অভয়ের ঘুম যখন ভাঙল তখন সন্ধে। ঘুমের ঘোরে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। ধড়মড় করে উঠে বসে চারদিকে চেয়ে হাঁ হয়ে গেল। এখানে যে কি করে এল, কেন এল তা ঘুমজড়ানো চোখে প্রথমটায় কিছুতেই বুঝতে পারল না। তারপর হঠাৎ ঝাঁ করে সব মনে পড়ে গেল। আতঙ্কিত চোখে চারদিকে চাইল সে। চারদিকে ধীরে-ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠছে। ঝিঝি ডাকছে। মিটমিট করছে জোনাকি পোকা।
অভয় টের পেল তার যেমন প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছে তেমনই দাউদাউ খিদে। ছোটখাটো খিদেই অভয়ের সহ্য হয় না, আর এ তো বড় খিদে। এই জঙ্গলের মধ্যে খিদেতেষ্টা কোনওটারই কোনও সমাধান পাওয়া যাবে বলে ভরসা হল না অভয়ের। তার ওপর অন্ধকার হয়ে আসছে। একঝাঁক শেয়ালও কাছেপিঠে ডেকে উঠল।
এরকম গা-ছমছমে পরিস্থিতিতে কখনও পড়তে হয়নি অভয়কে। সে শহুরে মানুষ। সে জন্তু-জানোয়ার, সাপ-বিছে, ভূত-প্রেত ইত্যাদিকে ভীষণ ভয় খায়। এই জঙ্গলে যদি রাত কাটাতে হয় তা হলে ভয়েই মরে যাবে অভয়।
সে টপ করে উঠে পড়ল। এবং উঠতে গিয়েই টের পেল তার সবাঙ্গে হাজারটা বিষফোড়ার যন্ত্রণা। অভয় জীবনে কখনও দৌড়ঝাঁপ করেনি, ব্যায়াম করেনি, তার থলথলে আদুরে শরীর। সেই শরীর নিয়ে আজ সকালে যে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে তাতে ৩৮
যন্ত্রণা তো তুচ্ছ, মরেই যাওয়ার কথা।
হাঁটতে গিয়ে দেখল, মাথায় খচখচ করে এমন ব্যথা উঠছে যে, দুপা হাঁটতে গেলে তিন মিনিট দম নিতে হয়। কিন্তু প্রাণের ভয় বড় ভয়। অভয় তার শরীরটাকে একরকম টানতে টানতে হ্যাঁচড়াতে-হ্যাঁচড়াতে নিয়ে চলতে লাগল। জঙ্গলের বেশি ভেতরে সে ঢোকেনি, বাইরেটা দেখাও যাচ্ছে। অভয় সুতরাং খুব উৎসাহ নিয়ে পায়ে-পায়ে এগোতে লাগল। কাছেই গ্রাম আছে, সেখানে গিয়ে পড়লে লোকে বোধ হয় ফেলবে না।
বাইরে বেরিয়ে এসে অভয় একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ছাড়ল। সামনেই একটা অশ্বথ গাছ। তার পাশ দিয়ে আবছা অন্ধকারেও একটা পায়ে-হাঁটা পথ দেখা যাচ্ছে। ও পথ ধরে একটু এগোলেই গ্রাম।
অভয় প্রাণপণে এগোতে লাগল। শরীরের ব্যথা আর হাঁটার ধকলে এই শীতেও তার ঘাম হতে লাগল। হাঁফ ধরে গেল। মাথা ভোঁ-ভোঁ করে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল।
তবু হাল ছাড়ল না অভয়। পৈতৃক প্রাণটা বাঁচাতে কোনওরকমে এখন তাকে লোকালয়ে পৌঁছতেই হবে।
একটা বাঁশবন পেরিয়ে রাস্তাটা একটা বাঁক খেয়ে গাঁয়ের মধ্যে ঢুকেছে। হারিকেন বা কুপির আলো দেখা যাচ্ছে এদিক-সেদিক। বাচ্চাদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। গোরুর গলার ঘণ্টা বাজছে। একটা ছাগলও যেন ম্যা করে উঠল। এসব শুনে আর দেখে ভারী ভাল লাগতে লাগল অভয়ের।
একটা লোক দুটো বলদ তাড়িয়ে ফিরছিল, কাঁধে লাঙল, অভয় তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে বলল, “আচ্ছা ভাই, এ-গাঁয়ের মোড়ল-মশাইয়ের বাড়িটা কোনদিকে?”
লোকটা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, “এ-গাঁয়ে সবাই
মোড়ল। তা মোড়লকে কিসের দরকার আপনার?”
অভয় কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “এ-গাঁয়ের খুব নাম শুনেছি কিনা, তাই দেখতে আসা।”
লোকটা বলদের লেজে একটা মোচড় দিয়ে জিভে একটা বিকট ট-ডু-ডু-ড আওয়াজ তুলে অভয়কে খুব চমকে দিল। তারপর খুব অবাক হয়ে বলল, “এ-গাঁয়ের নাম শুনেছেন! এমন আশ্চর্য কথা আর কারও মুখে জন্মে শুনিনি। তা এ-গাঁয়ের নামটি কী বলুন তো।”
অভয় নামটা সকালে বোধ হয় একবার শুনেছিল। কিন্তু এখন তার মাথা বেবাক ফরসা। কিছুই মনে নেই। সে আমতা-আমতা করে বলল, “খুবই ভাল নাম আপনাদের গাঁয়ের। কিন্তু নামটা আমার পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”
“অ। তা ভাল। এই গাঁয়েই কি আজ দেহরক্ষা করার ইচ্ছে?”
অভয় আঁতকে উঠে বলে, “তার মানে?”
“বলছি এ-গাঁয়েই কি রাতটা কাটাবেন?”
“তা বটে। কিন্তু দেক্ষা করার কথা বলছেন কেন? দেহরক্ষা মানে তো পটল তোলা!”
লোকটা এবার অন্ধকারেও সাদা দাঁত দেখিয়ে এক পলক হেসে বলে, “ওই হল। আমরা মুখসুখ মানুষ, কত ভুলভাল বলি। একটু ঘষেমেজে নেবেন। তা আপনার কোনও অসুবিধে হবে না এখানে। দিব্যি থাকবেন।”
অভয় আশার আলো দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বলে, “আঃ, বাঁচালেন। আজ বড্ড ধকল গেছে কিনা। খিদেতেষ্টায় প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত।”
লোকটা ফ্যাচ করে হেসে বলে, “তা আপনাকে ন্যাংচাতে দেখেই বুঝেছি। ধকলটা গেল কিসে? কেউ তাড়াটাড়া করেছিল নাকি?”
