ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৩. গুরুশিষ্য সংবাদ

৩. গুরুশিষ্য সংবাদ

দ্বিরদ ও বিদর্ভ নামক রাজ্যদুটির মাঝখানে অবস্থান করছে বিশাল বিস্তীর্ণ বনভূমি। দ্বিরদ রাজ্যের সীমানা থেকে যে সুদীর্ঘ বনপথ অরণ্যের গর্ভে হারিয়ে গেছে, সেই পথ ধরে লোকালয় থেকে বহুদূরে গভীর থেকে গভীরতর বনভূমির দিকে এগিয়ে চলেছে একটি কিশোর। তার মুখ বিষণ্ণ, দৃষ্টি উদভ্রান্তের মতে, মন্থর পদক্ষেপের ভঙ্গিতে মনে হয় কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য তার নেই– সে যেন চলার জন্যই চলছে, চলছে আর চলছে..

হঠাৎ চমকে থেমে গেল সে মুহূর্তের জন্য মুখের উপর বিষাদের কালো ছায়াকে মুছে দিয়ে জাগল উচ্ছ্বসিত পুলকের আভাস, অজ্ঞাতসারেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল অস্ফুট আনন্দধ্বনি, বাঃ!

ঘন বনের ভিতর দিয়ে পথটা যেখানে একটা ফাঁকা ঘাসজমির উপর এসে পড়েছে, সেইখানে তৃণভোজনে ব্যস্ত রয়েছে একদল হরিণ। মৃগযুথের চিত্রবিচিত্র দেহের উপর অপূর্ব সৌন্দর্যের মায়াজাল ছড়িয়ে হাসছে অপরাহ্নের রক্তিম সূর্যালোক। অপ্রত্যাশিত ওই দৃশ্য মুহূর্তের জন্য কিশোরকে ভুলিয়ে দিয়েছিল তার বর্তমান পরিস্থিতি, তার দুঃখ, তার হতাশা কিন্তু পরক্ষণে যে ঘটনা ঘটল, তার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না সে…।

একটা অস্ফুট শব্দ, যে শব্দ মানুষের কর্ণগোচর হয় না, একটা অতি মৃদু গন্ধ, যে গন্ধ বনের বাতাস মানুষের নাকে পৌঁছে দেয় না সেই শব্দ ও গন্ধ বনের বাতাসে ভেসে যায় বনের সন্তানের কাছে

সামনে যে মস্ত শৃঙ্গী হরিণটা তৃণাবৃত প্রান্তর থেকে খাদ্য আহরণ করছিল, সে হঠাৎ চমকে মুখ তুলে তাকাল এবং সভয়ে দেখল গাছের আড়াল থেকে তাকেই লক্ষ্য করছে একটি দ্বিপদ মনুষ্য! তীব্রকণ্ঠে দলকে সতর্ক করে পাশের জঙ্গলের দিকে ছুটল দলপতি শৃঙ্গী এবং তাকে অনুসরণ করে হরিণের দল বিদ্যুতের মতো অন্তর্ধান করল অরণ্যের অন্তঃপুরে!

হরিণের গমনপথের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে কিশোর সামনে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করল, কিন্তু তার গতিরুদ্ধ হল পরক্ষণেই। আচম্বিতে তার পায়ের কাছে বিস্তৃত গুচ্ছবদ্ধ তৃণগুল্মের ভিতর থেকে উঠে দাঁড়াল একটি অস্ত্রধারী মানুষ হাতে ধনুর্বাণ, কোমরে ছুরি ও তলোয়ার!

লোকটি ক্রদ্ধদৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল, কে রে তুই? কোন নরক থেকে এখানে এসে উদয় হয়েছিস রে?… ঈস! আর এক লহমার মধ্যেই শিঙালটাকে বিধে ফেলতাম, তুই এসে তৈরি শিকার ফসকে দিলি?

কিশোর ভয়ার্তকণ্ঠে বলল, আমি বুঝতে পারি নি, আমি

তোকে বুঝিয়ে দিচ্ছি, ক্রুদ্ধ শবর হাতের ধনুর্বাণ পৃষ্ঠে স্থাপন করে সজোরে মুষ্ঠাঘাত করল কিশোরের মুখে। অস্ফুট আর্তনাদ করে কিশোর ছিটকে পড়ল মাটিতে। শবর ক্ষান্ত হল না, ছেলেটিকে মাটি থেকে তুলে সে বলে উঠল, ভবিষ্যতে যাতে কারও শিকারে বাগড়া না দিস, তাই তোকে আজ কিছু শিক্ষা দিয়ে যাব।

শবরের মুষ্ঠিবদ্ধ দক্ষিণ হস্ত আন্দোলিত হল, কিন্তু আঘাত নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই পিছন থেকে একটি হাত তাকে ধরে ফেলল। পরক্ষণেই প্রবল আকর্ষণে সে ছিটকে সরে এল কয়েকহাত দূরে!

