৩. গ্রুস্তান পরিবার

৩. গ্রুস্তান পরিবার

রিহান বাটি থেকে চুমুক দিয়ে স্যুপটা শেষ করে খালি বাটিটা ত্রানাকে ফেরত দিল। ত্রানার বয়স দশ যদিও তাকে দেখে আরো কম মনে হয়। সে খালি বাটিটা হাতে নিয়ে সাথে সাথে চলে গেল না, রিহানের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল। রিহান চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, কী হল ত্রানা, তুমি কিছু বলবে?

ত্রানা মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাও, লজ্জা করো না, জিজ্ঞেস করে ফেলো।

ত্রানা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, তোমার পা যে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে তোমার ব্যথা করে না?

রিহান শিকল দিয়ে বাঁধা ডান পাটি নাড়িয়ে বলল, নাহ। অভ্যাস হয়ে গেছে।

ত্রানা এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, তোমাকে বেঁধে রেখেছে কেন? তুমি কি খুব ভয়ংকর?

রিহান মুখে হাসি টেনে আনার চেষ্টা করে বলল, তোমার কী মনে হয়?

আমি জানি না। ত্রানা তার মুখে বয়সের তুলনায় বেশি গাম্ভীর্য ফুটানোর চেষ্টা করে বলল, বাবা বলেছে তুমি খুব ভয়ংকর সেজন্যে তোমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে।

রিহান কী বলবে বুঝতে না পেরে বিস্ময়াভিভূত বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্রানা গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো বলল, বাবা বলেছে তুমি নিশ্চয়ই তোমার কমিউনে কাউকে খুন করে পালিয়ে এসেছ। তোমার কমিউনের লোকেরা তোমাকে নিশ্চয়ই খুঁজছে।

রিহান হেসে বলল, আমি যদি আসলেই ভয়ংকর হতাম তা হলে কি তোমার বাবা তোমার মতো এরকম একটা ছোট মেয়েকে দিয়ে স্যুপ পাঠাত?

ত্রানা ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে মাথা নেড়ে বলল, সেটা তুমি ঠিকই বলেছ।

আসলে আমাকে তো কেউ চেনে না তাই সবাই ভয় পায়। অচেনা মানুষকে সবাই ভয় পায়।

ত্রানা কিছুক্ষণ রিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বাবা যখন তোমাকে এনেছিল আমরা সবাই ভেবেছিলাম তুমি মরে যাবে?

আমিও তাই ভেবেছিলাম।

তুমি কি তোমার কমিউন থেকে পালিয়ে এসেছ?

সেটা অনেক বড় গল্প।

ত্রানার চোখ চকচক করে ওঠে, তার খুব গল্প শোনার শখ। রিহানের আরেকটু কাছে এসে বলল, আমাকে গল্পটা বলবে?

রিহান ত্রানার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু তুমি কাউকে বলে দেবে না তো?

জানা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, কাউকে বলব না। ঈশ্বরী প্রিমার কসম!

ঈশ্বরী প্রিমা! রিহানের বুকের ভেতর হঠাৎ ধক করে ওঠে, প্রভু ক্লডের হাত থেকে সে কোনোভাবে বেঁচে এসেছে, এখানে আছেন ঈশ্বরী প্রিমা। আবার কি নূতন করে কোনো বিপদে পড়বে? ঈশ্বরী প্রিমা যখন তার সম্পর্কে জানবে তখন কী হবে তার?

জানা একটু অধৈর্য গলায় বলল, কী হল? বলবে না?

হ্যাঁ বলব। আরো কয়দিন যাক তারপর বলব।

ত্রানার খানিকটা আশাভঙ্গ হল, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন কন্টেইনারের দরজায় ছোট ছোট কয়েকটা ছেলেমেয়ে ভিড় করে এসে ডাকাডাকি রু করে দেয়। তাদের খেলার সময় হয়েছে এবং ত্রানাকে ছাড়া খেলা কিছুতেই জমে ওঠে না!

