তিন – জুহা মৌলবির কড়চা
জুহা মৌলবির বাড়ি স্টেশন থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে গোকর্ণের পাশের গ্রাম চাটরা। মাথায় ফুট পাঁচেক উঁচু, বেশ নাদুসনুদুস সুডৌল চেহারা। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। গায়ের রঙটি ফরসা। অনবরত পানজর্দা খাওয়ার অভ্যেস আছে। মুখের প্রসন্নতায় আত্মসুখী ভাব আছে। ঈষৎ মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখটি স্বভাবত মাকুন্দে। অল্পকিছু নীলচে ‘চুরুকদাড়ি’ চিবুকে ঝুলছে, গোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। তিনি ‘ফরাজি’ (গোঁড়া পিউরিটান) সম্প্রদায়ের মুসলমান এবং ধর্মগুরু। এঁরা পৃথিবীর সবখানেই সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে ‘হানাফি’ সম্প্রদায়ের মুসলমানরা। তাই হানাফিরা বলেন, ‘জুহা মৌলবি গোঁফ ক্ষুরে কামান না—ধান দিয়ে একটা করে টেনে উপড়ে ফেলেন। ক্ষুর ব্যবহার না করার কারণ, ক্ষুর অপবিত্র কেশও কাটে কিনা! এবং ফরাজিরা তাই ক্ষুরকে অপবিত্র বা ‘না—পাক’ মনে করেন। ওঁরা হেঁদুর বোষ্টম—শুচিঅশুচির বড্ড ভয়। দেখে রাস্তা হাঁটেন।
এই শুনলে কার না রাগ হয়! ফরাজিকুলগুরু জুহা সাহেব জোব্বার আস্তিন গুটিয়ে খেপে—তেতে বলেন, ‘হানাফিরা জাহান্নামী—নারকী। ওরা হারামখোর অর্থাৎ নিষিদ্ধাচারী। ওরা গানবাজনা করে বা শোনে। ওরা বিড়ি তামাক খায়। ওরা কাছা দিয়ে কাপড় পরে। ওরা মেয়েদের পর্দায় রাখে না। ওরা ‘মহরম’ উৎসবে তাজিয়া গড়ে—লাঠি খেলে—মাতমজারি (বিলাপ) করে—অবিকল হিন্দুদের পুজোর শোভাযাত্রা যেমন। তাছাড়া ওরা নমাজের সময় নাভির ওপরে দুহাতে জোড় না বেঁধে তলপেটের নিচে বাঁধে। নমাজে ওরা সুরা বা শ্লোকপাঠের শেষে ‘অ্যামেন’ শব্দটা মনে মনে বলে—পুরো শ্লোকের চেয়ে আরও সশব্দে নয়।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
জুহা মৌলবি খবরের কাগজ পড়েন। অনেকগুলো সাহিত্যের কাগজের গ্রাহক তিনি। প্রায় সবগুলোই কলকাতার মুসলিম সম্পাদিত পত্রপত্রিকা। ‘আল এসলাম’, ‘নওরোজ’, ‘বুলবুল’, ‘গুলিস্তা’, ‘সওগাত’, এবং বিশেষ করে শ্রেষ্ঠ ফরাজি মৌলানা আক্রাম খাঁয়ের ‘মোহাম্মদী’। গোরাংবাবু ‘প্রবাসী’ রাখেন। কথায় কথায় একদিন বলে ফেলেছিলেন, ‘প্রবাসীর রামানন্দ চাটুয্যে তোমাদের মৌলানা আক্রাম খাঁকে কী বলেছেন জানো? আক্রমণ খাঁ!’
এই শুনে জুহা মৌলবি তাঁর প্রাণপ্রতিম বন্ধু গোরাংবাবুর বাড়ি আসা ছেড়েই দিয়েছিলেন কিছুদিন। তখন গোরাংবাবুরই ভীষণ দুঃখ হয়েছিল।…’বুঝলি মা স্বর্ণ, মৌলুবি নির্ঘাৎ রেগেছে। ব্যাটা নেড়ের রাগ, সহজে পড়বে না। হুহু, হুই, দ্যাখ স্বর্ণ’ হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছিলেন গোরাংবাবু। স্টেশনে একটা গাড়ি ছেড়ে গেল সবে। জুহা মৌলুবি ‘সফর’ শেষে বাড়ি ফিরলেন ওই গাড়িতে কাঁহা কাঁহা মুল্লুক সেই বর্ধমান হাওড়া মেদিনীপুর অব্দি ঘুরে বেড়ান উনি। শিষ্য বা পরিচিত অনুগতজন থাক বা নাই থাক, ওঁকে ঘুরতে এই রকম সফরে। কু—লোকে বলে, নিছকপেটের ধান্না ছাড়া কিছু নয়। উনি বলেন—খোদার মিশন। মুসলিম গাঁয়ে গিয়ে সটান মসজিদে উঠতে হয়। তারপর…
সেকথা পরে। সেদিন জুহা মৌলবি আড়চোখে গোরাংবাবুর ডাক্তারখানার দিকে তাকাতে তাকাতে বটতলা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁর মনেও দুঃখ প্রচুর। হঠাৎ দৌড়ে এসেছে ডাক্তারবাবুর বিধবা মেয়ে স্বর্ণলতা। ‘চাচা, মৌলুবিচাচা!’
জুহা মৌলবি দাঁড়িয়ে গেছেন। সাদা গোলটুপির ওপর জড়ানো সাদা পাগড়ি, সাদা জোব্বা পিরহান, গোড়ালির ওপর অব্দি কাবুলি পাজামা, কাঁধে দেওবন্দ শরিফের (বিহার অঞ্চলের সেরা মাদ্রাসা) সাংস্কৃতিক প্রতীকস্বরূপ সোনালি ডোরাকাটা বিশাল গামছা (অর্থাৎ যেমন শান্তিনিকেতনী চাদর), কাঁধে একটা ঝোলা। জুহা মৌলবির পাগড়িতে পাকা বটফল পড়ছে। চোখ পিটপিট করছে। যে এইমাত্র চোখে ছানি পড়ে গেল।…’কে, কে বাছা?’