“যা বলেছেন। এখানকার লোকগুলো যেন কেমনধারা। সত্যি কথা বললেও বিশ্বাস করতে চায় না।”
লোকটা খুব বুঝদারের মতো বলে, “কথাটা সত্যি, এদিককার লোক বিশেষ সুবিধের নয়। তবে আর চিন্তা নেই, আপনি ঠিক জায়গাটিতেই এসে পড়েছেন। একেবারে সিংহের গুহায়।”
অভয় ফের আঁতকে উঠে বলে, “তার মানে?” লোকটা ফের ফ্যাচ করে হেসে বলে, “মুখ-সুখ মানুষ আমরা কী বলতে কী বলে ফেলেছি। ওসব ধরবেন না। আমরা খুব যত্নআত্তি করব আপনার, কিছু ভাবতে হবে না। আমরা একটু মোটা চালের ভাত খাই। মোটা রাঙা মিঠে ভাত। মোটা চালের ভাত চলবে তো আপনার?”
ভাতের কথায় অভয়ের চোখে জল এল, বলল, “খুব চলবে। কতকাল যে ভাত খাইনি মনে হচ্ছে। সঙ্গে ডাল থাকবে তো!”
লোকটা তেজী গলায় বলে, “থাকবে না মানে? সোনামুগের ডাল একেবারে গরমাগরম ঢেলে দেওয়া হবে ভাতের মাথায়। সঙ্গে ফুলকপি ভাজা, মটর শাকের ঘণ্ট, মাছের ঝোল, শেষ পাতে গোরুর দুধ, তাতে আবার পুরু সর।”
অভয় যেন নিজের দুই কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বলল, “অত দরকার নেই।”
“না, না, দরকার থাকবে না কেন? গাঁয়ে এতকাল পরে একজন অতিথি এলেন, তার সৎকার ভালমতো করতে হবে না? কী বলেন?”
‘সকার’ শব্দটা খট করে লাগল অভয়ের কানে। তবে সে আর ওটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। সকার কথাটার ভাল মানেও আছে। হাঁটতে হাঁটতে গাঁয়ের মাঝ বরাবর চলে এল তারা। দুটো পুকুর এবং আর-একটা বাঁশঝাড় পেরোতে হয়েছে। তারপর একটা মস্ত উঠোনওলা বাড়ি। লোকটা আগল ঠেলে বলদ তাড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আসুন, আসুন, লজ্জা করবেন না। এই হল আমার বাড়ি। ওরে, অতিথি এয়েছে মহামান্য অতিথি, তোরা একটা মোড়া বা জলচৌকি দে তো। তারপর পাদ্যঅর্ঘ্য দে।”
আপ্যায়নটা বড় বাড়াবাড়ি ঠেকছে অভয়ের কাছে। এতটা কেউ করে নাকি?
জলচৌকি, মোড়া বা পাদ্যঅর্ঘ্য কোনওটাই অবশ্য এল না। লোকটা গোয়ালঘরের দিকে যেতে-যেতে মুখ ফিরিয়ে বলল, “বাবুমশাই, ওই দাওয়াতেই একটু চেপে বসুন। আমি বলদ দুটোকে জাবনাটা দিয়েই এলুম বলে। তারপর দেখবেন কেমন যত্নআত্তি করি।”
দাওয়ায় একটা টেমি জ্বলছে। লোকজন বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। তবে দু-একজন মহিলা উঁকিঝুঁকি দিয়েই আড়ালে সরে গেলেন। রান্নাঘর থেকে ভাত ফুটবার গন্ধ আসছে। ডালে সম্বরা দেওয়ারও একটা ছ্যাঁক শব্দ এল। অভয় শরীরের ব্যথা আর ক্লান্তি ভুলে আকুল হয়ে বাতাস শুকতে লাগল। আঃ, কী সুবাস! পেটে খিদেটাও যেন একেবারে উথলে উঠল।
বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকবার পরও লোকটার দেখা পাওয়া গেল না। ভাতের খিদে চাগাড় দিচ্ছে। জলতেষ্টাও আর সহ্য করা যাচ্ছে না। উঠোনের এককোণে ইদারা আর দড়িবাধা বালতি দেখতে পেয়ে অভয় নিজেই উঠে গেল। জল তুলে-তুলে প্রাণভরে খেল। জলের যে এত স্বাদ, তা যেন জানা ছিল না এতকাল। মুখে-ঘাড়ে জল দিয়ে বড় আরামও হল। গাঁয়ের লোকেরা সাঁঝরাতেই খেয়ে নেয় বলে সে শুনেছে। তাই আশা হল, এরাও বোধ হয় এখনই খেতে ডাকবে।
দাওয়ায় বসে এসব ভাবতে-ভাবতে ক্লান্তিতে আবার একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল অভয়ের। হঠাৎ একটা প্রবল চিৎকারে চমকে চাইল।
“ওরে! এই তো সেই! এই তো কুঞ্জখুডোর বাড়ির সেই ডাকাত! এই তো আজ সকালে আমাদের তাড়া খেয়ে মনসাপোঁতার জঙ্গলে সিঁধিয়েছিল!”
অভয় অবাক হয়ে দেখল, সামনে তাকে ঘিরে লাঠিসোঁটা নিয়ে অন্তত চোদ্দ-পনেরো জন লোক। অন্তত চার-পাঁচটা হ্যারিকেন জ্বলছে। একটা মশালও। সামনের ভিড়ে সকালের সেই দুটি চাষিকেও চিনতে পারল অভয়। ভয়ে সে সিঁটিয়ে গেল।
বাড়ির মালিক একটু ফিচিক হাসি হেসে বলল, “ব্যাটা যখন গাঁয়ের নামটাই বলতে পারল না তখনই বুঝেছি এব্যাটা সাঙ্ঘাতিক লোক। আগেই তোমাদের বলে দিচ্ছি ভাই, কুঞ্জখুড়োর পঞ্চাশ হাজারের মধ্যে আমি বেশি চাইব না, দশটি হাজার কিন্তু আমার চাই। নইলে এ-ডাকাত আমি হাতছাড়া করব না।”
জগা বলল, “ভাগ-বাঁটোয়ারার কথা পরে হবে। আগে কুঞ্জখুড়োর কাছে খবরটা তো পাঠাতে হয়। নইলে ওই পেটমোটা দারোগা এসে আসামিও নিয়ে যাবে, প্রাইজও।”
নেতাই বলল, “তোরা আহাম্মক আছিস বাপু। ওরে, চোরাই মাল উদ্ধার না হলে কুঞ্জখুড়ো ট্যাঁক থেকে ফস করে টাকাটা দিয়ে ফেলবে ভেবেছিস? এর মুখ থেকে কথা বের করতে হবে না আগে? দলে কে কে ছিল, চোরাই মাল কার কাছে আছে সেসব আগে জেনে নে। তারপর মাল উদ্ধার করে দিতে হবে না? বলি মাথায় আছে সেসব কথা? অক্ষয়, কী বলল হে?”
কথাটা যে ন্যায্য, সেটা সবাই স্বীকার করল। অক্ষয় হল বাড়ির মালিকের নাম। সে বলল, “তোমার কথা কখনও ফেলনা নয়। এখন বাঁশডলা দিয়ে বিছুটি লাগিয়ে এর পেট থেকে কথা বের করতে হবে।”
একজন ভিতু ও সরল গ্রামবাসী বলে উঠল, “ও অক্ষয়দা, এর কাছে আবার অস্তর নেই তো?”
