ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৩. অথ শার্দূল ঘটিত

৩. অথ শার্দূল ঘটিত

মন্ত্রণাসভায় নেকড়ের দলের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর মোগলি নেকড়েদের গুহা ছেড়ে পাহাড়ের তলদেশে অবস্থিত যে-জমিতে গ্রামের মানুষ বসবাস করে, সেইখানে নেমে এল। কিন্তু সেই জায়গায় সে থামল না, কারণ, জায়গাটা জঙ্গলের খুব কাছাকাছি আর সেইজন্যেই তার পক্ষে নিরাপদ নয়। রুক্ষ অসমান পথ বেয়ে সে এগিয়ে চলল এবং প্রায় কুড়ি মাইল পর একটা অজানা গ্রামের কাছে এসে পড়ল। গ্রামের প্রান্তে গরু-মোষ চরে বেড়ানোর উপযোগী মাঠ, তারপর শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। মাঠের উপর গরু আর মোষের পাল চরে বেড়াচ্ছিল, তাদের উপর নজর রাখছিল কয়েকটা বাচ্চা ছেলে। মোগলিকে দেখে তারা চেঁচিয়ে উঠে দৌড় দিল। গ্রামের নেড়ি কুত্তার দল বিরক্তি প্রকাশ করল ঘেউ ঘেউ শব্দে। তখন সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, কাঁটাঝোপের বেড়া টেনে দেওয়া হয়েছে গ্রামের প্রবেশপথের উপর– মোগলি নির্বিকারভাবে ওই বেড়া সরিয়ে ভিতরে ঢুকল।

বুনো জন্তুদের বাধা দেওয়ার জন্যই যে কাঁটাঝোপের বেড়া দেওয়া হয়, সেকথা মোগলির অজানা ছিল না। জঙ্গলের সীমানা পেরিয়ে আহারের সন্ধানে নৈশ অভিযান চালানোর সময় ওই ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছে সে অনেকবার।

হু, এখানেও দেখছি জঙ্গলের বাসিন্দাদের ভয় পায় মানুষরা। মোগলি নিজের মনেই বলল, তারপর প্রবেশপথের দরজার পা

একটু পরেই সেখানে একটা লোক উপস্থিত হল। মোগলি উঠে দাঁড়াল, তারপর হাঁ করে তার হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে ক্ষুধার্ত, তার খাবার চাই। লোকটা তার দিকে তাকিয়েই গ্রামের রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে পুরোহিতকে ডাকতে লাগল। অতঃপর স্থূলকায় পুরোহিতের আবির্ভাব। তার সঙ্গে এল প্রায় একশো লোকের জনতা। তারা সকলেই মোগলির দিকে তাকিয়ে চেঁচামেচি করতে লাগল। মাঝে মাঝে তারা আঙুল তুলে দেখাচ্ছিল মোগলিকে।

মানুষগুলো দেখছি ভারি অভদ্র, মোগলি নিজের মনেই বলল, ওদের সঙ্গে বাঁদরদের বিশেষ তফাৎ আছে বলে তো মনে হয় না।

ওকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই, পুরোহিত বলল, ছেলেটার হাত আর পায়ের দাগগুলোর দিকে তাকাও। ওই দাগগুলো হচ্ছে নেকড়ের কামড়ের দাগ। ছেলেটা নেকড়েদের পালিত পুত্র, জঙ্গল থেকে পালিয়ে এসেছে।

খেলার সময়ে নেকড়ের বাচ্চারা মোগলিকে খেলার ছলেই কামড়েছে, তাই মোগলির হাত-পায়ের উপর ফুটে উঠেছে সাদা সাদা দাগ। কিন্তু ওই দাগগুলিকে মোগলি কামড়ের দাগ বলে মানতে রাজি নয়, সে জানে সত্যিকার কামড় কাকে বলে।

আরে! আরে! দু-তিনজন মেয়ে বলে উঠল, বেচারাকে নেকড়েরা কেমন কামড়েছে দেখেছ? ছেলেটা কিন্তু দেখতে ভারি সুন্দর। মেসুয়া, তোমার যে-ছেলেটিকে বাঘে নিয়েছিল, এই ছেলেটা যেন তারই মতো মনে হচ্ছে।

একটি মেয়ে এগিয়ে এসে মোগলিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল, না, সে নয়। তবে আমার ছেলের সঙ্গে এই ছেলেটির যথেষ্ট মিল আছে।

পুরোহিত অতিশয় ধূর্ত, সে জানত, মেসুয়া হচ্ছে গ্রামের সবচেয়ে ধনী গৃহস্থের স্ত্রী তাকে খুশি করতে পারলে লাভবান হওয়ার আশা আছে। অতএব আকাশের দিকে প্রায় মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে সে বলে উঠল, অরণ্য যাকে হরণ করেছিল, অরণ্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সুতরাং হে ভগিনি, তুমি তোমার ছেলেকে ঘরে নিয়ে যাও। কিন্তু যে পুরোহিত মানুষের অতীতকে দেখতে পায়, তাকে সম্মান জানাতে কখনো ভুলে যেও না।

মোগলি আপনমনেই বলল, নেকড়েরা যেভাবে আমায় পরখ করছিল, মানুষরাও মনে হচ্ছে সেইভাবেই আমাকে যাচাই করে নিল। ঠিক আছে, আমি যদি মানুষ হই, তাহলে মানুষের মতোই আমায় চলতে হবে।

জনতা সরে গিয়ে পথ করে দিল। মেয়েটি মোগলিকে নিয়ে তার কুটিরে প্রবেশ করল। সেখানে ছিল একটি খাট, শস্য রাখার জন্য একটি মাটির সিন্দুক, এক ডজন তামার তৈরি রান্নার বাসন, কুলুঙ্গির মধ্যে একটি দেবমূর্তি এবং দেয়ালে টাঙানো একটি আয়না।