স্বর্ণ মিটিমিটি হাসে।…’আমি স্বর্ণ, চাচা। আসুন, বাবা ডাকছে।’
জুহা মৌলবি ফ্যাঁচ করে নাক ঝেড়ে বলে, ‘অ—তাই বটে। মা স্বর্ণলতা! তা আমি যাই বেটি। কদ্দিন ঘরছাড়া। আমাকে যেতে দে রে আজ।’
স্বর্ণ পথ রোখে।…’উঁহু। মোটেও না। আমি বুঝি আপনার মেয়ে না? ‘সফর’ থেকে কত কী আনলেন—আমি বুঝি ভাগ পাবনা?’
কে জানে কেন, জুহা মৌলবির চোখে জল চিকচিক করে। একবার ডাক্তারখানার বারান্দায় চেয়ারে আসীন গোরাংবাবুকে দেখে নেন। একটু ইতস্তত করেন। শালা হেঁদুটা…মনে মনে বলেন। … শালা আমাদের শ্রেষ্ঠ ফরাজি মৌলানা আক্রাম খাঁকে আক্রমণ খাঁ বলেছিল! বাড় হয়েছে শালার। আর কদিন বাদে তো যাবে কোদলার ঘাটে—কাঁকড়াপোড়া হবে!
দুরন্ত স্বর্ণ অতর্কিতে ওঁর ব্যাগ ধরে টানে।…’কার ওপর এত রাগ, তা কি বুঝিনে? কিন্তু বাবা যে ওদিকে দিনরাত্তির জপছেন—নেড়ের রাগ হয়েছে মা স্বর্ণ…’
জুহা মৌলবি আর পারেন না। হা হা হো হো হাসেন।…’ওরে শালা বামুন! রোস—মজা দেখাচ্ছি!…’ বলে এক দৌড়ে গোরাংবাবুর সামনে ঝোলা থেকে একটা পত্রিকা বের করে বলেন, ‘দ্যাখ, দ্যাখ হে ডাক্তার—কেমন ঠুকেছে তোমাদের রামানন্দ চাটুয্যেকে!’
দুই বন্ধু আবার একত্র হয়। সন্ধেবেলার ভাঙা আসর জমে ওঠে। পত্রপত্রিকার খবর, ব্রিটিশ সরকারের হালচাল, গান্ধীজী, মৌলানা মহম্মদ আলী, মৌলানা শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয়… নানান প্রসঙ্গ। মৌলানা আক্রাম খাঁকে ঠাট্টা করে কথা বলেছে যারা, তারা এখনও ওঁকে ঠিক বুঝতে পারেনি। আসলে কী জানো ডাক্তার? মৌলানা বাঙালি—মুসলমানদের মধ্যে একটা রেঁনেশা ঘটাতে চান। ভীষণ কুসংস্কারে অন্ধতায় ওরা ভুগছে। মুসলমানরাই ওঁকে গাল দেয় তো অন্যেরা দেবেই। সবার বিশ্বাস হজরত মোহাম্মদ সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিলেন। মৌলানা লিখলেন—না, ওটা পয়গম্বরের স্বপ্ন। সবাই বলে—হজরত চাঁদকে আঙুলের ইশারায় দুভাগ করে দিয়েছিলেন। মৌলানা বললেন, ওটা গল্প। হজরত মোহাম্মদের ওপর অলৌকিকতা চাপানো কেন? তাহলে যে তাঁর শক্তিকেই অস্বীকার করা হয়। আর খোদাতালার রাজ্য ন্যাচারাল ল বলে কানুন রয়েছে। যা কিছু ঘটে, সেই ল অনুসারেই ঘটে। ওরা বলে, হজরত মোজেস বা মুসা ‘আছা’ অর্থাৎ লাঠির সাহায্যে সমুদ্র দু’ভাগ করে পালিয়েছিলেন অনুচরসহ। মৌলানা আক্রাম খাঁ সনতারিখ কষে দেখালেন ওই সময় চাঁদের ওই তিথিতে লোহিত সাগরের ওই অংশে ভাঁটা পড়ত এবং হেঁটে পার হওয়া যেত। ‘আছা’র প্রকৃত প্রাচীন অর্থ লাঠি নয়—গোষ্ঠী বা মণ্ডলী। পরে যখন ফেরাউন বা ফ্যারাও তাঁদের তাড়া করে এল—তখন জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। ফ্যারাও সদলবলে ডুবে মরল।
গোরাংবাবু বলেন, ‘তা যাই বলো মৌলবি সাহেব—আক্রাম খাঁর ‘ছ’ আমিও সইতে পারিনে। সাহেবকে ছাহেব বললে হাসি পায় না? তার ওপর বাংলা ভাষাটা গোল্লায় দেবার জোগাড় করেছে। রাজ্যের আরবি—ফারসি ঢুকিয়ে দিচ্ছে।’
সেই সময় স্বর্ণ এতদঞ্চলে সেকালে দুর্লভ এবং বিস্ময়কর পানীয় চা এনে ধরেছে সামনে। মৌলবি চা দেখে সব ভুলে যান।…’আহা—হা—মা, আমার বেটি রে, জানের চেরাগটি আমার!’
চেরাগ শুনে খেতে খেতে গোরাংবাবু বলেন, ‘লানটিনটা জ্বেলে দিয়ে যা স্বর্ণ।’
তখনও ওখানে হেরিকেন আসেনি। কাচঢাকা লন্ঠন—ভিতরে কুপি, তাই লানটিন। স্বর্ণ সেটা রেখে যায় বারান্দায়। জুহা মৌলবি বলেন, ‘উঠি ডাক্তারবাবু। আড়াই ক্রোশ রাস্তা ভাঙতে হবে। কদিন পরেই আবার আসছি। যাব বর্ধমান। একটা ধর্মসভা আছে। মা স্বর্ণমণি, যাই রে!’
