প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

৩৯. যোগ-এর উৎস

যোগ-এর উৎস

তাহলে অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্তের এই মন্তব্য অনুসারে সহজিয়া, তথা তান্ত্রিক সাধনার অকৃত্রিম রূপটিকে খুঁজে পেতে হলে যোগসাধনার আদি-তাৎপর্য অনুসন্ধান করা দরকার। অবশ্যই উত্তরকালের পাতঞ্জলি প্রণীত যোগসূত্র প্রভৃতি গ্রন্থে আমরা যোগসাধনার যে-পরিচয় পাই তার সঙ্গে নর-নারীর ওই সঙ্গম—বা ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত যাকে যৌন-তৃপ্তির উদ্‌গতি (sublimation) বলে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন, তার—সম্পর্ক নেই। অতএব, যোগসাধনার এই উত্তরকালের সংস্করণকে পরীক্ষা করে ওই সুপ্রাচীন যোগ-সাধনপদ্ধতির পরিচয় পাবার আশা করা উচিত হবে না।

অতএব, আমাদের আলোচনার এই পর্যায়ে প্রশ্ন ওঠে, উত্তরকালে যোগসাধনা বলতে যাই বোঝাক না কেন, এই সাধন-পদ্ধতির আদিরূপটি ঠিক কেমন ছিলো? কিংবা, যা একই কথা, কোথা থেকে এই সাধন-পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিলো? লোকায়তর উৎস-সন্ধানেও এ-প্রশ্ন অবান্তর হবে না। কেননা, আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, গুণরত্ন বলছেন লোকায়তিকেরা গায়ে ভস্ম মাখে, তারা মিথুনাসক্ত, তারা যোগী। অর্থাৎ, আদিতে লোকায়তর সঙ্গে যোগ-এরও যে একটা সম্পর্ক থাকা সম্ভবপর, এ-ইংগিত গুণরত্বের রচনা থেকেই পাওয়া যাচ্ছে।

বলাই বাহুল্য, যোগ-এর উৎস-সংক্রান্ত সমস্যা কঠিন ও জটিল। আমাদের পক্ষে এখানে তার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা তোলা নিশ্চয়ই সম্ভব হবে না। অতএব আমরা এখানে উক্ত সমস্যার শুধু সেইদিকটুকুরই আলোচনা তুলবো যেটুকু আমাদের যুক্তির বর্তমান পর্যায়ে একান্তই প্রাসঙ্গিক।

এখানে আমাদের যুক্তির পক্ষে ঠিক কোন প্রশ্ন একান্তভাবে প্রাসঙ্গিক? প্রশ্নটা হলো, যোগসাধনার আদি-রূপটির সঙ্গে আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-বিশ্বাস বা জাতু-অনুষ্ঠানের সম্পর্ক অনুমান করবার মতো কোনো ইংগিত খুঁজে পাওয়া যায় কিনা? এই প্রশ্নটি এখানে না-উঠে পারে না। তার কারণ, আমাদের যুক্তি অনুসারে তান্ত্রিকাদি—তথা লোকায়তিকও— ধ্যানধারণার উৎসে রয়েছে ওই আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাসই।

অবশ্যই উত্তরকালে এই তন্ত্রের উপর নানারকম অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন ধ্যানধারণ প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। অতএব, আমাদের এই যুক্তির সমর্থনে প্রথমে দেখানে প্রয়োজন ছিলো যে, যদিও আমরা উত্তরকালে তন্ত্রকে নান৷ সম্প্রদায়ে বিভক্ত হিসেবে নানারূপে দেখতে পাই, তবুও তার আদি এবং অকৃত্রিম রূপটি এ-জাতীয় সম্প্রদায়বিভাগের চেয়েও অনেক প্রাচীন।

এই কথাটি প্রতিপন্ন করবার আশায় আমরা প্রধানতই বৃদ্ধসম্মতির উপর নির্ভর করেছি। শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত উভয় বিদ্বানই তন্ত্রবিষয়ে সুপণ্ডিত। এবং উভয়ের রচনাতেই এই কথাটি স্বীকৃত হয়েছে। শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “তন্ত্রের যে কোন পুঁথি পাঠ কর না কেন, তাহা পাঠ করিলে বুঝা যাইবে যে, অতি পুরাতন একটা শক্তি-ধর্মের বুনিয়াদের উপর বৌদ্ধ মনীষা একটা নতুন ধর্মের প্রাসাদ গড়িয়া তুলিয়াছিলেন; পরে নব্য-হিন্দুর ব্রাহ্মণ-প্রতিভা বৌদ্ধের সেই মনীষা-প্রাসাদের উপর ব্রাহ্মণ্যের লেখা গাঢ় করিয়া লিখিয়া রাখিয়াছেন।” ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্তও একই সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন। কেবল তিনি সেই আদিম সাধনপদ্ধতিটিকে শক্তিধর্ম না বলে sexo-yogic practice আখ্যা দিচ্ছেন। তাঁর মতে এই যৌন-যোগ-সাধনাই তন্ত্রের আদিরূপ। উত্তরকালে এরই সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব প্রভৃতি নানাপ্রকার ধ্যানধারণার সংমিশ্রণ হয়ে তন্ত্রের নানা সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিলো।

