ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

৩. কুঁড়েঘরের ভিতর নিদ্রিত

আচ্ছা, এবার জিভারোদের গ্রামে একটা কুঁড়েঘরের ভিতর নিদ্রিত ফ্রাঙ্ক নোভাককে নিয়ে আবার কাহিনি শুরু করছি।

নোভাকের ঘুম ভাঙল অত্যন্ত রূঢ়ভাবে।

অচম্বিতে তার পাঁজরের উপর এসে পড়ল একটা লাথি আর শ্রবণেন্দ্রিয়ে আঘাত করলে অনেকগুলি মানুষের কণ্ঠস্বর। এমন সাংঘাতিক অভ্যর্থনা পেয়ে নোভাকের ঘুম ভেঙে গেল। সে ভাবল, এবার নিশ্চয়ই তার মুণ্ডুটাকে ঘচাং করে কেটে জিভারোদের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ত-সানটা করা হবে।

নোভাক ভালো করে চারদিকে তাকাল।

কুঁড়েঘরের ভিতর এসে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলি লোক।

যে সর্দার আগের রাতে নোভাকের বন্দুকটা অধিকার করেছিল সেই লোকটিও ভিড়ের মধ্যে আছে, তবে আজ তার হাতে বন্দুকের পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে একটা মস্ত ধনুক।

নোভাকের ঘুম ভেঙে যেতেই ধনুকধারী সর্দার কুটিরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চিৎকার করে বললে, চিচা ম্যনিয়ক!

নোভাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

চিচা হচ্ছে এক ধরনের উত্তেজক পানীয় আর ম্যনিয়ক একজাতীয় গাছের মূল, রেড-ইন্ডিয়ানদের প্রিয় খাদ্য।

নোভাক বুঝলে জিভারোরা এখনো তাকে হত্যা করার সঙ্কল্প করেনি। সেই ধরনের ইচ্ছা থাকলে অন্তত তাকে খাদ্য-পানীয় দিয়ে তারা আপ্যায়ন জানাবে না।

আহার্য এবং পানীয় নিয়ে এল একটি অর্ধবয়স্ক জিভারো রমণী। ক্ষুধার জ্বালায় বাঘ ঘাস খায় কিনা জানি না কিন্তু যে অপরূপ খাদ্য ও পানীয় কোনো শ্বেতাঙ্গ মানুষের গলা দিয়েই নামত না, সুসভ্য আমেরিকার অধিবাসী হয়েও ফ্রাঙ্ক নোভাক সেই বস্তু অম্লানবদনে গিলে ফেলল।

তবে স্বাদ যতই খারাপ তোক, শরীরের পক্ষে ওই খাদ্য ও পানীয় নিশ্চয়ই খারাপ নয়। কারণ, পানাহারের পরেই নোভাকের অবসাদ কেটে গেল, সে দস্তুরমতো সুস্থবোধ করলে।

এবার তাকে নিয়ে যাওয়া হল আর একটা কুটিরের দরজায়। গ্রামের মধ্যে যে কটা কুঁড়েঘর নোভাকের চোখে পড়েছিল এটা তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো।

যে সর্দার নোভাকের সঙ্গে এসেছিল সে নোভাককে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলে। কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করতেই নোভাকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল একটি বলিষ্ঠ দেহ মানুষের উপর।

লোকটির মুখ দেখে তার বয়স অনুমান করা যায় না, তবে সে যে একেবারে তরুণ নয়, এ কথাটা নোভাক সহজেই বুঝতে পারলে। লোকটির মুখের রেখায় রেখায় বহু অভিজ্ঞতার ছাপ, কিন্তু তার পেশীবহুল দেহের উপর বয়স স্বাক্ষর এঁকে দিতে পারেনি।

ঘরের ভিতর একটা কাঠের আসনের উপর বসে আছে সেই অপরূপ মনুষ্য-মূর্তি এবং তার পাশেই একটা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ঝুলছে তিনটি শুষ্ক নরমুণ্ড ও নোভাকের বন্দুক। নোভাক সবিস্ময়ে দেখলে মুণ্ড তিনটির গঠন স্বাভাবিক নরমুণ্ডের মতো হলেও একটি সাধারণ মানুষের মাথার তুলনায় মুণ্ডগুলি প্রায় চারগুণ ছোটো।

একেই বলে ত-সানটা, সঙ্কুচিত নরমুণ্ড!

উপবিষ্ট মানুষটির দিকে একনজর তাকিয়ে নোভাক বুঝল পূর্ববর্তী সর্দার একটি ছোটোখাটো দলের নায়ক মাত্র- এই হচ্ছে জিভারোদের প্রধান দলপতি!

দলপতি একা নয়, তার সঙ্গে রয়েছে দুজন স্ত্রীলোক।

একজন প্রৌঢ়া, অপরজন তরুণী।

প্রৌঢ়াকে দেখে নোভাক অনুমান করলে দলপতির স্ত্রী।

তরুণীর দিকে একবার তাকিয়ে সে চমকে উঠল।

জিভারো মেয়েদের সৌন্দর্য ইতিপূর্বেই নোভাকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু এই মেয়েটির সঙ্গে অন্য কোনো মেয়ের তুলনাই হয় না। দুর্ভেদ্য অরণ্যের অন্তরালে হিংস্র নৃমুণ্ড শিকারির অন্তঃপুরে এমন রূপসীর অস্তিত্ব কল্পনার অতীত- এক মুহূর্ত নোভাকের দৃষ্টি নিশ্চল হয়ে রইল মেয়েটির মুখের দিকে, পরক্ষণেই সে চোখ ফিরিয়ে নিলে।

মেয়ে দুটি ছাড়া তাঁবুর মধ্যে অন্য মানুষও ছিল।

 দলপতির পিছনে মাটিতে বিছানা পাতা রয়েছে এবং সেই শয্যা আশ্রয় করে শুয়ে আছে একটি কিশোর। অনেকগুলি চাদর ও কম্বল দিয়ে টাকা দেওয়া হয়েছে সেই ছেলেটিকে। কুটিরের মধ্যে খুব গরম— এই দারুণ গরমে ছেলেটিকে এতগুলো কাপড় কম্বল দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে দেখে নোভাক আশ্চর্য হল। সে লক্ষ করলে ছেলেটি টেনে টেনে অতিকষ্টে শ্বাসগ্রহণ করছে এবং তার উন্মুক্ত অধরোষ্ঠের আশেপাশে জমে উঠেছে নীলাভ ফেনা ও লালা নোভাক অনুমান করলে ছেলেটি অসুস্থ।

একটু পরেই ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় দলপতি কথা কইতে শুরু করলে। স্প্যানিশ ভাষা নোভাকের ভালোভাবেই জানা ছিল, দলপতির কথা বুঝতে তার অসুবিধা হল না।

কিছুক্ষণ কথাবার্তা চার্লিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে নোভাক জানতে পারলে দলপতির নাম হচ্ছে পনি। রোগশয্যায় শায়িত কিশোরটি পনির পুত্র তার নাম পটো। জিভারোদের ওঝা বলেছে বনের মধ্যে কোনো শয়তানের কু-নজর লেগেই পনির ছেলে পটো হয়েছে অসুস্থ। সেই শয়তানের মুণ্ড কেটে আনতে পারলেই নাকি পটো আরোগ্যলাভ করবে। সেই জন্যই জিভারো যোদ্ধারা চতুর্দিকে নরমুণ্ড শিকার করতে শুরু করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আসল শয়তানের মুণ্ডটা কেউ আনতে পারেনি।

হায় হায়, নোভাক ভাবলে, এই তুচ্ছ কারণে এতগুলো মানুষকে হত্যা করা হল!

