অঘোরকৃষ্ণবাবুর সময়টা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। গতকাল সন্ধেবেলা নাতি আর নাতনিদের সঙ্গে কুইজ কনটেস্টে গো-হারা হেরেছেন। মহাত্মা গাঁধীর বাবার নাম, মেরি গাইয়ের ইংরিজি প্রতিশব্দ আর ক্রিকেটে ‘চায়নাম্যান’ কাকে বলে তা বলতে পারেননি! অবশ্য তাঁর মনঃসংযোগ করতে না পারার যথেষ্ট কারণও ছিল। দিন চারেক আগে খুবই দামি একজোড়া নতুন চটি কিনেছেন। পরশুদিন তাঁর সেজো শালা হরিপদ ভুল করে সেই চটি পরে চলে গেছে। কাছেপিঠেনয়। হরিপদ গেছে নাগপুরে, বছরখানেকের মধ্যে তার আর আসার সম্ভাবনা নেই। কথাটা তুলতেই স্ত্রী ফোঁস করে উঠেছেন, “কেমন আক্কেল তোমার বলো তো! না হয় নিয়েইছে দেড়শো টাকার একজোড়া চটি, তাতে কোন রাজ্যপাট যেতে বসেছে তোমার! তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি, বুঝতে পারলে ঠিক পার্সেল করে পাঠিয়ে দেবে।” পার্সেলের ভরসা অঘোরকৃষ্ণ করছেন না। মোটেই। বারবার চটিজোড়া যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে আর দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। শুধু চটি হারানোর দুঃখই নয়, গদাধরের মতো আনাড়ির কাছে গত তিনদিনে বারসাতেক দাবায় হেরেছেন। পরশু বিকেলে তো গদাধরের বোড়ের মুখে গজটা চেপে দিতে গিয়ে ঘোড়ার চাঁটে গজ উড়ে গেল। নিজের আহাম্মকির জন্য নিজেরই দু’গালে থাবড়া মারতে ইচ্ছে যায়। আর শুধু কি তাই? পরশুদিন হরিহর হাই স্কুলের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে তাঁকে সভাপতি করতে নিয়ে গিয়েছিল। সভাপতির কাজ বড্ড যাচ্ছেতাই, সারাক্ষণ ভ্যাজরং-ভ্যাজরং ভাষণ শুনতে হয়। তাই তিনি ভাষণের সময়টায় দিব্যি ঘাড় কাত করে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলেন। তারপর যখন তাঁর নিজের ভাষণ দেওয়ার সময় হল তখন চটকা ভেঙে উঠে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি যে কেন রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান কাঁঠালপাড়ার মহিমা কীর্তন করতে লাগলেন, তা তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারেন না। শ্রোতারা সবাই হেসে ওঠায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি খুব গম্ভীরভাবে বললেন, “কাঁঠালপাড়া অতি ভাল জায়গা, রবীন্দ্রনাথ সেখানে জন্মালেও ক্ষতি ছিল না। কারণ কাঁঠালপাড়ায় অনেক মহাপুরুষ জন্মেছেন। যদিও কে কে জন্মেছেন তা তাঁর ঠিক মনে পড়ছে না ইত্যাদি।” ফলে সভায় হাসির অট্টরোল উঠল। অঘোরকৃষ্ণবাবু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বসে পড়লেন। আর সেখানেই শেষ নয়, গত কয়েকদিনে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। গতকাল কালু মুদির দোকানে তেরো টাকা বিয়াল্লিশ পয়সার সঙ্গে তেত্রিশ টাকা বাইশ পয়সা যোগ দিয়ে কী করে যে তিনি আটাত্তর টাকা আশি পয়সা হিসেব করলেন কে জানে। কালু খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “মেসোমশাইয়ের দেখছি ভীমরতি ধরেছে।”
এই যে এই অঞ্চলে লোকে তাঁকে রয়াল বেঙ্গল টাইগার বলে উল্লেখ করে, তা তো আর এমনিতে নয়। তাঁর প্রবল প্রতাপ, সাঙ্ঘাতিক ব্যক্তিত্ব এবং দুর্দান্ত কর্তৃত্ব করার ক্ষমতার জন্যই খাতির করে লোকে তাঁর ওই নাম দিয়েছে। এর জন্য মনে-মনে তিনি খুশিই ছিলেন। কিন্তু এই পরশুদিন তাঁর বন্ধু ডি এম এস, জ্যোতিষার্ণব, সাহিত্য সরস্বতী, বিদ্যাবারিধি, পুরাণার্ণব, কাব্যশ্রী, রোগাভোগা নটবর হালদার তাঁর উত্তরের বারান্দায় বসে সকালবেলায় চা খেতে-খেতে হঠাৎ বিজ্ঞান নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল। তার বক্তব্য, “বিজ্ঞান-টিজ্ঞান সব বোগাস, ওতে মানুষের কোনও কৃতিত্বই নাই। ভগবানই সব দিয়ে রেখেছেন, মানুষ শুধু ভগবানের নকল করে এসেছে এতকাল।”
অঘোরকৃষ্ণ চটে উঠে বললেন, “নকল মানে? মানুষ বুদ্ধি খাঁটিয়ে, সুক্ষ্ম হিসেবনিকেশ করে যে এত আবিষ্কার করল, তা নকল হতে যাবে কেন?”