গোরাংবাবু বলেন, ‘যেয়ো না। বাঘে ধরবে।’
জুহা মৌলবি হাসেন। বাঘের ভয় থেকেও নেই তাঁর। রাতবিরেতে কতবার স্টেশন থেকে বাড়ি গেছেন। অবশ্য বর্ষাবাদলা হলে ডাক্তারের এখানেই থেকে যান। এখন তো খটখটে খরা। আর বাঘ! বাঘের ডাক কতবার আশপাশে শুনেছেন, সামনাসামনি দেখেছেনও। কোনো বিপদ হয়নি। একবার দু—দুটো বাঘ তাঁর সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছিল—রাতটা ছিল জ্যোৎস্নার—সে গল্প স্বর্ণ কতবার শুনেছে। মৌলবিচাচার কাছে এসব গল্প শোনার চেয়ে আনন্দ আর কীসে আছে তার? জীবনে তো আর কিছু নেই—সামনে খরা চলেছে। বৃষ্টিবিহীন ধূ ধূ মাঠ! মাঠি পাথর হয়ে গেল দিনে দিনে। কী হবে!
স্বর্ণ বলে, ‘না চাচা। যেতে নেই। আরেক ভয় বেড়েছে, এখন। শোনেননি?’
জুহা মৌলবি বলেন, ‘আরে! সেই হেরুটা কই? হেরু থাকলে এগিয়ে দিয়ে আসত বরং। জ্যোৎস্না তো সেই মাঝরাত্তিরে ফুটবে। যা অন্ধকার পড়েছে! হেরু কই হে ডাক্তার?’
গোরাংবাবু অমনি গম্ভীর। ‘আর হেরু!’ বলে চুপ করে কী ভাবেন।
স্বর্ণ একটু হেসে বলে, ‘শোনেননি? হেরু ডাকাত হয়ে গেছে হঠাৎ। এই তো কিছুদিন আগে পালিতবাবুদের সবাইকে খুন করেছে। তারপর ডাবকইয়ের সেরাজুল হাজিকে আধমরা করে কীসব নিয়েছে। কোদলার ঘটকের বউ গঙ্গায় চান করছিল, গয়ে গয়না ছিল। একা চান করছিল সন্ধেবেলা। লাসটা পরে পেল। সবাই বলছে, হেরুর কাজ।’
জুহা মৌলবির মুখটা সাদা হয়ে গেছে ভয়ে—বিস্ময়ে। একমাস প্রায় ঘর ছাড়া। এসব কাণ্ড কিছুই শোনেননি। সঙ্গে কিছু টাকা রয়েছে। বাড়িতে একপাল পুষ্যি দিন গুনছে ওঁর। বুকে ঢেকি পড়তে লাগল। বলেন, ‘সর্বনাশ! অত ভালো সরল লোকটা হঠাৎ ডাকাত হল কেন?’
তারপর গোরাংবাবু ইনিয়ে—বিনিয়ে সবটা শোনালেন। শুনে তো জুহা মৌলবি থ। তাহলে রাতটা এখানে কাটানোই ভালো। মেঝেয় দুদিকে দুটো বিছানা পেতে দুই বন্ধু শোবেন। স্বর্ণ চৌকাঠে বসে গল্প শুনবে। হাই তুলবে। তারপর ভিতরঘরে শুতে যাবে। তখন গয়াপ্যাসেঞ্জার বাঁকের মুখে ঘন ঘন শিস দিচ্ছে। হাউলির ব্রিজে বেজে উঠছে : এক ধামা চাল তিনটে পটল। এইসব শুনে মন যে কোথায় চলে যেতে চায় স্বর্ণর—রেলগাড়ি চেপে চলে যায়, আর চলে যায়, সেইদিকে—যেদিকে কেবলই যাওয়া, কেবলই উদাস শিসের শব্দ, চাকায় চাকায় ধ্বনিতরঙ্গ। জুহা মৌলবি কাটোয়ায় একটা পাগলা দেখেছিলেন। সে নাকি বলত—রেলগাড়ির চাকায় কী বলে শোনরে শালারা! দোজখ থেকে দোজখে…নরক থেকে নরকে, নরক থেকে নরকে… নরকে নরকে… নরক থেকে নরকে…!
