেছি তাঁর—ভা প্র্যাকটিস।

এলাহাবাদ যাবার আগের দিন তার বাড়িতে একটা কাজে যেতে হয়েছিল আমাকে। সেখানেই সে কথায় কথায় আমাকে বলে নরেন মল্লিককে নাকি সে চিনত, একই সঙ্গে বিলেত থেকে তারা একই বছরে ব্যারিস্টার হয়।

সত্যি?

হ্যাঁ।

তারপর?

কলকাতায় ফিরে এসে অমলের সঙ্গেই প্র্যাকটিস শুরু করে। তবে বাপের কিছু পয়সা থাকায় প্র্যাকটিস্ জমানোর চাইতে স্ফূর্তির দিকেই তার নজর ছিল। একদল সোসাইটি মেয়ে পুরুষের সঙ্গে আজ পার্টি, কাল পিকনিক, পরশু চ্যারিটি শো এই সব নিয়েই থাকত। এমন সময় তার বাপ হঠাৎ মারা গেলেন সন্ন্যাস রোগে এবং তার মৃত্যুর পর দেখা গেল মৃত বাপ বাজারে প্রচুর দেনা করে গিয়েছেন, যার ফলে মল্লিকের টানাটানি হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু তা তো হলোই না বরং পূর্বের মতই সে হৈ হৈ করে বেড়াতে লাগলো।

তারপর?

তারপর হঠাৎ বছর দুয়েক বাদে সে যে কোথায় উধাও হয়ে গেল বাজারে প্রচুর দেনা করে কেউ জানতে পারল না। অনেকদিন পরে অবিশ্যি জানা যায় যে সে গিয়েছিল মগের মুলুকেই।

কিরীটী তালুকদারের কথা উগ্রীব হয়ে শুনছিল। এবার মৃদু কণ্ঠে বললে, তা হলে নরেন মল্লিকের বর্মা যাবার পশ্চাতে একটা উদ্দেশ্য পাওয়া গেল। পাওনাদারদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া!

তা ছিল বৈকি। তাই তো অমল বলছিল, মল্লিক লোকটা যাদু জানে নচেৎ বর্মা থেকে পনের বছর পরে যখন ফিরে এলো, ব্যাগ ভর্তি করে সৌভাগ্য নিয়ে এলো কি করে? পনের বছরে কি করে সে ভাগ্যটাই ফিরিয়ে নিল?

তোমার ব্যারিস্টার ঘোষের সঙ্গে আমার একটু আলাপ করিয়ে দিতে পারো তালুকদার?

পারবো না কেন! কবে যেতে চাও বল!

যত শীঘ্র সম্ভব।

কাল চলো সন্ধ্যার পর।

বেশ তাই যাব, তাহলে এবারে উঠি।

এসো। আর একটা কথা তালুকদার!

কি বল তো?

বলছিলাম শুধু নরেন মল্লিকের বাড়িটাই আর একবার ভাল করে সার্চ করা নয়, ঐ সঙ্গে কৃষ্ণা কাবেরীদের ফ্ল্যাটটাও আর একবার ভাল করে সার্চ করা প্রয়োজন।

তার মানে সেই খোঁড়া সঞ্জীব চৌধুরীর ফ্ল্যাট! না বাবা, সেখানে আমি যেতে পারবো না। ভদ্রলোক যেন খোঁচা খাওয়া বাঘের মত সর্বদা থাবা বাড়িয়েই আছে। যেতে হয় তুমি যাও।

বেশ, আমিই না হয় যাবো। হাসতে হাসতে কিরীটী বলে, তাহলে তুমি যাও মল্লিক ভবনে।

তা যাবো।

বিদায়ের আগে রহমান সাহেব বললেন, ডাইরীটা কি তাহলে আপনার কাছেই—

হাঁ রহমান সাহেব। ডাইরীটা আমার কাছেই থাক।

রহমান ও তালুকদার বিদায় নিল। কিরীটী কিন্তু উঠলো না। সে যেমন সোফার উপরে বসেছিল তেমনই বসে রইলো।

ডাইরীটা পড়বার পর থেকে এবং তালুকদারের মুখে নরেন মল্লিক সম্পর্কে আরো কিছুটা নতুন তত্ত্ব শুনে তার মনের চিন্তাধারাটা যেন সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন পথে বইতে শুরু করেছে। এবং এতক্ষণে যেন সমস্ত ঘটনাগুলোকে নতুন করে পর পর সাজিয়ে নির্দিষ্ট একটি আকারে পৌঁছবার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছে। কৃষ্ণা ও কাবেরীর ফ্ল্যাটটা সার্চ করবার চাইতেও খোঁড়া সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করবার ইচ্ছাটাই কিরীটীর প্রাণে প্রবল হয়ে উঠছিল। খোঁড়া অর্থাৎ বিকলাঙ্গ হয়েও মেয়েদের প্রতি তার অদ্ভুত একটা আধিপত্য, বিশেষ করে তারা অপরূপ সুন্দরী, শিক্ষিতা ও উপার্জনশীল হওয়া সত্ত্বেও, যা এ যুগের মেয়েদের মধ্যে বড় একটা দেখাই যায় না এবং শুধু আধিপত্যই নয়, বাপের অমতে চলবার কৃষ্ণা বা কাবেরীর কারোই সাহস নেই। বাঘিনী যেমন বাচ্ছাদের আগলে রাখে সর্বদা তেমনি করেই খোঁড়া সঞ্জীব চৌধুরী তার মেয়ে কৃষ্ণা ও কাবেরীকে আগলে রেখেছে।

কিন্তু কেন এ সতর্কতা!

এর মূলে কোন সন্দেহ বা কোন রকম কমপ্লেকস্ সঞ্জীবেরই। আর মেয়েরাই বা বাপকে অত ভয় করে চলে কেন? কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ মেয়েদের নিয়ে চলে যাবার পর দীর্ঘ পনের বছরের সঞ্জীব চৌধুরীর ইতিহাসটা আজো জানা যায় নি। দীর্ঘ পনের বছর এক আধ দিনও নয়। একটা যুগ। দীর্ঘ পনের বছর। হঠাৎ যেন বিদ্যুৎচমকের মতই একটা সম্ভাবনা কিরীটীর মনের মধ্যে উঁকি দেয়।

কি আশ্চর্য! আশ্চর্য, সেও ঠিক পনের বছর! সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো সরল হয়ে আসে। আনন্দে চোখের তারা দুটো চক্ চক্ করে ওঠে। আর দেরি নয়, কালই যেতে হবে তাকে সঞ্জীব চৌধুরীর ওখানে। কিরীটী উঠে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল। ডাক্তারই তাকে ঠিক সংবাদ দিতে পারবে। এবং যেতে হবে তাকে কৃষ্ণা ও কাবেরীর অনুপস্থিতিতে।

বেলা তখন ঠিক দ্বিপ্রহর। কিরীটী আগে হতেই সংবাদ নিয়ে জেনেছিল ঐদিন দ্বিপ্রহরে দুটি বোনেরই অফিসে ডিউটি আছে, দুজনের একজনও দ্বিপ্রহরে বাড়ি থাকবে না। আসবার পথে কিরীটী পার্ক সার্কাস থানা ইনচার্জ খোদাবক্সের কাছ থেকে দুজন লাল পাগড়ী সঙ্গে করে নিয়ে এল।

সোজা উপরে উঠে এসে কিরীটী দরজার কলিং বেল টিপতেই একটু বাদে একটি বৃদ্ধা গোছের ঝি এসে দরজা খুলে দিল।

কাকে চান বাবু?

মিঃ চৌধুরী, মানে বুড়ো বাবু বাড়িতে আছেন?

আছেন, কিন্তু তিনি কারো সঙ্গেই দেখা করেন না বাবু।

তুমি বুঝি এ বাড়িতে চাকরি করো, কি নাম তোমার?

আজ্ঞে সরলা।

দিনরাতের?

আজ্ঞে বাবু না, ঠিকে কাজ করি।

আমার বড্ড জরুরী দরকার, একটিবার বাবুর সঙ্গে দেখা না করলে চলবেই না। তুমি গিয়ে বাবুকে বরং একবার—

ঝি ভীত, শঙ্কিত ভাবে বলে ওঠে, ওরে বাবা! তাঁর কাছে কে যাবে বাবু? কদিন থেকে কর্তাবাবুর যা মেজাজ হয়ে আছে, আর তা ছাড়া বাবুর ঘরে ঢুকবারও আমার হুকুম নেই–

এমন সময় হঠাৎ ভিতর থেকে গম্ভীর গলায় কে যেন প্রশ্ন করল, কে? একটা খট্ খট্‌ শব্দও শোনা গেল ঐ সঙ্গে।

খট খট খট! …শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে।

একটু পরেই ভিতর ও বাইরের মধ্যবর্তী দরজার উপরে দেখা গেল সঞ্জীব চৌধুরী ক্রাচে ভর দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন।

তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সঞ্জীব প্রশ্ন করলেন, কে আপনি, এখানে কি চান?

কিরীটী বিনম্র কণ্ঠে বললে, এখানকার ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের এইচ. কিউ. থেকে আসছি, আমার নাম ধূর্জটি রায়।

ওঃ। তা এখানে আপনার কি প্রয়োজন?

আপনিই কি মিঃ সঞ্জীব চৌধুরী?

হাঁ।

তা দেখুন, প্রয়োজন বিশেষ একটা আছে বৈকি। কিন্তু সেটা তো এভাবে এইখানে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলা চলে না।

ওঃ। আসুন তাহলে ভিতরে।

কিরীটী কমধ্যে এসে প্রবেশ করল।—বসতে পারি?

বসুন।

কিরীটী একটা সোফার উপরে উপবেশন করল।

বলুন কি চান আপনি?

আপনার বাড়িটা একবার সার্চ করতে চাই—

সার্চ করতে চান, মানে?

হ্যাঁ, বিশ্বস্ত সূত্রে আমাদের অফিস অবগত হয়েছে, আপনার বাড়িতে নাকি কতকগুলো জরুরী পলিটিক্যাল ডকুমেন্টস্ লুকানো আছে—

ভ্রূ কুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সঞ্জীব চৌধুরী কিরীটীর দিকে বারকয়েক তাকালেন, কি বললেন পলিটিক্যাল ডকুমেন্টস্?

আজ্ঞে।

কিছুক্ষণ ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সঞ্জীব যেন কি ভাবলেন, পরে গম্ভীর নিরুৎসুক কণ্ঠে বললেন, বেশ, আসুন। দেখুন খুঁজে।

কিরীটী প্রথমেই কৃষ্ণা কাবেরীর ঘরটা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করা শুরু করলে।

কিরীটীকে এই ঘরে পৌঁছে দিয়ে সঞ্জীব তার নিজের কক্ষে গিয়ে চেয়ারটার উপরে একটা বই খুলে নিয়ে বসলেন। কিরীটী কিন্তু কিছু তেমন খুঁজে পেল না কৃষ্ণা কাবেরীর ঘরে।

এ ঘরের যা কিছু দেখবার দেখে কিরীটী সঞ্জীবের কক্ষে এসে প্রবেশ করলো।

সঞ্জীব বই হতে মুখ না তুলেই প্রশ্ন করলেন, কি চাই?

আপনার ঘরটাও একবার দেখতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন!

দেখুন—স্বচ্ছন্দে।

কথাটা বলে সঞ্জীব যেমন বই পড়ছিলেন তেমনি বই পড়তে লাগলেন।

কিরীটী বিনা বাক্যব্যয়ে তার অনুসন্ধান শুরু করে দিল।

প্রথমেই বইয়ের আলমারি ও অন্যান্য ড্রয়ার ও ডেস্কগুলো তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করেও কিরীটী তার অভীপ্সিত বস্তু খুঁজে পেল না।

কি হলো, কিছু পেলেন?

অ্যাঁ! কি বললেন?

বলছিলাম, পেলেন খুঁজে সেই পরশ পাথরটি—that valuable document of your most Honourable the ইংরাজ সরকার বাহাদুরের?

সঞ্জীবের কথায় চকিতে ফিরে দাঁড়াল কিরীটী। সঞ্জীবের চোখের দৃষ্টিও কিরীটীর উপরে নিবদ্ধ, পাথরের মত স্থির দৃষ্টি, সমস্ত মুখের রেখায় যেন একটা সুকঠিন তাচ্ছিল্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

শুনুন মিঃ সি. আই. ডি. যে মুহূর্তে আপনি ঘরে এসে ঢুকেছেন আপনার আসল ইচ্ছাটা আমার কাছে আর অস্পষ্ট থাকে নি। আমি জানি কি জন্য আপনি এ সময় আমার বাড়িতে হানা দিয়েছেন। আপনি কেন, এ দুনিয়ায় কারো সাধ্য নেই একবার সঞ্জীব চৌধুরীর হাতে মুঠোর মধ্যে যা আসে তাকে ছিনিয়ে নিতে পারে। যাক সে কথা, আশা করি আপনার যা জানবার ছিল আপনি জেনেছেন।

কিরীটীর চোখে মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে ওঠে, বুঝলাম, কিন্তু যাবার আগে আমি একটা জিনিস মাত্র আপনার এখান হতে নিয়ে যাবো–

কি? বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকান সঞ্জীব কিরীটীর মুখের দিকে।

বিশেষ তেমন অবিশ্যি কিছুই নয়—আপনার হাতের ঐ বইটি—

এই বইটা! ফ্যালফ্যাল করে তাকান সঞ্জীব কিরীটীর মুখের দিকে।

হাঁ। বলেই মুহূর্তে যেন ছোঁ মেরে কিরীটী সঞ্জীবের কোলের উপর রক্ষিত বইটা তুলে নেয় এবং তাকে দ্বিতীয় বাক্যব্যয়ের অবকাশমাত্র না দিয়ে বলে ওঠে, যা আমি এখানে খুঁজতে এসেছিলাম পেয়েছি মিঃ চৌধুরী। ধন্যবাদ। আচ্ছা good bye!

কিরীটী তড়িৎ-পদে কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল।

সঞ্জীব চৌধুরী কতকটা যেন বোকা বনে গিয়েছেন এমনি ভাবে কিরীটীর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।

.

কিরীটীর বসবার কক্ষ। একা একা তালুকদার বসে বসে খানকয়েক চিঠি একটার পর একটা পড়ে যাচ্ছিল। কিরীটী এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

আরে তালুকদার যে, কতক্ষণ?

তা আধ ঘণ্টাটাক তো হবেই—এই যে এই চিঠিগুলো নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষের একটা আলমারির গুপ্ত ড্রয়ার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

কিরীটী সঞ্জীব চৌধুরীর ঘর হতে আনীত মোটা বইখানা পাশের টেবিলের উপরে রেখে একটা সোফার উপরে গা এলিয়ে দিতে দিতে বললে, প্রেমপত্র নিশ্চয়?

হুঁ।

প্রেমিকাটি কে?

সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না।

কি রকম?

এই দেখো না—এগিয়ে দিল তালুকদার চিঠিগুলো ও খামগুলো কিরীটীর দিকে।

চিঠি ও খামগুলো উল্টে-পাল্টে দেখে কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বললে, হুঁ, এখানেও অগাধ জল। প্রত্যেকটা চিঠির মধ্যেই দেখছি সম্বোধন করা হয়েছে প্রিয়া আমার প্রিয়তম বলে আর চিঠির নিচে নাম স্বাক্ষর করা হয়েছে ইতি তোমার ক বলে। ক অর্থাৎ কৃষ্ণাও হতে পারে। কাবেরীও হতে পারে। এদিকে আমি যে চিঠিগুলো উদ্ধার করে এইমাত্র আনলাম তাতেও দেখলাম লেখা আছে, প্রিয়তম আমার সম্বোধনে, আর ইতি করা হয়েছে তোমার প্রিয় ‘ন’ বলে। Again that blessed কৃষ্ণা কাবেরীর puzzle!

যা বলেছে, যে দিকে যাই ঐ কৃষ্ণা কাবেরী যেন পথরোধ করে দণ্ডায়মান–

কিন্তু যেমন করে হোক কৃষ্ণা কাবেরী রহস্য আমাদের সমাধান করতেই হবে। শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠে যেন একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সুর ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে।

রায়, এবারে দেখছি সত্যিই তোমায় হার মানতে হলো!

হার মানতে হলল! সিংহের মত গ্রীবা বেঁকিয়ে, কেশর ফুলিয়ে কিরীটী যেন সহসা সোজা হয়ে বসে, আমিও কিরীটী রায়, তালুকদার।

কিরীটীর চোখে, মুখে, সর্বদেহে এবং কণ্ঠস্বরে পর্যন্ত একটা ঋজু কাঠিন্য যেন ইস্পাতের মতই ঝিকিয়ে ওঠে।

হঠাৎ কিরীটী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এবার জাল গুটাবো। এগিয়ে গিয়ে কিরীটী ফোনের মাউথ-পিষ্টা তুলে নেয়। হালো! Put me to P. K. …Please!

কে, ডাক্তার? আমি কিরীটী।

হাঁ। কি সংবাদ?

শোন—

.

মধুর কাছে অনুসন্ধান করতেই কিরীটী বিনতা দেবীর একটা সন্ধান পেয়ে গেল। কলকাতা ছেড়ে বিনতা দেবী আপাততঃ যান নি। পার্ক সার্কাসের কাছে একটা অখ্যাতনামা গলির মধ্যে একটা ঘর নিয়ে আছেন। মধু সেখানে মধ্যে মধ্যে যায়। বেচারী মধু তাকে সত্যিই ভালবেসেছিল। তাই আজও তার মায়াটা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। মধ্যে মধ্যে সেখানে গিয়ে তার বাজারটা-আসটা করে দিয়ে আসে। মধু গলির নাম বা বাড়ির নম্বরটা বলতে পারল না, কিন্তু দূর থেকে কিরীটীকে দেখিয়ে দিল।

হঠাৎ মধু একটা প্রশ্ন করে কিরীটীকে, বিনতা মাকে আপনার কি দরকার বাবু? তার এত খবর নিচ্ছেন কেন এত করে?

তোমার বাবুর চাকরি তো ছেড়ে দিলেন, তাই ভাবছিলাম যদি ওঁর অন্য কোথাও একটা ভাল ব্যবস্থা করে দিতে পারি!

আহা, তা যদি পারেন তো তার বড় উপকার হয়। মা আমার বড় ভাল।

তা সুবিমলবাবু তো শুনলাম ওঁকে চাকরি থেকে ছাড়াতে চান নি, তবে উনি চাকরি ছেড়ে দিলেন কেন মধু?

কি জানি বাবু, সেটাই তো বুঝতে পারলাম না। তবে আমার মনে হয় ভয়ে।

ভয়ে! কিসের ভয়ে?

মধু এবার যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে।

কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, কি ব্যাপার বল তো?

বাড়িটার মধ্যে বাবু মারা যাবার পর থেকেই কেমন যেন সব শব্দ শোনা যায়—

বল কি!

হাঁ বাবু, আর আর যারা সব আছে তারাও ইতিমধ্যে পালাই পালাই শুরু করেছে।

শব্দ! কি রকম শব্দ বল তো?

সে বাবু নানা রকমের শব্দ!