অতএব, আমাদের যুক্তির দিক থেকে প্রশ্ন উঠলে, ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত যাকে ওই যৌন-যোগসাধন পদ্ধতি বলে বর্ণনা করছেন তার সঙ্গে আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাতৃঅনুষ্ঠানের যোগাযোগ অনুমান করবার মতো কোনো ইংগিত পাওয়া যায় কি? লেখক যদি তার বর্ণনায় ‘যোগ’ শব্দটি ব্যবহার না করতেন তাহলে অবশ্যই আমাদের সমস্যা অপেক্ষাকৃত লঘু হতো। কেননা, পঞ্চমকার-প্রাণ তন্ত্রের মৈথুনাদি যে আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠানেরই স্মারক—এ-কথা আমরা ইতিপূর্বেই দেখাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যোগ বলতে অন্তত আধুনিক কালে আমাদের মনে প্রধানতই এমন সব ধারণা জাগে যার সঙ্গে ওই আদিম অনুষ্ঠানের সম্পর্ক কল্পনা করা আয়াস-সাধ্য।

ফলে, আমাদের কাছে ওই দ্বিতীয় প্রশ্নটি—অর্থাৎ, আধুনিক কালে যোগ বলতে যাই বোঝাক না কেন, তার আদিরূপটির সঙ্গে কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠানের সম্পর্ক ছিলো কি না,—বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ালো।

 

আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে কেউকেউ ইতিপূর্বেই ‘যোগ’-এর উৎস-প্রসঙ্গে এমন কোনো কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হবার চেষ্টা করেছেন যা থেকে আমাদের অনুমানটিরই অন্তত আভাস পাওয়া যায়। তাই এ-জাতীয় সিদ্ধান্তের আলোচনা থেকেই আমাদের পক্ষে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয় হবে।

অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডে(৬৫৪)  সিদ্ধান্ত করছেন, আদিতে ‘যোগ’ একরকমের অবৈদিক সাধন-পদ্ধতিই ছিলো। দেশের আর্য-পূর্ব আদিবাসীদের মধ্যেই এই সাধন-পদ্ধতি প্রচলিত ছিলো। ব্রাহ্মণ-গ্রন্থগুলি রচিত হবার সময় বৈদিক আর্যরা এ-দেশের অনেকখানি অভ্যন্তর-প্রদেশ পর্যন্ত প্রবেশ করেছিলো। ফলে, এই যুগ-বরাবরই তাদের সঙ্গে স্থানীয় আর্য-পূৰ্বদের সম্পর্ক অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। সে-ঘনিষ্ঠতার পরিণাম হিসেবেই বৈদিক আর্যদের চিন্তাচেতনায় ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে স্থানীয় আর্যপূর্বদের নানাবিধ বিশ্বাস এবং অনুষ্ঠান প্রবেশলাভ করে। অবশ্যই, বৈদিক আর্যদের কাছে প্রধানতম বিষয় ছিলো যাগযজ্ঞ। ফলে, আর্যপূর্বদের কাছ থেকে গৃহীত বিশ্বাস এবং অম্বষ্ঠানাদিকেও তারা এই যাগযজ্ঞেরই অঙ্গীভূত করে নেবার চেষ্টা করেছে। সেগুলি তাই আৰ্যপূৰ্বদের বিশ্বাসাদিরই একরকম আর্যসংস্করণে পরিণত হয়েছিলো। এ-জাতীয় একটি পরিণতিরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো যোগ-সাধনা। অর্থাৎ, এই যোগ-সাধনা প্রকৃতপক্ষে কোনো এক প্রাক্-আর্য সাধনপদ্ধতিরই আর্য-সংস্করণ মাত্র।

যে-আর্যপূৰ্বদের কাছ থেকে এই যোগ-সাধন গৃহীত হয়েছিলো তাদের সনাক্ত করবার প্রচেষ্টায় লেখকদ্বয় অনুমান করছেন, হয়তো আর্য-আক্রমণের ফলেই এরা উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছিলো। কিংবা, এমনও হতে পারে যে, মানবোন্নতির সোপান ভেঙে যাযাবর জীবনের চেয়ে তারা তখনো খুব বেশি উঁচুতে উঠে আসতে পারেনি। এই দ্বিতীয় সম্ভাবনা-প্রসঙ্গে অধ্যাপক রানাডে আর বেলভেলকার বলছেন, আজকের দিনেও ভারতবর্ষের বুক থেকে এজাতীয় অনুন্নত মানবদলের পরিচয় বিলুপ্ত হয়নি : such people are not extinct in India even up to the present day(৬৫৫)।