এইসব সময়ে গা শিউরে ওঠে স্বর্ণর।
গেলেন না জুহা মৌলবি। রাতের খাবারটা দরজা ভালোমত বন্ধ করে খাওয়া হবে। ফরাজি মুসলমান—তায় ধর্মগুরু; কিন্তু পেটের ব্যাপার, একটা প্রাকটিক্যাল না হলে চলে না। কত দেশ ঘুরতে হয়। সবসময় মেনে চলাও তো যায় না। এই যে উনি ধর্মসভায় (ফরাজিদের) সগর্জনে বলেন, বেনামাজি (যে নমাজ পড়ে না) যে, কাফের যে, আর যে ফরাজি নয়—তাদের হাতের পানিও হারাম—নিষিদ্ধ। অথচ সবজায়গায় না খেলে ‘সফরে’ যাওয়া হয় না। সফলে না গেলে একপাল পুষ্যিসহ উপোস করে মরতে হয়। মজার কথা, এই গোঁড়া ফরাজি জুহা মৌলবি কত অচেনা নতুন জায়গায় হানাফি মুসলমানের সমাজে দিব্যি ‘হানাফি’ সেজে যান। উপায় কী? তখন নাভির নিচে হাত বেঁধেই নমাজ পড়তে হয়, মনে মনে ‘আমিন’ বলতে হয়। মেয়েরা তাঁর সামনে হেঁটে গেলেও গর্জে তাড়া করেন না, কিংবা তারা পুরুষের মতন গোড়ালির উঁচুতে কাপড় পরেছে বলে এবং মাটিতে ঠেকিয়ে কাপড় পরার উপদেশসহ ধমকও দেন না! মনে মনে বলেন, খোদা, তোমার অধম বান্দার সামনে এত সব পরীক্ষার আয়োজন! কিন্তু কী করব? যদি আমি মনে মনে সৎ হই, তোমাতে আর তোমার সৃষ্টিতে বিশ্বাসী হয়ে থাকি, আমার সব গোনাহ ক্ষমা কি করবে না? আমার ঘরে কতজন মানুষ হাপিত্যেস করে বসে আছে ওদিকে। তুমিই তো সবার রুজিদেনেওআলা মালিক, প্রভু! আমেন… আমেন।
শোবার সময় জুহা মৌলবি বলেন, ‘এক কাবুলিওয়ালার কাণ্ড! হল কী, হাওড়া জেলার একটা গাঁয়ের রাস্তায় দেখা। আসসালামু আলাইকুম বলে হাতে হাত বাড়াল ব্যাটা। আমিও প্রত্যুত্তর দিলুম—ওয়া আলাইকুম আস—সালাম! তারপর আমার রীতি অনুযায়ী শুধোলুম—ভাইসাহাবকা মজহাব? অর্থাৎ সম্প্রদায় কী ভায়ার? বললে—ইমাম আবুল হানিফাকা মজহাব—অর্থাৎ হানাফি। হজরত মোহাম্মদের মৃত্যুর পর আরবে চারজন ইমাম অর্থাৎ ধর্মগুরু মুসলমানদের মধ্যে চারটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করেন। ইমাম আবু হানিফার সম্প্রদায়ের নাম হানাফি; ইমাম মালেকের সম্প্রদায় মালেকি, ইমাম হাম্বলের সম্প্রদায় হয় হাম্বালি, আর ইমাম শাফির সম্প্রদায় ‘শাফি’ বা ফরাজি মোহাম্মদি। আমরা ফরাজি অর্থাৎ শাফি—কিন্তু আসলে নিজেদের বলি লা—মজহাবি। অর্থাৎ কোনো সম্প্রদায় স্বীকার করিনে। হজরত মোহাম্মদ যা করেছেন, সেই শরিয়তি আচার অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চাই। ইমাম শাফির এই নির্দেশ। যাই হোক, ব্যাটা কাবুলিওয়ালা যখন পালটা জিগ্যেস করল আমার সম্প্রদায় কী, বললাম—লা—মজহাবি! শুনে ব্যাটা খেপে গিয়ে বললে, এ দেশটা আফগানিস্তান হলে এতক্ষণ আমাকে কোতল করে ফেলত। বোঝ কাণ্ড! আমাদের কেউ সইতে পারে না। তুমি তো তখন আরবের ধর্মগুরু আবদুল ওহাবের সম্প্রদায় ওহাবিদের কথা বলছিলে ডাক্তার। ওহাবিরা খিলাফত আন্দোলন করছেন। ভারতেও শুরু হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে। ওহাবিরা ব্রিটিশবিরোধী। আমরা ফারাজিরা কিন্তু ধর্মসংস্কারক আবদুল ওহাবের পন্থী—আমরা ওহাবি। কাজেই ব্রিটিশবিরোধী।’
গোরাংবাবু হাসেন!…’কংগ্রেস তো তোমাদের সমর্থন করছে। গান্ধীজীর ফতোয়া! তা হ্যাঁ হে মৌলুবি, তোমাকে ইংরেজ সায়েবরা খোঁয়াড়ে পুরছে না কেন?’
জুহা মৌলবি পালটা হাসেন। ‘এখনও মুখ খুলিনি, তাই। খুলব—খুলতে হবে একদিন একদঙ্গল পুষ্যির কথা ভেবেই দমে থাকি হে ডাক্তার!’
হঠাৎ স্বর্ণ বলে, ‘বাবা! সেদিন রাতে একটা লোক লুকিয়ে থেকে গেল আমাদের বাড়ি। সে কে?’
গোরাংবাবু চোখ টেপেন।
কিন্তু জুহা মৌলবির চোখে পড়ে যায়। চতুর দেশচরা অভিজ্ঞ মানুষ তিনি। চাপা হেসে বলেন, ‘লুকিয়ে থেকে গেল? কী সর্বনাশ! তলে তলে তুমিও ডুবে জল খাচ্ছ নাকি?’
