৩. ঘুম হয়নি

০৩.

 গত ছত্রিশটি ঘণ্টা অভ্র জ্বালা নিয়ে কাটিয়েছে। আজ ফার্স্ট জুন। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। উঠতে দেরি হয়েছিল। কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছিল না, গার্গী তাকে প্রচণ্ড অপমান করে বসেছে। একটা ভয়ঙ্কর কিছু করে ফেলতে চাইছিল অভ্র। কিন্তু সকালে চা খেতে খেতে বাড়িতে রটে গিয়েছে, গার্গী নাকি রাত্রেই পালিয়ে গেছে। সত্যি, ভাবা যায় না এমন কিছু ঘটতে পারে।

খবরটা মা ফিসফিস করে দিয়ে গেলেন। ঠাকুর-দেবতার উদ্দেশে একশো প্রণিপাত করেছেন। কারণ, ওই পালিয়ে যাওয়া মেয়ের সঙ্গেই অভ্রের বিয়ের মতলব, মাথায় এসেছিল ওঁর এবং উনিই স্বামীকে প্ররোচিত করেছিলেন তারকবাবুর কাছে যেতে। এদিকে মণিবাবু পুরুষোচিত গর্বে বারবার বলছেন, একই বলে স্ত্রী! আরে বাবা, পুলিশের চাকরিতে জীবনটা পুরো কাটিয়ে দিলুম। আমি কি মেয়েটাকে চিনিনি ভাবছ? নেহাত তুমি জেদ ধরলে, তাই, যাকগে– চেপে যাও। জোর বাঁচা গেছে।

অভ্র বাড়ি থেকে সটান বেরিয়ে পাড়ার একটা রেস্তোঁরায় গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে কেটে পড়ছিল। গার্গী পালিয়ে গেছে, এ ব্যাপারটা তার মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছিল না। যতবার মনে পড়েছিল গত পরশু রাতে গার্গী অকারণ চেঁচামেচি করে তার নামে জঘন্য কেলেঙ্কারি করে ফেলল–ততবার মনে মনে খেপে উঠছিল সে। সব ভোলা যায়, এটা কিছুতেই ভোলা যায় না।

আশ্চর্য, আশ্চর্য..আশ্চর্য! এ বাড়ি আসার পর গার্গী নিজেই যেচে পড়ে তার সঙ্গে আলাপ করেছিল। প্রশ্রয় দিয়েছিল। সিঁড়ির আবছা অন্ধকারে একদিন অভ্র হঠাৎ তাকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে ফেললেও সেদিন সে একটুও আপত্তি করেনি! যখনই অভ্র তাকে একা পেয়েছে, শারীরিক ঘনিষ্ঠতা এসে গেছে অথচ গার্গীর এতটুকু বাধা ছিল না। অভ্র দিনে দিনে টের পাচ্ছিল, গার্গীকে সে অন্ধের মতো ভালবেসে ফেলেছে এবং এই অন্ধতা থেকে তার উদ্ধার নেই। গার্গীও তার চোখে চোখ রেখে কতদিন বলেছে, অপেক্ষা করে থাকো।

গার্গীকে নিয়ে সে সিনেমা দেখেছে। কত সন্ধ্যায় ফোর্টের কাছে বা লেকের ধারে গিয়ে বসে থেকেছে। অন্ধকার থাক বা না থাক, নির্জনতা থাকলেই গার্গী তার উরুতে মাথা রেখেছে।

সেই গার্গী! অভ্রের স্মৃতি অভ্রকে অস্থির করছিল।

ইদানীং গত এক সপ্তাহ যেন কেমন আনমনা দেখাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলে বলত, কিছু না তো! এমনি। শুক্রবার সকাল থেকেই গার্গীর হঠাৎ যেন রূপান্তর ঘটেছিল। ডাকলে এড়িয়ে যাচ্ছিল। চোখে চোখ পড়লে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। খুব হঠাৎ এই পরিবর্তন বলেই অভ্রের জেদ চড়েছিল মাথায়। সেদিনই সন্ধ্যায় অফিস থেকে ওর ফেরার প্রতীক্ষায় ছিল অভ্র। যা হবার হবে। গার্গীর সঙ্গে একটা চরম বোঝাপড়া হয়ে যাক্। আর সেইই সময় লোডশেডিং হয়ে সুযোগটা বাড়িয়ে দেয়। সে দরজায় গার্গীর মুখোমুখি হয়। গার্গী তার পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকে। প্যাসেজে অভ্র খেপে গিয়ে তার পিছন থেকে কাধ ধরে ফেলে। ধস্তাধস্তি হয়। গার্গীর ব্লাউজ ছিঁড়ে যায়। সে চেঁচিয়ে ওঠে। কেলেঙ্কারি হয় চূড়ান্ত রকমের। …..