কিরীটীর ইচ্ছা ছিল কথাপ্রসঙ্গে মধুর ক্ষণপূর্বের বিনতা সম্পর্কে কৌতূহলের চিন্তাধারাটা একটু ঘুরিয়ে দেবে। কথাপ্রসঙ্গে সেটা আপনা থেকেই হয়ে যেতে কিরীটী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

মধুর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে তাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী অন্য পথ ধরলো। পার্ক সার্কাস অর্থাৎ এ অঞ্চলেই কৃষ্ণা ও কাবেরীদের ওপর সর্বদা নজর রাখবার জন্য সে নিজের যে লোকটিকে নিযুক্ত করেছিল, ভাবল তার সঙ্গে একবার দেখা করে যাবে যখন এ অঞ্চলেই এসেছে। কৃষ্ণা কাবেরীদের ফ্ল্যাটটা সেখান থেকে বেশী দূরেও নয়।

বড় রাস্তাটার একদিকে ফ্ল্যাট বাড়িটা এবং ঠিক তার উল্টোদিকে ডিলুক্স রেস্তোরা। সন্ধ্যা সবে তখন উত্তীর্ণ হয়েছে। শীতের সন্ধ্যা। রেস্টুরেন্ট ইতিমধ্যেই চা-পিয়াসীদের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠেছে।

রেস্টুরেন্ট থেকে অল্প দূরে গাড়িটা পার্ক করে মন্থর পদে এগিয়ে চলল কিরীটী রেস্টুরেন্টের দিকে। মাঝারি গোছের একটি ঘরের মধ্যে রেস্টুরেন্ট। ভিতরের খরিদ্দারের ভিড় দেখে বোঝা যায় বিক্রিপত্র ভালই। ঘরের মাঝখানে গোটাচারেক টেবিল পেতে খদ্দেরদের বসাবার জন্য স্টীলের চেয়ার পাতা আর দেওয়ালের ধার ঘেঁষেও ব্যবস্থা আছে। দেওয়ালের চারদিকে চারটে ফ্লোরেসেন্ট টিউব জ্বলছে। কাউন্টারের একপাশে রেডিও সেটে শোনা যাচ্ছে পল্লীমঙ্গল আসর জমে উঠেছে। ঘরের বাতাসে পিঁয়াজ রসুন ও মাংস ভাজার একটা লোভনীয় মিশ্র গন্ধ।

ভিতরে প্রবেশ করে কিরীটী একবার চারদিকে তাকাতেই দৃষ্টিটা তার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। দক্ষিণ কোণে মুসলমান বেশভূষায় মাথায় একটা শালের টুপী ২৫/২৬ বছরের একটি যুবক একাকী বসে চা-পান করছিল। কিন্তু চা-পানের চাইতেও তার মনোযোগ ছিল বেশী রাস্তার ঠিক অপর পারে কৃষ্ণাদের ফ্ল্যাটের মেইন দরজাটার দিকে। কারণ সেখান থেকে স্পষ্ট সব কিছু দেখা যায়।

কিরীটী এগিয়ে গিয়ে তার টেবিলেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

রেস্টুরেন্টের একটি ছোকরা এগিয়ে এলো, কি দোব?

এক কাপ স্ট্রং করে চা দাও। ছোকরাটি চলে যেতেই চাপা গলায় কিরীটী তার সামনে উপবিষ্ট মুসলমান-বেশ-পরিহিত লোকটিকে সম্বোধন করে বলল, চন্দ্রনাথ খবর কি?

খবর আছে, স্যার। চা-টা খেয়ে সামনের পার্কে আসুন। আমি সেখানেই অপেক্ষা করছি। চন্দ্রনাথের চা-পান হয়ে গিয়েছিল। উঠে গিয়ে কাউন্টারের দাম মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল।

মিনিট পাঁচেক বাদে কিরীটীও রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো। বড় রাস্তাটা ধরে একটু এগুলেই বাঁ-হাতে একটা ছোট ত্রিকোণা পার্ক। একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে ধূমপান করতে করতে কিরীটী সেই পার্কের মধ্যে প্রবেশ করল।

কিরীটী এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো চন্দ্রনাথের সন্ধানে।

হঠাৎ তার নজর পড়ল চন্দ্রনাথ তারই দিকে এগিয়ে আসছে।

আরো কাছে এসে চন্দ্রনাথ বললে, চলুন স্যার, ঐ বেঞ্চটায় গিয়ে বসা যাক।

বেঞ্চে তখন আর কোন তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না। দুজনে পাশাপাশি বসল।

আপনার কাছে কালই আমি যেতাম আপনি না এলে। গত চার-পাঁচদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম রাত এগারটার পর একটি রিকশা ঠুং ঠুং করে ঐ ফ্ল্যাট বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর সর্বাঙ্গ চাদরে মোড়া ঘোমটা টানা একটি ভদ্রমহিলা রিকশা থেকে নেমে ঐ ফ্ল্যাট বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করেন এবং কিছুক্ষণ বাদে আবার বের হয়ে যান। কিন্তু কাল রাত্রে–

কি?

ভদ্রমহিলাকে গতকাল রাত্রে আমি ফলো করেছিলাম।

করেছিলে?

হাঁ। ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢোকবার পর আমিও কিছুক্ষণ পরে ফ্ল্যাটটার মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।

তারপর?

দেখলাম সোজা তিনি কৃষ্ণা দেবীদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বদ্ধ দরজার গায়ে আঙুল দিয়ে আস্তে আস্তে তিনটি টোকা দিতেই একটু পরে কৃষ্ণা বা কাবেরী দুজনার মধ্যে একজন এসে দরজা খুলে দিলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভিতর থেকে দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

তার পর কি হলো?

তা ঠিক বলতে পারব না, কারণ রাত দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন দেখলাম ভদ্রমহিলা আর ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এলেন না, আমি ফিরে গেলাম।

হুঁ! কিরীটীর হৃদুটো কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।

তাই আজ ভাবছিলাম, আজও যদি তিনি আসেন তো আবার তাঁকে ফলো করবো ও শেষ পর্যন্ত তাঁর জন্য অপেক্ষা করবো।

কিন্তু হয়তো আর তিনি ও-বাড়ি থেকে না-ও বের হতে পারেন।

আপনি বলছেন গত রাত্রে সেই যে তিনি ঢুকেছেন আর বের হন নি!

হাঁ।

হতে পারে। তবু দেখবো।

বেশ। তুমি অপেক্ষা করো। আমিও রাত্রে একবার আসবো।

আসবেন?

হ্যাঁ।

নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পূর্বেই কিরীটী এসে হাজির হলো এবং বাড়িটা থেকে কিছু দূরে একটা গাছের নীচে অন্ধকারে গাড়িটা পার্ক করে সব আলো নিবিয়ে অপেক্ষায় রইলো। চন্দ্রনাথ পিছনের সীটে বসে রইলো। কিন্তু রাত তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোন রিকশা বা অবগুণ্ঠনবতী মহিলার দেখা পাওয়া গেল না। এবং রাত বারোটা নাগাদ ফ্ল্যাটের মেইন দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

কিন্তু কিরীটী এক রাত্রের বিফলতাতেই হতাশ হলো না। পরের রাত্রেও তেমনি অপেক্ষা করল। এবং সে-রাত্রিও নিম্ফলেই গেল।

দেখা মিলল তৃতীয় রাত্রে।

রাত বারোটায় ঠিক গেট বন্ধ হয়ে গেল। এবং রাত যখন একটা হবে, কিরীটীর একটু ঝিম মত এসেছে, পিছন থেকে পৃষ্ঠদেশে একটা মৃদু ধাক্কা খেয়ে সে সচকিত হয়ে উঠল।

এসেছে, স্যার!

অদূরে গীর্জার ঘড়িতে ঢং করে রাত্রি একটা ঘোষিত হলো।

কিরীটী তাকিয়ে দেখলো সর্বাঙ্গে একটা সাদা চাদর আবৃত একটি ভদ্রমহিলা নিঃশব্দ পদসঞ্চারে এগিয়ে আসছেন। মেইন গেটটার সামনে এসে দাঁড়াবার কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ গেটটা খুলে গেল। খোলা গেটের উপরে রাস্তায় লাইটপোস্টের আলোটার খানিকটা অংশ গিয়ে পড়েছে। এবং সেই আলোতেই দেখা গেল, খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা কাবেরীর এক বোন।

আগন্তুক ভদ্রমহিলা ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গেটের কপাট দুটো বন্ধ হয়ে গেল।

অপেক্ষমাণ এক-একটা প্রহর যেন এক এক যুগ বলে মনে হয়। তবু অপেক্ষা করেই থাকে কিরীটী-শেষ পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবেই! এবং শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো। রাত যখন ঠিক চারটে বেজে দশ, গেট খুলে গেল এবং একাকিনী সেই চাদরে আবৃত মহিলা বের হয়ে এলেন।

কিরীটীও সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে তাকে অনুসরণ করল। পায়ে ছিল তার পুরু রবার সোলের দামী জুতো। নিঃশব্দে অগ্রগামী মহিলাকে অনুসরণ করে সে চলল।

নির্জন রাস্তা। একেবারে খাঁ খাঁ করছে। সম্মুখে পশ্চাতে ডাইনে বাঁয়ে জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। শুধু রাত্রিশেষের অন্ধকারে এসেছে একটা দিকে অস্বচ্ছ আভাস। কিন্তু আর ওকে অগ্রসর হতে দেওয়া উচিত হবে না। এবারে একেবারে গলির মুখোমুখি এসে পড়েছে।

কিরীটী আচমকা তার চলার গতি অত্যন্ত দ্রুত করে অগ্রগামী মহিলাকে একেবারে ধরে ফেললে এবং ডাকলে, বিনতা দেবী দাঁড়ান!

চকিতে ভদ্রমহিলা কিরীটীর সেই ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন।

বিনতা দেবী!

সুস্পষ্ট নারীকণ্ঠে এবারে জবাব এলো, আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?

হাঁ।

আপনি বোধ হয় ভুল করেছেন।

ভুল করেছি!

হাঁ। আমার নাম বিনতা নয়। সুস্পষ্ট প্রত্যুত্তর, কোন সংশয় বা জড়তা মাত্রও নেই কণ্ঠস্বরে।

না, আমি ভুল করি নি। তবে বিনতা দেবী ছাড়াও আপনার অন্য কোন যদি নাম থাকে তো বলতে পারি না। কিন্তু সে কথা থাক। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল যে—

আমার সঙ্গে! কিন্তু আপনাকে চেনা তো দূরে থাক, কখনো দেখেছি বলেও তো মনে পড়ছে না আমার। বলতে বলতে হঠাৎই যেন মহিলা তার মুখের উপরের অনতিদীর্ঘ অবগুণ্ঠনটা বাঁ হাত দিয়ে টেনে একেবারে কপালের উপরে তুলে দিলেন।

গলির ঠিক মুখেই একটা গ্যাসপোস্ট ছিল, অবগুণ্ঠন উন্মোচিত মুখখানির ওপর চকিতে সেই আলো এসে পড়ল। এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা আর্ত শব্দ কিরীটীর অজ্ঞাতসারেই তার কণ্ঠ দিয়ে বের হয়ে আসে। কোন জীবিত মানুষের মুখ যে এত ভয়াবহ, এত কুৎসিত হতে পারে এ যেন কিরীটীর চিন্তারও অতীত ছিল।

শুধু ভয়াবহ ও কুৎসিত বললেই হয়ত সবটুকু তার বলা হয় না, বিকৃত একটা দুঃস্বপ্ন। যেন! আগুন বা তীব্র অ্যাসিড জাতীয় কিছুতে পুড়ে গেলে বিশ্রীভাবে যা দাঁড়ায় ঠিক তাই।

মুখের রেখা বা গঠনটাই আছে শুধু। নাক চোখ মুখ ওষ্ঠ জ্বর কোনটারই চিহ্নমাত্রও নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। একটা চোখ আছে, দ্বিতীয়টা নেই।

যার হাঁটা, দেহের গঠন, হাত এবং পায়ের রং দেখে একদা কিরীটীর মনে হয়েছিল কতই না সুন্দরী মহিলা, তার অবগুণ্ঠনের তলায় যে এত বড় একটা ভয়াবহ বিভীষিকা ঢাকা থাকতে পারে বুঝি সে কল্পনাও করে নি।

বিস্ময়ের ঘোরটা কেটে যাবার পর কিরীটীর স্বাভাবিক অবস্থাটা যখন ফিরে এলো দেখলো অবগুণ্ঠিতা মহিলা ধীরে ধীরে সামনের গলির মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছেন।

নির্বাক কিরীটী দাঁড়িয়ে রইলো। একটি শব্দও আর তার ওষ্ঠপ্রান্তে জাগল না। ফিরে এলো যখন কিরীটী, গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রনাথ।

কি হলো স্যার?

বিশেষ তেমন কোন সুবিধা করতে পারলাম না চন্দ্রনাথ। গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিতে দিতে কথাটা মৃদু কণ্ঠে বললে কিরীটী।

আমি কি এখনো যেভাবে ফ্ল্যাটটার দিকে নজর রাখছিলাম রাখব?

হ্যাঁ।

ঐদিন সন্ধ্যার ঠিক মুখে। টেলিফোন অফিস। অপারেটিং রুমে অপারেটাররা যে যার মাথায় হেডপিস লাগিয়ে কাজে ব্যস্ত।

হঠাৎ এক সময় কৃষ্ণা উঠে দাঁড়ায়, তার রিলিফ এসে গিয়েছে সুধীরা নাগ।

রিলিফের হাতে কার্যভার তুলে দিয়ে কৃষ্ণা কাবেরীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, আমার duty off হলো, আমি চললাম কাবি, তোর তো দশটা পর্যন্ত ডিউটি আছে, না?

হাঁ। কৃষ্ণা অপারেটিং রুম থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

অপারেটিং রুমে কাজ চলেছে, মধ্যে মধ্যে অপারেটাররা নানা আলাপ-আলোচনা, হাসিতামাশাও করছে।

নবনিযুক্ত দুটি মেয়ে ইতিমধ্যে পরস্পরের মধ্যে নিজেদের ব্যক্তিগত আলোচনা নিয়ে মেতে উঠেছে।

একজনের নাম মিস লীলা ঘোষ, অন্যটির নাম মিস সবিতা চ্যাটার্জী। আরো দুচারজনও সেখানে এসে আড্ডায় যোগ দিয়েছে।

লীলা—জানিস ভাই সাবি, হিমাংশুটা একটা আসল ন্যাকা, কেবল শুনতে চাইবে তাকে আমি ভালবাসি কিনা?

সবিতা-বললেই পারিস, বাসি না।

লীলা—ওরে বাবা! তাহলে রক্ষে আছে? বলবে পটাসিয়াম সায়ানাইড় খাবো।

মিস ঘোষ স্থূলকায়া, বয়সও প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি, এগিয়ে এসে বলে, অমন ঢের বীরই সায়ানাইড় খেয়ে থাকে, এই তো সবে শুরু, বলে কত দেখলাম!

নীরা মল্লিক বলে ওঠে, বলুন না মিস ঘোষ, আপনার সেই fifty second লাভারের কথাটা!

ওদিকে বোর্ডে তখন ঘন ঘন ক আসছে, শ্ৰীমতীদের সেদিকে কারো কিন্তু এতটুকু খেয়াল নেই।

মিস ঘোষ কানেকশনটা দিয়ে বলে, Number please?

ওধার থেকে জবাব আসে, কতক্ষণ ধরে তো বলছি, B. B. 4542-শুনতে পান না নাকি?

মিস ঘোষ কানেকশনটা কেটে আবার আলাপে রত হয়, সে এক মজার ব্যাপার! সে ছেলেটি এক ইনসিওরেন্স অফিসে ১০০ টাকা না কত মাইনের যেন কাজ করতো–

বোর্ডে আবার আলো জ্বলে ওঠে, কল্ এসেছে।

পাশের থেকে একজন অপারেটার বলে ওঠে, আঃ জ্বালাতন! বলুন না মিস ঘোষ এনগেজড!

মিস ঘোষ আবার কনেকশনটা দিয়ে বলে, Number please!

Please put me B. B….

নম্বর বলা শেষ হবার আগেই মিস ঘোষ জবাব দেয়, Engaged! বলেই কনেকশনটা কেটে দেয়।

আর একজনও নম্বর চাওয়ায় বলে দিল, West line engaged!

আর একজনকে বললে, No reply!

আলাপ-আলোচনায় সব মশগুল।

যাকে No reply জবাব দেওয়া হয়েছিল, সে আবার কল্ করলে, শুনছেন? Clerk-inchargeকে কনেকশন দিন তো?

সবিতা জিজ্ঞাসা করে, কি বলছে রে মলি?

মলি হাসতে হাসতে জবাব দেয়, ক্লার্ক ইশ্চার্জকে কানেকশনটা দিতে বলছে।

চুপ করে থাক। সাড়া দিস না। কতক্ষণ ট্যাপ করবে করুক না।

এবার সুধীরা নাগের আলোটা জ্বলে উঠলো।

Number please!

দেখুন আপনাদের অপারেটর মিস চৌধুরী আছেন?

কি নাম বললেন? কৃষ্ণা চৌধুরী? সুধীরা কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

হ্যাঁ, কৃষ্ণা চৌধুরী। বলুন থিয়েটার রোড থেকে ডাঃ সুকুমার গুপ্ত কথা বলতে চাইছেন, অনুগ্রহ করে একটু ডেকে দিন না—

কথাটা কাবেরীর কানে গিয়েছিল, মিস নাগ জবাব দেওয়ার আগেই সে কানেকশনটা নিয়ে প্রশ্ন করলে, হ্যালো কে? ডাক্তার গুপ্ত?

হাঁ। মানে—আপনি, মানে

হ্যাঁ, কৃষ্ণা কথা বলছি, ব্যাপার কি?

কৃষ্ণা, আজ তোমার off কখন?

কেন বল তো?

বল না আগে, তারপর বলছি—

রাত দশটায়।

আজ ডিউটির পর আসবে এখানে?

যেতে পারি, কিন্তু আগে বল তো কেন?

বলতেই হবে!

নিশ্চয়ই।

আজ ভাবছি দুজনে গিয়ে কাফে-ডি-মুনে ডিনার খাবো, ইনডিয়ান ডিশ।

তারপর?

তারপর a long pleasure drive—

Oh how lovely! কোথায়—কতদূর?

So long as the petrol tank is not empty! রাত দশটায় ঠিক হাজির থাকবো। গেটের সামনে—with my car–

O. K.!

.

ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার।

ডাঃ সুকুমার একটা সোফার উপরে আরাম করে গা এলিয়ে দিয়ে কৃষ্ণাকে ফোন করছিল, ফোন শেষ হতেই ফোনটা যেমন নামিয়ে রাখতে যাবে, সুইং ডোর ঠেলে কৃষ্ণা এসে প্রবেশ করল কক্ষে। পদশব্দে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকাতেই সুকুমার চমকে ওঠে, কতকটা আত্মগতভাবেই যেন উচ্চারণ করে, এ কি! তু-তুমি?

খুব আশ্চর্য হয়েছে তো! Surprise একটা রীতিমত দিয়েছি তো?

পরক্ষণেই ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণাও যেন কতকটা বিস্মিত হয়ে বলে, ব্যাপার কি বল তো? এসে কি অন্যায় করলাম নাকি হঠাৎ এ সময়? ফিরে যাবো?

কৃষ্ণা সত্যি সত্যিই চলে যেতে উদ্যত হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।

আরে না না—চলে যাচ্ছো কেন—সুকুমার ততক্ষণে অভাবনীয় পরিস্থিতিটা সামলে উঠেছে, মৃদু হেসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, চলে যাবে মানে? জান এই মুহূর্তে আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম!

কৃষ্ণা মৃদু হেসে ফেলে, কিন্তু ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মুখের চেহারা যা হয়েছিল তাতে করে মনে হয়েছিল

কি মনে হয়েছিল বল তো?

কি আবার! মনে হয়েছিল—মনে হয়েছিল আর যাকেই হোক ঠিক ঐ মুহূর্তটিতে আমাকে অন্তত যেন তুমি expect করো নি।

হা ভগবান! দিবানিশি যার ধ্যানে আছি নিমগন, সেও কিনা হেন বাক্য করে উচ্চারণ! কিন্তু দাঁড়িয়ে কেন কৃষ্ণা, বোস! চা আনতে বলি, কৃষ্ণা জবাব দেবার আগেই বেল্ বাজিয়ে জগদেওকে ডাকে সুকুমার।

জগদেও এসে কক্ষে প্রবেশ করে। সুকুমার বলে, জগদেও, জলদি চা!

সোফা হতে উঠে সুকুমার বলে, এক মিনিট—একটু বোস, আমি চট করে dressটা একটু বদলে আসি।

হঠাৎ? ড্রেস চেঞ্জের কি এমন দরকার পড়লো এ সময় শুনি?

