তৃতীয় পর্ব : পোয়ারোর ভাবনাচিন্তা
০১.
কোনো জন?
পোয়ারো কিচেন কামরায় এসে দেখলেন কুক এবং ডাক্তার কথাবার্তা বলছিলেন।
আপনি যদি এই রহস্যের সমাধান করতে পারেন বুঝব অসম্ভবও সম্ভব হয়। কুক বললেন।
আপনাকে ব্যাপারটা খুব ভাবাচ্ছে তাই না?
হ্যাঁ বুঝতে পারা যাচ্ছে না।
সায় দিলেন ডাক্তারও।
এরপর আমাদের করণীয় কি আছে সেটাই মাথায় আসছে না, সমাজ, লোকালয় থেকে আমরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। কোনো সাহায্য বাইরে থেকে পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং সবকিছুই মাথা খাঁটিয়ে করতে হবে।
তা ঠিক, এবার তাহলে কিভাবে এগোবেন?
কেন? যাত্রীদের তথ্য এবং আমাদের পর্যবেক্ষণ এসবই তথ্য মজুদ। যাত্রীদের সাক্ষ্য থেকে কিই বা জানা গেছে?
না জানতে পারলাম। তারা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অনেক কিছু তথ্যই সরবারহ করেছেন।
প্রথমে ম্যাককুইনের কথা ধরুন। উনি বলেছিলেন ভ্রমণ ছিল মিঃ রাশেটের নেশা। কিন্তু বিদেশী ভাষায় দখল না থাকার ফলে সেক্রেটারী এবং দোভাষী দুই-এর কাজের জন্য তাকে বহাল করা হয়েছিল। আরও একটা সূত্র হচ্ছে যদি আমেরিকান ইংরাজী ছাড়া আর কিছুই জানা না থাকে তবে চলাফেরাই মুশকিল ছিল।
তার মানে।
ফরাসী ভাষা রাশেট জানত না। যখন কণ্ডাক্টর দরজায় টোকা মারে ভেতর থেকে ফরাসী ভাষায়ই জবাব আসে স্য ন্য রিয়, মে সুই ঐ পে। কথাটা স্পষ্ট শুনেছিলাম। ফরাসী ভাষায় দখল না থাকলে এত সুন্দর ভাবে বাক্য গঠন করা সম্ভব নয়। সুতরাং রাশেটের কামরায় নিশ্চয় অন্য কেউ উপস্থিত ছিল।
চেঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার।
আপনি তাই ঘড়ির ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব দেননি। রাশেট মৃত তার মানে একটা বাজতে তেইশ মিনিটে। এবং কামরার ভেতর থেকে হত্যাকারী কথা বলেছিল, কুক বললেন।
না না, এত তাড়াতাড়ি এগোনোর কিছু নেই। এটুকু বলা যায় যে একটা বাজতে তেইশ মিনিটে রাশেটের কামরায় এমন একজন কেউ ছিল যে অনর্গল ফরাসী ভাষায় কথা বলতে পারে।
বড় বেশি আপনি সাবধানী মঁসিয়ে।
একধাপ করে এগোনোই শ্রেয় আর এখন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই যে রাশেট সেই সময়ই মৃত।
কেন? তার একটু আগেই তো আপনার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আর্তনাদ শুনে।
তা অবশ্য ঠিক।
এতে কতটুকু লাভ হল অবশ্য জানি না, কুক বললেন। রাশেটের পাশে একটা লোক ছিল হয়তো সেই সময়। খুনটুন করে হাত ধুচ্ছে বা চিঠিটা পোড়াচ্ছিল, তারপর সুযোগ বুঝে শ্ৰীমতী হার্বাডের কামরার মধ্যে দিয়ে পালিয়েছে। হত্যাকারী অ্যালিবাই সৃষ্টি করার জন্য ঘড়ির কাটাও আধঘন্টা পিছিয়ে দিয়েছিল।
হ্যাঁ। ঘড়ির কাঁটা একটা বেজে পনের মিনিটে বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সময় মঞ্চ থেকে হত্যাকারী বিদায় নিয়েছিল। একটা বেজে পনের মিনিট এই সময়টা নিয়ে আমাদের প্রধান কাজ হল ওই সময়কার অ্যালিবাই সবচেয়ে নিখুঁত ছিল তা হদিশ করা।
ডাক্তার হ্যাঁ হ্যাঁ তা ঠিক।
কুকও উৎসাহিত হলেন।
মনে রাখতে হবে খুনী কখন কামরায় ঢুকেছিল। সম্ভাব্য সময় হল ভিনভোকিতে ট্রেনটা যখন থেমে ছিল।
তারপর তো করিডোরের সামনে কণ্ডাক্টর বসে ছিল।
তাহলে অন্য কাউকে কণ্ডাক্টরের পোশাকে দেখলে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। সুতরাং মিশেল যখন ভিনভোকি প্ল্যাটফর্মে নামে ওই লোকটা গাড়িতে ওঠে।
এই ব্যক্তিটি মনে হয় মহামান্য যাত্রীদেরই একজন।
পোয়ারো হাসলেন।
আমি একটা তালিকা তৈরি করেছি আপনার এটা কাজে লাগে কিনা দেখুন তো।
হেক্টর ম্যাককুইন– আমেরিকান নাগরিক। ৬ নম্বর বার্থ।
দ্বিতীয় শ্রেণী কিন্তু তিক্ততা থাকা অসম্ভব নয় মৃত ব্যক্তির উদ্ভট সম্পর্কের ফলে।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (রাত্রি বারোটা থেকে একটা ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত কর্নেল আবাথনট কর্তৃক এবং একটা পনের মিনিট থেকে দুটো পর্যন্ত কণ্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য– কিছু নেই।
সন্দেহজনক গতিবিধি কিছু নেই।
কণ্ডাক্টর পিয়ের মিশেল– ফরাসী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (বারোটা সাইত্রিশ মিনিটে রাশেটের কামরা থেকে যখন কথা শোনা গিয়েছিল সেই সময় পোয়ারো তাকে করিডোরে দেখেছিলেন। রাত্রি একটা থেকে একটা মোল মিনিট পর্যন্ত তার গতিবিধি কন্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য — নেই।
সন্দেহজনক গতিবিধি –মিশেলের সুবিধে হয়েছে একটি ইউনিফর্ম পাওয়াতে নইলে সন্দেহটা তার দিকে পড়ত।
এডওয়ার্ড মাস্টারম্যান –ইংরেজ, ৪ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –মৃত ব্যক্তির পরিচারক। ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়।
অ্যালিবাই– রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (আস্তেলিও ফলকারেল্লি কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য — নেই।
সন্দেহজনক গতিবিধি– নেই। তবে কণ্ডাক্টর পোশাকটি মাপসই হতে পারে তবে ফরাসী ভাষায় জ্ঞান না থাকা সম্ভব।
শ্ৰীমতী হাবার্ড –আমেরিকান। ৩ নম্বর বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –বারোটা থেকে দুটো। কিছু নেই।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য — কিছু নেই।
সন্দেহজনক গতিবিধি –একটি লোকের উপস্থিতি সম্পর্কে যা বলেছেন তা মিঃ হার্ডম্যান ও শ্রীমতী স্মিটের সাক্ষ্যে পরোক্ষভাবে সমর্থিত।
গ্রেটা অঁলস –সুইডিস।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো ( মিস ডেবেনহ্যাম কর্তৃক সমর্থিত)।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ –শেষবারের মতো ইনিই জীবিত দেখেন রাশেটকে।
রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ– জন্মসূত্রে রাশিয়ান। বর্তমানে ফরাসী নাগরিক। ১৪ নং বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অভিপ্রায় –একসময় আমং পরিবারের সাথে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন এবং সোনিয়া আর্মষ্ট্রং ছিলেন এঁর ধর্মকন্যা এবং বিশেষভাবে স্নেহের পাত্রী।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (কণ্ডাক্টর ও পরিচারিকা কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য– সন্দেহজনক গতিবিধি কিছু নেই।
কাউন্ট আন্দ্রেনী –হাঙ্গেরীয়। কূটনৈতিক পাসপোর্ট। ১৩ নং বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অ্যালিবাই –রাত্রি বারোটা থেকে দুটো (রাত্রি একটা থেকে একটা পনের মিনিট পর্যন্ত সময়টুকু বাদে বাকি সময় কণ্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
কাউন্টেস আন্দ্রেনী –কাউন্ট আন্দ্রেনীর স্ত্রী। ১২ নম্বর বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছুই নেই।
অ্যালিবাই বারোটা থেকে দুটো ( ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন ওঁর স্বামী কর্তৃক সমর্থিত) কামরায় ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে।
কর্নেল আর্বাথনট –ইংরেজ। ১৫ নম্বর বার্থ, প্রথম শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই– বারোটা থেকে দুটো (একটা ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত ম্যাককুইনের সঙ্গে গল্প করছিলেন। তারপর নিজের কামরায় যান ম্যাককুইন ও কণ্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য –পাইপ ক্লিনার।
সাইরাস হার্ডম্যান –আমেরিকান। ১৬ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –অজ্ঞাত।
অ্যালিবাই– বারোটা থেকে দুটো (নিজের কামরাতেই ছিলেন ম্যাককুইন ও কণ্ডাক্টর কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য –কিছু নেই।
আন্তেলিও ফলকারেল্লি –জন্মসূত্রে ইতালিয়ান। বর্তমানে আমেরিকার নাগরিক। ৫ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –অজ্ঞাত।
অ্যালিবাই –বারোটা থেকে দুটো (মাস্টারম্যান কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য –কিছু নেই। তবে যে অস্ত্রের সাহায্যে রাশেটকে হত্যা করা হয়েছে সেটি ব্যবহার করা এঁর পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয়। কুকের মতে লোকটি সন্দেহজনক তালিকায় পড়ে।
মেরী ডেবেনহ্যাম –ইংরেজ। ১১ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –বারোটা থেকে দুটো (গ্রেটা অঁলস কর্তৃক সমর্থিত)।
বিরুদ্ধ সাক্ষ্য –পোয়ারোর কাছে ইনি নিজের বক্তব্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে অসম্মত হন।
ইল্ডগ্রেদ স্মিট –জার্মান। ৮ নম্বর বার্থ, দ্বিতীয় শ্রেণী।
অভিপ্রায় –কিছু নেই।
অ্যালিবাই –বারোটা থেকে দুটো (কণ্ডাক্টর ও রাজকুমারী কর্তৃক সমর্থিত কামরায় ঘুমোচ্ছিলেন)। বারোটা আটত্রিশ মিনিট নাগাদ কণ্ডাক্টর ডেকে তোলে। তারপর কত্রীর কামরায় গেছিলেন।
দ্রষ্টব্য– যাত্রীদের এবং কণ্ডাক্টরের সাক্ষ্য থেকে সাধারণভাবে জানা যাচ্ছে যে রাত্রি বারোটা থেকে একটা এবং একটা পনের মিনিট থেকে দুটোর মধ্যে রাশেটের কামরায় কেউই ঢোকেনি বা বেরোয়নি। একটা থেকে একটা পনের মিনিট এই সময়টুকুর জন্য কণ্ডাক্টর পাশের কোচে গেছিলেন।
কুক ব্যাগদুটো ফেরত দিলেন।
কিছু হদিশ করতে পারেলেন না মঁসিয়ে পোয়ারো।
এবার এই কাগজটা দেখুন বলে এগিয়ে দিলেন পোয়ারো।
.
