৩৯তম অধ্যায়
একত্র মিলিত গুণত্রয়ের কাৰ্য্য
“ব্রহ্মা বলিলেন, ‘হে ঋষিগণ! সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণ সৰ্ব্বদা প্রাণীগুণের দেহে অবিচ্ছিন্নরূপে অবস্থান করিতেছে; সুতরাং উহাদিগকে কখনই পৃথকভাবে অবস্থিত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। উহারা নিরন্তর পরস্পর পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হইয়া পরস্পরকে আশ্রয় করিয়া থাকে। সত্ত্বগুণ সত্ত্বে, তমোগুণ এবং তমঃ ও সত্ত্বগুণ সত্ত্বে, রজোগুণ কদাচ তিরোহিত হয় না। ঐ গুণত্রয় পরস্পর মিলিত হইয়া সাংসারিক সমুদয় কাৰ্য্য নির্ব্বাহ করে। কেবল জন্মান্তরীণ পাপপুণ্যনিবন্ধন প্রাণীগণের দেহে উহাদিগের তারতম্য লক্ষিত হইয়া থাকে।
‘তির্য্যগযোনিগত প্রাণীগণের তমোগুণ অধিক, এই নিমিত্ত উহাদিগের রজঃ ও সত্ত্বগুণের, মনুষ্যগণের রজোগুণ অধিক, এই নিমিত্ত উহাদিগের তমঃ ও সত্ত্বগুণের এবং দেবগণের সত্ত্বগুণ অধিক, এই নিমিত্ত উহাদিগের তমঃ ও রজোগুণের ন্যূনতা হইয়া থাকে। সত্ত্বগুণ হইতে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় হইতে শব্দাদি বিষয়সমুদয় প্রকাশিত হয়। সত্ত্বগুণের তুল্য পরমধর্ম্মের সাধন আর কিছুই নাই। সত্ত্বগুণসম্পন্ন মনুষ্যদিগের উৎকৃষ্ট গতি, রজোগুণসম্পন্ন মনুষ্যদিগের মধ্যম গতি ও তমোগুণসম্পন্ন মনুষ্যদিগের অধোগতি লাভ হইয়া থাকে। তমোগুণ শূদ্রকে, রজোগুণ ক্ষত্রিয়কে এবং সত্ত্বগুণ ব্রাহ্মণকে আশ্রয় করিয়াই অবস্থান করে, কিন্তু উহাদিগের মিশ্রভাবনিবন্ধন কখন কখন ইহার ব্যতিক্রমও লক্ষিত হইয়া থাকে।
‘সূৰ্য্যে সত্ত্বগুণের আধিক্য, তস্করসমূহে তমোগুণের আধিক্য এবং আতপতাপিত পথিকগণে রজোগুণের আধিক্য বিদ্যমান থাকে; এই নিমিত্ত সূর্য্যোদয় হইলে তস্করগণ ভীত এবং পথিকগণ সমধিক দুঃখিত হয়। সূর্য্যের প্রকাশ সত্ত্বগুণ, তাপ রজোগুণ এবং রাহুকৃতগ্রাস তমোগুণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। এইরূপ সমুদয় জ্যোতির্ম্ময় পদার্থের প্রকাশ ও অপ্রকাশনিবন্ধন পৰ্য্যায়ক্রমে গুণত্রয়ের প্রকাশ ও অপ্রকাশ দৃষ্টিগোচর হয়।
‘স্থাবরসমুদয়ে তমোগুণের আধিক্য বিদ্যমান রহিয়াছে। কিন্তু উহারা রজঃ ও সত্ত্বগুণে একেবারে বিরহিত নয়। মধুরাদি রস উহাদিগের রজোগুণ এবং স্নেহপদার্থ উহাদিগের সত্ত্বগুণ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। দিবা, রাত্রি, পক্ষ, মাস, ঋতু, বৎসর প্রভৃতি কাল এবং দান, যজ্ঞ, স্বর্গাদি লোক,, দেবতা, বিদ্যা, গতি, ত্ৰৈকালিক বিষয় ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম এবং প্রাণ, অপান ও উদানাদি বায়ু এই সমুদয়ই ত্রিগুণাত্মক। বস্তুতঃ ইহলোকে যেসমুদয় পদার্থ বিদ্যমান আছে, তৎসমুদয়েই তিনগুণ পৰ্য্যায়ক্রমে প্রকাশিত হইয়া থাকে। প্রকৃতি হইতে এই গুণত্রয়ের উৎপত্তি হয়। অধ্যাত্মচিন্তানিরত পণ্ডিতেরা প্রকৃতিকে তম, অব্যক্ত, শিব, ধাম, রজ, যোনি, সনাতন, বিকার, প্রলয়প্রধান, প্রভব, লয়, অনুদ্রিক্ত, অন্ন, অকম্প, অচল, ধ্রুব, সৎ, অসৎ ও ত্রিগুণাত্মকনামে নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। যাঁহারা প্রকৃতির এই সমুদয় নাম ও সত্ত্বাদি গুণের গতি সবিশেষ অবগত হইতে পারেন, তাঁহারা সর্ব্বগুণবিমুক্ত হইয়া দেহত্যাগপূৰ্ব্বক মুক্তিলাভে সমর্থ হয়েন।”