৩. কন্গ্রের দামামা
বাস্কেথ, ফিলিপ আর মরিস যদি কখনও একবার স্টটেন আইল্যাণ্ডের পশ্চিম দিকটায় জরিপে বেরুতো, তাহ’লে দেখতে পেতো যে সেদিককার উপকূলরেখা বেশ অন্যরকম। খাড়া-খাড়া পাহাড় দিয়ে গড়া এই অংশটা যেন অতর্কিতে হুড়মুড় ক’রে সমুদ্র থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। অন্যখানে যখন বেশ শান্ত আবহাওয়া, তখনও এখানে জলের মধ্যে ঢেউ আর ঘূর্ণির দাপট ভয়ংকর।
এই পাহাড়গুলোর গায়ে অজস্র গুহা পাতালপ্রসারী হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। সংকীর্ণ, গভীর, স্যাঁতসেঁতে আর অন্ধকার। চারপাশে উঁচু-উঁচু ঢিবির মতো পাথরের স্তূপ। দ্বীপের মধ্যেকার সমতলভূমিটায় যেতে হ’লে অন্তত হাজার দুই ফুট উঁচু চূড়া আর মাইল পনেরো পথ পেরুতে হবে এখান থেকে। সমুদ্র এখানে এতটাই ভয়ংকর যে দ্বীপের এই দিকটাতেও একটা বাতিঘর বানালে ভালো হ’তো। আশা করা যায়, আরহেন্তিনার সরকারের পন্থানুসরণ ক’রে চিলের সরকার হয়তো একদিন সে-চেষ্টা করবে।
কিন্তু আসল কথাটা হ’লো, স্টটেন আইল্যাণ্ডের দু-দিকে দুটো বাতিঘর তৈরি করা হ’লে এই এলাকার জলদস্যুদের পক্ষে ব্যাপারটা রীতিমতো সঙিন হ’য়ে দাঁড়াবে। অনেকেরই ধারণা, এখানকার সমুদ্রে যত জাহাজডুবি হয় তার সব কটাই প্রকৃতির কৃপায় নয়, বরং বোম্বেটেদের বদান্যতায়। এখানকার জলে জলদস্যুদের উৎপাত অবর্ণনীয়রকম ভয়াবহ।
ক-বছর আগে ইগোর উপসাগরে ঢোকবার মুখটায় বোম্বেটেদের একটা দল একটা ঘাঁটি তৈরি করেছিলো। দ্বীপের এই পশ্চিম দিকেই লুকিয়ে থাকবার মতো একটা গভীর গুহা তারা আবিষ্কার করেছিলো। স্টটেন আইল্যাণ্ডে কখনোই কোনো জাহাজ আসতো না ব’লে এটা তাদের একটা নিরাপদ আশ্রয় হ’য়ে উঠেছিলো। এই বোম্বেটেদের দলে মোটমাট জনা বারো লোক। তাদের সর্দারের নাম কনগ্রে। আর কন্গ্রের প্রধান শাগরেদ হ’লো সের্সান্তে
সবাই তারা দক্ষিণ আমেরিকার লোক। জনা পাঁচেক হয়তো আরহেন্তিনা বা চিলের লোক, বাকি সবাই তিয়েরা দেল ফুয়েগোর বাসিন্দা। এরা সবাই কন্গ্রের পাল্লায় প’ড়ে জলদস্যু ব’নে গিয়েছিলো।
সের্সান্তে চিলের লোক। তবে চিলের কোন গাঁয়ে তার জন্ম, কিংবা সে কোন পরিবারের মানুষ, তা কেউ জানতো না। কোনকিস্তাদোরদের সুযোগ্য এই বংশধরটির বয়স বছর চল্লিশ, দোহারা চেহারা, গায়ে প্রচণ্ড জোর, আর প্রচণ্ড খাটতেও পারে। দুনিয়ায় এমন-কোনো দুষ্কর্ম নেই যা সে করতে পারে না।