মেয়েটি মোগলিকে দুধ আর রুটি খেতে দিল। তারপর মোগলির চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এই ছেলেটি হয়তো তারই সন্তান, যাকে একদিন বাঘে নিয়েছিল- দৈবক্রমে বেঁচে আবার মায়ের কাছে ফিরে এসেছে। সে বলে উঠল, নাথু! ও নাথু! কিন্তু মোগলি সাড়া দিল না। ওই নামটি তার অপরিচিত। মেয়েটি আবার বলে উঠল, নাথু, তোমার কি সেইদিনের কথা মনে পড়ে না, যেদিন তোমায় আমি নতুন জুতো দিয়েছিলাম? মেয়েটি নত হয়ে মোগলির পায়ে হাত দিল– মোষের শিং-এর মতন শক্ত! না, সে বিষণ্ণস্বরে বলল, এই পায়ে কখনো জুতো ওঠেনি। কিন্তু তুমি আমার নাথুর মতোই দেখতে। নাথুর মতোই তুমি আমার ছেলে হয়ে থাকবে।

মোগলি অস্বস্তি বোধ করছিল। সে কখনো ছাদের তলায় বাস করেনি। কিন্তু ভালোভাবে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল, মাথার উপর খড়ের চালটা সে ইচ্ছা করলেই ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া ঘরের জানালাতেও লোহার গরাদে বা কাঠের তক্তা বসানো হয়নি, সেখান দিয়েও বাইরে যাওয়ার রাস্তা খোলা রয়েছে।

মানুষের মাঝখানে থাকতে হলে মানুষের ভাষা শিখতে হবে, মোগলি আপনমনে বলল, জঙ্গলে এসে যদি কোনো মানুষ আমাদের অর্থাৎ জন্তুদের ভাষা বুঝতে না পারে, তাহলে তার যে অবস্থা হবে, আমার অবস্থাও হয়েছে তারই মতো অসহায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানুষের ভাষা আমায় বুঝতে হবে, তাদের ভাষায় কথা কইতে হবে।

মোগলি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। সেই রাতেই মেসুয়ার মুখ থেকে কয়েকটা কথা শুনে সে নিখুঁতভাবে সেই কথাগুলোর উচ্চারণ আর অর্থ বুঝে নিল। কুটিরের মধ্যে বসে-বসেই মানুষের ভাষা শিক্ষার পাঠ শুরু করল মোগলি। রাত্রে ঘুমানোর সময় আবার একটা গোলমালের সূত্রপাত হল চারদিক বদ্ধ ঘরটাকে একটা মস্ত ফাঁদের মতন মনে হওয়ায় মোগলি কিছুতেই সেখানে শয্যাগ্রহণ করতে চাইল না। দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে সে জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। মেসুয়ার স্বামী তাকে বুঝিয়ে বলল, যে-বনচারী বালক চিরকাল মুক্ত প্রকৃতির বুকে বাস করেছে, সে বদ্ধ ঘরে রাত্রিযাপন করতে রাজি হবে না ছেলেটি যদি সত্যিই তাদের সন্তান হয়, তাহলে তাদের ফেলে সে পালাবে না কখনোই।

মাঠের একধারে জঙ্গল যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেইখানে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে নিদ্রার উদ্যোগ করল মোগলি। কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়ার আগেই সেখানে উপস্থিত হল ধূসর নেকড়ে (মা-নেকড়ের বাচ্চাদের মধ্যে সে-ই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো)। তার কাছেই বনের খবর জানতে পারল মোগলি। নেকড়ের দলের মধ্যে যারা মোগলির হাতে ঘূর্ণায়মান জ্বলন্ত কাঠের আঘাতে আহত হয়েছিল, তারা ছাড়া দলের অন্য জন্তুরা ভালো আছে। শেরখান অনেকদূর শিকারের স্থান নির্বাচন করে সরে গেছে। তার শরীরের পোড়া জায়গায় নতুন চামড়া গজিয়ে ওঠার আগে সে তার পুরোনো জায়গাতে ফিরে আসবে না। মোগলির হাতের পূর্বোক্ত জ্বলন্ত আপ্যায়ন শেরখানকেও কাবু করেছিল দস্তুরমতো।

নেকড়েরা যেমন তোমাকে দল থেকে তাড়িয়েছিল, এই মানুষরাও একদিন তোমাকে তেমনি দূর করে তাড়িয়ে দেবে, ধূসর নেকড়ে বলল, ছোট্ট ভাইটি, মোষের পাল যেখানে চরে বেড়ায়, তারই একপাশে বাঁশঝাড়ের মধ্যে আমি তোমার জন্য মাঝে মাঝে অপেক্ষা করব। এখন আমি যাচ্ছি।

মোগলির গ্রামে আসার পর তিনটি মাস চলে গেছে। মানুষের ভাষা ও নিয়ম-কানুন ওই সময়ের মধ্যেই আয়ত্ত করে ফেলেছে সে। বনের পশুদের মধ্যে সে দুর্বল পরিগণিত হলেও মনুষ্যসমাজে তাকে অসাধারণ বলবান বলেই মনে করা হত। তার বয়সী ছেলেরা মাঝে মাঝে তাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করলেও মোগলি নিঃশব্দে তাদের এড়িয়ে যেত। নিজের শক্তি সম্পর্কে সে ছিল যথেষ্ট সচেতন– সে জানত, ওই ছেলেগুলোকে ইচ্ছা করলেই সে। দু-টুকরো করে ফেলতে পারে; কিন্তু জঙ্গলের আইন তাকে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছিল, তাই সে কখনো মেজাজ খারাপ করত না।