তখন নটবর বলল, “আহা, বুদ্ধিটাও তো ভগবানই দিয়েছেন রে বাপু।”
তর্ক যখন তুঙ্গে উঠেছে তখনই নটবর বলে বসল, “অত তর্জন-গর্জন করছ কেন? তুমি কি বাঘ-সিংহী নাকি যে, তর্জন-গর্জনে ভয় খাব?”
তখন বুক চিতিয়ে অঘোরকৃষ্ণ বললেন, “আলবত বাঘ। লোকে আমাকে তা-ই বলে।”
“সেটা তোমার প্রশংসা করার জন্য বলে না, বলে তোমার গায়ের বোঁটকা গন্ধের জন্য।”
অঘোরকৃষ্ণ ভারী অবাক হয়ে বললেন, “বোঁটকা গন্ধ! আমার গায়ে বোঁটকা গন্ধ! কই, কোথায়?” বলে তাড়াতাড়ি নিজের গা শোঁকার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন।
নটবর বলল, “আহা, বোঁটকা গন্ধটা কথার কথা, বলছিলাম ওইরকমই কোনও হেঁদো কারণে তোমাকে সবাই বাঘ বলে হাসিঠাট্টা করে আর কি। তুমি তো আর আশু মুখুজ্জে নও কিংবা বাঘা যতীনের মতো লালমুখোদের সঙ্গে লড়াইও করোনি। তোমাকে বাঘ বললে বাঘেদের অপমানই হয়, তারা চাইলে তোমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও করতে পারে।”
নটবরের মতো রোগাভোগা লোকও আজকাল তাঁকে অপমান করে যাচ্ছে, এটা খুবই ভাবনার কথা।
অঘোরকৃষ্ণের দুঃখের শেষ এখানেই নয়। তাঁর বয়স এখন পঁয়ষট্টি। তাঁর বাবা হরিকৃষ্ণের বয়স এখন নব্বই। অতি শক্তসমর্থ হরিকৃষ্ণের এখনও মাথা-ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল, মুখে বত্রিশটা শক্ত দাঁত। পাঁঠার হাড় চিবিয়ে খুঁড়ো করে ফেলতে পারেন। রীতিমত ডনবৈঠক করেন, মুগুর ভাঁজেন, পাঁচ-দশ মাইল টানা হাঁটতে পারেন। দাপটও প্রচণ্ড। রোজ সকালে বাবাকে প্রণাম করতে যান অঘোরকৃষ্ণ, আর প্রতিদিনই হরিকৃষ্ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “কবে যে তুই একটা মানুষের মতো মানুষ হবি, সেটাই বুঝতে পারি না। রাত্রিবেলা বউমা এসে বলল, কালও নাকি তুই বাজার থেকে একটা কানা বেগুন এনেছিস। এখনও তুই নাকি পাতে নিম-বেগুন দিলে থালার নীচে চালান দিয়ে লুকিয়ে ফেলিস। সকালে দুধ খাওয়ার কথা, তা সেটা নাকি বেড়ালের বাটিতে চুপিচুপি ঢেলে দিয়ে আসিস। শুনতে পাই, সেদিন নাকি ব্রজমাস্টারকে বাজারে দেখেও পেন্নাম করিসনি! আর ইদানীং শুনতে পাচ্ছি, তুই নাকি দুপুরবেলায় ছাদে উঠে চারদিকে ঢিল মারিস!হরবাবুর বৈঠকখানার কাঁচ আর নবকৃষ্ণর মেটে কলসি নাকি তোর ঢিলেই ভেঙেছে!”
অভিযোগগুলো কোনওটাই মিথ্যে নয়। অঘোরকৃষ্ণ তাই মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকোতে থাকেন।
হরিকৃষ্ণ ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “অন্যগুলো তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু দুপুরবেলা ঢিল ছোঁড়াটা তো মোটেই কাজের কথা নয়। ঢিল মারিস কেন?”
অঘোরকৃষ্ণ মিনমিন করে বললেন, “আজ্ঞে চার-পাঁচটা হনুমান এসে ক’দিন ধরে বাগানে খুব উৎপাত করছে, সেইজন্যই ঢিল মেরে তাড়াচ্ছিলাম।”
হরিকৃষ্ণ বললেন, “হনুমানেরা চিরকালই গাছের কলাটা মুলোটা খেয়ে আসছে, তাই বলে ঢিল মারতে হবে?”
