লোকে বলে, চোরেক্কে চোর, চোর দু-গুনে টকাই। তা কথাটা মিথ্যে নয়। টকাইকে শুধু চোর বললে গুণী মানুষের অমর্যাদা হয়। এই যেমন কেতুগাঁয়ের হরমন ওস্তাগর। সে কি শুধু দরজি? তা হলে তার হাতের তৈরি পায়জামা পরে রাস্তায় বেরোলে চারদিকে ঠেলাঠেলি পড়ে যায় কেন? আর কেনই বা কেয়াবাত কেয়াবাত ধ্বনি শোনা যায়, মাঝের গাঁয়ের নটবর অতি সুপুরুষ। বিয়ে করতে গেলে হরমনের তৈরি পাঞ্জাবি পরে। তা বিয়ে বাড়িতে বরকে দেখে বরের পাঞ্জাবির প্রশংসায় লোকে এমন শোরগোল তুলে ফেলল যে, নটবর বিয়ে না করেই ফেরত এসেছিল। শুধু কি তাই? হরমনের তৈরি হাফ পেন্টুল পরে কালীপুরের বিখ্যাত কাপুরুষ অভয়পদ অবধি একদিন দিব্যি নিশিদারোগার চোখে চোখ রেখে বুক ফুলিয়ে কথা কয়ে এল। পরে অবস্য ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা মনে পড়ায় সে ভিরমি খায়। গুণী মানুষের অভাব নেই এ-তল্লাটে। ওই যে খয়রাপোতার ফকির জোলা, রোগাভোগা বুড়ো মানুষ ক্ষয়াটে চেহারা, রুক্ষ দাড়ি আর পাকা চুলে তেমন আহামরি কেউ বলে মনেও হয় না। ঘরে কেঠো তাতে গামছা আর লুঙ্গি বানিয়ে বুড়ো হল। তার ওইসব লুঙ্গি আর গামছার জন্য বছরখানেক আগে থেকে আগাম দাম দিয়ে নাম লিখিয়ে রাখতে হয়। হাটের জিনিস তো নয় যে, পয়সা ফেললেই পাওয়া যাবে। ফকিরের লুঙ্গি আর গামছার সমঝদার সব নবাব-বাদশা গোছের লোক। হিল্লি-দিল্লি থেকে লোক এসে মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে যায়। এ-তল্লাটের লোক সে জিনিস চোখেও দেখতে পায় না। তবে বিক্রমগড়ের রানিমার জন্য একখানা বেনারসী বুনে দিয়েছিল ফকির। মাঘী পূর্ণিমার স্নানের দিন বেনারসীখানা পরে হাতিতে চেপে চানে যাচ্ছিলেন রানিমা। তা বেনারসীটা দেখে হাতিও নাকি সেলাম দিয়েছিল। পরে লোকে বলেছিল, রানি না রামধনু তা যেন ভালো করে বোঝাই গেল না, আহা কী রং! কী জেল্লা! চোখ সার্থক। আর তায়েবগঞ্জের মানুষখেকো বাঘের গপ্পো তো সবাই জানে। তায়েবগঞ্জের ধার ঘেঁষে খয়রাপোতার গভীর জঙ্গলের ধারে মতি পাড়ুই হারানো ছাগল দুখিয়াকে খুঁজতে গিয়ে পড়ে গেল বাঘের খপ্পরে। মতি মনের দুঃখে দুখিয়াকে ডাকতে-ডাকতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কাঁধে এসে পড়ল বিশাল একখানা থাবা। একটি থাবায় তাকে মাটিতে ফেলে বাঘ বেশ করে দিনান্তে জলযোগ সেরে নিতে সবে হাঁ করেছে, ঠিক সেই সময়েই সন্ধের মুখে একটু দূরে নিজের একডেরে ঘরটিতে বসে তমিজ মিয়া পূরবীতে তান ধরলেন। বাস, বাঘ আর কামড় বসাতেই পারল না। খানিকক্ষণ উদাস নয়নে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। হিংস্র বাঘ হয়ে গেল স্বপ্নাতুর, থাবার নখ লুকিয়ে ফেলে সেই থাবা দিয়েই চোখের জল মুছতে মুছতে ধীর পায়ে জঙ্গলে ফিরে গেল। একদিন গভীর রাতে তমিজ মিয়া দরবারি কানাডায় আলাপ ধরেছেন, সেইসময়ে তাঁর বাড়ির সামনে গালপাট্টাওয়ালা, জরির সাজ পরা একটা লোককে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে গাঁয়ের চৌকিদার রামলাখন চৌবে গিয়ে লোকটাকে চোখ রাঙিয়ে জিগ্যেস করেছিল, ক্যা রে চোট্টা, ক্যা মতলব?