.

অভ্র খুব জেদী আর মরিয়া প্রকৃতির ছেলে বরাবর। তাকে নিয়ে মণিবাবু কতবার ঝামেলায় পড়েছেন। ঝামেলা মেটাতে অবশ্য অসুবিধে হয়নি। কারণ তিনি নিজেই পুলিশ অফিসার। শেষদিকে এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চে প্রমোশন পেয়ে বদলি হয়েছিলেন। কিন্তু অভ্রের যেন দুটি সত্তা। একদিকে সে বরাবর মেধাবী ছাত্র হিসেবে নাম কিনেছে, অন্যদিক দুষ্টুমি গুণ্ডামিও কম করেনি। বাবা পুলিশ অফিসার–এই ব্যাপারটা হয়তো তা অবচেতনায় একটা শক্তি যুগিয়ে থাকবে। কারণ মারামারি করে এলে লোকেরা তার নামে নালিশ তুলতে ভয় পেত। এতেই ভাদ্র লাই পেয়ে যেত সম্ভবত। ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে এম. এ. পড়তে ঢোকার পর অভ্র অনেকটা বদলে গিয়েছিল। ডানপিটেমি কমেছিল এবং সংযত হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু একেই যেন বলা হয় সময়ের প্রহার। পরীক্ষার অনিশ্চয়তা অভ্রের শান্তি নষ্ট করল দিনে দিনে। যদি বা দেড় বছর দেরি করে পরীক্ষা হল, অভ্রের মধ্যে তখন হতাশা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরীক্ষা ভাল হল না। ফল বেরুল আরও একবছর পরে। সে ফেল করে বসল। করবে, তা নিজেই জানত। তারপর চাকরির প্রশ্ন। মণিবাবু যেটাই জোগাড় করে দেন, অভ্রের পছন্দ হয় না। বলেধুস! এ নিয়ে সাংসারিক অশান্তিও যথেষ্ট হয়েছে। শেষে মণিবাবু হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন ইদানীং। কিন্তু গার্গীর সঙ্গে অভ্রের ব্যাপারটা টের পেয়ে মণিবাবুর স্ত্রী উৎসাহিত হয়েছিলেন। গার্গী দেখতে শুনতে মন্দ নয়। ছেলের যখন এত পছন্দ, বউ করে ঘরে তুললেই ছেলে চাকরি পেলে লুফে নেবে। এটাই তো সংসারের চিরাচরিত নিয়ম।

তারপর এই অঘটন ঘটে গেছে। গার্গী হঠাৎ পালিয়ে গিয়ে কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত।

কেন ওভাবে চলে গেল গার্গী? অভ্রের মাথায় সারাদিন শুধু ওই চিন্তা। আগের দিন সে এত ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে ফের মুখোমুখি হলে গার্গীকে ওই হঠকারিতার কৈফিয়ত চাইবে ভেবেছিল। সকাল থেকে সুযোগ পায়নি। গার্গীর ঘরে ঢুকলে আবার হই চই হবে! তাই অভ্র সুযোগ খুঁজেছিল। কিন্তু গার্গী সকাল থেকে বেরোয়নি। তার আপিসে যাবার সময় সকাল নটা থেকে সাড়ে নটার মধ্যে। অভ্র ওৎ পেতে ছিল। কিন্তু বাথরুমে ঢোকার তাড়া থাকায় ব্যাপারটা ভণ্ডুল হয়ে যায়। বেরিয়ে নেমে এসে টের পায়, গার্গী চলে গেছে।

অনেক ভেবেচিন্তে সে বিকেলে গার্গীর আপিসে হানা দেবে ভেবেছিল। শনিবারও ওদের বিকেল পাঁচটা অবধি চলে। আপিস থেকে বেরুলে গার্গীকে ধরে ফেলবে ভেবে অপেক্ষা করছিল। তারপর অবাক হয়ে দেখল, গার্গী এক ধোপদুরস্ত একজিকিউটিভ ট্রাইপ ভদ্রলোকের সঙ্গে সটান নামল এবং তার গাড়িতে ঢুকল। গাড়িতে একটা প্রকাণ্ড কুকুরও ছিল। গাড়িটা তক্ষুনি জোরে বেরিয়ে গেল।

এই আবিষ্কার অভ্রের রাগ বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু ঘটাতে পারেনি। স্তম্ভিতও হয়েছিল সে। তার সঙ্গে গার্গীর মেলামেশা হঠাৎ বাঁক নেওয়ার কারণ কি তাহলে ওই গাড়ি কুকুরের মালিকই? কে ও?

