৩. দিল্লির স্টেটসম্যানে বিজ্ঞাপন

॥ ৩ ॥

পাঁচ দিন পরে রবিবারের কলকাতা আর দিল্লির স্টেটসম্যানে বিজ্ঞাপনটা বেরোল।

প্রথম দিন কোনো ফলাফল নেই, কেউ যোগাযোগ করল না।

‘বোঝাই যাচ্ছে কলকাতার কেউ নয়; তা হলে এর মধ্যে টেলিফোন এসে যেত,’ বলল ফেলুদা।

বুধবার সকালে ফেলুদার একটা ফোন এল। গ্র্যান্ড হোটেল থেকে। জন ডেক্সটর বলে একজন টুরিস্ট। তিনি একটা অস্ট্রেলিয়ান দলের সঙ্গে ভারতবর্ষ ভ্রমণে বেরিয়েছেন, দিল্লিতে এসে আচমকা কাগজে ছবিটা দেখেই স্থির করেছিলেন কলকাতায় এসে ফেলুদার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বললেন আজই বিকেলে কাঠমাণ্ডু চলে যাচ্ছেন, দুপুর একটা নাগাদ আমাদের বাড়ি আসতে পারেন।

ফেলুদা অবশ্যই হ্যাঁ বলল। সে বেশ উত্তেজিত। বিজ্ঞাপনের যে কোনো ফল হবে সেটা ও আশা করেনি।

একটার কাছাকাছি একটা ট্যাক্সি এসে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। ফেলুদা দরজা খুলল। ট্যাক্সি থেকে নেমে এক বছর পঞ্চাশেকের সাহেব ফেলুদার দিকে এগিয়ে এল।

‘মিস্টার মিটার?’

‘ইয়েস—প্লীজ কাম ইন।’

ভদ্রলোক ভিতরে এসে ঢুকলেন। গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে একটা বাদামী রঙে এসে দাঁড়িয়েছে। বোঝাই যায় ভদ্রলোক বেশ কিছু দিন হল ভারত দর্শন করে বেড়াচ্ছেন।

ভদ্রলোক বসার পরে ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কাগজের ছবিটা দেখেছেন?’

‘সেট দেখেছি বলেই ত আসছি। অ্যাদ্দিন পরে আমার খুড়তুতো ভাই পিটার ডেক্সটরের ছবি কাগজের বিজ্ঞাপনে দেখে খুব অবাক লাগল।’

‘এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিত যে এটা আপনার খুড়তুতো ভাইয়ের ছবি?’

‘হ্যাঁ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমি খুব অল্প বয়সে অস্ট্রেলিয়া চলে যাই। তারপরে আর পিটারের খবর রাখিনি। ইন ফ্যাক্ট, আমার ফ্যামিলির সঙ্গেও আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই ওরা এখন কে কী অবস্থায় আছে তা বলতে পারব না। এইটুকু মনে আছে যে পিটারের বাবা—আমার কাকা—মাইকেল ডেক্সটর ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিলেন। আমার মনে হয় ইনডিপেনডেন্সের পরে উনি আবার দেশে ফিরে যান।’

‘পিটারই কি ওঁর একমাত্র ছেলে ছিল?’

‘ওঃ নো! সবসুদ্ধ সাতজন সন্তান ছিল মাইকেল ডেক্সটরের। পিটার ছিল ষষ্ঠ। বড় ছেলে জর্জও ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিল।’

‘মাইকেল ডেক্সটর বিলেতে কোথায় থাকতেন?’

‘কাউন্টিটা মনে আছে। নরফোক। শহরের নাম মনে নেই।’

‘এতেও অনেক কাজ হল।’

জন ডেক্সটর উঠে পড়লেন। তাঁকে হোটেলে গিয়ে লাঞ্চ খেতে হবে—তাঁর দলের লোক সব অপেক্ষা করছে। ফেলুদা ভদ্রলোককে আবার ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে দিল।

পরদিন আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আমরা রঞ্জন মজুমদারের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম।

‘বিজ্ঞাপনের কোনো ফল পেলেন?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

‘সেইটে জানাতেই আপনার কাছে আসা,’ বলল ফেলুদা। ‘ছেলেটি ব্রিটিশ, নাম পিটার ডেক্সটর।’

‘কী করে জানলেন?’