গোরাংবাবু বলেন, ‘না—না! ও একটা লোক—মানে,…’
জুহা উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘মানে টেররিস্ট বিপ্লবী।’
‘যাঃ, চুপ করো হে! দেয়ালের কান আছে।’… গোরাং ডাক্তার স্বর্ণর ওপর বিরক্ত হয়েছেন। মুখ খুললি খুললি, এই নানান জায়গা ঘোরা লোকটার সামনে? একটু ভেবে পরক্ষণে আশার আলো দেখেন। জুহা মৌলবি ফরাজি অর্থাৎ ওহাবি। ব্রিটিশ সরকারকে দুচোখে দেখতে পারে না বটে। অনেক কথা মনে পড়ে যায় গোরাংবাবুর। মৌলবি আর যাই করুক, এ নিয়ে কোথাও মুখ খুলবে না। ইংরেজ মুসলমানদের কাছ থেকে বাদশাহি কেড়েছে, মুসলমান হিসেবে মৌলবির এতে বড্ড রাগ।
কথায় কথায় হেরু বাউরির কথা এসে পড়ল আবার। হেরুকে পুলিশে খুব খোঁজাখুঁজি করছে। সদর থেকে খোদ গোরা পুলিশ ইনসপেকটার ম্যাকডোনাল্ড এসে কাছারি বসিয়ে রিপোর্ট নিয়ে গেছে। এলাকার গেরস্থরা ঘুমোতে পারছে না। রাঢ় এলাকার যত গোরুমোষের পাইকার আঁরোয়া হয়ে কোদলার ঘাটে গঙ্গা পরিয়ে বেলডাঙার গোরুমোষের হাটে যায় প্রতি মঙ্গলবার, তারা আর এপথে ফেরে না। সঙ্গে টাকাকড়ি থাকে, তাই। ব্যাপারীরাও মুশকিলে পড়ে গেছে। স্টেশনে এখন একজন মাস্টার—অগস্তিবাবু। ভদ্রলোক শিগগির বদলি হচ্ছেন হান্টার সাহেবকে ধরে। কবে হেরুকে ইঁদারার জল খেতে দেননি, মনে পড়ে গেছে। তার ওপর নির্জন কোয়ার্টার মাঠের মধ্যে। একটা কিছু হলে কেউ জানতেও পারবে না।
সেদিন সদর থানার পুলিশ এবং এলাকার ধনী লোকদের অনুচর আর গোবরহাটির জমিদারবাবুদের পাইকবরকন্দাজ মিলে দেড়শো থেকে দুশোজন সশস্ত্র লোক আঁরোয়ার জঙ্গল তোলপাড় করেছে। কে খবর দিয়েছিল, হেরুর আড্ডা নাকি ওখানেই। কিন্তু কোথায় সে? রাঙি বউরানিকে প্রচণ্ড মার দেওয়া হয়েছে। সে বলেছে—জানে না। এদিকে গর্ভবতী মেয়ে। ওতেই পেটের বাচ্চাটা বেরিয়ে আসতে পথ পেল না! মেয়ে হয়নি—ছেলে। হেরু ছেলেকে রেলের গ্যাঙম্যান করবে বলেছিল!
‘হু, কতকগুলো ব্যাপার বেশ আশ্চর্য! হেরু একা ডাকাতি করছে—এক। হেরু বউকে নাকি পালিতবাবুকে মারার দিন থেকে আর দেখাও দ্যায়নি, পয়সাকড়ি খাবারদাবারও দ্যায়নি। রাঙি বেচারির বড় কষ্ট—দুই। হেরু যা পাচ্ছে, তা কী করছে এই একটা রহস্য—তিন। হেরু খাচ্ছে কোথায়, কে দিচ্ছে খেতে এও দারুণ রহস্য—চার। … মৌলবি! শুনছ?’
‘উঁ? হু।’
‘হুঁ—না। ঘুমোচ্ছ! ঘুমোও।’
‘না হে, বলো। তাজ্জব লাগছে।’
‘ঠিক বলেছ। হেরুর ছেলেটা দেখে এলুম কাল, বুঝলে?’
‘দেখলে নাকি?’
‘দেখলুম। কারণ, মানুষ আমার কাছে বরাবর রহস্য। তা আমাকে দেখে রাঙি খুব কাঁদতে লাগল। কী করব? দু আনা পয়সা ছিল পকেটে। রাঙামাটির মধু মণ্ডলের মেয়ের ভূতেধরা রোগ—অনেক ওঝা দেখাল, কাজ হয়নি। তখন ডেকেছিল আমাকে। গিয়ে দেখেই বুঝেছিলুম—চোখের পাতায় ঠিক লেখা ছিল : এ কেস অফ বেলেডোনা। মাত্র সিক্স এক্সেই ফিট ভাঙল। বেলেডোনা দিতে হলে চোখটা লক্ষ্য করা চাই।’
স্বর্ণ তেড়ে আসে।…’দু’আনা পয়সা দিয়ে খালি পকেটে বাড়ি এলে কাল! বাঃ! কী মিথ্যুক রে বাবা! তখন বললে,…’
গোরাংবাবু জিভ কেটে বলেন, ‘তুই আছিস এখনও? শো গে মা। রাত বেড়েছে।’
স্বর্ণ জেদে বলে, ‘শোব না। হেরুর ছেলের কথা বলো।’
‘শুনবে?’…সোৎসাহে গোরাংবাবু বলেন।… রাঙি এখন শম্ভু ঘেটেল আছে না কোদালার ঘাটে—তার বাড়ি আছে। শম্ভু বুড়োর ভাইঝি যে রাঙি। শম্ভুর বউটউ নেই। একা মানুষ। ঘরখানা খালি পড়েছিল, দেখাশোনা করছে। খাওয়াদাওয়া আর বস্তরের বিশেষ অভাব হবে না। রাঙির কপাল! ওই শম্ভু একদিন হেরুকে দেখলে দাঁত কিড়মিড় করে শাপমন্যি করত। তা বুঝলে মৌলুবি? ছেলেটা ভাই অবিকল বাপের মতন গড়ন—ছড়ালো হাত পা। গায়ের রঙ মায়ের মতন ফরসা। শম্ভুর একটা দুধী ছাগল আছে। আর ভাবনা কী?
জুহা মৌলবি বলেন, ‘হেরুর ব্যাপারে তোমাদের বাপ—ঝির বড্ড মাথাব্যথা। কেন হে?’
গোরাংবাবু বিষণ্ণমুখে বলেন, ‘বড্ড ন্যাওটা ছিল আমার। তুমি তো জানই—সন্দেবেলা এখানে ছাড়া আড্ডা ছিল না। যা বলুতম, শুনত—তার দিন—রাত্তির সময় অসময় নেই। আমার ওই ঘোড়াটা, বুঝলে মৌলবি, ঘোড়াটা ওর সাহসেই রাখা। দেখাশোনা যত্নআত্তি, ঘাস—ভুঁষি জোগানো, পুকুরধার থেকে নিয়ে আসা—সব ও ব্যাটাই করত! বেশ নিশ্চিন্ত ছিলুম। এখন বড্ড ঝামেলায় পড়া গেল। আজ বিকেলের কাণ্ড শোনো। ওই কোটালদিঘি—দেখেছ জঙ্গুলে পুকুরটা? সেখানে চরতে দিয়েছিলুম ঘোড়াটা। পিছনের দু’ঠ্যাং বাঁধা! দিব্যি জলাঘাস, পাতা খেয়ে বেড়াচ্ছে। আনতে গেলুম। ওরে বাবা! হঠাৎ ফাঁড়িঘাস থেকে ফোঁস করে উঠেছে ইয়াবড়ো চক্কারওয়ালা কেউটে! উঃ আমি তো ভাই পৃথিবীসুদ্ধ নিজেকে ভুলে গেলুম।’
‘তারপর, তারপর?’