কিন্তু জিভাবোদের নিবৃত্ত করবে কে? এই ওঝারা হচ্ছে রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সর্বশক্তিমান তাদের কথা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে একেবারে অকাট্য, অভ্রান্ত।

তারপর পনি যা বললে তা শুনে নোভাকের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। পনি বললে তাদের ওঝা বলেছে নোভাকই হচ্ছে সেই শয়তান। অতএব তার মুণ্ডটাকে স্কন্ধচ্যুত করতে পারলেই পটো করবে আরোগ্যলাভ।

নোভাকের মাথা গরম হয়ে উঠল। নির্বোধ, মুখ, বলে সে সবাইকে গালাগালি দিতে লাগল।

হঠাৎ ঘরের ভিতর ঢুকল একজন জিভারো, তার কাঁধে ও হাতে রয়েছে নোভাকের চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং আরও দুটো মস্ত মস্ত বাক্স।

পনি বললে, এই হচ্ছে তোমার ওষুধপত্র। আমি দেখেছি এইসব ওষুধ দিয়ে খ্রিস্টান পাদরিরা অসুস্থ লোকদের সারিয়ে দেয়। তুমি যদি খারাপ লোক না হও, তাহলে এক্ষুনি আমার ছেলেকে সারিয়ে দাও।

একটু থেমে সে আবার বললে, তুমি বলছো তুমি খারাপ লোক নও। বেশ, তাহলে আমার ছেলেকে সারিয়ে দাও। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই না, আমার ছেলে যদি সুস্থ হয়ে বেঁচে ওঠে তুমিও বাঁচবে! সে যদি মরে, তুমিও মরবে।

কি মুশকিল! নোভাক প্রতিবাদ করলে, ওর অসুখটা কি তাই তো আমি জানি না!

 ওকে বাঁচাও!

ওষুধ হয়তো কাজ না করতে পারে।

পনি তার পাশে যে ব্লো-গানটা ছিল সেটাকে তুলে নিলে, তারপর অঙ্গুলি নির্দেশ করলে খুঁটিতে দোদুল্যমান নরমুণ্ডগুলির দিকে ইঙ্গিত অতি স্পষ্ট।

নিরুপায় নোভাক শেষ পর্যন্ত বাক্স থেকে পেনিসিলিন ও ইনজেকশনের সরঞ্জাম বার করলে। যা থাকে বরাতে, একবার পেনিসিলিন দিয়ে দেখা যাক–কাপড় সরিয়ে নোভাক ছেলেটির নিতম্বে অ্যালকোহল লাগিয়ে দিলে। ঘরের মধ্যে সমবেত জিভারো পুরুষ ও নারী সকলেই খুব আগ্রহের সঙ্গে নোভাকের কার্যকলাপ দেখতে লাগল।

হঠাৎ ঘটনাস্থলে প্রবেশ করলে একটি জিভারো।

লোকটি নেহাৎ সাধারণ মানুষ নয়– কুটিরের দরজায় দণ্ডায়মান দুই প্রহরীকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে সে এসে দাঁড়াল দলপতি পনির সম্মুখে!

কয়েকজন ফিসফিস করে বলে উঠল, উইশিন! উইশিন!

 নোভাক বুঝল এই হচ্ছে জিভারোদের ওঝা!

লোকটার সর্বাঙ্গে ও মুখে বিভিন্ন রং দিয়ে নকশা আঁকা হয়েছে, কালো চুলে বাহার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি লাল আর কালো রঙের পাখির পালক, হাতে রয়েছে একটা কাষ্ঠদণ্ড এবং সেই দণ্ডের অঙ্গসজ্জা করা হয়েছে শুষ্ক অস্থিচূর্ণ, পাখির পালক ও লাল-নীল কাপড়ের সাহায্যে।

এই অপরূপ দণ্ডটি হচ্ছে তার যাদুদণ্ড।

লোকটির নাম ফ্যাচুয়ে।

কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। হঠাৎ লোকটি উগ্রকণ্ঠে চিৎকার করে পনির উদ্দেশ্যে কিছু বললে। প্রত্যুত্তরে পনিও চিৎকার করে উঠল। তারপর উভয়পক্ষে উচ্চৈঃস্বরে কথা কাটাকাটি চলল। নোভাক তাদের কথা খুব ভালো বুঝতে পারলে না, তবে এইটুকু সে বুঝল যে পটোকে ইনজেকশন দেওয়াতে ফ্যাচুরের আপত্তি আছে।

পনি অবশ্য সাদা চামড়ার মানুষের ওষুধে খুব বিশ্বাস করে, কিন্তু ফ্যাচুয়ের ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ উপেক্ষা করতে সে ভরসা পাচ্ছে না।

ওঝাদের ক্ষমতা রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে অতিশয় প্রবল। রোগের চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ে পরাক্রান্ত দলপতিও ওঝাদের কথার উপর কথা বলতে সাহস পায় না, আর এটা তোত একেবারেই চিকিৎসার ব্যাপার।

চিৎকার-চেঁচামেচি চলল, উভয়পক্ষই উচ্চৈঃস্বরে নিজের নিজের মত প্রকাশ করতে ব্যস্ত।

নোভাক কিন্তু এই চেঁচামেচিতে কান দিলে না, সে ছেলেটির দেহে ইনজেকশন করে দিলে!

 ছুঁচ ফুটতেই ছেলেটি আর্তনাদ করে উঠল।

ফ্যাচুয়ে ও পনি দুজনেই চমকে উঠে তর্ক বন্ধ করে ফেললে।  

নোভাক তখন তার কাজ শেষ করে ছুঁচটাকে বার করে আনছে। তর্কের অবকাশে কারও কোনো মতামতের অপেক্ষা না করে নোভাক যে ঔষুধ প্রয়োগ করতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা দুজনের কারও মাথাতেই আসেনি।

ওঝা রাগে জ্বলে উঠল।

পনি কিন্তু তখন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, সমস্ত ঘটনার দায়িত্ব যে এখন তার কাঁধ থেকে নোভাকের কাঁধে চেপেছে তাতেই সে খুশি।

ওঝা ফ্যাচুয়ে তখনও ক্রোধ প্রকাশ করছে উগ্রকণ্ঠে।

নোভাক হঠাৎ এগিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল, এই! শোনো!

ফ্যাচুয়ে চমকে উঠল। নোভাক ক্ষিপ্রহস্তে ফ্যাচুয়ের একটা হাত ধরে ফেললে তারপর ইনজেকশনের যন্ত্রপাতি জোর করে তার হাতে গুঁজে দিলে। হতভম্ব ফ্যাচুয়ে কিছু বলার আগেই নোভাক চিৎকার করে বললে, ঠিক আছে পটো সেরে যাবে।

তারপরই ধীর পদক্ষেপে সে কুটিরের বাইরে বেরিয়ে গেল। সশস্ত্র রক্ষীরা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ তাকে বাধা দিলে না।

কিছুক্ষণ পরে নোভাক ফিরে এল, আরও দুটো পেনিসিলিন ইনজেকশন দিলে রোগীর দেহে। তার বরাত ভালো ওষুধটা কাজে লেগে গেল। দুদিন পরেই অসুস্থ ছেলেটি ম্যনিয়ক সিদ্ধ আর কাকাতুয়ার মাংসের গ্রিল গোগ্রাসে খেতে শুরু করলে! আরও দিন সাতেক বাদে দেখা গেল রোগী অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে মিলে নদী থেকে মাছ ধরছে এবং গ্রামের পথে পথে ছুটোছুটি করে খেলে বেড়াচ্ছে।

নোভাক বুঝল ফ্যাচুয়ে যতই রাগ করুক, এ যাত্রা তার মুণ্ড যথাস্থানেই বজায় থাকবে। পনি তাকে কথা দিয়েছিল তার ছেলে যদি বাঁচে তাহলে নোভাককে হত্যা করা হবে না। নোভাক জানত রেড-ইন্ডিয়ানরা কখনো কথার খেলাপ করে না, অতএব বর্তমানে সে সম্পূর্ণ নিরাপদ।

জিভারোরা নোভাককে খুব আদর-যত্ন করলে একথা বললে ভুল হবে, তবে পনি তাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিলে। নোভাকের বন্দুক তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল এবং গ্রামের ভিতর যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালেও তাকে কেউ বাধা দিত না, কিন্তু গাঁয়ের বাইরে যাওয়ার স্বাধীনতা তার ছিল না। অর্থাৎ জিভাবোরা তার সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহার করলেও তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে তারা রাজি হয়নি।

বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। হঠাৎ একদিন পনির কুটিরে নোভাকের তলব পড়ল।

ঘরের মধ্যে ঢুকতেই নোভাককে ডেকে পনি বললে, তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিলুম! তুমি ম্যাকানিকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও- আজ থেকে তোমরা স্বামী-স্ত্রী।

কথাটা বলেই পনি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

নোভাক দেখলে ঘরের ভিতর সে আর পনির মেয়ে ম্যাকানি ছাড়া আর কেউ নেই। খানিকক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে সে মেয়েটির হাত ধরে পনির ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করলে।

পনির ঘরে প্রথম যে সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে নোভাক মুগ্ধ হয়েছিল এই হচ্ছে সেই মেয়ে ম্যাকানি! নোভাকের জিভারো বউ।