বিস্মিত শবর সচমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল সেখানে আত্মপ্রকাশ করেছে একটি যুবক! আগন্তুক শবরের মতোই অস্ত্রধারী, তারও কোমরে ঝুলছে কোষবন্ধ অসি এবং পৃষ্ঠদেশে শোভা পাচ্ছে ধনুক ও তীক্ষ্ণশরে পরিপূর্ণ তুণীর; উপরন্তু তার কটিবন্ধে আবদ্ধ রয়েছে একটি শিঙা বা রণভেরী। এমন নিঃশব্দে সে এসে দাঁড়িয়েছে যে, কিশোর অথবা শবর তার উপস্থিতি জানতেই পারে নি।

চমকিত ও সচকিত শবর জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, তারপর উত্তেজিত ক্রুদ্ধকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, কে তুই? আমার গায়ে হাত দিলি কেন?

যুবক কঠোরস্বরে বলল, পামর! এই অসহায় কিশোরের উপর বীরত্ব প্রকাশ করছিস কেন?

বাক্য অসমাপ্ত রেখে আগন্তুক সজোরে চপেটাঘাত করল শবরের মুখে। একটা প্রচণ্ড শব্দ উঠল করতল ও গণ্ডের সংযোগে হাত দিয়ে গাল চেপে ধরে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করল প্রহৃত শবর।

যুবক আবার বলল, সমানে সমানে লড়াই করার সহাস থাকে তো এগিয়ে আয়। আর যদি ভয় হয়, তাহলে এই বালকের কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে অবিলম্বে স্থানত্যাগ করে চলে যা।

শবর আহত গণ্ডস্থল থেকে হাত নামিয়ে নিল, হিংস্র রোষকষায়িত চক্ষে আগন্তুককে নিরীক্ষণ করল, তারপর ভীষণ চিৎকারে বন কাঁপিয়ে অসি কোষমুক্ত করে ঝাঁপিয়ে পড়ল আগন্তুকের। উপর।

বিদ্যুৎবেগে নিজের তলোয়ার খাপ থেকে খসিয়ে এনে আক্রমণ ব্যর্থ করে দিল আগন্তুক এবং পরমুহূর্তেই তার হাতের তলোয়ার শত্রুর ডান কাঁধে ছোবল মেরে ফিরে গেল! আর্তনাদ করে অস্ত্র ফেলে বাঁ হাত দিয়ে দক্ষিণ স্কন্ধে রক্তাক্ত ক্ষতস্থান চেপে ধরল শবর। স্তম্ভিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল আক্রান্ত কিশোর তার ত্রাণকর্তার দিকে। এমন দ্রুত চকিত আবির্ভাব এবং ক্ষিপ্ত অসিচালনা তার কাছে অভাবনীয় ব্যাপার!

আবার দুলে উঠল তলোয়ার, অস্তায়মান সূর্যালোকে বিদ্যুৎরেখার মতো আবার ছুটে গেল শবরের দিকে প্রাণভয়ে আর্তনাদ করে উঠল শবর না, অসি তাকে আঘাত করে নি, যে চর্মরঙ্কু স্কন্ধবেষ্টন করে ধনুক ও শরপূর্ণ তুণীরকে পিঠের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল, খুরধার অসি সেই চামড়ার ফিতা কেটে ধনুক ও তুণীরকে ফেলে দিয়েছে মাটির উপর!