হঠাৎ নয় দেবী, পূর্বপরিকল্পিত এবং ইতিমধ্যে তুমি না এসে পৌঁছে গেলে হয়ত তোমাকে ফোন করতাম।

কিন্তু পেতে না, কারণ আজ সন্ধ্যা ঠিক ছটায় আমার duty off তুমি জানতে না—

দ্বিতীয়টা স্বীকার করি, কিন্তু প্রথমটা স্বীকার করতে রাজী নই।

মানে?

মানে যাকে মনেপ্রাণে ডাকা যায়, ফোনে তার সাড়া না পেলেও সশরীরে এসে সে হাজিরা দেয়—ইহাই বেদবাক্য কহে সুধীজন। সুকুমার কথাটা শেষ করে হাসতে থাকে।

তা বইকি! কক্ষনো না। রাস্তায় বের হয়েই হঠাৎ তোমার কথা মনে হলো, তাই চলে এলাম তোমার এখানে সোজা।

আসতেই হবে, জান তো আমি একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট একেই বলে টেলিপ্যাথি, এর আকর্ষণ মাধ্যাকর্ষণের চাইতেও বেশী। বেচারী নিউটন ভূমি আকর্ষণ নিয়েই মেতে ছিল—মনের আকর্ষণ যে ভূমির আকর্ষণের চাইতে শত-সহস্র গুণে বেশী টের যদি পেত তাহলে হয়ত–

থাক, আর আকর্ষণের কাজ নেই যাও পোশাক বদলাতে যাচ্ছিলে তাই বদলে এসো।

হাঁ যাই—তুমিও ইতিমধ্যে বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখটা ধুয়ে এসো না।

মন্দ বল নি। কৃষ্ণা উঠে বাথরুমের দিকে চলে গেল।

কৃষ্ণা ঘর হতে বের হয়ে যেতেই চট্‌ করে সুকুমার ফোনটা তুলে নিল : হ্যালো, please put me to south…

ওপাশ হতে কিরীটীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, Kirity Roy speaking!

কে, কিরীটী? আমি সুকুমার।

কি ব্যাপার? হঠাৎ ফোন?

আজকেই–সব ready রাখবি, সুযোগ হঠাৎ মিলে গিয়েছে অভাবনীয়, এখন আর নয়, আবার মিলনী সঙ্ঘ থেকে তোকে ring করবো।

সুকুমার ফোনটা নামিয়ে রেখে বেশ পরিবর্তনের জন্য পাশের কক্ষে চলে গেল। কৃষ্ণা তখনও বাথরুম থেকে বের হয় নি।

.

একটু পরে জগদেও ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। ত্রিপয়ের ওপরে ট্রে-টা নামিয়ে রেখে চলে যেতেই কৃষ্ণা প্রসাধনান্তে কক্ষে এসে প্রবেশ করল গুনগুন করে গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে। কাপ সাজিয়ে দুধ চিনি দিয়ে সব প্রস্তুত করে রেখে কৃষ্ণা সুকুমারের অপেক্ষা করতে থাকে। এবং একটু পরেই সুকুমারও এসে কক্ষে প্রবেশ করল, পরিধানে তার ধুতি-পাঞ্জাবি।

এ কি, বসে আছো কেন? শুরু করলেই পারতে। সুকুমার কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে।

এসো, আজ কি তোমার চেম্বার বন্ধ?

আজ যে রবিবার।

সত্যিই তো, মনে ছিল না।

চা-পান চলতে থাকে। হঠাৎ কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, আচ্ছা অফিসে আমাকে ফোন করবে বলেছিলে কেন?

আজ তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।

কোথায়?

মিলনী সঙ্ঘে!

মিলনী সঞ্জ?

হ্যাঁ, দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত মহলের নর-নারীদের একটা ক্লাব বা মিলন কেন্দ্র। আজ সেখানে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান আছে—বিখ্যাত আধুনিক গাইয়ে শ্রীমন্ত মুখার্জি সন্ধ্যায় গান গাইবেন। শুনেছো শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর গান?

না।

সত্যিই শোনবার মত। যেমন মিষ্টি তেমনি সুরেলা কণ্ঠ।

কিন্তু–

ভয় নেই, রাত দশটার আগেই তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।…আর দেরি করলে হয়ত ওদিকে গানের পালা শেষ হয়ে যাবে, চল ওঠো।

কৃষ্ণা উঠে দাঁড়ায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, আচ্ছা কিরীটী রায়কে তুমি চেনো সুকুমার?

চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সুকুমার, কিরীটী রায়!

হ্যাঁ, চেনো নাকি তাই বল না?

চিনি। কিন্তু কেন বল তো? তুমিও তাকে চেনো নাকি?

হ্যাঁ, গতকাল পরিচয় হলো।

ও। তারপর হঠাৎ কি ভেবে প্রশ্ন করে, কেমন লাগল ভদ্রলোকটিকে?

আজ নয়, এ প্রশ্নের জবাব তোমাকে অন্য একসময় দেবো।

.

কিরীটীর বাড়ি। তালুকদার ও রহমানের সঙ্গে কিরীটী কথা বলছিল।

বেশ, রহমান জবাব দেয়, তাহলে আমি উঠি।

হ্যাঁ, আসুন।

রহমান চলে যেতে উদ্যত হতেই কিরীটী সহসা রহমানকে বাধা দিয়ে বলে ওঠে, হাঁ ভাল কথা রহমান সাহেব, গতরাত্রি থেকেই নরেন মল্লিকের মার্ডার সম্পর্কে একটা কথা ভাবছিলাম আপনাকে জিজ্ঞাসা করবো, তা—

কি বলুন তো?

আচ্ছা নরেন মল্লিকের বাড়িটা ভাল করে সার্ভে করা হয়েছিল নিশ্চয়?

হ্যাঁ, কেন বলুন তো?

আচ্ছা, মল্লিকের বাড়িতে মেইন গেট ছাড়া আর কোন প্রবেশ পথ আছে কিনা জানেন?

হ্যাঁ, বাড়িটার পিছন দিকে ছোট একটা বাগান আছে, বাগানের প্রাচীরের ওপাশে সরু একটা blind lane আছে, সেই blind lane দিয়েই একটা দরজা আছে বাড়িতে প্রবেশ করবার দেখেছি।

আছে? যাক বাঁচা গেল। শেষ পর্যন্ত এসে ঐ puzzleটাই আমাকে বিব্রত করে তুলেছিল গত দুদিন ধরে, যদিচ ঐরকম একটা কিছুর সম্ভাবনা সম্পর্কে না জানা থাকলেও কতকটা sureই ছিলাম—It was so important—কিরীটীর কণ্ঠস্বরে উল্লাস যেন উপচে পড়ে।

আমি আপনাকে ঠিক follow করতে পারলাম না তো! মিঃ রহমান বলে ওঠেন।

বলেন কি রহমান সাহেব! খুনোখুনির ব্যাপারে একটা দরজা থাকার importance কি কম?

কিন্তু দরজাটায় তো সর্বদা তালা লাগানো থাকত—সেদিনও তালা লাগানোই ছিল, যতদূর মনে আছে আমার।

কোন্ দিক থেকে তালা লাগানো থাকতো, ভিতরের দিক থেকে না বাইরের দিক থেকে?

বাইরের দিক থেকেই—অবশ্য তালাটা কখনো সেইজন্য ভোলাই হতো না।

ঠিক উল্টো। সেই কারণেই প্রায়ই তালা খোলা হতো এবং ঐ দ্বারপথেই নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষে ঘোরানো সিঁড়ি অতিক্রম করে, পরে সেরাত্রে বাথরুমের দরজা দিয়ে খুনী প্রবেশ করেছিল।

কি বলছেন? আমরা তো পরের দিন সকালে গিয়ে বাথরুমের সে দরজাটা বন্ধ দেখেছিলাম! খুনী যদি ঐ রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে থাকবে তবে–

তবে সে কোন্ পথে পলায়মান হলো, এই তো আপনার প্রশ্ন?

হ্যাঁ, মানে—

পালিয়েছে সে সদর দ্বার দিয়ে।

অ্যাঁ! তালুকদার এবার বলে ওঠে।

হ্যাঁ, easiest and shortest route! খুনীর গৃহে প্রবেশ, হত্যা ও পলায়ন পর্যন্ত solved! বাকী এখন আয়নাটার ভাঙা কাচ and why at all that particular knife was used and not a bullet! এটার জবাব অবশ্য আশা করি কৃষ্ণা ও কাবেরীর কাছ থেকেই পাবো।

একটু পরে কিরীটী আবার রহমানকে লক্ষ্য করে বলে, আচ্ছা রহমান সাহেব আপনি তাহলে আসুন।

রহমানের প্রস্থানের পর কিরীটী তালুকদারকে বললে, চলো একবার মিলনী সঙ্ঘের আশপাশ চক্কর দিয়ে আসা যাক্।

সেখানে আবার কেন?

চলই না।

.

মিলনী সঙ্ঘ। দক্ষিণ কলকাতার অতি আধুনিক ও আধুনিকাদের মিলন কেন্দ্র ঐ সঙ্। সুকুমারের গাড়ি যখন মিলনী সঞ্জের বাড়ির পোর্টিকোর নিচে এসে দাঁড়াল রাত্রি তখন সোয়া সাতটার বেশী নয়। সামনেই আলোকোজ্জ্বল হলঘরটি বহু নর-নারীর কণ্ঠস্বরে গুঞ্জনমুখরিত তখন। হাসির হল্লা উঠছে।

গাড়িটা একপাশে পার্ক করে সুকুমার কৃষ্ণাকে নিয়ে হলঘরে প্রবেশ করতেই যুগপৎ সকলেরই মুগ্ধ ও বিস্মিত দৃষ্টি প্রথমে কৃষ্ণাকে পরিক্রম করে পরে সুকুমারের ওপরে নিবদ্ধ হলো। সকলেই সুকুমারের পরিচিত। অথচ কৃষ্ণাকে ইতিপূর্বে কেউ দেখে নি এবং চেনেও না। দুচারজন তরুণ সাদর আহ্বান জানায়, সুস্বাগত—সুস্বাগতম্ ডাঃ গুপ্ত!

একটি হালফ্যাসনদুরস্ত, এনামেলিং করা শ্যামবর্ণা তরুণী এগিয়ে এসে আধো আধো ন্যাকামিভরা কণ্ঠে বলে ওঠে, হ্যালো সুকুমার, naughty boy, where been so long!

ব্রিফলেস ব্যারিস্টার মিঃ নির্মল মিটার দুর্দান্ত সাহেব, ওষ্ঠাধরে ধৃত সরু পাইপে সিগারেট। একটু কাছ ঘেঁষে এসে মৃদু চাপা কণ্ঠে বলে, who is this dream, my dear Gupta?

আঃ, কি হচ্ছে মিত্র! চাপা তর্জন করে ওঠে সুকুমার।

সুকুমার এরপর কৃষ্ণাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, আমার বান্ধবী কৃষ্ণা চৌধুরী।

হঠাৎ একসময় সেই এনামেলিং করা তরুণীটি সুকুমারের সামনে এগিয়ে এসে চাপা কণ্ঠে বলে, আমাদের লতা সেনকে তা হলে

সুকুমার ভূ-কুঞ্চিত করে একবার সেই তরুণীটির দিকে তাকিয়ে হলের অন্যদিকে কৃষ্ণাকে নিয়ে সরে যায়।

একটু পরেই শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর গান শুরু হলো। আধুনিক এক গীতিকারের একটি আধুনিক গান প্রথমে গাইতে আরম্ভ করেন শ্ৰীমন্ত মুখাজী। একটি বিরহের সঙ্গীত।

গানের সুরে সবাই মশগুল, কৃষ্ণাও মুগ্ধ হয়ে যায় শ্রীমন্ত মুখার্জীর গান শুনে, মুগ্ধবিস্ময়ে সে একপাশে বসে গান শুনতে থাকে। ঐ অবসরে নিঃশব্দে অন্যের অলক্ষ্যে সেই ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরে গিয়ে ছোট একটা টেবিলের উপরে রক্ষিত ফোনটার রিসিভারটা তুলে নেয়? Please put me to south…

***

ফোন সেরে হলঘরে ফিরে এসে দেখে কৃষ্ণা সেখানে নেই। সুকুমার হলঘরের সামনের টানা বারান্দায় বের হয়ে আসে। লম্বা টানা বারান্দা মৃদু আলোয় ছায়াচ্ছন্ন, রেলিংয়ের ধার দিয়ে সব টবে পামট্রি বসানো, ঝুড়িতে নানাজাতীয় সব অর্কিড়। একপাশে অন্ধকারে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল কৃষ্ণা নিঃশব্দে যেন ছায়ার মত।

সুকুমার এগিয়ে এসে ডাকে, কৃষ্ণা!

কে? চম্‌কে ফিরে তাকায় কৃষ্ণা, বলে, ওঃ তুমি! হঠাৎ আমাকে একা ওখানে ফেলে কোথায় গিয়েছিলে?

কিন্তু তুমি এখানে যে—গান ভাল লাগল না?

মাথাটা হঠাৎ বড্ড ধরেছে—তাই এখানে খোলা জায়গায় একটু—

চল গঙ্গার ধারে খানিকটা না হয় ঘুরে আসি, মাথাটা ছেড়ে যাবেখন।

না। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও সুকুমার।

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সুকুমার বললে, রাত মাত্র তো সবে সাড়ে আটটা, এখুনি বাড়ি যাবে?

হ্যাঁ, চল—

কি ভেবে সুকুমার বলে, বেশ চলল।

বাড়ির কাছে এসে সুকুমার কৃষ্ণাকে নামিয়ে দেয়।

Good night—সুকুমার বলে।

Good night!

সুকুমারের গাড়ি চলে গেল।

কৃষ্ণা কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢুকল না, সামনের পার্কের দিকে এগিয়ে গেল। পার্কটি তখন প্রায় নির্জন হয়ে এসেছে, কেবল দুচারজন ইতস্তত পরিক্রমণ করছে। কৃষ্ণা একটা বেঞ্চের উপরে গিয়ে বসল।

.

টেলিফোন অফিস।

কাবেরীর ডিউটিও শেষ হয়ে গিয়েছিল রাত্রি সাড়ে আটটায়। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে বেশভূষা করে আবার কাবেরী অফিসেই ফিরে এল।

সুকুমারকে বলেছে সে, রাত দশটায় duty off হবে—সে আসবে এখানে। অপেক্ষা করতে থাকে কাবেরী সুকুমারের জন্য অপারেটরদের বিশ্রামকক্ষে বসে। হাতঘড়িতে ঠিক দশটা বাজতেই কাবেরী বেশভূষাটা ঠিক করে উঠে দাঁড়াল।

বাড়ি থেকে বেরুবার আগেই কাবেরী বেশভূষার মধ্যে সামান্য অদলবদল করে নিয়েছিল, এবং নিজের নাম লেখা ভ্যানিটি ব্যাগটা আনবে না ভেবেও দৈবক্রমে কৃষ্ণার নাম লেখা ব্যাগটা আনতে গিয়ে নিজেরটাই নিয়ে এসেছিল অজ্ঞাতে। আর কৃষ্ণা লেখা ব্রোটা শাড়ির ওপরে কাঁধে এঁটে এসেছে। গেটের কাছে আসতেই দেখলে সুকুমারের গাড়ি আসছে।

সুকুমার গাড়িটা গেটের কাছে এনে দাঁড় করিয়ে গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে দিয়ে কাবেরীকে আহ্বান জানাল, এসো কৃষ্ণা।

কাবেরী মৃদু হেসে গাড়িতে উঠে সুকুমারের পাশের সীটে এসে বসল, খুব punctual তো?

হ্যাঁ, বিশেষ করে মহিলাদের সঙ্গে appointment ঠিকমত রক্ষা করতে না পারলে

আজকালকার দিনে কি চলে!

তাই নাকি?

নিশ্চয়ই।

পাতলা একটা স্নিগ্ধ সুবাস কাবেরীর বেশভূষা থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

যদি কিছু মনে না কর কৃষ্ণা, বাড়িটা একবার ঘুরে যেতে চাই—

বাঃ, কি আবার মনে করবো, চল!

.

কাবেরী লক্ষ্য করে নি, অদূরে সুবিমলও ঠিক ঐ সময়টিতে তার ফ্লুইড় ড্রাইভ ডজ গাড়িতে বসে ওদের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল। ডাক্তার ও কাবেরীর সম্পর্ক কিছুদিন হতেই তার মনের মধ্যে একটা সন্দেহের ছায়াপাত করেছিল। ..

তাই কিছুদিন হতে কাবেরীকে সে অলক্ষ্যে অনুসরণ করছিল। কাবেরীকে ডাক্তারের গাড়িতে উঠতে দেখে ব্যাপারটা ঠিক সে বুঝে উঠতে পারল না, তা ছাড়া কৃষ্ণা বলে ডাক্তারের ডাকটাও তাকে কতকটা বিভ্রান্ত করেছিল। ডাক্তারের গাড়ি চলে যেতে সুবিমলও গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

সুকুমারের গাড়ি তার বাড়ির কম্পাউণ্ডে এসে প্রবেশ করলো।

এসো কৃষ্ণা—সুকুমার আহ্বান জানায় কাবেরীকে দরজা খুলে। দুজনে এসে সুকুমারের চেম্বারে প্রবেশ করলবোস।

সুকুমারের নির্দেশে কাবেরী একটা সোফার উপরে উপবেশন করে।

হঠাৎ তোমার আজকে বেড়াবার ও হোটেলে ডিনার খাবার শখ হলো যে সুকুমার? কাবেরী প্রশ্ন করে।

কাবেরীর সুকুমার সম্বোধনে সুকুমার প্রথমটায় চমকে ওঠে, কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, কি ভোলা মন তোমার কৃষ্ণা, এর মধ্যেই পরশু রাতের কথা ভুলে গেলে? কি কথা হয়েছিল আমাদের লেকের ধারে বসে?

এবারে কাবেরীর চমকাবার পালা, কিন্তু কাবেরীর হাবভাবে এতটুকু সেটা প্রকাশ পেল না, বরং মৃদু হেসে বললে, সত্যিই তো! দেখেছো কি ভোলা মন আমার, একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।

তারপর সহসা একসময় সুকুমার কাবেরীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, একটা কথার সত্য জবাব দেবে কৃষ্ণা?

বল, কি কথার জবাব চাও?

সত্যি কি তুমি কিছু বুঝতে পারো নানা বুঝেও বুঝতে চাও না?

বুঝতে যে পারি না তা নয়—তাছাড়া সত্যিই এই দূরে দূরে থাকতে ভালও লাগে না, কিন্তু–

কিন্তু কি কৃষ্ণা?

ভাবছি বাবার কথা। তিনি যদি রাজী না হন?

নাই-বা হলেন রাজী, তাই বলে চিরকালটা এমনি করেই জীবন কাটাতে হবে নাকি? এমনি করেই তোমাদের দুটি বোনের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে নাকি?

কাবেরী সুকুমারের কথার কোন জবাব দেয় না, নিঃশব্দে বসে বসে শাড়ির আঁচলের পাড়টা টানতে থাকে।

কিন্তু তোমরা ওভাবে ব্যাপারটার অতটা importance দিলেও আমি কিন্তু ততটা চিন্তিত নই। একটা লোকের অদ্ভুত একটা খেয়াল নিয়ে আর দশজনের জীবন নিয়ন্ত্রিত হবে কেন? কিন্তু তা ছাড়াও যে জিনিসটা আমাকে মধ্যে মধ্যে চিন্তিত করে তোলে সেটা—

কি?

