৩. কালাচান ধলাচান

কালাচান ধলাচান

রতন একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে টেবিলের উপর রাখা ছোটো একটা যন্ত্রকে খুব মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করছিল। মানিক প্রায় একইরকম মনোযোগ দিয়ে রতনকে পরীক্ষা করতে করতে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “একসময় আমার ধারণা ছিল তুমি একজন বড়ো বিজ্ঞানী।”

রতন ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে টেবিলের উপর রাখা ছোটো যন্ত্রটা দেখতে দেখতে বলল, “এখন তোমার কী ধারণা হয়েছে?”

“এখন ধারণা নয়, এখন আমি নিশ্চিতভাবে জানি তুমি আসলে বিজ্ঞানী না।”

“আমি তাহলে কী?”

“তুমি হচ্ছ টয়-মেকার। খেলনা প্রস্তুতকারক। তুমি দিনের পর দিন বসে বসে খেলনা বানাও। এই যেরকম তুমি দিনের পর দিন বসে বসে দুটি হাত বানাচ্ছ। পুতুলের হাত।”

রতন কোনো কথা না বলে পুতুলের হাতের মতো যন্ত্রটা মানিককে দেখিয়ে বলল, “এটা?”

“হ্যাঁ, দুই হাত বানাতে দুই মাস। তারপর পা বাকি আছে। তারপর মাথা ঘাড় বুক পিঠ ঊরু।”

রতন বলল, “তোমার দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই হাত দুটি বানানোর পর আমার কাজ শেষ। মাথা পিঠ বুক এসব বানাতে হবে না।”

মানিক বিরক্ত হয়ে বলল, “কী আবোল-তাবোল বলছ? ঠিক করে বল।”

রতন অবাক হয়ে বলল, “ঠিক করে বলব? কী ঠিক করে বলব?”

“বলো, মাথা ঘাড় বুক পিঠ উরুছন্দ দিয়ে বলো।”

“রতন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, আমার বলারই দরকার নাই। তুমি বলো। আমি শুনি।”

মানিক বলল, “কিন্তু তার আগে তুমি বলো হাত দুটো বানানোর পর তোমার কাজ শেষ কেন? একটা পুতুলের শুধু হাত থাকে না। সবকিছু থাকে।”

“আর যদি পুতুল না হয় তাহলে কি সবকিছু থাকতে হবে?”

“পুতুল না হলে মানে?”

“মানে এটা পুতুলের হাত না। এই দুটি হাত আসলে রবোটিক হ্যাঁন্ড। ইলেকট্রনিক সিগনাল দিয়ে এটা কন্ট্রোল করা যাবে। এই দুটো হাত সূক্ষ্মভাবে কাজ করতে পারবে। আর এটা কন্ট্রোল করার জন্যে যে ইন্টারফেসটা তৈরি করতে হয়েছে সেটা বানাতে আমার জান বের হয়ে গেছে। মাইক্রোস্কপিক আইসি কিনতে হয়েছে। যে এলগরিদম তৈরি। করতে হয়েছে—“

মানিক রতনকে বাধা দিয়ে বলল, “তুমি তোমার ভ্যাদর-ভ্যাদর থামাবে?”

রতন থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি জানতে চাইছ–“

“আমি মোটেও তোমার আলু-করলা-দম শুনতে চাচ্ছি না।”

“শব্দটা আলু-করলাম না, শব্দটা এলগরিদম। তোমার শুদ্ধ করে বলা উচিত। অন্তত চেষ্টা করা উচিত।”

মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “শুধু আমি শুদ্ধ বলার চেষ্টা করব, আর সারা পৃথিবীর মানুষ যা খুশি বলবে, যা খুশি লিখবে তাতে দোষ নেই?”

রতন জিজ্ঞেস করে, “কে কী বলেছে? কী লিখেছে?”

মানিক তার হাতে ধরে রাখা পত্রিকাটা খুলে বলল, “এই দেখো পত্রিকার একটা বিজ্ঞাপন–” তারপর জোরে জোরে পড়ে শোনাল, “কাকের বাচ্চা চাই। বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। উপযুক্ত মূল্য দেওয়া হইবে।”

রতন ইতস্তত করে বলল, “এই বিজ্ঞাপনের সমস্যা কী?”

“পরিষ্কার গুরুচণ্ডালী। চলিত এবং সাধুর মিশ্রণ। কবিগুরু এই বিজ্ঞাপনটা দেখলে আত্মহত্যা করতেন। যে এই ভাষায় বিজ্ঞাপন লিখে তাকে একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা শহীদ মিনারে গুলি করে মারা উচিত।”

রতন মাথা চুলকে বলল, “আসলে, মানে হয়েছে কী এই বিজ্ঞাপনটা আমি পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। ভাষার ব্যাপারটা মানে”

মানিক চোখ বড়ো বড়ো করে রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি? তুমি এই বিজ্ঞাপন দিয়েছ? তু-তুমি?”

“হ্যাঁ। আমি।”

“কাকের বাচ্চা দিয়ে তুমি কী করবে?”

“আমার পরের প্রজেক্টটা হচ্ছে পাখি নিয়ে।”

“পাখি নিয়ে গবেষণা করতে চাও করো, আমার যত আপত্তি থাকুক আমি মেনে নেব। তাই বলে কাক? কাক নিয়ে গবেষণা?”

“কাক হচ্ছে—“

মানিক রতনকে কথা শেষ করতে দিল না, বলল, “কাক নিয়ে কোনো কবিকে কবিতা লিখতে দেখেছ? কোনো শিল্পীকে গান গাইতে শুনেছ? ভাস্করকে ভাস্কর্য বানাতে দেখেছ?”

“আমি তো কাকের উপর গান গাইব না। আমি কাককে নিয়ে—“

মানিক আবার রতনকে থামিয়ে দিল, “এটা টিয়া পাখি হতে পারত। কাকাতুয়া হতে পারত, কবুতর হতে পারত এমনকি শালিক হতে পারত, কিন্তু তাই বলে কাক?”

“আসলে হয়েছে কী–”

“আমি হচ্ছি কবি মানুষ। কবিরা সুন্দরের পূজারি। তুমি আমাকে বল কাকের মাঝে কোনো সৌন্দর্য আছে? তার গলার স্বর কর্কশ। প্রিয় খাবার মরা ইঁদুর। প্রিয় খেলা ছোটো শিশুর হাত থেকে ছোঁ মেরে খাবার নিয়ে যাওয়া–”

কয়েকবার কাকের বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে কোনো সুবিধে করতে না পেরে রতন আবার তার রবোটিক হ্যাঁন্ডের উপর ঝুঁকে পড়ল।

মানিক তার পাশে বসে টানা কথা বলে যেতে লাগল। বক্তব্য কাক থেকে চিল, চিল থেকে শকুন এবং শকুন থেকে শেষে মনুষ্যরূপী শকুন প্রজাতির দিকে যেতে লাগল। মানিক যখন রতনের কানের কাছে নিশ্বাস না ফেলে টানা কথা বলতে থাকে রতন তখন খুব সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করতে পারে, তার সমস্যার নানারকম সমাধান বের করে ফেলে। এবারেও সে দুই দুইটা জটিল সমস্যা কীভাবে সমাধান করবে বের করে ফেলল। মানিকের সাথে পরিচয় হবার। পর নিঃসন্দেহে তার গবেষণার কাজ অনেক ভালো হতে শুরু করেছে।

.

দুদিন পর লোকজন কাকের বাচ্চা নিয়ে আসতে শুরু করল। বিজ্ঞাপনে গুরুচণ্ডালী থাকলেও মানুষজন বিজ্ঞাপনের ভাষা পড়ে মানিকের মতো এত উত্তেজিত হলো না। প্রথম যে এলো তার সুচালো মুখ এবং তার সুচালো গোঁফ। চোখেমুখে একটা ধুরন্ধরের ভাব। রতনকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “পত্রিকায় আপনি বিজ্ঞাপন দিছিলেন?”

ভাগ্যিস আশেপাশে মানিক ছিল না, সে শুদ্ধ ভাষা ছাড়া কথা বলে না, তার সামনে দিয়েছিলেন না বলে দিছিলেন বললে তার কপালে দুঃখ থাকে। রতন অবশ্যি ভাষা নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, “হ্যাঁ। আমি দিয়েছিলাম।”

“বিজ্ঞাপন পরিষ্কার হয় নাইক্কা। আপনি বলেন নাই কয়টা কাউয়ার। বাচ্চা লাগবি। খুচরা না পাইকারি।”

রতন কখনো চিন্তা করে নাই এরকম একটা ব্যাপার হতে পারে। ভুরু কুঁচকে বলল, “আপনি কয়টা দিতে পারবেন?”

“সেইটা নির্ভর করে দামের ওপরে। পার পিছ কাউচার বাচ্চা কত করে দিবেন?”

“সেটা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করতে পারি। আগে আপনি দেখান। কয়টা এনেছেন?”

“সেম্পল হিসেবে একটা আনছি।”

“দেখান।”

মানুষটা তার হাতের ছোটো বাক্সটা থেকে খুব সাবধানে একটা মুরগির বাচ্চা বের করল। ছোটো এবং হলদে রঙের শরীরে কোমল পালক। বাক্স থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে কিউ কিউ করে ডাকল।

রতন মুখ শক্ত করে বলল, “এটা কাকের বাচ্চা না। এটা মুরগির বাচ্চা।”

মানুষটা মুখ আরো বেশি শক্ত করে বলল, “এইটা কাউয়ার বাচ্চা।

রতন বলল, “আমি আপনার সাথে তর্ক করতে চাই না। এটা কাকের বাচ্চা না। আপনি একটা মুরগির বাচ্চা নিয়ে এসেছেন।”

“কাউচার বাচ্চা ছোট্ট থাকতি মুরগির বাচ্চার মতন থাকে। বড়ো হলি কাউয়ার বাচ্চার মতন হয়। হলুদ লোম পড়ে কালা লোম ওঠে।”

“আমি সেটা নিয়েও কথা বলতে চাই না। আপনি মুরগির বাচ্চাটাকে নিয়ে যান। আমি এটাকে কাকের বাচ্চা হিসেবে কিনব না। মুরগির বাচ্চাটাকে কষ্ট দিবেন না। যেখান থেকে এনেছেন সেখানে ফেরত দিয়ে দেবেন।”

মানুষটা তখন খুবই বিরস মুখে মুরগির বাচ্চাটা তার বাক্সে ঢোকাল। তারপর বলল, “কামটা ঠিক হইল না।”

রতন জিজ্ঞেস করল, “কোন কাজটা ঠিক হলো না?”

“আমারে পয়সা খরচ কইরা পুরান ঢাকা থেকি আনলেন। এখন বলেন আমার কাউয়ার বাচ্চা নিবেন না। এইটা নাকি মুরগির বাচ্চা! আপনার কারণে আমার বিশাল লস।”

রতন কিছু জিজ্ঞেস না করে ধুরন্ধর চেহারার মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা বলল, “অন্তত আমারে ট্যাকি ভাড়টা দেন।”

“আপনাকে ট্যাক্সি ভাড়া দিতে হবে?”

“একশ বার। আমারে আপনে চিনেন না। পুরান ঢাকায় আমারে সবাই চিনে। আমি যেইটা বলি সেইটাই ফাইনাল। মুরগির বাচ্চা কইলে মুরগির বাচ্চা। কাউয়ার বাচ্চা বললে কাউয়ার বাচ্চা। পুলিশের সার্জেন্ট পর্যন্ত আমারে দেখলে সেলাম দেয়।”

মানুষটা তখন বুকের কাছে শার্টের একটা বোতাম খুলে শার্টের কলারটা সোজা করল। রতন বলল, “ঠিক আছে।”

তারপর গলা উঁচিয়ে ডাকল, “টাইগার!” সাথে সাথে বাঘের মতো গর্জন করে ভিতর থেকে এলসেশিয়ান কুকুরটা ডেকে উঠল, তারপর ভারি গলায় গর্জন করতে করতে ছুটে আসতে থাকে।

কুকুরের ডাকে ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। পুরান ঢাকার বিখ্যাত মাস্তান চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। রতন আগেও দেখেছে ভারি গলায় কুকুরের ডাকের এই রেকর্ডিংটা সব সময়ে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। সে এমনভাবে এটা রেডি করেছে যে, টাইগার বলে ডাকলেই রেকর্ডিংটা বেজে ওঠে। ডাকটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। মনে হয় ভেতর থেকে বাইরে ছুটে আসছে।

কাকের বাচ্চা নিয়ে দ্বিতীয় যে মানুষটি এলো সেও মহা ধুরন্ধর, সত্যি কথা বলতে কী সে পুরান ঢাকার মাস্তান থেকেও বড়ো ধুরন্ধর। সেও একটা মুরগির বাচ্চা নিয়ে এসেছে কিন্তু সে এনেছে কালো রং করে। রতন মুরগির বাচ্চাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কাজটা ঠিক করেননি।”

মানুষটা কিছু বুঝতে পারেনি সেরকম ভান করে বলল, “কোন কাজটা?”