০২.
দশটি প্রশ্ন
এক : রুমালের উপর এইচ অক্ষরটি তোলা আছে। রুমালটি কার?
দুই : পাইপ ক্লিনার ফেলে দিয়েছিলেন কে? কর্নেল আবাথনট না আর কেউ?
তিন : লাল কিমানো পরা মহিলাটি কে?
চার : কণ্ডাক্টরের ছদ্মবেশে পুরুষ বা স্ত্রীলোকটি কে?
পাঁচ : ঘড়ির কাঁটা একটা পনের বেজে বন্ধ। এর ইঙ্গিত কি?
ছয় : হত্যা কি ওই সময় হয়?
সাত : না ওই সময়ের আগে?
আট : অথবা পরে?
নয় : একজনের বেশি লোক ছোরা মেরেছিল তার নিশ্চয়তা কি?
দশ : অন্য কি ব্যাখ্যা ক্ষত চিহ্নগুলোর হতে পারে?
রুমাল দিয়েই শুরু করা হল। এইচ অক্ষর দিয়ে শুরু শ্রীমতী হার্বাড, কুমারী হারমিয়োন ডেবেনহ্যাম। আর শ্রীমতী ইল্ডগ্রেদ স্মিট।
এই তিন জনের মধ্যে?
মিস ডেবেনহ্যাম নিজেকে হারমিয়োন বলতেই পছন্দ করেন। একটু সন্দেহজনক চরিত্রের কারণ উনি কিছু সাক্ষে ভাঙ্গেননি।
শ্ৰীমতী হার্বাডের রুমাল বলেই মনে হয় বললেন ডাক্তার কেননা উনি আমেরিকান এবং রুমালটাও দামী। সবাই জানে পছন্দ হলে দামের জন্য পরোয়া নেই আমেরিকানদের।
শ্ৰীমতী স্মিটের যে রুমালটা নয় আপনারা দুজনেই তাহলে একমত।
হ্যাঁ। বেশ দামী উনিই তো বলে গেলেন।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন পাইপটা কি কর্নেল আবাথনটের?
যেহেতু ইংরেজরা চট করে ছোরাছুরি চালায় না এবং কর্নেলের ওপর যাতে সন্দেহটা যায় সেজন্যই হয়ত ওটাকে রাশেটের কামরায় ফেলে রাখা হয়েছিল।
কেউ দুটো জিনিষই ভুল করে ফেলে যাবে এটা ঠিক নয়, ডাক্তার বললেন। অবশ্য পাইপক্লিনারের কথাটা আলাদা। এটা ইচ্ছাকৃত এবং কর্নেল স্বচ্ছন্দেই বললেন যে তিনি ঐ পাইপক্লিনারেই ব্যবহার করে অন্ধকারে আ সৈটাই প্রশ্ন।
কিমানোটার প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ অন্ধকারে আছি। কুক এবং ডাক্তারের একই মত।
কণ্ডাক্টরের ছদ্মবেশে পুরুষ বা মহিলাটি কে সেটাই প্রশ্ন।
যারা নয় বলা সহজ। যাদের বাদ দেওয়া যেতে পারে তারা হলো হার্ডম্যান, কর্নেল, ফলকারেল্লি, কাউন্ট আন্দ্রেনী, আর ম্যাককুইন এঁরা যথেষ্ট লম্বা। শ্রীমতী হার্বাড, শ্রীমতী স্মিট আর গ্রেটা অঁলস আর ফলকারেল্লি জানিয়েছে যে মেরী ডেবেনহ্যাম বা মাস্টারম্যান কেউই কামরা ছেড়ে বাইরে বেরোয়নি। শ্রীমতী স্মিট বলেছে রাজকুমারী তার কামরায় ছিলেন। কাউন্ট বলেছেন তার স্ত্রী ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন। ব্যাপারটা খুবই জটিল হল।
আমার ধারণা কিন্তু চারজনের মধ্যেই কেউ হবেন যদি না কোনো বাইরের লোক আসে, ডাক্তার বললেন।
একটা পনের মিনিট বেজে ঘড়ির কাঁটা বন্ধ, এর দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। হত্যাকারী অ্যালিবাই সৃষ্টি করার জন্য ঘড়ির কাটা ঘুরিয়ে রেখেছিল কারণ যখন সে দেখল তার কামরা থেকে বেরোতে দেরি হচ্ছে। আর যদি তা না হয় তবে দ্বিতীয় হত্যাকারী যে ন্যাটা এবং স্ত্রীলোক বলে অনুমান তারও একই উদ্দেশ্য ছিল।
চমৎকার, বললেন পোয়ারো। দ্বিতীয় হত্যাকারী কামরায় ঢুকে ছোরা চালালো। যদিও রাশেট আগেই নিহত।
যখন অন্ধাকরে টের পেল যে রাশেটের পায়জামার পকেটে ঘড়ি আছে অন্ধকারেই ঘড়ির কাটা সরালো এবং ঘড়িটাকে ভেঙ্গে অচল করল তারপর ঠিকঠাক করে পকেটে রেখে বেরিয়ে গেল।
হত্যা কি একটা পনের মিনিটে হয়েছে।
ডাক্তার এবং মঁসিয়ে কুক আপনারা একমত কি হত্যা হয়েছে ঐ সময়ের পরে?
আমার বিশ্বাস পোয়ারোর ধারণা কিন্তু উনি এখন মত প্রকাশে অনিচ্ছুক, ওঁর মত বোধহয় প্রথম হত্যাকারী সম্ভবতঃ ন্যাটা। যাত্রীদের কেউ ন্যাটা আছেন কিনা সেটা খোঁজ করা উচিত।
আমি অনুসন্ধান করে দেখছি পোয়ারো বললেন।
আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন প্রত্যেককেই নিজের নাম ঠিকানা লেখার জন্য বলেছিলাম একমাত্র রাজকুমারী সন্দেহের উর্দ্ধে কারণ ওর শরীর দুর্বল, ডাক্তার বললো। ডাক্তার একটা কথা জানেন কি এটা এমন একটা কাজ যা দৈহিক শক্তির চেয়ে মনের জোর বেশি দরকার।
রাজকুমারী একজন প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী নারী। যাই হোক এই প্রসঙ্গ থাক দশ নম্বর প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি, পোয়ারো বললেন।
রাশেটের হত্যাকারী দুজন এটা ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে বলা যায়। প্রথম জন চলে যাবার পর অন্ততঃ আধ ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় আততায়ী আসে। প্রথমজন বলশালী, দ্বিতীয়জন অপেক্ষাকৃত কমজোরী এবং ন্যাটা। এর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা আর নেই কারণ সে ডান হাতে ছোরা চালাবে আর খানিক পরে এসে নিশ্চয় বাম হাতে ছোরা চালাবে এটা কি সম্ভব।
আততায়ী যে দুজন এটাও কি সম্ভব?
সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি ডাক্তার, পোয়ারো বললেন।
.
০৩.