মনে পড়ে পার্ক সার্কাসে নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে পুলিসের কর্তৃপক্ষ তোমাদের দুবোনকে suspect–

সুকুমারের কথাটা শেষ হল না, কাবেরী তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠে, nonsense! কোথায় কি? কারো সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু পুলিসের সন্দেহের কথা ছেড়েই দাও, তুমি—তুমিও কি—

আমি? আমার কথা না হয় ছেড়েই দাও, কিন্তু একটা সন্দেহের দুঃস্বপ্ন অবিরত আমাদের পিছনে পিছনে তাড়া করে ফিরবে এও তো–

কিন্তু আমি তোমার কথাই জানতে চাই।

অন্য কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি কিন্তু এটা তো ঠিকই, তোমাদের দুবোনের মধ্যে একজন নরেন মল্লিককে চিনতে–

সুকুমার!

হ্যাঁ, এটা শুধু মুখের কথা নয়, সাক্ষীপ্রমাণও যে তার আছে। সত্য যা একদিন না একদিন তা দিনের আলোর মত আত্মপ্রকাশ করবেই, সেদিন—একটু থেমে হঠাৎ সুকুমার আবার বলে, অন্তত আমার কাছে তুমি সব কথা খুলে বল কৃষ্ণা, সত্যিই যদি তুমি আমাকে ভালবাস, এ যন্ত্রণা থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দাও। আমাদের পরস্পরের প্রেমের মধ্যে এই যে সন্দেহের একটা কালো রাহু এ থেকে আমাকে মুক্তি দাও।

কাবেরী যেন পাষাণের মতই স্থির, অনড়। চোখের দৃষ্টি অকম্পিত।

কৃষ্ণা!

বল।

বল, বল কৃষ্ণা, সত্যিটুকু আমাকে খুলে বল! সহসা এগিয়ে এসে দুহাতে কাবেরীর একখানা হাত তুলে ধরে আবেগকম্পিত কণ্ঠে কথা কটি বলে সুকুমার।

সহসা কাবেরী সুকুমারের মুষ্টি হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, না না, আমি কিছু জানি না—আমি কিছু জানি না—

কৃষ্ণা!

সস্নেহে কাবেরীর অবনত পৃষ্ঠে একখানা হাত রেখে সুকুমার বলে, আমায় তুমি বিশ্বাস টী

না, না—আমায়—আমায় তুমি ক্ষমা করো সুকুমার। আমি কিছু জানি না জানি না। কাবেরী উঠে দাঁড়ায়, তার কোলের ওপর থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা মাটিতে পড়ে যায়।

নিচু হয়ে ব্যাগটা তুলতে গিয়ে সুকুমারের নজর পড়ল, ব্যাগটার গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ও কাবেরী।

ঠিক এমনি সময় টেলিফোন বেজে ওঠে : ক্রিং! ক্রিং! ক্রিং!

সুকুমার তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফোনটা তুলে নেয়, হ্যালোর্য্যা, হাঁDr. Gupta speaking. কি—কি বললেন, হ্যাঁ, accident! Motor accidentয়ে মারা গেছেন? হাঁ। হাঁ আসছি, এখুনি আসছি–

কি–কি ব্যাপার সুকুমার? প্রশ্ন করে কাবেরী।

বড় sad news কৃষ্ণা! তোমার বোন কাবেরী, মানে—

কি–কি হয়েছে কাবির? বল—বল সুকুমার, চুপ করে রইলে কেন, বল?

সে, মানে, কাবেরীর মোটর অ্যাসিডেন্ট—। মুহূর্তে কাবেরীর সমগ্র মুখখানা যেন রক্তহীন, ফ্যাকাশে হয়ে যায়। একটা আর্ত অস্ফুট চিৎকার কাবেরীর কণ্ঠ হতে নির্গত হয়। কাবেরী মুহ্যমানের মত সোফাটার ওপরেই ধপ করে বসে পড়ে।

সুকুমার কাবেরীর পাশে এসে দাঁড়ায়, সস্নেহে ধীর কণ্ঠে বলে, এ সময় নার্ভ হারালে তো চলবে না কৃষ্ণা—চল বরং তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমিই হাসপাতালে যাই।

না, না—আমি—আমিও তোমার সঙ্গে যাবো সুকুমার—

তুমি যাবে?

হাঁ। আমায়—আমায় তুমি নিয়ে চল।

বেশ চল।

দুজনে উঠে দাঁড়ায়। গাড়িতে উঠে সুকুমার গাড়িতে স্টার্ট দিল। গাড়ি ছুটে চলল। হাসপাতালের দিকে।

সার্কুলার নার্সিং হোম। সুকুমারের গাড়ি কাবেরীকে সঙ্গে নিয়ে এসে নার্সিং হোমের কম্পাউণ্ডে প্রবেশ করল। নার্সিং হোমের কক্ষে কক্ষে খোলা জানালাপথে নজরে পড়ে ডোমেঢাকা স্বল্প পাওয়ারের মৃদু আলোর আভাস। বাইরের মৃদু আলোকিত বারান্দায় একটি যুবক বোধ হয় ওদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল, বললে, ডাক্তার গুপ্ত?

হাঁ।

এইদিকে আসুন।

যুবকের সঙ্গে সঙ্গে তাকে অনুসরণ করে সুকুমার আর কাবেরী আললাকিত নাতিপ্রশস্ত একটি কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করে। অল্পবয়েসী একজন নার্স বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আর ঘরের মধ্যে অস্থির অশান্ত পদে কিরীটী পায়চারি করছে। স্বল্পবয়েসী একজন ডাক্তার অ্যাপ্রন গায়ে একপাশে দাঁড়িয়ে।

ওদের কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতে দেখেই কিরীটী ডাক্তারকে আহ্বান জানায়, এই যে ডাক্তার, আসুন।

ব্যাপার কি বলুন তো মিঃ রায়? কি করে দুর্ঘটনা ঘটল?

সত্যিই বড় দুঃখের ব্যাপার। আমারই গাড়ির নীচে হঠাৎ—মানে আমি আমীর আলি অ্যাভিনু দিয়ে ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে গাড়িতে করে আসছিলাম, রাস্তা অনেকটা খালি থাকায় বেশ জোরেই গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ আচমকা মেয়েটি ছুটে রাস্তা cross করতে গিয়ে আমার সামনে এসে পড়ে, আমি থামাতে পারলাম না, ফলে—

আঘাত, মানে—

মাথাটা একেবারে চাকার তলে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে যান, একটু আগে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য মাত্র জ্ঞান হয়েছিল, কি সব নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপার, আপনার নাম, কৃষ্ণা না কাবেরী—কি সব যেন বললেন। আপনার নামটা আমার জানা ছিল, ফোন গাইড থেকে আপনার নাম খুঁজে বের করে তাই আপনাকেই ফোন করেছি। আর একটু আগেও যদি আসতেন ডাঃ গুপ্ত, হয়ত শেষ দেখাটা হতো

আমি—আমি তার dead bodyটা একবার দেখতে পারি না! অ্যাপ্রন পরা ডাক্তারটি বললে, আসুন—পাশের ঘরেই আছে।

সুকুমার ডাক্তার ও নার্সের সঙ্গে পাশের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে পর্দার ওপাশে।

.

একটা চেয়ারের উপরে মুহ্যমানের মত বসেছিল কাবেরী। মনের মধ্যে যে তার প্রচণ্ড একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার চোখ-মুখ দেখে তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

একসময় পায়ে পায়ে কিরীটী কৃষ্ণার ছদ্মবেশে কাবেরীর ঠিক সামনে এগিয়ে এসে মৃদু কণ্ঠে বলে, মাপ করবেন, যিনি মোটর অ্যাসিডেন্টে একটু আগে মারা গেছেন, আপনার চেহারার সঙ্গে তার চেহারার অদ্ভুত একটা সৌসাদৃশ্য আছে বলে মনে হচ্ছে, আপনারা

হ্যাঁ, সে আমারই যমজ বোন কাবেরী।

ঠিক ঐ সময়ে ইনসপেক্টার মজিবুর রহমান এসে কক্ষে প্রবেশ করে কাবেরীকে অদূরে উপবিষ্ট দেখেই বলে ওঠে, আপনি এখানে?

হাঁ ইনপেক্টার, আমার বোন কাবেরী—

I see! আপনারই বোন তাহলে মোটর অ্যাকসিডেন্টে—

হাঁ।

নরেন মল্লিক মার্ডার কেসের একজন suspect তাহলে দুর্ঘটনাতেই শেষ পর্যন্ত শেষ হয়ে গেলেন! কতকটা যেন আত্মগতভাবেই কথাটা উচ্চারণ করলেন মজিবুর রহমান।

ইনসপেক্টার! কাবেরীর ডাকে রহমান ওর দিকে তাকান।

আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই—

কি বলুন তো?

আজ আর আপনার কাছে কোন কথাই গোপন করবো না ইনসপেক্টার—

ইনপেক্টার মজিবুর রহমান আবার কাবেরীর মুখের দিকে তাকালেন।

কাবেরী বলতে লাগল, কারণ যেজন্য সেদিন বাধ্য হয়েই আমাকে গোপনতার আশ্রয় নিতে হয়েছিল আজ আর তার প্রয়োজন নেই। কাবেরীর দুচোখে অশ্রু ঘনিয়ে আসে। চোখের জল মুছে কাবেরী বলে, যাকে পুলিসের সন্দেহ থেকে বাঁচাবার জন্য সেদিন—মায়ের পেটের বোন হয়ে মিথ্যার আশ্রয় আমাকে নিতে হয়েছিল, হতভাগিনী সে-ই যখন আজ আর বেঁচে নেই—

একটু অপেক্ষা করুন মিস্ চৌধুরী! কাবেরীর বক্তব্যে বাধা দিয়ে হঠাৎ অদূরে দণ্ডায়মান যুবকটির দিকে তাকিয়ে রহমান বলে, অবিনাশ, কৃষ্ণাদেবীর জবানবন্দিটা টুকে নাও। Yes—হ্যাঁ, এবারে বলুন মিস চৌধুরী কি বলছিলেন!

কাবেরী অরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে শুরু করে, আমাদের বাবা সঞ্জীব চৌধুরীকে আপনি জানেন ইনপেক্টার। আমাদের দুই বোনের স্বাধীনতা বলতে সত্যিকারের কিছুই ছিল না। বাড়িতে এবং বাইরে সর্বদা যেন বাবার হাজারটা অদৃশ্য চক্ষু আমাদের প্রতি সজাগ হয়ে থাকত। একান্ত অর্থাভাবের জন্যই আমাদের দুই বোনকেই টেলিফোনের কাজ নিতে হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কারও সঙ্গে, বিশেষ করে কোন পুরুষেব সঙ্গেই আমাদের দুবোনের কারোই। আলাপ-পরিচয় করবার বা মিশবার উপায় ছিল না। বাবার কড়া আদেশ ছিল, কোন পুরুষের সংস্রবেই যেন আমরা না যাই।

আপনাদের বিবাহ দেবার ইচ্ছাও তার ছিল না? প্রশ্ন করে কিরীটী।

না। বাবা বলতেন, বিবাহ করলেই নাকি আমরা পর হয়ে যাব। বাবার তা সহ্য হবে না। আমাদের ছেড়ে তিনি থাকতে পারবেন না।

তারপর? রহমান বলে।

কিন্তু বাবার এত সাবধানতা, সদাসতর্ক ও জাগ্রত দৃষ্টি আমাদের ওপরে থাকা সত্ত্বেও কাবেরী যেন কোন্ একাকে মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল—আমি বা বাবা প্রথমটায় আদপেই তা টের পাইনি। পরে যখন জানতে পারলাম—

আপনার বাবা তাহলে শেষ পর্যন্ত কাবেরী দেবীর মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা জানতে পেরেছিলেন? প্রশ্ন করে কিরীটী।

আচমকা কিরীটীর প্রশ্নে কাবেরী যেন চমকে ওঠে। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই জানতেন। এত বড় একটা ব্যাপার তার দৃষ্টিকে এড়িয়ে যাবে তা মোটেই সম্ভব নয়।

তারপর আপনার বাবা ঐ ব্যাপার জানা সত্ত্বেও কোনরকম গোলমাল করেন নি বা বাধা দেন নি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

না।

আশ্চর্য! বলুন, তারপর?

মধ্যে মধ্যে গোপনে আমাদের বাড়ির সামনেই যে পার্কটা আছে, সেখানে নরেন মল্লিক কাবির সঙ্গে এসে দেখা করতে এবং পার্কেই একদিন তার সঙ্গে কাবির মধ্যস্থতাতে আমারও আলাপ হয়।

আচ্ছা একটা কথা কৃষ্ণা দেবী—কিরীটী প্রশ্ন করে।

বলুন?

মিঃ নরেন মল্লিক ও আপনার বোন কাবেরী দেবী, এদের মধ্যে, মানে পরস্পরের মধ্যে পত্রবিনিময় হতো কিনা আপনি জানেন কিছু?

কি জানি, বলতে পারি না ঠিক। আর হলেও আমার নজরে কখনও পড়ে নি।

হুঁ, বলুন—তারপর?

তারপর সেই ২৭শে পৌষ রবিবার যেদিন রাত্রে নরেন মল্লিক তার শয়নকক্ষে ছুরিকাঘাতে নিহত হন—

কিরীটী লক্ষ্য করে কাবেরীর চোখে-মুখে হঠাৎ যেন একটা অদ্ভুত পরিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, চোখের দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ, সমগ্র মুখখানি রক্তচাপে রক্তিম হয়ে উঠেছে, গলার দু পাশে ও কপালের দুদিককার শিরাগুলো আরো স্পষ্ট ও সজাগ হয়ে উঠেছে, নাসিকার অগ্রভাগ ফুলে ফুলে উঠছে।

কাবেরী বলতে থাকে ও আমাদের দুবোনেরই সেদিন সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত off-duty ছিল। সন্ধ্যার কিছু পরেই সাজগোজ করে কাবেরী বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। রাত্রি এগারটা সাড়ে এগারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে যখন ফিরল না, বাইরের ঘরে তার অপেক্ষায় সোফার ওপরে বসে একটা বই পড়তে পড়তেই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ মৃদুভাবে দরজার গায়ে শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হলো চাপা গলায় কে যেন ডাকছে : দিদিদিদি! উঠে দরজা খুলে দিতেই দেখি—কাবেরী! কাবেরী ঘরে এসে প্রবেশ করল। ঘরের উজ্জ্বল আলোয় কাবেরীর দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম। তার চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি। আর—আর–

বলুন? বলুন? কিরীটী প্রশ্ন করে।

রক্ত! তার কাপড়ে রক্তের দাগ! অকারণে একটা ভয়ে বুকের ভিতরটা আমার কেঁপে উঠলো। বললাম, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি? আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে সে সোজা শয়নকক্ষের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থেকে আমি যখন শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাম, দেখলাম ঘর অন্ধকার। আর সেই অন্ধকার ঘরে কার চাপা কান্নার শব্দ যেন গুমরে গুমরে উঠছে। পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি কাবেরী তখনও ঘুমিয়ে—তার ডিউটির সময় হয়েছে, তবু তাকে না জাগিয়ে আমি একাই ডিউটিতে চলে যাই।

***

ঠিক এমনি সময়ে বাইরে একটা মোটর গাড়ি এসে থামবার শব্দ শোনা গেল। কাবেরী একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, অফিসে সে সেদিন একটু লেটেই এলো। পাশাপাশি বসে দুজনে কাজ করছি, তবু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছি না।

বাইরের বারান্দায় একটা শব্দ শোনা যায়—খট্ খট্ খট্‌। খট খট শব্দটা ক্রমে যেন ঐ ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে।

খট খট শব্দে সকলেরই দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষিত হয়। ক্রাচে ভর দিয়ে দরজার উপরে এসে দাঁড়ালেন সঞ্জীব চৌধুরী। চোখে মুখে তার উদ্বেগের সুস্পষ্ট চিহ্ন।

সঞ্জীবকে দরজার গোড়ায় দেখেই হঠাৎ কাবেরী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং তার বিস্মিত কণ্ঠ হতে অর্ধস্ফুট একটা আর্ত শব্দ নির্গত হয়, বাবা!

কাবেরী কোথায়? সত্যিই কি সে মোটর-অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছে? বলতে বলতে সঞ্জীব চৌধুরী কমধ্যে এসে প্রবেশ করেন এবং পরক্ষণেই কাবেরীকে অদূরে দণ্ডায়মান দেখে বলে ওঠেন, কিন্তু এই তত—এই তো! তবে—তবে যে কে এক ডাক্তার ফোনে বললে, তুমি—তুমি নাকি মোট অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে!

সঞ্জীবের কথায় কাবেরীর মুখখানা যেন সহসা ছাইয়ের মত রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বিহ্বল বোবাদৃষ্টিতে সে তাকায় বাপের মুখের দিকে।

কিরীটীর কণ্ঠস্বর হঠাৎ শোনা গেল, তাহলে আপনি—আপনিই কাবেরী চৌধুরী! এতক্ষণ তাহলে কৃষ্ণা চৌধুরীর পরিচয়ে ধোঁকা দিচ্ছিলেন! মারা গেছেন তাহলে আসলে কৃষ্ণা দেবীই কাবেরী চৌধুরী নন?

আমি-আমি–, কি যেন কাবেরী বলবার চেষ্টা করে।

কিরীটী ঘুরে সঞ্জীব চৌধুরীকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করে, মিঃ চৌধুরী, তাহলে ইনিই কাবেরী। দেবী?

নিশ্চয়ই। আমার মেয়েকে আমি চিনি না! ঐ তো আমার ছোট মেয়ে কাবেরী—কিন্তু–

হঠাৎ কাবেরী যেন পাগলের মত চিৎকার করে ওঠে, না না, আমি কাবেরী নয়—আমি কৃষ্ণা। বাবা, তুমি কি আমায় চিনতে পারছো না? চেয়ে দেখো ভাল করে চেয়ে দেখো বাবা, আমি–আমি কাবেরী নই, আমি—আমি তোমার কৃষ্ণা।

কৃষ্ণা! হঠাৎ হাঃ হাঃ হাঃ করে পাগলের মত হেসে ওঠেন সঞ্জীব চৌধুরী, তুই কৃষ্ণা, হ্যাঁ। তুই কৃষ্ণা! হাঃহাঃহাঃ! পাগলের মতই হাসতে থাকেন সঞ্জীব চৌধুরী।

কাবেরী ছুটে এসে তার বাপ সঞ্জীব চৌধুরীকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে আর্ত ব্যাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে, বাবা–বাবা! আমি—আমি সত্যিই তোমার কৃষ্ণা! দেখো, আমি সত্যিই তোমার বড় মেয়ে কৃষ্ণা—

য়াঁ! হঠাৎ হাসি থামিয়ে বোবাদৃষ্টিতে তাকান সঞ্জীব মেয়ের মুখের দিকে। তারপর অধস্ফুট স্বরে বলেন, তুমি—তুমি তাহলে কাবেরী নও? তুমি কৃষ্ণা? তাহলে—তাহলে কৃষ্ণা মরে নি—মরেছে কাবেরী? না না, তা কি করে হবে? কাবেরী কাবেরী! কৃষ্ণ কৃষ্ণা! না না, আমি যাই—আমি যাই—

ক্রাচে ভর দিয়ে অস্থিরভাবে খট খট শব্দ তুলে সঞ্জীব ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

আর কাবেরী হঠাৎ চেয়ারটার উপরে বসে দুহাতে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রোরুদ্যমানা কাবেরীর দিকে।

হঠাৎ কাবেরী উঠে পড়ে। তারপর বলতে বলতে বের হয়ে যায় ঘর হতে, বাবা–বাবা, শোন—শোন, দাঁড়াও!

অবিনাশ ও রহমান দুজনেই কাবেরীকে অনুসরণ করতে যাচ্ছিল, কিরীটী ওদের বাধা দিয়ে বলে, না, ওঁকে যেতে দিন রহমান সাহেব।

.

কক্ষের মধ্যে যেন নাটকের একটা দৃশ্য অভিনীত হয়ে গেল।

কাবেরী ও তার পিতা সঞ্জীব চৌধুরীর পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তাগুলো নরেন মল্লিকের হত্যাকে কেন্দ্র করে গত ২৭শে পৌষ যে রহস্যজাল বিস্তৃত করেছিল এ যেন তারই সমাপ্তির রূঢ় ইঙ্গিত। সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কারো মুখে কথাটি পর্যন্ত নেই।

সর্বপ্রথম কথা বললে কিরীটী, এতটা আমি ভাবি নি। অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত তীর অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করেছে।

রহমান বললেন, কাবেরীকে ওভাবে না যেতে দিলেই কি ভালো হতো না মিঃ রায়!

