দারোগা মদন হাজরা খুবই করিৎকর্মা লোক। পরদিন সকালে তিনি দলবল নিয়ে অ্যাকশনে নেমে পড়লেন। বেলা বারোটার মধ্যে পাঁচ-ছ’টা গ্রাম থেকে মোট এগারোজন বামাচরণকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসা হল। তাদের মধ্যে পনেরো। থেকে পঁচাশি সব বয়সের লোকই আছে। কেউ বেঁটে, কেউ লম্বা, কেউ কালো, কেউ ধলো, কারও লম্বা সাদা দাড়ি, কারও পাকানো কালো কুচকুচে মোচ। একটা লম্বা দড়ি দিয়ে এগারোজনকেই কোমরে বেঁধে সারি দিয়ে দাঁড় করানো হল।
দৃশ্যটা দেখে মদন হাজরা খুবই খুশিয়াল হাসি হাসলেন। তিনি রোগাভোগা মানুষ, বারোমাস আমাশায় ভোগেন। লোকে তাঁকে আড়ালে চিমসে দারোগা বলে উল্লেখ করে, তিনি জানেন। তিনি যে একজন ডাকসাইটে মানুষ, এ-বিশ্বাস কারও নেই। তাই সুযোগ পেলেই তিনি নিজের কৃতিত্ব দেখানোর চেষ্টা করেন। আজ এগারোজন বামাচরণকে গ্রেফতার করার পর তিনি খুবই আহ্লাদ বোধ করছিলেন। ঝোলা গোঁফের ফাঁকে ফিচিক-ফিচিক হাসতে-হাসতে তিনি জগাকে ডেকে বললেন, “এই যে জগা, তল্লাট ঝেটিয়ে সবকটা বামাচরণকে ধরে এনেছি। এবার বাছাধন, তোমার বামাচরণটিকে দেখিয়ে দাও তো? বেশ ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে তবে বলবে, বুঝলে তো!”
জগারও আজ আত্মাদ্রে সীমা নেই। থানার সামনে মেলা লোক জড়ো হয়েছে। সেপাইরা ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। বামাচরণরা সবাই এবং জড়ো হওয়া মানুষেরা তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। নিজেকে ভারী কেষ্টবিষ্টু মনে হচ্ছিল জগার।
সে উঠে প্রথম লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, লোকটা ছ’ ফুট লম্বা, তেমনই চওড়া, বিরাট পাকানো গোঁফ, চোখদুটো বাঘের মতো গুলুগুলু।
জগা একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, ইনিই সেই বামাচরণ। একেবারে হুবহু তিনিই”।
লোকটা চোখ পাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বলল, “অ্যা।”
জগা দুহাত পেছিয়ে গিয়ে বলল, “আজ্ঞে না। আপনি না। বামাচরণবাবুর বোধ হয় গোঁফ ছিল না।”
দ্বিতীয়জন বেঁটেখাটো, মাথায় টাক, দাড়িগোঁফ কামানো।
জগা তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলে উঠল, “আরে! এই তো বামাচরণবাবু! এই তো সেই–”
লোকটা দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “ইয়ার্কি হচ্ছে! ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাওনি, হনুমান কোথাকার!”
জগা চোখ মিটমিট করতে করতে বলল, “আজ্ঞে ইনি হবেন কী করে? বামাচরণবাবুর যে বাঁ গালে আঁচিল ছিল।”
তৃতীয়জন পাকা দাড়িওলা বুড়ো মানুষ। চশমার ফাঁক দিয়ে জগাকে দেখছিলেন। হাতে লাঠি।
জগা গদগদ হয়ে বলল, “পেন্নাম হই বামাচরণবাবু, কতদিন পরে দেখা! সেই যে হাটে বাঘ মারার অন্তরটা দিলেন, তারপর আর দেখাই নেই! ভাল আছেন তো! বাড়ির খোকাখুকিরা সব ভাল?”
একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বুড়ো বামাচরণ বললেন, “হাতের লাঠিটা দেখছ তো! এমন দেব কয়েক ঘা–”
জগা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, “আরে না, আপনার কথা হচ্ছে না, আপনার কথা হচ্ছে না। সেই বামাচরণের তো দাড়িই ছিল না মোটে।”
চতুর্থজন বয়সে ছোঁকরা, ভাল করে দাড়িগোঁফ ওঠেনি। জগা মিটমিট করে তার দিকে চেয়ে থেকে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “বামা না! উঃ, কী সাঙ্ঘাতিক জিনিসই দিয়েছিলি বাপ! কী শব্দ, কী তেজ অন্তরটার!”
ছোঁকরা ফ্যাচ করে হেসে বলল, “জগাপাগলা, এক মাঘে শীত যায় না, বুঝলে! আমার জগদ্ধাত্রী ক্লাবের ছেলেরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ঢিল মেরে তোমার মাথার চাঁদি উড়িয়ে দেবে আজ”
জগা গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি কি তোকে কিছু বলেছি রে বামা? বল তো, বলেছি? ওরে, আমার সেই বামাচরণের যে পেল্লায় দাড়িগোঁফ ছিল, তুই তো দুধের শিশু।”
পঞ্চমজন বেশ লম্বা একহারা চেহারার মানুষ। মুখোনা ভারী বিনয়ী। জগা তার দিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা চাপা গলায় বলে উঠল, “জিলিপি খাবে বলে জষ্টিমাসে যে আড়াইটে টাকা ধার নিয়েছিলে সেটা এবার ছাড়ো তো বাপু। নইলে দারোগাবাবুকেই কথাটা বলতে হয়।”
জগা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “এ নয়। এ একেবারেই বামাচরণ নয়। কিছুতেই নয়। এ হতেই পারে না!”
ষষ্ঠজন এক আখাম্বা তান্ত্রিক। কাঁচাপাকা দাড়ি, রক্তাম্বর, কপালে প্রকাণ্ড তেল-সিঁদুরের তিলক, চোখ দুখানা লাল, চেহারাখানাও পেল্লায়।
জগা হাসি-হাসি মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “বামাবাবু যে! ক’দিনেই চেহারাখানা শুকিয়ে একেবারে আদ্দেক হয়ে গেছে দেখছি? তা বামাবাবাজি–”
তান্ত্রিক বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠল, “জয় শিবশন্তো! জয় মা তারা! তোর মাথায় বজ্রাঘাত হবে রে জগা, এই দিলুম তোকে অভিশাপ–”
তান্ত্রিক অভিশাপ দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই জগা চট করে বসে পড়ল। তারপর একলাফে সরে চারদিকে চেয়ে অভিশাপটা কোথায় পড়ল তা খুঁজে দেখতে-দেখতে বলল, “তা বাজটা কোথায় পড়ল বাবাজি?”
“পড়েনি। পড়বে। তোর নিস্তার নেই রে জগা–”
জগা খুব অভিমানের গলায় বলল, “দিয়েই ফেললেন নাকি শাপটা?”
“এখনও দিইনি। এই দিচ্ছি–”
“থাক, থাক। আপনি মোটেই সেই বামাচরণ নন। সেই বামা পিস্তল নিয়ে ঘোরে, বাজ নিয়ে নয়।”
সপ্তমজন রোগাপাতলা চালাক-চালাক চেহারার একজন লোক। বাহারি সরু গোঁফ, বাবরি চুল, ঠোঁটে পানের দাগ।
বামাচরণ তার কাছাকাছি যেতেই লোকটা খুব মিহি গলায় বলল, “পরশু হাটুগঞ্জে আমাদের ফুল্লরা অপেরার কৃষ্ণার্জুন পালা হচ্ছে। গিয়ে আমার নাম বোলো গেটম্যানকে, বামাচরণ বিশ্বাস, একেবারে সামনের সারিতে বসিয়ে দেবে।”
জগা একগাল হেসে বলে, “কস্মিনকালে দেখিনি মশাই আপনাকে।”
অষ্টমজন মাঝবয়সী একজন নিরীহ লোক। এতক্ষণ ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিল। জগা তার সামনে যেতেই ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠে বলল, “এত হেনস্থাও কপালে লেখা ছিল ভাই জগা? সারা জীবন গরিব-দুঃখীর জন্য এত করলুম, শেষে আমাকে কিনা পুলিশে ধরল?”