ব্যস, শুরু হল তাদের বিবাহিত জীবন।

জিভারোদের জীবনযাত্রায় কোনো জটিলতা নেই। পিতার সম্মতি পেলেই যে কোনো লোক কন্যার পাণিগ্রহণ করতে পারে। এজন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের দরকার হয় না।

নতুন বউ পেয়ে নোভাক খুবই খুশি হল। মেয়েটি দেখতেও যেমন সুন্দর, তার স্বভাব-চরিত্র তেমনই নম্ব। একটা বিষয়ে নোভাক বড়ো অসুবিধা বোধ করতে লাগল- ম্যাকানি স্প্যানিশ কিংবা ইংরাজি জানে না, শুধুমাত্র আকার ইঙ্গিতেই পরস্পরের মধ্যে ভাব বিনিময় করতে হত-~ কথা বলার কোনো উপায় ছিল না।

কিছুদিন পরে এই অসুবিধাও নোভাক আর অনুভব করলে না। ম্যাকানি বড়ো মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে এবং বুদ্ধিমতীও বটে। নোভাকের ইশারা সে সহজেই বুঝতে পারত আর খুব বেশি কথা কইবার জন্যেও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না, নোভাকের সঙ্গে থাকতে পারলেই সে খুশি থাকত। ম্যাকানিকে নোভাকের খুবই পছন্দ হল- এমন অনুগত স্ত্রী সুসভ্য ইউরোপীয় বা মার্কিনদের মধ্যেও বড়ো একটা দেখা যায় না।

একঘেয়ে ভাবে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। নোভাকের মনে আর বিপদের আশঙ্কা ছিল না, তবে সে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছিল- বুনো মানুষদের মধ্যে সংসার করে দিন কাটাতে সে আসেনি, সে এখানে এসেছে অন্য উদ্দেশ্যে। নোভাক বুঝল তেলের সন্ধান এখন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে গেলে জিভারোদের মনে নানা রকম সন্দেহ দেখা দিতে পারে, এমনকী হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতাটুকুও হয়তো আবার কেড়ে নেওয়া হবে। মনে মনে অস্থির হয়ে পড়লেও সে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল সুযোগের প্রতীক্ষায়…

জিভারোদের শান্ত জীবনযাত্রায় একদিন ঝড় উঠল।

যে লোকটিকে নিয়ে গোলমালের সুত্রপাত তার নাম নানিও।

এই নানিও একদিন ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত হল পনির কাছে তার মুখ ও শরীর ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত!

নানিও যা বললে তার মর্ম হচ্ছে এই–

নদীর ধারে সে মাছ রান্না করছিল। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হল একদল রেড-ইন্ডিয়ান। এই মানুষগুলিকে নানিও জানে তারা জিভারোদের গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে বাস করে। নদীর স্রোত যেদিকে চলে গেছে, এই নবাগত মানুষগুলোর গ্রামও সেইদিকে।

লোকগুলো এসেই হাতের লাঠি দিয়ে নানিওকে দারুণ প্রহার করলে! আহত নানিও যখন মাটিতে পড়ে ছটফট করছে, তখন লোকগুলি আবার অরণ্যের পথে অদৃশ্য হয়ে গেল। নানিরও ধারণা আক্রমণকারীরা দূরে কোথাও ক্যানো লুকিয়ে রেখেছিল, কার্য শেষ করে তারা আবার ক্যানো চার্লিয়ে জলপথে অদৃশ্য হয়েছে। খুব সম্ভব তারা এদিকে এসেছিল শিকার করতে, হঠাৎ নানিওকে একা পেয়ে তার উপর খানিকটা অত্যাচার করে গেল- জিভারোদের সঙ্গে এই উপজাতির মোটেই সদ্ভাব ছিল না, তাই বেচারা নানিওর কপালে এই লাঞ্ছনা।

নানিও আরও বললে যে লোকগুলির সঙ্গে বর্শা, ব্লো-গান প্রভৃতি অস্ত্র তো ছিলই, তার উপর তাদের মধ্যে একজন বন্দুকধারী। নানিওর সৌভাগ্যবশত তাকে কেউ অস্ত্রাঘাত করেনি, যদিও বন্দুকধারী লোকটি মাঝে মাঝে তাকে বন্দুক তুলে ভয় দেখিয়েছে।

নানিওর কাহানি শুনে জিভারোরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল- তারা এখনই যুদ্ধযাত্রা করতে চায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক সশস্ত্র জিভারো জনতা ক্যানো ভাসাবার জন্য প্রস্তুত হল। পুরুষ-যোদ্ধাদের সঙ্গে সেজেগুজে তৈরি হল জিভারো-মেয়েরা।

পনির বক্তব্য হচ্ছে মেয়েদের দেখলে শত্রুপক্ষ হয়ত অসাবধান হতে পারে। তাদের অসাবধানতার সুযোগে যদি আক্রমণ চালানো যায়, তাহলে নিশ্চয়ই খুব তাড়াতাড়ি জয়লাভ করা যাবে।

সাধারণত মারাত্মক যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে মেয়েরা অংশগ্রহণ করে না কিন্তু দলপতির ইচ্ছাতেই মেয়েরা এই অভিযানে যোগ দিলে।

সশস্ত্র যোদ্ধারা এবং মেয়েরা যখন নৌকার দিকে ছুটে চলল তখন পনি নোভাকের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, ক্রুদ্ধ উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, দাও! তোমার বন্দুকটা আমায় দাও! ওদের সঙ্গে একটা বন্দুক আছে, আমাদেরও একটা থাকা দরকার। তাড়াতাড়ি।

নোভাক বললে, না, আমি বন্দুক দেব না। তবে আমি তোমাদের সঙ্গে যেতে রাজি আছি! আমার বন্দুক আমার সঙ্গেই থাকবে, যদি দরকার হয় আমি নিজেই গুলি ছুড়ব- অন্য লোকের হাতে আমি বন্দুক দেব না।

পনি অসন্তুষ্ট হল, কিন্তু নোভাককে যেতে বারণ করলে না।

যোদ্ধাদের সঙ্গে নৌকায় চড়ে নোভাক যুদ্ধ যাত্রা করলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জিভারোদের ক্যানো নৌকাগুলি শত্রুপক্ষের গ্রামের কাছে নদীর তীরে ভিড়ল। শক্ত কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে গ্রামের কুটিরগুলিকে। সেই বেড়ার আড়ালে আত্মগোপন করে শত্রুরা ওত পেতে আছে জিভারোদের অপেক্ষায়। কাঠের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শত্রুর অস্ত্র সজ্জা ব্লো-গান, তীরধনুক, বর্শা, ম্যাচেট, মুগুর প্রভৃতি মারাত্মক অস্ত্রগুলি নোভাকের চোখে পড়ল। নানিও যে বন্দুকধারীর উল্লেখ করেছিল তাকেও নোভাক দেখতে পেল। সেটা বন্দুক নয় রাইফেল- কিন্তু তেলের অভাবে অস্ত্রটার অবস্থা অতিশয় শোচনীয়। নোভাক বুঝল রাইফেলের অধিকারী অস্ত্রটাতে কখনো তেল দেয় না, খুব সম্ভব তেল দেওয়ার পদ্ধিত সম্বন্ধে তার কোনো জ্ঞান নেই– ফলে বহুদিন ধরে মরচে পড়ে রাইফেলটার অবস্থা এমন হয়েছে যে গুলি চালালে অস্ত্রটা হয়তো অস্ত্রধারীর হাতেই ফেটে যেতে পারে।

নৌকাগুলি নদীতীরে থেমে যেতেই পনি ডাঙায় নামল। তার সঙ্গে নামল মেয়েরা আর কয়েকটি পুরুষ যোদ্ধা।

শত্রুরা বেড়ার গাত্র-সংলগ্ন দরজাটা খুলে দিলে। মেয়েদের দেখে তাদের ধারণা হয়েছিল যে পনি এসেছে বন্ধুভাবে মিটমাট করতে, খারাপ উদ্দেশ্য তার নেই। ঠিক এই ব্যবহারই পনি আশা করেছিল, ভিতরে ঢুকেই সে চেঁচিয়ে উঠল, নান কি সুশায়ে! (এই নাও আমার বর্শা!)