“আর হবে না।”
হরিকৃষ্ণ অত্যন্ত কঠিন চোখে ছেলের আপাদমস্তক একবার
দেখে নিয়ে বললেন, “আর যেন তোমার সম্পর্কে কোনও নালিশ শুনতে না হয়–। এখন তুমি যেতে পারো।”
না, অঘোরকৃষ্ণ অনেক ভেবে দেখলেন, সময়টা তাঁর খারাপই যাচ্ছে। কারণ, দুপুরবেলা তিনি যখন ভাত খাওয়ার পর সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছেন তখনই তাঁর জানলার পাশে পেয়ারা গাছে হনুমানগুলো এমন দাপাদাপি শুরু করল যে, তিষ্ঠোতে না পেরে তিনি উঠে পড়লেন। ঢিল মারা বারণ, সুতরাং বেতের মজবুত লাঠিগাছ বাগিয়ে তিনি বাগানে ঢুকে যখন বীরবিক্রমে এগোচ্ছেন হঠাৎ কোথা থেকে একটা ঢিল এসে তাঁর ডান কাঁধ ঘেঁষে মাটিতে পড়ল। অঘোরকৃষ্ণ আঁতকে উঠে চারদিকে চাইছেন। সঙ্গে-সঙ্গে উপর্যুপরি আরও তিন-চারটে বড় বড় ঢিল এসে গাছপালায় পড়তে লাগল। একটা পড়ল তাঁর বাঁ হাতের কবজিতে। তিনি ককিয়ে উঠলেন। আর-একটা সাঁ করে তাঁর মাথা ঘেঁষে কান ছুঁয়ে চলে গেল। কিন্তু ঢিলটা মারছে কে? ঠিক দুপুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা–এই সেই বৃত্তান্ত নয়তো। তিনি সভয়ে একটা ঝুপসি আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করতে করতে চারদিকে চাইতে লাগলেন।
হঠাৎ ছাদের দিকে নজর যেতেই তিনি হাঁ। স্পষ্ট দেখলেন ছাদে দাঁড়িয়ে বীরবিক্রমে ঢিল ছুড়ছেন তাঁর বাবা হরিকৃষ্ণ। হাতের শেষ ঢিলটা ছুঁড়ে হরিকৃষ্ণ আত্মতৃপ্তিতে হাতটাত ঝেড়ে আপনমনেই হেসে বললেন, “অপদার্থ! অপদার্থ! বুঝলে! অঘোরটা একেবারেই অপদার্থ। হাতে টিপ নেই মোটে, হনুমান মারতে গেছে! গিয়ে কার কাঁচ ভাঙছে, কার কলসি ভাঙছে। এ যুগের ছেলেদের কি আর সেই সাধনা আছে, না অধ্যবসায়? ঢিল ছুঁড়তেও তো এলেম দরকার রে বাপু!”
অঘোরকৃষ্ণের ভারী রাগ হল। কারণ, তাঁর বাবা হরিকৃষ্ণের হাতেও যে মোটেই টিপ নেই তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। এলোপাতাড়ি ছোঁড়া ঢিলগুলো একটাও কোনও হনুমানের গায়ে লাগেনি। বরং একটা ঢিল অঘোরকৃষ্ণের কবজি জখম করেছে, আর-একটা আর-একটু হলেই তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিত। কিন্তু এসব কথা হরিকৃষ্ণকে বলার মতো বুকের পাটা কার আছে! পৃথিবীতে চিরকালই অত্যাচারীরা অত্যাচার করে এসেছে, আর অত্যাচারিতরা মুখ বুজে থেকেছে। এই অবিচারের জন্যই তো লোকে কমিউনিস্ট হয়!
হরিকৃষ্ণ আবার ঢিল ছুঁড়তে শুরু করেছেন। ঠকাস-ঠকাস করে চারদিকে ঢিল এসে পড়ছে। মাথা বাঁচাতে অঘোরকৃষ্ণ তাড়াতাড়ি দূরে সরে এলেন। একেবারে বাগানের পাঁচিলের ধার ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে তবে নিশ্চিন্ত।
কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়ার কি জো আছে? হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে খুব অমায়িক গলায় বলল, “অঘোরবাবুর কি সময়টা একটু খারাপ যাচ্ছে?”
“কে?” বলে লাঠি বাগিয়ে অঘোরকৃষ্ণ ঘুরে দাঁড়ালেন, যা দেখলেন তাতে তাঁর চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু পাঁচিলের ওপর গোঁফ-দাড়িওয়ালা একটা লোক ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছে। পরনে ময়লা একটা ছেঁড়া পাতলুন, গায়েও একটা আধময়লা বোম খোলা বিবর্ণ জামা। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তার দু’পাশে তিনটে-তিনটে করে মোট ছ’টা হনুমান বেশ শান্তশিষ্ট হয়ে বসে আছে। এত নিশ্চিন্তে বসে থাকার কথা নয়, কারণ দেয়ালের ওপর কাঁচ আর পেরেক বসানো আছে।
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে অঘোরকৃষ্ণ দাঁত কড়মড় করে বললেন, “তুমি কে হে বেয়াদব? দেয়ালে উঠেছ যে বড়! কী মতলব?”
লোকটা একগাল হেসে বলল, “মতলব কিছু খারাপ নয় মশাই। এই আপনাদের বাগানটা বসে বসে দেখছি।”
“বাগান দেখছ? না কি আর কিছু! আর ওগুলো নিশ্চয়ই তোমার পোষা হনুমান! আমার বাগানে কস্মিনকালে কখনও হনুমানের উৎপাত হয়নি! তাই ভাবি, হঠাৎ এখানে হনুমান এল কোত্থেকে! এখন বুঝতে পারছি, এ তোমারই কাজ।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না, আমি কস্মিনকালেও কোনও হনুমান পুষিনি মশাই।”
“তা হলে ওগুলো তোমার কাছে অমন ভালমানুষের মতো বসে আছে কী করে?”