লোকটা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, চোপ, এখন গন্ডগোল কোরো না, আমি মিয়া তানসেন, তমিজের গান শুনতে চলে। এসেছি। সেই কথা শুনে রামলাখনের দাঁতকপাটি লেগেছিল।
কথাটা হল, এইসব গুণী মানুষের পাশাপাশি টকাইকেও ধরতে হয়। ওরে বাপু, গাঁ-দেশে চোরের অভাব কী? তবে সেইসব নির্ঘিম্নে চোরেদের দলে তো আর টকাইকে ফেলা যায় না। ছা-পোষা গেরস্তদের ঘরে সে কখনও পায়ের ধুলো দেয়নি। নজর সর্বদা উঁচু। লাখপতি, কোটিপতি ছাড়া তার রোচে না। তার গুণের কথা না বললে অধর্ম হবে। কাউকে সে সর্বস্বান্ত করে আসে না। লাখ টাকার নাগাল পেলেও সে অর্ধেকটা ছেড়ে অর্ধেকটা নেয়। কারও বাড়িতে আবার পরদিনের বাজার-খরচ রেখে আসে।
গোবরদহের মহেন্দ্র সৎচাষির বিশটি হাজার টাকা সে লোপাট করেছিল বটে, কিন্তু তার খোকাখুকুর জন্য রঙিন পোশাক, খেলনা আর তার বউয়ের জন্য দামি শাড়ি রেখে এসেছিল।
লোকে তাই পঞ্চমুখে বলে, হ্যাঁ, টকাই সহবত জানে বটে।
প্রতাপপুরের নকুল প্রতিহার সেদিন চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডায় নিজের বাড়ির চুল্লির গল্প ফেঁদে বলল, যাই বলল, এমন চোরের কাছে বোকা বনেও সুখ। কী বলব ভাই, দরজায় ভিতর থেকে লোহার বাটাম দেওয়া, তালা মারা, তার উপর আমার সজাগ ঘুম। শেষরাত্রে দেখি, দরজা যেমনকে তেমন বন্ধ আছে। পাশের দরজাটাও দেখলাম আঁট করে সাঁটা, বাথরুম ঘুরে এসে জল খেয়ে শুতে যেতেই হঠাৎ খটকাটা লাগল। আচ্ছা, আমার সদর দরজা তো একটা! তবে দুটো দরজা দেখলাম কেন? তাড়াতাড়ি উঠে বাতি জ্বেলে দেখি, কী বলব ভাই, দেওয়াল কেটে রাতারাতি কে যেন ভারী যত্ন করে দুনম্বর দরজাটা বানিয়ে গেছে। তখন চৈতন্য হল, তাই তো, খালধারের জমি বেচে লাখদুই টাকা পেয়ে লোহার আলমারিতে রেখেছিলাম যে! তা দেখলাম, আলমারিটাই নেই। অবশ্য তার বদলে ঝাঁ-চকচকে একটা নতুন আলমারি কেউ দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে। তাতে লাখখানেক টাকা যত্ন করে রাখা আছে। আমার বউয়ের চল্লিশ ভরি গয়না নেই বটে, কিন্তু মেয়ের বিয়ের জন্য গড়ানো গয়নাগুলো সাজিয়ে রেখে গেছে। রাগ করব কী মশাই, চোখে জল এল। কই হে পোদ্দার, তোমার সেই গল্পটা বলো না, সবাই শুনুক।
বিরিঞ্চি পোদ্দার মুখ থেকে হুঁকোটা সরিয়ে বলল, ওঃ, সে এক কাণ্ডই বটে। মাঝরাত্তিরে হঠাৎ সংস্কৃত মন্ত্র পাঠ হচ্ছে শুনে ধড়মড় করে উঠে দেখি, পাশের ঘরে তিন চারজন জটাজুটধারী সাধু মাঝখানে ধুনি জ্বেলে একমনে যজ্ঞ করছে। দেখে তো আমি আর গিন্নি ভ্যাবাচ্যাকা। অশৈলী কাণ্ড যাকে বলে! কিছুই বুঝতে না পেরে আমি আর গিন্নি গুটি-গুটি গিয়ে জোড়হাতে পিছনে বসে যজ্ঞ দেখতে লাগলাম। বলব কী ভাই, বিশুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্রে নিখুঁত যজ্ঞ।
দেখলে পাষণ্ডেরও ভক্তিভাব এসে পড়ে। তা ঘণ্টাখানেক মুগ্ধ হয়ে যজ্ঞ দেখলাম। তারপর বড় সাধু আমার দিকে ফিরে বলল, অবাক হচ্ছিস যে ব্যাটা! এই সাড়ে তিনশো বছর বয়সে হিমালয় থেকে এতদূর ঠেঙিয়ে কি এমনি এসেছি রে আহাম্মক! তোর রিষ্টি কাটাব বলেই আসা। নে, যজ্ঞের তিলক কপালে সেঁটে এবার নিশ্চিন্তে ঘুমো। রিষ্টি কেটে গেছে।
আমি খুঁতখুঁত করে বললাম, যজ্ঞ করলেন, সে তো খুব ভালো কথা! কিন্তু একটু ডাকলেও তো পারতেন, দরজা খুলে দিতুম।
সাধু অট্টহাসি হেসে বলে, কোনও দরজা কি আমাদের আটকাতে পারে রে বোকা! সূক্ষ্ম দেহে সর্বত্র যাতায়াত। ডাকাডাকি করে পাড়াসুদ্ধ লোকের ঘুম ভাঙানো কি ভালো রে বদ্ধ জীব? তা হলে যে সবাই টানাহ্যাঁচড়া করে তাদের বাড়িতে নেওয়ার চেষ্টা করত। এবারটায় শুধু তোর জন্যই আসা কিনা!
তা সেই কথা শুনে কেমন যেন ভ্যাবলা হয়ে গেলাম, মাথাটা কাজ করছিল না। গিন্নি তো কেঁদেকেটে একশা। ধাঁ করে একশো এক টাকা প্রণামী দিয়ে ফেলল। তা সাধুরা। প্রণামী ছুঁলও না। বড়সাধু বলল, টাকাপয়সা নোংরা জিনিস। ওসব আমরা দুই না। গিন্নি তখন হাতের দু-গাছা বালা খুলে দিয়ে বলল, না নিলে গলায় দড়ি দেব বাবা।
সাধু নাকটাক কুঁচকে চেলাদের বলল, নে, তুলে নে। গরিব-দুঃখীর কাজে লাগাস। তারপর তারা বিদায় হল। পরদিন সকালে দেখি, আলমারি আর বাক্স-প্যাটরা সব ফাঁক। ও চোর শুধু চুরি করতেই আসে না রে ভাই, শিক্ষেও দিতে আসে।
সবাই একমত হয়ে বলল, তা বটে!
.