আর বোম্বেটেদের সর্দার কন্গ্রে জীবনের কোনো তথ্যই কেউ জানতো না। সে-যে কোথাকার লোক, তা পর্যন্ত সে ঘুণাক্ষরেও কারু কাছে ফাঁস করেনি। সত্যি-সত্যিই তার নাম কনগ্রে কি না, তাও কারু জানা ছিলো না। সমুদ্রের এদিকটায় কন্গ্রের দলবলের কুকীর্তির কথা সবাই জানে। নিজে সে বেপরোয়া মানুষ, সেও দানবের মতো খাটতে পারে। অন্য-কোনো পেশা বেছে নিলে সে মস্ত নাম করতে পারতো, কিন্তু স্বেচ্ছায় সে জলদস্যুর জীবন বেছে নিয়েছে। বোম্বেটে বলতে যা বোঝায়, সে আপাদমস্তক তাই : সবরকম কুকাজেই সে সমান ওস্তাদ। ওয়ালটার রলে বা ফ্রানসিস ড্রেকও বোধহয় দস্যুবৃত্তিতে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতো না।
কী ক’রে যে কন্গ্রে আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা এই দ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো খুব সংক্ষেপেই তা সেরে নেয়া যায়।
ফাঁসিতে ঝোলবার উপযোগী বিস্তর অপকর্ম ক’রে মাগেলান প্রণালীর প্রধান বন্দর থেকে চম্পট দিয়ে তিয়েরা দেল ফুয়েগোয় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো এই মানিকজোড়-কন্গ্রে আর সের্সান্তে। সেখানে ডেরা পাতবার সঙ্গে-সঙ্গেই তাদের কানে গিয়েছিলো যে সমুদ্রের এদিকটায় প্রায়ই জাহাজডুবি হয়। তার মানে, স্টটেন আইল্যাণ্ডের আশপাশে নানা জায়গা নিশ্চয়ই জাহাজডুবির দামি-দামি মালে ভরা; এ-রকম একটা কথা মাথায় খেলে যেতেই তিয়েরা দেল ফুয়েগোর ডাকাবুকো জনা বারো লোক নিয়ে কে আর সের্সান্তে একটা দুর্দান্ত দল গ’ড়ে তুলেছিলো।
একটি জেলে নৌকোয় করে লেময়র প্রণালী পাড়ি দেবার সময় কলনেট অন্তরীপের পাহাড়ে ঘা খেয়ে তাদের নৌকো ভেঙে টুকরো-টুকরো হ’য়ে যায়। অনেক কষ্টে তারা সেবার প্রাণে বেঁচেছিলো। তারপর পায়ে হেঁটে ইগোর উপসাগরের কাছে এসে পৌঁছেছিলো। সেখানে তাদের নিরাশ হ’তে হয়নি। সান হুয়ান অন্তরীপ থেকে সেভারেল পয়েন্ট অব্দি জায়গায় অগুনতি জাহাজডুবির মাল তাদের দখলে এসেছিলো। বড়ো-বড়ো সিন্দুক থেকে অজস্র সোনারুপোর তাল, অস্ত্রশস্ত্র, পিস্তল-বন্দুক, গুলি-বারুদ লাভ করেছিলো তারা। এই ভয়াবহ স্টটেন আইল্যাণ্ডের কথা নাবিকদের অজানা ছিলো না। যত-কটি জাহাজ ঝড়ের কবলে প’ড়ে এদিকে এসেছে, তাদের একটিও উপকূলের পাহাড়ের সঙ্গে