অভ্র স্পষ্ট বুঝল, গার্গী কেমন মেয়ে। নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের পক্ষে এটাই হয়তো স্বাভাবিক। তার চেয়ে ভাল ক্যান্ডিডেট পেয়ে মাথাটা ঘুরে গেছে।

অভ্র খেপে গিয়েছিল। বাড়ি এসে গার্গীর সঙ্গে ফের একটা হেস্তনেস্ত সে করতে পারত। কিন্তু বাবা-মায়ের মুখ চেয়ে অন্তত খাতিরেই, সেপথ নিল না। আবার পরদিন কিংবা তার পরদিন হয়তো আজীবন আমৃত্যু গার্গী তাকে ফাঁকি দিয়ে বেড়াবে এবং অভ্র হেস্তনেস্তর সুযোগ খুঁজে হন্যে হবে–এইসব ভেবে অভ্র গতরাতে ভাবতে বসেছিল। তখন রাত সাড়ে তিনটে।

অভ্র একটা ছোরা আর একটা সরু শিক নিয়ে পা টিপেটিপে নেমেছিল। সিঁড়ির বাল্বটা নিবিয়ে দিয়েছিল। নিচে বারোয়ারি ঘোরালো বারান্দায় অনেক লোক ঘুমোচ্ছে। গার্গীর বাবাও একটা খাঁটিয়ায় ঘুমোন–গার্গীর ঘরের সামনে। আস্তে আস্তে এগিয়ে সে থামের একপাশে দাঁড়ায়। শিক দরজার ফাঁকে গলিয়ে দরজা সহজেই খোলা যায় সে জানে। পুরনো বাড়ি। দরজার কপাটেও যথেষ্ট ফাঁক থাকে–ছিটকিনি লাগে না। শুধু একটা হুড়কো আটকানো থাকে। গার্গীর দরজায় এক টুকরো হাল্কা কাঠ আছে মাত্র।

অভ্র মেন সুইচটা থামের কোনায় অফ করে দেয়। তারপর সাবধানে দরজার কাছে যায়। ভূতগ্রস্তের মতো–যেভাবে নিশির ডাকে নাকি লোক কাজ করে, সেইভাবেই।

কিন্তু শিক ঢোকাতেই কপাটদুটো দুপাশে সরে গেল। অবাক হয়ে অভ্র দেখল, দরজা ভেজান রয়েছে। সে ঘরে ঢুকে পড়ে। তারপর বিছানার দিকে তাকিয়েই হতভম্ব হয়ে যায়। মাথার দিকের জানলাটা খোলা। বাইরের রাস্তার আলো এসে পড়েছে। বিছানায় কেউ নেই।…

অভ্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এটাই যে, সে কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনা করতে পারে না। রাতে যদি গার্গীকে বিছানায় পেত, খুন সে করতই এবং তার জন্যে এতটুকু অনুশোচনা তার হত না। ছাত্রজীবনে দুচারটে খুনখারাবি সে না করেছে, এমন নয়। সে ছিল সাতষট্টি থেকে উনসত্তর সালের মারাত্মক সময়।

আসলে অভ্রের রক্ত একটা খুনীর, সে নিজেও বোঝে। তার অস্তিত্বে এক হঠকারী হত্যাকারী আছে বহু ঘটনায় টের পেয়েছে। প্রথম-প্রথম শিউরে উঠত–পরে সেটা সয়ে যায়। দমদমে একটি তার বয়সী যুবককে থামে বেঁধে সে তার গলা পেঁচিয়ে কেটেছিল।

কিন্তু তার অস্তিত্বে এক প্রেমিকও রয়েছে, সে বোঝে। কত মেয়েকে তার ভালবাসা দিতে ইচ্ছে করেছে, দেবার সুযোগ পায়নি। জীবনে এই প্রথম সে। গার্গীর কাছ থেকে বিমুখ হয়নি। তাই এত জ্বালা।