গ্রামের কয়েকটি মানুষের সঙ্গে তার বিরোধ বাধল। প্রথমে ঝগড়া লাগল পুরোহিতের সঙ্গে। পুরোহিত বলেছিল মোগলি যদি তার আম খায়, তাহলে দেবতা তাকে শাস্তি দেবে। উত্তরে দেবস্থান থেকে দেবমূর্তি তুলে এনে পুরোহিতের বাড়িতে রেখে দিয়েছিল মোগলি-বলেছিল, পুরোহিত এবার যেন দেবতাকে রাগিয়ে দেয়, সে ক্রুদ্ধ দেবতার সঙ্গে সর্বদাই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। তখন মেসুয়ার স্বামী প্রচুর টাকা দিয়ে পুরোহিতকে শান্ত করে। ফলে ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়।

 গ্রামের শিকারি বালদেও গ্রামবাসীদের কাছে অতিশয় সম্মানিত ব্যক্তি। মোগলির আবির্ভাব তার প্রভাব-প্রতিপত্তিকে বিপন্ন করে তুলল। বালদেও জন্তুদের সম্পর্কে যে-সব গল্প বলত, অনভিজ্ঞ গ্রামের মানুষ তা বিশ্বাস করলেও মোগলি সেগুলিকে মিছে কথা বলে উড়িয়ে দিত।

একদিন বালদেও বলে বসল, যে-বাঘটা মেসুয়ার ছেলেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সে একটা ভুতুড়ে বাঘ। কয়েক বৎসর আগে মৃত একটা বুড়ো সুদখোরের আত্মা ওই বাঘের শরীরে ভর করেছে।

বালদেও বলেছিল, পূরণ দাস নামে বুড়ো সুদখোর দাঙ্গায় মার খেয়ে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। বাঘটাও খুঁড়িয়ে চলে। আমি ওর পায়ের দাগ দেখে বুঝতে পেরেছি বাঘটা খোঁড়া।

ঠিক, ঠিক, গ্রামের কয়েকটি বুড়ো সায় দিয়েছিল, আলবৎ পূরণ দাসের প্রেতাত্মা বাঘের উপর ভর করেছে। তাই ওই বাঘটা খুঁড়িয়ে চলে।

এসব কথার কোনো মানে হয় না, মোগলির মন্তব্য, ওই বাঘটা জন্ম থেকেই খোঁড়া। তার ঘাড়ে সুদখোরের আত্মা ভর করেছে এমন কথা শুধু পাগলেই বলতে পারে।

বলাই বাহুল্য, মোগলির মন্তব্য শুনে শিকারি বালদেও খুশি হয়নি। বালদেও যেসব ভূতপ্রেতের গল্প বলত, সেগুলিকেও নিতান্ত গাঁজার ধোঁয়া বলে উড়িয়ে দিতে মোগলি। ফলে মোগলির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল বালদেও। সামনা-সামনি ঝগড়া না হলেও অবরুদ্ধ ক্রোধ বালদেওকে তপ্ত করে তুলেছিল।

পল্লীসমাজের নিয়ম অনুসারে গ্রামের ছোটো ছোটো বাচ্চা ছেলেরাই গরু-মোষ চরিয়ে থাকে। খুব সকালেই ছোটো ছেলেরা মোষের পাল চরাতে নিয়ে যেত, সন্ধ্যা হতে-না-হতেই তাদের নিয়ে ফিরে আসত গ্রামের মধ্যে। গৃহপালিত হলেও মোষগুলো ছিল অতিশয় হিংস্র রাখাল ছেলেদের লাঠির আঘাত সহ্য করে তাদের হুকুম তামিল করলেও বিদেশি মানুষকে হত্যা করতে তারা মুহূর্তমাত্ৰ ইতস্তত করত না। রাখাল ছেলেরাও মোষের দলের কাছাকাছি থাকত, তারা জানত, দলের কাছে না থাকলে যেকোনো সময়ে বিপদ ঘটতে পারে। মহিষযূথকে বাঘও ভয় পায়।

গ্রামের অন্যান্য ছোটো ছেলের সঙ্গে মোগলিও একদল মোষকে চরাতে নিয়ে যেত। ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে চরত মোষের দল। তাদের পরিচালনার ভার থাকত বিভিন্ন বালকের উপর। রাম নামে একটা প্রকাণ্ড পুরুষ মহিষের পিঠে চড়ে তার দলটাকে পরিচালিত করত মোগলি। মোযগুলো সাধারণতঃ ডোবা, পুকুর আর ভিজে স্যাৎসেঁতে কাদার মধ্যে পড়ে পড়ে জাবর কাটত….

একদিন মোষগুলোকে ছেড়ে দিয়ে বাঁশঝাড়ের ভিতর ধূসর নেকড়ের সঙ্গে দেখা করে মোগলি জানতে পারল, শেরখান গ্রামের খুব কাছে এসে পড়েছে এবং মোগলিকে হত্যা করার সুযোগ খুঁজছে।

ভালো কথা, মোগলি বলল, সে যতক্ষণ দূরে আছে, ততক্ষণ তুমি কিংবা ভাইদের মধ্যে কেউ-একজন ওই পাথরটার উপর বসে থাকবে। আমি গ্রাম ছেড়ে বেরুলেই তোমাদের উপর আমার নজর পড়বে। সে কাছে এসে পড়লে তোমরা খাদের ভিতর ধাক্ গাছের তলায় আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমরা কেউ অসাবধান হয়ে শেরখানের শিকার হতে চাই না।