সংঘর্ষ থেকে রেহাই পায়নি। কন্গ্রে আর তার দলবল উপসাগরের মাঝখানে আশ্রয় না-নিয়ে সান হুয়ান অন্তরীপের ওপর নজর রাখবার জন্যে এর প্রবেশপথের ডানদিকে আস্তানা গেড়েছিলো। গোটা দলটার থাকবার উপযোগী মস্ত একটা গুহাও চোখে পড়েছিলো তাদের। উপসাগরের উত্তর দিকে একটা টিলার পেছনে গুহাটার অবস্থান ব’লে ঝড়ের প্রকোপ থেকে রেহাই পাবারও সুবিধে হয়েছিলো। তারা প্রথমেই তাদের সমস্ত মালপত্তর নিয়ে গুহায় বোঝাই করেছিলো, এমনকী খাবারদাবার ও বিছানাপাটির ব্যবস্থা করতেও ভোলেনি। এই গুহারই কাছাকাছি অন্য-একটা গুহায় বেশি দামি মালপত্র, যেমন সোনা-রুপো ধনরত্ন ইত্যাদি দিয়ে বোঝাই ক’রে রীতিমতো একটি রত্নভাণ্ডার বানিয়ে তুলেছিলো। কন্গ্রের মলব ছিলো কোনো জাহাজ দখল করতে পারলে সমস্ত মালপত্র নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো দ্বীপে চ’লে যাবে। তার বোম্বেটে-জীবনের হাতেখড়ি ঐ এলাকাতেই হয়েছিলো ব’লে অঞ্চলটার ওপর অদ্ভুত এক মমতা ছিলো তার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো সুযোগ না-আসায় এই জলদস্যুর দল স্টটেন আইল্যাণ্ড ছেড়ে চ’লে যেতে পারেনি।
দু-বছর ধরে ক্রমাগত লুঠতরাজ চালিয়ে-যাওয়ার দরুন তাদের ধনভাণ্ডার ক্রমশ ফেঁপে উঠেছে। জাহাজডুবি থেকেও প্রচুর লাভবান হয়েছে তার দল। দরকার হ’লে হিংস্র লুঠতরাজ চালাতেও একটু পেছপা হয়নি। কিন্তু তবু এই দ্বীপে প্রায় বন্দীর মতোই থেকে গিয়েছে তারা। আজ অব্দি তারা কোনো অটুট জাহাজ দখল করতে পারেনি।
দিনের পর দিন কেটে যায়। লুঠপাটের ফলে রত্নগুহা ভর্তি হ’য়ে যেতে থাকে। কন্গ্রের ঐশ্বর্য প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়েই চ’লে যায়।
সের্সান্তের সঙ্গে এই নিয়ে কন্গ্রে প্রায়ই আলোচনা করে। তার কাছে মনে হয় এত ধনরত্ন যদি ভোগেই না-আসে তাহ’লে খামকা এ-সব জমিয়ে কী লাভ? জলদস্যু হবার পর এমন-একটা দুর্ভাগ্য যে তাদের তাড়া ক’রে ফিরবে তা কে জানতো?
অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও সের্সান্তে বললে, ‘যদি একটা জাহাজ এই দ্বীপে নোঙর ফেলতো, আর আমরা যদি সেটা দখল ক’রে নিতে পারতুম! কিন্তু হায়, সে-রকম ভাগ্য ক’রে বোধহয় আসিনি আমরা।’
কন্গ্রে দৃঢ় কণ্ঠে বললে, ‘কিন্তু যেভাবেই হোক এখান থেকে আমাদের পাততাড়ি গুটোতে হবে। এখান থেকে যেতেই হবে!’