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ভয় নেই রহমান সাহেব, এ অজগরের গ্রাস, একবার যখন দাঁত বসিয়েছে, পূর্ণগ্রাসের থেকে আর ও নিস্তার পাবে না।

ইতিমধ্যে একসময় ডাঃ সুকুমারও কক্ষে এসে প্রবেশ করে একপাশে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, ডক, this is the world! কিন্তু আমি বলছি তুমি ঠকে নি!

ঠিক এমনি সময়ে একটা গাড়ি এসে থামবার শব্দ পাওয়া গেল।

কে এলো?

দেখুন তো রহমান সাহেব কে এলেন!

রহমানকে আর বাইরে বের হয়ে দেখতে হলো না, তালুকদার কক্ষে প্রবেশ করলে, চোখেমুখে তার সুস্পষ্ট একটা উত্তেজনার ভাব।

ব্যাপার কি তালুকদার সাহেব?

জব্বর সংবাদ! উত্তেজিত ভাবে তালুকদার বলে।

হেঁয়ালি ছেড়ে বল, বর্মা থেকে কোন সংবাদ পেয়েছ বোধ হয়!

আশ্চর্য! How could you guess?

Simple rule of three! বর্তমানে যে কেস নিয়ে আমরা ব্যস্ত তার মধ্যেই তো একটা অপ্রাপ্ত সূত্র ঐ বর্মা-সংবাদ। এবং এত রাত্রে হন্তদন্ত হয়ে যখন এসেছো, বুঝতে কষ্ট হওয়া তো উচিত নয়—কি হতে পারে তোমার অত্যাশ্চর্য সংবাদ। Now—now tell me, নরেন মল্লিকের অতীত বর্মা-বাস সম্পর্কে কি এমন সংবাদ গ্রহণ করলে!

তুমি জান, আমাদের হেড কোয়ার্টার থেকে বর্মার স্পেশাল পুলিশে নরেন মল্লিকের details চেয়ে পাঠানো হয়েছিল তোমারই পরামর্শমত!

হ্যাঁ, তা তো জানি।

এই কিছুক্ষণ আগে এখানকার হেড কোয়ার্টারে সিগন্যাল মেসেজ এসেছে। নরেন মল্লিকের যৌথ কারবার ছিল বার্মা-টিকের ইসমাইল খাঁ নামে এক পাঠানের সঙ্গে। ইসমাইলের বাপ ছিল পাঠান ও মা বর্মী এবং ব্যবসাসূত্রেই নরেনের ইসমাইল-গৃহে যাতায়াত ও ঘনিষ্ঠতা খুবই ছিল।

অর্থাৎ মল্লিক মশাই ইসমাইল খাঁর ঘরে ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করে! বল, তারপর?

ইসমাইল খাঁর এক পরমা সুন্দরী শিক্ষিতা কন্যা পীরবানু নরেনের সঙ্গে বিশেষ একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

কলির ডন যুয়ান একেবারে, তারপর?

কিন্তু ইমসাইল খাঁ কন্যার পরদেশীর সঙ্গে অত ঘনিষ্ঠতাটা ঠিক বরদাস্ত করে উঠতে পারে নি।

ফলে পিতা ও কন্যার মধ্যে মতান্তর!

Exactly—

হতেই হবে, শিক্ষিতা কন্যা যখন! Yes, go on—তারপর?

এমন সময় সহসা এক রাত্রে নরেন পীরবানুকে নিয়ে—

পলায়মান! চমৎকার! তারপর?

ইসমাইল খাঁ ক্ষেপে গেল সংবাদ পেয়ে এবং ছুটলো ওদের পিছু পিছু। শেষ পর্যন্ত ধরে ফেললে বর্মা সীমান্তে। বাপ-মেয়েতে কথা-কাটাকাটি হলো এবং শেষ পর্যন্ত বাপ মেয়েকে জোর করে নিয়ে গেল নরেন সোজা ফিরে এল কলকাতায়।

উঁহু, শুধু ঐ নয়—আরো story আছে!

আছে, তবে সেটা সঠিক জানা যায় নি, কেবল জানা গেছে ইসমাইলের রত্ন-ভাণ্ডারে—

তালুকদার এই পর্যন্ত বলেছে, সহসা কিরীটী লাফিয়ে ওঠে, Hurry up—চল, এখুনি চল–

বিস্মিত তালুকদার শুধায়, কোথায়?

কিরীটী বলে, আমীর আলি অ্যাভিনুতে কৃষ্ণা কাবেরীর ফ্ল্যাটে —quick!

***

ঘণ্টা দুই পরে।

কৃষ্ণাদের ফ্ল্যাট বাড়ির বাইরের ঘর। সোফার উপরে বসে দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে কাবেরী। দরজাটা হা-হা করছে খোলা। নিঃশব্দে কিরীটী এসে কক্ষে প্রবেশ করে-কাবেরী দেবী!

চমকে মুখ তুলে তাকায় কাবেরী—কে?

পুলিশ এসেছে, আপনাকে নরেন মল্লিকের হত্যাপরাধে গ্রেপ্তার করতে। কিরীটী বলে।

পুলিশ! আর্ত চিৎকার একটা বের হয়ে আসে কাবেরীর কণ্ঠ হতে।

হ্যাঁ, ঐ দেখুন।

সত্যিই দরজার গোড়ায় দুজন লাল পাগড়ী নিঃশব্দে দণ্ডায়মান।

ত্রস্ত ব্যাকুল হয়ে উঠে দাঁড়ায় কাবেরী, কিন্তু আমি—আমি তো হত্যা করি নি নরেনকে! আমি

বৃথা লুকোবার আর চেষ্টা করে কোন ফল হবে না কাবেরী দেবী। আপনি—আপনি নরেন মল্লিককে হত্যা করেছেন। মৃত্যুর পূর্বে কৃষ্ণা দেবী পুলিসের কাছে statement দিয়ে গিয়েছেন—

কিরীটীর কথা শেষ হলো না, কাবেরী পাগলের মতই যেন চিৎকার করে উঠল, মিথ্যা—মিথ্যা! কৃষ্ণা-কৃষ্ণা মিথ্যা কথা বলেছে।

না। সে মিথ্যা কথা বলে নি। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী প্রতিবাদ জানায়।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, হাঁ—সে মিথ্যা বলেছে, বলতে বলতে সহসা উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় কাবেরী এবং উঠে দাঁড়াতেই তার পূর্ণ প্রতিকৃতি সম্মুখে দেওয়ালের গায়ে প্রলম্বিত দর্পণে প্রতিফলিত হলো। সেই প্রতিবিম্বিত নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়েই অকস্মাৎ যেন ক্ষেপে ওঠে কাবেরী এবং মুহূর্তে নিজের কোমর থেকে তীক্ষ্ণ ধারালো একখানা ছোরা বের করে, কতকটা উন্মাদিনীর মতই যেন ছুটে গিয়ে দর্পণের কাচের উপরে ছোরা দিয়ে সজোরে আঘাত করে চিৎকার করে ওঠে, কৃষ্ণা—

ঝন্ ঝন্ করে ছোড়ার আঘাতে দর্পণের কঁচটা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়। তাতেও যেন কাবেরীর রোষ প্রশমিত হয় না, আবার আঘাত হানবার জন্যে হাত তুলতেই চোখের পলকে কিরীটী এগিয়ে এসে সজোরে কাবেরীর উত্তোলিত হাতটা চেপে ধরে কঠিন কঠোর কণ্ঠে বলে ওঠে, আবার—আবার আপনি কাবেরী দেবী সেরাত্রের মতই ভুল করেছেন! She is not কৃষ্ণা—but reflection-your own reflection on the mirror! কৃষ্ণা নয়, দর্পণে আপনারই ছায়া ওটা। ভাল করে চেয়ে দেখুন—আপনারই ছায়া, আপনি কৃষ্ণা নয়!

আর্ত চিৎকার করে ওঠে কাবেরী, ছায়া! কৃষ্ণা নয়—ছায়া!

হ্যাঁ, ছায়া—আপনারই ছায়া। যমজ বোনের একজন—আপনারই ছায়া, কাবেরী দেবী।

কৃষ্ণা নয়? ছায়া-ছায়া!

হ্যাঁ, ছায়া। এখন বসুন—স্থির হয়ে বসুন।

মুহ্যমান কাবেরীকে একপ্রকার যেন জোর করেই কিরীটী সোফার উপরে বসিয়ে দেয়। —এখন বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন, হিংসায় অন্ধ হয়ে রাগে উত্তেজনায় সে-রাত্রে নরেন মল্লিকের শয়নঘরের আয়নাটার উপরে আঘাত হেনে আপনি সেটা ভেঙে দিয়েছিলেন— নিজের ছায়াই আয়নাতে দেখে কৃষ্ণা ভেবে কৃষ্ণাকে ছোরা দিয়ে খুন করতে গিয়ে!

দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে কাবেরী বলে ওঠে, সত্যিই বলছেন কৃষ্ণাকে আমি দেখি নি–কৃষ্ণাকে আমি দেখি নি–

না, দেখেন নি। That was your own reflection! নরেন মল্লিকের ঘরের আয়নার ভাঙা কাচই সে কথা সেদিন আমায় বলেছিল। এবং তাই প্রথমে আমার সব কেমন গোলমাল ঠেকেছিল, ছোরাটা মৃতের বক্ষে বিদ্ধ রইলো, কোন গুলি ছোঁড়ার শব্দ শোনা গেল না, অথচ আয়নার কাচটা ছিল ভাঙা!

এমন সময় রহমান, ডাক্তার সুকুমার ও কৃষ্ণা এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

আসুন কৃষ্ণা দেবী! কিরীটীই আহ্বান জানাল।

কাবি? কৃষ্ণা বলে ওঠে।

অকস্মাৎকৃষ্ণার কণ্ঠস্বর শুনে কাবেরী যেন বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ায় এবং উন্মাদিনীর মতই কৃষ্ণার দিকে চিৎকার করে ছুটে যায়, খুন করবো তোকে সর্বনাশী! তুই-তুই-তুই-ই আমার

জীবনের সব চাইতে বড় শত্রু!

মুহূর্তে কিরীটী এগিয়ে এসে কাবেরীকে প্রতিরোধ করে, কাবেরী দেবী!

না—না, আমায় ছেড়ে দিন আমায় ছেড়ে দিন। ওকে ওকে আমি খুন করবোই।

কিরীটীর বজ্রমুষ্টি হতে নিজেকে ঝাঁকি দিয়ে মুক্ত করবার চেষ্টা করতে করতে চিৎকার করে

কাবেরী বলতে থাকে।

কাবেরী দেবী! দুহাতে কাবেরীর স্কন্ধের দুপাশ দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে প্রচন্ড এক ঝাঁকুনি দিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলে ওঠে কিরীটী, চুপ করে বসুন–না হলে বাধ্য হবো আমি আপনার হাতে হাতকড়া লাগাতে!

কাবেরী সোফাটার উপরে বসে পড়ে সোফার মধ্যেই মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। মিনিট পাঁচ-সাত কিরীটী কাবেরীকে কঁদতে দেয়। কিছুক্ষণ কেঁদে কাবেরী একটু সুস্থ হলে কিরীটী ডাকে, কাবেরী দেবী, এখন নরেন মল্লিককে কেন খুন করতে–

খুন—হ্যাঁ, খুন নরেনকে আমি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি—শুধু নরেনকে কেন, একই সঙ্গে দিদি কৃষ্ণাকেও!

কিন্তু কেন—কেন ওদের খুন করতে চেয়েছিলেন? কথাটা বলে ওঠেন রহমান সাহেব।

কেন খুন করতে চেয়েছিলাম! জঘন্য, হীন প্রতারকরাগে উত্তেজনায় কাবেরীর সমগ্র মুখখানি যেন রক্তচাপে লাল হয়ে ওঠে, কেন খুন করতে চেয়েছিলাম জিজ্ঞাসা করছেন? ভাবতে পারেন, যাকে সমস্ত প্রাণ দিয়ে আমি ভালবেসেছিলাম—যাকে ভালবেসে জীবনের নীতিকে বর্জন করেছি, পিতার স্নেহ-ভালবাসাকে উপেক্ষা করেছি, পিতাকে প্রতারণা করেছি, সেই শঠ প্রতারক নরেন—যখন জানতে পারলাম আসলে সে কৃষ্ণাকেই ভালবাসে, আমাকে নয়, আমার প্রতি ভালবাসা তার অভিনয় মাত্র, দিনের পর দিন আমার বুকভরা ভালবাসাকে নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলেছে, পদদলিত করেছে—ভাবতে পারেন নারী হয়ে সে কি মর্মান্তিক লজ্জা, কি দুঃসহ বেদনা! শঠ, নীচ, প্রতারক!

কিরীটী বাধা দিয়ে বলে, কিন্তু তাই যদি হয় সে তো ওর দোষ নয়!

আবার ক্ষেপে ওঠে কাবেরী এবং কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, দোষ নয়? ওরই দোষ-ঐ—ঐ শয়তানীকে সে ভালবাসতো অথচ পরিচয় আগে তার আমার সঙ্গেই। আমিই কৃষ্ণার সঙ্গে পরে তার পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলাম। দিনের পর দিন প্রলোভনের জাল বিস্তার করে, প্রেমের ভালবাসার অভিনয় করে আমাকে আকর্ষণ করেছে, এমন কি চোরের মত লুকিয়ে ওর বাড়ির পশ্চাতের দ্বার দিয়ে রাত্রে সেই শঠ প্রতারকের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়েছি। কিন্তু যেদিন বুঝলাম আসলে সে আমাকে চায় না, চায় কৃষ্ণাকেই—স্থির করলাম তাকে খুন করবো-শুধু তাকেই নয়, কৃষ্ণাকেও!

বুঝতে পারছি এখন আপনার তখনকার মনের অবস্থা কাবেরী দেবী সহানুভূতির সঙ্গে কিরীটী বলে।

কতটুকু বুঝতে পেরেছেন সে জ্বালা, সে দাহ! না না, কেউ বুঝতে পারে না—আমার মত যে না জ্বলেছে সে ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না, পারবে না। হ্যাঁ, তারপর থেকেই সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। প্রতিশোধ! প্রতিশোধ! সুযোগ এলো। জন্মতিথি উৎসবে নরেন আমায় নিমন্ত্রণ করলে না, করলে কৃষ্ণাকে—রাত্রে তার ওখানে যাওয়ার জন্য। চিঠি নন্দুয়ার হাতে পাঠিয়েছিল, আমার হাতে এসে পড়লো। এই সুযোগ। লুকিয়ে ফেললাম চিঠিটা। অফিস হতে ঐদিনই কৃষ্ণার পরিচয়ে নরেনের সঙ্গে appointment করলাম রাত্রি সাড়ে আটটায় দেশপ্রিয় পার্কে দেখা করবার জন্য।

তারপর? রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কিরীটী প্রশ্ন করে।

কৃষ্ণার পরিচয়েই দেশপ্রিয় পার্কে কৃষ্ণার মত সাজসজ্জা করে ঠিকসময় নরেনের সঙ্গে দেখা করলাম—বললাম, চিঠি পেয়েছি। রাত বারোটায় তার শয়নকক্ষে গিয়ে দেখা করবো, সে যেন বাথরুমের দরজাটা খুলে রাখে। আমার কথা শুনে আনন্দে সে উল্লসিত হয়ে উঠলো। এতদিন সে আমার সঙ্গে অভিনয় করে এসেছে, কিন্তু এমন নিখুঁত অভিনয় সেরাত্রে আমি তার সঙ্গে করলাম ধরতে পারলে না সে!

একটু থেমে কাবেরী আবার বলতে লাগল, আগেই একটা ছোরা কিনে রেখেছিলাম বাড়িতে ফিরে দেখি কৃষ্ণাও ইতিমধ্যে ঘরে ফিরে এসেছে। বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন নিয়ে, কোনমতে মুখে চারটি খুঁজে তাড়াতাড়ি শয্যায় গিয়ে কৃষ্ণার সঙ্গে শুয়ে পড়লাম যে যার পৃথক শয্যায়। ঠিক রাত যখন সাড়ে এগারটা, নিঃশব্দে শয্যার ওপরে উঠে বসলাম।

ঘর অন্ধকার। অন্ধকারেই চেয়ে দেখলাম, কৃষ্ণা তার শয্যায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে বাবার শরীর খারাপ বলে বাবা নাকি কৃষ্ণা যখন সন্ধ্যার সময় বের হয় তাকে বলেছিলেন বিরক্ত না করতে। ঘরের আলো নিভিয়ে তিনি শুয়ে পড়েছিলেন আমাদের আগেই।

বাবার ঘরের দিকে তাকালাম, কোন সাড়াশব্দই নেই। পা টিপে টিপে শয্যা হতে উঠে, প্রথমেই কোমরে ছোরাটা গুঁজে নিয়ে নিঃশব্দে পাশের কক্ষে চলে এলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ ভাল করে সাজলাম। অভিনয় করতে চলেছি। অভিনয়—অভিনয়ের শেষরাত্রি। লাল রক্তবর্ণ শাড়ি পরলাম। মাথার চুল এলোখোঁপা করে বেঁধে, ঠিক কৃষ্ণার মত করে তার ব্রোচটা শাড়িতে এঁটে, তার ভেইলটা মাথার ওপরে দিয়ে রাস্তায় এসে নামলাম। হনহন করে হেঁটে চললাম নরেনের বাড়ির দিকে। নির্জন রাস্তা, একটুকু ভয় করে নি আমার।

নরেনের বাড়িতে অনেক রাত্রেই তো অমনি করে অভিনয় করে গিয়েছি এসে বাড়ির পশ্চাতের গলিপথের দরজাটা দিয়ে ঢুকে। তাই বাইরে থেকেই সেটায় ইদানীং তালা লাগানো থাকতো। চাবি আমার কাছেই থাকতো। চাবি দিয়ে তালা খুলে বাগানে প্রবেশ করলাম। ঘোরানো সিঁড়িপথে নরেনের শয়নকক্ষ-সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম। বাথরুমের দরজাটাও ভোলাই ছিল কিন্তু নরেনের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে দেখি ঘর অন্ধকার দেওয়ালের গায়েই সুইচ, হাত বাড়িয়ে আলোটা জ্বাললেই–

হ্যাঁ, মুহূর্তে যেন মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠলো-মনে হলো যেন কৃষ্ণাই ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, দ্বিধামাত্র না করে কোমর থেকে ছোরাটা টেনে ছুটে গিয়ে কৃষ্ণা ভেবে দর্পণের ওপরেই হাতের ছোরাটা দিয়ে আঘাত হানলাম। ঝনঝন করে দর্পণের কঁচটা ভেঙে যেতেই সেই শব্দে আমার জ্ঞান যেন ফিরে এলো এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই সামনের দিকে নজর পড়তে আতঙ্কে দুপা পিছিয়ে গেলাম! নরেনের মৃতদেহটা মেঝের কার্পেটের ওপরে পড়ে আছে। আর তার বুকে বিঁধে আছে সমূলে একখানা ছোরা। ভয়ে আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ এমন সময় ফিরে চেয়ে দেখি পিছনের বাথরুমের দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে বাবা আর তারই পিছনে কৃষ্ণা!

আমি—আমি এবারে বলবো ইন্সপেক্টার, আমায় বলতে দিন—আচা কাবেরীর উক্তিতে বাধা পড়ায় এবং অন্য একটি কণ্ঠস্বরে একসঙ্গে ফিরে তাকাল কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে।

ঠিক দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজার উপরে ইতিমধ্যে কখন যে একসময় নিঃশব্দে সকলের অলক্ষ্যে ক্রাচে ভর দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী কেউ তা লক্ষ্য করে নি। কিন্তু সঞ্জীব চৌধুরীকে কথা বলতে শুনে সেই দিকে ফিরে তাকিয়ে কাবেরী যেন পাষাণে পরিণত হয়ে গেল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে কৃষ্ণাও চিৎকার করে উঠলো, বাবা! বাবা! না না—তুমি না—তুমি না!