“এই যে মুরগির বাচ্চাকে আলকাতরা দিয়ে কালো রং করে নিয়ে চলে এসেছেন। এত ছোটো বাচ্চাটা তো এখন মরে যাবে।”

মানুষটা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু। এটা মোটেও আলকাতরার রং না, এটা পাকা রং।”

“পাকা হতে পারে কিন্তু আমি আলকাতরার গন্ধ পাচ্ছি। রংটা এখনো কাঁচা, হাত দিলে হাতে উঠে আসছে।”

মানুষটা তখন খুব অবাক হবার ভান করে বলল, “কী আশ্চর্য! এই জন্যে মানুষকে বিশ্বাস করতে নাই। আমি অফিসের স্টাফকে দায়িত্ব দিয়েছি, ব্যাটা যেন আমাকে কাকের বাচ্চা এনে দেয়, আর সে কী দিয়েছে দেখলেন? মুরগির বাচ্চাকে আলকাতরাতে চুবিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ব্যাটা বদমাইস, আজকেই ব্যাটাকে তাড়িয়ে দেব! চাকরি নট করে দিব।”

রতন কোনো কথা না বলে মানুষটাকে আলকাতরা দিয়ে কালো রং করা মুরগির বাচ্চাটা ফিরিয়ে দিল। মানুষটা তার বাক্সে সেটা ভরে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল। রতনের এবারে টাইগারকে ডাকতে হলো না।

এভাবে সারাদিনই নানা ধরনের মানুষ নানাকিছু নিয়ে আসতে লাগল। একজন একটা আধমরা কাক নিয়ে এসে বলল, এটা কাকের বাচ্চা, তার বাপ মা তাকে বেশি বেশি মরা ইঁদুর খাইয়ে তাড়াতাড়ি বড়ো করে ফেলেছে। একজন কয়েকটা ডিম নিয়ে এসে বলল, এটার ভিতরে কাকের বাচ্চা আছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। (রতন টেবিলে ডিমটাকে দুই পাক দিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ভেতরে বাচ্চা নেই, বাচ্চা থাকলে মোমেন্ট অফ ইনারশিয়ার কারণে ভিন্ন এংগুলার মোমেন্টাম হতো কিছু না বুঝে লোকটা মুখ কালো করে ফেরত গেল) একজন কয়েকটা কালো কবুতরের বাচ্চা কাকের বাচ্চা হিসেবে গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল।

সত্যিকারের কাকের বাচ্চা নিয়ে এলো দশ বারো বছরের একটা ছেলে। ছেলেটার জ্বলজ্বলে চোখ উশকোখুশকো চুল এবং সারা শরীরে অসংখ্য কাটাছেঁড়া। পলিথিনের ব্যাগে দুইটা কাকের বাচ্চা রতনের সামনে রেখে বলল, “হুশ!”

হুশ মানে কী কিংবা কেন বলা হয় রতন জানে না, তাই সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী হয়েছে? শরীরে এত কাটাছেঁড়া, ছাল ওঠা কেন?”

“বদমাইস কাকগুলি এটাক করেছিল। যখন কাকের বাচ্চা নিচ্ছিলাম তখন হাজার হাজার কাক এসে আমাকে আক্রমণ করেছে।”

রতন সত্যি সত্যি একটু ভয় পেয়ে বলল, “সর্বনাশ!”

“চারটা বাচ্চা ছিল। দুইটা রেখে এসেছি কাকের ফেমিলির জন্যে। বদমাইশগুলি জানে না ছোটো পরিবার সুখী পরিবার।”

“তুমি ব্যথা পাওনি তো?”

“পাই নাই আবার। কাকের ঠোঁট কী ভয়ংকর জানেন?”

“তুমি এত ছোটো ছেলে এরকম একটা ডেঞ্জারাস কাজ করতে গেলে! কাকেরা খুব দল বেঁধে থাকে।”

ছেলেটা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “হুশ!”

রতন পলিথিনের ব্যাগ থেকে কাকের দুইটা বাচ্চা বের করে টেবিলে রাখল। শরীরে কোনো পালক নেই, মনে হয় রোস্ট করার জন্যে কেউ ছোটো ছোটো মোরগের বাচ্চার পালক তুলে ফেলেছে। কাকের বাচ্চা দুটি একটা আরেকটার সাথে জড়াজড়ি করে মুখ হা করে নড়তে লাগল।

রতন বলল, “ফ্যান্টাস্টিক! কোথায় পেলে বাচ্চাগুলো?”

“আমাদের ফ্ল্যাট চারতলায়, পাশে বাড়িওয়ালার আম গাছ আছে। সেই আম গাছে কাক বাসা করে ডিম পেড়েছে। আমাদের ফ্ল্যাট থেকে দেখা যায়। কালকে মাত্র ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়েছে।”

“ভেরি গুড।” ছোটো ছেলেমেয়েদের সাথে কীভাবে কথা চালিয়ে যেতে হয় রতনের জানা নেই, তাই কী বলবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি বুঝি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনটা দেখেছিলে?”

বাচ্চাটা মাথা নাড়ল, বলল, “সেটা অনেক লম্বা স্টোরি।”

“লম্বা স্টোরি?”

“হ্যাঁ। হুশ!”

“কী স্টোরি?”

“ফাটাফাটি একটা সায়েন্স ফিকশানের বই বের হয়েছে। আব্বুকে কিনে দিতে বললাম। আব্বু কানে ধরে একটা চটকানি দিয়ে বলল, পাঠ্যবই বাদ দিয়ে আউট বই পড়বে! নো মোর আউটবুক। যেদিন নিজে পয়সা কামাই করবি সেইদিন নিজের পয়সা দিয়ে আউটবুক কিনবি।”

ছেলেটা একটু থামল, রতন জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”

“তখন নিজে কীভাবে পয়সা কামাই করা যায় সেইটা দেখার জন্যে পত্রিকাটা ঘাটাঘাটি করলাম। তখন বিজ্ঞাপনটা দেখেছি।” ছেলেটার মুখে এগাল-গাল জোড়া হাসি ফুটে উঠল, বলল “আমার জন্যে এক্কেবারে। মিলে গেছে। শুধু বদমাইশ কাকের গুষ্টি কাকগুলো বড়ো ঝামেলা করেছে।”

রতন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। দল বেঁধে কাক যখন এটাক করে সেটা খুব ডেঞ্জারাস। আলফ্রেড হিচককের এরকম একটা সিনেমা আছে, নাম দি বার্ডস।”

ছেলেটার সিনেমা নিয়ে খুব আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না, জিজ্ঞেস করল, “কাকের বাচ্চা দিয়ে কী করবেন?”

“পাখি নিয়ে আমার একটা থিওরি আছে সেটা সত্যি কি না টেস্ট করব।”

ছেলেটার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল, “আপনি সাইন্টিস্ট?”

“বলতে পারো!”

“আপনি গবেষণা করেন? আপনার ল্যাবরেটরি আছে?”

“মোটামুটি একটা আছে।”

ছেলেটার চোখ আরো বড়ো বড়ো হয়ে গেল, বলল, “হুশ!”

রতন বলল, “তোমার কাকের বাচ্চার জন্যে কত দিতে হবে? বেশ কয়েকটা সায়েন্স ফিকশানের বই যেন নিতে পার সেরকম দিলে কি হবে?”

ছেলেটা বলল, “আপনাকে টাকা দিতে হবে না। আমি আগে কখনো সাইন্টিস্ট দেখি নাই। আজকে দেখলাম। বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে আপনাকে আমি ফ্রি কাকের বাচ্চা দিয়ে গেলাম।”

“সে কী!”

“হ্যাঁ। ফ্রি! গবেষণার জন্য আর কী লাগবে বলেন। সেগুলাও দিয়ে যাব।”

“আপাতত কিছু লাগবে না। কিন্তু তোমার ফ্রি কাকের বাচ্চা দিতে হবে না।” রতন তখন তাড়াতাড়ি একটা খামে কয়েকটা বড়ো বড়ো নোট ভরে ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিল। ছেলেটার জীবনের প্রথম উপার্জন এটা, তার মনে রাখার মতো হলেই ভালো। ছেলেটা খামটা হাতে নিয়ে বলল, “হুশ!”

“তোমার নামটা কী?”

“মিঠু। বন্ধুরা ডাকে–” ছেলেটা কথা শেষ না করে থেমে গেল।

“বন্ধুরা কী ডকে?”

“মৃত্যু।”

“মৃত্যু? কী সর্বনাশ! তোমাকে মৃত্যু ডাকে কেন?”

“আমাকে ভয় পায় তো সেই জন্যে?”

“তোমাকে ভয় পায় কেন?”

“কী জানি!” ছেলেটা এই আলাপটা চালিয়ে যেতে বেশি উৎসাহ দেখাল না। কিন্তু রতন অনুমান করতে পারল। যে ছেলে হাজার হাজার কাকের আক্রমণকে পরোয়া না করে কাকের বাসা থেকে তার বাচ্চা ছিনতাই করে নিয়ে আসতে পারে তাকে মনে হয় একটু ভয় পাওয়াই যেতে পারে।

খামটা হাতে নিয়ে চলে যেতে যেতে ছেলেটা থেমে গেল, ফিরে এসে বলল, “আমি কি মাঝে মাঝে এসে এই কাকের বাচ্চাকে দেখে যেতে পারব?”

রতন বলল, “অবশ্যই! যখন ইচ্ছা। তুমি যদি চাও তাহলে তোমার বাসার টেলিফোন নম্বর দিয়ে যেতে পার। দেখানোর মতো কিছু হলে তোমাকে ফোন করে আমি খবর দিয়ে দিব।”

মিঠু খানিকক্ষণ কিছু-একটা চিন্তা করে বলল, “আব্বুর টেলিফোন নম্বর দিয়ে লাভ নাই, উলটো ধরে আমাকে পিটুনি দিবে। আম্মুর নম্বর দিয়েও লাভ নেই, ফোনটাই ধরবে না। আপুর নম্বরটা দিতে পারি। মেজাজ ভালো থাকলে আমাকে ফোন দিতেও পারে।”

“ঠিক আছে, তাহলে তোমার বোনের নম্বরটাই দিয়ে যাও।”

মিঠু রতনকে তার বোনের টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে গেল।

.

মানিক কাকের বাচ্চা দুটিকে দেখল একদিন পর। রতন টেবিলের উপর বাচ্চা দুটোকে রেখে একটা সিরিঞ্জ দিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছিল, মানিক দেখে চিৎকার শুরু করল, “কী? এগুলো কী?”

রতন বলল, “কাকের বাচ্চা।”

“কাকের বাচ্চা এরকম কেন? এদের পালক কে ছিঁড়েছে?”

“কেউ ছিঁড়েনি। এদের পালক এখনো গজায়নি।”

“কী কুৎসিত! দেখে মনে হচ্ছে কেউ এদের ন্যাংটো করে রেখেছে!”

রতন একটা কাকের বাচ্চার মুখে সিরিঞ্জটা ধরে চাপ দিয়ে খানিকটা খাবার ঢুকিয়ে দিতেই বাচ্চাটা আগ্রহ নিয়ে সেটা খেতে থাকে। দ্বিতীয় বাচ্চাটা তখন মুখ হা করে এগিয়ে আসে।

মানিক বলল, “শুধু কুৎসিত নয়। এগুলো নির্লজ্জের মতো ক্ষুধার্ত এবং লোভী। এদের খাওয়ার মাঝে কোনো সৌন্দর্য নেই।”

রতন বলল, “খাওয়ার মাঝে যে সৌন্দর্য থাকে আমি জানতাম না।”

মানিক বলল, “এই বাচ্চা দুটি যে শুধু কুৎসিত তাই নয় এরা যখন খাচ্ছে তখন বাথরুম করছে। ইয়াক থু, ছিঃ।”

রতন বলল, “তোমার মা বেঁচে থাকলে আমি তার সাথে দেখা করে জিজ্ঞেস করতাম, যখন তুমি খুব ছোটো ছিলে তখন তুমিও খাওয়ার সময় বাথরুম করতে কি না।”

মানিক কথাটা না শোনার ভান করে বলল, এতকিছু থাকতে তুমি কেন দুটি কাকের বাচ্চার পিছনে এত সময় দিচ্ছ?”

“পাখি নিয়ে আমার একটা থিওরি আছে, আমি সেটা টেস্ট করব।”

“সেটি কী?”

“তুমি নিশ্চয়ই জান পাখিরা খুব বুদ্ধিমান।”

মানিক মাথা নাড়ল, বলল, “আমি জানি না।”

“ঠিক আছে না জানলেও সমস্যা নেই। এখন জানলে। বুদ্ধিমান প্রাণী তাদের হাত দিয়ে অনেক কিছু করে। পাখিদের হাত নেই, যে দুটো অংশ হাত হতে পারত সেগুলো হয়ে গেছে পাখা। কাজেই আমরা যে কাজগুলো হাত দিয়ে করি, পাখিদের সেগুলো করতে হয় ঠোঁট দিয়ে।”

“তাতে সমস্যাটা কী?”