‘কিন্তু কী ক’রে।’ সের্সান্তের সেই পুরোনো জিজ্ঞাসা।
এ-প্রশ্নের অবশ্য কোনো জবাব আসে না। কন্গ্রে চুপ ক’রেই রইলো।
সের্সান্তে বললে, ‘একদিন-না-একদিন আমাদের রসদ তো ফুরিয়ে যাবেই। যতদিন দ্বীপের আশপাশে মাছ না-ফুরোয় আর শিকার জোটে, ততদিনই ভরসা। তারপর একবার শীতের কথা ভাবো দেখি! শীতের কথা মনে হ’তেই এখনই আমার গায়ের লোম কাঁটা হ’য়ে যায়।’
কন্গ্রে কোনোই জবাব দিলে না। মনোভাব চেপে রাখতে তার কোনো জুড়ি নেই। কিন্তু তবু এই অসহায়তার কথা মনে ক’রে মাঝে-মাঝে সে ভীষণ খেপে উঠতো। ভাগ্যের ওপর তার কোনো হাত নেই, নেহাৎ হাত না-কামড়ানো ছাড়া। কিন্তু এই কাহিনী শুরু হবার বছর দেড়েক আগে হঠাৎ একদিন অবস্থা বদলে গিয়েছিলো।
১৮৫৮-র অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকে দ্বীপে হঠাৎ একটি জাহাজ এসে ভিড়েছিলো। তার মাস্তুলে পৎপৎ করে উড়ছিলো আরহেন্তিনার পতাকা। কন্গ্রে আর তার দলবল দেখবামাত্রই চিনতে পেরেছিলো যে এটি একটি যুদ্ধজাহাজ। সুতরাং অযথা কাছে ঘেঁষবার দুঃসাহস না-দেখিয়ে, তাদের উপস্থিতির সমস্ত চিত্র লোপাট ক’রে দিয়ে, গুহার ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো তারা, সারাক্ষণ অপেক্ষা ক’রে ছিলো কখন জাহাজটি দ্বীপ থেকে ফিরে যায়। জাহাজটি ছিলো সান্তা-ফে। বাতিঘর তৈরির বিষয়টার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতেই সান্তা-ফের এই আবির্ভাব ঘটেছিলো। সেবার দিন কয়েক বাদেই প্রাথমিক কাজকর্ম শেষ ক’রে সান্তা ফে দ্বীপ ছেড়ে চ’লে গিয়েছিলো। বোম্বেটে দল মোটেই ধরা পড়েনি। বরং সের্সান্তে এক অন্ধকার রাত্রে সান্তা-ফের কাছাকাছি লুকিয়ে-লুকিয়ে ঘোরাঘুরি করে টুকরোটাকরা কথাবার্তা শুনে জাহাজটি কেন দ্বীপে এসেছে তার আসল উদ্দেশ্যটা জেনে ফেলেছিলো।
ইগোর উপসাগরে একটি বাতিঘর তৈরি হবে।
অথচ এই দ্বীপ ছেড়ে অন্য কোথায় গিয়েই বা তারা আশ্রয় নেবে?
কিন্তু এখানে তো আর থাকা চলে না। আঁতিপাঁতি ক’রে আরো ভালো একটা আস্তানা খুঁজেছিলো কন্গ্রে। শেষ অব্দি স্টটেন আইল্যাণ্ডের পশ্চিম দিকে একটা নতুন গুহার সন্ধান পেয়ে সমস্ত মালপত্র স্থানান্তরিত করেছিলো। এক বছরেরও বেশি থাকবার উপযোগী রসদ নিয়ে সেখানেই তারা উঠে গিয়েছিলো। কারণ, সের্সান্তে জেনে এসেছিলো, বাতিঘর তৈরি করবার জন্যে শিগগিরই অনেক লোকজন এই দ্বীপে এসে হাজির হবে। কিন্তু দু-দুটো গুহার মালপত্র সরিয়ে নেবার সময় ছিলো না ব’লে বেশির ভাগ মালপত্র সরিয়ে নিয়ে, গুহার মুখটা ভালো ক’রে পাথর-টাথর দিয়ে বন্ধ ক’রে, বাকি জিনিশপত্র, সেখানে রেখেই দ্বীপের পশ্চিমদিকটায় তারা প্রস্থান করেছিলো।