অভ্র আরও অস্থির হল, যখন ভালভাবেই বুঝল যে, গার্গী তার ভালবাসার মর্যাদা দেয়নি। গাড়ি আর কুকুরের ভালবাসার মর্যাদাই গার্গী দিতে জানে।

অতএব এমন একটি মেয়েকে গত রাতে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলে এতটুকু অন্যায় হত না।

এখানে-ওখানে টো টো করে অভ্র যখন বাড়ি ফিরল, তখন দুপুর একটা। সে দেখল বারো ঘর এক উঠোন অস্বাভাবিক চুপচাপ। গার্গীদের ঘরের কাকেও দেখা যাচ্ছ না। সে বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়িতে উঠতে যাচ্ছে, হঠাৎ গার্গীর মায়ের চাপা গলার ডাক শুনে দাঁড়াল। কুমুদিনীর মুখটা করুণ। অসহায়তা কালো ছায়া ফেলেছে মুখে। চোখ দুটো লাল। অভ্র বলল, কী?

–একটু এ ঘরে আসবে বাবা?

অগত্যা অভ্র গেল। এটা গার্গীর সেই ঘর। ঘরে ঢুকলে কুমুদিনী সাবধানে পর্দাটা টেনে দিলেন। বললেন, দাঁড়িয়ে কেন? বসো বাবা।

অভ্র বলল, বলুন।

–সব তো শুনেছ! যা হবার হয়েছে। …কুমুদিনী চোখ মুছে চাপা গলায় বললেন। …ও যে এমন করে বসবে, একটুও বুঝতে পারিনি। বাবা অভ্র, তোমাকে ডাকলুম শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে। আমি তোমার মায়ের মতো। সত্যি বলবে তো বাবা?

অভ্র বলল–না বলার কী আছে মাসিমা? আপনারা তো জানেন, আমি লুকিয়ে কিছু করি না বা বলিও না।

কুমুদিনী ওর মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন–ও এমন করে কেনই বা গেল, তুমি জানো?

অভ্র ঘাড় নাড়ল–নাঃ!

–কোনরকম ইশারা-ইঙ্গিত কিছু পাওনি?

–কিছু না।

একটু চুপ করে থেকে কুমুদিনী বললেন–তোমার কাকাবাবু তো সেই সকাল থেকে নানান জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে হন্যে হয়ে এলেন এক জায়গায় একটু সন্দেহ মতো হয়েছিল। তারপর…–

কথা কেড়ে অভ্র বলল–কোথায় বলুন তো?

–ভবানীপুরের এক ভদ্রলোক, দীপঙ্কর সেনের কিছু চিঠি গার্গীর বাকসে পাওয়া গেছে। আরও দুজনেরও পাওয়া গেছে। এই তিনজন গার্গীকে চিঠিপত্তর লিখত। তোমায় লুকোব না–গার্গীর সঙ্গে ভাব-ভালবাসা যাই বলো, চিঠি পড়লে বোঝা যায়–ওই রকম কিছু ছিল। তা সেই দীপঙ্কর আজ ভোরবেলা বাইরে গেছেন। মোহনপুরে নাকি। মুঙ্গেরের ওদিকে মোহনপুর আছে, সেইখানেই। উনি ভালভাবে খোঁজ নিয়ে এসেছেন। ড্রাইভার প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। অনেক কথা খরচ করে কথাটা আদায় করেছেন। উনি রেলে চাকরি করতেন কি না, তাই হাওড়া স্টেশনে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে এসেছেন একটু আগে। আজ সকালের ট্রেনে দীপঙ্কর মোহনপুরে গেছেন। রিজার্ভেশান খাতায় নাম আছে।

অভ্র বলে উঠল–একা?

কুমুদিনী মাথা নেড়ে বললেননা। লেখা আছে ফার্স্টক্লাসে দুটো লোয়ারবার্থে মিস্টার আর মিসেস ডি সেন নামে দুজন গেছে। এবার তাহলে বোঝ, কী হয়েছে।

–কেন? দীপঙ্করবাবুর স্ত্রীও হতে পারে।

না। ও ভদ্রলোক বিয়েই করেননি। উনি সব খবর নিয়েছেন যে। …কুমুদিনী একটু চুপ করে থেকে ফের বললেন কিন্তু ওভাবে গেল কেন গার্গী, সেটাই বুঝতে পারছিনে। শুধু মনে হচ্ছে।…

অভ্র অনুমান করে বলল–আমার ভয়ে তো?

