অধ্যাপক ত্রিবেদী ও খেলোয়াড় গদাই
কলকাতার কাছে গোলাপ কলোনি নামে এক শহরতলিতে এসে অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী এক আশ্চর্য-গাছ আবিষ্কার করেছেন। ওই গাছের পাতা চিবিয়ে খেলে শরীরে অসাধারণ শক্তির সঞ্চার হয় বটে, কিন্তু পূর্বোক্ত আশ্চর্য-পাতার ভেষজ গুণ চিরস্থায়ী কিনা, অথবা সাময়িকভাবে স্থায়ী হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ, এবিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেননি অধ্যাপক ত্রিবেদী।
তিনি যেখানে থাকেন, সেই গোলাপ কলোনির সঙ্গে বাগনান ক্লাবের কপাটি-প্রতিযোগিতা শুরু হতে আর বিশেষ দেরি নেই, কিন্তু প্রধান খেলোয়াড় মুকন্দ ওরফে বাঘা মকলের অনুপস্থিতি গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়দের ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গিতে বোঝা যায় বাঘা মুকুন্দের ব্যাঘ্রবৎ বিক্রমের সহায়তা না পেলে গোলাপ কলোনিকে যে পরাজয়ের কলঙ্ক বহন করতে হবে এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই।
পল্টু নামে গোলাপ কলোনির এক খেলোয়াড় বলল, চারটে বাজতে আর দেরি নেই। চারটে থেকে খেলা শুরু। মুকুন্দ না এলে তো মহা মুশকিল।
মুশকিল তো বটেই, দলের ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বলল, তবে খেলা বন্ধ রাখা যাবে না। মুকুন্দ না এলে তাকে বাদ দিয়েই আমাদের খেলতে হবে। কিন্তু ও আসছে না কেন? আমাদের ক্লাবকে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, ওকে বাদ দিয়ে খেললে আমরা যে হারব, একথাও সে জানে– তবে? তবে কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল?
হতে পারে, বলাই নামে আর একটি খেলোয়াড় মন্তব্য করল, মুকুন্দ যা কাঠ-গোঁয়াড়, কোথায় হয়তো মারামারি বাধিয়ে বসেছে। রাগলে তো হতভাগার জ্ঞান থাকে না।
সেটাই সম্ভব, উদ্বিগ্নকণ্ঠে শশাঙ্ক বলল, নিশ্চয় কারও সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছে। নইলে আজকের ম্যাচে সে নিশ্চয়ই হাজির থাকত।
অত ভাবছ কেন ক্যাপ্টেন? একটি বেঁটেখাটো বলিষ্ঠ চেহারার খেলোয়াড় এগিয়ে এল, মুকুন্দের উপর আমরা বড়ো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এটা ঠিক নয়। আমরা কি খেলতে জানি না? মুকুন্দ না খেললে হেরে যাব এটা কেমন কথা?
তোর দম আছে, জোর আছে, খেলিসও ভালো স্বীকার করছি, আর একজন খেলোয়াড় বলে উঠল, কিন্তু মদন, গদাইকে তুই সামলাতে পারবি?
তা-তা-হ্যাঁ, এটাই তো সমস্যা, শুকনো মুখে মদন বলল, গদাইকে নিয়েই তো ভয়। মুকুন্দ ছাড়া আর কেউ গদাইকে সামলাতে পারে না।
বাগনান ক্লাবের তরফ থেকে একজন হেঁকে বলল, ওহে শশাঙ্ক, চারটে তো বাজল– এইবার মাঠে নেমে পড়া যাক, কি বলো?
যে খেলোয়াড়টি হাঁক দিল তার চেহারাটা সত্যি দেখার মতো। তার লম্বা-চওড়া প্রকাণ্ড দেহের সর্বত্র খেলা করছে মাংসপেশীর তরঙ্গ, আর সেই অতিশয় দর্শনীয় দেহের ভারসাম্য রেখে দুই গালের শোভা বর্ধন করছে বিশাল চাপদাড়ি এবং ঠোঁটের উপর একজোড়া ঘন কালো গোঁফ! মাথার চুল ঢেকে বাঁধা রয়েছে একটা রঙিন বুটিদার রুমাল খেলার সময়ে চুলগুলো যাতে মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দৃষ্টিকে না ব্যাহত করে, সম্ভবত সেইজন্যেই রুমালের শাসন। দুই পক্ষের খেলোয়াড়দের মধ্যে তার চোহরাই সর্বপ্রথম দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম গদাই, যাকে নিয়ে গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়দের এত দুশ্চিন্তা।
গদাই-এর হাঁক শুনে গোলাপ কলোনির ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বলল, মুকুন্দ এখনো আসেনি। গদাই, আমরা তার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
হ্যাঁ, মুকুন্দ না থাকলে খেলাটা তেমন জমবে না, গদাই তার অভিমত জানাল, আমরা ওর জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
আমিই রাজি নই, মধ্যস্থ অনিলবাবু তার কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, চারটে বেজে পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। এবার ম্যাচ শুরু করতেই হবে।
মধ্যস্থের কথার উপর কথা চলে না। উভয়পক্ষের সমর্থক ও দর্শকদের প্রবল উত্তেজনার মধ্যে খেলা শুরু হল…
কিছুক্ষণ খেলা চলার পর দেখা গেল গোলাপ কলোনির অবস্থা কাহিল। দৈত্যাকৃতি গদাই যেন একাই একশো! সে দান দিতে এলে তিন-চারজন মিলেও তাকে ধরে রাখতে পারে না অপরপক্ষের কোনো খেলোয়াড় বাগনান ক্লাবের সীমানার মধ্যে হানা দিতে এসে দৈবাৎ যদি গদাই এর কবলে ধরা পড়ে, তাহলে নিজেকে ছাড়িয়ে আনার ক্ষমতা তার হয় না, সেইখানেই তার খেল খতম!