“কোনো সমস্যা নেই। শুধু একদিন হাত ব্যবহার না করে মুখ দিয়ে জুতার ফিতা বাঁধার চেষ্টা কর।”

“আমি কেন মুখ দিয়ে জুতার ফিতে বাঁধব?”

“ঠিক আছে বাঁধতে না চাইলে বেঁধো না। কিন্তু যদি বাঁধতে চেষ্টা করতে তাহলে বুঝতে পারতে মুখের তুলনায় হাত দিয়ে কাজ করা কত সহজ! হাত দিয়ে কাজ করতে পারলে তুমি অনেক কিছু করতে পারো, হাত না থাকলে তুমি কিছুই পারো না।”

“আমি এখনো বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছ।”

“তার কারণ আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা এখনো বলিনি। এখন বলি, তুমি শোনো। পাখিরা অনেক বুদ্ধিমান হলেও তারা কিছুই করতে পারে না, কারণ তাদের হাত নেই। তাদের যদি হাত থাকত তাহলে তারা

জানি কতো কিছু করতে পারত। সেজন্যে”

“সেজন্যে কী?”

“সেজন্যে আমি তাদের শরীরে দুটো ছোটো ছোটো রবোটিক হাত লাগিয়ে দিতে চাই। দেখতে চাই তখন তারা তাদের বুদ্ধি ব্যবহার করে সেই হাত দিয়ে কী করে।”

“তার মানে তুমি যে দুই মাস সময় লাগিয়ে পুতুলের দুইটা হাত তৈরি করেছ সেগুলো আসলে এই কাকের বাচ্চাদের জন্যে?”

রতন বলল, “তুমি ঠিক অনুমান করেছ।”

“আমি এখনো পুরোটুকু অনুমান করতে পারিনি। ছোটো ছোটো হাত লাগাতে চাও ভালো, কিন্তু এই কুৎসিত বাচ্চাগুলোকে কেন? এত ছোটো। বাচ্চা নিজে খেতেই পারে না সে হাত দিয়ে কী করবে?”

“একবার বড়ো হয়ে গেলে সে আর হাত ব্যবহার করতে পারবে না। ছোটো থাকতে চেষ্টা করলে সেটাকে অভ্যস্ত করানো যাবে।”

মানিক অনেকক্ষণ কথা না বলে চুপ করে রইল, তারপর ফোঁস করে। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি সবকিছু বুঝতে পেরেছি শুধু একটা জিনিস এখনো বুঝতে পারিনি।”

রতন জিজ্ঞেস করল, “কী?”

“পৃথিবীতে এত বিচিত্র পাখি রয়েছে, এত সুন্দর সুন্দর পাখি রয়েছে, সবকিছু ছেড়ে তুমি কাককে কেন বেছে নিলে? কালো কুৎসিত কদাকার কাক?”

রতন বলল, “তার কারণ পাখিদের মাঝে কাক হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। কাকদের বলে পাখিদের আইনস্টাইন।”

“পাখিদের আইনস্টাইন?”

“হ্যাঁ।”

মানিক তখন আবার একটা লম্বা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, “পাখিদের যদি আইনস্টাইন থাকে তাহলে কি পাখিদের শেকসপিয়ার আছে?”

“নিশ্চয়ই আছে?”

“সেটি কোন পাখি?”

“আমি জানি না। প্যাচা হতে পারে।”

“প্যাঁচা? প্যাঁচা কেন হবে?”

রতন বলল, “কবি সাহিত্যিকদের কথা মনে হলেই আমার কেন জানি মনে হয় একজন মুখ ভোঁতা করে বসে আছে, অনেকটা প্যাচার মতো।”

মানিক চোখ গরম করে রতনের দিকে তাকাল, বলল, “তুমি অত্যন্ত অশোভন একটা কথা বলেছ।”

রতন মাথা নাড়ল, বলল, “আমার যেটা মনে হয় সেটা বলেছি। আমি কী করব? আগে শুধু একটা ভাসা-ভাসা ধারণা ছিল তোমাকে দেখে ধারণাটা পাকা হয়েছে।”

মানিক মুখটা প্যাঁচার মতো করে বসে রইল। রতন গভীর মনোযোগ দিয়ে কাকের বাচ্চা দুটোকে খাওয়াতে লাগল।

.

কাকের বাচ্চা দুটির ডানায় রবোটিক হাত লাগানোর কাজটা মোটেও সহজ হলো না। বাচ্চা দুটি খুবই বিরক্ত হলো এবং যতবার দুটো হাত লাগানো হলো ততবার সেগুলো খুঁটে খুঁটে খুলে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। রতন হাল ছাড়ল না, সে অনেকভাবে চেষ্টা করে হাতগুলো লাগিয়ে যেতে লাগল। রতনের ধৈর্যের শেষ নেই তাই কাকের বাচ্চা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল এবং দেখা গেল তাদের দুই ডানা থেকে ছোটো ছোটো দুটো হাত লম্বা হয়ে বের হয়ে এসেছে। সেখানে এখনো কোনো কানেকশান দেয়া হয়নি, রতন প্রথমে কাকের বাচ্চাগুলোকে তাদের রবোটিক হাতে অভ্যস্ত করতে চায়। যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখন হাত দুটোকে চালু করা যাবে।

মানিক যখন দেখতে এলো তখন কাকের বাচ্চা দুটি তাদের বাড়তি হাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ডানা থেকে দুটি হাত সোজা সামনের দিকে বের হয়ে এসেছে। যখন কানেকশান দেয়া হবে তখন সেগুলো ভাজ হবে, নড়বে–এই মুহূর্তে সেগুলো দুটো ছোটো ছোটো কাঠি ছাড়া আর কিছু নয়।

এর মাঝে রতন কাকের বাচ্চা দুটির জন্যে থাকার জায়গা করেছে। তার বাসার পিছনে খোলা জায়গাটা সে নেট দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। ভেতরে কয়েকটা গাছও আছে। সেরকম একটা গাছে সে একটা বাক্স বসিয়ে তাদের বাসা তৈরি করেছে। ভিতরে কাঠকুটো দিয়ে তৈরি কাকের বাসা। বাচ্চা দুটো সেখানে থাকতে আপত্তি করে না। রতন ঘড়ি ধরে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ায়। বাচ্চাগুলো এখন রতনকে দেখলেই মুখ হা করে তার দিকে এগিয়ে আসে, রতন আদর করে খাইয়ে দেয়। কাকের বাচ্চা দুটোর গায়ে ছোটো ছোটো কালো পালক উঠতে শুরু করেছে সেই ল্যাদল্যাদা পালকছেঁড়া ভাবটা আর নেই। বাচ্চাগুলো রতনের গলার স্বরেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ডাকলে তারা সাড়া দেয়। রতন বাচ্চা দুটোর নাম দিয়েছে কালাচান এবং ধলাচান। দেখতে দুটো একইরকম, রতন অবশ্যি আলাদা করতে পারে, চোখের রং গায়ের পালক আর পাখার গঠনে ছোটোখাটো পার্থক্য আছে যেটা রতন ছাড়া আর কারো চোখে ধরা পড়ে না।

মানিক কাকের বাচ্চা দুটির দিকে এক ধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “শুধু কাকের বাচ্চা দেখতে যথেষ্ট খারাপ। এখন এই দুটো ঘটঘটিক হাত লাগানোর পর এদের দেখতে আরো খারাপ লাগছে।”

রতন বলল, “শব্দটা ঘটঘটিক না। রবোটিক।”

“এক কথা। আমার কানে রবোটিক আর ঘটঘটিক আলাদা কোনো ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে না। আমার কাছে দুটিই এক।”

রতন কোনো উত্তর না দিয়ে কাকের বাচ্চা দুটোর কাছে গিয়ে ডাকল, “কালাচান, ধলাচান এদিকে আসো।”

রতনের ডাক শুনে দুটো বাচ্চাই হাঁচড়পাঁচড় করে তার দিকে এগিয়ে এসে, তার হাতে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। মানিক চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললে, কী বললে তুমি?”

রতন বলল, “আমি বাচ্চা দুটোকে ডাকলাম। একটার নাম কালাচান আরেকটা ধলাচান।”

“হায়, হায় হায়! তুমি এ কী করেছ? এরকম দুটো অমার্জিত শব্দ ব্যবহার করে নাম রেখেছ? নাম দেয়ার আগে তুমি আমাকে কেন জিজ্ঞেস করলে না? এদের নাম হতে পারত কৃষ্ণকলি, একটা কৃষ্ণ আরেকটা কলি।”

রতন তার হাতের উপর উঠে বসে থাকা বাচ্চা দুটোকে আদর করতে করতে বলল, “আমি বুঝতে পারিনি তুমি এদের নাম দিতে চাইবে। আমি ভেবেছিলাম তুমি এদের দুইচোখে দেখতে পার না।”

মানিক বলল, “অবশ্যই দুই চোখে দেখতে পারি না। তাই বলে দুটো সুন্দর নাম দিতে আপত্তি করব কে বলেছে?”

রতন ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ছেড়ে দাও! আমার তো কালাচান আর ধলাচান নাম দুটো ভালোই লাগছে। ডাকলে কি সুন্দর সাড়া দেয় দেখেছ?”

রতন ব্যাপারটা দেখানোর জন্য ডাকল, “কালাচান” সাথে সাথে একটা বাচ্চা তার পাখা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সাড়া দিল। তারপর ডাকল, “ধলাচান” তখন অন্যটা পাখা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সাড়া দিল।

মানিক হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “কী ভয়ানক! তুমি কি কালা আর ধলা শব্দের মানে জানো না? কালা মানে কালো, ধলা মানে সাদা। এর মাঝে সাদা কাক কি আছে? তাহলে সাদা নাম কেন দিলে?

রতন বলল, “আমি কি আসলেই রতন? তুমি কি আসলেই মানিক? কিন্তু আমাদের নাম রতন আর মানিক। তাতে কার কী সমস্যা হয়েছে?”

মানিক বলল, “তাই বলে কালো আর ধলার মতো এরকম অমার্জিত শব্দ?”

রতন উত্তর না দিয়ে কালাচান আর ধলাচানকে আদর করতে লাগল। শব্দ কেমন করে অমার্জিত হয় সেটা সে বোঝে না।

.

এর মাঝে একদিন মিঠু, যাকে তার ক্লাশের ছেলেমেয়েরা মৃত্যু বলে ডাকে, কাকের বাচ্চা দুটো দেখতে এল। সে অবশ্যি একা আসেনি। তার সাথে আরো দুইজন এসেছে, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের নাম মৃত্যু না হলেও গজব কিংবা তাণ্ডব হওয়ারই কথা। কাকের বাচ্চার যে জিনিসগুলো মানিক অপছন্দ করেছিল মিঠু আর তার বন্ধুরা সে জিনিসগুলোই পছন্দ। করল। কালাচান এবং ধলাচান নাম দুটো তাদের খুবই পছন্দ হলো, হাতে কিল দিয়ে মিঠু বলল, “ফাটাফাটি নাম! হুশ!”

ছোটো ছোটো রবোটিক হাত দেখে তারা মুগ্ধ হয়ে গেল। বলল, “ফ্যান্টাস্টিক! এক্কেবারে বুংগাবুংগি। হুশ! হুশ!

রতন বুংগাবুংগি শব্দটা আগে কোনোদিন শোনেনি, তাই তার মানে বুঝতে পারল না। কিন্তু অনুমান করল এটাও ফাটাফাটি’ অর্থ বোঝানোর জন্যে তৈরি করা একটা শব্দ হবে।

মিঠু জিজ্ঞেস করল, “কালাচান ধলাচান কি রবোটিক হাত নাড়াতে পারে?”

“এখনো হাত নাড়ানোর ট্রেনিং দেই নাই। প্রথমে অন্য ট্রেনিং দিচ্ছি।”

“কী ট্রেনিং?”

“টয়লেট ট্রেনিং।”

মিঠু এবং তার দুই বন্ধু অবাক হয়ে বলল, “টয়লেট ট্রেনিং?”

রতন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। পাখিদের নিয়ে কাজ করার এই হচ্ছে সমস্যা। যখন তখন বাথরুম করে দেয়। এ জন্যে কালাচান আর ধলাচানকে ট্রেনিং দিচ্ছি। যখন তখন বাথরুম করবে না। যখন বলবে তখন করবে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। ট্রেনিং মোটামুটি কমপ্লিট। এখনো মাঝে মাঝে একসিডেন্ট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেটা তো হবেই। মানুষেরই হয় এরা তো কাকের বাচ্চা।”

মিঠু বলল, “হুশ! কী রকম ট্রেনিং, দেখানো যাবে?”