তা টকাইয়ের নামডাক আছে বটে, কিন্তু ইদানীং তার কেমন যেন একটু বৈরাগ্য এসেছে। সারাদিন ক্ষণে-ক্ষণে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে আর মাঝে-মাঝে হাহাকার করে ওঠে, ওঃ বড় পাপ হয়ে গেল রে।
তার চেলাচামুণ্ডার অভাব নেই। চেলাদের মধ্যে নবা হল তার একেবারে ছায়া। সর্বদা সঙ্গে সেঁটে আছে। সেবাটেবাও করে খুব। তা টকাইয়ের এসব লক্ষণ তার মোটেই ভালো ঠেকছে না।
বেড়ে বিষ্ণুপুরের মহাজন হরমোহন পালের গদিতে হানা দিয়েছিল টকাই। গেল হপ্তার রোববারের ঘটনা। চারখানা জাম্বুবান তালা চোখের পলকে খুলে ফেলল। ভিতরে ঢুকে মজবুত লোহার সিন্দুকের গায়ে মোলয়েম করে হাত বোলাল, আর তাইতেই সিন্দুকের ভারী পাল্লাটাও যেন অবাক হয়ে হাঁ করে ফেলল। ভিতরে না হোক বন্ধকি গয়না আর মোহর আর রুপোর জিনিস মিলিয়ে তিন-চার লাখ টাকার মাল। টকাই তবু শেষ মুহূর্তে হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল, এসব করা কি ঠিক হচ্ছে রে। লোকে কত খেটেপিটে রোজগার করে, কত কষ্টে এক পয়সা দুপয়সা করে জমায়। আর আমি পাষণ্ড সেসব লেপেপুঁছে নিয়ে আসি। এ কি ভালো? এসব পাপের কি ক্ষয় আছে? সাত বছর গঙ্গায় ডুবে থাকলে বা সাত হাজার ব্রাহ্মণভোজন করালেও গা থেকে পাপের গন্ধ যাবে না। মরার পর যমরাজা হয়তো আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বলবেন, ওরে বাপ, এই ঘোর পাপীটাকে নরকে দিলে যে নরকও অপবিত্র হয়ে যাবে।
নবা জানে, ওস্তাদের আজকাল বড় অনুতাপ যাচ্ছে। সাবধানে কথা কইতে হয়। সে মোলায়েম গলায় ফিসফিস করে বলল, আজ্ঞে, আপনি জ্ঞানী মানুষ, আপনার কথার উপরে তো কথা চলে না। তবে কিনা ওস্তাদ, আমরা কি আর ইচ্ছে করে চুরি করি? আমাদের পেট আর অদৃষ্টই যে এ-লাইনে টেনে আনল, আমাদের দোষ কী বলুন!
টকাই তবু ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল, ওটা কোনও যুক্তি নয় রে নবা! অভাব, কষ্ট, পেটের দায় থাকলেই কি আর লোকে চুরি করে? তা হলে তো ভিতরে ভিতরে আমি দগ্ধে মরে যাচ্ছি। সোনাদানা, টাকাপয়সায় আমার বড় অরুচি হয়েছে। এখন আমার সাধুসঙ্গ করা দরকার। খোঁজ নে তো, ভালো সাধু কে আছেন কাছেপিঠে। ধর্মকথা না শুনলে আমার মনটা শান্ত হবে না রে।
ওস্তাদের কথা অমান্যই বা করে কী করে? তাই নবা পরদিন থেকে খুঁজতে শুরু করে তেরাত্তিরের মাথায় খবর আনল, ময়নাগড়ের উত্তরের জঙ্গলে একজন সাধুগোছের লোক আছেন বটে, তার নাম জটাবাবা। জনসমক্ষে বড় একটা বেরোন না। জঙ্গলের মধ্যে কুটির বানিয়ে আপন মনে সাধনভজন নিয়ে থাকেন।
শুনে টকাইয়ের চোখ উজ্জ্বল হল। বলল, বাঃ, এরকম সাধুই তো চাই।
টকাইয়ের অগম্য জায়গা নেই। পরদিন সকালেই সে ময়নাগড়ের উত্তরের জঙ্গলে গিয়ে হাজির হয়ে গেল। পেত্নি জলার ধারে ফলসাবন, সেটা পেরিয়ে গহীন জঙ্গল। তার মধ্যে একটা বটগাছের তলায় জটাবাবার কুটির খুঁজে বের করতে বিশেষ কষ্ট হল না টকাইয়ের।
কুটিরের চেহারা দেখে অবশ্য কুটির বলে বোঝবার উপায় নেই। রাজ্যের ডালপালা, পাতানাতা দিয়ে কোনওরকমে একটা স্থূপাকার জিনিস খাড়া করা হয়েছে। উপরে খেজুরপাতার ছাউনি, কুটিরে ঢোকার একটা ফোকর আছে বটে, তবে দরজা-জানলার বালাই নেই। বাইরে থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হয়, রাজ্যের শুকনো গাছপালা কেউ জড়ো করে রেখেছে। লোকের বাড়িতে রাতবিরেতে ঢোকা টকাইয়ের কাছে জলভাত। কিন্তু সাধু-মহাত্মাদের ঠেক-এ তো আর ওরকমভাবে ঢোকা যায় না। তাই টকাই বাইরে থেকেই হাত জোড় করে জটাবাবার উদ্দেশ্যে মোলায়েম গলায় বলল, বাবা!
ভিতর থেকে প্রথমটায় কোনও সাড়া এল না। গলাখাঁকারি দিয়ে টকাই ফের ডাকল, বাবা!
সাড়া নেই। বারপাঁচেক ডাকাডাকির পর ভিতর থেকে একটা বাজখাই গলা বলল, কে তুই?
আজ্ঞে, আমি এক পাপিষ্ঠ। আমার নাম টকাই।
কী চাস?
টকাই গদগদ গলায় বলল, আপনার দয়া চাই বাবা।
ভিতরে আয়।
ফোকরটা দিয়ে সাবধানে বুক ঘষটে ঢুকে পড়ল টকাই, সঙ্গে নবাও।
ভিতরটা অন্ধকার বটে, কিন্তু অন্ধকারেই টকাইয়ের কাজকারবার বলে সে সবই স্পষ্ট দেখতে পেল। একটা কম্বলে ঢাকা উঁচু বেদির মতো আসনে জটাজুটধারী লম্বাটে রোগা চেহারার বেশ তেজস্বী একজন মানুষ বসে আছেন। দাড়িগোঁফ কালোই বটে, তবুও বয়স হয়েছে বোঝা যায়। এই শীতেও খালি গা, তাতে ছাইমাখা। পাশে চিমটে, কমণ্ডলু, বেদির একপাশে বৌলওলা খড়ম। সামনে ধুনি জুলছিল, তবে এখন মিইয়ে গিয়ে ধিকিধিকি ছাইচাপা একটু আগুনের আভাস দেখা যাচ্ছে মাত্র। ধুনির বাঁ-ধারে একটা লম্বাপনা ফরসামলো ছোঁকরা বসে আছে। তবে তাকে সাধুর চেলা বলে মনে হয় না। তার গায়ে ঢোলা পোশাক, একটা বাদ্যযন্ত্র আর একটা পোঁটলা।
জটাবাবাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে টকাই আর নবা ঠান্ডা ভেজা-ভেজা মাটিতেই বসে পড়ল।
জটাবাবা মিটমিট করে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, সঙ্গে ওটি কে?