মধ্যবর্তী বিরতির সময়ে দেখা গেল গোলাপ কলোনির সাতজন খেলোয়াড়ের মধ্যে পাঁচজনরেই মোড় হয়েছে, অর্থাৎ বসে পড়েছে। মুকুন্দকে বাদ দিলে ওই দুজনই গোলাপ কলোনির সেরা খেলোয়াড়, কিন্তু উভয়পক্ষই বুঝে গেছে আবার খেলা আরম্ভ হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পূর্বোক্ত দুই খেলোয়াড় বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।
গোলাপ কলোনির পক্ষে দুজন খেলোয়াড় এখনও কোনোরকমে পরাজয় ঠেকিয়ে রেখেছে, কিন্তু বিরোধীপক্ষ বাগনান ক্লাবে এখনও সক্রিয় হয়ে অবস্থান করছে পাঁচজন খেলোয়াড়–মোড় হয়েছে মাত্র দুজন।
..খেলার মধ্যবর্তী বিরতির নিদিষ্ট পনের মিনিট পেরিয়ে গেল, মধ্যস্থ আবার খেলা শুরু করার নির্দেশ দিতে যাবেন- এমন সময়ে হঠাৎ শোনা গেল বহুকণ্ঠের উল্লসিত কোলাহল, মুকুল এসেছে! মুকুন্দ এসেছে!
সচমকে কোলাহল লক্ষ্য করে চোখ ফেরাতেই ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক আর মদন দেখতে পেল খেলার মাঠে উপস্থিত হয়েছে মুকুন্দ। কিন্তু এ কী দৃশ্য!–সাইকেলে সামনের রডে বসে আছে মুকুন্দ এবং যথাস্থানে আসন গ্রহণ করে তিরবেগে সাইকেল চুটিয়ে আসছেন অত্যন্ত রোগা ও দুর্বল চেহারার চশমাধারী এক বয়স্ক ভদ্রলোক।
ভদ্রলোকের চেহারা যেমনই হোক, লোকটা খুব দুর্বল নয়। শশাঙ্ক নিজের মনেই বলল, মুকুন্দর মতো যা চেহারার জোয়ানকে নিয়ে যে-লোক এত জোরে সাইকেল চালাতে পারে, তাকে দেখতে যত রোগাই লাগুক, আসলে মানুষটা খুব দুর্বল নয়।
ততক্ষণে একেবারে সামনে এসে পড়েছে মুকুন্দ। সাইকেল থামিয়ে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক, এগিয়ে এল মুকুন্দ ক্যাপ্টেনের সামনে। খুব গম্ভীর হয়ে মুকুন্দের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বলল, তোমার আর একটু দায়িত্বজ্ঞান থাকা উচিত ছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত যে এসে পড়েছ এটাই আশার কথা। আমাদের দলে এখন রয়েছি আমি আর মদন, সুতরাং আমাদের অবস্থা যে কতটা শোচনীয় তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। বাগনান ক্লাবের গদাইকে নিয়ে পাঁচজন খেলুড়ে মজুত। এখন মদনকে বসিয়ে ওর বদলে তুমি মাঠে নামবে। একবার চেষ্টা করে দেখি– তুমিই আমাদের শেষ ভরসা, মুকুন্দ।
না হে ক্যাপ্টেন, আমি খেলতে পারব না, মুকুন্দ বলল, আমার কোমরে সাংঘাতিক মচকে গেছে। আমার বদলে এই ভদ্রলোক ওহো, তোমার সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি এ হচ্ছে আমাদের ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক দত্ত, আর ইনি আমাদের পাড়ায় নবাগত অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী। হ্যাঁ, যা বলছিলাম আমার বদলে ত্রিবেদী স্যারই খেলবেন।
আমরা ভীষণভাবে হেরে যাচ্ছি, ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল শশাঙ্ক, এই সময় রসিকতা ভালো লাগে না, মুকুন্দ।
–আরে না, রসিকতা নয়। শোনো এই দিকে, তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি..
গোলাপ কলোনির সমর্থকদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, আমাদের ক্যাপ্টেন শশাঙ্ককে ডেকে নিয়ে মুকুন্দ কী এমন প্রাইভেট টক করছে রে! সঙ্গে আবার একটা রোগা-পটকা লোক।
-ওই তো সাইকেলে চাপিয়ে মুকুন্দকে নিয়ে এল। লোকটা পাড়ায় নতুন এসেছে। কোনো একটা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।
বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যেও উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে, ওরে গদাই, বাঘা মুকুন্দ এসে গেছে। এইবার সাবধানে খেলতে হবে।
গদাই-এর কপালে ভাঁজ পড়ল, কুঁচকে গেল ভুরু। মুকুন্দকে আমি ভয় পাই না। আমরা পাঁচজন আর ওরা মাত্র দুজন… আরে! ওদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে মনে হচ্ছে।
গদাই, দ্যাখ, বাগনান ক্লাবের এক খেলোয়াড় উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, মুকুন্দ খেলছে না। মুকুন্দের বদলে একটা রোগা-পটকা লোককে ওরা মাঠে নামাচ্ছে!… কী আশ্চর্য! উনি তো অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী, কলোনিতে নতুন এসেছেন।
গদাই অট্টহাস্য করে বলল, মুকুন্দই তো জোর করে লোকটাকে মাঠে নামাল মনে হচ্ছে। মুকুন্দটার মাথা খারাপ হল নাকি? ওই তালপাতার সেপাইকে তো ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে।
