রুদ্রপ্রসাদ বারবাড়িতে দক্ষিণের বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে ধূমপান করছেন। সামনেই বাগান, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে, তবু দেয়ালে দেয়ালে দেয়ালগিরি।
দেবীপুর মৌজার ধারেকাছে বিদ্যুৎ এসে গেছে, বেশ কিছুদিন। অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল বাবুদের বাড়িতে এসে যাবে বিদ্যুৎ। কিন্তু আশ্চর্য, রুদ্রপ্রসাদের তাতে অনীহা। বিদ্যুতের আলোকে তিনি অনভিজাত মনে করেন, বিদ্যুৎচালিত পাখাকে বলেন অফিস আদালতের মাল।
রুদ্রপ্রসাদের মতে চিরকালীন ঠাট অক্ষুণ্ণ রাখাই হচ্ছে আভিজাত্য। তাঁর মতে–
ঝাড়লণ্ঠনের আলো, টানা পাখার হাওয়া, পালকি, জুড়ি গাড়ি, টমটম, এই সব সাবেকি চালই শ্রেষ্ঠ। যেন চিরন্তন ধারা অব্যাহত থাকে। ছন্দ ভঙ্গ না হয়।
অতএব থাকবে তেল-মাখানোর লোক, থাকবে পা টেপার লোক, থাকবে রুপোর গড়গড়া, রুপোর থালায় ভাত।…সাহেব সুবোর জন্যে ডিনার টেবল সেট-এর ব্যবস্থা ছিল শক্তিপ্রসাদের, ছিল উচ্চমানের বাবুর্চি যুগল। নিজে তিনি সেই ছাঁচেই চলতে চাইতেন। রুদ্রপ্রসাদের শখ-খেয়াল আলাদা। তিনি তাঁর ঠাকুরদার স্টাইলে মখমলের আসন পেতে রুপোর বাসনে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন নিয়ে খেতে বসতেই পছন্দ করেন, এখনও এ যুগেও।…কে জানে বাপের উপর বিতৃষ্ণাই এই পিছু হাঁটার কারণ কিনা। কারণটা যাই হোক রুদ্রপ্রসাদ তাঁর দেবীপুর মৌজার মধ্যে বিদ্যুতের প্রবেশ অধিকার ঘটতে দেননি, এবং সমগ্র পরিবেশটিতে যতটা সম্ভব সাবেকি বনেদি ভাব বজায় রেখেছেন।
অবশ্য প্রাসাদতুল্য ওই বাড়িতে শক্তিপ্রসাদ যে সব আধুনিকতার সংযোগ স্থাপন করেছিলেন, সেগুলো বর্জন করেও বসেননি। ঠাকুরদার আমলে অন্দরমহলের এলাকার মধ্যে উঁচু পাঁচিল ঘেরা বিরাট পুকুর ছিল মহিলাদের জন্যে। যেখানে বেআব্রু হবার ভয় নেই। তার মধ্যে আবার ছিল পাথরে বাঁধানো স্পেশাল রানিঘাট…বাইরে ছিল পুরুষদের আলাদা দিঘি।
শক্তিপ্রসাদই শোয়ার ঘরের লাগোয়া স্নানের ঘরের প্রবর্তন করেছিলেন। আনিয়েছিলেন চিনেমাটির বাথটব। গেঁথেছিলেন দেয়াল ফুড়ে শাওয়ার।
এগুলো আছে। তবে আর নতুন কোনও সংযোজন ঘটেনি রুদ্রপ্রসাদের দ্বারা।…তিনি এখনও ইচ্ছা হলে দিঘিতে সাঁতার দিয়ে এপার ওপার করে স্নান করেন। রানিঘাটটা এখন মালদা কোম্পানির করতলগত। সরমা তাঁর শ্বশুরের অবদানটি গ্রহণ করেছেন।
নতুনকে ঢুকতে দেব না এই যে হৃদয় রহস্য।
রুদ্রপ্রসাদের কে জানে কী তার উৎস। ক্রমশ ভিতরে ভিতরে কি অনুভব না করে পারছেন না দিন ফুরোবার পালা এসে গেল বলে! তাই পুরনো খোলসটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে অতীতের কাঠামোয় নিমজ্জিত থাকতে চান?
তাই অলস সন্ধ্যায় দক্ষিণের বারান্দায় আরাম কেদারায় মধ্যযুগীয় জমিদারদের মতো গড়গড়ার নল হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারেন।
ভঙ্গিটা অলস, কিন্তু মনের মধ্যে প্রচণ্ড ছটফটানি। ভুজঙ্গ গোয়ালার মতো একটা নিকৃষ্ট জীবের কাছে হেরে যাবেন তিনি? রুদ্রপ্রসাদের পুত্রহারা শূন্য হৃদয় নিয়ে হাহাকার করবেন, আর সেই টিকটিকি আরশোলার মতো তুচ্ছ জীবটা চালাকি করে খুনি ছেলেকে সরিয়ে ফেলে দিব্যি বাঁচিয়ে রেখে তাজা বুকে ঘুরে বেড়াবে?
অসম্ভব!
যতক্ষণ না রুদ্রপ্রসাদ সেই শয়তানের বাচ্চাটাকে পৃথিবী থেকে সরাতে পারছেন, ততক্ষণ দীপ্তিপ্রসাদের আত্মার শান্তি হবে না।…যেখানের মাটি তার রক্তে ভিজে উঠেছিল সেই মাটিতে গর্ত কেটে গয়লার বেটার লাশ পোঁতাবেন রুদ্রপ্রসাদ। তারপর তার উপরে পাথর গেঁথে দীপ্তিপ্রসাদের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। এটাই হবে রুদ্রপ্রসাদের পুত্রের আত্মার শান্তির জন্যে পারলৌকিক ক্রিয়া কাজ!…কিন্তু দিন চলে যাচ্ছে, হচ্ছে না!
হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে দীপ্তিপ্রসাদ যেন কোথায় বসে বাপের এই অক্ষমতা দেখে ব্যঙ্গ হাসি হাসছে, হাততালি দিয়ে বলছে দুয়ো দুয়ো।
বারান্দায় ঝাড়ের বাতি নেই, আছে দেয়ালে দেয়ালে দেয়ালগিরি। তবু সেই আলোতেই মাঝে মাঝে ঝিকিয়ে উঠছে রুদ্রপ্রসাদের আট আঙুলের আটটা আংটির হিরে পান্না চুনি নীলা।…দেখতে পাওয়া যাচ্ছে মাটিতে লুটিয়ে পড়া কোঁচার কোঁচানো আগা, শ্বেতপাথরে গড়া পায়ে হরিণের চামড়ার চটি। আর্দির পাঞ্জাবির মিহি গিলের কুঁচি। বাগান থেকে বাতাস আসছে প্রচুর, বাতাস বাহিত হয়ে আসছে বহুবিধ ফুলের সৌরভ। তবু মাথার উপরে টানা পাখা চলছে, সামনের চৌকিতে ফুলের তোড়া।
এটা নিয়ম।
মালীর করণীয় কর্তব্য।
কিন্তু এই ফুল ওই বাতাস এই জ্যোৎস্না ওই রুদ্রপ্রসাদের মনের উপর কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। এক সময় আলবোলা রেখে উঠে পড়েন রুদ্রপ্রসাদ। ব্ৰজেন হতভাগা হাতে পায়ে ধরে আর কয়েকটা দিন সময় নিয়েছে। কিন্তু রুদ্রপ্রসাদের তার উপর আস্থা নেই, লোকটা অপদার্থ।
অপরাধীকে ধরে খুঁটিতে বেঁধে সামনে ধরে দিলে ব্ৰজেন তার শাস্তিবিধান করতে পারে। তার বেশি নয়।…শোনা যাচ্ছে সেই শয়তান পাজি ভুজঙ্গটাকে এমন পিটুনি পিটিয়েছে যে, বেটাকে সদর হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। কিন্তু মরতে দিলে তো চলবে না, ওর কাছেই তো সন্ধান। তাই চিকিৎসার জন্যে পাঠানো।..নইলে অমন কত মার খেয়ে পাট হয়ে চড়ি উলটে যাওয়া লাশ পাচার হয়েছে কাছারিবাড়ি থেকে।
তা ব্ৰজেনের উপর ভরসা করে বসে নেই আর রুদ্রপ্রসাদ। ব্ৰজেনের ঘর জ্বলবেই নিশ্চিত। এখন রুদ্রপ্রসাদ গোয়ালাপাড়া থেকে ভুজঙ্গর জ্ঞাতিদের ডাকিয়ে চুপিচুপি হাজার টাকা বকশিশ করেছেন।
এতেই কাজ হবে মনে হয়।
ওই জ্ঞাতিগুলোই জানে কোথায় যেতে পারে ছোঁড়া, কতদুর তার দৌড়।..এই সন্ধ্যাবেলাই ভুজার খুড়োর খবর নিয়ে আসবার কথা। তাই চঞ্চল হয়ে উঠে পড়লেন রুদ্রপ্রসাদ। কে? কে ওখানে?
বৃদ্ধ সরকারমশাই মৃদু গলায় বললেন, আজ্ঞে আমি!
রুদ্রপ্রসাদকে ইনি জন্মাতে দেখেছেন। একদা খোকাবাবু ডাকতেন, তুমি করে কথা বলতেন, এখন সে প্রশ্ন নেই।
রুদ্রপ্রসাদ রুক্ষ গলায় বললেন, কী দরকার এ সময়?
আজ্ঞে, মালদা থেকে মামাবাবু এয়েছেন
কে? কে এসেছেন?
আজ্ঞে মামাবাবু
মামাবাবু! মামাবাবু মানে?
রুদ্রপ্রসাদ চিৎকার করে ওঠেন, কার মামাবাবু?
ওঃ! তাই তো!
সরকারমশাই মরমে মরে যান। অভ্যস্ত এই পরিচয়টা তো এখন মিথ্যা হয়ে গেছে। ভয়ে কেঁপে উঠলেন।
তবু সাহসে ভর করে বললেন, বউরানিমার ভাই।
এ পরিচয়টা তো ভুল নয়। মার ভাই তাকে মামাই বলা চলে।
রুদ্রপ্রসাদ বলে উঠলেন, কী বললেন? বউ-রানি-মার ভাই! ওঃ। তাই নাকি? তা হঠাৎ তাঁর শুভাগমন? বাড়িতে কারও বিয়ে-টিয়ে নাকি? কুটুম নেমন্তন্ন করতে এসেছেন? না কি পিতৃশ্রাদ্ধে?
বেশ জোর গলাতেই বলেন, অদূরবর্তীর কানে যাতে পৌঁছয়।
সরকারমশাই হঠাৎ স্থির করে ফেলেন, ঢের দিন তো দাসত্ব করলাম। আর না! এবার ছুটি হোক এই ক্লেদাক্ত দাসত্বের।
স্থির শান্ত গলায় বললেন, এখানের দুর্ঘটনার খবরে দেখা করতে এসেছেন।
এখানে দুর্ঘটনায়! ও হো। তাই নাকি? নিকট কুটুম্ব, কর্তব্য করতে এসেছেন।…তা কুটুম্বকে ভাল করে জলটল খাওয়ানো হয়েছে তো? অনেক দূর থেকে এসেছেন।
সরকারমশাই ক্ষণপূর্বের সংকল্পে আরও দৃঢ় হন।
আরও শান্ত গলায় বলেন, না। তিনি হাতে মুখে জলও দেননি! আগে দেখা করতে চান।…
হঠাৎ এমন কঠোর সংকল্প কেন? আশ্চর্য তো। তা দেখাটাই করিয়ে আনুন তা হলে? তারপর দেখবেন, খাওয়া-দাওয়াটা যেন ভাল হয়।
সরকারমশাইয়ের মনে হয়, এতদিন তিনি রয়েছেন কী করে এখানে?