ত্রানা চলে যাবার পর রিহান উঠে দাঁড়ায়, তাকে কয়েক মিটার লম্বা একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, কন্টেইনারের ভেতরে সে একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারে, খোলা দরজার কাছাকাছি বসে বাইরে তাকাতে পারে কিন্তু এর কেশ কিছু করতে পারে না। রিহান কন্টেইনারের ভেতর পায়চারি করতে থাকে, ত্রানাকে বলেছে পায়ের মাঝে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকতে তার অভ্যাস হয়ে গেছে কিন্তু আসলে অভ্যাস হয় নি। একজন মানুষ সম্ভবত অন্য। অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হতে পারে কিন্তু শেকল বাঁধা অবস্থায় বেঁচে থাকতে কখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠে না।

.

তালা খোলার শব্দে রিহান ঘুম থেকে জেগে ওঠে। গ্রুস্তান কন্টেইনারের তালা খুলে ভিতরে এসে ঢুকেছে। এখন খুব সকাল, ভালো করে দিনটি শুরু হয় নি। গ্রুস্তান রিহানের পায়ে বাধা শিকলটির অন্য মাথায় তালাটি খুলে বলল, চল।

রিহান আগেও লক্ষ করেছে গ্রুস্তান খুব কম কথার মানুষ। এর আগেও রিহান তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু সুবিধে করতে পারে নি। তার প্রাণ রক্ষা করার জন্যে সে অনেকবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে, গ্রুস্তানের কোনো ভাবান্তর হয় নি। শেকল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখার ব্যাপারটি নিয়ে রিহান অনেকবার কৌতূহল কিংবা আপত্তি প্রকাশ করেছে গ্রুস্তান সেখানেও কখনো কোনো কথা বলে নি, তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে একজন মানুষকে পশুর মতো শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা সম্ভবত খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।

রিহান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কোথায়?

গ্রুস্তান উত্তর না দিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে।

রিহান নিজের শেকলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, আমাকে আগে খুলে দাও।

না।

কেন নয়?

আমাদের আক্রমণ করতে আসছে, তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে।

রিহান ভয়ংকরভাবে চমকে উঠল, মাথা ঘুরিয়ে গ্রুস্তানের দিকে ভালো করে তাকাল, চুপচাপ ঠাণ্ডা ধরনের মানুষটির চেহারার মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা। রিহান কান পেতে শুনতে পেল বাইরে মানুষজন ছোটাছুটি করছে, নীরব এক ধরনের ব্যস্ততা, কোনো একটা কমিউনে যখন বাইরের কোনো দল আক্রমণ করে তখন এরকম অস্থির একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

রিহান জিজ্ঞেস করল, আমাকেও যুদ্ধ করতে হবে?

হ্যাঁ।

শেকল দিয়ে বেঁধে রাখলে কেমন করে যুদ্ধ করব?

তুমি যেহেতু পালাতে পারবে না তাই জানপ্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করবে। তা ছাড়া—

তা ছাড়া কী?

তোমাকে আমরা চিনি না। তোমার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, এমনও হতে পারে যারা আসছে তারা তোমাদেরই মানুষ।

রিহান হতবুদ্ধি হয়ে গ্রুস্তানের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু গ্রুস্তান সুযোগ দিল না, শেকলে টান দিয়ে বলল, চল। তাড়াতাড়ি।

রিহান কন্টেইনারের বাইরে পা দিয়ে চারদিকে তাকায়। ট্রাকগুলো গোল করে সাজানো হয়েছে। মানুষেরা অস্ত্র হাতে ছোটাছুটি করছে। একটা ট্রাকের ছাদে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ বাইনোকুলার দিয়ে দূরে দেখার চেষ্টা করছে। রিহান কান পেতে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা মোটরবাইকের ইঞ্জিনের মৃদু গর্জন শুনতে পায়, মনে হয় বেশ বড় একটা বহর এদিকে আসছে।

গ্রুস্তান একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের হাতে রিহানের শিকলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, একে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। ফ্রন্ট লাইনে কোনোকিছুর সাথে বেঁধে রেখো।

ঠিক আছে।

এর কাছাকাছি থেকে তোমরা।

থাকব।

মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে একটু নার্ভাস দেখায়, সে কাঁপা গলায় বলল, ঈশ্বরী প্রিমা কী বলেছেন?