আমাদের মন্তব্য হলে, অধ্যাপকদ্বয়ের এই উক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যদিও দুঃখের বিষয় তারা সে-গুরুত্বের প্রতি উপযুক্ত মনোযোগ দেননি। কেননা, তাদের ওই মন্তব্য যদি অভ্রান্ত হয়, অর্থাৎ, যদি সে-জাতীয় অনুন্নত পর্যায়ে সত্যিই আমাদের দেশে কোনোকোনো মানবদল আজো টিকে থাকে, তাহলে যোগ-সাধনার আদিরূপটিকে উদ্ধার করবার উদ্দেশ্যে তাদেরই বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠানকে বিশ্লেষণ করে অগ্রসর হওয়াই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত হওয়া উচিত। এবং এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, উক্ত পদ্ধতি অনুসারে অগ্রসর হলে লেখকদ্বয় অত্যন্ত মূল্যবান সিদ্ধান্তে উপনীত হবার অবকাশ পেতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা তা করেননি। তার বদলে তারা ওই মূল্যবান উক্তিটির বিকল্প হিসেবে কল্পনা করেছেন, হয়তে আর্য-আক্রমণের ফলেই আলোচ্য আর্য-পূৰ্বর উদ্বাস্তুর অবস্থায় পরিণত হয়েছিলো এবং অতএব তারা একরকম যাযাবর-বৃত্তিই গ্রহণ করেছিলো। এ-জাতীয় একটি বিকল্পের সম্ভাবনা লেখকদ্বয়ের কল্পনায় উদিত হচ্ছে কেন? কেননা, তারা যাযাবর-বৃত্তিকেই আদি-যোগসাধকদের প্রধানতম লক্ষণ বলে চেনবার চেষ্টা করছেন। তার কারণ হয়তো এই যে, আমাদের চলতি ধারণা অনুসারে যোগীরা গৃহহীন পরিব্রাজক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যোগসাধনার আদিরূপটিকে উদ্ধার করবার জন্য ওই যাযাবর-বৃত্তির উপরই অমন ঐকান্তিক গুরুত্ব আরোপ করবার প্রয়োজন আছে কি? নিশ্চয়ই নয়। এমন কি, লেখকদ্বয়ের নিজেদের উক্তির দিক থেকেও নয়। কেননা, তার নিজেরাই বলছেন, আর্যপূর্বদের কয়েকটি অত্যন্থত এবং অতি-প্রাকৃত বিশ্বাসাদিরই আর্য-সংস্করণ হিসেবে কালক্রমে যোগ-সাধনার উদ্ভব হয়েছিলো। যদি তাই হয়,—এবং ওই তথাকথিত যাযাবর-বৃত্তি নিশ্চয়ই সে-রকম কোনো অত্যন্থত ব্যবহার নয়,—তাহলে যোগসাধনার উৎস-সন্ধানে সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন হওয়া উচিত : সেই অতি-প্রাকৃত বিশ্বাসাদির স্বরূপটা কী রকম ছিলো?

সুখের বিষয় লেখকদ্বয় গ্রন্থের অন্যত্র(৬৫৬) এই প্রসঙ্গে প্রত্যাবর্তন করেছেন। এবং সেখানে তারা ন্যায়সঙ্গতভাবেই আদিম জাদুবিশ্বাস ও জাদুঅনুষ্ঠানের দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন।

অধ্যাপক বেলভেলকার এবং রানাডে বলছেন, যোগসাধনার মূল কথা হলো শরীর-মনের একরকম অবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা,—সেই প্রচেষ্টার সাহায্যে শুধুই যে শরীর ও মনের নির্দিষ্ট শক্তিকে জাগিয়ে তোলায় বিশ্বাস তাই নয়, নানাপ্রকার প্রাকৃতিক শক্তিকেও আয়ত্তে আনবার কল্পনা করা হয়। যোগ-সাধকের মনে করেন, এ-জাতীয় শক্তিকে জাগরিত করা সত্যিই সম্ভব। প্রশ্ন ওঠে, এ-হেন বিশ্বাস এলো কোথা থেকে? লেখকদ্বয় বলছেন, বৈদিক যাগ-যজ্ঞকে বিশ্লেষণ করলেও তার পিছনে ওই একই বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়। অতএব তাদের মতে, বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের অন্তর্নিহিত ওই বিশ্বাসটির বিশ্লেষণ থেকেও যোগ-সাধনার উৎস সংক্রান্ত সমস্যার উপর আলোকপাত হতে পারে। এবং বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের অন্তর্নিহিত ওই বিশ্বাসটিকে সনাক্ত করতে গিয়ে তারা বলছেন, অন্তত বহু ক্ষেত্রেই একে আদিম মানুষদের জাৰ্ছ-বিশ্বাস—sympathetic magic—না বলে উপায় নেই। বৈদিক অনুষ্ঠানের মধ্যে যে জাদুবিশ্বাসের স্থান সত্যিই ছিলো তারই আর একটি নজির হিসেবে লেখকদ্বয় বৈদিক দীক্ষার কথা উল্লেখ করছেন; বৈদিক দীক্ষার সঙ্গে আদিম মানুষদের সমজাতীয় অনুষ্ঠানের তুলনা করলে সহজেই দেখতে পাওয়া যাবে, ওই বৈদিক অনুষ্ঠানটিতে আদিম জাদুবিশ্বাসের পরিচয় কতো স্পষ্ট!