“হ্যাঁ। এই দেখ।” বলে কালাচান আর ধলাচানকে ঘরের এক কোনায় নিয়ে গেল, সেখানে একটা ছোটো বাক্স তার ভেতরে খবরের কাগজ বিছানো। বাক্সের ওপর কালাচান আর ধলাচানকে ধরে বলল, “পিচিক।”

সাথে সাথে পিচিক করে একই সাথে কালাচান ধলাচান বাথরুম করল। সেটা দেখে মিঠু আর তার দুই বন্ধু আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, “ঝিংগা মিংগা।”

ঝিংগা মিংগা শব্দটাও রতন জানে না, ধরে নিল এটাও বুংগাবুংগি কিংবা ফাটাফাটির মতো কোনো শব্দ হবে। বোঝাই যাচ্ছে শব্দটা আনন্দ প্রকাশ করার শব্দ, শব্দটা কালাচানের ধলাচানের জন্যে একটু বেশি হয়ে গেল, ভয় পেয়ে তারা ওড়ার চেষ্টা করল, এখনো উড়তে শেখেনি। তাই ডানা ঝাঁপটে তারা নীচে এসে পড়ল। তারপর হাঁচড়পাঁচড় করে একটা কোনায় লুকানোর চেষ্টা করল।

রতন কালাচান ধলাচানকে আদর করে তুলে নিয়ে বলল, “আরে বোকা, এত অল্পে ভয় পেলে চলবে? এই দেশে থাকতে হলে আরো কতরকম শব্দ শুনতে হবে! তাই না মিঠু?”

মিঠু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনার ট্রেনিংটা এক্কেবারে ফাটাফাটি। পিচিক বললেই বাথরুম–”

মিঠুর মুখে পিচিক শব্দটা শুনে আবার কালাচান ধলাচান বাথরুম করে দিল, রতন প্রস্তুত ছিল না বলে এবারে তার হাতের মাঝে!

মিঠু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “হায় হায়! আমি বুঝতে পারি নাই এই শব্দটা বললেই বাথরুম করে দেবে–”

রতন বলল, “কোনো সমস্যা নেই, এটা অনেকবার হয়েছে। আমার পরের প্রজেক্ট হচ্ছে পাখিদের জন্যে ডাইপার আবিষ্কার।”

কথাটা শুনে এই তিন রত্ন খুব মজা পেল। তারা খানিকক্ষণ হি হি করে হাসল। হাসি থামার পর তিনজনই হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল, মিঠু বলল, “বুঝলি তোরা, এই কাকের বাচ্চা দিয়ে কী সাংঘাতিক কাজ করা। যাবে।”

“কী কাজ?”

“এটা যখন উড়ে উড়ে কারো মাথার ওপর আসবে তখন আমরা এই শব্দটা বলব আর সাথে সাথে তার মাথায় বাথরুম করে দেবে।”

দৃশ্যটা কল্পনা করে তিনজন আবার আনন্দে হি হি করে হাসতে থাকে। অনেক কষ্ট করে হাসি থামিয়ে মিঠু বলল, “সবার আগে মোখলেস স্যারের মাথায়।”

“তারপর বিলকিস মিস।”

“তারপর শাহজাহান স্যার।”

“তারপর কুদ্স স্যার।”

“তারপর জাহানারা ম্যাডাম।”

একেকজন স্যার কিংবা ম্যাডামের নাম বলে আর তারা হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকে, রতন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা কল্পনা করেই তাদের এত আনন্দ সত্যি সত্যি করতে পারলে না জানি কী হবে!

.

এর কয়েকদিন পর রতন কালাচান আর ধলাচানের রবোটিক হাতের সার্কিট প্রথমবারের মতো অন করল। তখন যা একটা ভয়ংকর ব্যাপার হলো তা বলার মতো না। হাত দুটি পুরোপুরি অনিয়ন্ত্রিতভাবে সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে নড়তে থাকে। হাতের আঙুল খুলতে থাকে বন্ধ হতে থাকে আর কাকের বাচ্চা দুটি ভয় পেয়ে ঝাপাঝাপি শুরু করে দেয়। রতনকে তাই একটু পরেই সার্কিটের সুইচটা আবার বন্ধ করে দিতে হলো।

রতন অবশ্যি খুব নিরুৎসাহিত হলো না, শুরুতে এরকম কিছু-একটা ঘটবে সেটা অনুমান করেছিল। কাকের বাচ্চা দুটির হাতগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকদিন সময় লাগবে এটা সে ধরেই রেখেছিল। রতন ধৈর্য ধরে লেগে রইল, প্রত্যেকদিন একটু পর পর সে সার্কিট অন করতে থাকে।

এক সপ্তাহের মাথায় প্রথমে ধলাচান তার রবোটিক হাতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারল। ব্যাপারটা ঘটল হঠাৎ করেই, ধলাচান হঠাৎ করে বুঝে গেল কীভাবে হাত দুটিকে কাছে আনতে হয় আবার দূরে নিতে হয়। তখন সে বারবার হাত দুটিকে কাছে আনতে থাকে আবার দূরে নিতে থাকে। কালাচান তখনও ব্যাপারটা ধরতে পারেনি তার হাত দুটো মোটামুটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়ছে। ধলাচান তখন এসে কলাচানকে তার হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিল, দেখে মনে হলো কাজটা করে সে খুব মজা। পেয়েছে।

কালাচানও পরের সপ্তাহ শেষ হবার আগেই তার নিজের হাত ব্যবহার করা শিখে গেল। তখন হাত দিয়ে একে অন্যকে ঠেলাঠেলি করা কালাচান ধলাচানের মজার একটা খেলা হয়ে দাঁড়াল।

কয়েকদিনের মধ্যেই তারা বুঝে গেল যে তাদের রবোটিক হাত দিয়ে তারা ঠেলাঠেলি ছাড়াও আরও মজার কাজ করতে পারে। তারা ইচ্ছে করলে কিছু-একটা ধরতে পারে। তারা তখন হাতের কাছে যেটাই পেল সেটাকেই ধরা শুরু করল, সেটাকে নাড়াচাড়া করা শুরু করল। ভুল করে একটা ফড়িং তাদের কাছে এসে হাজির হওয়ার পর সেটাকে যখন কালাচান খপ করে ধরে ফেলল তখন তাকে দেখে মনে হলো সে বুঝি রাজ্য জয় করে ফেলেছে!

রতন তাদের জন্যে কয়েকটা সাদা কাগজ বিছিয়ে দিল, তারপর সেখানে নানা রঙের কয়েকটা সাইনপেন রেখে দিল। কালাচান ধলাচান তাদের হাত দিয়ে কলমগুলো ধরে ধরে দেখল কিন্তু এটা দিয়ে কী করা যায় সেটা তারা বুঝতে পারল না। রতন তখন তার নিজের হাত দিয়ে রঙিন কলমগুলো দিয়ে কাগজে কিছু আঁকাজোখা করল। কালাচান আর ধলাচান খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখল। তারপর তারা নিজেরাই কলমগুলো ধরে কাগজে আঁকাজোখা শুরু করল। নানা রঙের দাগগুলো কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং ছাড়া আর কিছুই হলো না। কিন্তু তারপরেও তো সেটা সত্যিকার কাকের বাচ্চাদের নিজেদের হাতে আঁকা ছবি!

কালাচান এবং ধলাচানের আরো একটা বিষয়ে বেশ প্রতিভা আছে দেখা গেল। তাদের বাসায় ছোটো একটা ইলেকট্রিক অর্গান রেখে দেয়া হয়েছে। তারা সেটা বাজিয়ে নানা ধরনের শব্দ তৈরি করে। রতন খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনে বোঝার চেষ্টা করল এই শব্দগুলোর মাঝে কোনো সুর আছে কি না–কিন্তু সে কোনো সুর খুঁজে পেল না!

নানা অকাজে ব্যস্ত থাকার কারণে মানিকের অনেকদিন হলো রতনের বাসায় আসা হয়নি। কালাচান ধলাচানের কথা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তাই অনেকদিন পর এসে সে যখন দেখল টেবিলে একটা বড়ো কাগজ বিছানো এবং কালাচান আর ধলাচান দুজনে দুটো সাইনপেন দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা ছবি আঁকছে তখন তার প্রায় একটা হার্ট এটাকের মতো অবস্থা হলো। সে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করল, “এ-এ এরা কী করছে?”

“ছবি আঁকছে।”

“ছবি? কাকের বাচ্চারা ছবি আঁকতে পারে?”

রতন কালাচান ধলাচানের একটা ছবি হাতে ধরে বলল, “এটাকে যদি ছবি বলতে রাজি থাক।”

মানিক কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর সেই দৃষ্টিতে প্রথমে এক ধরনের বিস্ময় তারপর মুগ্ধতা নেমে এল। মানিক নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, “অসাধারণ!”

রতন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “অসাধারণ?”

“তুমি দেখছ না? মানুষের জীবনের ব্যর্থতা দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার কী অসাধারণ বিমূর্ত ছবি?”

“মানুষের? কালাচান ধলাচান এঁকেছে তাই এটা বড়োজোর কাকের জীবনের দুঃখ কষ্ট হতে পারে।”

মানিক খুবই বিরক্ত হলো, বলল, “সবকিছুকে সংকীর্ণ করে দেখা তোমার অভ্যাস। দৃষ্টিকে প্রসারিত কর। এই বিমূর্ত ছবির ভেতরকার সৌন্দর্য দেখার চেষ্টা কর।”

রতন দৃষ্টিকে প্রসারিত করে ছবির মাঝে শুধু কাকের ঠ্যাং আর বকের ঠ্যাংই দেখতে পেল। তাই মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে, তুমি যেহেতু এই ছবিতে সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছ, আমি এই ছবিটা তোমাকে বাঁধাই করে দিব, তুমি তোমার ড্রয়িংরুমে টানিয়ে রেখো।”

“ছবি বাঁধাই, কী বলছ? এই ছবির প্রদর্শনী করা সম্ভব। এই ছবি মিউজিয়ামে থাকা সম্ভব!”

রতন হাসি গোপন করে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি কাক পছন্দ কর না! তার আঁকা ছবি দেখে তুমি এত মুগ্ধ–“

মানিক মাথা নেড়ে বলল, “কাক সম্পর্কে আমার ধারণা সঠিক ছিল। আসলে কাকদের নিয়ে কবিরা কবিতা লিখেছেন। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন হয়ত ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে জয়নুল আবেদিন তাঁর দুর্ভিক্ষের ছবিতে কাকদের স্কেচ এঁকেছেন। ঈশপ পর্যন্ত কাকদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গল্প লিখেছেন। এখন তুমি দেখালে কাকেরা শিল্পী!”

রতন বলল, “আমার কালাচান ধলাচান শেষ পর্যন্ত তোমার মনের মতো হয়েছে শুনে খুশি হলাম।”

মানিক বলল, “এখন এদের নিয়ে কী করবে? এদের নান্দনিক অনুভূতিকে আরো বিকশিত করা যায় কীভাবে?”

রতন বলল, “আসলে আমি ঠিক করেছি এদের হাতগুলো খুলে এখন এদের ছেড়ে দেব।”

মানিক আঁতকে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি?”

“হ্যাঁ। ঠিকই বলেছি।”

“কেন?”

পাখিদের নিয়ে আমার একটা থিওরি ছিল, যে পাখিদের হাত থাকলে তারা নানারকম কাজ করতে পারত। আমার সেই থিওরিটা প্রমাণ হয়ে গেছে, কাজেই আমার কাজ শেষ। এখন কালাচান ধলাচানকে ছেড়ে দেবার সময় হয়েছে।”

“ছেড়ে দেবে?” মানিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, “তুমি এদের ছেড়ে দেবে?”

“হ্যাঁ। হাত থাকার কারণে তারা অনেক কিছু করতে পারে যেটা অন্য কাকেরা করতে পারে না। তাই কাকদের সমাজে অন্য কাকেরা মনে হয় কালাচান ধলাচানকে নিবে না। তাই হাত খুলে স্বভাবিক কাক বানিয়ে এখন এদের ছেড়ে দিতে হবে।”

মানিক বলল, “কখন ছাড়বে?”

“আজকেই ছেড়ে দেবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মিঠুকে না দেখিয়ে ছাড়া ঠিক হবে না।”

“মিঠু কে?”

“যে বাচ্চাটা কালাচান ধলাচানকে এনে দিয়েছে।”

“তাকে কখন দেখাবে?”

“আমি তাকে ফোন করে খবর দিয়েছি, আজ কাল কোনো এক সময় চলে আসবে।”

মানিক কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল, তারপর বলল, “রতন, তুমি মনে হয় একটা বিষয় বুঝতে পারছ না।”

“কী বিষয়?”

“তোমার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা মানুষের জানা দরকার।”

“যুগান্তকারী আবিষ্কার?”

“হ্যাঁ। আমরা আগে জানতাম শুধু মানুষের বুঝি নান্দনিক বোধ আছে। তুমি দেখালে শুধু মানুষ নয় পাখিদের ভেতরেও সেই শিল্পবোধ আছে। সৃষ্টিশীলতা আছে। এই অসাধারণ সত্যটি আমাদের সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে–”

“সবাইকে জানাতে হবে?” রতন চোখ কপালে তুলে বলল, “সর্বনাশ!”