বোম্বেটেরা নতুন গুহায় চ’লে যাবার পাঁচ দিনের মধ্যেই সান্তা-ফে বাতিঘর তৈরির মালমশলা আর লোকজন সমেত আবার দ্বীপে এসে হাজির হয়েছিলো। বাতিঘর বানাবার জায়গা বেছে নেয়া হ’লো, যথারীতি কাজও শুরু হ’য়ে গেলো।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাই দ্বীপের পশ্চিম দিকের গুহায় আশ্রয় নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো বোম্বেটেদের। একটি ঝরনা থেকে তারা তাদের পানীয় জল সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছিলো। মাছ ধ’রে, এবং একআধটু শিকারের সাহায্যে, তাদের জমানো রসদ কম ক’রে খরচ করারও আয়োজন করেছিলো তারা। তারা শুধু অপেক্ষা ক’রে ছিলো কবে এই বাতিঘরের নির্মাণ শেষ হয়, কবে সান্তা-ফে তার কাজ সেরে চ’লে যায়। তারপরেই বেজে উঠবে কন্গ্রের দামামা। আকাশবাতাস কেঁপে উঠবে তখন তার ভীষণ শব্দে
কন্গ্রে আর সের্সান্তে দ্বীপের ঘটনাবলির ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলো। বাতিঘর তৈরির কাজ কখন শেষ হবে, তার মোটামুটি একটা আন্দাজ কে করেছিলো কাজের গতি দেখে; অধীরভাবে সে প্রতীক্ষা করছিলো ডিসেম্বর মাসের জন্যে, সে ধ’রে নিয়েছিলো তখনই বাতিঘর তৈরির কাজ শেষ হবে। আর তারই ওপর নির্ভর ক’রে সে তার ফন্দি এঁটেছিলো : বাতিঘর বানিয়ে, আলোকরক্ষীদের রেখে, সান্তা ফে চ’লে যাবে—তখন শুধু ক-জন আলোকরক্ষী ছাড়া দ্বীপে আর-কেউ থাকবে না। তাই পুরো সময়টাই তাদের দলের কেউ-না-কেউ সাত-আট মাইল দূরের পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে বাতিঘরের আলো দেখতে পাবার প্রতীক্ষা করতো। নয় ডিসেম্বরের রাত্রে সের্সান্তেই খবরটা নিয়ে আস্তানায় পৌঁছেছিলো।
তারপরের কয়েকটা দিন কেটেছে ঘটনাবিহীন। কিন্তু সেদিন যখন শিকার করবার সময় সের্সান্তে তার বন্দুকের গুলিতে একটি গুঅনাকোকে জখম করলে, সেটি কিন্তু বেশ খানিকটা ছুটে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলো—আর সেটাকে আবিষ্কার করেছিলো মরিস। ওই ঘটনার ফলেই বাস্কেথরা জেনে গেলো যে দ্বীপে আরো লোক আছে, তবে তারা যে কে, সে-সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই। এই লোকগুলো যখন খোলাখুলি তাদের সামনে আসতে চাচ্ছে না, তখন তাদের মলব খুব-একটা সুবিধের হবে ব’লে বাকেথের মনে হয়নি।
এদিকে কন্গ্রে ফন্দি এঁটেছিলো যে ২২ ডিসেম্বর রওনা হ’য়ে, বড়োদিনের আগের দিন সন্ধেয়, অর্থাৎ ২৪ ইগোর উপসাগরের কাছে গিয়ে হাজির হবে। বাতিঘর দখল করতে আর কতক্ষণ লাগবে? মাত্র তো তিনজন আলোকরক্ষীই আছে, সম্পূর্ণ অরক্ষিত ও অপ্রস্তুত। এর পর ফের আগের গুহায় মালপত্তর সরিয়ে ফেলা যাবে।