কুমুদিনী মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন–সেও হতে পারে বইকি বাবা। তোমাকে তো পাড়ায় বাই একটু ইয়ে করে। কিন্তু তার চেয়ে অন্য একটা…হঠাৎ থেমে গেলেন উনি।

–হ্যাঁ, ভয়টয় করে আর কী! অভ্র একটু হাসবার চেষ্টা করল। তারপর ফের বলল, যদি মনে করেন, গার্গী আমার ভয়েই পালিয়েছে–আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, আমার থেকে কোন ক্ষতি হবে না। আপনারা ওকে সব বলে ফিরিয়ে আনুন।

কুমুদিনী জোরে মাথা দুলিয়ে বললেন–তার চেয়েও বড় কথা বাবা অভ্র, গার্গীর চিঠিটা পড়ে ভালভাবে পড়ে আমাদের কেমন যেন মনে হচ্ছে, কী। একটা গোলমাল আছে।

–কিসের গোলমাল?

–চিঠিটা টানা বড় বড় হরফে লেখা। কিছুক্ষণ খোঁজখবর নিয়ে ফিরে এসে ফের দেখছিলেন। তারপর আমাকে ডাকলেন। বললেন দেখ চিঠিটা যেন গার্গীর হাতের লেখা নয়। তখন হঠাৎ একবার দেখেই আমরা অতটা বুঝিনি। এখন মনে হচ্ছে, অন্য কার লেখা।

অভ্র চমকে উঠে বলল–সে কী। চিঠিটা দেখি!

কুমুদিনী বললেন–উনি তক্ষুনি ফের ওটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আর…

–থানায়?

কুমুদিনী আরও ফিসফিস করে বললেন–না। …ওঁর এক বন্ধুর সঙ্গে কোন এক কর্নেল সাহেবের চেনাজানা আছে। সেই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন।

–কে সে?

কী যেন কর্নেল …কী। ভদ্রলোকের সঙ্গে পুলিশের ওপর মহলের খুব খাতির। গরিবের কেস নিয়ে তো ফেলে রেখে দেবে বাবা তুমি ভালই জানো। তাই ওপরতলা থেকে তদ্বির হওয়াই ভাল। আমাদের মনে সেই থেকে খটকা ছিল, গার্গী যদি কাকেও বিয়ে করবে, অমনভাবে পালাবে কেন? আর যেটা এখন সবচেয়ে গোলমেলে ব্যাপার, সেটাও বলছি। তুমি এ সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াও বাবা।

অভ্র চাঞ্চল্য চেপে বলল বলুন মাসিমা।

–গার্গীর ব্যাংকের পাসবইটা দেখে আমরা অবাক হয়েছি। সেভিংসে এত টাকা কোত্থেকে জমাল বুঝতে পারছিনে। কী জানি কী ফ্যাসাদ বাধবে এ নিয়ে…

কত টাকা।

–বেয়াল্লিশ হাজার সাতশো টাকা। গত সাত মাসে জমা দিয়েছে গার্গী। এত টাকা কোথায় পেল ও? ..কুমুদিনী কথাটা বলতে কেঁপে উঠলেন। আজকাল তো বেশি টাকাপয়সা থাকাও বিপদ। রোজগার গোপন করলে রক্ষা নেই। গার্গীর এই টাকা নিয়ে কী হ্যাঁঙ্গামা হবে কে জানে। বাবা অভ্র, তোমার বাবা সকালে বেরিয়েছেন–ফেরেননি। হয়তো ওনাকেও সব বলত। তোমরা বাবা সবাই পাড়ার ছেলে মিলে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াও।

কুমুদিনী চোখে আঁচল চাপা দিলেন।

অভ্র একটু ভেবে বলল–চিঠিটা গার্গীর হাতের লেখা নয় বলছেন! ভারি আশ্চর্য তো।

কুমুদিনী বললেন নিশ্চয় কিছু একটা গণ্ডগোল ঘটেছে। আর…আরও একটা কথা বলি। তোমায় কিছু গোপন করব না বাবা। তুমি আমাদের ছেলের মতো। হতভাগী যদি এই সব কাণ্ড না বাধাত তোমার সঙ্গেই…

অভ্র বাধা দিয়ে বলল–ওকথা ছাড়ুন। আর কী?