মানিক বলল, “সর্বনাশ? সর্বনাশ কেন হবে? আমি অনেক পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকদের চিনি। টেলিভিশন চ্যানেলের লোকজনকে চিনি। তাদের খবর দিলেই চলে আসবে। পত্র-পত্রিকায় সংবাদ ছাপাবে। টেলিভিশনে টক শো হবে। সাংবাদিক সম্মেলন হবে।”

রতন মাথা নেড়ে বলল, “মানিক, তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না। আমি দুইটা জিনিসকে ভয় পাই। কোমাডো ড্রাগন আর সাংবাদিক।”

মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “কেন? তুমি সাংবাদিকদের কেন ভয় পাও? তুমি জান সাংবাদিকতা অনেক মহান পেশা।”

“সেই জন্যেই ভয় পাই। আমার নিরিবিলি জীবন একেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে যাবে।”

মানিক মেঘস্বরে বলল, “ছ্যাড়াব্যাড়া বলে বাংলা ভাষায় কোনো শব্দ নেই। শব্দটি অত্যন্ত অশালীন।”

“ঠিক আছে আমার জীবনটা আউলাঝাউলা হয়ে যাবে।”

“এই শব্দটিও যথেষ্ট অমার্জিত–কিন্তু সেটা আলোচনার বিষয় নয়। আমি জানতে চাই কেন তুমি সাংবাদিকদের ভয় পাও?”

“তার কারণ সাংবাদিকেরা বাড়িয়ে চাড়িয়ে সবকিছু বলবে, তখন অন্য সাংবাদিকেরা দেখতে আসবে। তারা আরো বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলবে। তখন আরো সাংবাদিকেরা আসবে এইভাবে সবার কাছে জানাজানি হয়ে যাবে! আমি সেটা চাই না। আমি নিরিবিলি নিজের কাজ করতে চাই।”

“কিন্তু এত বড়ো একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার–”

রতন বলল, “আমি শুধু মজা করতে চাই। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের খেতা পুড়ি!”

মানিক হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “খেতা পুড়ি খুবই অমার্জিত কথা। শব্দটা কথা “

“যাই হোক। আমি কোনো পাবলিসিটি চাই না। পাখি নিয়ে গবেষণা শেষ হয়েছে এখন নূতন গবেষণা হবে।”

“কিন্তু দেশের মানুষ এটা সম্পর্কে জানবে না? যদি না জানে “

মানিক বিশাল একটা বক্তৃতা দেয়া শুরু করেছিল কিন্তু ঠিক তখন দরজায় শব্দ হলো। রতন দরজা খুলে দেখে মিঠু দাঁড়িয়ে আছে। আজকে তার সাথে একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে। মিঠুকে যদি মৃত্যু ডাকা হয় তাহলে তার সাথে যে দুজন আছে তাদেরকে বিভীষিকা না হয় আতংক ডাকা যেতে পারে। তবে তাদের নাম বিভীষিকা বা আতংক নয়। ছেলেটির নাম গুল্লু, মেয়েটি রিমি।

মিঠু বলল, “এই যে এরা বিশ্বাস করতে চায় না আপনি কাকদের ট্রেনিং দিচ্ছেন।”

রিমি নামের মেয়েটি বলল, “মিঠু দশটা কথা বললে তার মাঝে নয়টা মিথ্যা কথা থাকে।”

মিঠু বলল, “কোনোদিনও না। আমি কোনোদিন মিথ্যা কথা বলি না।”

রিমি রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দেখেন, কত বড়ো মিথ্যা কথা বলল।”

রতন বলল, “অন্য সময় মিঠু কী বলে আমি জানি না এইবারে সত্যি কথাই বলেছে। আমি আসলেই দুটি কাকের বাচ্চাকে ট্রেনিং দিচ্ছি।”

রতন কথা শেষ করার আগেই বাচ্চাগুলো টেবিলে রাখা কালাচান ধলাচানকে দেখতে পেল। কালাচান তখন একটা বোতল খুলছে, ধলাচান আরেকটা বোতল খুলে দুই হাতে ধরে ঢক্‌ করে কিছু-একটা খাচ্ছে। বাচ্চাগুলো বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে কাক দুটোর দিকে ছুটে গেল। মিঠু বলল, “হুশ!”

রিমি নামের মেয়েটি বলল, “মাইয়ারে মাইয়া!”

গুল্লু নামের দ্বিতীয় ছেলেটি বলল, “বুংগা বুংগা!”

রতন লক্ষ করল এই শব্দগুলো যে বাংলা ভাষায় নেই এবং শব্দগুলো যে অমার্জিত সেটা নিয়ে মানিক কোনো কথা বলল না বরং চোখ বড়ো বড়ো করে বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। মিঠু এবং তার পিছু পিছু ছেলে এবং মেয়েটি টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায়। মিঠু চিৎকার করে ডাকল, “কালাচান! ধলাচান!”

কালাচান আর ধলাচান তাদের হাতের ড্রিংকের বোতল দুটি নীচে নামিয়ে মিঠুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “কা। কা।”

মিঠু আনন্দে লাফ দিয়ে বলল, “আমার সাথে কথা বলেছে! কথা। বলেছে! হুশ! হুশ!!”

তখন গুল্লু এবং রিমিও এগিয়ে গিয়ে কাক দুটোকে ডাকল, “কালাচান! ধলাচান!”

কাক দুটো তাদের কোল্ড ড্রিংকের বোতল থেকে মুখে ঢক্‌ করে খানিকটা ড্রিংক ঢেলে গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, “কা কা।”

বাচ্চাগুলো কাক দুটোকে ঘিরে লাফালাফি চেঁচামেচি করতে থাকে। মিঠু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “হ্যান্ডশেক! হ্যাঁন্ডশেক!”

রতন অবাক হয়ে দেখল, কলাচান কিছুক্ষণ মিঠুর হাতটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল! মিঠু আনন্দে চিৎকার করে বলল, “হুশ!”

ছোটো বাচ্চাদের আনন্দ ভয়ংকর সংক্রামক একটা বিষয়। কালাচান ধলাচানকে ঘিরে তাদের আনন্দোল্লাস লাফ-ঝাঁপ দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে। রতন আর মানিকও অনেকটা ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল। তাদের সাথে হাসাহাসি করতে লাগল। কালাচান ধলাচানের প্রতিভার যে বিষয়গুলো রতন গবেষণা করেও বের করতে পারেনি কিছুক্ষণের মধ্যে বাচ্চাগুলো সেগুলোও আবিষ্কার করে ফেলল। যেমন হাত নেড়ে তারা যদি নাচানাচি করে তাহলে কালাচান ধলাচানও হুবহু তাদের অনুকরণ করে হাত পা নেড়ে নাচানাচি করে। সবচেয়ে মজা হলো যখন মিঠু আনন্দে চিৎকার করে বলল, “হুশ!” আর কালাচানও অবিকল মিঠুর গলার স্বরে বলল, “হুশ!” কাক যে মানুষের গলার অনুকরণ করে শব্দ করতে পারে সেটা তারা কেউ। জানত না।

মেয়েটি কিছুক্ষণ নাচানাচি করে হঠাৎ ঘুরে রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “সাইন্টিস্ট চাচ্চু, কালাচান ধলাচানকে আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতে পারি? অন্যদের দেখাব!”

রতন একটু থতমত খেয়ে বলল, “তোমাদের স্কুলে নেবে?”

মিঠু মেয়েটিকে থামিয়ে বলল, “ধুর বেকুব! কালাচান আর ধলাচান অনেক স্পেশাল। সারা পৃথিবীতে একটাও নাই! এটা কি খেলনা নাকি যে আমাদের স্কুলে নেব! “

অন্য ছেলেটিও মাথা নাড়ল, বলল, “এইটা কোটি টাকার থেকে বেশি মূল্যবান। তাই না সাইন্টিস্ট চাচ্চু?”

রতনকে এর আগে কেউ সাইন্টিস্ট চাচ্চু ডাকেনি। সে তার নূতন পরিচয়ে বেশ মজা পেল বলে মনে হলো। হাসতে হাসতে মেয়েটিকে বলল, “তোমরা কালাচান ধলাচানকে তোমাদের স্কুলে নিতে চাও?”

মেয়েটি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। নিতে চাই।”

 “তোমাদের স্কুলের স্যার ম্যাডামরা আপত্তি করবে না? ক্লাশে মানুষের বাচ্চা যাবার কথা, কাকের বাচ্চা গেলে কেমন দেখাবে?”

মিঠু হি হি করে হেসে বলল, “কালাচান ধলাচানের বুদ্ধি আমাদের ক্লাশের অনেক ছেলেমেয়ে থেকে বেশি!”

মেয়েটি বলল, “অনেক স্যার ম্যাডাম থেকে বেশি।“

রতন বলল, “সেটা ঠিক আছে, কিন্তু স্কুলে কাকের বাচ্চা নেবে কীভাবে? রাখবে কোথায়?”

মিঠু তো তার ছেলেমানুষি মুখ বড়ো মানুষের মতো গম্ভীর করে বলল, “সাইন্টিস্ট চাচ্চু, আপনি সেটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমাদের স্কুলে সায়েন্স ফেয়ার হচ্ছে। সায়েন্স ফেয়ারে সবকিছু নেয়া যায়। এর আগেরবার ক্লাশ নাইনের রত্নাপু একটা গরু নিয়ে এসেছিল।”

“গরু?” রতন অবাক হয়ে জানতে চাইল, “গরু কেন?”

“গরুর হজম প্রক্রিয়া দেখানোর জন্যে।”

রিমি মনে করিয়ে দিল, “সায়েন্স ফেয়ার শেষ হবার পর কতদিন ক্লাশে গোবরের গন্ধ ছিল মনে আছে?”

মিঠু বলল, “সায়েন্স ফেয়ারের সময় কাক গরু ছাগল সবকিছু নিতে দিবে।” তারপর খুব আশা নিয়ে বলল, “দেবেন নিতে?”

রতন বলল, “এক শর্তে দিতে পারি?”

তিনজন একসাথে জিজ্ঞেস করল, “কোন শর্তে?”

“তোমাদের স্কুলের ছেলেমেয়ে ছাড়া আর কেউ কালাচান ধলাচানের কথা জানতে পারবে না।”

তিনজন একসাথে চিৎকার করে বলল, “জানবে না। খোদার কসম।”

রতন বলল, “খোদার কসম দিতে হবে না, তোমরা কথা দিলেই যথেষ্ট।”

মিঠু হুংকার দিয়ে বলল, “কথা দিলাম।”

“আরো একটা কথা।”

“কী কথা?”

“কোনো সাংবাদিক টেলিভিশন চ্যানেল পত্রিকার ফটোগ্রাফার কেউ যেন এটার কথা জানতে না পারে।”

“জানবে না।” রিমি এবারে হুংকার দিয়ে বলল, “কোনো সাংবাদিকদের আমরা স্কুলেই ঢুকতে দেব না। ঢোকার চেষ্টা করলে ঠ্যাং ভেঙে দেব।”

মানিক একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “ঠ্যাং শব্দটা অসুন্দর। আর সাংবাদিকতা খুবই মহান পেশা। তাই সাংবাদিকদের সম্পর্কে। অসম্মানজনক কথা বলা ঠিক নয়।”

রিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “আপনি সাংবাদিক?”

“না, আমি ঠিক সাংবাদিক না, তবে আমি সংবাদপত্রে মাঝেমধ্যে লেখালেখি করি।”

“আপনি লেখক?”

মানিক মুখে একটা আলগা গাম্ভীর্য নিয়ে এসে বলল, “আসলে আমি কবি।”

“কবি?” তিনজন একসাথে বিস্ময় প্রকাশ করল। মিঠু বলল, “আসলে আমি কখনো সত্যিকারের কবি দেখি নাই।”

তারপর মানুষ যেরকম করে একটা বিচিত্র প্রাণী দেখে সেভাবে ঘুরে ঘুরে তাকে দেখল। একজন তার আঙুলগুলো টিপে দেখল। দেখা শেষ হবার পর মিঠু বলল, “হুশ!”

রতন বলল, “তাহলে কথা দিচ্ছ তোমরা কোনো সাংবাদিককে কালাচান ধলাচানকে দেখতে দেবে না?”

তিনজন একসাথে বলল, “কথা দিচ্ছি।”

তারা স্পষ্ট শুনল কালাচান আর ধলাচানও বলল, “কথা দিচ্ছি।”

রতন বলল, “ঠিক আছে। তোমরা তোমাদের স্কুলের ঠিকানা দাও। যেদিন সায়েন্স ফেয়ার সেদিন আমি কালাচান ধলাচানকে তোমাদের স্কুলে দিয়ে আসব। দুইদিন পর আবার নিয়ে আসব।”

তিনটি বাচ্চা এত জোরে তাদের মাথা নাড়ল যে মনে হলো মাথা বুঝি তাদের ঘাড় থেকে খুলে আসবে!

বাচ্চাগুলো চলে যাবার পর মানিক বলল, “কাজটা কি ঠিক হলো? এত ছোটো বাচ্চাদের হাতে এত মূল্যবান দুটো কাকের বাচ্চাকে তুলে দিচ্ছ?”

রতন বলল, “এই কাকের বাচ্চা দেখে স্কুলের ছেলেমেয়েরা যদি একটু আনন্দ পায় সমস্যা কী?”