দিন কাটতে লাগল একঘেয়েভাবে। মোষের দলকে ছেড়ে দিয়ে তাদের কাছাকাছি গাছের ছায়াতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মোগলি। মোষগুলো মাঠ থেকে ঘাস ছিঁড়ে খায়, তারপর ভোবা কিংবা পুকুরে নেমে শরীর ডুবিয়ে পড়ে থাকে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই গ্রামের অন্যান্য রাখাল ছেলের সঙ্গে মোগলিও তার মোষের দলকে ডেকে নিয়ে গ্রামের দিকে যাত্রা করে। প্রত্যেকদিন ফাঁকা মাঠের উপর থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে ধূসর নেকড়েকে দেখতে পায় মোগলি, অর্থাৎ শেরখান এখনও ওই অঞ্চলে পদার্পণ করেনি। ওয়েনগঙ্গা নদীর ধারে জঙ্গলটার মধ্যে যদি শেরখান আসে, তাহলে তার আগমন-বার্তা লুকানো থাকবে না মোগলির কাছে।

অবশেষে একদিন নির্দিষ্ট স্থানে ধূসর নেকড়ের দেখা পেল মোগলি। মোষের দলটাকে নিয়ে খাদের মধ্যে অবস্থিত ধাক্ গাছের উদ্দেশ্যে রওনা হল মোগলি। সেখানেই বসেছিল ধূসর নেকড়ে, দারুণ উত্তেজনায় খাড়া হয়ে উঠেছিল তার পিঠের লোম।

ধূসর নেকড়ের সঙ্গে কথা বলে মোগলি জানতে পারল, ওয়েনগঙ্গার প্রকাণ্ড শুষ্ক খাদের মধ্যে এখন শুয়ে রয়েছে শেরখান। তাবাকুই নামে শেয়ালটাও তার সঙ্গে এসেছিল শুনে উদবিগ্ন হয়ে উঠেছিল মোগলি- কারণ, তাবাকুই অতিশয় ধূর্ত জন্তু। মোগলিকে আশ্বস্ত করে ধূসর নেকড়ে জানাল, সকালেই সে ওই শেয়ালটাকে হত্যা করেছে, এখন তার মাংসে ভোজ বসিয়েছে ক্ষুর্ধাত চিলের দল। শেরখান কাছাকাছি ছিল না বলেই তাবাকুইকে মারতে পেরেছিল ধূসর নেকড়ে।

শেরখান কি খাওয়া-দাওয়া করেছে, না উপোস করে আছে? মোগলি জানতে চাইল, ওই প্রশ্নের উপর তার জীবন-মরণ নির্ভর করছে।

সকালেই সে একটা শুয়োর মেরে খেয়েছে, ধূসর নেকড়ে বলল, তারপর তৃষ্ণা মিটিয়ে আকণ্ঠ জলপান করেছে। প্রতিশোধ নিতে এসেও শেরখান না খেয়ে থাকতে পারে না।

নির্বোধ জানোয়ার! আমার সঙ্গে যদি দশটি নেকড়ে থাকত, তাহলে ওই খাদের ভিতরেই ওকে শেষ করে দিতে পারতাম। আমার মোষগুলো বাঘের গন্ধ না পেলে আক্রমণ করবে না। আমি ওদের ভাষাও জানি না। আচ্ছা শেরখান যে রাস্তা ধরে এসেছে, সেই রাস্তায় যদি মোষগুলোকে নিয়ে যাই, ওরা তার গন্ধ পাবে। তখন মোষের দল সেই গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে গিয়ে ওকে আক্রমণ করতে পারে বটে।

সেই সম্ভাবনা নেই, ধূসর নেকড়ে বলল, এখান থেকে অনেক দূরে ওয়েনগঙ্গা নদীতে নেমে জল সাঁতরে এসেছে শেরখান, তার গায়ের গন্ধ স্রোতের জলেই ভেসে গেছে।

এটা নিশ্চয়ই তাবাকুই-এর বুদ্ধি, মোগলি বলল, শেরখান কখনোই তার গায়ের গন্ধ চাপা দেওয়ার কথা ভাবত না। এখন কী করা যায়?

কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর মুখ তুলল মোগলি, শেরখান যে-খাদের ভিতর শুয়ে আছে, তার একদিকে ঢালু জায়গা দিয়ে আমি মোষের দলকে চালিয়ে দিতে পারি। কিন্তু বাঘ তাহলে খাদের অন্য দিক দিয়ে পালিয়ে যাবে। ধূসর ভাইটি, তুমি যদি মোষের দলটাকে দুভাগে ভাগ করে একটা দল নিয়ে খাদের একটা মুখ আটকাও তাহলে বাঘের আর পালানোর পথ থাকে না। কী বলো তুমি? যা বললাম, তা করতে পারবে?

আমি হয়তো পারব না, ধূসর নেকড়ে বলল, তবে আমার চাইতে বুদ্ধিমান একজনকে এখানে নিয়ে এসেছি।

একটু দুরে একটা গর্তের ভিতর ঢুকল ধূসর নেকড়ে, পরক্ষণেই গর্তের মুখে দেখা দিল একটা প্রকাণ্ড মাথা– আকেলা!

আকেলা! আকেলা! সোৎসাহে চিৎকার করে উঠল মোগলি, তুমি তাহলে আমাকে ভুলে যাওনি! আকেলা, এখন সামনে মস্ত কাজ। মোষের দলটাকে দু-ভাগে ভাগ করো একভাগে থাকবে বাচ্চাদের সঙ্গে মাদী মোষগুলো আর একভাগে থাকবে মদ্দা মোষের দল।

কাজ শুরু হল ধূসর নেকড়ে আর আকেলা দলের ভিতরে আর বাইরে ছোটাছুটি করতে লাগল– দেখতে দেখতে দুভাগে ভাগ হয়ে গেল মোষের দল। একদিকে বাচ্চাদের মাঝখানে রেখে ক্ষুরের আঘাতে মাটিকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল মাদী মোষগুলো, অন্যদিকে মদ্দা মোষের দল হিংস্রভাবে নাসিকাধ্বনি করতে করতে ভূমিতে পদাঘাত করতে লাগল বারংবার ভয়াবহ দৃশ্য!