ফেলুদা জন ডেক্সটরের ঘটনাটা বলল।

রঞ্জনবাবু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তারপর বিড়বিড় করে দু’বার বললেন, ‘পিটার ডেক্সটর…পিটার ডেক্সটর…’

‘কিছু মনে পড়ছে কি?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘আবছা আবছা। একটা দুর্ঘটনা…না, এই স্মৃতির উপর নির্ভর করা চলে না।’

‘আপনি যে-সময়ের কথা ভুলে গেছেন, সেই সময়ের ঘটনা কি মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায়?’

‘যা মনে পড়ে সেটা সত্যি কি না কি করে বিচার করব? এমন ত কেউ নেই যাকে জিজ্ঞেস করে যাচাই করতে পারি। বাবা-মা দু’জনেই মারা গেছেন। আমার বিলেতের ঘটনা ওঁরাই জানতেন।’

‘একটা জিনিস বোধ হয় বুঝতে পারছেন, যে কলকাতায় বসে এই পিটার ডেক্সটর সম্বন্ধে আর কিছু জানা যাবে না।’

‘হ্যাঁ…হ্যাঁ…তা ত বুঝতেই পারছি…’

ভদ্রলোক আবার অন্যমনস্ক।

‘না কি ব্যাপারটা এখানেই ইতি দেবেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

ভদ্রলোক হঠাৎ যেন সজাগ হয়ে উঠলেন।

‘মোটেই না—মোটেই না!’ হাঁটুতে চাপড় মেরে বললেন রঞ্জন মজুমদার। ‘সে কোথায় আছে, কী করছে, আমাকে মনে আছে কি না—সব আমি জানতে চাই। আপনি কবে যেতে পারবেন?’

হঠাৎ এই প্রশ্নে যেন ফেলুদা একটু হকচকিয়ে গেল। বলল, ‘কোথায়?’

‘লন্ডন—আবার কোথায়? লন্ডন ত আপনাকে যেতেই হবে।’

‘হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পারছি।’

‘কবে যাবেন?’

‘আমার ত অন্য কোনো কাজ নেই। এটাই একমাত্র কেস।’

‘আপনাদের পাসপোর্ট-টাসপোর্ট হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ। আমরা কয়েক বছর আগে হংকং যাই; তখনই করিয়ে নিয়েছিলাম।’

‘তা হলে আর কী—বেরিয়ে পড়ুন। আমি টিকিটের ব্যবস্থা করছি।’

‘আমাদের সঙ্গে এক বন্ধু যাবেন—নিজের খরচে অবশ্য।’

‘ঠিক আছে—তাঁর নাম আমার সেক্রেটারি পশুপতিকে দিয়ে দেবেন। পশুপতিই আমার ট্রাভল এজেন্টের থ্রু দিয়ে আপনাদের যাবার এবং ওখানে থাকার সব ব্যবস্থা করে দেবে। তা ছাড়া ফরেন এক্সচেঞ্জের ব্যাপারটা ত আছে; সেটাও ও করে দেবে।’

‘ওখানে কদ্দিন থাকা?’

রঞ্জনবাবু একটু ভেবে বললেন, ‘সাত দিনে যদি হল ত হল, না হলে চলে আসবেন। আমি রিটার্ন বুকিংটাও সেইভাবেই করব।’

‘আমি যদি সাকসেসফুল না হই, তা হলে কিন্তু আপনার কাছ থেকে টাকা নিতে প্রস্তুত নই।’

‘আপনি কোনো কেসে বিফল হয়েছেন?’

‘তা হইনি।’

‘তা হলে এটাতেও হবেন না।’