লোকটা একটু হেসে বলল, “জাতভাই মনে করেছে বোধহয়। আমি কি আর মানুষের মধ্যে গণ্য হওয়ার যোগ্য? যেখানেই যাই, কুকুর-বেড়াল-পশু-পক্ষী পিছু নেয়। শুধু মানুষের কাছেই কলকে পাই না মশাই। এই একটু দেয়ালে উঠে আরাম করে বসে আছি বলে আপনি কত কথাই না শোনাচ্ছেন!”
অঘোরকৃষ্ণ হুঙ্কার দিলেন, “আরাম করে বসে আছ মানে! দেয়ালে কাঁচ নেই? পেরেক নেই?”
“থাকবে না কেন? খুব আছে।”
“সেগুলো ফুটছে না?”
লোকটা হেসে বলে, “গরিবের হল গিয়ে মোটা চামড়া। সারাজীবন কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরেই তো আমাদের চলা। ওসব কি আমাদের লাগে?”
“ওঃ, কথার দেখছি খুব বাহার! এখন ভালয়-ভালয় নামবে কি না!”
“কোনদিকে নামি বলুন তো! ভেতরে, না বাইরে? ভেতরে নামলে আপনি আমাকে পাকড়াও করতে পারেন। আর বাইরে নামলে আমি পালাতে পারি।”
“তোমাকে পাকড়াও করার ইচ্ছে আমার নেই। তুমি তোমার হনুমানদের নিয়ে কেটে পড়।”
“আজ্ঞে, হনুমানগুলো যে আমার নয়।”
“আলবাত তোমার।”
“আজ্ঞে না। বিশ্বাস করুন। আমি দেয়ালে উঠে আপনাদের বাগানটা দেখছিলুম, হনুমানগুলো আপনার বাবামশাইয়ের ঢিলের ভয়ে গুটিগুটি এসে আমার দু’পাশে বসে পড়ল। তবে যা-ই বলুন, আপনার চেয়ে আপনার বাবামশাইয়ের ঢিলের হাত অনেক ভাল।”
অঘোরকৃষ্ণ খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “ছাই ভাল, একটাও ঢিল হনুমানের গায়ে তো দুরের কথা, লেজেও লাগেনি। এলোপাতাড়ি ছুড়ছেন, একটু হলে আমার মাথাটাই ফাটত।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, ন্যায্য বিচার যদি করতে হয় তবে আমি বলব, আপনার বাবামশাইয়ের হাতের জোর অনেক বেশি। কাল তো দেখলুম আপনার ঢিলগুলো ওই মাদার গাছটাও পেরোয়নি। আর আপনার বাবার ঢিল ওই জামগাছটা অবধি এসেছে।”
অঘোরকৃষ্ণ ভারী ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, “আমার হাতে জোর নেই বলছ? তা হলে হরবাবুর বৈঠকখানার কাঁচ আর নবকৃষ্ণর মেটে কলসি ভাঙলুম কী করে? অ্যাঁ?”
লোকটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “ওই আনন্দেই থাকুন। আপনার বাবামশাই কী কী ভেঙেছেন তা জানেন কি? তিনি পানুবাবুর শোয়ার ঘরের ড্রেসিংটেবিলের আয়না চুরমার করে দিয়েছেন, পানুবাবু থানায় যাওয়ার জন্য ধুতিতে মালকোঁচা মারছেন এখন। তা ছাড়া চৌধুরীবাড়ির ছাদের পাথরের পরীর একটা ডানা ঢিল মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। সে বাড়ির দরোয়ানরা ভয় খেয়ে খাঁটিয়ার তলায় ঢুকেছে বটে, তবে তারাও লাঠিসোঁটা নিয়ে এল
বলে! তার ওপর আপনার বাবামশাইয়ের ঢিলে কালীপদর নারকোল গাছ থেকে একটা নারকোল পড়ে তার পিসিমার টালির চাল ফুটো হয়ে গেছে। কালীপদর পিসিমা কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে শাপশাপান্ত করছেন। না মশাই, আমাকে স্বীকার করতেই হবে, আপনার বাবামশাইয়ের ঢিলের হাত আপনার চেয়ে ঢের ভাল।”
একথায় খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে অঘোরকৃষ্ণ বললেন, “থাক থাক, তোমাকে আর ফোঁপরদালালি করতে হবে না। সবাই হল শক্তের ভক্ত আর নরমের যম। বাবার হাঁকডাক আর দাপট বেশি বলেই সবাই তাঁকে তেল দেয়। তবে আমিও বলে রাখছি, এক মাঘে শীত যায় না। ঢিল মারা কাকে বলে তা আমিও দেখিয়ে দেব।”
লোকটা ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে উদাস গলায় বলল, “সত্যি কথা বললেই আজকাল লোকে চটে যায় দেখছি। তা আমি কী করব বলুন, নিজের চোখে যা দেখেছি তা অস্বীকার করি কী করে?”
“তার মানে তুমি রোজই এ-বাগানে হানা দাও!”
“তা দিই। গত বাইশ দিন ধরেই দিচ্ছি।”
অঘোরকৃষ্ণের চোখ কপালে উঠল, “অ্যাঁ! বাইশ দিন! তুমি তো ডাকাত হে! বলি তোমার মতলবখানা কী?”
লোকটা ঘাড় চুলকে বলে, “মতলব কিছু খারাপ ছিল না মশাই। গা ঢাকা দিয়ে কী করে বাড়ির মধ্যে ঢোকা যায় তার সুলুকসন্ধান করছিলুম।”
“বলো কী? দিনে-দুপুরে গা-ঢাকা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে চাও? সে কথা আবার বুক ফুলিয়ে বলছ?”
লোকটা বিমর্ষ গলায় বলে, “কী করব মশাই, রাতে যে আমার সুবিধে হয় না। তখন বড্ড ঘুম পায়।”
“এঃ, নবাবপুত্তুর! রাতে ঘুম পায়! চোর-ছ্যাঁচড়দের আবার রাতে ঘুম কিসের? অত আয়েসি হলে কি ও লাইনে চলে?”
লোকটা শুকনো মুখে বলে, “সেইজন্যই তো জীবনে উন্নতি হল মশাই! যে তিমিরে ছিলুম সেই তিমিরেই পড়ে আছি।”
খুবই বিরক্ত হয়ে অঘোরকৃষ্ণ বললেন, “অপদার্থ! অপদার্থ। সাধনা নেই, অধ্যবসায় নেই, কাজে নেমে পড়েছেন! আর কাজের ছিরিই বা কী! দিনে-দুপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে দেয়ালের ওপর উঠে বসে পাঁচজনের কাছে নিজেকে জাহির করছেন। আচ্ছা, লজ্জা সরম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে রে বাপু। এত আনাড়ি হলে কি চলে?”
লোকটা দুঃখিত মুখে তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে বলল, “আজ্ঞে অতি নির্জলা সত্যি কথা। কায়দাকানুন আমার বিশেষ জানা নেই। তা মশাই, আপনি যদি একটু সুবিধে করে দেন, তা হলে আমার বড় উপকার হয়।”
অঘোরকৃষ্ণ অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “কীসের সুবিধে হে? তোমার হয়ে কি চুরি-ডাকাতি করে দিতে হবে নাকি?”
লোকটা একগাল হেসে ভারী লজ্জার সঙ্গে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, “অনেকটা সেরকমই আর কি।”
অঘোরকৃষ্ণ সমবেদনার সঙ্গেই বললেন, “বাপু হে, তুমি যখন কোনও কাজের নও তা হলে এ লাইনে এলে কেন?”
“পেটের দায়েই আসা মশাই। অন্য লাইনে সুবিধে হচ্ছিল না কি না।”
“তা আগে কী করতে?”
“সে শুনলে আপনি হাসবেন। ছিলুম বাজিকর। এই একটু-আধটু ম্যাজিক ট্যাজিক দেখাতুম।”
“বটে! ম্যাজিশিয়ান?”
“অনেকটা সেরকমই।”
“তা সেটা খারাপ কাজ হবে কেন? চুরির চাইতে তো ভাল।”
“পেট চালাতে পারলে খারাপ নয় বটে, তবে ওতেও বিশেষ সুবিধে হয়নি।”
“নাঃ, তুমি দেখছি কোনও কম্মের নও! ভেবেছিলুম তোমাকে চোর বলে ধরে নিয়ে গিয়ে বাবার কাছে একটু বাহবা আদায় করব। এখন দেখছি তোমার মতো অপদার্থকে ধরে নিয়ে গেলে বাবা হেসেই খুন হবে।”
লোকটা জুলজুল করে অঘোরকৃষ্ণের দিকে চেয়ে বলল, “তা এখন আমাকে অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বটে, কিন্তু মশাই, একসময়ে আমারও একটু নামডাক হয়েছিল।”
“তাই নাকি? তা তোমার নামটা কী?”
“আজ্ঞে, জাদুকর গজানন।”
অঘোরকৃষ্ণের মুখে হাসি হাসি ভাবটা মিলিয়ে গেল। বড়বড় চোখ করে চেয়ে বললেন, “কী–কী বললে যেন!”
“আজ্ঞে, জাদুকর গজানন।”
“গ-গ-গ…”
বলতে বলতে অঘোরকৃষ্ণ হঠাৎ চোখ উলটে মূৰ্ছিত হয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন।
ওদিকে হরিকৃষ্ণ খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফের চারদিকে দুমদুম করে ঢিল ছুড়ছেন আর বিজয়গর্বে হাসছেন। এমন সময় হঠাৎ বাগানের একটা দুর্ভেদ্য কোণ থেকে একটা ঢিল উড়ে এসে ঠং করে জলের ট্যাঙ্কে লেগে ছিটকে এসে তাঁর মাথায় পড়ল। তিনি বাপ রে’ বলে চেঁচিয়ে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লেন। ভাবলেন মাথাটা বোধ হয় দু’ফাঁক হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে বুঝলেন তাঁর আঘাত তেমন গুরুতর নয়, আর ঢিলটাও ছোট। তখন তিনি রাগে লাফিয়ে উঠে রেলিঙের কাছে ছুটে গিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, “কে রে? কার এত সাহস? এমন বুকের পাটা কার?”