জোড়হাতে টকাই বলল, আর-এক পাপিষ্ঠ, আমার সাঙাত নবা।
জটাবাবা মজবুত সাদা দাঁত দেখিয়ে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, কী পাপ করেছিস বল তো?
আজ্ঞে, আমি চোর।
জটাবাবা যেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। একটু ভেবে বললেন, তা চুরি করা কি পাপ?
পাপ নয়! বলেন কী মহারাজ? চুরি করা তো ভয়ংকর পিপ বলেই জানি।
জটাবাবা যেন আরও চিন্তিত হয়ে বললেন, সে তো শুনলাম, কিন্তু কোন আইনে পাপ হচ্ছে সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। ওরে বাপু হিজিবিজি, তুই জানিস?
যে ছেলেটা ধুনির পাশে বসেছিল সে হাতে একটা চৌকোমতো ক্যালকুলেটর গোছের যন্ত্রে কী যেন দেখছিল। অখণ্ড মনোযোগ।
এ কথার জবাব দিল না। একটুক্ষণ হাতের যন্ত্রটার দিকে চেয়ে থেকে তারপর মাথা নেড়ে বলল, না, জানি না।
ফাঁপরে পড়ে টকাই বলল, চুরি করা তো সবাই পাপ বলেই জানে।
জটাবাবা ভাবিত মুখে বললেন, তা জানলেই তো হবে। দুনিয়ার সব জিনিসই ভগবানের সৃষ্টি, নাকি রে? আজ্ঞে, সে তো ঠিকই।
তুইও ভগবানেরই সৃষ্টি জীব।
যে আজ্ঞে, তাই তো হওয়ার কথা।
তা হলে ভগবানের যা কিছু সৃষ্টি, সবতাতেই তোর হক আছে। তা হলে অন্যের জিনিস বলে তো কিছু নেই। সবই তোর এবং সবার। তা হলে চুরিকে পাপ বলি কী করে?
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নড়েচড়ে বসে টকাই বলল, তা হলে কি চুরি করা পাপ নয় বাবা? লোকে কি ভুল বলে?
জটাবাবা গভীর চিন্তিত মুখে বলেন, ওরে দাঁড়া, দাঁড়া। অত হুড়ো দিলে কি হয়? ধর, গাছ থেকে একটা ফল পেড়ে নিলি, সেটাও কি গাছের সম্পত্তি নয়? তা হলে সেও তো চুরি! যদি হিসেব করে বিচার করে দেখিস, তা হলে মানুষেরপ্রায় সব কাজই তো চুরির খাতেই ধরতে হয়।
তা হলে কি আমার পাপ হয়নি বাবা?
উঁহু, তাও বলা যাচ্ছে না। আরও ভেবে দেখতে হবে। এই সক্কালবেলায় এসে বড় চিন্তায় ফেলে দিলি বাপ! ওরে বাপু হিজিবিজি, একটু ভেবে দ্যাখ তো, চুরিটাকে পাপের খাতে ধরা যায় কিনা।
হিজিবিজি নামের ছেলেটা তার হাতের যন্ত্রটা ঝোলায় পুরে টকাইয়ের দিকে চেয়ে বেশ হাসি-হাসি মুখ করে বলল, আপনি চুরি করেন বুঝি?
জটাবাবা যখন একে নেকনজরে দেখেন, তখন ইনিও একজন মহাত্মাই হবেন ভেবে টকাই হাতজোড় করে বলল, যে আজ্ঞে, নিজের উপর বড় ঘেন্না হচ্ছে আজকাল। তা আপনারা সাধু-মহাত্মা লোক, আপনারা যদি ভেবেচিন্তে একটা নিদান দেন তো প্রাণটা জুড়োয়।
হিজিবিজি একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা যে একজন ভাল চোরই খুঁজছি। কিন্তু মনের মতো চোরই কি আর পাওয়া যায়? এ পর্যন্ত অনেক বেছেগুছে সাতজনকে বের করেছি বটে। কিন্তু তাদেরও নানা খাকতি। কারও হাত চলে তো পা চলে না, কেউ দিনকানা, কেউ ভারী আনমনা, কারও বা ভূতের ভয়। তা আপনি কেমন চোর?
নবা হঠাৎ ফুঁসে উঠে বলল, তুমিই বা কেমন লোক হে ছোঁকরা, টকাই ওস্তাদের মুখের উপর জিগ্যেস করছ, কেমন চোর? এ তল্লাটে যার কাছে টকাই ওস্তাদের নাম বলবে, সে-ই জোড়হাত কপালে ঠেকাবে। বলি, টকাই ওস্তাদের নাম শোনোনি, এতদিন কি বিলেতে ছিলে নাকি?
টকাই বিরক্ত হয়ে নবাকে ধমক দিয়ে বলে, আঃ, সাধুমানুষের সঙ্গে ওভাবে কথা কইতে আছে? ওঁরা সাধনভজন নিয়ে থাকেন, চুরি-চামারির খবর রাখবেন কী করে?
ছেলেটা হঠাৎ চোখ বড়-বড় করে বলল, ও, আপনিই টকাই ওস্তাদ? তাই বলুন, আপনি তো প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ।
নবা বুক চিতিয়ে বলল, তা হলেই বুঝে দ্যাখো বাপু, কার সঙ্গে কথা কইছ! তিন-তিনবার নিখিল ভারত পরস্পাপহরক সমিতির বর্ষসেরা হয়ে সোনার মেডেল পেয়েছেন। রাজ্যস্তরে পাঁচবার চোর-চ্যাম্পিয়ন। দেশের সেরা সম্মান তস্কররত্নও দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। টকাই ওস্তাদের মর্ম তুমি কী বুঝবে হে সেদিনের ছোঁকরা?
হিজিবিজি লাজুক একটু হেসে ভারী লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, ছি ছি, এরকম একজন গুণী মানুষকে চিনতে না পারায় ভারী বেয়াদপি হয়ে গেছে। আমি ছোট ছেলে বলে মাপ করে দিন। মাত্র বারো বছর বয়স, কত কী শেখার বাকি!
নবা চোখ পিটপিট করে বলল, কার বারো বছর বয়স?
আমার কথাই বলছি।
শোনো বাপু, একসময় মালদহে দুশো আমকে একশো বলে ধরা হত। দেদার আম ফলত বলে ওটাই ছিল রেওয়াজ। একশো আম কিনলে একশো আম ফাউ। তা তুমি কত বছরে এক বছর ধরছ?
