ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

৩. জগদীশের কথা

।। তিন ।। – জগদীশের কথা

পরের দিন সকালেই জগদীশ ঘোষ এসে হাজির হল।

আমাদের দুজনকে অ্যাটেনশান হয়ে লম্বা স্যালুট ঠুকে বেচারি বেচারি মুখে দাঁড়িয়ে রইল।

ভেবেছিলাম এইরকম নিরীহ কনস্টেবলদের চেহারা যেমন হয় অর্থাৎ কালোকোলো মোটাসোটা হেঁড়ে মাথা বয়স্ক—এরও সেরকম চেহারা হবে। কিন্তু দেখলাম তা নয়, বেশ স্বাস্থ্যবান, স্মার্ট চেহারা, বয়েসও অল্প।

প্রণবেশ বলল, তুমিই তো জগদীশ ঘোষ?

ইয়েস স্যার।

বোসো। কত দিন পুলিশের চাকরি করছ?

ন’ বছর পূর্ণ হয়ে পাঁচ মাস।

এখন জোড়াসাঁকোয় পোস্টেড?

ইয়েস স্যার।

এখানে কত দিন এসেছ?

দু’বছর তিন মাস।

এর আগে রাতে টহল দিয়েছ কখনো?

অনেক বার।

পরশুদিন রাতে কোথায় তোমার ডিউটি ছিল?

গণেশ টকিজের কাছে—নতুন বাজার এলাকায়।

সেদিন তুমি কিছু দেখেছিলে?

ইয়েস স্যার।

একটু গুছিয়ে বলো তো শুনি।

জগদীশ একটু ভেবে নিয়ে বলল, ওই দিন রাত্রে আমি আর রাম সিং ডিউটি দিচ্ছিলাম। রাম সিং অন্য দিকে গিয়েছিল। আমি একাই বিবেকানন্দ রোডের মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সব দোকানপাট বন্ধ। লোডশেডিং কিনা জানি না, রাস্তায় আলো জ্বলছিল না। কাছেপিঠে জনপ্রাণী ছিল না। আমার কীরকম ভয় ভয় করল। অথচ বিশ্বাস করুন স্যার, এরকম নির্জন রাতে কতবার তো ডিউটি দিয়েছি, কোনোদিন ভয় পাইনি। ভয় তো একমাত্র ডাকাতদের। তা সঙ্গে বন্দুক আছে, রাম সিং আছে। তবু কেন যেন ভয় পেলাম। মনে হল খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি ঘাড় ফিরিয়ে এদিক—ওদিক দেখছি ঠিক তখনই দেখলাম একটা তেরো—চোদ্দো বছরের ছেলে তরতর করে বিবেকানন্দ রোড ধরে যাচ্ছে। সে দৌড়চ্ছিল না, হাঁটছিল। কিন্তু এত জোর হাঁটা যেন মনে হচ্ছিল দৌড়চ্ছিল।

প্রণবেশ বাধা দিয়ে বলল, কোন দিক দিয়ে এল?

সেটা স্যার লক্ষ করিনি। টেরও পাইনি। তবে যখন বিবেকানন্দ রোড ধরে বিধান সরণি হয়ে মানিকতলার দিকে এগোচ্ছিল তখন অনুমান করি সে স্ট্র্যান্ড রোডের দিক থেকেই আসছিল।

স্ট্র্যান্ড রোড শুনেই প্রণবেশ আমার দিকে তাকাল। ও বোঝাতে চাইল বোধ হয় স্ট্র্যান্ড রোড মানেই হাওড়ার দিক থেকে।

আমি কোনো মন্তব্য করলাম না।

তারপর?

আমি স্যার, প্রথমে ভেবেছিলাম ভিখিরিদের ছেলেটেলে হবে—যারা ফুটপাথে শোয়। কিন্তু সে যেভাবে জোরে জোরে হাঁটছিল তাতে মনে হল সে কিছু চুরি করে পালাচ্ছে। তখনই আমি হাঁক দিয়ে দাঁড়াতে বললাম। কিন্তু সে শুনল না। ফের হাঁকড়ে উঠলাম। তবু সে ফিরেও তাকাল না। তখন—

ফের বাধা দিয়ে প্রণবেশ বলল, কীরকম চেহারা ছেলেটার?