এখনো কিছু বলেন নি। তোমরা ফ্রন্ট লাইনে চলে যাও ঈশ্বরীর নির্দেশ আসা মাত্রই জানিয়ে দেব।

ঠিক আছে।

মধ্যবয়স্ক মানুষ দুজন কঠোর চেহারার মেয়েকে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। রিহানের পায়ে বাধা শিকলটা গুটিয়ে নিয়ে একজন মেয়ে তার হাতে একটা মাঝারি শক্তির স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে বলল, এটা হাতে রাখ। ফ্রন্ট লাইনে গিয়ে কেমন করে চালাতে হয় শিখিয়ে দেব।

রিহান অস্ত্রটা একনজর দেখল, আমাকে শিখাতে হবে না। আমি এটা চালাতে জানি।

মেয়েটা একটু অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল, রিহান বলল, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চল।

পাথুরে রাস্তা দিয়ে রিহান এবং অন্য তিনজন এগিয়ে যায়। প্রায় কয়েক শ মিটার দূরে বড় বড় কিছু পাথরের কাছে এসে সবাই দাঁড়াল। মধ্যবয়স্ক মানুষটি এদিক–সেদিক তাকিয়ে একটা পুড়ে যাওয়া লরির এক্সেলের সাথে রিহানের শেকলটা বেঁধে দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেল। রিহান বলল, আমাদের আরো সামনে যাওয়া দরকার।

মানুষটি অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল। তুরু কুঁচকে বলল, কী বললে?  

বলেছি, আমাদের আরো সামনে যাওয়া দরকার।

কেন?

মোটরবাইকগুলোকে তা হলে আমরা সামনাসামনি পাব। একেবারে খোলা টার্গেট। এখানে থাকলে সেগুলো হঠাৎ করে চলে আসবে আমরা প্রস্তুত হবারও সময় পাব না।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি খানিকক্ষণ বিস্ফারিত চোখে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, আমাদের কী করতে হবে সেটা তোমার কাছ থেকে শোনার কোনো প্রয়োজন নেই। সেজন্যে ঈশ্বরী প্রিমা আছেন।

রিহান অপমানটা গায়ে মাখল না, একটু পরেই এখানে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হবে, এখন মান–অপমান নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। রিহান তার বুকের ভেতর ভয় এবং অস্থিরতার এক ধরনের কাপন অনুভব করে। বহু দূরে ধুলো উড়িয়ে মোটরবাইকগুলো আসছে, মোটরবাইকের গুঞ্জন এবারে বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। রিহান কান পেতে কিছুক্ষণ শুনে একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, বেভাস্টিসি ৪৩!

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, কী হয়েছে?

বেভাষ্টিসি ৪৩ মোটরবাইক। দুই হাজার সিসির ইঞ্জিন!

তুমি কেমন করে জান?

শব্দ শুনে বোঝা যায়। আমি চালিয়েছিলাম একবার, খুব শক্তিশালী মেশিন!

মধ্যবয়স্ক মানুষ এবং মেয়ে দুটি রিহানের উচ্ছাসে কোনো অংশ না নিয়ে দুই পাশে সরে যেতে থাকে। রিহান তবু দমে গেল না, বলল, বেভাস্টিসি ৪৩-এর খুব বড় গোলমাল আছে

মধ্যবয়স্ক মানুষটি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, কোনো যন্ত্রপাতি নিয়ে তুমি কোনো অশোভন উক্তি করবে না। খবরদার।

রিহান থতমত খেয়ে বলল, আমি কোনো অশোভন উক্তি করছি না। যেটা সত্যি সেটা বলছি। গ্যাসোলিন ট্যাংকটা অরক্ষিত। হালকা এলুমিনিয়ামের মান্ড। বারো গ্রামের এক্সপ্রেসিভ বুলেট দিয়ে গুলি করলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি তার অন্য দুইজন সঙ্গীর দিকে তাকাল এবং সবাই মিলে রিহানকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আশপাশে অস্ত্র বসানোর ভালো জায়গা খুঁজতে শুরু করে। বড় একটা। পাথরের উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি দাঁড় করিয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটি মাথা নিচু করে সেটার প্রতি সম্মান দেখাল, বিড়বিড় করে কিছু একটা উচ্চারণ করে অস্ত্রটির ব্যারেলে হাত দিয়ে স্পর্শ করে কপালে ছোঁয়াল।