মাত্র দু-টি নেকড়ে যেমন চমৎকারভাবে মোষের দলটাকে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিল, ছয়টি মানুষ মিলিত হয়ে পরিশ্রম করলেও ওই সময়ের মধ্যে কাজটা করতে পারত না।

এবার কী করব? হাঁপাতে হাঁপাতে আকেলা বলল, ওরা আবার মিশে যেতে চাইছে।

না, ওদের মিলতে দিও না, মোগলি বলল, মদ্দা মোষগুলোকে বাঁদিকে খাদের মাথার দিকে নিয়ে যাও। ধূসর ভাইটি, তুমি মাদী মোষগুলোকে খাদের পায়ের দিকে জড়ো কর।

খাদের মাথায় দাঁড়িয়ে বাঘের গন্ধ পেয়েই ক্ষেপে গেল রাম নামে সর্দার-মহিষ, তীব্র নাসিকাধ্বনি করে ঢালু জমি বেয়ে সে ছুটে চলল শত্রুর উদ্দেশ্যে, সশব্দে তাকে অনুসরণ করল পুরুষ মহিষের দল।

ঘুম ভেঙে চমকে উঠে শেরখান, দেখল, খাদের মাথা থেকে ঢালু জমিতে নেমে আসছে। রুদ্রমূর্তি মহিষের দল। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে পালাতে চেষ্টা করল– না, সেই পথও বন্ধ, মাদী মোষগুলো খাদের অপর প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে তাকেই লক্ষ্য করে। খাদের দুধারে উঠে গেছে মাটির খাড়া দেয়াল, গুরুভোজনের পর ভারী শরীরটাকে দেয়াল বেয়ে টেনে তোলা সম্ভব নয়– অতএব লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হল শেরখান…

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল লড়াই। অনেকগুলো ক্ষুরের আঘাতে চূর্ণবিচুর্ণ শেরখানের মৃতদেহ মাড়িয়ে পুরুষ মহিষের দল বিপরীত দিক থেকে ছুটে-আসা মহিষীদের মধ্যে এসে পড়ল প্রচণ্ড ধাক্কায় দুর্বল জন্তুগুলো ছিটকে পড়ল, দুটো দলই তখন উঠে এল খোলা মাঠের উপর। ক্রোধে অন্ধ মহিষগুলো তখন নিজেদের মধ্যেই লড়াই করতে উদ্যত তারা গর্জন করছে, ক্ষুরের আঘাতে মাটিকে ক্ষতবিক্ষত করছে এবং শিং-এর আঘাতে আহত করছে পরস্পরকে।

কিন্তু লড়াইটা হল না। আকেলা ও ধূসর নেকড়ের সাহায্যে দলটাকে আবার মোগলি তাড়িয়ে নিয়ে গেল জলাভূমির দিকে, তার তেল-পাকানো বংশদণ্ডটিও সে কয়েকবার ব্যবহার করল মহিষযুথের উপর। জলার মধ্যে নেমে পড়ল মোষের দল এবং ঠাণ্ডা জলের স্পর্শে উত্তপ্ত মেজাজকে শান্ত করতে সচেষ্ট হল।

শেরখানের মৃতদেহের পাশে বসল মোগলি। মনুষ্যসমাজে আসার পর থেকে গলার সঙ্গে ফিতে দিয়ে যে ছুরিটাকে সে গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখত, এখন সেই ছুরি দিয়েই মোগলি মৃত বাঘের চামড়া ছাড়াতে শুরু করল। মানুষের গৃহে পালিত কোনো বালক কারো সাহায্য না নিয়ে দশ ফুট লম্বা একটা বাঘের চামড়া ছাড়ানোর কথা ভাবতেই পারে না কিন্তু বনের মোগলি খুব ভালোভাবেই জানত, পশুদেহের সঙ্গে সংলগ্ন চামড়াটা কীভাবে ছাড়িয়ে ফেলতে হয়। মাঝে মাঝে তার নির্দেশ অনুসারে টানাটানি করে তাকে সাহায্য করছিল ধূসর নেকড়ে আর আকেলা। এইভাবে যখন প্রায় একঘণ্টা পার হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ তার কাঁধের উপর এসে পড়ল একটি হাত বালদেও!

মোষের দলটাকে হঠাৎ নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে অন্যদিকে ছুটে যেতে দেখে অন্য রাখাল ছেলেরা আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল, তারাই গ্রামে এসে খবরটা জানিয়েছিল বালদেওকে। মোগলি কর্তব্যপালন করেনি বলেই যে মোষের দল ছুটে পালিয়েছিল, এবিষয়ে বালদের সন্দেহ ছিল না। অতএব মোগলিকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই গ্রাম ছেড়ে বন্দুক হাতে বেরিয়ে এসে তাকে খোঁজাখুঁজি করছিল বালদেও। তাকে আসতে দেখেই গা-ঢাকা দিয়েছিল নেকড়ে দুটি, অবশ্য আড়াল থেকে তারা নজর রেখেছিল বন্দুকধারী আগন্তুকের উপর।