কয়েকটি লক্ষ্যণীয় বিষয়
পোয়ারো অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি। এতক্ষণ এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেই ভাবছিলাম কিন্তু এর জন্য একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। এই ট্রেন যেন এক চলামান পান্থশালা মঁসিয়ে কুক কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন। বিভিন্ন দেশের অপরিচিত মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে চলছে….।
এই প্রসঙ্গে আমার মনে হয়েছিল যে ট্রেনটা একদম ফাঁকাই যায় বছরের এই সময়টাতে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এথেন্স-প্যারিস কোচটা ভর্তি। শুধু একজন টিকিট কেটেও ঠিক সময়ে পৌঁছোননি; এটা লক্ষ্য করার বিষয়।
দরজার ছিটকানিকে আড়াল করা জন্য একটা ঝোলা রাখা ছিল। শ্রীমতী হার্বাড-এর কামরা দিয়ে পাশে রাশেটের কামরায় যাবার তাতে ভোলা বা বন্ধ কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। ঝোলাটা ওখানে ছিল কেন? শ্রীযুক্ত আর্মষ্ট্রং-এর মায়ের নাম। শ্রীযুক্ত হার্ডম্যানের গোয়েন্দাগিরি, রাশেটের কামরায় আধপোড়া চিঠি, ম্যাককুইনের বক্তব্য, রাজকুমারীর নাম, কাউন্টেস আন্দ্রেনীর পাসপোর্টে দাগ এগুলো লক্ষ্যণীয় বিষয়। এগুলো থেকে কি মনে হয় আপনাদের?
দুজনেই বুঝিয়ে দিলেন যে তারা কিছুই বুঝতে পারছেন না। কাউন্টেসের পাসপোর্টটা মেলে ধরে কুক বললেন, এই দাগটার কথা বলছেন?
হা দেখুন কোথায় লেগেছে?
আন্দ্রেনীর নামের গোড়ায় কিন্তু তাতে কি হল?
রুমালের ব্যাপারে মিস ডেবেনহ্যাম, মিস হার্বাড আর পরিচারিকা স্মিট এই তিনজন সন্দেহের তালিকায় ছিলেন কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে, এটা প্যারিসের এবং খুব দামী রুমাল। কিন্তু এই তিনজন সাধারণ জামাকাপড়, রুমাল ব্যবহার করেন এবং রুমালটার দাম কমসে কম দুশো ফ্র। এই রুমালটির সম্ভাব্য দাবীদার : রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ আর…।
অবাক হলেন কুক।
ওর নাম তো নাতালিয়া।
হ্যাঁ। কথাটা মনে রাখবেন আর অন্যজন কাউন্টেস আন্দ্রেনী আর তখনই মনে হল…।
এবার আপনার। আমরা এতে নেই মশাই।
বেশ, কাউন্টেসের পাসপোর্টের দাগটা সন্দেহজনক হয়ত নিছক দুর্ঘটনা। কিন্তু ওঁর আসল নাম কি! এলেনা?
এমন তো হতে পারে ওর নামটা আসলে হেলেনা।
এটা অবশ্য অনুমানভিত্তিক।
হা কাউন্টেসের ব্যাগের লেবেলটা সেদিন ভিজে ভিজে লেগেছিল কেন? হয়ত সেদিন সেটা বদলানো হয়ে থাকে, এই হত্যাকাণ্ড কিন্তু আকস্মিক নয় পূর্ব পরিকল্পিত। আকস্মিক ব্যাপার দুটো। এক বরফ ঝড় দুই এই ট্রেনে এরকুল পোয়ারোর উপস্থিতি।
এই অবস্থার জন্য হত্যাকারী বা হত্যাকারীরা প্রস্তুত ছিল না। যদি বরফ ঝড় না হত তবে নির্দিষ্ট সময় ট্রেনটা ইতালি-সীমান্তে গিয়ে পৌঁছাত। সেই সময় হত্যাকাণ্ডের সংবাদ জানা যেত। এবং এই রকম সাক্ষ্য ইতালিয় পুলিসের কাছে দেওয়া হত। ম্যাককুইন দেখাতেন উড়োচিঠির নমুনা ব্যার্থ গোয়েন্দাগিরি শোনাতেন হার্ডম্যান। শ্রীমতী হার্বাড রহস্যময় লোকের বিবরণ শোনাতেন। বোতামটি এবং কণ্ডাক্টরের উর্দিটি বাথরুমে পাওয়া যেত। হত্যাকারীরা যে বাইরের লোক এটাই প্রমাণ করা হচ্ছে হত্যাকারী বা হত্যাকারীদের মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু মাঝখানে বরফ ঝড়ই সব ওলোটপালোট করে দেয়। রাশেটের কামরায় হত্যাকারী অপেক্ষা করেছিল কারণ সে হয়ত ভেবেছিল ট্রেন চলবে। কিন্তু ট্রেন না চলায় পরিকল্পনা বদল হল যে হত্যাকারী ট্রেনের মধ্যে আছে।
সবই ভাঁওতা ছিল উড়ো চিঠিগুলো কারণ রাশেট জানত তার শত্রু কে বা কারা। তবে যেটা আধপোড়া অবস্থায় পেয়েছি সেটা দেখে সে সত্যিই ভয় পেয়েছিল। এবং সেই কারণেই পোড়ানো হয়েছিল। এবার রুমাল আর পাইপক্লিনার। রুমালটা ভুল করে সত্যিই ফেলে যাওয়া হয়েছিল। এমন কোনো মহিলার যদি রুমালটা হয় যিনি আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে যুক্ত তিনি নিমোতে তার পরিচয় গোপন করবেন এবং এই ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। কাউন্টেস আন্দ্রেনী নাম বদল করেছেন ওঁর প্রকৃত নাম এলেনা নয়, হেলেনা।
উনি আমেরিকায় কখনও যাননি তিনি তা বলেছেন। তাহলে আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে ওঁর কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
হা সাক্ষ্যে তাই বলেছেন। কারণ ওঁর চেহারা ইংরেজ বা আমেরিকানদের মত নয়। অনেকটা ইউরোপ অধিবাসীদের ধাঁচের এবং ইংরাজী উচ্চারণেও জড়তা আছে। আমি বুঝতে পেরেছি উনি কে?
ডেইজি আর্মষ্ট্রং-এর মাসী হেলেনা। শ্রীযুক্তা আর্মষ্ট্রং-এর আপন ছোট বোন। অভিনেত্রী লিণ্ডা আর্ডেন-এর কনিষ্ঠ কন্যা।
লিণ্ডা আর্ডেন ছিলেন পেশাদার মঞ্চাভিনেত্রী। আমরা সবাই জানি তাঁর অতুলনীয় পারদর্শিতার কথা, পেশাদার নাম নিয়েই এক্ষেত্রে সবাই থাকে। লিণ্ডা আর্ডেন শেক্সপীয়ারের অ্যাজ ইউ লাইক ইট নাটকে আর্ডেন অরণ্য আর রোজা লিণ্ডা দুইয়ে মিলে লিণ্ডা আর্ডেন হওয়া বিচিত্র নয়। লিণ্ডার পূর্ব পুরুষরা হয়ত মধ্য ইউরোপের লোক ছিলেন। তার প্রকৃত পদবী হয়ত গোল্ডেনবার্গ। লিণ্ডা আর্ডেনের ছোট মেয়ে হেলেনা গোল্ডেনবার্গ বর্তমানে কাউন্টেস আন্দ্রেনী। ওয়াশিংটনে কাউন্ট যখন ছিলেন তখনই বিয়ে হয় ওদের।
রাজকুমারী তো বলেছেন যে লিণ্ডা আর্ডেনের ছোট মেয়ে এক ইংরেজকে বিয়ে করেছে। এবং সেটা রাজকুমারীর মনে নেই। রাজকুমারী ওদের পরিবারের বন্ধু অথচ এই তথ্যটুকু জানবেন না। কিন্তু ট্রেনে যে হেলেনা আছেন এবং রাজকুমারীও তাকে দেখেছেন কিন্তু আমরা যাতে হেলেনাকে সন্দেহ না করি তাই তিনি মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
খানাকামরায় নৈশভোজের জন্য যাত্রীদের আহ্বান করা হল।
.
০৪.
পাসপোর্টে নাম বদল
খাবার পরিবেশন করার আগে প্রধান পরিচারককে ডেকে কিছু একটা নির্দেশ দিলেন পোয়ারো। কাউন্ট আর কাউন্টেসকে সবার শেষে পরিবেশন করা হচ্ছে দেখলেন ডাক্তার এবং মঁসিয়ে কুক। বিলের ক্ষেত্রেও একটু দেরি হল তাদের। সবাই যখন বেরিয়ে গেলেন ওঁরা তখনও টেবিলে বসে। দাম মিটিয়ে যাবার পথে আটকালেন পোয়ারো হাতে সেই দামী রুমালটা। এই রুমালটা মাদাম আপনি ফেলে যাচ্ছেন।
কাউন্টেস রুমালটি হাতে নিয়ে দেখলেন এবং বললেন আপনার ভুল হয়েছে মঁসিয়ে, রুমালটা আমার নয়।
আপনার নয়?
না।
কিন্তু এইচ অক্ষরটা সেলাই করা আছে যে।
কাউন্টেস অবিচলিত মুখে বললেন আমার নামের প্রথম অক্ষর এইচ নয় ই।
না মাদাম। আপনার নাম এলেনা নয় হেলেনা, হেলেনা গোল্ডেনবার্গ। অভিনেত্রী লিণ্ডা আর্ডেনের কনিষ্ঠ কন্যা শ্রীমতী আর্মষ্ট্রং-এর ছোট বোন।
কাউন্ট আর কাউন্টসের মুখে মৃত্যুর বিবর্ণতা। দুপক্ষই চুপ থাকলেন দুই মিনিট।
নরম গলায় পোয়ারো বললেন, আমি যা বললাম তা সত্যি কিনা অস্বীকার করবেন না মাদাম।
কাউন্ট গলা চড়িয়ে বললেন, আপনি কোনো অধিকার…. তা আমি জানতে চাই।
লক্ষ্মীটি মাথা গরম করো না। আমায় বলতে দাও এবং এঁর কাছে অস্বীকারের উপায় নেই।
হা মঁসিয়ে আমি হেলেনা গোল্ডেনবার্গ। শ্রীমতী আর্মস্ট্রং আমার দিদি।
সেটা আগে বলেননি কেন উল্টে আপনার স্বামী-সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলে গেছেন।
গর্জে উঠলেন কাউন্ট। কাউন্টেস তাকে চুপ করিয়ে বললেন। উনি যা বলছেন তা তিক্ত এবং সত্য।
আচ্ছা মাদাম পাসপোর্টে নাম বদল করলেন কেন?