ঠিক এরকম সময়ে গ্রুস্তানকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়। পাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সে কিছু একটা বলতে বলতে ছুটে আসছে। কাছাকাছি এসে গ্রুস্তান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ঈশ্বরী প্রিয়ার নির্দেশ এসে গেছে।

মধ্যবয়স্ক মানুষটা খুশি হয়ে গেল, জয় হোক ঈশ্বরী প্রিমার। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে দুইজনের একজন বলল, কী বলেছেন ঈশ্বরী প্রিমা?

বলেছেন এগুলো বেভাষ্টিসি ৪৩ মোটরবাইক। এর গ্যাসোলিন ট্যাংক হালকা এলুমিনিয়ামের মোন্ড। বারো গ্রামের এক্সপ্রেসিভ বুলেট দিয়ে গুলি করতে বলেছেন।

মধ্যবয়স্ক মানুষ এবং তার সাথের মেয়ে দুজন কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তাদের মুখ দেখে মনে হল তারা গ্রুস্তানের কথা বুঝতে পারছে না। গ্রুস্তান একটু অবাক হয়ে বলল, কী হল তোমাদের?

না–না–কিছু না। বলে মধ্যবয়স্ক মানুষটি রিহানের দিকে তাকাল। হঠাৎ করে তার চোখে এক ধরনের ভীতি ফুটে উঠেছে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না ঈশ্বরী প্রিমার কথাটুকু রিহান আগেই বলে দিয়েছে।

গ্রুস্তান অবিশ্যি সেটা বুঝতে পারল না, সে বলল, ঈশ্বরী বলেছেন তোমরা আরো সামনে যাও। তা হলে মোটরবাইকগুলোকে সামনাসামনি আক্রমণ করতে পারবে। একেবারে খোলা টার্গেট হিসেবে পেয়ে যাবে, যাও দেরি করো না।

গ্রুস্তান যেভাবে ছুটে এসেছিল ঠিক সেভাবে পাথরের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে কমিউনের দিকে ফিরে গেল। রিহান তার হাতের অস্ত্রটি হাত বদল করে বলল, এখন আমার কথা বিশ্বাস হল?

মধ্যবয়স্ক মানুষটি কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, তুমি কেমন করে জেনেছ?

রিহান কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সেটা নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। এখন তাড়াতাড়ি চল। দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

মানুষটি পোড়া লরির দিকে এগিয়ে গিয়ে শেকলের তালা খুলে আনে। সেটা শক্ত করে ধরে রেখে কঠোর দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে বলল, সামনে এগিয়ে যাও। একটু যদি বাড়াবাড়ি কর তা হলে আমি কিন্তু তোমাকে খুন করে ফেলব। ঈশ্বরী প্রিমার কসম।

শক্ত চেহারার মেয়েটি রিহানকে পিছনে ধাক্কা দিয়ে সামনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, যুদ্ধ শেষ হলে ঈশ্বরী প্রিমার কাছে তোমাকে রিপোর্ট করতে হবে।

অন্য মেয়েটি বলল, রিপোর্ট করতে হবে না। ঈশ্বরী প্রিমা নিজেই জেনে যাবেন।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, জয় হোক ঈশ্বরী প্রিমার।

অন্য দুজন যন্ত্রের মতো বলল, জয় হোক।

.

দুই শ মিটার দূরে খানিকটা উঁচু চালে রিহান এবং অন্য তিনজন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো তাক করে নিয়ে মোটরবাইকগুলোর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। মুখ খুললে পরে বিপদ হতে পারে নিশ্চিত জেনেও রিহান বলল, রেঞ্জের ভিতরে না আসা পর্যন্ত গুলি করবে না। লেজার লক গ্যারান্টি হবার পর ট্রিগারে হাত দেবে। তার আগে নয়।