মানিক ফোঁস করে খুব লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কী জন্যে কে জানে!

.

নির্দিষ্ট দিনে রতন কালাচান আর ধলাচানকে একটা কালো কাপড়ে ঢাকা বড়ো খাঁচার ভিতরে ভরে মিঠুদের স্কুলে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দিল। মিঠু তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে স্কুলের গেটে অপেক্ষা করছিল, তারা মহা উৎসাহ নিয়ে খাঁচাটাকে ভিতরে নিয়ে গেল। রতন সাথে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, “এর ভেতরে কালাচান ধলাচানের খাবার আছে। প্রত্যেক ঘণ্টায় একবার করে দুজনকে দুটো প্যাকেট খাবার আর দুটো ড্রিংকের বোতল দিও।”

মিই বলল, “দেব। মরা ইন্দুর দিতে হবে কি না বলেন। মেরে নিয়ে আসব।”

রতন বলল, “না, মরা ইঁদুর লাগবে না। শুধু লক্ষ রেখো সবসময়েই কালাচান ধলাচানের যেন কিছু-একটা করার থাকে। ভিতরে কাগজ কলম আছে। ইলেকট্রনিক গিটার আছে, নানারকম খেলনা আছে, সেগুলো যেন থাকে।”

“থাকবে। ক্রিকেট ব্যাট ফুটবল দিতে হলে–”

“দিতে হবে না। আর যদি কোনো ইমার্জেন্সি হয় আমাকে ফোন করো।”

“করব। আপনার নম্বর আমার মুখস্থ।”

“গুড।” রতন এক মুহূর্ত থেমে বলল, “আর মনে আছে তো? নো সাংবাদিক।”

“মনে আছে। কোনো সাংবাদিক টিভি ক্যামেরা ধারে কাছে আসতে পারবে না। কাছে আসলেই—“

মিঠু হাত দিয়ে গলায় পোচ দেবার ভঙ্গি করল।

.

কালাচান ধলাচানকে দেখার জন্যে সারা স্কুল ভেঙে পড়ল। যারা নিজেরা নানারকম বিজ্ঞানের প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে তার পর্যন্ত তাদের প্রজেক্ট ফেলে রেখে কালাচান ধলাচানকে দেখতে এল। মিঠু দরজার মাঝে তার ভলান্টিয়ার দাঁড় করিয়ে রাখল, ঘরে ঢোকার আগে সবাইকে বুকে হাত দিয়ে বলতে হলো, “আমি খোদার নামে কসম খেয়ে বলছি, এই রুমে। যেটি দেখব সেটি কাউকে বলব না। যদি বলি তাহলে জাহান্নামের আগুনে যেন আমি জ্বলে পুড়ে মরি।”

ভেতরে বড়ো খাঁচা, খাঁচার সামনে কাঁচ এবং তার ভেতর দিয়ে কালাচান ধলাচানকে দেখা যাচ্ছে। তারা সবসময়েই কিছু না কিছু করছে। খাবার সময় তাদের রবোটিক হাত দিয়ে প্যাকেট খুলে কিছু না কিছু খাচ্ছে। সফট ড্রিংকের বোতলের ছিপি খুলে ঢক করে ড্রিংকস মুখে ঢেলে দিচ্ছে। কাগজ বিছিয়ে তার ওপর রঙিন কলম দিয়ে ছবি আঁকছে। একটা গিটার আছে সেটা বাজাচ্ছে। কখনো কখনো দুজনে আবার ধাক্কাধাক্কি করছে, মনে হয় এটা তাদের এক ধরনের খেলা।

স্কুলের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে কালাচান ধলাচানকে দেখছে। এত ছেলেমেয়ে দেখে প্রথম প্রথম কালাচান ধলাচান একটু ভড়কে গিয়েছিল কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি তারা ব্যাপারটা মেনে নিল। শুধু যে মেনে নিল তাই না ছেলেমেয়েরা কিছু-একটা বললে সেটা তারা অবিকলভাবে বলারও চেষ্টা করতে লাগল।

ছেলেমেয়েদের এই প্রচণ্ড ভিড় দেখে মিঠু মহাখুশি, অহংকারে তার মাটিতে পা পড়ে না এরকম অবস্থা। যেই আসছে তাকেই সে বলছে, “বুঝলি, এই যে দুইটা ফাটাফাটি কাক দেখছিস সেগুলি কে দিয়েছে জানিস? আমি (এই সময় সে তার বুকে একটা থাবা দেয়!)। কাক দুইটার হাত কে লাগিয়েছে জানিস? (সবাই উৎসুক হয়ে শোনার জন্যে তাকায় তখন সে ঘাড় বাঁকা করে বলে) পৃথিবীর কেউ সেটা জানে না। টপ সিক্রেট প্রজেক্ট।”

বাচ্চারা গভীরভাবে মাথা নাড়ে, তাদের নানারকম প্রশ্ন থাকে এবং মিঠু বানিয়ে বানিয়ে তার উত্তর দিতে থাকে। কাকের হাত লাগানোর পর এই টপ সিক্রেট সায়েন্টিস্ট মানুষের পাখা লাগানোর একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করবে এই ধরনের একটা খবর সে ঘোষণা করে দিল। পানির নীচে নিশ্বাস নিতে পারে এই রকম একটা মেয়ে তৈরি করা হয়ে গেছে এই খবরটাও সে ছড়িয়ে দিল। কপালের উপর তিন নম্বর একটা চোখ লাগানোরও একটা গোপন প্রজেক্ট আছে সেটা সে খুবই গোপনে শুধু অল্প কয়েকজনকে বলল।

স্কুলের ছেলেমেয়েরা টপ সিক্রেট প্রজেক্টের কথা শুনে বিদায় নিলেও স্যার ম্যাডামরা তাকে এত সহজে ছাড়লেন না। কালাচান ধলাচান কোথা থেকে এসেছে কে তৈরি করেছে তাদের এরকম অসংখ্য প্রশ্ন। মিঠু অবশ্যি মুখ শক্ত করে জানাল, “এটা বলার পারমিশন নাই।” স্যার ম্যাডামরা তাকে ধমকাধমকি করলেন কিন্তু মিঠু মুখ খুলল না।

বিকেলবেলা যখন সায়েন্স ফেয়ার শেষ হয়েছে তখন কালাচান। ধলাচানের খাঁচাটা কালো কাপড়টা দিয়ে ঢেকে দিল। স্কুলের দপ্তরিটা যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের ঘরটাতে তালা না মারল মিঠু সামনে থেকে নড়ল না। দপ্তরি চলে যাবার পর মিঠু ঘরের দরজার মাঝে আরো একটা তালা লাগিয়ে দিল, বুদ্ধি করে বাসা থেকে সে আরেকটা তালা নিয়ে এসেছে। সায়েন্টিস্ট চাক্ষুকে সে কথা দিয়েছে কালাচান ধলাচানকে সে দেখেশুনে রাখবে।

মিঠু আর তার দলের ছেলেমেয়েরা ভেবেছিল পরের দিন বুঝি ভিড় কম হবে, কিন্তু দেখা গেল ছেলেমেয়েদের উৎসাহের কোনো কমতি নেই। পরের দিন ভিড় আরো বেশি। দরজায় পাহারা বসানো হয়েছে যেন কোনো সাংবাদিক চলে আসতে না পারে। সায়েন্টিস্ট চাচ্চুকে কথা দিয়েছে কোনোভাবেই কোনো সাংবাদিক যেন খবর না পায় তাই তারা খুবই সতর্ক। যদিও তারা মোটেও বুঝতে পারছে না কেন সাংবাদিকদের এটা দেখানো যাবে না। তারা বরং এতদিন উলটোটাই জেনে এসেছে যা কিছু সম্ভব সাংবাদিকদের জানাতে হবে।

গেটে যখন ভলান্টিয়ারদের ধাক্কাধাক্কি করে ছেলেমেয়েরা কালাচান ধলাচানকে দেখতে আসছে তখন মিঠু সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাশে রিমি দাঁড়িয়েছিল, তাকে বলল, “বুঝলি রিমি, একটা ভুল হয়ে গেছে।”

“কী ভুল?”

“দুই টাকা করে টিকেট ধরা উচিত ছিল। তাহলে একদিনে বড়োলোক হয়ে যেতাম।”

“পাঁচ টাকা করে টিকেট ধরে রাস্তার পাবলিককে ডেকে আন, আরো তাড়াতাড়ি আরো বড়োলোক হয়ে যাবি।”

“সাংবাদিকদের ডেকে আনলে তো আরো বেশি টাকা বানাতে পারতাম।”

ঠিক এইরকম সময় গেটের ভলান্টিয়ারদের ধাক্কা দিয়ে গুল্লু ভিতরে ছুটে এল, হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ হয়েছে।”

মিঠু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “সাংবাদিক?”

“হ্যাঁ। এই এত বড়ো বড়ো ক্যামেরা!”

“তুই নিজে দেখেছিস?”

“হ্যাঁ।” গুল্লু বলল, “হেডস্যারের রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ শুনলাম ভিতরে টেলিভিশন চ্যানেলের কথা বলছে। তখন দাঁড়িয়ে ভিতরের কথা শোনার চেষ্ট করেছি।”

“কী শুনেছিস?”

একজন হেডস্যারকে জিজ্ঞেস করছে, “আপনার স্কুলে নাকি দুইটা কাক আছে যার দুইটা করে হাত, সেই হাত দিয়ে নাকি সবকিছু করতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, ড্রিংক খেতে পারে?”

“সর্বনাশ! কেমন করে খবর পেল?”

“কোনো ছেলে না হলে মেয়ে বাসায় গিয়ে বলে দিয়েছে।”

মিঠু দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “খুন করে ফেলব আমি।”

রিমি বলল, “খুন করার অনেক সময় পাবি, আগে সাংবাদিকদের কীভাবে ঠেকাবি সেটা ঠিক কর।”

গুরু বলল, “মারপিট না করে ঠেকানো যাবে না। হেডস্যার টেলিভিশনের ক্যামেরা দেখে মহাখুশি। এক্ষুনি নিয়ে আসবে।”

মিতু নাক দিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “হুশ!”

গুল্লু বলল, “কী করব বল। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ল্যাং দিয়ে ফেলে। দেব? হেডস্যার সাথে থাকলে সমস্যা।”

মিঠু কয়েক সেকেন্ড কিছু-একটা চিন্তা করল, তারপর গুল্লুকে বলল, “তুই যা, সাংবাদিকদের কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখ।”

“কীভাবে ঠেকিয়ে রাখব, ভয় দেখিয়ে? চাকু আছে কারো কাছে?”

রিমি বলল, “না না চাকু ফাকু দিয়ে হবে না। তুই সাংবাদিকদের ভুল জায়গায় নিয়ে যা ভুলিয়ে ভালিয়ে দেরি করিয়ে দে।”

“তোরা কী করবি?”

“এই সময়ের মাঝে কালাচান ধলাচানকে সরিয়ে ফেলব।”

“পারবি?”

“পারতে হবে।”

মিঠু গলা উঁচিয়ে ভলান্টিয়ারদের বলল, “তোরা এখন কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিবি না।”

দরজায় দাঁড়ানো ছেলেমেয়েরা আপত্তি করল, “কেন ঢুকতে পারব?”

মিঠু বলল, “কালাচান ধলাচানকে ভিটামিন খাওয়াতে হবে। দিনে একবার ভিটামিন ওয়াই এক্স খাওয়াতে হয়।”

রিমি নীচু গলায় বলল, “ভিটামিন ওয়াই এক্স নাই গাধা।”

মিঠু ফিস ফিস করে বলল, “না থাকলে তোর সমস্যা কী?”

ছেলেমেয়েদের মিঠুর কথা শোনার কোনো আগ্রহ ছিল না, কিন্তু ভলান্টিয়াররা তাদের ঠেলে বের করে দিল। ঘরটা খালি হওয়ার সাথে। সাথে মিঠু বলল, “রিমি, তোর ব্যাকপ্যাকটা কই?”

রিমি টেবিলের তলা থেকে তার ব্যাকপ্যাকটা বের করে দেয়, “এই যে।”

“খালি কর।”

“খালি করব?” রিমি আপত্তি করল, “আমার সব দরকারি জিনিস খাতাপত্র–”

“তোর দরকারি জিনিস খাতাপত্রের খেতাপুড়ি। হুশ! খালি করে সবকিছু টেবিলের নীচে রাখ।”

রিমি তার ব্যাকপ্যাক খালি করে খাতাপত্র টেবিলের নীচে রাখল। মিঠু। তখন সাবধানে খাঁচার ভেতর থেকে কালাচান ধলাচানকে বের করে ব্যাকপ্যাকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল। কাক দুটো একটু আপত্তি করল, একটু ডানা ঝাঁপটালো কিন্তু মিঠু সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাল না। ব্যাকপ্যাকের জিপ টেনে বন্ধ করার পর কালাচান ধলাচান একটু শান্ত হয়ে যায়।

রিমি বলল, “খাঁচা খালি দেখেই বুঝে যাবে।

মিঠু দুই এক সেকেন্ড কিছু-একটা চিন্তা করে কালো কাপড়টা দিয়ে যাচাটা ঢেকে দিয়ে বলল, “বলতে হবে এখন কালাচান ধলাচান রেস্ট নিচ্ছে।”

রিমি বলল, “কিন্তু ক্যামেরার লোকজন তোর কথা শুনবে না। টান দিয়ে এই কাপড় খুলে ফেলবে…”

মিঠু বলল, “হুশ! ভিতরে কিছু-একটা রাখতে হবে। ক্যামেরার লোকজনের যেন বুঝতে সময় লাগে।”

“কী রাখবি?”