অক্ষয় বলে, “থাকতে পারে। তবে কজনকে আর মারবে? বল্লমে গেঁথে ফেলব না! ওরে ও জগা, দ্যাখ তো কোমরে পিস্তল ভোজালি কিছু আছে কি না?”
ছিল না। থাকার কথাও নয়। জগা হাতিয়ে দেখে নিয়ে বলে, “নেই। বোধ হয় জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে ভয়ে।”
অভয় হঠাৎ বুঝতে পারল, গরম-গরম ডালভাত জোটার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। এবার যা জুটবে তা সইতে পারার ক্ষমতাও তার নেই। সে জীবনে মারধর খায়নি। অভয় তাই আচমকা উঠেই একটা দৌড় লাগাল।
কিন্তু সেটাই ভুল হয়েছিল। এই চক্রব্যুহ ভেদ করা যে অসাধ্য কাজ তা বুঝতে পারেনি। ছুটতে শুরু মাত্র দু-তিনটে লাঠি দমাদম তার পিঠে, মাথায় আর কাঁধে এসে পড়তে লাগল। পায়ে লাঠি দিয়েই কে যেন ল্যাং মেরে ফেলে দিল তাকে। আরও দু-চার ঘা পড়তেই চোখ অন্ধকার হয়ে গেল তার।
যখন চোখ মেলল, তখন তাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে লোক।
জগা বলল, “কুঞ্জখুড়ো, ভাল করে দ্যাখো, এই লোকটাই কিনা?”
গায়ে তুষের চাঁদর-জড়ানো আর সাদা গোঁফওলা একটা লোক
হ্যারিকেন তুলে অভয়ের মুখোনা দেখে নিয়ে বলল, “ধরেছিস ঠিকই বাপ। তবে এ কবুল করলে হয়। মাল উদ্ধার না হলে কিন্তু আমি টাকা দিচ্ছি না।”
“উদ্ধার হবে না মানে! পেট থেকে কী করে কথা বের করতে হয় তা আমরা জানি।”
কুঞ্জখুড়ো ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে, “ওরে, আমার চোখের সামনে ওসব আসুরিক কাজ করিস না। ও আমি সইতে পারি না। আমি ধর্মভীরু লোক। আমি বিদেয় হই, তারপর তোরা যা পারিস করিস। তবে কথা আদায় করাই চাই।”
কুঞ্জখুড়ে বিদেয় নিতেই জগা চুলের মুঠি ধরে অভয়কে তুলে পেল্লায় একখানা কিল মারল মুখে, “কী রে হতভাগা, বলবি কিনা!”
অভয়ের ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়তে লাগল। জিভে রক্তের নোনতা স্বাদ পেল সে। গায়ে আর একরত্তি জোর নেই। মনে কোনও শক্তি নেই। সে ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইল। কিছু একটা না বললে এরা যে থামবে না এবং মারতে-মারতে মেরেই। ফেলবে তাতে তার সন্দেহ নেই। জগা আবার কিল তুলল ওই।
হঠাৎ অভয় হাত তুলে বলল, “বলছি, বলছি।”
“মিছে কথা বোলো না কিন্তু।”
“টাকা আর সোদানা পোঁতা আছে শুখানালার সরকারদের বাড়িতে।”
নেতাই অবাক হয়ে বলে, “এসব কী বলে রে ব্যটা?”
অভয় অতশত জানে না। মার ঠেকাতে সে নিজের পৈতৃক বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে।
অক্ষয় খুব ভাবিত মুখে বলে, “শুখানালার সরকার-মশাইদের বাড়ি তো কবে হেজেমজে গেছে। সেখানেই এখন ডাকাতদের আস্তানা! তা হলে তো ভীম সরকারের গপ্পোটা মিথ্যে হয়ে যায়। ওখানে তো জনমনিষ্যি যেতে পারে না।”
জগাও চিন্তিত মুখে বলে, “সেটাই তো কথা। সরকারবাড়িতে ঢোকা তো আর ফাজলামি নয়।” বলে সে অভয়ের দিকে চেয়ে বলে, “ওরে ও ভূত, সত্যি কথা বলছিস তো! মিথ্যে বললে কিন্তু বল্লমে গেঁথে জলায় পুঁতে রাখব। বিশ বছরেও কেউ লাশ খুঁজে পাবে না।”
অভয় চিচি করে বলল, “আজ্ঞে, সত্যি কথাই বলছি। আমাকে আর মারবেন না। শরীরে আর মার খাওয়ার মতো জায়গা নেই।”
জগা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “আর অন্যদের যখন মারো কাটো, তখন তাদের শরীরে কী হয় সেটা ভেবে দেখেছ? ডাকাতি করতে গিয়ে যখন ছোরাছুরি গোলাগুলি চালাও, ঘরে আগুন দাও, মেয়েদের কান থেকে দুল ছিঁড়ে নাও, তখন কী হয়?”
অভয় হাতজোড় করে বলল, “ওসব মহাপাপ।” নেতাই ফ্যাচ করে হেসে বলল, “ওরে, এর যে ধর্মজ্ঞান হতে লেগেছে। দড়িদড়া নিয়ে এসে পিছমোড়া করে বাঁধ এটাকে থামের সঙ্গে। রেমোটা কোথায় গেল?”
নাপিত রেমো নিবিষ্ট-মনে একধারে বসে ক্ষুর শানাচ্ছিল। গম্ভীর গলায় বলল, “আছি।”
নেতাই বলে, “আর দেরি কেন, দে ডাকাতটার মাথা কামিয়ে।”
রেমো ক্ষুর হাতে এগিয়ে এসে উবু হয়ে বসল অভয়ের পাশে, বলল, “বাঃ দিব্যি ঢেউ-খেলানো চুল দেখছি। ডাকাত হলে কী হয়, চুলের বাহার আছে।”
অভয় সভয়ে ক্ষুরটার দিকে চেয়ে রইল। চুলে তার খুব
পরিপাটি। সেই সাধের চুল এরা কামিয়ে দেবে? অভয় হতাশ হয়ে চোখ বুজে ফেলল। প্রতিবাদ করার বা বাধা দেওয়ার শক্তিটুকু অবধি তার নেই।
রেমো অভয়ের মাথার বাঁদিকটা কামিয়ে দিল শুধু। তারপর বলল, “বাঃ, এবার সবাই দ্যাখো কেমন নতুন রকমের বাহার খুলেছে।”
অভয় ক্লান্তিতে তলিয়ে যেতে-যেতে টের পেল সবাই খুব হাসছে আর আনন্দ করছে। করুক গে, সে আর পারছে না। প্রায় অচৈতন্য অবস্থাতেই সে টের পেল, একটা থামের সঙ্গে তাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হচ্ছে। এও শুনতে পেল, তাকে নাকি সারারাত জলবিছুটি দিয়ে জাগিয়ে রাখা হবে। কারণ গাঁয়ে অনেকদিন যাত্রা বা কীর্তন বা কবির লড়াই হয়নি। মানুষ বড্ড মনমরা হয়ে আছে। তাই আজ তাকে যন্ত্রণা দিয়ে সবাই সারারাত আনন্দ করবে। জলবিছুটির সঙ্গে গরম কলকে, লোহার শিকের ছ্যাঁকাও দেওয়া হবে। অনেকরকমের আয়োজন হচ্ছে। সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেল খেয়েদেয়ে আসতে।
অভয় হাল ছেড়ে দিয়েছিল অনেক আগেই। ঘাড় লটকে সে নিস্তেজ হয়ে ঝুলছিল থামটার সঙ্গে। ঠিক এই সময়ে কে যেন তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “বাঁধন ক্ষুর দিয়ে একটু-একটু কেটে রেখেছি। হ্যাঁচকা টান মারলেই খুলে যাবে, বুঝলে!”