হতভাগা গোবিন্দর মাথার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা দেখেও বুঝি এত ঘৃণা আর ধিক্কার আসেনি।
দৃঢ় গলায় বললেন, বউরানিমা বলে পাঠিয়েছেন, আগে আপনার সঙ্গে দেখা না করে, অন্দরে যাওয়া চলে না। নিয়ম নয়।
বটে! তাই নাকি, এই কথা বলেছেন তিনি? আচ্ছা!
ভারী যেন কৌতুক অনুভব করেছেন রুদ্রপ্রসাদ, এমনি ভাবে বলেন, তবে ডাকুন তাঁকে। আপনাদের বউরানিমার যখন তাই হুকুম।
.
সবংশে নিধন হলাম এবার।
ভরদুপুরে রোদ থেকে ঘুরে এসে দাওয়ায় বসে পড়ে ব্ৰজেন বলে উঠল, হাতে পায়ে ধরে আর তিনটে দিন মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছি, তারপর ব্যস সর্বস্বান্ত।
ব্ৰজেনের বউ নয়নতারা দাওয়ার ধারে একঘটি জল, একখানা গামছা আর একটা হাতপাখা মজুত রেখেছিল। তাড়াতাড়ি হাতপাখাখানা তুলে নিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে করতে বেজার গলায় বলল, বাপের আমল থেকে ওই কাছারিবাড়িতে কাজ করছ, চিরটাদিন কেনা গোলাম হয়ে আছ, বিনি দোষে তোমার ভিটেমাটি উচ্ছেদ করবে? ঘর জ্বালিয়ে দেবে? এও কি সম্ভব?
অসম্ভবের কিছু নেই মেজবউ? তবে আর বলেছে কেন রাজার বুদ্ধি না গোঁজার বুদ্ধি। সেই লক্ষ্মীছাড়া ছোঁড়াটা আমার পূর্বজন্মের কী-মহাশত্ত্বরই ছিল।
নয়নতারা বাতাসটা হঠাৎ থামিয়ে ফেলে আস্তে বলে, তা হ্যাঁগা সবাই যে বলচে খুঁজে পেলে ছেলেটাকে নাকি খুন করে ফেলবে রাজাবাবু।
তা খুন করে ফেলবে না তো কি মণ্ডা খাওয়াবে?
ব্ৰজেন খিঁচিয়ে বলে, হাজার টাকা বকশিশ করছেন অমনি? উঃ। লক্ষ্মীছাড়াকে কোথাও থেকে একবার চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে আসতে পারতাম! পারলে, সর্বস্ব বজায়, তার উপর উপরি লাভ ওই বকশিশের টাকাটা। অথচ কী হল? এইটুকুতেই হাত বেরিয়ে গেল? পাখা আর নড়ছে না যে
নয়নতারা আবার হাত নাড়তে নাড়তে বলে, ছেলেটাকে ধরে এনে খুন করবে আর তুমি তার লেগে খুঁজে বেড়াচ্চো? এ তো জল্লাদের কাজ।
আচ্ছা! খুব ধম্ম কথা শেখা হয়েছে। চিরকালের শান্তরের কথা হচ্ছে আপনি বাঁচলে বাপের নাম।…
নয়নতারা আরও বেজার গলায় বলে, ছেলেপুলে নে ঘর, এত পাপ জন্মে সইবে?
বেশি বকবক কোরো না মেজবউ, আমার বলে মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল। বলি আদালতে জজ সায়েব যখন ফাঁসির হুকুম দেয়? বেশ তো ধম্মে সয়। তারা ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করে না?
শোনো কতা! সেই আর এই এক হল?
তফাতও কিছু না, জজ ফাঁসির হুকুম দেয় উকিল ব্যালিস্টারেরা ওঠে পড়ে লেগে চেষ্টা করে যাতে ওই হুকুমটা বেরোয়। তবে? ধরে নাও রাজাবাবু জজ, আর আমরা উকিল ব্যালিস্টার।
ধরে নিয়ে মনকে চোখ ঠারোগে। ফাঁসি দেয় কাকে? খুনে গুণ্ডা বদমাশকে। ওই বাচ্চাটা তাই?
পাকেচক্রে তাই। ও কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল। তাই না খোকারাজাবাবু
নয়নতারা জেদের গলায় বলে, ওসব আমি মানিনে। কুকুরটা এমনিই ঝাঁপিয়ে পড়েছেলে।
আচ্ছা আচ্ছা থামো তো। কাজের কথাটা হোক। মেধো মালপত্তরগুলো ও বাড়িতে চালান করেছে? এ বাড়িতে যদি সত্যি আগুন ধরে তো
নয়নতারা বলে ওঠে, চালান অমনি করলেই হল? পাড়ার লোকের চোখ নেই? ওই বিরোদ বিরোদ পিকচার অতসব পেতল কাঁসা রুপোর বাসন, ভারী ভারী গালচে চাদর লোকের চোক বাঁচিয়ে পাচার করবে কেমন করে?
রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে যায় ব্রজেনের।
খিঁচিয়ে বলে, আমি যেমন করে বাবুদের বাড়ি থেকে পাচার করিচি তেমনি করে। বলি ও সব কি রাজাবাবু আমায় সদব্রাহ্মণ বলে দান করেছে, না উচ্ছ্বগ্ন করেছে? …মানে তোতার বাড়িটার খবর তো এখনও পাঁচকান হয় নাই, এখন ওখানে নিয়ে যাক। মেধোকে বলে দিও চটপট কাজ সারতে।
নয়নতারা মুখ বাঁকিয়ে বলে, হু–পাঁচকান হতে বাকি আছে। বাতাসে কথা ভাসে। সবাই জানে মসনে তোতার কতা। সমানে বলিচি, অন্নদাতা মনিব তার ঘরের থেকে তলে তলে এই যে জিনিস সরিয়ে আনচ এর ফল ভাল হবে না। এখন বোঝো। একে তো রাজাবাবু উগ্রচণ্ডা হয়ে আছে, এর উপুর যদি শোনে তলে তলে কাছারিবাড়ি ফাঁক করেচ তুমি, রাজবাড়ির মাল সরিয়েছো
থামবে তুমি?
ব্ৰজেন কড়া গলায় বলে, সংসারেই যার শত্রুর বিরাজিত, তার আবার ভাগ্যি।…যাবে যাবে সব যাবে।…
বলে গামছাখানা টেনে নিয়ে কুয়োর পাড়ে চলে যায়।
বেচারি ব্রজেন।
কতদিন থেকে কত কৌশলে তলে তলে এই পাচারের ব্যবসা চালিয়ে চলেছে। বৃহৎ বৃহৎ সব অয়েলপেন্টিং দামি দামি গালচে ভারী ভারী কাঁসা পেতলের বাসন। এদিক ওদিক রুপোর বাসন আয়না দেয়ালঘড়ি ফুলদানি এটা সেটা কত কী।
কে দেখছে? কে হিসেব নিচ্ছে? যারা দেখতে পাচ্ছে তারাও ভয়ে কথাটি কয় না। ব্ৰজেন তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ধুলো ময়লায় ভরে গেছে সাফ করতে পাঠাচ্ছি।
তারা বুঝে সুঝেও অবোধের ভানে বলে, ও তাই বুঝি?
নায়েবের কোপে কে পড়তে যাবে বাবা!
শনি শীতলা মনসা আর জমিদারের নায়েব এঁরা হচ্ছেন–চার সহোদর ভাইবোন।
কুয়ো থেকে ঘড়া ঘড়া জল তুলে মাথায় ঢালে ব্রজেন, আর চিন্তা করতে থাকে কোন কৌশলে খুঁটি চালালে, ধনপ্রাণ মান প্রতিষ্ঠা সবটি রক্ষা হয়। ভয় ওই ষড়যন্ত্রের সহায়কারী রাজবাড়ির ভৃত্যকুল। সময় বুঝে হয়তো ফাঁস করে দিয়ে সব দোষ ব্ৰজেনের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা যুধিষ্ঠির সাজবে। পৃথিবীটা তো এই রকমই নেমকহারাম।
নেমকহারাম পৃথিবীকে ধিক্কার দিতে দিতে বেআন্দাজি জল মাথায় ঢেলেই চলে ব্ৰজেন।
.
ভুজার খুড়ো বিহঙ্গবুড়ো বড় ফাঁপরে পড়ে গেছে।
রাজাবাবু এই গয়লাপাড়া থেকে বড় মুখ করে বিহঙ্গকেই ডেকে কাজটার ভার দিয়েছেন, তার উপর আবার বকশিশের বহর। বকশিশ তো আছেই, তা ছাড়া রাজাবাবুর কাছে মুখ থাকা।…কে বলতে পারে খোশমেজাজের মাথায় বিঘেকতক জমিই লিখে দেবে কিনা। এত বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে?
রাত গম্ভীর হলে গলা নামিয়ে কথাটা নন্দরানিকে বোঝতে বসে বিহঙ্গ, কিন্তু বোঝাবে কি, লক্ষ্মীছাড়া কাশিই বাদ সাধে। গলা তুললে বরং পার আছে, স্বর খাদে নামালেই যেন আরও শত্ত্বরতা সাধে। তবু বলতে থাকে বিহঙ্গ, দুদশে কুড়ি হয় তা জানিস তো? খক খক খক তবে গুনে রাক পাঁচ কুড়িতে এক শতো মাতায় ঢুকল খক খক এবার শোন দশবার ওই একশতোয় থাক দিলি হাঃ খক খক খক হাজার।
আন্দাজ করতে পারতেচিস? খক খক খক।
নন্দরানি হাই তুলে বলে, করলিই বা আন্দাজ, টাকাটা পেয়েচিস হাতে?
পেতি কলোক্ষ্যান? খক খক তুই যদি কৌশল করি অ্যাকবার সুনুক নিতি পারতিস কোতায় কোতায় ওদের আত্মকুটুম্ব আছি–তাহলিই
এর আর সুলুক নেয়ালিই কি। জানিনে? ভাশুরপোদের বাপের বাড়ির গুষ্টির তো সবই.বালুরঘাটায়।…শুদু মাসি থাকে ধূপগুড়ি। মামাটা কোতায় যেন–তা। ওই মাসিটাই টানে বেশি। ত্যাখোন ত্যাখোন-যৌততা সোমসার যে তো কে নিত্যি ছুটতো মাসির বাড়ি। ভেন্ন হয়ে পায়ে বেড়ি। আর বেরোনোর নামটি দেকি না। সাদে আর শান্তরে বলেচে, অ্যাকলা ঘরে চাকলা হোয়ে খেতে বড়ো সুক, মাত্তে এলে ধত্তে নাই, ওইডাই যা দুক। তা আমার বিশ্বেস, গোবিন্দ ওই মায়ের মাসির কাছে পাইলে গে লুকিয়ে আছে। অবস্থা ভাল তো মাসির।
বিহঙ্গ উত্তেজিত হয়, এত সব জানিস তুই?