ভয়ার্ত শবরকে লক্ষ্য করে হেসে উঠল আগন্তুক, আমি নিরস্ত্র মানুষের অঙ্গে অস্ত্রাঘাত করি না। তবে তোর মতো কাপুরুষকে বিশ্বাস নেই– আড়াল থেকে তীর ছুঁড়ে তুই আমাকে হত্যা করতে পারিস, তাই তোর অস্ত্র হরণ করলাম। এইবার প্রাণ নিয়ে পলায়ন কর।

শবর নিচু হয়ে মাটি থেকে তার তলোয়ার তুলে নেবার উপক্রম করল। তাকে বাধা দিয়ে আগন্তুক বলল, না, ওটা ওখানেই থাকবে। শীঘ্র এই স্থান ত্যাগ কর। অধিকক্ষণ তোর কুৎসিত মূর্তি দর্শন কলে আমার ক্রোধের উদ্রেক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর ক্রোধ হলে তরবারির উপর আমার কর্তৃত্ব থাকে না, অসংযত অসি আমার অজ্ঞাতসারেই চালিত হয়ে তোর রক্তপান করতে পারে। অতএব এই মুহূর্তে স্থানত্যাগ করাই হবে তোর পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ।

এমন ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা শুনে শবর আর বিলম্ব করল না, তরবারি ও ধনুর্বাণের মায়া ত্যাগ করে সে চটপট অদৃশ্য হল বনের আড়ালে। আগন্তুক তখন কিশোরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল, কিশোর! তুমি এই বনে কি করছ? এখানে মৃগয়ালুব্ধ শবর ব্যতীত কেউ প্রবেশ করে না। অবশ্য দ্বিরদ ও বিদর্ভ রাজ্যের মানুষ কখনো কখনো এই বন পার হয়ে এক রাজ্য থেকে অপর রাজ্যে যাতায়াত করে। কিন্তু সন্ধ্যার প্রাক্কালে একক নিঃসঙ্গ কোনো পথিক বনপথে যাতায়াত করে না, কারণ, এই অরণ্য হিংস্র শ্বাপদের প্রিয় বাসস্থান। তোমার এই বনপথ অতিক্রম করার এমন কি কারণ ঘটল যে, সন্ধ্যার সময়ে বনমধ্যে আসন্ন রাত্রির বিপদকে তুচ্ছ করে তুমি অগ্রসর হয়েছ? তুমি কি জানো না এই অরণ্যে নরখাদক সিংহ ও শার্দুল বাস করে?

কিশোর মুখ তুলল, আমাকে অত্যাচারী দুবৃত্তের কবল থেকে তুমি উদ্ধার করেছ, তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। এই পৃথিবীতে আমি একক নিঃসঙ্গ; আমার মৃত্যুতে অশ্রুপাত করার মতন কোনো ব্যক্তি কোথাও নেই। এই অরণ্য নরখাদক শ্বাপদের বাসস্থান কি না আমার জানা নেই; জানা থাকলেও বনে প্রবেশ করতে দ্বিধা করতুম না। ক্ষুধার্ত না হলে মাংসলোভী শ্বাপদও মানুষকে আক্রমণ করে না; কিন্তু দ্বিপদ মনুষ্য যে চতুস্পদ শ্বাপদের চাইতেও হিংস্র হতে পারে, এই মাত্র তার প্রমাণ পেলুম।

যুবক হাসল, তুমি চলেছ কোথায়?

–জানি না। যে দিকে দুচোখ যায়, সে দিকেই চলেছি।

এখনই রাত্রি নামবে। ঘন অন্ধকারে তোমার দুই চোখই হয়ে যাবে অন্ধ, তখন কি করবে?

তখন কোনো বৃক্ষের উপর আশ্রয় গ্রহণ করব।

বৃক্ষে আরোহণ করে ভল্লুক বা চিতাবাঘের কবল থেকে নিস্তার পাবে না। ওই দুটি জন্তু বৃক্ষ আরোহণে অতিশয় দক্ষ। তাছাড়া গাছের ডালে মহাকায় অজগর বা বিষধর সর্পের উপস্থিতি অসম্ভব নয়। তারাও তোমাকে রেহাই দেবে না।

তাহলে আজ রাতের মতো তুমিই আমাকে আশ্রয় দাও। তুমি আমাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছ, এখন আশ্রয় দিয়ে আমার প্রাণরক্ষা করো।

–বেশ। আজ রাতের মতন না হয় তোমাকে আশ্রয় দিলাম, কিন্তু তারপর তুমি কোথায় যাবে?

-আর্য! আমার একটি অনুরোধ রাখবে?