‘কী করব? ঘোড়াটা রেখেই চলে আসতে হল। তখন স্বর্ণ—স্বর্ণ গেল। এত বারণ করলুম—শুনল না। হাতে লাঠি নিয়ে গেল। ঘোড়া নিয়ে ফিরল। সাপটাপ নাকি আমার হ্যালুসিনেশন—ভ্রম!’
দুজনে হেসে উঠল। স্বর্ণ একবার মুখ তুলে বলে, ‘আমাকে সাপে খাবে না।’
জুহা মৌলবি বলেন, ‘ওকথা বলতে নেই। সেবার এক চাঁদনি রাতে বাঁকিনদীর ঘাটের ওপর একজোড়া সাপ আমাকে তিনচার ঘণ্টা আটকে রেখেছিল।’
গল্পের গন্ধ পেয়ে চনমন করে উঠেছে স্বর্ণ। বয়স বাইশ বছর—কিন্তু মনে কিশোরীর বাসা। ‘সবটা বলুন না মৌলুবিচাচা!’
গোরাংবাবু বলেন, ‘বেচারিকে জ্বালাস নে মা। ক্লান্ত মানুষ। রাত জাগলে ভোরে ঘুম ভাঙবে না। তখন ডাবকইয়ের কোনো মুসলমান যদি দ্যাখে যে জুহামৌলুবি হিঁদুর ঘরে রাত্রিবাস করেছে!’…খুব হাসেন গোরাংবাবু।
জুহা মৌলবি বলেন, ‘হ্যাঁ—সেও তো কথা। ডাবকইয়ে ক’ঘর ফরাজিমতে শিষ্য করে এই এক জ্বালা। হ্যাঁ হে ডাক্তার, ওরা বরাবর বলেছে, ওদের গাঁয়ে চলে আসতে। ঘর করে দেবে। দেখাশোনা করবে। আসব?’
গোরাংবাবু খুশি হয়ে বলেন, ‘এসো, এসো। আমি তো বলছিই বরাবর। রেলরাস্তার ধার। স্টেশন আছে। ভালোই হবে তোমার মতন মৌলুবি লোকের পক্ষে। ও স্বর্ণ, তোর মৌলবিচাচার এক জব্বর কীর্তি শুনবি? তুই জানিসনে। তখন তো তুই শ্বশুরবাড়ি গোবরহাটিতে ছিলি।’
স্বর্ণ বলে, ‘কী কীর্তি চাচা?’
জুহা মৌলবি একটু হেসে বলেন, ‘ও তোমাদের শুনতে নেই, মা। পাপ হয়।’
গোরাংবাবু বলেন, ‘হাতি হয়! স্বর্ণর ওসব সওয়া। ওর শ্বশুরবাড়ির দোতলা থেকে মুসলমানপাড়ার সব দেখা যেত। আমি নিজেও দেখে এসেছি। বড় বড় গোরু কাটা হত ঈদের পরবের সময়। স্বর্ণ হাঁ করে দেখত। স্বর্ণকে তুমি চেন না। বলে ফেলো।’
‘তাই বুঝি?’…জুহা মৌলবি একটু ইতস্তত করে বলেন। ‘…ডাবকই গাঁয়ের মাটি এক হিন্দু জমিদারের। তাই ওখানে মুসলমানদের গোরু খাওয়া নিষেধ ছিল বরাবর। আমি ওখানে গিয়ে ক’ঘর শিষ্য করলুম—কীভাবে জানো মা?’