এটি ঈশ্বরী প্রিমার নির্দেশ নয়, তারপরেও মধ্যবয়স্ক মানুষ এবং সাথের মেয়ে দুজন সেটি গোমড়া মুখে মেনে নিল। তারা বুঝে গিয়েছে রিহানের ভেতরে কিছু একটা আছে যেটা তাদের নেই। সেটা কী তারা ধরতে পারছে না সেজন্যে তারা খুব অস্বস্তিতে আছে। রিহানের কথামতো তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে এবং মোটরবাইকের বহরটি যখন খুব কাছাকাছি হাজির হয়েছে তখন টার্গেট লক ইন করে তারা ট্রিগার টেনে ধরল, সাথে সাথে পুরো পরিবেশটি ভয়ংকর হয়ে উঠল। চোখের পলকে তিনটি মোটরবাইক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেল। মানুষের চিৎকার, গোলাগুলি এবং বারুদের গন্ধে পরিবেশটি নারকীয় হয়ে ওঠে। আক্রমণকারী দলটি বেপরোয়া, দলের অর্ধেক যোদ্ধাই মহিলা, তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে বারবার তাদের ব্যুহ ভেদ করে চলে আসতে চেষ্টা করছিল। গ্রুস্তান আরো কিছু মানুষ নিয়ে তাদের সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে। আসে। ভয়ংকর গোলাগুলিতে পুরো এলাকাটা প্রকম্পিত হতে থাকে।

যুদ্ধটা যেরকম প্রায় হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল সেরকম হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল। আক্রমণকারী দলটি হঠাৎ করে পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মোটরবাইকে তাদের আহত পুরুষ এবং মেয়েদের তুলে নিয়ে গুলি করতে করতে ধুলো উড়িয়ে তারা দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। বড় ধরনের কোনো ক্ষতি ছাড়াই শত্রুকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সবার ভেতরে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে। মোটামুটিভাবে পুরো এলাকাটা একটা উৎসবের মতো আনন্দে মেতে উঠল। সবাই কমিউনে ফিরে যাবার পর রিহান আবিষ্কার করল সে একা এখানে রয়ে গেছে। শেকল দিয়ে তাকে একটা ট্রাকের এক্সেলের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল, তাকে খুলে নিয়ে যাবার কথা কারো মনে নেই।

রিহান অবিশ্যি তাতে খুশিই হল। কন্টেইনারের ছোট ঘুপচি ঘরে সে দীর্ঘদিন থেকে আটকা পড়ে আছে। বাইরে খোলা প্রান্তরে বসে থাকতে তার খারাপ লাগছে না। রিহান একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে দূরে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক জানা নেই কেন তার মনটা বিষণ্ণ হয়ে আসছে। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল জানা নেই, হঠাৎ শুনল রিহান।

বাচ্চা মেয়ের গলার স্বর। রিহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, ত্রানা ছোট একটা পানীয়ের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিহান নরম গলায় বলল, কী খবর ত্রানা!

তুমি এখানে একা একা কেন বসে আছ?

আমাকে এখানে বেঁধে রেখেছে।

ও! ত্রানা কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে তার দিকে পানীয়ের বোতলটি এগিয়ে দেয়, এইটা তোমার জন্যে এনেছি।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ত্রানা। রিহান পানীয়ের বোতলটা খুলে ঢকঢক করে গলায় খানিকটা উত্তেজক পানীয় ঢেলে বলল, আমার কথা সবাই ভুলে গেছে মনে হয়।

উঁহু। ত্রানা মাথা নাড়ল, ভোলে নি।

রিহান একটু অবাক হয়ে তাকাল, তুমি কেমন করে জান?

আমি বাবাকে অন্যদের সাথে কথা বলতে শুনেছি।

কী কথা বলছে?

ত্রানা মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। তোমাকে মনে হয় ঈশ্বরী প্রিমার কাছে নিয়ে যাবে।

রিহান চমকে উঠে বলল, কী বললে?

ত্রানা ভুরু কুঁচকে রিহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি খুব ভয়ংকর, তাই না?

রিহান কোনো কথা বলল না, সে মোটেই ভয়ংকর নয়। সে অন্যরকম। অন্যরকম মানে ভয়ংকর নয়। কিন্তু এই কথাটি সে কেমন করে অন্যদের বোঝাবে?