পরক্ষণেই তার হাতের তীক্ষ্ণ বল্লম একজন শত্রুর কণ্ঠভেদ করলে।

ব্যস বারুদের গাদায় কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিলে।

অরণ্যের শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল বহু কণ্ঠের হিংস্র গর্জন, শনশন শব্দে ছুটে এল অসংখ্য তির জিভারোদের দিকে!

নোভাক তাড়াতাড়ি ম্যাকানিকে টেনে নিয়ে মাটির উপর শুয়ে পড়ল- তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাক উড়ন্ত মৃত্যুদূত। পনির তিরন্দাজরা এবার তির ছুঁড়ল।

উভয় পক্ষেই কয়েকজন হতাহত হয়ে ধরাশয্যায় লম্বমান হয়ে পড়ল।

নোভাক দেখলে একজন জিভারো-যোদ্ধার গলার মধ্য দিয়ে ঢুকে একটা তির পিছনের কাঠের গুঁড়িতে বিধে গেল। লোকটি যথাসাধ্য টানাটানি করেও নিজেকে মুক্ত করতে পারলে না– সেই অবস্থায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুখৃস্টের মতো প্রাণ বিসর্জন দিলে।

এবার শুরু হল হাতাহাতি লড়াই। দুজন শত্রু পানিকে ঘিরে ফেলল। নোভাক এবার স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করলে জিভারো দলপতির বীরত্ব পনি একাই বর্শা চার্লিয়ে দুজন শত্রুকে হত্যা করলে।

নোভাকের সামনে, পিছনে, এপাশে, ওপাশে চলছে হাতাহাতি লড়াই। ঝকঝক করে উঠছে শাণিত ম্যাচেট, ধারাল বর্শার আঘাতে ফুটো হয়ে যাচ্ছে যোদ্ধাদের দেহ, মুগুরের আঘাতে চুরমার হয়ে যাচ্ছে মানুষের মাথা এক বীভৎস রক্তাক্ত কাণ্ড!

হঠাৎ একটা লোক মুগুর হাতে এগিয়ে এসে ম্যাকানির হাত ধরে টানলে।

এক ঝটকায় নোভাক ম্যাকানিকে ছাড়িয়ে নিলে। শত্রু এবার মুগুর তুলল নোভাকের মঞ্চ লক্ষ্য করে–

নোভাক গুলি ছুড়ল না, বন্দুকের নল দিয়ে সজোরে গুঁতো মারল তার মুখে! দাঁত ভেঙে বন্দুকের নলটা প্রায় তিন ইঞ্চি ভিতরে ঢুকে গেল– লোকটা মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল, তার মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্তের ধারা এবং অনেকগুলো ভাঙা দাঁতের টুকরো।

ইতিমধ্যে যে লোকটার হাতে রাইফেল ছিল সে নোভাককে লক্ষ্য করে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলে।

নোভাক তার বন্দুকের ট্রিগার টিপল।

একই সঙ্গে গর্জে উঠল দুটি আগ্নেয়াস্ত্র।

নোভাকের গুলি ফসকে গেল, কিন্তু রাইফেলধারীর নিজের অস্ত্রই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে। মরচে পড়া রাইফেল সশব্দে ফেটে পড়ল- হ্যাঁমার, স্প্রিং প্রভৃতি যান্ত্রিক অংশগুলি রাইফেলধারীর মুখে চোখে যেখানে-সেখানে বিঁধে গেল। লোকটি আর্তনাদ করে রাইফেল ফেলে দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল। খুব সম্ভব সে একেবারেই অন্ধ হয়ে গেছে!

অল্প সময়ের মধ্যেই লড়াই শেষ হয়ে গেল। বিজয়ী জিভারোরা ধরাশায়ী শত্রু যোদ্ধাদের দেহ থেকে মাথাগুলোকে কচাকচ কেটে ফেললে; তারপর সেই রক্তাক্ত নরমুণ্ড গুলিকে হাতে নিয়ে বিজয়গর্বে ক্যানোতে উঠে বসল। পনি চিৎকার করে হুকুম দিলে, নৌকা চালাও।

জিভারো যোদ্ধারা তৎক্ষণাৎ হুকুম তামিল করলে। কারণ, যে কোনো সময়ে বিজেতারা আবার দল বল নিয়ে বিজয়ীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে- অতএব চটপট সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

ছিন্ন নরমুণ্ডগুলি দেখে প্রথমে নোভাকের মনে জিভারোদের সম্বন্ধে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছিল কিন্তু একটু পরেই তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল বিগত মহাযুদ্ধের ছবি।

সেই যুদ্ধে নোভাকও সৈন্য হয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছিল। সভ্য মানুষ যে কত অসভ্য হতে পারে সে কথা নোভাক জানে- মহাযুদ্ধের সে একজন ভুক্তভোগী সৈনিক।

যুদ্ধের সময়ে সুসভ্য ইউরোপের মানুষ যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিল তার কোনো তুলনা নেই, নরমুণ্ড শিকারি জিভারো-যোদ্ধা মানুষের ইতিহাসকে এতখানি কলঙ্কিত করতে পারেনি।

নোভাক বুঝল জিভারোদের ঘৃণা করা তার উচিত নয়…।

শুধু জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে জিভাষোরা শত্রুর মুণ্ডচ্ছেদ করেনি। একটু পরেই নোভাকের বোধগম্য হল যে ছিন্ন মুণ্ডগুলো সঙ্গে আনার বিশেষ কারণ আছে। গ্রামে এসেই একটা গাছের বড়ো বড়ো পাতা দিয়ে মুণ্ডগুলোকে ঢেকে দেওয়া হল। পনি নোভাককে বুঝিয়ে দিলে মুগুগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়া দ্বারা শোধন করে নেওয়া হবে। ওই ভাবে শোধন করে নিলে মুণ্ডগুলো আকারে ছোটো হয়ে ত-সানটায় পরিণত হবে এবং যে সব মানুষ মস্তক বিহীন অবস্থায় প্রেতদেহ ধারণ করে প্রতিহিংসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের প্রেতাত্মাগুলিও প্রক্রিয়ার ফলে শুন্যে লীন হয়ে যাবে। যতক্ষণ ওই প্রেতাত্মা বেঁচে আছে ততক্ষণ পর্যন্ত জিভাবোরা নিরাপদ নয়। একমাত্র সানটা হলে অর্থাৎ মুণ্ডগুলোকে প্রক্রিয়া অনুযায়ী সঙ্কুচিত করতে পারলেই হত্যাকারীরা প্রেতের আক্রোশ থেকে মুক্তিলাভ করবে অদ্ভুত কুসংস্কার!

শোধন প্রক্রিয়ার সমস্ত কার্যকলাপ নোভাককে দেখতে দেওয়া হল না, কারণ জিভারোদের কাছে এখনও সে বিজাতীয় মানুষ তাকে কখনই সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করা চলে না। প্রক্রিয়ার কিছু কিছু অংশ নোভাককে দেখতে দেওয়া হল বটে কিন্তু ওই বীভৎস কার্যকলাপের বর্ণনা দেবার ইচ্ছা আমার নেই আমার ধারণা ওই সব বর্ণনা পাঠক-পাঠিকাদের বিশেষ ভালো। লাগবে না।

যাইহোক, কাজ শেষ হয়ে গেলে পনি নোভাককে ডেকে পাঠাল। বিস্মিত নোভাক দেখলে সেই মুণ্ডগুলির মুখের আকৃতি একটুও পরিবর্তিত হয়নি বটে কিন্তু দৈর্ঘ্য প্রস্থে তাদের আকার হয়ে গেছে অতিশয় ক্ষুদ্র- সেই সঙ্কুচিত মুণ্ডগুলি এখন স্বাভাবিক নরমুণ্ডের তুলনায় অন্তত চারগুণ ছোটো! ত-সানটা!

সেই শুষ্ক সঙ্কুচিত নরমুণ্ডগুলিকে বর্শাফলকে বিদ্ধ করে জিভারোরা উৎসব শুরু করলে নৃত্য, গীত, পান ও আহার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলল সেই উন্মত্ত উৎসব…

আর এই উন্মত্ত উৎসবের ফাঁকে এতদিন পরে নোভাক যা চাইছিল তাই হল। পনি তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে। এখন থেকে সে গ্রামের ভিতর অথবা গ্রামের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে যেখানে-সেখানে বিনা-অনুমতিতে ঘুরে বেড়াতে পারবে-যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করার জন্যই এই পুরস্কার।

নোভাক ঠিক করলে এইবার চারপাশের জঙ্গলে সে তেলের খোঁজ করবে। যে-সব জায়গায় তেলের অস্তিত্ব আছে বলে সন্ধানকারীর সন্দেহ হয় সেই সব জায়গায় সে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অনুসন্ধান করে। বিস্ফোরণের ফলে ভূমির কম্পন এবং প্রতিধ্বনির শব্দ থেকেই অভিজ্ঞ তৈল-বিশারদরা তেলের সন্ধান বুঝতে পারে!