ওমা। জানবনি? আজ নয় ভেন্ন হাঁড়ি। বলি, ছেলাম তো একোত্তর? ত্যাকোন ত্যাকোন মাসির ঘরের কতো গপপো কোরেচে ভাশুরপো বউ।
ছোটকালে মা গ্যাছে, ওই মাসির কাঁচেই তো মানুষ।
বিহঙ্গ বুড়ো বয়েসে যৌবনকালের মতো আবেগভরে নন্দরানির হাতটা চেপে ধরে বলে, ওঃ তুই আমায় বাঁচালি পাঁচুর মা। যে করে তোক ওই মাসির ঠেকানাটা আমায় জোগাড় করে দে।
নন্দরানি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, ওর আর জোগাড় করার কী আছে? ইস্টিশানের গায়েই মেসোর মস্ত মিষ্টি মণ্ডার দুহান। নাম অন্নোপুন্নো ভান্ডার। মায়ের নামে দুকান দেচে। মেসো তো–
ব্যাস ব্যাস, যত্তোটা বলেছিস মাইরি, ওতেই হবে। পূর্বো জন্মে তুই আমার কেউ ছিলি পাঁচুর মা।
মরণ।
নন্দরানি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, পূর্বো জন্মে কেউ ছেনু? এ জন্মে কেউ না?
ওই হালা। এখেনেই গিয়ে বসে আচে হারামজাদা ছোঁড়া কী বলিস?
নন্দরানি সায় দেয়, আমারও সেই সন্দ। আগে আগে গ্যাচে এয়েচে তো? পত্ চেনে।
বাকি রাতটা ঘুমোত পারে না বিহঙ্গ। ভোর না হতেই উঠে পড়ে।
এ একেবারে মোক্ষম খবর। এ ছাড়া আর কিছুনয়। একটু ফরসা হতেই ছুটে গিয়ে খবরটা জানাতে হবে। নির্ঘাত সঙ্গে সঙ্গে লোক চলে যাবে। ব্যাস কাজ ফতে। একেবারে বামাল সমেত এসে যাবে।
বিহঙ্গর তোড়জোড় দেখে নন্দরানি বলে, একুনি ছুটবে যে? রাজাবাবুর ঘুম ভেঙ্গেছে?
কী ভাবিসরে তুই পাঁচুর মা? রাজাবাবুর কি চোক্কে ঘুম আচে? দেগে যা হয়তো বাগানে পায়চালি করতেছে।
তুই দেকগে যা। কিন্তুক বলি রাকতিচি। ট্যাকা পেলে সব নিজের গভ্যে ভরবিনে। পাঁচুর বের জন্যি রাকতি হবে। চারকুড়ি টাকা পোনের আভানে সোবোনের ভাইজিডা হাতছাড়া হয়ে গ্যালো।
হবে। হবে। সব হবে রে বাবা।
বলে গামছাখানা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে যায় বিহঙ্গ।
নন্দরানি একটুক্ষণ পথপানে তাকিয়ে থাকে, যখন দেখে আর কোনও কাজে ঘুরে এল না, চোখছাড়া হয়ে গেল, তখন এদিক পানে চলে এসে ভাঁড়ারের চালার মধ্যে ঢুকে আসে। এখানে বছরের ধান চাল অড়র কলাইয়ের বড় বড় জালা বস্তা মটকি মজুত। জমি জিরেত আছে বিহঙ্গর, দুধের মাঠা তুলে তুলে নিয়ে ঘিয়ের ব্যবসাটা ভালই তার। সচ্ছলতা আছে।
ঘরটায় বিচ্ছিরি একটা গুমো গুমো গন্ধ। নন্দরানি পাশ কাটিয়ে সেই গুমসুনির আড়ালে ঢুকে গিয়ে বস্তার আড়ালে উঁকি দিয়ে ফিসফিসে গলায় ডাক দেয়, গোবিনদো, বেইরে আয়! বুড়ো চোকছাড়া হোয়েচে।
রোগা হাড় জিরজিরে ছেলেটা তার চট পাতা রাজশয্যা ছেড়ে উঠে এসে চোখ মুছতে মুছতে ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকায়।
নন্দরানি বলে, ভয় নেই। পেঁচো গদা দুজনাই বেইরেচে। তুই এই ব্যালা বাঁশঝাড়ের ধারে চলে যা। জল রেকেচি ডাবায় ভরে।
গোবিন্দ পত্রপাঠ মাত্র নির্দেশ পালন করতে চলে যায়।
ততক্ষণে নন্দরানি একখানা খোরায় এক পালি মুড়ি রেখে, তার উপর সদ্য দোয়া একঘটি বটের আঠার মতো দুধ ঢেলে দিয়ে এক খাবলা খাঁড় নিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে মাখতে থাকে।
চান সেরে গোবিন্দ ভিজে খেটেখানা পরেই উবু হয়ে তার সামনে বসে পড়ে। গ্রীষ্মকাল, ভিজে ধুতি গায়েই শুকোবে। ধুতি বদলের হ্যাঁঙ্গামা করতে গেলে হয়তো ধরা পড়ার সম্ভাবনা। নন্দরানি বলে, হাঁসহাঁস করে খেয়ে নে গোবিদো, কে কখন এসে পড়বে।
বেড়ার দোর দেয়া আচে?
আচে।
কৃতাৰ্থমন্য গোবিন্দ ওই রাজভোগটি এক গ্রাস মুখে তুলেই হঠাৎ বাঁ হাতে চোখ মুছে বলে, ঠামা।
কী রে?
বাবা বলে, তোমরা আমাদের শত্তুর।
নন্দরানি এক গাল হেসে বলে, ঠিকই বলে। নচেৎ তোর জন্যি এতো দুভূভোগ ভুগি? দিনে এতে কাঁটা হয়ে আছি।
ও বাড়িতে কী হতেচে?
কী আর হতেচে? আতদিন নায়েবের লোক এসে তল্লাশ করচে তুই নুইকে আচিস কিনা। ওই শত্রুর রবেই বাঁচোয়া। জানে দুবাড়ি মুক দেকাঁদেকি বন্ধ। তাই এখেনে উটকোতে আসে না। নে চটপট সেরে নে ভাই। তোকে মটকায় তুলে দে নিচ্চিন্দি হয়ে গোয়াল কাড়তে ঢোকবো।
গোবিন্দ আর একবার চোখটা মুছে নিয়ে, ঢকঢক করে বড় এক ঘটি জল গলায় ঢেলে চুপি চুপি চলে যায় ঠাকুন্দার খড়ের গুদোমে।
মেঝে থেকে চালা পর্যন্ত উঁচু করে পাহাড়প্রমাণ খড় বোঝাই করা আছে।
বিহঙ্গর অবস্থা সম্পন্ন, গোয়ালে অনেক গোরু। ছেলেরা বড় হয়েছে। দেখেশোনে।…বছরের খড়ও ভোলা থাকে আটি বাঁধা বাঁধা।…
গোবিন্দ কোঁচড়ে এক কোঁচড় চাল কলাই ভাজা বেঁধে নিয়ে, সেই পর্বতের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে পিছন দিকে পৌঁছে খড়ের আটির খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে সিঁড়ি ওঠার মতো উঠে যায়।…খড়ের বোঝার উপর গামছাখানা পেতে আবার শুয়ে পড়ে। শোয়াই কাজ এখন গোবিন্দর। উঠে দাঁড়ালেই তো লোকের চোখে পড়ে যেতে পারে।…কিছুক্ষণ পরে খিদে লাগলে, দাঁত চেপে চেপে নিঃশব্দে চাল কলাই ভাজাগুলো শেষ করবে। তারপর অপেক্ষা করবে, কখন ঠাম্মার সব কাজ সারা হবে, স্বামী পুতুরদের ভাত খাইয়ে শুতে পাঠিয়ে, তারপর লোককে শুনিয়ে শুনিয়ে বলবে, যাই ক্যানটুকু নে গিয়ে বুদি মুঙলিকে খাইয়ে আসি। হাঁক ছাড়ছে। ওদের নামই করে। ওরা এখন নতুন মা হয়েছে, ওদের দাবি আগে।
সুকৌশলে ডাল চচ্চড়ি মাখা এক শাকি ভাত ফ্যানের গামলার তলায় চেপে গোয়ালে ঢুকে যায় নন্দরানি। দেয়াল ধারে শানকিটা নামিয়ে বলে, আমি থাকতে থাকতে নেবে এসে সেরে নে গোবিদো। আমি পাহারা দেচ্চি।
অতঃপর গোয়ালের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে সুর করে ছড়া কেটে গোরু আদর করে নন্দরানি।
ও আমার মুঙলিরানি, চাঁদবদুনী,
খাবে য্যাতো মিছরি ননী।
দুদ দেবে ঘড়া ঘড়া,
মুংলি আমার টাকার তোড়া।
বলে,
বুদি আমার, নক্কী সোনা, চেঁদের কণা
বলে, খোল বিচুলি দে না, দে না।
বুদি আমার হলি ডাগর,
বুদির দুদে গঙ্গাসাগর।
বানিয়ে বানিয়ে আবোল তাবোল বকতে থাকে, যতক্ষণ না গোবিন্দ পর্ব সাঙ্গ হয়। গোবিন্দ যতক্ষণ না আবার নিজ সিংহাসনে গিয়ে ওঠে। চালার মাথায় খানিকটা ফাঁকা করে ফেলেছে গোবিন্দ। যাতে আলো আসে হাওয়া আসে। সারা দিনমান তো এখানেই। গভীর রাত্তিরে ভাঁড়ার ঘরের কোণে। বাড়িতে নন্দরানি ছাড়া আর কোনও মেয়েছেলে নেই, তাই বাঁচোয়া। পুরুষের চোখে ধুলো দেওয়া যায়, মেয়েমানুষের চোখকে নয়। রাতের খাওয়াটা একটু জুতের হয়।
চাষিদের থেকে গোয়ালাদের আরাম।
দুপুরভর ঘুম মারতে পারে।
বিহঙ্গ ঘুমজড়ানো গলায় বলে, আজকাল তোর মা ভগোবতীদিগের প্রিতি সোয়াগ বড় বেড়েছে দেকচি পাঁচুর মা। বলি নিজের গেলন কোটন হয়েছে?
এই তো প্রেম প্রকাশের পরাকাষ্ঠা। আবার কী হবে?
নন্দরানিও তদ্রূপ জবাব দেয়। নিজের হোয়েচে তো। তালেই হোলো। অপরের চিন্তেয় কাজ কী?
.
খিড়কি পুকুরের ঘাটের ধারে হাতমুখ ধধায়ার মুখে ভুজঙ্গর বউ টগর এসে দাঁড়ায়। আস্তে বলে, খাওয়া হল খুড়ি?
এটা সাংকেতিক শব্দ।
জ্ঞাতিদের আর কেউ উপস্থিত থাকলে, সন্দ করবে না কার খাওয়া।
তবে নন্দরানি সন্দ’কে একেবারে নির্মূল করে ছাড়ে, গলা তুলে বলে, খুড়ির খাওয়া হোয়েছে কিনা, তা জানতে তোর আঁতো মাতা ব্যাতা ক্যানলা টগর বউ? না হলি কি তুই ভাত বেড়ে ডাকবি? রোজদিন এখেনে ঘরঘুর করতি আসিস ক্যানো শুনি? উটোনধারের কাঁচানঙ্কার গাচড়ার প্রিতি বুজি দিষ্টি পড়িচে? নিষেধ করে দিচ্ছি বউ, আমার ইদিকে উঁকি ঝুঁকি দিবিনে! তোদের সাতে আমাদের কীসের কী?