বৈদিক অনুষ্ঠানাদির মধ্যে আদিম জাদুবিশ্বাসের এই পরিচয় থেকে যোগসাধনার উৎস-সংক্রান্ত সমস্যার উপর কোন ধরনের আলোকপাত হতে পারে? লেখকদ্বয়ের ধারণায়, বৈদিক অনুষ্ঠানের এ-জাতীয় অঙ্গ স্থানীয় আর্যপূৰ্বদের কাছ থেকেই গৃহীত হয়েছিলো এবং যোগসাধন পদ্ধতিও কালক্রমে এইভাবেই আর্য সংস্কৃতির অঙ্গীভূত হয়েছে। যোগ-সাধনার মূল বিশ্বাস হলো প্রাণায়াম, আসন প্রভৃতি কয়েকটি শারীরিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে যেমন চিত্তকে সংহত ও শক্তিশালী করা সম্ভব তেমনিই চিত্তের একাগ্রত। প্রভৃতি কয়েকটি আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে শারীরিক শক্তিকেও উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। শুধু তাই নয়। এইভাবে নিজের মধ্যে শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তারই সাহায্যে প্রকৃতিকেও আয়ত্তে আনা যেতে পারে। এই জাতীয় ধারণায় জাদুবিশ্বাসের প্রভাব অস্পষ্ট নয়। আদিম ধর্মাচরণ ও জাদুবিশ্বাসের মূলে এ-জাতীয় বিশ্বাসের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর। পারিভাষিক অর্থে ‘যোগ’ শব্দটি প্রচলিত হবার আগেই ওই আদিম বিশ্বাসটি বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

অবশ্যই আমরা ইতিপূর্বে দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, বৈদিক সাহিত্যে যা-কিছু আদিম তাই আৰ্য-পূৰ্বদের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছিলো, এ-কথা অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত নয়। কেননা, বৈদিক মানুষদেরও একটা অতীত ছিলো : পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত মানবজাতির মতোই বৈদিক মানুষদের পক্ষেও আদিম পর্যায় পার হয়ে এগিয়ে আসতে হয়েছে; এবং, অতএব, সেই আদিম পর্যায়ের চিন্তাচেতনার অনেক স্মারক বৈদিক সাহিত্যে টিকে থাকা নিশ্চয়ই আশ্চর্যের বিষয় নয়। কিন্তু তবুও যোগ-সাধনার আদিরূপ সংক্রান্ত নির্দিষ্ট সমস্যাটি প্রসঙ্গে অধ্যাপকদ্বয়ের উদ্ধৃত মন্তব্যের যাথার্থ সম্ভাবনা একদিক থেকে যথেষ্ট বেশি। অর্থাৎ আদিম জাদুবিশ্বাস বা জাদুঅনুষ্ঠান থেকেই যদি যোগসাধনার উৎপত্তি হয়ে থাকে তাহলে তার পক্ষে আদিতে ওই তথাকথিত আর্য-বহির্ভূতদের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের অঙ্গ হবার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত প্রবল। তার কারণ, বৈদিক মানুষদের জীবন প্রধানতই পশুপালন-নির্ভর ছিলো; তুলনায় তথাকথিত আৰ্য-পূর্ব বা আর্য-বহির্ভূতরা প্রধানতই কৃষি-নির্ভর জীবনযাপন করতো এবং আমরা আগেই দেখেছি, পশুপালনের চেয়ে কৃষিকাজের পক্ষেই জাদুবিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি (পৃ. ৩৪৭)।

অধ্যাপক এ. ই. গফ-ও অনুমান করছেন, স্থানীয় অনার্য আদিবাসীদের কাছ থেকেই বৈদিক আর্যরা কালক্রমে যোগসাধন-পদ্ধতিটি গ্রহণ করেছিলো। অতএব, যোগ-সাধনার আদিরূপকে খুঁজে পাবার আশায় লেখক(৬৫৭) অসভ্য অধিবাসীদের অত্যদ্ভুত বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের দিকেই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতে চাইছেন :

আর্যরা তখন যে-সব আধ-বুনো জাতিদের সঙ্গে মিশ্রিত হচ্ছিলো ও যাদের উন্নয়ন-সাধন করছিলো তাদের কাছ থেকেই আর্যরা এই যোগ-সাধনপদ্ধতিটি গ্রহণ করেছিলো। যোগ অনুসারে, সাধারণ অবস্থার তুলনায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে মর্মর মূর্তির মতো নিশ্চল করে রাখবার অভ্যাস এবং ক্যাটালেন্সি রোগে শরীরটা ষে-রকম স্থায়ু ও স্পর্শকাতরহীন হয়ে যায় সে-রকম অবস্থায় পৌঁছোনোর চেষ্টাই সাধকের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই অবস্থাটিকেই সাধকের নির্বিকল্প সমাধিতে বিলীন হয়ে যাওয়া বলে কল্পনা করেন। মাঝে মাঝে সাধকের স্বায়ুতন্ত্র এবং মস্তিষ্কের অসুস্থ উচ্ছ্বাস দেখা দেয়, ফলে প্রত্যক্ষ ও কল্পনার মধ্যে প্রভেদ মুছে যাবার উপক্রম হয় এবং শুধুই যে যোগী নিজেকে অতিমানবীয় শক্তির অধিকারী বলে মনে করেন তাই নয়, অপরেও তাকে এ-জাতীয় শক্তির অধিকারী বলে বিবেচনা করে।