ছুটে এসে কৃষ্ণা সঞ্জীবকে যেন দুহাতে আগলে ধরতে চেষ্টা করে।

সঞ্জীব বাধা দিয়ে মেয়েকে সরিয়ে দেন, বলতে দে মা আমায় বলতে দে! পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমায় করতে দে!

বাবা! বাবা! কৃষ্ণা আবার পিতাকে বাধা দেবার চেষ্টা করে।

আঃ সরে যা! শুনুন ইনসপেক্টর-নরেন মল্লিককে আমিই খুন করেছি কাবেরী খুন করে নিখুন করেছি আমি, আমার মেয়েকে সে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে আমি সহ্য করতে পারি নি। আমার স্ত্রী করুণার ব্যবহারে আমি মেয়েজাতটার ওপরেই অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম। তাই নিজের ঔরসজাত মেয়েদেরও আমি বিশ্বাস করি নি কারো সঙ্গে মিশতে দিই নি। সর্বদা চোখে চোখে রেখেছি। কিন্তু যেদিন জানতে পারলাম কাবেরী তার মায়ের রক্তের ঝণই শোধ করতে চলেছে, আমাকে প্রতারণা করে নরেনের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে, কাবেরীর ওপর নজর রাখলাম। ওর ঘর থেকেই চিঠি চুরি করে সব জানতে পারলাম। তারপর যখন জানতে পারলাম—শুধু আলাপই নয়, কাবেরী অনেক রাত্রে নরেনের গৃহে যায়—রাগে তখন আমার মাথায় খুন চেপে যায়। সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। এলো সুযোগ-নরেন যে চিঠিতে তার জন্মতিথির দিন রাত্রে কৃষ্ণাকে ওর বাড়িতে যাবার জন্য আমন্ত্রণ করে, সে চিঠিখানা কাবেরী তখন তার ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে স্নানঘরে গিয়েছে, সেই ফাঁকে লুকিয়ে পড়ি, এবং বুঝি ঐ চিঠি হতে, কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে নরেনের ব্যাপারে একটা গোলযোগ আছে। যা হোক, ঠিক করলাম ঐ রাত্রেই দুজনকে একসঙ্গে হত্যা করবো। লোডেড রিভলভারটা নিয়ে—ওরা দুবোন বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেই সিঁড়ির নিচে গিয়ে আত্মগোপন করে রইলাম কাবেরীর অপেক্ষায়। ঠিক রাত সাড়ে এগারোটার কিছু পরে সিঁড়িতে পদশব্দ পেলাম, বুঝলাম কাবেরী আসছে। সত্যিই কাবেরী! কাবেরীকে অনুসরণ করলাম নিঃশব্দে। কাবেরী তালাচাবি খুলে নরেনের বাড়ির পশ্চাতের দ্বারপথে প্রবেশ করল–গলির মধ্যে অন্ধকারে কিছুদূরে আত্মগোপন করে রইলাম।

রহমান এমন সময় প্রতিবাদ জানিয়ে ওঠেন, তা হলে মিঃ চৌধুরী, আপনি যদি কাবেরী দেবীকে ফলো করে থাকেন, তবে কেমন করে–

হাঁ হাঁ, আমি—আমিই খুন করেছি! মিঃ চৌধুরী চিৎকার করে ওঠেন।

না, আপনি খুন করেন নি। নিজের মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে আপনি মিথ্যা কথা বলছেন—খুন করেছেন তাকে আপনার বড় মেয়ে কৃষ্ণা!

এতক্ষণ কিরীটী নীরবে সঞ্জীব চৌধুরীর কথা শুনতে শুনতে ভূ কুঞ্চিত করে কি যেন ভাবছিল, হঠাৎ সে বলে ওঠে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে, Now কৃষ্ণা দেবী, বলুন আপনি কি জানেন!

সকলের দৃষ্টি কিরীটীর কণ্ঠস্বরে যুগপৎ গিয়ে অদূরে দণ্ডায়মান কৃষ্ণার উপরে পড়লো। সকলের চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি। একসঙ্গে পাঁচজোড়া চোখের অনুসন্ধানী, সন্দিগ্ধ দৃষ্টি যেন কৃষ্ণাকে গ্রাস করছে। কিরীটীর অদ্ভুত ঋজু কঠিন কণ্ঠস্বর এবারে যেন সকলকেই সচকিত করে তোলে। সে বললে, বলুন কৃষ্ণা দেবী আপনার যা বক্তক বলুন!

আবার প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠলেন সঞ্জীব চৌধুরী, আমি তো বলছি, ও কিছু জানে না মিঃ রায়! কেন—কেন মিথ্যে মিথ্যে ওকে আপনারা পীড়ন করবেন?

এবারে কিরীটী সঞ্জীব চৌধুরীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, মিঃ চৌধুরী, আপনি যদি এভাবে আমাদের কাজে বাধা দেন তো বাধ্য হবো আপনাকে পুলিসের হেফাজতে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিতে!

কিন্তু যা ও জানে না তার জন্য ওকে আপনারা পীড়ন করবেন? বিশ্বাস করুন আমার কথা মিঃ রায়, ও কোন কথাই গোপন করে নি কৃষ্ণা সম্পূর্ণ নিরপরাধ। করুণ মিনতিতে যেন সঞ্জীব চৌধুরীর কণ্ঠস্বর ভেঙে গুড়িয়ে গেল।

কিন্তু আমি বলছি, উনি—আপনার বড় মেয়ে কৃষ্ণা দেবী অনেক কিছুই গোপন করে রেখেছেন। কৃষ্ণা দেবী, আমার দিকে ফিরে তাকান, এখনো বলুন সব কথা!

কৃষ্ণা যেন পাথর। কেবল দেহই নয়, যেন তার অনুভূতিও পাথর হয়ে গিয়েছে। নিষ্কম্প ভাবলেশহীন দৃষ্টি।

কৃষ্ণা দেবী, আর চুপ করে থেকে লাভ হবে না! বলুন, কি আপনার বলবার আছে?

আমি—আমি কিছুই জানি না। এতক্ষণে ক্ষীণকণ্ঠে প্রত্যুত্তর শোনা গেল কৃষ্ণার।

আপনি কিছুই জানেন না?

না।

বেশ। তবে সে রাত্রে অর্থাৎ ২৭শে পৌষ রবিবার, যে-রাত্রে নরেন মল্লিক নিহত হয়, সেরাত্রে কেন গিয়েছিলেন মল্লিক ভবনের পিছনদিককার বাগানে?

বাগানে আমি যাই নি।

আমি জানি আপনি গিয়েছিলেন এবং তার প্রমাণও আমার হাতে আছে। কঠোর প্রতিবাদ জানায় কিরীটী।

প্রমাণ।

হাঁ। দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কিনা? বলতে বলতে পকেট থেকে একটা গগলস্ বের করে হাতটা সামনের দিকে তুলে ধরল কিরীটী, চিনতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে না আপনার যে এটার মালিক আপনিই! দেখুন, ভাল করে চেয়ে দেখুন—চশমাটার উঁটে দেখুন লেখা আছে কৃষ্ণা ইংরাজীতে। নিশ্চয়ই কোন একসময় নিজের নামটা ডাঁটের গায়ে কুঁদে নিয়েছিলেন, পাছে আপনার বোন কাবেরী দেবীর চশমার সঙ্গে গোলমাল হয়ে যায় বলে, তাই নয় কি? এটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি বাগানে ডালিয়ার ঝাড়ের কাছে।

কৃষ্ণা একেবারে নির্বাক নিষ্কম্প।

চুপ করে আছেন যে! এ চশমাটা কি আপনার নয়?

হাঁ আমারই।

তাহলে এবার বলুন কেন সেরাত্রে বাগানে গিয়েছিলেন? কারো সঙ্গে দেখা করতে কি?

হাঁ।

কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন? বিনতা দেবী, না মিঃ মল্লিকের সঙ্গে?

কিরীটীর কথায় যেন ভূত দেখার মতই চমকে মুখ তুলে তাকাল কৃষ্ণা ওর মুখের দিকে।

চমকে উঠবেন না। কিন্তু বুঝতেই পারছেন যে, আমি জানি যে বিনতা দেবীর সঙ্গে আপনার আলাপ ছিল!

সঞ্জীব চৌধুরী চিৎকার করে ওঠেন এমন সময় সহসা, কৃষ্ণা!

কিন্তু কিরীটী সে চিৎকারে যেন ভূক্ষেপও করল না। কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকিয়েই আবার প্রশ্ন করল, কি করে আপনার বিনতা দেবীর সঙ্গে আলাপ হলো, বলবেন কি?

তিনিই আমাকে চিঠি দিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে আলাপ করেছিলেন। মৃদু ক্ষীণ কণ্ঠে কৃষ্ণা প্রত্যুত্তর দেয়।

হাঁ। তাহলে সেই আলাপের সূত্র ধরেই তিনি এখানেও ইদানীং মধ্যে মধ্যে রাত্রে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করতেন তাই বোধ হয়, না?

কিন্তু জানেন কি তাঁর সত্যিকারের পরিচয়টা?

না।

জানেন না?

না।

সত্যি বলছেন, জানেন না? তিনিও কখনও তাঁর পরিচয় দেন নি?

না।

সেরাত্রে তাহলে আপনি বাগানে তারই সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?

হাঁ।

কেন?

তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

কেন?

তার কিছু কথা আমাকে বলবার ছিল তাই।

কি কথা জানতে পারি কি?

ক্ষমা করবেন। বলতে পারবো না।

ঠিক ঐ সময় চন্দ্রনাথ এসে ঘরে প্রবেশ করল। কিরীটী চন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কি খবর চন্দ্রনাথ? তুমি একা?

তাঁকে পাওয়া গেল না সে-বাড়িতে।

পেলে না?

না। আজ সকালেই তিনি সে-বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন।

কোথায় কিছু জানতে পারলে?

না। কেউই তা বলতে পারল না। তবে—

কি?

বাড়িওয়ালার হাতে তিনি আপনার নামে একখানা চিঠি দিয়ে গিয়েছেন যাবার আগে। চিঠি!

হ্যাঁ, এই যে, চন্দ্রনাথ জামার পকেট থেকে একটা মুখ-আঁটা পুরু সাদা খাম নিঃশব্দে এগিয়ে দিল কিরীটীর দিকে।

মুখ-আঁটা খামটার উপরে পরিষ্কার অক্ষরে বাংলায় লেখা—শ্ৰীযুক্ত কিরীটী রায় সমীপেষু। ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলেই তখন স্তব্ধ বিস্ময়ে কিরীটী ও চন্দ্রনাথের পরস্পরের কথোপকথন শুনছিল। কিরীটী খামটা ছিঁড়ে ফেলল। ভিতর থেকে বের হলো একখানা চিঠি। দীর্ঘ তিনপৃষ্ঠা ব্যাপী। কিরীটী চিঠিটা পড়তে লাগল।

কিরীটীবাবু,

আপনি সেরাত্রে ঠিকই আমাকে চিনেছিলেন, ভুল আপনার হয় নি। ভেবেছিলাম কাউকে কিছু না জানিয়েই নিঃশব্দে চিরদিনের মত সরে যাবো। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে আমার নিজস্ব বক্তব্যটুকু অন্তত যদি না জানিয়ে যাই শেষ বিদায়ের আগে, কোন তৃতীয় নিরপরাধ ব্যক্তি হয়তো শেষ পর্যন্ত নরেন মল্লিকের হত্যাপরাধের সন্দেহে অযথা পীড়িত হবে। সেও একটি কথা এবং নরেনের হত্যা-ব্যাপারটার সঙ্গে এমন দুজন জড়িত আছে যাদের চাইতে প্রিয় এ জগতে আমার আর কিছুই নেই—এবং বিশেষ করে শেষোক্ত কারণেই এই চিঠিখানা যাবার আগে আপনাকে লিখে গেলাম।

সেদিন রাস্তার মাঝখানে গ্যাসের আলোয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনার চোখে যে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল তা আমার নজর এড়ায় নি। কিন্তু সে বিস্ময়কে জানতে হলে আমার অতীত কাহিনী আপনার জানা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, আমার কথা বুঝতে হলেও আমার অতীত না জানলে সবটা ঠিক বুঝে উঠতে পারবেন না।

আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগেকার কথা। কাহিনী হচ্ছে একটি তথাকথিত আলট্রামডার্ন বা আলোকপ্রাপ্তা(?) শিক্ষিতা(?) তরুণীর কাহিনী। ভগবান রূপ দিয়েছিলেন তার দেহে অকৃপণভাবে ঢেলে। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থাৎ তার দেহে যখন কৈশোর এলো তখন থেকেই তার মা তাকে তার রূপ সম্পর্কে এমন আত্মসচেতন করে তুলেছিল যে যৌবন তার দেহে আসবার আগেই রূপের দেমাকে হয়ে উঠেছিল সে আত্মহারা, তার সঙ্গে মায়ের শিক্ষায় হয়ে উঠেছিল সে উদ্ধৃঙ্খল বেপরোয়া। মার কাছ থেকে সে শিক্ষা পেয়েছিল, নারীর রূপ হচ্ছে পুরুষ-পতঙ্গকে পোড়াবার জ্বলন্ত অগ্নিশিখা এবং যে মেয়ে সে নীতিকে জীবনে না অনুসরণ করে, তার দুঃখের আর সীমা থাকে না। বোকা মেয়ে তাকেই জীবনের পরম সত্য বলে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলল।

উচ্ছৃঙ্খল জীবনে তার হৃদয় বলে কোন পদার্থই ছিল না। অর্থাৎ দেহের অভ্যন্তরে যে একটা মন থাকতে পারে তার সন্ধান সে কোন দিনই পায় নি। রূপমুগ্ধ পুরুষদের নিয়ে খেলা করাই ছিল তার একমাত্র কাজ। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে শোষণ। এমনি করে যখন জীবনের একুশটা বছর কেটে গিয়েছে, এমন সময় দেখা হলো তার একটি পুরুষের সঙ্গে কোন একটি পার্টিতে, যে পুরুষটির তথাকথিত ঐসব মেয়েদের সম্পর্কে কোন জ্ঞানই ছিল না। পুরুষটির তখন বয়স চল্লিশের কোঠা ছাড়িয়ে চলেছে।

ধীর, সৌম্য, শান্ত, রূপবান এবং অবস্থা খুব ভাল। কলকাতায় তিন-চারখানা বাড়ি, মোটা ব্যাংক-ব্যালেন্স। পুরুষটিও পার্টিতে প্রথম দিন সেই মেয়েটিকে দেখেই মুগ্ধ হলো। মেয়েটিরও যে পুরুষটির উপরে কিছুটা দুর্বলতা জেগেছিল সেদিন অস্বীকার করা যায় না। যাহোক সেই পার্টির পর থেকেই দুজনার মধ্যে আলাপ জমে উঠলো। মেয়েটির মা একদিন বললে, যদি বিয়ে করতে হয় তো একেই কর। গোবেচারী ধরনের লোক। টাকাকড়ি যথেষ্ট আছে। বয়সও হয়েছে। একে তুই অনায়াসেই মুঠোর মধ্যে রেখে নিজের খুশিমত জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবি। তাছাড়া আজ রূপ-যৌবন আছে, কিন্তু একদিন যখন ওসব কিছুই থাকবে না তখন একটা শক্ত আশ্রয় না পেলে বাঁচতে পারবি না। মেয়েটিও ভেবে দেখলো, কথাটা নেহাৎ মিথ্যা নয়। যার ফলে মেয়েটির সঙ্গে পুরুষটির বিবাহ হয়ে গেল।

কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই দুটি সত্য মেয়েটির চোখের সামনে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠলো। তার একটি হচ্ছে, নির্বিবাদী শান্ত ও সংযমী পুরুষ হলেও তার স্বামীর মনের মধ্যে একটা লৌহ কঠিন পৌরুষ আছে যা সহজে বিদ্রোহ ঘোষণা করে না বটে কিন্তু একবার বিদ্রোহী হলে তাকে শান্ত করা স্বয়ং বিধাতারও দুঃসাধ্য। দ্বিতীয়, লোকটির অসম্ভব এবং অত্যুগ্র একটা আভিজাত্য ও রুচিবোধ আছে। যার ফলে কারোই সহজ চলার পথে সে অনিচ্ছা থাকলেও বাধা দেয় না। এবং ঠিক দুটি কারণেই মেয়েটি বিবাহের পরও যখন তার স্বামীকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেই নিজের গতানুগতিক উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে গা ভাসিয়ে চলতে লাগল, স্বামীর গৃহ থেকে বহুদিন পর্যন্ত কোন বাধাই পায় নি—আর ঐটাই হলো তার জীবনের সব চাইতে বড় ভুল। যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তাকে সর্বস্ব দিয়ে করতে হলো। বেঁচে থেকেও তিলে তিলে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে কাউকে দেখেছেন কি মিঃ রায়! ধারণা করতে পারবেন না—সে কি যন্ত্রণা সে কি দাহ!

যাক যা বলছিলাম—বুঝতে পারছেন বোধ হয় সেই মেয়েটিই আমি! বিবাহের দুই বৎসরের মধ্যেই আমি মা হলাম। কিন্তু তবু হতভাগিনী আমার চোখ খুলল। যে মাতৃত্ব নারীকে দেয় নতুন জীবন, যে মাতৃত্ব নারীর জীবনে আনে অমৃতের স্বাদ, সে মাতৃত্ব পেয়েও আমি সুধা ফেলে গরলের পিছনেই ছুটতে লাগলাম! আকণ্ঠ গরল পান করেই নেশায় বুদ হয়ে রইলাম। সেই গরলই হচ্ছে আপনাদের ঐ নরেন মল্লিক। নরেনের দুটো নাম ছিল—একটা পোশকী, একটা সর্বত্র চলতি। চলতি নামটা আর করবো না, নরেন নামটাই বলি।

জানি না সদ্য বিলাত-প্রত্যাগত ঐ নরেন কি কুক্ষণেই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ঐ নরেনই শেষ পর্যন্ত আমার এত দুঃখের কারণ, নরেনই দিল আমাকে যত উৎসাহ, যত বুদ্ধি-বুদ্ধি নয় বলবো দুর্বুদ্ধি!