জগা সঙ্গে-সঙ্গে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আহা-আহা, কাঁদো কেন বাপু? গরিব-দুঃখীর জন্য খুব করো বুঝি তুমি?”
লোকটা চোখে হাত চাপা দিয়ে মাথা নেড়ে বলে, “করতে আর পারলুম কই? যতবার গরিব-দুঃখীর জন্য কিছু করতে যাই ততবার আমার মাসি আমাকে বলে, “ওরে বামাচরণ, তোর মতো গরিব, তোর মতো দুঃখী আর কে আছে? তাই আর কিছু করে উঠতে পারলাম না রে ভাই!”
লোকটা জগার কাঁধে মুখ গোঁজার চেষ্টা করায় জগা একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল, “আহা, আর কাঁদে না। তোমাকে না হয় ছেড়েই দিচ্ছি।”
“ছাড়বে কেন ভাই। বরং ফাটকেই দাও। তাও তো এরা দু’বেলা দুটি খেতে দেবে!”
নবমজন ঢুলুঢুলু চোখের একজন কেশ বাবু চেহারার যুবক। মুখে কোনও দুশ্চিন্তা নেই। গুগুন করে একটা সুর ভাঁজছিল।
জগা তার সামনে দাঁড়াতেই লোকটা জিজ্ঞেস করল, “বলো তো কী রাগ?”
জগা তটস্থ হয়ে বলে, “রাগারাগির কী আছে? আমি কি বাপু, রাগের কথা কিছু বলেছি?”
লোকটা মৃদু হেসে বলল, “পারলে না তো? এ হল বেহাগ। আচ্ছা এবার শোনো”
লোকটা ফের গুগুন করে সুর ভাঁজতে লাগল। ভারী আনমনা।
দশ নম্বর লোকটা খুবই বেঁটে। জগার কোমরসমান হবে।
জগা একটু ঝুঁকে দেখে বলল, “বামাবাবুই মনে হচ্ছে যেন!”
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলল, “তা তো বটেই। অধমের নাম বামাচরণ সরখেল। আমার মামাশ্বশুর কে জানো? ডাকসাইটে
উঁকিল হিদারাম রায়। জজেরা তাকে দু’বেলা সেলাম ঠোকে। আমার পিসতুতো শালা হল গয়েশপুরের দারোগা দাশরথি দাস। আমার খুড়শ্বশুর কে জানো? কালিয়াগঞ্জের–”
জগা একটু রেগে গিয়েই বলল, “থাক, থাক, মশাই, আপনার আর বামাচরণ হয়ে কাজ নেই।”
এগারো নম্বর এক বুড়োঘূখুড়ে মানুষ। তাকে দেখেই বিকট গলায় বলতে লাগল, “ক্যা ক্যা ক্যা রে তুই? অলপ্লেয়ে! পাজি! ছুঁচো! কেন ধরে এনেছিস র্যা আমায়? আমার চান-খাওয়ার সময় হয়নি নাকি র্যা? অ্যা, এখন বাজে ক’টা খেয়াল আছে?”