আগন্তুক আর্যরাই যে এদেশের আধবুনো অধিবাসীদের উন্নত করে তুলেছিলো—এমনতরো একটা কল্পিত ইতিহাসের সঙ্গে ইংরেজ শাসকদের ‘হোয়াই্ট্‌-ম্যান্‌-বার্ডেন’ বলে অতিকথাটির অপরূপ সাদৃশ্য সত্ত্বেও, এককালে এমন কি আমাদের বিদগ্ধ-মহলেও ওই কল্পিত ইতিহাসটি যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো। মুখের বিষয় আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এই সংস্কারগত মতবাদটি থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করছেন। তাই অধ্যাপক গল্ফ-এর উদ্ধৃত সিদ্ধান্তের মধ্যে মূল্যবান মন্তব্যটা অন্য। তিনি বলছেন, যোগসাধনার উৎসে প্রাকৃত পর্যায়ের বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠান অনুমান করবার অবকাশ রয়েছে এবং এই কথাটি প্রতিপন্ন করবার উদ্দেশ্যে লেখক আদিম সংস্কৃতিংক্রান্ত নৃতত্বমূলক গবেষণা থেকেই আলোক পাবার চেষ্টা করছেন। তিনি এখানে টেলর-এর গবেষণার নজির দেখাচ্ছেন। টেলর(৬৫৮) বলছেন, ধ্যান, উপবাস, মাদকদ্রব্য ইত্যাদির সাহায্যে একটা অসুস্থ অবস্থা সৃষ্টি করাই অনেক সময় আদিম মানুষদের কাছে একরকমের পুরুষাৰ্থ :

নিচু-পর্যায়ের জাতিদের মধ্যে এবং এমন কি তাদের চেয়ে অনেক উন্নত অবস্থাতেও, ধ্যান, উপবাস, মাদকদ্রব্য, উত্তেজনা এবং রোগজনিত অসুস্থ উচ্ছ্বাসের দশা প্রায়ই চোখে পড়ে এবং বিশেষত পৌরাণিক ভাববাদে বিভোর জাতিগুলি এই অবস্থাকে সম্মানের চোখে দেখে। সভ্যতার নিম্ন পর্যায়ে সর্বত্রই চোখে পড়ে, রোগ, শ্রান্তি, অসুস্থ-উত্তেজনা বা মাদকদ্রব্যের প্রভাবজনিত মায়া-দৃশ্যগুলির বাস্তবতায় সকলেই গভীরভাবে বিশ্বাসী। উপবাস, তপস্যা, মাদকদ্রব্য ইত্যাদির সাহায্যে অসুস্থ উত্তেজনা সৃষ্টি করবার একটি উদ্দেশ্য হলো, এইভাবে রোগীরা অশরীরী জীবের দর্শন পাবে এবং সেই অশরীরী জীবের কাছ থেকেই তারা আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও এমন কি পার্থিব শক্তিও সংগ্রহ করতে পারবে।

প্রশ্ন হলো, টেলার-এর এ-জাতীয় মন্তব্য আমাদের আলোচ্য বিষয়ের উপর সত্যিই কতোটুকু আলোকপাত করতে পারে? আমাদের ধারণায় খুব বেশি নয়। কেননা, এ-জাতীয় বর্ণনা থেকে আমাদের মূল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। আমাদের কাছে প্রশ্নটা এই নয় যে, আদিম মানুষদের মনে ভ্রান্ত ধারণা ছিলো কি না। তার বদলে, আমাদের প্রধান প্রশ্ন হলে, আজকের দিনে আমরা যে-বিশ্বাসকে সহজেই আত্মপ্রবঞ্চনা বলে চিনতে পারি ওই আদিম মানুষের কেন তাকেই ও-রকম পরম গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলো? এ-কি শুধুই তাদের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ফল। টেলর-এর সিদ্ধান্ত মোটের উপর ওই রকমই কোনো এক কথায় পরিসমাপ্ত হয়। কেননা, ওই ‘কেন’র কোনো বৈজ্ঞানিক উত্তর তিনি অনুসন্ধান করেননি। কিংবা যেটুকু উত্তর তিনি দিয়েছেন তার বৈজ্ঞানিক এবং বাস্তব মূল্য অত্যন্ত সংকীর্ণ।