কী বলব স্যার, বললে বিশ্বাস করবেন না স্রেফ একটা নড়বড়ে কঙ্কালের ওপর যেন চামড়া ঢাকা।

প্রণবেশ আবার আমার দিকে তাকাল।

পরনে কী ছিল?

অন্ধকারে ঠিক দেখতে পাইনি। তবে মস্ত লম্বা ঢিলে একটা ফতুয়া মতো। ড্রেসটাও স্যার অদ্ভুত।

বেশ তারপর?

দু—দুবার দাঁড়াতে বললাম। কিন্তু দাঁড়াল না দেখে রেগে ছুটে গেলাম ওর কাছে। বোধ হয় আমার জুতোর শব্দ পেয়ে ও একবারই শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। স্যার, বলতে গিয়ে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে—তার দু—চোখ যেন টর্চের বাল্বের মতো জ্বলছিল। কোনো মানুষের দৃষ্টি ওরকম হতে পারে না। আর মুখ? স্রেফ একটা ছোট্ট মাথার খুলির ওপর চামড়া বসানো। গাল বলে কিছু নেই। যেন গালের মাংস কেউ চেঁচে তুলে নিয়েছে। কপালটা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।

তারপর?

যদিও আমার হাত ভয়ে কাঁপছিল তবু আমি বন্দুক তুলে ধরে তেড়ে গেলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ও দৌড় লাগাল। সে দৌড়নো মানুষের মতো দৌড়নো নয়, বাতাসে সাঁতার কাটা। দু—মিনিটের মধ্যে সে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।

এই পর্যন্ত বলে জগদীশ তার বক্তব্য শেষ করল।

মিনিট পাঁচেক আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না।

একটু পরে প্রণবেশ বলল, আর কিছু লক্ষ করেছিলে?

জগদীশ একটু ভেবে বলল, ও যখন দৌড়ে দৌড়ে হাঁটছিল তখন আকাশের দিকে মুখ করে যেন স্যার বাতাস শুঁকতে শুঁকতে এগোচ্ছিল।

আর কিছু?

না স্যার।

আবার যদি ওইরকম কিছু দ্যাখো আমাদের জানাবে।

নিশ্চয় জানাব স্যার। তবে আর যেন ওকে দেখতে না হয়।

প্রণবেশ মুচকে একটু হেসে বলল, ঠিক আছে জগদীশ। তুমি এখন যেতে পার।

জগদীশ আবার আমাদের স্যালুট দিয়ে চলে গেল।

জগদীশ চলে গেলে আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।

তারপর প্রণবেশই প্রথম কথা বলল, কী বুঝলে?

রহস্যময়।

যতই রহস্যময় হোক উনি যে রাজু সুব্বাই সে বিষয়ে সন্দেহমাত্র নেই।

কিন্তু ও কী করে কলকাতায় আসবে?

প্রণবেশ হেসে বলল, যেমন করে সুদূর নেপাল থেকে তোমাদের দেশের বাড়ি হরিদেবপুরে এসেছিল।

এখানে আসার উদ্দেশ্য কী?

তাও বুঝতে পারছ না? যে কাজটা ও শেষ করবার আগেই কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলে, সেই কাজটি শেষ করার জন্যে।

অর্থাৎ আমাকে মারবার জন্যে?

সে তো আমার চেয়ে তুমিই ভালো করে জানো।

কিন্তু রাস্তা খুঁজে খুঁজে এই সল্টলেকে এসে আমায় মারতে পারবে? একটা রোগা—পটকা কঙ্কালের এতখানি ক্ষমতা? না প্রণবেশ, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারব না জগদীশ যাকে দেখেছিল সে সুব্বাই। অনেক কিছু ও বাড়িয়ে বলেছে। আসলে ও একটা রাস্তার ভিখিরির ছেলে ছাড়া আর কিছু নয়।

তাই যদি হয় তাহলে মঙ্গল। ঠিক আছে, এখন আমাদের চোখ রাখতে হবে খবরের কাগজে। গভীর রাতে আর কেউ ওকে অন্য কোথাও দেখতে পায় কিনা।