স্বামী আমার কোন কাজেই বাধা দেন না। মুক্ত স্বাধীন আমি। যথেচ্ছাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে দিন কাটছে। আর বিশ্বাস করে স্বামী তার যে অর্থ ও সম্পত্তি আমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন–সেই অর্থ ক্রমে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে আসছে। কিন্তু জেনেও বুঝতে পারি নি, চোখ আমার খোলে নি যে প্রায়শ্চিত্তের দিন আমার এগিয়ে এসেছে।

হঠাৎ তারপর একদিন এলো আমার স্বামীর চিঠি, কলকাতার বাস উঠিয়ে এবার তার কাছে যেতে হবে। তখনও ভেবেছি ও কিছু না। কেবল একটা নিছক হুমকিই বুঝি। আর নরেনও তাই আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করল। কিন্তু অকস্মাৎ যেদিন স্বামী এসে হাজির হলেন, তার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করেই বুঝলাম, কোথায় যেন সত্যিকারের গণ্ডগোল ঘটেছে। আমার ভাগ্যাকাশে কত বড় দুর্যোগের মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে ঝড়ের কালো মেঘ! সুখের স্বপ্ন আমার ভাঙার মুখে। কিন্তু মানুষের দুর্ভাগ্য, রাহু যখন একবার তাকে গ্রাস করে মুক্তি যে তার সহজে মেলে না তা তো বুঝি নি। তাই সেদিন রাত্রেই গৃহে ফিরে স্বামীর কণ্ঠস্বরে সেই মেঘই যখন গর্জে উঠলো, তখনই স্পষ্ট বুঝলাম আগুন জ্বলছে এবং ভয়াবহ সে আগুন মেলেছে শত শত লোল বাহুঁ। রক্ষে নেই আর। মুহূর্তে সে আগুন আমার সর্বাঙ্গে বেষ্টন করে ধরল। পদাঘাতে বিতাড়িত হলাম আমি সেই রাত্রেই স্বামীগৃহ থেকে। ধাক্কা খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে এসে পড়লাম কিন্তু তবু মৃত্যু আমাকে আশ্রয় দিল না। দেবেই বা কেন? পাপের প্রায়শ্চিত্ত যে তখনও আমার পূর্ণ হয় নি। রক্তাক্ত মুখে ছুটে গেলাম সেই রাত্রেই নরেনের গৃহে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখিনরেন তখন আর এক নারীর আলিঙ্গনে বদ্ধ। একে অপমানের জ্বালায় পুড়ছিলাম, তার উপরে নরেনের সেই মিথ্যাচার প্রতারণা আমাকে যেন একেবারে হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য করে তুলল। নরেনকে আঘাত দেবো বলে পাগলিনীর মত যেমন তার দিকে এগিয়ে গিয়েছি সে আমাকে দিল একটা প্রচণ্ড ধাক্কা। সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়লাম টেবল-ল্যাম্পটার ওপরে। বিস্ফোরণের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালাম। তিন দিন পরে জ্ঞান ফিরে এলো হাসপাতালে। সমস্ত মুখে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। টেবল-ল্যাম্পটা ফেটে সমস্ত মুখটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল, পরে জানতে পারি। এবং হাসপাতাল থেকে তারপর বের হয়ে এলাম একদিন মুখের উপরে অবগুণ্ঠন টেনে। সেই হলো নবজন্ম। নাম নিলাম বিনতা।

এবারে শুনুন বিনতার ইতিহাস :

মাসচারেক বিনতা বাংলাদেশের একেবারে বহুদূরে এক তীর্থক্ষেত্রে আত্মগোপন করে রইলো। এবং ঐ চার মাস সময়ের মধ্যে প্রচণ্ড এক অগ্নিদাহ চলেছিল বিনতার নিভৃত মনে। এবং সেই অজ্ঞাতবাসের সময়েই বিনতা জানতে পারল যে তার নারীমনের মধ্যে সহজাত যে মাতৃত্ব, যাকে সে এতকাল কণ্ঠরোধ করে অবহেলা ও অবজ্ঞায় অস্বীকার করার চেষ্টা করে এসেছে—কোন নারীই যাকে আজ পর্যন্ত অস্বীকার করতে পারে নি, তাই মনের এক কোণে জ্বলছে যখন প্রতিহিংসার ভয়াবহ অগ্নিস্রোত, অন্য কোণে চলেছে বয়ে নিঃশব্দে অতৃপ্ত মাতৃত্বের স্নিগ্ধ এক ক্ষীণ ধারা এবং একদিন সেই ধারাই তাকে অজ্ঞাতবাস থেকে টেনে নিয়ে এলো কলকাতা শহরে তার ছেড়ে যাওয়া সন্তানদের সন্ধানে। এসে শুনল স্বামী তার সন্তানদের নিয়ে সেই রাত্রেই কোথায় যেন নিখোঁজ হয়েছেন। আরো শুনলো নরেন মল্লিকও বর্মায় গিয়ে আত্মগোপন করেছে। কিন্তু অতৃপ্ত মাতৃত্ব তাকে যেন স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। সে বের হলো তার সন্তানদের সন্ধানে এবং শুনে হয়ত আশ্চর্য হবেন, শেষ পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে সে পেল তার সন্তানদের সন্ধান। দূর থেকে আজ সে শুধু দেখেই তার বুকজোড়া নিধিদের কিন্তু অধিকার নেই তার তাদের স্পর্শ করবার। দূরত্ব রেখেই সে তার সন্তানদের পিছনে পিছনে সর্বত্র ছায়ার মতই ঘুরতে লাগল। ভাবতে পারবেন না মিঃ রায়, এক অভাগিনী জননীর দিনের পর দিন তার বুকভরা স্নেহের সঙ্গে সে কি যুদ্ধ! কত সময় মনে হয়েছে ছুটে গিয়ে তাদের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি কিন্তু স্বামীর ভয়ে ও নিজের কলঙ্কিত পরিচয় পাছে তার সন্তানদের শুভ্রতায় কালি ছিটায়, পারেনি সে অভাগিনী নারী কোনদিনই তাদের সামনে দাঁড়াতে। বুকভরা তৃষ্ণার হাহাকার নিয়ে সে দূরে সরে রয়েছে। তারপর দীর্ঘকাল পরে আবার তার স্বামী কলকাতায় এলে তাঁর সন্তানদের নিয়ে। এবং তারই বছর দেড়েক বাদে বর্মা প্রত্যাগত নরেন মল্লিক এসে কলকাতায় জাঁকিয়ে বসল। আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন কৃষ্ণা কাবেরীর অভাগিনী জননীই আমি। নরেন যে কলকাতায় ফিরে এসে জাঁকিয়ে বসেছে আগে কিন্তু তা টের পাই নি। হঠাৎ একদিন রাত্রে নরেনকে পার্ক সার্কাসের একটা স্টেশনারী দোকানে দেখে চমকে উঠলাম। তার পাশে ছিল কাবেরী। দোকানের উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় এতকাল পরে নরেনকে দেখেও আমার চিনতে কষ্ট হয় নি। কিন্তু নরেনকে দেখে যতখানি না চমকে ছিলাম, তার চাইতেও বেশি চমক লেগেছিল আমার সেরাত্রে নরেনের পাশে আমার মেয়ে কাবেরীকে দেখে। আমার কাজকর্ম করবার জন্য ও আমাকে সদাসর্বদা দেখাশোনা করবার জন্য একটি পাহাড়ী ভৃত্য ছিল বীরবাহাদুর। তাকে নিযুক্ত করলাম নরেনের সমস্ত সন্ধান নেবার জন্য। সে-ই আমাকে নরেনের সব সংবাদ এনে দিল। তার মুখেই শুনলাম নরেনের গৃহে কৃষ্ণা কাবেরী দুজনারই যাতায়াত আছে। শয়তান নরেন মল্লিককে আমি চিনি। সে একদিন আমার জীবনে রাহুর মত উদয় হয়ে আমার সর্ব গ্রাস করেছিল, আজ আবার সে আমার আত্মজাদের জীবনে রাহুর মত উদয় হয়েছে। বহুদিনের পুরাতন ক্ষতে আবার নতুন করে রক্ত ঝরতে লাগল। নরেনের হাত থেকে যেমন করেই হোক আমার কৃষ্ণা ও কাবেরীকে বাঁচাতে হবে প্রতিজ্ঞা করলাম। কিন্তু কেমন করে? এমন সময় ভগবানই যেন হাতে আমার সুযোগ এনে দিলেন। নরেন একজন হাউস-মেইডের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। একটা দরখাস্ত ছেড়ে দিলাম। অনেকের সঙ্গে নয়, মাত্র তিনজনের ইন্টারভিউ হলো। লক্ষ্য করেছিলাম আমার কণ্ঠস্বর শুনেই নরেন যেন হঠাৎ চমকে উঠেছিল। তারপর নানাভাবে আমাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যেতে লাগল। বুঝেছিলাম আমাকে সে তার পূর্বপরিচিত সন্দেহ-বশেই যাচাই করে দেখছিল—তার সন্দেহ বা অনুমান সত্য কিনা। কি বুঝল জানি না, তবে আমাকেই সে কাজে বহাল করলো।

মাথায় দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টেনে থাকলেও এবং কারো সঙ্গে একমাত্র মধু ছাড়া ও বাড়িতে কোন প্রকার কথাবার্তা না বললেও, দুটি কান আমার সর্বদা সজাগ থাকত। চক্ষুও আমার সজাগই থাকত অবগুণ্ঠনের তলায়।

কিছুদিন যেতেই দুটি ব্যাপার নজরে পড়লো। একটি হচ্ছে কৃষ্ণা ও কাবেরীর নরেনের গৃহে যাতায়াত আছে। এবং নরেন ওদের মধ্যে কৃষ্ণার প্রতি আসক্ত ও কাবেরী নরেনের প্রতি আসক্ত। এবং দ্বিতীয়তঃ কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে কাবেরীই যেন পেয়েছে আমার অতীতের মনোবৃত্তি। কৃষ্ণা হয়েছে তার বাপের মত স্থির ধীর ও সংযত। আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম, সুবিমল কাবেরীর প্রতি আসক্ত কিন্তু কাবেরী সুবিমলকে নিয়ে খেললেও তার নজর ছিল আসলে নরেনের প্রতি নয়, তার সঞ্চিত বা অর্জিত অর্থের প্রতি। সঙ্গে সঙ্গে আমি সাবধান হলাম,-সতর্ক হলাম, যাতে করে নরেনের দ্বারা ওদের কোন অনিষ্ট না হয়। জানতাম আমি, মধ্যে মধ্যে রাত্রে কাবেরী বাগানের দ্বারপথে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাথরুমের দরজাপথে নরেনের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করত। তাদের দেখাসাক্ষাৎ হতো রাত্রে গোপনে। ঐ ব্যাপারটাই আমাকে সত্যিকারের চঞ্চল করে তোলে। অর্থের লোভে কাবেরীর নরেনের গৃহে রাত্রের ঐ গোপন অভিসার যে একদিন কাবেরীর সর্বনাশ ডেকে আনবে এ যেন কেন মন আমার পূর্বেই বলেছিল। তাই একদিন শেষ পর্যন্ত কাবেরীর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় ভীতা আমি রাত্রে নরেনের শয়নঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

আমি জানতাম রাত বারোটা সাড়ে বারোটার আগে কখনো সে ঘুমোয় না। সে রাত্রেও সে জেগেই ছিল। ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল। অবিশ্যি আশাও করি নি যে ঘরের দরজাটা খোলা থাকবে। বলতে পারেন দৈবই আমার সহায় ছিল বোধ হয় সেরাত্রে। নিঃশব্দে ভেজানো দরজাটা একটু ঠেলতেই দরজার কবাট দুটো ফাঁক হয়ে গেল। আর সেই ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে দৃষ্টিপাত করেই আমি যেন চমকে উঠলাম। চেয়ারের উপর বসে আছে নরেন আর তার হাতে একটা ছোট কেসে একটা বাদামের আকারের পাথর যার সংকীর্ণ বিচ্ছুরিত জ্যোতি ঘরের টেবিল-ল্যাম্পের মৃদু আলোকে ছাপিয়ে যাচ্ছে যেন। পরে বুঝেছিলাম সেটা একটা দামী। হীরা। সামান্য কয়েকটা মুহূর্ত ইতস্তত করে কমধ্যে প্রবেশ করলাম। নিজের মধ্যে তন্ময় ছিল নরেন তাই বোধ হয় প্রথমটায় ঘরের মধ্যে আমার নিঃশব্দ পদসঞ্চার সে টের পায় নি। কিন্তু আমি দুপা এগুতেই সে টের পেল। চমকে লাফিয়ে উঠে হীরাটা জামার পকেটে লুকিয়ে ফেলে সে তখন উঠে দাঁড়িয়েছে।

কে? এ কি বিনতা তুমি? তুমি এ সময়ে এ ঘরে কেন?

আমার দু-একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।

আমার সঙ্গে কথা!

হ্যাঁ।

কি কথা তোমার?

কৃষ্ণা কাবেরীর সঙ্গে আপনি মিশতে পারবেন না!

আমার বক্তব্য এত আকস্মিক ও এত বিস্ময়কর যে প্রথমটায় নরেন যেন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। নিষ্ঠুর হাসিতে তার মুখটা ভরে গেল। এবং প্রায় চাপা কণ্ঠেই সে বলল, তাহলে আমার অনুমান মিথ্যা নয়!

কি বলছেন আপনি?

কি যে ঠিক আমি বলছি তা তুমিও জান! তাহলে তুমি আজো বেঁচে আছে! বলতে বলতে হঠাৎ নরেন এগিয়ে এলো যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত। করুণাকরুণা—তুমি তাহলে সত্যিই আজো ঘেঁছে আছো?

সঙ্গে সঙ্গে দুপা পিছিয়ে গিয়ে কঠোর কণ্ঠে আমি বললাম, কি সব পাগলের মত যাতা বলছেন! কে করুণা?

কেন মিথ্যে ছলনা করছে করুণা?

আপনি ভুল করছেন—আমি করুণা নই, আমি বিনতা।

তুমি করুণা নও?

না।

বেশ। করুণা তুমি নও—তুমি বিনতাই, কিন্তু কৃষ্ণা কাবেরীর সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক?

সে শুনে আপনার লাভ নেই। আপনাকে যা বললাম তাই করবেন।

ক্ষণকাল চুপ করে থেকে নরেন বললে, আর তা যদি না করি?

আপনার ভালর জন্যই কথাটা বললাম। যদি আমার কথা আপনি না শোনেন—

না শুনি তত কি?

কৃষ্ণা কাবেরীর বাপ সঞ্জীব চৌধুরীকে সব আমি জানাবো। জানবেন আপনার সত্যিকারের পরিচয় সে জানতে পারলে আপনাকে সে এবারে আর জীবন্ত রাখবে না।

আমার সত্যিকারের পরিচয়?

হাঁ। আমি সব জানি আপনার অতীত ইতিবৃত্ত। যা বললাম মনে থাকে যেন। আমি চললাম। বলে আর এক মুহূর্ত আমি অপেক্ষা করলাম না, ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। কিন্তু তারপর কয়েকদিন লক্ষ্য করে দেখলাম, আমার সাবধান বাণী নরেনকে এতটুকুও বিচলিত করতে পারে নি।

তখন অনন্যোপায় হয়ে আমি কৃষ্ণাকেই একটি চিঠি দিলাম রাত্রে গোপনে বাগানে আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য। তাকে নরেন সম্পর্কে সাবধান করে দেবো, যাতে সে কাবেরীকে বুঝিয়ে বলে সময় থাকতে নিবৃত্ত করতে পারে।

নরেনের জন্মতিথির উৎসবের আগের রাত্রে কৃষ্ণা এলো গোপনে বাগানে আমার সঙ্গে দেখা করতে। মা ও মেয়েতে এই প্রথম সামনাসামনি ও প্রথম কথা।

কৃষ্ণা বললে, আপনি আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন দেখা করবার জন্য?

হাঁ।

কেন বলুন তো?

এ বাড়ির মালিক নরেন মল্লিকের সঙ্গে তোমরা মিশো না।

কেন এ কথা বলছেন?

তোমাদের মঙ্গলের জন্যই বলছি। তা ছাড়া আমার নিশ্চয়ই ধারণা, তোমরা যে এখানে যাতায়াত কর এবং নরেন মল্লিকের সঙ্গে মেশো নিশ্চয়ই তোমাদের বাবা জানেন না!

আমার শেষের কথায় যেন কৃষ্ণা ভয়ানক চমকে উঠলো।

আপনি—আপনি সে কথা জানলেন কি করে?

মৃদু হেসে বললাম, জানি।

আপনি—আপনি কি আমার বাবাকে চেনেন?

মৃদু, অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললাম, এককালে পরিচয় ছিল।

কিন্তু আপনি—আপনি কে?

আমি এ বাড়ির হাউস-মেইড।

না, না—তা নয়। আপনার পরিচয়—কি করে আমার বাবাকে আপনি জানলেন?

তোমার মা আমার বান্ধবী ছিলেন কলেজের ছাত্রীজীবনে।

আপনি তাহলে আমার মাকে জানতেন?

জানতাম। বলেই হঠাৎ যে কি হলো, একটা কথা কৃষ্ণাকে জিজ্ঞাসা করবার লোভ যেন কিছুতেই সামলাতে পারলাম না।

জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার-তোমার মাকে মনে আছে কৃষ্ণা?

মা!

হ্যাঁ, মনে আছে তাকে তোমার?

খুব অস্পষ্ট মনে পড়ে, আবছা আবছা—

তোমার বাবার মুখে কোনদিন শোন নি তোমাদের মার কথা?

না। কেবল এইটুকুই একবার শুনেছিলাম—

কি–কি শুনেছিলে?

আমাদের খুব ছোটবেলায় মা নাকি কি একটা অ্যাকসিডেন্টে মারা যান।

অ্যাকসিডেন্টে মারা যান?

হাঁ। তাছাড়া—

তাছাড়া আর কি কৃষ্ণা?

বড় হয়ে ভাল করে জ্ঞান হবার পর বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা নিজেও যেমন মার স্মৃতি কখনো মনে করতে চান না তেমনি আমাদেরও মনে করতে দেন নি। তাতেই মনে হয়—

কি?

মার ব্যাপারে বাবার মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা মর্মান্তিক দুঃখ লুকিয়ে আছে। তাই আমরাও কখনো ও সম্পর্কে ভুলেও উচ্চবাচ্য করি নি। একটা ছবি পর্যন্ত বাড়িতে কোথাও নেই মার। অথচ–

কি কৃষ্ণা?

মুখে বাবা যাই বলুন না কেন, আমার কিন্তু ধারণা বাবার মনের মধ্যে আজও মা বেঁচে আছেন।

কৃষ্ণা!

হ্যাঁ, কতদিন ঘুমের মধ্যে বাবাকে মার নাম ধরে ডাকতে শুনেছি। তাই তো ব্যাপারটা চিরদিন যেন কেমন গোলমেলে মনে হয়েছে। আচ্ছা আপনি তো মার বান্ধবী ছিলেন, আপনি জানেন কিছু মার অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যুর কথা?

না। কেবল শুনেছিলাম এক রাত্রে আগুনে পুড়ে তার মৃত্যু হয়।

আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন মা?