অসম্ভব না হলে অবশ্যই তোমার অনুরোধ রক্ষা করব।

-আর্য! তোমার বেশভূষা দেখলে মনে হয় তুমি পেশাদার সৈনিক। একটু আগেই তোমার অসিচালনার কৌশল আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে দিয়েছে। আমাকে তোমার শিষ্য করবে? যাবতীয় অস্ত্রচালনায় শিক্ষিত করে তুলবে? তোমার পৃষ্ঠে ধনুর্বাণ দেখে বুঝতে পারিছ তুমি দক্ষ তীরন্দাজও বটে।

কিশোর! তুমি কি যোদ্ধা হতে চাইছ? যুদ্ধব্যবসায়ী পেশাদার যোদ্ধা?

না, না, কিশোর ব্যগ্রকণ্ঠে বলল, অর্থের বিনিময়ে যারা যুদ্ধ করে, তারা ন্যায় অন্যায় বিচার করে না। আমি যদি অস্ত্রচালনায় দক্ষ হতে পারি, তাহলে অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে সর্বদা অস্ত্রধারণ করব। হে আর্যযোদ্ধা! আমায় বিমুখ কোরো না।

আগন্তুক কিছুক্ষণ মৌন থেকে কিশোরের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল, তারপর তার কঠোর গাম্ভীর্য ভেদ করে ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা, তোমার অনুরোধ আমি রাখব। রণবিদ্যায় দীক্ষিত হওয়ার জন্য এত আগ্রহ যার, তাকে বঞ্চিত করা অনুচিত। শিক্ষাগ্রহণের সময় আমার আস্তানাতেই তোমাকে বাস করতে হবে। তবে যেখানে আমার আস্তানা, সেই বাসস্থানও আমায় ছেড়ে যেতে হবে এক বৎসরের মধ্যে। ওই সময়ের মধ্যেই তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। আমার দুটি সঙ্গী আছে। তারা তোমায় তরবারি ও মল্লযুদ্ধের তালিম দেবে। কিন্তু আমার ভবিষ্যশিষ্যের নামটি তো এখনও জানলাম না।

–আমার নাম রাহুল। আমিও এখন পর্যন্ত আমার গুরুর নামটি জানি না।

-আমার নাম সুবন্ধু। তবে আমার সঙ্গীরা আমায় কুমার বলে সম্বোধন করে। তুমিও আমায় কুমার নামে ডাকতে পার। এখন একটু তাড়াতাড়ি পা চালাও। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই আমাদের আস্তানায় পৌঁছানো দরকার।

..রাহুল যখন ত্রাণকর্তার সঙ্গে তার আস্তানায় এসে উপস্থিত হল, তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। রাহুল দেখল একটি বৃহৎ কুটির তার আশ্রয়দাতার বাসস্থান। কুটিরের সামনে একটি লোক অগ্নিকুণ্ডের সম্মুখে ইতস্তত দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে। লোকটি যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া একনজর দেখলেই বোঝা যায় সে অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষ। রাহুল ও তার সঙ্গীকে দেখে সে বলে উঠল, কুমার! তুমিও তো শিকার পাও নি, দেখছি। তা, এই বালককে কোথা থেকে সংগ্রহ করলে?

সংক্ষেপে তাকে রাহুলের কাহিনি শুনিয়ে সুবন্ধু বলল, রাহুল! এর নাম বজ্র। আমার অন্যতম বন্ধু। এর কাছেই তুমি শিখবে লাঠির লড়াই। আমার আর এক বন্ধু এখানে উপস্থিত নেই। সে এখানে এলেই তোমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেব। সে দক্ষ তীরন্দাজ, তার কাছে তুমি ধনুর্বাণের তালিম নেবে।

রাহুল বলল, অরণ্য এখন অন্ধকার। আর্য, তোমার কাছে শুনেছি এই অরণ্য নরখাদক শ্বাপদের প্রিয় বাসস্থান। অন্ধকারে তোমার বন্ধু এখন কী করছে? যে কোনো মুহূর্তে মাংসলোলুপ পশুর আক্রমণে তার মৃত্যু ঘটতে পারে।

সুবন্ধু উত্তর দেওয়ার আগেই অট্টহাস্য করে বজ্র বলে উঠল, ওহে বালক! তুমি আশ্বস্ত হও। ক্ষুদ্রককে হত্যা করতে পারে এমন চতুষ্পদ জীব এখনও জন্মগ্রহণ করে নি… আরে! আরে! বলতে বলতেই দেখছি আমাদের বন্ধু এসে পড়েছে। ক্ষুদ্রকের ভাগ্য ভালো, আমাদের মতো শূন্যহাতে তাকে ফিরতে হয় নি।