গোলাপ কলোনির পাঁচজন খেলোয়াড়ই মোড় হয়ে বসে পড়েছে। নিয়ম-অনুসারে বিরোধী দলের কোনো খেলোয়াড়কে ঘায়েল করতে পারলে নিজের দল থেকে দলপতির নির্বাচন অনুযায়ী একজন মোড় বা বসে-যাওয়া খেলোয়াড় আবার উঠে খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বিরোধী দলের পাঁচজন খেলোয়াড় যেখানে সক্রিয় আবার তাদের মধ্যে গদাই-এর মতো বিভীষিকাও যেখানে উপস্থিত সেইখানে মাত্র দুজনের পক্ষে গদাই সমেত আর চার-চারটি খেলোয়াড়কে বিধ্বস্ত করা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। তা-ও যদি মুকুন্দ খেলত, তাহলে যৎপরোনাস্তি ক্ষীণ হলেও একটু আশা ছিল কিন্তু মুকুন্দের পরিবর্তে অধ্যাপক মশাইকে মাঠে নামতে দেখে গোলাপ কলোনির সমর্থকরা একেবারেই হতাশ হয়ে পড়ল।
অন্যান্য খেলোয়াড়দের সমবেত আপত্তি তুচ্ছ করেই ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক ত্রিবেদীকে মাঠে নামাল। তার আগে অবশ্য শশাঙ্ককে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা চুপি চুপি জানিয়েছিল মুকুন্দ। অন্য খেলোয়াড়দের কাছে অবশ্য ব্যাপারটা সে চেপে গিয়েছিল। বাঘা মুকুন্দকে একটা লোক সজোরে আছাড় মেরেছে এটা তো গর্ব করে বলার বিষয় নয়– শশাঙ্ককে সব কথা খুলে না বললে সে ত্রিবেদীকে মাঠে নামাতে রাজি হত না বলেই তাকে আদ্যন্ত নিগ্রহের ইতিহাস খুলে বলতে বাধ্য হয়েছিল মুকুন্দ। ওই সঙ্গে অবশ্য অনুরোধ করেছিল আছাড় মারার লজ্জাকর ঘটনা যেন শশাঙ্ক গোপন রাখে।
বিস্মিত দৃষ্টিতে ক্ষীণকায় অধ্যাপক মশাইকে নিরীক্ষণ করতে করতে শশাঙ্ক বলেছিল, ভদ্রলোককে দেখলে তোমার কথা বিশ্বাস করা শক্ত, মুকুন্দ। তবে অধ্যাপক মশাই যে তোমার মতো গায়ে-গতরে ভারি মানুষকে নিয়ে বন্ বন্ করে সাইকেল চালাচ্ছিলেন, সেটা তো নিজের চোখেই দেখেছি। যাক তোমার কথামতো ভদ্রলোককে নামাচ্ছি। একটা এক্সট্রা জার্সি ছিল, কাজে লেগে গেল। এখন দেখা যাক কি হয়।
…চুউউ-ইই-কি-কিৎ-কিৎ, দম নিয়ে একজন বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড় দান দিতে ঢুকল গোলাপ কলোনির ঘরে। হঠাৎ নিচু হয়ে প্রায় ড্রাইভ দেওয়ার ভঙ্গিতে ঝাঁপ দিয়ে বিপক্ষের খেলোয়াড়টিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল শশাঙ্ক। তার চেষ্টা সফল হল না- বিপক্ষের খেলোয়াড় সজোরে ধাক্কা মেরে আলিঙ্গনে উদ্যত দুই হাতের বন্ধন এড়িয়ে গেল এবং তিরবেগে ছুটে নিরাপদ সীমানার খুব কাছে পৌঁছে গেল কয়েকমুহূর্ত পরেই খেলোয়াড়টি নিজের ঘরে পৌঁছে যাবে আর মোড় হয়ে বসে যাবে ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক! বাগনান ক্লাবের সমর্থকদের ভিতর থেকে একটা তীব্র উল্লাসধ্বনি উঠেই থেমে গেল তৎক্ষণাৎ, কারণ—
আচম্বিতে একটা গতির ঝড় যেন উড়ে এসেছে পলাতক খেলোয়াড়ের দিকে এবং মুহূর্তের মধ্যে একজোড়া পা সাঁড়াশির মতো তার কোমর পেঁচিয়ে তাকে ধরাশায়ী করে দিয়েছে!
ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক ধাক্কার চোটে ছিটকে পড়েছিল, এখন ভূমিশয্যা ত্যাগ করে সে ছুটে এল ত্রিবেদীকে সাহায্য করতে। কিন্তু শশাঙ্কর উদ্যম তখন বাহুল্য মাত্র, ত্রিবেদীর দুই সরু ঠ্যাং-এর যাঁতাকলে পড়ে খেলোয়াড়টির দম ফুরিয়ে গেছে নিজের সীমানায় ছুটে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না…
এতক্ষণ পরে গোলাপ কলোনির সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটল। নিয়ম-অনুযায়ী বাগনান ক্লাবের ধরা-পড়া খেলোয়াড় মোড় হয়ে বসে পড়ল এবং মোড় হয়ে বসে পড়া গোলাপ কলোনির দল থেকে একজন খেলোয়াড় খেলাতে অংশগ্রহণ করতে মাঠে নামল। গোলাপ কলোনির অবস্থা এখন আর অতটা শোচনীয় নয়– পাঁচ আর দুই-এর পরিবর্তে চার-এর বিরুদ্ধে তিন-এর লড়াই গোলাপ কলোনির খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার করল।
ত্রিবেদীর কীর্তি বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। একজন খেলোয়াড় গদাইকে উদ্দেশ করে বলল, ওরে গদাই, এ তো সাংঘাতিক খেলুড়ে– বর্ণচোরা আম! চোখে কানে দেখতে দিল না, ঝড়ের মতো উড়ে এসে কাঁচি মারল ঝংকার কোমরে! আরে ব্বাস রে বাস!
গদাই বলল, লোকটা চটপটে আছে। তবে আমার কাছে চালাকি চলবে না। আসুক একবার এইদিকে।
–ওরে গদাই, ওই লোকটাই যে দান দিতে আসছে রে!
আসুক। ঝট করে চেপে ধরলে আর নড়তে পারবে না। যতই চটপটে হোক, অত রোগা লোকের গায়ে জোর থাকে না। চেপে ধরলেই ফিনিশ… সাবধান ঝন্টু, ও আসছে।
ত্রিবেদী এলেন। এ আগমন নয়, আবির্ভাব!
বিদ্যুতের শিখা যেন সহসা প্রকাশ!চুকিৎ-কিৎ শব্দে দম নিতে নিতে ত্রিবেদী যখন নিজের সীমানায় ফিরে গেলেন, তখন দেখা গেল বাগনান ক্লাবের আরও দুই খেলোয়াড় অধ্যাপক মশাই-এর স্পর্শসখ অনুভব করতে করতে মাটির উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে।
যে-ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে গদাই বলেছিল রোগা লোকের গায়ে জোর হয় না, চেপে ধরলেই ফিনিশ, সে এইবার গদাই-এর দিকে তাকিয়ে তিক্তস্বরে বলে উঠল, কী রে গদাই, কী হল? তুই না বলেছিলি চেপে ধরলেই ফিনিশ! এখন দেখছিস তো ফিনিশ হওয়ার জিনিস এ নয়। আরে ব্বাস- যেন একটা ঝড় ছুটে গেল।
অপর দিকের সীমানায় দণ্ডায়মান ত্রিবেদীর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে গদাই বলল, যদি একবার ধরতে পারতাম, তাহলে দেখিয়ে দিতাম ফিনিশ করা যায় কিনা. আচ্ছা, এবার আমি যাচ্ছি।
চুকিৎ-কি-কিৎ দম নিতে নিতে অগ্রসর হল গদাই, মনে মনে বলল, তালপাতার সেপাইটাকে একবার নাগালে পেলে হয়, এমন একখানা ঝাড়ব যে বাছাধনকে তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।
তালপাতার সেপাই অর্থাৎ অধ্যাপক ত্রিবেদীর উপর এখন গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়দের অগাধ বিশ্বাস ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক ফিস্ ফিস্ করে ত্রিবেদীকে বলল, গদাই আসছে। ত্রিবেদী স্যার, ওকে ধরে ফেলুন। গদাই বসে গেলে নির্ঘাত জিতব। আপনি যদি গদাইকে মাত্র কয়েক সেকেন্ড রুখে দিতে পারেন, তাহলে আমরা সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে কাবু করতে পারব।
দরকার হবে না, ত্রিবেদী হাসলেন, গদাইকে ধরতে পারলে কারও সাহায্য ছাড়া আমি একাই ওকে কাবু করতে পারব।
গদাই এসে ঢুকল প্রতিপক্ষের সীমানার মধ্যে। মুখে তার দম নেওয়ার কিৎ-কিৎ ধ্বনি, তার শালের গুঁড়ির মতো দুই পেশিপুষ্ট বাহু ছোবল মারার জন্য প্রসারিত- গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়রাও তাকে ঘিরে ফেলতে সচেষ্ট… দর্শকদের মধ্যেও তখন প্রবল উত্তেজনা– দারুণ খেলছে গদাই… দুজন ওকে জড়িয়ে ধরতে এসে ছিটকে পড়ল… আরও একজন…শাবাশ গদাই, শাবাশ! তিনজনকে মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে গদাই!
-উঃ! আমার চোয়ালটাও যে মেরে উড়িয়ে দিলে মশাই!
-স্যরি! খেলার ঝোঁকে হাত ছুঁড়েছি, কনুইটা আপনার চোয়ালে লেগে গেছে। কিছু মনে করবেন না।
–না, না, মনে করব কেন? খেলার ঝেকে আমার হাতের মুঠো যদি হঠাৎ মশাই-এর নাকে লেগে যায়, আশা করি আপনিও কিছু মনে করবেন না।
তার মানে? আমার কনুইটা হঠাৎ আপনার চোয়ালে লেগে গেছে। আমি কি ইচ্ছে করে আপনাকে মেরেছি? আর আপনি এখন আমার নাকে ঘুসি মারতে চাইছেন? একবার মেরে দেখুন
–তাই নাকি? দেখবেন তবে?
অনেকগুলো ক্রুদ্ধকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, দুটোকেই ঘাড় ধরে বার করে দেব। ঝগড়া করার বাসনা থাকলে এখান থেকে সরে গিয়ে যত খুশি গুঁতোগুতি করুন। এখানে ঝামেলা করলে দুজনকেই আগাপাশতলা ভালো মতো পালিশ করা হবে।
এমন ভয়ংকর নিরপেক্ষ বিচারের সম্ভাবনা কনুই এবং ঘুসি উভয় পক্ষকেই নিরস্ত ও নীরব করে দিল। জনতা আবার খেলার মাঠের দিকে মনোনিবেশ করল…
গদাই তখন প্রায় নিজের ঘরে ফিরে গেছে, হঠাৎ পিছন থেকে একলাফে এসে তার একটা পা চেপে ধরলেন ত্রিবেদী। পরক্ষণেই তিনি অনুভব করলেন তার শরীর থেকে সমস্ত শক্তি অন্তর্ধান করছে, অস্ফুটস্বরে তিনি বলে উঠলেন, সর্বনাশ! আশ্চর্য-পাতার ক্ষমতা ফুরিয়ে গেছে!
নিজেকে মুক্ত করার জন্য গদাই পা ছুড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ত্রিবেদীর দেহ শূন্যপথে উড়ে গিয়ে মাঠের পাশে একটা ঝোপের মধ্যে ছিটকে পড়ল!
দর্শকদের ভিতর থেকে ভেসে এল বিরূপ মন্তব্য। ওই চেহারা নিয়ে কপাটি খেলা যায় না।
–হুঁ, হুঁ, বাবা; ওর নাম গদাই। এতক্ষণ বাবাজি খুব খেল দেখাচ্ছিলেন, এখন শক্ত পাল্লায় পড়ে হিম্মৎ ছটকে গেছে।
-হা! হা! হা!
ভিড়ের ভিতর থেকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল মুকুন্দ! কী হল স্যার? লাগল নাকি?
না, লাগেনি, ত্রিবেদী বললেন, ভাগ্যিস এই গাছটা ছিল, এটার ডালপালার উপর পড়েছিলাম বলেই বেঁচে গেছি, নয়তো হাড়গোড়–আরে! আরে! এ কী!
-কী হল স্যার? হঠাৎ অমন চেঁচিয়ে উঠলেন কেন?
–না, না, ও কিছু নয়। একটা লতা দেখে সাপ ভেবে ভুল করেছিলাম।
ঝোপের মধ্যে সাপখোপ থাকতে পারে। ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনার কোথাও চোট লাগেনি তাহলে?
-না, না।
–ওখানে আর দাঁড়াবেন না। দলের সবাই যেখানে মোড় হয়ে বসে পড়েছে, সেইখানে গিয়ে বসুন। যদি বরাত ভালো থাকে, আপনি আবার একটা সুযোগ পেতে পারেন।
কিন্তু ত্রিবেদী তখন মুকুন্দের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না– দুই চোখ পাকিয়ে তিনি সেই গাছটার দিকেই তাকিয়েছিলেন, যেটা তার শূন্যপথে ধাবমান দেহকে কঠিন ধরণীর সাংঘাতিক সংঘাত থেকে রক্ষা করেছে। ত্রিবেদীর অভিজ্ঞ চক্ষু একনজরেই গাছটার স্বরূপ নির্ণয় করতে পেরেছে, মাঠের একপাশে ঝোপের মধ্যে অভাবনীয় ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে আশ্চর্য-পাতার একটি গাছ!
মুকুন্দের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকটা আশ্চর্য পাতা মুখে পুরে দিলেন ত্রিবেদী, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দলের যে সব খেলোয়াড় মোড় হয়ে বসেছিল, তাদের মধ্যে স্থান গ্রহণ করলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বিরোধীপক্ষের একজনকে ছুঁয়ে নিরাপদে ফিরে এল নিজেদের সীমানার মধ্যে। কপাটি খেলার নিয়ম-অনুসারে একপক্ষের যে কয়েকজন খেলোয়াড় মোড় হবে, বিরোধীপক্ষের সম-সংখ্যক সেই কয়জন খেলোয়াড় আবার মাঠে নেমে খেলতে পারে। অতএব আবার মাঠে নামলেন ত্রিবেদী।
মুকুন্দ তাকে উৎসাহ দিল, ভালো করে খেলবেন স্যার।
ত্রিবেদী অভয় দিয়ে বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মুকুন্দ। এবার আমি খুব ভালো করে খেলব।
আশ্চর্য-পাতার গুণে ইতিমধ্যেই সর্বাঙ্গে অফুরন্ত শক্তির জোয়ার অনুভব করছেন ত্রিবেদী, তাই মুকুন্দকে অভয় দিতে তিনি কিছুমাত্র ইতস্তত করলেন না। তিনি বুঝতে পারছিলেন বিরোধীপক্ষের খেলোয়াড়রা মিলিতভাবে আক্রমণ করেও তাকে কাবু করতে পারবে না।
শানু নামে এক খেলোয়াড় চুপি চুপি শশাঙ্ককে জিজ্ঞাসা করল, ভদ্রলোক তো একটু আগে দারুণ খেলছিলেন। কিন্তু গদাই-এর পাল্লায় পড়ে ওনার যে অবস্থা হল, তাতে আমি খুব ভরসা রাখতে পারছি না। ভদ্রলোক অবশ্য মুকুন্দকে নিশ্চিন্ত থাকতে বললেন- তা, তুমি কীরকম বুঝছ ক্যাপ্টেন?
ভালো বুঝছি না, শশাঙ্ক ফিসফিস করে বলল, দলের ক্যাপ্টেন হিসাবে আমি খুব নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি না।
ত্রিবেদী হাঁক দিয়ে বললেন, শশাঙ্ক, এবার আমি দান দিতে যাচ্ছি। এই দানেই সবাইকে মেরে ফিরে আসব। খেলা এবং তোমাদের দুশ্চিন্তার এইবারেই শেষ।
উভয়পক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে দুই পক্ষকে তফাত করে যে সরলরেখাঁটি অবস্থান করছে, সেই সরলরেখার একপাশে নিজস্ব সীমানা থেকে বিপক্ষের উপর হানা দিতে এগিয়ে গেলেন ত্রিবেদী এবং শিকারি জন্তু শিকারের উপর ঝাঁপ দেওয়ার আগে যেমনভাবে সমস্ত শরীরকে গুটিয়ে প্রস্তুত হয়, ঠিক সেইভাবেই প্রস্তুত হলেন তিনি। আশ্চর্য পাতা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বদলে দিয়েছে তাকে!
ত্রিবেদীর আক্রমণোদ্যত ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে শানু আবার বলল, গদাইকে ধরতে গিয়ে ভদ্রলোকের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়েছিল বটে, কিন্তু উনি যে ভালো কপাটি-খেলুড়ে সে-কথা উনি প্রমাণ করে দিয়েছেন। তবে এই মাত্র উনি যে কথা বললেন, সেটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। খেলা আর দুশ্চিন্তার শেষ মানে? এখনই খেলা শেষ করতে হলে ওদের দলের সব কয়টি খেলুড়েকে মোড় করে ফিরে আসতে হবে। একজন লোকের পক্ষে এমন অসাধ্য সাধন কি সম্ভব?
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ত্রিবেদীকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে গম্ভীর ভাবে শশাঙ্ক বলল, সম্ভব কি অসম্ভব এখনই বুঝতে পারবে- অনর্থক মাথা ঘামিয়ে মরছ কেন?