মিঠু মাথা চুলকাচ্ছিল, তখন রিমি বলল, “দুই তালায় ক্লাশ নাইনের ইনকিউবেটর প্রজেক্ট আছে। সেইখানে দুইটা মুরগি আছে।”

“মুরগি?”

“হ্যাঁ।”

“কালো?”

“কালো কি না মনে নাই। যে রঙেরই হোক, সমস্যা কী?”

“কোনো সমস্যা নাই। তুই আনতে পারবি?”

“দেখি চেষ্টা করে।” বলে রিমি বের হয়ে গেল।

মিঠু খালি ঘরটার মাঝে একটু অস্থির হয়ে হাঁটে, গুল্লু সাংবাদিকদের বুদ্ধি করে আটকে রাখতে পেরেছে কি না কে জানে!

.

গুল্লু ঠিকই সাংবাদিকদের আটকে রেখেছিল, সিঁড়ির গোড়ায় সে সাংবাদিকদের ধরল, চোখে-মুখে একটা আনন্দের ভাব করে বলল, “আপনারা এসেছেন? কতক্ষণ থেকে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছি। আসেন আমার সাথে–“

সাংবাদিকেরা একটু থতমত খেয়ে গেল, গুল্লু তখন তাদের হাত ধরে টেনে নিতে থাকে। একটা ঘরের ভিতরে ঢুকে ছেলেমেয়েদের বলল, “এই যে দেখ! টেলিভিশনের লোকজন চলে এসেছে আমাদের প্রজেক্ট দেখতে।”

টেলিভিশন ক্যামেরার সাথে আরেকজন মানুষ, হাতে মাইক্রোফোন, সে ইতস্তত করে বলল, “আমরা এসেছি কাক–”

গুরু বলল, “কী বলছেন, কাক! এই প্রজেক্ট দেখেন এইখানে শুধু কাক, চিল শকুন সব আছে!” গুল্লু এক নজর প্রজেক্টটা দেখে নেয়, পরিবেশবান্ধব নগরের পরিকল্পনা–তারপর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভিডিও শুরু করেন। আমি বলি এইটা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব নগর। মানুষের যেরকম বন্ধু-বান্ধব থাকে, শহরেরও বন্ধু-বান্ধব থাকে পরিবেশেরও বন্ধু-বান্ধব থাকে। পরিবেশের বন্ধু-বান্ধব কারা? আমরা! তার কারণ আমরা কোনোরকম কালো ধোঁয়া ছাড়া ইলেকট্রিসিটি বানাতে পারি। সামনে একটা টারবাইন থাকবে আর আমরা একসাথে হাঁচি দেব। হাঁচির বাতাসে টারবাইন ঘুরবে ইলেকট্রিসিটি তৈরি হবে–”

ক্যামেরা হাতে মানুষটা গুল্লুর কথা শুনে হকচকিয়ে গেল। মাইক্রোফোন হাতে মানুষটা বলল, “আমরা এই প্রজেক্ট ভিডিও করতে আসি নাই। দুইটা নাকি কাক আছে যারা হাত দিয়ে ছবি আঁকতে পারে?”

গুল্লু থামিয়ে দিয়ে বলল, “কেন? আমাদের প্রজেক্ট পছন্দ হয় না? আমরা কি রাস্তা থেকে এসেছি? আমাদের প্রজেক্ট কি ফালতু প্রজেক্ট?”

“না, না, ফালতু কেন হবে?”

“তাহলে কেন ভিডিও করছেন না?” গুল্লু তখন ছাত্রছাত্রীদেরকে বলল, “তোরা দরজাটা বন্ধ করে দে। আমাদের সব কয়টা প্রজেক্ট ভিডিও না করে কেমন করে যায় আজকে দেখে নেব।”

সাংবাদিকদের মুখ একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেল, এবং চারিদিক এক নজর দেখে তারা দ্রুত ভিডিও করতে শুরু করল।

এদিকে রিমি ক্লাশ নাইনের ইনকিউরেটর প্রজেক্ট থেকে দুটি মুরগির বাচ্চা নিয়ে এসেছে, একটা কালো আরেকটা লালচে। মিঠু দুটো স্ট্র নিয়ে এসেছে, মাঝখানে কেটে চার টুকরো করে সেগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে মুরগির ডানার সাথে লাগিয়ে দিল। তারপর ড্রয়িং বোর্ডে ছোটো ছোটো হাত এঁকে সেটা স্ট্রয়ের মাথায় স্বচ্ছ টেপ দিয়ে লাগিয়ে নিল। বিষয়টা খুবই হাস্যকর কিন্তু সাংবাদিকদের কিছুক্ষণ নিশ্চয়ই বিভ্রান্ত করে রাখা যাবে।

মুরগি দুটো তাদের এই বিচিত্র হাত দুটো মোটেও পছন্দ করল না এবং খুবই বিরক্ত হয়ে ঠোঁট দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুলে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে। মিঠু আর রিমি মিলে কালো কাপড় দিয়ে আবার ভালো করে খাঁচাটা ঢেকে রাখল।

মিঠু তখন রিমির ব্যাকপ্যাকটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, “নে, তুই এটা নিয়ে বের হয়ে যা। সাইন্টিস্ট চাক্ষুর বাসার দিকে হাঁটতে থাক। আস্তে আস্তে হাঁটিস।”

রিমি জিজ্ঞেস করল, “তোরা আসবি না আমার সাথে?”

“আসব। সাংবাদিকেরা যখন কালাচান ধলাচানের ভিডিও করতে গিয়ে মুরগির ভিডিও করে ফেলবে তখন তাদের মুখের অবস্থাটা কী হয়। দেখতে চাই।”

“আমিও দেখতে চাই।”

মিঠু মাথা নাড়ল, “না, না, তোর দেখতে হবে না। তা হলে দেরি হয়ে যাবে–যদি বুঝে যায় তোর ব্যাকপ্যাকে কালাচান ধলাচান তাহলে মুশকিল হবে।”

রিমি তখন এত বড়ো মজার দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখবে না বলে একটু হতাশ হয়ে তার ব্যাকপ্যাকটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

ঠিক তখন দরজা খুলে সাংবাদিকেরা ভিতরে ঢুকে পড়ল–তাদের সাথে গুলও আছে। গুল্লু বলল, “মিঠু, এই যে এদের কথা বলছিলাম, কালাচান ধলাচানের ভিডিও করতে এসেছে।”

রিমি তাদের পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সাংবাদিকেরা চোখ সরু করে রিমিকে সন্দেহের চোখে একবার দেখল কিন্তু কিছু বলল না। মিঠু গুল্লুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভিডিও করার পারমিশন কে দিয়েছে? তুই?”

গুল্লু বলল, “আমি দেই নাই। এরা জোর করে চলে এসেছে।”

মিঠু বলল, “তুই জানিস না, আমরা সাইন্টিস্ট চাচ্চুকে কথা দিয়েছি কোনো সাংবাদিককে এটা দেখতে দেব না?”

গুন্তু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, “আমি বলেছি। আমি অন্য সব প্রজেক্টে নিয়ে গেছি কোনোটার ভিডিও করতে চায় না। শুধু এইটা ভিডিও করবে।”

মিঠু এই প্রথমবার সাংবাদিকদের দিকে তাকালো, বলল, “হুশ!”

দুইজন সাংবাদিক, মাইক্রোফোন হাতে মানুষটা ফর্সা, ক্যামেরা ঘাড়ে মানুষটা কালো। ফর্সা মানুষটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “কী বললে?”

মিঠু বলল, “কিছু বলি নাই। বলতে চাচ্ছি যে কালাচান ধলাচানকে ভিডিও করা যাবে না। আমরা করতে দিব না, আমাদের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দেখার জন্যে সাইন্টিস্ট চাচ্চু আমাদেরকে দিয়েছেন। বলে। দিয়েছেন কোনোভাবে যেন সাংবাদিকেরা না দেখে।”

ফসা মানুষটা বলল, “শোনো ছেলে, এই স্কুল থেকে আমাদের কাছে। চিঠি গেছে, এইখানে সায়েন্স ফেয়ার হবে সেটা কাভার করার জন্য। আমরা কাভার করতে এসেছি, আমাদের ভিডিও করতে করতে দেবে না মানে? ফাজলেমি পেয়েছ?”

“আমাদের স্কুল থেকে প্রত্যেক বছর চিঠি পাঠানো হয়, কোনো বছর কোনো সাংবাদিক আসে না, এই বছর চলে এসেছেন, ব্যাপারটা কী?”

মাইক্রোফোন হাতে ফসা মানুষটা খুবই বিরক্ত হলো, তার মুখটা কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেল। মুখ খিঁচিয়ে বলল, “সেই কৈফিয়ত আমার তোমাকে দিতে হবে? পুঁচকে ছোঁড়া তোমার সাহস বেশি হয়েছে?”

মিঠু শীতল চোখে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমার এই একটাই সমস্যা সাহস বেশি।”

ফসা মানুষটা ক্যামেরা হাতে কালো মানুষটাকে বলল, “ক্যামেরাটা রাখ, রেখে দরজা বন্ধ কর।”

ক্যামেরা হাতে মানুষটা বলল, “ওকে বস।” তারপর ক্যামেরাটা টেবিলে রেখে দরজাটা বন্ধ করল।

মাইক্রোফোন হাতে ফর্সা মানুষটা তার মাইক্রোফোনটা ক্যামেরার পাশে রেখে শার্টটা উপরে তুলল, মিঠু আর গুল্প চমকে উঠে দেখল, প্যান্টে একটা রিভলভার খুঁজে রাখা আছে। ফর্সা মানুষটা হিসহিস করে বলল, “এখন বুঝছিস আমরা কারা? আমরা তোর কাউয়ার ছবি তুলতে আসি নাই তোর কাউয়ারে নিয়া যাইতে আইছি।”

ফর্সা মানুষটা যতক্ষণ সাংবাদিক হওয়ার ভান করেছে ততক্ষণ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেছে, এখন খারাপ ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে। তাদের তুই তুই করে বলছে। মিঠু চুপচাপ থাকার চেষ্টা করল কিন্তু তার মুখ থেকে বের হয়ে এল, “হুশ!”

“কী বললি?”

মিঠু মাথা নাড়ল, “কিছু বলি নাই। হুশ!”

কালো মানুষটা বলল, “বাদ দেন বস। আমাগো কাম আমরা করি।”

ফসা মানুষটা বলল, “কালা কাপড়টা তুল, কোটি টাকার কাউয়ারে দেখি।”

গুল্লু চমকে উঠে বলল, “কোটি টাকা?”

“হ। তোগে কাউয়ার খবর সারা দুনিয়াতে জানাজানি হইছে। বিদেশিগো সাথে আমাগো কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট।”

গুল্লু বলল, “কেমন করে জানাজানি হলো?”

“এই খবর চাপা থাকে না।”

কালো মানুষটা খাঁচার কাছে গিয়ে কালো কাপড়টা তুলে একটু উঁকি দিয়ে সন্তুষ্টির মতো শব্দ করল। ফর্সা মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “আছে?”

“আছে বস। দুইটা। একটা কালা আরেকটা লাল।”

“লাল?” ফর্সা মানুষটা অবাক হয়ে বলল, “কাউয়া লাল হয় কেমন করে?”

“তাইতো।” কালো মানুষটা এবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে টান দিয়ে কালো কাপড়টা সরিয়ে দিতেই মুরগি দুটো কককক শব্দ করে দাঁড়িয়ে গেল। মাথা নাড়িয়ে সবাইকে দেখল।

ফর্সা মানুষটার মুখটা হঠাৎ কেমন যেন বিকৃত হয়ে যায়, দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “কাউয়া দুইটা কই?”

মিঠু অবাক হয়ে বলল, “কাক? কাক নেই, আমাদের কাছে এই দুটোই আছে। কালোটার নাম কালাচান আর লালটার নাম ধলাচান। আমরা এই দুটোই দেখাচ্ছি।”

কালো মানুষটা বলল, “বস। ঠিকই আছে। দেখছেন না হাত আছে। মনে হয় মুরগিরে ভুল করে কাউয়া বলেছে।”

ফর্সা মানুষটা চিৎকার করে বলল, “ঠিক নাই। আমি ছবি দেখেছি। মুরগি ছিল না, কাক ছিল। আর দেখছিস না প্লাস্টিকের স্ট্র দিয়ে হাত বানাইছে? রাবার ব্যান্ড দিয়ে মুরগির ডানার সাথে লাগাইছে?”