নোভাকের সঙ্গে যে সাজ-সরঞ্জাম ছিল তার মধ্যে কয়েকটা ডিনামাইটের স্টিক সে নিয়ে আসতে ভোলেনি। এইবার সব কিছু গুছিয়ে তার অভিযান শুরু করার আগে সে পনিকে বললে, ম্যাকানিকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব। সে আমায় সাহায্য করবে।

পনি একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে নোভাকের দিকে, তার গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ঘৎকার জাতীয় অসন্তোষের ধ্বনি- কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বাধা দিলে না।

ম্যাকানি প্রথমে নোভাকের প্রস্তুতি দেখে ভয় পেয়েছিল, তার ধারণা ছিল তার স্বামী বুঝি তাকে ফেলে প্রস্থান করতে চায়। অবশেষে যখন সে বুঝল যে নোভাক তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে তখন তার মুখের ভাব হয়ে উঠল অতিশয় হাসি-খুশি!

মালপত্র নিয়ে ম্যাকানির কাঁধে একটা প্যাকেট ঝুলিয়ে নোভাক যাত্রার উদ্যোগ করছে এমন সময়ে বিপত্তি- রঙ্গমঞ্চে হঠাৎ ভুতুড়ে ওঝা ফ্যাচুয়ের আবির্ভাব।

ফ্যাচুয়ে পনিকে উদ্দেশ করে কি বললে নোভাক তা বুঝল না কিন্তু আচম্বিতে একদল অস্ত্রধারী যোদ্ধা পনির আদেশে নোভাকের পথরোধ করে দাঁড়াল।

নোভাক রুষ্টকণ্ঠে পনিকে প্রশ্ন করলে, এর মানে কী?

পনি বললে, যাওয়া হবে না!

–যাওয়া হবে না! যাওয়া হবে না মানে? তুমি কথা দিয়েছিলে যে আমাকে কোথাও যেতে বাধা দেওয়া হবে না, এখন তুমি কথার খেলাপ করতে চাও? তোমার কথার কোনো দাম নেই? বাঁদরের কিচির-মিচির শব্দের মতো তোমার কথাও দেখছি নিতান্ত মূল্যহীন!

পনির মুখ লাল হয়ে উঠল, সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওঝা ফ্যাচুয়ের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

ফ্যাচুয়ে দন্তবিকাশ করে হাসল, তারপর তার গলায় ঝোলানো চামড়ার থলি থেকে একটা কোনো বস্তু বার করলে ইনজেকশন সিরিঞ্জ।

নোভাকের মনে পড়ল প্রথম যেদিন সে পটোকে ইনজেকশন দেয় তখন খালি সিরিঞ্জিটাকে সে ওঝার হাতেই গুঁজে দিয়েছিল– এটা সেই সিরিঞ্জ!

ফ্যাচুয়ে সিরিঞ্জটাকে মট করে ভেঙে ফেলল তারপর পনির দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে হাসতে লাগল যেন সে একটা মস্ত কাজ করে ফেলেছে।

রাগে নোভাকের সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল কিন্তু সে তার মনোভাব প্রকাশ করলে না, শান্তভাবে পনিকে প্রশ্ন করলে, এর অর্থ কি?

পনি বললে, ওঝা বলছে তুমি আমার মেয়েকে জঙ্গলের ভিতর নিয়ে যাবে কিন্তু আর ফিরবে না। তুমি ওর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো খেয়ে ফেলবে আর এমন সব গুণ-তুক করবে যে গ্রামের লোকের ভীষণ অকল্যাণ হবে।

কী! নেভাক চিৎকার করে উঠল, আমি আমার বউকে হত্যা করে তার মাংস খাব? শয়তান! বর!… পনি, তোমার ছেলেকে আমি বাঁচিয়েছি সেকথা কী এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?

ফ্যাচুয়ে বলছে আমার ছেলেকে সে বাঁচিয়েছে, তুমি নও। এইমাত্র তোমার ওষুধটা সে ভেঙে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস ফ্যাচুয়ে ঠিকই বলছে। তোমার ওষুধের মোটেই জোর নেই তাই সে তোমার ওষুধে ভালো হয়নি, তাকে বাঁচিয়েছে ফ্যাচুয়ে।

–হুঁ। ফ্যাচুয়ে আর কি বলছে?

-সে বলছে তুমি অত্যন্ত খারাপ লোক। তোমার মাথা দিয়ে ত-সানটা করতে পারলে গ্রামের লোকের কল্যাণ হবে।

নোভাক বন্দুকটাকে আঁকড়ে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাইল। ম্যাকানি তার পাশ থেকে তখন সরে গেছে- স্বামী তোক আর যাইহোক নোভাক হচ্ছে বিদেশি, কলহের সময় জিভারো রমণীর স্থান স্বজাতির পাশে, বিধর্মীর পাশে নয়!

হু নোভাক মনে মনে বললে, আমার মাথা ত-সানটা করার আগে অন্তত কয়েকটা মাথা আমি ফুটো করে দেব। মরবার আগে কয়েকজনকে আমি মেরে মরব…।

হঠাৎ নোভাকের রাগ ঠান্ডা হয়ে এল। সে বুঝল জিভারোদের সঙ্গে তার ঝগড়ার কোনো কারণ নেই, ওই শয়তান ফ্যাচুয়েটাকে জব্দ করতে পারলেই তার পথ হবে নিষ্কণ্টক।

নোভাক পনির মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললে, আমি একবার প্রমাণ করেছি যে ফ্যাচুয়ের যাদুবিদ্যার চাইতে আমার ওষুধের শক্তি বেশি। এবার আমি প্রমাণ করে দেব যে মানুষ হিসাবে আমি তার চেয়ে অনেক বড়ো, পুরুষ হিসাবেও তার চেয়ে আমি অনেক শক্তিশালী পুরুষ। পনি, আমাকে চারখানা মাদুর আর একটা চাকভর্তি ভীমরুল আনিয়ে দাও।

পনির আদেশে কয়েকজন জিভারো মিনিট কুড়ি বাদে একটা ভীমরুলের চাক এবং চারখানা মাদুর হাতে নিয়ে ফিরে এল। চাকের প্রবেশ পথ কাঠের ছিপি দিয়ে বন্ধ করা আছে।

সমস্ত ব্যাপারটা ফ্যাচুয়ের পছন্দ হল না। কিন্তু এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই— পরীক্ষার সম্মুখীন না হলে জিভায়রারা তাদের ওঝাকে আর সম্মান করতে রাজি হবে না। ফ্যাচুয়ে অস্বস্তির সঙ্গে নোভাকের কার্যকলাপ লক্ষ করতে লাগল।

নোভাক কাঠের ছিপি খুলে ভীমরুলের চাকটাকে আগুনের উপর ধরলে। অগ্নিকুণ্ড থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধুমরাশি প্রবেশ করলে চাকের মধ্যে, ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল ভীমরুলের গুঞ্জনধ্বনি– অবশেষে যখন নোভাক বুঝল ভীমরুগুলি চাকের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেছে তখন সে দুখানা মাদুর বিছিয়ে চাকটাকে ওই মাদুর দুটির উপর ঝাঁকাতে লাগল। প্রায় অচেতন অবস্থায় ভীমরুলগুলি এসে পড়ল মাদুরের উপর। কয়েকটা তখনও খুব দুর্বল ভাবে নড়াচড়া করছিল বটে কিন্তু তাদের অবস্থা খুব ভালো নয়। নোভাক গুনে দেখল এক একটা মাদুরে রয়েছে প্রায় চব্বিশটা ভীমরুল। সে এবার অন্য দুটো মাদুর দিয়ে আগের মাদুর দুটিকে চাপা দিলে।

ভীমরুলগুলিকে দুজোড়া মাদুরের মাঝখানে বন্দি করে চাকটাকে নোভাক ছুঁড়ে ফেললে অগ্নিকুণ্ডর মধ্যে…।