আমাদের মন্তব্য হলো, ক্রমোন্নতির যে-পর্যায়ে এবং অতএব জীবন-সংগ্রামের যে-অবস্থায় মানুষ এককালে এ-জাতীয় ভ্রান্ত বিশ্বাসকে অবলম্বন করবার চেষ্টা করেছে তারই পটভূমিতে বিচার না করলে আদিম মানুষের জীবনে এ-জাতীয় বিশ্বাসের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না। অতএব, প্রাচীনদের জীবনে এ-বিশ্বাসের তাৎপর্য অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের পক্ষে সর্বপ্রথম মনে রাখা দরকার তাদের অসম্ভব আর অভাবনীয় দৈন্যের কথা : প্রকৃতিকে আয়ত্তে আনবার দিক থেকে দৈন্য, আর তারই অনুপাতে প্রকৃতিকে চেনবার দৈন্য, জ্ঞানের দৈন্য। আমরা আগেই দেখেছি, আদিম মানুষদের পক্ষে এই অভাবনীয় দৈন্যের সঙ্গে যোঝবারই একটা উপায় হলো জাদুবিশ্বাস আর জাদু-অনুষ্ঠান : জাদু-অনুষ্ঠানের দরুন বহির্জগতের উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব নিশ্চয়ই পড়ে না, কিন্তু অনুষ্ঠানরত মানুষগুলির মনের উপর একটা প্রভাব পড়ে এবং তারই দরুন পরোক্ষভাবে প্রকৃতির উপরও একটা প্রভাব বিস্তৃত না হয়ে পারে না। ফলে, জাদু-বিশ্বাস ভ্রান্ত কুসংস্কার হলেও আদিম মানুষদের জীবনের বাস্তব পটভূমিতে তা জীবন-সংগ্রামের অঙ্গও। আমরা আরো দেখেছি, কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক পর্যায়েই এই জাদুবিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। অতএব, এখানে বিশেষ করে সেই পর্যায়টির কথাই ভেবে দেখা যাক। প্রকৃতির উৎপাদিকাশক্তির রহস্য তখনো মানুষের কাছে অজ্ঞাত আর তাই মানুষের পক্ষে প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকে আয়ত্তে আনবার প্রচেষ্টাও অনেকাংশেই সুদূর-পরাহত। অথচ, ওই অর্ধ-অসহায় মানুষকেই তার জ্ঞান ও শক্তির অনুপাতে প্রায় অসম্ভব কঠিন এই সমস্যাটির সম্মুখীন হতে হয়েছে। সে চেয়েছে, প্রকৃতিকে ফলপ্রসূ হতে বাধ্য করতে। অতএব, এই সুকঠিন সমস্যাটির সমাধানের জন্য তার নিজের মধ্যে,—অন্তত তার নিজের ধারণায়,—একটা প্রচণ্ড শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। যে-পদ্ধতি ও উপকরণের সাহায্যে সে এই অতি মানবীয় শক্তিকে নিজের মধ্যে জাগিয়ে তোলবার চেষ্টা করছে—ধ্যান, উপবাস, মাদকদ্রব্য বা অসুস্থ উত্তেজনা—সেগুলিকে আমরা আধুনিক ও উন্নত জ্ঞানের মানদণ্ডে উৎকট কুসংস্কার বলে বুঝতে পারি। কিন্তু শুধুমাত্র উৎকট কুসংস্কার বলে বুঝলেই এগুলিকে ঠিকমতো চেনা হবে না। ওই অর্ধঅসহায় মানুষদের কাছে এগুলি কোন ধরনের জীবনোপায় ছিলো, সে-কথাও স্পষ্টভাবে বোঝা দরকার।

ধ্যান, উপবাস, মাদকদ্রব্য এবং ওই জাতীয় অন্যান্য উপায়ের সাহায্যে সাধকের মধ্যে এক অতি-মানবীয় শক্তি জাগিয়ে তোলবার আদিম কল্পনা থেকেই যে যোগ-এর উৎপত্তি হয়েছিলো এবং এই সাধন-পদ্ধতি যে আদিতে পশুপালনজীবী বৈদিক মানুষদের পরিবর্তে কৃষিজীবী তথাকথিত আর্য-বহির্ভূত আদিবাসীদের মধ্যেই প্রচলিত থাকবার সম্ভাবনা—এ-কথার প্রতি অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডে এবং অধ্যাপক এ. ই. গল্ফ ইতিপূর্বেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠান থেকেই যে যোগ-সাধনার উৎপত্তি সে-কথা তারা স্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করেননি। অতএব আমরা সেই বিষয়টির দিকেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করবো। অবশ্য, আমরা আগেই বলেছি, যোগের উৎস-সংক্রান্ত জটিল সমস্যাটির পূর্ণাঙ্গ আলোচনা তোলা এখানে আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তার বদলে, আমাদের যুক্তির পক্ষে যেটুকু প্রসঙ্গের অবতারণা করা প্রয়োজন আমরা শুধু সেইটুকুরই উল্লেখ করবো।

আমাদের কাছে সমস্যাটা বিশেষ করে উঠেছিলো তন্ত্রসাধনার অঙ্গ হিসেবে ‘যোগ’ বলতে যে বিশেষ প্রণালীটি চোখে পড়ে তাই নিয়ে। কথাটা জরুরী। বিশেষ করে এই কারণে জরুরী যে, পাতঞ্জল-যোগদর্শন প্রভৃতি পরের যুগের রচনায় যোগসাধনার যে-পরিচয় আমরা পাই তা অনেক অর্বাচীন বলেই পরের যুগের ধ্যানধারণার সংমিশ্রণে অনেক বেশি জটিল। যোগসাধনার এই জটিল ও অবাচীন রূপটির দিক থেকেই যোগের আদিরূপ হঠযোগ বলে নিন্দিত হয়েছে। অপরপক্ষে, তন্ত্রসাধনার অঙ্গ হিসেবে যোগ বলে যে সাধনপদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায় তারই মধ্যে যোগসাধনার অপেক্ষাকৃত আদিমরূপটি টিকে থেকেছে। তাই, অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত তন্ত্র-প্রসঙ্গে যে-পদ্ধতিটিকে sexo-yogic-practice বলে বর্ণনা করছেন তারই আলোচনা থেকে যোগ-এর উৎস সংক্রান্ত সমস্যার উপর আলোকপাত হবার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি।