কালো মানুষটা বলল, “তাইতো!”

তারপর দুজনেই মিঠু আর গুল্লুর দিকে তাকাল। ফর্সা মানুষটা তার কোমরে গোজা রিভলভারটা টান দিয়ে বের করে মিঠুর মাথায় ধরল, বলল, “কাউয়া দুইটা কই?”

মিঠু বলল, “হুশ!”

“খুন করে ফেলব আমি।”

মিঠু বলল, “এত সোজা না। এই স্কুলে এক হাজার ছেলে মেয়ে থাকে। আমারে খুন করে বের হবার চেষ্টা করলে সবাই ছাতু করে ফেলবে। হুশ!”

কথাটায় যুক্তি আছে। ফর্সা মানুষটা বলল, “ঠিক আছে তাহলে।” তারপর রিভলভারটা প্যান্টে গুঁজে মিঠুর হাত ধরে ঘুরিয়ে এমনভাবে মোচড় দিল যে যন্ত্রণায় তার চোখে পানি এসে গেল। ফর্সা মানুষটা বলল, “বল, কাউয়া দুইটা কই? বল!”

মিঠু যন্ত্রণায় ছটফট করে বলল, “হুশ!”

“বল। বল এক্ষুনি।”

“হুশ! হুশ!”

“বল বলছি। নাহলে হাত খুলে আসবে।”

কথাটা সত্যি তাই মিতু বলল, “ঠিক আছে বলছি। আগে হাতটা ছাড়।”

ফর্সা মানুষটা হাতটা ছেড়ে বলল, “বল কাউয়া দুইটা কই?”

“সাইন্টিস্ট চাক্ষুর কাছে ফেরত পাঠিয়েছি।”

“কেমন করে ফেরত পাঠালি? কখন ফেরত পাঠালি?”

“রিমির ব্যাকপ্যাকে করে, তোমাদের সামনে বের হয়ে গেল মনে নাই!”

“ঐ মেয়েটা? তখনই মনে হলো মেয়েটার কোনো বদ মতলব আছে।”

মিঠু বিড়বিড় করে বলল, “মেয়েটার কোনো বদ মতলব নাই। বদ মতলব তোমাদের।”

“কী বললি?”

“কিছু বলি নাই। হুশ!”

কালো মানুষটা বলল, “ঐ ছেমড়ি বেশি দূর যাবার পারে নাই। কোনদিকে গেছে?”

ফর্সা মানুষটা বলল, “আমাদের নিয়া চল। এক্ষুনি।”

মিঠু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমাকে আগে সাইন্টিস্ট চাক্ষুর সাথে কথা বলতে হবে।”

“তোর মাথা খারাপ হইছে।”

মিঠু বলল, “হয় নাই। কথা বলতে হবে।”

ফর্সা মানুষটা বলল, “ঠিক আছে। কথা বল।” সে তার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে মিঠুর হাতে দিল। তারপর আবার রিভলভারটা বের করে তার মাথায় ধরল।

মিঠু রতনকে ফোন করল, দুবার রিং হতেই রতন ফোন ধরল, “হ্যালো।”

“আমি মিঠু।”

“কোনো সমস্যা?”

“জি, অনেক বড়ো সমস্যা।

“কোনো মানুষ কালাচান আর ধূলাচানের জন্যে তোমাদের ভয় ভীতি দেখাচ্ছে? তোমাদের কোনো ধরনের বিপদ? ডেঞ্জার?”

রতন কেমন করে বুঝে গেল মিঠু বুঝতে পারল না। সে বলল, “জি সাইন্টিস্ট চাচ্চু।”

“তাকে কিংবা তাদেরকে দিয়ে দাও। এক্ষুনি দিয়ে দাও। তোমাদের যেন কোনো বিপদ না হয়।”

“আপনার এত মূল্যবান কালাচান ধলাচান।”

“আমার যেটা জানার ছিল জেনে গেছি এর মূল্য আমি পেয়ে গেছি। তুমি যদি কাকের বাচ্চা এনে দাও তাহলে দরকার হলে আমি আবার কালাচান ধলাচান বানাতে পারব। বুঝেছ? আমি চাই না কালাচান ধলাচানের জন্যে তোমাদের কোনো ঝামেলা হয়। এক্ষুনি দিয়ে দাও, দিয়ে আমাকে ফোন কর।”

“দিতে একটু সময় লাগছে। দিয়ে আপনাকে ফোন করব।”

“ঠিক আছে।”

মিঠু টেলিফোনটা ফর্সা মানুষটার কাছে ফেরত দিয়ে বলল, “হুশ।”

“কী বললি?”

“বলেছি, চল আমার সাথে, গুল্লু, তুইও আয়।”

ফর্সা মানুষটা তার টেলিফোনটা হাতে নিয়ে কোনো একটা নম্বর ডায়াল করল, তারপর বলল, “জগু, কী বলি মন দিয়া শোন। আমরা এখন এই আন্ডাবাচ্চার স্কুল থেকে বের হইতাছি। ডেরাইভারকে বল রেডি থাকতে, আর তুই গাড়ি থেকে নাম, একটা মেয়ে পিঠে একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে বের হয়েছে একটু আগে

“জে দেখেছি। লাল ব্যাগ।”

“হ্যাঁ, এই মেয়েটারে রাস্তায় খুঁজে বের কর। মেয়েটারে কিছু বলবি। খালি চোখে চোখে রাখবি।”

“ঠিক আছে।”

ফর্সা মানুষটা টেলিফোনটা রেখে বলল, “চল, যাই। কোনো রকম ঝামেলা করবি না তাহলে কিন্তু ঐ মেয়ে খরচা হয়ে যাবে।”

মিঠু বলল, “হুশ।”

কালো মানুষটা আবার ক্যামেরা ঘাড়ে তুলে নিল, তারপর দরজা খুলে বের হয়ে এল। দরজা খুলতেই বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে ছুটে এল, একজন জিজ্ঞেস করল, “ভিডিও হয়েছে?”

ফর্সা মানুষটা বলল, “একটা পার্ট শেষ হয়েছে, এখন অন্য পার্টটা ভিডিও করার জন্যে যাচ্ছি।” তারপর মিঠুর দিকে তাকিয়ে মধুরভাবে হেসে বলল, “এসো থোকা।”

বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভলান্টিয়ার জিজ্ঞেস করল, “এখন ছাত্রছাত্রীদের ঢুকতে দেব?”

মিঠু বলল, “এখন না দেওয়াই ভালো। কালাচান আর ধলাচানের একটু বিশ্রাম দরকার।”

ফর্সা মানুষটা মিঠুকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না, প্রায় একটা ধাক্কা দিয়েই বাইরের দিকে নিয়ে যায়।

স্কুলের বাইরে একটা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়েছিল, মিঠু আর গুল্লুকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে ফর্সা আর কালো মানুষটাও ভেতরে ঢুকল। মিঠুকে জিজ্ঞেস করল, “কোনদিকে যাব?”

“সোজা।”

ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে সোজা যেতে থাকে। রিমি আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছিল তাই কিছুক্ষণের ভিতরেই তাকে পাওয়া গেল। এদিক সেদিক দেখতে দেখতে রিমি সাবধানে হেঁটে যাচ্ছে। মিঠু বলল, “ঐ যে রিমি। গাড়ি থামাও।”

মাইক্রোবাসটা রিমির কাছে থামল, রিমি একটু অবাক হয়ে তাকাল, মাইক্রোবাসের ভেতরে মিঠু গুল্লু আর সাংবাদিকদের দেখে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

মিঠু গাড়ি থেকে নেমে বলল, “কিছু হয় নাই।”

“তোর সাথে এরা কেন?”

অন্যরাও ততক্ষণে নেমে এসেছে, জগু নামের মানুষটাও হঠাৎ কোথা থেকে হাজির হয়ে সবাই মিলে রিমিকে ঘিরে ফেলেছে। রিমি এবারে একটু ভয় পেয়ে গেল। মিঠু বলল, “কোনো ভয় নাই। তোর ব্যাকপ্যাকটা দে।”

“কেন?”

“এখন প্রশ্ন করিস না। পরে বলব। তুই ব্যাকপ্যাকটা দে।”

“না, আমি দেব না।”

ফর্সা মানুষটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তোমার বাবা দেবে।”

রিমি বলল, “সাহস থাকলে নেয়ার চেষ্টা করেন।”

মিঠু বলল, “মাথা গরম করিস না। এর মাঝে অনেক ব্যাপার আছে। ব্যাগটা দে।”

“না।”

মিঠু তখন রিমির পিছনে গিয়ে ব্যাগটা খুলে নেয়ার চেষ্ট করল। কেউ বুঝতে পারল না যে আসলে সে মোটেই ব্যাগটা খুলে নেয়ার চেষ্টা করল না, সে হুটোপুটি করে ব্যাকপ্যাকের জিপটা টেনে ব্যাগটা খুলে দিল। ব্যাগের ভিতরে একটুখানি জায়গায় এতক্ষণ আটকে থেকে কালাচান ধলাচান নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, ব্যাগটা খুলতেই দুইজন উড়ে বের হয়ে গেল।

ফর্সা মানুষটা একেবারে পাগলের মতো হা হা করে ছুটে এসে কালাচান ধলাচানকে ধরা চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে দুজনেই নাগালের বাইরে চলে গেছে। কালাচান ধলাচান বেশি দূরে গেল না, তাদের মাথার উপর উড়তে লাগল।

মিঠু চিৎকার করে বলল, “পিচিক।”

কালাচান ধলাচান নিশ্চয়ই বুঝে গেল যে কোনো জায়গায় পিচিক করলে হবে না, তাই খুব হিসাব করে নিখুঁতভাবে ফর্সার মুখের উপর পিচিক করে বাথরুম করে দিল। প্রথমে ধলাচান, তারপরে কালাচান।

ফর্সা লোকটা হাত দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করে, কোন লাভ হয় না, তার চোখের মাঝেও কাকের বাথরুম ঢুকে গেছে, ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। গুল্লু আর রিমিও তখন চিৎকার করে বলল, “পিচিক পিচিক।”

কালাচান ধলাচান তাদের নিরাশ করল না। বোম্বার প্লেনের মতো উড়ে উড়ে মানুষগুলোর চোখে-মুখে বাথরুম করে যেতে লাগল। সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্যে মানুষের ভিড় জমে যায় এবং প্রত্যেকবার সফলভাবে বাথরুম করা মাত্র তারা হাততালি দিতে থাকে।

ফর্সা মানুষটা কোনোভাবে চোখ খুলে মিঠুর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই ছেড়ে দিলি? তোর মনে এই ছিল আগে বললি না কেন? তোকেও না। হয় কোটি টাকার ভাগ দিতাম।”

মিঠু বলল, “তোমার কোটি টাকার ভাগে আমি পিচিক করে দেই।”

কালাচান ধলাচানের বাথরুম সাপ্লাই শেষ হবার পর তারা তাদের মাথার উপর কয়েকপাক উড়ে একটা ইলেকট্রিক তারের উপর বসল, তারপর উড়ে গেল।

.

কালাচান আর ধলাচানকে আর দেখা যায়নি। রতন বলেছে ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলে হাত দুটো অচল হয়ে যাবে তখন সেগুলো কালাচান ধলাচানের জন্যে একটা বাড়তি ঝামেলা হয়ে দাঁড়াবে। রতন অবশ্যি নিশ্চিত ছিল কালাচান ধলাচান তখন ঠুকরে ঠুকরে সেগুলো খুলে ফেলতে পারবে। হাত ছাড়াই তখন তাদের কাক জগতে বেঁচে থাকা শিখতে হবে। রতনের ধারণা। এটা বড়ো কোনো সমস্যা হবে না, কারণ কাক হচ্ছে পাখিদের আইনস্টাইন!

.

বহুদিন পর রতন একদিন বিজয় সরণি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তখন হঠাৎ কোথা থেকে একটা কাক কা কা করে ডাকতে ডাকতে তার মাথার উপর উড়তে লাগল। রতন তখন হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ডাকল, “কালাচান? ধলাচান?”

কাকটা তখন উড়ে তার হাতের উপর বসল। রতন চিনতে পারে, এটা ধলাচান। আরো বড়ো হয়েছে আরো তেজি হয়েছে। সাথে আরো কয়েকটা। কাক ছিল তারা অবশ্যি রতনের কাছে এল না, দূরে দূরে উড়ে উড়ে কাকা করে ডাকতে লাগল।

রতন বলল, “ধলাচান, তুমি ভালো আছ?”

ধলাচান বলল, “কা কা।”

“কালাচান কোথায়?”

ধলাচান বলল, “কা কা।”

“ঐ যারা উড়ছে তারা বুঝি তোমার ফেমিলি? বাচ্চা-কাচ্চা?”

ধলাচান বলল, “কা কা।”

রতন সাবধানে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “যাও ধলাচান, বাচ্চা-কাচ্চাকে দেখে শুনে রেখো। যেখানেই থাকো ভালো থেকো।”

ধলাচান বলল, “কা কা” তারপর উড়ে গেল।