কিছুক্ষণ পরেই ধোঁয়ার প্রভাব কেটে গেল। মুক্ত বায়ুর সংস্পর্শে চঞ্চল হয়ে উঠল মাদুরের বন্ধনে বন্দি ভীমরুলগুলি- ক্রুদ্ধ গুঞ্জনধ্বনি তুলে তারা জানিয়ে দিলে বর্তমান অবস্থাটা তারা মোটেই পছন্দ করছে না।

নোভাক তার গায়ের শার্ট খুলে ফেললে, তারপর পনির দিকে ফিরে বললে, আমরা দুজন এবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ব, তোমরা ভীমরুল সুদ্ধ এক-একখানা মাদুর আমার আর ফ্যাচুয়ের বুকের উপর চাপিয়ে দাও। আমি শক্তিশালী পুরুষ, ভীমরুলের কামড় সহ্য করতে পারব কিন্তু তোমাদের ওঝা ওই বুজরুক ফ্যাচুয়েটা হচ্ছে মেয়েমানুষের অধম ও এখনই উঠে দৌড় মারবে।

নোভাক এবং ফ্যাচুয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। জিভাবোরা খুব সাবধানে দুপাশ থেকে ধরাধরি করে মাদুর দুটাকে দুজনের বুকের উপর চাপিয়ে দিলে। মাদুরের বুনোটের ফাঁক দিয়ে ক্রুদ্ধ ভীমরুলগুলি তাদের ভীষণভাবে দংশন করতে শুরু করলে…

অসহ্য যাতনায় নোভাকের কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে আসছিল একটা আর্তচিৎকার- দাঁতে দাঁত দিয়ে সে আর্তনাদ রোধ করলে। আর কতক্ষণ? তার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সমস্ত পৃথিবী তার চোখের সামনে যেন অন্ধকার হয়ে আসছে- দুহাতের আঙুল দিয়ে নোভাক প্রাণপণে মাটি আঁকড়ে ধরলে…

ফ্যাচুয়ে আর সহ্য করতে পারলে না। মাদুরটাকে ছুঁড়ে ফেলে সে উঠে পড়ল এবং দুহাতে বুকের মাংস চেপে ধরে আর্তনাদ করতে লাগল।

নোভাক এবার টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। অস্থির পদক্ষেপে সে প্রবেশ করলে নিজের কুটিরে, তারপর কীট-পতঙ্গের দংশনের প্রতিবোধ যে ওষুধ ছিল তার সঙ্গে ডিসটিলড ওয়াটার (পরিশ্রুত জল) মিশিয়ে স্বহস্তে বাহুতে ইনজেকশন করলে। এতক্ষণ পরে নোভাক তার রুদ্ধ আবেগকে মুক্ত করে দিলে বাঁশের খাঁটিয়ার উপর শুয়ে সে ফোঁপাতে লাগল…।

কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে সে উঠে পড়ল এবং সোজা প্রবেশ করলে ফ্যাচুয়ের কুটিরের মধ্যে। যাতনাকাতর ফ্যাচুয়েকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সে আবার বাইরে বেরিয়ে এল।

…এর পর আর কোনো দিন ফ্যাচুয়ে তার পিছনে লাগতে চেষ্টা করেনি..

নোভাক এবার নতুন উদ্যমে তৈলখনির সন্ধানে অভিযান শুরু করলে। জঙ্গলের মশা, জোঁক প্রভৃতির অত্যাচারে সে অস্থির হয়ে উঠল, বু ভাগ্যের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হল না।

একজন রেড ইন্ডিয়ানকে সে ডিনামাইটের ব্যবহার শিখিয়ে দিয়েছিল। ডিনামাইটের সাহায্যে অরণ্যের বুকে ধ্বংসের তাণ্ডব সৃষ্টি করে সেই লোকটি অবশ্য খুবই আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল কিন্তু নোভাকের মনে এতটুকুও আনন্দ ছিল না কোথাও সে তেলের সন্ধান পায়নি।

এত পরিশ্রম আর আশাভঙ্গের দুঃখে নোভাক হয়তো ভেঙে পড়ত, তবে অনেক কষ্টের মধ্যেও তার একটি আনন্দের কারণ ছিল- সে হচ্ছে ম্যাকানি, তার জিভাবেউ!

মেয়েটি স্প্যানিশ কিংবা ইংরেজি ভাষা বলতে পারে না। তাই ইশারা ইঙ্গিতের সাহায্যে সে কোনোমতে নোভাককে তার মনের ভাব বোঝাবার চেষ্টা করত।

স্বামীর সঙ্গে বাক্যালাপ করার উপায় তার ছিল না। কিন্তু কথা বলতে না পারলেও নোভাকের সুখ-সুবিধার জন্য তার দৃষ্টি থাকত সর্বদাই জাগ্রত। ছায়ার মতো সে অনুসরণ করত স্বামীকে সারাদিনের ক্লান্তি ও পথশ্রমে আচ্ছন্ন হয়ে যখন নোভাক বিছানায় লুটিয়ে পড়ত তখন ম্যাকানি নিঃশব্দে এসে দাঁড়াত তার পাশে, নিপুণ হাতের সযত্ন সেবায় নোভাকের চোখে নেমে আসত সর্বসস্তাপহারিণী নিদ্রার আবেশ….

নোভাক কখনো ভাবতে পারেনি যে ম্যাকানির সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হতে পারে…

বিচ্ছেদ এল। নোভাক আর ম্যাকানির মধ্যে হঠাৎ নেমে এল দুস্তর ব্যবধানের যবনিকা। আচম্বিতে বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো হিংসা আর আক্রোশের বন্যা আঘাত হানলে জিভায়রা-পল্লীর বুকে…

১৫ জানুয়ারি, ১৯৫৬ সাল।

পনি সদলবলে বেরিয়ে গেছে মাছ ধরতে ও শিকার করতে। প্রায় ফাঁকা, অধিকাংশ লোক আছে পনির সঙ্গে। মাত্র দুজন জিভারো বসে বসে তিরের মুখে শান দিচ্ছে আর ব্লো-গান তৈরি করছে। নোভাক প্রস্তুত হচ্ছে তার দৈনন্দিন অভিযানের জন্য, অ্যানি নামে যে রেড-ইন্ডিয়ানটিকে নোভাক ডিনামাইট ফাটাতে শিক্ষা দিয়েছিল সেও তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে নোভাকের হুকুম পেলেই সে বেরিয়ে পড়বে।

নোভাক বললে, অ্যানি, এবার চলো, বেরিয়ে পড়ি!

অ্যানি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল তারপর হঠাৎ দরজার দুদিকে হাত দিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

অসহিষ্ণু কণ্ঠে নোভাক বললে, কী হল? থামলে কেন? চলো, চলো।

নোভাক এগিয়ে এসে অ্যানির পিঠে হাত দিয়ে আস্তে ধাক্কা দিলে, সঙ্গেসঙ্গে অ্যানির দেহ গড়িয়ে পড়ল মাটির উপর!

নোভাক এবং অপর দুজন জিভারো দেখলে অ্যানির বুকে বিঁধে আছে একটা তির!

জিভারো দুজন ঊধ্বশ্বাসে ছুটল পনির উদ্দেশে।

নোভাক চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি সঞ্চালন করলে কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে কোনো মনুষ্য-মূর্তি তার নজরে পড়ল না।

একটু পরেই ছুটতে ছুটতে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করলে পনি এবং অন্যান্য গ্রামবাসীরা। পনি চিৎকার করে বলছে, অকা! অকা!

কিন্তু তার গলার স্বর অত্যন্ত ক্ষীণ ও দুর্বল। স্পষ্ট বোঝা গেল অনেকটা পথ দ্রুত ছুটে এসে সে হাঁপিয়ে পড়েছে।

গ্রামের ভিতরে ঢুকেই জিভারোরা বেড়ার গাত্ৰ-সংলগ্ন প্রধান ফটকটা বন্ধ করে দিলে। কাঠের গুঁড়ির তৈরি বেড়ার ফাঁক দিয়ে তারা চারদিক লক্ষ্য করতে লাগল- হাতে তাদের ব্লো-গান, বর্শা, ম্যাচেট প্রভৃতি অস্ত্র।

জিভারোদের ভাবভঙ্গি দেখে নোভাক বুঝতে পারল তারা ভীষণ ভয় পেয়েছে। এই ভীত সঙ্কুচিত মানুষগুলিকে দেখলে মনেই হয় না যে মাত্র কয়েকদিন আগেও তারা গর্বিত পদক্ষেপে যুদ্ধ যাত্রা করেছিল।

নোভাক পনিকে ডেকে প্রশ্ন করলে, ব্যাপারটা কি?