ছেলেটা মিষ্টি হেসে বলল, হিসেব খুব সোজা। আমাদের দেশে আঠারো মাসে বছর কিনা!
কেন হে বাপু, তোমাদের আঠারো মাসে বছর কেন? বারো মাসে সুবিধে হচ্ছে না বুঝি!
আমাদের বছর বড় গড়িমসি করে ঘোরে যে! তার বড্ড আলিস্যি। তার উপর আপনাদের চেনা তিরিশটি দিন পেরোলেই মাস পুরে যায়। আমাদের কী তা হওয়ার জো আছে? মাস আর পুরোতেই চায় না। গড়াতে-গড়াতে সেই একশো কুড়ি দিনে মাস পূর্ণ হয়।
চোখ গোল-গোল করে শুনছিল নবা, বলল, ও বাবা! এ যে একেবারে বোম্বাই মাস হে বাপু! মাসমাইনে পেতে গেরস্তের যে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়। একশো কুড়ি দিন মানে কত হপ্তায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে বলো তো?
হপ্তা? না মশাই, আমাদের হপ্তা নেই। আমাদের হল। দশ!
দশ জন্মে শুনিনি বাপু, সে আবার কী বস্তু? ভারী লজ্জায় মরমে মরে গিয়ে হিজিবিজি বলে, আপনাদের যেমন সাতদিনে হপ্তা, আমাদের তেমনই দশতা। আমাদের বড় ঢিলাঢালা ব্যাপার মশাই। সকালে সুয্যিঠাকুর উদয় হলেন বটে, কিন্তু তারপর আর নড়তেই চান না। মধ্য গগনে উঠছেন, যেন বেতো রুগি। সকালে আমাদের বারতিনেক প্রাতঃরাশ করতে হয়। মধ্যাহ্নভোজনও কম করে বারতিনেক। নৈশভোজও ধরুন তিন থেকে চারবার।
বাপ রে! তবে তো খেয়েই তোমরা ফতুর!
তা তো বটেই। কিন্তু কী করা যাবে বলুন! আমাদের যে বাহাত্তর ঘণ্টায় একটা দিন।
বলো কী হে?
তাও যদি আপনাদের ঘণ্টার মতো চটজলদি ঘণ্টা হত। তা ধরুন, আমাদের ঘণ্টার মাপটাও একটু বেঢপ রকমের। মোট একশো আশি মিনিট।
বটে হে!
তার উপর আবার এক মিনিটও কী সহজে হয়? দুশো চল্লিশ সেকেন্ড পর মিনিটের কাঁটা নড়ে।
বাপ রে! না বাপু, তা হলে তোমার ন্যায্য বারো বছর বয়সই বটে। বরং একটু বেশিই ধরা হচ্ছে। আট কী সাত হলেই যেন মানায়। তা তোমাদের দেশটা কোথায় বলল
তো! শুনেছি, বিলেতে নাকি ওরকম সব অশৈলী কাণ্ড হয়। সেখানে কাকের রং সাদা, বিধবাদের একদাশী নেই, শীতকালে আকাশ থেকে কাঠি-বরফ পড়ে।
হিজিবিজি ভাল মানুষের মতো মুখ করে বলে, বিলেত নয়, আমার দেশটা একটু দূরে। নবা মাথা নেড়ে বলে, তা হয় কী করে? বিলেতের পরই তো পৃথিবী শেষ। তারপর আর ডাঙা জমিই নেই।
আমার দেশটা ওদিকপানে নয় কিনা!
তবে কোন দিকটায় বলো তো! সাতবেড়ে পেরিয়ে নাকি? সাতবেড়েয় আমার খুড়শ্বশুরের বাড়ি কিনা! জব্বর জায়গা। তা শুনেছি বটে সাতবেড়ে পেরিয়ে ঘুরঘুট্টি নামে একটা জায়গা আছে, সেখানে হাটে ভূতের তেল বিক্রি হয়। সেখানে নৃমুণ্ডমালিনী নামে এক ধরনের গাছ আছে, লাল টকটকে ইয়া বড়-বড় ফুল হয়, তারপর ফুলের ভিতর থেকে নরমুণ্ডের মতো ফল বেরোয়। সেই গাছে পাখি বাসা বাঁধে না, তলা দিয়ে মানুষ কেন, কুকুর-বিড়ালও যায় না। কাছে গেলেই কপাত করে গিলে ফেলে। তা কানাঘুষো যেন শুনেছিলাম যে, সেখানেও দিন-রাত্তির একটু অন্য নিয়মের।
আমার দেশের নাম ঘুরঘুট্টি নয়। তা হলে?
সে আরও বেনিয়মের জায়গা মশাই! দেশটার নাম হল রূপকথা।
অ্যাঁ! রূপকথা! মনসাপোতা নয়, সাতবেড়ে নয়, গাড়া শিবতলা নয়, একেবারে রূপকথা। এ আবার কেমন নাম হে! নামটা তেমন মজবুত নাম নয় তো! কেমন যেন এলিয়ে পড়া ভাব নামের মধ্যে! উচ্চারণ করে জুত হচ্ছে না তো!
আমাদের ভাষায় অবশ্য জায়গাটার নাম ডোডো।
নবা অবাক হয়ে বলে, বাড়িতে কি তোমরা ইংরিজিতে কথা কও নাকি?
না মশাই, আমরা ডোডো ভাষাতেই কথা কই। নবা হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, না বাপু, তোমার কথাবার্তা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
এদিকে যে এত কথাবার্তা হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে মোটেই খেয়াল নেই টকাইয়ের। সে জটাবাবার মুখের দিকে চেয়ে হাতজোড় করে সেই যে তদ্গত হয়ে আছে, আর কোনওদিকে হুঁশই নেই। ওদিকে জটাবাবাও সেই যে ধ্যানস্থ হয়েছেন, আর চোখ খোলেননি।
নবা গলাটা কয়েক পরদা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, তুমি কি জটাবাবার চেলা নাকি হে বাপু?