জগা তাড়াতাড়ি পরের লোকটার সামনে গিয়ে একটা নিশ্চিন্তের খাস ছেড়ে বলল, “এই যে! পেয়ে গেছি দারোগাবাবু। এই হল সেই বামাচরণ। একেই ভাল করে ধরুন।”
লোকটা চোখ পাকিয়ে বলল, “ইয়ার্কির আর জায়গা পেলে না? আমি আবার বামাচরণ হলাম কবে? আমি এই থানার সেপাই গুলবাগ সিং।”
জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে জগা বলল, “সেপাইজি! ছিঃ ছিঃ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে।”
কাণ্ড দেখে বাইরের জমায়েত লোকজন হোঃ হোঃ করে হাসতে লেগেছে। আর এগারোজন বামাচরণ সমস্বরে চেঁচাচ্ছে, “আমরা দেখে নেব। এইভাবে কোমরে দড়ি বেঁধে হাজারটা লোকের সামনে এই যে আমাদের হেনস্থা হচ্ছে এর প্রতিশোধ আমরা নেবই। মদন দারোগার নামে মামলা করব আমরা। জেল খাঁটিয়ে ছাড়ব”…ইত্যাদি।
মদন হাজরার মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, গোঁফ ঝুলে পড়েছে, চেঁচামেচি শুনে দু’হাতে কান চাপা দিয়ে মদন হেঁকে বললেন, “সসম্মানে খালাস! সসম্মানে খালাস! ওরে কে আছিস, বামাচরণদের কোমরের দড়ি খুলে দে…”
এক নম্বর বামাচরণ এগিয়ে এসে মদনের টেবিলে এক পেল্লায় চাপড় মেরে বলল, “শুধু ছেড়ে দিলেই হবে? আমার যে অপমান হল তার জন্য এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ চাই।”
অন্য বামাচরণরাও এককাট্টা হয়ে চেঁচাতে লাগল, “আমি দেড় লাখ চাই। আমার সারাদিনের ব্যবসা নষ্ট, পাঁচ লাখের নীচে নামতে পারব না। …আমার দশ লাখ..”
মদন হাজরা লাফিয়ে উঠে চেঁচাতে লাগলেন, “দরওয়াজা, শিগগির বামাচরণদের সসম্মানে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে থানা থেকে বের করে দে।”
চেঁচামেচি হইহট্টগোলে চারদিকে তুলকালাম হতে লাগল। যে-সেপাইটা বামাচরণদের ঘাড়ধাক্কা দিতে গিয়েছিল তাকে এগারোজন বামাচরণ পেড়ে ফেলল। মদন হাজরা হা-ক্লান্ত হয়ে বসে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন, “যত নষ্টের গোড়া হল ওই জগাপাগলা। ওরে গুলবাগ সিং, ওটাকে ধরে হাজতে পুরে দে তো! তারপর ব্যাটাকে এমন ধোলাই দিতে হবে যে–”
ঠিক এই সময়ে ভিড়ের ফাঁক দিয়ে সরু হয়ে রসময় চক্রবর্তী এসে সামনে দাঁড়ালেন, হাতজোড় করে বললেন, “বড়বাবু। কোথায় যেন একটা ভুল হচ্ছে।”
“ভূল! কিসের ভুল?”
“বলছিলুম যে, বামাচরণ কাঁচা লোক নয়। সে নিজের আসল নামটাই জগাকে বলেছে বলে মনে হয় না।”
“আসল নামটা তা হলে কী?”
“সেটা জানলে আর এত জল ঘোলা হবে কেন? জগাকে সে শুধু পিস্তলটাই দেয়নি, প্রতাপরাজার শুলটাও চুরি করার দায়িত্ব দিয়েছে, সেটা ভুললে চলবে না।”
গম্ভীর হয়ে মদন হাজরা বললেন, “। কিন্তু শুলটা দিয়ে কী করবে?”
“সেটাই ভাবনার বিষয়। শুলখানা আমি দেখেছি। সোনাদানা দিয়ে তৈরি হলেও না হয় কথা ছিল। তা নয়, শুলখানা নিতান্ত লোহা দিয়েই তৈরি। তার ওপর ওজনদার জিনিস, প্রায় দেড় মন। বামাচরণ এই শুল দিয়ে কী করবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। দুধসায়রের দ্বীপে তার কোনও আস্তানা আছে কি না সেটাও দেখা দরকার। আমি বলি কি হুজুর, হুটপাট না করে আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা ভাবা উচিত।”
দারোগা চিন্তিত হয়ে বললেন, “হুঁ।”