আশঙ্কা অবিশ্যি একটা র’য়ে গেলো। সান্তা-ফে নিশ্চয়ই ফিরে গিয়ে নতুন বানানো বাতিঘরের কথা সাড়ম্বরে প্রচার করবে। সুতরাং কোনো-একটি জাহাজ, খুব বড়ো না-হোক মাঝারি মাপের চাই অন্তত, শিগগিরই জোগাড় ক’রে নিতে হবে। কনগ্রের পরিকল্পনা ছিলো, এ-রকম কোনো জাহাজ পেলেই সেটা দখল ক’রে সোজা আগেকার মৎলব অনুযায়ী প্রশান্ত মহাসাগরে পাড়ি দেবে। কিন্তু কোনো জাহাজ যদি এখানে নোঙর না-ই ফ্যালে, তখন? সান্তা-ফে ফিরে এলে সব ভণ্ডুল হ’য়ে যাবে, আবার পড়ি কি মরি ক’রে ছুটে পশ্চিম দিকে পালিয়ে আসতে হবে। কাজেই এই পরিকল্পনাটা কিছুতেই ভেস্তে দিতে দেয়া চলবে না।
২২শে ডিসেম্বর সন্ধেবেলায় কন্গ্রে আর সের্সান্তে তাদের গুহার পাশে সমুদ্রের ধারে হাঁটতে-হাঁটতে ওস্তাদ মাঝিমাল্লার মতো সমুদ্রকে খেয়াল ক’রে দেখছিলো। আবহাওয়া চমৎকার। দিগন্তে অবশ্য মেঘ জমেছে একটু, উত্তরপুব থেকে জোর হাওয়া দিচ্ছে। তখন সন্ধে সাড়ে-ছটা। কন্গ্রে আর তার স্যাঙাত্রা আগেকার পরিকল্পনা অনুযায়ী যাবার জন্যে তৈরি, এমন সময়ে সের্সান্তে জিগেশ করলে, ‘তাহ’লে আমরা আমাদের সব মালপত্তর এখানে ফেলে রেখেই যাচ্ছি, তাই তো?’
কন্গ্রে জবাব দিলে, ‘হ্যাঁ, ওগুলো বরং পরে নিয়ে গেলেই সুবিধে হবে। আমরা যখন সে-জায়গা দখল ক’রে নেবো, তখন…’ মুখের কথা মুখেই রইলো তার। খোলা সমুদ্রের পানে চোখ পড়তেই সে একটু থমকে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘সের্সান্তে! দ্যাখো! ঐদিকে তাকিয়ে দ্যাখো—ঐ-যে দূরে-
তার দেখানো দিকটায় তাকিয়েই সের্সান্তেও চেঁচিয়ে উঠলো, ‘জাহাজ- কোনো ভুল নেই—একটা জাহাজ!
‘কী মনে হয়?’ কন্গ্রে বললে, ‘জাহাজটা তো এদিকেই আসছে, তাই না?‘
‘হ্যাঁ। দেখে তো মনে হচ্ছে একটা স্কুনার,’ সের্সান্তে জানালে।
কন্গ্রেও সায় দিলে, ‘ঠিকই বলেছো। দেড়শো-দুশো টনের একটা স্কুনার।‘
জলদস্যুর দল তক্ষুনি গুহার সামনে ভিড় ক’রে দাঁড়ালে। কন্গ্রে বললে, ‘কোনোমতেই এ-সুযোগ হারানো চলবে না। এটাকেই দখল করার চেষ্টা করতে হবে। ঐ দ্যাখো, হাওয়া আর জোয়ারের বিরুদ্ধে কেমনভাবে লড়ছে জাহাজটা—মনে হচ্ছে বেশ মজবুত!’
রাত ঘন হ’য়ে এলো। প্রণালীর মধ্যে প্রবেশ করা এখন আর সম্ভব হবে না। কালও এটাকে অন্তরীপের পথেই দেখা যাবে। তারপর বোঝা যাবে আমরা কী করতে পারি।’
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জাহাজটা অন্ধকারের মধ্যে বেমালুম হারিয়ে গেলো। এমনকী তার কোনো আলো অব্দি চোখে পড়লো না।
পরদিন ভোরবেলায় কন্গ্রেরা যখন গুহার ভেতর থেকে বেরুলো, দেখতে পেলে সেন্ট বার্থলেমিউ অন্তরীপের পাহাড়ের নিচে স্কুনারটা স্থির হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে।