বলেন বৈশস্পায়ন শুন জন্মেজয়।
এতেক শনিয়া তবে ধর্ম্মের তনয়।।
মায়া মোহ তেয়াগিয়া হলেন সুস্থির।
পুনরপি ভীষ্মে জিজ্ঞাসেন যুধিষ্ঠির।।
কিরূপে এ ঘোর মায়া ত্যজে জ্ঞানিজন।
কিরূপে জনম সেই করয়ে খণ্ডন।।
কিরূপে সাধুসঙ্গ করয়ে জীবগণ।
সংসারের মায়াজাল করয়ে খণ্ডন।।
সাধুসঙ্গ করি কিবা ভক্তি পায় নর।
ইহার বৃত্তান্ত কহ ওহে কুরুবর।।
ভীষ্ম বলিলেন ভাল জিজ্ঞাস রাজন।
ঈশ্বরের মায়া খণ্ডে আছে কোন্ জন।।
সকলের আত্মা হন এক ভগবান।
কারো শত্রু মিত্র নহে কারে ভিন্ন জ্ঞান।।
মায়ার প্রভাবে সব অখিল মোহয়।
জ্ঞানিজন মায়াজাল জ্ঞানেতে ছেদয়।।
জ্ঞানরূপ ভগবান মায়ার নিদান।
কহিব তাঁহার কথা শুন মতিমান।।
ঈশ্বর তাঁহার কথা শুন মতিমান।
ঈশ্বর মায়ার বিমোহিত চরাচর।।
মায়া অবলিম্বি অবস্থিত দামোদর।
মায়াতে হইয়া বন্দী রহে মূঢ়জন।।
মম ঘর মম বাড়ী মম পরিজন।
এ সব সম্পত্তি মম, মম ভ্রাতৃগণ।।
এ সব চিন্তিত হয় মায়ার কারণ।
মায়ার প্রভাবে কাম বাড়ে অতিশয়।।
চুরি হিংসা পরিবাদ ক্রোধ লজ্জা ভয়।
কখন মরিব বলি চিত্তে নাহি করে।।
মায়াজালে বদ্ধ হয়ে ভ্রময়ে সংসারে।
ঈশ্বর লিখিত সব না জানে অজ্ঞানে।।
আমার আমার করি মরে অকারণে।
পুত্র মিত্র ভার্য্যা কেহ সঙ্গে সাথী নয়।।
মরিলে সন্বন্ধ নাহি কারো সাথে রয়।
হরিনাম হরিগুণ শ্রবণ কীর্ত্তন।।
মায়াতে হইয়া বদ্ধ না করে স্মরণ।
এইরূপে ঈশ্বরের মায়ার বিধান।।
তরিবে ইহাতে যেই হয় মতিমান।
গৃহধর্ম্ম করিয়া করিবে সাধুসঙ্গ।।
হরিনাম হরিগুণ কীর্ত্তন প্রসঙ্গ।
সাধুমুখে কৃষ্ণজ্ঞান অস্ত্র করে ধরি।।
মায়ার বন্ধন কাই, ত্বরা করি।
জ্ঞানে বা অজ্ঞানে করে সাধু দরশন।।
ঈশ্বরের মায়া তরে সেই মহাজন।
অজ্ঞানে বা জ্ঞানে করে অমৃত ভোজন।।
তথাপি অমর হবে বেদের বচন।।
পূর্ব্ব ইতিহাস কথা কহিব ইহাতে।
সাবধান হয়ে রাজা শুন একচিতে।।
কলিক নামেতে ব্যাধ ছিল শান্তিপুরে।
বহু পাপ দুরাচার করিল সংসারে।।
চুরি হিংসা পরদ্রোহী বেশ্যাপরায়ণ।
পরদ্রব্য লোভ লুব্ধ করে অনুক্ষণ।।
গো ব্রাহ্মণ মিত্র হিংসা করে সর্ব্বক্ষণ।
তাহার পাপের কথা না হয় কথন।।
অনুক্ষণ পরদ্রব্যে অপহার করে।
একদিন গেল ব্যাধ সৌরভ নগরে।।
নগর ভিতর গিয়া পশিল সত্বর।
বিচিত্র কাননে আছে দিব্য সরোবর।।
তথা গিয়া কলিক হইল উপনীত।
দেবালয় সেই স্থানে দেখে আচন্বিত।।
নানাধাতু বিরচিত বিচিত্র গঠন।
উপরেতে শুশোভন কলস কাঞ্চন।।
দেখিয়া হইল ব্যাধ আনন্দিত মন।
মন্দির নিকটে তবে করিল গমন।।
দেখিল ব্রাহ্মণ এক আছয়ে বসিয়া।
জিজ্ঞাসিল কহ দ্বিজ আছ কি লাগিয়া।।
উতঙ্ক নামেতে দ্বিজ সর্ব্ব গুণান্বিত।
বেদশাস্ত্রে বিজ্ঞ সাধু সর্ব্বত্র বিদিত।।
নানাবিধ অলঙ্কার স্বর্ণ পাত্রাসন।
শীলারূপী মূর্ত্তি তথা দেব জনার্দ্দন।।
পূজার সামগ্রী নানা সুবর্ণ রচিত।
দেখি আনন্দিত ব্যাধ হৃদয়ে চিন্তিত।।
ভাবিলেন নিশাযোগে এই ব্রাহ্মণেরে।
মারিয়া লইয়া যাব দ্রব্য নিজ ঘরে।।
এতেক ভাবিয়া মনে নিশ্চয় করিল।
মন্দির সমীপে বনে গোপনে রহিল।।
দিন অবসান নিশা হইল তথাতে।
হাতে খড়গ এল ব্যাধ মুনিরে মারিতে।।
বুকে জানু দিয়া তবে ধরে সেইক্ষণ।
খড়গ ঊর্দ্ধ করি হানিবার কৈল মন।।
খড়গ হস্তে দেখি মুনি বলয়ে ব্যাধেরে।
কি হেতু আমারে তুমি চাহ মারিবারে।।
একাকী দেখি যে তোমা নিষ্পাপ ভক্ষণ।
তবে কোন হেতু বুদ্ধি দেখি কুলক্ষণ।।
অহিংসা পরম ধর্ম্ম বেদেতে বাখানে।
সাধু নাহি হিংসা করে অহিংসক জনে।।
কালেতে কুবুদ্ধি যদি ঘটে কদাচিত।
তথাপিও হিত করে না করে অহিত।।
কালরূপী ভগবান এক সনাতন।
সুবুদ্ধি কুবুদ্ধি তিনি করেন সৃজন।।
সেই হেতু তোমারে দেখি যে কুলক্ষণ।
প্রায় বুঝি কুবুদ্ধি দিলেন নারায়ণ।।
অখিলপতির মায়া অখিলে মোহময়।
ঈশ্বরের মায়াজাল কেহ না বুঝয়।।
মায়াতে করিয়া বদ্ধ যত জীবগণে।
কালীরূপী জনার্দ্দন ভ্রমেণ ভুবনে।।
পুত্র মিত্র সকল বান্ধব পরিজন।
ভৃত্য আদি ধন জন এ সব কারণ।।
ব্যস্ত হয়ে করে লোক নানা পর্য্যটন।
নানা দুঃখ পেয়ে করে নিত্য উপার্জ্জন।।
নানা ভোগ দুঃখ পেয়ে পোষে পরিবারে।
মোর ঘর দ্বার বলি অকারণে মরে।।
মরিলে সন্বন্ধ নাহি, না বুঝে পামর।
একা হয়ে জন্মে জীব যায় একেশ্বর।।
পুত্র মিত্র পরিবার না যায় সঙ্গেতে।
আপনা না ভাবে জীব ঈশ্বর মায়াতে।।
সাধু সঙ্গ বিবর্জ্জিত লুব্ধক হইয়া।
না জানে ঈশ্বর মায়া তত্ত্ব না বুঝিয়া।।
যাঁর নাম গুণের প্রভাব অবর্ণিত।
কেবা সে বুঝিবে তত্ত্ব নাহি জানে।।
মনুষ্য হইয়া কেবা জানিবে কেমনে।
জ্ঞানরূপী ভগবান ব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বর।।
জ্ঞানে মাত্র জানে জ্ঞানী জ্ঞানের অপর।
চরণারবিন্দ তাঁর যে, করয়ে সার।
আপনাকে দিয়া প্রভু বশ হন তার।।
যে জন পদারবিন্দ চিন্তে নিরন্তর।
দুঃসহ সঙ্কটে তারে রাখেন শ্রীধর।।
যাঁর নাম স্মরণে অশেষ পাপ হরে।
পাপী হয়ে তত পাপ করিতে না পারে।।