হিজিবিজি বলল, তা একরকম বলতে পারেন।
নবা একটা হাই তুলে বলল, তা ধর্মকর্ম হয়তো ভালো জিনিসই হবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, এতে তেমন গা গরম হয় না। চুরি-ছ্যাচড়ামির মধ্যে বেশ একটা গা গরম করা ব্যাপার আছে। ধর্মেকর্মে তো কেবল ভালো ভালো কথা আর উপদেশ। আমাদের কি ওসব পোষায়? তবে কিনা টকাই ওস্তাদের হঠাৎ বাই চেপেছে বলে আসা। তা জটাবাবা তো পষ্টাপষ্টি বলেই দিলেন যে, চুরি করা তেমন খারাপ কিছু নয়। এখন ফিরে গিয়ে কাজকর্মে মন দিলেই বাঁচি। তা বাপু, তোমরা চোর খুঁজছ কেন? সুলুকসন্ধান কিছু আছে নাকি?
হিজিবিজি ভারী মিষ্টি হেসে বলল, আছে বইকি।
নবা সাগ্রহে বলল, আহা; একটু খোলসা করে বলেই ফ্যালো না। তেমন বড় দাঁও হলে ওস্তাদকে আমি ঠিক রাজি করিয়ে ফেলব।
হিজিবিজি ভালো মানুষের মতো মুখ করে বলল, আজ্ঞে, চোর খুঁজছি আমাদের দেশে নিয়ে যাব বলে।
নবা অবাক হয়ে বলে, যাঃ, চোর আবার কেউ নিয়ে যায় নাকি? কেন বাপু, তোমাদের গাঁয়ে কি চোর নেই নাকি?
আজ্ঞে না। চোরের বড়ই অভাব। তবে কি সেখানে সবাই ডাকাত?
ডাকাতই বা দেখলাম কোথায়? না মশাই, চোর-ডাকাত ওসব কিছুই আমাদের নেই। সেই জন্যই গোটাকয়েক চোর আর ডাকাত নিয়ে যেতে চাইছি লোককে দেখাব বলে।
নবা চিন্তিত হলে বলে, চোর-ডাকাত নেই? সে আবার কেমন জায়গা হে! এ তো মোটেই ভালো কথা নয়! ভগবানের দুনিয়ায় বাঘ-সিংহ, শেয়াল-কুকুর, বিড়াল-হঁদুর, কাক-বক, কোনওটা বাদ দিলে কি চলে? তোমাদের বাপু সৃষ্টিছাড়া গাঁ। রূপকথায় গিয়ে আমাদের জুত হবে না হে।
ঠিক এই সময়ে ধ্যানস্থ জটাবাবা হঠাৎ বাঁ-চোখটা পট করে খুলে টকাইয়ের দিকে তাকালেন। তারপর বজ্রনির্ঘোষে বললেন, যা ব্যাটা, ধ্যানযোগে গিয়ে চিত্রগুপ্তের খাতায় তোর পাপপুন্যির হিসেবটায় চোখ বুলিয়ে এলুম। না, চুরি বাবদ তোর পাপের খাতে কিছুই ধরা হয়নি। নিশ্চিন্তে বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমো। সামনের অমাবস্যায় রাত এগারোটায় এইখানে চলে আসবি। পাপতাপ যা করেছিস, সব ঝেড়ে নামিয়ে দেব। তারপর মন্তর পাঠ। এখন বিদেয় হ।
গদগদ হয়ে টকাই তাড়াতাড়ি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে পড়ল, সঙ্গে নবাও।
জটাবাবার ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকটা তফাত হওয়ার পর হঠাৎ টকাইয়ের ভক্তিভাবটা খসে গিয়ে কপালে সুকুটি দেখা দিল। গম্ভীর গলায় ডাকল, নবা!
নবা পিছন থেকে বলল, আজ্ঞে!
চুরি-ডাকাতি খুব খারাপ জিনিস, বুঝলি!
যে আজ্ঞে, তবে কিনা…
টকাই হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল, এ কথাও ঠিক যে, চুরি-ডাকাতির উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
যে আজ্ঞে, সেই কথা ভেবে ভেবেই তো আমার রাতে ঘুম নেই। কাল রাতেই তো গিন্নি ফুলকপি দিয়ে কই মাছ বেঁধেছিল। এক কাঠা চালের ভাত উড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কী বলব ওস্তাদ, দু-গরাসও গিলতে পারিনি।
টকাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই কতকাল আমার শাগরেদি করছিস বল তো নবা?
তা ধরুন, সামনের অঘ্রানে দশ বছর পুরবে।
দশটি বছর আমার সঙ্গে থেকে শিখলি কী বল তো! এখনও তোর দেখার চোখ ফুটল না। কান তৈরি হল না, মগজ সজাগ হল না, হাত-পায়ের আড় ভাঙল না। সেই যে প্রথম দিন তোকে পরীক্ষা করার জন্য পটলার সাইকেলখানা চুরি করে আনতে পাঠিয়েছিলাম, সে-কথা মনে আছে?
ভারী লজ্জা পেয়ে বা বলে, তা আর নেই! খুব মনে আছে।
জলের মতো সোজা কাজটা যেভাবে ভণ্ডুল করেছিলি, তাতেই এলেম বোঝা গিয়েছিল তোর।
নবা কঁচুমাচু হয়ে বলল, তা কী করব ওস্তাদ, হাঁদারাম পটল যে তার সাইকেলের পিছনের চাকায় শেকল পরিয়ে তালা দিয়ে রেখেছে, তা কে জানত? সাইকেলটা টেনে নিয়েই চটপট উঠে পড়ে চালাতে গিয়েই দড়াম করে পড়লুম যে! প্রথম কেস তো!
সে না হয় হল। প্রথমটায় লোকে ভুলচুক করতেই পারে। সেটা ধরছি না। কিন্তু এই গেল হপ্তায় শিবু সমাদ্দারের বুড়ো পিসেমশাইয়ের হাতে ধরা পড়ে যে পঞ্চাশবার কান ধরে ওঠবোস করলি, তাতে যে আমার কতখানি বেইজ্জত হল, তা খেয়াল করেছিস?