চোখ না চেয়েও অভয় বুঝতে পারল, এ হচ্ছে রেমো নাপিতের গলা। সে অতি কষ্টে ঘাড় নেড়ে বলল, “বুঝেছি।”
“উঠোনের উত্তরে কচুবনের পিছনদিক দিয়ে যদি পালাতে পারো তা হলে বেঁচে যাবে। মাইলখানেক যেতে পারলেই শুকনো নালার খাত পেয়ে যাবে। আর শোনো বাপু, হুকুম সিং যে সরকারবাড়িতে আস্তানা গেড়েছে তা তো বলেনি কখনও আমাকে! এটা খুব অন্যায় কথা। আমি তো জানতুম হুকুম সিং ময়নাগড়ের টিলার পেছনে জঙ্গলে থাকে। ঠিকানা বদলে ফেলেছে তা তো বলেনি আমাকে। আর আমি কিনা বহুঁকাল ধরে তাকে খবর জোগাচ্ছি, সুলুকসন্ধান দিচ্ছি কোন বাড়িতে কী আছে আর সে কিনা আমার সঙ্গে বেইমানি শুরু করেছে। তাকে বোলো এরকম হলে কিন্তু আমি তার হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে পারব না।”
অভয় মাথা নেড়ে বলল, “যে আজ্ঞে।”
“তুমি হুকুম সিং-এর লোক বলেই পালাতে দিচ্ছি। এটাও তাকে বোলো। আমি নেমকহারাম নই। তবে হুকুম সিং কাজটা ভাল করছে না। কুঞ্জখুডোর বাড়ির খবরও তো আমিই দিয়েছিলাম। কয়েক লাখ টাকা লুটে নিয়ে গেল, আর আমাকে কী দিল জানো? মোটে দু হাজার টাকা আর একখানা আংটি। এসব কি তার ধর্মে সইবে?”
অভয় এবার চোখের কোণ দিয়ে চারদিকটা দেখে নিল। উঠোন এখন ফাঁকা। সারারাত মজা দেখবে বলে সবাই ভাত খেতে গেছে। একা রেমো তাকে পাহারা দিচ্ছে।
রেমো তার ক্ষুর-কাঁচির বাক্স গুছিয়ে বন্ধ করে বলল, “ওরা এলেই আমি বাড়ি যাব বলে কথা আছে। কিন্তু লোকজন এসে পড়ার আগেই সরে পড়তে হবে তোমাকে। অক্ষয় খেতে বসেছে। আমি বরং রান্নাঘরে গিয়ে অক্ষয়ের সঙ্গে একটু জরুরি কথা সারছি, এই ফাঁকে পালিও। বেশি সময় পাবে না কিন্তু।”
অভয় ঘাড় নাড়ল।
রেমো শব্দ করে একটা হাই তুলল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, “ও অক্ষয়, মকর নন্দীর জমিটা কি কিনছো নাকি? মকর একটা খবর পাঠিয়েছে। বলব?”
অক্ষয় ভাতভর্তি মুখেই উঁচু গলায় বলল, “বলবে না মানে! কতকাল ধরে জমিটার ওপর নজর আমার! এসো এসো, খবরটা বলে যাও।”
“যাব তো, কিন্তু ডাকাতটা আবার এই ফাঁকে পালাবে না তো?”
“আরে না। ওর হাড়গোড় কি আর আস্ত রেখেছি নাকি, তার ওপর আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। পালাবে না। তুমি এসে খবরটা বলল।”
“যাই।” বলে যেন অনিচ্ছের সঙ্গেই রেমো উঠে গেল। চাপা গলায় বলে গেল, “এই সুযোগ কিন্তু আর আসবে না।”
সুযোগ বলতে সুযোগ! একেবারে সুবর্ণ সুযোগ। হ্যাঁচকা টান মারলেই বাঁধন খুলে যাবে। কিন্তু হ্যাঁচকা মারবার ক্ষমতাটুকুও যে অভয়ের নেই। তার আদরের শরীরের ওপর দিয়ে আজ যা ঝড় গেল!
বার কয়েক হ্যাঁচকা মারার চেষ্টা করে দেখল অভয়। হচ্ছে না। বরং সেই পরিশ্রমে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু বাঁচতেও তো হবে! হাতে বেশি সময় নেই। দূরে যেন লোকজনের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। কারা আসছে বুঝি!
অভয় প্রাণ হাতে করে শরীরে একটা মোচড় দিল। তারপর দুটো।
তিনবারের বার বাঁধন খুলে সে হড়াস করে পড়ে গেল বারান্দা থেকে উঠোনে। পড়ার ধাক্কাটা সামলে সে আর দাঁড়ানোর চেষ্টা করল না। হামাগুড়ি দিয়ে কচুবনের দিকে এগোতে লাগল।
চার-পাঁচজন লোক হল্লা করতে করতে উঠোনে ঢুকে পড়েছে। মুখ ফিরিয়ে দৃশ্যটা দেখেই অভয়ের শরীরে যেন দূননা বল এল।
প্রবল বেগে হামা দিতে দিতে সে কচুবনে ঢুকে পড়ল, তারপর উঠে দাঁড়াল। রেমো পথের কথা বলেছিল, কোথায় পথ? সামনে বুকমান আগাছা আর অন্ধকার। পথ নয় বটে, তবে বিপদে পড়লে সব আঘাটাই পথ।
অভয় কাঁদছিল, জীবনে এত হেনস্থা, অপমান আর লাঞ্ছনা তাকে কেউ কখনও করেনি। এত মারধর জীবনে খায়নি। এত পরিশ্রমও জীবনে করতে হয়নি। নিজের জন্য আজ তার বড় কষ্ট হচ্ছে। বেঁচে থাকায় আর কী লাভ?