বহু ক্লেশে লোক ধন করে উপার্জ্জন।
ধন দিয়া পোষয়ে বান্ধব পরিজন।।
ঈশ্বরের কর্ম্মে কিছু নাহি করে ব্যয়।
অধর্ম্মের সঙ্গে অসৎ পাত্রেতে মজয়।।
পরলোকে কি হইবে চিত্তে নাহি ধরে।
ঈশ্বরের নাম গুণ স্মরণ না করে।।
অন্তঃকালে হয় তার নরকে বসতি।
আপনাকে না জানে দারুণ মোহ মতি।।
মোহমদে মাতিয়া করয়ে অহঙ্কার।
সাধুজন নিন্দা করে দুষ্ট ব্যবহার।।
গো ব্রাহ্মণ হিংসা করে হিংসে সাধুজন।
অধোগতি হয় তার নরকে গমন।।
এইরূপে শাস্ত্রকথা অনেক কহিল।
শুনিয়া কলিক মনে বিষ্ময় মানিল।।
সাধু পরশন মাত্রে পাপ দূরে গেল।
করযোড় করি তবে উতঙ্কে কহিল।।
অপরাধ কৈনু মুনি ক্ষম মহাশয়।
তোমার পরশে মম পাপ হৈল ক্ষয়।।
নমো নমঃ তোমার চরণে নমস্কার।
যাহার প্রসাদে তরি এ ভব সংসার।।
পূর্ব্বজন্মে যত কৈনু পুণ্য উপার্জ্জন।
এই জন্মে তত পাপ না হয় গণন।।
পাপ দূরে গেল মম তোমার পরশে।
জন্মিল যে নিত্যানন্দ ভক্তি হৃষীকেশে।।
তুমি হে পরম গুরু হইলা আমার।
তোমার প্রসাদে হইলাম ভবপার।।
নমো নমো নারায়ণ অনাদি নিদান।
জয় জগন্নাথ নাম পতিত পাবন।।
সাধু সমাগম মাত্রে দুর্ব্বুদ্ধি খণ্ডিল।
তোমার চরণে দেব ভক্তি উপজিল।।
এইরূপে বহু স্তুতি কৈল নারায়ণে।
হৃদয়ে ভাবিয়া যুক্তি করিলেক মনে।।
এ দেহ রাখিয়া আর নাহি প্রয়োজন।
পুনরপি পাপে পাছে ধায় মম মন।।
ত্রিগুণে জন্মিল দেহ ক্ষণেক চঞ্চল।
সে কারণে এ দেহ রাখিয়া নাহি ফল।।
এতেক ভাবিয়া ব্যাধ নিন্দে আপনাকে।
হে বিধি আমাকে রাখিলেন কোন্ পাকে।।
আমার সমান নাহি পাপী দুরাচার।
কেমনে পৃথিবী ভার সহয়ে আমার।।
আমার যতেক পাপ আছে বল কার।
এইক্ষণে আয়ুক্ষয় হউক আমার।।
অন্তরে ভাবিতে অগ্নি উঠিল নয়নে।
অতি শীঘ্র পঞ্চত্ব হইল সেইক্ষণে।।
ব্যস্ত হয়ে উতঙ্ক উঠিল সেইক্ষণ।
বিষ্ণুপাদোদক অঙ্গে করেন সেচন।।
বিষ্ণুপাদোদক স্পর্শে সাধু সমাগমে।
সর্ব্ব পাপ খণ্ডিল জানিল অনুক্রমে।।
প্রদক্ষিণ করিয়া উতঙ্কে করে স্তুতি।
দিব্য রথ পাঠাইয়া দেন জগৎপতি।।
চতুর্ভূজ দিব্য মূর্ত্তি হৈল সেইক্ষণে।
প্রভু অনুক্রমে গেল বৈকুণ্ঠ ভুবনে।।
দেখিয়া উতঙ্ক হৈল সবিস্ময় মতি।
নানাবিধ প্রকারে অনেক কৈল স্তুতি।।
তুষ্ট হয়ে নারায়ণ দেন দরশন।
বর দিয়া যান কৃষ্ণ আপন ভুবন।।
কহিনু তোমারে রাজা ধর্ম্মের কুমার।
ঈশ্বরের মায়া বুঝে শক্তি আছে কার।।
মহাভারতের কথা অমৃতের সার।
কাশীদাস দবে কহে রচিয়া পয়ার।।