বাকিটা বলে দিলেন গোরাংবাবু। ফরাজি মৌলবিকে পাত্তা দেবে কেন ওই হানাফি মুসলমানরা? তখন জুহা করল কী—ওদের চাপা লোভের জায়গায় সুড়সুড়ি দিল। গাঁয়ের লোক জড়ো করে প্রকাশ্যে গোরু কাটল। খবর পেয়ে জমিদারের লোকজন আর এলাকার অনেক হিন্দু তাড়া করতে গেল লাঠিসোটা নিয়ে। তখন এই জুহা মৌলবি সেই গোরুর রান ইত্যাদি মাথায় নিয়ে হিন্দুদের দিকে এগোতে লাগল। অমনি ব্যস! সব্বাই রামনাম করতে করতে পালিয়ে গেল। সে—দৃশ্য গোরাংবাবু স্বচক্ষে দেখেছেন। আসলে একটা বীভৎস দৃশ্য তো বটে! তখন এখানে সবে রেললাইন বসছে। অনেক গোরাসায়েব ক্যাম্প করে রয়েছে। একটা বিশাল রান উপহার দিয়ে জুহা মৌলবি তাদের সমর্থন আদায় করে নিলেন। তারপর সদরে মামলা গেল। খবরের কাগজে হইচই করা হল। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গোরাসায়েব। শেষঅব্দি সব নিষ্পত্তি করা হল। ডাবকইতে যখন একজনও হিন্দু নেই—তখন সেখানে কী হল না হল, তা নিয়ে হিন্দুদের মাথাব্যথা করে কী লাভ? গত বছর হিন্দু জমিদারবাবু এক মুসলমান জমিদারবাবুকে ডাবকই মহাল বেচে দিয়ে নিষ্কৃতি লাভ করেছেন। এখন জুহা মৌলবির জয়জয়াক্কার সেখানে। কয়েকঘর ইতিমধ্যে তাঁর মতে দীক্ষা নিয়ে তৌবা করেছে। বাকি সবাই নেবে এ আশা প্রচুর।
তবে এহেন কট্টর গোঁড়া মৌলবিকে গোরাংবাবু ভালোবাসেন, এর একমাত্র কারণ গোরাংবাবুর চরিত্র। তিনি বলেন, ‘মানুষ সব্বাই ভগবানের সন্তান। কেউ ছোটবড় নয়—সবাই সমান। আর মানুষের যখন রসনা আছে যা খুশি খাবে। হাতি খাবে সাপ খাবে। খাক। পেট—এই পেট দিল কেন বিধাতা? দেখবে—এমন দিন আসবে, যখন খাবার মতন কিছু না পেয়ে মানুষ নিজেকে কামড়ে কামড়ে খাবে—নিজেকে কড়মড়িয়ে কামড়ে—কামড়ে খাবে।
স্বর্ণ বাবাকে এতদিন ভালো চিনেছে। কী বলবে? মা নেই—একা বয়স্ক মানুষ। বললে চুপচাপ বসে কাঁদবেন নীরবে। ঠিক স্বর্ণ যেমন করে। বাপ—মেয়ে স্বভাবে খুব কাছাকাছি ছিল বরাবর—এখন তো সহবাসের গুণে আরও কাছাকাছি হয়েছে। এত কাছাকাছি যে অনেক সময় কে বাবা কে মেয়ে আলাদা বুঝে ওঠাও কঠিন হয়।
তা ওইসব কীর্তি করে জুহা মৌলবির নামডাক বেড়ে গেছে সবখানে। স্বর্ণ লোকটাকে যত দেখে, ধর্ম দূরে রেখেই দেখে, এবং কেমন অবাক লাগে। এই লোকটাও তো মানুষ—অথচ তাদের মতন নয়। পুজোআচ্চা করে না—নমাজ পড়ে। ওদের ঠাকুর নেই—খোদা আছে। খোদা আবার নিরাকার। তা কী করে হয়? হয়। বাবা বুঝিয়ে দিয়েছে—আদি হিন্দুধর্মেও নিরাকার ঈশ্বরের কথা ছিল।
রতনপুরের ওমরশেখের কথা এসে পড়ে তারপর। তার ঝোলায় আবার বাইবেল গীতা কোরান সব ঠাসা। সে আর একটা অদ্ভুত মানুষ। গোরাংবাবুর আরেক নেওটা।
কিন্তু ওমরের নাম শুনেই খাপা হয়েছে জুহা মৌলবি। ‘তৌবা। ও ব্যাটা ভণ্ড—স্রেফ নাস্তিক। ছিঃ ছিঃ, ওর মুখ দেখলে গোনাহ হয়। ও হল শাস্ত্রোক্ত কলির দজ্জাল।’
গোরাংবাবু সকৌতুকে হাসেন। ওমরের সামনাসামনি পড়লে সে এক দৃশ্য। দুজনের মুখের কথা ভাবলে হাসির চোটে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে। ওর অবশ্য জুহা মৌলবিকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেই ক্ষান্ত হয়। জুহা মৌলবি ওকে লাঠিপেটা করতে বাকি রাখেন। আড়ালে চোখ নাচিয়ে বলেন, ‘সেই ফাদার ওমরচন্দ্র ঠাকুরের খবর কী?’
ওমর অনেকদিন আসেনি এদিকে। রাঙামাটি তার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। কে জানে, মেয়েকে ওরা তালাক দিলে নাকি। ওমরের মেয়ে নাকি এই উনিশ—বিশেই পাঁচসাতটা শ্বশুর ঘর ঘুরেছে। যাক, সে কথাও পরে।
কথায় কথায় রাত বাড়ে। গয়া প্যাসেঞ্জারও চলে যায়। স্বর্ণ শুতে যায় ভিতর ঘরে। ডাক্তারখানার মেঝের দুদিকে দুই বন্ধুর নাক ডাকতে থাকে একসময়।…
সে রাতে যখন চাঁদ উঠেছে, মজা ভাগীরথীর ঝিলের মাথায় ভাঙা কাঁসার থালার মতন চাঁদ—জ্যোৎস্নার ফিং ফুটেছে, হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে গেল জুহা মৌলবির। কোনো গাড়িটাড়ি গেল নাকি? কান করলেন কতক্ষণ। না। কেন ঘুম ভাঙল? একটা স্বপ্ন দেখছিলেন। চমৎকার স্বপ্ন। স্ত্রী জাহানারা বেগম আর পাঁচটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন। খুব আনন্দময় যাওয়া। হঠাৎ সব গোলমাল হয়ে গেল। স্ত্রীর কথা ছেলেমেয়েদের কথা ভাবতে—ভাবতে মন নরম হয়ে গেল। চোখে জল এল। এই এক মানুষের ওপর নির্ভর করে ওরা দুনিয়ায় বেঁচে আছে।
উঠে বসলেন জুহা মৌলবি। লানটিনটা নিভে গেছে। খোলা জানালা দিয়ে ডাক্তারের বিছানার ওপর মাখনের মতন একদলা জ্যোৎস্না পড়েছে। ডাক্তার কই? মাঝরাতে এরকম জ্যোৎস্নাপড়া খালি সাদা বিছানা দেখলে বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে। হায়, কে যেন হারিয়ে গেল!