ওকে কিছু বলবেন না ওটা আমিই করেছি, বললেন কাউন্ট।
হেলেনা শুরু করলো। ট্রেনে যে লোকটা খুন হয়েছে সে একসময় আমার দিদির ছোট্ট মেয়েকে চুরি করে হত্যা করেছিল এবং সে আমার দিদি-ভগ্নিপতির মৃত্যুর জন্যও দায়ী। একটা সুন্দর সংসার নষ্ট করে দিয়েছিল মঁসিয়ে পোয়ারো।
এই ট্রেনে রাশেটকে হত্যা করবার স্বপক্ষে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি ছিল।
আপনি তো তাকে খুন করেননি?
না। এটা শপথ করে বলছি এক আধবার হয়তো ভেবেছি এই পর্যন্তই।
আমি ভগবানের নামে শপথ করে বলছি যে আমার স্ত্রী রাতে একবারের জন্যও কামরা ছেড়ে বেরোয়নি ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। কাউন্ট বললেন।
তাহলে নাম বদল করতে গেলেন কেন পাসপোর্টে? আমি চাইনি কোনো পুলিশি জেরার মুখোমুখি হোক আমার নিরাপরাধ স্ত্রী, ও খুব নরম মনের মেয়ে।
আপনাকে অবিশ্বাস করছি না এবং এও জানি আপনি অভিজাত বংশের। আপনার নিশ্চয় এটা কাম্য ছিল না যে আপনার স্ত্রী একটা বিশ্রী মামলায় জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু রুমালটার ব্যাপারে কি বলবেন?
রুমালটা আমার নয় মঁসিয়ে কারণ এই রুমাল আমি ব্যবহার করি না। এটা আপনি বিশ্বাস করুন, কাউন্টেস বললেন।
আপনাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলার জন্যই কি এই রুমালটা ফেলে আসা হয়েছিল?
তা জানিনা তবে সত্যিই রুমালটা আমার নয়।
পাসপোর্টে নাম বদল করতে গেলেন কেন?
কাউন্ট বললো, যে লোকটিকে খুন করা হয়েছে তার কামরা থেকে এইচ অক্ষরের একটা রুমাল পাওয়া গেছে তাই অযথা হেলেনাকে সন্দেহ না হয় এবং জেরার ভয়ে।
তাই বলে এতবড় একটা বে-আইনী কাজ করলেন?
না না, আসলে খুবই ভয় পাওয়ার জন্য এবং আবার হয়ত পুরনো ক্ষত খুঁচিয়ে ভোলা হবে তাই।
গম্ভীর গলায় পোয়ারো বললেন, এখন আপনি আমাকে সাহায্য করুন মাদাম।
আপনি কার কথা জানতে চান? রবার্ট, সোনিয়া, ডেইজি কেউই এদের বেঁচে নেই।
মাদাম আরও একটা মৃত্যু হয়েছিল।
সুশান? ওঁর কথা ভুলেই গেছিলাম। অন্যায় সন্দেহ করেছিল পুলিশ ও আত্মহত্যা করে, জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে কিন্তু ও সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিল।
মাদাম মেয়েটি কোনো দেশীয় ছিল?
ফরাসী।
তার পদবী কি ছিল?
সেটা জানি না তবে সুশান বলেই ডাকতে শুনেছি।
একজন নার্স ছিলেন না ডেইজিকে দেখাশোনা করার জন্য?
হা শিক্ষিত নার্স। শ্রীমতী স্টেনগেলবার্গ।
আচ্ছা এই ট্রেনে আপনার ছেলেবেলায় চেনা জানা কাউকে দেখেছেন?
না।
রাজকুমারী –দ্রাগোমিরফ?
হ্যাঁ আমি ভাবলাম বোধহয় অন্য কারোর কথা জিজ্ঞাসা করছেন।
কেননা ওর কথাই আলাদা।
ভালো করে ভেবে বলুন মাদাম?
না মঁসিয়ে।
তখন অবশ্য ছেলেমানুষ ছিলেন পড়াশুনা কার কাছে করতেন?
আমার এক কড়া গভর্নেস ছিলেন ইংরেজ বা স্কচ হবেন। তবে সোনিয়ার সঙ্গে ভীষণ ভাব ছিল। মাথার চুলগুলো লালচে ধরণের।
তার নাম কি?
মিস ফ্রিবভি।
তাঁর বয়স কত ছিল?
আমার তো তাকে বেশ বুড়ি বুড়িই লাগত। এখন ভাবলে মনে হয় সে সময় তার বয়স চল্লিশ-টল্লিশ হবে।
বাড়িতে আর কে কে থাকত?
কয়েকজন চাকর বাকর গোছের।
এই ট্রেনে আপনি তাহলে কাউকে চেনাজানা দেখেননি?
না মঁসিয়ে।
.
০৫.
রুশ রাজকুমারীর নাম
আপনার কি অপূর্ব বিচার ক্ষমতা তবে কাউন্টসের জন্য দুঃখ হয়। বেচারীর অল্প বয়স কয়েক বছরের বেশি অবশ্য জেল হবে না কেননা বয়স এবং মানসিক আঘাতের কথা চিন্তা করে বিচারকরা নিশ্চয়ই লঘু শান্তির বিধানই দেবেন। বললেন কুক।
তাহলে আপনি ধরে নিচ্ছেন যে রাশেটকে উনি হত্যা করেছেন?
করেননি?
তার স্বামী-তো কত সাফাই গেয়েছিল শুনলেন তো।
সে তো স্ত্রীকে বাঁচাতে উনি চাইবেনই।
কাউন্টের কথা আমার কিন্তু সত্যি বলেই মনে হয়। কিন্তু রুমালটা। ওঃ রুমালটা তো বলেছি দুটো সম্ভাবনার দিক।
আপনারা নাকি একটা রুমাল পেয়েছেন? রুমালটা আমার, বললেন রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ।
তাই নাকি, মাদাম এইটা কি?
হা হা, এইটা। ওর কোণে আমার নাম লেখা আছে।
মাদাম আপনার নাম তো নাতালিয়া, কুক বললেন।
ঠিকই কিন্তু রাশিয়ান ভাষায় এন অক্ষরটা ইংরেজীর এইচ-এর মতো দেখতে।
কুকের অস্বস্তি হতে আরম্ভ করল।
পোয়ারো সামলে নিয়ে বললেন, কই সকালে তো বলেননি যে রুমালটা আপনার।
আপনি তো জিজ্ঞাসা করেননি।
বলুন মাদাম।
আমি জানি পরবর্তী প্রশ্নটা এবার জিজ্ঞাসা করবেন রাশেটের কামরায় এটা গেল কি করে। আমি উত্তরটা জানি না।
জানেন না?
না।
আপনার কথার উপর আমরা কতটা আস্থা রাখতে পারি?
একথা বলার অর্থ কি এই যে হেলেনা আন্দ্রেনী সে সোনিয়ার বোন জানাইনি বলে।
আপনি আমাদের এ বিষয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন।
নিশ্চয়। দরকার হলে আরও করব। জানেন সে আমার বান্ধবীর মেয়ে। এবং বন্ধুর প্রতি আনুগত্য আমি বিশ্বাস করি।
কিন্তু এতে যদি বিচারের অসুবিধা হয়?
বিচারের কি আছে, রাশেট উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছে।
কাউন্টেসকে বাঁচবার জন্যই কি এই রুমালটা আপনার বলে দাবী করছেন?
না না, রুমালটা সত্যিই আমার। যদি বিশ্বাস না হয় প্যারিসের যে দোকানে কেনাকাটা করি সেখানে জিজ্ঞাসা করলেই বুঝতে পারবেন। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে!
আপনার পরিচারিকাও তো বলেনি যে রুমালটা আপনার।
বলেনি বুঝি সেও তার মানে আনুগত্যে বিশ্বাস করে। বলে বেরিয়ে গেলেন রাজকুমারী।
রাশেটকে কি উনি হত্যা করতে পারেন? ডাক্তারকে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন।
মনে হয় না। যথেষ্ট দৈহিক শক্তির দরকার হয় এই ধরনের আঘাত করতে গেলে।
আর মৃদু আঘাতগুলো?
সেগুলো অবশ্য সম্ভব হতেও পারে।
আমি সকালবেলায় যখন ওঁকে বললাম যে হাতের থেকে মনের জোর বেশি ওঁর তখন উনি ডান বা বাঁহাত নয় দুটো হাতের দিকে নজর দিয়ে স্বগোতোক্তি করেছিলেন। সত্যিই ওঁর হাতে জোর নেই।
উনি যে ন্যাটা তাতে প্রমাণ হয় না।
কত মিথ্যা কথাই এঁরা সবাই মিলে বলেছেন, মঁসিয়ে কুক বললেন।
পোয়ারো হেসে বললেন, এটাই মজা। এর জন্যই এরা ফাঁদে পড়ে, নিজেদের বাঁচাতে মিথ্যা কথা বলাটা কিন্তু পরোক্ষে আমাদেরই সুবিধা হওয়া।
এবার তা হলে কর্নেল সাহেবকেই ডাকা যাক।
.