এটা কী হচ্ছে? বালদেও ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, তুই বাঘের চামড়া ছাড়াতে পারবি? কী মনে করিস নিজেকে? মোষগুলোই দেখছি বাঘটাকে মেরেছে। আরে! এটাই তো দেখছি সেই খোঁড়া বাঘটা! এটাকে মারার জন্যই একশো টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। বেশ! বেশ! মোষগুলোকে ছুটোছুটি করতে দিয়ে তুই কর্তব্যপালনে যে অবহেলা করেছিস, সেই অন্যায়টাও আমি এবার ক্ষমা করব। পুরস্কারের একশো টাকা থেকে হয়তো একটা টাকা আমি তোক দিতে পারি। এখন খানিওয়াড়াতে বাঘের চামড়াটা আমি নিয়ে যাব।

বালদেও তার কোটের পকেট থেকে চকমকি পাথর আর একটা ইস্পাতের টুকরো বার করল, সে এখন আগুন জ্বালিয়ে শেরখানের গোঁফ পুড়িয়ে দিতে চায়। স্থানীয় শিকারীরা সকলেই নিহত বাঘের গোঁফ পুড়িয়ে দেয়। তাদের বিশ্বাস, ওই কাজটি না করলে বাঘের প্রেতাত্মা প্রতিশোধ নিতে পারে।

হুম, মোগলি একটা থাবার ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি তাহলে পুরস্কারের একশো টাকা থেকে একটা টাকা আমায় দিতে রাজি আছ? সেই পুরস্কার আনতে তুমি ছাড়ানো চামড়াটা নিয়ে খানিওয়াড়াতে যাবে? কিন্তু আমি ভাবছি, এই বাঘের চামড়াটা নিজের কাছেই রাখব। হেই! বুড়ো, আগুনটা সরিয়ে নাও।

-কী, গ্রামের প্রধান শিকারির সঙ্গে তুই এইভাবে কথা বলিস? তোর বরাত ভালো– মোষগুলোর বোকামির জন্যই বাঘটা মারা পড়েছে। বাঘের পেট ভর্তি ছিল, তা না হলে এতক্ষণে সে বিশ মাইল পার হয়ে যেত। তোর এত বড়ো স্পর্ধা যে আমার মতো পাকা শিকারিকে বাঘের গোঁফ পোড়াতে নিষেধ করিস? তোকে এক টাকা ছেড়ে একআনা পয়সাও : দেব না, পয়সার বদলে দেব আচ্ছা করে ঠ্যাঙানি। ছেড়ে দে বাঘের লাশ।

এ তো ভারি মুশকিল হল দেখছি, মোগলি তখন কাঁধের ছাল ছাড়াতে চেষ্টা করছে, সারা দুপুর এই বুড়ো বাঁদরটার সঙ্গে আমায় বক বক করতে হবে নাকি? আকেলা, এই লোকটা আমায় জ্বালিয়ে মারল যে!

বালদেও তখনও শেরখানের মাথার দিকে ঝুঁকে দেখছিল, হঠাৎ এক প্রচণ্ড ধাক্কায় সে ছিটকে পড়ল এবং ভয়ে-বিস্ময়ে বিস্ফারিত দুই চক্ষু মেলে দেখল তার বুকের উপর দাঁড়িয়ে আছে একটা প্রকাণ্ড নেকড়ে। মোগলি তখনও একমনে ছাল ছাড়াচ্ছে, যেন সেখানে সে ছাড়া আর কোনো জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব নেই।

আচ্ছা, দাঁতে দাঁত চেপে মোগলি বলল, তুমি ঠিকই বলেছ বালদেও। তোমাকে এক আনা পয়সাও দিতে হবে না। কারণ, ছালটা আমি তোমাকে দেব না, কাজেই পুরস্কারও তুমি পাবে না। এই খোঁড়া বাঘটার সঙ্গে আমার একটা ফয়সালা বাকি ছিল– ঝগড়াটা অনেক দিনের পুরোনো– আজ সেই ঝগড়ার ফয়সালা হয়ে গেল।

শিকারি বালদেও খুব ভীরু মানুষ নয়। আলোর সঙ্গে বনের মধ্যে দেখা হলে সে লড়াই করতে ভয় পেত না কিন্তু মানুষখেকো বাঘের সঙ্গে যার ব্যক্তিগত বোঝাঁপড়া থাকে, তার হুকুম তামিল করে যে জানোয়ার সে বড়ো সহজ জানোয়ার নয়। বালদেও ভাবতে লাগল, তার গলায় যে মন্ত্র-পড়া তাবিজটা তাকে এতকাল বহু বিপদ-আপদ থেকে বাঁচিয়ে এসেছে, সেটা এখন তাকে বাঁচাতে পারবে কি?

আকেলার থাবার তলায় সে আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, এই বুঝি মোগলি একটা বাঘের রূপ ধরে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে!…।

বেশ কিছুক্ষণ কাটল, সেরকম কিছুই যখন ঘটল না, তখন খুব ভয়ে ভয়ে বালদেও ডাকল, মহারাজ! হে মহারাজ!

হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি। কী বলতে চাও? মোগলি যা করছিল তা-ই করতে লাগল, একবারও তার দিকে তাকাল না শুধু তার গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল চাপা হাসির শব্দ।

আমি বুড়ো মানুষ, অন্যায় করে ফেলেছি। তোমার অনুচর কি আক্রমণ করবে? দয়া করে আমায় বাড়ি যেতে দাও।

যাও। তবে ভবিষ্যতে কখনো আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না। আকেলা, ওকে যেতে দাও।

আকেলা সরে দাঁড়াল। বালদেও খোঁড়াতে খোঁড়াতে যথাসম্ভব দ্রুতবেগে রওনা হল গ্রামের দিকে। যেতে যেতে সে পিছন ফিরে দেখছিল– তার আশঙ্কা, মোগলি যে-কোনো মুহূর্তে মানুষের রূপ ছেড়ে কোনো ভয়ংকর প্রাণীর রূপধারণ করতে পারে। গ্রামে পৌঁছে সে মোগলিকে নিয়ে একটা চমকপ্রদ গল্প সবাইকে শুনিয়ে দিল সেই আজগুবি গল্পের মধ্যে মন্ত্রতন্ত্র আর যাদুবিদ্যার ব্যাপারগুলো গ্রামবাসীদের মনে আতঙ্কের সঞ্চার করল।