বাড়ির দরজার ওপাশের রোয়াকে, যেখানে তোমরা বসে থাকো, রতন। পানসিগ্রেটওয়ালার ভাগ্নে সেখানে ঘুমুচ্ছিল। সে বলেছে অনেকটা রাতে এ বাড়ি থেকে একটা মেয়েকে একা বেরিয়ে যেতে দেখেছে। গলির মোড়ে একটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল নাকি। তারপর কী হল সে দেখেনি। দেখে নিয়ে ফের চোখ বুজেছিল। তারপর নাকি গাড়িটা চলে যাবার আওয়াজ শোনে।…

অভ্র হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। –ঠিক আছে মাসিমা। সব শুনে রাখলুম। দরকার হলে ডাকবেন।

অভ্র সটান বেরিয়ে ওপরে চলে গেল…

.

দুপুরে খাওয়ার পর ঘণ্টা তিন ঘুমনো অভ্যাস অভ্রের। ছোট বোন লালীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। লাল চোখে সে তাকাল। এভাবে ঘুম ভাঙালে অভ্র। ভীষণ চটে যায়।

লালী বলল, নিচের তারকবাবু তোমাকে ডাকছেন।

অভ্র চোখ বুজে বলল, এখন হবে না। বলগে যা!

সেই সময় বাইরে তারকবাবুর ভাঙা গলার ডাক শোনা গেল–অভ্র! ও অভ্র! একবার এদিকে এসো না বাবা।

অভ্রের মা শুভময়ী ঘরে ঢুকে ফিসফিস করে বললেন–যা বলবে, শুধু শুনে যাবে। ওদের ব্যাপারে কখনো নাক গলাতে যাবে না। ছি ছি! এ কোন বাড়িতে এসে জুটলুম! আগে জানলে ওই কেলেঙ্কারিবাজ মেয়েকে…

বাধা দিয়ে অভ্র বলল-থামো তো মা! খুব হয়েছে। ঘুমের সময় যত ঝামেলা।

শুভময়ী ছেলের মেজাজ সমঝে চলেন। লালীকে ধমক দিয়ে চাপা গলায় বললেন–তোর কোন আক্কেল হবে না রে! বললেই পারতিস, দাদা বাড়ি নেই। ওকে এখন ডাকতে কে বলল–ঘুম ভাঙিয়ে? দালাল কোথাকার!

অভ্র কিন্তু উঠে বসল। পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে গেল। দেখল তারকবাবু কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাকে দেখে তিনি বললেন–কিছু মনে করো না বাবা তোমাকে ডিসটার্ব করতে হল বলে সত্যি লজ্জিত। কিন্তু এ বাড়িতে আর তুমি ছাড়া কে আমাদের এখন হেল্প করবে বলো!

অভ্র বলল–কী ব্যাপার?

দয়া করে একবার নিচে আসবে অভ্র? খুবই জরুরি ব্যাপার। আমার মাথার আর ঠিক নেই। জীবনে এমন বিপাকে কখনও পড়িনি! …তারকবাবুর মুখে অসহায় মানুষের কাকুতি-মিনতির ছাপ ফুটে উঠল।

অভ্র বলল–চলুন।

দুজনে নিচে নামল। বিকেল হয়েছে। বারোয়ারি উঠোনে গাঢ় ছায়া জমেছে। এঘরে-ওঘরে বারান্দা বা দরজায় উৎসুক চোখগুলো চনমন করছে। অভ্র টের পেল, নিচের তলায় ফিসফিস চাপা কথাবার্তা চলছিল, যেন তাকে দেখেই সব থেমে অস্বাভাবিক স্তব্ধতা জেগে উঠল! এ একটা কেলেঙ্কারি তো বটেই পরশু রাতের চেয়েও মাত্রাটা বড় বেশি। গার্গীর ওপর আবার অভ্রের রাগটা বেড়ে গেল।

গার্গীর সেই ঘরেই তাকে ঢোকালেন তারকবাবু। কুমুদিনী বসে ছিলেন সেখানে। পাথরের মূর্তির মতো। বললেন, এসো বাবা, বসো। আবার তোমাকে না ডেকে পারলুম না আমরা।

তারকবাবু স্ত্রীকে বললেন–তুমি ঝটপট চা করে নিয়ে এসো।

কুমুদিনী যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেই বেরিয়ে গেলেন। তারপর অভ্র বলল বলুন।

তারকবাবু বললেন–গিয়েছিলুম ইলিয়ট রোডে এক কর্নেল ভদ্রলোকের বাসায়। আমার এক কলিগের সঙ্গে। তো আমার দুর্ভাগ্য, ভদ্রলোক কদিন আগে বাইরে গেছেন। কবে ফিরবেন, ঠিক নেই। শুনলুম, বড্ড খামখেয়ালি–

অভ্র কথা কেড়ে বলল–কে তিনি?

রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার। নাম কর্নেল সরকার। এন করকার। পুলিশমহলে ওনার নাকি খুব খাতির-টাতির আছে। আমার কলিগ বরদা– বরদাভূষণ ঘোষ দস্তিদার ইস্টার্নরেলে ট্রাফিক সেকশনে ইন্সপেক্টর ছিল। এখন আমার মতোই রিটায়ার করেছে। তো বরদার সঙ্গে কর্নেল ভদ্রলোকের চেনা জানা আছে। বরদা বললে, ব্যাপারটা খুব মিটিরিয়াস মনে হচ্ছে। তাই…..

আবার ওঁকে থামাতে হল। অভ্র তারকবাবুর স্বভাব জানে। মূল কথাটা বলতে পুরো একখানা মহাভারত করে ফেলবেন। সে বলল ঠিক আছে। এখন কী করতে চান?

তারকবাবু বললেন–তোমার বাবা এখনও ফেরেননি। পুলিশমহলে ওনারও তো চেনাজানা প্রচুর আছে। তাই ভাবছিলুম, ওঁকে দিয়ে কিছু করা যায় কি না।

অভ্র বিরক্ত হয়ে বলল–তাহলে আমাকে ডাকলেন কেন?

তারকবাবু বললেনবলছি, বাবা। বুঝতেই তো পারছ, মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা এখন। বরদা বলল, কর্নেলসায়েব থাকলে ভাবনা ছিল না। যাক গে, তুমি তোমাদের মণিবাবুর পরামর্শ নাও। নিজে থানায় গিয়ে সব জানাও। কেলেঙ্কারি যা হবার হয়েছে। কেস যে মিসট্রিয়াস! তো বাবা, কথাটা শুনে আমার খালি মনে হচ্ছে, থানায় ধরো গেলুম। তোমার বাবাকে নিয়েই গেলুম। কিন্তু ওনারা এনকোয়ারি করবেন। করলেই কিন্তু গার্গীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বেরিয়ে পড়বেই পড়বে। তখন উল্টে যে বিপদ বেধে যাবে, বাবা!

অভ্র কথাটার যুক্তি স্বীকার করে বলল–হু।

তারকবাবু ফিসফিস করে বললেন–শেষে ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করেছি। সাপও যাতে মরে, আবার লাঠিও না ভাঙে–এমন একটা কিছু করতে হবে। গার্গী যে সেই সেনসায়েবের সঙ্গেই মোহনপুরে গেছে, তাতে কোন ভুল নেই। বাবা অভ্র, আমি বুড়োমানুষ। এতেই তো শরীরের যা অবস্থা হয়েছে, বোঝাতে পারব না। যে কোন সময় দেখবে স্ট্রোক-টোক বাধিয়ে বসে আছি। তাই বলছিলুম–তুমি পরোপকারী ছেলে, তোমার মহৎ অন্তঃকরণের পরিচয় আমি পেয়েছি…

অভ্র বলল–আমি কী করব?

তারকবাবু ওর হাত দুটো ধরে ফেললেন। বললেন–তুমি মোহনপুরে যাও বাবা। গিয়ে মেয়েটাকে যেভাবে হোক, সব অথরিটি তোমায় দিচ্ছি–লিখিত ভাবেই দিচ্ছি–ওকে নিয়ে এসো।

অভ্র হাত ছাড়িয়ে নিয়ে একটু হাসল রাস্তা থেকে কাকেও ধরে এনে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি। কিন্তু পাঁচ-সাতশো মাইল দূর থেকে কীভাবে ধরে আনব?

তারকবাবু বললেন না, না। ধরে আনতে হবে না। দেখবে, তোমাকে দেখলে গার্গী মনে বল পাবে। নিজেই চলে আসবে। ও তো নিজের ইচ্ছেয় যায়নি। সেনসায়েব ওকে ওষুধ-টষুধ খাইয়ে নিশ্চয় বশ-টশ করে গায়ের জোরে নিয়ে গেছেন। চিঠিটা মোটেও গার্গীর হাতের লেখা নয়। জানলা গলিয়ে ফেলে দিয়ে, গেছে কেউ। সেভাবেই তো পড়ে ছিল চিঠিটা। সকালে আমরা অতটা বুঝতে পারিনি কি না! কিডন্যাপিং কেস ছাড়া কিছু নয়।

অভ্র এবার একটু চমকে উঠল। বলল–কিডন্যাপ যদি করে, নিয়ে গেল কীভাবে? আর কিডন্যাপ করারই বা কারণ কী?