চু-কিৎ-কিৎ, সজোরে দম নিয়ে বিরোধীদলের সীমানায় এসে পড়লেন ত্রিবেদী এবং গোলাপ কলোনির সমর্থকদের জ্বলন্ত উৎসাহে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ ধরা পড়লেন বাগনান ক্লাবের এক খেলুড়ের হাতে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টায় সামান্য একটু ধস্তাধস্তি করতে না করতেই তার উপর ঝাঁপ দিল গদাই, সঙ্গে সঙ্গে পুরো দলটাই ঝাঁপিয়ে পড়ল ত্রিবেদীর উপর। সমবেত খেলোয়াড়ের মিলিত আক্রমণে ধরাশায়ী হলেন ত্রিবেদী। অতগুলো জোয়ান খেলোয়াড়ের দেহের আড়ালে তাঁর ছোটোখাটো শরীরটা একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল বটে, কিন্তু দম নেওয়ার চুকিৎ-কিৎ শব্দটা সজোরে ভেসে এসে সবাইকে জানিয়ে দিল তার দম এখনো ফুরোয়নি, এখনও লড়ছেন তিনি!
দর্শকদের ভিতর থেকে মন্তব্য শোনা গেল, লোকটা প্রথমে খুব আশা দিয়েছিল আমাদের। কিন্তু শেষকালে ডুবিয়ে দিল। এমন আনাড়ির মতো কেউ ধরা পড়ে? ও যেন ধরা দেওয়ার জন্যই তৈরি হয়েছিল।
–কিন্তু যাই বলো, লোকটার দম সাংঘাতিক। তখন থেকে কিৎ-কিৎ করে যাচ্ছে, থামার নাম নেই।
-আরে কিৎ-কিৎ কতক্ষণ করবে? কতক্ষণ দম রাখতে পারবে ও? সারাদিন চেষ্টা করলেও অতগুলো খেলোয়াড়কে ঠেলে উঠতে পারবে না লোকটা।
আরেকটি বিরূপ মন্তব্য ভেসে এল, ওই চেহারা নিয়ে কপাটি খেলা হয় না, কপাটি খেলতে গদ লাগে।
তাদের পরিচয় পরক্ষণেই পাওয়া গেল হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝটকায় ছিটকে পড়ল বাগনান ক্লাবের খেলুড়ের দল এবং তাদের দেহের তলা থেকে ভূমিশয্যা ত্যাগ করে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী! তাকে যারা জাপটে ধরে পেড়ে ফেলেছিল, তারা তখন গড়াগড়ি দিচ্ছে মাঠের উপর, পতনজনিত ধাক্কায় তাদের চোখের সামনে ফুটে উঠেছে রাশি রাশি সর্ষে ফুল উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তাদের ছিল না।
প্রতিপক্ষের সাময়িক বিহ্বলতার সুযোগ নিলেন ত্রিবেদী, নিজের দলের সীমানা লক্ষ্য করে তিনি দৌড় দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গোলাপ কলোনির সমর্থকদের ভিতর জাগল তীব্র উল্লাসধ্বনি
কিন্তু শব্দটা যেমন হঠাৎ উঠেছিল, ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল। সকলের মতো গদাইও ছিটকে পড়েছিল ত্রিবেদীর ধাক্কায়, কিন্তু তার অসাধারণ শারীরিক ক্ষমতা তার সংবিৎ ফিরিয়ে এনেছিল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আচম্বিতে একলাফে উঠে এসে পিছন থেকে সে জড়িয়ে ধরল ত্রবেদীকে– তিনি তখন সীমারেখার খুব কাছে এসে পড়েছেন!
এই অভাবিত ঘটনার স্তব্ধ হয়ে গেল গোলাপ কলোনির সমর্থকদের উল্লাসধ্বনি, তবে সেই নীরবতা স্থায়ী হল মাত্র কয়েকটি মুহূর্তের জন্য কারণ তারস্বরে চিৎকার করে গদাইকে এবার সংবর্ধনা জানাল বাগনান ক্লাবের সমর্থকবৃন্দ।
হঠাৎ পিছন থেকে আক্রান্ত হয়ে চমকে গেলেন ত্রিবেদী। তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন বিপক্ষের খেলোয়াড়দের সমবেত শক্তিও তাকে বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারবে না, তাই ইচ্ছা করেই তিনি বিরোধীদলের খেলোয়াড়দের আলিঙ্গনে ধরা দিয়েছিলেন। কপাটির নিয়ম অনুসারে বিপক্ষের যে কয়টি খেলুড়েকে ছুঁয়ে খেলোয়াড় আবার সীমানার মধ্যে দম নিতে নিতে ফিরে আসতে পারবে, সেই কয়জন ছোঁয়া লাগা খেলুড়েকেই মোড় হয়ে বসে পড়তে হবে।
বাগনান ক্লাবের প্রত্যেক খেলোয়াড়ই তাকে পাকড়াও করার আশায় জড়িয়ে ধরেছিল, এখন তিনি যদি নিরাপদে স্বস্থানে প্রস্থান করতে পারেন, তাহলে বিপক্ষের সব খেলোয়াডকেই মোড় হয়ে বসে পড়তে হবে এবং গোলাপ কলোনি লাভ করবে বিজয়লক্ষ্মীর জয়মাল্য! মনে মনে পরিকল্পনাটি সাজিয়ে নিয়ে ধরা পড়ার অভিনয় করেছিলেন অধ্যাপক ত্রিবেদী, তার পরিকল্পনায় ভুলও হয়নি কিন্তু বিশাল শরীর আর প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি দিয়ে খেলোয়াড় গদাই অধ্যাপক ত্রিবেদীর সমস্ত উদ্যম আর পরিকল্পনা ব্যর্থ করার উপক্রম করল..