কেউ অবশ্য জবাব দিল না।
হরিকৃষ্ণ রাগে গরগর করতে করতে দোতলায় নেমে আলমারি থেকে বন্দুক বের করে বাগানে ছুটে গেলেন।
যেদিক থেকে ঢিলটা এসেছিল সেদিকটায় ঝোঁপঝাড় একটু বেশি। বন্দুক বগলে নিয়ে পাকা শিকারির মতো এগিয়ে যাচ্ছিলেন হরিকৃষ্ণ। হঠাৎ দেখতে পেরেন, পাঁচিলের কাছ বরাবর তাঁর বড় ছেলে অঘোরকৃষ্ণ দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে ঘাসজমির ওপর চিতপাত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
হরিকৃষ্ণ কাছে গিয়ে ছেলের পেটে বন্দুকের নলের একটা খোঁচা দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমাকে না কতদিন দুপুরে ঘুমোতে বারণ করেছি! দুপুরে ঘুমোলে মানুষ অলস, বোকা আর অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। আমার ভয়ে এখন ঘরে না ঘুমিয়ে লুকিয়ে বাগানে এসে ঘুমোতে শুরু করেছ! ছিঃ ছিঃ অঘোর, শেষমেশ এইরকম কপটতার আশ্রয় নেবে, এটা আমি ভাবিনি!”
অঘোরকৃষ্ণের ঘুম ভাঙার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। হরিকৃষ্ণ আরও কিছুক্ষণ তাঁর উদ্দেশ্যে ভর্ৎসনামিশ্রিত একখানা ভাষণ দিলেন এবং তারপর বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি কিছুটা গম্ভীর। বুঝতে পারলেন অঘোরকৃষ্ণ ঘুমোচ্ছেন না, অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তাঁর ভয় হল, একটু আগে তিনি যে দুর্দান্ত ঢিলগুলো মারছিলেন, তারই কোনওটা লেগে অঘোরকৃষ্ণের এই দশা হয়েছে কি না। কিন্তু তেমন কোনও ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না।
হরিকৃষ্ণ তাড়াতাড়ি বাগানে জল দেওয়ার লম্বা রবারের পাইপটা টেনে এনে অঘোরকৃষ্ণের মুখে চোখে জলের ছিটে দিলেন।
অঘোরকৃষ্ণ চোখ মিটমিট করে চাইলেন। তারপর পটাং করে সোজা হয়ে বসে বললেন, “সর্বনাশ! লোকটা গেল কোথায়?”
হরিকৃষ্ণ অবাক হয়ে বললেন, “লোক! কোথায় তোক দেখলে হে তুমি?”
“ওই তো। পাঁচিলের ওপর বসে ছিল।”
“পাঁচিলের ওপর! তোমার কি মাথাখারাপ হল নাকি? পাঁচিলের ওপর পেরেক আর কাঁচ লাগানো, ওখানে কেউ বসতে পারে?”
“আজ্ঞে, নিজের চোখে দেখা।”
হরিকৃষ্ণ তাঁর বড় ছেলের ওপর বিশেষ আস্থা রাখেন না। একটা “হুঃ” দিয়ে বললেন, “তা লোকটা কি তোমাকে মারধর করেছে নাকি? হঠাৎ মূর্ছা গেলে কেন?”
“মূর্ছা যাব না! বলেন কী? আপনি হলেও মূর্ছা যেতেন।”
“বটে! কেন, লোকটার চেহারা কি খুব ভয়ঙ্কর? বাঁকানো শিং, বড়বড় মুলোর মতো দাঁত, কিংবা বাঘ-সিংহের মতো থাবা টাবা ছিল?”
“না না, ওসব নয়। রোগাভোগা চেহারা। তবে তার নাম যে জাদুকর গজানন!”
“অ্যাঁ!” বলে খানিকক্ষণ হাঁ করে রইলেন হরিকৃষ্ণ। তাঁরও একটু মূৰ্ছার লক্ষণ দেখা গেল। চোখ দুটো একটু উলটে গেল, মাথা ঝিমঝিম করে একটু টলতে লাগলেন। বন্দুকটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল। তবে শক্ত ধাতের লোক বলে একটা গাছে ভর দিয়ে সামলেও গেলেন। তারপর বললেন, “অ্যাঁ। জাদুকর গজাননকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দিলে?”