সন্ধ্যার ঠিক আগে মোগলির কাজ শেষ হল- বাঘের শরীর থেকে চামড়াটা তখন ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। মোগলি বলল, এখন চামড়াটা একজায়গায় লুকিয়ে রেখে মোষগুলোকে তাদের আস্তানায় পৌঁছে দিতে হবে। দলটাকে চালাতে আমায় সাহায্য করো, আকেলা।

গোধূলির অস্পষ্ট আলো-আঁধারির মধ্যে মোষের দলটাকে নিয়ে গ্রামের কাছাকাছি এসে মোগলি দেখল, সেখানে অনেকগুলো আলো জ্বলে উঠেছে এবং ঘন ঘন বেজে উঠছে মন্দিরের ঘণ্টা আর শঙ্খ। আরও এগিয়ে এসে মোগলি দেখল, গ্রামের প্রধান দরজার কাছে। তার জন্য অপেক্ষা করছে এক বৃহৎ জনতা।

আমি শেরখানকে মেরেছি বলেই ওরা আমায় অভ্যর্থনা করতে চাইছে, মোগলি আপনমনে বলল।

ভুল ভাঙল তৎক্ষণাৎ তার কানের পাশ দিয়ে ছুটে গেল অনেকগুলো পাথরের টুকরো, সেইসঙ্গে বহু মানুষের চিৎকার, জাদুকর! নেকড়ের বাচ্চা! জঙ্গলের শয়তান! যাও এখান থেকে! বালদেও! বালদেও! গুলি চালাও!

বালদেওর হাতের বন্দুক সগর্জনে অগ্নিবৃষ্টি করল, আর্তনাদ করে উঠল একটি আহত মহিষ।

আবার জাদুবিদ্যা! জনতা চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা গুলি ফিরিয়ে দিয়েছে! বালদেও, ওটা তোমার মোষ!

আরে! এটা কী হচ্ছে! মোগলি হতভম্ব হয়ে গেল।

তোমার জাতভাইদের সঙ্গে নেকড়ের দলের কোনো তফাৎ নেই, আকেলা বলল, তোমায় দেখে যখন ওরা গুলি চালাচ্ছে, তখন বুঝতে হবে ওরা তোমাকে পছন্দ করছে না, ওরা তোমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে।

নেকড়ে! নেকড়ের বাচ্চা! গ্রামের পুরোহিত চিৎকার করে উঠল, চলে যাও এখান থেকে। এই গ্রামে তোমার জায়গা হবে না।

এইসময় জনতা ভেদ করে এগিয়ে এল একটি নারী- মেসুয়া! মোগলির মানুষ-মা! সে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল, ওরে আমার খোকা! আমার খোকা রে! এরা তোকে জাদুকর বলছে। ওদের কথা আমি বিশ্বাস করি না! আমি জানি, তুই নাথুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিস।

ভিড়ের ভিতর থেকে চিৎকার উঠল, মেসুয়া! মেসুয়া! ফিরে এস! না এলে তোমার উপরেও পাথর পড়বে।

একটা পাথর এসে লাগল মোগলির মুখে, সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র হাসিতে ফেটে পড়ল সে, মেসুয়া! ফিরে যাও। তোমার ছেলেকে যে হত্যা করেছে, আমি সেই হত্যাকারীর উপর প্রতিশোধ নিয়েছি। এখন তাড়াতাড়ি দৌড়ে পালাও। কারণ, এইবার আমি মোষগুলোকে পাঠব। আমাকে লক্ষ্য করে যারা পাথর ছুঁড়ছে, তাদের ছুঁড়ে-মারা পাথরগুলোর চাইতেও তাড়াতাড়ি ছুটে যাবে আমার মোষের দল। আমি যাদুকর নই, মেসুয়া- বিদায়!

মোষের দল তাদের অভ্যস্ত আশ্রয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, আলোর চিৎকার শোনার সঙ্গেসঙ্গে তারা ঘূর্ণিঝড়ের মতো ছুটে গেল মূর্তিমান মৃত্যুর সঙ্গে সেই ধাবমান মহিষযুথের সামনে থেকে ছিটকে সরে গেল ভয়ার্ত জনতা!

গুনতি করে দেখে নাও কটা মোষ আছে, মোগলি চেঁচিয়ে বলল, হয়তো আমি দল থেকে একটা মোয চুরি করেছি। তাই ভালো করে গুনে দেখে নাও- কারণ, কাল থেকে আমি আর মোষ চরাতে তোমাদের এখানে আসব না। আর মেসুয়াকে ধন্যবাদ দাও সে না থাকলে আমি গ্রামের পথে পথে নেকড়ের দল নিয়ে হামলা করতাম। শুধু মেসুয়ার জন্যই তোমরা বেঁচে গেলে।

মোগলি এবার পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল, তাকে অনুসরণ করল আকেলা। আমি আর মানুষের তৈরি ফাঁদের মধ্যে (কুটিরের মধ্যে) ঘুমাব না। চলো আকেলা, লুকানো জায়গা থেকে শেরখানের চামড়া নিয়ে চলে যাই। মেসুয়া আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে, তাই আমি গ্রামের কোনো ক্ষতি করলাম না।

যখন চাঁদ উঠল তখন জ্যোৎস্নার আলোতে গ্রামের তাবৎ মানুষ ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল, মোগলি মাথায় একটা বোঝা নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে। তার সঙ্গে নিঃশব্দে পদচালনা করছে দুটি নেকড়ে। অমঙ্গল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তখন গ্রামের মানুষ মন্দিরের ঘণ্টা বাজাতে লাগল এবং শঙ্খধ্বনি করতে লাগল বারংবার নিদারুণ দুঃখে মেসুয়ার গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল আর্ত ক্রন্দন এবং বালদেও তার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কাহিনি শোনাচ্ছিল একদল উৎসুক গ্রামবাসীকে। তার কাহিনি যখন শেষ হল তখন শ্রোতারা জানতে পারল, মোগলির সহচর নেকড়েটা দুই পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বালদের সঙ্গে মানুষের ভাষায় কথা বলেছিল!