হয়তো বা কখনও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, তোর ঘরে আবাব নেগেচে তো আমি কী করব? আজের মতো এই চাল কড়া নে যা, ফুটিয়ে ছানাপোনা গুলানকে দেগে যা। ব্যাস। আর আসবিনে।…ক্যানো, এখোন তো হাঁড়ি ভেন্ন, এখোন আবার আমার কী দায়?
যত পারে গলা তুলে বলে।
অন্য জ্ঞাতিগুষ্ঠিরা বলে, ওই দ্যাকো খাণ্ডারনি চেল্লাতে নেগেছে। আহা কী নেমায়িক! বউটো দুকের জ্বালায় মরতেচে, সোয়ামীডা মার খেয়ে পাট হয়ে হাসপাতালে পড়ে, ছেলেডার নামে হুলিয়ে, তবু সেই কোঁদল কেজিয়া। এ্যাকোন তা ভুজুর বউ খুব নরমে গ্যাচে বাবা। তবু
কথাটা মিথ্যা নয়, এখন টগর বড়ই নেতিয়ে গেছে। নইলে এদের খুড়শাশুড়ি বউতে কলহ কোঁদল পাড়ার একটা বিখ্যাত ব্যাপার ছিল। কিন্তু আজকাল চেঁচানিটা একতরফা। একতরফা বলেই সেই তরফে স্পষ্ট ভাষণটা শোনা যায় বেশি।
.
পাঁচুর কানে গেলেও বেজায় গলায় বলে, অ্যাকনো চালিয়ে যাচ্ছিস মা? ছাড়ান দে না! মন প্রাণ ভাল নাই মানুষটার।
নন্দরানি নির্মমতার অবতার হয়ে বলে, নাই তো নাই, তাতে আমার কী রে নীছাড়া? বলি ওদের সোমসারে অ্যাকোন নিত্যি নেই। তো নিত্যি কে রসদের জোগান দেবে র্যা? রোজদিন মুক শুইকে এসি দাঁড়াবে, বাচ্চা গুনাল খেতি পায় নাই
পাঁচু নির্লিপ্ত ভাবে বলে, তো দিলিই নয় ওদের ভাতের চালডা। বড়দা ঘরে নাই।
দিলিই নয়? অ্যাঁ? রোজ ওদের ভাত জোগাবো আমি?
তা তাতে কি তুই ভিকিরি হোয়ে যাবি?
সঙ্গে সঙ্গে গদাইও বলে ওঠে, তা তাই তো কতা। অ্যাক সোমসারিরই তো লোক! একত্তর থাকলে, খেত না?
অ্যাকোন আবার অ্যাক কীসের? ভেন্ন হবার সময় মনে ছেলনি? আচ্ছা! অ্যাতো য্যাকোন ইয়ে দেচ্চি।
বলে নন্দরানি দুমদাম ভাঁড়ারে ঢুকে জালা কাত করে হড়হড়িয়ে চাল ঢেলে নেয় একটা মেটে কলসির মধ্যে। বলে, এই রইলো। আদ হয় ঘাড়ে করে বয়ে দিয়ে আয়।
এরা দুই ভাই নিজের মনে বলাবলি করে, মেয়েছেলের মন বড় নিচু।
মায়ের উপর তেমন কিছু বলার সাহস নেই, গোরুগুলোকে ছাড়া বাঁধা, আর ঘি মাখনের কাজ ছাড়া সকল কাজ নন্দরানি নিজের ঘাড়ে নিয়ে রেখেছে। খড়কুচনো, জাবনা মাখা, দুধ দোহানো, কাছেপিঠে দুধের জোগান দেওয়া সবই নন্দরানি। তা ছাড়া যত ধানী জমি আছে তার কাজেও তো অর্ধেক ভার নন্দরানি। ফসল শস্য ঝাড়াই বাছাই তোেলা পাড়া, রাখা ঢাকা সব তার মুঠোয়। অতএব-মেয়েছেলের মন বড় নিচু বলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না ছেলেরা। মানবিকতা উদারতা মায়া মমতা-সবই সিন্দুকে পুরে রাখতে হয়।
বাপের ব্যবহারও তো ভাল নয়।
ভুজঙ্গকে কাছারি বাড়িতে আটকে রাখার দরুন এরা দু ভাই বড়দার গোরু কটার দায়িত্ব নিতে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল, কিন্তু বিহঙ্গ হাঁ হাঁ করেছে।…
যে নোক বাবুর কোপে পড়ি বসি আছে, তার সোমর নে মাতা ব্যাতা ক্যারে? মরতি হবে?
তবু বাপের কথায় যুক্তি আছে।
কিন্তু মা?
মন নিচু। মেয়েছেলে বই তো না।
সেদিন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালিয়ে যাওয়া ছেলেটা দিশেহারা হয়ে সেই বাড়িটায় এসে ঢুকে পড়েছিল, যে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোনোয় দু পক্ষের দিব্যি দেওয়া। কিন্তু ছেলেটা তখন এই খাণ্ডারনি নিচু মন মেয়েছেলেটাকেই জড়িয়ে ধরে বলে উঠেছিল, ঠাম্মা গো আমারে লুকিয়ে রা। বাবুদের নোক আমারে মেরে ফ্যালাইতে আসতেছে।
.
মনকে ঠিক করেই এসেছিল চন্দন সান্যাল, দেবীপুর মৌজার জমিদার রুদ্র লাহিড়ীর বাড়িতে অপমান ঘটবেই। ইচ্ছে করেই করবে সেই অপমান, অকারণ অহংকার স্ফীত মদমত্ত লোকটা। অতএব কিছুতেই গায়ে মাখব না। গায়ে না মাখলে, কার সাধ্য অপমান করে?
রুদ্রপ্রসাদ যখন কৌতুকের ভঙ্গিতে ডেকে পাঠালেন, তখন সেই প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়েই এসে ঘরে ঢুকল চন্দন।
রুদ্রপ্রসাদ বললেন, হঠাৎ শুভাগমনের হেতু?
চন্দন বলল, এমনি।
এমনি? এমনি কী হে? কাজের তো একটা হেতু থাকবে? অহেতুক কাজ শুনেছি তারাই করে, যাদের মাথার ঠিক নেই।
চন্দন শান্তভাবে বলল, ধরে নিন তাই।
অ্যাঁ! ধরে নিতে হবে তাই? ও সরকারমশাই এ শালা বলে কি? এ যে বিপদের ব্যাপার!
শালা শব্দটা ব্যবহার করা বেআইনি নয়, কাজেই সরকার মশাইয়ের পক্ষেও প্রতিবাদ চলে না।
সরকারমশাই শান্তভাবে বলেন, বউরানিমার সঙ্গে দেখা করতে এয়েছেন
ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। তখন বললেন বটে তাই। কী যেন আত্মীয়তা আছে তাঁর সঙ্গে, তাই না? তা হলে নিয়ে যান, নিয়ে যান তাঁর কাছে। তবে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাটা মনে রাখবেন। লাহিড়ীবাড়ির ইজ্জত থাকে যেন।…আর শুনুন, অন্দরে আলাপ আলোচনার সময় একজন দাসীকে উপস্থিত রাখতে ভুলবেন না।
বৃদ্ধ সরকার আহত বিস্ময়ে বলে ওঠেন, এটা কী বলছেন রাজাবাবু? উনি বউরানিমার ছোট ভাই, ভুলে যাচ্ছেন নাকি?
অ্যাাঁ কী বললেন? ছোট ভাই? তাই বুঝি? তা ওসব ছোট-মোটো কথা ভুলে যাওয়াটা আশ্চর্য নয়। তবে আপনিও ভুলে যাচ্ছেন সরকারমশাই এটা লাহিড়ী বাড়ির চিরাচরিত প্রথা।
চন্দন সান্যাল নির্লিপ্ত গলায় বলে, ঠিক আছে। তাই রাখবেন সরকারমশাই। এটাই যখন আপনাদের লাহিড়ীবাড়ির ইজ্জত রক্ষার অস্ত্র।
অ্যাঁ! কী বললে?
অন্য কিছু না। বলছি–আপনাদের যেটা প্রথা সেটা রাখতে হবে বইকী!
রুদ্রপ্রসাদ চড়া গলায় বলেন, ছোকরা তো ভারী ডেপো হে সরকারমশাই? অন্দরে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ তো?…জমিদারের প্রজা খ্যাপানোর বদভ্যাস আবার জমিদার গিন্নিকে খেপিয়ে তোলার তাল করবে না তো?
চন্দন বলল, তেমন ভয় থাকলে, অন্দরে প্রবেশের অনুমতি নাই দিলেন। এখান থেকেই বিদায় নিই।
ভয়? ভয় মানে? এই তোমাদের মতো ফকে পলিটিকসবাজদের ভয় করবে রুদ্রপ্রসাদ লাহিড়ী? তা সে করে না, বুঝলে?
না করেন তো উত্তম।..তাহলে সরকারমশাই, চলুন। দেখুন কোথায় আপনার পাহারাদার দাসীটাসী আছে
রুদ্রপ্রসাদের মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে।
এই হতভাগা ছুঁচোটা যেন তাঁকেই প্রতি কথায় পরাজিত করছে! ভাবলেন, এক্ষুনি চেঁচিয়ে হুকুম দিয়ে দিই, থাক! যাওয়া হবে না অন্দরে।…কিন্তু তাতেও ছোট হয়ে যাবার সম্ভাবনা। সম্ভাবনাটা সরমার কাছে। সরমা রুদ্রপ্রসাদের সম্মানার্থে, আগে দেখা করেনি। তাঁর অনুমতি ব্যতীত ছোট ভাইকেও অন্দরে প্রবেশাধিকার দেয়নি।…অতঃপর যদি জানতে পারে রুদ্রপ্রসাদ হুকুম দিয়ে দিয়েছেন, দেখা হবে না। সেটা রুদ্রপ্রসাদের উদার মহৎ উজ্জ্বল ছবির উপর কালির ছিটে হবে যে।
কিন্তু ধনুকে তীর লাগানো হয়েছে, একটা কোথাও ছোঁড়া হোক। সবল কণ্ঠে বললেন, সরকারমশাই, মনে রাখবেন, আধ ঘণ্টার বেশি নয়।
চন্দন অগ্রসর হচ্ছিল, থমকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, আধ ঘণ্টা? এত কী হবে? একবার দেখা করা বই তো নয়। দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। আমারই বা এত সময় কোথা?
রুদ্রপ্রসাদ দাঁতে ঠোঁট কামড়ালেন।
পলিটিকসবাজ ছোঁড়াগুলো এমনিই হয়। মানসম্মানের বালাই নেই। অপমান গায়ে মাখে না। কালই তলে তলে পুলিশে খবর দিতে হবে।
.
সরমা বললেন, আসাটা কি তোর খুব দরকার মনে হয়েছিল চন্দন?
চন্দন দিদির মুখের দিকে তাকাল।
ওর সেই দিদিকে মনে পড়ছে।…যে দিদি কোনও একটা সকালে একটা প্রাচীন মন্দিরের সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চন্দন নামের ছোট্ট একটা ছেলেকে তিরস্কার করছে, এও জানিস না মুখ?..কী জ্যোতির্ময় সেই মুখ। কী উজ্জ্বল সেই চোখ।
তারপর ভাবল, আচ্ছা বোকা তো আমি। ভগ্ন্যুপের মধ্যে আমি জ্যোতি খুঁজতে বসতে চাইছি!
আস্তে বলল, হ্যাঁ খুব দরকার মনে হয়েছিল।
এখনও তাই মনে হচ্ছে?