অঘোরকৃষ্ণ করুণ গলায় বললেন, “ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে মোটেই ছিল না, হঠাৎ মূর্ছা যাওয়ায় ব্যাটা পালিয়ে গেছে।”
হরিকৃষ্ণ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “মূৰ্ছা যাওয়ার আর সময় পেলে না তুমি? যখন-তখন মুছা গেলেই হল? ওরে বাপু, সব কিছুরই একটা সময় আছে। ওরকম মোক্ষম সময়ে কেউ মূর্ছা যায় বলে শুনেছ কখনও! এখনও ডিসিপ্লিন শিখলে না, আর কবে এসব শিখবে? পাঁচ লাখ টাকা হাতের মুঠোয় এসেও ফসকে গেল! মূৰ্ছা-টুছাগুলো যদি একটু আগে সেরে রাখতে তা হলে এমন দাঁওটা হাতছাড়া হত না। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়েছে, জাদুকর গজাননকে ধরিয়া দিলে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার। গঞ্জের লোক হন্যে হয়ে তাকে খুঁজছে। আর সে নিজে এসে তোমাকে ধরা দিতে চাইল, তুমি গেলে মূৰ্ছা!”
অঘোরকৃষ্ণ একটু লজ্জিতভাবে বললেন, “জীবনে তো কখনও মুছা যাইনি, তাই মূৰ্ছা যাওয়ার নিয়মকানুনগুলো ভাল জানা ছিল না। লোকটা যখন বলল, আমার নাম গজানন’ তখন আমি দেখলুম, দেয়ালের ওপর যেন পাঁচ লাখ টাকা বসে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে। এত কাছাকাছি পাঁচ লাখ টাকা বসে আছে দেখে মাথাটা কেমন করে উঠল যেন।”
“ওই তো তোমাদের দোষ। কোনও ব্যাপারে গা নেই, তৎপরতা নেই। পট করে লাফিয়ে গিয়ে সাপটে ধরবে তো! এঃ, ধরতে পারলে এতক্ষণে। তা যাক গে, বলি ঠিকানাটা কি জিজ্ঞেস করেছিলে?”
“আজ্ঞে না।”
“তোমাদের সব কাজই বড্ড কাঁচা।”
ঘটনাটা নিয়ে সন্ধের পর বাড়িতে একটা মিটিং বসল। সভার মধ্যমণি অবশ্যই হরিকৃষ্ণ। তাঁর সামনে তিন ছেলে অঘোরকৃষ্ণ, হরিৎকৃষ্ণ এবং নীলকৃষ্ণ। আর ছয় নাতি গন্ধর্ব, কন্দর্প, অশ্বিনী, ইন্দ্র, বরুণ, গণেশ। আর তাদের ছেলেপুলেরা।
হরিকৃষ্ণ খুব গম্ভীর মুখে বললেন, “মানুষের জীবনে সুবর্ণ সুযোগ খুব বেশি আসে না। আজ সুবর্ণ সুযোগটি শুধু এসেছিল তা-ই নয়, সে আমাদের বাড়িতে ঢুকতেও চেয়েছিল। হয়তো তার চুরিটুরির মতলবও ছিল। তা থাক। অঘোর যদি তাকে সেই সুযোগ দিত, তা হলে আমরা তাকে চোর-কুঠুরিতে বন্ধ করে রেখে মেঘনাদবাবুকে খবর পাঠিয়ে এবং তাঁর হাতে লোকটাকে তুলে দিয়ে এতক্ষণে পাঁচ লাখ টাকার মালিক হয়ে বসে থাকতাম। তাই বলছিলাম, সুবর্ণ সুযোগ যে কখন কোন পথে কোন ছদ্মবেশে আসে, সে বিষয়ে তোমরা হুশিয়ার থেকো।”
হঠাৎ গন্ধর্ব বলল, “আচ্ছা দাদু, এই মেঘনাদবাবুটি কে?”
হরিকৃষ্ণ বললেন, “একজন গণ্যমান্য লোকই হবেন। বিষাণ দত্ত জানে।”
গন্ধর্ব মাথা নেড়ে বলে, “এই ধর্মনগর-শিবাইতলাতে আমাদের অন্তত চার পুরুষের বাস। এ অঞ্চলের সবাইকে চিনি। কিন্তু মেঘনাদবাবু বলে কারও নাম শুনিনি। ওরে, তোরা কেউ শুনেছিস?” বলে সে ভাইদের দিকে তাকাল।
সকলেই নেতিবাচক মাথা নাড়া দেওয়ায় হরিকৃষ্ণ একটু অস্বস্তিতে পড়ে বললেন, “নাম শোনোনি বলেই কি আর নেই নাকি? হয়তো দূরে থাকেন, হয়তো নতুন এসেছেন। বিষাণ উকিল মানুষ, কাঁচা কাজ করার লোক নয়।”
গন্ধর্ব বলল, “পোস্টারগুলো আমি খুঁটিয়ে দেখেছি। তাতে বলা হয়েছে গজাননকে ধরতে পারলে যেন বিষাণ দত্তকে খবর দেওয়া হয়।”
হরিকৃষ্ণ বললেন, “তা হলে তো সমস্যা মিটেই গেল। রামায়ণের মেঘনাদের মতো ইনিও আড়ালে থাকতে চাইছেন। তা থাকুন না। আমাদের তো তাঁকে দরকার নেই, দরকার তাঁর পাঁচ লাখ টাকার।”
গন্ধর্ব বলল, “না দাদু, আরও সমস্যা আছে।”
“কী সমস্যা?”
“সমস্যা জাদুকর গজাননকে নিয়ে। গজাননকে মেঘনাদ ধরতে চাইছে কেন?”
হরিকৃষ্ণ বললেন, “হয়তো গজানন মেঘনাদের ছেলেই হবে। কিংবা ভাই বা ভায়রাভাই যা তোক একটা কিছু হলেই হল। আমাদের অত খোঁজখবরে দরকার কী?”
“এ-ব্যাপারে বিষাণদাদুও ভেঙে কিছু বলছেন না। শুধু মুচকি হেসে বললেন, “লোকটাকে খুঁজে দিলে টাকা কিন্তু ঠিকই পাবে।’ যেন টাকাটাই আসল, আর কিছু জানার দরকার নেই।”
হরিকৃষ্ণ উজ্জ্বল হয়ে বললেন, “আমিও তো তাই বলি। কাজ কী বাপু অত খোঁজখবরে! ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল।”
গন্ধর্ব গম্ভীর হয়ে বলল, “জাদুকর গজানন সম্পর্কে আরও একটু কথা আছে দাদু।”
“কী কথা?”
“আমাদের এক পূর্বপুরুষ ধর্মনগরে থাকতেন। তাঁর নাম সদাশিব। তিনি একজনকে নিয়ে একটা পুঁথি লিখেছিলেন। যাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন তিনিও একজন ভোজবাজিকর গজানন। এখনও গাঁয়েগঞ্জে বুড়ো মানুষরা তাঁর কিছু কিছু কাহিনী বলেন। অনেকের ধারণা, গজানন এখনও বেঁচে আছেন। যদিও সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হয় দুশো বছরের কাছাকাছি।”
হঠাৎ হরিকৃষ্ণ সোজা হয়ে বসে বলে উঠলেন, “তাই তো!”
সবাই তাঁর দিকে তাকাল।
হরিকৃষ্ণ বললেন, “কথাটা একদম খেয়াল ছিল না। এ-গল্প আমরা ছেলেবেলায় শুনেছি। ইনফ্যাক্ট এখনও আমাদের বাড়িতে বহু পুরনো আমলের কিছু জিনিসপত্র রক্ষিত আছে। তার মধ্যে একটা ছোট ডিবের মতো কৌটোও ছিল। সেটায় হাত দিতে গিয়ে একবার ঠাকুমার কাছে বকুনি খেয়েছিলাম। ঠাকুমা বলেছিলেন, ‘ওরে ও যে গজাননের জিনিস। ওতে হাত দিসনি, কুড়িকুষ্ঠ হবে, নির্বংশ হবি।’ ভয়ে আর কখনও হাত দিইনি। তা গজানন একজন ছিল বটে, সে বহুঁকাল আগে মারা গেছে। হঠাৎ এখন তার কথা কেন? লোকে অনেক গাঁজাখুরি কথা বলে, ওতে কান দিও না।”
গন্ধর্ব বলল, “লোকের কথায় কান দিচ্ছি না। কিন্তু গজাননকে নিয়ে ইদানীং হঠাৎ নানা গল্প কেন ছড়াচ্ছে তা জানার জন্য আমার কিছু কৌতূহল হয়েছে। মেনে নিচ্ছি, এই গজানন সেই গজানন নয়। কিন্তু একথা মানতেই হবে যে, এই গজাননেরও কিছু রহস্য আছে, নইলে জনৈক মেঘনাদবাবু হঠাৎ তাকে পাকড়াও করার জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করবে কেন? আরও প্রশ্ন, গজানন এবাড়িতেই বা হানা দিচ্ছে কেন?”
হরিকৃষ্ণ বললেন, “আমার মনে হয় এই গজানন একজন ফেরারি চোর বা ডাকাত। মেঘনাদবাবুর বাড়িতে বড়সড় চুরি বা ডাকাতি করে পালিয়েছে। তাই মেঘনাদবাবু হন্যে হয়ে তাকে খুঁজছেন।”
গন্ধর্ব মাথা নেড়ে বলল, “চুরি বা ডাকাতির ব্যাপার হলে পুলিশের কাছে খবর থাকত। আমি অনুসন্ধান করে জেনেছি, পুলিশের কাছে সেরকম কোনও অভিযোগ নেই। পুলিশ গজানন নামের কাউকে খুঁজছে না।”
হরিকৃষ্ণ বললেন, “সে যাই হোক, গজানন যে বদ মতলবেই এখানে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ সে গা-ঢাকা দিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢোকার সুযোগ খুঁজছিল। অঘোরকে সে নিজের মুখেই কবুল করেছে সেকথা। এমনকী বাড়িতে ঢোকার জন্য সে অঘোরের কাছে সাহায্যও চেয়েছিল।”
অঘোরকৃষ্ণ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, “সেকথা সত্যি। চোর হলেও সে তেমন এফিসিয়েন্ট চোর নয়। বাইশ দিন ধরে সে নাকি এ বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করছে। পেরে ওঠেনি।”
গন্ধর্ব একটু হেসে বলে, “আপনারা কি এমন চোরের কথা শুনেছেন, যে নাকি গেরস্তর বাড়িতে ঢোকার জন্য গেরস্তরই সাহায্য চায়? একথা শুনলে যে লোকে হাসবে।”