০৬.
কর্নেলের সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার
তিনি যে বিরক্ত তা তাঁর ধরণ দেখলেই বোঝা যায়। ক্ষমা করবেন কর্নেল আপনাকে ডেকে পাঠাতে হল বিশেষ প্রয়োজনে। আপনি আমাদের কিছু সংবাদ-জানাতে পারেন এই কারণে।
তাই নাকি?
হা। এই পাইপ ক্লিনারটা কি আপনার?
কি করে বলি বলুন, চিহ্ন তো দিয়ে রাখিনি।
আপনি এই কোচের মধ্যে যে পাইপ খান সেটা কি জানেন?
সেক্ষেত্রে ওটা আমার হলেও হতে পারে।
জানেন কি এটা কোথায় পাওয়া গেছে?
কি করে জানব?
নিহত লোকটির পাশে।
একটু ভুরু তুললেন কর্নেল।
এ জিনিষটা ওখানে গেল কেমন করে বলতে পারেন? পোয়ারো বললেন।
আমি ওটা ওখানে ফেলে এসেছিলাম নিশ্চয় বলতে চাইছেন!
উত্তরটা ঠিক হল না।
রাশেটের কামরায় কি একবারও আপনি গিয়েছিলেন?
কখনও কথাই বলিনি ওঁর সঙ্গে।
তাকে খুনও করেননি কথাও বলেননি?
যদি করেও থাকি, তাহলে কি আমি আহাম্মক যে সাত কাহন করে বলতে যাব। তবে লোকটিকে আমি খুন করিনি।
তাতে কিছুই যায় আসে না।
মানে?
তাতে কিছুই যায় আসে না আমি বলছি।
ও।
কর্নেল চুপ থাকলে পোয়ারো বললেন, তাহলে পাইপ ক্লিনারটার কোনো গুরুত্ব নেই আর কেন ওখানে পড়েছিল তার ডজন খানেক সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ আমার কাছে মজুদ আছে। যাক কেন আপনাকে ডেকেছি সেই প্রসঙ্গে আসি। মিস ডেবেনহ্যাম আপনাকে কোনিয়া স্টেশনে বলেছিল না না এখন নয় পরে, আগে সব শেষ হোক। তারপর এই কথাগুলোর মানে কি কর্নেল?
সেটা আপনাকে জানাতে বাধ্য নই আমি। এটা সম্পূর্ণ একজন মহিলার ব্যক্তিগত ব্যাপার সেটা ওঁকেই বরং জিজ্ঞাসা করে দেখবেন।
সেটা জিজ্ঞাসা করতে উনি উত্তর দেননি।
তাহলে আমিই বা কি করে বলি বলুন?
মিস্ ডেবেনহ্যামও বলেছে এটা তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের।
কেন তার কথা মানছেন না?
কারণ তিনি সন্দেহজনক চরিত্রের মেয়ে।
কি সব বলছেন?
ঠিকই বলছি।
আপনি মিস ডেবেনহ্যাম সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
তিনি যে আর্মষ্ট্রং পরিবারের গভর্নেসের কাজ করতেন সেইটা জেনেছি; তাহলে স্বীকার করেননি কেন?
আপনি ভুল করছেন এমনও তো হতে পারে।
ভুল হয় না আমার। কেন উনি আমার কাছে মিথ্যা কথা বললেন।
আমার এখনও মনে হয় আপনি ভুল করছেন, যাই হোক ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন।
পোয়ারো পরিচারককে আদেশ দেবার ফলে মিস ডেবেনহ্যাম কিচেন কামরায় চারজনের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন।
মঁসিয়ে পোয়ারো আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
হা। আপনি সকালে আমার কাছে মিথ্যে কথা বলেছিলেন কেন সেটাই জানতে চাই। মিথ্যে কথা! কখন?
ডেইজিকে অপরহণ ও হত্যার সময়ে আপনি আর্মষ্ট্রং-এর বাড়িতে ছিলেন আপনি তো বলেননি। উল্টে বলেছেন আপনি নাকি কখনও আমেরিকায়ই যাননি।
মেরী একটু লাল হলেন। তারপর বললেন কথাটা ঠিক।
ওঃ তাহলে স্বীকার করছেন।
ঈষৎ বঙ্কিম হলো মেরীর অধর।
আপনি যখন সব জেনেই ফেলেছেন তখন মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই।
তাহলে সকালে মিথ্যে কথাটা বলেছিলেন কেন?
কারণটা খুবই স্পষ্ট।
আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না।
আপনি জানেন না মঁসিয়ে পোয়ারো যে একটি মেয়ের পক্ষে খুবই শক্ত একটি ভদ্রজীবিকা খুঁজে বের করা; তাই যদি এ কথা সবাই জানত যে নিহত শিশুর পরিবারের সাথে আমি যুক্ত তাহলে কোনো ভদ্র পরিবারে বা ভালো প্রতিষ্ঠানে আমার চাকরী বা পেশা কিছুই থাকবে না।
তা কেন? যদি নিরাপরাধ হন?
আপনি নিশ্চয় বোঝেন যে মানুষ গুজবে কান দিতে ভালোবাসে অপপ্রচার যে সাংঘাতিক জিনিষ।
একটা ব্যাপারে একটু সাহায্য করবেন মাদমোয়াজেল?
কি ব্যাপারে?
একটা সনাক্ত সম্পর্কে। আপনি নিউইয়র্কে যে মেয়েটিকে পড়াতেন তিনিই বর্তমানে কাউন্টেস আন্দ্ৰেনী। এটা নিশ্চয় আপনি ধরতে পেরেছেন।
কাউন্টেস আন্দ্রেনী! সত্যি আমি কিন্তু ধরতেই পারিনি। বিয়ের পর তো বিদেশী হয়ে গেছে, হয়ত ওর স্বামী বিদেশী বলেই তবে… অবশ্য একটু চেনা চেনা ঠেকছিল ওর পোশাক আর স্বামীটাকেই লক্ষ্য করছিলাম। মেয়েদের যা স্বভাব, বলে হাসলেন মেরী।
সবই বললেন, সেই গোপন কথাটা তো বললেন না।
না না, সেকথা কিছুতেই বলতে পারব না। বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মেরী।
মেরীর মাথায় কর্নেল হাত রেখে শান্ত করলেন।
আশা করি আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই মঁসিয়ে পোয়ারো, আবার দরকার হলে বলবেন।
কর্নেল মেরীকে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ফিরে এসে বললেন, মিস ডেবেনহ্যামের সঙ্গে এই ব্যাপারের কোনো সম্পর্কই নেই, আশা করি আপনি আপনার সীমাবদ্ধতায় থাকবেন। বলে শাসিয়ে চলে গেলেন কর্নেল।
কি প্রচণ্ড অনুমান শক্তি আপনার। সত্যিই আপনার বিশ্লেষণ ক্ষমতা দেখলে হিংসে করতে ইচ্ছে হয়, বললেন ডাক্তার।
এতে আমার কোনো কৃতিত্বই নেই। খানিকটা কাউন্টেস আন্দ্রেনী বলে গিয়েছিলেন আর বাকিটা আন্দাজ।
কাউন্টেস আন্দ্রেনী? মেরী ডেবেনহ্যামের কথা কখন বললেন?
এক গভর্নেসের কথা কাউন্টেস বলেছিলেন না?
তিনি তো মাঝবয়েসী চেহারার বর্ণনা অনুযায়ী মেরী ডেবেনহ্যামের বিপরীত, মিস ডেবেনহ্যামকে আমরা চিনতে পারি এই কারণেই। উনি ভদ্রমহিলার নাম বলেছিলেন শ্রীমতী ফ্রিবভি। নিউইয়র্কে একটি বিখ্যাত দোকানের নাম ডেবেনহ্যাম অ্যাণ্ড ফ্রিবভি। ডেবেনহ্যাম পদবীটা কাউন্টেসের মাথায় ঘুরছিল। উনি তাড়াহুড়ায় বানাতে গিয়ে বলে ফেলেন ফ্রিবভি। সেই জন্যই মিস ডেবেনহ্যামকে খুঁজতে অসুবিধা হল না।
সকলেই কি কিছু কিছু মিথ্যে বলেছেন?
সেটাই চেষ্টা করছি যাচাই করবার।
এই ট্রেনের কোনো না কোনো যাত্রী আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে যুক্ত তাহলেও আর কিন্তু অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এবার আস্তেলিও ফলকারেল্লিকে ডাকা যাক।
আন্তেলিও ফলকারেন্নি চোখে মুখে ভয়ের ছাপ নিয়ে প্রবেশ করলেন।
আমার আর কিছু নতুন করে বলার নেই।
তাই নাকি? অনেক কথাই বলার আছে আমার তো তাই মনে হয়। অন্ততঃ যেগুলো সত্যি। ফলকারেল্লি অস্বস্তি মাখানো দৃষ্টিতে তাকালেন পোয়ারোর দিকে।
সত্যি কথা!
হা। আপনার কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই যদি আপনি সব কিছু খুলে বলেন কারণ আমার সবই জানা আছে।
আপনি যে দেখছি আমেরিকান পুলিশদের মতো কথা বলছেন।
তার মানে আমেরিকান পুলিশদের সাথে আপনার মোলাকাত হয়েছিল?