হচ্ছে।
ভিতরের বাষ্পোচ্ছাসে সরমার মুখটা লাল দেখাচ্ছে। দরজার বাইরে যেননী বসে আছে, সেটা সরমা অনুমান করতে পারছেন।
সরমা ভিতরের বাষ্পেচ্ছাসকে ভিতরে সংহত রেখে বললেন, খুব রোগা হয়ে গেছিস। রোদে রোদে ঘুরিস বেশি তাই না?
তা ঘুরতে হয়।
তোদের ওই ঘোরার দলে মেয়ে আছে?
আছে বইকী! চার পাঁচজন আছে।…
ভদ্রবাড়ির মেয়ে?
চন্দন একটু হেসে ওঠে, তবে কি ইতর বাড়ির?
সরমাও সামান্য হাসির মতো করে বলেন, তাও তো বটে! ইতর বাড়ির কাউকে নেওয়া চলে না রে?
চন্দন শান্তগলায় বলে, আমাদের দল হচ্ছে মানুষের দল। সত্যকে স্বীকার করবার সাহস আছে যাদের, তাদের দল। বাড়ির প্রশ্ন ওঠে না।
তাই বলছিস? তা হলে ভরসা রইল।
চন্দন স্থির গলায় বলল, তেমন কেউ সন্ধানে আছে কিনা তোর?
মনে হচ্ছে। একটু খুঁজে দেখতে হবে।…শরবত খাবি?
পাগল। মেঠোঘেটো লোকেদের অত শৌখিন মাল পেটে সহ্য হয় না।…তোদের এ ঘরে অনেক বই আছে দেখছি।
সরমা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসেই বলে, পাষাণঘেরা প্রাসাদ মাঝে আছেন ভাগ্যমন্ত, মেহগিনির মঞ্চ জুড়ি পঞ্চ হাজার গ্রন্থ।
চাবি বোধহয় খাজাঞ্চিখানায়?
আশ্চর্য! সরমা সত্যিই হাসছেন।
দীপ্তিপ্রসাদ নেই, এটা কি হঠাৎ ভুলে গেলেন এই এক স্নেহ আধার দেখে? তাই হেসে বললেন, নাঃ। অতটা অবিচার করিস না। আমার আঁচলেই আছে। তবে পূর্বতন কর্তার আমল থেকে
তবু ভাল।…অন্ধকূপ হত্যার গহ্বরে একটা ঘুলঘুলি।
দীপ্তিপ্রসাদের কথা কেউ তুলছে না। বরং সাবধানে এড়িয়ে যাচ্ছে। চন্দন বলতে যাচ্ছিল, যে কবারই এসেছি, তোদের এই হলটা দেখিনি! বলল না।
বললেই হয়তো আসার কারণের হিসেব বেরিয়ে পড়বে।…সেই বিয়ের সময় আসার পর, প্রথম এসেছিল শক্তিপ্রসাদের শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে, বাপের প্রতিনিধি হয়ে। অতঃপর দীপ্তিপ্রসাদের অন্নপ্রাশনে আর উপনয়নে।…হ্যাঁ সেটা হয়েছিল বইকী! ছেলে নবম বছরে পদার্পণ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই উপনয়ন দেওয়া লাহিড়ীবাড়ির কুলপ্রথা।…তো থাকেনি চন্দন সে সময়। বাপমায়ের নির্দেশে একটা দামি হাতঘড়ি নিয়ে এসেছিল, সেইটা দিয়েই পালিয়েছিল।
সন্তর্পণে কথা।
মা বাবা কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলি না যে?
কী হবে জিজ্ঞেস করে? যদি শুনি, অসুখ, দেখতে যেতে পারব?
চিঠিপত্র সেনসার হয় বোধহয়?
জানি না। যদি হয়, ভেবে ও পথে পা বাড়াই না।
এটা বলতে হবে মাকে। সে ভদ্রমহিলার ধারণা অন্য।
চন্দন, তুই খুব কাজের লোক হয়ে গেছিস না?
বাজে কাজেরও বলতে পারিস! আচ্ছা–তোদের এইসব ঘরে সবসময় ঝাড়লণ্ঠন জ্বলে?
জ্বলে বোধহয়। ঠিক জানি না।
ছেলেবেলায় পড়ার বইয়ের একটা পদ্য মনে পড়ছে।
পদ্য?
হু। যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার হেরিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি।
সরমা হাসলেন, এত সর্দার হয়েছিস, নেতা হয়েছিস, এখনও ছেলেমানুষিটা আছে।
এত সব হয়েছি, কে বলল তোকে?
বলতে হয় না। এমনিই জানা যায়। আচ্ছা চন্দন, যদি কোনওদিন কোনও কাজে ডাকি, আসবি?
কানে পৌঁছতে পারলে অবশ্যই।
কত সময় ভেবেছি। কিন্তু ভয় হয়। এখানে তোর মান সম্মান রাখার দায়িত্ব কি নিতে পারব?
আমার মান সম্মান? তার দায়িত্ব তুই নিতে যাবি কোন দুঃখে? আমার নিজের নেই ওটুকু দায়িত্ব?..আচ্ছা ডেকে দেখিস। এখন উঠলাম। দশ মিনিট হয়ে গেছে।
দশ মিনিট!…ওঃ। মিনিট মাপা সময় মঞ্জুর হয়েছিল বুঝি?
মিথ্যে অপবাদ দেব না। আধঘণ্টা সময় মঞ্জুর হয়েছিল। কিছুটা ত্যাগ করবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছি। আচ্ছা!…
চন্দন!
কী রে?
আমায় তোর সঙ্গে নিয়ে যেতে পারিস?
তুই যেতে পারলে, অক্লেশে। এই পাষাণ প্রাসাদের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবি?
সরমা একটা নিশ্বাস ফেললেন, মুক্তির একটা দরজা তো খুলে গেছে।…আচ্ছা তোকে আর আটকাব না। যা।
যা বললি যে বড়? মনে নেই মা কী বলতেন?
নরক থেকে যা বলতে দোষ নেই।
.
চলে গেলেন?
রুদ্র লাহিড়ী ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, জল গ্রহণ করে গেলেন না লাহিড়ীবাড়ির?..আপনি একটি অপদার্থ সরকারমশাই।
সরকারমশাই ঠাণ্ডা গলায় বললেন, সেটা বুঝতে পারছি। তাই কাজ থেকে ছুটি চাইছি রাজাবাবু। কাল থেকে আমার বিশ্রাম মঞ্জুর করুন।
রুদ্র লাহিড়ী এর জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না।
চোখ কুঁচকে বলেন, তার মানে?
মানে, অনেকদিন তো খাটলাম। এবার রেহাই চাইছি।
রেহাই। ওঃ! উত্তম কথা। অনায়াসে পেতে পারেন। আপনার পাওনাগণ্ডা যা আছে বুঝে নিয়ে যাবেন।
সরকারমশাই একটু দাঁড়ালেন।
ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেছে, আর তিনি রুদ্রপ্রসাদের কর্মচারী নন। বলতে পারা যায় পিতৃবন্ধু।…সেটা ভুল নয়, শক্তিপ্রসাদ সে সম্মান দিতেন এঁকে। ছেলেকে তার ছেলেবেলায় সরকার জ্যাঠা বলে ডাকতে শেখাবার চেষ্টা করেছিলেন। বৃদ্ধ এখন সেই অতীতের মাটিতে দাঁড়ালেন।
বললেন, আমার পাওনা আমি পেয়ে গেছি খোকাবাবু! আর আমার
দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
রুদ্রপ্রসাদের জন্মক্ষণটা মনে পড়ল সরকারের।
শক্তিপ্ৰসাদ ঢালাও হুকুম দিয়ে দিলেন, গ্রামে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিন সরকারমশাই, আজ থেকে সাতদিন প্রজাদের কারও ঘরে উনুন জ্বলবে না হাঁড়ি চড়বে না। এখানে সবাইয়ের বন্দোবস্ত হবে।
সরকারমশাই। সরকারমশাই। এ ছাড়া কথা ছিল না।
অতিষ্ঠ হয়ে ছেড়ে যেতে চাইছিলেন, এখন ছেড়ে চলে যাবার সময় সমস্ত শিরায় স্নায়ুতে মোড় দিয়ে উঠছে, বুকের মধ্যে ভয়ানক একটা যন্ত্রণা হচ্ছে, কোথায় কোনখানে যেন কীসব ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে।…
.
তবে আর বলচি কী গো পিসিমা?
ননীদাসী গলা খাটো করে বলে, ছেলের কতার নামগন্ধো মাত্তর নাই। ভাইবোনে হাসি গপপো ঠাট্টা মস্করা।
নীরদা গালে হাত দেন, বলছিস কি ননী? হাসি গপপো ঠাট্টা মস্করা?
ননী কি আর বাইনে বলতেছে গো পিসিমা? আবার শোনো–এতবড় একখান মান্যিমান দিদিকে ছোটলোকের মতন তুই মুই করে কতা। সেসব কতার ভঙ্গিমেই বা কী!
আর বলিসনে ননী! শুনে মাতা জ্বলে উটচে। বলি রুদ্র জানে এসব বিত্তান্ত?
জানে।
না বললে নয় এইভাবে বলে ননী, অ্যাকবার নাকি রাজাবাবুর ঘরে গেলো। তা পায়ে হাত দে পেন্নাম করেই না কি, হাত তুলে সেলাম ঠুকেছে। রাজাবাবু এগে আগুন হয়ে আছে।
নীরদা বেজার গলায় বলেন, তবু তো পরিবারের উপর ধমক টমক দেকিনে। মহারানি তো নিজের তালে আচেন। অঙ্খরে মাটিতে পা পড়ে না। অ্যাতোবড় অ্যাকটা শোক হল, ডোকরা ডুকরি কান্নার পাট নেই। যেন পুরুষছেলে। কাট হয়ে বেসে আচেন, নোকে যে একটু সান্ত্বনা দিতে যাবে, কি গায়ে মাতায় হাত বুলোবে তার জো নেই। তাই কয় না। অথচো অ্যাকোন ভেয়ের সঙ্গে হাসি গপপো–
এমন চটকদার প্রসঙ্গে মানদা নেই, এ কি হয়? নীরদা ডাক দেন, মেজদি শুনেছো কতা?
মেজদি এসে দাঁড়ান, তোদের এখেনে আর কী কতা শুনবো? ওদিকে যা ব্যাপার!
সেটা আবার কী?
ভূজুর সেই খুড়োটা? বেহঙ্গ না কী যেন নাম? সে নাকি গোবিন্দ ছোঁড়ার খবর এনেছে। না কি মাসির বাড়ি পালিয়ে বসে আচে সেখেনে নাকি লোক ছুটছে।
কে বলল? কে বলল?
বড়লোকের বাড়িতে ধরে ধরে কাউকে কিছু বলতে হয় না। সকল খবর বাতাসে রটে।…এই যে সরকারমশাই বিদায় নিলেন, কাউকে কি ডেকে হেঁকে বলতে হল? সবাই জানলা রাজাবাবুর মুখের উপর চোপা করার ফলে চাকরি গেছে সরকারমশাইয়ের।
.