দুই হাতে প্রাণপণে ত্রিবেদীকে চেপে ধরেছিল গদাই, হঠাৎ সে অনুভব করল লোহার সাঁড়াশির মতো পাঁচ-পাঁচ দশটি আঙুল তার হাত চেপে ধরেছে, আর সেই আঙুলের চাপে তার হাত দুটি ক্রমশ অবশ হয়ে পড়ছে।
দাঁতে দাঁত চেপে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও সে নাছোড়বান্দার মতো আঁকড়ে ধরে রইল ত্রিবেদীকে, কিছুতেই হাতের বাঁধন আগা করতে রাজি হল না।
ত্রিবেদী বুঝতে পারছিলেন আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি বাহুবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করতে পারবেন, গদাই-এর হাত তার আঙুলের চাপে অসাড় হয়ে আসছে। কিন্তু আড়-চোখে তাকিয়ে তিনি দেখলেন ধরাশায়ী খেলোয়াড়দের মধ্যে কয়েকজন উঠে বসেছে। তারা সবাই মিলে যদি আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে, তাহলে আশ্চর্য-পাতার আশ্চর্য ক্ষমতাও তাকে রক্ষা করতে পারবে না। তাঁর দেহের শক্তি এখনও অক্ষুণ্ণ আছে বটে, কিন্তু দম ফুরিয়ে আসছে। অতগুলো খেলুড়ের হাত ছাড়িয়ে নিতে যে সময় লাগবে, সেই সময়টুকু পর্যন্ত দম ধরে রাখার ক্ষমতা তাঁর থাকবে না– সুতরাং যা করার তা এখনই করতে হবে…
জন দুই আহত খেলুড়ে তখন নিজেদের সামলে নিয়ে ত্রিবেদীর দিকে ছুটে আসার উপক্রম করছে; ত্রিবেদী বুঝতে পারছেন তার দেহের উপর গদাই-এর হাতের বাঁধন আগ্ধ হয়ে এলেও আরও কয়েকটি মুহূর্ত তাকে বন্দি থাকতেই হবে। ইতিমধ্যে অন্য দুই খেলোয়াড়ের উদ্যম ও ধরাশায়ী অন্যান্য সকলের শায়িত অবস্থা থেকে দণ্ডায়মান হওয়ার প্রচেষ্টা সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ করেছেন ত্রিবেদী এবং সেইসঙ্গে অনুভব করছেন ফুরিয়ে আসছে তার দম, অতএব Now or Never, যা করণীয় করতে হবে এই মুহূর্তে–
পরক্ষণেই শত্ৰুমিত্র উভয় পক্ষের খেলোয়াড়দের চোখগুলো উঠল কপালে, আর বাগনান ক্লাবের সমর্থকদের কোলাহল হল স্তব্ধ- সমবেত জনতাকে স্তম্ভিত করে একটি প্রচণ্ড লক্ষে ত্রিবেদী পৌঁছে গেলেন গোলাপ কলোনির সীমানার মধ্যে; তাকে আঁকড়ে ধরে তখনও ঝুলছে নাছোড়বান্দা গদাই! ত্রিবেদী যখন বুঝলেন গদাই-এর হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার আগেই অন্য খেলোয়াড়রা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাদের প্রতিরোধ করে নিজেদের ঘরে ফিরে আসার আগেই ফুরিয়ে যাবে তার দম। তখনই আর গদাই-এর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা না করে একটি সুবৃহৎ লক্ষত্যাগ করেছেন তিনি এবং গদাই-এর গুরুভার বিপুল বপুকে অবলীলাক্রমে বহন করে ফিরে এসেছেন স্বপক্ষের সীমানার মধ্যে।
কয়েকটি নীরব মুহূর্ত– তারপরই বিস্ময়মিশ্রিত তীব্র কোলাহলে ত্রিবেদীকে অভিনন্দন জানাল সমবেত জনতা! সেই কোলাহলে গোলাপ কলোনির সমর্থকদের সঙ্গে সমানভাবে গলা মিলিয়েছিল বাগনান ক্লাবের সমর্থকবৃন্দ! ত্রিবেদীর কল্পনাতীত কার্যকলাপ এবং অমানুষিক শক্তির পরিচয়ে মুগ্ধ জনতার এই অভিনন্দন স্বতঃস্ফূর্ত, সেখানে মুছে গেছে রেষারেষি আর ভেদাভেদ জ্ঞান! উভয় পক্ষের সমর্থকদের সঙ্গে গোলাপ কলোনির খেলুড়ের দলও গলা মিলিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল, কিন্তু বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড়রা ছিল নির্বাক, স্তব্ধ।
হঠাৎ বাগনান ক্লাবের দল থেকে এক দৈত্যাকৃতি পুরুষ এগিয়ে এল সেই দিকে, যেখানে অধ্যাপক ত্রিবেদীকে কাঁধে তুলে আনন্দে মত্ত হয়ে উঠেছে গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়ের দল। একজন হঠাৎ চিৎকার করে উন্মত্ত আনন্দধ্বনিকে ভাষায় রূপান্তরিত করল, থ্রি চিয়ার্স ফর–
কিন্তু অন্য সকলে ধুয়া ধরে ত্রিবেদীর নাম উচ্চারণ করার আগেই সকলের কণ্ঠস্বর ডুবিয়ে জাগল এক ষণ্ড কণ্ঠের ভৈরব গর্জন চুপ! চুপ! চুপ।
মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়ের দল। তাদের আনন্দ-উৎসবে বাধা দিতে এগিয়ে এসেছে খেলোয়াড় গদাই! কিন্তু কেন? সে কি ঝগড়া করতে চায়? খুবই অবাক ব্যাপার প্রকাণ্ড দেহ আর প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হলেও গদাই শান্ত প্রকৃতির মানুষ। খেলার মাঠ ও ব্যায়ামাগার ছাড়া অন্য কোথাও সে তার আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে আতঙ্কের সঞ্চার করেনি। এমন ভদ্র আর শান্ত মানুষটা হঠাৎ খেপে গেল কেন? নাকি, এই অভাবিত বিপর্যয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে হামলা করতে চাইছে বাগনান ক্লাব? গদাই কি আক্রমণকারীদের অগ্রদূত হতে চাইছে?..