হাঁ। কিন্তু আর দেরি করো না কৃষ্ণারাত অনেক হলো, এবারে বাড়ি যাও।

সে-রাত্রে কৃষ্ণা চলে গেল। কিন্তু বাকী রাতটুকু মুহূর্তের জন্যও চোখের পাতায় আমার ঘুম এলো না।

আমার বক্তব্য শেষ হয়ে এসেছে মিঃ রায়। এবার নরেন মল্লিকের মৃত্যুর কথা বলে এ কাহিনীর উপরে আমি পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেবো।

মনে আছে সে তারিখটা, ২৭শে পৌষ সোমবার। নরেনের গৃহে তার জন্মতিথি উৎসব। বিরাট হৈ-চৈ হলো বিকেল চারটে থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। ভিড় কমতে কমতে রাত প্রায় পৌনে আটটা হলো। নরেন উৎসবের পরে বের হয়ে গিয়েছিল। ফিরলো রাত দশটায়। উৎসব-শেষে সমস্ত বাড়িটা যেন অকস্মাৎ একেবারে নিঝুম হয়ে গিয়েছে। উৎসবের খাটুনিতে শরীরটা ক্লান্ত হয়ে ছিল, নিজের ঘরে শয্যার উপরে আলো নিবিয়ে চোখ বুজে পড়েছিলাম। আপনি লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, নরেনের শয়নঘরের ঠিক নীচের ঘরেই আমি থাকতাম। তাই উপরের ঘরের সামান্যতম শব্দও রাত্রে নীচের ঘরে আমার কানে আসতো। রাত তখন বোধ করি সাড়ে এগারটা হবে, হঠাৎ মনে হলো উপরের ঘরে কি যেন একটা ভারী বস্তু মেঝেতে পড়ল। তারপরই একটা দুষ্পাপ পায়ের শব্দ। কি রকম কৌতূহল হলো, তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে এলাম। সিঁড়ির প্রথম ধাপ পার হয়ে দ্বিতীয় ধাপে উঠেছি, দেখি কে যেন অত্যন্ত দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। সিঁড়ির আলোটা রাত্রে নেভানোই থাকত, তাই হয়তো অন্ধকারে সে আমাকে দেখতে পায় নি বা উত্তেজনায় আমার দিকে নজর দেবার ফুরসৎ পায় নি। আমি তাড়াতাড়ি একটু পাশে সরে দাঁড়ালাম। ঝড়ের মতই সে আমার পাশ দিয়ে নেমে, প্যাসেজটা পার হয়ে প্যাসেজের অপর প্রান্তের দরজাটা দিয়ে বাড়ির পিছনের বাগানের দিকে চলে গেল। প্যাসেজের শেষ প্রান্তের আলোয় অপস্রিয়মাণ সেই মূর্তিকে আমার চিনতে কষ্ট হয় নি, সে আমারই মেয়েদের মধ্যে একজন—হয় কৃষ্ণা, না হয় কাবেরী। কিন্তু খানিকটা দূর থেকে তাড়াতাড়ি দেখেছিলাম বলে ঠিক দুজনের মধ্যে কে, কৃষ্ণা না কাবেরী চিনে উঠতে পারি নি। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে সিঁড়ির সেই ধাপে কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপরই সোজা উপরে উঠে গেলাম। নরেনের শোবার ঘরটা হা-হা করছে খোলা। ঘরের মধ্যে জ্বলছে আলো। খোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। একপাশে কাত হয়ে নরেনের দেহটা পড়ে তখনো আক্ষেপ করছে। দুটো হাতই গোটানো। আরো একটু এগিয়ে গিয়ে নরেনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। একটা ছোরা সমূলে প্রায় বিদ্ধ হয়ে আছে নরেনের বুকের বাঁ দিকে। আর ছোরার বাঁটটা তখনও সে ডানহাতের মুষ্টি দিয়ে ধরে আছে। রক্তে সমস্ত জায়গাটা ভেসে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে নরেনকে চিৎ করে শুইয়ে দিলাম। নরেন একবার মাত্র যেন অতিকষ্টে চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল, কি যেন বলবার চেষ্টা করল, সবটা নয়—কেবল বুঝলাম একটি কথা, ক্ষমা। তার পরই একটা হেঁচকি তুলে দেহটা স্থির হয়ে গেল। স্তব্ধ নির্বাক কতক্ষণ যে সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার পরেও মনে নেই। 

খেয়াল হতেই দেখি, বাথরুমের দরজাটা হা-হা করছে খোলা। ভয় পেয়ে আর সেখানে না দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি আমি সোজা নিজের ঘরে নীচে চলে এলাম। নিজের ঘরে বসে আছি ভূতের মত, বোধ হয় আরো আধ ঘণ্টা পরে আবার উপরের ঘর থেকে ঝঝন্ শব্দ কানে এলো। আবার উপরে গেলাম কিন্তু ভোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আমার স্বামী কাবেরীর হাত ধরে টানতে টানতে তাকে বাথরুমের দরজা দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। কাবেরী বাধা দিচ্ছে তাকে যাবে না বলে, আর কৃষ্ণা চাপা গলায় বলছে, চল্ কাবি, শীগগিরি এখান থেকে চশীগগিরি চ।

শেষ পর্যন্ত কোনমতে কৃষ্ণা ও আমার স্বামী কাবেরীকে নিয়ে চলে গেল। একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, প্রথমবারে যখন উপরের ঘরে সেরাত্রে আমি যাই—ঘরে ঢুকবার পরই, বোধ হয় মিনিটখানেক পরেই, একটা গাড়ির শব্দ আমি পেয়েছিলাম। কৌতূহলে জানালাপথে তাকাতে দেখেছিলাম, বাড়ির গেটের সামনে থেকে একটা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। গাড়িটা কালো রংয়ের সিডনবডি। গাড়ির নম্বরটা দেখেছিলাম এবং নম্বরটা আজও আমার মনে আছে, কারণ মধুর মুখে আগে একবার শুনেছিলাম ঐ নম্বরের ঐ গাড়িটাকে নাকি দুএকবার রাত্রে নরেনের ঘরে জল রেখে আসবার সময় জানালা বন্ধ করতে গিয়ে সে দেখেছিল, ঠিক গেটের অল্পদূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে। এবং সে-ই আমাকে বলেছিল নম্বরটা—BLA 6786। তাই গাড়িতে পরিচিত নম্বরটা দেখে চমকে উঠেছিলাম সেরাত্রে। মধু এও আমাকে বলেছিল, সে নাকি ড্রাইভার নন্দুয়ার মুখে শুনেছে-প্রায়ই একটা গাড়িকে নিঃশব্দে নন্দুয়া তার প্রভুর গাড়িকে অনুসরণ করতে দেখেছে। আমার যা জানাবার বা বলবার জানালাম। এবং এইটুকু আমি নিশ্চয়ই করে বলতে পারি, নরেনের হত্যার জন্য। আমার মেয়ে কৃষ্ণা ও কাবেরী দায়ী নয়। এবং নরেনের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চয় একটা রহস্য আছে। আপনার কাছে তাই শেষ প্রার্থনা অভাগিনী জননীর প্রতি অনুকম্পায় কৃষ্ণা ও কাবেরীকে এ হত্যার কলঙ্ক থেকে আপনি যেন বাঁচাবার চেষ্টা করেন। আর একটা কথা, নরেনের মৃত্যুর পর কৃষ্ণার সঙ্গে আমি দুচার দিন দেখা করেছি তাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে-বিনতার পরিচয়েই। সে আজও জানে না আমিই তার হতভাহিনী কলঙ্কিনী স্বামীপরিত্যক্তা জননী। তাদের চোখে আজ মৃতা হয়েও বেঁচে আছি। এবং দয়া করে একথা তাদের জানাবেন না। তারা যেমন জানে জননী তাদের মৃতা তাই যেন জানে। আমার কিছু অর্থ আছে ব্যাঙ্কে সঞ্চিত—সে টাকার জন্য আমি ব্যাঙ্কে আপনার নামে নির্দেশ দিয়ে গেলাম, আপনি টাকাটা তুলে কোন অবলা আশ্রমে দান করে দেবেন। আমাকে খোঁজবার চেষ্টা করবেন না, কারণ পৃথিবীতে কারো পক্ষে আমাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। নমস্কারান্তে–

বিনতা দেবী।

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কিরীটী একটানা চিঠিটা পড়ে গেল।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিসের ব্যাকুল প্রতীক্ষ্ণয় যেন। তারপর কিরীটী ঘরের সেই জমাট বরফের মত স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, ডাকল, কৃষ্ণা দেবী।

বলুন।

এই চিঠিটা কার জানেন?

কৃষ্ণা কিরীটীর কথার কোন জবাব না দিয়ে কেবল নির্বাক দৃষ্টিতে বারেকের জন্য তাকাল ওর মুখের দিকে। সে দৃষ্টিতে প্রশ্ন বা বিস্ময়, ভয় বা ব্যাকুলতা যেন কিছু নেই। ভাবলেশহীন স্থির পাথুরে দৃষ্টি।

চিঠিটা লিখেছেন বিনতা দেবী। তাঁর পরিচয়টা নিশ্চয়ই নতুন করে আর আপনাকে দিতে হবে না! আপনি তো তাকে ভাল করেই চেনেন, তাই না?

চিনি।

হঠাৎ ঐ সময় সঞ্জীব চৌধুরী ব্যাকুলকণ্ঠে কৃষ্ণাকে প্রশ্ন করলেন, কে-কাকে তুই চিনিস কৃষ্ণা? কার নাম বিনতা?

মিঃ চৌধুরী, আবার আপনাকে এই শেষবারের মত আমি বলছি—হয় আপনি চুপ করে থাকবেন যদি এঘরে থাকতে চান, নচেৎ বাধ্য হবো আমি আপনাকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিতে!

কিন্তু কেন—কেন বলুন তো মিঃ রায় আপনি এভাবে আমাদের উপরে অত্যাচার করছেন, জুলুম করছেন? আমি তো বলছি বার বার যে আমিই নরেন মল্লিককে হত্যা করেছি। ওরা—কৃষ্ণা কাবেরী কিছুই জানে না। নরেনের প্রতি বহুদিন আগে থাকতেই আমার কোন পারিবারিক ঘটনার জন্য আক্রোশ ছিল, তাই তাকে আমি হত্যা করেছি।

না। সে-সবই আমি জানি মিঃ চৌধুরী, আপনি নরেন মল্লিককে হত্যা করেন নি, করতে পারেন না। কথাটা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেই কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল আবার কৃষ্ণার দিকে এবং প্রশ্ন করল, কৃষ্ণা দেবী, রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে আপনি নরেন মল্লিকের হত্যার রাত্রে তার বাড়িতে তার শয়নঘরে গিয়েছিলেন? বলুন, মিথ্যে আর সব কিছু গোপন করবার চেষ্টা করবেন না—আমি সব জানি।

হাঁ গিয়েছিলাম।

কোন্ পথ দিয়ে তার শয়নঘরে প্রবেশ করেছিলেন?

বাথরুমের দরজা দিয়ে।

কৃষ্ণা—ওরে হতভাগী কি বলছিস তুই! আবার চেঁচিয়ে উঠলেন সঞ্জীব চৌধুরী যেন সব কিছু ভুলে।

বাধা দিও না বাবা, মিঃ রায় যা জানতে চান—সব আমাকে বলতে দাও। বলে উঠলো এবারে কৃষ্ণাই। এবং তার কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা ও প্রতিজ্ঞার সুর যেন ঝরে পড়ল এতক্ষণে। কৃষ্ণা বলতে লাগল, হাঁ মিঃ রায়, গিয়েছিলাম সে-রাত্রে আমি নরেন মল্লিকের ঘরে।

কেন—কেন গিয়েছিলেন?

তাঁকে সাবধান করে দিতে গিয়েছিলাম, কাবেরীর সঙ্গে যেন তিনি আর ভবিষ্যতে না মিশবার চেষ্টা করেন।

তারপর দেখা হয়েছিল—কোন কথাবার্তা হয়েছিল তার সঙ্গে?

না।

কোন কথাবার্তাই হয় নি?

না, কারণ ঘরে যখন ঢুকছি দেখি বক্ষে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় তিনি তখন রক্তাক্ত ঘরের মেঝের উপরে পড়ে ছটফট করছেন। তাই দেখেই ভয় পেয়ে তখুনি আমি ছুটে পালাই।

সিঁড়ি দিয়ে আপনি পালিয়েছিলেন?

হাঁ।

সে সময় কারো সঙ্গে সিঁড়িতে আপনার দেখা হয়েছিল বা কাউকে সিঁড়ির নীচে দেখতে পেয়েছিলেন?

কোনদিকেই তখন আমার লক্ষ্য ছিল না, ছুটে পালাতেই তখন আমি ব্যস্ত।

আপনি যখন নরেন মল্লিকের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন, ঘরের মধ্যে আর কাউকে দেখেছিলেন?

না।

ভাল করে ভেবে বলুন!

না, দেখি নি।

আর একটা কথার সত্যি জবাব দেবেন, কৃষ্ণা দেবী?

বলুন।

নরেনের মুখে কখনো দামী জুয়েলস্ বা অন্য জাতীয় কিছুর কথা শুনেছেন?

না।

কাবেরী দেবী, আপনি?

না।

আপনারা ঐজাতীয় কখনো কিছু তার কাছে দেখেছেন?

উভয়েই একসঙ্গে জবাব দিল, না।

ঠিক এই সময় একটি সাধারণ বেশভূষায় সজ্জিত তরুণ যুবক ঘরে এসে প্রবেশ করল।

কিরীটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, কি খবর বিভূতি?

ইনসপেক্টর মিঃ রক্ষিত আমাকে পাঠিয়েছেন একটা কথা বলতে—

বল।

ফৈয়াজ খানের details পাওয়া গেছে। সে বর্মা থেকেই আসছে। এবং মাস দশেক আগে তার বর্মার বাড়ির সেফ থেকে একটা দামী হীরা আশ্চর্যরকমভাবে চুরি যায়, যার সন্ধান বর্মা পুলিস আজও করতে পারে নি। সে আদপেই দালাল নয়।

কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর চোখের তারা দুটো যেন কি এক উত্তেজনায় ঝক্ঝক্ করে ওঠে। সে ব্যগ্রকণ্ঠে বলে, আর কোন সংবাদ বলেছেন?

হ্যাঁ, বলেছেন ফৈয়াজ খানের মুভমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে সে হয়তো দুচার ঘণ্টার মধ্যেই হোটেল ছেড়ে চলে যাবে।

সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী রহমানের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার সঙ্গে তো জীপ আছে রহমান সাহেব?

হাঁ।

তাহলে আসুন। কিরীটী দরজার দিকে এগুলো।

কোথায়–কোথায় যাবো?

আঃ, এখন তর্ক করবেন না—আসুন!

একপ্রকার যেন টানতে টানতেই কিরীটী রহমান সাহেবকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাকী সবাই ঘরের মধ্যে স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইল, নির্বাক।

সোজা কিরীটীর গাড়ি তাজ হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। ম্যানেজারকে ডাকতেই সে চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে এলো, কি চান? সিট খালি নেই!

পরক্ষণে পুলিসের পোশাক পরা রহমানকে দেখে একটা ঢোক গিলে ম্যানেজার বললো, ব্যাপার কি?

ফৈয়াজ খাঁ নামে কোন পাঠান এখানে আপনার হোটেলে আছে? কোন্ ঘরে থাকে লোকটা? কিরীটী প্রশ্ন করল।

সে তো এইমাত্র আধ ঘণ্টাটাক হলো হোটেলের বিল চুকিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বর্ধমান চলে গেল!

বাকী কথাটা আর কিরীটী শেষ করতে দিলে না, আবার রহমানকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নীচে নেমে গেল এবং গিয়ে জীপে উঠে বসল।

 গভীর রাত্রি। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড। ঝড়ের বেগে কিরীটীর গাড়ি ছুটে চলেছে। ড্যাসবোর্ডের নীলাভ আলোয় দেখা যায় স্পিডোমিটারের নিডল্টা কাঁপছে—৬০-৬৫, ৬০-৬৫! এগিয়ে চলে ঝড়ের বেগে নির্জন রাস্তা ধরে জীপটা।

লিলুয়া, উত্তরপাড়া, কোন্নগর, মাহেশ, শ্রীরামপুর শ্রীরামপুর লেভেলক্রসিং পার হয়ে এলো বদ্যিবাটি। আরো আরো দ্রুত। ব্যাণ্ডেলের স্টেশন ইয়ার্ডের আলো দেখা যাচ্ছে। ঐ—ঐ যে সেই গাড়ি ছুটে চলেছে! টেল ল্যাম্পে দেখা যাচ্ছে নম্বরটা : BLA 6786। উল্লাসে কিরীটীর মন নেচে ওঠে।

অগ্রগামী গাড়ির আরোহীও বোধ হয় বুঝতে পারে একটা গাড়ি তাকে অনুসরণ করছে, গতিবেগ তারও বেড়ে যায়।

কিরীটীও তার গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দেয় একসিলারেটারে আরো চাপ দিয়ে। স্পিডোমিটারের নিল্টা এবারে কাঁপছে—৬৫-৭০, ৬৫-৭০! সামনের গাড়িটা ছুটছে ঝড়ের গতিতে।

কিরীটীর নির্দেশে রহমান সাহেব হাত বাড়িয়ে আগের গাড়ির পশ্চাতের চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালায়।

দুড়ুম! দুড়ুম!

আগের গাড়িটা এঁকেবেঁকে চলে হঠাৎ মন্দগতিতে। আবার গুলির শব্দ।

হঠাৎ এবার সামনের গাড়িটার পশ্চাতের একটা টায়ার ভীষণ শব্দ করে ফেটে যায়, সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা একটা গাছের সঙ্গে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে উল্টে গেল।

কিরীটীর গাড়ি এসে থামল উল্টে-যাওয়া গাড়িটার সামনে। গাড়ির আরোহী মৃত। কিরীটী মৃতের বুকপকেট হতে পাসটা টেনে বের করলে এবং পার্সের মধ্যে থেকেই বের হলো বাদামের মত একটা হীরা। অন্ধকারে ঝলমল করে উঠলো হীরাটা।

কিরীটী উত্তেজিত কণ্ঠে রহমান সাহেবকে বললে, এই কমল হীরাটা নরেন মল্লিক বর্মা টী এরই খোঁজে এসেছিল হতভাগ্য ঐ পাঠান ইসমাইলের চর হয়ে, কিন্তু নরেন মল্লিককে হত্যা করেও সে হীরাটা পেল না—ভগবানের মার হাতে-হাতেই পেল। চল এবার ফেরা যাক।

উভয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ফিরে চললো কলকাতার দিকে।

.

দিন-দুই পরে। ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার। ডাক্তার একটা সোফার উপরে আড় হয়ে শুয়ে আপনমনে একখানা ইংরাজি নভেল পড়ছিল। সুইংডোরটা খুলে গেল। ডাক্তার চেয়ে দেখলে ঘরে প্রবেশ করছে কৃষ্ণা।

ডাক্তারের মুখখানা হাসিতে ভরে গেল, মধুর কণ্ঠে আহ্বান জানাল, আরে এসো এসো কৃষ্ণা!

কৃষ্ণা নই তো আমি, আমি কাবেরী!

পাশে এসে দাঁড়ায় ডাক্তার, মৃদু হেসে বলে, তবে প্রশ্নের উত্তর দাও আমার।

কর প্রশ্ন?

Ready!

Ready.

রাত্রি?

উঁহু, এখন সন্ধ্যা—ঠিক সন্ধ্যা।

শুভদৃষ্টি?

যাও। লজ্জায় রক্তিম হয়ে কৃষ্ণা মুখখানা নিচু করে।

যাও বললে চলবে না, জবাব দিতে হবে। সোফা ছেড়ে উঠে কাছে এসে দাঁড়াল সুকুমার কৃষ্ণার মুখোমুখি।

তবু কৃষ্ণা কোন জবাব দেয় না।

ডাক্তার, ওর হয়ে আমি জবাবটা দিচ্ছি শোন!

হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে দুজনেই দরজার দিকে ফিরে তাকায়।

দুহাতে পর্দাটা সরিয়ে দরজার ধারে কেবল পর্দার ফাঁক দিয়ে মুখখানা মাত্র বের করে নিঃশব্দে হাসছে কিরীটী।

আরে কিরীটী! এসো এসো।

না ভাই, হীরাটা সরকারকে ফেরত না দিয়ে যার প্রাপ্য তার হাতেই তুলে দিতে এসেছি। নিন কৃষ্ণা দেবী, নরেনের হয়ে আপনাদের দেয় তার বিবাহের যৌতুকটা আমিই দিয়ে গেলাম।

কৃষ্ণা সলজ্জ কুণ্ঠার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে হীরাটা নেয়।

তবে ভাই চলি!

আরে শোন শোন—

না ভাই, কৃষ্ণা দেবীকে তোমার প্রশ্ন শুভদৃষ্টি এবং তার জবাবটা শুনবার অধিকার একমাত্র তোমারই—তাছাড়া জান তো, আমাদের দেশে প্রথা আছে শুভদৃষ্টির সময় চাদর দিয়ে আচ্ছাদন দিতে হয় অন্যের দৃষ্টিকে। হাতের কাছে যখন চাদর নেই, মধুর অভাবে গুড়ং দদ্যাৎ—শাস্ত্রবিধি যখন আছেই, অতএব–

হাসতে হাসতে দুহাতে দরজার পর্দাটা টেনে দিতে যাচ্ছিল, সেই সময় হঠাৎ কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, একটা কথা মিঃ রায়, বিনতা দেবীর কোন সংবাদ পেলেন?

কিরীটী কৃষ্ণার দিকে তাকাল, না।

তারপরই কি রকম যেন সন্দেহ হতে সে-ই প্রশ্ন করে, তাঁকে কি আপনি চিনতে পেরেছিলেন কৃষ্ণা দেবী?

হাঁ।

চিনেছিলেন?

হ্যাঁ, শুধু আমিই নয়, বাবাও। বাবা তারই সন্ধানে বের হয়ে গিয়েছেন গত পরশু।

কৃষ্ণা চুপ করল। তার দুচোখের কোলে যেন দুফোঁটা অশ্রু টলমল করছে।