যেখানে যেমন ঘটনা ঘটুক, চন্দ্র সূর্য নিজের নিয়মে উদয় হয়, অস্ত যায়।..ফুল ফল গাছ পাতা তৃণগুল্ম, সবাই বিনা পঞ্জিকা, বিনা ক্যালেন্ডার নির্ভুল নিয়মে হাজিরা দিতে আসে। আর সময় শেষ হলে ফাইলটি গুটিয়ে বাড়ি ফেরে।
পাখি পক্ষী সাপ ব্যাঙ মাছ বাঘ পিঁপড়েটি পর্যন্ত এই এক নির্ভুল নিয়মের অধীন। শুধু মানুষই ব্যতিক্রম। সে আত্মকেন্দ্রিক। প্রকৃতির ওই অমোঘ ছন্দে নিজেকে বেঁধে নিয়ে অবধারিত পথে চলতে পারে না সে। প্রকৃতির সপত্নী সন্তান সে। তাই সর্বদাই দুপক্ষে লড়ালড়ি।
তবু কিছু কিছু নিয়মে মানুষ নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। ঋতুচক্রের আবর্তনে যা আবর্তিত হয়ে চলেছে। মানুষেরই খেয়ালে তৈরি তারা তাই-অজন্মা, অনাবৃষ্টি খরা বন্যা ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ সব কিছুর মধ্যেও পালা পার্বণগুলো ঠিক ঠিক সময় এসে পড়ে আপন খাজনা আদায় করে নিয়ে যায়।
এই তো দুমাস আগে চড়ক পুজোর বাদ্যি বেজেছে। গ্রামসুষ্ঠু লোক শিবের নাচনের সঙ্গে নেচেছে, খরা বলে কি বাদ দিয়েছে? আর না কি চাষিরা ঘরে ভাত নেই বলে বোশেখী সংক্ৰিন্তিতে ভেঁকিপুজোর মেলা বসায়নি?
চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ সংক্রান্তি পর্যন্ত পুরো একটি মাস ঢেঁকির গড়কে গড় করে কাজে বেরিয়েছে চাষিরা। আর কর্ম অন্তে সেই গড়ের সামনে সাষ্টাঙ্গে পড়ে ভক্তি দিয়ে তবে ঘরে ঢুকেছে। অতঃপর তিনদিনব্যাপী মেলা।
পরবর্তী অনুষ্ঠান জ্যৈষ্ঠ-পূর্ণিমায় রাম-সীতার বে।
কিন্তু গ্রাম এখন একটু দ্বিধাগস্ত।
রাজাবাবুর এই মনোকষ্ট, এবারে কি আর রামসীতার বে-তে ঘটাপটা হবে?
এই আলোচনা চলছিল কদিন ধরে, অবশেষে মন্দিরের সেবাইতের কাছে গিয়ে পড়া। সেবাইত গম্ভীর গলায় বলেন, বন্ধ দেওয়া তো চলবে না। ঠাকুর দেবতার কাজ। তো নমো নমো করে সারতে হবে। বাজনা বাদ্যি কমাতে হবে।
কিন্তু সময় সময় শোনা গেল রাজাবাবু আদেশ দিয়েছেন, যথারীতি যা হয় তোক কমতি কিছু হবে না। জমিদার বাড়ি থেকে যেমন অধিবাসের তত্ত্ব যায় যাবে, যেমন বিয়ের ভোজের সিধে যায় যাবে।
অতএব আর কী?
উঠে পড়, বেরিয়ে পড়।
এ বিবাহের কন্যা কর্তা স্বয়ং মন্দিরের সেবাইত। বরকতা কোনও নির্বাচিত দশরথ। এই দশরথটি প্রতি বছরই নির্বাচন করা হয় গ্রামের মোড়লবাড়ি থেকে। ব্রাহ্মণ হবার প্রয়োজন নেই, রামচন্দ্র তো ক্ষত্রিয় ছিলেন।
এই দশরথের পোস্টটি পাওয়ার জন্যে গ্রামের মোড়লরা লালায়িত থাকেন। যার ভাগ্যে যেবার জোটে, সে সেই বছরের গ্রাম প্রধান হয়। অন্য লাভও আছে। রাজবাড়ি থেকে আসা অধিবাসের বড় তত্ত্বটি সেবাইতের প্রাপ্য হলেও গ্রামসুন্ধু দর্শনার্থী কনের মুখ দেখানি যা ভেট দেয়, তার থেকে সিংহভাগটি যায় দশরথের বাড়ি।
তা কম কিছু হয় না।
সাধারণ গৃহস্থ লোকেরা দেয় টাকাটা সিকেটা, সম্পন্ন গৃহস্থেরা দেয় কলের শাড়ি সিঁদুর কৌটো নথ নোয়া, আলতা মাথাঘষা আয়না চিরুনি যে যা পারে। আর নেহাত চাষিরা আনে তাদের খেতের ফসল, বাগানের ফল। গতবার নবীন পোদ্দার তার বাগানের যা একখানা কুমড়ো দিয়েছিল তার গল্প এখনও চলে। গত বছরের দশরথ সেই সমগ্ৰ কুমড়োটারই মালিক হয়েছিল। সেবাইত স্বেচ্ছায় তার স্বত্ব ত্যাগ করেছিলেন। আর গতবারে খোকারাজার উপনয়ন উপলক্ষে রাজাবাবু রামচন্দ্রের জন্যে রুপোর হরধনু বানিয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া সীতার চেলি বেনারসী শাঁখা লোহা কণ্ঠমালা, এসব তো আছেই।
এবারের সম্ভাবিত দশরথ মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বেড়াচ্ছিল কী জানি এবার কী হয়। হয় কি না হয়। দেখা যাচ্ছিল রাজকুমারের বিয়োগব্যথাকে ছাপিয়ে দুঃখ উথলে উঠেছিল সকলের। উৎসব হবে না ভেবে।
হবে জেনে আনন্দের জোয়ার এল।
তলিয়ে গেল সেই লালন করা দুঃখটি।
অতএব সাজ সাজ রব।
যে দুটো লোককে গোবিন্দর খোঁজে ধূপগুড়ি যেতে হল, তারা জিজ্ঞেস করে গেছে, বাবুমশাই, রামসীতার বের আগেই ফেরা হবে তো?
দুটোর মধ্যে একটা হচ্ছে বোঁচা। বাবুমশাইয়ের সঙ্গে কথা কওয়ার অভ্যাস তার আছে একটু একটু।
রুদ্রপ্রসাদ গম্ভীর গলায় বললেন, সেটা–তোমাদের ক্ষমতার উপর নির্ভর করছে।…যা বলে দিয়েছি সেইভাবে বলবে। কাজ সমাধা করতে পারো কালই চলে আসবে।
বলতে বলা হয়েছে, তোর বাপ মরো মরো, শেষ দেখা করতে চাস তো চল।
কথাটা মিথ্যা বলাও হবে না।
গতকালই রুদ্রপ্রসাদ বলেছেন, ব্ৰজেন, লোকটা যদি মরে জমিদারের হাত এড়িয়ে যায়, তাহলে তোমার ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হবে, কি হবে না?
ব্ৰজেন মাথা নিচু করে বলে, আজ্ঞে হবে।
ধূপগুড়ির আশায় রুদ্রপ্রসাদ কিছুটা ঠাণ্ডা। তাই কথার মধ্যে জ্বলন্ত আগুনের ভাব কম।
তোমার মেয়াদ আর কদিন?
আজ্ঞে যা বলেন।
যা বলি মানে? কদিন সময় নিয়েছিলে?
আজ্ঞে সামনের বুধবার অবদি।
ব্যস। বৃহস্পতির সকালে তোমার বাড়ি জ্বলছে
আজ্ঞে যা হুকুম। তবে লক্ষ্মী বারটা! বাড়িতে ঘট বসিয়ে পুজো করে।
সেই ঘটসুদ্ধুই জ্বলবে।
আজ্ঞে, তাই হবে তা হলে।
উজবুকের মত আজ্ঞে আজ্ঞে কোরো না। সামনে থেকে দূর হও।
ব্ৰজেন হাত কচলে বলে, রামসীতার বে-তে একটা মানুতি পুজো ছিল।
বাড়ির ভস্মের উপর বসে পুজো কোরো।
আজ্ঞে তাই হবে।
দূর হবে তুমি?
আজ্ঞে নিশ্চয়।
ব্ৰজেন দূর হয়ে বাঁচে। এবং কাছারিবাড়ি পৌঁছেই যাকে সামনে পায় খিচোয়। এই মাৎস্যন্যায়েই জগৎ সমাজ নিয়ন্ত্রিত।
.
আছে সুখ দুঃখ সমস্যা প্রতিহিংসা চরিতার্থর তীব্র আক্রোশ, মাথার উপর ঝুলন্ত খাঁড়া, তবু দেবীপুরে উৎসবের মেজাজ।…যার যা সামর্থ্য ভেট গোছাচ্ছে; ঘরে ঘরে এখন ওই আলোচনা।
হবে কি হবে না করে হচ্ছে, তাই উৎসাহ বেশি।
এ উৎসবের ঝংকারধ্বনি অন্তরীণ গোবিন্দর কানেও পৌঁছয় বইকী! তাক বুঝে একবার সকালে খাবার সময় নন্দরানির কাছে কেঁদে পড়ল, ঠাকমা আমি রামসীতার বের ঘটা দেখতে পাব না?
নন্দরানি আরও কাঁদো কাঁদো হয়, কেমন করে দেকবে মানিক, পতে বেনোনেই যে বাঘ-ভালুকের ভয়।
তুই তো বলিস ঠাকমা, আমার চ্যায়ারা খারাপ হয়ে গ্যাচে, আমায় আর চেনা যায় না।
বলি তো। কিন্তুক যমের প্যায়দা ঠিক চিনবে ভাই।
আতের আঁদারে গা ঢেকে নে চল না ঠাকমা, ভিড়ের মদ্যি কেউ বুজতে নারবে।
নন্দরানির মন টলে।
নন্দরানি একটু হেসে বলে, তবে তুই মেয়েছেলে সাজ। ঘোমটা দে, কনে সাজিয়ে নে যাই।
ঘোমটার মদ্যি থেকে দেকতে পাবো?
যা পাবি? বউগুলান যেমন দ্যাকে।…কে কে বেড়ার ঘোরে হুড়কো খুলল?
ছুটে এগিয়ে গেল নন্দরানি।
গোবিন্দও মুহূর্তে হাওয়া। সেই তার রাত্রির আস্তানায়। কিন্তু হাওয়া করতে পারল না পাথরের খোরাখানা আধ খাওয়া ফলার মাখা সমেত।
পাঁচু এসেছিল জোগানের ঘি নিতে।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এটা কী?
নন্দরানি উদাসগলায় বলল, দেকতেই তো পাচ্ছিস।
তা তো পাচ্ছি। বলি সাত-সকালে ফলার নে বসেছেলো কে!
নন্দরানি গম্ভীর হয়, আমি।
মিচে কতা বোলতে হবে না। বলি বেপার কী?
কিচু না। একটা দুক্কী মানুষ খেতে ছেলো, তোর সাড়া পেয়ে ছুট মারলো।
সেও তো দেকতেছি। কিন্তু মানুষ কে তাই শুদোই।
নন্দরানি বলে, শুনে তোর কী সগগো লাভ হবে?
পাঁচু রেগে উঠে বলে, ন্যাকরা করিসনে মা, পষ্ট কতা ক।
পষ্ট!
নন্দানি হঠাৎ শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। ঘেন্নার গলায় বলে, যে মানুষকে ধরি দিলি তোর বাপ অ্যাক ছালা টাকা পাবে।
অ্যাঁ।
নন্দরানি পাথরখানা সরিয়ে নিতে নিতে বলে, তা এবার বাপ ব্যাটায় মিলে ধইরে দে বকশিশ নে গা যা।
পাঁচু একটু গুম হয়ে থেকে বলে, সে কতা হচ্ছে না। বাবা অর্থো পিচেশ। কিন্তুক হঠাৎ ও এলো কোথা থেকে?
আসবে আবার কোথাথেকে? তদবধি এইখেনেই রইচে।
বিস্তারিতের সময় নেই। সংক্ষেপিত ভাষণে ছেলেকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে দেয় নন্দরানি। বলে অ্যাকোন বলল মাকে ধরে মারবে না কাটবে।
পাঁচু চিন্তার গলায় বলে, সে কতা নয়, তবে কাজ খুবই দুঃসাহসী হয়েছে। বাবার চোখে পড়লে কি আর রক্ষে থাকবে?
তা বলে বংশের ঝাড়, জ্ঞেয়াতির পুত, বেপদে এসে ঠাকমা বলে পড়লো, তারে বাগের মুকে ধরি দেবো?
তাতো বলি নাই। বেপদের কতা বলচি। ইদিকে তারে খুঁজতি নাকি কোতায় কোতায় লোক গ্যাচে।
গ্যাচেতো।
এরপর?
বোজো তুমি। আর বুদ্ধিতে যা বুজিচি, অ্যাকোন তোমার বুদ্ধিতে যা বলে।
পাঁচু বলে, ওর মা জানে?
জানবে নাই? রোজদিন ছল ছলনা করে খোঁজ নে যাই।
তবে ওর মায়ের কাঁচেই ধরি দিগে যা। যা হয় হবে।
আমি অমন অধর্ম করতে পারবুনি।
আচ্ছা ঝামেলায় ফেললি বটে। তবে আর দু দিন যেমন রেকেচিস রাক। দেকি রামসীতের বের রাতে গোলেমালে যদি কিছু বেবস্তা হয়।
নন্দরানি আস্তে বলে, ছেলেমানুষের ছেলে বুদ্ধি। বলতে ছেলে, ঘোমটা টানা বে। সেজে একবার বেটা দেকতে যাবে।
সর্বোনাশ! বলিস কী!
আহা মেয়েছেলের বেশ ধরলি চিনবে কে? মুক ঢাকা থাকবে। সবাই মত্ত।
.
তা নন্দরানির হিসেব ভুল নয়।
উৎসব সন্ধ্যায় সবাই মত্ত।
গ্রাম ঝেটিয়ে সবাই গেছে রামসীতাতলায়। সেখানে সানাই, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি। সবাইয়ের হাতে হাতে ভেট। কে কার দিকে তাকায়!
নেহাত অভাগা ব্যতীত এ সন্ধায় কেউ ঘরে পড়ে নেই। বাড়িতে রান্নারও হাঙ্গামা নেই, ঢালাও ভোজ বিয়েবাড়িতে।
রাজবাড়িও প্রায় শূন্য। পুরনারীকুল সবাই বে দেখতে। দাসীকুল সমভিব্যাহারে অবশ্য। অন্দরে একা আছেন সরমা। বহির্বাটিতে রুদ্রপ্রসাদ আর যাদব। যাদবকে ছুটি দিতে চেয়েছিলেন রুদ্রপ্রসাদ। বলেছিলেন রুদ্র লাহিড়ীকে আগলাতে থাকবে একটা নেংটি ইঁদুর? যা যা। বন্দুকটি হাতের কাছে রেখে যা।
কিন্তু যাদব মিছে করে বলেছে তার পায়ে ব্যথা হাঁটতে পারবে না। এই একটা ত্যাগ স্বীকারের বদলে, ভবিষ্যৎটা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে ফেলল ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চায় যাদব।
অন্দরেও বসুমতী থাকতে চেয়েছিল, সরমাই হাত নেড়েছেন।
দূরে থেকে মন্দিরের বাজনা ভেসে আসছে।
এই বাজনায় খোকনকে ঘরে আটকে রাখা যেত না। সে ওইখানে যাবে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরবে। ভিড়ে ভিড়াকারের মধ্যে জনতাকে তছনছ করে দুদিকে ছপটি মারতে মারতে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে যাবে, এই তার শখ।
মাথায় পাগড়ি, শম্মা চুমকির কাজকরা মখমলের পোশাক, রাজার মতো ভঙ্গি। রুদ্রপ্রসাদ আদর করে বলছেন, বাদশা। আশ্চর্য, সেই সাজে একটা ফটো তো কই তুলে রাখা হয়নি তার। সরমাই কি বলেছিলেন?…সরমা সে উদ্ধত দুর্বিনীত শিশুর সমস্ত শিশুসুলভ কাজগুলোর মধ্যে এক ভয়াবহ সর্বনাশা ছবি দেখতে পেয়েছেন বারবার। তাই সেই সুন্দর সুঠাম শিশু বাদশার ছবিটা তুলে রাখার কথা চিন্তা করেননি কখনও।
এখন সরমা কল্পমা করতে চেষ্টা করেন, সেই সাজে উৎসব প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছে দীপ্তিপ্রসাদ। ছপটি মারতে মারতে ঘোড়া চালিয়ে চলেছে ভীত সহিসটা, আগে থেকে সাবধান করতে জোরে জোরে হাঁক পাড়ছে, সামাল সামাল সামনেওয়ালা ভাগো।
ভয়ানক অস্থিরতা অনুভব করলেন।
ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। হঠাৎ চোখে পড়ল চকমিলোনো দালাল কোঠায় মধ্যবর্তী পাথর পাতা বিরাট উঠোনটার একধারে দুটো ছায়া ছায়া মানুষ। যেখানটায় সরমার এজলাসে দুঃখী মানুষরা এসে জটলা করত। কারা ওরা? এখনও? সেই সরমা কি আছেন এখনও? কিন্তু আজ এই উৎসবের দিনে কেন? আজ তো সুখী দুঃখী সবাই সেই আলোকোজ্জ্বল বিবাহ প্রাঙ্গণে।
বলে উঠলেন, কে?
ভীত একটা কণ্ঠ, আমি আনী মা।
আমি…মানুষ ভাবে আমি বললেই যেন সব বলা হয়ে গেল। আমি বললেই বুঝে ফেলা যাবে কী তার পরিচয়।
রেলিঙে একটু ঝুঁকে বললেন, কী চাও?
আপনাকে দুটো কতা বোলবো রে মা।
সরমা আস্তে বলেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসো।
.
সরমা অবাক হয়ে অস্ফুটে বললেন, তুমি? কোনদিক দিয়ে ঢুকলে?
দীনহীন দুঃখী চেহারার মেয়েটা এদিক ওদিক তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, এই আন্নাবাড়ির পেছন বাগান দে।
খুব তো সাহস তোমার। তা কী দরকার? সঙ্গে ও কে?
বলে ওর পিছনে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা আবক্ষ ঘোমটাটানা লাল ডুরে পরা এতোটুকু একটা বউয়ের দিকে তাকালেন সরমা।
ভুজঙ্গর বউ টগর কাতর গলায় বলল, ওই ওর কতাই কইতে আসা। ওরে তোমার চরণে ফেলে দিতে এইচি মা। গত্তর ইঁদুর ছুঁচোর মতন জেবন কাটাতে পারতেচেনা আর ছেলে। এই আপনার দুয়োরে ফেলে দে যাচ্ছি! মার্তে হয় মায়েরা কাটতে হয় কাটো। আকতে হয় আকো।
সরমা বিমূঢ় ভাবে বলেন, ছেলেটা। কোন ছেলেটা?
এই যে! টগর খুদে বউটার ঘোমটটা তুলে ধরে দেখায়।…
সরমার কণ্ঠ থেকে অস্ফুটে স্খলিত হয়ে পড়ে একটা শব্দ।…এ কী!
আশ্রয় নিতে এসেছে ফাঁসির মঞ্চে? লুকিয়ে থাকতে এসেছে বধ্যভূমিতে? সরমা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন।
টগর অতি সংক্ষেপে পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিয়ে বলে, আজকের এই গোলেমালে লোকের চোকে ধুলো দেওয়া সয়োজ তাই এই বউ সাইজে বের করা গো মা। আমসীতের বে দেকবো বলে পেরাণ যাচ্ছিল। সেখেনে থে ঘুইরে নে চলি এনু। আজ এখানে কেউ কোত্তাও নাই। এই সুবিদে। আপনি লোককে বোলবে। অ্যাকটা দুকী মেয়ে, শোউর বাড়িতে ওৎপীড়ন তাই পেইলে এসে তোমার কাঁচে আশ্রয় নেচে। তোমার সাবা যত্নে কোরবে, পা টেপবে, দু মুটো খাবে। পাশপাশের তলায় পড়ে থাকবে।
সরমা হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন।
কী অবোধ আশা!
বললেন, প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টায় আগুনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে যেতে এসেছ গয়লাবউ? এই বৃহৎ সংসারে ওর আসল পরিচয় কদিন চাপা থাকবে?
আপনার সোয়োলে একে দিও না। কে ধরতি আসবি? আপনি বোলবে, আমার পা টেপুনি দাসী।…ওর বাপতো কাঁচারিবাড়ি মার খেয়ে হাসপাতালে পোড়ে। বাঁচে কি মরে। ছেলেডারে ওকে করমা! রক্ষে।
সরমা স্থির গলায় বলেন, পাগল হয়েছে গয়লাবউ? এ হয় না। এইবেলা কেউ এসে পড়ার আগে পালাও।
টগর ভেঙে পড়ে বলে, কোতায় পালাবো মা? বলুন তো চাদ্দিকে শত্রুর। খুড়শাউরিরার দয়ার পেরাণ, তাই অ্যাতোদিন বেচেছি। আপনি আপনার সোয়োলে এমনিতর মেয়েছেলে সাইজে নুইকে আকো।
সরমা কি এই অবোধ আশাকে প্রশ্রয় দেবেন?
একটু কঠিন গলাতেই বলেন, লুকিয়ে রাখো বললেই কি রাখা যায় গয়লাবউ? এ বাড়ির লোকজন দাসদাসীদের চেনো না? আর তোমাদের রাজাবাবুর ঘোষণাও শোনোনি তা নয়। জানো তো ওকে খুঁজে দিতে পারলে অনেক টাকা বকশিশ।
বধূবেশী গোবিন্দ হঠাৎ দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে সিঁড়ির ধাপেই বসে পড়ে চাপা গলায় ডুকরে কেঁদে ওঠে। আর টগর সরমার পায়ের উপর হুমড়ে পড়ে মরিয়া গলায় বলে, তবে তুমি প্রেকাশ করিই দিও মা। রাজাবাবুকে জোর তলবে বোলে দিও, আমিও তো এ আজ্যের আনী। আমার কিচু অধিকার নাই? আমি এরে আশ্রয় দেচি, ভর্সা দেচি, তুমি এরে মার্তি পিরবেনি।
কথা শেষ করেই তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে হনহনিয়ে চলে যায় টগর, সরমাকে বাকশক্তিহীন করে রেখে দিয়ে!
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন সরমা। অথচ মাথার মধ্যে কে যেন ধাই ধাই করে হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে। সেই আঘাতে দেহের সমস্ত স্মায়ুশিরা ঝনঝনিয়ে বেজে উঠছে।
.
কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন সরমা।
কখন যেন এক সময় নীচের তলায় কার কার গলার স্বর ঝংকৃত হল। উৎসব ক্ষেত্র থেকে ফিরেছে কেউ কেউ।
তাকিয়ে দেখলেন, লাল ডুরে শাড়ি পরা গুঁজে বসে থাকা প্রাণীটা সেই একই ভাবে বসে আছে। একই ভাবে তার পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে।
সরমা কি ওকে তাড়িয়ে দেবেন?
বলবেন, তোর মার মুক্ষুমির দায় আমি পোহাতে যাব কেন? ভুল বলেছে সে। আমি এ রাজ্যের কেউ নেই। আমার কোনও অধিকার নেই। আমার সাধ্য নেই তোকে বাঁচাবার!…
..কল্পনা করলেন নীচের তলার দৃশ্যটার মাঝখান দিয়ে বিতাড়িত গোবিন্দ সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে যাচ্ছে।…
…ছেলেবেলায় দেখা কলকাতার চিড়িয়াখানার একটা দৃশ্য মনে পড়ল।…বাঘের খাঁচার মধ্যে মাংস ছুঁড়ে দিচ্ছে তার পরিচালক। ভয়াবহ সেই ছবিটা এখন মনে এল কেন সরমার?
শুকনো কঠিন গলায় বললেন, এদিকে উঠে আয়।
.
বরাবর ভঙ্গিটা ছিল স্বচ্ছন্দচারী সিংহের মতো।
কেশর ফোলানো দৃপ্তমূর্তি। মানুষের দিকে হৃদয়হীন অবজ্ঞার দৃষ্টি। যেন যে কোনও মুহূর্তে অকারণে আর অনায়াস অবহেলায় তাকে থাবার তলায় পিষে শেষ করে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে।…সে ভঙ্গিটা বদলেছে। এখন প্রায়শই খাঁচায় পোরা বাঘের মতো দেখতে লাগে। যেন একটা তীব্র আক্রোশের বন্দি মূর্তি। যেন যে কোনও মুহূর্তে কারও উপর হিংস্র থাবা বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।
আজ সন্ধ্যায়ও সেই মূর্তিতেই বার মহলের চত্বরে পায়চারি করছিলেন রুদ্রপ্রসাদ। আজকের জ্বালাটা একটা বাড়তি অগ্নিদাহের বাহক। এ কথা ঠিক, নিজেই তিনি ঢালাও হুকুম দিয়েছিলেন মন্দিরে রামসীতার বিবাহ অনুষ্ঠান বরাবর যেমন হয় তোক। গ্রামব্যাপী উৎসবের চেহারাও বরাবরের মতোই অবিকল থাক।
রুদ্রপ্রসাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই কারও। দেবীপুর মৌজার চিরছন্দে ব্যাঘাত না ঘাটে।…তবু অহংকারী এই উক্তির অন্তরালে কোথাও ছিল অন্য প্রত্যাশা।..তাই গোধূলিবেলা থেকেই যেই সানাই উঠল বেজে, আর চিরপরিচিত গ্রাম্য বাজনাবাদ্যিগুলোর আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল উন্মুক্ত প্রকৃতির শূন্যতা ভেদ করে, তখন রুদ্রপ্রসাদের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণেই রুদ্রের বীণা ঝংকৃত হতে থাকল। আওয়াজের উন্মত্ততা যতই প্রবল হয়ে উঠছে, ততই প্রবল হয়ে উঠছে একটা দুর্বল ইচ্ছা। সে ইচ্ছা একটা পাগলা হাতির পায়ের শিকল খুলে দিয়ে ওই উৎসব প্রাঙ্গণে ছেড়ে দেওয়া।
তছনছ হয়ে যাক সব।
পিষে যাক সব।
এমন একখানা দৃশ্য রুদ্রপ্রসাদ চোখে দেখেননি বটে, তবে গল্প শুনেছেন। নীলকুঠির সাহেবরা নাকি এইভাবে চাষিদের প্রাণপাত করা প্রাণতুল্য পাকা ফসলের খেতের উপর হাতি ছেড়ে দিয়েছে, চাষি নীলের বদলে ধান চাষ করলে।…সেই অত্যাচারের দৃশ্যটা কল্পনায় ছবি হয়ে কোথায় চাপা ছিল, সেই ছবিটা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠছে।
লাহিড়ীবাবুদের একটা হাতি আছে বটে, কাছারিবাড়ি সংলগ্ন জমিতে তার বাসস্থান হাতিখানাও আছে। কিন্তু সেটা তো একটা জরাগ্রস্ত বুড়ো হাতি। তাকে দিয়ে কি এই দুর্দমনীয় ইচ্ছাটার পূরণ সম্ভব?..অপচয়ের নমুনা হিসাবে বসে থাকে সে শেকলবাঁধা পা চারখানা মুড়ে? এখনও খেয়ে চলে হাতির খোরাক কিন্তু বৃহৎ দুখানা কান নেড়ে মাছি তাড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না সে। গ্রামের ছেলেদের কৌতূহলও নেই আর ওর সম্বন্ধে।
কালই ওটাকে গুলি করে শেষ করে ফেলব। ভাবলেন রুদ্রপ্রসাদ। এই অকারণ অপচয়কে টেনে চলার কোনও মানে হয় না।
হঠাৎ হাতিটার উপরই দারুণ খাপ্ত হয়ে উঠলেন রুদ্রপ্রসাদ। কাল, কাল সক্কালবেলাই ওটাকে শেষ করে ফেলব।
কিন্তু সে তো কাল।
আজ এখন কী করবেন?
প্রমোদমত্ত বেয়াদব বেহায়া নির্লজ্জ প্রজাদের উল্লাসধ্বনি শুনবেন বসে বসে?
.
ও অঞ্চলে এই রামসীতার বিবাহহাৎসবটিই হচ্ছে প্রধান উৎসব।…এদিক সেদিক থেকে আমোদপ্রমোদের নানা উপকরণ এসে জড় হয়।…আসে-কেষ্টযাত্রা ঝুমুরগান বাইনাচ তর্জার লড়াই গম্ভীরা গান…তিনদিনব্যাপী আয়োজন।
বিশেষ দিনক্ষণ অনুসারে জমিদারমশাই একবার গিয়ে আসরে বসেন, এই বিধি পুরুষানুক্রমে চলে আসছে। বসেন, বকশিশ দেন, মেডেল ঘোষণা করেন। এবারও সবই করবেন ঠিক করে রেখেছিলেন। তাক লাগিয়ে দেবেন সবাইকে। সেটা আগামী কালকের অনুষ্ঠানে।… কিন্তু আজকের মেজাজ অন্য রকম।…আজকে? কে ওখানে?
নিঃশব্দে দুটো ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। সরাসরি মুখোমুখি নয়। পাশের দিক থেকে। এগিয়ে এল, নীরবে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে কুর্নিশ সদৃশ প্রণাম করে মাথা হেঁট করে দাঁড়াল।
ওদের চেহারা দেখেই ব্যাপারটা বোঝা গেছে।
স্রেফ ভগ্নদুতের চেহারা।
নিবারণ আর বোঁচা!
রুদ্রপ্রসাদের সবথেকে বিশ্বস্ত ক্রীতদাস। বিহঙ্গর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ধূপগুড়ি গিয়েছিল ওরা।
রুদ্রপ্রসাদ কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন।
পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী, চেনবার অসুবিধে হল না।
বললেন, কাজ হয়নি মনে হচ্ছে!
স্বরের ভীষণতায় দুজনেই কেঁপে উঠল, কথার উত্তর দেবার সাহস হল না।
রুদ্রপ্রসাদের সেই ভয়ংকর কণ্ঠস্বর যেন এই মায়াময় প্রকৃতিকে ধমক দিয়ে উঠল, ঠিকানাটা বোধহয় ধাপপা!
বোঁচা চিরদিনই কর্তার মেজাজের নাড়ি টিপে এসেছে, তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আজ্ঞে না না। গয়লার পো বেহঙ্গর বাপের সাধ্যি যে আপনাকে ধাপা দেবে! জান প্রাণের ভয় নেই? গেলাম ঠিক ঠাঁইতেই, সেই মিষ্টির দোকানের মালিক স্বীকারও পেল, আচে তার ওই নামের অ্যাক আঁত্তীয়। আসা যাওয়াও আচে। কিন্তুক দেড় দুবচরের মধ্যে যায় নাই।
লোকটা যুধিষ্ঠির?
আঁ-আগ্যে!
বলি, তার মুখের কথাটা শুনেই অমনি চলে এলি? লুকিয়ে রেখে মিছে কথা বলতে পারে না সে?
আঁগ্যে তাতেই কি ছেড়েচি? আশপাশের সকল দোকান পশারে, লোকটার বাসার ধারে কাছে, সব্বাইকে শুদিয়েচি। বলিচি, রাগ করে ঘর থেকে পালিয়ে এয়েচে ছোঁড়া, তো অ্যাকন বাপের যায় যায় অবস্তা, হাসপাতালে পড়ে আচে খবর পাই। কেউ বলল না দেকেচে।
হারামজাদা শুয়োরটাকে বলেছিলি, খবর গোপন করলে সবংশে নিধন হবে।
আগ্যে বলি নাই আবার আপনার নাম শুনে আমাদের হাতে পায়ে ধরে মা কালীর দিব্যি কাটল।
নিবারণ আবার কথা বলে ফেলে, তা পর গে আমাদের দোকানে বসিয়ে, তোয়াজ করে পেট পুরে কত খাওয়ানো! ছ্যানার জেলবি, কুঁদে, খাসা মোয়া পানতোয়া —
ঠাশ করে তার গালে একটা চড় এসে পড়ল, চোপরাও উল্লুক। শুয়োরের বাচ্চা।
নিবারণ গালে হাত চেপে মাথা নিচু করে।
বোঁচা মাথা হেঁট করে বলে, আগ্যে জোচ্চোর ওই বেহঙ্গটা। ভাব দেকালো কতই যেন খুঁজতেচে।…তানয়, আন্দার্জে ওই সংবাদটি দেচে। জানে যাওয়া আসা আচে। মায়ের মাসির বাড়ি।..
কথাটা বুঝেও, হারামজাদার মুণ্ডুটা তার ধড়ের উপর রেখে এলি?
বোঁচা তাড়াতাড়ি বলে, অগ্যে ইচ্ছে কি হচ্চেলল রেকে আসি? তবে আপনার হুকুম ব্যেতিত, তো হতে পারে না কিচু।
ধড়িবাজ লোকটা এই করেই বাগান পুকুর খেত বাড়ি করে ফেলেছে।…
রুদ্রপ্রসাদ কড়া গলায় বলেন, জুতো খেতে না চাস তো সামনে থেকে দূর হয়ে যা বাঁদরের বাচ্চা।
পালিয়ে বাঁচে ওরা।
ওদিকে আকাশে অফুরন্ত জ্যোৎস্না।…
বাতাসে মাদকতা।
মাঠঘাট ভেদ করে ঘন ঘন কানে আসছে রামসীতার বিয়ের উলুধ্বনির ধ্বনিরেশ।
জেবনে ঘেন্না ধরে গেচে বুইলি বোঁচাদা।
নিবারণের খেদোক্তিতে বোঁচা মুখ বাঁকিয়ে বলে, তবে সরকার বুড়োর মতন সেলাম ঠুকে চলে যা।
রাজাবাবুর যা চ্যায়ারা দেকচি, হঠাৎ না মাতার শির ছিঁড়ে মরে।
ওনাদের মাতার শির অ্যাতো ঠুনকো নয় রে নিবারণ! ইটিলদে তৈরি।
.