তন্ত্রের এই যোগসাধনার মূল কথাটা কী? অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত(৬৫৯) বলছেন :

The most important of the secret practices is the yogic control of the sex-pleasure so as to transform it into transcendental bliss, which is at the same time conducive to the health both of the body and the mind.
ওই গুহ্যসাধনাগুলির প্রধানতম অঙ্গ হলো যোগপদ্ধতিতে রতিমুখের নিরোধ, যাতে সে-রতিসুখ ঐশি আনন্দে পরিণত হয়; তারই সাহায্যে শরীর ও মনের স্বাস্থ্য (শক্তি) বৃদ্ধি পাবে।

অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত বলছেন, বৈষ্ণব-সহজিয়াদের গানে এবং ছোটোবড়ো অসংখ্য রচনায় বারবার এই যোগ-পদ্ধতিরই উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, হিন্দু-তন্ত্র এবং বৌদ্ধ-তন্ত্র এবং বৌদ্ধ-গান ও দোহার সবচেয়ে মৌলিক কথা বলতে ওই যোগ-পদ্ধতিরই কথা। এরই সঙ্গে শিব-শক্তির তত্ত্ব মিলে হিন্দু-তন্ত্র, প্রজ্ঞা-উপায়ের তত্ত্ব মিলে বৌদ্ধ-তন্ত্র এবং রাধা-কৃষ্ণ বা রস-রতির তত্ত্ব মিলে বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে।

যোগসাধনার,—অন্তত তান্ত্রিক যোগসাধনার—সঙ্গে রতিসাধনার বা কামসাধনার সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত নিশ্চয়ই আমাদের কৃতজ্ঞতা-ভাজন হয়েছেন। কিন্তু এ-সাধনা শুধুই যে রতি-নিরোধ বা yogic control of the sex pleasure বুঝিয়েছে সে-কথা মনে করাও ঠিক হবে না। এমন কি আমাদের পুঁথিপত্রের মধ্যে আজো যেখানে যোগসাধনার আদিরূপটির কথা স্মারক হিসেবে টিকে রয়েছে সেখানে রতি-নিরোধের বিপরীত উপদেশও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, যোগশিখা উপনিষদে(৬৬০) বলা হয়েছে :

রজসো রেতসে যোগাদ রাজ-যোগ ইতি স্থতঃ।।

তাহলে যোগসাধনার মধ্যে আপাত-বিরোধী দুটি দিকের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। পঞ্চমকার প্রভৃতির আলোচনায় আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, তান্ত্রিক সাধনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো মৈথুন। অপরপক্ষে, অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্তের উদ্ধৃত উক্তিটির মধ্যে ঠিক এর বিপরীত কথা—রতি-নিরোধের কথা—পাওয়া যাচ্ছে। বস্তুত, প্রয়োগ ও নিরোধ,—উভয়বিধ প্রক্রিয়াই তান্ত্রিক যোগসাধনার অঙ্গ। এবং আমরা যে-হেতু আদিম কৃষিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানাদি থেকেই তন্ত্র সাধনার উৎপত্তি অনুমান করবার চেষ্টা করছি সেই-হেতু আমাদের কাছে এখানে প্রধান প্রশ্ন হবে, আদিম কৃষিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান বিশ্লেষণ করলে তন্ত্রসাধনার বা তান্ত্রিক যোগের ওই আপাতঃ-বিরোধী দুটি দিকের উপর আলোকপাত হয় কি না।

স্তর জেমস্‌ ফ্রেসার(৬৬১) ইতিপূর্বেই এ-বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, প্রাকৃতিক জননশক্তির কামনায় যে-আদিম বিশ্বাস রতি-প্রয়োগ হিসেবে বিকশিত হয় তাই আবার বিকল্পে রতি-নিরোধ হিসেবে বিকশিত হতে পারে :