পনি বললে, অকা! অকারা আমাদের আক্রমণ করেছে।

তা এত ভয় পাচ্ছ কেন? অকারা তো তোমাদের মতোই মানুষ।

–অকাদের সবাই ভয় করে।

জিভারোদের মতো ভীষণ যোদ্ধারা যাদের ভয়ে এমন বিচলিত হয়ে উঠেছে তাদের স্বভাব-চরিত্র অনুমান করতে নোভাকের একটুও অসুবিধা হল না। তবে সে ঠিক করলে এবারের লড়াইতে সে নিরপেক্ষ থাকবে। সবসময় রেড-ইন্ডিয়ানদের ঘরোয়া ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা তার ছিল না।

অবশ্য আক্রান্ত হলে তাকে বাধ্য হয়ে বন্দুক ধরতে হবে- নোভাক তার কুটিরে প্রবেশ করলে। ঘরের মধ্যে ঢুকেই সে দেখলে একটা কাঠের আসনের উপর বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তার বউ ম্যাকানি!…

ঠিক দুপুরবেলায় অকা-যোদ্ধারা জিভারোদের পল্লী আক্রমণ করলে। জঙ্গলের মধ্যে টুইটি টিট শব্দে পাখির শিস শোনা গেল হঠাৎ শুনলে মনে হবে সত্যিকার পাখির ডাক– কিন্তু আসলে সেটা আক্রমণোদ্যত অকাদের সঙ্কেত ধ্বনি।

কাঠের বেড়ার চারদিকে জঙ্গলের ভিতর থেকে ঘন ঘন ভেসে এল সেই নকল পক্ষী কণ্ঠের কলরব জিভারো-যোদ্ধারা ব্লো-গানে তির লাগিয়ে প্রস্তুত হল। একটু পরেই ছুটে এল একঝাক তির জঙ্গলের ভিতর থেকে। জিভায়রারা চুপ করে থাকল না, তাদের স্লোগান থেকে ঝাঁকে ঝকে তির নিক্ষিপ্ত হল জঙ্গলের দিকে শন শন শব্দে বাতাসে আলোড়ন তুলে উড়ে গেল এক ঝাঁক মৃত্যুদূত শত্রুর উদ্দেশে। অকাদের মধ্যে কেউ হতাহত হল কিনা বোঝা গেল না কারণ ঘন পত্র-পল্লবের আড়ালে কোথায় তারা গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে আছে তা অনুমান করা অসম্ভব। কিন্তু দুজন জিভারো যোদ্ধা শত্রুর তিরে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে পা ছুঁড়তে লাগল। নোভাক আশ্চর্য হয়ে দেখলে যে তির যদিও সাংঘাতিক ভাবে তাদের দেহ ভেদ করেছে তবুও দুটি যোদ্ধার মধ্যে একজনও চিৎকার করছে না!

একজন যোদ্ধা শরীরের ভিতর থেকে তিরটা নিজের হাতেই টেনে বার করে ফেললে তিরের পশ্চাৎভাগে কাঁটা তার জড়ানো থাকায় লোকটির পাকস্থলী ক্ষতপথে বাইরে বেরিয়ে এল! তবুও আহত যোদ্ধা একটুও আর্তনাদ করলে না– আশ্চর্য সহ্য শক্তি!…

মেয়েরা তখন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। ঝাঁকে ঝাকে ছুটে আসছে তির– সেই অসংখ্য মৃত্যুদূতের উড়ন্ত দংশন উপেক্ষা করে জিভায়রা-যোদ্ধারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না– কাঠের গুঁড়ির পিছন থেকে সরে এসে তারা যে যার ঘরের মধ্যে গা-ঢাকা দিলে।

অকারা এবার বনের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করলে। কাঠের গুঁড়ির বেড়া ডিঙিয়ে তারা ভিতরে ঢুকলে এবং বেড়ার বড়ো দরজাটা খুলে ফেললে; জঙ্গলের ভিতর থেকে আরও অনেক অকা-যোদ্ধা ছুটে এসে খোলা দরজা দিয়ে জিভারো পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করলে।

ঘরের মধ্যে যেসব জিভারো যোদ্ধা লুকিয়েছিল এবার তারা বাইরে এসে শত্রুকে আক্রমণ করলে। শুরু হল হাতাহাতি লড়াই।

নোভাক তার কুটিরের ভিতরে সরে এল। তার পিছনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল তার জিভায়রা-বউ ম্যাকানি।

দরজার কাছে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে যথাসম্ভব আত্মগোপন করে নোভাক যোদ্ধাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে

জিভারো পল্লীর মাঝখানে তখন ভীষণ লড়াই শুরু হয়েছে।

নোভাকের চোখের সামনেই একটা বর্শা একজন জিভারো-যোদ্ধার মস্তক ভেদ করলে… একটি জিভারো হাতের ধারাল ম্যাচেট চার্লিয়ে একজন অকা-যোদ্ধাকে মাটির উপর পড়ে ফেললে আর সঙ্গেসঙ্গে বিজয়ীর পৃষ্ঠদেশে বিদ্ধ হল তিন-তিনটে শাণিত তির…

অকাদের পুরুষ বাহিনীর পিছন পিছন ছুটে এল মেয়েরা!

 নোভাক সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলে অকা-নারী পুরুষদের চাইতে অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও হিংস্র!

 চারদিক তখন ধুলায় ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে, এখানে সেখানে জিভারো কুটিরে অগ্নিসংযোগ করছে অকা-সৈন্য… জ্বলন্ত গৃহত্যাগ করে বাইরে এসে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছে জিভারো মেয়েরা আর তাদের উপর হিংস্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে শত্রুপক্ষের নারী বাহিনী… নোভাকের চোখের সামনেই তিন চারটি অকা রমণী একটি জিভারো মেয়েকে জ্বলন্ত কাষ্ঠের সাহায্যে প্রহার করতে লাগল…

হঠাৎ চারজন অকা-যোদ্ধার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল নোভাকের কুটিরের দিকে। তারা একসঙ্গে এগিয়ে এল ঘরটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণের জন্য নোভাক বুঝল জিভারোদের লড়াই তার লড়াই, যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার উপায় নেই!

উন্মুক্ত দ্বারপথে একজন বন্দুকধারীর আকস্মিক আবির্ভাবে অকারা চমকে গেল, চারজন যোদ্ধাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

নোভাক তাদের দিকে এগিয়ে এল, কাছে, কাছে আরও কাছে…

হঠাৎ মুখ বাড়িয়ে সে চিৎকার করে উঠল, চুলোয় যাও তোমরা! চারজন যোদ্ধা একসঙ্গে লক্ষত্যাগ করলে সচমকে!

অকারা দেখেছে তাদের সামনে দাঁড়ালেই যে কোনো শত্রু ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় এমন অপ্রত্যাশিত অভ্যর্থনা তারা কোনো আশা করেনি!

অকা চারজন কি করত বুলা যায় না, হয়তো তারা ধীরে ধীরে সরে পড়ত– কিন্তু অকস্মাৎ রঙ্গস্থলে আত্মপ্রকাশ করলে নোভাকের বউ ম্যাকানি।

নোভাকের পিছন থেকে হঠাৎ ভেসে এল অস্পষ্ট ক্রন্দন ধ্বনি। সচমকে পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করতেই নোভাক দেখতে পেল ম্যাকানিকে। সে বুঝল শূন্যঘরে একা থাকার সাহস তার হয়নি, তাই সে স্বামীর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

স্ত্রীর উপরে নোভাকের দারুণ রাগ হল! এতক্ষণ শুধু তাকে আত্মরক্ষার কথাই ভাবতে হচ্ছিল কিন্তু এখন ম্যাকানির ভারও তার উপরেই এসে পড়ল। যতই রাগ হোক, এই সঙ্গীন মুহূর্তে স্ত্রীর প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা সম্ভব নয়! ম্যাকানিকে আড়াল করে সে ধীরে ধীরে কুটিরের দিকে পিছিয়ে চলল। তাদের দুজনকে ঘিরে এগিয়ে আসতে লাগল চারজন অকা-যোদ্ধা।

ম্যাচেট হাতে একজন বলিষ্ঠ অকা সামনে এগিয়ে এল।

 তার ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠল নিষ্ঠুর হাসির রেখা।

নোভাক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তার একটু পিছনেই কুটিরের দেয়াল আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

ম্যাচেটধারীর মুখের হাসি মুছে গেল, বাঘের মতো গুঁড়ি মেরে সে নোভাকের দিকে এগিয়ে এল আক্রমণের পূর্বাভাস..