রাহুল দেখল বন থেকে বেরিয়ে কুটিরের দিকে এগিয়ে আসছে অতিশয় খর্বকায় এবং অতিশয় বলিষ্ঠ এক ব্যক্তি, তার কাঁধের উপর অবস্থান করছে একটি বন্য শূকর। বলাই বাহুল্য শূকরটি জীবিত নয়, কিন্তু বিপুলবপু বরাহকে বহন করে যে-মানুষটি অনায়াস পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে, সে যে অত্যন্ত বলিষ্ঠ পুরুষ সে বিষয়ে সন্দেহ নাস্তি। লোকটি সুবন্ধু বা বজ্রের মতো বিশাল দেহের অধিকারী নয়, কিন্তু বৃষবৎ স্থূল মাংসল স্কন্ধ এবং পেশিবদ্ধ বাহু ও বক্ষ তার অসাধারণ শারীরিক শক্তির পরিচয় বহন করছে।

লোকটি অগ্নিকুণ্ডের কাছে এসে মৃত বরাহকে সশব্দে ভূমিতে নিক্ষেপ করে বলে উঠল, এই নাও, রাতের আহার্য পুস্তুত। জন্তুটাকে অনুসরণ করে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। বরাহ সহজে পরাজয় স্বীকার করেনি, শরে আহত হয়েও আমাকে আক্রমণ করতে ছুটে এসেছিল। দ্বিতীয়বার শরনিক্ষেপ করে শূকরের মস্তিষ্কভেদ করতে না পারলে এতক্ষণে আমার মৃতদেহ বন্যপশুদের ক্ষুধা তৃপ্ত করত সন্দেহ নেই।

অগ্নিকুণ্ডের আলোকে রাহুল দেখল শূকরের বামচক্ষু ভেদ করে একটি তীর মগজে পৌঁছে গেছে। রাহুল বুঝল আক্রমণোদ্যত ধাবমান শূকরের চক্ষুতে যে ব্যক্তি অব্যর্থ সন্ধানে তীরবিদ্ধ করতে পারে, সে অসামান্য তীরন্দাজ এর কাছেই তাকে ধনুর্বাণের শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে জেনে সে মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

সুবন্ধু রাহুলকে বরাহ শিকারির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। রাহুল সম্বন্ধে পূর্বোক্ত ব্যক্তিকে যাবতীয় তথ্য পরিবেশন করে সুবন্ধু বলল, রাহুল! এই আমার আর একটি বন্ধু। এর নাম ক্ষুদ্রক। তুমি এই ক্ষুদ্রকের কাছেই লক্ষ্যভদে শিক্ষা গ্রহণ করবে।

পরের দিন সকাল হতেই রাহুল তিন গুরুর কাছে বিভিন্ন অস্ত্রচালনা ও মল্লযুদ্ধের কৌশল শিক্ষা করতে লাগল। তবে সুবন্ধুর পরিচয় তাকে জানানো হয়নি, সঙ্গীদের মতন সেও তাকে কুমার নামেই সম্বোধন করত। সুবন্ধু তার দুই সঙ্গীর সাথে সহজভাবে সমকক্ষ বুন্ধুর মতো ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল কিন্তু বজ্র ও ক্ষুদ্রক যেদিন থেকে জানতে পেরেছিল সুবন্ধু প্রকৃতপক্ষে ছদ্মবেশি এক রাজপুত্র, দুর্ভাগ্যবশতঃ দুষ্ট লোকের ষড়যন্ত্রে পিতৃরাজ্য থেকে বঞ্চিত ও বিতাড়িত সেইদিন থেকেই সমীহবশে তারা সুবন্ধুকে কুমার নামে সম্বোধন করতে শুরু করেছিল।

পুরো দুটি মাস নিরলস অধ্যবসায়ের সঙ্গে অস্ত্রচালনা ও মল্লযুদ্ধের তালিম নেওয়ার পর রাহুল একদিন আবিষ্কার করল তার শরীরে প্রচুর পরিবর্তন ঘটেছে– শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঠেলে উঠেছে কঠিন মাংসপেশি এবং চোয়াল হয়েছে যোদ্ধাসুলভ কাঠিন্যে দৃঢ়। সে আরও বুঝেছে এই অরণ্যে কেবল শিকারের আনন্দ লাভ করার জন্যই সুবন্ধু ও তার দুই বন্ধু আস্তানা বাঁধেনি, তাদের কিছু গোপন অভিসন্ধি আছে। তারা তিনজনে সর্বদাই সশস্ত্র থাকে, সাময়িক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পরের সান্নিধ্য ত্যাগ করলেও একটি শিঙা অবস্থান করে তাদের কটিবন্ধে- রাহুল শুনেছে বনমধ্যে বিপদে পড়লে বিপন্ন ব্যক্তি শিঙার ফুকারে সংকেত পাঠিয়ে বন্ধুদের সাহায্য চাইতে সমর্থ হয়।