ভাবলেন, বাইরে জল সারতে গেছেন। তাঁরও পেচ্ছাব পেল। কিন্তু সদরদরজা খুলতে সাহস হল না। বাঘের ভয় একটু ছিল, ভয়টা আজ হেরুর। যা সব শোনা গেল ওর বীভৎস কাণ্ডকীর্তি! ও ব্যাটা জুহা মৌলবির ব্যাপার জানে। সফর শেষে বাড়ি ফেরার সময় মৌলবির কাছে কী থাকে না থাকে, সব জানে। হে খোদা আমার অবলা জেনানা আর নাবালকদের মুখের রুজি—তুমি বাঁচিয়ে দিয়ো প্রভু! বিড়বিড় করতে করতে উঠলেন জুহা মৌলবি। আরবি শ্লোক পড়লেন—শয়তানের হাত থেকে পরিত্রাণ করো হে দীনদুনিয়ার বাদশাহ!
তারপর অন্দরের খোলা দরজায় উঁকি দিলেন। পায়খানার বালাই এ তল্লাটে হিন্দুদের মধ্যে নেই—এক জমিদার বাড়িটাড়ি ছাড়া। সবাই মাঠে ব্যাপারটা সেরে নেয়। কেবল ধনী মুসলমান—বিশেষ করে ফরাজি সম্প্রদায়ের ধনী গরিব সবাই খাটা পায়খানা বানিয়ে রাখে বাড়িতে। কুয়োর মতন গর্তের ওপর ছাদে—ছাদ খানিকটা ফুটো। একবার হয়েছিল কী, জুহা মৌলবি তাঁর বাড়ির পায়খানায় ওই ছাদ ধসে নিচের কুয়োয় পড়ে গিয়েছিলেন। গাগতরময় পচা মল—উঃ জাহান্নাম! ফায়ারব্রিগেড কোথায় যে ওঠাবে তাঁকে? মই নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে এক দুঃস্বপ্ন। জুহা মৌলবি ভাবলেন, গোরাংবাবু রাত্রিবেলা বাইরে না বেরিয়ে খিড়কির কাছের নর্দমায় পেচ্ছাপটা সেরে নেন। তিনিও তাই করবেন।
হঠাৎ চমকে উঠলেন জুহা। ভিতর ঘরের দরজা একটু ফাঁক হয়ে আছে। ওদিকের বারান্দার কিছু অংশে কুপির আলো গিয়ে পড়েছে। সেই আলোয় মহাকায় দৈত্যের মতন একটা লোক—আর কেউ নয়, স্বয়ং হেরু বাউরি বসে গোগ্রাসে খাচ্ছে। স্বর্ণ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। গোরাংবাবু হেরুর সামনে বসে ফিসফিসিয়ে কী বলছেন।
আর পেচ্ছাপ হল না জুহা মৌলবির। ফিরে এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। গোরাং ডাক্তার লোকটি সম্পর্কে তাঁর ধারণা বদলে গেল। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এরা বাপমেয়ে তাহলে ওই দৈত্য পুষে রেখেছে। আর সেই দৈতকে দিয়ে….
আর ভাবতে পারলেন না। গা শিউরে উঠল। তাঁর কাছে মোট সাত টাকা চার আনা তিন পয়সা আছে। প্রায় চার মণ চালের দাম। হে খোদা, বাঁচাও দুশমনের হাত থেকে। তাঁর ঝোলায় সেলাইয়ের কৌটোয় একটা মাঝারি সাইজের সূচ আছে। সেটা শিগগির বের করে নিয়ে হাতে রাখলেন। একটা ছুরিও ছিল ছোট্ট। আপাতত বিপদের সময় তার পাত্তা নেই। অগত্যা সূচটা নিয়ে চোখ বুজে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলেন।
কতক্ষণ—কতক্ষণ পরে গোরাংবাবু চুপিচুপি এসে শুয়ে পড়লেন। বাকি রাতটুকু আর ঘুম হল না জুহা মৌলবির। যেই না প্রথম কাক কোকিল ডেকেছে, অমনি চুপিচুপি কেটে পড়লেন। গোরাংবাবুর তখন নাক ডাকছে।
আঁরোয়া গ্রাম পেরোলে চারপাশের গাছপালায় নানারকম পাখি ডাকতে লাগল। সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছিল বউ কথা কউ। এই গ্রীষ্মকালের ভোরবেলায় আঁরোয়ার পথে হেঁটে যাওয়া এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। শুধু পাখির ডাক নয়, কতরকম ফুলের গন্ধ কত শ্যামলতা—যেন বেহশতের ছায়া ঠিক এই সময়ই দুনিয়ার ওপর কিছুক্ষণ পড়ে থাকে। সাবধানে চারদিক লক্ষ্য করতে করতে জুহা মৌলবি প্রায় দৌড়ে চললেন। বাঁকির ঘাটে গিয়ে একদল সবজিওয়ালা চাঁই সম্প্রদায়ের লোকের সঙ্গে দেখা হল। ওরা গঙ্গাতীরে উর্বর মাটিতে বসতি করে থাকে। কোন আমলে বিহার থেকে এসেছিল এখানে। খোট্টাই বুলি বলে। বাংলাও বলে। তরিতরকারির চাষ ওদের পেশা। আজ গোকর্ণে হাটবার। ওরা হাটে চলেছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন জুহা মৌলবি। গোকর্ণ চাটরার সবিশেষ খবর নিতে নিতে এগোলেন।
কথাটা কি গোকর্ণ ফাঁড়িতে পুলিশের কানে তুলে দেবেন? সেইসময় হঠাৎ স্বর্ণর মুখটা মনে পড়ল। থাক। কতরকম মানুষ থাকে আল্লাতলার দুনিয়ায়। কথায় বলে, আমেডুমুরে বাগান। আর মানুষ হয়ে মানুষের বিচারক হতে নেই। নিজেকে সম্বোধন করে বললেন জুহা মৌলবি—এ্যায় বান্দা সামসুজ্জোহা! তুই নিজে হাকিম সাজিস নে। ভেবে দ্যাখ, তোরও একজন হাকিম আছেন ওপরে। যা করার, তাঁকেই করতে দে। আমেন…আমেন…আমেন!