গোলাপ কলোনির ছেলেরা ভীতু নয়, যদিও গদাইকে তারা যথেষ্ট সমীহ করে, তবু মনে মনে আসন্ন লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হল তারা, মুছে গেল তাদের মুখের হাসি, চোয়াল হয়ে উঠল শক্ত ও আড়ষ্ট, সম্ভাব্য হামলা রুখতে নিঃশব্দে প্রস্তুত হল গোলাপ কলোনির খেলুড়ের দল…
সেই ত্রস্ত স্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে বেজে উঠল মুকুন্দের সুগম্ভীর কণ্ঠ। কেন? চুপ করব কেন? কী বলতে চাস তুই? মনে রাখিস গদাই, বাঘা মুকুন্দ এখনও মরেনি।
মরিসনি বটে, তবে তোর মরাই উচিত, চেঁচিয়ে উঠল গদাই, বলি কপাটি খেলা কি বিদেশি খেলা? স্বদেশি খেলায় জিতে বিদেশী ভাষায় জিগির দিতে লজ্জা করে না তোদের? আমাদের বাংলা ভাষা কি এতই গরিব?
হকচকিয়ে গেল মুকুন্দ, না, মানে, ইয়ে ব্যাপারটা হচ্ছে–
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই গর্জে উঠল খেলোয়াড় গদাই, বলো ভাই– জয়, অধ্যাপক ত্রিবেদী কী জয়!
মুহূর্ত পরেই ফেটে পড়ল বহু কণ্ঠের গর্জিত উল্লাস, জয়, অধ্যাপক ত্রিবেদীকী জয়!
গদাই-এর কাঁধে হাত রাখল বাগনান ক্লাবের ক্যাপ্টেন বিজয় চৌধুরি, তোর কি মাথা খারাপ হল গদাই? ওদের দলের খেলুড়ের নামে জিগির দিতে তোর লজ্জা করল না?
লজ্জা করবে কেন? গদাই সপ্রতিভ, আমি খেলোয়াড়, তাই ভালো খেলোয়াড়কে সম্মান জানাতে কখনো লজ্জা পাই না। তোমার মধ্যেই বরং খেলোয়াড়ি মনোভাব নেই, লজ্জা তোমারই পাওয়া উচিত, বিজয়।
মাঠের উপর থেকে জনতার অধিকাংশ মানুষই যখন অন্তর্ধান করেছে বা করছে, সেই সময় দেখা গেল দর্শকরা যেখানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল, সেইখানে তখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি কী-যেন ভাবছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আর একটি লোক পূর্বোক্ত ব্যক্তির মুখের দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করছে।
প্রথম ব্যক্তি দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে ও উচ্চতায় খুবই সাধারণ, গায়ের রং নাফর্সা, নাকালো, তবে খুব ভালোভাবে লক্ষ করলে তার চোখে-মুখে একটা ধূর্ত নিষ্ঠুরতার আভাস ধরা পড়ে। কিন্তু সেটা এমন কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নয়। তবে হ্যাঁ, এই শহরতলিতে কোট-প্যান্ট, নেকটাই ও বুটজুতোয় সজ্জিত নিখুঁত সাহেবি পোশাক-পরা মানুষ বড় একটা চোখে পড়ে না– সেদিক থেকে বিচার করলে প্রথমোক্ত ব্যক্তি নিশ্চয়ই কিছুটা বৈশিষ্ট্যের দাবি করতে পারে। পরবর্তীকালে আমাদের কাহিনিতে সে যখন আবার আত্মপ্রকাশ করবে, তখন আমরা দেখতে পাব তার চলনেবলনে এমন এক ভয়াবহ বন্য ব্যক্তিত্বের প্রভাব রয়েছে, যাকে তুচ্ছ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
বহু মানুষের ভিড়ের মধ্যে প্রথম ব্যক্তির চেহারা কারও নজরে পড়ার কথা নয়। কিন্তু তার সঙ্গীর কেশহীন মসৃণ মস্তক, অত্যন্ত খর্ব ও অত্যন্ত পেশীবহুল দুই বাহু ও বিস্তৃত বক্ষপট ভিড়ের মধ্যেও মানুষের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। তার গায়ের রং বেশ ফর্সা, আর যে গেঞ্জিটা তার অতি-খর্ব, অতিবলিষ্ঠ গৌরবর্ণ দেহের শোভা বৃদ্ধি করছে, সেই ডোরাকাটা গেঞ্জিটাও রং-এর বাহারে দস্তুরমতো দ্রষ্টব্য বস্তু।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর খর্বকায় দৈত্য সাহেবি পোশাকে সজ্জিত সঙ্গীকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, ডাক্তার! আমরা তো দিনের আলো থাকতে থাকতে ভালো করে এই এলাকাটাকে একনজরে মেপে নিতে এসেছিলাম, এখন যে বেলা পড়ে গেল, একটু পরেই সব আঁধারে ঢেকে যাবে। কেন যে পথ চলতে চলতে হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে ঢুকে এতক্ষণ কপাটি-খেলা দেখে সময় নষ্ট করলেন, তা বুঝলাম না।
ডাক্তার নামে অভিহিত ব্যক্তির মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটল, বৎস গজু, কেন যে আমি সময় নষ্ট করলাম, সেটা বুঝলে আমার বদলে তুমিই লিডার হতে। জেনে রাখো বোকারাম আমি অকারণে সময় নষ্ট করি না…।
কে এই ডাক্তার? চেহারা দেখে আর যাই হোক, মানুষটিকে চিকিৎসক বলে তো মনে হয় না। আর ডাক্তারের সঙ্গী গজু নামক জীবন্ত বিভীষিকাকে কোনো চিকিৎসকের অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা সহকারী বলে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। কপাটি-খেলার দর্শকের ভূমিকায় ডাক্তার নামে অভিহিত ব্যক্তির চালচলন দস্তুরমতো রহস্যজনক বলে মনে হলেও রহস্য সমাধানের জন্যে আমাদের পরবর্তী কাহিনির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে, যার নাম অধ্যাপক ত্রিবেদী ও ডাঃ সাটিরা!