To the student who cares to track the devious course of the human mind in its gropings after truth, it is of some interest to observe that the same theoretical belief in the sympathetic influence of the sexes on vegetation, which has led some peoples to indulge their passions as a means of fertilising the earth, has led others to seek the same end by directly opposite ImôánS……. If we ask why it is that similar beliefs should logically lead, among different peoples, to such opposite modes of conduct as strict chastity and more or less open debauchery, the reason, as it presents itself to the primitive mind, is perhaps not far to seek. If rude man identifies himself, in a manner, with nature; if he fails to distinguish the impulses and processes in himself from the methods which nature adopts to ensure the reproduction of plants and animals, he may leap to one of two conclusions. Either he may infer that by yielding to his appetites he will thereby assist in the multiplication of plants and animals; or he may imagine that the vigour that he refuses to expend in reproducing his own kind, will form as it were a store of energy whereby other creatures, whether vegitable or animal, will somehow benefit in propagating their species. Thus from the same crude philosophy, the same primitive notions of nature and life, the savage may derive by different channels a rule either of profligacy or of asceticism.
মানবমনের সত্যান্বেষণবৃত্তির বিবিধ বিকাশ সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসুদের পক্ষে একটি বিষয় চিত্তাকর্ষক হতে পারে : উদ্ভিদ জগতের-উপর যৌন-জীবনের অনুকরণজনিত প্রভাব সংক্রান্ত তত্ত্বগত যে-বিশ্বাস পৃথিবীকে ফলবতী করবার উদ্দেশ্যে কোনো মানবদলকে কামপরায়ণতার পথে নিয়ে গিয়েছে সেই বিশ্বাসই এবং সেই উদ্দেশ্যেই অপর মানবদলকে একেবারে বিপরীত উপায়ের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। সমজাতীয় বিশ্বাসই বিভিন্ন মানবদলকে কঠিন শুচিতা ও প্রায় প্রকাশ্য লাম্পট্যের মতো সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যবহারের প্রতি কেন আকৃষ্ট করলো?—এ-প্রশ্ন তুললে আদিম মানুষদের দিক থেকে কারণটা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না। আদিম মানুষ যদি কোনোভাবে নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে অভিন্ন মনে করে, যদি সে নিজের অন্তর্গত প্রবৃত্তি ও পদ্ধতির সঙ্গে প্রকৃতিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্মদানসংক্রান্ত পদ্ধতির পার্থক্য বুঝতে না পারে, তাহলে তার পক্ষে দু’রকম সিদ্ধান্তের মধ্যে যে-কোনো একটি গ্রহণ করা সম্ভব। সে হয়তো মনে করতে পারে যে, তার নিজের কাম চরিতার্থতার সাহায্যেই উদ্ভিদ এবং জীবজন্তুর সংখ্যাবৃদ্ধি করা যাবে; কিংবা সে কল্পনা করতে পারে নিজের বংশবৃদ্ধি নিরুদ্ধ করে যে-শক্তিক্ষয় সে বন্ধ করলে সেই সতি-শক্তির সাহাযুেই উদ্ভিদ এবং অন্যান্য প্রাণীরা নিজেদের বংশবৃদ্ধির ব্যাপারে সহায়তা লাভ করবে। অতএব, ওই একই আদিম দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে,–প্রকৃতি ও জীবন সংক্রান্ত ওই একই ধারণা থেকে—আদিম মানুষ দুটি স্বতন্ত্র পথে রিরংস বা রতি-নিরোধ উভয় বিধিই গ্রহণ করতে পারে।

স্তর জেমস্ ফ্রেসার(৬৬২) এ-বিষয়ে নিম্নোক্ত তথ্যের উল্লেখ করছেন। নিকরগুয়া বলে রেড-ইণ্ডিয়ানরা বীজ বোনবার সময় থেকে ফসল কাটার দিনটি পর্যন্ত সুকঠিন ব্রহ্মচর্য পালন করে; পুরুষেরা স্ত্রীদের সঙ্গে এক বাড়িতে রাত্রি যাপন করে না, নুন বা তাড়ি খায় না—এককথায়, স্পানিস ঐতিহাসিক যেমন বলছেন, এই সময়টিতে তাদের কঠিন আত্মসংযমের পালা। আধুনিক যুগ পর্যন্ত মধ্য-আমেরিকার কোনো কোনো রেড-ইণ্ডিয়ান ট্রাইবকে শস্য বৃদ্ধির কামনায় ব্ৰহ্মচর্য পালন করতে দেখা গিয়েছে : কেকচি-জাতির মধ্যে বীজবপন প্রসঙ্গে পাঁচদিন এবং অন্য কোনো কোনো জাতির মধ্যে তেরো দিন কঠোর সংযম পালনের নিয়ম। হাঙ্গেরিতেও একই নিয়ম চোখে পড়ে : কৃষকদের বিশ্বাস এভাবে সংযম পালন না করলে শস্য দুর্বল হবে। মধ্য-অস্ট্রেলিয়ায় কাইটিস নামের ট্রাইবের মধ্যে প্রথা হলো, শস্য-বৃদ্ধি কামনায় মোড়ল যতোদিন জাদুআনুষ্ঠান চালাবে ততোদিন পর্যন্ত সে স্ত্রী-সংসর্গ করবে না; তার বিশ্বাস এই নিয়মটি ভঙ্গ হলে বীজ থেকে ঘাস উৎপন্ন হওয়া বন্ধ হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

যোগসাধন-পদ্ধতি যদি আর্য-বহির্ভূতদের যাদুবিশ্বাস থেকেই গৃহীত হয়ে থাকে এবং ওই তথাকথিত আর্য-বহির্ভূতদের প্রধানতম জীবনোপায় বলতে যদি কৃষিকাজই হয়ে থাকে, তাহলে আদিম মানুষদের কৃষিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের অঙ্গ এই নিরোধ-সাধনা স্বভাবতই যোগের উৎস-সংক্রান্ত সমস্যার উপর আলোকপাত করতে পারে।

——————————
৬৫৪. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade HIP 2:81, 451.
৬৫৫. Ibid. 81.
৬৫৬. Ibid. 451-2.
৬৫৭. A. E. Gough PUAIM 18.
৬৫৮. Ibid. 19.
৬৫৯. S. Dasgupta op. cit. 134.
৬৬০. উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য : ভারতদর্শনসার ১৬৬।
৬৬১. J. Frazer GB 138.
৬৬২. Ibid.