তবু জৈব তাগিদে সে চলতে লাগল। শীত, কুয়াশা, অন্ধকার, জঙ্গল, তবু চোখের জল মুছতে মুছতে অভয় এগোচ্ছে। দৌড়নোর মতো অবস্থা তার নয়। একটু পেছনে দূরে চেঁচামেচি আর ছোটাছুটির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকগুলো মশাল জ্বলে উঠে আগাছার জঙ্গলেও আলোর আভা এনে ফেলল। কিছু মানুষ যে তার খোঁজে পিছু নিয়ে আসছে তাও টের পেল অভয়। কিন্তু তবু তাড়াহুড়ো করল না। যা হওয়ার হবে। মরবে? তা না হয় মেরেই ফেলুক। এর চেয়ে মরাটা আর এমনকী বেশি?
ক্রমে-ক্রমে চারদিকে উঁচু-উঁচু গাছ দেখা দিতে লাগল। অন্ধকার আরও ঘন হতে লাগল। পেছনের কোলাহল থেমে গিয়ে চারদিক ভীষণ নির্জন হয়ে গেল। অভয় বুঝতে পারল যে, আবার মনসাপোঁতার জঙ্গলে ফিরে এসেছে। সভয়ে দাঁড়িয়ে সে চারদিকটা দেখল। অন্ধকার ছাড়া অবশ্য দেখার কিছু নেই। আর কুয়াশাও বড্ড ঘন। নিজের হাতখানা পর্যন্ত ঠাহর হয় না। রাতচরা একটা পাখি টি-হিট করে ডেকে উঠল। শেয়ালের ঝাঁক হাসল তাদের অট্টহাসি। একটা বুনো জানোয়ার খ্যাখ্যা করে যেন
অভয়কেই ভ্যাঙাল।
অভয় সামনের দিকে পা বাড়াতেই চমকে উঠে শুনল, তার
পেছনে যেন কেউ হাই করে একটা শ্বাস ছাড়ল।
“কে?” কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে অভয়।
কেউ জবাব দেয় না। কিন্তু অভয় আবার এগোতেই পেছনে আবার হাই-হাই-হাই শব্দ হতে লাগল। অভয় চলা ছেড়ে ছুটতে লাগল। পেছনে হাই-হাই শব্দটাও সমান বেগে তেড়ে আসছে। গাছপালা ক্রমে ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে, ঝোঁপঝাড় লতাপাতায় পথ এত দুর্গম যে, এগনো যাচ্ছে না। অভয় বারবার আছাড় খাচ্ছে, কিন্তু ঝোঁপঝাড়ের ওপর পড়ায় তেমন ব্যথা পেল না। তবে দুবার দুটো গাছের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ হল তার। তাতে ব্যথা পেলেও তার শরীরে ইতিমধ্যেই এত ব্যথা জমা হয়েছে যে, তার তুলনায় এব্যথা নস্যি।
একটা ঘন ঝোঁপ পেরিয়ে হঠাৎ সামনে আলো দেখতে পেল অভয়। তেমন জোরালো আলো নয়। ভারী মোলায়েম মিঠে নীলচে একটা আভা। পেছনে হাই-হাই শব্দটা থেমেছে।
বিপদ কি তা হলে কাটল? সামনে কি কারও বাড়ি-টাড়ি আছে?
একটু বাদেই ভুল ভাঙল। বাড়ি নয়, সামনে একটু ফাঁকা গোল জায়গা। সেখানে কোথা থেকে যেন নীলচে একটা আলো এসে পড়েছে।
তারপর অভয় যা দেখতে পেল তাতে গায়ের রক্ত জল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ফাঁকা জায়গাটায় একটা অস্বাভাবিক লম্বা লোক দাঁড়িয়ে আছে। খালি গা, গলায় পৈতে, সাদা ধবধবে লোকটার গায়ের রং। মাথায় জটা রয়েছে। পরনে শুধুমাত্র একটা লেংটি। হাতে একটা মুগুরের মতো জিনিস। ব্রহ্মদৈত্য!
লোকটা যেন অভয়ের জন্যই অপেক্ষা করছিল। নীলচে আলোয় একজোড়া কুদ্ধ চোখ যেন নীল আলোয় ছ্যাঁদা করে দিল অভয়কে।
লোকটা মুগুর তুলে অভয়ের দিকে এগিয়ে আসতেই অভয় দুহাত ওপরে তুলে “বাবা গো! মেরে ফেললে!” বলে চেঁচিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
ব্রহ্মদৈত্য তার মুগুরটা নামিয়ে অভয়ের কাছে এসে নিচু হয়ে মুখটা দেখল। তারপর জঙ্গলের দিকে চেয়ে বজ্রগম্ভীর স্বরে হাঁক দিল, “কালু, এদিকে আয়।”
জঙ্গল কুঁড়ে একটা কালোমতো মজবুত চেহারার লোক বেরিয়ে এল, হাতে টর্চ।
ব্ৰহ্মদৈত্য বলল, “একে চিনিস? ভাল করে মুখটা দেখ দিকি।”
কালু টর্চ জ্বেলে মুখটা দেখে নিয়ে বলল, “আজ্ঞে না। এদিককার লোক নয়। কোথা থেকে এসে পড়েছে।”
ব্রহ্মদৈত্য মাথা নেড়ে বলল, “এর অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না। খুব মারধর করেছে কেউ, গায়ে দাগড়া-দাগড়া কালশিটে। কিন্তু মুখ দেখে একে আমার খারাপ লোক মনে হচ্ছে না।”
“আমারও তাই মত।”
“তা হলে একে তুলে ডেরায় নিয়ে চল। বাঁচাতে হবে।”
কালু অত্যন্ত বলবান মানুষ। সে অভয়কে অনায়াসে তুলে একখানা চাঁদরের মতো কাঁধে ফেলে নিয়ে একটা শুড়িপথ দিয়ে এগোল। ব্রহ্মদৈত্য ফাঁকা জায়গাটার দুধারে দুটো ঝোঁপের আড়ালে রাখা দুটো স্পটলাইট নিবিয়ে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে কালুকে অনুসরণ করল।
গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি। অন্ধকার, সামনের দিকটায় বিকট ধ্বংসস্তূপ। সেটা পেরনো বেশ কষ্টকর। কারণ, পুরনো কড়ি-বরগা, বিম, থাম, রাবিশ সব
পাকার হয়ে আছে। সেটা পেরিয়ে একটু পরিচ্ছন্ন জায়গা। কয়েকটা বড়বড় খাঁচা আছে। জীবজন্তুর খাঁচা। একটা হায়েনা খাঁচার ভেতর থেকে হেসে উঠল। গরর শব্দ করে উঠল অন্য খাঁচা থেকে একটা নেকড়ে। ব্ৰহ্মদৈত্য বা কালু, কেউ অবশ্য ভূক্ষেপ করল না।
বাড়ির পেছনের দিকটা একটা আলাদা মহল। সেটার অবস্থা কিছু খারাপ নয়। অবশ্য যথেষ্ট পুরনো হয়েছে এবং মেরামতি হয়নি।
একটা ঘরে কেরোসিনের বাতি জ্বলছিল। একটা খাঁটিয়া পাতা। সেখানে এনে অভয়কে খাঁটিয়ায় শুইয়ে দিল কালু। গায়ে কম্বল চাপা দিল।
ব্রহ্মদৈত্য অভয়ের নাড়ি দেখে গম্ভীর মুখে বলল, “একটু গরম জলে অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে নিয়ে আয়। আর টেটভ্যাক, আমি চট করে পাঁচন তৈরি করে আনছি।”
নিঃশব্দে দু’জন মানুষ অভয়কে বাঁচাতে যন্ত্রের মতো কাজ করে যেতে লাগল।
ভোরের দিকে যখন ঘুম ভাঙল অভয়ের, তখন তার মনে হল, সারারাত সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। যা ঘটেছে তা সত্য নয়। কিন্তু চোখ চেয়ে ভোরের আবছা আলোয় সে যা দেখতে পেল তাও তার সত্য বলে মনে হল না। সে কি এখনও স্বপ্ন দেখছে? সে একখানা ঘরে খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে কিন্তু এরকম তো হওয়ার কথা নয়! এ ঘর তার চেনাও নয়। সে চোখ বুজে ফেলল। গায়ে এখনও অসহ্য ব্যথা, মাথা ধরে আছে। তবু অভয় উঠে বসতে পারল। খাঁটিয়া এবং গায়ে কম্বল দেখে সে আরও অবাক। এত যত্নআত্তি তার কে করল?