না না ওরা কোনো তথ্যই পায়নি সে চেষ্টাও অবশ্য করেনি।
আর্মষ্ট্রং মামলায় তাই না। আপনি ড্রাইভার ছিলেন বোধ হয়?
অ্যাঁ। হ্যাঁ।
বিস্ফারিত চোখে তাকালেন পোয়ারোর দিকে। আপনি যখন সবই জানেন তাহলে জিজ্ঞাসা করার অর্থ কি?
এক ঝুড়ি মিথ্যা কথা সকালে বললেন কেন?
আমি চাইনি মঁসিয়ে আমার বর্তমান ব্যবসার ক্ষতি হোক এবং কালকের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমি যে নিজের কামরা থেকে বেরোইনি সেজন্য সাক্ষীর দরকার হলে আমার সহযাত্রী ইংরেজটাই সাক্ষী হবে। আমি ঐ রাশেট হারামজাদাকে খুন করিনি এবং কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না আপনারা।
আপনি এখন আসতে পারেন।
আপনারা আমার বিরুদ্ধে শুধু শুধু চক্রান্ত করছেন। বহুদিন আগেই ওকে মারার দরকার ছিল যদি আমি থাকতাম…।
আপনি এত ভাবছেন কেন? ডেইজিকে আপনি তো আর অপহরণ করেননি।
ডেইজি আহা। তাকে ভুলতে এখনো পারিনি। তার সেই মিষ্টি ডাক যে যেন সাদা গাড়িটায় এসে বসেছে। পুরোনো স্মৃতিতে দু চোখে জলে ভরে যায় ফলকারেল্লির এবং বিদায় নেন।
পোয়ারো সুইডিস মহিলাটিকে ডাকবার আদেশ দিলেন।
গ্রেটা অঁলস এলেন। তিনি আঁকুল হয়ে কাঁদছিলেন।
আপনাকে একটি মাত্র প্রশ্ন করব দয়া করে সত্যি কথাটা বলবেন। ডেইজির দেখাশোনার ভার তো আপনার হাতে ছিল তাই তো?
হা। সকালেই একথা বলতাম কিন্তু ভয়ে বলিনি। ডেইজি এবং ডেইজির মায়ের ব্যবহার সম্পর্কে সমস্ত কথাই বললেন শ্রীমতী অঁলস।
শ্রীমতী অঁলস যাবার পরই মাস্টারম্যান এসে ঘরে ঢুকল। এবং বললেন আর্মষ্ট্রং পরিবারের উনি আদালী ছিলেন এবং নিউইয়র্কের বাড়িতে পরিচারকের কাজ করতেন। আপনারা স্যার টোনিওকে অযথা সন্দেহ করবেন না। ও সারারাত নিজের কামরায় ছিল এবং ও ভীষণ নরম মনের মানুষ। সুতরাং ওর পক্ষে একাজ একেবারেই অসম্ভব।
আর কিছু বলবে?
না স্যার।
এইসব বলার পর মাস্টারম্যান চলে গেল।
বারো জন যাত্রীর মধ্যে নজনই যে আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে যুক্ত। কুক বললেন, একি এ তো তাজ্জব কাণ্ড।
নতুন অতিথিটিকে এবার দেখুন। আমেরিকান সেই গোয়েন্দা শ্রীযুক্ত হার্ডম্যান।
হার্ডম্যান সতর্কভাবে সকলের দিকে তাকাতে তাকাতে এসে বসলেন।
কি হুলুস্থুল কাণ্ড চলছে মশাই, ট্রেন না তো যেন পাগলা গারদ।
পোয়ারো হেসে বললেন, আপনার উপর তো আর্মষ্ট্রং বাড়ির বাগানের পরিচর্যার ভার ছিল। তাই না?
ওদের বাগানই ছিল না।
তবে কি খানসামার দায়িত্বে ছিলেন।
মাথা আমার খারাপ হয়নি।
আর্মস্ট্রংদের সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিল বলুন।
কিছু না।
পরোক্ষ ভাবেও না।
না, তবে ধন্যবাদ জানাতে এবং অভিনন্দন জানাতে এলাম কারণ আপনার প্রতিভা অসাধারণ। ধন্যবাদ।
আমাকে বাদ দিন আমার সঙ্গে ঐ পরিবারের কোনো যোগাযোগই ছিল না। কিন্তু আর দুজন শ্ৰীমতী হার্বাড আর শ্রীমতী স্মিট এদের সঙ্গে। এই রহস্যের সম্পূর্ণ সমাধান কি করতে পেরেছেন আপনি?
বহুক্ষণ আগেই। তাহলে বলছেন না কেন?
সত্যিই আপনারা সবাই অধৈৰ্য্য হয়ে উঠেছেন এইবার বলব। সকলের সামনে এই রহস্যের জট খুলে দেব। হার্ডম্যান আপনি বরং সকলকে এইখানে আসতে বলুন। দুটো সম্ভাব্য সমাধান আছে সেটাই সকলের সামনে পেশ করব।
সবাই খানাকামরায় এসেছেন এবং চুপচাপ ও শান্ত। কিন্তু গ্রেটা অঁলস কেঁদে চলেছেন এবং শ্রীমতী হার্বাড তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাবৃন্দ আমরা সবাই এখানে সমবেত হয়েছি স্যামুয়েল এডওয়ার্ড রাশেট ওরফে কাসেট্টির মৃত্যু সম্পর্কে তদন্তের জন্য এবং আমি আমার বক্তব্য ইংরেজী ভাষাতেই নিবেদন করব যাতে সকলেই ইংরেজী মোটামুটি বুঝতে পারেন।
এই হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য দুটি সমাধান আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব। কোনো সামাধানটি গ্রহণযোগ্য তার বিচারের ভার পুরোপুরি মঁসিয়ে কুক এবং ডাক্তার কনস্টানটাইনের উপর।
আপনারা জানেন রাশেটের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারে আজ সকালে তাকে ছুরিকাঘাতে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়। কাল সে শেষবারের মতো কণ্ডাক্টরের সাথে কথা বলেছিল রাত বারোটা সাইত্রিশ আন্দাজ। জানতে পারা যায় একটি ঘড়িও তার পায়জামার পকেটে পাওয়া যায় এবং তার থেকে আবিষ্কৃত হয় যে রাত একটা পনের মিনিটে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করে রায় দেন যে বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে তার হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। রাত বারোটা ত্রিশ মিনিট নাগাদ ট্রেন বরফ ঝড়ের কবলে পড়ে আপনারা জানেন। সুতরাং ঐ সময় ট্রেন ছেড়ে বাইরে যাওয়া কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।
নিউইয়র্ক ডিটেকটিভ এজেন্সির মিঃ হার্ডম্যান তার জবান বন্দীতে বলেছেন যে কারোর পক্ষে কোচের শেষ প্রান্ত ১৬নং কামরার (মিঃ হার্ডম্যানের) সামনে দিয়ে চলে যাওয়া সম্ভব নয় কারণ তিনি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছেছি যে হত্যাকারী এই ইস্তাম্বুল ক্যালে কোচের মধ্যেই রয়েছে। এবার বিকল্প সমাধানটি হল খুবই সহজ। মিঃ হার্ডম্যানকে রাশেট সম্ভাব্য শত্রুর বর্ণনা দিয়েছিল কারণ তার মনে মৃত্যুভয় ছিল। এবং এও বলেছিলেন যে তাকে হয়ত দ্বিতীয় রাত্রেই এই ট্রেনে হত্যার চেষ্টা করা হবে।
মিঃ হার্ডম্যানকে রাশেট যা বলেছিল তার অনেক বেশিই সে জানত। ওর শত্ৰুটি বেলগ্রেড অথবা ভিনভোকিতে ট্রেনে ওঠে। কর্নেল এবং ম্যাককুইন প্ল্যাটফর্মে নেমেছিলেন এবং ভুল করে কোচে ঢোকার দরজাটা খুলে রেখে আসেন। কণ্ডাক্টরের একটা উর্দি আর বিশেষ ধরণের চাবি লোকটা যোগাড় করে রেখেছিল। এবং এই চাবি সাধারণত রেলকর্মীদের কাছে থাকে। সুতরাং দরজা বন্ধ থাকলেও তা খোলা যায়। এই চাবি দিয়ে রাশেটের কামরায় আততায়ী যখন ঢোকে তখন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আততায়ী রাশেটকে হত্যা করে মিসেস হার্বাডের কামরায় চলে যায় মাঝের দরজাটা দিয়ে।
শ্ৰীমতী হার্বাড শুনে সম্মতি জানালেন।
পোয়ারো বলে চললেন, আততায়ী এর পর হাতের কাছে শ্রীমতী হার্বাডের ভোলোটা পেয়ে তার মধ্যেই ছোরাটা ফেলে দেয় এবং তার পোশাকের একটি বোতামও খোয়া যায় মুহূর্তের অসতর্কতার ফলে। তারপর অন্য একটি খালি কামরায় পোশাকটা ছেড়ে ঐ কামরার মহিলা যাত্রীর বাক্সে ঢুকিয়ে দেয় এবং ট্রেন ছাড়বার আগের মুহূর্তে চট করে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ে। হ্যাঁ, যে পথে সে কোচে প্রবেশ করে সেই পথেই।
কিন্তু ঘড়ির ব্যাপারটা! মিঃ হার্ডম্যান বললেন।
রাশেটের ঘড়িতে পূর্ব ইউরোপের সময় নির্দেশ করা আছে যার ফলে সব সময় সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা এগিয়ে থাকে। রাশেট জারব্রেডে এসে ঘড়ির কাটা পিছিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিল। সুতরাং সে খুন হয় সওয়া একটায় নয় সওয়া বারোটায়।
রাশেটের কামরা থেকে একটা বাজতে তেইশ মিনিটে যে স্বর শোনা গিয়েছিল তার ব্যাখ্যাটি কি?