নবা ভারী অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে ওস্তাদ, পাকা খবর ছিল যে, শিবু সেদিন মাদারপুরে শ্বশুরবাড়িতে গেছে। তাই নিশ্চিন্তে তার ঘরে ঢুকে মনের আনন্দে জিনিসপত্র সরাতে লেগেছিলাম। তা মেলা খুচরো জিনিস হয়ে যাওয়ায়, ভাবলুম, বিছানার চাঁদরে বেঁধে একটা পোঁটলা করে নিলে সুবিধে হবে। তখন কী আর টের পেয়েছিলাম যে, বিছানায় শিবুর বুড়ো পিসেমশাই শুয়ে আছে। মাইরি, বিশ্বাস করুন, শিবুর যে কস্মিনকালে কোনও পিসেমশাই আছে, সেটাও আমার জানা ছিল না। কোন গোবিন্দপুর গাঁ থেকে সেদিন রাতেই এসে হাজির হয়েছে। তা পোঁটলা বেঁধে তুলতে গিয়ে দেখি বেজায় ভারী। তখন কী আর জানতুম যে, জিনিসপত্রের সঙ্গে শিবুর পিসেমশাইও পোঁটলাসই হয়েছে! কেঁদে ককিয়ে পোঁটলা সবে ঘাড়ে তুলেছি, অমনই পোঁটলার ভিতর থেকে দুখানা হাত বেরিয়ে এসে গলাটা পেঁচিয়ে ধরে বড্ড বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। প্রথমে ভেবেছিলুম, ভূত! তাই একটু চেঁচামেচিও করে ফেলেছিলুম বটে! কপালটাই আমার খারাপ! নইলে পোঁটলার হাত গজাবে কেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টকাই বলল, শিবুর পিসেমশাইয়ের বয়স কত জানিস? একানব্বই বছর! হিসেব মতো থুথুড়ে বুড়ো, আর তুই ত্রিশ বছরের জোয়ান মর্দ। ঘাড়ে-গদানে চেহারা নিয়ে কোন আকেলে তুই বুড়ো মানুষটার হাতে নাকাল হলি বলতে পারিস?
মুশকিল কী জানো ওস্তাদ, আচমকা কাণ্ডটা হওয়ায় ঘাবড়ে গিয়েছিলুম কিনা! আর ঘাবড়ে গেলে আমার শরীরটা ভারী দুর্বল হয়ে পড়ে। তার উপর শিবুর পিসেমশাই হল গে বুড়ো মানুষ! বয়োজ্যেষ্ঠ, গুরুজন! বয়সের মানুষকে তো একটু সম্মান দেখাতে হয়! তাই তার অপমান হবে ভেবে পালাতে ইচ্ছে হল না।
তাই পায়ে ধরে কেঁদেকেটে ক্ষমা চেয়েছিলি?
না, পায়ে ধরার লোক আমি নই। যতদূর মনে আছে, হাঁটুর নীচে নামিনি। আর কান্না বলে লোকে মনে করলেও, ও ঠিক কান্না নয়। বেজায় সর্দি লেগেছিল বলে একটু ফ্যাচ ফঁ্যাচ ভাব ছিল। কান্না হতে যাবে কেন?
আর কান ধরে যে তোকে লোকজনের সামনে ওঠ বোস করাল, সেটা বুঝি অপমান নয়?
নবা একটু গ্যালগ্যালে হাসি হেসে বলল, তা ওঠ-বোস করেছি বইকি! সেদিন বিকেলে ডন-বৈঠক মারতে বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম কিনা! তা পিসেমশাই যখন ওঠ-বোস করতে বলল, তখন ভাবলুম, ভালোই হল! এই মওকায় মেরে নিই। হেঃ হেঃ, লোকে অবিশ্যি বুঝতে পারেনি। সবাই ভেবে নিল, আমি বোধহয় সত্যিই ভয় পেয়ে কান ধরে ওঠবোস করছি। কিন্তু আমি যে কায়দা করে বৈঠকি মারছি, সেটা আহাম্মকেরা ধরতেই পারেনি। হেঃ হেঃ, দিব্যি বোকা বানিয়ে এসেছি সবাইকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টকাই বলল, কেলেঙ্কারী যা করার তা তো করেইছিস, কিন্তু তা বলে কোন বুদ্ধিতে তুই শিবুর পিসেমশাইকে বলতে গিয়েছিলি যে, তুই আমার চেলা! নামটা ফাস করা কি তোর উচিত হল?
ভারী অবাক হয়ে নবা বলে, নাম নেব না মানে? আমি কত বড় ওস্তাদের শাগরেদ, সেটা পাঁচ জনকে বুক ঠুকে না বলে পারি? টকাই ওস্তাদের চেলা শুনলে যে লোকে হাতজোড় করে, পথ ছেড়ে দেয়।
বটে! তা হলে শিবুর পিসেমশাই সেটা করল না কেন? নবা একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ, সেটা একটা কথা বটে! তবে বুড়ো মানুষদের তো ভীমরতিতেও ধরে। তারপর ধরুন, কানেও হয়তো খাটো; তারপর ধরুন, ঝোঁকের মাথায় অপমানটা করে ফেলেছে, পরে হয়তো ক্ষমা চাইবে।
মাথা নেড়ে টকাই বলে, ওসব নয় রে, শিবুর পিসেমশাই হরদেব সিংহ আমার কাছে দুঃখ করে বলেছে, ওরে টকাই, তোর যে এমন দুরবস্থা হয়েছে, তা তো জানতুম না। তুই কত বড় ওস্তাদ ছিলি, লোকের পকেট মারলে পকেট নিজেও টের পেত না। আর সেই তুই কিনা এসব আনাড়ি লোককে দলে নিয়েছিস! এ তো চুরির অ-আ-ক-খই শেখেনি!
নবা ছলছল চোখে বলল, আরে ওস্তাদ, আমিও তো সেই কথাটাই আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। আপনি লাইন ছেড়ে দিলে আমার মতো অপদার্থ অপোগণ্ডের কী হবে! চুরি সমুদ্রের তীরে আমি যে এখনও নুড়ি কুড়োচ্ছি! জটাবাবা কী বলল শুনলেন না! চুরি মোটেই পাপের মধ্যেই পড়ে না। অত বড় সাধক, ত্রিকালজ্ঞ, টক করে চিত্রগুপ্তের খাতায় অবধি উঁকি মেরে এসে বললে, আপনার পাপের খাতায় কিছু জমা পড়েনি!