যে-পাহাড়ের উপর মন্ত্রণাসভার অধিবেশন হয়, সেখানে উপস্থিত হল মোগলি তার দুই সহচর নিয়ে তারপর মা-নেকড়ের গুহার সামনে থমকে দাঁড়াল।

মানুষরা আমাকে তাদের দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে মোগলি বলল, কিন্তু আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছি। সঙ্গে নিয়ে এসেছি শেরখানের চামড়া!

বাচ্চাদের নিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়ে এল মা-নেকড়ে, তার দুই চোখ ব্যাঘ্রচর্মের দিকে তাকিয়ে জ্বলে উঠল, আমি মানুষখেকোটাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম যেদিন সে এই গুহার মুখ আটকে দাঁড়িয়েছিল, তার মাথা আর কঁধ গুহার মুখটাকে বন্ধ করে দিয়েছিল সেইদিন আমি তাকে বলেছিলাম, আজকের শিকারি একদিন শিকারের হাতেই শিকার হয়ে যাবে। আমার সেই কথা আজ সত্যি হয়েছে।

ছোট্ট ভাইটি, কাজটা তুমি ভালোই করেছ, একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর বেজে উঠল ঝোপের ভিতর, তুমি ছিলে না, তাই জঙ্গলে বড়ো নিঃসঙ্গ বোধ করছিলাম।

পরক্ষণেই কণ্ঠস্বরের মালিক ঝোপের বাইরে আত্মপ্রকাশ করল– কালো চিতা বাঘিরা!

তারপর সবাই গিয়ে উঠল মন্ত্রণাসভার মস্ত পাথরটার উপর। যেখানে একসময় আকেলা বসে থাকত, সেই জায়গাটার উপর বাঘের চামড়াটা বিছিয়ে দিল মোগলি এবং চারটি বাঁশের কঞ্চির সাহায্যে টান টান করে সেটাকে ছড়িয়ে রাখল। ব্যাঘ্রচর্মের উপর শুয়ে তীব্রকণ্ঠে মন্ত্রণাসভার আহ্বান জানাল আকেলা, এস, নেকড়ের দল, এস– ভালো করে তাকিয়ে দেখ।

মোগলিকে যখন প্রথম মন্ত্রণাসভায় নিয়ে আসা হয়, তখন যেভাবে আকেলা নেকড়ের দলকে আহ্বান জানিয়েছিল, আজ ঠিক সেইভাবেই নেকডেদের সে ডাক দিল মন্ত্রণাসভায় যোগ দিতে।

আলোকে দলপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর আর কোনো নেকড়ে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেনি বা গ্রহণ করতে সমর্থ হয়নি। দলপতি ছাড়াই নেকড়েরা দিন কাটিয়েছে, শিকার করেছে বা লড়াই করেছে। তাদের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা বলতে কিছুই ছিল না। অনেকে মানুষের ফাঁদে পা দিয়ে খোঁড়া হয়েছে, কেউ আহত হয়েছে বন্দুকের গুলিতে, আবার খারাপ খাদ্য খেয়ে অনেকে ভুগছে চর্মরোগের তাড়নায় এবং বহুসংখ্যক নেকড়ে ইতিমধ্যেই হয়েছে। যমরাজ্যের অতিথি। তবু ছন্নছাড়া নেকড়েরা নিতান্ত অভ্যাসবশেই মন্ত্রণাসভার আহ্বানে সাড়া দিয়ে চিহ্নিত স্থানে উপস্থিত হল। শেরখানের ডোরাকাটা চামড়াটা এবং চারটি থাবার প্রকান্ড নখগুলো তাদের বিস্মিত দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করল।

ওহে নেকড়ের দল, ভালো করে তাকিয়ে দেখ, মোগলি বলল, আমি কথা রাখতে পেরেছি কি?

নেকড়েরা সমবেতকণ্ঠে জানিয়ে দিল, হা, তুমি কথা রেখেছ বটে।

হঠাৎ ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে একটি নেকড়ে চেঁচিয়ে উঠল, আকেলা। তুমি আবার আমাদের নেতৃত্ব দাও। দলপতি হারিয়ে আমরা হয়ে পড়েছি ছন্নছাড়া, আমাদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ আর নেই। ওহে মানুষের বাচ্চা, তুমি আমাদের চালনা কর।

না, সেটা আর হবে না, গর গর করে উঠল বাঘিরা, পেটভরে খেতে পেলেই তোমাদের মাথায় আবার পাগলামি চাড়া দিয়ে উঠবে।

মানুষের দল আর নেকড়ের দল আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে, মোগলি বলল, আমি এখন একলা চলব। একাই শিকার করে পেটের খিদে মিটিয়ে নেব।

আমরাও তোমার সঙ্গে শিকার করব, বলল মা-নেকড়ের চারটি বাচ্চা।

তখন অকুস্থল ত্যাগ করে চলে গেল মোগলি। তার সঙ্গে গেল তার চার দুধ-ভাই। নেকড়ের দলের সঙ্গে আর তাদের কোনো সম্পর্ক রইল না।