তারকবাবু ব্যস্তভাবে বললেন–সব জানতে পারবে গার্গীর মুখে। তুমি শার্প ব্রেনের ছেলে। মোহনপুরে গিয়ে খুঁজে বের করবে। নিশ্চয় ওকে সেখানে লুকিয়ে রেখেছে। এতক্ষণে প্রাণে মেরে ফেলল কি না কে জানে!

তারকবাবু চোখ বুজে নিজেকে সামলে নিলেন। গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর ফের বললেন–তা যদি করে থাকে, সেও তুমি টের পাবে। আমার জীবন কেটেছে রেলের কোয়ার্টারে–নানা জায়গায়। মোহনপুর আমি ভালই চিনি। ছোট শহর। গার্গীকে জ্যান্ত হোক, মড়া হোক–চাপা দিতে পারবে না। কিছুতেই পারবে না।

–কিন্তু কিডন্যাপ যদি না করে থাকে? গার্গী স্বেচ্ছায় গিয়ে থাকে?

তারকবাবু দৃঢ়তার সঙ্গে মাথা দুলিয়ে বললেন না। স্বেচ্ছায় যায়নি। কেন যাবে?

ধরুন, আমার ভয়ে!

তারকবাবু আরো জোরে মাথা দোলালেন।

অভ্র বলল–চিঠিটা একবার দেখাবেন?

তারকবাবু বুকপকেট থেকে নোটবই বের করে ভাজকরা একটুকরো কাগজ দিলেন। অভ্র দেখল, কাগজটা একটু দলাপাকানো ছিল–টেনে সমান করা হয়েছে। গার্গীর হাতের লেখা সে চেনে না। ডটপেনে দ্রুত কয়েকটা লাইন। লেখা : আমি চলে যাচ্ছি। খুঁজলে পাবে না। বৃথা চেষ্টা করো না। তলায় কোন স্বাক্ষরই নেই!

অভ্র অবাক হয়ে বলল–গার্গী সই করেনি দেখছি!

–গার্গীর হাতে লেখাই যে নয়। দেখছ না, হরফগুলো কেমন পুরুষালি?

এইসময় কুমুদিনী চা নিয়ে এলেন। তারকবাবু বললেন–চা খাও অভ্র।

কুমুদিনী বসলেন। স্বামী উদ্দেশে বললেন কী ঠিক হল?

তারকবাবু বললেন–অভ্রকে রিকোয়েস্ট করছি। ও বুদ্ধিমান শক্তিমান ছেলে।

অভ্র চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল–হু। সত্যি মিটিরিয়াস মনে হচ্ছে। তারপর চায়ের কাপ হাতে নিয়েই সে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। জানলার বাইরেটা দেখে নিয়ে ঘুরে ঘরের ভেতরটা দেখতে থাকল। তারপর বলল–চিঠিটা কোথায় ছিল?

তারকবাবু বিছানার ওপর একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন–এখানে। দলাপাকানো অবস্থায় পড়ে ছিল।

তার মানে জানলা দিয়ে বাইরে থেকে ছুঁড়ে দিয়েছে।

–আমারও তাই ধারণা।

 –জানলা দিয়ে নিশ্চয় কেউ গার্গীকে ডেকেছিল। খুব চেনা কেউ।

–হ্যাঁ। ওই সেনসায়েবই। আবার কে? নইলে কি বেরুত?

–ঠিক আছে, আমি যাব তারককাকা। কিন্তু আপনিও সঙ্গে চলুন।

 তারকবাবু একটু ভেবে নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে যেন সায় চেয়ে বললেন মন্দ বলনি। হ্যাঁ, আমিও যাই তোমার সঙ্গে। আজ সন্ধ্যাতেই। রেলে ম্যানেজ করার অসুবিধে হবে না। চেনাজানা বিস্তর আছে।

কুমুদিনী তক্ষুনি চোখ বুজে দুহাত জোড় করে বললেন, দুর্গা দুর্গা!…