টকাই ভুকুটি করে বলল, জটাবাবা যাই বলুক, চুরিটুরি যে খারাপ কাজ তাতে সন্দেহ নেই। তবে চোর যদি হতেই হয়, তা হলে চোরের মতো চোর হওয়াই ভাল। দিনকানা, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন, বোকা-হাঁদা, লোভী আর চুকচুঁকে চোর হওয়া ঘেন্নার কাজ। হরদেববাবু কী আর সাধে দুঃখ করছিল, সে ছিল কদমপুরের ডাকসাইটে বড়দারোগা। জাহাবাজ লোক। সারা জীবনে মেলাই চোর-ডাকাত টিট করেছেন।
নব বড়-বড় চোখে চেয়ে বলে, দারোগা! শিবুর পিসেমশাই তা হলে দারোগা ছিলেন! তাই বলুন। অঙ্কটা তা হলে মিলেই গেল!
কী অঙ্ক মেলালি?
আজ্ঞে সে যখন আমাকে জাপটে ধরে পেড়ে ফেললে, তখনই আমি ওর গা থেকে পুলিশ-পুলিশ গন্ধ পেয়েছিলাম। চোর ধরার কায়দাকানুনও দেখলুম বেশ রপ্ত। তাই মনে হয়েছিল, এ-লোক পুলিশ না হয়ে যায় না। কিন্তু একে বুড়ো মানুষ, তার উপর গায়ে পুলিশের উর্দিও নেই, ফলে একটা খটকা লেগেছিল।
হ্যাঁ রে, পুলিশের গায়ে কী আলাদা গন্ধ থাকে?
নবা একগাল হেসে বলল, তা আর থাকে না! পুলিশের গন্ধ আমার খুব চেনা। সেবার গঁাদালপোয় মুরগি চুরির দায়ে যখন ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তখন দু-চারটে চড়চাপড় মেরে বড়বাবু শিবেশ্বর পুরকায়েত বলল, এটাকে আর ফাটকে পুরে কী হবে? বরং হাতে একটা হাতপাখা ধরিয়ে দে, সারারাত আমাকে বাতাস করুক, যা গরম পড়েছে! তা বড়বাবুকে সারারাত বাতাস করতে-করতে গন্ধটা খুব চিনে রেখেছিলুম। ও ভুল হওয়ার জো নেই। অনেকটা মোষ-মোষ গন্ধ।
তোর নাকের তো খুব এলেম দেখছি। তা ভাল চোরের মতো চোর হতে গেলে নাক-মুখ-চোখ সব কিছুই সজাগ হওয়াই দরকার। তা জটাবাবার কুটিরে ঢুকে কোনও গন্ধ পেয়েছিস?
তা আর পাইনি ওস্তাদ! খুব পেয়েছি। ফুল, চন্দন, আতর, ধূপকাঠি, সব মিলিয়ে মিশিয়ে ভারী স্বর্গীয় গন্ধ। মনে ভক্তিভাব এসে পড়ে।
তোর মাথা! এসবের নামগন্ধও ছিল না।
তা হলে?
ফাঁকা মাঠ, শুকনো পাতা আর মাটির সোঁদা গন্ধ ছাড়া আরও একটা সন্দেহজনক গন্ধ ছিল। সেটা হল স্পিরিট গামের গন্ধ।
সেটা কী জিনিস ওস্তাদ?
ওই আঠা দিয়ে যাত্রা-থিয়েটারের অ্যাক্টরের নকল দাড়ি গোঁফ লাগায়। মনে হচ্ছে জটাবাবার দাড়ি-গোঁফও আসল নয়।
বলেন কী ওস্তাদ! অমন তেজি দাড়ি দেখে আমি তো ভাবলাম, মস্ত বড় সাধক।
সাধক বটে, তবে অন্য জিনিসের। আর ওই হিজিবিজি ছোঁকরাও দু-নম্বরি জিনিস।
নবা চোখ গোল-গোল করে বলে, বটে ওস্তাদ!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টকাই বলে, এদের মতলব ভালো নয় রে নবা। জটাবাবার বেদিটা ভালো করে লক্ষ করেছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ, চৌকোমলতা, বেশ উঁচু।
হ্যাঁ, কিন্তু বেদি বানাতে মাটি বা ইটের দরকার হয়। এই জঙ্গলে তো ইটের জোগাড় নেই, আর আশপাশে কোথাও মাটি কাটার দাগও ছিল না। মনে হচ্ছে গোটাদুই বাক্সর উপর চট আর কম্বল দিয়ে ঢেকে বেদি করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাক্সটা কিসের। আরও কথা আছে।
নবা অবাক হয়ে বলে, আরও কী কথা ওস্তাদ?
আমি, তুই, জটাবাবা আর হিজিবিজি ছাড়া এই ঘরে আরও একটা কেউ ছিল।
কই ওস্তাদ, আর তো কাউকে দেখলুম না।
সব জিনিস কি চোখে দেখা যায় রে, তবে আন্দাজ পাওয়া যায়। আমি পাঁচ জনের শ্বাসের শব্দ পেয়েছি। রাতের অন্ধকারে যখন অচেনা বাড়িতে অন্ধকারে ঢুকতে হয়, তখন চোখ ততটা কাজ করে না, কিন্তু চোখের জায়গা নেয় কান। বুঝলি? তোর অবশ্য নাক, কান, চোখ, সবই সমান, সবকটাই ভোঁতা।
নবা লজ্জা পেয়ে বলে, তা বটে ওস্তাদ, কিন্তু ওই পাঁচ নম্বর লোকটা কে?
লোক কিনা তা জানি না! পাঁচ নম্বর যে মানুষই হবে এমন কোনও কথা নেই।
নবা শশব্যস্তে বলে, তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে ওস্তাদ?
পাঁচ নম্বরের শ্বাসের শব্দটা একটু অন্যরকম, অনেকটা খুব আস্তে শিষ দেওয়ার শব্দের মতো। আর শ্বাসটা অনেকক্ষণ বাদে-বাদে ছাড়ে।
সাপখোপ নয়তো!
না। দেশের সব সাপের শ্বাস আমার জানা। এ অন্য কিছু, মানুষ হলেও অন্যরকম মানুষ। শোন, জটাবাবার কাছে এসেছিলাম নিজের পাপ কবুল করে মন্তর নেব বলে, কিন্তু এখন অন্য কথা ভাবছি। জটাবাবা বোধহয় আমার চেয়েও এককাঠি উপরের জিনিস, সুতরাং এখনও রিটায়ার করলে আমার চলবে না, ব্যাপারটা দেখতে হবে।