আগের দিনের ঘটনা ধীরে-ধীরে সবই তার মনে পড়ে গেল। সকাল থেকে সন্ধে অবধি তাকে অমানুষিক কষ্ট আর নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। দানাপানি জোটেনি, তার ওপর ওই মার? এ সত্ত্বেও যে সে বেঁচে আছে সেটাই অবাক কাণ্ড। শুধু বেঁচেই নেই, গায়ে ব্যথা-বেদনা সত্ত্বেও সে অনেকটা হালকা আর সুস্থ বোধ করছে।
অভয় গায়ের কম্বলটা সরিয়ে ধীরে-ধীরে খাঁটিয়া থেকে নেমে মেঝের ওপর দাঁড়াল। ঘরটা বেশ বড়। বহু পুরনো বাড়ি বলে দেওয়ালের চাপড়া অনেক জায়গাতেই খসে গেছে। উঁচু সিলিং। বেশ বড় বড় দুটো ভোলা জানলা দিয়ে ভোরের আবছা আলোতে বাইরের নিবিড় জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। সে কি এখনও মনসাপোঁতার জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে? এবাড়ি এখানে এল কোত্থেকে? এখানে কারা থাকে?
কাল রাতের ব্রহ্মদৈত্যের কথা মনে পড়ায় সে একবার শিউরে উঠল।
অভয় ঘরের একমাত্র দরজাটা ভয়েভয়ে একটু ঠেলল। ভেজানো দরজা মচমচ শব্দে খুলে যায়। দরজার ওপাশে একটা বেশ লম্বা দরদালান। দরদালানে পা দিয়ে দেখতে পেল, আশপাশে আরও দু-তিনটে ঘর রয়েছে। দরদালানের দরজা খুলে বেশ বড় উঠোনের মতো দেখতে পায় অভয়। উঠোনে পাঁচ-সাতটা জীবজন্তুর খাঁচা। তাতে হিংস্র চেহারার কয়েকটি পশু রয়েছে। নেকড়ে বাঘটাকে চিনতে পারল অভয়, হায়েনাটাকে চেনা-চেনা মনে হল। বাদবাকিগুলো সম্পর্কে তার উৎসাহ রইল না। কে পোষে এগুলো? উঠোনের ওপাশে ধ্বংসস্তূপ।
অভয় একটা বিচ্ছিরি পশুর ডাক শুনতে পেয়ে চমকে দরদালানে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই কে যেন বজ্রগম্ভীর গলায় বলে উঠল, “বাঃ, এই তো আমার ওষুধে দিব্যি কাজ হয়েছে।”
মুখ ফিরিয়ে ব্রহ্মদৈত্যকে দেখেই আঁ-আঁ করে ওঠে অভয়।
ব্রহ্মদৈত্য হাসিমুখে বলে, “চেঁচিও না বাপু, ভয়ের কিছু নেই, আমি ব্ৰহ্মদৈত্য নই, মানুষ।”
অভয় এরকম দীর্ঘকায় মানুষ জীবনে দেখেনি। কত লম্বা হবে। লোকটা? সাত ফুট বা আট ফুট নয় তো!
লোকটা যেন অভয়ের মনের কথা পড়ে নিয়ে বলল, “আমার হাইট দেখছ? তা মন্দ নয়। ছ ফুট সাত ইঞ্চি। প্ল্যাটফর্ম শু
আর টপ হ্যাঁট পরলে সাত ফুটের ওপর।”
অভয় গলা-খাঁকারি দিয়ে সভয়ে বলল, “আপনি কে? আ-আমি বড় ভয় পাচ্ছি।”
“লম্বা লোককে ভয় কী?”
“আ-আপনি সত্যিকারের মানুষ তো!”
“হ্যাঁ। সত্যিকারেরই। তবে মাঝে-মাঝে ব্ৰহ্মদৈত্য সাজতে হয় আর মানুষজনকে চোরাগোপ্তা মারধরও করতে হয়। নইলে ভগবানের দান এই জঙ্গল কি বাঁচাতে পারতুম! আহাম্মক লোকগুলো গাছ কেটে আর জন্তু মেরে নিকেশ করছিল।”
“আপনি এখানেই থাকেন?”
“হ্যাঁ। এটাই আমার ডেরা বলতে পারো।”
“আপনি কি বাঙালি?”
লোকটা সবেগে মাথা নেড়ে বলে, “না হে বাপু। গায়ের রং দেখছ না? আমি ঘোর ইউরোপিয়ান। সুইডেনে বাড়ি। ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার আকর্ষণে চলে এসেছিলাম বছর দশেকআগে। সেই থেকে রয়ে গেছি।”
“আপনি কি সাধু?”
“সাধু হতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে বাপু, ভণ্ড নই। যা করার তা প্রাণপণ করি। একশো পারসেন্ট। তোমার দেশের লোকগুলো বড় লোভী। আহাম্মক আর অদূরদর্শী। বন-জঙ্গল, গাছপালার প্রতি কোনও মায়া নেই। যখন-তখন ইচ্ছেমতো গাছ কেটে চারদিক ন্যাড়া করে দেয়। পশুপাখিও মারে নির্বিচারে। সেইটে বন্ধ করতে পেরেছি বলে আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।”
“আপনি এখানে এলেন কী করে? এই জায়গাতেই বা রয়েছেন কেন?”