সে স্বর হয় রাশেটের নয় হত্যাকারীর।
সেটা নাও হতে পারে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হয়ত তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন। যখন তিনি দেখলেন রাশেট মৃত তৎক্ষণাৎ কণ্ডাক্টরের উদ্দেশ্যে ডাক ঘণ্টা বাজান। পরে তার নিজের ভুল বুঝতে পারেন। কণ্ডাক্টর যদি এসে তাকেই হত্যাকারী বলে সন্দেহ করে এই কারণেই তিনি রাশেটের জবানীতে বলেছিলেন কামরার ভেতর থেকে। কণ্ডাক্টর বুঝেছিলেন তাকে প্রয়োজন নেই বলেই ফিরে গিয়েছিলেন।
মাদাম আপনি মনে হয় কিছু বলবেন?
হা নিজের ঘড়ির কাঁটা তো আর ঘোরাতে ভুলে যাইনি?
না মাদাম, আপনার কামরায় লোকটি যখন ঢোকে আপনি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। আপনি আধ ঘুমে তার উপস্থিতি অনুভব করেন ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর দুঃস্বপ্ন চোখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এবং আপনি তখন ঘন্টা বাজান। কোনো হিসাব ছিল না চেতনায় ঘুম, স্বপ্ন এসবের।
রাজকুমারী বললেন, আমার পরিচারিকাটি সে বলেছে আমার কামরায় গভীর রাতে আসার সময় সে দেখেছিল লোকটিকে।
আপনার একটা রুমাল রাশেটের কামরায় পাওয়ার ফলে যে আপনাকে সন্দেহ মুক্ত করতে উল্টোপাল্টা বলেছিল তার আনুগত্যের তারিফ করতে হয়। সে লোকটিকে দেখেছিল ঠিকই ট্রেনে তবে চলার পরে নয়, গভীর রাতে গাড়িটা যখন ভিনভোকিতে দাঁড়িয়েছিল তখনই।
সত্যিই আপনার বিচারবুদ্ধি প্রশংসনীয় মঁসিয়ে, রাজকুমারী বললেন।
না না এটা কোনো প্রকৃত রহস্যের সমাধান নয়। এই ব্যাখ্যা পুলিশ হয়ত মেনে নেবে কিন্তু এতে আমার সায় নেই, বললেন ডাক্তার।
বেশ তাহলে আমি অন্য সম্ভাব্য সমাধানটা জানিয়ে দিচ্ছি, তবে প্রথম সমাধানটি ভুললে চলবে না। বলা যায় না শেষ পর্যন্ত প্রথমটাই হয়ত গ্রহণযোগ্য বলে মনে করবেন আপনারা, বললেন পোয়ারো।
প্রথম দিন কুক খানাকামরায় বসে বলেছিলেন যে নানা দেশ নানা ভাষা আর নানা জাতের মানুষ আছেন এই যাত্রীদের মধ্যে। তখনই আমার মনে হয় একমাত্র ট্রেন বা জাহাজ ছাড়া কোথায় এমনভাবে বিভিন্ন দেশের মানুষ জমায়েত হতে পারেন। শুধুমাত্র আমেরিকাতে একটা সংসার হতে পারে নানা দেশের লোক নিয়ে। একই বাড়িতে থাকতে পারে ইতালিয়ান ড্রাইভার। ইংরেজ গভর্নেস, সুইডিস নার্স, ফরাসী পরিচারিকা ইত্যাদি। বিষয়টি একটু ভাবতেই আর্মষ্ট্রং পরিবারে কোনো ভুমিকা কাকে দেওয়া যায় সেই বিষয়ে নির্ভুল অনুমান করতে পেরেছি।
প্রত্যেক যাত্রীরই সমস্ত অদ্ভুত তথ্য পেলাম ম্যাককুইনের সাথে দ্বিতীয় বার যখন মিলিত হলাম। উনি অদ্ভুত একটি মন্তব্য করলেন, রাশেটের কামরায় একটুকরো আধপোড়া কাগজ পাওয়া গেছে। উনি সেটা শুনে বিস্মিত হলে বললেন কিন্তু সেটা তো…মানে তার পক্ষে খুবই বোকামীর কাজ হয়েছিল। ম্যাককুইন তার কথাটা ঘোরাতে গিয়ে প্রায় বলেই ফেলেছিলেন যে সেটা তো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল তার মানে তিনি চিঠিটা সম্পর্কে জানতেন। অর্থাৎ হয় তিনি বা তার সহযোগী হত্যাকারী।
মাস্টারম্যান বলেছিল যে তার মনিব ট্রেনে যাতায়াতের সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে থাকেন। অন্যান্যবার সত্যি হলেও গত রাত্রে যে প্রাণহানির আশঙ্কায় ঘুমের ওষুধ না খাওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা তার বালিশের তলায় গুলিভরা পিস্তল পাওয়া গিয়েছিল। তবে রাশেট গতরাত্রে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল অজান্তে। ঘুমের ওষুধ কে তাকে খাওয়াতে পারে? যে কোনো একজন হয় মাস্টারম্যান নয়ত ম্যাককুইন।
মিঃ হার্ডম্যানের পরিচয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না কিন্তু রাশেটকে বাঁচাতে তার অন্তরিকতা সম্বন্ধে। যদিও রাশেটকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেন তবে নিশ্চয় তিনি তার কামরাতেই থাকতেন অথবা এমন কোনো জায়গায় থাকতেন যাতে তীক্ষ্ণ নজর রাখা যায় বা মঁসিয়ে কুককে বলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন। তবে তার সাক্ষ্য থেকে এটুকু প্রমাণ হয় যে হত্যাকারী কোচের বাইরের কেউ নয়।
কর্নেল আর মেরী ডেবেনহ্যাম যে পরস্পর পরস্পরের খুব কাছাকাছি এবং ওদের অন্তরঙ্গতা আমার চোখে ধরা পড়ে যায়। তা সত্ত্বেও ওরা না চেনার ভান করে ছিলেন, দুজনে। দুজনকে সেটা বুঝতে একেবারেই অসুবিধা হয়নি। রাশেট পুলিশকে ফাঁকি দিলেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা আর্মষ্ট্রং পরিবারে যুক্ত ছিলেন তারা রাশেটকে চরম শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং চমৎকার ভাবে ছকে ফেলেন তারা।
ক্ষতচিহ্নগুলোর কথা ধরলে প্রত্যেকেই একবার করে আঘাত করেছিলেন রাশেটকে। সেইজন্যই কোনো আঘাত সমান নয়। ছোরাকেই অস্ত্র হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল যাতে সকলেই ব্যবহার করতে পারেন। অনেকে মিলে চিঠিগুলোও লিখে ছিলেন তবে ম্যাককুইন যে চিঠিগুলো আমাকে দেখান ওগুলো সম্পূর্ণ ভুয়ো এবং ধোঁকা দেবার জন্যই লেখা হয়েছিল। ম্যাককুইন আসল চিঠিগুলি নষ্ট করে ফেলেছিলেন। সম্পূর্ণ আকস্মিক ভাবেই সেই চিঠির আধপোড়া অংশ আমি পাই। হার্ডম্যানের আততায়ীর বর্ণনাটিও আজগুবি গল্প, যা কারোর ক্ষেত্রেই খাটে না আর ছদ্মবেশে থাকলে সকলের সম্বন্ধেই খাটে।
আমার অনুমান রাশেট গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হবার পর শ্রীমতী হার্বাড আর রাশেটের মাঝের কামরার দরজা দিয়ে যাত্রীরা একে একে মেরে আসে, তবে–কার আঘাতে মৃত্যু হয় সেটা বলা শক্ত।
সবই পরিকল্পনা মাফিক হবার পর নিজেরা আলোচনা করে নিয়ে এই হত্যার ব্যাপারটা জটিল করার জন্য কর্নেলের পাইপ ক্লিনার এবং রাজকুমারীর রুমাল ফেলে রেখে আসা হয় অকুস্থলে। কারণ এতে কোনো ক্ষতি নেই যেহেতু এদের সাথে আর্মস্ট্রং পরিবারের সাথে কোনো মতোই সম্পর্ক থাকতে পারে না। রাজকুমারীর শারীরিক অক্ষমতা নিয়েও দুবার ভাবতে হবে পুলিশের। এক রহস্যময়ী লাল কিমানো পরা নারীকেও হাজির করা হল এবং সেটা দেখতে কণ্ডাক্টর, মিস ডেবেনহ্যাম আর ম্যাককুইন ছাড়া আমাকেও দেখতে বাধ্য করা হল। আমারই বাক্সে কিমানোটা পাওয়া গেল। তবে সঠিক ভাবে বলতে পারছি না কিমানোটা কার। তবে মনে হয় কাউন্টেস আন্দ্রেনীর। তার জিনিষপত্রে গাউন আছে বটে তবে ড্রেসিং গাউন নেই।
আর্মষ্ট্রং পরিবারের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আমি জেনে যাবার ফলে ম্যাককুইন সবাইকে সতর্ক করে দেন এবং খুব বিচলিত হয়ে পড়েন কাউন্টেস আন্দ্ৰেনী। তিনি ব্যাগ লেভেল এবং পাসপোর্টে নাম বদল করলেন হেলেনা থেকে এলেনা। আপনারা বোধহয় আশাও করতে পারেননি সকলকে একসঙ্গে এইভাবে অভিযুক্ত করব। কণ্ডাক্টর মিশেল ছাড়া এই কাজ আপনাদের পক্ষে কখনই সম্ভব হত না। রাশেটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা সংখ্যায় বারো। কর্নেল জবানবন্দীতে বলেছিলেন আইন আদালতের আশ্রয় নেওয়াই ভালো। অর্থাৎ জুরিপ্রথার গুণকীর্তন করেন। ইংল্যাণ্ডে সাধারণত বারোজন সদস্য নিয়ে জুরি গঠিত হয়। মামলার রায়দানের জন্য আমাকে আর রাশেটকে বাদ দিয়ে, মিশেলকে নিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় তেরো। কিন্তু তেরো সংখ্যাটা অপয়া ভাবার জন্য একজন এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি হলেন কাউন্টেস আন্দ্রেনী। কাউন্ট বলেছিলেন তাঁর স্ত্রী সারারাত কামরায় ছিলেন এ কথায় অবিশ্বাস করিনি। স্ত্রীর বদলে তিনিই আঘাত করে আসেন।
দীর্ঘদিন সুনামের সাথে চাকরী করার পরও এ কাজ মিশেল করল কেন? তাকে তো ঘুষ দিয়েও বশ করা যায় না তাহলে কি মিশেল আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে যুক্ত? যদি তা হয় তবে কিভাবে? যে মেয়েটি অন্যায় ভাবে পুলিশের কাছে সন্দেহজনকভাবে মনোকষ্টে আত্মহত্যা করেছিল তখনই মনে পড়লে যে মিশেল হয়ত সেই হতভাগিনীর পিতা এবং তখনই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে উঠল। এবং ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসকেই খুনের সম্ভাব্য জায়গা হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং কিভাবে? মনে হয় কর্নেল আবাথনট আর্মষ্ট্রং-এর বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে যুদ্ধের সময় হয়ত কাজ করে থাকবেন। ইল্ডগ্রেদ স্মিটকে ভালো রাঁধুনি হিসাবে মনে হয়েছিল আমার, তবে কি আর্মষ্ট্রং-এর বাড়িতে রান্নার কাজ করত?
কথার ছলে তাকে জিজ্ঞাসা করি আপনি খুব ভালো রান্না জানেন তাই না। শ্রীমতী স্মিট এ কথায় সায় দেন। যাদের কাছেই তিনি রান্না করেছেন সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। সুতরাং পরিচারিকার কাজ তাতে রান্নার প্রশংসা পাবার সুযোগ তার থাকার কথা নয়।
মিঃ হার্ডম্যানের প্রেমিকা ছিল সেই ফরাসী মেয়েটি। শুধু এটুকু ছাড়া কোনো যোগাযোগ ছিলনা আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে। ওঁর কাছে বিদেশিনীর কথা তোলায় ওর চোখ জলে ভরে যায়। তবে উনি এমন ভান করেছিলেন যে বরফের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।
এই হত্যাকাণ্ডের রহস্যময় নাটকে শ্রীমতী হার্বাডের ভূমিকা সবচেয়ে কঠিন। এই ভূমিকায় তিনি অতুলনীয় তিনিই রাশেটের পাশের কামরায় ছিলেন। তিনি এও জানতেন যে রাশেট খুন হলে সন্দেহ তার দিকেই পড়বে তাতে তিনি পিছু না হঠে আগাগোড়া চমৎকার অভিনয় করে গেছেন। কারণ তিনি প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী শ্রীমতী আর্মষ্ট্রং-এর মা।
সত্যিই আপনি বুদ্ধিমান। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলে উঠলেন শ্রীমতী হার্বাড। আমার আরো ভালো করে খেয়াল করা উচিত ছিল। আপনি তো সবই বোঝেন। কিন্তু এটা নিশ্চয় বোঝেন নিউইয়র্কের একটি সকাল কি ভয়ঙ্কর হয়েই না ধরা দিয়েছিল কয়েকজন নিরাপরাধ মানুষের জীবনে। আমি দুঃখ যন্ত্রণায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম মঁসিয়ে, শুধু আমি নই সমস্ত আর্মস্ট্রং পরিবারে যারা ওই সময় যুক্ত ছিল তারা সকলেই। কর্নেল আবাথনট-জনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আমার জীবন রক্ষা করেছিলেন যুদ্ধের সময়। স্বৰ্গতজন আমরা বড় দুঃখে শপথ নিয়েছিলাম, বললেন শ্রীমতী হার্বাড। যে কাসেট্টিকে চরম দণ্ড দেব। বারোজন ছিলাম আমরা দলে, না না এগারোজন, ফ্রান্সে তখন সুশানের বাবা মিশেল। আমরা প্রথমে ঠিক করি লটারিতে যার নাম প্রথমে উঠবে সেই যাবে কাসেটিকে চরমদণ্ড দিতে। শেষে মত বদল হয়। আন্তেলিও প্রথম এই প্রস্তাব করে। মেরী সেটাকে ছকে ফেলে। ম্যাককুইনের সাহায্যে, ম্যাককুইন আমার মেয়ের বন্ধু স্থানীয় ছিল।
আমরা দীর্ঘদিন মাথা খাটিয়েছিলাম। রাশেটের সম্বন্ধে খোঁজ হার্ডম্যানের চেষ্টায় মেলে। হেক্টর আর মাস্টারম্যান বুদ্ধি খাঁটিয়ে চাকরী যোগাড় করে নেয়। তারা মিশেলের সাথে যোগাযোগ করে। কর্নেল বারোজনের দল যাতে হয় চেয়েছিলেন, তবে ছোরাছুরি ওঁর পছন্দ ছিল না। কিন্তু অন্য উপায় না থাকতেই এই ব্যবস্থাই পাশ হয়। মিশেলের একমাত্র সন্তান ছিল সুশান এবং খুশি মনে এই সাহায্যে ও রাজী হয়। হেক্টর আমাদের খবর দেয় যে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে কাসেট্টি ওরফে রাশেট ফিরছে। আমাদের কপাল ভালো মিশেলও ওই লাইনে কাজ করে। তাই এই সুযোগ আমরা হারাতে চাইনি এবং ট্রেনে এই সময় বাইরের লোকজন থাকার সম্ভাবনা কম ছিল।
হেলেনাকে জানাতে ওঁর স্বামী না শোনার ফলে রুগুলফ ও এল ওঁর সঙ্গে। এমনই ব্যবস্থা হেক্টর করেছিল যাতে মিশেলের রাতে ডিউটি থাকে এবং রাশেট সেদিনই টিকিট কাটে। আমরা পুরো ইস্তাম্বুল কোচটাই দখল করাবার চেষ্টা করি অবশ্যই আলাদা নামে। একটা কামরা রেল ডিরেক্টরের নামে থাকায় পাওয়া যায় না। মিঃ হ্যারিন একটা ভুয়া নাম। আমরা চাইনি অন্য কোনো লোক হেক্টরের কামরায় থাকুক তাই ভুয়ো নামে বার্থটা রিজার্ভ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আপনি এলেন… এবার আপনার সবকিছুই জলের মতে পরিষ্কার মঁসিয়ে পোয়ারো তবে আমার অনুরোধ আমাকে সব দায় মাথা পেতে নিতে দিন এবং প্রয়োজনে বারো বার রাশেটকে আঘাতে আমি প্রস্তুত ছিলাম। শুধু আমার নাতনি নয় আমার মেয়ে এমন কি অনাগত শিশুকেও সে হত্যা করেছিল। আমার জামাই জন আর সুশানের কথা ভুলে যাবেন না মঁসিয়ে। ডেইজি…
এই মধুর পৃথিবীর আলো দেখতে আরও কত শিশুকে দেননি রাশেট ভবিষ্যতেও দিত না। মিশেলের মনের অবস্থাটা ভাবুন। মেরী আর কর্নেল ওদের ভবিষ্যতও আমি নষ্ট হতে দেব না..ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ মুক্তকণ্ঠে রাশেটকে ধিক্কার জানিয়েছিল। আইন শাস্তি দেবার চেষ্টা করেছিল পারেনি কিন্তু আমরা তা পেরেছি। এটা ছিল আমাদের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যও। বয়স এবং শরীর নয় ভেঙ্গে গেছে আমার, আপনি আমাকে অভিযুক্ত করে কাঠগোড়ায় তুলুন। কিন্তু এতগুলো নবীন জীবন নষ্ট করে দেবেন না নিষ্ঠুর হবেন না।
সেই কণ্ঠস্বর যা একদা পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে কত শত মানুষকে হাসাতো কাঁদাতো ভালোবাসতে শেখাতে নিউইয়র্কের মানুষ যা শুনে পাগল হয়ে যেত। অভিভূত হয়ে যেত। পোয়ারো বন্ধুর দিকে তাকালেন।
মঁসিয়ে কুক আপনি কি বলেন?
কুক বললেন, প্রথম সমাধানটাই থাক। আমরা বরং সেটা পুলিশ এলে জানিয়ে দেব। ওটাই সঠিক সমাধান হিসাবে গ্রহণ করতে চাই। ডাক্তার আপনার কি মত? ডাক্তার কনস্টানটাইন বললেন, আমারও ঐ একই মত। পোয়ারো স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
বেশ তবে তাই হোক।