পূর্বে উল্লিখিত দুই মাসের মধ্যেই হঠাৎ একদিন এক রহস্যময় ব্যক্তির আবির্ভাব হল তিন বন্ধুর আস্তানায়। লোকটি সুবন্ধুর সঙ্গে নতস্বরে কিছু আলোচনা করল এবং একটি দিন কুটিরে বাস করেই আবার উধাও হয়ে গেল। রাহুল লক্ষ্য করেছিল লোকটি সশস্ত্র, তবে ধনুর্বাণের পরিবর্তে তার কোমরে ঝুলছিল একটি সুদীর্ঘ তরবার। রাহুলের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে লোকটি কিছু একটা চিন্তা করছিল কিন্তু মুখ ফুটে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। সুবন্ধু ও তার সঙ্গীরাও লোকটির সঙ্গে রাহুলের পরিচয় করিয়ে দিল না। তবে তাদের কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে রাহুল জানতে পেরেছিল লোকটির নাম ভানু। সে চলে যাওয়ার পরেও ভানু সম্পর্কে কেউ যখন রাহুলকে কিছুই বলল না, তখন নিতান্ত কৌতূহলের বশেই সে বজ্রের কাছে ভানুর পরিচয় জানতে চাইল। তার তিন শিক্ষকের মধ্যে বজ্ৰকেই সবচেয়ে কাছের মানুষ বলে ভাবত রাহুল। ক্ষুদ্রক কথা বলত খুব কম; সুবন্ধু বা কুমার খুব হাসিখুশি সহজ মানুষ হলেও তার কঠিন ব্যক্তিত্ব এমন এক দূরত্বের সৃষ্টি করতে যে, রাহুল সেই বাধা এড়িয়ে কিছুতেই সুবন্ধুর কাছে সহজ হতে পারত না। বজ্র ছিল ব্যতিক্রম তার প্রকাণ্ড দেহের মধ্যে বাস করত একটি স্নেহপ্রবণ হৃদয়, কিশোর রাহুলের সঙ্গে সে ব্যবহার করত সমবয়সী বন্ধুর মতো। তবু রাহুলের প্রশ্ন শুনে সে গম্ভীর হয়ে গেল। রাহুল একটু আশ্চর্য হল, সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ব! ওই লোকটি কে? সে হঠাৎ এসে কী বলল? তার কথা শুনে কুমার দেখলাম খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠল ব্যাপারটা কী বলতো?

শোন রাহুল, বজ্র ঠিক বজ্রের মতোই কঠোর স্বরে বলল, তুমি যদি লাঠি, তলোয়ার, ধনুর্বিদ্যা বা মল্লযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু জানতে চাও, তাহলে আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব। কিন্তু অন্য কোনো প্রশ্ন বিশেষ করে আমাদের কুটিরে কোনো আগন্তুক সম্পর্কে প্রশ্ন করলে কোনো উত্তরই পাবে না। আরও একটা কথা জেনে রাখো, তোমার যেটুকু জানার আছে, সেইটুকুই জেনে সন্তুষ্ট থাকো– অধিকারের বাইরে কিছু জানতে চাইলে কুমার ক্রুদ্ধ হবে, হয়তো শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখেই তোমাকে এই কুটির ছেড়ে চলে যেতে হবে। কুমার নিজের থেকে কিছু না বললে কিছু জানতে চাইবে না।

হতভম্ব হয়ে রাহুল বলল, কিন্তু আমি তো কুমারের কাছে কিছু জানতে চাই নি। আমি তোমার কাছে ভানুর পরিচয় জানতে চেয়েছি।

আমিও তোমাকে আমার বক্তব্য জানিয়ে দিয়েছি, বজ্র কুটিরের ভিতর থেকে দুটি তৈলপক্ক বংশদণ্ড নিয়ে এল, এখন এস, লাঠি ধরো..