“ঘুরতে-ঘুরতে চলে এলুম। সাধুদের তো পরিক্রমা করতেই হয়। এ-জায়গাটা ভালও লেগে গেল। সাধন-ভজনের পক্ষে ভাল জায়গা। তবে সাধু দেখে লোকেরা এসে বড্ড বিরক্ত করত। হাত দেখতে বলে, কোষ্ঠী বিচার করতে বলে, জলপড়া চায়, রোগ সারানোর বায়না করে। তিতিবিরক্ত হয়ে শেষে জঙ্গলে ঢুকে আত্মরক্ষা করলুম।”
“আপনি যে কী চমৎকার বাংলা বলেন!”
“কেন কইব না বাপু? আমার গুরু যে বাঙালি। তোমাদের ভাষাটিও ভারী মিষ্টি, শিখতে আমার কষ্ট হয়নি। এবার তোমার কথা শোনা যাক। তুমি কে? কী করে এখানে এলে? মারধরই বা খেলে কেন?”
অভয় ধীরে-ধীরে সংক্ষেপে সবই বলল। খুনের মামলায় সাক্ষী দেওয়া থেকে শুরু করে ব্রহ্মদৈত্য অবধি।
ব্ৰহ্মদৈত্য মাথা নেড়ে বললেন, “তোমাকে চোরাশিকারি মনে করে আমার শাগরেদ কালু ভয় দেখাতে ওই হাই-হাই আওয়াজ করতে করতে তাড়িয়ে আনছিল। কালু হচ্ছে হরবোলা। আমিও তোমাকে মুগুরপেটা করতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তোমার অবস্থা দেখে আর সেটা করিনি। ওই গ্রামের লোকগুলোর ওপর তোমার নিশ্চয়ই খুব রাগ হচ্ছে! কিন্তু ওদের খুব দোষ নেই। এখানে খুবই ডাকাতের উৎপাত। পুলিশ কিছুই করতে পারে না। ঠাকুরের দয়ায় তুমি বেঁচে গেছ। এখন কি শরীরে একটু জোর পাচ্ছ বাপু?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“তা হলে আমার ওষুধে ভালই কাজ হয়েছে। কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলি। শরীরটাকে এত অবহেলা করছ কেন? তোমার বয়স তো ছাব্বিশ-সাতাশের বেশি নয়, এই বয়সে ওরকম থলথলে চেহারা কেন হবে? শরীর থলথলে হলে মানুষ ছুটতে পারে না, পরিশ্রম করতে পারে না, রোগভোগও দেখা দেয়। তুমি বোধ হয় খেলাধুলো বা ব্যায়াম করো না?”
অভয় লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে বলল, “আজ্ঞে না।”
ব্রহ্মদৈত্য বললেন, “ঠিক আছে, কয়েকদিনের মধ্যেই আমি তোমাকে শক্তপোক্ত করে দেবো। এখন আমার সঙ্গে ভেষজাগারে এসো, তোমার জন্য কয়েকটা পাতার রস করে রেখেছি। একটু তেতো লাগবে, কিন্তু মহা উপকার।”
ব্রহ্মদৈত্য অভয়কে যে ঘরটায় নিয়ে এলেন সেটা রীতিমত একটা ল্যাবরেটরি-বিশেষ। বকযন্ত্র থেকে শুরু করে বুনসেন বানার অবধি আছে। চারদিকে দেওয়ালের তাকে হরেকরকম ছোটবড় কাঁচের শিশি ও জারে নানারকম তরল পদার্থ রয়েছে। ব্রহ্মদৈত্য একটা ছোট্ট গেলাসে খানিকটা তরল জিনিস দিলেন। ঘন সবুজ রং।
অভয় সভয়ে বলে, “কী আছে এতে?”
“থানকুনি, কুলেখাড়া, কালমেঘ, পাথরকুচি আর আরও কয়েকটি পাতা। নির্ভয়ে খাও। এর পর আরও চিকিৎসা আছে।”
অভয় ওষুধ খাওয়ার পর ব্রহ্মদৈত্য তাকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে এলেন। মেঝের ওপর মাদুর আর তার ওপর শতরঞ্চি পাতা, ব্রহ্মদৈত্য বললেন, “এবার কয়েকটা যোগ আবো। গায়ের ব্যথা উবে যাবে।”
অভয় জীবনে কখনও ব্যায়াম করেনি বলে ভয় পাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু ব্ৰহ্মদৈত্য তাকে এত ধীরে-ধীরে এবং সুকৌশলে নানারকম যোগাসন করিয়ে নিলেন যে, তার তেমন কোনও কষ্ট হল না। বরং বেশ আরাম লাগতে লাগল। সবশেষে কিছুক্ষণ শবাসন করিয়ে বললেন, “যাও এবার বিশ্রাম। আধঘণ্টা পর কিছু খেয়ে নিতে হবে। পেছনদিকে কুয়ো পাবে, খুব ভাল জল, স্নান করে নাও। তোমার জন্য ধুতি আর গামছা দরদালানে রাখা আছে।”
ঘণ্টাখানেক বাদে স্নান করে দই-চিড়ে খেয়ে যখন অভয় উঠল তখন তার শরীর ঝরঝরে হয়ে গেছে। মনটাও খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে ইচ্ছে করলে সে এখন বেশ হাঁটাচলা এবং খানিকটা দৌড়ঝাঁপও করতে পারে। তারপর সে কৌতূহলী হয়ে ব্রহ্মদৈত্যকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, উঠোনে খাঁচার মধ্যে যেসব জীবজন্তু দেখছি ওদের কি আপনি পোষেন?”
“তা বলতে পারে। তবে ইচ্ছে করে পুষিনি। জঙ্গলের প্রাণীরা নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। তীর-ধনুক, বল্লম, বন্দুক দিয়ে একেবারে পশুমেধ শুরু করেছিল লোকে। আমি যে কটাকে পেরেছি বাঁচিয়েছি। রাত্রিবেলা খাঁচাতেই থাকে। একটু বেলা হলে ছেড়ে দিই। সময়মতো ওরা ফিরেও আসে।”
ব্ৰহ্মদৈত্য ঘুরে-ঘুরে তাকে জায়গাটা দেখাচ্ছিলেন। চারদিকে একটা বেশ নিবিড় লতাপাতার প্রতিরোধ আছে। ঘর বাঁশবনও রয়েছে। ব্রহ্মদৈত্য বললেন, “এটা প্রায় দুর্গের মতো জায়গা। বাইরে থেকে এ বাড়িটা দেখাও যায় না, দুম করে এসে হাজিরও হওয়া যায় না। ফলে নিরিবিলিতে ভালই থাকি। মনে হয় কোনও দেশী জমিদার বাড়ি বানিয়েছিল, তখন হয়তো বসতিও ছিল এখানে। এখন সবই হেজেমজে গেছে।”
অভয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, শুখানালা বলে কোনও জায়গা আছে এখানে?”
ব্ৰহ্মদৈত্য যেন একটু চমকে উঠে বললে, “শুখানালা? কেন, শুখানালা দিয়ে কী হবে?”
অভয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “কী আর হবে! ওই শুখানালায় আমাদের আদি বাড়ি ছিল। এখন নিশ্চয়ই কিছু নেই। তবে জায়গাটা একবার চোখে দেখতে পেলে ভাল লাগত।”
দুটো দীর্ঘ শক্তিমান হাত অভয়ের দু কাঁধে রেখে ব্ৰহ্মদৈত্য গম্ভীর মুখে অভয়ের দিকে চেয়ে গাঢ় স্বরে বললেন, “তোমার পদবি তো সরকার? বাই চান্স তুমি শুখানালার সরকারদের বংশধর নও তো?”
অভয় বলল, “হ্যাঁ, আমি সরকার বাড়িরই ছেলে। তবে এখানে কখনও আসিনি।”
ব্রহ্মদৈত্য বললেন, “তুমি ছাড়া বোধ হয় সরকারদের আর কোনও বংশধর নেই। শোনন, সব রহস্য তোমার কাছে খুলে বলা যাবে না। কিন্তু এই জঙ্গল ধরে যদি উত্তরদিকে যাও তবে খানিকদূর গিয়ে একটা শুকনো নালার মতো খাত পাবে। মনে হয় কোনও কালে ওটা নিকাশি খাল ছিল। ওইটে ধরে যদি এগোও তা হলে শুখানালায় পৌঁছনো কঠিন নয়। কিন্তু, সব ব্যাপারেই একটা মস্তবড় কিন্তু আছে।”
“কেন বলুন তো!”
“সেটা বললেও তোমার বিশ্বাস হবে না। তবে যদি তুমি বাস্তবিকই সরকারদের বংশধর হয়ে থাকে, তা হলে তোমার হয়তো ভয় নেই।”
উৎকণ্ঠ অভয় বলে, “ভয়ের কথা উঠছে কেন? ভয়ের জিনিস আমি মোটেই ভালবাসি না।”
“কেউই বাসে না বাবা। তবে শুখানালার ধারে কাছে লোকে যায় না।”
“আপনিও না?”
“আমার কথা বাদ দাও। আমার অগম্য স্থান কমই আছে।”
হাঁটতে-হাঁটতে যখন ধ্বংসস্তূপটার কাছে এসে পড়েছে তারা, তখন হঠাৎ একটা ভারী মিষ্টি পাখির ডাক শোনা গেল। অভয় উৎকর্ণ হয়ে শুনল, পাখির ডাক সে বড় একটা শুনতে পায় না। বলল, “আচ্ছা, এ কি দোয়েল পাখি ডাকছে?”
ব্ৰহ্মদৈত্য সামান্য ভ্রূ কুঁচকে বলেন, “না, ও হচ্ছে কালু।”
“কালু কে বলুন তো?”
ব্রহ্মদৈত্য হেসে বললেন, “কালুও একদিন মানুষের নিযাতনে পালিয়ে এসেছিল ডাকাতের দল গড়বে বলে। বিহারের গাঁয়ে ওর বাড়ি। কাজেই নিচু জাত বলে রাজপুতরা খুব অত্যাচার করত। বাড়ি জ্বালিয়ে, চাষের খেত কেড়ে নিয়ে সে অনেক কাণ্ড। মরতে-মরতে ছোঁকরা বেঁচে যায়। মতলব ছিল ডাকাতের দল গড়ে নিয়ে প্রতিশোধ নেবে। আমিই সেটা ঠেকাই। এখন
আমার কাছেই থাকে।”
“ভারী সুন্দর শিস দেয় তো?”
“তোমার ভাল লাগছে শিসটা? আমার লাগছে না। কারণ, ওই শিসের একটা বিশেষ অর্থ আছে। কালু জানান দিচ্ছে যে, জঙ্গলে কিছু বাইরের লোক ঢুকেছে এবং তারা ভাল লোক নয়। তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। সংখ্যায় তারা চারজন।”
অভয়ের মুখ একথা শুনে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে একটু কাঁপা গলায় বলল, “সর্বনাশ! এরা তো বোধ হয় পানু মল্লিকের দল।”
ব্রহ্মদৈত্য চিন্তিত মুখে অভয়ের দিকে চেয়ে বলেন, “তাই। হবে। কারণ, স্থানীয় লোকদের কুসংস্কার আছে। তারা এ-জঙ্গলে ঢুকবে না।”
“এখন তা হলে কী হবে?”
“ভয় পেও না। ভয় পেতে নেই। বিপদের সময় ভয় পেলে বুদ্ধি ঘুলিয়ে যায়, আর বুদ্ধি ঘুলিয়ে গেলে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন।”
“এদের ব্রহ্মদৈত্যের ভয় দেখালে হয় না?” ব্রহ্মদৈত্য একটু হেসে মাথা নেড়ে বলেন, “সরল সোজা গ্রামবাসী হলে হত। কিন্তু এরা বোধ হয় পেশাদার খুনি। অত সহজে দমবার পাত্র এরা নয়। তা ছাড়া এরা মরিয়া, তুমি বেঁচে থাকলে এদের বিপদ।”
কাঁদো-কাঁদো হয়ে অভয় বলে, “তা হলে এখন আমি কী করব?”
“চিন্তা কোরো না। ওরা খুব সহজে এ-জায়গা খুঁজে পাবে না। তবে খুব বেশিক্ষণও লাগবে না। হয়তো দুপুরের দিকে ওরা ঠিকই খুঁজে-খুঁজে চলে আসবে এখানে। ততক্ষণে চলো, তোমাকে আর-একবার পাঁচন খাইয়ে দিই। গায়ে একটু বল পাবে। আরও একটা কথা আছে। তোমার মাথার বাঁদিকটা ওরা কামিয়ে দিয়েছে, ডানদিকটাও কামিয়ে নাও। আমার কাছে ভাল ক্ষুর আছে, চলো।”
তাই হল। ব্রহ্মদৈত্য তাকে আরও একটা বিকট স্বাদের পাঁচন খাওয়ালেন। তারপর মাথাটা পুরো ন্যাড়া করে দিলেন। তারপর গরম-গরম ডালভাত আর কচুসেদ্ধ খাইয়ে দিয়ে বললেন, “দুপুর প্রায় হয়ে এল। এবার তোমাকে এ-জায়গা ছাড়তে হবে। আমার অনুমান, চারটে খুনি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এদিকে এসে পড়বে। পেশাদার গুণ্ডাদের হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার নেই। কাজেই তোমাকে পালাতে হবে।”
অভয় হাতজোড় করে বলল, “কোথায় যাব?” ব্রহ্মদৈত্য চিন্তিত মুখে বলেন, “আমি তো একটা ছাড়া অন্য উপায় দেখছি না।”
“সেটা কী?”
“শুখানালা। তোমাদের আদি বাড়ি। উত্তরদিকে যেমন বলেছি তেমনই এগিয়ে যাও। একটা নাম মনে রেখো, ভীম সরকার। এখন পালাও।”
অভয় পালাল।