গর্জে উঠল নোভাকের বন্দুক, লোকটি ছিটকে পড়ল মাটির উপর তার মস্তক ভেদ করে ছুটে গেছে বুলেট!

বাকি তিনজন শত্রুর চোখে চোখ রেখে পিছিয়ে গেল। একজন হাতের বর্শা তুলে নোভাকের দিকে ছুড়বার উপক্রম করলে। আবার অগ্নিবৃষ্টি করলে বন্দুক- লোকটি দুপাক ঘুরে সশব্দে মাটিতে বসে পড়ল, তার কাঁধে গুলি বিঁধেছে…

বন্দুকের গর্জনধ্বনিতেই শেষ হয়ে গেল যুদ্ধ।

উভয় পক্ষই মুহূর্তের জন্য নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল- অকাদের মধ্যে অনেকেই বন্দুকের শব্দ কখনো শোনেনি।

পাখির কণ্ঠ অনুকরণ করে চেঁচিয়ে উঠল অকা-যোদ্ধার দল। দুএকজন অকা বন্দুকধারী নোভাক এবং গুলিবিদ্ধ আহত সঙ্গীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে, স্পষ্টই বোঝা গেল আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার ইচ্ছা তাদের নেই। আবার জাগল নকল পক্ষীকণ্ঠের কলধ্বনি– অকাদের পলায়ন সঙ্কেত!

অতিদ্রুত অথচ সুশৃঙ্খল ভাবে অকা যোদ্ধারা পিছিয়ে গেল প্রধান দরজার দিকে। নোভাক তাদের অনুসরণ করলে…

হঠাৎ তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তীব্র উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কায় সে নিজেকে হারিয়ে ফেললে চিৎকার করে উঠল নোভাক, উচ্চৈঃস্বরে অভিশাপ বর্ষণ করতে লাগল অকাদের উদ্দেশে।

নিজের উপর আর নোভাকের কর্তৃত্ব রইল না, বিকল স্নায়ু এবার বিদ্রোহ ঘোষণা করলে অজ্ঞাতসারে তার ডান হাতের অবাধ্য আঙুল বারংবার বন্দুকের ঘোড়া টিপে ধরলে, যান্ত্রিক কণ্ঠের হুঙ্কারে অরণ্যের বুকে প্রতিধ্বনি তুলে লক্ষ্যহীন অনির্দিষ্ট পথে ছুটল গুলির পর গুলি…

অকাদের মধ্যেও এবার ভীতির সঞ্চার হল। এতক্ষণ তারা সুশৃঙ্খল সৈনিকের মতো পিছিয়ে অসছিল, এবার সব নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙে তারা ছড়িয়ে পড়ল- এলোমেলো ভাবে যে যেদিকে পারে ঊর্বশ্বাসে ছুটল।

পলায়নের সময়েও অকারা ক্ষতি করতে ছাড়ল না।

জিভারোদের যে কখানা ক্যানো নদীর ধারে ছিল সেগুলোকে অকা-যোদ্ধার দল লুঠ করে জলপথে পলায়ন করলে…

নোভাক ভেবেছিল এবার নিশ্চয়ই জিভাবোরা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। কিন্তু কোথায় কি? তারা সমস্ত ব্যাপারটাকে খুব সহজ ভাবেই গ্রহণ করলে। যোদ্ধারা দুএকবার নোভাকের দিকে দৃষ্টিপাত করে অন্য কাজকর্মে ব্যস্ত হয় পড়ল। মেয়েরা কোনো দিকে চাইল না, হতাহত পুরুষদের জন্যে করুণ কণ্ঠে তারা শোকপ্রকাশ করতে লাগল।

যে অকা-যোদ্ধাটি প্রথমেই বন্দুকের গুলি খেয়ে মারা পড়েছিল নোভাক তার মৃতদেহের পাশে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ তার চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল অত্যন্ত প্রখর-মৃতের গলায় চামড়ার ফাঁসের সঙ্গে ওটা কি ঝুলছে? সে নীচু হয়ে নিহত অকার গলা থেকে সেই বস্তুটি খুলে নিয়ে দেখল জিনিসটা আর কিছু নয়– একটা পাথর।

পাথরটার উপর ভালো করে নজর বুলিয়ে সে চমকে উঠল– এটা সাধারণ পাথর নয়, বালিপাথর!

এই বালিপাথরের নীচেই থাকে তেলের ভাণ্ডার!

নোভাক নাসারন্ধ্র সঙ্কুচিত করলে; তার নাকে এসে ধাক্কা মেরেছে একটা পরিচিত তীব্র গন্ধ আর সেই গন্ধ আসছে অকা-যোদ্ধার মৃতদেহ থেকে–

নোভাক মৃতদেহের উপর ঝুঁকে পড়ল।

তেল! তেল! তেল! অকা-যোদ্ধার দেহ থেকে ভেসে আসছে তেলের গন্ধ!

খনিজ তৈলের মূল্যবান খনি আবিষ্কার করেছে এই বর্বর অকা, যুদ্ধে যাত্রা করার আগে সেই তেলে রং মিশিয়ে নকশা এঁকেছে নিজের সর্বাঙ্গে!

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল নোভাক।

অকারা যে অঞ্চলে বাস করে সেদিকে অনুসন্ধান চালালে হয়তো তেলের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। একমাত্র পনি ছাড়া এ বিষয়ে অন্য কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলে লাভ নেই। কিন্তু জিভাবো দলপতি এখন আহতদের শুশ্রূষা এবং মৃতদেহগুলি সকার নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত নোভাক বুঝল এই মুহূর্তে তাকে কৌতূহল সংবরণ করতেই হবে।

সে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, তবু সকাল পর্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করলে। পরের দিন সকালে সে পনিকে সেই পাথরটা দেখিয়ে অকাদের আস্তানা কোথায় জানতে চাইল।

পনি বললে আক্রমণকারী অকা-যোদ্ধাদের গলায় এই ধরনের বালিপাথর ইতিপূর্বে সে বহুবার দেখছে কিন্তু ওই পাথর বা তেল তারা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে তা সে বলতে পারে না।

পনির ধারণা অকাদের বাসস্থানের কাছেই আছে সেই তৈলভাণ্ডার। নোভাক ঠিক করলে এবার সে একাই তেলের সন্ধানে যাত্রা করবে।

পনিকে তার উদ্দেশ্য জানাতেই সে নোভাককে বারণ করলে। তার বক্তব্য হচ্ছে অকারা এমনই হিংস্র, আর এখন তারা আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। অতএব এখন অকাদের আস্তানায় গেলে বিদেশির মৃত্যু অবধারিত।

নোভাক স্থির হয়ে জিভারো দলপতির বক্তব্য শুনল কিন্তু নিজের সঙ্কল্প ত্যাগ করলে না। একদিন সকালে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে তৈল অভিযানে যাত্রা করলে। যাওয়ার আগে সে জিভারোদের কাছ থেকে আর একটা ধাক্কা খেল। গ্রাম ছেড়ে সে যখন চলে গেল কোনো জিভারো-যাদ্ধাই তাকে বিদায় দিতে এগিয়ে এল না, এমনকী তার বউ ম্যাকানি পর্যন্ত একবার তার সামনে এসে দাঁড়াল না।

আগের দিন নোভাক ম্যাকানিকে বুঝিয়ে বলেছিল যে সে চলে যাচ্ছে আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।

ম্যাকানি নোভাকের ভাষা বুঝতে না পারলেও স্বামীর বক্তব্য ভালো ভাবেই বুঝেছিল।

এতদিনের মধ্যে নোভাক কখনও ম্যাকানির মুখে ইংরেজি ভাষা শোনেনি, যাওয়ার আগের দিন সে স্ত্রীর মুখে ইংরেজি শুনল- সেই প্রথম সেই শেষ!

শুধু দুটি কথা, নোভাক গোয়িং! (নোভাক যাচ্ছে)।

নোভাক আশা করেছিল যাওয়ার সময়ে নিশ্চয়ই ম্যাকানি তার সামনে এসে দাঁড়াবে কিন্তু তার আশা পূর্ণ হল না। সে গ্রাম ছেড়ে অরণ্যে প্রবেশ করলে,

ম্যাকানি একবারও তার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করলে না!…